সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সন্দীপ রায় ❖ শেষ নবাবের সঙ্গে কিছুক্ষণ
আবুল হুসাইন আলেগাজী ❖ জায়নবাদ ও ইহুদিবাদ এবং ফিলিস্তিনের ইতিবৃত্ত
সুজিত সিনহা ❖ ২০২৮-এর মে মাসে ভাল সমাজের গ্রামে একটি দিন ❖ ভাষান্তর : সুব্রত কুণ্ডু
অম্লান বিশ্বাস ❖ পঞ্চাশের আকাল ও ফেমিন কোড
জয়ন্ত কুমার ঘোষাল ❖ বেদ, পুরাণ, মহাকাব্য – সত্যের খোঁজ
শৈবাল দত্ত ❖ বিহারের সাম্প্রতিক জাতগণনা ও তার তাৎপর্য
অসীমেশ গোস্বামী ❖ প্রস্তাবিত ফৌজদারি আইন সংস্কার : স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার নীল নকশা
অভিজিত দত্ত ❖ নতুন সাক্ষ্য আইনের প্রস্তাবনা : কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত সরকারের নয়াচমক
সম্বিত পাল ❖ মিজোরামের ভোটে পুরনোর অবসান, আসল জয় নাগরিক সমাজের
সুকান্ত সরকার ❖ দরবারি মাধ্যম বনাম জনবাদী মাধ্যম
অমল সরকার ❖ প্রশ্নবিহীন সাংবাদিকতা, স্বাধীনতাকেই বেশি ভয় সংবাদমাধ্যমের
(পর্ব ১)
অজিত কুমার দাস ❖ স্বাধীনতা : দেশবিভাগ
সুকান্ত সরকার ❖ বাংলার কারিগরি শিল্প-ভিত্তিক জাত-বিন্যাসের
একটি আকর গ্রন্থ
১৯৮৭-৮৮ সাল হবে। কলকাতার আশুতোষ শীল লেনের কালধ্বনি পত্রিকার কার্যালয়ে আমাদের পূর্বপরিচিত বন্ধু সিতেন বসু আলাপ করিয়ে দিলেন বছর ৩৪-৩৫- এর এক যুবকের সঙ্গে। চওড়া বিস্তৃত কপাল, সযত্ন চর্চিত ঘন শ্মশ্রু গুম্ফে আবৃত মুখমণ্ডল। ফুলহাতা পাঞ্জাবি আর বড় ঢোলা পাজামা। কাঁধে ব্যাগ। প্রয়োজনে যুবকের ঈষৎ ভারি চেহারার ওজন বহন করতে সক্ষম, হাতে তেমনই একটি লাঠি। নাম, মদন দাস। সরকারি অফিসে চাকরি করেন। কবিতা লেখেন।
কালধ্বনির ঘরে তখন বৈদ্যুতিক আলো নেই। দরজা দিয়ে ঢুকে ডান দিকে বড় শতরঞ্চি পাতা। মধ্যিখানে মোমবাতি। বাঁ দিকে একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল, গোটা চারেক চেয়ার। সন্ধের পর অন্ধকার। আমরা তো বটেই, সাধারণভাবে যারা আসেন, সবাই-ই প্রায় ডানদিকের শতরঞ্চিতেই বসেন।
নবাগত মদন দাস একটু ইতস্তত করে বসার চেষ্টা ও বসতেই খেয়াল করলাম একটি পা কৃত্রিম। প্রতিস্থাপিত অঙ্গ। ক্ষণিক নিস্তব্ধতা ভেঙে সিতেনদা বলে উঠলেন, মদনের ওই পা’টা নেই। মদন তার ছড়ানো পায়ের দিকে তাকিয়ে জানালো, বসতে জায়গা বেশি লাগে।
সেদিন মদন কবিতা পড়েছিল। বেশ কয়েকটা। আর কালধ্বনি পত্রিকায় মদন দাসের কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল মার্চ, ১৯৮৯-এ। কেমন করে জানি মদনের নাম মগন হয়ে গিয়েছিল। পত্রিকায়, কালধ্বনির আড্ডায় এবং আমরা যেখানে যেখানে যাই সর্বত্রই মদন হয়ে যায় মগন।
১৯৯০ সালে কালধ্বনি থেকে বের হয় ‘দেবী যাক বিসর্জনে’। মদন কালধ্বনির অনেকটা জায়গাই নিয়ে নিল। ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসা মেখে। তেমনি তো ছিল সেই সময়টা। কালধ্বনির নামে ভাড়া করা ঘরটা ভাগ করে নিয়েছিল আরো দুটো পত্রিকা গোষ্ঠী। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান কর্মী আর উৎস মানুষ। বৈদ্যুতিক আলো না থাকায় এবং ঠিকানা ব্যবহার করতে না পারায় ওই দুই পত্রিকা গোষ্ঠী পরবর্তীকালে অন্যত্র চলে যায়। সপ্তাহে ছ’দিনই কালধ্বনির আড্ডার ঘর। যার যখন সময় সে তখন আসতো। সকাল দুপুর বিকেল সন্ধে।
মগন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গ খুবই ভালোবাসতেন, ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডাও দিতেন, তবুও খুব সম্ভব একা থাকা আরও উপভোগ করতেন। ডুবে থাকতেন বইয়ের পাতায়,সাহিত্যের গভীরে। ইজিচেয়ারের হাতলে অথবা জানলার পাদদেশে রাখা দু-এক পেগ ‘রাম’ বেশ কয়েকঘন্টা সঙ্গী করে। ফেলে আসা সেই অতীত, যে অতীতে ১৯৭১ এর বছর শুরুর প্রথম দিনে কালধ্বনি পত্রিকার কার্যালয় থেকে মাত্র ফুট তিরিশেক দূরে থেঁতলে যাওয়া নিজের পা নিয়ে বাঁচামরার দোলাচলে রাস্তায় যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকেন, নিজেরই বড় হয়ে ওঠা পাড়ায়- বেরিয়ে আসেন সেই অতীত থেকে বর্তমানের অক্ষমতায় এবং সেখান থেকেও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায়। তিন কালের কোনো কালেই থিতু হতে পারেন না, ভিতর বাহির দুই জগতের বাসিন্দা মগন।
ভাবনা বা অনুভূতি মানুষকে বিশালত্ব দেয়। মানুষের কল্পনার মূল্য প্রতিষ্ঠান দেয় না। মগনও পায়নি। ওর একটা ছোট্ট চাওয়া ছিল, নিজের কর্তৃত্ব নিজের কাছে থাকবে। অভিভাবক মানবে না কাউকে। সম্ভব হয়নি, ওকে নির্ভরশীল হতে হ’তই। পছন্দ নয়, অথচ...
পছন্দ অপছন্দের দোলাচলেই মদন দাস, আমাদের মগন দাস কাউকে তোয়াক্কা না করেই চিরতরে চলে গেল ২২ নভেম্বর, ২০২৩ দিনের আলো থাকতে থাকতেই।
মদন দাস স্কটিশচার্চ স্কুল হয়ে আর.জি.কর মেডিক্যাল কলেজে
প্রি-মেডিক্যাল শিক্ষান্তে ১৯৭০-এ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি শিক্ষায় প্রবেশ করেন। নকশালবাড়ি আন্দোলনেও সক্রিয় অংশ নেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে রাজনৈতিক দুষ্কৃতির বোমায় রক্তাক্ত ও গুরুতর আহত। অল্পের জন্য প্রাণরক্ষা হলেও নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের আবহে সুচিকিৎসার অভাবে একটি পায়ের ব্যবচ্ছেদ হয়। ডাক্তারি পড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। রাজনৈতিক হিংসা-সন্ত্রাসের শারীরিক-মানসিক আঘাত সারাজীবন নীরবে বয়ে বেরিয়েছেন। মানুষটি ঘোরতর অ-সংসারি কিন্তু বন্ধুবৎসল। প্রিয় বন্ধুর আপ্যায়নে পায়ে স্ক্র্যাচ নিয়েও নিজের হাতে রান্না করা চাই-ই। বেসরকারি সংস্থা ও সরকারি অফিসে কর্মজীবনের মধ্যে নিরন্তর সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, লেখালিখি। অনীক, কালধ্বনি ইত্যাদি পত্রিকায় লিখেছেন। লেখালেখি আড্ডার সূত্রে কখন যেন মদনের নাম মগন হয়ে গিয়েছিল। মার্চ, ১৯৮৯-এ কালধ্বনি পত্রিকায় মদন দাসের কবিতা, মগন দাস নামেই প্রকাশিত হয়। ১ বৈশাখ ১৩৯৭-এ কালধ্বনি থেকে প্রথম কবিতা সংকলন, ‘দেবী যাক বিসর্জনে’র লেখক, মগন দাস-ই।
জীবনাবসানের আগের শেষ বছর দশেক ছাড়া ১৯৮৬-৮৭ থেকেই কালধ্বনি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত এবং আড্ডার নিয়মিত সদস্য।
প্রতিষ্ঠাবিমুখ কবির অনেক লেখাই হারিয়ে গেছে। ক্যান্সারে চিকিৎসা চলাকালীন অবস্থায় একটি কবিতা-সংকলনের আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রয়াণ (২২ নভেম্বর, ২০২৩)-এর কয়েকদিন আগে নিজেই বইটির নামকরণ করেন - দ্বিরুক্তি। কবির শেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁর স্বনির্বাচিত নামেই কলকাতা বইমেলা ২০২৪-এ কবিতার বইটি কালধ্বনি থেকেই প্রকাশিত হবে।
কালধ্বনি থেকে প্রকাশ পেলেও এই উদ্যোগ সফল করতে বাড়ির আত্মীয়-স্বজন-পরিজন ও বিশেষভাবে মগনের ভাইসম বন্ধু, ডঃ সুব্রত চট্টোপাধ্যায়ের আন্তরিক প্রচেষ্টা ছাড়া সম্ভব হ’ত না।