সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
তুমি তার ডুবে যাওয়া জানো?
দেখেছো কখনো, কীভাবে আঁধার
শরীরের কাছে আসে...
কতো কিছু রয়ে যায়
মোহ আর আগুনের
মাতাল কোটরে, বাউল পাতায়
ইতিমধ্যে বৃষ্টি নামে, গাছকে ভেজায়
সেই সব জলস্নান, তুমুল বৃষ্টিতে
পায়ে-চলা-পথ ভেঙেছিল বলে
হাতে গড়া এক লাজুক ভেলাই ছিল
ভেসে যাওয়া, আর ফেরার অছিলা;
স্রোতের ভিতরে, এ-ওকে ধরে
সাঁতার সাঁতার খেলা সন্ধ্যাগভীরে
সন্ধ্যার আগে/
শুধু তো হরিণ ফেরে না,
বহুতর শ্বাপদেরা পদচিহ্ন চেনে...
ইতিউতি আঁধারের বনে বর্ষা আসে
সমতলে ওরা আসে না; তবু
মনে পড়ে ওর তো কথাই ছিল
ফিরে আসবেই, হয়তো অসুখ হয়ে
হয়তো নীরবে, ছেলেবেলা হয়ে
আসেনি বলেই মনে হয়
হয়তো একেই ফিরে যাওয়া বলে
হয়তো বা সব আগুনের চোখে জল থাকে
হয়তো শিউলি এভাবেই ঝরে দেহের বাগানে
কলাপাতা গ্রামে স্থির দুখ্খু পুকুর...
ওর পাড়ে স্নান জমা হয়;
ভেলা ডুবে গেলে পানডুবি মাঠে
টুপটুপ ঝরে যায় এ-ওকে বাড়ানো দুহাত
জল এতো উদাসীন, তুমি তার
গভীরতা জানো? দেখেছো কীভাবে
প্রদাহের অবসান হয়...
কিছু তার বুক-তোলপাড় আঁধি
বাকী সব স্বমোহ-সমাধি
ভঙ্গিতে এসো না আলোতে
ছায়া এতো ম্লান করে দেয়
ছবি তার কিছুই জানে না...
বরং সহজ হও...
গোলাপে পতঙ্গ হও,
কাঁটা শুধু মানুষের জন্য
কাঁটা অতি, মানুষের জন্য
একটা তেমন কলম পেলে
কবিতা লিখতাম...
লেখা থাকতো, খেলা শেষ হলে
বাঁশি নয়, শেষ নয়,
আমি পড়ে থাকি মাঠে
আমি হেরে গেলে
তবে খেলা শেষ হয়
কতভাবে হেরে আছি ভাবলেই হাসি পায়
এই তো সেদিন সারা উঠোন জল
জলপরীদের সঙ্গে যাবো বলে
ছবির মধ্যে লিখেছিলাম ঢেউ...
হঠাৎ কেমন সন্ধে হয়ে এলো...
ম্লান হয়ে এলো বেলা
এমন জটিল খেলা --
একদিকে তার কমলা সবুজ ঘর
অন্যধারে বালুচরের টান
স্রোত ভুলে তাই বসি ছবির পাশে
জানি, হেরে গেছি আমি সাঁতারের কাছে
ঈশ্বর বললেই শুধু ফুলঘ্রাণ বুঝি
তাই প্রতিমার কাছে হেরে গেছি
আমি তো দেখেছি
যথাযথ দিনছায়া দিগন্ত ছুঁলেই
শঙ্খেরা ডিম পাড়ে গানের কিনারে...
সুরের পালক ওড়ে শরীর সৈকতে
গাইতে আমি পারি নি কক্ষনো
হেরে গেছি তাই ফাগুনের কাছে
ঢেউপাখিদের ডানা-ঝাপটানো,
তীক্ষ্ণ কলহ, আর যাওয়া-আসা পথে
ঝরে পড়া প্রবাল কুসুম মেখে
বালিও কী ঘরে ফেরে স্রোত কমে এলে!
স্তব্ধ জলের বুকে ঘূর্ণি দেখেছি
হেরে আছি তাই উড়ানের কাছে
এতোভাবে হেরে বসে আছি
তাই সূর্যাস্ত আমার আজও এতো ভালো লাগে
কোথাও পড়িনি কতবড়ো টবে
কতো অর্কিড ফোটে...
আমার কি জানা আছে উহাদের কথা!
অর্কিড পাহাড়ের সহজাত ফুল;
যথার্থ পাথর আর জল যথাযথ--
বিছন-বিছন মায়া কিছু...
এইটুকু নদী পেলে অর্কিড হয়
নদীসব রাখা ছিল নাগালের ঘেরে;
ঝলক স্ট্যাটাস পেলে অর্কিড ফুটবেই,
এমনই তো বলেছিল আনন্দ চ্যানেলে
তবু অর্কিড আজও পোষ মানিলো না!
উপচার ঠিক হলে অর্কিড ফুটবেই--
এমনই তো বলেছিল সুবর্ণ বন্ধুরা...
বলেছিল, ঠিকঠাক কড়ার করাতে;
কতোটা প্রশ্রয় পেলে 'ওরা' চিরকাল
কীভাবে সুযোগ নেয়,
বেশী জল খেয়ে পচে পড়ে থাকে টবে
আমাকে ঠকাবে বলে...
সব জানা ছিল, তবু অর্কিড ফুটিলো না,
স্বজনে কূজন বুঝি মিলিলো না আর
ফুলেরা আদেশ মানে না বলে মনে হয়..
চুপিচুপি বলে রাখি, সদ্য জেনেছি
অর্কিড আসলে ফোটে সহজ আদরে;
ফোয়ারায় ফোটে না, অর্কিড মানুষেরা
খানিক অশ্রুতে ফোটে, বাকীটুকু স্নেহে
আসলে তোমার বলবার কিছু নেই।
নতুন কোন কথা,
অণুগল্প বা দীর্ঘকবিতা।
শব্দেরা সুদোকুতে ক্লান্ত এখন।
থামাও জাগলারি।
জানো, মানুষ বুঝতে শিখেছে
অবশেষে...
নদীর তীর ধরে সূর্যাস্ত বরাবর হাঁটতে জানলেই
গল্প হয় না, কবিতাও না।
তোমার সাজঘরে সেই পোষাক কি আছে?
যা পরিয়ে দিলে শব্দদের গল্প বা কবিতার মত দেখায়?
বারুদের অমন গন্ধ পছন্দ নয় তোমার?
কিন্তু ওটাই এখন ট্রেন্ড।
তবে কি খোঁপায় গোলাপ সাজিয়ে সেই মোহব্বতের দিনকালের মত,
গলির অন্ধকারে অপেক্ষা করবো?
তুমি ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে উদ্ধার করবে পাষাণী কে!
ভিতরের মানুষ অনেকদিন মরেছে।
পচা মাংসের গন্ধ টের পাওনা?
তোমাকে কি সুরভিত ডিও ঘিরে থাকে?
জানো, বৃষ্টি শেষে এক আঁচল বকুল ফুল কুড়িয়েছিলাম।
কাকে দেব?
...বরং নদীতে ভাসিয়ে দিলাম উজানী স্রোতে।
কালচে রক্ত, ফুলে ওঠা শব,শেলের ফাঁপা খোলস এড়িয়ে,
দিব্বি দুলে দুলে ঝরা বকুলের মান্দাস হয়তো জীবনের দিকেই চললো...
চলে যাব চুপচাপ খেলা ভেঙে
সাগরের ঢেউ আদুল বুকে
কুয়াশা আদর আলজিভ শুষে
চাঁদের মীনার যখন তীক্ষ্ণ জেগে ওঠে
এক ফালি কোজাগর রাত মধ্যযাম
ক্ষয়ে এলে জীর্ণ শরীরের মোম
আলোর ফুলকি দাবানল হয়
সব কৌমার্য্য চিহ্ন ভষ্ম হবার আগেই
অন্তরঙ্গ চিতা নিভিয়ে দেব এক ফুঁয়ে
দগ্ধ নাভিকুণ্ডলী নির্লিপ্ত হাত
ক্ষুধা তৃষ্ণা ভয় কাম লোভ মোহজাল
ভাঙা শাঁখা সিঁদূরের ভান
শুধু আবছায়া জলছাপ
বিরহ বাঁশীর অবশ্যম্ভাবী সোহাগ মুছে
রাধিকা আয়ানের ঘরে ফেরে
মিথ্যে আলোর ফুলকি পিছু পিছু
রাতচরা চাঁদ ঝুপ করে ডুবে যায় উপেক্ষায়
তারপর অতর্কিত ছায়া সরে গেলে
চলে যাব চুপচাপ নিঃশব্দ বৈঠায়
বিপরীত কোন অসময়ের স্রোতে
কোন অপেক্ষা আমার জন্য নেই...
তুমি কি এখনো ঘন ঘন বদলাও ডিপি!
এখনো তুমুল বৃষ্টির চিলেকোঠা ঘরে
বসন্তবাহার নামে শরীরে তোমার?
কস্তুরী গন্ধ নাভিমূলে পথ হারায় কিশোর প্রেমিক?
হঠাৎ রেগে উঠে ভেঙে ফ্যালো কৃষ্ণচূড়া
ফুলদানি?
এখনো ও কি ঈশ্বরীপাটে
দোলের সংকীর্তন শেষে, ঘরে ফিরে
চুপিসারে আয়নায় দেখো
আবীরে রাঙানো সিঁথি?
বসন্তবিকেল ছাদ বাগানে গুনগুনিয়ে ভ্রমর শুনিয়ে যেত গান
শিমূলের এলোমেলো ফুলগুলো
তোমার কোলে আনমনে লুটোপুটি
সন্ধের সেই ফুচকার গাড়ি এলে
দু হাত ছড়িয়ে উছল হরিণীর মত
ছাদ থেকে তোমার নেমে যাওয়া
ঢেউ তুলে জিভে নেওয়া স্বাদ
এখনো আমার ঠোঁটে।
এতসব চিহ্ন তোমার পথরেখা জুড়ে
ভুলে যেতে চাই তবু পথভোলা নাই
অঝোর মল্লার থেকে বসন্ত বাহার।
হাওয়া মোরগ আমি শুধু
তোমার ঝড়ের পূর্বাভাসের
অপেক্ষায় থাকি।
ছমছমে আর একটা দিন পেরোলেই
হিসেবের খাতা থেকে ফুরিয়ে যাবে
বস্তাপচা লাভক্ষতির হলদে পাতাটা।
অতর্কিত ঝঞ্ঝায় ভাসবে কথার আবর্জনা
স্তূপাকৃতি মিথ্যে মায়ামুখোশ
হিংসের সবুজ ডালপালা।
নিভু নিভু চেহারার মেয়েটির বুকে
দাঁত বসাবে সবল প্রেমিক
গভীর করুণার অভ্যেসে।
ফুরিয়ে যাবার আগে
দিনটাকে হাতের মুঠোয় পুরে
ভাবছি তাকেও ভালোবাসতে শেখাই।
চলো, ফুরিয়ে যাবার আগে
একবার দপ করে জ্বলে উঠে
আলো দিই মুমূর্ষু অন্ধকারে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে আসে
সিগন্যালে গোধূলির রং
ছাতিমের গোল বেদী
ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে
ঝিম ধরা প্যাসেঞ্জার
ঘরমুখী।
চাওয়ালার হাঁক
ফিরিওলার চোরা চোখ
চেটে নেয় সাঁওতাল কামিনের
ঘেমো বিভাজিকা।
ওয়েটিংরুমে উন্মুখ মেয়ে
জানলায় চোখ
যদি থামে ট্রেন...
সময় পেরিয়ে যায়
বাঁশী বাজছে
বহুদূরে ।
মোরাম বিছানো প্ল্যাটফর্মে
ঝরছে পলাশ
আগুন রংএ অশোকের গুচ্ছ
বাতাসে মহুলের বিধুর গন্ধ
মাদল বাজছে ঝিনিঝিনি
সাঁওতাল বস্তিতে।
বাঁশীর শব্দ এখন কাছে
তীব্র থেকে তীব্রতর
ফাঁকা ওয়েটিংরুম
ছাতিমতলা।
সন্ধে আসছে
ছাতিমের ভারী গন্ধ
ধীরে ধীরে
মায়াষ্টেশনে
সিগন্যাল গ্রীন
সেই ট্রেন আর থামেনা ...
একটা মানুষের জন্য খুব বেশি হলে
সাড়ে তিন হাত জায়গাই লাগে
ঠিক সেই জায়গাটুকুতেই ফুটে আছে এত ফুল!
কী অদ্ভুত তাদের সৌন্দর্য, কী অসাধারণ তাদের সৌষ্ঠব
ফুটে আছে রাস্তার একপাশে সভ্য মানুষের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে
হয়ত কত শত বছরের ওপারে বিছানা পেতে ছিল
আমাদের কোনো পূর্ব পুরুষ
গাছেদের সংসারে সূর্যের আলো মেখে ভালোবেসে জড়িয়ে রেখেছিল প্রিয় সন্ততি
বুনে ছিল ফুল-লতা-প্রকৃতির এক অকৃত্রিম জগৎ
আজ কাকে দিয়ে যাবে সে উত্তরাধিকার
তুমিই বল কিয়ামত!
আসলে একা একা ভয় লাগে---
ভোরের নরম আলোয় আমার ভয়
কুয়াশা চোখ ধাঁধানো সরষে ক্ষেত
আর কপোতাক্ষ নদীর মৌরালা মাছ ,
এসব খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে গেল ন'কাকা
আসলে আমার কি মনে হয় জানিস
ন'কাকা হারিয়েই যেতে চেয়েছিল
তুই আসলেই আর একবার খুঁজে দেখব
এই নদী মাছ কুয়াশার দেশটাকে...
সকালে আমার বিছানায় এখন
নিমগাছ খেলা করে
আরো পুবে রোদ
ছায়ারা নড়ে-চড়ে, দোল খায়
উথাল-পাথাল ঝড় উঠল কোথাও!
বিছানার চাদর পাল্টে দিয়ে
একটা ধবধবে সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছি
এতে খেলা ভালো জমে
রোদ-গাছ-জানালা-বিছানার চাদর
ফ্রেমটা বারে বারে ভেঙেচুরে যায়
আর আমার লোভ ধীরে ধীরে লম্বা হয়
ছুঁয়ে দিতে চায় ঐ ছায়া-শরীর
আর প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দিতে
আমি নির্বাসিত হই চিরতরে..
প্রতিদিনই ফিরি, ঘরে
এখানেই কি ফিরতে চাই, ফিরে ফিরে আসতে চাই?
ভিড় ঠেলে, ধোঁয়া গিলে, উগরে দেওয়া
গালাগালের ধূসর চাদর গায়ে দিয়ে!
আসলে ফিরতে নয়, পালাতে চাই; হ্যাঁ,
প্রতিদিনই পালাতে চাই নাগরিক মুখোশ খুলে ফেলে
আদিগন্ত সবুজের মধ্যে, মিঠে বাতাসের শীতল সমারোহে
যেখানে এখনও অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে জল-ধোয়া গাছ
ছায়া-আলপনা আঁকা মাটির শীতলপাটি
একমুঠো মাটি বুকে মেখে নিয়ে গেয়ে উঠতে পারি
স্বদেশপ্রেমের গান !
আজ সমস্ত নগরের দরজা বন্ধ হয়ে যাক,
বন্ধ হয়ে যাক সব সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট
আজ একবার হয়ে যাক ঘরে ফেরার গান...
গাছেদের পৃথিবীতে এসো
দুটো গাছ পাশাপাশি
ধরি একটি আনন্দ আর অন্যটি বিষাদ
আমি নিয়মিত যাই ওদের দরবারে
বাকলে কান পাতি, শুনি
মাটি থেকে শুষে নেওয়া রসের স্রোতের শব্দ
পাতা থেকে পাঠিয়ে দেওয়া জীবন-সুধা...
গাছ দুটোর নাম পাল্টে দিই এবার,
ধরবার চেষ্টা করি ব্যথা আর আনন্দের নাড়ি
দেখি আনন্দ আর বিষাদে একই সুর বাজে ;
আনন্দের কোলে সোহাগে মাথা রাখে বিষাদ,
আসলে গাছেদের মধ্যে কখনো দূরত্ব বাড়ে না!
কতদিন যাইনি গাছেদের উৎসবে,
কতদিন কতরাত গেল, পা ফেলিনি গাছেদের উঠোনে
তোমরা বলতেই পার, নিমন্ত্রণ কি পেয়েছ,
লেফাফার উপরে কি লেখা ছিল নামধাম?
যাব অতিথি হয়ে, বিনা নিমন্ত্রণে
রবাহুতের মত আড়াল থেকে শুনে নেব শাশ্বত গান
চোখ ভরে দেখে নেব দশভুজার বিস্তার, দেখে নেব
কিভাবে ওমে জড়ায় বীজ, ছিটিয়ে দেয় প্রাণ-সুধা,
লালন করে প্রাণ---
যদি ভরসা পাই তো আর একটু কাছে যাব
কান পাতবো বুকে, দু'হাত ছড়িয়ে দিয়ে
ভিক্ষা চাইব দু'এক পাত্র ক্ষমা---
হাজার হাজার চোখ কাঁপিয়ে দেবে আমার অন্তরাত্মা
প্রবল জ্বরে মেপে নিতে চাইবে আমার বাঁক বদল
আমার নিঃশ্বাস থেকে ছেঁকে নেবে অভিসন্ধির পোড়া গন্ধক---
যদি গান চাও, ছন্দ চাও, জীবন চাও,
তবে সব পথ মিশে যাক গাছেদের উঠোনে...
ফসলের বুকে জমে থাকে
কত ঘাম, বেদনা
কে খোঁজ রাখে তার,
কার রাখবার কথা ছিল?
হাতড়াই হাতড়াই ...
দেখি শুধু মাটি, আর কেউ না...
কতদিন হাঁটিনি আল পথ ধরে
ধান খেত, গোড়ায় জমে থাকা জল
হালকা বাতাস খেলে গেলে সন্ধ্যায়
বৈশাখেও চোখে মুখে শিরশিরানি জাগে
কতদিন হাঁটিনি নদীর পাড় ধরে
নুয়ে পড়া বাঁশ আর ঋজু জারুল
হাতছানি দিয়ে ডাকে এখনও
মাছরাঙাটাও ওর ইশারা জানে
কতদিন হাঁটিনি শিশিরে-ঘাসে
ধুলো পথ নিয়ে যায় আরো দখিনে
বুড়ির মাঠ, মজা পুকুর, কাঁটাঝোপ
চুপকথার মানে সময় শুধু জানে
জানিনা কোন্ পথে লেখা আছে নাম-ধাম
পৃথিবীর থানে রেখে যেতে চাই বাউল-প্রণাম
দেখা অদেখার আলোছায়া ছুঁয়ে
আমিই কি শুধু হারি -
আকাশ ছুঁয়েছে ঋজু বৃক্ষের
উদ্গত পাতা স্বাধীন
খেলা লুটোপুটি রোদের আদরে
আঁধার তাড়ানো খুশী-সঞ্চারী
নিজের উঠোনে নিজের পৃথিবী
গুছিয়ে রাখতে পারি
যা দেখিলে তুমি তাই কি চেয়েছো
ছিঁড়েখুঁড়ে গেলে বুকের আকাশ
তুলসী মঞ্চ করে হাহাকার
অসাড় চেতনা অন্ধ পৃথিবী –
এই চেয়েছিলে – ব্যর্থ পুরুষ
হারিনি আমরা এই দেখো নত
দৃষ্টি সামনে রোদ মেখে বুকে
আমার আননে এই আমি নারী।
চারিদিকে শব্দ শমণের
ফাটে অন্ধকার
ছেঁড়া ত্বক অতলান্ত মাপে
অজানা প্রহার
ছিনতাই করে সুর; ভাঙ্গে ছন্দ তুলি
দোহার দেশপ্রেমে ছাড়ে ব্রজবুলি
জারুল বিবর্ণ হলে মড়কের তাপে
পাতা অক্সিজেন মাপে উন্নয়ন খাতে
চারিদিকে শব্দ শমণের
ফাটে অন্ধকার
ছেঁড়া ত্বক অতলান্ত মাপে
অজানা প্রহার
তবু এ ধূসর কাল বহে পোড়া কাঠ
নবীন আগামী হোক পঁচিশে বৈশাখ।
তোমার কাছে কিই বা পাঠাই
যখন বিকেল সদ্য-স্নাত
চুল এলিয়ে আকাশ জোড়া
বাড়ানো হাত অনাঘ্রাত
তুলির মতো তর্জনী সেই
বৃষ্টিভেজা শহর চিরে
আঁকলো ছবি দৃষ্টি-আড়াল
রাস্তা জুড়ে ছড়ায় হিরে
দেখলো না কেউ ইতস্তত
অন্য জগত চিনলো না তাই
স্বত্ব-বিহীন এই ছবিটাই
ছোঁয় যেন আজ তোমার হাতও।
আনাচ-কানাচ এখন ঘুরি একাই
আঁধার মাখি অন্তরালে যখন
পর্দা বদল বৃষ্টি-সোহাগ আলোর মতো দেখায়
চোখের আড়াল সুর এঁকেছে হারিয়ে যাওয়া কাঁকন
হারিয়ে যাওয়া কাঁকন বেকুব রাস্তা চিনে নেয়
সোনার গান, ওদিকে নয়, মাটির পথে পা
বৃক্ষাবলী, প্রাণের পাতা চোখ ঠেরেছে আশায়
বুঝবে আগুন কেবল বাঁচে জলের কিনারায়
জলের ছাপ অঙ্গ তাপ কে যেন ওই দূরে
মাপছে মাটি রক্ত ছুঁয়ে অশ্রুজলের কবি
সবার বুকে মানুষ আঁকে মহাকালের তুলি
প্রার্থনাতে অপার্থিব রঙ ছড়ালে সমীর। ।
ভ্রূপল্লব ছায়া ফেলে আশ্চর্য দুচোখে
কিছু ব্যথা সন্নিহিত তুমি জানো, আলোকিত
নিশানায় গাঁথা, ও চোখের চেরা পথে, অভিন্ন
আকাশে গান ছুঁয়ে যায় হৃদি-কল্প সুরে
কপালের ঘাম বিন্দু ধুয়ে গেলে বৃষ্টি আরোপিত
অযুত জীবন-হীরা মালা গাঁথে স্বপ্নের টানে
এবং ব্যাখ্যা দিতে ধুলোমাখা ঝরা কৃষ্ণচূড়া
পরিশ্রমী শুখা পথে ঘামে ভেজা বিকেলের মতো
নিজস্ব কোটর খোঁজে ক্ষণস্থায়ী দুরাশার ডানা
অমিত-স্বপনচারী শিশিরের জহরব্রততে
শিহরণ গেঁথে নেয় উঁচুনিচু কোকিলের সুর
পৃথিবীর সব পথে সুতরাং আমারও উঠোনে
আমার উঠোন আমি নিকিয়ে রেখেছি
চালবাটা গুলে আঁকা আলপনা বারান্দায় তাও
তক্তপোষে সুজুনি বিছানো, এসো বসো
তার আগে মলিনতা মুছে নিও কল-পাড়ে
ভিক্ষা দিতে এসো না কখনো উঠোন ডিঙিয়ে
সব নদী স্রোতধারা জানে মাধুকরী আমার আকাশ।
আঙ্গুল দিয়ে আঙ্গুল ছুঁলে
কথার পিঠে কথা
হোক অনাবিল বেভুল ছাঁদে
আদর ছোঁয়া কাঁথা
হাঁটতে নেমে গর্ত পেরোও
নিজের ছন্দে পায়ের চাপে
বুঝবে মাটি তোমার ব্যথা
কোন বেহাগে, তারায় কাঁপে
বলবে ওরা চুপ ক’রে যাও
বলবে ওরা আওয়াজ তোলো
বাঁধানো ঘাট শুকনো ডাঙায়
ছিটিয়ে দেবো তোমার ভালো
আমার কথা বলবো আমি
সঙ্গোপনে তোমার কানে
ইচ্ছে ব্যথা আনন্দে তা
থৈ-থৈ-দিন সম্ভবামি
নিত্য পূজা, চিত্ত খোঁজা
কথায় আগুন, কথায় ভেজা
আমার বুকে যে সুর বাজে
তোমার তারে কথায় সাজা
আঙ্গুল দিয়ে আঙ্গুল ছুঁলে
কথার পিঠে কথা
হোক অনাবিল বেভুল ছাঁদে
আদর ছোঁয়া কাঁথা।
তোমাকে যখন দেখেছি দূরের মেঘে
ফেলেছো আলতা অযথা মনের ভুলে
আনমনা ছাঁদে কিছু ভাবছিলে যেন
কোপাই এর জলে আয়না-বন্দী হ’লে
খুব গোপনীয় কথা কিছু ছিল নাকি
পুরনো গাছের বাকলে যে রঙ কালো
বানভাসি দিন অরক্ষণীয়ার চোখে
রেখে দিয়ে যেও অবুঝ নবীন আলো
দূরে যেতে যেতে বৃষ্টি-বাহন ডানায়
এখনো কি আঁকো ভেজা দুচোখের টান
ডানা-হীন মাটি কোপাইএর জল ছুঁয়ে
আমার শরীরে তোমার ঘুঙুরে গান।
সকাল থেকে ভাবছি গেঁথে নেবো
অসংলগ্ন চারু ইচ্ছে-মালা
কেননা ফুল বৃক্ষ আলো করে
প্রসঙ্গত বিজ্ঞাপণে ঢালা
সূর্য-আলো তখনও তীর্যক
আমিও পা বাড়াই যথাতথা
রঙ পছন্দ না হলে ঠিকঠাক
ব্যর্থ মালায় ঘটে যাবে অন্যথা
বন্ধু এসো বাড়িয়ে দিয়ে হাত
এই দিনটাও ফুরিয়ে যাবার আগে
অযান্ত্রিক স্পর্শ বুনে দিও
ইচ্ছে-মালা স্পষ্ট অরুণ রাগে
বাইরে পুরনো দিন- ছাড়ালেই চোখে পড়ে আবছার ওপারে
ফাঁকা আবছা মাঠ, দুপুর ততক্ষণে নিভে আসে
ঢিলেঢালা হাওয়া বইছে - অবিচ্ছিন্ন, একা - অজচ্ছল,
কোন দিক চিহ্ন জেনে কটি বয়স্ক ঘোড়া দিব্যি চলেছে এঁকে বেঁকে
কবে কোন ব্যস্ততায় ঘোড়া ফেলে চলে গেছে পুরনো সহিস
আজ এ পথেই বার্তাবহ একজন পিয়ানো বাদক ---
সে আনন্দ গাইছিল
শেষে, কিনারে কিনারে সন্ধ্যা, মাঠঘাট জুড়ে ক্লান্ত গীতি।
দিন ফুরোনো দেখতে যারা বাইরে অল্প আলোয়,
তারা ভিজে শুকনো মাটিতে খুঁজলো দেবতার চোখ
তখন তো দেখার কাছে সঞ্চরণে মুগ্ধ অজবীথি
সামনে তবে এ কোন দুয়ার !
নিভৃতে আলো জ্বললো, আঁধার ফুরোলো ততক্ষণে
শুনলে না কি ওই দূর মাঠ থেকে কিভাবেই
ধানখেতের অন্ধকার শব্দ করে ওঠে
তার কোন কথা ছিল, ভাষা ছিল না কি
না হলে পথিক এসে কিভাবে যে খুঁজে নেয় অজ্ঞাত বাগান
আর প্রাণ ভরে রবীন্দ্র গায় --
ব্যতিব্যস্ত করে তোলে অনির্মিত ঘর – বাড়ি -- পথ
অনর্থক ডেকে আনে বীতশোক শ্রাবণ গাথাও ঝরঝর...
তখন তো কি এক জীবন জাগে আলোর ভেতরে কুন্ঠায়
ভেজা দিন শেষ হলে কাউকে খুঁজতে যাবো ভাবি।
মস্ত বড় ডাঙায় উঠে - শরীরে শরীর যত্নে রেখে
ব্যাকুল দু চোখে দেখি--
ঘর খুলে রাস্তা বেরিয়েছে
খুদ্কুঁড়োর সংসারে আবার আষাঢ় - কথা এলো।
মা, দাওয়ার আলোতে বসে চাল বাছছে, মাথা ঝুঁকে...
দূরত্বের রঙে মেঘ আকাশের দক্ষিণে, পশ্চিমে---
ওই কোথায় মোল্লার মাঝি সে-ও বুঝে নিতে চায় মেঘদূত
ফুলপাতার নিস্তব্ধ গাছে আড়াল করছে, দেখলে
অপু – দুর্গা -- অপর্ণা -- কাজল।
ততক্ষণে নিরিবিলি প্রান্তেই ভাঙা নদী তার হাহাকার --
ভেসে যাচ্ছে অকালের কাছে। এখন আঁধার ফুরিয়ে আসে।
সলতেটুকুর আলো তাকে আমি ঠিক বলে দেবো--
জীবন খরচ করে কিভাবে যে জীবন পুনঃ
--- ' আপন আসন আপনি লবে '।
খুদকুঁড়োর সংসারের মা- সুদর্শনার মত কিভাবে যে
অন্ধকারের প্রভুকে চিনে নেয়।
বড় বেশি শেখানো কথা তার আঁচ কতদিকে সত্যি ইতস্তত
রাস্তাঘাট ম্রিয়মান লাগে।
জীবন দাঁড়িয়ে থেকে ক্রমাগত শুনতে থাকে --
পাওয়া আর হওয়া নিয়ে দীর্ঘ এক মলিন উৎক্রোশ।
' সকল নিয়ে বসে...' তারা কখন ভাবলো - নিজেকেই চেনাটুকু
কিভাবে যে বাকি পড়ে থাকে।
যেভাবে পৃথিবীর বুকের মাঝখান থেকে --
সুদর্শনাও একদিন রাজাকে চিনতে চেয়েছিল।
আজ মানুষের গা থেকে আলো ডানা মেলে অপার্থিব চাঁদে-
আমাদের পাড়ায় পাড়ায়
পথিক কখন যে খুঁজবে তাকে !
আমাদের রাজার নিশানে আজ কিংশুক ফুল আঁকা।
তাতে মুখরিত বর্ণের উচ্ছ্বাস - সেখানেও অসহ,অস্থির...
তাঁর বজ্রটুকু ভাঙা ভাঙা - ছায়া তার মাটিতে নেমেছে
পথে উৎসব দলবেঁধে - কম্পিত উল্লাস থরথর
ধ্বজা পূজো জয়ধ্বনির নিচে, আজ কাকে প্রণাম করবো তবে !
প্রভু, সে কোন দেবতা ?
আস্তাবলে পুরনো ঘোড়ার মত অভ্যাসের দু:খ নিয়ে
কবেকার আর্তনাদগুলি একা একা। বিচ্ছিন্ন। এদিক-- ওদিক...
আমাদের কাছাকাছি শুকনো হাওয়া, সময় ফুরোনোর ধ্বনি --
একদিন সুরের কাছে কোন সারেঙ্গী বাদক এসে আমাদের মগ্ন করবে
এমন আকাঙ্খাটুকু কবে দূর প্রয়োজনে চলে গেছে।
অথচ আমাদের চাওয়ার মধ্যে, পাওয়ার বা হওয়ার এক
তীব্র কলরোল -- তাতে দূরের পাওনা নিয়ে
মানুষের যে নিরন্তর দু:খ সে কিন্তু নিজেরই।
দূরের সে চাওয়ার কথা, সে অভীপ্সার কথা বলেছিল
রক্তকরবীর বিশু --- আড়াল ডিঙিয়ে।
তখনও মানুষ কিভাবে যে আগ্রহে অদ্ভূত সময় ডেকে শোনে।
'সে-' অদ্ভূত তো জমা-ই আর কিম্ভূতটি তবে যে 'খরচ'
যক্ষপুরীতে এমন তত্ত্ব বোঝাতে কি ভীষণ ব্যস্ত অধ্যাপক - তাতে
মুহূর্তেই নন্দিনীর তীব্র অস্থির আর্তস্বর : এ তো রাক্ষসের তত্ত্ব
এমন পুরনো কথা মহল্লার অন্ধকারে
আবার রাস্তা খুঁজবে না তো !
কে তোমায় ডেকেছে শুনলে -- তার কোন শব্দদল
পথ ডেকে সত্যি চলে যায় নি তো দূরে --- মহাকাশে ?
পথ চলার দু:খ ডেকে তুমি তবে শুনে নিলে --
জীবন তো পূর্ণ নয়, পূর্ণতার দিকে এক
অনির্ভার যাত্রাই -- অন্তর্গত আমিতে পৌঁছানো।
দূর পথে গুচ্ছ গুচ্ছ নিরুপায়ের দল --
কবেকার পুরনো পরিচ্ছদের এক কোচোয়ান এলো --
পথের সারথী
তখনো দেখলে পায়ে পায়ে চলার দু:খ
কোন দু:খই পাকাপাকি বুকে বাসা বাঁধবে কেন!
জীবন কি পূর্ণ না কি? তাকে পূর্ণতার দিকে চলা ভাবতেই
খুব কাছে কে গাইলো -- 'সুখের গ্লানি সয়না যে আর '
তখন আবার শীতের করুণ হাওয়া তেঁতুলবনের নীচে।
ভাঙা ঘরে, শতচ্ছিন্ন আলোয়ান ঢাকা কাছের দু:খটুকু...
সে তবে নিজের কাছে নিজেকেই ফিরিয়ে আনার দু:খ না কি?
পৃথিবীর মস্ত এক বিকেল নিয়ে ঘরে ফেরে মেষপালক --
অবাঙ্মুখ। এখন (হেমন্ত) বুদ্ধের ঋতু তাকে চোখে রেখে
জেনে নেয়, সে কেমন কত ঈশ্বরীয়।
তখনো অবশিষ্ট না কি অপূর্ণ সখ্যতা আটকে ছিল নদীর ভাঙনে।
প্রান্ত রেখার পাশে ভেজা কিছু প্রাচীন উদ্ভিদ, ভেড়ির গন্ধও
ক'টি উচাটন হাঁস গলা তুলে ফিরে যাচ্ছে অযথা সময়ে,
পৃথিবী নামের এক প্রাচীন কোটরে।
সন্ধ্যার মুখে জাতকমালার গল্প।
ক্লান্ত মেষপালক -- এখন তো খড়ের বিছানায়
অন্য এক নিরালা বিশ্রামে।
রাত্রে নিদ্রার কাছে কিভাবে সে জানতে পারে --
প্রাত: সূর্যকালে মেষগুলি ফিরে যাবে
চিরবাতাসের সাথে, দূরে --
কাল পৃথিবীর কোথাও রঙিন মহোৎসব তবে...
যুদ্ধ পারে একদিন মনে হোল
আমাদের নিজস্ব শ্বাসে, মূলে গান মিশে আছে
তার করুনানয়ন আশ্চর্য দিশায় সাবেকি দুপুর ছেড়ে
বনানীর ছায়া জালে আশ্রয় খুঁজতে চলে যায়।
সে সময় মেঘ যদি মুখ রাখে মাটির পুলকে
যুদ্ধের পুরনো মাঠ মহাপ্রস্থানের পথেই ফিরে যাবে।
কতকাল পরে দেখবে
কি আনন্দে গলা তুলে অশান্ত হাঁসেরা বৃষ্টি গায়।
গাছের মাথায় কে গুঁজেছে ফুল?
খোঁপা তো নেই, গাছের মাথায় ফুল
কে গুঁজেছে ফুল?
কলকে ফুল ভিজতে ভিজতে ইশারা করে
কাকে ইশারা করে?
বৃষ্টিতে ভিজছে আষাঢ়ি শবর।
জলে ছোঁ মেরে উড়ে গেল বক
নদী উদাসীন
এই নদীতেই হাতি আসে হরিণ আসে
এই নদী থেকেই কুমির ওঠে ডাঙায়
রোদ পোহায়
নদী উদাসীন
এই নদীতেই সিনান করে আকাশি সোরেন।
জঙ্গলে গাছপালা আছে পশুপাখি আছে
জঙ্গলে চুরি করতে গেলেই
বলি হয়ে যাবে
গন্ডারের খড়গ আছে।
গড়িয়ে নামছে পিরিত
গরু চেনে। গা চাটে তালগাছের।
অর্জুন ফল কামরাঙার মত হলেও
কামড়ানো যাবে না।
অর্জুন ফল গাই-গরু--ছাগলের আহার।
অর্জুন গাছের ছাল থেকে জড়িবুটি।
রোগ নিরাময় করে জলপেশ মুড়া।
একমুঠি ধান থেকে ক ' মুঠি চাল?
ইঁদুরের গর্তে হাত ঢুকিয়ে এক মুঠি ধান
ইঁদুরের খাদ্য ইঁদুরের কাছেই থাকুক
উই ঢিবি ভেঙ্গে সাপের খোঁজ করবে
সাপের মাংসে হাড় নাই।
ভুঁইয়ে প'ড়ে চোখের জল
শব্দ করে উঠলো ঘুঙুরের মত
কে দেখবে ঘুঙুর?
কে দেখবে কান্না?
ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে জঙ্গল
একা হয়ে যাচ্ছে জঙ্গল।
ক:
পাখিকে মারার আগেই
গুলতি থেকে পড়ে গেল পাথর।
সহজ নয় পাথর, পাথর যে জটিল
সইতে পারে না বনদেবী।
খ:
পাখি শিকারির চোখে পড়লেও
কাঠবিড়ালির দিকে ছুটে যাবে না
একটি ও পাথর।
কাঠবিড়ালি দেখিয়ে দেয়
কোন্ গাছে লুকানো আছে পাকা ফল।
গ:
গাছে গাছে মাকড়সা জাল ফেলেছে
কাকে ধরবে বাছা কে জানে!
যদি ধরা পড়ে চাঁদ, ছিঁড়ে ফেলবে
জালের বিস্তার।
ক:
অর্জুন গাছের ডালে চামচিকে ঝুলছে।
নজর করছে, পোকারা কোথায় উড়ছে, কত দূরে!
এই রাতে কোথায় যাচ্ছে শুয়োর?
লক্ষ্য করছে একটি বল্লম।
খ:
বল্লম ছুঁড়তে ছুঁড়তে যদি গাছকে বিদ্ধ করে?
যদি মাটিকে বিদ্ধ করে?
বল্লমের ফলায় দেখা যাবে যন্ত্রণা
শত শত বছরের যন্ত্রণা।
গুহার গায়ে যা যা আঁকা
সেও তো যন্ত্রণা অথবা ব্যথা বেদনার
এক একটি ফল
শত শত বছর ধরে পেকে উঠেছে।
টাঁড় জমি
এপার থেকে শব্দ করলে
ওপারে শুনতে পাবে না কেউ
টাঁড় জমি
ঢাক ঢোল বাজালে
শুনতে পাবে আকাশও।
মৃদু ছন্দে পাতা নাচ
মৃদু লয়ে কেঁদরিও বাজে
বাঁশিও করুণ
গুমরে গুমরে ওঠে তল উপরের মাটি
হাতে হাত ধরে হাওয়া
পূর্ণিমার জাগরণ।
আষাঢ়! চির আকুতির আষাঢ়!
সমস্ত দহন তোমাকেই সমর্পণ।
ভুল পথে কেন এমন হারাও!
কিছুতেই ছুঁতে পারি না তোমায়।
পথে পথে খুঁজে মরি
আঁচলে লুকানো বকুলগন্ধী মালা
পরাবো বলে তোমার গলায়।
জানি, আমাদের কখনও সংসার হবে না
থাকল শুধু ...পথঅনন্ত পথ—
একদিন দেখা হবে ঠিক সেই পথে।
সেদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই ইঁটখোলার মাঠে রামধনু নেমে আসবে।
তোমার ধূপছায়া উত্তরীয়তেও লেগে থাকবে সেই আভা।
ওদিকে; শুকোতে দেওয়া কাপড় চোপড় ভিজতে থাকবে তারে।
কয়েকটা ছাতার পাখি বৃষ্টির জমা জলে স্নান করা থামিয়ে
অবাক চোখে দেখবে—
রামধনু সিঁড়ি বেয়ে কে যেন মিশে গেল
আষাঢ়ের মেঘে।
কিছু স্মৃতি বোবা হয়ে
ঝুলে থাকে ফটোফ্রেমে।
নিরন্তন পত্র মোচন তার।
কিছু স্মৃতি বুকের ওমে
শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়।
স্মৃতিরাও খোলোস বদলায়।
স্মৃতির আতিশয্যে বেড়ে গেলে জল
ভিজে যায় ভেতর ঘর।
ক্ষয়িষ্ণুতা জুড়ে ব্যথার স্তব্ধ সরোবর।
আমাদের গল্পটা শেষ হয়নি এখনো।
এতগুলো বছর অপেক্ষায় আছি
আর একবার অন্তত মুখোমুখি দাঁড়াবো আমরা।
খোলা আকাশের মতো নীরব সম্ভাষণে
মেলে ধরব আমাদের অতীত যাপন।
না কোনো অভিযোগ
না কোনো সম্পর্কের কাটা-ছেঁড়া, অথবা
দোষ-গুণের সূক্ষ্ম মূল্যায়ন।
মননের নিরক্ষীয় তল বরাবর শুধু আমরা নিরুচ্চারে পিছনে হাঁটবো।
পথে বৃষ্টি নামবে
বুকের উপত্যকায় বিদ্যুতের বেগে
ছুটে যাবে কিছু চিতল হরিণ।
ব্যাকগ্রাউন্ডে তখন সেই চেনা সুর-'রিম্ ঝিম্ গিরে শাওন--'
আমরা দুজনে ভিজবো,
ভিজতেই থাকবো।
১
লিখতে লিখতে ঝড় উঠেছে লিখতে লিখতে রক্ত
এখন কাঁধে বইতে পারা এমন কী আর শক্ত
অনভ্যাসের ফোঁটার মতো
সুখের পুঁতি ইতস্তত
চড়চড়ালো মালার বুকে, দুঃখতে আসক্ত
বুকে বেদন সইতে পারা এমন কী আর শক্ত
লিখতে লিখতে যেমন ফোটে দু-একটা অত্যুক্তি
২
কে আর মোছে রঙের ছিটে
বসন্তে বেশ তো কালসিটে
রইল গালে, ঘুম কপালে গ্রীষ্মাবধি উঠলো
এখন তাকে ফেরাতে, ধুম নেশার বিষও জুটলো
কিন্তু আবীর গলায় এখন জ্বলছে
মুখচোরা সেই বেলুন পেল রাক্ষুসে হৃৎপিণ্ড
আগুন খেয়ে গলছে
৩
একটি পাতা ব্যাকুল ছিল একটি ছিল ধূর্ত
আলগা হাওয়া লাগলে দুটি উড়ত
একটি ওড়ে শান্তিতে
আরেকটি বিভ্রান্তিতে
হঠাৎ কোনো ঝর্ণা দেখে জিরোয় দুটি ক্লান্তিতে
জলের বুকে ব্যাকুল পাতা, কীসের জ্বালা জুড়ত
আয়না ছিল গান ছিল
ভেতরে খান খান ছিল
লাল পাথরে ছড়িয়ে তাও টুকরো টুকরো প্রাণ ছিল
আসলে ঐ ধূর্তটিরও ভেতরে আনচান ছিল
৪
আমি কি আর তোমায় পথে থমকে দেব, নদী
জলের মধ্যে পাথর ভেসে আটকে পড়ে যদি
শ্যাওলা লাগে গায়ে মাথায় শ্যাওলা লাগে চোখে
পাথর, তখন কী উচাটন দেখতে লাগে তোকে
যেই জুটেছে বুকের ছায়া ঘোর লাগা এক ভূত
সারাজীবন ভাসিয়ে দিতে মুহূর্তে প্রস্তুত
কিন্তু যদি না ভাসিয়ে আছাড় মারো তটে
তাতেই বা কী, এ দুর্দৈবে কত জখম ঘটে
আমি কি আর, নদী, তোমায় থমকে দেব পথে
৫
হাওয়ায় কিছু দুলল না
আগল মোটে খুলল না
জয়ীর কাছে এ আন্দোলন আদতে দুর্মূল্য না
পরাজিতের পেখম এই খসা পালক ভুলল না
কিন্তু জেতা হারার মাঝে
একটি প্রাণে বেদম বাজে
প্রণয় পেষা আর্দ্র মুখ একটিবার তুলল না্
১
দরজার আড়াল দিয়ে বাবার কান্নার মতো তোমাকে দেখেছি
যেতেও পারিনি কাছে ভুলতেও পারি না বোবাফুল
চোখে ও চিবুকে যেন ক'জন্মের ঘন ছায়া, ভেঙে
তোমাকে সুন্দর আমি কখনো করিনি
এই চোখ যে দুঃখটি নাগালে পেল না
তাকে কে ধুইয়ে দেবে কে শোনায় আরোগ্যের শিস
যেতে যে পারিনি কাছে, যাব না যে সে কি ও জানে না
২
আমি যে তোমাকে চাই সে আমার মনের বিভ্রম
আসলে নিজেকে কিছু মুহূর্তের অনুগত ভেবে
হঠাৎ সিদ্ধান্তে আসি। মন, দেখো, কিছু দূর থেকে।
নিভৃতে এলেই হাতে আসে হত্যার নিখুঁত ফন্দী,
ফেরাতে পারি না, জেনো, তোমাকে যতটা কাটে গূঢ় চক্র এই
আমাকেও কিছু কম ঘায়েল করে না
৩
কারণ তখনও তুমি খুঁজে দাওনি এ জাদুসফর
শব্দের বাণিজ্যে এত গূঢ় দু;খ-বিনিয়োগরীতি
তখনও শিখিনি, তাই, নাগাড়ে হোঁচট নাভিশ্বাস
সমস্ত কবিতা আজ 'তুমি' শব্দে শুরু হয় ব'লে
তোমাকে এখনও চাই, এ ভ্রান্তিতে কখনো অহং
দিও না জাগাতে মর্মে, এসমস্ত আমারই ভেতরে
অমর পঙ্গুর মতো অহর্নিশ সম্মুখ দেয়ালে
একটি রবার বল ধাক্কা দিয়ে লুফে নেয়, অন্য কোন পথে আর বলো
তোমাকে অতীতশিল্পে, উল্লেখ না ক'রে ডাকা যায়?
৪
আমার দর্পের মধ্যে যে রয়েছে ভীতু ও ছাপোষা
তাকে তুমি চিনে ফেলবে, সে আশায় বসে থেকে থেকে
দিবসাবসান হল। এখন রাত্রির গাঢ় গান
আঠালো জ্যোৎস্নায় দেখি আটকে আছে কপালের ভাঁজে
কেন এই অকৃত্রিম সন্দেহপ্রবণ হামাগুড়ি
অনুচ্চ দর্পের মধ্যে, এতদিনে চিনে ফেলবে প্রকৃত স্বরূপ
কী উদ্গ্রীব বসে আছি, যক্ষ-হাতে সারল্য আমার
এখনো প্রহরাপ্রাপ্ত, ভেঙে ফেলো, অধিকৃত হই
৫
কী আর উপায়, তাই, আস্ত একবগ্গা প্রেমে কামড় বসিয়ে
ভেবেছি দু-টুকরো করি, সামান্য উৎকণ্ঠা কতদূর যায় যে তার প্রবাহে
আকাশে নক্ষত্র জ্বলে নেভে, গোপনে মিথ্যের পিঠ
চাপড়ে তাকে ঘুমে রাখি, স্তন্য দিই, বড়ো করি সত্যের ভ্রমেই
কোলে কোলে, ন্যস্ত থাকে কাঁধে তার নধর মাথাটি
শিশু ওষ্ঠে চওড়া ফোটে পিশাচ-হাসির রেখা, ক্রূর দৃষ্টি চোখে
নিদ্রাভান ভেঙে স্পষ্ট হয়, কিন্তু, কে আর জানায়
পিঠের প্রভূত ক্ষতি-সম্ভাবনা মানুষের সম্মুখ বাগানে
তবু কি বুঝি না তার বিন্দুমাত্র, আভাস তো অল্প অল্প পাই টের তবু
কী আর উপায়, তাই, আস্ত একবগ্গা প্রেমে কামড় বসিয়ে
ভেবেছি দু টুকরো করি, ফুরায় সামর্থ্য ফোঁটা ফোঁটা
গলায় দড়ির দাগ নিয়ে ঘুরে মরছে একা বিফলা বাহার
৬
যে সন্দেহ নিজেরই ওপর, তাকে কী দিয়ে ভোলাই
সকল আগামী পিঠে দুলে চলছে নখ ও চাবুক
সময় না দিলে তার প্রকৃতি কি চেনা যায়, চর্চার ভেতর
পুতুলেরও পেশী ফোটে, অন্তত বিশ্বাস এই মতো
যদি নাই রাখি মনে, কার জন্য ফাঁকা পড়ে আছো, তবে, মন
ধাঁধা না আলোয় কীসে মিটবে খিদে জানি না তবুও
তোমার ধারণা থেকে ক্রমে দূরে সরেছি এবার
সরেছি কি? উইয়ে খাওয়া বইয়ের ভেতরে উজ্জ্বল রয়েছে অংশত
কিশোরের পেন্সিলের টীকা, আছো সেইভাবে, আছো
পুনরায় যত্ন করে ভিন্ন অর্থে পাঠ নেবে আদিম সূর্যের
সে ক্ষমতা আছে শুধু মানুষেরই, জীবনের ঘাটে,
যে জল বন্যায় আসে সেই জলই আসে না খরায়
তা বলে তোমার থেকে এতদূরে যাব না কখনো,
যাব না কি? যে সন্দেহ নিজেরই ওপর, তাকে খাই
ফিরিয়ে দেওয়া কঠিন ছিল না তত...
ছুঁতে পারা তীরে নৌকাডুবির দাহ!
পায়ের বিলাপে নোঙর বাড়ালো ক্ষত...
নিরবধি, তাও জেগে ছিল আগ্রহ!
দেরি হয়ে যায়, মাঝির বারতা শুনি;
ডুবছে ভাসছে, এসেছে কখনো কাছে...
নির্জন ভোরে অবহেলা খুঁজে গুনি..
যেটুকু পেলাম তাই কী ফেরাতে আছে!
দিনান্ত পথে একাকী রোদের ছায়া,
মেঘ অহরহ তৃষ্ণাকে পিছু ডাকে...
অতল দহনে পোড়া ছাই খোঁজে মায়া;
পরিযায়ী চেনে শীতের উষ্ণতাকে!
নিরস্ত্র থাকি, জীবন, সাজিও ব্যূহ...
দু'চোখে এমন মেঘ নেমে আসা ভালো!
অবুঝ বরষা পাড়ি দেয় মহীরুহে..
ভেজানো আগলে শিকল চুঁইয়ে আলো...
অবোলা স্মৃতিও বারবার হেঁটে আসে...
কাঙাল, তবুও গোপনে বিষাদ মাখি!
পরমায়ু নয়, বিষটুকু ভালোবেসে...
তীব্র গহনে জীবনকে ডাকাডাকি!!
অভিমান যথারীতি বিধিসম্মত হাঁটা ভোলে;
অতীব দুরূহ জেনে চোখ ভেজে সহায়সম্বলে
মাঝপথে নেমে যেতে শেখেনি সে সাঁতারের লোভে;
তাই বুঝি অবহেলা অযত্ন অপেক্ষা সম্ভোগে
কিঞ্চিৎ জীবনের যাবতীয় আয়োজনে বিধিবাম;
তবুও বালাই ষাট, ব্যাকরণ দুচ্ছাই... " ভালোবাসিলাম!
এখনো তোমার স্বরেদের দোলাচলে...
অনায়াস ভরি পলাশের রাঙা মুঠো!
হারিয়ে ফেলার ধারাপাত বিন্যাসে
বাংলা নামের অযাচিত খড়কুটো!
এখনো তোমার যত্নে লালিত হাতে
সিঁদুরে মেঘের বারোমাস্যা সাজে!
শ্রাবণ এর মতো এলোমেলো থই থই....
কৈশোর টানে অভিমান কিছু বাজে!
এখনো তোমার মর্যাদা অপব্যয়ে
অবনত মাথা, আকুল বৃষ্টি গুনি!
মন-কেমন আর বিষণ্ণতার রাতে
চিবুক ঠেকাই,অক্ষর স্নান শুনি!
এভাবেই থাক মননের যাতায়াত
বিপন্ন এক ঘরকন্নার কাছে;
চৈত্র দিনেও ফুল ফোটাতে পারে
আমার আঁচলে এমন ভাষাই আছে!!
চলো খুলে ফেলি অবসাদের ভ্রূক্ষেপ
ভয়ের অন্ত্যমিল
ঈর্ষার সোঁদা গন্ধ
বরং ধাক্কা খেতে খেতে চলি,
সমাজের খেই হারিয়ে ফেলি,
অন্ধকারে জ্ঞানশূন্য হই!
পৃথিবীর তলদেশ থেকে তুলে আনি গভীর অসুখ;
বরং ধরে নেওয়া যাক, হেরে যাওয়াটাই লক্ষ্য
মুঠো ভরে থেকে যাক বিস্ময়,
শুধুই বিস্ময়
যত বিশ্রী ক্ষত তত যুদ্ধজয়
মুখোশ ছুঁয়ে সূর্য ওঠে ওই,
ঠিক যেখানে মরা নদীর বাঁকে
কথাগুলো ফেলনা মনে হয়...
প্রতিশ্রুতি অবাধ জলে কাঁপে!
ঘরের মধ্যে জ্বলছে ধুধু বালি,
ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে ব্যথার গ্রাম;
এখনো তো জ্বলন্ত রাত ধরে
অলীক স্নেহে লিখেছি তোর নাম!
ঠোঁটের ভারে যেমন হেঁটে যাওয়া,
ফেরা আবার স্মৃতি সুতোর টানে;
হু হু করে বাড়তে থাকা শীতে
পশম জানে অপেক্ষাদের মানে!
মেঘ ভিখারি হয়েও পুড়ি রোদে,
রান্নাঘরে সাজাচ্ছি প্রাণপণ...
লন্ঠনেরই উপুড় করা আলোয়
যুদ্ধজাহাজ ;নিরিবিলি কোণ!
ডানায় যখন সাহস নেভে রোজ,
বাসি রক্ত ব্লটিং পেপার খোঁজে!
বিয়োগ নিয়ে খেলার শেষে তাই
যোগের দেশে আত্মীয়তা বোঝে!
অজুহাতের নিপুণ পথের শেষে
ক্ষমা তোমায় দিয়েছি সওগাত....
থার্মোমিটার ভাঙ্গা পারদ জানে
ঠিক কতটা ছেড়েই গেছে হাত!
বসন্ত শেষ, নির্বাসনের পথে...
ভালোই আছি; তুমি এখন ভালো?
আটকে থাকে শহর জলছবি...
শরীর মাপা গোপন ইচ্ছেগুলো!
ভেড়ার পালের মতোই সন্ধে নামে,
জন্মদিন একলা পড়ে থাকে,
আকাশ ভর্তি কালপুরুষের ঘ্রাণে
অবহেলা মেঘ জমিয়ে রাখে!
সময় থামে ঝড়ের আয়োজনে;
কথা ভাঙার গল্পে নৌকো ভাসে...
দৃশ্যের পর দৃশ্য জমায় পাথর,
ইনবক্স তাও আপোস ভালোবাসে!
যেসব ব্যথা রাতের উদযাপনে
প্রশ্ন ফেলে নিয়ম করে বাঁচে;
নীরবতার ভ্রমণ শেষে হাঁটা...
একাই হেলান অবিশ্বাসের আঁচে!
বুকের ভেতর আটকে গেছে ঘুড়ি;
তাইতো আকাশ একলা আছে আজো!
স্বজন চেনা ভিড়ের ওজন মুঠোয়,
অবাক দাপট শূন্যস্থান সাজো...
ভুলের খাতায় অনেক যত্ন করে
নিখুঁত হিসেব ;টাটকা গভীর ক্ষত!
হাসতে হাসতে ছায়ার অভিনয়ে
আহত হই আবার, অবিরত....
কতটুকু ব্যথা দূর থেকে বোঝা যায়!
কতটা জটিল সহজ হতে চেয়ে
কত রোদ্দুরে যুদ্ধের পাহারায়
শান্তি কিনতে চাইছে একলা মেয়ে!
তোমরা ভাবছো আপোসটা দরকারি;
সংঘাত শুধু পুড়তে পোড়াতে জানে
মেয়েটা দেখছে তুল্য মূল্য জারি
সমাজ বনাম ভালোবাসার মানে!
প্রতি রাতে ভাবে কালটা নতুন পাবে...
এতোটা হোঁচটে বুঝি বা সারলো ঘা!
অবহেলারাও কিছুটা ক্লান্ত হবে;
আদরে সারবে আহত কঠিন পা।
এমন কতই সাধ্য সাধনা বেয়ে
জীবন কুড়োয় অবিশ্বাসের ধুলো;
একটা ঘরের আকাশ হাঁটতে চেয়ে
সে মেয়ে হারালো সামান্য চালচুলো!
মাছরাঙা যেভাবে জলে ঝাঁপ দেয়
সেভাবেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে এই নগরীতে
এখনও হেমন্ত রয়ে গেছে,যদিও শহরে
তার কোনো চিহ্ন নেই
তবুও সন্ধ্যা নামে, দ্রুত, অন্ধকারে
সন্ধ্যা নামে আকাশের গাএ,
গোধূলির সবটুকু আলো শুষে নিয়ে
মেঘেরাও ঘরে ফেরে
ধূসর বাড়িগুলো, ধূসরতর ঘর
আলোর অপেক্ষা নিয়ে পোকামাকড়ের সাথে কথা বলে
সন্ধ্যা নামে একা একা,রমণেচ্ছু বেড়ালের মতো
চুপিসারে, তার নখে ও থাবায় লেগে
স্মৃতিচিহ্ন, বিগত প্রেমের
সন্ধ্যা নামে হাওয়ার শরীরে
কুয়াশার মতো কিছু অস্পষ্টতা
এখনও রয়ে গেছে
ফ্রেমহীন বিবর্ণ ছবির মতো কিছু মায়া
এখনও অবশিষ্ট আছে
তাই, অতর্কিতে সন্ধ্যা নামে, এই নগরীতে
অন্ধ দু'চোখে তার ঘ্রাণ
নষ্ট প্রেমের মতো, থেকে যায়
হেমন্ত শরীরে ...
যে কোনো নারীর সাথে সঙ্গমের মতো
যে কোনো বিষয়ে ইদানীং কবিতার মতো কিছু লেখা হয়
চুম্বনের ক্ষত নেই, শীৎকার শুনে
ভণ্ড ও বিদূষক গ্যালারিতে হাত ধরে হাততালি দেয়
শরীরে রহস্য নেই, সুর নেই,গান নেই
অন্ত্যমিলে মজে থাকে কৌশলী পাঠ
পাঠের হৃদয় নেই, বৃক্ষ নেই,
নেই কোনো অরণ্যর সন্ধান
এভাবে কি প্রেম হয়? নক্ষত্র পুড়ে যায়
অবসাদে, কর্কশ বিষাদে পড়ে থাকে অক্ষরপ্রতিমা
শীত ও গ্রীষ্মের মাঝে দূরত্ব যতটা,
তারও চেয়ে দূরে থাকে
সম্পর্ক
অবসন্ন বিকেলে আজকাল
আর কোনো বালকেরা
ফেরে না
ক্ষতটিতে বসে আছে মাছি
কেউই নেই তাড়িয়ে দেওয়ার
তাকে
বিবর্ণ ছবিগুলি, তার গাএ
মাকড়সার জাল, সেখানে জড়িয়ে আছে
কীট
অপস্রিয়মাণ আলো, তার সাথে কথা
ফুরিয়ে ফেলেছে এই মাটি,জল,মেঘ ও বাতাস
ইদানীং
একবার চেয়ে দেখো গাছের পাতাটিকে
তার
বর্ণ ত্বক শিরাগুলি, শরীরের কথা,
তাকে স্পর্শ করো
পাতাটিকে মন দিয়ে দেখো
তাকে ছুঁয়ে থাকা ফড়িঙের মতো
অমলিন শিশিরের গাএ
লেগে থাকা সূর্যের মতো
তোমারও অস্তিত্ব আছে
ঐ পাতার শরীরে,
তাকে চেনো
ঝরে যাওয়া বিকেলের মতো
আরণ্যক ঘ্রাণে
জেগে থাকা পাতাটিকে
চেনো,
এই জল ও বাতাসে
তুমি গাছ হও
লতাগুল্মবনস্পতিবৃক্ষের মতো
উদ্ভিন্ন হয়ে ওঠো ...
কিছু কথা হৃদয়জনিত
ভেলা ভাসে অন্তরীক্ষে
আদি লতাগুল্মবৃক্ষে
নিহত প্রেমেরই এপিটাফ
নক্ষত্র হারিয়ে যাবে
হৃদয়ের বিজন স্বভাবে
রমণেচ্ছু কিশোরের ক্বাথ
গোপন স্বপ্নের চিঠি
রক্তে রাঙানো মুঠি
সর্বাঙ্গে ধুলোমাটি লেগে
বিষণ্ণ চোখের আলো
কে তাকে বাসেনি ভালো
অন্ধকারে তবু থাকে জেগে
তুমি যে মায়ার কথা বলো,
সে মায়া কি কমলকুমারীয়?
অসতর্ক বাউলের একতারা ভেঙে গেলে
যেরকম মায়া হয়,
তেমন আর পাবে না এখানে
শহুরে আমোদ এসে ঘিরে ফেলে গ্রাম
ভালোবাসা পাবে বলে যে শরীর অপেক্ষায় ছিল
মায়ার কাজল পরে চোখে ,
সে নাকি নিভিয়ে দিয়ে আখড়ার আলো
রিএলিটি শো-য় গেছে
রিক্ত অজয় পড়ে আছে, তার গভীরে কোথাও
মায়াচিহ্ন খুঁজে পেলে বড়ো সুখ লাগে
খাদানের লোভ, তার আঠালো তরল
চেটে খাবে বলে যারা হয়েছিল জড়ো--
সেখানে কি মায়া থাকে? এত ভুল কীভাবে করেছ?
মায়াবী খোয়াই , তার সোনাঝুরি পাতার চাদরে
কিছু মায়া যদি পেয়েছে আশ্রয়,
তবে তো আবার
বেঁচে থাকবার কথা বলা যেতো গোপনে তোমায়
১.
কী দেখতে চাইছ তুমি ক্যামেরার লেন্স জুম করে—
ক্ষমা চাইবার জন্য প্রস্তুত ছিল না কোনও মুখ
জেব্রা ক্রসিংয়ের সাদা রঙে
হালকা কিছু ছোপ পড়েছিল—লালের
শিল্পের, কৃষির বিপ্লব গিয়েছে বুঝি ওই পথে?
আত্মহত্যার সমৃদ্ধি যোজনা!
কতদূর দেখতে চাইছ তুমি ক্যামেরায়?
তুমিও মেনেছ শেষমেষ—
বহু ডুবন্ত পাহাড় সমুদ্রকে বেঁধে রেখেছে
কথামালার এই দেশে!
২.
প্ল্যাকার্ড জুড়ে দখলদারি
আর ভাবছেন, পরিকল্পনা মাফিক সাফাই অভিযানের কথা
মাদারীর তাঁবু উঠে গেলে,
জয়ের আনন্দ-গান গায় যেভাবে চাপা পড়ে থাকা মাটি
দিন, বড়দিন—আজ!
বাবু-বিলাসের রং মেখে
ভুলে যাওয়া যাবে অচ্ছুত, ছিন্ন জীবনের দাগ
এসব আপনাকে কেন বলছি—
সুখ বলতে কি বোঝায়, পরিণত বোধে জেনেছেন নিশ্চয়?
অসীম সাহসী কেউ এইসব দৃশ্য দেখে,
মাটি থেকে গড়ে তুলেছে পাথর
এবং একটি একটি করে দাগ কেটেছে ক্যালেন্ডারের চৌখোপে।
৩.
প্রবল হাততালির শব্দে দুয়েকটা পাতা খসে পড়ল ডাস্টবিনে
সন্ধ্যায়, বিশেষজ্ঞরা ভাবল—একে অপরকে থামিয়ে বলল অনেক
খুঁজে বের করল, কার্নিশে ফাটল; হলুদ ফুলে বসা প্রজাপতি
এমনকি টবে গজিয়ে ওঠা বুনো আগাছাদেরও
সুসংবাদের আশায়
বিশেষজ্ঞ ও শ্রোতা-দর্শকেরা প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে যায়
যাহ্! কী ছেলেমানুষি হচ্ছে!—বলে, ফিরেও আসে
এসবের পাশ দিয়েই যদিও চলতে থাকে মঞ্চের কার্পেট গোটানো
কাঠের পাটাতনের পেরেক ওপড়ানো—কেননা, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই যে,
হারমোনিয়াম সংগতে আজীবন, নিয়মমাফিক রেওয়াজ করলেই
ভাষণের বিপ্রতীপে, পরবর্তী শিল্পী হিসাবে...
৪.
অন্ধকার থেকে চুঁইয়ে পড়ে বেদনার নীল রশ্মি
এ কথাটা
কে যেন বলেছিল, কে যেন লিখেছিল—কোথাও!
ঘরের দরজা-জানলা মুড়ে দিয়েছি কালো কাপড়ে
নাবিকের নিশান হয়ে পথ দেখাবে—বেদনার ওই আলো
বদ্ধ ঘরে জমে উঠছে কালো মেঘ,
বিদ্যুতের চকিত ঠাট্টা
বেড়ে উঠছে চুল-নখ
সেসব মেপে দেখে লেখা হবে, হবে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড!
হে বেদনার নীল রশ্মি—
তোমার দেখা পাওয়ার অপেক্ষায় থেকে থেকে ব্যর্থ হয়ে
আমি ক্রমশ জাদুকর হয়ে উঠছি!
না-ভেবে ছুড়েছি জাল, চাঁদ ফেঁসে গ্যাছে।
জালে ম্যালা জ্যোৎস্না-চাঁদা, নক্ষত্র-মৌরলা
ছাড়াতে পারছি না আমি। টানাটানি হলে
ঘাই ছিঁড়ে যাবে।
থাকো তবে জাল থাকো, এভাবে আকাশে গোল হয়ে।
আমার অনেক হয়ে আছেঃ
নারী ও পুকুর-ঘাট, জলসেঁচি, কুটুম্ব-পাখিরা...
খালুই আতিথ্য নিতে আর পারছে না
তার এখন দশা টুবুটুবু।
আমারও এ-গালে জ্যোৎস্না, ও-গালে গভীর অমারাত।
অন্তিম জালের দড়ি শূন্য থেকে নামছে মুঠোয়...
সংযোগ-বিয়োগ-হারা, বাঞ্ছাহারা দড়ি।
না-ভেবে ছুড়েছি জাল, চাঁদ ফেঁসে গ্যাছে।
ঘা দিয়েছো কর্তালে কর্তালে
নেচে উঠছে কবেকার অস্পষ্ট কীর্তন
না গেয়ে কি পারি?
আবাহনে লাগিছে মাথুর?
সমে এসে মিলিছে না সুর? না মিলুক
আমার কদমখন্ডি তোমার শ্রীপুর...
অজয় বহিয়া যাক মাঝখান দিয়ে
সাধি নি, সাধি নি আমি, কিচ্ছুটি সাধি নি
রয়ে গেছি তোমার আনাড়ি
ঘা দিয়েছো কর্তালে কর্তালে
নেচে উঠছে কবেকার অস্পষ্ট কীর্তন
না গেয়ে কি পারি?
ব্যথার মতো জল ছলাচ্ছে, জোয়ার যাচ্ছে ফিরে
ভালোবাসার হালুম জাগছে বারোটা রাত্তিরে
জেগে ঘুমাও মউলি মেয়ে, শয্যা সোঁদরবন
কাদায় গোপন শূল রয়েছে, সামলে পদার্পণ
করো কন্যা, মন অনন্যা রাখো বাঘের দিকে
মউপোকারা গুনগুনাচ্ছে, জোস্নাটি ফিকফিকে
মুখ ঘুরিয়ে পিছনে চাও, সামনে মুখোশ বাঁধো
‘ভাল্লাগেনা বাঘ তোমাকে’ নখড়া করে কাঁদো
ধোঁয়ার মশাল জ্বালো কন্যে, মশালে দাও ফুঁ
চক্ষু টাটাক মউপোকাদের, কাল বাদে পরশু
বাঘ তোমাকে নিয়ে যাবে, ভালোবাসার বাঘ
গরগরাচ্ছে সোঁদরবনে, তোমার দিকে তাক
ভান করে সে চুপ ঘুমন্ত কেওড়াঝোপের আড়ে
তোমায় ধরে না নিয়ে বাঘ ফিরবে না সংসারে
চাঁদ ঘুমোতে অস্তে যাচ্ছে হাইতুলে খুব ধীরে
ভালোবাসার হালুম জাগছে বারোটা রাত্তিরে
দূরবর্তী বুলবুলি তুমি
নিমগাছটিকে নিয়ে কাছে চলে এসো।
তোমাদের একটুখানি রঙ্ মেখে দেবো।
দিনান্তে ছলকাচ্ছে খুব ব্যর্থতার রঙিন নির্যাস
যাকে পাবো তাকেই লাগাবো।
মানুষ পাচ্ছি না, তার টায়ার দরকার,
পেট্রল দরকার তার, ডিজিটাল পিস্টন দরকার...
আর কিনা দোলমঞ্চ হয়ে আছি আমি?
নেমে যাচ্ছে মেরুন সিগনাল।
আকাশ ফেস্টুন করে শালের মিছিল শুরু হোক,
খোঁপায় ফুলের ঝান্ডা, গোধূলি স্লোগান দাও
চিহড়লতারা!
ও দোয়েল, রঙ্... শুধু রঙ্...
সত্যি বলছি, বুকে কোনো জলকামান নেই।
বিষাদগুচ্ছটি
হিসাব মিলিয়ে দ্যাখো, বিষয় নিইনি।
তুমি দিয়েছিলে বলে
বিষাদগুচ্ছটি
বুকে লয়ে শুয়ে আছি আমি।
আশেপাশে রজনিগন্ধার ভীড় ধূপকাঠি লয়ে
জমিয়েছে রীতিমতো শোকের আবহ।
এরা সঙ্গে ততদূরই যাবে
যতদূর শোকার্তরা যায়, যেতে পারে —
চুল্লির বাহির অব্দি, ভেতরে যাবে না।
কেবল তোমার দেয়া বিষাদগুচ্ছটি
বুকে করে চুল্লির ভিতরে
প্রবেশিব আমি।
ভালবাসা কিছু দিলে, সঙ্গে নিয়ে পুড়ে যেতে হয়।
আলখাল্লা মেজাজে বানিয়ে
কী করে যে আমি তার বাইরে রয়ে গেছি!
আলনাতে ফকিরি অবাক।
নিজেরই পোর্ট্রেট আঁকতে স্কেচকে ডিঙিয়ে
চলে যাচ্ছি নক্ষত্রপাড়ায়।
ইজেল থাকলো খাড়া তেরো বাই দুই কোন ভুল সরণিতে।
ঠিকমতো গীটারে বাজছি না
বেতালা থাপকি হচ্ছি হই-রই গানের গাজনে—
বিটোফেন ভিতরে কাতর।
ভালবাসা ভেবে ভুল শরীরের দিকে
পৌঁছে আমি হল্লা তুলে সোনাগাছি তোলপাড় করিঃ
আছো নাকি রামী!
আছো নাকি রামী... রামী... রামী প্রতিধ্বনি...
কাঁপে ধোবিঘাট।
ডায়েরিতে ষোলো পাতা শাদা পদাবলি।
ভোলাদা জিলিপি ভাজছে, এসে বসে পড়ো
হাটখোলা শ্রীক্ষেত্র হোটেল—
ফ্রি-ভোজন, ফাটিয়ে ঢেকুর তোলো, ব্বাস্।
ইচ্ছে আছে ঢেকুর ফাটাবো...
সবকিছু জীবনকড়ার
আদিগন্ত বেহিসাব পৃষ্ঠার বিস্তার –
খাতকের নাম নেই, টিপছাপ কোনোখানে নেই।
যা দরকার লোটো।
খুব লুটছি জলদাপাড়া অযোধ্যাপাহাড়...
লুটের কেঁদুলি-ধুলো...মেখে ফেলছি গোটা জয়দেব –
বাউল গানের সঙ্গে কতো নেবো গাবগুবির মাতন...
কোঁচড়ে জায়গা নেই আর।
চতুষ্কোণ দিয়ে ঘেরা জানালায় সন্ধ্যার আকাশ –
চেষ্টা করছি, কামরাতে ঢোকাতে পারছি না।
সাইড ব্যাগে চাঁদতারা ঢোকাতে পারছি না
সাইড ব্যাগ বেফালতু কিনেছি।
গাছ নদী শেওলা শালুক বেনেবউ,
কবিতা করব আমি, একটুখানি শব্দরূপ ধরো।
ভোলাদা, জিলিপি ভাজছো... শ্রীক্ষেত্র হোটেল, তুমি খোলা...
একটি প্রণাম লিখবো, অনুমতি করো।
জলের রংটি সবুজ এবং কালচে
(যেন) বিছিয়ে রয়েছে মনোরম এক গালচে
ভাসমান দুটি পরিযায়ী হাঁস আঁকা
তারপরে আর কিছু নেই... শুধু ফাঁকা।
ওইদিকে গেলে আকাশ ছুঁয়েছে সন্ধে
সারস ডাকছে মাছেদের ভাইবোনদের।
রোজ দুই বেলা পার হয়ে যাই খাঁড়ি
জলের প্রকৃত পাশে আমাদের বাড়ি।
আমরা দুজনে ভুবনডাঙায় বন্দি
বয়স বাড়ছে, অবসরে আঁটি ফন্দি
কোথায় পালাব... জল উঠে আসে পাড়ে
যাবৎ-শরীর ছুঁয়ে যায় নিঃসাড়ে।
যুদ্ধ অথবা শান্তিজনিত অশালীন পরিহাসে
বুদ্ধ কখনও ক্রুদ্ধ হন না, গোপনে মুচকি হাসেন।
করুণায় তাঁর আঁখিপল্লব নত, শরতের মত
করতলে নীল পদ্ম, ছদ্ম প্রেমেতে মর্মাহত।
ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ, আলোর প্লাবনে দ্রব নভ-নীলিমাতে
ওড়াউড়ি করে, বনতল জাগে স্নেহ-কর-সম্পাতে।
ওড়াউড়ি করে মেঘেদের নিচে নির্বিকল্প ড্রোন
আমার ব্য-থা-আ-র পূজা হয়নি-ই সমাপন...
ধ্বংস তোমাকে আহত করে না, উদাসীন সন্ন্যাসী?
বুঝি না, অধরে খেলা করে মৃদু রহস্যময় হাসি।
১
বন্ধুরা রয়েছে বলে পৃথিবী এখনও
বাসযোগ্য লাগে। ‘বাসযোগ্য’ শব্দটাকে
কেটে দিয়ে ‘শ্বাসযোগ্য’ লিখি।
চরম ফিনিকি – বন্ধুরা গালি দেয় – শালা বাল্মীকি!
বন্ধুরা রয়েছে বলে রোগতাপ ফিরে চলে যায়।
২
পোস্ট-কোভিড শব্দেরা ওঁত পেতে আছে
বারান্দায়, একেকটি পাকা শয়তান
ছুতো খুঁজছে ভিতরে আসার...
কার আঙুল খেলা করছে হারমোনিয়ামে
ক্রমশই বিলম্বিত হচ্ছে লয় তান।
৩
ক্যাচমেন্ট এরিয়ায় বৃষ্টিপাত হলে
যে নদী ভাসিয়ে দিত ইতিপূর্বে রাস্তাঘাট
রোয়াক, দালান, সে এখন সমতলে নেমে
কাকচক্ষু হ্রদ হয়ে গেছে। ইচ্ছে করে সোফাসেটে
পাশাপাশি বসে, তার সাথে পাখিদের ওড়াউড়ি দেখি।
যে নগরে টগর ফোটে না, দুটি সামুদ্রিক হাঁস
বলে গেল চুপিচুপি, “কোনও কথা বোলো না বেফাঁস।
দেওয়ালেরও কান আছে, যদিও সে চোখে বেঁধে ঠুলি
সামাজিক প্রয়োজনে করে যায় আকুলি বিকুলি।”
“এদেশে ফলন হয়,”ধরো যদি কেউ মিছিমিছি
বলে ফেলে, “বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীচি,
কম করে।” দেওয়াল কখনও তাকে করে নাকো ক্ষমা
যতই বলো না, “প্রভু, করেছেন ভুল তর্জমা,
তেরো যে অপয়া কত, সে বিচার কখনও করিনি
এমনকি কাঁকুড়ের কাছে আমি মনে মনে ঋণী।
তারপরও প্রভুপাদ, পড়ে থাকে এক হাত ফাঁকি
সেটুকু গুটিয়ে নিলে শেষ হয় করুণ মাজাকি...”
যতই সাধো না তুমি, মুখে ফেনা, দেওয়াল দোলে না
অজর অচল থাকে, অনুযোগ কানেও তোলে না।
১
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সব মানুষেরই রহস্যময়তা কমে আসে। যেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পারদ-চটা আয়না। আরপার দেখা যায়।
আয়না ব্যাপারটা এমনিতে বেশ রহস্যময়। একটা দ্বিমাত্রিক কাচের টুকরোর ভিতর ত্রিমাত্রিক পৃথিবী। তবে ওই পারদের আড়ালটা নিতান্ত জরুরি। যতক্ষণ প্রলেপ থাকে, কেউ সামনে এসে দাঁড়ালে ছায়া পড়ে। ভুল করে মনে হয় দ্বিতীয় বাস্তব।
পুরনো অংশত পারদবিহীন আয়নায় ছায়ার অপসৃয়মান শক্ত মুখ ভেঙেচুরে যায়। কখনও ভুতুড়ে লাগে, কখনও দুঃখিত। যে আয়না দেখে সেই আহত হয়, মনে করে ছায়াটার দোষ, পারদর্শী পারদের কথা ভুলে যায়।
বুঝতে চায় না, সচরাচর, বয়স বাড়লে পৃথিবীর সমস্ত আয়নাই রহস্য হারায়।
২
একদিন সেই সুসময় আসবে যখন আর কেউ কবিতা লিখবে না। এমনকি বেকার বাঙালি যুবকেরাও নয়। মানুষ দু-বেলা পেট ভরে ভাত খাবে, প্রেমে ব্যর্থ হবে না। দিনে রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য প্রাণপাত করবে, রাতে সোহাগ সংসার।
প্রতিটি প্রযুক্তি সফল হবে। এবং সঙ্গম। দুঃস্বপ্ন দেখে কেউ ধড়মড়িয়ে উঠে বসবে না বিছানায়। অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে পারবে প্রিয় মানুষের শরীর।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামানোর সময় নিজেকে আর তেমন কদাকার মনে হবে না। (কারণ পুরনো আয়না সব ক্ষত ঢেকে দেয়।) ক্বতবেলের গাছ ফলবতী হবে। গৃহপালিত পশুরা নির্দ্বিধায় বংশবিস্তার করবে।
প্রতিবার দরজা খুললে অনিশ্চিত সংক্রমণের আশঙ্কা থাকবে না। মানুষ পিকনিক করতে যাবে দূষণহীন নদীর কিনারে। মেয়েরা উঁচু করে খোঁপা বাঁধবে আর ছেলেরা বিশুদ্ধ খেউড়।
বিশ্বাস করুন স্যর, সেদিন আর কেউ কবিতা লিখবে না। রাষ্ট্রও নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে শোবে।
১
একদিন একজন নাবিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম - তুমি কোনওদিন মারমেড দেখেছ? সে বলেছিল - মারমেডদের বাড়ি সমুদ্রের অনেক গভীরে। ডুবসাঁতার না জানলে সেখানে যাওয়া যায় না। যেতে যেতে যেতে যেতে সময় ফুরিয়ে যায়। দম শেষ হয়ে আসে। তাও গিয়েছিলাম দেখা করতে। দরজা খুলে তার মা বলল - সে বাড়ি নেই গো, সে বাড়ি নেই...
২
ঝুলবারান্দার রেলিং এ হাত রেখে যারা ঝুঁকে পড়ে রাস্তা পড়ত, তারা আজ কেউ নেই। এমনকি বারান্দার নিচে সাইকেল থামিয়ে যে ছেলেটা ভরদুপুরে সেরেনেড শোনাত সে এই মফসসল শহর ছেড়ে চলে গেছে কবেই। ঝুলবারান্দাওলা বাড়িগুলোই আজকাল আর চোখে পড়ে না। কত কী বদলে গেছে শহরটার। হাসপাতাল মাঠে আর সার্কাসের তাঁবু পড়ে না। ক্লাউনরাও বেমালুম বেপাত্তা। সম্ভবত তারা সবাই গোষ্ঠীপিতা হয়ে গেছে। তাদেরও সেভাবে কেউ মিস করে না।
রাষ্ট্রনেতারা ঘুমিয়ে পড়লে পৃথিবীতে পরি নামে। পাড়াবেড়ুনি পরিরা খোঁজ নেয় ভরা জ্যোৎস্নায় কাহার ওষ্ঠ্যের’পরে মুকুতা ফুটেছে। যদিও সে নিতান্তই ত্বকের নিঃশ্বাস-বাষ্প, দু-এক বিন্দু ঘাম, এক পরি অন্য পরির কাঁকালে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে বলে, “মা গো! মাগির ঢং দেখে মরে যাই। রাধারানি নজ্জা পেয়েছেন। দেখ, দেখ কচু পাতায় জলের মতন কেমন শিউরে শিউরে উঠছে।” অন্য পরিরা ফিক ফিক করে হাসে। বলে, “চল, ওই গানটা করি, আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি...”
সে বড়ো সুখের সময়। মানুষের মেয়েটি চোখ নামিয়ে নেয় আর পরিরা তাকে ঘিরে ঘিরে নাচে। গুনগুন গান গায়, পরিদের গানে কথা নেই, শুধু ধুন। মেয়েটির শরীরে আগুন। পরিদের ডানার বাতাস লেগে ফুলকি ওড়ে, বাতাবি লেবুর কুঁড়ি ফুটে ওঠে। কোনও হতভাগ্য পুরুষ সেই দৃশ্যে উপস্থিত থাকলে তার স্মৃতিভ্রংশ হয়। বেচারা আসন্ন নির্বাচনের কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় ভাইরাস। মৃত্যুভয়। অনাদি আকাশ থেকে টুকরো-টুকরো হিম ঝরে পড়ে। শীত করে। তার খুব শীত করে।
ছোটবেলা কাটতেই—ঘরের দেওয়ালে দেবদেবির ছবিতে চোখ টানতো। ভালো লাগতো। — কপি করতাম। একটি ছবি—
তো কী ধাক্কা তাতে!— ওঁ—এর রাধাকৃষ্ণ—যুগলমূর্তি।
অনেক পরে রবীন্দ্রনাথের গানেও তাকে পেয়ে গেলাম—
‘মূর্তি তোমার যুগল সম্মিলনে সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে।’ কি এক বিস্ময়! গানের সঙ্গে ছবি মিলে কি প্রকাশআনন্দ বল!
শাকসব্জি, ধান, ঘাস—
এর সবুজ রঙ—
কি সত্যির দেখা — তাই না? আমায় খুব টানতো।
এই রঙের সঙ্গে লালমাটি, মশলা হিসেবে হলুদ ব্যবহার করে — ছবিতে লাগাতাম।
একদিন বৃষ্টির পর মোরাম ধুয়ে বেরিয়ে পড়ল ভেতর—
ওমা! তার যে নীল রঙ ! খাবলা মেরে তুলে তা দিয়ে পুতুল তৈরি করায় সে দিনটা আমার হয়ে গেল।
নন্দলাল বাবুর সাহস নিয়ে একদিন বাইরের মূর্তি গড়ে ফেললাম। তারপর কি দুরু দুরু ভয় — রবি ঠাকুর (গুরুদেব) ডেকে পাঠালেন। ‘সমস্ত আশ্রম বড় মুর্তি গড়ে ভরে দে…’ — ছুট্টে বেরিয়ে এলাম। এ কি বিস্ময়ের আনন্দ!
অনেক নিরিবিলি সময়ে — ছবিগুলি আমাকে বলছে খুশিতেই তো — কিঙ্কর, তোমাকে কিন্তু আমরাও চিনি…
#
সে শোনায় অন্যমনস্ক কিঙ্কর। সামনের কাগজে রঙে আঁচড় কাটছেন।
তখন তো একটা সূর্যমুখী।
কত কম বয়সে একদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা।
সকালের দিকে বসে আছেন ইজি চেয়ারে। ঈষৎ ন্যুব্জ।
আরেক দিন — মনে পড়ে। সেদিন উত্তরায়ণের জানালায়
তার শোকাহত মুখ —
টেবিলেই ঝুঁকে বসে। আঃ এন্ড্রুজ স্যার মারা গেছেন…।
পড়ন্ত আলোয় গুরুদেবের শোকাহত মুখ —
মাথার ভিতর কেমন তালগোল পাকিয়ে দিল।
ঘরে ফিরে অনভ্যাসের তাড়ায় এক এক স্কেচ করলাম —
পরে তা ব্রোঞ্জের মূর্তিও হোল। কবেকার রামকিঙ্করকে শোনা।
কলাভবনের দোতলায় রামকিঙ্করের সে-রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হোল গত পৌষমেলার কিছু আগে—
ফেরার পথে উত্তরায়ণের জানালায় কি খোঁজার ছলে—
দুচোখই বাড়িয়েছিলাম।
সেদিন সে আবার রতনপল্লিতে। জীর্ণ মলিন চেহারার বাড়িটুকু —
একটি ভগ্নস্তূপ যেন। কংক্রিটের তৈরি একটা উড্ডীন পাখি – এখানেও। লাল মাটির দেয়াল একা দাঁড়িয়ে—তাতে শ্যাওলাও।
এখানে রামকিঙ্কর এখন নেই — দূরে কুড়ি নম্বর কোয়াটার্সে।
কিছু দূরে এগোতেই ‘সাঁওতাল পরিবার’, ‘ধান ঝাড়া মূর্তি’ সন্ধ্যার শীত গায়ে মেখেই— দাঁড়িয়ে।
কাছে অন্ধকার ক্রমশ।
কিছু ভীত বিহ্বলতাও।
কুড়ি নম্বরেই— এন্ড্রুজ পল্লিতে দেখা মিললো রামকিঙ্করের।
দেখি— তক্তপোষে বসে। মলিন গরম পোষাকে গা ঢাকা।
সরানো লেপের কাছে বিড়ির বাণ্ডিল, জবা ফুল,….অসমাপ্ত বোতল। কুপি জ্বলছে।
ঘরে কোনো ছবি নেই।
এখন চোখে দেখতে পাই না কিছুই। কেউ পড়ে দিলে শুনি,
কেউ ধরলে — হাঁটি।…পঙ্গু হয়ে গেছি।
মাথার ভিতর কত কিছু ক্রশ-পাজল খেলে।...
কিন্তু কিছু করার নেই। থেমে থেমে বলা — শুনছি কিঙ্করকে।
শূন্য দেয়াল — ছবি টাঙানো নেই তো।
নিজের শিল্পকর্ম চোখের সামনে না থাকলে নতুন ভাবনা কি ফিরে যায়?
জানা হয় কই !
রামকিঙ্করকে আর একবার পড়ে এলাম। আর একবার।
কত আগের শোনা গল্পটা পুরনো ভিড় ঠেলে আবার যে সামনেই। সেবার নাট্যঘর মঞ্চের দুধারেই মূর্তি গড়ার পরিকল্পনা —
দায়িত্বে সেই মানুষটি — কিঙ্কর।
তাতে বাম দিকের মূর্তি গড়া একরকম শেষ হতেই — ডান দিকের লালন ফকিরের কাজ শুরু। ন্যাশনাল স্কলারশিপ নিয়ে এই কাজের সাথে পৌঁছে গেলেন এক ছাত্রও। কাজের আগে মূর্তির নানা স্কেল স্থির করে রাখা তার স্বভাব তো। কিন্তু টাইফয়েডে আক্রান্ত কিঙ্কর এত সময়ে হাসপাতালে ভর্তি যে …
হাসপাতালে প্রতিদিন তাকে দেখতে গিয়ে সে আরেক দেখার সুন্দর সেখানে। বিছানা ছেড়ে রোগী নাচছেন—
পরে নাচের ভঙ্গিটি ততক্ষণে স্কেচ করেও রাখছেন।
সেই স্কেচ সাজিয়ে লালন ফকির — মূর্তি হয়ে গেল।
অনেক বছর পর রামকিঙ্করের এ-গল্পটুকু জানিয়েছিলেন তাঁর এক ছাত্র। শান্তিনিকেতনের খোলা আকাশের নীচে নিঃসঙ্গ দরাজ রামকিঙ্করকে পিয়ার্সন পল্লির খোয়াইয়ের কাছে —
ঈশ্বরের পাশে ঘুরতে দেখেছিলেন কতজন।
তাঁকে ‘আমার রামকিঙ্কর’ বলতে কতবার যে ইচ্ছে জেগেছে প্রাণে …
বিনোদবিহারী বলছেন – রামকিঙ্কর …
শান্তিনিকেতনেই একদিন বিনোদবিহারীর কাছ থেকে শোনা কথা —
শিল্পী প্রভাস সেন, তাঁকে রামকিঙ্করের একটি গদ্য পড়ে শুনিয়েছিলেন।
বলেছিলেন — ‘এরকম লেখা রঁদার সঙ্গে তুলনা করা যায়।
‘আমি কি বলেছিলাম জানো — ( বিনোদবিহারী বলছেন ): এ লেখাটি পেলে রামকিঙ্করবাবুর আর জীবনচরিত লেখার দরকার হবে না’। কিঙ্করের লেখায় এক জায়গায় —
: জীবনের উদ্যানে যেটি দেখি। চোখের সামনে দিনের আলোয় তা ছবিতে আঁকি। আর যা টাচ করি অন্ধকারে, তা স্কাল্পচার করি।
নিজেকে এমন করে নিজে চেনা — কি অপরূপ সত্য। আর কোন্ রামকিঙ্করকে দেখব তখন নির্মাণের বিমূর্ততায় না মূর্ততায় শুধু।
কী এক উৎসবে —খোয়াই-এর কাছাকাছি পথে ভাস্কর্যশিল্পী সোমনাথ হোড়ের সঙ্গে দেখা। চারপাশে সাদা রোদ। আলাপ নেই। কাছে পৌঁছে বলি — আপনার কথা শুনবো একটু। তর সইছিল না।ইচ্ছাটা জানিয়ে ফেললামঃ একটু রামকিঙ্কর বলুন না।
মানুষটির কোথায় যেন নাড়া পড়লো। শুনছি —
: রামকিঙ্কর দেবশিশু ছিলেন। পরিণত বয়সে দেবতা হতে পারেননি। কুটিলতা, পরশ্রীকাতরতা … কোনটিই তাঁর আয়ত্ত্বে আসেনি। এমন নির্মল স্বভাবের মানুষ কোটিকোটিতে একজন আসে।
একটু থেমে চোখে কি গোপন করে মুছলেন।
আর একদিনের চোখে। পি.জি. হাসপাতালের হিমঘরে শিল্পী গণেশ হালুই অবশেষের রামকিঙ্করের দিকে চেয়ে। ভেতরটা মরমর করে ভাঙছে —নিজের ভেতরটা । অনুভব গড়িয়ে পড়ে —
: লোকটা মারা গেল। ভরা হাঁড়িটা কাত হয়ে গেছে। ভেজা মাটির রঙ আরও গাঢ় হয়েছে। এই গ্রন্থিতেই তাঁর শক্তি।
একজন নিঃস্ব মানুষ। মাতাল সমীরণের নীচে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আছড়ে ভাঙব ওই কালো মেহগনির টেবিল-ওপরে
থিতু গ্লোবটিকে।
গ্লোবাটি পুরনো নয় খুব বেশি,
যখন কিনে আনা হয়েছিল সেটিকে
তার চারকোনা মসৃণ বাক্সে ছিল খয়েরি রক্তের দাগ,
আমার স্মৃতিতে খয়েরি রক্তের দাগ রয়ে যায়
রয়ে যায় তার স্থিতিজাড্যতা।
এ যেন বরাহমিহিরের কাল থেকে একভাবে আছে বলে মনে হয়।
অসহ্য অসহ্য এই অপার্থিব প্রেম!
মেহগনির টেবিল-ওপরে সাদা গোলাপদানিটিও থাকতে পারে না
বাস্তবিক পিঙ্ক কালারটি দেখলেই
আমার অশ্লীল ইচ্ছাগুলি জেগে ওঠে
আর বাসি লাল গোলাপ আমি কখনো কিনি না।
একটি শান্ত আগুনও
জ্বলেছিল ঝড়ের আকাশে
দীপিত মুখগুলি বহু…বহু দূরে
আকাশের খোলা বারান্দা থেকে
স্থির তাকিয়েছিল আমাদের দিকে।
আমরাই শুধু বুঝতে পারিনি
কেন খিদে ক্ষোভ নিদ্রায়
অথবা রিরংসায়
ভুলে গেছি বারবার
সে শান্ত আগুনের অনুচ্চ কথকতা।
কথার ভিতরে তাপ নিয়ে
নিভে গেল একদিন সে শান্ত আগুন
অন্তর্হিত হয়ে গেল দীপিত মুখগুলি।
এখনও আমরা ফের একবার
সে আগুন, সে মুখগুলির
সাক্ষাৎ-প্রত্যাশায় দিন গুজরান করি।
হায়রে আমার বেবাক মিথ্যে দিন।
অবিমৃশ্যকারীদের হাতে একখণ্ড শুয়োরের মাংস ধরিয়ে দিলাম
উত্তম রূপে প্রস্তুত,
সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল সে।
মুবারক হো কাকা!
এ কী হর্ষ! এ কী নদগুলির বহুতর ক্রন্দন!
যে কোনো প্রকৃত প্রফুল্লতার অভ্যন্তরে আলোর ঝালর থাকে
থাকে শিশিরের ওপরের রোদ্দূর।
তবু আমি কিছুতে হারাতে পারি না এই জ্ঞান
যে আমি বিশ্বনিন্দুক হতে পারিনি এখনো
যা আমি হতে চেয়েছিলাম যৌবনশীর্ষ হতে।
কলাবিদ্যার মারপ্যাঁচ আমাকে প্রতিবার ধরাশায়ী করে ফেলে
প্রতিবার আমি হারাই সত্যকে
যখনই রক্তমাংসের অভ্যন্তরে ধাতব সুদূর টিংটাং বেজে ওঠে
পুরনো রুপিয়া সিকি ও আধুলি
পঞ্চম জর্জের মুখ।
টাঁকশালগুলিতে আগুন জ্বালাতে হবে জানি
কিন্তু আমি এখনো প্রকৃত সমুদ্র দেখিনি।
দুরন্ত পিপাসামাখা এই হাত ছুঁয়েছিল জল
দ্যাখো, এই শিরাজালে সেই আলো প্রবাহিত আজও
চোখের কোটর বেয়ে চলে যায় রুপালি ঝিনুক
যেইখানে ক্ষেত ছিল রয়েছে অতলস্পর্শী খাদ
কোটিবর্ষ পার করে সর্বনাশের মত উঠে আসে জল
জলস্রোত কালস্রোতে টেনে নেয় অগ্নি ও বিদ্যুৎ
আঙ্গুলে পিপাসামুদ্রা এই হাত ছুঁয়েছিল মুখ?
কতোটুকু ধরে বলো দু’হাতের অঞ্জলিতে
আর? তোমাকে তৃণাগ্রে ডাকি
যে ঘাস পবিত্র
যেই মুঞ্জতৃণ গোপন আসন পেতে
একান্ত আশ্রয় হবে নদীকূলে
তার কথা বলো
আজ সকালের রোদে
তোমার শব্দের তুলি রামকেলি এঁকে দিলে
স্রোতস্বিনী পুলকে আকুল
বহে যেতে মরুভূমি পথ তার? নির্জল প্রান্তর?
তাও থাক, তবু আজ ভোর
এক প্লাটফর্ম থেকে অন্য প্লাটফর্মে
একযাত্রা থেকে অন্য যাত্রার মাঝখানে
জনারণ্যে মুহূর্তে নির্জন
আকাশী চিলের ডাকে হঠাৎ শূন্য বেয়ে নামে
আর আমার চরাচর ভরে
ভেসে উঠল তোমার মুখ
চুলে ঝাঁঝি, মরচে ধরা কপাল
তুমি শুয়ে আছ ডুবে যাওয়ার নিচে।
শহরে যখন খুব কোলাহল ওঠে
স্বজনেরা ছেড়ে যায় সারি বেঁধে দুপুর রোদ্দুরে
কান ফাটানো হুইসলের শব্দে তুমি কাঁদো
সমস্ত শেকলের শব্দ ছাপিয়ে
চিলের ডাকে, ভারী ইঞ্জিনের হৃৎপিন্ডের মর্মরে
তোমার সেই গুমরে ওঠা
আজ আমার বুকের শিরায় টান দিল
গরম পাথর থেকে ভাপ ওঠে
গহন কাজলে আঁকা তিনটি চোখ
বিপুল আঁধার থেকে উঠে আসে আসে ছিন্নমস্তা
স্বশোণিত পিপাসিতা উগ্রকালী নেতিস্বরূপিণী
তখনও এখানে ছিলে? কথিত সে শান্তিকালে?
তখনও খণ্ড খণ্ড দীর্ণচিহ্নে
তীব্র পদছাপ? নিজের কন্ঠছেঁড়া রক্তিম ফিনিক
নিজের কপালপাত্রে ধরা।
তবুও পিপাসা জ্বলে শুকনো জলে
পাথরে আগুন
আঙুলের নষ্টসৃষ্টি তোর
সিঁদূরে কাজলে ভাসা
তিনজোড়া আত্মঘাতী চোখ
মধ্যরাত্রে সুহৃদময় বিছানা ছেড়ে নেমে দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে আমার পৃথিবী। এসে দাঁড়াচ্ছে খুব আকাশের ঘর-ছাড়ানো সর্বনাশের নিচে যেখানে ঝরাপাতা আর টুপিয়ে পড়া জলের শব্দ মিলেমিশে এক রাস্তা হারানোর দিকে খুব চলে যেতে থাকে। এখন সে কোথায় যেতে চায় যখন কোনো মানুষই স্পষ্ট করে দেখতে পাবে না নিজের মুখ? ঝিঁঝির ডাকে চাপা পড়ে যাবে শিরার ভিতর নিজের রক্তধারার ফিসফিস? রাত্রি মাথায় নিয়ে যখন সন্ধ্যা এসেছিল তখন থেকেই ওর মজ্জায় কুয়াশার বিষ। অন্ধকারের কৃষ্ণাজিনে তা গাঢ় হল প্রগাঢ়তম। এখনো তো কোনো পথ দেখা দিল না, আঁচল মেলে, আমাকে এখানেই ফেলে রেখে ধুলো পায়ে ও যাচ্ছে কোথায়? কার ডাকের দিকে?
তানের তরঙ্গ লেগে পৃথিবী উথলে ওঠে
বিদ্যুতে ছড় টানে মিয়া কি মলহার
ব্যথার চমক লেগে থমকে থাকে হাওয়া
পাথরও পুলকে গলে
অশ্রুধারা হয়ে তার গান বাজে জলদে ঝালায়
ভরাজল ভরাজল এস’
এই মুখে বুকে বৃষ্টি হয়ে ঝরো
আমাকে ডোবাও বারবার মগ্ন করো
নিমজ্জিত করে নাও। গভীর গম্ভীর ধারা আমাকে ভাসাও স্রোতপথে
ভরে যাক প্রতীক্ষার মাঠঘাট উচুনিচু টিলা ডুংরি
শুকনো মাঠে আসুক আসুক তৃণদল
ভরাজল এস’
জ্বলে যাওয়া অরণ্যে আবার
জাগুক অক্ষরগুল্ম। শুষ্ক তারা মাঠে
ফুল হয়ে ফুটে থাক পাখিদের গান
সবকিছু লেখা আছে চোখে
লজ্জা ঘেন্না ভয়, অনন্ত প্রস্তাবে আকুলতা
যত কিছু বিবরণ মনসিজ ভ্রমণের সাথে,
ক্রৌঞ্চ মিথুনের শোকে প্রথম শ্লোকের ব্যাপকতা
সবকিছু লেখা থাকে
তুমি যা বলেছো কথা
যে সুরে দেখেছো ছবি, এঁকেছিলে গান
সেই রেখা প্রাণ হয়ে আকাশে ছড়ালো
আকাশের কোণে জমা বাষ্প অনুপম
খবর রাখেনি ব্যথা কার বুকে বাজে
কার শিরা-ছেঁড়া রঙে আগুনের সাজে—
তুমি তা জানোনি
যে আছে দাঁড়িয়ে পথে
সমতলে পাহাড়ে বা নদীর কিনারে
রোদ হাসে আঁধারের অপেক্ষায় আজও
যাবার সময় হলো ফেলে রেখে জীবনের ওম
যেই তাপ মিশে আছে প্রতি ফুলে রঙে
নষ্ট সময় কিছু আঁধারের পরিতাপ মাপে
তোমার চোখের কোনে কাজলের টানে—
জেনেছো কি
কত কিছু শেখা হলো কত অঙ্ক সুষ্ঠু মিলে যায়
সে পেলব খাতা আছে কোন ঘন অন্ধকার তাকে
হাতের কলম কালি মাথা খোঁড়ে অন্ধ জিজ্ঞাসায়
শুধুই হারালে সব কুলুঙ্গির গোপন ভাঙনে
অপাপবিদ্ধ পল, ফুল আঁকা রুমালের গিঁট
মুহূর্তের মহারাজা হারুন অল রশিদের ধাঁচে
মহান বৃক্ষ তলে সেই সব ছবি জমা আছে—
জানিলে না
এখন শীতের কুয়াশায় জলঙ্গীর মরা টান জাগে
কত শত মহাপথ চোরাটানে দিকহারা
রাখালের চোখে ঘর খোঁজে
ধুলো না মাখালে আলো গোধূলি হবে না
যতই রঙের তুলি বিকেল সাজাক
নত দিন সে কথাটি জানে, আর জানে
শেষ হলে আলো একমুঠো কুয়াশার খাঁজে
তার চিহ্ন কেউ খুঁজবে না
শুধু অভ্রময় সময়ের চোখ নিষ্পলক জাগে
আর মাটি জুড়ে পিঁপড়ের সারি হাতে হাত
ধ্বংসের বিরুদ্ধে দূর্গ গড়ে।
কূলে আছড়ালো ঢেউ—
ময়দান ছুঁয়ে ফুটপাত ছেড়ে
রাজধানী ঘিরে সিঙ্ঘু বর্ডারে
আকাশে দুহাত দাঁড়িয়েছে বুঝি
সমুদ্র বুকে কেউ—
চোখ ঠেরে আছি ফলসা বিকালে
চুপ-জোৎস্নার মাধুকরী আঁকা
পকেটে হিসাব কখনো মেলেনি
সীমান্ত সীমাতেও—
কে আছে অদূরে সুদূরে ডেকেছে
কোন্ হাতছানি কতটা আদরে
আ-ভূবন ভয় নীল রং কিনা
বিতর্ক সভাতেও—
পলক পড়ে না সময়ের চোখে
হাঁটছে আগুন তার পাশে পাশে
মুখে যাই বলো ভিতরে জেনেছি
শৃঙ্খল পোড়াতেও—
কূলে আছড়ালো ঢেউ
ময়দান ছুঁয়ে ফুটপাত ছেড়ে
রাজধানী ঘিরে সিঙ্ঘু বর্ডারে
আকাশে দুহাত দাঁড়িয়েছে বুঝি
সমুদ্র বুকে কেউ—
আমার সামনে এসে কথা বলে সহজ সুন্দর
নিঝুম গাছের নীচে কমলা বালিকা সহজ সুন্দর
একটি সবুজ পাতা ঘুরে ঘুরে ভেসে যায় মেঘের ডানায়
নক্রেক চূড়া ঘিরে ঝিঁঝিঁ তোলে ঘন্টাধ্বনি স্নেহ মন্দিরায়
বাঁকানো রাস্তায় আঁকা আঁধার কণিকা মুখ ঢাকে তন্দ্রার আঁচলে
কৃশকানু বাঁশ পাতা তির তির মেঘ মাখে সকালে বিকালে
পাহাড়ে সবুজ ঢেউয়ে ভেজা যুবতীর টানে অন্ত্যমিল স্থাণু
জুমক্ষেতে ধোঁয়া ওঠে, কমলা সোনালী হয় গারো মেয়েটির খুশী ছুঁলে
সর্পিল সহজ পথ বেয়ে নেমে আসে মেঘ ও যুবতী
দুজনেরই কাঁধে বোঝা পিঠে বোঝা ফসলের ভার
মুক্তো-জলে সেজে থাকা মাকড়সার জাল, ছিঁড়ে গেল ফসলের টানে
বাতাস আবিষ্ট ক’রে হাঁড়িতে ‘মিনেল’ ফোটে, স্বপ্ন পারাবার
মেঘের আড়ালে থাকে মেঘের উপরে ভাসে নক্রেক চূড়া
অজস্র কন্দরে তার তালি দিয়ে ছুটে যায় সিমসাঙ নদী
অনিবৃত্ত ছন্দ তার, গারো প্রাণ সেই সুরে বাঁধা
বৃথা সূর্যাস্তের দাবী— এইখানে ঠাঁই হোত যদি।
যে কোনো আকুল মুহূর্তে তুমি
আকাশে চাইতে পারো
আকাশ তোমাকে দেখছে না-
তোমার মুগ্ধ দৃষ্টি দোদুল ফুলের দিকে
ফুলের বয়েই গেছে তোমাকে দেখতে
তাই প্রশ্ন অবুঝ রাখো পাথরের কাছে
কেননা নিশ্চিত তার উত্তর পাবে না
তবু প্রশ্ন খোদাই করো পাথরের বুকে
তোমার নিখাদ সত্যিগুলো।
আবার কবে যাব, রাস্তা খোলা পাব
দিগদিগন্ত যে দিকে চোখ যায়
পায়ের তলায় মাটি, গাছের ছায়ায় হাঁটি
বন্ধ ঘরে স্লোগান হেরে যায়
ভয়ের ধাঁধায় বাঁচা, ঝলসানো চোখ বুকে
আর কতকাল বরং, প্রশ্ন-তুণের থেকে
তর্জনী-তীর খুঁজি —লক্ষ্য বাঁকা সোজায়
না-জানা কাল অন্ধকারে আঁকা
আয়রে আমার সোনা, মানিক দেব গুনে
ছেড়ে বাসি কাপড় কাচা, বিষণ্ণ তর্জায়
ভাবছে লক্ষ্মী প্যাঁচা, সন্ধে হবার ঝোঁকে
সত্যি আলো কোথায় খুঁজে পায়
মায়ার ধাঁধা ছিঁড়ে লক্ষ্মী আলোর খোঁজে
নিজের বুকেই ডুব দিয়েছি তাই
রাস্তা এলো ঘরে, বাড়ানো হাত খোঁজে
হোক না শুরু নতুন ভণিতায়
পায়ের তলায় মাটি, গাছের ছায়ায় হাঁটি
বন্ধ ঘরে স্লোগান হেরে যায় ।
নৌকার ছই ধরে দুলুনি সামলে
অবাধ্য উড়ো চুল আলতো সরিয়ে
ঠোঁট কেঁপে উঠেছিল —এই তো
কয়েকটা দিন, অপেক্ষায় থেকো—
হর্ন দিয়ে বাস ছেড়ে দিলে
জানালায় বাড়ানো মুখ ফ্রেমে বাঁধা ছবি
ধুলো ধোঁয়া মাখা সেই আশ্চর্য বিকেলে
আকাশ বাণীর মতো ভেসে এসেছিল
—এই তো কয়েকটা দিন, অপেক্ষায় থেকো—
বিবর্ণ শব্দের মতো অতীত ফুরোয়
ঘাসফুল বর্তমানে সশব্দ সময়
আনত লুটোয় যেই এয়ারপোর্ট গেটে
ঝকঝকে মেঝে আর কাঁচে মোড়া ক্ষণে
পিছু ফেরা দুচোখের হাহাকার ভাসে
পূরবী আঁকতে হলে
আমি তোমাকেই ভেঙেচুরে
গোধূলি-বিলাস করে দেবো;
গোপন সাঁতার দেবো, পাতার কম্পন দেবো
চুম্বন চন্দন দিয়ে
আকাশ ললাটে লিখে দেবো
নিষাদ মাথুর
প্রবাহে লবণ এলে
সমুদ্র উঠে আসে চোখে, তাই
লাবণ্য দেবোনা আর
হাসির বিলাপ দেবো শ্রবণে তোমার;
পথ খুঁড়ে দেবো ক্ষুধা দিয়ে...
ব্যথার
প্রদাহ লেগে
ঋষভ কোমল হয়ে বেজে ওঠে যদি রঙের গভীরে
তবে তো দিনান্ত হবে, বলো!
পূরবী আঁকতে হলে
আমি হেমন্ত বুনে দেবো
তোমার কুসুমে
জানি না কিছুই
জানি না কেন ব্যর্থ ছবির ভিতরে
রয়ে যায় কিছু আলো ও স্পর্শ,
কেন যে উচ্চহাসিতে
মালিকানাহীন
অতীত গেলাস ভেঙে যায়
জানিনা কখন ডালঘেঁষা ফুল
ঠোঁটে তুলে নেয় রোদ ও লবণ
এরপর চলে যেতে হয়
এরপর চলে যেতে হয়
কী চাও বলো -- স্পর্শসুখ?
স্মৃতি এবং সন্ধ্যা?
বরং দিলাম বালকবেলার
শ্রাবণ বারান্দা...
বারান্দাতে গ্রিল ছিল না
বৃষ্টিকথায় ভাসতো,
কথার পিঠে বসতো ছবি
সবুজ, এবং জ্যান্ত
জ্যান্ত ছিল উঠোনপাড়ে
তুলসীমঞ্চ, ছায়া,
অন্নকাঁথা, ভেজা বিকেল,
আগুন এবং ধোঁয়া
এখন ধোঁয়ার বিশীর্ণতায়
আছি, এবং নেই
রংমিলান্তি তাস ফেলেছি
ক্লান্তিনদীতে
নদীর বুকে জলবসন্ত
বালি, এবং জ্বর;
প্লাবন এলে ফিরিয়ে দেবে
পলিমাটির ঘর
ইচ্ছে হয়ে আছি;
সেজেগুজে শাদা হয়ে আছি,
কেউ যদি কিছু লিখে যেতে চায়!
গৃহ লিখে, ছায়া লিখে, নিজেকে নগ্ন করে
জন্মঋণ লিখে যেতে চায় কেউ!
নাহয় দুঃখ লিখুক ধার ঘেঁষে,
চোখের আড়াল করে; অবশেষ কিছু
রোদনকণিকা দিয়ে এঁকে দিক
তার সব দাহ ও শ্রাবণ...
খুব ভালো হয় কেউ যদি
উষ্ণতা লিখে যায়...
শীত তো আসছে হেমন্ত বেয়ে
যে লেখে লিখুক যা খুশি
তুমি শুধু আলো লিখে দিও সন্ধ্যার আগে
কিছু একটা হোক...
পরিমিত হাততালি হোক
শনিবারে ফুলকপি হোক
'ভালো থেকো' বলে রূপশালী পথ
চলে যাক আপনার পরিযায়ী পথে
কথার খেলাপ হোক;
কিছু একটা শুরু হয়ে
অন্যকিছু হয়ে যাক মাঝপথে...
প্রভুর চরণে রাখা প্রণামী থালায়
আজ রাখা থাক মাটি ও লবণ...
অপার সবুজ হয়ে যাক ফসলের মাঠ।
আকাশ অংশত মেঘলা থাকুক;
উষ্ণতা হোক,
আর জমা হোক বিষাদ গেলাসে
বিদ্যুৎ-বিভা কিছু...
সব জল জাহ্নবী হোক, প্রহরা সতর্ক হোক;
তরবারী হেরে যাক সরোদের কাছে...
বালি ভরি আমরণ বস্তায়--
ফেলে দিতে হবে হৃদয়ের
অনিকেত শিকড় সমীপে
জল উঠে এলে
পাড় ভেঙে যাবে রাত্রেই
ঝরে যাবে পরিযায়ী বালি
ফুটোফাটা বুকের উঠোনে--
এই ঘরে সঞ্চয় রাখা ছিল!
প্লাবনের ভয় নেই আর;
ভাঙন দেখেছি রোজ
বীতশোক পাড়ের পাঁজরে
শিরায় লেপেছি মাটি
ক্ষত মুছে দিতে
আজ এই কলরোল যদি
মুছে দেয় অশ্রুদাগ, স্মৃতি,
যাপনের ক্লেশচিহ্ন যত
তবুও মাটির ঋণ,
প্রবাহের প্রতিকূল কিছু
দীর্ঘশ্বাস, চোখের লবণ কিছু
থেকে যাবে নাচার ভিটেয়
দুহাতের আতুর ভিটেয়...
দয়া ও দাক্ষিণ্য হেতু নতমুখ
বহমান শিল্প সুষমা
অধিকন্তু ম্লান ভস্মাধারে
যেন-বা প্রদীপ দান ততোধিক মলিন হয়েছে
অদৃশ্য ভয়াল চিত্র চরাচর
জুড়ে
সুকৌশলে প্রকীর্ণ এখন
সম্পদের লুটতরাজ, দিনে ও দুপুরে চলেছে
সম্পর্কেও অবাধ ডাকাতি
অকারণ জাতিদাঙ্গা, যুদ্ধ-খেলা, বাণিজ্য-দানব
প্রতিহত করে ঠিক কালজয়ী
প্রকৃতি দাঁড়াবে।
তুমি কি বিবেক জাগিয়ে তোলার প্রতিভূ?
অহর্নিশ উদ্দাম করে তোল আমাকে
একটা সময় দুর্বল করে দিচ্ছ, রোজি
একোমেবাদ্বিতীয়মে পুরুষকার জাগিয়ে তুলছ
আমার মধ্যে
পারঙ্গমতার শঙ্কা উৎখাত করছ আমার থেকে
অল্প রাধা-ভাব দেখিয়ে
ঝিকিয়ে তুলছ বিবেকের আলো
অনির্বচনীয় দশনক্ষত ছাপিয়ে
উভোত্তল তোমার নাভির পরিখা যখন
আশার তর্জনী ছোঁয় অথবা কবোষ্ণ
নিশ্বাস তোমার বইতে থাকে আমার কপালে
অবিমিশ্র সেই ঘোর উপহাস করে বিবেক ও
সাবেক কামসূত্র।
কীর্তনের সুর একাদিক্রমে বাজলে সময়সাপেক্ষে
একটা ভালো-লাগা, সহনশীল সৌন্দর্য নিয়ে আসে
দুনিয়া যাচ্ছে ঐহিক, তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে
ঈশ্বর ও শয়তান যৌথ উদ্যোগে যা তৈয়ার করেন
কোথায় পেটো ফেলতে হবে, সুবিধামত গণহত্যা
বা প্রয়োজনীয় ত্রাণ-সামগ্রী ফেলতে হবে
নারী-পুরুষদের শারীরিক নির্যাতন বা ধর্ষণ
করতে হবে
সবকিছুই দায়িত্বেই সেই ব্যবসা
পরিচালিত হয়
তার সূচক লিখিত থাকে কীর্তনের ভাষায়
রিনিঝিনি, রুনুঝুনু যন্ত্রানুষঙ্গ
মাঝে মধ্যে সুরের ওঠানামায়
যে বা যারা এই কীর্তন তথা নাম-গান শুনতে ব্যর্থ
তারা জীবিত না মৃত, জ্ঞান হারিয়েছে
না, যৌন ক্ষমতালুপ্ত
এটাই দস্তুর
অস্ত্রপরীক্ষা, যুদ্ধ পরিকল্পনা, ফুলে-ওঠা বা
ফেঁপে-ওঠা তো, পরের ব্যাপার
বৃহৎ-বঙ্গে কীর্তন-খোলা নদীটি কি এখনো আছে?
বর্ণময়। গন্ধময় অথবা তা
শব্দময়, উচ্চকিত প্লাস্টিক
প্রহরা। সাধ্যমত ফিরিয়ে দিয়েছি
অঙ্গার তোমাকেও, গন্ধক ও যবক্ষারজান
সেই রসায়নে যেভাবে, সেভাবে
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রাকৃতিক উপভোগ্য
বিরেচন-ক্রিয়া আর কেবলি বেসাতি
রূপ-রস-রক্ত কিংবা যৌনাচার
সমানুপাতক, অশ্বেতর বিনির্মাণ
সমস্ত উৎসন্নে গেছে। উড়িয়ে পুড়িয়ে
কিছু গবেষণাগারে, অস্থি-শীতল-করা
বিকিরণে । অনাগত ভবিষ্যের বিকট উল্লাসময়
উপলব্ধি ছিল। অদ্যভক্ষ্য ধনুর্গুণ—
এখন ফেরৎ পাচ্ছ। এ সাধের জগৎ-সংসার
যেমন, সে ভেসে যাচ্ছে, যাবে।
তুমিও প্রসন্ন হয়ে যাবে, অনপোদনীয়
তবে যাও। সময়ের চক্রফেরে সে যদি
শান্ত হয়, হবে। তুমিও শান্তি পাবে
সৎকারবিধির পর, শান্তিজলও
শরীরে ছড়াবে এবং অনন্ত জাগবে পুনর্বার।
ঘুমঘোরে তখনো পড়োশি
একটা প্ররোচনা-মূলক
আনুমানিক অঙ্ক কষছেন
কতিপয় চিকিৎসক
জ্যোতিষচর্চা বিশ্ববিদ্যালয়েও
ঢেউ আসছে, ঢেউ ভাঙছে
আর আসন্ন প্রসূতিদের জল-ভাঙার শব্দ
শোনা যে, যাচ্ছে না
আতঙ্কে কুঁকড়ে গর্তে সেঁধিয়েছে
বিপ্লবী, পিঁপড়েরা
এ দেশের কী হতো!
কৃষিকাজ না-থাকলে--
মৃত্যুভয় জাগিয়ে-রাখা কেবল আর ব্যাঙ্ক-লুঠ
কখনো ডোল-দেওয়ার রাজনীতি
দেশ-বিদেশে আমাদের ছেলেমেয়েরাও কত
অন্যরকমের ব্যবসায় নেমেছে
উদগাণ্ডু শাসকেরা ওষুধপত্রের ব্যবসায়, অথবা
ঢপের উন্নয়ন চলছে
চাষীদের পেটেও যখন লাথি মারছে সরকার
গণতান্ত্রিক কৌপীন ও চাড্ডিতে
শিল্প যে রকম ভাবে ভোগে যাচ্ছে
আমরা, আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠার আগেই
আপাতত সমরাস্ত্রের উন্মাদনা কিছুটা স্থগিত।
ছোট-বড়ো ভূখন্ডগুলির শিল্প ও বাণিজ্য
স্থিতিকরণের খেলা
প্রাণের উৎসবে জারি-রাখা ধ্বংস ও মৃত্যুভয়
বিষাদ-মলিন একটু সৃজন -ইশারা
দুর্বলেরা মুছে যাবে
ধরণী বহুধা হতে পারে
অসামান্য অগ্নুৎপাত, জলোচ্ছ্বাস ও বিপর্যয়
সাহিত্যও কালজয়ী নয়
সীমায়িত অথবা স্থানিক, যুদ্ধ হবে
তার মাঝে অন্যেতর ইচ্ছার সমাধি
গ্রহ বিজয়ের কালে, উপগ্রহ নিয়ন্ত্রিত তথ্যের
সড়কে,এইসব বাক্য লিখে রাখা।
আট
আড়মোড়া ভাঙতেই পুরোনো কফিন চৌচির। বাঁচতে চায় বলে মৃতরা যে যার লাশ আর লাশ গুলো মাপ মত পায়জামা খুঁজে ঢুকে পড়ল তার ভিতরে।এতদিনের ঠান্ডা শরীরে উত্তাপ ফিরছে দেখে মমি রক্ষনাবেক্ষনে যারা ছিল তাদের অনির্দিষ্ট কাল ছুটি ও ব্যাজার মুখ।
কতকাল পরে এরা বাঁচতে শিখছে দেখে পলাশ আরো লাল হল। কেউ দেখেনি। পাখি’রা বহুদিন বাদে গানে ফিরলো। কেউ শোনেনি। আকাশ আরো নীল, উঁকি দিল কৃত্তিকা। বাঁচবে বলে এ শহর ভুল উল্লাস ছেড়ে উড়াল দিয়েছে ছায়াপথে। আকাশগঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে পুরোনো পালক।
নয়
এ একটা ভাঙাচোরা ক্যারাভান অথবা নূহের নৌকো। মরুসমুদ্রে ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই। উথালি পাথালি নাও বুক চেপে উগরে দিচ্ছে ভয় আর শ্বাসকষ্ট। অকরুণ আগুন পুড়িয়ে দিচ্ছে চোখ, চুল, পায়ের পাতা আর হিমস্রোতে কুঁকড়ে যাচ্ছে কেউ। ক্লান্তিহীন উজানে চোখে জুড়ে ইঁদুরের মৃত্যু ভয় অথবা আরারাত পাহাড়। ফ্যাসফ্যাসে শুকনো গলায় ঈশ্বর ও তার দালালদের অভিশাপ দিযে লুটিয়ে পড়লো কেউ। ওরা হাঁটছে। পায়ে পায়ে ধুলোমেঘ। কতকগুলো চলমান ধুলোমেঘ আরারাত পাহাড়ের খোঁজে সারারাত্রি হেঁটেছে। নষ্ট বলতে কয়েকটা ইঁদুর।
দশ
একঘেঁয়ে লাশ ছেড়ে বেঁচে নিতে ইচ্ছে হলে পুরাণের গল্পগুলো জড়ো করি। ক্রমশ স্বাগতোক্তি’র মত বিলম্বিত আলাপ এবং ক্রমউন্মোচন যেমন ঘরানা। এসময় সপ্তডিঙ্গা ক্ষণিক উদ্বেল, অদূরেই লাশ ফুঁড়ে কমলে কামিনী আর বাঘিনীও নেমে এল হাতানিয়া-দোয়ানিয়া জলে।
আমিও সওদাগর। ষোল আনা সাঁতরে ডিঙা সামলে উঠে আসি পুরোনো লাশের পাশে। বাঘিনীও জল মুছে পুরোনো ডাঙায়।
এগারো
এখানে পুরাণ কথার মাঝে অনন্ত স্পেস। সেসময় শীতঘুম। পলেস্তারা মেরামতি। কফিনের দেওয়ালে সদ্য রঙ। “বিজ্ঞাপন মারিবেন না” ঘুম বিজ্ঞাপন জুড়ে গুটখা হিংসে। স্বভাবত অনিদ্রা জুড়ে জান্তব ক্রোধ আস্ফালন, অস্থির ভ্রম-অমনিবাস আর ঘুমবড়ি।
এরকম অসংখ্য মহড়া শেষে যদি ইচ্ছে মৃত্যু চাই কথক ফিরে আসে, ফিরে ফিরে আসে পুরাণের গল্পগাছা নিয়ে।
শীতঘুম ফেলে আরো একবার বেঁচে উঠি।
বারো
শেরিফের নির্দেশ মত অবন্তী নগর কুকুর কুন্ডলী। তার বগলে, তলপেটে, নিতম্বে, ক্লিভেজে যে যেমন হরিপদ আর মফিজুল আর রামা কেওড়া কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমোতে যাবে।এসময় তাদেরও বগলে, তলপেটে, পাছায়, প্রোস্টেটের নীচে উসখুস অথবা তাদের ছা’য়ের মা-পুতের অসাধ্য কুলকুন্ডলীনি সাধন। সে কারনে চুলকুনি বশত একটু নড়াচড়া, সে ধাক্কায় অবন্তী নগর কেঁপে উঠলেই হাতের তালু নিবাসী স্ফিঙ্কস হাঁক দেয়, খামোশ……
তেরো
বহুদিন পর জুলুস বেরোবে আজ, পুরোনো পায়জামার বেয়াদবি ছুঁড়ে সবার নতুন পাতলুন।
দাঁতাল পাহাড়ের দিক থেকে বাহার যাত্রা যাবে বাস্তু দেবতার আনখ বিগ্রহের দিকে।
মাংসাশী পাতলুনের আজ অন্তিম নিরামিষ দিন, বাহার যাত্রা।
ক্ষুধার্ত বাঘের কাল থেকে হিসেব বরাবর।
চোদ্দ
এই সেই মহাজনপদ নীল বাল্বের নিচে শুয়ে ছিল।
এই সেই মুখোশ ওয়ালা পিঁপড়ে যারা নীল বাল্বের নীচে তৈরি করেছিল এই মহাজনপদ
এই সেই নীল বাল্ব এই মহাজনপদকে ওম দিত দুধনদীর ধারে।
এই সেই দুধনদী, অভিমানী সরিয়ে নিয়েছে মহাজনপদ থেকে বহুকাল আগে।
এই সেই অভিমান মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল নীল বাল্ব থেকে।
এই সেই নীল বাল্ব ক্রমশ নিভিয়ে দিয়েছিল মুখোশ ওয়ালা পিঁপড়ের আঁচ।
এই সেই মুখোশ ওয়ালা ঠান্ডা পিঁপড়ে যারা তৈরি করেছিল এই মহাজনপদ।
এই সেই মহাজনপদ, আজ শুধু শৈত্যপ্রবাহ।
এই সেই শৈত্যপ্রবাহ......।
দুঃখ পেতে হয়,
খুঁড়ে দেখতে হয়...
ওই-যে কথক, ফুরনো গল্পের
ওই-যে ঊষর মরু-বালক
ওরাই জানে, ওরাই শুধু জানে ---
হৃদয় যদি পাখির বাসা হয়
খাদ্য তবে অমিত সঞ্চয়...
খুঁড়ে দেখতে হয়
চোখের তারায় ক্লান্ত বিকেলঘর
সন্ধে মানেই মরানদীর সোঁতা,
চাওয়া এবং ভুলে যাওয়ার
মাঝখানে বয় খরস্রোতা
ইচ্ছেগুলো, ওদের গায়ে ধুলো,
স্রোতের টানে আবারো ঘর ভাঙলো?
পাঁজর-বেড়ার ভেতর-উঠোন
এখনো জলমগ্ন?
হাত খুঁজছে আঁকড়ে ধরার হাত,
জল বাড়ছে, জল বাড়ছে শুধু
আমার তবু নৌকাডুবির ভয় --
দুঃখ পেতে হয়
খুঁড়ে দেখতে হয়
বিশ্বাস করুন, প্রভু
আমি আপনার সবকথা বিশ্বাস করি
আমি জানি, জিভ আসলে
ভক্তিগানে নেচে ওঠার একান্ত লেজ,
প্রতিটি মৃত্যু আসলে পরিযায়ী--
খানিক জিরোচ্ছে শুধু আমার এ-ঘরে;
অথবা সবই কর্মফল, গীতায় আছে,
সবই আমার দোষ
আমি জানি, আপনার মৃদু হাসি
আসলে ছুরির ফলার মতো নিষ্কলুষ, সাদা...
আমি নিশ্চিত জানি
কাঁসর-ঘন্টার আওয়াজে হাহাকার ঢেকে যায়,
মোমের আলো আপনার মুখে পড়লে
নেপথ্যে যে ধাতব শৃঙ্খল বেজে ওঠে --
সে আমার শোনার দোষ
আমি বিশ্বাস করি
আপনার প্রতিটি কথা আপনিও বিশ্বাস করেন;
দুঃখ কিসে যায়
সে-মন্ত্র আপনিই বলে দেবেন সময় হলে;
আমি তো জানি
মৃতদেহ আগুনে দিলে মাংস-পোড়া গন্ধ নয়,
বাতাসে ভাসে আত্মার অবিনাশী সৌরভ
তবু, প্রভু, এই দারুণ ঝড়-ঝঞ্ঝার সময়
বাইরে বেরোবেন না বেশী --
যদি সাজ খসে যায়..
লকডাউন উঠে গেলে
প্রতিটি ব্যর্থ পদচিহ্নে আবার শিশুঘাস জন্মাবে--
যেখানেই যাই, এবার তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব
লকডাউন উঠে গেলে
ঐ যে দেহটা আর্তনাদের মত ভেতর থেকে ফেটে
ছড়িয়ে আছে পাথর পাথর পথে--
সে আবার ‘আমি’ হয়ে উঠে
এক দুপুরে ঠিক এসে দাঁড়াবে তোমার দুঃখবটের নীচে
নতুন চানাচুর প্যাকেটটা ভাঙবো লকডাউন উঠলেই
লকডাউন উঠে গেলে
আমি আর ঝড়কে ভয় পাবো না কক্ষনো;
বৃষ্টিতে ভিজবো হাপুস, নদী হয়ে যাব,
আমার রুপোলি সাঁতার দেখে হাততালি দিলে
ভাসানের দিনে তোমাকে সুগন্ধী সন্ধ্যা এনে দেব...
লকডাউনের পর আবার
কুকুরের উল্টোনো মাড়ির মত আমপাতা বেয়ে
চাঁদের যে অশ্রু নামে ক্ষুধার্ত মাটিতে,
আমি তাকে আলো জেনে মরে যাব
লকডাউন উঠে গেলে মনখুলে কাঁদবো আবার
নিজেকে অজেয় ভেবেছিলে তুমি!
তুমি তো জানতে,
মানুষের সাধ্য নেই তোমাকে ছোঁওয়ার...
ভেবেছিলে, অরণ্যকে যত দূরে ঠেলে রাখা যাবে
ততদূর জীবনের সীমানা তোমার।
দুর্ভেদ্য করেছো দুর্গ!
এত উঁচু প্রাসাদ তোরণ, এত দাস-দাসী--
একমুঠো দানা ছুঁড়ে দিলে
মাদল ও কৃপাণ হাতে ছুটে যেত অরণ্যের দিকে!
তারা কেউ পথে নেই আজ।
আজ শুধু অরণ্যের দিন;
শুনশান, নিশিত পথ বেয়ে
উঠে আসছে ধীরে নগরের বুকে...
জন্মদাগ মুছে দিয়ে কুচিকুচি উড়িয়েছো যাকে,
আজ সে বৃক্ষের বল্কল
পথ শেষ, ম্যাকবেথ;
অস্ত্রের তমসা ছেড়ে, উল্লাস নিভিয়ে,
নেমে এসো মাটিতে, নতজানু হও,
মার্জনা চাও...
লক্ষ্মণরেখা
একটি অদৃশ্য রেখা বা গণ্ডি কোথাও
টানা আছে আইনের খাঁচায়
খাঁচার ভেতরের পাখি যতই ডানা ঝাপটাক
কিচির-মিচির করে সেই অদৃশ্য মহাকাব্যিক
গণ্ডির মধ্যে তার নাচন কোঁদন
বেরলেই (সেখান থেকে) বিপত্তি, বিষয়টা তেমনি
জটিল, ধুরন্ধর ব্যাসকূট ভেদি গণিতের মত
রেখাটি যখন অদৃশ্য, কোথায় আছে একমাত্র
বিচারকরাই জানেন সে-কারণে
কবিতাও একটি সংযমের সাধনা, অবভাস
কিন্তু ছোট্ট সপ্তসিন্ধু দশদিগন্তের পরিসীমায়
কবিদের বাক ও লিখন কর্মের দাপটে
দণ্ডিত হয়েছেন অনেকেই মৃত্যু পর্যন্ত
এ সব মৃত্যুর অর্থ, আইনের চোখে হেরে যাওয়া
হলেও যা পরাজয় নয়
পাঠক বা শ্রোতারাও যুগান্তরের পথে
লক্ষ্মণরেখা মানেন নি
চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হোক
মেধা ও মননের
আমি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার আগেই।
মার খেতে খেতে হেরে গেলেও যদি
রোজগার হয় কিছু, অর্থাৎ
যারা সেই দৃশ্য দেখবেন বক্সিং-মঞ্চে
আর খেলা পরিচালনা করেন অভিজ্ঞ এক
নীতি-রক্ষক
যিনি কোমরবন্ধের নীচে যোদ্ধাদের কাউকেই
আঘাত করতে দেবেন না
সেটাই হল বক্সিং
প্রজাপতির মত ওড়া আর ভীমরুলের মত
হুল ফোটানোর এই খেলা
দেখিয়েছেন মহম্মদ আলি
অন্যদিকে চ্যাপলিন তার, সিনেমায়
আমাদের দেশেও কুস্তি-নামে একটা খেলা আছে
গোবরবাবু যার মধ্যমণি ছিলেন
আর পাঁয়তারা চলছে
বাতিল একটা যন্ত্রেরও নিকৃষ্ট
এই সম্পদ
ওজনে, যার ধাতু মূল্য কিছু নেই
ইতস্তত ছত্রাকার, শিরা-উপশিরায় জঙ
পাটকিলে মাটি, আগাছার মধ্যে
অবহেলিত
অচলাবস্থা কৃষিতেও, গ্রন্থিত হচ্ছে
মন্বন্তরের দিকে
গণতন্ত্রের দুর্দশায় পরাজিত
হতবল, আলস্যের কূটকচালি ও
নিস্পৃহতায়
যা কাঙ্খিত
আদিউ! পুরনো মেশিন
এই দুই প্রকল্পে আমাদের লগ্নি বেড়েছে
অন্তঃসারশূন্য রাজনীতির প্রতি
পুলিশ ও আইনি ব্যবস্থার প্রতি
ক্রমবর্দ্ধমান মানুষের আনুগত্য
শ্রম থেকে বিযুক্ত করেছি আনন্দ ও
ভালোবাসার নির্মাণশৈলি
আমরা। তবে
কেন আমাদের আস্থা এই ব্যবস্থার প্রতি, অবুঝ, অবাধ
আনুগত্যই বা কেন প্রশাসনের প্রতি
অজ্ঞাত আমাদের
দেখতে পারছ বা পারছ না
প্রধান আলোকস্তম্ভগুলো
নিবে আসছে
প্রায়ান্ধকার
অবিমিশ্র, অপ্রধান আলো
তার অঙ্গীকার ঢেকে আছে
শীর্ষসংঘাতে পরাভূত
নিভে যায়, ফের জ্বলে ওঠে
ইতিউতি, অপ্রধান আলো
তোমারো মুখের নিচে
প্রচ্ছায়ার সঙ্গে লগ্ন আছে
হীনমন্যতায় যেন
বিবমিষা
তবে কি চমক জাগবে?
তক্ষক ডেকে উঠবে
কয়েদখানায় যেমন হয়। অতিকায় ঘড়ি গড়িয়ে চলে আর
ঘণ্টার শব্দ। যেমন ওঠাবসা, নিত্যকর্ম, বিশ্রাম। লোহার দরজা
খোলা ও বন্ধ হওয়া। জলপাই পোশাক ঘোরে, ফেরে। শাদা
দাঁতের কড়কড়, ডাণ্ডা-বেড়ির ঝনঝন। কখনো তাদের মুখ বাঁধা
রোমালে। মাঝেমধ্যে রক্তপাত। পট্টি লাগানো, অল্পবিস্তর
হাসপাতাল। আদালতের নিদান।
শ্বাসরুদ্ধপ্রায়, আলো আঁধারি। অন্ধ জন্তুর সঙ্গে দু-একটা গর্জন!
বিদ্যুৎস্পৃষ্টতার মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যাবার ভয়। চোখে চোখ না-রেখে
বা মাথা-নিচু, কথাও না বলতে পারার ভয়। ভয়ের বোঝা-চাপানো
দস্যু, তোমার মাথার ওপর। মানুষের রীতিনীতি অকেজো। রকমারি
ফন্দিফিকিরে গণতন্ত্র, মৃত। পাগলা-ঘণ্টি বেজে ওঠে না।
উঠোনে শুধু একটি নৌকো অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। আজই তো তোমার ফিরে যাবার কথা ছিল।
মাঝি কিন্তু এখনো মাঠ ভেঙে ফিরে আসতে পারেনি। তার নাকি কয়েক বছরও দেরি হতে পারে। কথাটা তুমি জানোনা বলেই মাঝরাতে এই তারাজ্বলা নিঃসীম আকাশের নিচে আবছা উঠোনে নেমে দাঁড়িয়ে রয়েছ। মাঝি ফিরে আসার অপেক্ষায়। ভূতাবিষ্ট একা। শাদা কুয়াশায়।
কোথা থেকে যে গান ভেসে আসছে মাঠের হাওয়ায়। ঝিমধরানো সুরে। একটানা। ভারী অবাক হয়েছ তুমি। কতোদিন আগে কোনো এক জনপদবধূর গলায় শোনা গান আজ এই মাঝিশূন্য নৌকোর রাতে কীভাবেই-বা ফিরে আসবে। অনেকদূরে টিমটিমে লন্ঠনের আলো একমাঠ অন্ধকার দোলাতে দোলাতে বাড়ি ফিরছে আলপথ ধরে।
এইসময় নিজের মুখোমুখি সম্পূর্ণ অনাবৃত তুমি। খুব শীত করছে তোমার। গানটাও থেমে গেছে অনেকক্ষণ। প্রান্তরে জঙ্গলে শুধু তারা ঝরে পড়ার টুপটাপ।
জীবনে আজ এই প্রথম তুমি প্রবল নৈঃশব্দ্য আর প্রগাঢ় সন্মোহনের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছ। যেখানে কিছুটা দূরেই একটি নৌকো, অপেক্ষারতা, শুধু তোমার জন্যেই, অল্প অল্প দুলে উঠেছে মাঠের হাওয়ায়।
হাইওয়ের দিক থেকে হঠাৎ বৃষ্টি এসে বাসস্টপে প্রতীক্ষারত যাত্রীদের ভিজিয়ে বলখেলার মাঠে নির্বিকার নেমে চলে যায়। জুনমাসের দীর্ঘ বিকেল বৃষ্টির এই বালখিল্যতায় ভারি খুশি। চোখ টিপে অফুরন্ত আমের বাগানে তাকে নিয়ে নিমেষে উধাও।
হাইওয়ের ওপারেই পৃথিবীর শেষ টার্মিনাস। সেখানে বৃষ্টি নেই। বিকেলও নেই। সেখানে দমবন্ধ হয়ে পড়ে আছে কবেকার পরিত্যক্ত একটা নিঃঝুম ডাবলডেকার। সেই বাসের দোতলা থেকে নেমে আসছে কলেজ ফেরত এক তরুণী। যাকে দেখতে অবিকল ‘রাজা’ নাটকের ‘সুরঙ্গমার’ মতো।
বোধনের সময় হলো। এসো, আলপনাআঁকা এই দরদালানের একধারে শান্ত হয়ে দাঁড়াই। খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে একটা বিকেল।
গ্রাম ঝেঁটিয়ে লোক আসছে। ঢাকের শব্দ। কাঁসি। কোলাহল। দালানের একপাশে উঁচু বেদি। ডাকের সাজের প্রতিমা। দ্যূতিময়ী। দশপ্রহরণধারিণী। মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত, তবু বেশ হাসিহাসি মুখ। জ্বলজ্বল করছে চোখদুটো। জমকালো শাড়ি-জামায়, খোলাচুলে মানিয়েছেও বেশ। আর কী আশ্চর্য! মুখটাও যেন খুব চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে, এই মেয়ের সঙ্গে না হোক, এর যমজ বোনের সঙ্গে নিশ্চয়ই আলাপ হয়েছিল আগে কখনো। কিন্তু কোথায়? সেইটাই তো মনে করতে পারছি না কিছুতেই।
গাঁয়েরই এক পটুয়া, কুমোরটুলির মাতব্বর নয় মোটেও, নেহাতই মামুলি একজন, প্রতিমা গড়েছে এবছর। বরাবরই উত্তেজওনায় তার খুব ঘাম হয়। তারপর শীত করে। আজও তেমনই। আবার নিজের সৃষ্টি থেকে নিরপেক্ষ দূরত্বে দাঁড়িয়ে স্রষ্টা হিসেবে একটু গর্বও যে হয় না, এমন নয়। যেমন এইসময়।
তার গড়া মূর্তির মতোই হাসিখুশি অল্পবয়সী পটুয়াটি। বেশ মিশুকেও বটে। নিজেই এসে আলাপ করলো আমাদের সঙ্গে। আবার আলাপ একটু গাঢ় হতে-না-হতেই জামার নিচে লুকোনো ডানা মেলে পলকে উধাও। বেশ চমৎকার কাটল সন্ধেটা।
ওই যাঃ! ছেলেটির নামটাই তো জানা হলো না শেষ পর্যন্ত।
খুব কি সময় চলে গেল
ঝড় বা বাদলে
পাখি ডাকা ভোর ছুঁয়ে, ঝলসানো রোদে
তারও আগে মধ্য যাম অরুন্ধতী স্মৃতি
যাকে ছুঁয়ে অমৃত আকুতি
কাছে তো ছিলে না তবু দূরত্বের মাপ
শিশিরের ফোঁটা হয়ে গ’লে যায় রাত
সময়ের খেলা - নিকট বা দূরের গান
ক্লান্ত অবহেলা মুছে নেয় মায়া টান
তবুও কি বেঁচে যায়
চলে যাওয়া সময়ের শিকড়ের সুতো
কর্কশ হাওয়া মেখে
দুলে ওঠে যেই
তাহার কপাল ছুঁয়ে ঈষৎ আনত
আকাশে প্রদীপ জ্বলে নক্ষত্র উঠোনে
অমোঘ সময় ডাকে আঁধারের কোনে
অপেক্ষার কাল ততটাই আলোকিত
যেমত সকাল
স্বপ্নের সংকেত, জিলা নদীয়া
সবুজ শরীর ছুঁয়ে জলঙ্গি নদী
ভোরের মোরগ ডাক গোধূলি কীর্তনের
মগ্ন নিমাই পথে হরিনাম ওড়ে
পুরনো ধুলোর রেনু, পলাশী প্রান্তরে
ইচ্ছে পলাশ আজও রোদকে হারিয়ে
ওই ডাকে পথ, নিয়ে চল আজ স্মৃতির দেশ
আশ্রম ছেড়ে আলপথ বেয়ে বুড়ির চুল
ছুঁয়েছে আঙ্গুল, ডাক দিয়ে গেল ছলাৎছল
ভাগীরথী তল ছুঁয়েছে যখন জলঙ্গি জল
তাকেই জড়িয়ে আছে স্মৃতির শিকড়
বর্ষার পাটক্ষেত, ধানশীষে ঢেউ
পুকুরের জলে ডুব, ঘড়া কাঁখে ফেরা
ফুটন্ত ভাতের গন্ধে মাতালের টান, ছাড়িয়ে
কিশোরী রাই বকুলের ফুল -
ওই ডাকে পথ, নিয়ে চল আজ স্মৃতির দেশ
আশ্রম ছেড়ে আলপথ বেয়ে বুড়ির চুল
ছুঁয়েছে আঙ্গুল, ডাক দিয়ে গেল ছলাৎছল
ভাগীরথী তল ছুঁয়েছে যখন জলঙ্গি জল
খুব ভোরবেলা ঝুপসি আঁধারে আমার বাড়ি
চুড়ির শব্দ সামলে দাওয়ায় বেড়ে দেয় ভাত
নত জ্যোৎস্নার চাঁদ ডুবে গেল শিশির মেখে
এই তো সেদিন সদ্য ছেড়েছি বাড়ানো হাত।
স্বপ্নের সংকেত, জিলা নদীয়া
সবুজ শরীর ছুঁয়ে জলঙ্গি নদী
ওই ডাকে পথ, নিয়ে চল আজ স্মৃতির দেশ
আশ্রম ছেড়ে আলপথ বেয়ে বুড়ির চুল
ছুঁয়েছে আঙ্গুল, ডাক দিয়ে গেল ছলাৎছল
ভাগীরথী তল ছুঁয়েছে যখন জলঙ্গি জল।