সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
নির্মলেন্দু শাসমল
সমীপে
২০২১-এর বর্ষশেষ। এপ্রিল ২১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ৮ মাস ১১ দিন। আপনি নেই, অথচ আপনার উপস্থিতি জড়িয়ে আছে কী গভীর আশ্লেষে। এই তো কয়েকদিন আগে কালধ্বনির ঘরে কথা হচ্ছিল, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে নাকি নানা রাজ্যে শিকড়ের সন্ধানে মাথা খুঁড়ছেন দেড় কোটিরও বেশি বাঙালি উদ্বাস্তু। ওড়িশা, কর্নাটক, অন্ধ্র, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, উত্তরপ্রদেশ, আসাম, আন্দামান, বিহারের মতো বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে রয়েছেন তাঁরা। মনে পড়ে গেল, বেশ কিছুদিন আগের কথা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যার প্রকাশকাল। বাইন্ডারের কাছ থেকে সবে পত্রিকা উঠেছে ঘরে। হাতে হাতে ঘুরছে পত্রিকা। কথা হচ্ছে আসামের বাঙালিদের নিয়ে।
আমাদের চোখের সামনে আসামের বাঙালিদের নাগরিক অধিকার, ভাষিক অধিকার, আইনী জটিলতার ঘেরাটোপে ফেলে তাদের রাষ্ট্রহীন করার সমস্ত প্রস্তুতি চলছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। ঘরের কথায়, ঘুরে ফিরে আসছিল দেশ সমাজ রাষ্ট্র। আপনি শুনছিলেন। আপনি তো বরাবরই মৃদুভাষী শুধু নন, অল্পভাষী। ব্যতিক্রম, রসায়নশাস্ত্র, রবীন্দ্রসঙ্গীত, উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ, ফোটোগ্রাফ আর পক্ষপাতপুষ্ট বন্ধুবান্ধবপ্রসঙ্গ। সেদিন আলোচনার মাঝখানে আপনি বলে উঠলেন, মেদিনীপুর আমার দেশ। সেখানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমন সুযোগ নেই বলেই কলকাতায় আসা। নদীমাঠের দেশেই ফিরে যেতে চেয়েছিলেন আপনি সেদিন। এটাই নাকি আপনার বরাবরের চাওয়া।
কথাটা কত আন্তরিক, আমরা বুঝলাম পত্রিকা-প্রকাশ-অনুষ্ঠানে। কয়েকদিন পরই। ২২ সেপ্টেম্বর, কাঁকুরগাছি মোড়ের কাছে সিআইটি স্কুলের হলঘরে। অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন আপনি, প্রধান অতিথি শঙ্খ ঘোষ। কালধ্বনির ওই সংখ্যার সামগ্রিক পরিকল্পনা করার সময় শঙ্খবাবুর পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল বারবার। প্রথম থেকে আপনি তো ছিলেনই। আপনাদের দুজনের হাত দিয়েই প্রকাশিত হয়েছিল ওই সংখ্যাটি আর সন্দীপ রায়ের গল্পগ্রন্থ, পূর্বাপর।
আনুষ্ঠানিক দু-চার কথার পরই শুরু হয় আলোচনা। শুরু করেছিলেন, বিভাস চক্রবর্তী আর তীর্থঙ্কর চন্দ। প্রথমজনের আদিনিবাস সিলেট, আর দ্বিতীয়জন এই কিছুকাল আগেও ছিলেন বরাক বাসিন্দা। অংশ নিয়েছিলাম আমরা অনেকেই। সভাপতি হিসাবে শেষ বক্তা আপনি।
দেশভাগ, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজন, উত্তর ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির আগ্রাসনে বাঙালি-গরিমার বিপন্নতার ইতিবৃত্ত শুনতে শুনতে আপনি, আমাদের অনুষ্ঠান সভাপতি, এতটাই আত্মগত হয়ে গিয়েছিলেন যে, ৩৪ বছর ধরে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজ ও সেখান থেকে অবসর নেওয়ার পর স্কটিশ চার্চ কলেজের স্নাতকোত্তর বিভাগে শিক্ষক আপনি, আপনার কথা নিয়ে সামান্য কিছুটা এগিয়েই, ভেঙে পড়লেন, কেঁদে ফেলেন মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই, বলতেই থাকেন, নিজের ভিটে মাটি বসত ভাষা ছেড়ে বাঁচা অর্থহীন...এর মীমাংসা হওয়ার দরকার...আমার জানা ছিল না... এতদিন কালধ্বনির ঘরের ভেতরেই ছিল এই আলোচনা... আজ সবার কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে সবাই মিলে চেষ্টা করলে আমরা পারবই এক সুন্দর বাংলা গড়ে তুলতে,.. শিকড়হীন মানুষগুলিকে ফিরিয়ে আনতে, ঐক্যবদ্ধ বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতির স্বপ্ন দেখতে...
আঁধারের অলকগুচ্ছ আলগোছে সরিয়ে ভোরের আলোটুকু ছড়িয়ে দেওয়ায় স্বপ্ন-বিশ্বাসী নির্মলেন্দু শাসমল,
শূন্যতা আর ধূসরতার ঘন অন্ধকার মাখা অলৌকিক অরণ্যের মধ্যে হারিয়ে গেলেন আপনি...
আমরা আমাদের আতঙ্ক, অস্তিত্বের তীব্র যন্ত্রণা, নি:সঙ্গতা, সংযোগহীনতা নিয়ে অভ্যস্ত যাপনে একরকম ব্যস্তই আছি। ‘২২শের জানুয়ারিতে নাকি কলকাতা বইমেলা হবে। কালধ্বনির সবাই যে যার সময়মতো সেখানে পৌঁছেও যাব। মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলব, ছবি উঠবে। শুধু আপনার ছবি উঠবে না। আপনার স্নেহ ঝরানো, মৃদু হাসিতে উজ্জ্বল মুখের ছবি আর উঠবে না কোনোদিন। হারিয়ে গেছেন আপনি নির্মলদা, যেমন গত দুবছরে একে একে হারিয়ে গেল প্রথমে মুকুন্দ (গায়েন) আর তারপর সৃজন (পাল)।
ভালো নেই আমরা। ভালো নেই নির্মলদা। মনকেমন করে বড়। কবে থেকে যেন একসঙ্গে হেঁটে চলেছি। পায়ে পায়ে ফিরে আসছে আমাদের অগণন স্মৃতি। একদিন না একদিন, একে অপরকে ছেড়ে যেতে হবে জানা কথা, কিন্তু আলাদা করে ভাবিনি কোনোদিন। ভাবা হয়েই ওঠেনি। আড়ালেই থেকে গিয়েছে মৃত্যুর মতো এক অনিবার্য সত্য।
শুধু কালধ্বনির সময়কালের হিসেবেই তো পত্রিকার প্রথম রেজিস্ট্রেশন (১৯৮৩) থেকে প্রথম প্রকাশ (১৯৮৫) হয়ে ২০২১ এর এপ্রিলে প্রকাশিত পঞ্চবিংশতি বর্ষ প্রথম-দ্বিতীয় সংখ্যা (সময়মতো সবসময় বের না করতে পারায় পত্রিকার জীবৎকাল আর প্রকাশের বর্ষসংখ্যা হয়ে গেছে এলোমেলো, যা ছিল আপনার একেবারেই অপছন্দ) প্রেস থেকে হাতে এল ১৯ এপ্রিল, ২০২১। আপনি তখন দীনেন্দ্র স্ট্রিটের জে এন রায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে। পত্রিকা নিয়ে বিকালে দেখা করার সময়, পত্রিকার সামনের প্রচ্ছদ থেকে ব্যাক কভার সব, সবটা দেখা শেষে জানতে চাইলেন, প্রকাশ-অনুষ্ঠান কবে? জানালাম, আপনি সেরে উঠলেই।
সুস্থ হয়ে ওঠারই কথা। বৌদি (ড: দীপ্তি শাসমল) অপরিসীম ধৈর্য, অক্লান্ত শ্রম আর সাধ্যাতীত যত্ন নিয়ে, নিজের জ্ঞান ও চিকিৎসকদের পরামর্শ সমন্বয় করে প্রায় একা হাতে হাসপাতাল ঘর সামলে - কেননা আপনার তখন ডায়ালাইসিস শুরু হয়েছে - আপনার পরিচর্যা করে প্রায় সুস্থ করে তুলেছিলেন। এবারের অসুস্থতার কয়েকদিন আগেও আপনি ডায়ালাইসিসের দিন বাদ দিয়ে চলে আসছিলেন। যেমন আসতেন আগে, স্কটিশ চার্চে ক্লাশ নিয়ে কালধ্বনির আড্ডাঘরে মিস্টি মুড়ি তেলেভাজা নিয়ে ঢুকতেন (কালধ্বনির নিজস্ব পরিভাষায়, মিড-ডে মিল)। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম তেমনই আবার ঘটবে। ডাক্তারও জানিয়েছিলেন ২১ তারিখ সকালে ডায়ালাইসিসের পর আপনাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। বৌদি, হাসপাতাল-শয্যা থেকে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর সহ আনুসঙ্গিক সবকিছু দিয়ে বাড়িতে আপনার নিজের চেনা পরিবেশ চিকিৎসা-উপযোগী করে রেখেছিলেন।
নির্মলদা, নিজের ইচ্ছেতে তো আর এই পৃথিবীতে আমরা আসিনি, যাওয়াটাও নিজের ইচ্ছেতে হয়ে ওঠে না।
কয়েকদিন পর, কালধ্বনি পঞ্চবিংশতি বর্ষ প্রথম-দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হ’ল, কোনো আয়োজন ছাড়াই, কালধ্বনির ঘরে।
এলোমেলো কথা সব। বলা কথা, না-বলা কথা। কত কথা বলতে পারিনি, বলা হয়ে ওঠেনি।
জানাও হয়ে ওঠেনি, আপনার অনেক কথা।
অবশ্য, আপনাকে জানতে গেলে যে ‘আপনি’ হতে হয়।