সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
স্মরণ
অধ্যাপক ডঃ নির্মলেন্দু শাসমল
(২১ জুলাই, ১৯৪৩ - ২১ এপ্রিল, ২০২১)
অননুকরণীয় শিক্ষক, সহকর্মী
দাদা ও কালধ্বনি পত্রিকার সুদীর্ঘকালব্যাপী শুভানুধ্যায়ী
এই নাতিদীর্ঘ অংশটি কালধ্বনি পত্রিকার ও কালধ্বনি প্রকাশনীর সদস্যবর্গের মিলিত প্রয়াসে এই বইয়ের ভূমিকার বদলে লেখা। অনেক দিন ধরেই আমরা বইটা বের করার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু লেখকের ঔদাস্যের সঙ্গে আমাদের আলস্য ও অযোগ্যতা মিশে কাজটাকে বারবার পিছিয়ে দিচ্ছিল। শেষপর্যন্ত সকল বাধা কাটিয়ে বইটা যে আমরা বের করতে পারলাম, আপাতত সেটাই যথেষ্ট মানছি।
প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কারোর বেলায় প্রায় আজন্মকালের, কারোর বেলায় দীর্ঘদিনের, কারোর বেলায় অপেক্ষাকৃত অল্পদিনের, কিন্তু বলার কথা এই যে সবার সঙ্গেই তাঁর সমান সম্পর্ক। তাঁর সম্পর্কে মোটামুটি যেটুকু খবর আমরা সকলেই রাখি সেগুলো হল যথাক্রমে, তিনি ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজে (বিকেসি) রসায়নের অধ্যাপনার সাথে সাথে সমাজ-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন এবং অধ্যাপনা থেকে অবসর নিলেও সে ক্ষেত্রের সঙ্গে এখনো যুক্ত আছেন। গত কয়েক দশক ধরে তিনি লোকসাংস্কৃতিক সংস্থা ‘ভ্রমরা’র অভিভাবক, দৃষ্টিহীন যুবকযুবতীদের নাট্যদল ‘ব্লাইন্ড অপেরা’র অভিভাবক। সাতের দশকে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, নাগরিক অধিকারের একজন যোদ্ধা হিসেবে পিইউসিএলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৫ সাল থেকে তিনি বের করতে শুরু করেন ‘কালধ্বনি’ পত্রিকা, যা তাঁরই সম্পাদনায় আজ প্রায় সাঁইত্রিশ বছর ধরে টানা চলেছে। ক্রমশ কালধ্বনি হয়ে উঠেছে বিচিত্র ভাবনার এক মুক্তমঞ্চ। নামী অনামী বিনামী এই কাগজে লেখেন নি এমন কেউ নেই। তাঁদের ভাবনায় পত্রিকা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে, সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছেন চিন্তাজগতের মানুষজন, আমরাও।
কিন্তু বরাবরই লক্ষ করে আসছি সম্পাদক প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের নিচে লেখক প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় চাপা পড়ে যাচ্ছেন। প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় তাঁর পত্রিকায় কখনো সম্পাদকীয় লেখেন নি, সর্বদাই তিনি উপস্থিত থাকেন স্বতন্ত্র এক প্রাবন্ধিক হিসেবে। একটুও অত্যুক্তি না করে বলা যায় সেই প্রবন্ধগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য আছে। উন্নয়ন নিয়ে অনেকেই লেখেন, দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বা অস্থিরতা নিয়ে বা দুরবস্থা নিয়েও লেখালেখির কোনো অভাব নেই, পরিবেশ নিয়েও তাই। কিন্তু প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় বিশিষ্ট এইখানে যে তিনি সেইসব দেখার ফাঁকগুলো ধরিয়ে দেন। আর সেইসঙ্গে সঠিক দেখার সূত্রগুলোও ধরিয়ে দেন। আর তার ফলে তাঁর লেখাগুলো অন্য মাত্রা পেয়ে যায়। যেমন, ‘মধ্যবিত্তমদির জগতে....’ প্রবন্ধে দেখার এই ফাঁকগুলোর কারণ বিশ্লেষণ করে তিনি দেখান, প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা ও শ্রমে আমাদের যে জ্ঞানভাণ্ডার গড়ে ওঠে তা প্রধানত ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। আর যেহেতু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমাদের খুবই কম, তাই তার ভাঁড়ারটাও ছোটো। আমাদের সামগ্রিক জ্ঞানের সিংহভাগটাই আসে পরোক্ষানুভূতির মাধ্যমে। প্রধানত ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা ও শ্রমে আমাদের যে জ্ঞানভাণ্ডার গড়ে ওঠে তার সঙ্গে এই পরোক্ষানুভূতি মিশেই গড়ে ওঠে পাশ্চাত্ত্য দর্শনের ‘being’, আমাদের দর্শনের ‘চিৎ’, চৈতন্য। কিন্তু সেই পরোক্ষানুভূতি আমাদের কোথায়? কোথায় সেই একাত্মতার বোধ? আমাদের যাপন-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে সেই পরোক্ষানুভূতির কোনো ঠাঁই আছে কি? তাই আমাদের যাবতীয় চেষ্টা শেষপর্যন্ত পর্যবসিত হয় নিছক পাণ্ডিত্যে, যে পাণ্ডিত্যের কোনো আলোকোজ্জ্বল দিশা নেই, কোনো স্বজ্ঞা নেই। যে ভুবনদের ঘিরে এই প্রবন্ধ, সেই ভুবনদের কথা টেনে তিনি বলেন,
আমরা পড়েছিলাম, ভুবনদের কাছে আমাদের শিখতে হবে। উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণি সংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া পাঠ যে অসম্পূর্ণ, তাও জেনেছিলাম। কিন্তু ভুবনদের কাছে সত্যিই কি আমরা কোনো পাঠ নিলাম? বোধহয় না। আমাদের জানা ছিল কেমন যেন নিশ্চিত। কে, কি, কোনজনা, কিইবা তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবই ছিল আমাদের জানা। আমাদের লক্ষ্য ছিল সংশয়মুক্ত, লক্ষ্যপথ নির্দিষ্ট, চূড়ান্ত।
ভুবন, ভুবনেরা ছিল আমাদের যাত্রাপথের সঙ্গী। স্বপ্ন আমাদের, আমরা কোনদিনই প্রস্তুত ছিলাম না, নিজেদের স্বপ্ন সরিয়ে রাখতে। ভুবনেরা তাদের লোকগানে অভাব অভিযোগের কথা বলবে, না বলবে না, নাকি বলতে তাদের ভালো লাগবে না, এমন সব কথা ছিল উদ্ভট, অবাস্তব। ভুবনেরা কেমন আচরণ করবে বা আদর্শ আচরণবিধি কি হওয়া উচিত, তাও ছিল আমাদের জানা। এমনকি সংগৃহীত ‘ডেটা’, ‘ডেটা’ হিসাবে বিবেচিত হত তখনই, যখন সেই ‘ডেটা’ আমাদের জানাকেই প্রতিষ্ঠিত করত। প্রেম বিরহ শাস্ত্রের গান, রাধাকৃষ্ণের গান ছিল উল্টোরথের যাত্রাপথ।
এরকম হল কেন? এর দার্শনিক ব্যাখ্যা কী?
উপাত্ত থেকে জ্ঞাপনে, জ্ঞাপন থেকে জ্ঞানে বা জ্ঞান থেকে প্রজ্ঞায় পৌঁছতে যে সরলরৈখিক পথ আমরা সাধারণভাবে নির্ণয় করি, তাতে অস্থির বা পরিবর্তনীয় অমিল বা বিরোধ বা বৈষম্যের কোনো স্থান নেই। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায় ইতিপূর্বেই স্থিরীকৃত কোনো এক সিদ্ধান্তের উপযোগী উপাত্ত সমাজ অভ্যন্তর থেকে সংগ্রহ করেই সাধারণীকৃত রূপরেখায় পৌঁছে যাই। শুধু তাই নয়, আগে থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত(সমূহ)র সত্যতা প্রতিপন্ন করতে বা যুক্তিগ্রাহ্য করতে অন্য কোনো উপাত্ত বা জ্ঞাপন বা জ্ঞান কোনোকিছুরই ব্যতিক্রম বা চলিষ্ণু বৈচিত্র্য মান্যতা পেল না বলেই মনে হয় মানুষ বা সমাজ অভ্যন্তরের নিয়ত পরিবর্তনশীলতা মান্যতা পেল না। অথচ এই জগৎ ও জীবনকে বোঝাতে আমরা সংসার শব্দটা ব্যবহার করি; সংসার যা সরে সরে যায়, গতিশীল। নদীর মত।
মোট সাতটি প্রবন্ধের সংকলন এই বই। প্রবন্ধগুলি ১৯৮৮ থেকে ২০১৯ সাল অর্থাৎ মোট ৩১ বছর এই সময়কালের মধ্যে লেখা। এই সময়ের মধ্যে তিনি অনেক বিষয়েই প্রবন্ধ লিখেছেন। তারই মধ্যে থেকে পুস্তকাকারে দুই মলাটের মধ্যে আনার জন্যে আপাতত সাতটি প্রবন্ধ বেছে নেওয়া গেল। বিষয়গুলো ভীষণভাবে সমকালীন। সেই সময়কার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিকে বা বলা যায় অস্থিরতাকে ঘুরে ফিরে পর্যবেক্ষণ। লেখকের মনের ও মননের অভিঘাতের নথি। কিন্তু সর্বোপরি লেখকের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি। সেই দৃষ্টির মধ্যেই নিহিত এই বইটির অভিনবত্ব। ‘উন্নয়ন ফিরে দেখা’য় পড়ি,
বিংশ শতাব্দীর আগে বৈজ্ঞানিক চিন্তার দুটো ধারা। একটি ধারায় পৃথিবীকে সম্পূর্ণ সুগঠিত বিকাশহীন যন্ত্র হিসাবে দেখা হয়। আর দ্বিতীয় ধারায় মনে করা হয় জগৎ অসম্পূর্ণ ও বিকাশমান এক প্রক্রিয়া। প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিতে জগতকে খণ্ড খণ্ড করে বিশ্লেষণ করা হয়। এই ধারণায়, জড়বস্তু ও প্রাণীজগৎ নিয়ে সমগ্র বিশ্বচরাচর অগণন খণ্ডে বিভক্ত। খণ্ডকে জানা হলেই, খণ্ড সমন্বয়ে তৈরি সমগ্রকেও আপনা আপনি জানা যাবে। দ্বিতীয় ধারণায় বিশ্বচরাচর সমগ্র হিসাবেই অভিব্যক্ত। খণ্ডের গাণিতিক যোগফল সমগ্রের রূপ ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। এই চিন্তা চেতনায়।...
সমগ্র জগৎ একটি সংগঠন। সংগঠনের মধ্যেকার বস্তুসমগ্রের পারস্পরিক আকর্ষণ-বিকর্ষণ, আদান-প্রদানই এই সংগঠনের চালিকাশক্তি। এই বোধে যদি নিজেদেরকে শিক্ষিত করতে পারতাম তাহলে বস্তুজগতের কোন সমস্যা বা তার সমাধানসূত্রকে এক সামগ্রিকতার দৃষ্টিতে দেখতাম। অরণ্য তখন আর শুধুই কাঠের জোগানদার নয়। গাছ মানে কাঠের কুইন্টালের হিসেব নয়। আমরা দেখতে পেতাম কিভাবে গাছ শিকড়বাকড় প্রসারিত করে টপ সয়েল ইরোশন হতে দেয় না। আমরা সম্পর্ক খুঁজে পেতাম বনাঞ্চলের সঙ্গে বৃষ্টিপাতের। মাথার ভেতর কাজ করত আমার শ্বাস নেওয়ার সময় প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কমে যাবে বৃক্ষ যদি অবলুপ্ত হয়। আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার চারপাশের গাছপালা, পশু পাখি নদী— সবায়েরই মধ্যে শুধু যে এক সামগ্রিক সম্পর্কসূত্র আছে তাই নয়, এই জগতের ওপর তাদেরও আছে সমান অধিকার।
এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির জোরেই তিনি কৃষি আর কৃষিব্যবসার তফাৎ দেখতে পান। এই দৃষ্টিভঙ্গির জোরেই তিনি বুঝতে পারেন অরণ্যানি আর শুষ্কং কাষ্ঠং-এর মধ্যে সাংগঠনিক তফাৎ কি। তিনি বুঝতে পারেন একটা নদীর মৃত হয়ে যাওয়ার অর্থ কি।
এই সামগ্রিক সম্পর্কসূত্রের জোরেই তিনি তাঁর লেখাগুলোতে ব্যষ্টি দিয়ে শুরু করে দেখতে দেখতে সমষ্টিতে পৌঁছে যান। ‘উন্নয়ন—ফিরে দেখা’য় লেখার শুরু হয় পুরুলিয়ার ১ নং ব্লকের চাকলাতোড় গ্রামের ৬২ বছর বয়সী জনৈক মৃগেন্দ্র সিংহর মৃত্যুর কথা দিয়ে। মৃগেন্দ্র সিংহ ও তাঁর পরিবারের জীবনসংগ্রামের আনুপূর্বিক বিবরণ দিয়ে তিনি চলে যান অনাহার ও সরকারি অনুদানের গল্পে। সেখান থেকে বড় বড় জলাধার ও বড় বড় বাঁধের কথায়, সেখান থেকে হেক্টরের পর হেক্টর চাষের জমি নষ্ট হয়ে যাবার কথায়, সেখান থেকে উচ্চ ফলনশীল বীজ, অজৈব ও রাসয়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কথায় এবং জমিহারা হয়ে কয়েক কোটি মানুষের উচ্ছেদ হয়ে যাবার কথায়। এইভাবে ব্যষ্টি থেকে সমষ্টির দিকে ক্রমাগত তাঁর রচনা এগিয়ে চলতে থাকে।
এরই উলটো পিঠে আছে তাঁর খণ্ড থেকে অখণ্ডে যাবার প্রক্রিয়া। দেশ নিয়ে আমরা সবাই ভাবি, প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়ও তাই ভাবেন। কিন্তু আমাদের বেলায় আমরা যখন লিখতে বসি, তখন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে মনোনিবেশ করি, অর্থাৎ একটি খণ্ডে মনোনিবেশ করি। সেটা কখনো উন্নয়ন, কখনো মানবিক অধিকার, কখনো জলবায়ু পরিবর্তন, কখনো জলসংকট, কখনো সংবাদমাধ্যম, কখনো কোনো সমসাময়িক ঘটনা, কখনো লোকসংস্কৃতি, কখনো কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, কখনো আসাম, কখনো গুজরাট, কখনো কাশ্মীর। এবং কদাচিৎ সেই খণ্ডের ধারণা থেকে সমগ্রের ধারণার দিকে যাবার চেষ্টা করি, কারণ এক, খেই হারিয়ে যাবার ভয়; কারণ দুই, সমগ্রের ধারণাটাই আমাদের পরিষ্কার নয়। তাই আমরা যদি উন্নয়ন নিয়ে লিখি, চেষ্টা করি সেই বিষয়টাকেই নানাদিক থেকে খুঁড়ে দেখার, তার মধ্যে লোকসংস্কৃতিকে সহসা টেনে আনি না। যদি মানবিক অধিকার নিয়ে লিখি, তার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনকে সহসা টেনে আনি না। যদিও ভালো লেখা দাবি করে বহুমাত্রিকতা ও বহুস্তরীয়তা, নানা বিষয়ের আন্তঃসম্পর্কে যা তৈরি হয়। সামগ্রিক সম্পর্কসূত্রকে জানেন বলে প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের সেই ক্ষমতা অধিগত। তাই খণ্ড থেকে অখণ্ডের বা সমগ্রের দিকে তাঁর নির্ভয় যাত্রা। তিনি যেমন শব্দতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতির দিক থেকে একটা বিষয়কে খুঁড়ে দেখতে জানেন, তেমনি জানেন অন্য যে কোনো বিষয়ের সঙ্গে অনায়াসে সেই উদ্দিষ্ট বিষয়ের যোগসাধন করতে।
প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় লেখক হিসেবে এখনো সমান সক্রিয়। আশা করা যায় তাঁর এযাবৎ প্রকাশিত হওয়া প্রবন্ধগুলির আর একটি সংকলন ভবিষ্যতে আমরা বের করতে পারব। যতদিন সেটা না পারছি, পাঠকের জন্য এই উপহার।
৪ মার্চ ২০২৩
জোবেদা বিবি বেঁচে গেলেন । অন্তত আরও কয়েক দিনের জন্য তো বটেই । হতদরিদ্র এই প্রৌঢ়া আশা করা যায় যতদিন না দুর্ঘটনাজনিত আঘাত কাটিয়ে উঠবেন ততদিন হাসপাতলে দুবেলা খেতে পাবেন । সঙ্গী ক-জন মারা গেছেন । এ -দফায় গুণতিতে ছ-জন। স্বাভাবিক মৃত্যু। রাস্তা উঁচু করতে জমা করা হয়েছিল ঘেঁস। আর ওই ঘেঁসের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে কেটে এগোতে থাকেন জোবেদা বিবিরা। কয়লা খোঁজেন। সেই কয়লা জমা করে বস্তাবন্দি হয়ে নিম্ন অথবা নিম্ন মধ্যবিত্তদের বাড়ি যায়। দুপক্ষেরই সুরাহা। যদিও পরিমাণ যৎসামান্যই। এরই মধ্যে জোবেদা বিবিদের আবার কয়লা সংগ্রহের জন্য ‘তোলা’ও দিতে হয়।
জোবেদা বিবিরা এখন আমাদের অসুখী করে না। নাগরিক জীবনে অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠার নানাবিধ উপচার সযত্নে সাজানো চারিদিকে। সুখ আজ সান্ত ব্যক্তি নিরাপত্তার পক্ষপুটে। স্থানচ্যুতির বিরোধী সে, নিরাপত্তা প্রয়াসী।
অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। বরং অবকাশ করে নিয়ে ভাবার ছিল জোবেদা কত সহস্র জন। চেনার কথা ছিল জোবেদা বিবিদের।
দুর্ঘটনা যখন ঘটে জোবেদা বিবি তখন প্রৌঢ়া। আমরা কি জানি জোবেদা বিবি যখন বিবি না হয়ে শুধুই ছিলেন জোবেদা অথবা যখন বিবি হয়ে নতুন ঘরে এসেছিলেন তখন তিনি কেমন ছিলেন? শৈশব কৈশোর অথবা যৌবন কত দ্রুত অতিক্রম করে প্রৌঢ়ত্বে স্থিত হন জোবেদারা। ফেলে আসা অন্যান্য ধাপ কতটুকু রেখাপাত করে তাঁদের জীবনে! অথবা দীর্ঘ প্রায়ান্ধকার এক জীবনছায়া প্রলম্বিত হয়ে অধিকার করে রাখে যা শুধুই প্রৌঢত্ব।
প্রৌঢ় প্রৌঢ়া ইত্যাদি শব্দ বড় বেশি পীড়িত করে আমাদের। কেননা প্রৌঢ় অথবা প্রৌঢ়া শব্দ নিজেই নিজ ভারে আক্রান্ত। সামাজিক অস্তিত্বের নিরিখে খুব কম সময়েই সে প্রচলিত অর্থের বাইরে নতুন কোনো অর্থ বহন করতে পারে । ঘোচাতে পারে ক্লান্ত জড় এমনতর সব অনুষঙ্গ।
শব্দের এই অনুষঙ্গ কি আমাদের সামগ্রিক জীবনাচরণেরও অনুষঙ্গ হয়ে উঠছে? তাই যদিও বিশ্বাস নেই পুনর্জন্মে; অথবা জন্মান্তরের কর্মফলে, দাবি করি বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ সচেতনতার তবুও আমাদের মধ্যে জোবেদারা নেই, থাকে না । আসে, হারিয়ে যায়। মিলিয়ে যায় অগোচরে সাবান জলে সৃষ্ট বুদবুদের স্থায়িত্ব নিয়ে।
অথচ বিশ্বাস কর্মে ও সংগ্রামে।
যে ঘটনায় জোবেদা বিবি বেঁচে রইলেন অথবা আর ছ’ জন মারা গেলেন এমন ঘটেই থাকে। এমনভাবে যে কত জায়গায় কতজন প্রাণের অন্বেষণে প্রাণ হারান সে হিসাব বোধহয় আজ আর আমরা তেমনভাবে মনে রাখি না । হিসাব অবশ্যই থাকে কোথাও, জমাও হয়, তবে সরকারের কাছে জন্ম-মৃত্যু তালিকা খাতায় সংখ্যা তথ্যের কিছু হেরফের হয় মাত্র।
আমাদের কাছে কি তাই! নাকি অন্য কোনো এক ধরনের হেরফের, যেখানে মৃত্যুকেই বেঁচে যাওয়া ধরে নেওয়া হয়। ধরে নেওয়া হয় দীর্ঘ অর্থহীন এক জীবন বয়ে নিয়ে যাওয়ার হাত থেকে মুক্তি। সমার্থক হয়ে ওঠে জীবন মৃত্যু ও মুক্তি ।
অথচ বিশ্বাস মৃত্যুতে নয় জীবনে।
জানুয়ারি, ১৯৮৮
এই জুলাইয়ের (২০০৯) শেষ সপ্তাহে খেতে না পেয়ে মারা গেলেন মৃগেন্দ্র সিংহ। পুরুলিয়ার ১ নং ব্লকের চাকলাতোড় গ্রামের ৬২ বছর বয়সী মানুষটি কায়িক শ্রম করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন প্রায় বছর দশেক। কাজ করতেন রাঁধুনি বামুনের। পরিবারের সদস্য-সংখ্যা ৮। স্ত্রী বাসন্তী দেবী আর দুই ছেলে ভোলানাথ আর মৃন্ময়। ছেলেরা বিবাহিত। তাদেরও একটি করে শিশুসন্তান। দুই ছেলেই কাজ করেন জামশেদপুরে, রাঁধুনির জোগাড়ে। জমিজমা যেটুকু ছিল আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে পেটের জ্বালায়। ছেলেদের রোজগারে বউ-শিশুদের খাইয়ে নিজেদের খাওয়া আধপেটা-সিকিপেটা, কখনও তাও জুটত না। গেছেন পঞ্চায়েত সদস্যের কাছে, দেখা করেছেন গ্রাম পঞ্চায়েত আর ব্লক অফিসে। কিন্তু সংস্থান হয় নি খাদ্যের। মাঝে মাঝে খাওয়া অবশ্য জুটতো। আত্মীয় প্রতিবেশীরা যেমন যেমন দিতেন। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে পঞ্চায়েত ছিল বামফ্রন্টের, এখন কংগ্রেসের।
মৃগেন্দ্ররা অনাহারেই মারা যান। ভারতে কমবেশি ৩০ কোটি মানুষই থাকেন অর্ধাহারে, না খেয়ে। সরকার যারা পরিচালনা করেন, তারা বলেন কোথাও কোন খাদ্যাভাব নেই। কোন মানুষেরই নাকি না খেতে পেয়ে মারা যাওয়ার কথা নয়। অনেক অনেক সব প্রকল্প আছে দরিদ্র মানুষজনের জন্যে - অন্নপূর্ণা, অন্ত্যোদয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। বার্ধক্য ভাতাও আছে। অবশ্য মৃগেন্দ্র সিংহ বা তার পরিবারের মানুষজন এসব কিছুই পাননি। তাদের বিপিএল কার্ড নেই, বার্ধক্য ভাতা নেই। ছোট ছোট দুটো কুঁড়েঘরের একটা ধ্বসে গিয়েছিল আগের বর্ষায়, তবু ইন্দিরা আবাস যোজনায় তিনি উপযুক্ত বিবেচিত হননি।
এবং মৃগেন্দ্র সিংহ মারা গেলেন। মৃতের সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ নিশ্চয়ই অনাহার ছিল না। অন্য কোন ভারি অসুখের নাম ছিল। এলাকার মানুষেরাই শুধু জানেন, স্পষ্ট করেই জানেন, মৃগেন্দ্র মারা গেছেন, অনাহারে।
কিন্তু মৃগেন্দ্র যখন বেঁচে ছিলেন, তখন মৃগেন্দ্রদের কেনইবা বেঁচে থাকতে হত অন্যের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর! মৃগেন্দ্ররা আত্মসম্মান নিয়ে নিজেদের শ্রমে বেঁচে থাকাটা উপভোগ করতে পারছেন না কেন? কি আমরা ভাবলাম, কেমন করেই বা ভাবলাম নিজেদের দেশ গড়ে তোলার কথা, যেখানে দরিদ্র মানুষ সঙ্গতি হারিয়ে হয়ে গেলেন অনুদান নির্ভর! কখনও এই অনুদান রাষ্ট্রের কখনওবা দেশি-বিদেশি সরকারি-বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠান বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের!
২
খরা দুর্ভিক্ষ আমরা পেয়েছি। হাজার হাজার মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেছেন আমরা দেখেছি। আমরা জেনেছি আমাদের দেশের, বাংলার সরল সাদাসিধে পরিশ্রমী নির্বিরোধী গরিব মানুষেরা পঞ্চাশের মন্বন্তরেও মিষ্টির দোকানের সামনে না খেয়ে মরেছেন তবু দোকান লুঠ করেননি। লুঠ করা তাঁদের জীবনবোধে নেই, তাঁদের জীবনচর্যায় নেই। বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরোধিতায় সামনের সারিতেই ছিলেন এইসব মানুষজন। একা এসেছেন, উঠে এসেছেন তাঁদের গ্রামসমাজ, আত্মীয়-পরিজন নিয়ে।
বৃটিশ শক্তিকে ভারত থেকে চলে যেতে হল। যারা ক্ষমতায় এলেন তাঁরা দেশকে আর্থিক স্বাবলম্বী করার কথা বললেন। দেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, মানুষজনের চলার ধরন এঁরা একেবারেই জানতেন না এমন নয় কিন্তু স্বাবলম্বনকে দেখলেন পশ্চিমী দুনিয়ার চোখ দিয়ে। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন বলতে ভাবলেন, পশ্চিমের সচ্ছলতা। এবং সেই পথটিকেই অনুসরণ করলেন।
সেসময় ইউরোপ আমেরিকাই হোক বা সোভিয়েট ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী সমাজ—সবাইয়েরই কৃষি উন্নয়ন ভাবনায় ছিল খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্যে জমিতে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত সেচব্যবস্থা চালু করার প্রয়োজনীয়তা।
এই তাগিদ থেকেই নাকি আমেরিকায় কলোরাডো নদীর ওপর গড়া হয়েছিল বিশাল হুভার বাঁধ। ১৯৩৫ সালের কথা। বৃহৎ থেকে সুবৃহৎ নির্মাণ শিল্পের গোড়ার সময়। উদ্বোধনে এসে তদানীন্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট জানিয়েছিলেন,“এলাম, দেখলাম, নত হলাম।” বাঁধের উচ্চতা ছিল ২২১ মিটার। সিমেন্ট মাটি পাথরের প্রকাণ্ড দানবাকৃতি সেই বাঁধ। স্থপতি জানিয়েছিলেন, সব ধরনের অলংকরণ ছেঁটে ফেলে বাঁধ নিরাভরণ করে দাও। স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে দাও এর বিপুলায়তন মহাশক্তিময় জমাট বাঁধা আকার। তখন বাঁধ ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির প্রতীক, দেশাত্মবোধের পরিচায়ক, প্রযুক্তিবিদ্যার প্রাধান্যকারী মতাদর্শ। প্রতিষ্ঠিত হল প্রকৃতির ওপর প্রভুত্বের বিস্তার।
বাঁধ তো হল। কিন্তু একই সঙ্গে শেষ হয়ে যেতে থাকল নদীর প্রবাহমানতাও। ১৯৬০ সালের পর থেকে কলোরাডো নদী মাত্র কয়েক বারই, প্রবল বন্যার বছরে সাগরে মিশেছে। মোহনা অঞ্চল হয়ে উঠল যাবতীয় নোংরা ও ক্ষেত থেকে পেস্টিসাইড ধোয়া জলের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু জলমগ্ন এলাকা। মোহনা অঞ্চলের বর্ণনা দিয়েছেন রাসেল ফ্লেমিং তাঁর ‘মিরাজ’ গ্রন্থে। বই আরম্ভই করেছেন এই বলে— ম্যাপ মিথ্যে।
সীমান্তঘেঁসা সান লুইস শহরের পশ্চিমে মাইল খানেক দূরে, অ্যারিজনার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের সেচসেবিত এক গমক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসের এক ঘর্মাক্ত দুপুরে এই কথাটাই আমার মধ্যে বেজে উঠল। বাঁ দিকে মাত্র কয়েক গজ দূরেই জং ধরা কাঁটা তারের বেড়া। বেড়ার ওপাশেই সান লুইস রিও কলোরাডোর রাস্তা বাড়ি ঘর। মেক্সিকোর সনোরার চতুর্থ বড় শহর। সেই শহরের কদর্যতম অংশ এই সীমান্ত অঞ্চল, যদিও গোটা দেশটা ছবির মত।
কাঁটাতার বরাবর মানুষজন চলাফেরা করছিলেন। তাদের কেউ কেউ, উত্তর আমেরিকার এই মরুভূমির মধ্যে, খুনী সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ভবঘুরে মানুষটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেনও। আমার নিজের মনোযোগ ছিল অবশ্য অন্যদিকে। ইউ-এস জিওলজিক্যাল সার্ভের টপোগ্রাফিক ম্যাপের, গ্যাসডেন চতুর্ভূজের দিকে তাকিয়েছিলাম। ম্যাপ অনুযায়ী আমি দাঁড়িয়ে আছি এমন এক জায়গায় যেখানে পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত নদী কলোরাডো ইউনাইটেড স্টেটস ছেড়ে মেক্সিকোতে ঢুকেছে। ম্যাপে ঘন নীল রঙে চিহ্নিত নদী যেন এক ফালি জমি। মাত্র শ’খানেক ফুট দূরে। আমি কিন্তু দেখছি একটা সরু সিমেন্ট বাঁধানো নালা। প্রায় ১২ ফুট গভীর সেই নালা দ্রুত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে গাঁজলা মেশানো চায়ের ঘন লিকার-রঙ জল। ওই নালার ওপারে, যেখানে নদী থাকার কথা সেখানে শুধুই বালি আর বালি।
লেখক রাসেল ফ্লেমিং এর পর জানাতে থাকবেন তাঁর নদী বাঁধ পরিক্রমার কথা। বাঁধের জন্য ক্ষেতের পর ক্ষেত কর্দমাক্ত হয়ে বন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার কথা। জানাবেন সয়েল স্ট্রাকচার নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। শুধু আমেরিকাই নয়, পরিক্রমা তার বিশ্বজুড়ে। সানফ্রানসিস্কোর সিয়েরা ক্লাব বুক প্রকাশিত ‘মিরাজ’ গ্রন্থে তারই দীর্ঘ বিবরণ। এবং আরম্ভকালেই কলোরাডো নদীর মোহনা নিয়ে লেখক আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবেন, বলবেন, জায়গাটা এককালে অন্য রকম ছিল। জল ছিল ভালো।
পর্যাপ্ত জল নিয়ে আর এক লেখক প্যাট্রিক ম্যাককুলি আমাদের জানিয়েছেন, নদী-বাঁধ সারা বিশ্বজুড়ে কী তাণ্ডবলীলাই না চালিয়েছে! ভেঙে যাওয়া জলাধারসৃষ্ট প্লাবনে কেমনভাবে ভেসে গেছে গ্রামের পর গ্রাম, মানুষ হারিয়ে গেছে গোটা জনপদ নিয়ে, লবণাক্ত হয়ে গেছে হাজার হাজার একর চাষজমি, নিশ্চিহ্ন হয়েছে বনভূমি। বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন তার গ্রন্থে—দ্য সাইলেন্সড রিভার। ভয়ে ক্রোধে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয় যখন ওরিয়েন্ট লংম্যান প্রকাশিত সেই বইয়ে ম্যাককুলি সমসাময়িক ইতিহাস থেকে তথ্য হাজির করে দেখান বাঁধ নির্মাণ আসলে এক শক্তি প্রদর্শন। প্যাট্রিক ম্যাককুলিও আমাদের জানাবেন, বইয়ের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে, নদীদের হারিয়ে যাওয়ার কথা, গভীর বিষণ্নতার এক কথা। পৃথিবীর বিপন্নতার কথা। পৃথিবীকে বিপন্ন করার কথা।
একসময় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকেও স্বীকার করতে হল বৃহৎ বাঁধের ক্ষতিকর দিকের কথা। ১৯৯৪ সালের ১৮ মে বুলগেরিয়ায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশন্যাল কমিশন অন ইরিগেশন অ্যান্ড ড্রেনেজের সভায় ইউ এস ব্যুরো অফ রিক্লামেশনের কমিশনার ড্যানিয়েল পি. বার্ড জানালেন,
আমরা নির্মাণ করেছি হুভার, গ্লেন ক্যানিয়ন সহ বহু বহু বাঁধ। বাঁধ নির্মাণ ক্ষেত্রে সৃজনশীল নির্মাণশৈলী আমাদের গর্বের বিষয়। ... বিগত সময়কাল ধরে আমাদের উপলব্ধি, পরিকল্পনার এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দরকার। ... মাটিতে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি, মাছচাষের হ্রাস বা বিলুপ্তি, দেশজ কৃষ্টির অবলুপ্তি, জলাধারে পলি সঞ্চয়, বাঁধের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া এমন সব ক্ষতিকারক প্রভাব টের পেয়ে ধীরে ধীরে গত দু দশকে আমরা বুঝেছি, উপলব্ধি করেছি এর ভয়াবহতা... ফলে আমেরিকায় বৃহৎ বাঁধ তৈরির আমল শেষ হতে চলেছে। ... বৃহৎ প্রকল্পের পক্ষে এখন না আছে জনসমর্থন, না রাজনৈতিক সমর্থন। আমরা উপলব্ধি করেছি, বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ ছাড়াও জলসম্পদ উন্নয়নের বহুবিধ পন্থা আছে। সেই বিকল্প ব্যবস্থায় ব্যয় অনেক কম। পরিবেশের স্বার্থও সুরক্ষিত হয়। আমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় জল সংরক্ষণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রাধান্য লাভ করবে, জল প্রকল্পের জন্য বৃহৎ নির্মাণ প্রকল্প নয়। এর মানে এই নয় যে আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থাটি আর থাকবে না। আমরা বর্তমান পরিকাঠামোয়, সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই অতিরিক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নির্মাণ কাজের ওপর জোর দেব। কিন্তু আমাদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য কখনই বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট কাজের ওপর জোর দেব না...
ড্যানিয়েল পি. বার্ডের ইন্টারন্যাশনাল কমিশনে পেশ করা বক্তব্যের একটা মূলানুগ অনুবাদ করেছিলেন জয়হিন্দ বসু কালধ্বনি পত্রিকার ২০০০ সালের অক্টোবর সংখ্যায়। গোটা বক্তব্য থেকে খুব পরিষ্কারভাবেই একটা কথা বের হয়ে আসে যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বড় বাঁধ তৈরি করাকে আর উন্নয়ন বলে ভাবে না। ইউরোপ আমেরিকার জ্ঞানচর্চার অনুসারী হয়েও বড় বড় দানবাকৃতি বাঁধ নির্মাণে আমাদের স্পর্ধা আর গর্ব খুঁজে পাই।
৩
নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সেচব্যবস্থা। প্রয়োজন প্রচুর জলের। প্রয়োজন জলাধারের। প্রয়োজন বাঁধের। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নেহরুর কাছেও বাঁধ ছিল ‘বিস্ময়কর, প্রাণবন্ত ও উত্তেজনাময়’। এমনভাবেই তিনি বর্ণনা করেছিলেন ১৯৫৪ সালে ভাকরা বাঁধের নাঙ্গাল খাল উদ্বোধনে এসে। বলছেন, ‘কি পরমাশ্চর্য দর্শনীয় কাজ - এই কাজ হাতে নিতে পারে একমাত্র সেই জাতি যার আছে সততা আর নির্ভীকতা, একটা জাতির শক্তি, প্রতিজ্ঞা ও সাহস নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প’।
দোদুল্যমানতা অবশ্য এসেছিল, সন্দিহানও হয়েছিলেন। কেননা পরবর্তী সময়ে সেচ ও বিদ্যুতের কেন্দ্রীয় বোর্ডের সভায় আমরা তাঁকে বলতে শুনলাম, ‘আমরা দেখাতে চেয়েছি বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ করতে পারি, বৃহৎ সুবৃহৎ উৎপাদন করতে পারি, কিন্তু এই যে বৃহৎ দেখনদারি সংস্থা, বৃহৎ কর্ম - তা মোটেই গ্রহণযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি নয়।’
বললেন বটে এই কথা, কিন্তু বড় বাঁধ নির্মাণ থেমে গেল না। হাল আমলেও নর্মদার উপর গড়ে উঠেছে বা উঠতে চলেছে একের পর এক বাঁধ, সর্দার সরোবর, নর্মদা সাগর। ১৩৫টি মাঝারি ও ৩০০০ ছোট বাঁধ। এখন তো আবার গঙ্গোত্রী থেকে ঋষিকেশ অবধি গঙ্গার ওপর ১৮টি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রূপায়িত হচ্ছে।
আমরা বুঝতে চাইছি না যে, নদীমাতৃক এই দেশে, নদী কোন বিচ্ছিন্ন জলপ্রবাহ নয়। আরো অনেক নদী, শাখানদী উপনদী সেচখাল নিয়ে বিস্তীর্ণ অববাহিকা জুড়ে তার নিবিড় ভরা সংসার। এক প্রবাহ রুদ্ধ হলে গোটা সংসারই বিপর্যস্ত হয়ে যায়। এটা তো সমাজ-সংসারেরও কথা।
গঙ্গার সংসারের কথাও তো তাই। কেমন এই সংসার! ভাগীরথী অলকানন্দা মন্দাকিনী ধৌলীগঙ্গা পিণ্ডার হিমবাহের ধারায় সমৃদ্ধ হয়ে হাজার মাইল পথ উজিয়ে বিহারের মহারাজপুর হয়ে রাজমহল পাহাড়কে ডাইনে রেখে গঙ্গার এক ধারা গেল বাংলাদেশে, অন্য আর এক ধারা এল আমাদের এই বাংলায়। বিভাজিত হওয়ার আগে মূল স্রোতধারায় মিশেছে যমুনা ৮৬০ মাইল পথ অতিক্রম করে। রামগঙ্গা ৪২৮ মাইল, ঘর্ঘরা ৬০০ মাইল, শোন ৪৮৭ মাইল, গণ্ডক ২৬৩ মাইল, বুড়িগণ্ডক ৩৭৮ মাইল, কোশি ৪৫০ মাইল পথ পেরিয়ে এসেছে। কেউ এসেছে নেপাল থেকে, কেউবা বিন্ধ্যপ্রদেশ হয়ে। উৎস থেকে সাগর, ১,৫৫৭.১৫ মাইল এই নদীর অববাহিকা অঞ্চল বিস্তৃত দিল্লি উত্তরপ্রদেশ হিমাচলপ্রদেশ পাঞ্জাব হরিয়ানা রাজস্থান মধ্যপ্রদেশ বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। প্রায় ৩,৩২,৫৮৯.৭ বর্গমাইল। নেপালের ঘর্ঘরা কোশী গণ্ডকের অববাহিকা অঞ্চল ৭, ৩৩৫৯.৩৫ বর্গমাইল। বাংলাদেশের মহানন্দা অববাহিকা অঞ্চল ৩,৪৭৫ বর্গমাইল। সব মিলিয়ে ৪,০৯,২৬৮ বর্গমাইল। এই প্রবাহ, এই অববাহিকা ঘিরেই তো সুপ্রাচীন আমার সমাজ-সভ্যতা-কৃষ্টির বিকাশ, আমাদের যাপনের নিজস্বতা।
বাঁধ দিয়ে বেঁধে দিলাম আমার আপন নদী। জলাধারে ডুবিয়ে দিলাম বনাঞ্চল। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ উৎখাত হয়ে গেলেন তাদের বাসভূমি থেকে। অববাহিকা অঞ্চল শূন্য করে দিলাম। এবার গাছের পাতায় ধাক্কা না খেয়ে, বৃষ্টির ফোঁটা সরাসরি নেমে আসছে মাটিতে। লতাগুল্ম আর গাছের শিকড়বাকড় আঁকড়ে ধরে রাখতে পারছে না মাটি। অসংখ্য নালা পথে বাধাহীন জলস্রোত ওই পলি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে নদীতে। মাটির উপরিতল ধুয়ে যাচ্ছে। ১ মিমি মাটির আস্তরণ তৈরি হতে সময় লাগে প্রায় ১০০ বছর!
বাঁধ দেওয়ায় সেচযোগ্য জমি প্রথমে বাড়লেও পরে কর্দমাক্ত হয়ে জমির পর জমি চাষের অনুপযোগী হয়ে গেছে। ২০০০ সালের শেষ দিকে প্রকাশিত হয়েছিল একটি রিপোর্ট, ‘ওয়ার্ল্ড কমিশন অন ড্যাম’। সেই রিপোর্টের ভারত বিষয়ক অধ্যায়ে বলা হয়েছে, বাঁধের জন্য খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে শতকরা ১০ ভাগ। আবার মিনিস্ট্রি অফ ফুড অ্যান্ড সিভিল সাপ্লাই-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে খাদ্যশস্যের শতকরা ১০ ভাগ নষ্ট হয়, খাদ্যশস্য ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না বলে। তার মানে, বাঁধের জন্য যে উৎপাদন বাড়ল, তা নষ্ট হল রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। এবং বড় বড় ৩৫০০-৩৬০০ বাঁধ নির্মাণে জলের তলায় তলিয়ে গেল ৫০ লক্ষ হেক্টর বনভূমি, চাষের জমি ও অন্যান্য পতিত জমি এবং ১ কোটি হেক্টর জমি হয়ে গেল কর্দমাক্ত ও লবণাক্ত। জমিহারা হয়ে কতজন উচ্ছেদ হলেন তার সঠিক হিসাব কোথাও লিপিবদ্ধ করা হয়নি, প্রয়োজনই বোধ করেননি কেউ, তবু সংখ্যার হিসেবে অন্তত ৩ কোটি ৩০ লক্ষ থেকে ৪ কোটি মানুষ। এমনটিই জানিয়েছেন, অরুন্ধতী রায় কেমব্রিজে ‘কস্ট অফ লিভিং” শীর্ষক বক্তৃতায়।
সেচের পরপরই এল উচ্চ ফলনশীল বীজ (এইচ-আই-ভি থেকে জি-এম), রাসায়নিক সার, হারবিসাইড, ইন্সেক্টিসাইড ও পেস্টিসাইড। এইসব ব্যবহার করতে করতে চাষের খরচ যেমন বেড়ে গেল, তেমনি বদলে গেল মাটির ‘ক্লে’ স্ট্রাকচার। মাটির জলধারণ ক্ষমতা কমে গেল। নিচের মাটি হয়ে উঠল শক্ত। জমি হারাল তার উর্বরতা শক্তি। ফলত কিছু জমি যেমন অনাবাদি থেকে আবাদি হল, তেমনই আবাদি জমিও পতিত হয়ে গেল। সেচজমিও তেমনভাবে কিছু বাড়ল না আবার অন্যদিকে বেড়ে গেল জমি-প্রতি উৎপাদন-খরচ। এক বিঘে জমিতে আগে যা রোজগার হত, টাকার হিসাবে তা হয়ত বেড়েছে, কিন্তু সমস্যা হল, আগে যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে হত, সেই বিনিয়োগ টাকার অংকে অনেকটাই বেড়ে গেল। বেড়ে গেল অসুখ বিসুখ এবং চিকিৎসা খাতে সরকারি পরিষেবা কমে যাওয়ায় পরিবারের খরচ বেড়ে গেল অনেক। সঙ্গে যুক্ত হল ভোগ্যপণ্যের বর্ধিত চাহিদা।
উচ্চ প্রযুক্তির চাষে প্রয়োজন অফুরান জলের। হাত পড়ল ভূগর্ভস্থ জলে। নাসার সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ২০০২ থেকে ২০০৮ সালের এই ছ’বছরে উত্তর ভারতের জলস্তর প্রতি বছর প্রায় ১ ফুট করে নেমে গেছে। এই অবস্থা নয়াদিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, রাজস্থান ছাড়াও একাধিক রাজ্যে। এই সব রাজ্যে চাষ ও অন্যান্য দৈনন্দিন কাজের জন্যে ওই ছ’বছরে প্রায় ১০৯ ঘন কিলোলিটার জল তুলে নেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে ওইসব এলাকার প্রায় সাড়ে ১১ কোটি মানুষকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হবে। কৃষিজ পণ্যের উৎপাদনও ব্যাপক হারে কমার সম্ভাবনা। কমবে পরিবহণযোগ্য জলের পরিমাণও। ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গও নয়। এখানে জলের প্রয়োজন মেটাতে বিদ্যুৎচালিত গভীর নলকূপের সংখ্যা ১ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। অগভীর নলকূপের সংখ্যা ৬ লক্ষেরও বেশি। জলস্তর নেমে গেছে হুহু করে। ভূগর্ভস্থ জল বিষাক্ত হয়েছে আর্সেনিকে। মালদহ থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগণা, বিভিন্ন জেলায় প্রায় ২ কোটি মানুষ আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত।
একই সঙ্গে অজৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহারে হারিয়ে যেতে থাকল শাকপাতা, মূল, চুনো, চিংড়ি, আমাছা। আগে গ্রামের মানুষজনের পুষ্টির একটা বড় অংশই আসত এইসব থেকে। ধানখেতের চিংড়ি আর পাওয়া যায় না। বাড়তে থাকল অপুষ্টি। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের তৃতীয় রাউন্ডের সমীক্ষায় (২০০৫-০৬) জানা গেল, ভারতের শিশুদের অর্ধেকই অপুষ্টিতে ভোগে। ৬-৩৫ মাস বয়সের শিশুদের মধ্যে রক্তাল্পতায় ভোগে ৭৯ শতাংশ। ১৯৯৯-২০০০ সালের সমীক্ষায় এই সংখ্যা ছিল ৭৪ শতাংশ। বিবাহিত মহিলাদের রক্তাল্পতাও এই সময়কালে বেড়ে হয়েছে ৫২ থেকে ৫৮ শতাংশ।
৪
যে পথ অনুসরণ করে দেখা গেল খাদ্য মানুষের কাছে সহজলভ্য হল না এবং সেচের জন্যে বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে ক্ষতিই হল, ক্ষতি হল চাষের, নদীর সে পথের মূল্যায়ন আমরা করলাম না।
মূল্যায়ন না করার অন্যতম একটা কারণ, আমাদের দেশে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অবস্থান। এদের একটা বড় অংশই স্কুল, কলেজ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবী। ছোট ব্যবসায়ী বা শিল্পোদ্যোগী মানুষজন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও শিল্প বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এদের সংখ্যাও বেড়েছে। এবং এই সব পরিবারের যুবক ও ছাত্রদের একাংশ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন।
এরা - শিক্ষক, চিকিৎসক, যন্ত্রবিদ, বিজ্ঞান গবেষক, আমলা, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যে সম্প্রদায় সেই সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত। এই সম্প্রদায়ের রোজগার ও সামাজিক মর্যাদা, দুই-ই বেশি। জনমত প্রভাবিত করতেও এরা বেশ দক্ষ। এই সব মানুষজন যখন রাজ্যপাট পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত হন, রাষ্ট্রনৈতিক নীতি নির্ধারকের ভূমিকায় আসেন তখন, গ্রাম ও গ্রাম সমাজকে এরা মানসিক ও ব্যবহারিক দিক দিয়ে বিবেচনার বাইরেই রাখেন। অর্থাৎ এক ধরনের এক্সক্লুশন বা বহিষ্কার পদ্ধতি। কারণ এরা জানেন, যেসব ভোগ্যবস্তু তাঁরা ব্যবহার করে আসছেন বা ব্যবহার করতে চান তা দেশের আপামর মানুষজনের কাছে লভ্য হতে পারে না। দেশে অত সম্পদই নেই।
গ্রাম-সমাজ বিচ্ছিন্ন এই মানসিকতায় দেশ গড়ার সমস্ত কর্মোদ্যম পরিচালিত হয় পশ্চিমী দুনিয়ার অন্ধ অনুকরণে সব কিছু ভোগ্যবস্তু এখুনি, এক্ষুনি করায়ত্ত করার প্রচেষ্টায় এবং এই বোধ ধারণ করা হল উন্নয়ন ভাবনায়। এদের ভাবনায় অনেক অনেক উৎপাদনই সমৃদ্ধির একমাত্র পথ। শিল্প কর্মোদ্যোগের দুয়ার খুলে দিলেই মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। আর এই কাজে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি জ্ঞান আনা হবে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে। যদিও মানুষ বলতে বাদ দেওয়া হল গ্রামীণ জনসংখ্যা।
উন্নয়ন সম্পর্কে এমনই এক ধারণার আধারে, বিশ্বপুঁজি অবাধে ঢুকে পড়ল আমার দেশে। পুঁজি এল সেসব দেশ থেকেই একদিন যেসব দেশ যন্ত্রপাতি নির্মাণ শিল্পে আলোড়ন এনেছিল। বৃহৎ থেকে সুবৃহৎ বাঁধ নির্মাণের জন্য যে প্রযুক্তি-বিদ্যা উদ্ভাবন করেছিল তারা, উৎপাদন করেছিল বৃহদাকার-দৈত্যাকার সব যন্ত্রপাতি, বাঁধ নির্মাণ যখন তারা পরিত্যক্ত ঘোষণা করল তখন আমার দেশকে তারা বেছে নিল তাদের প্রযুক্তি জ্ঞান ও যন্ত্রপাতি বিক্রির ক্ষেত্র হিসাবে। এবং আমার সেসব কেনার ক্ষমতাও তারাই জুগিয়ে দিল, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আই-এম-এফ, বা অন্যান্য বিনিয়োগকারী সংস্থা থেকে ঋণ দিয়ে। ইউরোপ-আমেরিকা নিজের দেশে পারমাণবিক তাপ বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দিল, নতুন কোন রিঅ্যাক্টর ইনস্টলেশন স্থগিত করে রাখল, কিন্তু আমাদের দেশে রপ্তানিতে সে ভয়ঙ্কর আগ্রহী হল।
৫
১৮ ডিসেম্বর ২০০৬ তারিখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি নতুন আইন প্রণয়ন করল -- ‘নিউ রিচ পলিসি’ (Registration, Evaluation and Authorisation of Chemicals, REACH) ২০০৬/২০০৭। তার ফলে ইউরোপে, ডাউ কেমিক্যালস, হেস্ট, বিএএসএফ, বেয়ারের মতো কোম্পানি যেসব রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন করত, সেইসব অনেক ব্যয়বহুল হয়ে গেল। ‘নিরাপত্তা ও পরিবেশ সুরক্ষা’ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ মানতে গিয়ে তার লাভ গেল কমে। শুধু তাই নয়, নতুন আইনে অনেক রাসায়নিক দ্রব্য আর উৎপাদন করাই যাবে না। সমস্যা তৈরি হয়েছিল অবশ্য তার আগেই।
ডাউ কেমিক্যালস উৎপাদন করত ‘সিলিকোন’। ব্যবহৃত হত ‘ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টেশন’এ, ‘স্তন পরিচর্যায়। পরে দেখা গেল, ‘সিলিকোন’ ব্যবহারে ক্যানসার হচ্ছে। দায়ের হতে থাকে একের পর এক মামলা। ১৯৯৫ সালে অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, ডাউ কর্নিংকে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে সরকারের কাছে বিশেষ রক্ষাকবচের আবেদন জানাতে হয় ডাউ কর্তৃপক্ষকে।
ডাউ উৎপাদন করত একটি কীটনাশক, ডারসবান। ১৯৯৫ সালেই এই কীটনাশকের বিষক্রিয়াজনিত অসুস্থতার ঘটনা ঘটে ২৪৯টি। কোম্পানিকে জরিমানা দিতে হয়, প্রায় ৩ কোটি টাকা (৭ লক্ষ ৩২ হাজার ইউ-এস ডলার)। পরে ২০০৩ সালে প্রায় ৮ কোটি টাকা (২০ লক্ষ ইউ-এস ডলার) ক্ষতিপূরণ দিতে হয় রাষ্ট্রকে।
এতসব রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি করতে যে প্রযুক্তিবিদ্যা আয়ত্ত করেছিল এইসব কোম্পানি তাতো ফেলে দেওয়া যায় না, সুতরাং এরা রাসায়নিক শিল্প গড়ে তুলল আমাদের মতো দেশে, আমার দেশে। প্রযুক্তিবিদ্যার নাকি বিস্ফোরণ ঘটবে আমার ভারতে। এখানে যে মানুষের দাম বড় কম!
কত কম? ভোপালের ইউনিয়ন কারবাইড কারখানায় মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস লিক করে (২-৩ ডিসেম্বর, ১৯৮৪; মাঝরাত) মারা গেলেন বহুসংখ্যক মানুষ। প্রথম ২-৩ দিনেই প্রায় ৭ হাজার। আজ অবধি কম করেও ২০ হাজার মানুষ। আর চিরকালের জন্য অসুস্থ হয়ে রইলেন কমবেশি ১ লক্ষ ১২ হাজার জন মানুষ। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর গ্যাস আক্রান্ত মানুষজনের স্বজন-পরিজনেরা অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন মাত্র ৫০০ ইউ-এস ডলার করে (আনুমানিক ২০ হাজার টাকা)। তাও সবাই নন। এই ইউনিয়ন কার্বাইডই পরবর্তীকালে অধিগ্রহণ ক’রে, ডাউ কেমিক্যালস। ২০০২ সালে ডাউ কেমিক্যালসের প্রধান জনসংযোগ অফিসার, কেথি হান্ট বলেন, ‘ভারতীয়দের জন্য এই ক্ষতিপূরণই যথেষ্ট’। অথচ আমেরিকায়, তাদের তৈরি কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত একটি পরিবারকেই ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে হয়েছে ১ কোটি ইউ এস-ডলার। বাধ্য হয়েছে দিতে। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে কারখানা গোটাতে চাইছে ডাউ কেমিক্যালস। ভারতে হবে সেই কারখানা। এখানে এইসব কারখানা বসাতে যে পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে তার ঋণের ব্যবস্থাও তারাই করে দেবে।
এবং এইসব কাজ যে তারা করবে, তা নাকি তাদের ব্যবসার স্বার্থে নয়। আমাদের দেশের অগণিত বেকার ছেলেমেয়েদের চাকুরির জন্যে। অ্যাডাম স্মিথের পর থেকে মূল ধারার অর্থনৈতিক তত্ত্ব সবসময়েই জোর দিয়ে বলে আসছে, পুঁজিপতিরা প্রত্যক্ষভাবে মুনাফা করে বটে কিন্তু পরোক্ষে সমাজেরও উপকার করছে। তারা কাপড় তৈরির কারখানা গড়ে তোলে, কাপড়-চোপড় তো ব্যবহার করে সাধারণ মানুষই। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প আছে বলেই তো খাদা অপচয় কমেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথা। কিন্তু আসলে তো ওরা ছোটে মুনাফার জন্যে সর্বোচ্চ লাভের জন্যে, এটাই তাদের মূল কথা। মুনাফার জন্যে তারা যে তাদের সব ন্যায়নীতি বিসর্জন দেয়, এই কথাটাই যতটা সম্ভব আড়াল করে রাখা হয়।
আই জি ফার্বেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আউসভিৎস-এ গড়ে তুলেছিল এক রাসায়নিক কারখানা। কন্সেট্রেশন ক্যাম্পের বন্দিদের এই কারখানায় বাধ্যতামূলক শ্রম দিতে হত। অন্ততপক্ষে ৩ লক্ষ বন্দী এখানে শ্রম দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কম করে ২৫ হাজার বন্দী কাজ করতে করতে মরে গেছেন এই কারখানায়। বহু বন্দী মারা গেছেন উৎপন্ন ওষুধের পরীক্ষা নিরীক্ষায়। নাৎসী জার্মানিতে গবেষণার কাজে যেসব মানুষ বাধ্য হতেন নিজেদের ওপর পরীক্ষামূলক ওষুধ ব্যবহার করতে দিতে, গবেষকদের কাছে তাঁদের নাম ছিল টি-পি, টেস্ট পারসন। মানুষ হিসাবে তাঁদের স্বীকারই করা হত না।
৬
কৃষক তার পেশায় হতাশ। ছুটে যাচ্ছেন মজুরি শ্রমে। গড়ে উঠছে এক বিশাল ‘সারপ্লাস লেবারপুল’। আর এই সস্তার শ্রমশক্তিই ভরসা খাদান, স্পঞ্জ আয়রন বা সিমেন্ট ফ্যাক্টরির। কাজের সামগ্রিক পরিমণ্ডল বিশ্রী রকমের খারাপ। ৫-১০ বছরেই শ্রমিকের সামর্থ্য ঠেকছে তলানিতে, দেখলে শিউরে উঠতে হয়।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে মে-জুন অবধি চলে এইসব খাদান আর ক্রাশার। ফুসফুসে জমা হতে থাকে পাথরের গুঁড়ো, আগামী দিনের সিলিকোসিস রোগের প্রস্তুতি, টি-বি, হাঁপানি আর পাথরকলের আওয়াজে এঁরা হারাতে থাকেন শ্রবণশক্তি। শ্রমিকেরাই শুধু নন, একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকেন চারপাশের মানুষজন। ডিনামাইট বিস্ফোরণে ছিটকে আসা পাথরে অঙ্গহানি হয় শ্রমিকদের। আশপাশের মানুষজনেরও। এমনকি মৃত্যুও হয়েছে। ধানিজমি পাথরগুঁড়োয় হয়েছে বন্ধ্যা। বন্ধ্যা জমি ২-৩ বছর পড়ে থাকার পর কৃষক সেই জমি বাধ্য হয়ে তুলে দেন খাদান মালিকের হাতে। খাদান বিস্তৃত হয়, মজুরের সংখ্যা বাড়ে।
স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় ভিন রাজ্যের শ্রমিকেরা থাকেন কারখানার ভেতরে। টানা ঝুপড়ি। লাইন পিছু একটা টয়লেট, কোথাও তাও নেই। কাজের সময় ১২ ঘন্টা তো বটেই। দৈনিক মজুরি ৫০-৬০-৭০ টাকা থেকে শুরু। অবশ্য কোন দুর্ঘটনা হলে কাগজপত্রে মজুরি দেখানো হয় ১১০ টাকা। আর এলাকা জুড়ে গাছ মাটি ছাদ ঢেকে যায় কার্বনে কার্বনে, আকাশ কালো। পুকুরের জলে কালো সরের আস্তরণ। নেমে গিয়েছে কুয়োর জলের স্তর। ক্ষেতে উৎপাদন গেছে কমে। ছাগল মুরগির ছানা জন্মাচ্ছে না। গরুর দুধ গেছে কমে। হাসপাতালে শ্বাসকষ্টে আসা রোগীর সংখ্যা গেছে বেড়ে।
একই ছবি সিমেন্ট কারখানার, খোলা মুখ কয়লাখনির। অবশ্য এমনটিই যে সব শিল্প-কারখানার ছবি, তা নিশ্চয়ই নয়। এ রাজ্যেই আছে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস বা মিৎসুবিসি কারখানা। সুন্দর, পরিচ্ছন্ন। কিন্তু এই সব কারখানায় কর্মসংস্থান খুবই কম। বলা হচ্ছে কারখানায় উৎপাদিত পণ্যে তৈরি হবে অনেক ছোট ছোট কারখানা যেখানে অনেক শ্রমিক কাজ পাবেন। পেয়েছেনও। কিন্তু অনুসারী শিল্পে যেসব পণ্য উৎপাদন হয়, তার বহু কিছুই অন্য চালু শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের বিকল্প। এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান আর উল্লেখজনক থাকে না। একই সঙ্গে পেট্রোলিয়ামজাত বিভিন্ন দ্রব্য বিভিন্ন ধরনের পলিমার ব্যবহারে যেসব আবর্জনা তৈরি হয় - যেহেতু সেসব মাটিতে মিশে যায় না - পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দূষণ হয় ধীরে ধীরে, কিন্তু নিশ্চিত এবং স্থায়ী।
দূষিত হচ্ছে সমগ্র পৃথিবী। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। গত মে (২০০৭) মাসে প্রকাশিত আই পি সি সি (ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) রিপোর্ট সে কথাই জানাচ্ছে। সমুদ্রে জলস্তর বাড়বে। বিশ্বের উষ্ণতা যদি ৪-৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বাড়ে এই শতাব্দীতে, যদি গ্রীন হাউস গ্যাসের emission (Business as Usual, BAU) এমনই থাকে আবহাওয়া পরিবর্তনে উচ্ছেদ হবেন মানুষ মূলত সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি ও খরা/অতিবৃষ্টি জনিত কারণে।
আমরা জানতে থাকছি এই উন্নয়নের আরো ভয়াবহ সব তথ্য। আত্মসংহারক এই শিল্প সভ্যতা প্রতি বছর গোটা বিশ্বে ধ্বংস করছে ৪৫,000 বর্গ মাইল বনাঞ্চল। বড় বাঁধ বা নদীর মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ায় বিশ্বের মূল নদীগুলির ৬০ শতাংশই আজ ক্ষতিগ্রস্ত। মাছের উৎপাদন কমেছে ৫০ শতাংশ। প্রকৃতি থেকে যে পরিমাণ সম্পদ আমরা আহরণ করতে পারি, যা নিলেও প্রকৃতি ফের তা পূরণ করে দিতে পারে, আমরা নিচ্ছি তার প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি প্রতি বছর।
৭
প্রাণিজগতের শ্বাসপ্রশ্বাসেও বাতাসের অক্সিজেন বিক্রিয়া করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করে। যে কোন দহনক্রিয়াতেই উৎপন্ন হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড। কিন্তু উদ্ভিদ জগতের আলোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রকৃতি অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের অনুপাতের সমতা বজায় রাখে। জলীয় বাষ্প ও অক্সিজেন সূর্যকিরণে বিক্রিয়া করে, গাছের পাতার সবুজ অনু ক্লোরোফিলের সাহায্যে তৈরি করে গ্লুকোজ, অক্সিজেন। আমরা একদিকে শক্তি উৎপাদনের জন্য কয়লা ডিজেল পেট্রলের ব্যবহার বাড়িয়েই গেলাম আর অন্যদিকে বিষুব অরণ্যের ক্রমবর্ধমান নিশ্চিহ্নকরণ করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ প্রক্রিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত করলাম। অক্সিজেন কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমতা বিনষ্ট হল। বায়ুমণ্ডলে অত্যাধিক বেড়ে যাওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস, ভূপৃষ্ঠের বিকিরিত তাপ এবং সূর্যরশ্মির তাপ অনেক বেশি ধরে রাখল। বাড়তে থাকল তাপমাত্রা। শুধু তাই নয় বেশি বেশি ডিজেল পেট্রলের দহনে শুরু হল আঞ্চলিক অ্যাসিড বৃষ্টি। ধ্বংস হচ্ছে জলাশয়, ধংস হচ্ছে অরণ্য। প্রাণীজগৎকে সূর্যকিরণের ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মির হাত থেকে বাঁচায় বায়ুমণ্ডলের যে ওজোন স্তর, তারও ক্ষয় হল । উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারে মাটির গঠন গেল বদলে, দূষিত করলাম জল; বাঁধ আর খনিজ দ্রব্যের অপরিমিত আহরণে ধংস হল অরণ্য, মাটির উপরিস্তর বৃষ্টির জলে ধুয়ে যেতে থাকল আর নদীখাত পলিবহনে অক্ষম হয়ে নাব্যতা হারাল, লবনাক্ত মাটি হারাল উর্বরতাশক্তি, নষ্ট হতে থাকল প্রাকৃতিক জল বিভাজিকা। একই সঙ্গে জমতে থাকল শিল্পজাত বর্জ্য। যে সমুদ্রকে ভাবতাম সব দূষিত বর্জ্যের অফুরান আধার, সেও আজ অসহায়, বিপন্ন। তালিকা অসম্পূর্ণ, সংকটের বিভিন্ন উপাদানের সুদূরপ্রসারী এবং জটিল আন্তঃসম্পর্কের ইঙ্গিতবাহী মাত্র।
এবং এই সংকট তৈরি করেছে এক বিশেষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সংকট তৈরি করেছে পুঁজির বিশেষ চরিত্র। সবই পণ্য করে নিচ্ছে জাতীয় ও বহুজাতিক, কর্পোরেট মালিকেরা। পুঁজির আগ্রাসন আজ আর শুধুমাত্র শিল্প মুনাফা অর্জনেই থেমে নেই, তার হাঁ-মুখ আজ আগ্নেয়গিরি, অবিরাম লাভাস্রোতে গ্রাস করছে আমাদের আকাশ, মাটি, বাতাস এবং এমনকি জলও।
পানীয় জল আজ বোতলবন্দী পণ্য। আমরা একে বলছি শিল্প। এই শিল্পের বাড়বাড়ন্ত কেমনভাবে ঘটল? সরকারের পরিকল্পনায় বলা হল পানীয় জল কেন্দ্রীয়ভাবে সরবরাহ করা হবে। গ্রামে গ্রামে পানীয় জল সংরক্ষণের যেসব ব্যবস্থা চালু ছিল গুরুত্বহীন হয়ে পড়ল। গ্রামীণ সমবায়িক উদ্যোগে ভাটা পড়ল।
সরকারি উদ্যোগের পরিণাম? আমাদের রাজ্যেই মাত্র ২৯.৯৫ শতাংশ পরিবার শুদ্ধ পানীয় জল পান (ন্যাশন্যাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে রিপোর্ট, ২০০৫- ০৬)। ২০০৬ সালে পশ্চিমবাংলায় নথিভুক্ত ডায়েরিয়ায় আক্রান্ত মানুষ, ২৬ লাখ আর টাইফায়েডে আক্রান্ত ১,১০, ৮৩৫ জন।
জলবাহিত অসুখের এমন এক পরিসংখ্যান ভীতি সঞ্চার করল, মানুষজন নির্ভরশীল হলেন বোতলের জলে। আর যারা বোতলের জল কিনে খাওয়ার সামর্থ রাখেন না তারা মানসিকভাবে নিজেদের ছোট ভাবতে থাকলেন, তেমন রোজগার থাকলে তারাও বোতলের জলই খেতেন। বোতলের জল শুধু পানীয় নয়, আর্থিক সামর্থ্যেরও পরিচায়কও!
পানীয় জলের বাজার বাড়ল। সে জলকে প্রথমে বলা হল মিনারেল ওয়াটার, জলে মেশান হল অপ্রয়োজনীয় পটাশিয়াম ক্লোরাইড। ভূগর্ভস্থ জল তুলতে বা প্লাস্টিক বোতল তৈরির জন্য বিদ্যুৎ খরচ বাড়ল, পেট্রোকেমিক্যালস ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজন বেশি করে অনুভূত হল এবং যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়ে থাকল সে সব বোতল, আবর্জনার স্তুপ হয়ে। চাহিদা তৈরি করা হল, কনসেন্ট ম্যানুফ্যাকচারড হল। পুঁজির বিকাশ হল। মুনাফা হল পুঁজিপতির। আর আমরা হারালাম স্বনির্ভরতার শক্তি। সমবায়িক উদ্যোগ। অপচয় করলাম প্রকৃতির সঞ্চয়।
যে জল বেচে পুঁজিপতি লাভ করলেন, সেই জল কিন্তু সর্বসাধারণের কারোর ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। যে জমি কিনে তিনি ভূগর্ভস্থ জল তুললেন, সেই জল কিন্তু শুধু সেই জায়গাটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। জল তোলার সময়, জল এসেছে চারপাশ থেকে। অন্য জায়গার জলস্তরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবুও জলের মালিকানা কিন্তু ওই শিল্প মালিকের! স্বীকৃতি দিল রাষ্ট্র, সরকার এবং আমরা।
৮
বিংশ শতাব্দীর আগে বৈজ্ঞানিক চিন্তার দুটো ধারা। একটি ধারায় পৃথিবীকে সম্পূর্ণ সুগঠিত বিকাশহীন যন্ত্র হিসাবে দেখা হয়। আর দ্বিতীয় ধারায় মনে করা হয় জগৎ অসম্পূর্ণ ও বিকাশমান এক প্রক্রিয়া। প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিতে জগতকে খণ্ড খণ্ড করে বিশ্লেষণ করা হয়। এই ধারণায়, জড়বস্তু ও প্রাণীজগৎ নিয়ে সমগ্র বিশ্বচরাচর অগণন খণ্ডে বিভক্ত। খণ্ডকে জানা হলেই, খণ্ড সমন্বয়ে তৈরি সমগ্রকেও আপনা আপনি জানা যাবে। দ্বিতীয় ধারণায় বিশ্বচরাচর সমগ্র হিসাবেই অভিব্যক্ত। খণ্ডের গাণিতিক যোগফল সমগ্রের রূপ ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। এই চিন্তা চেতনায়। সমগ্র জগৎ একটি সংগঠন। এই সংগঠনের মধ্যেকার বস্তুসমগ্রের পারস্পরিক আকর্ষণ-বিকর্ষণ, আদান-প্রদানই সংগঠনটির চালিকাশক্তি। জীবিত প্রাণীদেহের সঙ্গে মৃত প্রাণীদেহের তফাৎ খণ্ডের বিচারে কোনদিনই নির্ণয় করা সম্ভব নয়। একই উপাদান দিয়ে দুটিই সৃষ্ট। কিন্তু সমগ্রের বিচারে বোঝা যায়, জীবিত প্রাণীদেহে যে সংগঠনটি বিরাজমান, মৃত প্রাণীদেহে সেটি অনুপস্থিত। অর্থাৎ বস্তুজগৎ কি উপাদান দিয়ে তৈরি, সেটা জানাই শেষ কথা নয়, উপাদানগুলো কি ধরনের সমগ্র নির্মাণ করছে, সেই কথাও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম ধারাতে আমরা জেনেছিলাম দুটি গতিশীল জড় পদার্থের সংঘাত ঘটলে, যার ভর কম তাকে অপরটির জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। ভর সঞ্চয়ের ‘গ্রোথ এথিকস’। নিউটনীয় গণিত। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, সমাজ কোন দিকে যাবে। নিউটনীয় গতিসূত্র। নিউটনের তত্ত্বের এমন এক সামাজিকীকরণের সুদূর প্রসারী ফলই, রিডাকশনিজম আর ডিটারমিনিজম।
দ্বিতীয় চিন্তাধারাটি বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে গুরুত্ব পেতে শুরু করে। ইতিমধ্যে বিজ্ঞান জেনেছে, বস্তু ও শক্তির দ্যোতনা ও রূপান্তর সম্পর্ক। জেনেছে, আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রনের অবস্থান নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা যাবে না — এই অনিশ্চয়তা তত্ত্ব থেকে উচ্চারিত হয়েছে, ‘নিশ্চিত জানা’র অসম্ভাব্যতা।
দ্বিতীয় চিন্তাধারাটাতেই আমরা পেলাম বিশ্বজগতকে ব্যাখ্যা করার “সিস্টেম ভিউ’। সিস্টেম বলতে সংগঠিত সমগ্রকে বোঝানো হয় যার গুণাবলী বা আচার আচরণ কখনই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভাজ্য নয়। মৌলিক উপাংশের দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার বিপরীতে সমগ্র সংগঠনটির গঠন নীতির ওপর জোর দেওয়া হয়। যে কোন জীবিত প্রাণী তা সে ক্ষুদ্রতম ব্যাকটেরিয়া হোক বা মানবদেহ এই ধরনের এক অর্গানাইজেশন বা সিস্টেম। ‘পারস্পরিক সম্পর্ক’ও ‘বিকাশমান সমগ্র’ এই দুয়ের সমন্বয়ে এই চিন্তাধারা বিকশিত হয়।
সমগ্র জগৎ একটি সংগঠন। সংগঠনের মধ্যেকার বস্তুসমগ্রের পারস্পরিক আকর্ষণ-বিকর্ষণ, আদান-প্রদানই এই সংগঠনের চালিকাশক্তি। এই বোধে যদি নিজেদেরকে শিক্ষিত করতে পারতাম তাহলে বস্তুজগতের কোন সমস্যা বা তার সমাধানসূত্রকে এক সামগ্রিকতার দৃষ্টিতে দেখতাম। অরণ্য তখন আর শুধুই কাঠের জোগানদার নয়। গাছ মানে কাঠের কুইন্টালের হিসেব নয়। আমরা দেখতে পেতাম কিভাবে গাছ শিকড়বাকড় প্রসারিত করে টপ সয়েল ইরোশন হতে দেয় না। আমরা সম্পর্ক খুঁজে পেতাম বনাঞ্চলের সঙ্গে বৃষ্টিপাতের। মাথার ভেতর কাজ করত আমার শ্বাস নেওয়ার সময় প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কমে যাবে বৃক্ষ যদি অবলুপ্ত হয়। আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার চারপাশের গাছপালা, পশু পাখি নদী — সবায়েরই মধ্যে শুধু যে এক সামগ্রিক সম্পর্কসূত্র আছে তাই নয়, এই জগতের ওপর তাদেরও আছে সমান অধিকার।
৯
প্রাণীজগৎ বা উদ্ভিদজগৎ এমনকি বস্তুজগতেরও যে এই পৃথিবীর ওপর অধিকার আছে, এই উচ্চারণ আজ সামনে নিয়ে এসেছে ইকোয়েডর। লাতিন আমেরিকার ইকোয়েডর ২০০৭ সাল থেকে জাসুনি অঞ্চলে খনিজ তেল তোলা বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ তেল তুলতে গিয়ে ওখানকার বনাঞ্চল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিরল প্রজাতির জাওয়ার, সাদা পেটওয়ালা স্পাইডার বাঁদর, চশমা ভালুক এবং সর্বোপরি আদি জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষজন। (আর আমরা! সর্দার সরোবর ও নর্মদা সাগর বাঁধ নির্মাণে ৪.৫ থেকে ৫ লক্ষ মানুষজন ঘরবাড়ি গ্রামসমাজ থেকে উচ্ছেদ হলেন, তবু কতখানি নির্বিকল্প দূরত্বে নিজেদের রাখতে পারলাম।)। এখানেই শেষ নয়, ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর ইকোয়েডরে নতুন সংবিধান রচিত হল, গৃহীত হল গণভোটে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘Nature or Pachamama, where life is reproduced and exists, has the right to exist, persist, maintain and regenerate its vital cycles, structure, function and its process in evolution। বলা হচ্ছে প্রকৃতির অধিকারের মধ্যে আছে, ‘right to integral restoration’ এবং অধিকার আছে ‘to be free from exploitation’ এবং ‘harmful environmental consequences’ (সর্দার সরোবর ও নর্মদা সাগর বাঁধ নির্মাণে ৫৪ হাজার হেক্টর বনভূমি জলাধারের জলে ডুবে গিয়েছে)।
একই চিন্তাচেতনার প্রকাশ দেখি ২০০৮ সালের ১৫ এপ্রিল প্রকাশিত International Assesment of Agricultural Science & Technology for Development Report-এ। সেখানে বলা হয়েছে, কৃষি সম্পর্কে বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন দরকার। ভাবতে হবে ইকোসিস্টেমকে কৃষি কতখানি পরিষেবা দিতে পারে, ভাবতে হবে কৃষির সাংস্কৃতিক মূল্যের কথা। বলা হয়েছে, যদি বিশ্বজুড়ে খাদ্য-সুরক্ষার কথা ভাবতে হয়, তবে ভাবতে হবে ছোট ছোট ক্ষেতের কথা এবং কৃত্রিম জিন সংযোজন ও বিয়োজনের যে পথ নেওয়া হয়েছে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কমিটির মূল্যায়ন, নতুন বীজ, অফুরান জলের ব্যবহার, কৃষি রাসায়নিক দ্রব্য এবং প্রযুক্তির বিপুল ব্যবহার সবই কৃষিতে খারাপ হয়েছে। কমিটি গঠিত হয়েছিল ২০০২ সালের আগস্ট মাসে, উদ্যোগ World Bank Food & Agricultural Organisation-এর এবং উদ্দেশ্য, বিশ্বের খাদ্য চাহিদা ও সংকট মোচনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। রিপোর্টটি এখন অবধি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা (অভিযোগ, আধুনিক প্রযুক্তিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় নি) এবং বহুজাতিক বীজ ও কৃষি-রাসায়নিক প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলি (অভিযোগ, কৃত্রিম জিন ব্যবহার বিরোধী সংগঠনগুলি কমিটিকে হাইজ্যাক করে নিয়েছে)।
বিতর্ক যাই থাকুক, ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বজুড়েই জৈব চাষে আগ্রহ এসেছে। এমনকি ভারতেও। ডাউন টু আর্থের ২০০৯ সালের ১-১৫ জানুয়ারির সংখ্যায় দেখছি, অন্ধ্রপ্রদেশে ২০০৫ সালে ৪০০ একর জায়গা নিয়ে শুরু হয়েছিল NPM (নন পেস্টিসাইড ম্যানেজমেন্ট) অঞ্চল। ২০০৯ সালে এই এলাকা বেড়ে দাঁড়াবে ১৪ লাখ একর, ৩০০০ এন-পি-এম গ্রাম। এই গ্রামগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের ২৩টি জেলার মধ্যে ১৮টি জেলায়। প্রথমে পেস্টিসাইড ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন আস্তে আস্তে অজৈব সারও বন্ধ হতে চলেছে। অজৈব ইউরিয়ার বদলে, ব্যবহৃত হচ্ছে অ্যাজোলা প্ল্যান্ট। প্রাথমিকভাবে জমি তৈরি করার সময় ব্যবহার করা হচ্ছে, গোবর গোমূত্র ও কেঁচো সার। এমনকি ট্রাক্টরের বদলে লাঙল। ফলে গরু পালন বেড়েছে। পুকুর কাটা হচ্ছে NREGA প্রকল্পে। উৎপাদন বাড়ছে। বাড়ছে কর্মসংস্থান।
মানুষের আয় বাড়ছে। ২০০৭ সালের পর থেকে এইসব অঞ্চলে ঋণ বা দারিদ্র্যজনিত কারণে কোনো আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি। এমনকি কৃষকেরা বন্ধক দেওয়া জমি আবার ছাড়িয়ে নিতে পারছেন। উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকটি অলাভজনক সংস্থা। যুক্ত State Rural Development Ministry। এটা মৃগেন্দ্র সিংহদের বাঁচার একটা উপায় হতে পারে। সম্মানের সঙ্গে বাঁচার একটা পথ হতে পারে। কারণ এখানে আর্থিক উন্নতি নিজেকে করে নিতে হচ্ছে। নিজের শ্রম যেমন কাজে লাগানো যাচ্ছে, তেমনই একজন কৃষক তাঁর বংশপরম্পরায় অর্জিত জ্ঞানও এখানে প্রয়োগ করতে পারছেন। কৃষক নিজের সৃজনীশক্তির ওপর আস্থা ফিরে পাচ্ছেন। শ্রমের সম্মান খুঁজে পাচ্ছেন।
চাষের যে পদ্ধতিতে, যাকে আমরা এতদিন ‘আধুনিক’ অভিধায় চিহ্নিত করে আসছিলাম, কৃষককে উৎসাহিত করা হয়, সেখানে কর্পোরেট সংস্থা থেকে সরকারি কৃষি দফতর, কৃষি বিশেষজ্ঞ, বীজ-সার-কীটনাশক বিক্রেতা সবাই জানেন কেমন করে কখন কীভাবে চাষ করতে হবে, জানেন না শুধু কৃষকই। কৃষকও এখানে প্রায় শ্রমিকের মতো মজুরিদাসই, যদিও উৎপাদন মার খেলে যাবতীয় ঝুঁকি তাঁর। ফসল মার খেলে ঋণ তাঁকেই শুধতে হবে। বিশেষজ্ঞ থেকে বিক্রেতা সবাই সরে যাবে। যে শস্য উৎপাদনের ওপর তাঁর বাঁচামরা, তাঁর প্রতিদিনের যাপন, সেই তাঁকে তার যাবতীয় উদ্বেগ নিয়ে জমির বা ফলনের সম্পর্কসূত্রে যুক্ত নয়, এমন মানুষজনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়।
এই কৃষি-প্রযুক্তি ব্যবহারের একটি পর্যায়ে গিয়ে আমরা দেখেছি সারা ভারতে সরকারি হিসেবেই ১৯৯৭ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে এই দেশে ১,৮২,৯৩৬ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বয়ম্ভরতার প্রচার সত্ত্বেও মাথা পিছু খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ১৯৯০-৯১ সালের ৪৬৮ গ্রাম, ২০০৫-০৬ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪১২ গ্রাম, ডাল, কড়াই, মটর ইত্যাদির পরিমাণ ৪২ গ্রাম থেকে কমে হয়েছে ৩৩ গ্রাম। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (২০০৮) জানাচ্ছে ক্ষুধার্ত ৮৮টি দেশের সূচকে ভারতের স্থান ৬৬ তম। ন্যাশনাল স্যাম্পেলসার্ভে অর্গানাইজেশন জানিয়েছে, কৃষকেরা তাঁদের পেশায় হতাশ।
সুতরাং এটা পথ নয়। অন্ধ্রের অভিজ্ঞতার কথা আমরা ভাবতে পারি। এটা একটা স্বাবলম্বনের পথ হতে পারে। স্বনির্ভর গ্রাম অর্থনীতির পথ হতে পারে। আপত্তি একটা উঠতে পারে অবশ্য। ওখানে সরকারের NREGA প্রকল্পের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। যে সরকার ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আই-এম-এফের কাছে দেশকে বিকিয়ে দিচ্ছে, মানুষের প্রতিরোধ আন্দোলনের ওপর নামিয়ে আনছে সন্ত্রাস, সেই সরকারের অনুদান নেওয়া হবে কেন? NREGA প্রকল্প তো একধরনের অনুদান। আপত্তি উঠতেই পারে অলাভজনক সংস্থা বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ভূমিকা নিয়ে, কারণ এই সব সংস্থা চলে দেশি বিদেশি, সরকারি/বেসরকারি অনুদানের ওপর। তবুও বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা একটা স্বাবলম্বনের পথ হতে পারে।
আমাদের দেশে সরকার পরিচালনায় যারাই ক্ষমতায় আসে, সেই রাজনৈতিক দল বা একাধিক রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত ফ্রন্ট, সবাইকেই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে আসতে হয়। প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেন শুধু এই ব্যবস্থার যাঁরা বেনিফিসিয়ারি তাঁরাই নন, দেশের অত্যাচারিত, অবহেলিত গরীব মানুষেরাও। সুতরাং নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও নির্বাচিত হওয়ার জন্যে, ওইসব মানুষদের আর্থিক দূরবস্থা দূরীকরণের বা সামাজিক অত্যাচারের প্রতিবিধানের প্রতিশ্রুতিও দিতে হয়। সরকার বা রাষ্ট্র দায়বদ্ধ থাকে সেই সব প্রতিশ্রুতি পালনে।
ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলনের দুটো দিক থাকে। এক, দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে বাধ্য করা এবং দুই, নতুন প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভূক্ত করা। রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনেও দাবি থাকে, দাবি থাকে সরকারের কাছেই, সন্ত্রাস বন্ধ করার, যদিও তাঁরা এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই মানেন না।
সুতরাং NREGA প্রকল্পে যদি সাধারণ মানুষের শ্রমশক্তির সম্মানজনক বিনিয়োগের সম্ভাবনা থেকে থাকে, তাহলে এই প্রকল্প চালিয়ে যাওয়াই শুধু নয়, এই প্রকল্প আরও সম্প্রসারণের দাবিও যৌক্তিকভাবে উঠে আসতে পারে। বস্তুত সে সম্ভাবনাও আছে।
NREGA চালু রাখা ও সম্প্রসারণের দাবিতেই হয়ত আগামীদিনে আন্দোলন গড়ে তুলতে হতে পারে, কেননা কিছুদিন আগে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক তার ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট, ২০০৯ প্রকাশ করেছে। তাতে ইউ পি এ সরকারের তিনটি প্রকল্পের বিরোধিতা করা হয়েছে। NREGA, Watershed Programme, Small & Medium Township Programme। বলা হয়েছে এই সব প্রোগ্রাম দারিদ্র্য দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাহত করে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে ইউ পি এ সরকারের উচিত মাইগ্রেশনকে উৎসাহ দেওয়া। সরকারের উচিত প্রাম থেকে অনবরত শহরে মাইগ্রেশন হতে দেওয়া। পরিযায়ী ব্যক্তিরা যেখানে যাচ্ছে সেখানে সামাজিক পরিষেবা, বাসস্থান, রেশন ইত্যাদি সুনিশ্চিত করেই দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচী ঠিকমতো চালিয়ে যাওয়া যায়। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে জল-বিভাজিকা উন্নত করা বা ছোট ও মাঝারি শহর তৈরি করা বা গ্রামীণ রোজকার সুনিশ্চিত করার অর্থ পরিযানকে ঋণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা।
অর্থাৎ যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কথায় পরিকাঠামোগত পরিবর্তন করা হচ্ছে, সেই ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সঙ্গে আবার সরকারের বিরোধিতাও আছে। এই বিরোধিতা অনেক ক্ষেত্রেই। এটা বুঝতে না পারলে উন্নয়নের ভাবনা কার্যকর করা বেশ অসুবিধাজনক। সাদা বা কালো নয়, বস্তুর সব রঙগুলোই দেখতে শেখা প্রয়োজন।
একই কথা প্রযোজ্য অলাভজনক সংস্থা বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ভূমিকা বোঝার ক্ষেত্রেও। সরকারি সংস্থা নয় এমন যে কোন সরকারি রেজিস্টার্ড সংগঠনই, এন জি ও। এই সংগঠনগুলোর কেউ সরকারি বেসরকারি/দেশি বিদেশি অনুদান নেয়, কেউ নেয় না। যারা নেয় তাদের বলা হয় ফান্ডেড এন জি ও। বিদেশি অনুদান আবার হতে পারে বিদেশি সরকার, কর্পোরেট হাউস, ট্রাস্ট বা মিশনারি সংগঠনের। আবার ভারতীয় ছাত্র বা কর্মরত ভারতীয়রা নিজেদের রোজগারের টাকা জমিয়ে যৌথভাবে তহবিল তৈরি করে তাঁদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কোন প্রকল্পেও অনুদান পাঠান। দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই তাঁদের এই কার্যক্রম।
অর্থাৎ সব এন জি ও-র উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম বা তাদের অনুদানের উৎসকে এক করে দেখা ঠিক নয়। এমনকি ছোট বড় সব কমিউনিস্ট পার্টি ও গ্রুপও বিদেশি প্রতিষ্ঠান/সংগঠন থেকে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য পেয়ে আসছে, আর্থিক সাহায্যও; অবিভক্ত সিপিআই(এম-এল)-ও এই সাহায্য/অনুদান নিত। অন্ধ্রপ্রদেশে এন জি ও-দের উপস্থিতি তাই সবটাই সন্দেহের চোখে দেখা হয়ত ঠিক নয়। আশংকা সবসময় লজিক্যালি এবং .ব্যাশনালি আসে না, অবিশ্বাস থেকেও আসতে পারে; নিজের বোধ বিশ্বাস জানা ও ধারণার বাইরে নতুন কোন কার্যক্রম নিজের জানা-বোঝাকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুললে, তা থেকেও আসতে পারে। ভবিষ্যতে সঠিক বলে প্রতিপন্ন হলেই, তা তার দূরদর্শিতা প্রমাণ করবে এমনও নয়।
বস্তুত, যে উন্নয়ন ভাবনা সমাজকে ইনক্লুসিভ ও সমগ্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার চেষ্টা করবে, যা বর্তমানের এক্সক্লুসিভ ও খণ্ড ভাবনার বিপ্রতীপ, তাকে চেনা এবং নিজেকে তার সঙ্গে মানসিকভাবে যুক্ত করার জন্য আগে প্রয়োজন নিজেকে রঘুনন্দনীয় আচার বিচার থেকে মুক্ত করা, ছুৎমার্গীতা থেকে অব্যাহতি দেওয়া।
নতুন সমাজভাবনা দাবি করে, নিজের জানাটুকু উগড়ে দেওয়া নয়, নিজের জানাবোঝাকে প্রতিনিয়ত যাচাই করে নেওয়া। অনেক অনেক মানুষের সঙ্গে, এমনকি অপছন্দের মানুষটির সঙ্গেও চলতে শেখা। অন্যের জানাবোঝাকে মান্যতা দেওয়া। অবশ্যই নিজের মতামত স্পষ্ট করে জানিয়ে এবং নিজের ভুল সংশোধনের নমনীয়তা রেখে।
সেপ্টেম্বর ২০০৯
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)
ক্লাস সেভেনের ছাত্রী রাজিয়া। বয়স বছর ১৫। মাসখানেক স্কুলে অনুপস্থিত। দিদিমণিরা খোঁজ নিতে গেলেন ওর বাড়ি। বাড়ি মানে বিস্তৃত অপরিচ্ছন্ন বড়সড় বস্তির একটা ঘর। সাইজ মোটামুটি ৬ ফুট বাই ৮ ফুট। হাত ওঠালে ছাদে ঠেকে। উচ্চতায় সাড়ে ছয় থেকে সাত ফুট।
রাজিয়ার স্কুলে না আসার কারণ, রাজিয়ার মা ঠিক করেছেন ওকে মাসীর বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। সেখান থেকেই ও লেখাপড়া করবে। এই মাসী অবশ্য ওদের নিজেদের কেউ নয়, বস্তিতেই আলাপ-পরিচয়। বাড়ি বাঙ্গালুরু। মানুষটি নাকি ভাল। ১০০০ টাকা দিয়ে গেছেন রাজিয়ার পোশাক কিনতে। কেনা এখনও হয় নি। টাকার বেশ কিছুটা ইতিমধ্যে খরচও হয়ে গেছে ছোট ছেলের অসুখে।
ছেলের বয়স বছর আড়াই। অসুস্থ। দেখছেন চেনা ডাক্তারই। তাঁর ‘দাবাখানা’ থেকেই ওষুধ পাওয়া যায়। বাচ্চাটিকে সারাদিন দেখে ওর ঠিক ওপরের দিদি। বয়স ৮-৯। স্কুলে গিয়েছিল, ছেড়ে দিয়েছে, বাড়িতে ভাইকে দেখতে হয়। রাজিয়ার বড় দিদি ও মা কেউই ঘরে থাকে না। দিদি বড়বাজারে মশলা ঝাড়ার কাজ করে আর মা করে জরির কাজ। দুজনেই দিনে ৪০ টাকা করে পায়। পায় সপ্তাহে। গাড়ি ভাড়া যায় এক একজনের ৮ টাকা করে, মোট ১৬ টাকা প্রতিদিন। টিফিন দুজনেই বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। ভাত, মাড়ভাত, ছাতু।
সেদিনই যাওয়ার কথা রাজিয়ার। মাসীর কাছে পৌঁছে দেবে ওর মা. রাতে, হাওড়া স্টেশনে। টিকিট মাসীর কাছে। ট্রেন ছাড়বে রাত ৮টা নাগাদ। রাজিয়া সেদিন চলে যাবে বলে মা ও দিদি কেউই কাজে যায়নি। মেয়েটার সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে তার তো ঠিক নেই।
রাজিয়ার সঙ্গে কবে দেখা হবে ঠিক নেই। কেননা এর আগে বস্তি থেকে ১৪-১৫ বছরের আরও কয়েকজন মেয়ে কোন না কোন মাসীর হাত ধরে অন্য রাজ্যে চলে গেছে। কেউই ফেরেনি। গতবছর সেলিনার যেদিন বাঙ্গালুরু যাওয়ার কথা ছিল, সেদিন সে বড়দিদিমণির ঘরের দরজা ধরে হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমি বাড়ি যাব না, আপনাদের কারও বাড়িতে আমাকে থাকতে দিন।
সেলিনাকে নিজেদের বাড়িতে রাখতে ভরসা করতে পারেননি তাঁরা। সেই সেলিনা আর ফেরেনি। বাড়ির সবাই-ই কোথাও চলে গিয়েছিল। দিদিমণিরা পরে শুনেছিলেন যে পুরো পরিবারটাই নাকি চলে গিয়েছিল টিটাগড় বা মেটিয়াবুরুজে। মাস দুয়েক বাদে একজন বিশ-পঁচিশ বছরের ছেলে চাচাতো ভাই পরিচয় দিয়ে ওদের বাড়িভাড়ার টাকা মিটিয়ে জিনিসপত্র সব নিয়ে চলে যায়। তারও আগে ফরিদা চলে গিয়েছিল কাশ্মীর। তার নাকি ওখানে বিয়ে হয়েছে। মস্ত বড়লোকের বাড়িতে। তাদের বাগান আছে, আপেল আলুবোখরা চেরি আখরোটের বাগান। বিয়ের ছবি দেখিয়ে গিয়েছিল ওর মা। অনেক ছবি ছিল, সুসজ্জিতা ফরিদার ছবিও। কিন্তু যে ছেলেটির সঙ্গে ফরিদার বিয়ে হয়েছিল বলে ওর মা জানিয়েছিল, তার সঙ্গে একসাথে ফরিদার কোন ছবি ছিল না। বিয়েতে গিয়েছিল মা আর বাবা। গাড়িভাড়া পেয়েছিলেন ছেলের বাড়ি থেকেই। বিয়েতে নাকি অনেক জলুশ হয়েছিল। আজ আবার রাজিয়া যাচ্ছে বাঙ্গালুরু।
দিদিমণিদেরও রাজিয়ার অনুপস্থিতি নিয়ে এমনই এক আশংকা কাজ করেছিল। এমনি করেই তো হারিয়ে গেছে তাদের অনেক ক’জনা ছাত্রী। খোঁজ করেছিলেন সেই মাসীর। পাওয়া যায়নি। মাকে বলেছিলেন, যে টাকাটা খরচ হয়ে গেছে সেটা তাঁরাই দিয়ে দেবেন। সবটাই যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। স্কুলে গিয়ে নিয়ে আসতেও বলেছিলেন। পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, যেন খোঁজখবর রাখে, রাজিয়া যেন বাঙ্গালুরু চলে না যায়। রাজিয়ার মাকেও বুঝিয়েছিলেন অনেক করে।
ওরা চলে আসার আগে ভেঙে পড়েছিলেন রাজিয়ার মা। বড়দিদিমণির দুহাত জড়িয়ে বলেছিলেন, মেয়েকে পড়াব কী করে? খেতে দিতেই পারি না। ৫ জনের পরিবার। আগে তাও ওদের বাপের রোজগারটা ছিল, এখন সেও ওদের ছেড়ে চলে গেছে। অন্য বাড়িতে চলে গেলে মেয়েটা লেখাপড়া না শিখলেও খেয়েদেয়ে তো বাঁচবে। একটা পেট তো কমবে।
২
রাজিয়াদের মতো পরিবার কত? সারা ভারতে কতজন মানুষ এইভাবে দিন গুজরান করেন? একটা হিসেবে দেখছি সংখ্যাটা প্রায় ৬০ কোটি। কমবেশি ১১০ কোটি জনসংখ্যার ৬০ কোটি মানুষ খাদ্যের অনিশ্চয়তায় দিনযাপন করেন। নিশ্চয়ই কমপক্ষে সমসংখ্যক মানুষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও বস্ত্রের অভাবে থাকেন।
রাষ্ট্র এদের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবে না। ভাবে না কারণ এরা তেমন কোন ভোগ্যপণ্য ব্যবহার করে না। বরং গুনতিতে রাখলে সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে মাথা পিছু আয় বা মাথা পিছু ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার কমে যায়। দেশটাকে বড় বেশি গরীব গরীব লাগে। মরে গেলে আপদ চোকে এই কথাটা অবশ্য সরাসরি বলে না, কারণ ভারতের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সরকার নির্বাচনে এদেরও মতামত দেওয়ার অধিকার স্বীকৃত। কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথাটা চলেই আসে। অনেকদিন আগে একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে ‘লেটারস টু দ্য এডিটর’ কলামে একটা চিঠি বের হয়েছিল। লেখকের নাম মনে নেই, তবে তার নাম-পদবি থেকে সেসময় খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম তিনি এক বৃহৎ শিল্পপতি পরিবারেরই সদস্য। তিনি মুম্বইয়ের নির্মাণ-শিল্পের শ্রমিকদের প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, যখন কাজ থাকে না তখন এদের মুম্বই থেকে বের করে দেওয়া উচিত কেননা তারা মহামূল্য পানীয় জল ব্যবহার করছে, রাস্তাঘাট নোংরা করছে, এদের জন্য ‘স্যুয়ারেজ সিস্টেম’এর ওপর অযথা চাপ পড়ছে অথচ এরা কোনও কর দিচ্ছে না।
সেই পত্রকার যে কথাটি লিখতে পেরেছেন সেটা রাষ্ট্রপরিচালকদের মনের কথা। আমাদের চোখের সামনে সরকার পরিচালনা করতে যাঁদের দেখি, মন্ত্রী পরিষদ, তাঁদের পক্ষে এটা বলা অসুবিধাজনক। কারণ তাঁদেরকে নির্বাচিত হয়ে আসতে হয় এবং ভোট পাওয়ার জন্য এর উল্টো কথাটাই উচ্চারণে নিয়ে আসেন তাঁরা। তাঁদের এই সীমাবদ্ধতা শিল্পপতি মালিকেরা জানেন, জানেন বড় বড় জোত আর আড়তদারেরা এবং এও জানেন ঠিক ঠিক কারা সরকার গঠন করলে, রাজিয়াদের পরিবারের মানুষজনদের প্রান্তিক অবস্থানে রেখেই তাঁদের মুনাফার পরিমাণ আরও আরও বাড়ানো সম্ভব হবে। নিজেদের অবস্থান সুরক্ষিত রাখা যাবে। কারণ একটা ভয়, একটা আশংকা তাঁদের থেকেই যায় যে প্রান্তিক মানুষজনেরা যদি তাদের প্রাপ্য চাহিদা দাবি করে অস্থিরতা তৈরি করে! এবং সেই অস্থিরতায় তাঁদের মুনাফায় হাত পড়ে বা তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় অথবা রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁদের ভূমিকা যদি খর্ব হয়!
তাই তাঁরা রাষ্ট্র ব্যবস্থার কলকাঠি নাড়েন, কখনও পরোক্ষে কখনওবা প্রত্যক্ষে। তাঁদের পরামর্শ আর ব্যবস্থাপনায় প্রভাবিত করেন পুলিশ-প্রশাসন-বিচারালয়কে। সরকার গড়ার জন্য কোন রাজনৈতিক পার্টি ভালো আর কেইবা খারাপ এসবও প্রকাশ করেন ভারী ভারী সব সম্মেলন-সেমিনারে, প্রচার মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রিত করে। এই যেমন শ্রী রতন টাটা সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, পশ্চিমবঙ্গের উন্নতি করছে এখানকার বামফ্রন্ট সরকার, রাজ্যে যদি কোনোভাবে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে তাহলে এই রাজ্যের আর কোন ভবিষ্যৎ নেই।
এর মানে এই নয় যে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারে এলে তাঁদের খুব অসুবিধে হবে অথবা রাজিয়াদের অবস্থানের তেমন কিছু হেরফের হবে। আসলে যে ব্যবস্থাটা দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা তৈরি করেছেন, যার জন্য বেশ কিছু টাকা খরচও করে রেখেছেন (শিল্প উৎপাদনে, যেমন মূলধন বিনিয়োগ করে) তার কিছুটা জলে যাবে বা নতুন আর একটা বোঝাপড়া তৈরি করতে সময় লাগবে, অর্থ লাগবে, এমনতর সাত সতেরো ঝামেলা আর কি। তাছাড়া একটা শৃংখলিত (শৃংখল আর শৃংখলা’র মধ্যে তফাৎ ‘আ’কারের মাত্র) পার্টির মূল আদান-প্রদান কোনো একটি স্তরে সম্পন্ন হলে, সর্বস্তরেই সেই বোঝাপড়া বলবৎ হয় বা সবাইকেই তার মান্যতা দিতে হয়। মান্যতার অনুকূলে মত গঠন করার দায়ও বর্তায় পার্টির। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের মতো পার্টিতে ‘এই ওয়ান উইনডো সিস্টেম’ অচল। যে যার মতো রাজা। আর যিনি বললে হয়ত হত, তিনি ভয়ানক ‘আনপ্রেডিক্টেবল’। টাটাদের চাই সরকারি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
আর এই নিরাপত্তার বিষয়টা, সরকারের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়াটা শিল্পপতিদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ আরো এই কারণে যে, তাঁরা যে পথে দেশের উন্নতির দিশা দেখাচ্ছেন, সরকার সেই পথেই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, সেই পথে মানুষ উদ্বৃত্ত হচ্ছেন, বিপন্ন হচ্ছেন। যদি সেইসব বিপন্ন মানুষেরা অসংঘবদ্ধ অবস্থাতেই আইন-আদালত উপেক্ষা করে যত্রতত্র অরাজকতা নামিয়ে আনে!
সরকার-শিল্পপতির যৌথ আঁতাতে মানুষ কেমন করে বিপন্ন হন, সমসাময়িক ‘বেদান্ত’ শিল্পগোষ্ঠীর কার্যকলাপেই তার পরিচয়। ওড়িশায় ‘বেদান্ত’ একটা অ্যালুমিনিয়াম কারখানা তৈরি করতে চাইছে। এখন এই অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচুর শক্তি লাগে। ১ মেট্রিক টন অ্যালুমিনিয়াম শোধন করতে ঘন্টায় গড়ে ২৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ লাগে। অ্যালুমিনিয়াম গলাতেও লাগে ঘন্টায় ১৩০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ। ১ টন অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনে কম করে ১৩৭৮ টন জল লাগে। এর সঙ্গে আছে প্রচুর বর্জ্যের সমস্যা বা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মতো গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের সমস্যা। জল, বিদ্যুৎ বা পরিবেশ দূষণকে যদি হিসেবের মধ্যে আনা হয়, তবে অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনের খরচ যাবে অনেক বেড়ে। তাই শিল্পপতি চায় পরিবেশ দূষণের জন্য যে সামাজিক ক্ষতি, সেটা থেকে যেন তাকে ছাড় দেওয়া হয়। সরকার যেন কম খরচে জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। এবার শিল্পপতিকে শক্তি ও জলের যোগান দেওয়ার জন্য নদীতে বাঁধ দেওয়া হল। মাটির তলা থেকে প্রভূত পরিমাণ জল তুলে নেওয়া হল। জলস্তর নেমে গেল। চাষের ক্ষতি হল। বাঁধেও শক্তির জোগান সবটা দিতে না পারায়, থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বসাল সরকার। প্রয়োজন হল, আরও কয়লা খনির ইত্যাদি।
আর এসবের ফলে মানুষ উচ্ছেদ হলেন তাঁদের বসত থেকে, জীবন জীবিকা থেকে। অথচ এই যে অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদন হল, তার বেশিরভাগটাই ব্যবহৃত হয় যুদ্ধাস্ত্র, এয়ারোপ্লেন ইত্যাদি নির্মাণে। বাসন কোসন নির্মাণে কিছু অংশ ব্যবহৃত হয় বটে, আমাদেরও সেরকমটাই বোঝানো হয়, কিন্তু সে খুবই সামান্য অংশ। এবং সেক্ষেত্রেও একটা কথা থেকে যায়। সেটাও উপেক্ষণীয় নয় মোটেই। একটু বেশি বয়সের যে ‘অ্যালঝাইমার্স’ রোগের কথা এখন হামেশাই শোনা যায়, তার একটি অন্যতম কারণ নাকি, অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার। ইস্পাত শিল্পের গল্পও প্রায় একইরকমের। অর্থাৎ বাঁধ বা বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের জন্যে নাম কা ওয়াস্তে, আসল দরকার সেই সব শিল্পপতিদের।
‘বিশ্বায়ন’ আর উদার অর্থনীতির দাপটে ইস্পাত, খনি, থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট, বাঁধ, সিমেন্ট কারখানা বা স্পঞ্জ আয়রন কারখানার জন্য আরও হাজার লক্ষ একর জমি নিচ্ছে শিল্পপতিরা, নতুন করে উচ্ছেদ হচ্ছেন, হতে চলেছেন বহু বহু মানুষ। তাঁদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার দিকে। তৈরি হচ্ছে ‘সেজ’ এলাকা, যেখানে শ্রমিক কর্মচারির অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। নিরন্ন অসহায় মানুষের ঢল নামছে এক সর্বগ্রাসী ‘উন্নয়ন’ পরিকল্পনায়। হাজারে হাজারে রাজিয়াদের পরিবারের মতো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
৩
এই অবস্থার মুখোমুখি হয়ে সমাজ বেশ অস্থির। যেখানে সেখানে প্রতিবাদ আন্দোলন। প্রতিরোধ আন্দোলনও। অসংগঠিত প্রান্তিক মানুষেরা যেমনভাবে পারছেন তাঁদের কথা বলতে চাইছেন। কী চাইছেন সে বিষয়ে তেমন কোন স্পষ্ট ধারণাও নেই সবসময়। ‘হতে দেবো না’, এই কথাটা স্পষ্ট, স্পষ্ট নয় কোন্টা ‘হতে দেবো’। নন-ফোকাসড্ দাবি-দাওয়া। আন্দোলনের নেতা কে, কার কথা সবাই শুনবে বোঝা যাচ্ছে না। যাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তাঁরাও জানেন না, কার সঙ্গে কথা বললে সমঝোতা সূত্র পাওয়া যাবে। আন্দোলনের চরিত্র অনেকসময়ই ‘লোকালাইজড’। যদিও আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চাইছেন, কিন্তু পরিষ্কারভাবে একমাত্র সেই নেতৃত্বই যারা তাদের সব দাবিদাওয়ার মান্যতা দেবে। যার ফলে যখন কোন কেন্দ্রীয় সংগঠন নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসছে, তারা কোন আলোচনায় যাচ্ছে না, কেননা তারা যদি কোন রফাসূত্র বের করে, সেই রফা যাঁরা আন্দোলন শুরু করছেন তাঁরা গ্রহণ করবেন কিনা জানা নেই। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, কাটোয়া তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা অণ্ডালের বিমান বন্দর বা সালানপুর ইস্পাত প্রকল্প বা পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার স্পঞ্জ আয়রন কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলন সর্বত্রই মানুষ একটা কথা বলতে চাইছেন যে, দেশের উপকার না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমার! আমি কি খাব, কি খাবে, কি পাবে আমার সন্তান-সন্তুতি?
সত্যিই তো দেশের জন্যে এই যে কয়েক কোটি মানুষ এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন, ঝুপড়ি বস্তিতে আশ্রয় নয়, মাথা গুঁজতে হয়েছে যাদের, তাঁদের কথা তো কেউই বলেন না। রাজিয়াদের কোন এক পূর্বপুরুষ, হয়ত ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোনো’র অবস্থাতেই ছিলেন, কিন্তু সন্তান বেচতেন না, এটা অন্তত নিঃসন্দেহে বলা যায়।
এখন প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা, জিন্দালের ইস্পাত কারখানায় তাঁদের কি লাভ! ‘সেজ’ করে শিল্পপতির মুনাফা হবে কিংবা দেশের অগ্রগতি হবে, বেশ তো, আমার? আমার জমি-জিরেত-ঘর-উঠোনের বিনিময়ে সেটা হবে কেন? আমার জল-জঙ্গল-জমি তোমরা কেড়ে নেবে কোন্ অধিকারে? এমনকি তাঁরা একথাও বলছেন যে আমার উন্নতি, আমরাই বুঝে নেব। রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক দল কি বলছে আমাদের দেখার নেই। লালগড়ের আন্দোলন তো তাই নিয়েই। সে আন্দোলন বলছে, ‘ভিক্ষা চাই না মা, কুকুরটা সামলাও। তোমাদের আর আমাদের উন্নয়ন নিয়ে ভাবতে হবে না, তোমাদের ‘উন্নয়ন’ পরিকল্পনা থেকে আমাদের মুক্তি দাও।’
এবং এই আন্দোলন বিস্তৃত হচ্ছে। বিস্তৃত হচ্ছে শুধু নয়, তীব্রতর হচ্ছে মূলবাসী জনজাতি এলাকা জুড়ে। কেননা জিন্দাল-টাটাদের মতো আরো সব কোম্পানি, মিত্তাল, এসার, পস্কো, রিও টিন্টো, বিএইচপি বিলিটন, বেদান্ত ঝাঁপিয়ে পড়েছে নানান ধরনের ব্যবসায়িক উদ্যোগে। ইস্পাত, খনি, থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট, বাঁধ, সিমেন্ট কারখানা, কি নয়! আর এই সব কারখানার একটা বড় অংশই মূলবাসী জনজাতি এলাকায়। উচ্ছেদ হবে হাজারে হাজার মূলবাসী জনজাতির মানুষজন। এক বিস্তৃত এলাকার মানুষ, এই পশ্চিম বাংলা থেকে ঝাড়খণ্ড ওড়িশা ছত্তিসগড় অন্ধ্র ও মহারাষ্ট্রের একাংশ নিয়ে যে বিস্তৃত এলাকা, যেখানে বাস করেন ভারতের মূল সব জনজাতি, তাঁরা উদ্বাস্তু হয়ে যাবেন। এঁরা কোথায় যাবেন, কি খাবেন, কেমন করে বেঁচে থাকবেন এইসব ভাবনা তেমনভাবে কারো নেই। কেউ বলছেন, তাদের ঘর করে দেবে। কোথায়? কেমন ঘর? যে বনভূমে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে লালিত, যে ভূমি তাঁদের নিজস্ব সেখান থেকে তাঁদের উচ্ছেদ হতে হবে।
উচ্ছেদই শুধু নয়, ওই সব কোম্পানী এখানে শুরু হলে নষ্ট হবে জল, জঙ্গল, পরিবেশ, ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমগ্র এলাকার বাস্তুতন্ত্র, ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে মানুষ। এমন সব দাবি নিয়ে আন্দোলনকারীদের কয়েকজন সুপ্রিম কোর্টে একটা জনস্বার্থ মামলাও করেছিলেন বেদান্তের বিরুদ্ধে। সুপ্রিম কোর্ট এই নিয়ে একটা অনুসন্ধান কমিটিও তৈরি করেছিল। কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, বেদান্তকে (ওড়িশায়) যদি খনি তৈরি করতে দেওয়া হয় তবে জলের উৎস শুকিয়ে যাবে, জঙ্গল হারিয়ে যাবে, হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।
বেদান্তের বিরুদ্ধে পরিবেশ ও মানবিক অধিকার নষ্ট করার এমন গুরুতর অভিযোগ আছে যে একসময়ে নরওয়ে পেনশন ফান্ডের একটা বড় বিনিয়োগ ছিল এই কোম্পানীতে, কিন্তু তা তুলে নেওয়া হয়েছে। জনস্বার্থ মামলায় ওড়িশার সমাজ-কর্মীরা এই অভিযোগও নথিভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু বিচারপতি কাপাডিয়া, এসব তো নয়ই এমনকি কোর্টের নিজস্ব রিপোর্টকেও কোনো গুরুত্ব না দিয়ে, বেদান্তের বদলে স্টারলাইট কোম্পানিকে খনি চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। স্টারলাইট বেদান্তেরই ‘সিস্টার কনসার্ন’। শুধু তাই নয়, প্রকাশ্য কোর্টে ঘোষণা করলেন, ওই কোম্পানিতে তাঁর নিজেরও লগ্নি আছে।‘ আর আমাদের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম তো ২০০৪ সালে অর্থমন্ত্রী হওয়ার আগে ‘বেদান্তের’ পরিচালকবর্গেরই একজন ছিলেন! আপাতত চিদাম্বরম অঙ্গীকার নিয়েছেন, এলাকা ‘মাওবাদ’ মুক্ত করবেন। তাদের হিংসাশ্রয়ী রাজনীতি থেকে শিল্পায়ন বাধামুক্ত করবেন। চলছে ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’।
‘গ্রিন হান্ট’ আসার আগেই, শিল্পায়ন বাধামুক্ত করতে গড়ে তোলা হয় একটি সংগঠন, ‘সালওয়া জুডুম’। বলা হয়, দেশের উন্নয়নে যারা বাধা দেবে তাদের সশস্ত্র বিরোধিতা করার জন্যই নাকি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এটা গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে ‘মাওবাদী’ হিংসা প্রতিহত করার জন্যে। গড়ে উঠেছে ঠিক সেই সময়, ২০০৫ সালের সেই সপ্তাহে, যে সপ্তাহে ছত্তিসগড়ের দাঁতেওয়াড়াতে, টাটা ছত্তিসগড় সরকারের সঙ্গে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি ইস্পাত প্রকল্প চুক্তি সম্পন্ন করে। পরবর্তীকালে অবশ্য এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ‘সালওয়া জুডুম’-এর যোদ্ধাদের অস্ত্র ও মাসমাহিনা জোগায় সরকারই। এমনকি ‘সালওয়া জুডুম’ গড়ে ওঠার সমসময়েই তৈরি হয়েছে বস্তার জেলায়, ‘জঙ্গল ওয়ারফেয়ার ট্রেনিং স্কুল’। উদ্দেশ্য, ‘মাওবাদী’ দমন।
8
‘মাওবাদী’ বা সিপিআই (মাওবাদী) রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতেই ঘোষণা করা হয়েছে যে তারা সশস্ত্র উপায়ে ক্ষমতা দখল করবে। মিলিশিয়া গড়বে, ফৌজ গড়বে, মুক্তাঞ্চল গড়বে, ঘাঁটি এলাকা গড়বে, গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরবে এবং অবশেষে দখল করবে রাষ্ট্রক্ষমতা। এই ধরনের কর্মসূচি ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন নয়। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির একটি পর্যায়ে এসব ছিল। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি এটা। সিপিআই (এম)-এর কর্মসূচিতেও এই বিপ্লব উল্লেখিত। সিপিআই (এম-এল)-ও এই কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল একসময়।
এই ধরনের কর্মসূচির সঠিকতা বেঠিকতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তবে একটা কথা মনে রাখা হয়ত ভালো যে সোভিয়েত রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষিত হওয়ার পর রাষ্ট্র পুনর্গঠনের যে কর্মসূচি নিয়েছিল তাতে কৃষকেরা যথেষ্টই বঞ্চিত হয়েছিলেন। কৃষি থেকে সম্পদ আহরণ করে যেভাবে বৃহৎ শিল্পযজ্ঞের সূচনা করা হয়েছিল সোভিয়েতের ‘নিউ ইকনমিক পলিসি’তে, তার সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন মাও-সে-তুঙ নিজেই তাঁর ‘এ ক্রিটিক টু সোভিয়েট নিউ ইকনমিক পলিসি’ বইয়ে। এবং বস্তুত আমেরিকার উন্নয়ন কর্মসূচির ধারণা থেকে সোভিয়েতের তেমন কোন পার্থক্য ছিল না। তফাতের জায়গায় ছিল উদ্বৃত্ত মূল্য ব্যক্তি মালিকানায় নয়, রাষ্ট্রীয় তহবিলে জমা হত, পরবর্তীকালে যা ‘স্টেট ব্যুরোক্র্যাটিক ক্যাপিটাল’ বলে চিহ্নিত হল। প্রথম অবস্থায় অবশ্য খাদ্য শিক্ষা স্বাস্থ্য বাসস্থান বা বস্ত্র প্রাথমিকভাবে মানুষের বেঁচে থাকার, ভালো থাকার যে চাহিদা তা পূরণ হয়েছিল, কিন্তু তার বিনিময়ে রুশ জাতিসত্তার কর্তৃত্ব মেনে নিতে হয়েছিল অন্যান্য জাতিসত্তা শুধু নয়, এমনকি পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকেও। আমরা এখন যাকে বলি ‘আউটসোর্সিং’ অর্থাৎ কম মজুরি দিয়ে অন্য জায়গা থেকে উৎপাদনের সামগ্রী তৈরি করিয়ে নেওয়া, তেমনি সেই সময়কার সোভিয়েতও পূর্ব ইউরোপকে বাধ্য করেছিল সোভিয়েতের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ তৈরি করে দিতে। আজারবাইজান, কাজিগিস্তান এর মতো এশীয় দেশগুলো যারা একদা সোভিয়েতের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল তারা তাদের মতো করে উন্নতির পথ খুঁজতে পারেনি, পরিণত হয়েছিল সোভিয়েতের কৃষিজাত সামগ্রীর খামারে। বৃহৎ রুশ জাতিসত্তার দেশ হয়ে গিয়েছিল গোটা সোভিয়েত রাশিয়া, রুশ ভাষা প্রান্তিক করে দিয়েছিল অন্যান্য সব ভাষাকে, স্বাধীনতা হরণ করেছিল অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষের এবং পরিবেশের এমন অপূরণীয় ক্ষতি করেছিল যে মধ্য এশিয়ার সুবিশাল উরাল হ্রদের মতো সুবিখ্যাত হ্রদ নিয়ে ১৯৮৭ সালে রুশ পরিকল্পনাবিদদের বলতে হল ‘আহ্, ওকে শান্তিতে মরতে দাও।’
এছাড়াও স্বাধীন চিন্তাভাবনার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রই ছিল রাষ্ট্রের নজরদারির অন্তর্গত। গুপ্তহত্যা থেকে আরম্ভ করে উপচে পড়া জেল সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার এক ভয়াবহ স্বাক্ষ্য বহন করে। আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বিশ্বে উপনিবেশ গড়ার লক্ষ্য ছিল সোভিয়েতের। সেও চেয়েছিল দুনিয়াটাকে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিতে।
পরবর্তীকালে অবশ্য সোভিয়েত রাশিয়াকে বলা হল, সাম্রাজ্যবাদ। কথাটা চিনের, বিশদ ব্যাখ্যাও তাদের। আমাদের দেশে এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছিল সিপিআই (এম-এল)। সেই চিনও, রুই এ্যালি, এডগার স্নো বর্ণিত চিনও, শুধুমাত্র ‘সেজ’ অঞ্চল গড়ে তোলার জন্যেই উচ্ছেদ করেছে কয়েক কোটি মানুষ। ‘হান’ জাতিসত্তা প্রান্তিক করে দিয়েছে অন্যান্য জাতিসত্তাকে। তিব্বতকে অধিকার করে নিয়েছে। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামির সংখ্যার হিসেবে বিশ্বের এক নম্বর দেশ। আর পরিবেশ! হোয়াংহোর জল আর সাগরে পৌঁছায় না, নদীবাঁধ ভেঙে কয়েক হাজার মানুষ ভেসে গেলেও সে খবর বাইরের জগতে আসে না। এমনকি দুধে প্রোটিন মাত্রা ঠিক দেখাবার জন্যে এমন জৈবরাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয় বলে অভিযোগ উঠেছে, যাতে মারা গেছে তার নিজের দেশের শিশুও। সাম্প্রতিককালে চিন বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ছে ব্রহ্মপুত্র নদীতে। যদি তা সফল হয় তবে আসাম পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা বাংলাদেশই বিপন্ন হয়ে যাবে। কৃষিব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে বাংলাদেশের অস্তিত্বই সংকটাপন্ন হয়ে উঠবে।
অনেকেই হয়ত বলবেন, রাশিয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিনও অধঃপতিত হয়ে গেছে। এর সঙ্গে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদের যোগ নেই। মাওবাদী পার্টি কংগ্রেসের রিপোর্টেও তেমনই বলা হয়েছে। সম্প্রতি এই পার্টির অন্যতম নেতা কিষাণ বলেছেন, বিশ্বে এখন কোন সমাজতান্ত্রিক দেশ নেই এবং তারা ক্ষমতা দখল করে যে উন্নয়ন করবেন সেখানে বৃহৎ শিল্প নয়, অগ্রাধিকার পাবে ছোট শিল্প, বাতিল করে দেবেন সব বিদেশি লোন। কিন্তু তার জন্যে যে সশস্ত্র উপায়েই ক্ষমতা দখল করতে হবে তার অনিবার্যতা বোধহয় আজকের বিশ্বে নেই। নেই যে তার স্বপক্ষে ইকুয়েডরের কথা জেনে রাখা দরকার, যদিও দেশটি ভৌগোলিক আয়তন ও জনসংখ্যায় বেশ ছোট-ই।
২০০৮ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ইকুয়েডরের রাষ্ট্রপতি কোরেয়া বিপুল ভোটে জিতে নভেম্বর মাসেই ৪০,০০০ লক্ষ ডলার বিদেশী ঋণ শোধ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আগের সরকারের ঋণ চুক্তি অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। তার আগের বছরেই ইকোয়েডর জাসুনি অঞ্চল থেকে খনিজ তেল তোলা বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ তেল তুলতে গিয়ে ওখানকার বনাঞ্চল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আদিম জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষজন। অবলুপ্ত হচ্ছে বিরল প্রজাতির জাগুয়ার, সাদা পেটওয়ালা স্পাইডার বাঁদর, চশমা ভালুক।
ইকুয়েডরে এখন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় তিন গুণ বাড়ানো হয়েছে, একক মায়েদের মাসিক বেতন দ্বিগুণ করা হয়েছে। ২০০৮ সালে সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার, সমকামিতার অধিকার, বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার অধিকার এবং পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নিশ্চয়তা দান সম্পর্কীয় একাধিক বিষয় সংবিধানের অন্তর্ভূক্ত করেছে। এমনকি ইকুয়েডরের নতুন সংবিধান প্রকৃতির অধিকারকে অনুমোদন দিয়েছে। সংবিধান ঘোষণা করেছে, প্রত্যেক মানুষের পানযোগ্য জল পাওয়ার অধিকার আছে। কোন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেই এই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না।
ক্ষমতার এই যে ধরন, ক্ষমতা যেখানে ধারক, ক্ষমতা যেখানে বিস্তৃত হয়ে সবার বসার জন্য চাদর বিছিয়ে দেয়, মানুষ প্রকৃতি সবার আশ্রয়স্বরূপ নিজেকে নির্মাণ করে, এই বোধ অনুপস্থিত সিপিআই (মাওবাদী) পার্টির কার্যকলাপে। তার ক্ষমতা আস্ফালনের সাযুজ্য বরং অনেক বেশি রাষ্ট্র ও বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সব দলের সঙ্গে। এমনকি এক প্রশ্নের উত্তরে সিপিআই (মাওবাদী) দলের নেতা শ্রী কিষাণ জানিয়েছেন, অন্যান্য রাজনৈতিক দল যেভাবে টাকা তোলে তাঁরাও সেভাবেই টাকা তোলেন। কর্পোরেট, কন্ট্রাকটরেরা কোন বিপ্লবের স্বার্থে ‘ডোনেশন’ দেন, এটা বোধহয় অজানা নয়। তাঁদের কার্যকলাপের সূত্রে আরও জানিয়েছেন যে, তাঁরা যে সব হত্যা সংগঠিত করেন, গণআদালতে বিচার করেই তাদের এই শাস্তি দেওয়া হয়।
৫
গণবিচারে হত্যা! নিঃসন্দেহে নিন্দার্হ। গণবিচার করেই শুধু নয়, প্রকাশ্য আদালতে বিচার করে (মৃত্যুদণ্ডাদেশের নামে) খুনও সমর্থনযোগ্য নয়। এমনকি সত্তর পরবর্তী দিনগুলিতে সুন্দরবনের কিছু কিছু অঞ্চলে বা বিহারে (প্রধানত পালামৌ জেলায়) বিচারের নামে এমসিসি যে চার আনা ছ’আনা দশ আনা এমনকি ১৬ আনা শাস্তির (১৬ আনা মানে হত্যা আর চার আনা ছ’আনায়, হাত পা ভেঙে দেওয়া ইত্যাদি) বিধান প্রবর্তন করেছিল তার বিরুদ্ধাচরণও ব্যাপকভাবে হওয়া উচিত ছিল। আমাদের লজ্জা, আমরা সেসবের প্রতিবাদ গুরুত্ব দিয়ে করতে পারিনি।
এই যে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবাদ করতে পারলাম না তার অন্যতম কারণ, রাষ্ট্র অনুসৃত নীতির মধ্যে কাঠামোগত যে ভয়াবহ ‘হিংস্রতা’ রয়েছে, যে আইনসিদ্ধ হিংস্রতার শিকার হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ, আমরা তারও প্রতিবাদ করতে পারিনি। যেমন, মূলবাসী জনজাতি যেসব জায়গায় বাস করেন সেখানকার অনেক জায়গায় মাটির তলায় নানান খনিজ পদার্থ। সরকার জানাল, সম্পদ যেহেতু মাটির তলায় সুতরাং সে সম্পদ রাষ্ট্রের। সম্পদ যখন মাটির ওপরের অরণ্য, সেও রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে খনিজ ও বনজ সম্পদের অধিকার সরকার নিয়ে নেবে। জমি দিয়ে দিতে হবে। মাটির তলায় যদি কিছু নাও থাকে, তবুও দিয়ে দিতে হতে পারে শিল্প এলাকার প্রয়োজনে। কিন্তু লক্ষ করার মতো বিষয়, কৃষ্ণা-গোদাবরী অববাহিকায় আরওয়ান কূপে রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ সন্ধান পেল গ্যাসের, পেট্রোলিয়াম গ্যাসের, সেই গ্যাসের মালিকানা তখন কিন্তু সরকার দাবি করে না। ওটা রিলায়্যান্সেরই। কেননা জমির মালিকানা রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজের। বিষয়টা নিশ্চয়ই আইনসিদ্ধ। রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজের জন্য আইন আর একজন সাধারণ নাগরিকের জন্য আইন তাহলে আলাদা। সত্যিই এ এক শিবঠাকুরের দেশ, এ দেশের নদীও নাকি সরকারের!
এমন সব হাজারটা কাজের নিরিখেই তো আজও সশস্ত্র উপায়ে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি মান্যতা পায়। ‘সাম্যে’ বিশ্বাসী মানুষজন ‘হিংসা’র আশ্রয় নেন, হিংস্রতাকে যথাযথ বলে প্রচার করতে পারেন। ‘রাষ্ট্রীয় (শ্বেত) সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে ‘লাল সন্ত্রাস’। কিন্তু এও তো রাষ্ট্রেরই ভাষা। রাষ্ট্রশক্তির ভাষা। ‘পারমানবিক শক্তিকে প্রতিহত করতে আমাদেরকেও পারমানবিক অস্ত্রে সজ্জিত হতে হবে’, এই যুক্তিতেই তো একের পর এক পরমাণু অস্ত্রবাহী ‘মিসাইল’এর পরীক্ষা চলতেই থাকে, বাজেটের এক সুবৃহৎ অংশই ব্যয়িত হয়ে যায় সমর শক্তিতে বলীয়ান হতে গিয়ে। আর আমার দেশের মানুষ থাকেন অভুক্ত। অশিক্ষা কুশিক্ষা নিরাপত্তাহীন মানুষগুলোর ভেতরের ঘৃণা, ক্রোধের আগুন হয়ে হিংস্রতায় ফেটে পড়ে। হয়ত এটা ঠিকই সেই আগুনে নিজেরাই জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যান, তবুও...।
হ্যাঁ। এই তবুও...
নানুরের শাসপুর গ্রামের টুনু কৈবর্তের ৬ বছরের ছেলে কৃষ্ণ মারা গেল এই অক্টোবরের ৯ তারিখে (২০০৯)। চামড়ায় মোড়া কঙ্কাল। মহামূল্যবান ‘ডেথ সার্টিফিকেট’এ মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছে ‘অপুষ্টি’। ২৩ নভেম্বর মারা গেল তার ২ বছরের মেয়ে মন্দিরা। এবারের ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হয়েছে ‘হাইপোথারমিয়া’, ‘সেপ্টিসেমিয়া’, ‘ম্যালনিউট্রিশান গ্রেড ৪’। টুনুর বর পাপু কৈবর্ত কাজ করতেন দিল্লিতে। কাজ হারিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে ফিরে আসেন দেশের বাড়িতে। শাসপুর গ্রামে। টুনুর কাজ জোটে লোকের বাড়িতে বাড়িতে। মাস গেলে তার রোজকার ছিল ৩০০ টাকা। সরকারি (পঞ্চায়েত) সাহায্য পরিবারটি পেয়েছিল অবশ্য, একবার ৩ কিলো গম ও কিছু জামাকাপড়।
কৃষ্ণ আর মন্দিরার মৃত্যু নিয়ে আমরা, নাগরিক সমাজের মানুষেরা, সরকারের কাছে কোনো কৈফিয়ৎ দাবি করিনি। সরকারও কোথাও দুঃখপ্রকাশ করেনি। বিডিও, জেলাশাসক, থানার ওসি, সিআই, পুলিশ সুপার বা মন্ত্রী- সাংসদেরা কেউই কোথাও বললেন না যে এই মৃত্যুর জন্য তিনি বা তাঁরা দায়ী।
না। অনাহারে মৃত্যুর জন্যে কেউই দায়ী হন না। কারোরই বিবেক দংশায় না। না হলে, গত এক দশকে, ১৯৯৭ থেকে ২০০৭, এই সময়পর্বে ভারতে ১ লক্ষ ৮২ হাজার ৯৩৬ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন, অথচ আমরা সবাই, সবাই-ই কেমন প্রায় নির্বিকার থেকেছি! শুধুমাত্র মহারাষ্ট্র অন্ধ্র কর্নাটক ও মধ্যপ্রদেশে ২০০২ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ১ লক্ষ ১২ হাজার কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। এই সময়ে ভারতে গড়ে প্রতি ৩২ মিনিটে একজন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। কারা জানাচ্ছে? এটি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট।
লাখের হিসাবে মানুষ মরছেন। ইচ্ছা করে কেউ মরে নাকি! বাধ্য হয়ে, বেঁচে থাকার প্রতিবাদ করে, নিজেকে খুন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই রিপোর্ট কেমন করে ক্রাইম ব্রাঞ্চের রিপোর্ট হয়! মানুষগুলো কী ক্রাইম করলেন? ক্রাইম করল তো সরকার। কোথায় তাঁরা নিজেদের অকর্মণ্যতায় থুতু ফেলে ডুবে মরবেন, তা নয় লাখো মানুষ ‘ক্রাইম’ করেছে বলে তথ্য নথিভুক্ত করলেন। এবং এরপরও এই স্বরাষ্ট্র দফতর থেকেই বলা হল, রাষ্ট্র নয়, মাওবাদীরাই ‘হিংসা’র আশ্রয় নিচ্ছে! এবং তাদেরও সেই ডেটারেন্ট থিয়োরি, খুন কা বদলা খুন।
খুন কা বদলা খুন। গরব সে কহো, ম্যায় হিন্দু হ্যায়, খুন কর মুসলমান। মিরাট ভাগলপুর... গুজরাট। কতজন মারা গেলেন সেই রণহুঙ্কারে? কতজন...? শুধু আরএসএস-বিজেপি কেন, মিরাট ভাগলপুরে প্রভিন্সিয়াল আর্মড কনস্টেবুলারির ভূমিকা কি আমরা ভুলে যেতে পারি? কতজন মারা গেলেন এবং যাচ্ছেন কাশ্মীর, মণিপুরে ... কতজন? নন্দীগ্রাম... কতজন? মরিচঝাঁপি ... কতজন? কতজন মারা যাচ্ছেন প্রতিদিন আমার বাংলায় রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতায়? আর প্রতিনিয়ত এই এত সব হত্যার খবর শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে, খুন হত্যা কেমন যেন গা-সওয়া হয়ে উঠছে শুধুই নয়, সামান্য এক সাইকেল চোরকে ধরতে পেরে, বাজারের মধ্যে, অনেক লোকের চোখের সামনেই, চোরকে গাছের সঙ্গে বেঁধে গায়ে সাইকেলের টিউব টায়ার জড়িয়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে যায়, গণ অংশগ্রহণে খুন হন মানুষ, নিছক সন্দেহবশেই, আমার এই বাংলায়। যে বাংলাকে নিয়ে আমার গর্ব, গর্ব শ্রীচৈতন্য বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথে। লালন শরৎ পণ্ডিতে। যে বাংলা একদা আমাকে চেনায় জসীমুদ্দীন থেকে শুরু করে অগণন আউল বাউল ফকির বৈষ্ণবকে।
৬
মৃত্যুকে ওরা কেমনভাবে চেনে, একবার জানতে চেয়েছিলাম সার্কুলার রেলের ধারের ঝুপড়ির বাচ্চাদের কাছে। বছর ১০-১২ আগে। সেসময় নান্দীকারের উদ্যোগে ওদের জীবন, ওদের জীবিকা, ওদের ‘দেখা’র জগৎ নিয়ে নাটক রচনা করা এবং ওদের দিয়েই সেই নাটক মঞ্চস্থ করার একটা কাজ চলছিল। সেসময়ে আমরা সপ্তাহে প্রায় ২/৩ দিন ওদের সঙ্গে অন্তত ৫-৬ ঘন্টা করে কাটাতাম। ‘মৃত্যু’ সম্পর্কিত এই জিজ্ঞাসার জবাবে খেয়াল করেছিলাম ২০-২২ জন বাচ্চার একজনও স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা শোনায়নি আমাদের। মৃত্যু তাদের কাছে জলে ডুবে, চাকু বা বোমের আঘাতে, গাড়ি চাপা কিংবা অত্যধিক নেশায়।
গোল হয়ে বসে চলত গল্প বানানোর খেলা। গল্পে কারোর হাতে ধরিয়ে দিই আমরা কিছু টাকা। গল্প চলে কিভাবে সে খরচ করবে সেই টাকা। ফুটপাথে থাকা আমাদের ছোট্ট সাগরী, ওই টাকা প্রথমেই মাকে খাওয়াতে খরচ করে ফেলে। তার আগে সে অবশ্য চেষ্টা করে দোকানে খাবার কিনে পয়সা না দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার। পারে না। দোকানদার ভারি চালাক। আমরা তার হাতে দিয়ে দিই আরো টাকা। সে নিজে খায়। ভাই বোনেদের খাওয়ায়। বাবাকে খাওয়ায়। আরও টাকায় সে বাড়ি কেনে। ঘরের রঙ পছন্দ করে শাদা। মাকে পরের বাড়ি কাজ করতে দেয় না। এবং অনেক টাকাতেও সে তার সেই মস্ত শাদা বাড়ির ঘরের কাজের জন্য কোন দাসী চাকর রাখে না (যদিও সে দিকে নিয়ে যেতে ওকে আমরা বার বার প্রলুব্ধ করেছিলাম, কিন্তু সাগরী বলেছিল ও কাজ ভালো না, বড্ড বকা খেতে হয়, খাটুনিও বেশি)। তার স্থায়ী রোজগারের জন্যে কিছু একটা উপায়ের কথা বলে বটে কিন্তু লেখাপড়ার ধারকাছ দিয়ে যায় না। এই খেলায় একবার তো একটি বাচ্চা, সে অবশ্য ফুটপাথের ঝুপড়িতে থাকত না, থাকত হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটা উদ্বাস্তু কলোনিতে, খুব সম্ভব সে তখন ক্লাস সিক্স বা সেভেনের ছাত্র, শেষ অবধি বলে উঠেছিল, আর টাকা হলে ওই টাকা উইয়ে খাওয়াবে। সে খরচ করা শুরু করেছিল পায়খানা তৈরি করা দিয়ে, বানিয়েছিল ভারি সুন্দর একটা ফুলের বাগান, আকাশ ছোঁয়ার একটা মই।
গল্প বানানো ছাড়া আর একটি মজার খেলা ছিল, গল্প হঠাৎ করে থামিয়ে দিয়ে যুক্তি তৈরি করা। যেমন চার বন্ধু পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে নানারকম সমস্যায় পড়তে থাকল। এবং প্রায় সব সমস্যাতেই দেখা গেল একজন একটু বেশি রকমই নিজের সুবিধা দেখছে। বেশ খানিকটা স্বার্থপর আর কি। এমনই এক অবস্থায় ওই বন্ধুটি পা ফস্কে পাহাড়ের ঢালে পিছলে গেল, এখন অন্য তিনজন ভাবছে ওকে টেনে তোলা উচিৎ কিনা। কেননা ওকে বাঁচাতে গেলে বেশ কিছুটা ঝুঁকি ওদের নিতে হবে। জিজ্ঞেস করা হল সবাইকে, কি করা উচিত? কেউ জানালো হ্যাঁ, আর কেউবা সরাসরি উচিত নয় বলেই নিজের অভিমত ব্যক্ত করল। বাচ্চাদের গোটা দলটিকে ভাগ করে দেওয়া হল দুটি দলে, হ্যাঁ’য়ের দল আর না’য়ের দল। এবার যে যার পক্ষে কথা বলছে, তাকে বলতে হবে, কেন বলছে। অন্য পক্ষের যুক্তি সে যদি খণ্ডন করতে না পারে তবে তাকে গিয়ে বসতে হবে অন্য পক্ষে। এমনি করে এক পক্ষ কমতে থাকে আর ভারী হতে থাকে অন্য পক্ষ। শেষ অব্দি দেখা যেত, জিতে যেত উদ্ধার করার পক্ষ, যদিও তারা প্রথম দিকে সংখ্যায় কমই থাকত।
সমস্যাতেও পড়ে যেতাম আমরা। যে সময় আমরা কাজটা শুরু করেছিলাম মেট্রো রেলের দমদম অংশ তখনও একেবারে শেষ হয়নি। ছেলেমেয়েদের রোজগারের একটা জায়গা ছিল, লোহা সরানো এবং আমাদের সঙ্গে কাজের একটা পর্যায়ে গিয়ে লোহা সরানো বা চলন্ত লরিতে চাল ডালের বস্তায় ডোঙা ঢুকিয়ে সেই ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে আসা চাল ডাল সরানো, এইসব কাজ তারা অন্যায় বলেই ভাবতে শুরু করেছিল। আর অন্যদিকে আমরাও ওদের অন্নসংস্থানের কোন হদিশ দিতে পারিনি। ফলে সে এক বিশ্রী অবস্থা। ওদের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও এত অসহায় হয়ে পড়েছিলাম...।
তবু নাটকের কাজটা চালিয়ে যাওয়া গিয়েছিল, কেননা ওরাও খুব মানসিক আরাম পাচ্ছিল। এবং শেষ অবধি মঞ্চস্থ হল ওদের নাটক ‘হল্লা’। নাটকে একটা ভাঙা পড়ে থাকা গাড়ি নিয়ে ওদের জার্নি। প্রথম অভিনয়ের দিন, গিরিশ মঞ্চে, সে এক অন্য দর্শক-শ্রোতা। ঝুপড়ি উজাড় করে মানুষজন। কি তাদের গর্ব! ক্ষুদে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কি উজ্জ্বল মুখচ্ছবি।
এই নাটকের দল নিয়ে আমরা অনেক অনেক জায়গায় গেছি। আয়োজকদের আমরা একটা শর্তই আরোপ করতাম। টাকা পয়সা কি দেবে না দেবে তা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলতেই পারে, তবে খাওয়া দাওয়া ও থাকার জায়গার বন্দোবস্ত, একটা নামী দলের ক্ষেত্রে যেমনভাবে করা হয়, তেমনভাবেই করতে হবে।
এভাবেই একবার আমরা শো করতে গেছি কৃষ্ণনগর। খাওয়ার ব্যবস্থা একটা বেশ ভাল ‘ইটিং হাউসে’। সবাই একসঙ্গেই বসে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করছি। বড় জায়গা। আমাদের একটা টেবিলে দুটো জায়গা খালি ছিল। সেখানে একজন খেতে বসলেন। বসেই খেয়াল করলেন, এমন অনেকজন খাচ্ছে যারা স্পষ্টতই সে দোকানে বেমানান। বেমানান পোশাক আশাকে, বেমানান কথাবার্তা বা খাওয়ার আদব কায়দায়। তিনি বেশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই ওই টেবিলের একটি বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই তোরা কারা? এখানে কেন?
আমরা চারজন ছিলাম পাশের টেবিলে। দেখছিলাম আমাদের ক্ষুদে অভিনেতাটি কি বলে! চিন্তিতও ছিলাম, কেমনভাবে ছেলেটি ফেস করবে এই পরিস্থিতি। আমাদের অবাক করে দিল ছেলেটির উত্তর। ও বলল, বলল কোন তাড়াহুড়ো না করেই, সময় নিয়ে খেতে খেতেই, “আমি মুজাহিদ। অভিনয় করতে এসেছি আপনাদের পাশের হলে। সন্ধেয় আমাদের নাটক। হল্লা। আপনি দেখতে আসবেন কি? টিকিট না পেলে, সাজঘরে চলে আসবেন। আমাকে ডাকবেন। আমি আপনাকে কমপ্লিমেন্টারি দেবো...।”
মনে পড়ে যাচ্ছিল ১৯৯২ সালের কলেজের গরমের ছুটির সময়কার একটা দিনের কথা, প্রথম যেদিন মুজাহিদদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মুজাহিদদের দূর থেকে দেখছিলাম, কি দারুন উৎসাহে নিজেদের মধ্যে গল্প হৈ চৈ করছিল আর আমাদের সঙ্গে ওর দিদিমণিরা যখন পরিচয় করিয়ে দিল, তখন সে কিরকম কুঁকড়ে গেল এবং আরো পরে জেনেছিলাম ভদ্রলোকদের সঙ্গে ওদের বনে না। এই মুজাহিদ সেসময় হয় কথা বলতে গেলেই মুখ খারাপ করত, না হয় ক্লাসরুমের একটা কোণ বেছে নিত আমাদের কাছ থেকে লুকোবার জায়গা খুঁজে নিতে। ওদের সঙ্গে আমাদের প্রথম দেখা ‘ক্যালকাটা রেসকিউ’ নামের এক ডে কেয়ার সেন্টার ও ইনফর্মাল স্কুলে। কৃষ্ণনগরের খাওয়ার টেবিলে অন্য এক মুজাহিদ, অনুভব করেছিলাম ক্ষমতায়নের এক প্রকাশ।
কেমনভাবে সম্ভব হল এই ক্ষমতায়ন? ভাবতে চেয়েছি আমরা। যত ক্ষুদ্রই হোক তার প্রকাশ। মুজাহিদদের তো যেতে হবে আরও অনেক অনেক দূর, কতটা দূর গেলে ক্ষমতায়নের সফল এক প্রকাশ হবে তার কোন মাপকাঠি নেই যদিও। আরও খোঁজ করতে থাকি ওদের জীবন।
আমাদের কলকাতা এমন এক শহর (অন্য কোন শহর আমার তেমনভাবে দেখা হয়নি অবশ্য, সুতরাং কোন তুলনামূলক বিচারে যাচ্ছি না। আর এই শহরটাকেও যে খুব বেশি চিনি এমনও দাবি করছি না, কেবল উত্তর কলকাতার কিছু কিছু এলাকা একটু বিশদে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি মাত্র), যেখানে আপনি যদি আপনার নিজস্ব পরিপার্শ্ব থেকে একটু ছুটি নিতেন, তাহলে দেখতে পেতেন আমাদের এই শহরে না খেয়ে মরে যাওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। কত জায়গায় কত যে আয়োজন, কত রকম কত ধরনের যে আয়োজন, ভাবা যেত না। মল্লিকঘাটের কুস্তির কসরৎ থেকে চোখ ফেরালেই দেখতে পেতেন সার দিয়ে লোকেরা বসে খাচ্ছে, কেউ একজন খাওয়াচ্ছে। গরম পুরি, সঙ্গে তরকারি। পরে তরকারি দেওয়া যখন উঠে যায় তখন ঠিক তার পাশেই বিক্রি হতে থাকে তরকারি। পকেটে রেস্ত থাকলে পুরি তরকারি, না থাকলে শুধুই পুরি। তখন সকালবেলা মল্লিকঘাটের ফুলের হাটে দূরদূরান্ত থেকে আসছে ফুল, অনেক অনেক ফুল, ঝকঝকে রঙের তাজা ফুল, সুবাসিত ফুল, গাঁথা হচ্ছে মালা, ফুলের তোড়া, ফুলের খুচরো বিক্রেতারা এখন পাইকারের ক্রেতা।
হেঁটে হেঁটে চলতে থাকুন গঙ্গার পুব দিকের পাড় বরাবর। নুনপট্টি হয়ে আহিরীতলা। খাওয়া আর একবার সারতে পারতেন নিমতলার ভূতনাথ মন্দিরের ওখানে। কেউ না কেউ খাওয়াচ্ছে। পূণ্যের লোভে। উপলক্ষ্য কোনো মৃত্যু বা জন্মদিন, ব্রত উদযাপন বা ব্যবসায়ে কোনো লাভ বা এমন কোনো একটা কারণ যা একমাত্র তিনিই জানেন যিনি খাওয়াচ্ছেন। এমনি চলত সকাল থেকে সন্ধে, গঙ্গার ধার বরাবর। আহিরীতলার কাছে এক পাঞ্জাবি মানুষ ছিলেন, যিনি রাত্রে বেশ কিছু মানুষকে রুটি খাওয়াতেন। নিজের হাতে তৈরি রুটি।
বড়বাজারের আড়তে আড়তে ছিল পথশিশুদের রেশন কার্ড। প্রতিদিন সন্ধেয় ওই কার্ডে বাচ্চাদের মিলত চাল, ডাল, তেল এমনকি মশলাও। গুদাম ঝাঁট দেওয়া জিনিস নয়, ভাল মানের খাদ্যসামগ্রী। ব্যবসায়ীদের নিজেদের উদ্যোগেই।
সবই বলছি ছিল, হত, থাকত। কেননা সেই কলকাতা হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত; ফ্লাইওভার মল, জেএনএনইউআরএম প্রকল্প, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, জাপান সরকারের ঋণে ঝাঁ চকচকে শহর কলকাতা গড়তে গিয়ে। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে একদা এই শহরে আশ্রয় পাওয়া মানুষগুলো; দেশভাগ, বন্যা, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে আক্রান্ত আর জীবিকার সন্ধানে উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষগুলো। এরা সব উদ্বৃত্ত মানুষ! এদের গায়ে গন্ধ, এরা নোংরা স্বভাবে আচরণে! অথচ...
গঙ্গার ঘাটে কখনও কখনও পড়ে থাকতে দেখা যায় সদ্যোজাত শিশু। কোনো অভাগা মা, সামাজিক বা অর্থনৈতিক কোনও এক বা একাধিক কারণেই এভাবে তাঁর শিশু ফেলে যেতে বাধ্য হন। আর আমাদের সেই ঝুপড়ির ছেলেমেয়েগুলো খেলতে গিয়ে যদি দেখত অমন কোনো শিশু শুয়ে আছে গঙ্গার ঘাটে, তখনি সে তাকে পরম যত্নে নিয়ে আসত তার ঝুপড়িতে। সানন্দে বাচ্চাটিকে গ্রহণ করে নিত বাড়ির অন্যান্যরা। এ কোল ও কোল সব কোলেই আদর সেই শিশুর।
আমরা বলতাম, আপনাদেরই চলে না, আরেকটি বাচ্চা! কথা শেষ হওয়ার আগেই উত্তর চলে আসত, আমাদের যদি দু মুঠো জুটে যায়, ওরও যাবে। আমরা বলতাম, যদি কোন পুলিশ টুলিশের ঝামেলা হয়! ওরা বলত, হলে হবে, খুঁজে পেলে তো...।
কুড়িয়ে পাওয়া এই শিশুটি যদি মেয়ে হয় তবে ১১-১২ বছর বয়স হলেই, বাড়ির ছেলে সদস্যটিকে শুতে হত ঝুপড়ির বাইরে, মেয়েটি ভেতরে, আর যদি ছেলে হত তবে সে অন্যদের মতোই শুত, ঝুপড়ির ভেতরে বা বাইরে, স্থান যেমন যেমন সঙ্কুলান হত। শিশুটির অল্প বয়সেই তাকে জানিয়ে দেওয়া হত তার জন্মবৃত্তান্ত। ব্যস। ওই পর্যন্তই। তারপর আর সবই স্বাভাবিক সম্পর্কসূত্র। এবং সে যে ওই পরিবারেরই সন্তান এ এক অলঙ্ঘনীয় সত্য, সুতরাং ওই পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে কোনো শরীর সম্পর্ক গড়ে তোলা যাবে না।
লক্ষ্য করার মতো বিষয়, এক, যে বাচ্চাটি শিশুটিকে কুড়িয়ে নিয়ে এল সে কিন্তু তার বাবা-মার অনুমতির অপেক্ষা করেনি এবং বাবা-মা-ও কখনই এমন কোন অনুমতির প্রয়োজন, অনুভবই করেননি; দুই, কুড়িয়ে পাওয়া বাচ্চাটি সে পরিবারের সন্তান নয়, তা জানা সত্ত্বেও সে পারিবারিক বিধিনিষেধের অন্তর্গত। এই মানুষগুলো এখানে যে বহু বহু দিন একত্রে বাস করছেন এমন কিন্তু নয়, তবু তারা গড়ে তুলেছেন নিজেদের ধরনে এক রকমের একটি কাঠামো, সমাজ (হ্যাঁ ঝুপড়ি সমাজ) বিধান।
এবং এই বিধান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রসারিত। যেমন, একজন অন্যের কাছ থেকে ধার করলেন। একটু বেশি টাকাই। খালি হাতে এই ধার পাওয়া সম্ভব নয়। তাকে কিছু না কিছু বন্ধক দিতে হবে। বন্ধকী জিনিসের যেমন দাম, ধার পাওয়া যাবে সেই অনুপাতে। প্রায় ৮০ শতাংশ অব্দি। যে ধার নেবে তাকে জানাতে হবে কবের মধ্যে সে শোধ দেবে। সাধারণভাবে দিনসীমা ৪ থেকে ৬ মাস। একজন সাক্ষী থাকেন, সাধারণভাবে যিনি ঝুপড়িবাসীদের মধ্যে শ্রদ্ধেয়। তিনিও অবশ্য ওই ঝুপড়িরই বাসিন্দা। ওই নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে টাকা ফেরত দিতে পারলে কোন সুদ বা বাড়তি টাকা লাগবে না, কিন্তু দিন পেরিয়ে গেলে সে আর জিনিস ফিরে পাবে না।
অনিশ্চিত জীবনের মধ্যেও কেমন এক নিশ্চিত বিশ্বাস-যাপন। নিজেদের ওপর নির্ভরশীলতা। একের অপরের ওপর আস্থা। মানুষের নিজস্ব সহজাত ক্ষমতা। কিন্তু আমরা কিভাবে যেন বিশ্বাস করি, মানুষের প্রকৃতি হচ্ছে কেবলই, স্ট্রাগল ফর এগজিস্টেন্স’, একে অপরের সঙ্গে লড়াই এবং থেকে যাবে তারাই যারা বলবান, ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’। অথচ ফুটপাথের হতশ্রী যাপনে বাধ্য মানুষও এগজিস্টেন্সের জন্য প্রতিযোগিতা নয়, নির্ভর করেন একে অপরের ওপর, বিশ্বাস করেন একে অপরকে। সারভাইভাল বলতে বোঝেন, ফেলে যাওয়া শিশুটিকেও কোলে তুলে নেওয়া। ফুটপাথের জীবন ও জীবিকার সংকট তাঁদেরকে এভাবেই বাঁচতে শিখিয়েছে। বস্তুত এটাই আবহমান কাল ধরে আমাদের অস্তিত্ব টিঁকে যাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত। ‘মিউচ্যুয়াল কোঅপারেশন অ্যান্ড মিউচ্যুয়াল এইড’। দুর্বল সদস্যটিকে আলাদা করে যত্ন করা এবং সেটাই স্বাভাবিকতা। এর জন্যে প্রয়োজন হয়নি কোনো অনুশাসন।
৭
এই যে এভাবে বাঁচা বা অন্যকে বাঁচানো, রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের এমন ক্ষমতায় বিশ্বাস করে না। রাষ্ট্র পরিচালকদের বিশ্বাসে ক্ষমতার অর্থ দমন, প্রভুত্ব। স্বসম্প্রদায়নির্ভর স্বনির্ভর সমাজ যদি গড়ে ওঠে তাহলে তার কর্তৃত্ব খর্ব হবে। স্বসম্প্রদায়নির্ভর স্বনির্ভর সমাজ তাই অপসৃয়মান। রাষ্ট্র যত ক্ষমতাশালী হয়েছে বা বলা ভালো রাষ্ট্রকে আমরা যত ক্ষমতাশালী করেছি, ওই সমাজেরও ততটাই অবলুপ্তি ঘটেছে। সার্বিক অস্তিত্ব এখনও যতটুকু আছে তা কেবল আদিবাসী সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অবশ্য আদিবাসী সমাজ বলতে একটি কোন হোমোজিনিয়াস অস্তিত্ব বোঝায় না। একই জনজাতি বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকায় তাদের মধ্যেও ভিন্নতা বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, মানুষের সংস্কৃতি যেহেতু বহমান ও সম্প্রসারণশীল, সুতরাং স্থিত সম্প্রদায়ের সঙ্গে পাশাপাশি অবস্থিত অন্য সমাজেরও ক্রমাগতই মিশ্রণ ঘটে চলে। কৃষ্টি পরিশীলিত হওয়ার মধ্য দিয়েই তো সভ্যতার পথ চলা। জ্ঞানের জগৎ খুলে যাওয়া, অজ্ঞানতা থেকে উদ্ভূত সংস্কারের আবর্জনা থেকে মুক্ত হওয়া। এটাই ছিল স্বাভাবিক পথ।
এই স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ হয়ে গেল রাষ্ট্রের আবির্ভাবে। বলা হল, মানুষ যদি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে না থাকে তাহলে সমাজবদ্ধ মানুষ নিজেরা মারামারি করবে এবং নিজেদের সক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে সমর্থ হবে না। বলা হল, মানুষ সমাজের অন্তর্গত, সমাজ দেশের অন্তর্গত। দেশ পরিচালিত হবে এক কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনায়। বৈচিত্র্য অবাঞ্ছিত বোধ হল। প্রয়োজন হল একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার। সেই রাষ্ট্রব্যবস্থায় থাকবে সরকার, আইন আদালত, স্কুল কলেজ, এমন সব বহু প্রতিষ্ঠান। থাকবে পুলিশ মিলিটারি প্রশাসন। রাষ্ট্রকে, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মান্যতা দেওয়াই সেই দেশের প্রতিটি মানুষের পবিত্র কর্তব্য।
সবাই যে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অনিবার্যতাকে মেনে নিলেন তা অবশ্য নয়। অনেকেই বললেন মানুষ জন্মগতভাবে ভালো, একে অপরকে দেখে এবং এ ওর দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, সুতরাং রাষ্ট্রের কোন প্রয়োজন নেই। অনেকে আবার এও জানালেন, এখন রাষ্ট্রের প্রয়োজন বটে তবে রাষ্ট্রব্যবস্থা নতুনভাবে শ্রেণিবিন্যাসে বিন্যস্ত করে মানুষকে স্বার্থপরতা থেকে বের করে নিয়ে এসে রাষ্ট্রের বিলোপসাধন করতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকৃত, কিন্তু কেবল বর্তমানেই সীমাবদ্ধ, ভবিষ্যতে নয়।
রাষ্ট্রকে আমরা না হয় মান্যতা দিলাম। বিনিময়ে রাষ্ট্র কি দেবে? রাষ্ট্র, ভারত রাষ্ট্র তার সংবিধানে সে কি কি প্রতিশ্রুতি পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ তা আমাদের জানিয়েছে। জানিয়েছে রাষ্ট্রের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য এবং সরকারকে পালন করার জন্য বেশ কিছু নির্দেশিকাও সে দিয়েছে। সেখানে ভারতের নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য, বস্ত্র, অধিকার, স্বাধীনতা সব কিছুই উল্লেখিত থাকল।
উল্লেখিতই থাকল। কিন্তু চোখের সামনে সংবিধানের যে কাঠামো আমরা দেখলাম সেটা পরিবর্তিত এক ছবি। সব ধর্মেই ভাল ভাল কথা বলা হয়েছে, অথচ ধর্মীয় ভেদাভেদ, বিদ্বেষ, সংঘর্ষ কিন্তু নিত্যদিনের। অন্যধর্মসহিষ্ণুতাও রয়েছে আবার অন্য ধর্মকে ঘৃণা করাও রয়েছে। রাষ্ট্রের সংবিধানও তেমনই। সম্পত্তির অধিকারও স্বীকৃত, উচ্ছেদও আইনসিদ্ধ। ব্যক্তি স্বাধীনতা স্বীকৃত, আবার অধিকার হরণের অধিকারও দেওয়া রয়েছে। ধর্মীয় অনুশাসনের মতোই হাজারো তার ধারা উপধারা। এবং সবেরই ব্যাখ্যা আছে।
সবেরই ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যাকারও আছে। এবং এমন সব জটিল ব্যাখ্যা যে সাধারণ মানুষের বোঝার সাধ্য নেই। এসব বুঝতে পারেন বিশেষজ্ঞ মানুষজন। চলতে ফিরতে এঁরাই আমাদের ভরসা। ধর্মীয় পুরোহিত। এঁরাই ঠিক করে দেন আমাদের পাঁজি পুঁথি। সংখ্যা বিচারে এঁরা মাইনরিটি হলেও এই মাইনরিটিই নিয়ন্ত্রণ করেন মেজরিটিকে। একথা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি সত্যি বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামোতেও।
মাইনরিটির যদি মেজরিটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তবে তাকে রাষ্ট্র পরিচালনার যেসব প্রতিষ্ঠান আছে তা দিয়েই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে। পুলিশ প্রশাসন, আইন-আদালত তাদের হাতেই থাকতে হবে। এ সব পরিচালনা করতে তার আবার সমাজ বিচ্ছিন্ন মানুষজনের অথবা সমাজবদ্ধ মানুষজনকে সমাজ-পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়োজন হবে। তাঁরা সবাই আজ্ঞাবহ হয়ে উঠবেন রাষ্ট্র পরিচালকবর্গের। হতে তাঁদের হবেই, কেননা সমাজবিচ্ছিন্ন এইসব মানুষজন তো জানেনই না কেমনভাবে একে অন্যের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা যায়। তাঁরা কি ভাবতে পারেন বন্ধ কল-কারখানার শ্রমিকেরা, খরা-বন্যা-আয়লায় বিধ্বস্ত মানুষেরা কেমনভাবে বেঁচে থাকেন? জানেন না। তাঁরা খুঁজে পান শুধুই প্রতিদ্বন্দ্বিতা, একে অপরকে সরিয়ে কেমনভাবে ক্ষমতার বৃত্তে আসতে পারা যায়, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সুতরাং তাঁকে ভুগতে হয় নিরাপত্তাহীনতায়। নিরাপত্তা ক্রয় করতে হয় তাঁকে। বাজার থেকে কিনতে হয়। বাজারের ওপর তিনি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। সুতরাং কেনার ক্ষমতা যাতে থাকে তার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। কেনার ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এবং আরও বেশি বেশি ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্য রাষ্ট্রের কাছাকাছি থাকতে হয়। তোষামোদ করতে হয় রাষ্ট্রপরিচালকদের। ক্ষমতার শীর্ষে থাকা মানুষজনদের চাওয়া বুঝতে হয়, মান্যতা দিতে হয়, যদি সে চাওয়া অনৈতিক হয়, তাহলেও। যে পিতা সন্তানের না ফেরা অব্দি না খেয়ে অপেক্ষা করেন, সেই পিতাও রাষ্ট্রের নির্দেশে গুলি করেন অন্য এক পিতা-মাতার সন্তানকে। নিজস্ব ন্যায়-নীতিবোধ অর্পণ করেন রাষ্ট্রের বেদীমূলে।
এই সব ব্যবস্থা যাতে মসৃণভাবে চলে, তার জন্যে রাষ্ট্রকে সদাই সতর্ক থাকতে হয়। খেয়াল রাখতে হয় যাতে রাষ্ট্রকে কেউ চ্যালেঞ্জ না জানায়। এবং যেহেতু সে জনসংখ্যায় মাইনরিটি সুতরাং এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করতে হয়, যাতে বোঝানো যায় তার অনুসৃত পরিচালন সংস্কৃতিই মেইনস্ট্রিম। এবং এই মেইনস্ট্রিমেই সবাইকে আসতে হবে। এই মেইনস্ট্রিমের ধ্যানধারণাই অনুকরণ করতে হবে। এই মেইনস্ট্রিমই দেশের ভালমন্দ সবকিছু নির্ধারণ করার উপযুক্ত। বাকি সব মানুষ, যাঁরা আসতে চাইলেন না, যাঁরা আসতে পারবেন না, যাঁদের আসতে দেওয়া হবে না, তাঁরা সবাই প্রান্তিক।
বহু দিন ধরে বহু বহু মানুষ যেসব কাহিনির ভিতর দিয়ে নিজেদের কল্পনার জগতে যাতায়াত করেছেন অনায়াসে, এবার সেইসব কাহিনি হয়ে গেল ‘লোক কাহিনি’, সঙ্গীত ‘লোক গান’, সংস্কৃতি ‘লোক সংস্কৃতি’। নির্মাণ করা হল নতুন গল্প। নতুনতর আঙ্গিকে নতুন সংস্কৃতি। গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে নয়; অতীতকে প্রায় অস্বীকার করে, সংস্কৃতিকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলে ভিন্ন এক যাত্রা। সে যাত্রাপথে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সুবৃহৎ সংখ্যক মানুষ হয়ে গেলেন প্রান্তিক। নগরের কাছে গ্রাম প্রান্তিক, উচ্চবর্গের কাছে নিম্নবর্গ প্রান্তিক, হাইওয়ের কাছে সড়ক প্রান্তিক, মলের কাছে বাজার প্রান্তিক, রেফ্রিজারেটর-ওয়াশিং মেশিনহীন যাপন, প্রান্তিক যাপন এমন বহুতর প্রান্তিকতা। প্রান্তিকতার বহুতর স্তর। বিভাজিত হতে হতে সীমাহীন একক।
এই মেইনস্ট্রিম যাপন প্রণালীতে মাইনরিটি চায় প্রান্তিক মেজরিটি ধীরে ধীরে চোখের আড়ালে চলে যাক। নগরবাসী মফস্বলে চলে যান। একসময় আমরা বলতাম, অল ওয়ে লিডস টু রোম, শহরের আর্কিটেকচার তেমনই হত, সব রাস্তা শহরে এসে পৌঁছোত, আর এখন শহরের পাশ দিয়ে বড় বড় হাইওয়ে চলে যায়, শহরকে ছুঁয়ে মানুষজন এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যান, শহরে ঢুকতে হয় না, বাঞ্ছিতও নয় শহরে থাকা। শহর, বাসস্থান ক্ষমতার বৃত্তে থাকা মানুষজনের। শহরে থাকতে হলে আলাদা যোগ্যতা থাকতে হবে।
তবে মানুষ যেহেতু জড়বস্তু নয় তাই সবাই একইরকম ব্যবহার করবে বা রাষ্ট্র যেমন যেমন চাইবে ঠিক তেমন তেমনই ঘটবে এমন নয়। তা ছাড়া জ্ঞানচর্চারও একটা ভূমিকা থেকেই যায়। একজন মানুষ নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন, নির্ধারণ করেন তার এমন এক অবস্থান যা রাষ্ট্রের অভিপ্রেত ছিল না। ভূমিকা থেকেই যায় সেইসব মানুষজনের, যারা সমগ্র সত্তা দিয়ে ভালবাসেন তাঁদের মাটি, জল, জঙ্গল, নদী, প্রকৃতি এবং আঁকড়ে ধরতে চান তাঁদের যাপন-নিজস্বতা। সেই অসংখ্য ‘আমি’, আমার, আমার পরিবার, আমার আত্মীয়-স্বজন-পরিজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে এক বৃহত্তর সমাজ-প্রকৃতিতে মুক্তির আনন্দ খুঁজে নেয়। শুধু বিমূর্ত জ্ঞানচর্চাই নয় প্রাত্যহিক যাপনের সঙ্গে নিজের সৃজনীর মেলবন্ধনেও খোঁজে মুক্তি। নিজের মধ্যে ‘অপরকে স্থাপন করে’ সেই মানুষ হাঁটতে থাকেন, খোলা আকাশের নিচে নিজেকে নতুন করে খুঁজে নিয়ে অবগাহন স্নান করেন কোনো এক স্রোতস্বিনী ধারায়, যাপন-মলিনতা থেকে মুক্ত করেন নিজেকে, ডানা মেলেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরিচয় সন্ধানে। আনন্দ সন্ধানে।
এমনভাবে বলা যায় আমাদের কেউ কেউ যেমন সুখ সন্ধানে ব্যস্ত তেমনই অনেকেই আবার সুখের চেয়েও আনন্দের সন্ধানী। সুখ আর আনন্দের মধ্যে ভারি সুন্দর একটা প্রভেদ আমাদের চিনিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। বলছেন, ‘সুখ প্রতিদিনের সামগ্রী। সুখ শরীরের কোথাও ধুলা লাগে বলে সংকুচিত, আনন্দ ধুলায় গড়াগড়ি দিয়া নিখিলের সঙ্গে আপনার ব্যবধান ভাঙিয়া চুরমার করিয়া দেয়। এইজন্য সুখের পক্ষে ধুলা হেয়, আনন্দের পক্ষে ধুলা ভূষণ। সুখ কিছু হারায় বলিয়া ভীত। আনন্দ, যথাসর্বস্ব বিতরণ করিয়াই পরিতৃপ্ত। এইজন্য সুখের পক্ষে রিক্ততা দারিদ্র্য; আনন্দের পক্ষে দারিদ্র্যই ঐশ্চর্য।। সুখ সুধাটুকুর জন্য তাকাইয়া বসিয়া থাকে। আনন্দ, দুঃখের বিষয়কে অনায়াসে পরিপাক করিয়া ফেলে। এইজন্য কেবল ভালোটুকুর জন্যই সুখের পক্ষপাত- আর আনন্দের পক্ষে ভালোমন্দ দুই-ই সমান।
৮
আজ ০৮-১২-২০০৯। চাল কমবেশি ২০-২৪ টাকা, আলু ১৮-২০ টাকা, পিঁয়াজ ৪৫ টাকা, মুসুর ডাল ৭৫ টাকা, মুগ ১০০ টাকা, অড়হর ৮০ টাকা, চিনি ৩৮ টাকা। রাজিয়ার মায়ের জরি বসানোর কাজে মজুরি ৪০ টাকা। এই লেখাটা যিনি কম্পোজ করবেন তাঁর মজুরি দিনে ১০০-১২০ টাকা, যাঁদের কাছে লেখাটা যেতে পারে তাঁদের মাসিক রোজগার কমবেশি অন্ততপক্ষে ১০,০০০ টাকা অর্থাৎ দিনে অন্তত ৩৫০ টাকা। যুব ছাত্র রাজনৈতিক কর্মী বাদ দিলে এই ধরনের লেখার কথা যাঁরা ভাবেন তাঁদের উপার্জন মাসে অন্তত ২০-৩০ হাজার। ব্যতিক্রম নেই, তা নিশ্চয়ই নয়। তবু এও একটা খণ্ডচিত্র - যারা ভাবছেন এবং যাদের নিয়ে ভাবছেন; যা ভাবছেন, যেভাবে ভাবছেন এবং যে পদ্ধতিতে ভাবনা প্রকাশ করছেন সেসব নিয়ে। ভাবার অবসর আছে যাঁদের তাঁরা ভাবছেন, কিন্তু যাঁদের নিয়ে ভাবছেন তাদের কোন অবসর নেই। শুধু অবসরই নয়, পরিসরও নেই।
যাঁদের অবসর আছে, পরিসর আছে, তাঁদের আজ গভীরভাবে ভাবনার অবকাশ আছে এই দেশটা নিয়ে। অন্যের হয়ে ভাবনা ভেবে দেওয়ার জন্যে নয়, ভাবনার কারণ এই, যে আমি এতদিন বেঁচে থেকে আমার যাপন আয়ত্ব করলাম, আমার সেই প্রতিষ্ঠার অন্তরালে যে অসংখ্য মানুষ শ্রম দিয়ে গেছেন, আমার অন্ন জুগিয়েছেন নিজেরা নিরন্ন থেকেও; পোশাক বয়ন করে দিয়েছেন, নিজেরা স্বল্পবাসে থেকেও, আমার প্রয়োজনীয় কাগজ, বইপত্র, সব, সবকিছু জুগিয়ে গেছেন, তাঁদের ঋণ তো শোধ করা হয়ে ওঠেনি আমার সেসময়, এখন সময় সেই ঋণ পরিশোধের। আমায় ভেবে ঠিক করতেই হবে, কেমন করে আজ শুধৰ সেই ঋণ।
শুধু তাই নয়, আমার অবস্থানগত ভাবনা প্রতিবেশীকে নিয়ে, প্রতিবেশ নিয়ে, আমার আমাদের সন্তান-সন্ততি-স্বজন-পরিজনদের নিয়ে কিংবা আরও বাড়িয়ে নিয়ে জগৎ সংসারকে নিয়ে। আজ আর বিলাস নয়। নিজের জন্যেই এই ভাবনা প্রয়োজন। যে রাস্তা দিয়ে আমাকে হেঁটে যেতে হবে, সে রাস্তা অপরিচ্ছন্ন থাকলে হাঁটার আনন্দই যে মাটি হয়ে যাবে। যে শস্য আমি খাব, সে শস্যে যদি ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো থাকে আমার আয়ু কমে যাবে, শারীরিক সুস্থতার অভাব ঘটবে, প্রতিবেশীর ঘরে কান্নার রোল উঠলে আমি ভাল থাকব কি করে? আমার ভাল থাকার জন্যই প্রয়োজন আমার চারপাশের সুস্থতা।
ভাবনা চিন্তা এজন্যও প্রয়োজনীয়, পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। বিশ্বের উষ্ণতা যদি ৪-৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বাড়ে এই শতাব্দীতে, যদি গ্রিন হাউস গ্যাসের emission (Business as Usual, BAU) এমনই থাকে, তাহলে শুধুমাত্র সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি ও খরা অতিবৃষ্টি জনিত কারণে উচ্ছেদ হবেন অসংখ্য মানুষ। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে, শতাব্দীর শেষে ১২.৫ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হবেন। মুম্বাই, কলকাতা ও চেন্নাই থেকে নাগরিক মানুষজন ভিড় করতে থাকবেন দিল্লি, বাঙ্গালুরু, আমেদাবাদ, পুনে ও হায়দ্রাবাদে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে ভারতে ২০৩০ সালেই জলের জোগান কমবে ৩০ শতাংশ, বিলুপ্ত হবে ২৫ শতাংশ ফ্লোরা ও ফনা। প্রকৃতি থেকে যে পরিমাণ সম্পদ আমরা আহরণ করতে পারি, যা নিলেও প্রকৃতি ফের তা পূরণ করে দিতে পারে, আমরা নিচ্ছি তার প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি প্রতি বছর।
৯
প্রকৃতিকে আমরা সত্যিই রিক্ত করে দিচ্ছি। শহর ছাড়িয়ে যাদের একটু বেড়িয়ে পড়ার নেশা আছে, তাদের কাছে এ কোন অজানা তথ্য নয়। পুকুর ডোবা জলাশয় হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে কীট পতঙ্গ। প্রজাপতি, ফড়িং আর দেখাই যায় না। তরকারি ক্ষেতে পতঙ্গ আর পরাগ মিলন করিয়ে দেয় না, চাষীই জলে রেণু মিশিয়ে ছিটিয়ে দেন। মাটিতে এত রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহার করা হয় যে জমির উপকারি কীটপতঙ্গ সব শেষ। জমি উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ফেলছে। মাটি শক্ত হয়ে যাচ্ছে। জলে ধুয়ে কীটনাশক দ্রব্য মিশছে পুকুর নদী জলাশয়ে। ছোট ছোট মাছ সব মরে যাচ্ছে। পুকুরপাড়ে, পড়ে থাকা জমিতে যে শাক পাতা একসময় গরিব মানুষদের অনেকটা পুষ্টি জোগাত সেসব এখন কিনতে হয়। কয়েকদিন আগেই আমাদের এক বন্ধু জানাচ্ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডি এলাকায় যখন তিনি লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করতে যেতেন, তখন রাস্তার দুপাশে দেখতেন ময়ূর, একটা দুটো নয়, অনেক অনেক। এখন অযোধ্যা পাহাড়ই ন্যাড়া। এখন সেখানে ওপর থেকে জল নিচে ফেলে বিদ্যুৎ তৈরি হয়, আর বিদ্যুৎ দিয়ে নিচের জমা জল ওপরে তোলা হয়। এ নাকি বিদ্যুৎ সংরক্ষণের উপায় (পাম্প স্টোরেজ জেনারেশন)। যাঁরা একসময় পাঞ্চেত পাহাড় দেখেছেন, এখন গেলে দেখবেন কেমন করে পাহাড় কেটে পাথর চালান হচ্ছে। গোটা বীরভূম ছেয়ে গেছে পাথর খাদান আর ক্রাশারে। ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক জল-বিভাজিকা। বৃষ্টির জল যেসব পথে চাষের ক্ষেতে আসত, সেসব পথ গেল হারিয়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হল চাষের ক্ষেত। বর্ধমান-রানীগঞ্জ, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরে তৈরি হচ্ছে একের পর এক স্পঞ্জ আয়রন আর সিমেন্ট কারখানা। গ্রামের পর গ্রাম কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে। শুধু আকাশই নয়, পায়ের তলার ঘাসও। উজাড় হয়ে যাচ্ছে ক্ষেত। গোদের ওপর বিষফোড়া। মাটির নিচের জল টেনে নিচ্ছে হু হু করে এই সব কারখানা। জলস্তর নেমে যাচ্ছে। চাষ মার খাচ্ছে তো বটেই, পানীয় জলেরও হাহাকার। রাজস্থান জল সংরক্ষণের প্রাচীন উপায় প্রয়োগ করে শুকিয়ে যাওয়া নদীতে জল আনছে আর পুরুলিয়া বাঁকুড়ায় জল নেই বলে চাষ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যদিও রাজস্থানের থেকে পুরুলিয়া-বাঁকুড়ায় বৃষ্টিপাত অনেক বেশি। এবং আরও মজার কথা, রাজস্থানে সরকার কখনও কংগ্রেসের কখনও বিজেপির। এখানে ‘বামপন্থী ও মার্ক্সবাদী’ সরকার।
মার্ক্সের ‘আর্লি রাইটিংস’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে জন বেলামি ফস্টার, ‘মার্ক্স’স ইকোলজি’তে লিখেছিলেন ‘মানুষ প্রকৃতি থেকে বাঁচে, অর্থাৎ প্রকৃতিই তার শরীর, এবং মরতে না চাইলে তাকে তার সঙ্গে অবিরত কথোপকথন চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের শারীরিক ও মানসিক জীবন প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত, একথা বলার মানে হল প্রকৃতির নিজের সঙ্গে তার যোগের কথা বলা, কারণ মানুষ প্রকৃতির অংশ।’ (মাহুলি রিভিউ সংকলন, আধুনিক পরিবেশবিজ্ঞান ও মার্কসবাদ, সম্পাদনা আশীষ লাহিড়ী)। অথচ এমন প্রসঙ্গ যদি কেউ তোলেন তাহলে কিন্তু ‘বামপন্থী ও মার্ক্সবাদী’ সরকারও তাঁকে চিহ্নিত করবে ‘উন্নয়ন বিরোধী’ বলে। কারণ ‘উন্নয়ন’ এই কথার আড়ালে কাজ করে চলেছে অন্য এক স্বার্থ।
স্বার্থ আপামর মানুষজনের নয়। স্বার্থ ‘পুঁজি’র। ‘স্বার্থ’ পুঁজির মালিকদের কাছে বিকিয়ে গেছে যাঁদের সত্তা, সেই সব ব্যক্তিমানুষের, তাঁদের দ্বারা পরিচালিত সংগঠন, পার্টি। কেমনভাবে তাঁরা ভাবছেন পুঁজিমালিকেরা তাঁদের চরিত্র বদলে আমাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য ভাবনায় আকুল হয়ে উঠেছেন?
পুঁজিমালিক সবসময়ই মুনাফার অংক বাড়াতে চাইবেন। অর্থাৎ উৎপাদিত দ্রব্যের দাম বাড়াবেন এবং উৎপাদন খরচ কমাতে চাইবেন। ‘বাজার’ প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলক হওয়ায় প্রত্যেক পুঁজি-মালিক’ চাইছেন প্রতিযোগিতা যেন অসম হয়। (যেমন নয়াচরে ‘কেমিক্যাল হাব’ গড়ার জন্য ‘আন্তর্জাতিক দরপত্র’ ছাড়াই কোন এক বিশেষ ‘পুঁজি-মালিক’ বরাত ম্যানেজ করে নিয়েছেন); এবং উৎপাদনে নিযুক্ত শ্রমিক-কর্মচারিদের বেতনবাবদ প্রতি মাসের ‘রেকারিং কস্ট যেন কম হয়। এর জন্যে গড়ে উঠেছে ‘পুঁজি মালিকের সঙ্গে ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা আছে এমনসব ব্যক্তি ও সংগঠনের আলাদা এক ব্যবস্থা’ অর্থাৎ একটি সমান্তরাল অনৈতিক ব্যবস্থা।
উচ্চ প্রযুক্তির ‘শিল্প’ কিছু দক্ষ শ্রমিক-কর্মচারি ও চুক্তিশ্রমে নিযুক্ত নিরাপত্তাহীন নিরাপত্তারক্ষী, স্যুইপার, মালি নিয়োগ করলেও এখানে বিশ-ত্রিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতনের চাকুরি পাবেন ‘উচ্চ ডিগ্রিধারী’ যুবক-যুবতীরা; এঁদের দ্রুতগতির জীবনের জন্য দরকার ‘শপিং মল’, ‘ডিস্কোথেক’, ‘অ্যাকুয়াটিকা’, ‘গাড়ি ছোটাবার পাঁচ-দশ লেনের রাস্তা’, ইত্যাদি প্রভৃতি। এসবের জন্য দরকার অনেক লোহা, সিমেন্ট, ‘স্টোন চিপস’। এবার আর একদল শিল্পপতি এগিয়ে আসেন কারখানা গড়তে, স্পঞ্জ আয়রন, সিমেন্ট কারখানা, পাথর খাদান। নিয়োজিত হন, গাঁ থেকে উদ্বৃত্ত কৃষি শ্রমিক, দু-তিন-পাঁচ হাজার একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানা, নগরায়ন, বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁধ আর রাস্তা চওড়া করতে গিয়ে উচ্ছেদ হওয়া মানুষজন। দৈনিক বেতন পঞ্চাশ আশি-একশ টাকা।
গ্রামের মানুষজন কেন এলেন, হাজারে হাজারে মানুষ কেন কৃষি ছেড়ে শহরে চলে এলেন, চলে এলেন ঘর বাড়ি বসত উজাড় করে, শহরে দুমুঠো অন্নসংস্থানের জন্যে? যারা উচ্ছেদ হননি, তারাও! উত্তর দিচ্ছিলেন তামিলনাড়ুর নাগাপট্টনমের রেবতী। উত্তর দিচ্ছিলেন বাঁকুড়ার এক কৃষক ভৈরব সাইনি। উত্তর দিচ্ছিলেন সেদিন, দেবল দেব। আলোচনা চলছিল, কৃষি নিয়ে। লোকনদী রিসোর্স সেন্টার, মহাশ্বেতা দেবী ট্রাস্ট ও হকার সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে, ‘আমার স্বদেশ লুট হয়ে যায়’ শিরোনামে ‘বিড়লা একাডেমি অফ ফাইন আর্টস’-এ ১৪-২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত একটি স্বাক্ষ্য- আলোকচিত্র প্রদর্শনীর দ্বিতীয় দিনে।
রেবতী ছিলেন বিজ্ঞান শিক্ষিকা। শিক্ষিকা হিসাবে ছেলেমেয়েদের নিয়ে গ্রামে যেতেন পাখি চেনাতে। পাখি কেন হারিয়ে যাচ্ছে, সেই অনুসন্ধান করতে গিয়ে উত্তর পান, কীটনাশক। কীটনাশক কেন ব্যবহার করতে হয় তার উত্তর পান কৃষকদের কাছ থেকে, রাসায়নিক সার। রাসায়নিক সার কেন ব্যবহার করতে হবে, তার উত্তরে জানতে পারেন, উচ্চ ফলনশীল বীজের দস্তুর। আরও অনুসন্ধিৎসায় খুঁজে পান, সরকারি দফতর বীজ প্রস্তুতকারক সংস্থা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রস্তুতকারকদের এক নিবিড় সখ্যতার। নিজের কাছে উদ্ঘাটিত হয়, কৃষির এক রূপান্তর, এগরিকালচার থেকে এগরিবিজনেস। সার ও কীটনাশক প্রস্তুতকারকদের ফুলেফেঁপে ওঠা আর কৃষকদের সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়ার এক কাহিনি।
চাকরি ছেড়ে নিজেকে নতুনভাবে শিক্ষিত করতে থাকেন। এখন এলাকা থেকে এলাকা ছুটে বেড়ান, হারিয়ে যাওয়া বীজ পুনরুদ্ধারে, জৈবচাষে কৃষককে উৎসাহিত করতে, চাষের পুরাতন সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে। বলছিলেন, একসময়ে ক্ষেতে চটি জুতো পরে নামা ছিল মানা, ওখান থেকে যে অন্ন মেলে। আর এই অন্ন শুধু মানুষের নয়। এর তিন ভাগ। ধানের গোড়া মাটির, মাঝখানের অংশ পশুর, ওপরের ডগা মানুষের। রেবতী বাংলায় এসেছিলেন ‘আয়লা’য় নুন জমে যাওয়া জমি কেমনভাবে পুনরুদ্ধার করতে হবে সে বিষয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা জানাতে। সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত তার এলাকার মানুষ কেমনভাবে এখন চাষ করছে সেই কথা সুন্দরবনের চাষীদের জানাতে ও শেখাতে।
ভৈরব ১৯৯৩-৯৪ সাল থেকে চাষ করছিলেন রাসায়নিক সার আর কীটনাশক ব্যবহার করে। এখন সে সব ছেড়ে দিয়েছেন। এখন আর উচ্চ ফলনশীল বাজারি বীজ ব্যবহার করেন না। ৮ ধরনের ধান ছাড়াও চাষ করেন ৪ ধরনের বেগুন, কপি, তিল, শাকসবজি। প্রথমে এই চাষে এসেছিলেন প্রায় অবিশ্বাস থেকেই। এখন আত্মপ্রতায়ী। ফলনের বিষয়ে তিনি জানালেন, উচ্চ ফলনশীল ধানে যে পরিমাণ জল লাগে, বাঁকুড়া পুরুলিয়ায় সেই জল কোথা থেকে পাওয়া যাবে সেটা আর ‘কৃষিবিজ্ঞানী থেকে ব্লক কৃষি আধিকারিক’ কেউই আমাদের জানায় না। আমাদের প্রয়োজন ‘খরা প্রতিরোধক বীজ’, আমাদের লাল মাটির জমিতে জল জমে না, আমরা এমন বীজ চাই যা অল্প বৃষ্টিতেই ফলন দেয়। ভৈরব একথাও জানালেন সেদিন, তিনি যে ৮ ধরনের ধান এখন চাষ করেন, তার মধ্যে একটিতে এক একটা শীষে ধানের দানা পেয়েছেন ৫০৩ পর্যন্ত, যেখানে উচ্চপ্রজাতির স্বর্ণ প্রজাতিতেও দানা থাকে খুব বেশি হলে ২০০।
দেবল জানাচ্ছিলেন, ১২-১৪ হাজার বছর আগের কৃষিবিপ্লবের কথা। যা তাঁর কথায় ৫০০০ বছর আগে অব্দি বিস্তৃত। এই সময়কালের পর থেকে আজ অব্দি ধানের সংসারে আর নতুন কোন প্রজাতি মানুষ যুক্ত করতে পারেনি। পারেনি নতুন কোন প্রাণীকে গৃহপালিত করতে। জানালেন, ধানের ভিন্ন ভিন্ন সব প্রজাতির কথা। স্বাদের কথা, গন্ধের কথা। বললেন হাইব্রিড ধানের চাষের ফলে কেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গোটা বাস্তুতন্ত্র। ১৯৬৫ সালে দেশি বীজের বদলে যখন হাইব্রিড চাষের প্রচলন হয়, তখন একর প্রতি ২ কেজি ইউরিয়া লাগত। এখন বিঘাতেই লাগে ২২-৩০ কেজি। অথচ উৎপাদন কমছে। উৎপাদন বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী। অন্যদিকে ফলনও কমছে। চাষী চাষে উৎসাহ পাচ্ছেন না। শহরে আসছেন কাজের খোঁজে।
আমরাও এসব তলিয়ে ভাবিনা। সরকারি প্রতিষ্ঠান তো নয়-ই। নীতিনির্ধারকদের
ভাবনায় প্রান্তিক মানুষ উপেক্ষিত। বলা হল, কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে ‘উন্নয়ন’।
‘উন্নয়ন’-এর দাপটে শহরের রাজিয়া গ্রামে লতিকা। লতিকা পাল। কুমোর বাড়ির মেয়ে। বয়স যখন তার কুড়ি ছুঁই ছুঁই, বিয়ে হয় আর এক দরিদ্র পরিবারে। দরিদ্র বলতে দুবেলা অন্ন জোটে না এমনই এক পরিবারে। রাষ্ট্রের সজ্ঞায় বিপিএল। বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই লতিকার বরের প্যারালিসিস হয়ে যায়। কেন? গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রই জানে না কেন। শহরের হাসপাতাল! গাড়ি ভাড়ার টাকা আসবে কোথা থেকে। তাছাড়া হাসপাতালে গরীব মানুষজনের চিকিৎসা হয় সে কথা গ্রামের কেউই বিশ্বাস করে না, লতিকার শাশুড়িও নয়। শাশুড়ি অবশ্য একথা পরিষ্কার ভাবেই বোঝেন, বৌ নির্ঘাৎ অপয়া । এবং অপয়া বৌকে তিনি খাওয়াবেনই বা কেন? লতিকা কপালে চওড়া সিঁদুর আর প্লাস্টিকের শাঁখা পলা নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে আসে।
বাবা গনেশ পাল দিনমজুর। সে আর বিবাহিতা মেয়েকে খাওয়ায় কি করে? মেয়েকে নিয়ে গ্রামের আশপাশের ভদ্রলোকেদের বাড়ি ঘোরে। কাজের লোক হিসাবে মেয়েটার যদি কোন গতি হয় আর সেই সঙ্গে মেয়ের রোজগারের কিছুটা দিয়ে যদি তার সংসারের কিছুটা হিল্লে হয়।
মাস্টারবাড়ির মেয়ের তখন ১ মাসের বাচ্চা। শহরে থাকে। লতিকা শহরে যায় সেই মেয়ের বাড়ি। মাসে ৫০০ টাকা, দুবেলা খাওয়া দাওয়া আর অগ্রিম ১০০০ টাকা। ওখানে মেয়ের তো আর কোনো খরচ লাগবে না তাই মাসমাইনে বাবা গনেশই নিয়ে আসবে প্রতিমাসে।
চলছিল এমনই। মাস্টারের মেয়ের বাচ্চা যখন ২ বছর, তখন তারা ঠিক করল তাদের আর কাজের লোক লাগবে না। লতিকাকে ট্রেনে চাপিয়ে ফেরৎ পাঠিয়ে দিল। গনেশ পড়ল ফাঁপরে। ৫০০ টাকা রোজগার তো কমে গেলই, তার ওপর বাড়তি একটা পেট। গনেশকে ভদ্রলোকেরা এবার পরামর্শ দিলেন, এইভাবে কি মেয়েটার জীবন কাটবে? আবার বিয়ে দিয়ে দাও।
পুরুলিয়ার এই এঁদো গ্রামে বর পাওয়া এইসব পরিবারে শক্ত কিছু নয়। মেয়ে যদি সমর্থ হয়, গায়ে গতরে মাংস যদি থাকে, বর একটা জুটে যায়। বিয়ের পর সে মেয়ের অবশ্য সবসময় আর হদিশ পাওয়া যায় না, কোথায় না কোথায় চলে যায় সে মেয়ে, বিহার... উত্তরপ্রদেশ...। লতিকার ভাগ্য ভালো, বর মিলল কাছেপিঠেই। লোকমুখে চেনা ঘর, বড় গৃহস্থ সংসার। সংসারে হবু বর, তিন ছেলে, বিধবা মেয়ে, দুই ছেলের বৌ, তাদের বাচ্চারা।
লতিকার সতীন নেই, তিনি দেহ রেখেছেন। হবু বরের বয়স ৫৫-৫৬। লতিকা তখন ২৪। হবু বরের ছেলে দেখাশোনা করে গেল। দেওয়া থোওয়া কিছু নেই বরং হাজার দু-পাঁচ তারাই দেবে লতিকার বাবাকে, শর্ত একটাই। খুবই ছোট শর্ত। বিয়ের আগে লতিকাকে ‘লাইগেশন’ করিয়ে দিতে হবে। সে খরচও ওরাই দেবে। তাছাড়া লাইগেসন করার জন্য সরকার যে টাকা দেয়, সেটাও লতিকার বাবাই পাবে।
লাইগেশন হয়ে গেলে পর, বিবাহান্তে, লতিকা শ্বশুর ঘর করতে গেল। লতিকা আর কি কি করতে পারত? আমরা জানি না। আমরা লতিকাকে কি কি পরামর্শ দিতে পারতাম? আমি অন্তত জানি না। শুধু এইটুকু ভাবতে পারি, সমাজ জীবনে অবমাননা, নিষ্ঠুরতার, লাঞ্ছনার এমনতর প্রকাশ, আমাদের অপদার্থতার পরিচায়ক।
সর্বত্র এই ছবি। সৌন্দর্যহীনতার ছবি। এই ছবি তৈরি করেছেন শাসকেরা, আমলা মন্ত্রীরা, আমরা প্রতিবাদ করিনা। নাহলে আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী হয়ে কেমনভাবে প্রকাশ্য জনসভায় ভাষণ দেন, ‘তৃণমূল কংগ্রেসকে আমরা খচ্চরের পার্টি বলি। আর ওই দলের নেত্রী নিজে খচ্চর ছাড়া আর কি হতে পারে।...।’ (দৈনিক স্টেটসম্যান, ১৭/১২/২০০৯)। রুচিহীন এমন সব কথা মন্ত্রী, গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েত মন্ত্রী আনিসুর বলতে পারলেন, বললেনও; মঞ্চে তখন মহম্মদ সেলিম যিনি নাকি আদ্যন্ত ভদ্রলোক বলে খ্যাত, কোনো প্রতিবাদ জানালেন না। প্রতিবাদ তো করলেনই না, বরং এককাঠি এগিয়ে গিয়ে জানালেন, মমতা যদি মা হতে পারতেন, তবে ১০ মাসের জায়গায় ১ মাসেই গর্ভস্থ সন্তান বের করে আনতেন। সাধারণ মানুষের সৌজন্যবোধ, রুচি ও তাদের যাপনের ওপর কতখানি অশ্রদ্ধা থাকলে এমনভাবে কথা বলা যায়! ক্ষমতার কতখানি দম্ভ পোষণ করলে পর একজন মানুষ এতটাই নিচে নামিয়ে আনেন নিজেকে! এই সেই দম্ভ, যে দম্ভ মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে না।
১০
দম্ভ। ক্ষমতার দম্ভ। যে দম্ভে অগনিত সাধারণের জীবন-জীবিকা বিপন্ন করেও মূলত শহরকেল্দ্রিক উচ্চবর্ণ-বিত্ত সম্প্রদায়ের যাপন-সমৃদ্ধি মসৃণ করার লক্ষ্যে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সহযোগী হয় সরকার, সেই পরিকল্পনায় মানুষ উচ্ছেদ হবেনই। উচ্ছেদ হবেন তাঁদের ভিটে মাটি স্বজন পরিজন থেকে। এই উন্নয়ন পরিকল্পনা যাঁরা তৈরি করছেন, রূপায়িত করছেন, তাঁরা কিন্তু আমাদের দ্বারাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাঁরা জানেন যে ভারতে শহর এলাকায় দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন শতকরা ৩৭ ভাগ। গ্রামে ৪১.৮ ভাগ। বর্তমানে খাবার, জ্বালানি, আলো, পোশাক, জুতো এইসবে যাঁরা মাসে ৪৪৭ টাকাও খরচ করতে পারেন না, তাঁরাই দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষজন (ইকনমিক টাইমস, ১১/১২/২০০৯)। অর্থাৎ প্রতি ৩ জনে ১ জনেরও বেশি, খরচ করার জন্যে দিনে ১৫ টাকাও জোগাড় করে উঠতে পারেন না!
সার্বিক এই অবস্থা এসেছে দেশের একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চলাকালীন। ২০০৭ সালের আগে অব্দি দশ দশটা পরিকল্পনা আমরা পার হয়ে এসেছি। সব পরিকল্পনাতেই ছিল, অর্থনৈতিক দারিদ্র্য দূর করে দেশকে উজ্জ্বল করে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন পরিকল্পনাবিদেরা। উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বয়ম্ভরতার প্রচার সত্ত্বেও মাথাপিছু দৈনিক খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ কমেছে। ১৯৯০-৯১ সালে এই পরিমাণ ছিল ৪৬৮ গ্রাম, ২০০৫-০৬ সালে দাঁড়িয়েছে ৪১২ গ্রামে। রাষ্ট্রসংঘের মানব উন্নয়ন রিপোর্টে ভারতের স্থান ১২৬ থেকে এখন ১২৮-এ।
এমন ভয়ঙ্কর এক দারিদ্র্যের মধ্যেও যুদ্ধাস্ত্র কেনা বাবদ খরচ বাড়িয়েই চলেছি। গত ৩ বছর ধরে ভারতের সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ছে প্রতি বছর ১৮ শতাংশ হারে। ২০১২ সাল নাগাদ যুদ্ধের জন্যে অস্ত্র কেনা বেড়ে হবে ৩০ বিলিয়ন ডলার। (টেলিগ্রাফ পত্রিকা ১৩/০৯/ ২০০৮)। লাভবান হবে আমেরিকা, কারণ প্রথম ১০টি সমরাস্ত্র উৎপাদক ও বিক্রেতা কোম্পানির ৬টিই আমেরিকান কোম্পানি। সমরাস্ত্র বিক্রেতারা উৎকোচ নিয়ে প্রস্তুত। যোগান দেওয়ার অর্ডার পেলেই হয়। বোফোর্স কামান কিংবা সৈনিকের কফিন, সব যোগানেই দেদার টাকা। এইভাবে কখনও সমরাস্ত্র, কখনও বড় বাঁধ নির্মাণ বা আকরিক লোহা, তামা, কয়লা, অ্যালুমিনিয়াম খনি নির্মাণের বরাত পাইয়ে দিয়ে মধ্যস্বত্ত্বভোগী ভারতীয়দের হিসাব বহির্ভূত টাকার পরিমাণ সুইস ব্যাংকে বাড়তে বাড়তে এখন হয়েছে ১,৪৫,৬০০ কোটি ডলার, আমাদের টাকায় ৬০ লক্ষ কোটি টাকা।
অস্ত্র প্রতিযোগিতা কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের? প্রচলিত অস্ত্রসম্ভার থেকে পারমানবিক অস্ত্রসম্ভার! পারমানবিক অস্ত্রসজ্জিত ক্ষেপনাস্ত্র থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তা কোনো সীমান্তবেড়া মানে না। ওইসব ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষিপ্ত হবে গুটিকয়েক মানুষের অঙ্গুলিনির্দেশে! সভ্যতা, এই মানব কৃষ্টির মরণবাঁচন নির্ভর করবে কয়েকজনের সুমতির ওপর! এতো আরও বড় সামরিক-গোষ্ঠী-একনায়কতন্ত্র! গণতন্ত্রের পরিচায়ক নয়। এমন এক পিরামিডসদৃশ শাসনতন্ত্র হিংসাবর্জিত হতে পারে না, হওয়া সম্ভব নয়।
১১
সমাজে এই হিংস্রতার প্রকাশ নেই তা নয়, কিন্তু কারো স্বভাবে এর প্রকাশ ঘটলে আমরা বিচলিত হই। না ঘটলে আমরা আনন্দ পাই। মানে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হিংসা নয়। প্রাণীজগতেও নয়। বাঘও ক্ষুধার্ত না হলে শিকার করে না, সাপের ল্যাজে পা না পড়লে সাপ ছোবল মারে না। অথচ সমাজে হিংসা বিদ্যমান।
হিংসার কথা রামায়ণ, মহাভারতেও। অজস্র তার কাহিনি। শূর্পনখার নাক কাটা বা সুগ্রীব হত্যা বা মেঘনাদ বধ বা সীতার পাতাল প্রবেশের মধ্যে স্পষ্ট নজির। মহাভারতে শকুনির মন্ত্রণা বা অভিমন্যু বধ বা কর্ণবধ সাধারণ মানুষ মেনে নেন নি। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে মহাকাব্যের সমগ্র পাঠের পর অভিঘাত হিংসাতে নয়, হিংসা এসেছে, থিতু হয়নি, না সমগ্রতায় না খণ্ডে। কোনো চরিত্রই কলুষমুক্ত নয়, কিন্তু উত্তরণের দিশা অহিংসায়, শান্তিতে। অপূর্ণতা পূর্ণতায় সম্পন্ন। এ সেই পূর্ণতা যেখানে পূর্ণ থেকে পূর্ণ নিলেও পূর্ণ অবশিষ্ট থাকে। তাই সে হয়ে ওঠে মহাকাব্য। পাঠে ভিন্নতা থাকলেও এক বিস্তৃত সক্ষম তার চলা।
বস্তুত কাজ করার শক্তি, আত্মনির্ভরতার শক্তি, সৃজনের শক্তি, ভালবাসার শক্তি, সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, ধারণ করার শক্তি, এইসবই হওয়া উচিত ছিল ক্ষমতার প্রকাশ। কিন্তু রাষ্ট্রভাবনায় ক্ষমতা অন্যকে অবদমিত রাখার প্রতিযোগিতা। সহিংস্রতাই রাষ্ট্রের ভাষা। সেই ভাষাতেই রাষ্ট্রকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করে রাষ্ট্র-ক্ষমতা যদি দখলও করা হয়, সে আর এক ক্ষমতার জন্ম দেবে যে ক্ষমতাকে সে একদা পরাজিত করেছিল।
রাষ্ট্রের ভাষা অন্যত্রও একইরকম। সে-কথা শুনিয়েছিলেন বন্ধু শ্যামল ভট্টাচার্য। এই জানুয়ারি (২০১০) মাসের প্রথম সপ্তাহে সে ভিয়েতনাম থেকে ফিরেছে। বলছিল সে, দেখতে গিয়েছিল, সেই ভিয়েতনাম, যার নামে মিছিলে সে একদিন গলা মিলিয়েছিল, ‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম’।
‘জানেন, আমি মনে মনে তীর্থদর্শনে গিয়েছিলাম। ভিয়েতনামের মানুষজনের আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সেই লড়াই স্মরণ করতে গিয়েছিলাম, শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ... মোটামুটি ৮-সাড়ে ৮ কোটি মানুষের ওই দেশে কমবেশি ৩-সাড়ে ৩ লক্ষ পার্টিকর্মীদের জন্যই সব সুব্যবস্থা। বাকিরা ... পার্টিকর্মী ছাড়া কেউই কোন সরকারি অফিসার হতে পারে না। যেখানে সেখানে প্রাইভেট স্কুল, ঢালাও টিউশনি, হোটেল, পাব, বার আর দেহোপজীবিনী। আমাদের এখানে, প্রতিবাদেও সরকার সাড়া দেয় না আর ওখানে প্রতিবাদই করা যায় না...। অথচ এই সেদিন ভিয়েতনামকে আমরা দেখেছিলাম সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী সংগ্রামের পীঠস্থান হিসাবে। সুর মিলিয়েছিলাম ‘ভাগীরথী তুমি মেকং নদীর সীমানা ভাঙো...’।
পৌনঃপুনিক এই অবস্থান পরিবর্তনে ছেদ আনতে হলে, খুব সম্ভব প্রয়োজন, নতুন কোন ভাবনার। ক্ষমতার বলদর্পী প্রকাশ থেকে মুক্ত হয়েই ভাবতে হবে সে পথ। ক্ষমতার ভাষা সেখানে অসহিষ্ণুতা নয়, ক্ষমতার ভাষায় সৌহার্দ্য, সহযোগিতা, শ্রদ্ধা। অবিরত স্মরণে রাখা, সভ্যতার যে উদ্ধত প্ৰকাশ আমরা দেখছি, এই প্রকাশ প্রকৃতপক্ষে আত্মসংহারক। প্রকৃতিকে সে শুধু রিক্তই করছে। মনেই রাখছে না এই পৃথিবী অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের আবাসভূমি। স্থিত একে অপরের সঙ্গে এক অখণ্ড সামগ্রিকতায়, শৃঙ্খলায়। সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সেই ভারসাম্য আমরা বিনষ্ট করতে পারি না। এবং এই পথে অগ্রসর হওয়া যায় হিংসার বিরোধিতা করেই। এই বিরোধিতা কোনো কৌশল, রণকৌশলের অংশ নয়। নীতি হিসাবেই হিংসাকে বর্জন করতে হবে।
১২
অর্থাৎ রাষ্ট্রের বিপরীতে এক অন্য নির্মাণ। নিজেকে নির্মাণ। দেশ নির্মাণ। নিজেকে সাজানো, আমার নিজের দেশকে সাজানো। অনেক বৃহৎ কর্মযজ্ঞ নয়, যে যেখানে আছি সেখান থেকেই শুরু করা। গ্রাম দিয়েই শুরু এই কাজ, কেননা আমার দেশ শুরু গ্রাম দিয়ে। গ্রাম না চিনলে দেশ চিনব না। গ্রামেই বাস করেন আমার এই দেশের অধিকাংশ মানুষ। সভ্যতা কৃষ্টির ভরকেন্দ্র গ্রাম। এখানেই রাষ্ট্রের ক্ষমতা তুলনামূলক দুর্বল।
সমাজনির্ভরতা, সমাজসংবদ্ধতা রাষ্ট্র পছন্দ করে না, বাজারও নয়। ব্যক্তি অ-নিরাপদ বোধ করলে রাষ্ট্রের ওপর তার নির্ভরশীলতা বাড়ে। সামরিকীকরণ, অস্ত্রবাণিজ্য বৈধতা পায়। সন্ত্রাস আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠা করা সেজন্যে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের শর্ত। তাই রাষ্ট্রকে সন্ত্রাসের, বিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতি তৈরি করতে হয়।
আমাদের যাত্রাপথ হবে এর বিপ্রতীপ। রাষ্ট্র যেখানে একস্বরের নির্মাণ চায়, আমাদের চাওয়া বহুস্বরের। রাষ্ট্র চায় তার নির্মাণে স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো, আমাদের নির্মাণে গণতান্ত্রিক কাঠামো। রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের বিপরীতে ক্ষমতার প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ। রাষ্ট্র চায় প্রকৃতিকে রিক্ত করে, নিঃস্ব করে, প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এক শিল্প সমাজের গঠন। আমরা চাই প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানে প্রাকৃতিক সম্পদ যতটা সম্ভব রক্ষা করে, পুনর্নবীকরণযোগ্য সম্পদের ব্যবহারে এক স্নিগ্ধ সুন্দর সভ্য আধুনিক সমাজ। ভোগবাদী সমাজ-ধারণায় দেশকে বর্জ্যে ভরিয়ে ফেলার বিরুদ্ধে আমরা। নতুন বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনাসমৃদ্ধ গ্রাম গঠন আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। এগরি-বিজনেস নয়, এগরিকালচার।
রাষ্ট্র যেখানে আর্থিক বৈষম্য প্রতিষ্ঠিত করে, আমাদের লক্ষ্য বৈষম্য কমিয়ে আনা। রাষ্ট চায় ঐতিহ্য থেকে উপড়ে ফেলে এক নতুন সংস্কৃতি ও যাপনে আমাদের অভ্যস্ত করে তুলতে। আমাদের প্রচেষ্টা, ঐতিহ্যকেই ভিত্তিতে রেখে যাপনসমৃদ্ধ সংস্কৃতির চলমানতায় নিজেদের শিক্ষিত করা। এক জাতি এক ভাষা এক প্রাণ একতা নয়, বহু জাতি বহু ভাষা বহু প্রাণের আদান-প্রদান। খণ্ড খণ্ড জীবনবোধ নয়, এক অখণ্ড জীবনদর্শনের খোঁজ। আর এক স্বাধীনতা সংগ্রাম।
সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সত্যাগ্রহ এই সময়ের এক উত্তর হতে পারে। সত্যাগ্রহ আন্দোলন এই সময়ের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক চেতনা হয়ে উঠতে পারে। সেই চেতনা জনজাগরণের। সেই চেতনা ক্ষমতা দখলের জন্য নয়, শাসককে বাধা করা সংযত হতে। সেই চেতনা স্বয়ম্ভর হতে শেখায়। ক্ষমতাসীন শাসকপক্ষের কাছে হাত পাততে নয়। এই জাগরণ নতুন এক ভারত গড়ার লক্ষ্যে, স্বাধীন স্বনির্ভর সমাজ সংগঠন নির্মাণকল্পে।
আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরই অর্জন করতে হবে। শাসন হতে হবে প্রকৃতই বিকেন্দ্রিক। বর্তমান পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নয়, যেখানে পঞ্চায়েতের হাত ধরে রাষ্ট্র তার ক্ষমতা প্রসারিত করে। আমাদের গ্রাম পঞ্চায়েত হবে গ্রাম স্বরাজ। গ্রামের উন্নতি হবে কিভাবে, ঠিক করবে গ্রাম-সমাজই।
গ্রাম-সমাজই আমাদের আধুনিকতার ভবিষ্যৎ। সেই সমাজ হারিয়ে যেতে দেবে না রাজিয়াদের। সেই সমাজ লতিকাকে বাধ্য করবে না, বন্ধ্যা হয়ে সংসার করতে যেতে। টুনু কৈবর্তের ৬ বছরের ছেলে কৃষ্ণ বা ২ বছরের মেয়ে মন্দিরা মারা যাবে না ‘ম্যালনিউট্রিশান গ্রেড ৪’-এ। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, হরিপুর... আমাদের পথ দেখাতে পারে। আমাদের সামনে ইতিহাস আছে, গান্ধিজির লবণ সত্যাগ্রহের। আমরা কথা বলতে থাকি, অনেক কথা। নিজের সঙ্গে কথা, অপরের সঙ্গে কথা। ভাল মন্দ নিয়ে কথা। নির্মাণের কথা।
আমরা ছবি আঁকি আমার নদীর, নদীর ধারের হাট। হাটের মধ্যে গোলঘর। সেখানে আকাশ চেনার টেলিস্কোপ, জীবানু চেনার মাইক্রোস্কোপ। সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র। একধারে থাকুক, বট-অশ্বথ তলায় খোলা অঙ্গন, হাটবারে সেখানে কথায় কথায়, গল্পে গল্পে ভাবনার আদান-প্রদান। কৃষিকথার আসর কিংবা নতুন কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। যে যার নিজের জানাকে চারিয়ে দিক অন্যদের মাঝে। অন্যদের জানাকে আত্মস্থ করুক নিজের মধ্যে। কে বড় কে ছোট নয়, সম্মানে শ্রদ্ধায়।
ফিরে আসুক ফড়িংও। কোনো কোনো প্রজাতির ফড়িং নাকি বাঁচে মাস দুই তিন মাত্র। আকাশে ওড়ার ওই দু-তিন মাসের আগে বহু বহু বছর সে কাটায় জলে। বাইরে বের হয়ে ক্ষেতের অপকারী পোকা-মাকড় খায় গোগ্রাসে। মাজরা পোকার মত কীটের হাত থেকে রক্ষা করে চাষির ফসল। সেই উপকারী বন্ধুকে হারিয়েছি আমরা ক্ষেত থেকে ধুয়ে যাওয়া কীটনাশকে। আহা, ফিরে আসুক ফড়িংও আমাদের এই আবাসে।
এই আবাস সমৃদ্ধ হোক, স্পন্দিত হোক সবার আগমনে। বহুস্বরের অর্কেস্ট্রায় প্রতিধ্বনিত হোক আগামীকাল।
২০ জানুয়ারি, ২০১০
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)
‘চাঙ’ বাজিয়ে লোকগানের আসর বসিয়েছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের তিন শিল্পী। ভুবন খামরুই, মেথর না(লা)য়েক আর শ্রীদাম দণ্ডপাট। শ্রীদামই সর্বকনিষ্ঠ, বয়স ৪০। ভুবনের ৬০ আর মেথরের ৬২। চেহারা দেখে অবশ্য বয়স বোঝা যায় না। ক্ষয়াটে, ছোটখাটো অবয়বের মানুষ তিনজনার বয়স ৫০, ৬০, ৭০ সবই হতে পারে। আমাদের স্বাস্থ্য সমীক্ষক ও গবেষকদের নোটবুকে এরা নিশ্চিতভাবেই ‘অপুষ্ট’।
ভুবন, মেথর আর শ্রীদাম নাচে গানে আসর দোলান,
শাল পিয়ালের গন্ধে আমার
মন করে আকুল
ও তোরা নাচবি’তো আয়
ও তোরা গাইবি’তো আয়।।
ঢোল-ধামসা ঝুমকা মাদল
বাজিছে আখরায়।।
ও তোরা নাচবি’তো আয়
ও তোরা গাইবি’তো আয়।।
বাদ্যযন্ত্র চাঙ, পরম্পরাগতভাবে তাঁরা নিজেরাই তৈরি করেন। সাদৃশ্য হিন্দি বলয়ে ব্যবহৃত লোকবাদ্য ‘ডাফলি’র সঙ্গে। আকৃতি গোলাকার। ভুবনেরা নিজেরাই বানান। বেশ শ্রমসাধ্য। মাটিতে প্রথমে অর্ধচন্দ্রাকার গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে বাঁশের মোটা ও চওড়া বাখারি পুঁতে দেওয়া হয়। কিছুদিন পর, গর্তটিকে পর্যায়ক্রমে গোলাকার করা হয় এবং বাখারিটিও গোল করা হতে থাকে। এভাবে রাখা হয় আরও কিছুদিন। এরপর কুড়োল /বট/শ্যাওড়া বৃক্ষের ডাল দিয়ে বানানো কীলক বিধিয়ে ‘ট্যান’ করা ছাগলের চামড়া টান টান করে একদিকে বাঁধা হয়। সময় লাগে প্রচুর। কিন্তু ভুবনেরা বড়ই আনন্দ পান তাঁদের এই সৃজনে।
তিনজনেরই বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রামের জামবনি থানার চিলকিগড় গ্রাম। গ্রামের পুবে ডুলুং নদী। ভুবনেরা জাত পরিচয়ে জেলে কৈবর্ত। নিজেদের চাষজমি নেই। বর্গায় চাষ করেন ১ থেকে ১.৫ বিঘে জমি। নদী থাকায় জমিতে দুটো চাষ হয়।
ভুবনকে নিয়ে তাঁর পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১০। স্ত্রী সন্ধ্যা, দুই ছেলে স্বাধীন (২৫/২৬) ও ভরত (২৩/২৪), তাদের বৌ এবং দুই ছেলেরই দুটি করে পুত্র সন্তান। এক চালার নিচে থাকলেও হাঁড়ি উনুন আলাদা আলাদা। সবাই ক্ষেতমজুর। মেয়ে চন্দনার বিয়ে হয়েছে নারায়ণগড় থানার বড় কলখাই গ্রামে। জামাই শঙ্কর পাইক (৪০), পেশায় ক্ষেতমজুর। ভুবন নিরক্ষর। মেয়ে চন্দনাও। বাড়ির বৌয়েরাও প্রায় তাই। ছেলেরা সামান্যই পড়তে লিখতে জানে। একই চালার নিচে বাড়ির গরু, ছাগল, হাঁস, মুর্গি।
মেথর নায়েক চতুর্থ শ্রেণি অব্দি পড়েছিলেন। বৌ লক্ষ্মী, দুই ছেলে মুরলী ও তারক, মুরলীর এক মেয়ে ও এক ছেলে আর তারকের আট মাসের এক কন্যা সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার। মেয়ে উত্তরাই বড়, বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে। তার দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলেদের মতো জামাইও ক্ষেতমজুর। পড়া লেখা সবারই সামান্য।
শ্রীদামের বৌ জয়ন্তী। দুই ছেলে, উত্তম ও গৌতম। একান্নবর্তী পরিবার। উত্তম মাধ্যমিক পাশ, বিয়ে হয়ে গেছে, একটি ছোট মেয়ে। গৌতম মাধ্যমিক দেবে। শ্রীদামের মেয়ে শম্পা অষ্টম শ্রেণি অব্দি স্কুলে পড়েছিল, তারপর বিয়ে হয়ে যায়, তার এখন দুই ছেলে এক মেয়ে। জামাই রাসু দলাই পেশায় ক্ষেতমজুর।
ভুবন, মেথর আর শ্রীদামদের গোটা পরিবারের ওই চাষজমি থেকে সারা বৎসরের সংসার চলে না। ভরসা দিনমজুরির ১০০ টাকা। তাও অনিয়মিত। রোজগার অনিয়মিত, গানের মহলা কিন্তু নিয়মিত। শুরু অঘ্রাণে। পৌষ মাসের সংক্রান্তি থেকে আসর। এই গ্রাম ওই গ্রাম, এ পাড়া ও পাড়া। ঘুরে ঘুরে গান, কুটুমবাড়িতে গান, গান আত্মীয় স্বজনের ঘর-দুয়ারে।
গান গেয়ে রোজগার হয় না, চুন পান দোক্তা ছাড়া বৈষয়িক কোনো টাকা পয়সা নেই বটে, সম্মান আছে। ভুবন বলছিলেন। গান শিখেছেন ৬-৭ বছর বয়স থেকে। বাবার সঙ্গে ঘুরতেন। বয়স হলে নিজেই দল তৈরি করেন । গান তাঁরা বাঁধেন না। বাঁধা পদই গান। অভাব অভিযোগ আছে বটে কিন্তু গানে সেসব কথা তাঁরা নিয়ে আসেন না। ওই সব গান গাইতে তাঁদের ভালো লাগে না, গ্রামের মানুষেরাও পছন্দ করেন না। তাঁদের গান, প্রেম, বিরহ, শাস্ত্রের গান, রাধাকৃষ্ণের গান। ঘুরে ফিরে আসে কৃষ্ণ, কানু, কালা গ্রাম আঙিনা জুড়ে।
(যে) শুন কালো ভ্রমরা কালো মুখে লাজ নেই তুমার।।
(ভাইরে) কালিয়া বরন যার কঠিন হৃদয়ও তার
যদি পরিচয় দিত মনের জঞ্জাল যেত
তার সঙ্গে কিসের পরিচয় (ভাইরে) তার সঙ্গে কিসের পরিচয়।।
নীলজ কুসুমের ফুল বহুৎ ফুটে বনে
(ও ফুল) না পরিও কানে।।
ওই ফুল পড়িলে তোদের শখ উঠে মনে গো
ভাব উঠে মনে।।
ভুবনদের সত্যি সত্যিই ভাব ওঠে। হাতের তালু আর আঙুলের আঘাতে আঘাতে চাঙে সুরের মূর্ছনা তুলে, নাচতে নাচতে ‘পদ’ ধরেন,
রবি বসে রাজপাটে গেছিলাম যমুনার ঘাটে।
দাণ্ডাইয়া চাই চারপাশে
ব্রজেরই রাখাল যত ধেনু আনে কত শত
আজ কেন সবার পেছু তুমি
চঞ্চল ধবলীর সনে কত দুখো পেয়েছ বনে
চাঁদ মুখো গেছেনও শুকায়ে
এসো হেরি মুছি মুখো ঘুচাবো মনের দুখো
যাও দুগ্ধ আমার বালা লয়ে
আমার হৃদয়ও মাঝে
বিচিত্র পালঙ্ক আছে
আশে পাশে রসেরও বালিশ
যাহাতে দাঁড়িবেন পা
প্রসারে দুখানি পা
দূরে যাবে গায়েরও আলিশ
‘পদ’ শেষ হলে ভুবনেরা আসেন ‘রঙ’য়ে
ওইখানে দাঁড়াও অরূপ. নয়ন ভরে দেখি (গো) ।।
(ওই) নামের মালা দিব তাহার গলে
(ওই) ফুলের মালা দিব তাহার গলে।।
একবার যাও দূতি নিতান্ত দেখলে আমারে
দেখলে আমারে দূতি দেখলে আমারে দূতি।।
ওইখানে দাঁড়াও অরূপ
২
ভুবনদের চিলকিগড়ে বাস করেন মাত্র ২৭৬টি পরিবার। গ্রামটিও ছোট। ১২০.৭১ হেক্টর। জনসংখ্যা ১৩০৭। পুরুষ ৬৮১, স্ত্রী ৬২৬। ৬ বছর বয়স অব্দি শিশু ১৭৬ জন। ছেলে ৯০, মেয়ে ৮৬। সাক্ষর ৬৬২। ছেলে ৪২৬, মেয়ে ২৩৬। কর্মক্ষম মানুষ ৫৭০। মেয়ে ৩৫৫ ছেলে ২১৫। কৃষিশ্রমিক ৯৭। ছেলে ৯০ মেয়ে ৭। পরিসংখ্যান অবশ্য ২০০১ সালের সেন্সাস রিপোর্টের। ভুবনদের ঘরে সন্তান জন্ম নেয় বাড়িতেই। তবে এখন আর বাঁশের চাঁচরি দিয়ে নয়, নাড়ী কাটা হয় ব্লেডে। ভুবন অভাবী কিন্তু ভুবন সুখী। ভুবন লোকশিল্পী। ভুবন আলাপী। আগামী দিনে তাদের গানের ধারা বেঁচে থাকবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ভুবন অম্লান বদনে জানায়, কেউ রাখলে, থাকবে। ভালো না লাগলে রাখবে কেন?
কেউ রাখলে, থাকবে। ভালো না লাগলে রাখবে কেন? ভুবনদের এই জিজ্ঞাসা কি শুধুই তাদের ‘লোকগান’, ‘চাঙ’য়ের অস্তিত্ব ঘিরে, নাকি তাদের সামগ্রিক অস্তিত্ব ঘিরেই আবর্তিত এই জিজ্ঞাসা। শরীর সীমাবদ্ধ হলেও মানুষের মন সীমা ছাড়িয়ে অনন্তে প্রসারিত। শরীরকেও সে সীমা অতিক্রমের প্রেরণা জোগায়। এটাই বস্তুত বিবর্তনের ইতিহাস, সভ্যতারও। মনের ঐশ্বর্যে অপ্রয়োজনও প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত হয়। উদ্ভাসিত হয় চিত্রশিল্প, কারুকার্য, ভাস্কর্য, সঙ্গীত, সাহিত্য। গড়ে ওঠে শিল্প সংস্কৃতির ইতিহাস।
মানুষের বাস্তব প্রয়োজন মাত্র দুটো। নিরাপদ আশ্রয় ও খাদ্য। খাদ্য, আশ্রয়কে নিশ্চিত না করলেও, আশ্রয় যদি হয় নিশ্চিন্ত, যদি হয় নিরাপদ তবে সে অবশ্যই খাদ্যকে সুনিশ্চিত করে। এভাবে ভাবলে মানুষের প্রয়োজন মাত্র একটাই, নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয়।
ভুবন যখন উচ্চারণে আনেন, ‘কেউ রাখলে, থাকবে। ভালো না লাগলে রাখবে কেন’, তখন কি ভুবন তার সমস্ত অনুভূতি দিয়েই একথা বলেন? ভুবনদের আশ্রয় কি আর নিশ্চিত নয়, নিরাপদ নয়?
ভুবন ঈশ্বরবাদী, কিন্তু তাঁর বিভূতিতে নয়, তাঁর ঐশ্বর্যে বিশ্বাসী। ভুবন নিরীশ্বরবাদী নন। ভাগ্যাহত, বিষণ্ন, পরাজিত বলে নিজেকে মনে করেন না বা শোষণকে ঈশ্বরসৃষ্ট বিধান ভেবে নিশ্চেষ্ট নন।
ঘাসের সাজি বাঁধতে বাঁধতেও ভুবন তালের ছন্দে গেয়ে ওঠেন,
শাল পিয়ালের গন্ধে আমার
মন করে আকূল
ও তোরা নাচবিতো আয়
ও তোরা গাইবিতো আয়...
মনে পড়ছিল রবীন্দ্রনাথেরই এক অনায়াস উচ্চারণ, প্রাণের একটা শক্তি হচ্ছে গ্রহণ করবার শক্তি, আর একটা শক্তি হচ্ছে দান করার। যে মন গ্রহণ করতে জানে না, সে মন ফসল ফলাতেও জানে না। সে তো মরুভূমি।
ভুবনের মনোজগৎ মরুভূমি নয়। তার মন কৃষিকাজ জানে। সে ফসল ফলায়। সে মননে উদ্বেলিত হয়। শব্দ, রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শে উত্তেজিত হয়। তাহলে ভুবনের আশ্রয়-চেতনায় এহেন নিরাশ্রয়তা কেন? ভুবন কথা বলার সময়, ভিন্ন এক প্রসঙ্গে অভিযোগ নয়, ভেদ নয়, শুধু সামান্য তির্যকভাবে মৃদু উচ্চারণে আনেন একটি স্বল্প শব্দমালা, “গ্রামে সম্বল ভারি বাড়ন্ত।”
গ্রামে সম্বল ভারি বাড়ন্ত। গ্রামের সম্বল বাড়ানোর জন্যে দরকার ছিল মাত্র গোটাকয়েক জিনিস। গ্রামেই যেন কাজ পাওয়া যায়, শিক্ষা যেন পাওয়া যায় গ্রামেই। গ্রামের শ্রমশক্তি যেন গ্রামেই নিযুক্ত হতে পারে, বুদ্ধির বিকাশ এবং মনোরঞ্জন কেন্দ্র যেন গ্রামেই থাকে। এমনই সব। দরকার ছিল গ্রামের প্রাণশক্তি, হৃদয়শক্তি, বুদ্ধিশক্তি যাতে বিকশিত হয়ে ওঠে সেদিকে মন দেওয়ার। এর জন্য প্রয়োজন ছিল সমস্ত ‘উন্নয়ন’ পরিকল্পনা নতুনভাবে পর্যালোচনা করা। ভুবনেরা, হাজারে হাজারে, কৃষি ছেড়ে শহর-মফস্বলে এমনকি ভিন রাজ্যেও পাড়ি দিচ্ছেন। পাড়ি দিচ্ছেন জনমজুর হয়ে। ঘর বাড়ি বসত উজাড় করে, অন্নসংস্থানের জন্যে।
কৃষির রূপান্তর ঘটেছে। এগরিকালচার হয়েছে এগরিবিজনেস। সার ও কীটনাশক বিক্রেতারা ফুলে ফেঁপে উঠেছেন, আর কৃষকেরা হয়েছেন সর্বস্বান্ত। এখন গ্রামের মানুষই খেতে পান না। যেটুকু উৎপাদন হয়, চাষের খরচ মেটাতে কম দামেই সে ফসল বিক্রি করে দিয়ে ‘বিপিএল’ শ্রেণিভুক্ত হওয়ার জন্যে পঞ্চায়েত আর সরকারি দফতরে হা পিত্যেশ করে বসে থাকেন।
এমন শ্রীহীন আমরা আগে ছিলাম না। অভাব ছিল, কিন্তু এই ভয়াবহ দারিদ্র্য ছিল না। চাষের মধ্যে দিয়ে আগে সৃজনশীলতার যে প্রকাশ ঘটত, যে বৈচিত্র্য ছিল, শুধু বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চাষকে দেখায়, সেসব গেল হারিয়ে। ক্রমান্বয়ে রাসায়নিক সার, আর কীটনাশকের ব্যবহারে মাটি হারাল তার উর্বরাশক্তি, ফলন গেল কমে। চাষির উৎসাহে এখন ভাঁটার টান। এতসব কথা আমরা ভাবিনি।
প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা ও শ্রমেই আমাদের জ্ঞানভাণ্ডার গড়ে ওঠে, ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। জ্ঞানের বাকি সঞ্চয় পরোক্ষ অর্থাৎ ধারণা ও কল্পনাপ্রসূত। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমাদের খুবই কম। বলা যায়, পরোক্ষানুভূতির মধ্য দিয়েই আমাদের সামগ্রিক জ্ঞান। তাই আমাদের পাণ্ডিত্যে কোনো আলোকোজ্জ্বল দিশা নেই। স্বজ্ঞা নেই। পাণ্ডিত্য দরকার ঠিকই কিন্তু তার সঙ্গে দরকার আরও কিছুর। এই ‘কিছু’ পাশ্চাত্যদর্শনে
‘being’, আমাদের দর্শনে ‘চিৎ’, চৈতন্যের উপাদান।
মনের গভীর থেকে সত্য যখন আপনাআপনি ভেসে ওঠে তখনই সে হয় স্বজ্ঞা। প্রশ্নের উত্তর মনের গভীরে প্রোথিত থাকে, নজরে পড়ে না। মনকে একমুখী করতে পারলেই, উত্তর চেতনার স্তরে ভেসে ওঠে।
৩
ভুবনদের অস্তিত্ব আমাদের একমুখী চিন্তায় নেই। তাই আমাদের বহুবিধ চর্চার মধ্যে, ভুবনেরাও এসে পড়েন ঠিকই কিন্তু উন্নয়ন উন্নয়ন নিয়ে অনন্ত তর্ক বিতর্ক চালিয়েও আজও আমরা সত্যি সত্যি জানি না, ভুবনদের, চিলকিগড়ের এই মানুষজনদের উন্নয়ন বলতে কি বুঝবো?
সত্যি কি আমরা বুঝতে চাই? আমাদের যাপন-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে ‘ভুবন’দের কোনো ‘ঠাঁই রেখেছি কি? নিজেকে নিজের ঊর্ধ্বে মেলে ‘ভুবন’কে ধরতে না পারার কারণ আমাদের অজস্র। উপনিষদ জানিয়েছিল নিজেকে চিনতে না পারার কারণ পাঁচটি-- অবিদ্যা, অহংকার, আসক্তি, দ্বেষ ও অতিরিক্ত মাতামাতি। পঞ্চ পর্বাস। সেসব থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করিনি।
ভুবন, ভুবনেরা আমাদের সত্যিই অচেনা, অজানা রয়ে গেলেন। “কেউ রাখলে, থাকবে। ভালো না লাগলে রাখবে কেন?” ভুবন যখন এই কথা বলেন তখন হয়তোবা তাঁর মধ্যে এই ভাবনাও কাজ করে যে অন্যেরাও যেন তাঁকে, তাঁদেরকে দেখে। তাঁদের সুখ-দুঃখের শরিক হয়। তাঁদের ‘অনিরাপদ’ আশ্রয় যেন নিরাপদ হয়।
কথায় কথায় অবশ্য পঞ্চায়েতের কথাও উঠেছিল। ভুবন জানালো, পঞ্চায়েতের অনেক কাজ। তাদের কি আর সব দেখার অবসর আছে? কেমন করে জানাই ভুবনকে, আমাদের রাষ্ট্র, রাষ্ট্র বিপ্লব সম্পর্কিত জিজ্ঞাসায়, মানুষ এসেছে বর্গীয় চেতনার আধারে। মিত্রপক্ষ, শত্রুপক্ষ বোধে। ব্যক্তি ভুবন আসেননি। তাঁর মননজগতের খোঁজ নিয়ে ওঠা হয়নি।
আমরা পড়েছিলাম, ভুবনদের কাছে আমাদের শিখতে হবে। উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণি সংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া পাঠ যে অসম্পূর্ণ, তাও জেনেছিলাম। কিন্তু ভুবনদের কাছে সত্যিই কি আমরা কোনো পাঠ নিলাম? বোধহয় না। আমাদের জানা ছিল কেমন যেন নিশ্চিত। কে, কি, কোনজনা, কিইবা তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবই ছিল আমাদের জানা। আমাদের লক্ষ্য ছিল সংশয়মুক্ত, লক্ষ্যপথ নির্দিষ্ট, চূড়ান্ত।
ভুবন, ভুবনেরা ছিল আমাদের যাত্রাপথের সঙ্গী। স্বপ্ন আমাদের, আমরা কোনদিনই প্রস্তুত ছিলাম না, নিজেদের স্বপ্ন সরিয়ে রাখতে। ভুবনেরা তাদের লোকগানে অভাব অভিযোগের কথা বলবে না বলবে না নাকি বলতে তাদের ভালো লাগবে না, এমন সব কথা ছিল উদ্ভট, অবাস্তব। ভুবনেরা কেমন আচরণ করবে বা আদর্শ আচরণবিধি কি হওয়া উচিত, তাও ছিল আমাদের জানা। এমনকি সংগৃহীত ‘ডেটা’, ‘ডেটা’ হিসাবে বিবেচিত হতো তখনই, যখন সেই ‘ডেটা’ আমাদের জানাকেই প্রতিষ্ঠিত করতো। প্রেম বিরহ শাস্ত্রের গান, রাধাকৃষ্ণের গান ছিল উল্টোরথের যাত্রাপথ।
আমাদের যাত্রাপথ নির্ণায়ণে সমাজ ইতিহাস জ্ঞানের উৎসে যাওয়ার গতিপথ নির্ধারিত হয়েছিল, হয়তবা এইরকমভাবে:
উপাত্ত থেকে জ্ঞাপনে, জ্ঞাপন থেকে জ্ঞানে বা থেকে প্রজ্ঞায় পৌঁছতে যে সরলরৈখিক পথ আমরা সাধারণভাবে নির্ণয় করি তাতে অস্থির বা পরিবর্তনীয় অমিল বা বিরোধ বা বৈষম্যের কোনো স্থান নেই। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায় ইতিপূর্বেই স্থিরীকৃত কোনো এক সিদ্ধান্তের উপযোগী উপাত্ত সমাজ অভ্যন্তর থেকে সংগ্রহ করেই সাধারণীকৃত রূপরেখায় পৌঁছে যাই। শুধু তাই নয়, আগে থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত (সমূহ)র সত্যতা প্রতিপন্ন করতে বা যুক্তিগ্রাহ্য করতে অন্য কোনো উপাত্ত বা জ্ঞাপন বা জ্ঞান কোনোকিছুরই ব্যতিক্রম বা চলিষ্ণু বৈচিত্র্য মান্যতা পেল না বলেই মনে হয় মানুষ বা সমাজ অভ্যন্তরের নিয়ত পরিবর্তনশীলতা মান্যতা পেল না। অথচ এই জগৎ ও জীবনকে বোঝাতে আমরা সংসার শব্দটা ব্যবহার করি; সংসার যা সরে সরে যায়, গতিশীল। নদীর মতো।
জীবন নদীর মতোই গতিশীল। ভারতীয় সংস্কৃতি ‘পাশ্চাত্য’ সংস্কৃতির অনুশীলনে ঋদ্ধ, পরিশীলিত, আধুনিক মননে যথাযোগ্য মান্যতা না পেলেও, এই মাটি বরাবরই স্নিগ্ধ তার ভাবগম্ভীর উদ্ভাসে। সেখানে নদীকল্পে পাঁচটি স্রোতোধারা-- চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক। উৎসও পাঁচটি– আকাশ, বাতাস, জল, মাটি, আগুন (পঞ্চযোনি)। এই পঞ্চভূতকে আশ্রয় করেই আমাদের যা কিছু অভিজ্ঞতা। আরো বলা হল, নদীর ঢেউ হল পঞ্চপ্রাণ (প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান)। এই পঞ্চপ্রাণ বা বায়ু আমাদের ভেতর তরঙ্গ তোলে। নানারকম চিন্তা বা অনুভূতির ঢেউয়ে মন চঞ্চল হয়, বিক্ষিপ্ত হয়। প্রকাশ পায় বাক, পাণি, পাদ, উপস্থ এবং পায়ু – এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। মূল হল মন। মন ছাড়া কোনো কাজ হয় না।
মন ছাড়া কাজ হয় না। পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মূলও মন। মন আছে, আছে ইন্দ্রিয়ের আবর্ত— শব্দ, রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ। ভুলত্রুটিও তাই আছে। আছে আত্মপ্রীতি, আছে আসক্তি, ঘৃণা, জীবনতৃষ্ণা। সবকিছুকে জড়িয়ে রেখেছে বাসনা, বুদ্ধের কথায় তৃষ্ণা। এই তৃষ্ণা বা বাসনার টানেই জগৎ চলছে। বাসনাই আমাদের চালাচ্ছে। এই চলন বহির্মুখী, সেন্ট্রিফিউগাল। তাই অন্তর্মুখী চলন ছাড়া, জীবন টেঁকে না। জীবন কোমল হয় না। তাই, চলার পথ, জ্ঞানের পথ একমুখী হওয়াও প্রয়োজন। সবসময়ই বিশাল, বিস্তীর্ণ, বহুবিস্তৃত নয়। তন্নিষ্ঠ, নিবিড়, পুঙ্খানুপুঙ্খ ‘শরীরে মাটির গন্ধ মেখে, শরীরে জলের গন্ধ মেখে....একবার ভালোবেসে যদি ভালোবাসিতে চাহিতে তুমি’ সেই ভালোবাসা। যে পথ মানুষ করায়ত্ব করে ভালোবাসা আর প্রজ্ঞায়, চলতে চলতে, দেখতে দেখতে। বৈচিত্র্য উপলব্ধি করতে করতে, নিজেকে সতত পরিবর্তন করতে করতে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, সারাজীবন ধরে একটা নির্দিষ্ট মতের অনুবর্তন করে চলাটা মনের স্বধর্মের পরিচায়ক নয়।... পুরাতনকে বর্জন করতে বলি নে, কিন্তু সৃষ্টির পথে যদি তাতে কাঁটার বেড়া দেখা দেয় তবে তা নৈব নৈব চ। ভুবনেরা গেয়ে ওঠেন, ‘ওইখানে দাঁড়াও অরূপ, নয়ন ভরে দেখি।’
ভুবনদের গানে দোলায়িত হয় গ্রামের পঞ্চজনা। যে সবাইকে নিয়ে ভুবনদের যাপন, তাঁদের ঘরসংসার।
8
ভুবন, ভুবনদের কথা ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ভাবা হয় না। শিল্পপতিরা ভাবেন তাঁদের নিজস্ব লাভ-লোকসান নিয়ে। তাঁদের প্রয়োজন ক্রেতা। ক্রেতা না পেলে তাঁদের পুঁজি সচল থাকে না। শিল্পপতিদের সীমাহীন ক্ষুধা। টাকার ক্ষুধা, ক্ষমতার ক্ষুধা, আধিপত্যের ক্ষুধা। তাঁদের নজর বেশি লাভের ভোগ্যপণ্যে। প্রযুক্তি নির্ভর পণ্য। শিল্পপতিরা তাই মোটর গাড়ি বানানোর সঙ্গে সঙ্গে লবণও বানান। লবণ তাঁদের কাছে আর তখন শুধু লবণ নয়, আয়োডাইজড সল্ট। গবেষক, ডাক্তার, মিডিয়া প্রয়োজনীয় জমি তৈরি করে দেয়। রাষ্ট্র আইনি স্বীকৃতি জোগায়।
এই যে সবাই মিলে একযোগে বাজার তৈরি করে দেয়, নিজ নিজ স্বার্থে, এভাবেই বাজারে আসে নিত্যনতুন ভোগ্যসামগ্রী। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে। কৃত্রিম চাহিদা, কৃত্রিম বাজার। একই পণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য এনে, আগের উৎপাদিত পণ্যকে করে তোলে ব্যাকডেটেড। একদা সৃষ্ট সম্পদ হয় ওঠে ‘বর্জ্য’। বাজার এগোয়, বর্জ্য বাড়ে। বর্জ্য বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। বর্জ্যেরও বাজার তৈরি হয়। আমাদের মতো দেশে বাণিজ্যতরী নোঙর ফেলে, উজাড় করে দেয় বিষ, টক্সিক সব বর্জ্য।
অ্যালভিন টফলার ‘ফিউচার শক’ (১৯৭১) বইয়ে দেখান, অগ্রণী দেশগুলোয় প্রতি ১৫ বছরে উৎপাদিত বস্তুসামগ্রী ও পরিষেবা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ৭০ বছর জীবনকালে এই দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে ৫ বার। অর্থাৎ ৭০ বছর বয়সে সে যখন পৌঁছচ্ছে তখন তার জন্মের সময়ের চেয়ে ৩২ (২) গুণ জিনিসের মধ্যে ডুবে রয়েছে। সব জিনিসের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে বটে, কিন্তু সম্ভব নয় সব সম্পর্ক ধরে রাখা। ফলে প্রয়োজন হয়ে উঠেছে সাময়িক। সমাজ হয়ে উঠছে কোনো একটা জিনিসকে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবহার করে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতো মানসিকতাসম্পন্ন।
ভোগ্যবস্তু বা পরিষেবার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আর মানুষে মানুষে সম্পর্ক এক নয়। মানুষ বস্তুসামগ্রী বা পরিষেবা ভোগ করে। ভোগ্যবস্তুর ওপর তার থাকে নিরঙ্কুশ আধিপত্য। ভোগ্যবস্তুর ওপর এই আধিপত্য যতই বিস্তারিত হয়, মানুষে মানুষে সম্পর্ক হয়ে যায় ততই অন্তঃসারশূন্য। ফলে একজন ব্যক্তিকে পিছিয়ে পড়া বা হারিয়ে যাওয়ার ভীতি থেকে বের হয়ে আসার জন্যে হয় এটার বিরোধিতা করতে হয় (আমাকে আমার মতো থাকতে দাও/আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি/ যেটা ছিল না ছিল না/ সেটা না পাওয়াই থাক / সব পেলে নষ্ট জীবন) অথবা তার মনোজগৎকে নিত্য নতুন ভোগ্যপণ্য ও পরিষেবার সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে হয়। যাকে আমরা বলব উন্নয়ন।
যার টাকা নেই তার টাকা আসবে, যার টিভি নেই তার টিভি আসবে। টুনটুনি আধলা নিয়ে ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়বে আর বলবে, রাজার ঘরে যে ধন আছে, আমার ঘরেও সে ধন আছে। তুমি চুলে শ্যাম্পু করো শিশির শ্যাম্পু কিনে, আমি করি পাউচ প্যাকে। এ এক নতুন ব্রতকথা। নির্ধনের ধন হবে, গৃহহীনের গৃহ হবে, অপুত্রের পুত্র হবে, সোনার সংসার হবে... জয় মা মঙ্গলচণ্ডীর কৃপা। শুধু মা মঙ্গলচণ্ডী হয়েছেন ‘বিজ্ঞান’। এক বিশ্বাস থেকে অন্য আর এক বিশ্বাস! তাই পৃথিবী জুড়ে ‘উন্নয়ন’ শ্লোগানের কমতি নেই।
এবং এই একই ঘটনা ঘটবে সমাজতন্ত্রেও। কারণ মার্কসবাদের মতে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ বাধা পেলেই তা সমাজ কাঠামোকে ভেঙে ফেলে জন্ম দেবে নতুন সামাজিক বিন্যাসের। সুতরাং উৎপাদন সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হলেও, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশকে সে থামিয়ে দিতে পারে না। এই যে বলা হয় সমাজতন্ত্র অনিবার্য, তার কারণ উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের অনিবার্যতা।
ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র, দুই ব্যবস্থাতেই, সে ব্যক্তিপুঁজি হোক অথবা রাষ্ট্রীয় পুঁজি, রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে তার পণ্যরপ্তানির বাজার খোঁজার কাজে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পণ্যরপ্তানির বাজার খোঁজার তাগিদ থাকে অন্য আরেকটি কারণেও। ব্যক্তি মানুষের পছন্দ-অপছন্দের চাহিদার সঠিক হিসাব করা যায় না বলে, প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের উৎপাদনও প্রকৃত চাহিদার থেকে অনেক অনেক বেশি করতে হয়। উৎপাদিত বস্তুসামগ্রী উদ্বৃত্ত হয়। এই উদ্বৃত্ত উৎপাদনের জন্য তারও প্রয়োজন হয় বাজার। অন্য দেশের ক্রেতা।
অন্য দেশে বাজার তৈরি করতে হলে, পণ্যের গুণমান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশের সরকারকেও প্রভাবিত করতে হয়। প্রভাবিত করতে হয় যাতে তার পণ্য অবাধে সেদেশে প্রবেশ করতে পারে। সবাই তখন একে অপরের বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় নামছে অথচ চাইছে প্রতিযোগিতা যেন কম হয়। সবাই ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করছে। টাকা দিয়ে। ভয় ভক্তি দেখিয়ে।
আর আমাদের মতো দেশগুলোর বেশিরভাগ শাসক-প্রশাসক-রাজনৈতিক প্রধানদের ‘মানসিক দারিদ্র্য’ বেশি। লোভী ও ভীতু। এফডিআইয়ের মতো দেশের স্বাধীনতা বিক্রির চুক্তিও এরা মেনে নেয় ভয়ে, লোভে এবং ভক্তিতেও। কেউ চ্যানেলে বা দৈনিক পত্রে বিজ্ঞাপনের লোভে, কেউবা নগদে বিশ্বাসী আবার কেউ গলার বগলস স্টিল থেকে সোনা হলেই খুশি। নাহলে ওয়ালমার্ট লবিং (সরকার বা কোন নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে নিজেদের সিদ্ধান্তের অনুকূলে আনার জন্য তদ্বির করা) বাবদ মাত্র কয়েক’শ কোটি টাকা (স্বীকৃত অবশ্য ১২৫-১৩০ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করেই ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সহ সাংসদদের ‘ম্যানেজ’ করে নেয় কি করে?
এভাবেই গত শতকের সাতের দশকে ‘ভারত সোভিয়েত সামরিক চুক্তি’ সম্পাদিত হয়েছিল। বাতিল প্রযুক্তিতে তৈরি হয়েছিল ইস্পাত কারখানা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, ভারতীয় সেনা অবলীলায় ঢুকে পড়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে। ভারত মহাসাগরে ঘাটি গাড়ে আমেরিকান নৌবাহিনী, পাল্টা হুমকি সোভিয়েত রাশিয়ার। এমনটাই চলতে থাকে সারা বিশ্ব জুড়ে। সোভিয়েতের ভাঙনের পর থেকে বিশ্ব বাজার নিয়ন্ত্রণ করার একচেটিয়া দৌরাত্ম্য এখন আমেরিকার। পশ্চিমের যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির অন্যতম প্রধান বাজার এখন ভারত।
আগামী দু-এক বছরেই ভারত ৮০ বিলিয়ন ডলার, মানে ৪,৪০,০০০ কোটি টাকা খরচ করবে সামরিক অস্ত্রভাণ্ডার আধুনিকীকরণে। ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ভারত ১২.৭ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র আমদানি করেছে। আজকের ৪১ বিলিয়ন ডলার ২০১৭ সালে হবে ১২০ বিলিয়ন ডলার।
ভারতেও তৈরি হচ্ছে যুদ্ধসম্ভার। অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে টাটা পাওয়ার। টাটার গবেষণাগারে ১৫৫ মিমি হাউজার প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ডেনেলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই হাউজার তৈরি হচ্ছে। আপাতত যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হলেও, কোম্পানি জানিয়েছে ১৫০টি হাউজার কেনার অর্ডার পেলেই অধিকাংশ যন্ত্রপাতি এখানেই তৈরি করার পরিকাঠামো নাকি গড়ে তোলা হবে।
একদিকে আধুনিক প্রযুক্তির বিজয়ী ভূমিকা আর অন্যদিকে জঙ্গি রাষ্ট্রীয়তাবাদ। দেশের বাইরে সে চায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা। সমকক্ষ অপর রাষ্ট্র তার চোখে সম্ভাব্য শত্রু। শুরু হয়ে যায় ছোট বড় শক্তিগুলির মধ্যে লড়াই, অপরাপর জাতির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই। সমুদ্র ও আকাশপথে যুদ্ধমহড়া চলতেই থাকে। এই পথেই ভারতও চলে, স্বাধীন সার্বভৌম সিকিম ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে যায় সাতের দশকেই। ২০১৩ সালের ‘বিজ্ঞান কংগ্রেস’-এর ভাষণে মনমোহন সিং ঘোষণা করেন, ভারত হবে ‘সুপারপাওয়ার’।
৫
ধনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র, দুয়ের মধ্যে তফাৎ যাই থাকুক না কেন, দুটি সমাজ কাঠামোরই ভিত্তি শিল্পসভ্যতা। এই শিল্পসভ্যতায়, মানবসভ্যতার অগ্রগতির যে ছবি তুলে ধরা হয়, সেটি একেবারেই পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক। ইউরোপের রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লবকে বাকি পৃথিবীর ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানো হয়। এখান থেকে সৃষ্ট বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-শিল্পকলা-আচার-ব্যবহারকেই বিবর্তনের চূড়ান্ত রূপ হিসেবে দেখা এবং দেখানো হয়।
এবং এই আধিপত্যকে মেনে নিয়েই বিশ্বের যাবৎ ভাবনা-চিন্তা-বিজ্ঞান-কলা-শিল্প বিশ্লেষণরীতির পরিমাপ করা হয়। পাশ্চাত্যের সব কিছুই ভালো এবং চূড়ান্ত। অনুকরণীয়। দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রবল বিরোধিতাও এসেছে। রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন লেখায় এই শিল্পসভ্যতার সমালোচনা করেছেন। গান্ধিজীর ১৯০৮ সালে লেখা ‘হিন্দ স্বরাজ’-এ বিরোধিতাই শুধু ছিল না, ছিল বিকল্পের প্রস্তাবনাও।
আপনি আগামীদিনে ভারতকে কেমন দেখতে চান, গান্ধিজী উত্তর দিয়েছিলেন, আরও ভারতীয় এক ভারত। তিনি আরও বলছিলেন, ঈশ্বর করুন, ভারতবর্ষ যেন পশ্চিমের অনুকরণে শিল্পায়নের দিকে দৃষ্টি না ফেরায়। ব্রিটেনের মতো ছোট একটা দ্বীপের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ আজ পৃথিবীকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে। ত্রিশ কোটি মানুষের এই ভারত যদি একই রকম অর্থনৈতিক শোষণের পথে যায়, তাহলে পঙ্গপালের মতো সারা দেশ ঊষর করে দেবে।
পরবর্তীকালে শিল্পসভ্যতার আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ফাটল ধরিয়েছেন অনেক দার্শনিক, ঐতিহাসিক, সমাজবিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ববিদ, অর্থনীতিবিদ, বৈজ্ঞানিকেরা। মিশেল ফুকো, এডওয়ার্ড সাঈদ, দেরিদা, জোসেফ নীডহ্যাম, রণজিৎ গুহ, থমাস কুন, এ.জি. ফ্রাঙ্ক, নোয়াম চমস্কি প্রমুখ।
গত শতকের সাতের দশকে কেরালায়, পরমেশ্বরনের নেতৃত্বে কেরালা সাহিত্য শাস্ত্রীয় পর্ষদের সাইলেন্ট ভ্যালি আন্দোলন; গাড়োয়াল অঞ্চলে সুন্দরলাল বহুগুণা, চণ্ডীপ্রসাদ ভাট, বিমলা বহুগুণা, মীরা বেন, সরলা বেনদের নেতৃত্বে চিপকো আন্দোলন; গঙ্গা মুক্তি আন্দোলন; জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে দলহীন গণতন্ত্রে’র আন্দোলন, বোধগয়া কৃষক আন্দোলন, আট ও নয়ের দশকে মেধা পাটেকারের নেতৃত্বে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, বর্তমান পর্যায়ের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন, ওডিশায় পস্কো বিরোধী আন্দোলন, জল-জমি-জঙ্গল নিয়ে সারা ভারত জুড়ে আদিবাসী জনজাতিসমূহের আন্দোলন, কৃষি জমি রক্ষার আন্দোলন পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক শিল্পসভ্যতার বিরোধিতা করেছে।
স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠলেও, আন্দোলনে তিনটি ধারা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। (১) মূলবাসী জনজাতির আন্দোলন, (২) পরিবেশ আন্দোলন (৩) নারীবাদী আন্দোলন (উওম্যানিজম অর্থে, ফেমিনিজম নয়)।
ঘনিষ্ঠভাবে আন্দোলনগুলিকে যদি লক্ষ করা যায় তাহলে দেখা যাবে চরিত্রগতভাবে তিনটি আন্দোলনই (১) কেন্দ্রিকতাবিরোধী (২) বহুমুখী আন্দোলন ভাবনা (৩) প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার যে সব স্বীকৃত উপাদান আছে তার বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র উপাদানের খোঁজ এবং সমন্বয় ভাবনা (৪) স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি।
এবং সমস্ত আন্দোলনের মধ্যেই একটি মিল রয়েছে। জঙ্গলমহলের লড়াই যেমন জল জঙ্গল জমি জ্বালানি নিয়ে, তেমনই পাঞ্জাবের মানুষও মুখর হতে চাইছেন দূষণমুক্ত জল জমি বাতাস নিয়ে। মানুষ মেলে ধরছেন নিজেকে, প্রসারিত করছেন, ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন অন্যদেরও অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে। তাঁদের লড়াই পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। গড়ে উঠছে মেয়েদের নিজস্ব অধিকার আন্দোলন, স্বতন্ত্রতার আন্দোলন, ‘মেল ডোমিনেশনের’ বিরুদ্ধে আন্দোলন। সব আন্দোলন কেমন করে যেন যুক্ত হয়ে যাচ্ছে একে অপরের সঙ্গে।
পুরোনো দিনের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন একে বলতে পারেন, বিক্ষিপ্ত, ছড়ানো, এলোমেলো এমনকি ‘নন ফোকাসড’। কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলে দেখা যাবে, সব আন্দোলনেই মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। গণতন্ত্রের জন্যে লড়াই। এই লড়াইয়ে সামিল হচ্ছেন আরেকজনা, যিনি হয়তো এই আন্দোলনের আগুপিছু সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিবহাল নন। এমনকি নেতৃত্বে আছেন যারা তারাও যে স্বচ্ছভাবে আন্দোলনটিকে দেখতে পাচ্ছেন, তাও না। যেমন সাম্প্রতিক অতীতের দিল্লির স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনটিও।
১৬ ডিসেম্বর, ২০১২। দক্ষিণ দিল্লির মুনিরকার বাসস্টপ থেকে রাত ৯.৩০ নাগাদ বাসে ওঠা প্যারামেডিক্যালের বছর তেইশের এক ছাত্রীকে চলন্ত বাসেই ধর্ষণ করে ছ’জন। বাধা দিতে গিয়ে প্রহৃত হন ছাত্রীটির পুরুষ বন্ধু। মেয়েটির ওপর ছ’জন পুরুষের নির্মম শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের পর তাঁকে এবং তাঁর বন্ধুকে চলন্ত বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। তাদের ভর্তি করা হয় সফদরজঙ্গ হাসপাতালে।
২০ ডিসেম্বর জওহরলাল নেহরু, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের বাড়ির সামনে। ২২ ডিসেম্বরে ঘটনার প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ। ইন্ডিয়া গেটের সামনে হাজার হাজার মানুষের প্রতিবাদ। পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও শীতের মধ্যে জলকামান। ২৩ তারিখে ইন্ডিয়া গেটে জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ। বিক্ষোভ খানিকটা হিংসাত্মক। জখম পুলিশ কনস্টেবল তোমর। ২৫ তারিখে তোমরের মৃত্যু। ২৯ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় রাত ২.১৫-য় মেয়েটির মৃত্যু। মৃত্যু হয় সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে।
বিক্ষোভ চলেছিল শহর জুড়ে। রাইসিনা হিলস থেকে ইন্ডিয়া গেট। বাদ যায়নি নিজামুদ্দীন স্টেশন সংলগ্ন এলাকা। বিক্ষোভকারীরা বিক্ষোভস্থলে যাতে না আসতে পারে, শহর ঘিরে ফেলা হয়েছিল নিরাপত্তার ঘেরাটোপে, ৯টি মেট্রো স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বাস, ট্যাক্সি বা অটো প্রায় চলেইনি। ২৩ তারিখে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরপিএন সিং পুলিশের অমানবিক ব্যবহারে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবাদ আন্দোলন স্তিমিত হতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্ডে জানিয়ে দিলেন, ইন্ডিয়া গেট চত্বরে লাঠি চালিয়ে পুলিশ কোনও ভুল করেনি।
আন্দোলনকারীরা ধর্ষকদের দ্রুত বিচার চেয়েছে, মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যদের মধ্যে যাদের যাদের নামে ধর্ষণের অভিযোগ আছে, মহিলাদের শ্লীলতাহানির অভিযোগ আছে, তাদেরকে অবিলম্বে চিহ্নিত করে পার্টি থেকে বহিষ্কার এবং দ্রুত বিচার চেয়েছে। এসব দাবি কার কাছে, না এমন এক সরকারের কাছে যে সরকার মধ্যপ্রদেশের স্কুল শিক্ষিকা সোনি সোরিকে যৌন নিগ্রহের দায়ে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসার অঙ্কিত গর্গকে শৌর্যবীর্যের জন্য ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি পুরস্কার দিয়েছে।
দাবি করা হয়েছে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত একটি সরকারের কাছ থেকে। মনে রাখতে হবে প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে নিউক্লিয়ার চুক্তি নিয়ে সংসদে ভোটাভুটির সময়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধী সাংসদদেরও জেল থেকে বের করে সরকারের অনুকূলে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল এই মনমোহন-সনিয়া-দিগ্বিজয়েরাই।
এরাই দেশের ভালো মন্দের ভার নিয়েছে। এদের হাতেই আইন। ধর্ষণ বাড়ছে। সংখ্যায় বাড়ছে, বীভৎসতায় বাড়ছে। ধর্ষণ, ধর্ষিতা ছাড়া আর কারো পক্ষে এই অবমাননা বোঝা সম্ভব নয়। এমনভাবে অবমাননার শিকার হন একমাত্র মেয়েরাই। ক্ষমতার শীর্ষে বসেও পুরুষের এমন অবমাননাকর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রেহাই পান না মহিলা মুখ্যমন্ত্রীও। শুধুমাত্র মহিলা হওয়ার কারণেই তিনি যে কোনও পুরুষের অশালীন ঠাট্টার বিষয় হয়ে উঠতে পারেন।
ধর্ষণ কেন বাড়ছে, সমাজ বিশেষজ্ঞেরা জবাব দিচ্ছেন। চ্যানেল ফোরে, অরুন্ধতি রায় জানাচ্ছেন, মেল ডোমিনেশন বেড়ে যাচ্ছে। মার্কণ্ডেয় কাটজু বলেছেন, দিল্লির বিক্ষোভ যতটা না ধর্ষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, তার থেকে বেশি মানুষের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, ইত্যাদি।
পুলিশ বাড়িয়ে সমাধান? চরম শাস্তি দিয়ে সমাধান? ভোগবাদী সমাজের, বাজার সমাজের এটাই ছবি নয় কি? মোবাইলের চিপসে শরীরী উন্মাদনার চলচ্ছবির অবিরাম ঘোরাঘুরি।
পারফিউমের নাম ‘ব্রুট’।
সুগন্ধীর নাম ন্যুড।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমেরিকায় এই সুগন্ধীর প্রচারে নিজেও ‘ন্যুড’ হয়ে ক্যামেরার সামনে এলেন সেদেশের বিখ্যাত পপ গায়িকা রিহানা। গলায় শুধুমাত্র একটি সোনার নেকলেস। শরীরের প্রতিটি খাঁজ উন্মুক্ত। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে ‘ন্যুড’ সুগন্ধী ব্যবহার করলে আপনিও রিহানার মতোই যৌন আবেদনময়ী হয়ে উঠবেন।
বাজার খুবলে খুবলে ফেরি করছে পমেটম সৌন্দর্য। ভারত সরকারের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেডেও জাপানী তেলের বিজ্ঞাপন।
বিজ্ঞাপন আছড়ে পড়ছে মোবাইল ফোনে
Sexy Bollywood Babes N Their Super Cool Bikini
http://............
বা
Strictly for Adults!!!
Ab suniye aur sunaiye naughty spicy jokes Type kare bhej de ...par, aur roz paye ADULT ZOKES
এবং
ডট ডট ডট
বাজারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ হবে না?
৬
১৯৮২ সালে অনিল আগরওয়ালের সম্পাদনায় বের হয়, ‘সিটিজেন্স রিপোর্ট অন দ্য স্টেট অফ ইন্ডিয়া’জ এনভায়রনমেন্ট’ এবং পরবর্তীকালে তিনি তৈরি করেন ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’, বের হয় একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ‘ডাউন টু আর্থ’। দেরাদুনে বন্দনা শিবা’র ‘নবাদর্শ’ সংগঠন পরিবেশমুখী কৃষি আন্দোলনে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৪ সালে অমূল্য রেড্ডি তৈরি করেন ASTRA (Application of Science & Technology to Rural Areas)। আরও পরে সংঘর্ষ ও নির্মাণ ভাবধারায় গড়ে ওঠে বিকল্প ট্রেড ইউনিয়ন শঙ্কর গুহনিয়োগীর ছত্রিশগড় মুক্তি মোর্চা। মহারাষ্ট্রে শারদ যোশী গড়ে তুললেন ‘শ্বেতকারি সংগঠন’। অনিল সদগোপালের নেতৃত্বে মধ্যপ্রদেশে গড়ে ওঠে হোসেঙ্গাবাদ সায়েন্স টিচিং প্রোগ্রাম (IISTP, পরবর্তীকালে একলব্য)।
এনজিওদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষক তৈরি করার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে রাজেশ ট্যান্ডনের PRIA এবং বিজয় মহারাজের PRADAN। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে তৈরি হয় Voluntary Health Association of India (VHAI) এবং এই ধরনের আরও অনেক প্রচেষ্টা। প্রকাশিত হয় EPW। মাধব গ্যাডগিল, রামচন্দ্র গুহ, আশিস নন্দী, ক্লড অ্যালভারেজ, অনুপম মিশ্র, অজিত নারায়ণ বসুরা হলেন এই পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
বিকল্পের প্রস্তাবনায় এল অচিরাচরিত শক্তির ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা, প্রচুর ছোট ছোট শক্তিকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা যাতে বন্টনজনিত অপচয় রোধ করা যায়, ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা যাতে ব্যাপক যাতায়াতের প্রয়োজন না হয়, এমনভাবে অর্থনীতিকে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা যাতে স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করেই বেশিরভাগ উৎপাদন হয় ও উৎপাদিত সামগ্রী স্থানীয়ভাবে বন্টন করা হয়, জৈব উপাদান দিয়ে ও প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কৃষির বিকাশ ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা যাতে জমির উর্বরা শক্তি হ্রাস না পায় এবং কৃষকের সৃজনীশক্তি বিকশিত হয়, বনসৃজন পুকুর কাটা ও জল সংরক্ষণ ও সেচব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনীয়তা যাতে ভূগর্ভস্থ জল সঞ্চয় করা যায়, জেলা থানা শহর ও গ্রামস্তরে বিকেন্দ্রিকরণের প্রয়োজনীয়তা, সমবায়িক মালিকানার ধারণা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা, বিকেন্দ্রিক সার্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার (প্রতিরোধ ও চিকিৎসা) প্রয়োজনীয়তা, শিক্ষা ব্যবস্থায় মান অক্ষুন্ন রেখে বিভিন্ন রকম পদ্ধতির প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা, দেশের উপযোগী গবেষণা ইত্যাদি। সবই বিকল্প প্রস্তাবনা।
কিন্তু পাশ্চাত্য শিল্পসভ্যতাকেই উন্নতির একমাত্র বিধান মেনে যারা যাত্রা শুরু করল, সেই সব ব্যক্তিমানুষের, রাষ্ট্রের ধনদৌলত, ভোগবিলাস, আধিপত্য বিস্তারের শক্তি এমনই এক উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে যে পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গার শাসকগোষ্ঠী, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনগোষ্ঠী পাশ্চাত্যের এই শিল্প সভ্যতাকেই মানবসভ্যতার আগামী ধাপ বলে মেনে নিল।
এই শিল্পসভ্যতা আমাদের জানালো, নিরন্তন ধনসম্পদ বাড়িয়েই আসবে অগ্রগতি, প্রগতি, উন্নয়ন, আধুনিকতা। সে আরো জানালো ধনদৌলত অর্জন সম্ভবই শুধু নয়, সবাই-ই করায়ত্ত করতে পারে ধনদৌলত ভোগবিলাস। আম্বানি গোষ্ঠীর অনিল ও মুকেশের পিতা প্রয়াত ধীরুভাই আম্বানি ব্যবসার শুরুতে দোকানে দোকানে ছিটকাপড় সরবরাহ করতেন, তারপর একসময় তিনি শুধু ভারত নয় গোটা বিশ্বেরই অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়েছিলেন। সেটা যে ১১০-১১৫ কোটি জনবসতির ভারতের সবার পক্ষে সম্ভব নয়, এটা বলা হল না। বলা হল না, পৃথিবীর ধনসম্পদ সীমিত। ধনসম্পদ বাড়তে পারে, বাড়বেও, কিন্তু কিছু রাষ্ট্রের, কিছু গোষ্ঠীর, কিছু মানুষের, সবার নয়। অথচ সবাই বিশ্বাস করছে এবং করানো হচ্ছে সম্পদ সবারই বাড়তে পারে। প্রত্যেকেই ওপরে উঠতে চাইছে, তার জন্যে সে তার নিচের স্তরের মানুষকে শোষণ করছে। যে যত উঁচু স্তরে আছে সে তত বেশি প্রকৃতি ও মানবসম্পদকে নিজের সম্পদ বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করছে। বাড়ছে ধনদৌলত ক্ষমতার বৈষম্য। চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি। কমছে নিচের তলার জীবিকার সংস্থান, খাদ্যসংস্থান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর যত শিশু মারা যায় তার অর্ধেকই পরোক্ষভাবে অনাহার ও অপুষ্টিজনিত কারণে। ৭০ শতাংশ অপুষ্ট শিশুর আবাস এশিয়া মহাদেশ, ২৬ শতাংশ আফ্রিকা। ভারতবাসীর শতকরা ৮০ ভাগই দরিদ্র, প্রতি দ্বিতীয় শিশু ভোগে অপুষ্টিতে, সারা বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ গরীব মানুষের বাসভূমি ভারত। এন এসএসও-র ৬৮ তম রাউন্ড (জুলাই ২০১১ থেকে জুন ২০১২) সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষই দৈনিক ৩৩ টাকার কম খরচ করেন।
‘ফাও’ জানাচ্ছে, দারিদ্র্যের প্রধান কারণ ক্ষতিকারক অর্থনীতি এবং বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা। সামরিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভুত্বের ফলে খাদ্যপণ্যের অসম বন্টন। গৃহযুদ্ধ খরা ও বন্যায় অসংখ্য মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছেন। ভুবন, ভুবনেরা সংখ্যায় বাড়ছেন।
৭
১৯৯৬ সালেই মেহবুব আল হকের নেতৃত্বে এইচ.ডি.আই রিপোর্টে পৃথিবীর অর্থনৈতিক বিকাশের প্রকৃতিকে কর্মহীন বিকাশ, নিষ্ঠুর বিকাশ, অধিকারহীন বিকাশ, শিকড়হীন বিকাশ এবং অস্থায়ী বিকাশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
এই বিকাশের হাত ধরেই আমরা এগোতে চাইছি। শিল্পবিকাশ। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার রিপোর্ট, বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাস জমার ক্ষেত্রে রেকর্ড গড়েছে ২০১১। আমাদের কাজকর্মে ইতিমধ্যেই ৩৭৫ বিলিয়ন টন কার্বন পৌঁছে গিয়েছিল বায়ুমণ্ডলে। গত বছর আরও পুরু হয়েছে সেই স্তর। ২০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড। উষ্ণতা বাড়ছে। অ্যান্টার্কটিকার দিগন্ত বিস্তৃত সাদা বরফের আস্তরণে ১৯ মাইল দীর্ঘ ফাটলটা এখন স্পষ্ট উপগ্রহের ক্যামেরায়। ‘সভ্যতা’ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে এমন অসম্ভব ঘটনা যে ঘটতে পারে ভাবতেই পারেননি বিশেষজ্ঞেরা। পৃথিবীর আবর্তনে গ্রিন হাউস গ্যাস জমা হয়েছে উত্তর আর দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে। ওজোন স্তরে ফুটো। প্রতিবছর প্রায় ২০০ বিলিয়ন টন বরফ গলছে। হিসাব বলছে শেষ ২০ বছরে মহাসাগরীয় জলতলের উচ্চতা বেড়ে গিয়েছে প্রায় ১১ মিমি। বরফ গলার হার যদি অব্যাহত থাকে তা হলে সামনের কয়েক বছরেই পৃথিবীর উপকূলবর্তী এলাকাগুলি সমুদ্রের তলায় চলে যেতে পারে। মনে করছেন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ‘নাসা’ ও ‘ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সির’র বৈজ্ঞানিকেরা। এই আমাদের শিল্পনির্ভর বিশ্বের সামগ্রিক এক ছবি।
কেমন থাকেন এই শিল্পসভ্যতায় একজন আধুনিক শিল্প-শ্রমিক? তার জীবন-যাপনের মান, কর্ম-স্বাচ্ছন্দ্য, অধিকার ইত্যাদি কতখানি উন্নত হয়েছে? কেমন আছেন তিনি? মারুতি কারখানার একজন শ্রমিকের কথায়,
“আমার বয়স ২৬। হরিয়ানার পানিপত গ্রামে আমার বাড়ি। বাবা পেশায় দিনমজুর। একটা সরকারি স্কুলে দশ ক্লাস পড়ার পর পানিপতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ইনসটিটিউটে ভর্তি হই। দুবছর সেখানে মেশিন চালানো শেখার পর মারুতির গুরগাঁও কারখানায় শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ পাই। সেটা ২০০৬ সাল ।....
‘‘কারখানায় আমরা গাড়ি বানাই। আসলে মারুতির যোগানদার কয়েকশ কোম্পানিতে তৈরি হওয়া গাড়ির যন্ত্রাংশ কাঠামোয় জুড়ে জুড়ে আমরা গোটা গাড়ি নির্মাণ করি।
“আট ঘন্টা কাজ, টিফিনের ৩০ মিনিট আলাদা। ৭ মিনিট করে দুবার চা-পানের বিরতি। তারই মধ্যে চা খাওয়া, টয়লেট সারা। চা আসতে সময় লাগে দেড় মিনিট, চায়ের কাপ হাতে নিয়েই টয়লেটে দৌড়, কাজে ফিরে আসার আগে কাপ ধুয়ে জায়গা মতো রেখে আসা...
‘এইভাবে আইআইটি শেষ করে গুরগাঁও কারখানায় কাজের শুরু। ... মানেসর প্ল্যান্ট তখন সবে শুরু হয়েছে। ভোর ৪-৩০ মিনিটে ঘুম থেকে ওঠা, ৫-২০ তে বাস। আমরা যেখানে থাকতাম সেটা কারখানা থেকে ২৫-৩০ কিমি দূরে। শিফট শুরু সাতটায়।
“কয়েক মাস আগে শিফট শুরু হওয়ার সময় পাল্টে হল ৬.৩০ মিনিট। আরও সকাল সকাল ওঠা। যাতায়াত নিখরচায় হত না, সে বাবদ যেত ৫০০ টাকা। চা আর খাবারে কিছু ভর্তুকি ছিল, কাটত ৩৫০ টাকা। শপ ফ্লোরের পাশেই চা পাওয়া যেত কিন্তু দুপুরের খাবার খেতে ক্যান্টিনে যেতে হতো, বেশ খানিকটা দূরে, আধ ঘন্টায় খাওয়া এবং বাথরুমের কাজ সারা। দেরি হলে গালাগালি।
‘‘এখন শিফট শুরু ৬ টায়, তার অন্তত ১৫ মিনিট আগে পৌঁছতে হয়। ৩.৪৫ মিনিটেই ঘুম থেকে ওঠা। ৬ টায় কাজ শুরু হওয়ার আগে, প্রভাতি সভা, কাজ বুঝে নেওয়ার সভা। আগের দিন কে কোন্ ভুল করেছে, কার লাগানো পার্টস আলগা ছিল, কনভেয়র বেল্টের গতির সঙ্গে কে তাল রাখতে পারছে না এবং তার জন্যে কত সেকেন্ড উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে সেসব বিস্তারিতভাবে শ্রমিকদের নাম করে করে বলা হতো, ওয়ার্নিং দেওয়া হতো....
“সবার আগে মেশিনে ধাতব পাত ঢুকিয়ে গাড়ির বডির ছাঁচ, তার পর ওয়েল্ডিং বিভাগের শ্রমিকেরা টুকরোগুলি জুড়ে পাঠায় পেইন্টিং শপে, রং করা হয় আধাযান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এবার অ্যাসেম্বলি শপ। সেখানকার শ্রমিকেরা একটার পর একটা পার্টস জুড়তে থাকে। গাড়ির বডি কনভেয়র বেল্টে একেকজন শ্রমিকের কাছে আসে, কাজের ধরনের ওপর নির্ভর করে গড়ে ৩৫-৪০ সেকেন্ড থামবে। যার কাজ ব্রেক লাগানো, সে সেই কাজই করে চলেছে, কেউ হয়তো লাগাবে ৮-১০ টা বল্টু - সারাদিনই তাই লাগিয়ে চলেছে, সারাদিন যন্ত্রের সাথে যন্ত্রের মতো একই ভঙ্গিতে বিরামহীন... একহাতে একটা স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে সে একটা করে বল্টু লাগাচ্ছে, আবার দৌড়ে গিয়ে বল্টু নিয়ে আসছে, সেটা গাড়িতে লাগিয়েই আবার ছুটে যাচ্ছে বল্টু আনতে...
“আমি নিশ্চিত যে মানেসর প্ল্যান্ট সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুত হারে গাড়ি উৎপাদন করে। কনভেয়র বেল্ট যেন থামেই না, আমরা তার সঙ্গে দৌড়তেই থাকি, দৌড়তেই... মেশিন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে... অবস্থা এমনই যে তুমি যদি জল খাওয়া বা পিঠ চুলকাবার চেষ্টা করো তাহলে একটা বা দুটো গাড়ি বেরিয়ে যেতে পারে, যা করার কাজ করতে করতেই করতে হবে... একটা গাড়ি মিস করা মোটেই মজার ব্যাপার নয়, শিফটের পরে সুপারভাইজারকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে... প্যান্টে পেচ্ছাব করা, এমনকি পায়খানা করার ঘটনাও তাই ঘটে যায়...
“এখানে ভুল করা বা হওয়া নিষিদ্ধ। কেন তুমি এই কাজটা করতে পারলে না, অন্যেরা তো করছে। ভগবান করুন, কারুর যেন পেট খারাপ না হয়। মারুতি কর্তৃপক্ষ সুপারভাইজারদের নির্দেশ দেয় শ্রমিকদের জল খেতে মানা করতে, যাতে প্রস্রাব না পায়।”
“২০০৭ সালে আমার কাজের শুরুতে মজুরি ছিল ৩৫০০ টাকা, ২০০৮ সালে ৪৫০০, ২০০৯ সালে ৫৫০০ টাকা, আমি ছিলাম ট্রেনি। টানা ৩ বছর ট্রেনি। অনেকেই ৩ বছরের বেশি কাজ করতে পারে না, অন্তত ৩০ শতাংশ। ২০১০ সালে ওরা আমাকে স্থায়ী করে, মাহিনা হয় ১৫০০০ টাকা। মূল বেতন ৫০০১ টাকা। এর সঙ্গে ৮০০০ টাকা ইনসেনটিভ, যা কটা গাড়ি তৈরি হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে এবং কটা গাড়ি তৈরি হল, তা কখনই আমরা জানতে পারি না। ২০১০ সালের পর থেকে আমার মাহিনা আর বাড়েনি।
“কোম্পানি আমাদের বছরে ন’টা ক্যাজুয়াল আর বারোটা মেডিক্যাল লিভ দেয়। কিন্তু ইনসেনটিভ স্কিম এমনভাবে বানানো হয়েছে যে একদিন ছুটি নিলেই তোমার ১৫০০ টাকা কাটা যাবে। তাই খাতায় কলমে যদিও আমাদের বছরে ২১ দিন ছুটি বরাদ্দ, আমরা কেউ ছুটি নেওয়ার সাহস দেখাই না।..’’
জাপানি সুজুকি কোম্পানির জাপানের বাইরে যা বিক্রি তার ৬২ শতাংশই মারুতি সুজুকির বিক্রি ভারতে। সমগ্র বিশ্বে তার মোট বিক্রির ৪৮% (২০১১-১২ সালের হিসেব অনুযায়ী)। ২০০১-০২ থেকে ২০১০-১১, এই ৯ বছরে মারুতি সুজুকির লাভ বেড়েছে ২,২০০ শতাংশ।
২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচক ৫০% বাড়লেও শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে মাত্র ৫.৫%। সিইও-র আয় বেড়েছে গত ৪ বছরে (২০০৭-০৮ থেকে ২০১০-১১) ৪১৯%, আয় বেড়েছে সুপারভাইজার, ইঞ্জিনিয়ার, ম্যানেজমেন্ট স্টাফের। আমাদের, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের স্বজনপরিজন যে চাকুরি পেতে পারত। সন্তান গর্বে উজ্জ্বল হতে পারতাম আমরাও, বাড়ির কাছেই থাকত, যদি সিঙ্গুরে গড়ে উঠত টাটা কোম্পানির মোটর কারখানা।
এবং রাষ্ট্র চেয়েছিল গড়ে উঠুক সে কারখানা, সঙ্গে ছিল পুলিশ-প্রশাসন, ছিল আনন্দবাজার-গণশক্তি-টাইমস অফ ইন্ডিয়া-স্টার আনন্দ-এনডিটিভি; আইনও বলেছিল গাড়ি কারখানা ‘জনস্বার্থ’ শিল্প, তবু হল না, টাটার কথায় রাষ্ট্র চললেও, বিজ্ঞাপনের আয়ের লোভে ও শিল্পমালিকদের অংশীদারিত্বে চলা মিডিয়া, গাড়ি কারখানার অনুকূলে জনসমর্থন গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও, গাড়ি কারখানা হল না। সাধারণ মানুষ হতে দিলেন না।
৮
এই এক দ্বন্দ্ব। রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্ব। সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দ্বন্দ্ব। রাষ্ট্রব্যবস্থা যেমনই হোক না কেন, সেই ব্যবস্থা যেভাবেই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাক না কেন, সবসময় সে সফল হবে এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ বহুবিধ। তার মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে— প্রথমত ইউরোপীয় নেশন-স্টেট ধারণা এখানে তেমনভাবে কার্যকর হতে পারেনি, কারণ ভারতের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে এক বিস্তৃত ঐতিহ্যের বোধ। দ্বিতীয় কারণ, সর্বজনীন ভোটাধিকার। সরকারে ক্ষমতাসীন হতে গেলে নির্বাচনে জিতে আসতে হয়। তৃতীয় কারণ, আম্বেদকার রচিত ভারতীয় সংবিধান। এবং চতুর্থত প্রাচীন এই ভূখণ্ড ও জনপদের অসম ও অসমসত্ত্ব বিকাশ।
সরকার কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়কালে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলিতে একই দলের শাসনভার থাকলেও গত শতকের ছয়ের দশকে অনেকগুলি ঘটনা ঘটে গেল। পঞ্চশীল নীতির গুরুত্বহীনতা, চিন ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ, নেহরুর মৃত্যু, একের পর এক কালাকানুন, পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ, শাস্ত্রীর মৃত্যু, কংগ্রেসে নেতৃত্বের সংকট, লাগাতার অনাবৃষ্টি খরা, খাদ্যসংকট। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ছেদ, আমেরিকার চাপে নতুন কৃষিনীতি, টাকার অবমূল্যায়ন ইত্যাদি। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস অধিকাংশ রাজ্যে হেরে গেল, আঞ্চলিক দলগুলি শক্তিশালী হয়ে উঠল।
কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে সরকারের মূল্যায়নে একাধিক ধারণা প্রথম থেকেই ছিল। ১৯৪৭ সালে শ্লোগানও ছিল, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়েও দ্বন্দ্ব ছিল। তেলেঙ্গানা আন্দোলনের পর ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়িতে আবার সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতি ভারতীয় রাজনীতিতে এক প্রবল ও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। রাষ্ট্র বিরোধী এই আন্দোলন ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে অনেকগুলি রাজ্যে। রাষ্ট্র নামিয়ে আনে ব্যাপক দমনপীড়ন। ভবানী দত্ত লেন, বেলেঘাটা, বারাসাত, বরাহনগর-কাশীপুর, কোন্নগর, ডায়মণ্ডহারবার...অসংখ্য। সরকারি ক্ষমতার শীর্ষে তখন ইন্দিরা গান্ধী।
ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রথমেই পার্টি ও সরকারের মধ্যে সেসময় চলে আসা ক্ষমতার বিভাজন মুছে দিয়ে নিজেই কংগ্রেস সভাপতি হয়ে গেলেন। একের পর এক শিল্প, কয়লা থেকে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করলেন, ১৯৭১ সালে গরিবি হঠাও শ্লোগান দিয়ে ভারতবর্ষ থেকে দারিদ্র্য দূর করার প্রতিশ্রুতিও দিলেন। বাংলাদেশের মানুষজনদের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রায় সরাসরি ভারতকে যুক্ত করে দিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির যে অংশদুটি সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করত, তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ইন্দিরা গান্ধিকে সমর্থনই করে। অর্থনীতির প্রশ্নে, রাষ্ট্রনৈতিক প্রশ্নে। এমন বিশ্বাসও তৈরি করা হল যে রাষ্ট্রীয় পুঁজি সমাজতান্ত্রিক যাত্রাপথকেই প্রশস্ত করবে। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধি অবশিষ্ট গণতন্ত্রটুকু বিসর্জন দিয়ে জারি করলেন জরুরী অবস্থা। তৈরি হল এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। সমর্থন জানালো সিপিআইও।
১৯৭৭ সালে এই এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনমত প্রতিফলিত হলে, কেন্দ্রে অনেকগুলি পার্টি একত্রিত হয়ে ক্ষমতায় এল। পার্টিগুলির মধ্যেকার দ্বন্দ্বে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা হারালে ১৯৮০ সালে আবার ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় এলেন। তখন অসম, পাঞ্জাব, কাশ্মীর ও সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলে শেষবার কংগ্রেস একক দল হিসাবে কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসে।
রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পর থেকে বহু আঞ্চলিক দলের যৌথ নেতৃত্বেই কেন্দ্রে সরকার চলেছে। একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বহুদলীয় সরকার গঠন, আঞ্চলিক দলের রাজ্যের ক্ষমতায় আসতে পারা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সর্বজনীন ভোটাধিকার ও নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, আরও বেশি বেশি মান্যতা পেল।
ইতিমধ্যে ৭-এর দশক থেকে প্রকাশ পেল সমাজতন্ত্রের সঙ্কট, ফলে পাশ্চাত্যে শ্রমিক সংগঠন, বামপন্থী দলে দেখা দিল বিপর্যয় ও আত্মসমৰ্পণ; পাশ্চাত্য দেশগুলিতে সরকারের আর্থিক সঙ্কট: ব্যবসা ক্ষেত্রে মন্দা ইত্যাদি কারণে পাশ্চাত্যে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সরকারগুলি ব্যবসায়িক সঙ্কটের দায়ভার দরিদ্র নাগরিকদের ঘাড়ে চাপানো শুরু করল।
আমাদের দেশেও, গত শতকের আটের দশক থেকে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হয়। আর বর্তমান অর্থনৈতিক উদারীকরণের শুরু ১৯৯১ সাল। সেই বছরই ‘ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট’ নিয়ে ভারত সংকটে পড়লে, আইএমএফ-এর শর্ত মেনে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ সুইজারল্যান্ডে ২০ টন সোনা ও ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডে ৪৭ টন সোনা গচ্ছিত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উদ্ধার পেতে হয় ভারতকে। চন্দ্রশেখর তখন প্রধানমন্ত্রী। নরসিমা রাওয়ের আমলে মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন আইএমএফ-এর নির্দেশ মতো কাঠামোগত সংস্কার শুরু হয়। লিবারালাইজেশন, প্রাইভেটাইজেশন ও গ্লোবালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক পুঁজির কাছে ভারতীয় বাজার খুলে দেওয়া হতে থাকে।
বর্তমান এই নয়া উদারনীতি ব্যবস্থার মূলে রয়েছে তিনটি প্রধান ধারণা। প্রথমত, ইতিহাসের নিয়মেই বাজারি অর্থ ব্যবস্থার প্রসার অবশ্যম্ভাবী। দ্বিতীয়ত, অবাধ বাজারি লেনদেনের মাধ্যমে মানুষের অন্তর্নিহিত আত্মকেন্দ্রিক স্ব-উপযোগিতা বৃদ্ধির ইচ্ছা পূরণ হয়। তৃতীয়ত, যেহেতু এই ইচ্ছা বাজারি ব্যবস্থাতেই পূর্ণ প্রকাশ পায়, সেহেতু অবারিত বাজারি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সমাজ ইতিহাস তার পরিবর্তনশীলতার গতি হারায়।
আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার উদারনৈতিক পদক্ষেপ কার্যকর করার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, রাজ্যগুলিও একই পথ নিচ্ছে। বামফ্রন্ট শাসিত আমাদের রাজ্যেও একই ধারা পরিলক্ষিত হল। অর্থাৎ জাতীয় বা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমাধানসূত্রে মৌলিক কোন তফাৎ নেই। প্রত্যেকটি দলই বিশ্বাস করে ভারী শিল্প উদ্যোগই সাধারণ মানুষের দারিদ্র্যমোচনের একমাত্র পথ। প্রত্যেকটি দলই ক্ষমতার কেন্দ্রিকতায় বিশ্বাসী। উদারনৈতিক চিন্তায় আর্থিকভাবে অক্ষমদের দেখভালের কোন দায়িত্ব আজকের গণতান্ত্রিক সরকারের নেই। এর ফলে দরিদ্রজন তাদের উদ্যম হারিয়ে সরকার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় সমস্ত বামপন্থী দলই মেনে নিয়েছে, বাজারি ব্যবস্থাই সভ্যতার শেষ গন্তব্য।
২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দার পরিবেশ সৃষ্টি হল। কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্তে এল, অর্থনৈতিক এই মন্দা কাটিয়ে উঠতে পরিকাঠামোগত বিনিয়োগ প্রয়োজন। এর আগে এনডিএ পরিচালিত বাজপেয়ী সরকারের আমলেও পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য চালু হয়েছিল দেশ জুড়ে রাস্তা তৈরির কাজ, ‘সোনালি চতুর্ভুজ’ প্রকল্প। ইউপিএ পরিচালিত সরকারও সেই পথেই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা ভাবল।
বিনিয়োগ দরকার। বিনিয়োগ দরকার যে কোন মূল্যে। সুতরাং সমস্ত রাজনৈতিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২ ওয়ালমার্ট, টেসকো, ক্যারেফোরদের ভারতের বাজারে মাল্টি ব্র্যান্ড খুচরো ব্যবসায় ৫১% প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিল কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীসভা। বাড়ল কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় কংগ্রেসের সহযোগী আঞ্চলিক দল তৃণমূল কংগ্রেস। শরিক হলো বিরোধী। লোকসভা ও রাজ্যসভাতে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরোধিতা করে সোচ্চার হলো এই দল, কয়েকদিন আগেই যারা সরকারের সমর্থকই শুধু নয়, মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ দফতরেরও দায়িত্বে ছিল।
কেন্দ্রীয় সরকার এফডিআই সংক্রান্ত বিষয়টি প্রথম অবস্থায় সংসদে পেশ করতেই অনাগ্রহীই ছিল। পরবর্তীকালে মায়াবতীজী ও মুলায়মজীকে (সিবিআই তদন্ত রিপোর্ট যেন তাঁদের বিপক্ষে না যায় এই প্রতিশ্রুতিতে) ‘ম্যানেজ’ করতে পেরে সংসদের দুকক্ষেই ভোটাভুটিতে রাজি হয়ে যায়। ২০১২-র শীতকালীন অধিবেশনে লোকসভা ও রাজ্যসভায় সংখ্যাধিক্যের ভোটে এফডিআই ও ফেমা গৃহীত হয়।
২০১২ সালের ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের মঞ্চে সিএজি বিনোদ রাই মন্তব্য করেছেন, “যেমন বেপরোয়া ভঙ্গিতে কেন্দ্রীয় সরকার একের পর এক নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছে তা বিস্ময়কর।” ওই মঞ্চেই তিনি সিবিআই ও কেন্দ্রীয় ভিজিলেন্স কমিশনকে সরকারের আওতা থেকে বের করে সাংবিধানিক ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেন।
৯
সারা বিশ্বেই শিল্প-পুঁজির অবস্থা বেশ খারাপ। পুঁজি তার অস্তিত্বের নিশ্চয়তা পায় একমাত্র বিনিয়োগেই। ইউরোপ আমেরিকায় শিল্পপুঁজি যখন মুনাফার নিশ্চয়তা পাচ্ছে না, শিল্পপণ্যের বাজার যখন সারা বিশ্বজুড়েই সংকুচিত, নতুন নতুন উদ্ভাবিত পণ্যও অনাদৃত, সেসময় পুঁজি তার ক্ষেত্র বিস্তৃত করতে চাইছে কৃষিক্ষেত্রে। নতুন নয় তার এই ক্ষেত্র নির্বাচন। নতুন ভারতের কৃষিবাজারে তার এই আগ্রাসী অনুপ্রবেশ।
এই কাজ আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকায় আগেও করেছে। চিলি, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, এল সালভাদর, নিকারাগুয়া, দমিনিকান রিপাবলিকের মতো দেশগুলোয় খুব ভালো ফলের চাষ হতো। ১৯৫০-৬০এ মার্কিন সংস্থা ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি কলা চাষের দেশ হিসাবে গড়ে তোলে ওই সব দেশ। কোম্পানির অত্যাচারে বিপর্যস্ত হয়ে চিলি সরকার ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। উত্তর দেয় আমেরিকা চিলির আলেন্দে সরকারকে পদচ্যুত করে। ক্ষমতায় আনা হয় সামরিক প্রধান পিনোশেতেকে। অন্যত্রও। সে সবই নাকি হয়েছিল ওই সব দেশগুলির মঙ্গলের জন্য, মানবিক অধিকার সুরক্ষিত করতে। রচিত হয়েছিল ‘অ্যালায়েন্স ফর প্রগ্রেস’ নীতি। সাল ১৯৬১। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তখন নিক্সন।
ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে মার্কিন সেনেট ও হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভদের রিপোর্ট। সেখানে বলা হয়েছে এই বছর কমপক্ষে ১৫টি মার্কিন সংস্থা ভারতের বাজারে ঢোকার জন্যে মার্কিন সরকারকে আর্থিকভাবে প্রভাবিত করেছে, ওদের ভাষায় লবিং করেছে। যার জন্যে মার্কিন মুলুকে ব্যয় করা হয়েছে এবং হচ্ছে কয়েক’শ কোটি ডলার। তালিকায় রয়েছে ল্যাপটপ-কম্পিউটার প্রস্তুতকারক সংস্থা ডেল, এইচপি থেকে টেলিকম সংস্থা কোয়ালকম, ওষুধ সংস্থা ফাইজার, বিমা সংস্থা মরগ্যান-স্ট্যানলি ও প্রুডেনসিয়াল ফিনান্সিয়াল, গাড়ি সংস্থা অ্যালায়েন্স অফ অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স, বিমান সংস্থা এরোস্পেস ইনডাস্ট্রিজ, ভোগ্যপণ্য প্রস্তুতকারক সংস্থা কার্গিল ইনকর্পোরেশন ও কোলগেট-পামোলিভ। এই টাকার কত অংশ ভারতে ঢুকেছে, কার কার কাছে গেছে সেসব খবর এখনও পাওয়া যায়নি।
পেশাজীবী মধ্যবিত্ত যে মানুষটি এইমুহুর্তে চলতি বাজারের থেকে কম দামে জিনিস পেলেন, বাজার করার স্বাচ্ছন্দ্য পেলেন, এমনকি ক্রেডিট কার্ডে হোম ডেলিভারিতে জিনিস পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন তাকে থাকতে হবে এক ভয়ঙ্কর অস্থির সমাজে, যেখানে গ্রোথ ‘জবলেস’ এবং ‘জব’ হারানো মানুষটিকে বেঁচে থাকার জন্যে নিতে হবে হয়ত ডাকাতি রাহাজানির পথ। টিভি চ্যানেলে সান্ধ্য আসরে ওয়ালমার্ট, ক্যারেফোর, মেট্রো, টেসকোর গুণগান করে বাকি পথটা নির্বিঘ্নে অতিক্রম করা আগামী দিনে হয়ে উঠবে ভয়াবহ।
এনডিএ সরকার ২০০২ সালে যখন এফডিআই ভারতে চালু করার প্রস্তাব রাখে, তখন রাজ্যসভায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তার বিরোধিতা করে বলেছিলেন- এই সংস্কার কাম্য নয় কারণ এতে কর্মসংকোচন হবে, কৃষকদের অবস্থা খারাপ হবে। আর ২০১২ সালে সেই মানুষটিই আমাদের জানাচ্ছেন, এফডিআই এলে কর্মসংস্থান হবে, কৃষকদের ভাগ্য ফিরবে। কৃষকের ভাগ্যই যদি ফেরে ওয়ালমার্টেরা এলে, তাহলে খুচরো ব্যবসায় বিদেশী বিনিয়োগ ৫১ শতাংশতেই থেমে যাওয়া কেন, ১০০ শতাংশই বা নয় কেন? ওয়ালমার্টেরা থাকা সত্ত্বেও আমেরিকান সরকার বছরের পর বছর ধরে সেখানকার কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে কেন? আর একবার ভারতের পরাধীনতার সাক্ষী থাকতে চলেছি আমরা।
১০
অর্থনীতিবিদ কেইনস বলেছিলেন যেখানে বহু বহু টাকার অব্যবহৃত মূলধন পড়ে আছে, চাহিদা নেই বলে ব্যবহার করা যাচ্ছে না, বেকার মানুষজনের সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে, সেখানে চাহিদা বাড়াতে পারলে আমরা কাঠামোটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি। অর্থাৎ যদি কোন সময় দেখা যায় যে মোট চাহিদা যথেষ্ট হচ্ছে না, তাহলে মোট চাহিদা সৃষ্টি করে দাও। মোট চাহিদা তৈরি করে দাও সরকারি খরচে বিনিয়োগ করে। এইভাবে চাহিদাকে একটু ঠেলে দিলেই উৎপাদন ক্ষেত্রের বিকাশ হবে। ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রেই তিনি এই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন ইংল্যান্ডের অর্থনীতির পুনর্গঠনকল্পে।
নভেম্বর মাসে মনমোহন সিং নতুন ও পুরোনো মন্ত্রীদের নিয়ে সভায় জানিয়েছেন, “অর্থনীতির যা হাল, তাতে যদি পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ নিশ্চিত না করা যায়, তা হলে সমস্যা আরও বাড়বে। দ্বাদশ পরিকল্পনায় পরিকাঠামোয় নিশ্চিত করতে হবে ১ ট্রিলিয়ন ডলার (১০০০০০০০ লক্ষ ডলার)। সমস্যা টাকার। আর্থিক বৃদ্ধির হার কমছে, রফতানি কমছে, বাড়ছে আর্থিক ঘাটতি। টাকা আসবে কোত্থেকে ?
২০১২-১৩ আর্থিকবর্ষে অর্থমন্ত্রক ৩০ হাজার কোটি টাকা বিলগ্নীকরণের লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে। এ বছর মার্চ মাসে ওএনজিসি-র শেয়ার বিক্রি করে সরকার যখন ১২,৪০০ কোটি টাকা তুলতে চেয়েছিল, তখন শেয়ার নিলাম ব্যর্থ হলে ওই শেয়ার কিনতে হয় জীবন বিমা কর্পোরেশনকে। এবার সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নালকো, হিন্দুস্তান কপার, সেল, ভেল, ইন্ডিয়ান অয়েলের শেয়ার বিক্রি করতে চাইছে। ওএনজিসি-র মতো অবস্থা যেন না হয় সেজন্য সরকার এখনই এলআইসিকে দিয়ে এই সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার কিনিয়ে রাখছে।দেশের সম্পদ বিক্রি করাই হল সরকারের আয়ের উৎস! একই সঙ্গে চলেছে বেসরকারি পুঁজি ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে দেশের কর ব্যবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত ছাড়ের মাধ্যমে ভর্তুকি দেওয়া।
আমলা, মন্ত্রীদের অপদার্থতা আর দুর্নীতির মাশুল গুণছেন সাধারণ মানুষ। দুর্নীতি আজ আকাশ ছুঁয়েছে। একটি অসম্পূর্ণ তালিকা এইরকমঃ ২০১২- আই জি আই এয়ারপোর্ট স্ক্যামঃ সিএজি’র রিপোর্ট অনুযায়ী জমি নিলাম না করার জন্য সরকারের ক্ষতি ১.৬৩,০০০ কোটি টাকা; কোল মাইনিং স্ক্যামঃ ১,৭৬,০০,০০০ কোটি (সিএজি’র তথ্য); কর্নাটক ওয়াকফ বোর্ড স্ক্যামঃ ২,০০,০০০ কোটি; অন্ধ্রপ্রদেশ ল্যান্ড স্ক্যামঃ ১,০০,০০০ কোটি; ফোরেক্স ডেরিভেটস স্ক্যামঃ ৩২,০০০ কোটি; সার্ভিস ট্যাক্স অ্যান্ড সেন্ট্রাল এক্সাইজ ডিউটি ফ্রডঃ ১৯,১৫৯ কোটি; গুজরাট পিএসইউ ফিনানসিয়াল ইরেগুলারিটিঃ ১৭,০০০ কোটি; মহারাষ্ট্র স্ট্যাম্প ডিউটি স্ক্যামঃ ৬৪০ কোটি; মহারাষ্ট্র ল্যান্ড স্ক্যাম; এমএডিএইচএ রিপেয়ার স্ক্যামঃ ১০০ কোটি; হাইওয়ে স্ক্যামঃ ৭০ কোটি; মিনিস্ট্রি অফ এক্সটারন্যাল অ্যাফেয়ার গিফট স্ক্যাম; হিমাচল প্রদেশ পালস স্ক্যাম; ফ্লাইং ক্লাব ফ্রডঃ ১৯০ কোটি; অন্ধ্রপ্রদেশ লিকার স্ক্যাম; জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন স্ক্যামঃ আনুমানিক ৫০ কোটি; জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর পিএইচই স্ক্যাম; জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর রিক্রুটমেন্ট স্ক্যাম; পাঞ্জাব প্যাডি স্ক্যামঃ ১৮ কোটি; এনএইচপিসি সিমেন্ট স্ক্যাম; হরিয়ানা ফরেস্ট স্ক্যাম; গিরিবন (পুনে) ল্যান্ড স্ক্যাম (২০১১ সালে উদ্ঘাটিত পুনে ল্যান্ড স্ক্যাম নয়); টয়লেট স্ক্যাম; উত্তর প্রদেশ স্ট্যাম্প ডিউটি স্ক্যামঃ ১২০০ কোটি; উত্তর প্রদেশ স্ট্যাম্প হরটিকালচার স্ক্যামঃ ৭০ কোটি; উত্তর প্রদেশ পাম ট্রি প্ল্যানটেশন স্ক্যামঃ ৫৫ কোটি; উত্তর প্রদেশ সিড স্ক্যামঃ ৫০ কোটি; উত্তর প্রদেশ এলিফ্যান্ট স্ট্যাচু স্ক্যাম; পাতিয়ালা ল্যান্ড স্ক্যামঃ ২৫০ কোটি; ট্যাক্স রিটার্ন স্ক্যামঃ ৩ কোটি; ব্যাঙ্গালুরু মেয়র’স ফান্ড স্ক্যাম; রাঁচি রিয়াল এস্টেট স্ক্যাম; দিল্লি সার্জিকাল লেভস প্রকিয়োরমেন্ট স্ক্যাম; বিইএমএল হাউসিং সোসাইটি স্ক্যাম; এমএসটিসি গোল্ড এক্সপোর্ট স্ক্যামঃ ৪৬৪ কোটি; টিআইএন স্ক্যাম; নওগাঁ ল্যান্ড স্ক্যাম ইত্যাদি। এছাড়াও অসংখ্য দুর্নীতি।
এসব কোনো এক বিশেষ বছরের পরিসংখ্যান নয়। বরং বলা যায় এটাই স্বাভাবিক। কতটা যে স্বাভাবিক আগের বছর মানে ২০১১ সালের অবস্থাটা দেখলেই বোঝা যায়।
২০১১: উত্তর প্রদেশ এনআরএইচএম স্ক্যামঃ ১০,০০০ কোটি টাকা ইসরও’স এস ব্যান্ড স্ক্যাম (ইসরও ডেভাস ডিল নামেও পরিচিত, পরে এই চুক্তি বাতিল করা হয়) ২,০০,০০০ কোটি টাকা; এনটিআরও স্ক্যামঃ ৮০০ কোটি; কেজি বেসিন অয়েল স্ক্যাম; গোয়া মাইনিং স্ক্যাম; বেলারি মাইনিং স্ক্যাম; ব্রুহাট-বেঙ্গালুরু মহানগর পালিকা স্ক্যামঃ ৩,২০৭ কোটি; হিমাচল প্রদেশ এইচআইএমইউডিএ হাউজিং স্ক্যাম; পুনে হাউজিং স্ক্যাম; পুনে ল্যান্ড স্ক্যাম; ওডিশা পালস স্ক্যামঃ ৭০০ কোটি; কেরালা ইনভেস্টমেন্ট স্ক্যামঃ ১০০০ কোটি; মুম্বাই সেলস ট্যাক্স ফ্রডঃ ১০০০ কোটি; মহারাষ্ট্র এডুকেশন স্ক্যামঃ ১০০০ কোটি; মহারাষ্ট্র পিডিএস স্ক্যাম; উত্তর প্রদেশ টইট স্ক্যামঃ ১০,০০০ কোটি; উত্তর প্রদেশ এমজিএনআরইজিএ স্ক্যাম; ওড়িশা এমজিএনআরইজিএ স্ক্যাম ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স ল্যান্ড স্ক্যাম; টাটা স্ক্যামঃ ৭৫০ কোটি; বিহার সোলার ল্যাম্প স্ক্যামঃ ৪০ কোটি; বিএল কাশ্যপ ইপিএফও স্ক্যামঃ ১৬৯ কোটি; অসম এডুকেশন স্ক্যাম; স্ট্যাম্প পেপার স্ক্যাম (আবদুল করিম তেলগি’র স্ট্যাম্প পেপার কেলেঙ্কারি নয়); পুনে ইউএলসি স্ক্যাম।
এইসব স্ক্যাম বা আর্থিক কেলেঙ্কারি বা সামগ্রিকভাবে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষজন সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত মহাশয় ব্যক্তিরা। কেউ রাজনীতিক, কেউ সমাজসেবী, কেউ শিল্পপতি। তবে আমলা-মন্ত্রী ছাড়া এমন সব বড় মাপের দুর্নীতি সম্ভব নয়।
সনিয়া গান্ধীর জামাই রবার্ট ভাদরাকে ডিএলএফ বছর পাঁচেক আগে ৬৫ কোটি টাকা বিনা সুদে ধার দিয়েছিল। বিনিময়ে হরিয়ানায় জনস্বার্থে সরকার অধিগৃহীত জমি বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে ডিএলএফ। ভাদরার সংস্থা স্কাইলাইট হসপিটালিটি প্রাইভেট লিমিটেডকে প্রায় বিনামূল্যেই দিল্লির কাছে গুরগাঁওয়ে ম্যাগনোলিয়া আবাসনে ৭ টি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে, বিনিময়ে ডেভেলাপারকে হরিয়ানা সরকার ৩৫০ একর জমি পাইয়ে দিয়েছে। রবার্ট ভাদরার ছিল গোটা পাঁচেক কোম্পানি। ছোট ছোট কোম্পানি। মোট মূলধন ৫০ লাখ টাকা। ভাদরা ২০০৭ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ৩০০ কোটি টাকার সম্পত্তি কিনেছে যার বর্তমান বাজার দর নাকি ৫০০ কোটি।
দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন সনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠেছে সনিয়া পুত্র এবং কংগ্রেস মনোনীত আমাদের ভাবী প্রধানমন্ত্রী রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে। অভিযোগ, ইয়ং ইন্ডিয়ান’ নামে পরিচিত একটি সংস্থা, “অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস’-এর সমস্ত সম্পত্তি কিনে নিচ্ছে। অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস’-এর চেয়ারম্যান হলেন কংগ্রেসের কোষাধ্যক্ষ মতিলাল ভোরা। “অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস’-এর দিল্লিতে ‘ হেরাল্ড হাউস’ নামে একটি বিশাল বাড়ি রয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ১৬০০ কোটি টাকা। এছাড়াও উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় ‘অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস’-এর সম্পত্তি রয়েছে।
১৯৩৮ সালে অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস’ গড়ে ওঠে জওহরলাল নেহরু’র উদ্যোগে। প্রকাশিত হয় ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ পত্রিকা। ২০০৮ সাল অব্দি চলেছিল সেই পত্রিকা। ২০১১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস’কে ৯০ কোটি টাকা বিনা সুদে ধার দেয়। অভিযোগ, বিনিময়ে ‘অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস’, তাদের ৯ কোটি শেয়ার লিখে দেয় ইয়ং ইন্ডিয়া’কে। ইয়ং ইন্ডিয়ার মালিকানার ৩৮ শতাংশ করে শেয়ার সনিয়া গান্ধী ও তাঁর পুত্র রাহুল। ৯ নভেম্বর কেজরিওয়াল অভিযোগ করেছেন জেনিভার এইচএসবিসি-র অ্যাকাউন্টে মোট ৬ হাজার কোটি টাকা জমা রেখেছেন ৭০০ জন ভারতীয়। আর এই ব্যাংকের মাধ্যমেই সক্রিয় রয়েছে হাওয়ালা চক্র। তার অভিযোগ সুইস ব্যাংকের গ্রাহক তালিকা ২০১১ সাল থেকেই ভারতের কাছে আছে। ভারতের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করে তুলেছে সরকার। হাওয়ালার মাধ্যমে বাড়িতে বসেই খুব সহজে সুইস ব্যাংকে টাকা রাখা যায় এখন।
যাঁরা টাকা রেখেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন মুকেশ আম্বানি, অনিল আম্বানি, কোকিলা বেন, যশোবর্ধন বিড়লা, নরেশ গোয়েল, ডাবরের বর্ধন ভাইয়েরা, কংগ্রেস সাংসদ রাহুল ঘনিষ্ঠ অম্ল ট্যান্ডন। পূর্বতন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় জানা সত্ত্বেও কালো টাকা উদ্ধারে বা বিষয়টি সংসদে আনার কোনো উদ্যোগ নেননি তো বটেই বরং ইচ্ছা করেই ধামা চাপা দিয়েছেন।
দুর্নীতি। সীমাহীন দুর্নীতি। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে যে ৫৩ জন বিধায়ক আবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, গত ৫ বছরে তাদের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ২৭৩ শতাংশ। ৫ বছর আগে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় তাদের গড় সম্পত্তির পরিমাণ ১ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে গড়ে ৬ কোটি ৩ লক্ষেরও বেশি।
দুর্নীতি পরিণতি নয়, দুর্নীতি পদ্ধতি।
দুর্নীতি জমি নিয়ে, খনি নিয়ে। জল নিয়ে, জঙ্গল নিয়ে। লুঠ হয়েছে এবং হচ্ছে রাষ্ট্রের কোষাগার। ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে এবং নিচ্ছে ক্ষমতার বৃত্তে থাকা মানুষজন, তাদের পরিবার স্বজন। আর নিঃস্ব হচ্ছে দেশ, দেশের কমবেশি ৮০ শতাংশ মানুষজন, ভুবন, ভুবনেরা।
১১
মার্কস (১৮১৮- ১৮৮৩) যে বছর মারা যান, অর্থনীতিবিদ শুম্পেটার (১৮৮৩- ১৯৫০) সেই বছরই জন্মান। মার্কসের সঙ্গে শুম্পেটারের মতের ঐক্য থাকলেও, মার্কসের গ্রোথ থিয়োরিতে কিন্তু শুম্পেটার বিশ্বাস করতেন না।। শুম্পেটারের মতে মার্কস অনেক সময়ই শুদ্ধ সিদ্ধান্তে আসতেন, অশুদ্ধ যুক্তি দিয়ে, ভুল বিশ্লেষণ থেকে।
মার্কস মনে করতেন, সমস্ত কিছুর মূল হচ্ছে accumulation, সঞ্চয়। মূল হচ্ছে টাকা থেকে সেই অবস্থা, যেখানে টাকা আস্তে আস্তে মূলধনে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এই টাকা থেকে মূলধনে রূপান্তর, transformation যে ঠিক কীভাবে হয় সে সম্পর্কে তেমন কিছু বলা না থাকলেও, তাঁর কথায় প্রাথমিক accumulation থেকেই গতি সঞ্চারিত হবে। উৎপাদন ব্যবস্থায় একসময় রিজার্ভ ইনডাসট্রিয়াল আর্মি তৈরি হবে, মজুরি কমে যাবে। সংকট একটা বড় মাত্রা নিয়ে নিলে, বিদ্রোহ এবং বিপ্লব। পরিশেষে ধনতন্ত্রের বিলোপ। অবশ্য অর্থনৈতিক বিবর্তনে ধনতন্ত্রের একটা বড় ভূমিকা আছে বলেই তিনি মনে করতেন।
শুম্পেটার প্রথমদিকে ভাবতেন ধনতন্ত্র কখনই শেষ হয়ে যাবে না, ক্রমে ক্রমে তা আরও উন্নতির দিকে যাবে। এই উন্নতি আসবে নানারকম নবীকরণ থেকে, নতুন জিনিস তৈরি করা থেকে, নতুন কাঁচামালেতে, কাঁচামালের নতুন উৎস থেকে, কাঁচামাল সংগ্রহ করার পদ্ধতিতে, নতুন ধরনের সংগঠন সৃষ্টির মাধ্যমে, নতুন বাজার কাঠামো তৈরি করে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে। নবীকরণ থেকেই গতির শুরু, আর গতিটাকে বাঁচিয়ে রাখবে একদিকে আবিষ্কারক ও সংগঠক যাঁরা এই পরিবর্তনগুলি আনছেন এবং ব্যাঙ্ক।
শুম্পেটার বলছেন, একটা নতুন আবিষ্কারে যখনই কিছু কিছু উৎপাদক উৎসাহিত হয়ে পড়বে, তারা ব্যাঙ্কের কাছে যাবে, টাকা ধার নেবে। ব্যাঙ্ক ‘ক্রেডিট’ তৈরি করবে। অর্থাৎ দাদন দেবে। এর ফলে যে ক্রয়শক্তি entrepreneur-দের হাতে আসবে, সেই ক্রয়শক্তি দিয়ে উৎপাদনের জন্য যা যা দরকার, মূলধনী জিনিস বা কাঁচামাল বা শ্রমশক্তি সবই সংগ্রহ করতে পারবে তারা। উন্নতি হবে মর্ডানাইজেশন ও ব্যাঙ্কের ঋণ দিয়ে। সঞ্চয় আসবে ব্যাঙ্ক ক্রেডিটের প্রসার থেকে। ব্যক্তিগত সঞ্চয় নয়। আগে যে ধারণা ছিল যে আগে সঞ্চয় পরে বিনিয়োগ, তা নয়।
নতুন নতুন entrepreneur আসবে, পুরোনোরা নতুন উৎপাদন পদ্ধতি নেবে। সংকট যদি কিছু আসে সে হবে নতুন আবিষ্কার না হওয়ার জন্যে, আবার নতুন প্রযুক্তি এলেই আসবে উৎপাদনের নতুন জোয়ার। পরবর্তীকালে শুম্পেটার আমেরিকায় থাকাকালীন যখন ধনতন্ত্রকে খুব কাছ থেকে দেখছেন, তখন বলছেন ধনতন্ত্র টিকবে না। Capitalism will die of its own success। কেননা, এই ধনতন্ত্রের ফলে নতুন কতকগুলি সামাজিক শ্রেণি তৈরি হচ্ছে যে সামাজিক শ্রেণিগুলি ধনতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছিল তার বিলুপ্তি ঘটছে। সুতরাং ধনতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আসবে ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্র থেকে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র।
আমাদের দেশে ধনতন্ত্রই সেভাবে কোনদিন বিকশিত হতে পারল না। স্বাধীন ভারতে শিল্প উৎপাদনকে উজ্জীবিত করতে পারে সেরকম নতুন নতুন আবিষ্কারের ক্রমিক ইতিহাস নেই। বস্ত্রশিল্প বা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের কিছুটা নিজস্ব উদ্যোগে আধুনিকীকরণ হলেও অনতিবিলম্বে বিদেশি উৎপাদননির্ভর হয়ে গেছে। শিল্পপতিরা যন্ত্রপাতি আমদানিতে করছাড়ের জন্য যত উদ্যোগ দেখিয়েছেন, তার সামান্যতমও দেখাননি উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশের প্রয়োজনীয় শর্তাবলী পূরণ করতে। সরকারও তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, এমন কোনো কর্মসূচি ভারত সরকারও নেয়নি। পরবর্তীকালে ভূমিসংস্কারের মধ্য দিয়ে অবশ্য কৃষকের কিছুটা ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। আরও পরে জমির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে কৃষিতে ব্যাপকভাবে অজৈব সার ও নানান ধরনের কীট ও আগাছা নিরোধক রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার শুরু হয়। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে নতন প্রজাতির বীজ আসে, জল তুলতে শ্যালো আসে, আসে গভীর নলকূপ। জমি চষার জন্য ট্র্যাক্টর আসে, ধান ঝাড়াইয়ের মেশিন বসে। আরও আরও উৎপাদন। জমি ছিবড়ে হতে থাকলেও টাকা আসে কিছুটা।
কিছুটা। অল্প কিছুটা। এই কিছুটা বাড়ে ভোগ্যসামগ্রী কেনায়। সুদূর গ্রামবাংলায়ও পাউচ প্যাকে ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ ক্রিম বা ‘হেড অ্যান্ড শোল্ডার’ শ্যাম্পু দেদার বিকোয় বিজ্ঞাপনের জৌলসে। টিভি ঢুকেছে। মোটর বাইক ঢুকেছে। অবশ্য জমিতে জল নিয়ে যাবার পাম্পও এসেছে। এসেছে কৃষি যন্ত্রপাতি।
উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি দেশী বিদেশী বড় বড় শিল্পপতির। ভোগ্যসামগ্রীও বহুজাতিক কোম্পানির। দেশী বীজ, দেশীয় কৃষিযন্ত্রপাতি উধাও। সার, কীটনাশকের উৎপাদকও বিদেশী কোম্পানি। বিদেশী দ্রব্য ব্যবহারের বিজ্ঞাপন খবরের কাগজ জুড়ে, টিভি চ্যানেলে। তার বিপনণও কেতাদুরস্ত।
পুঁজিবাদ উপনিবেশবাদে পর্যবসিত হয়েছে, শুধু এমন একটি বাক্যবন্ধ ব্যবহার করেই এই সময়ের পুঁজির আগ্রাসনকে বোধহয় প্রকাশ করা যায় না। পুঁজিবাদকে বর্তমান স্তরে আর শুধুমাত্র চিরাচরিত অর্থে সীমানা ছাড়িয়ে বেশি পণ্য বিক্রির স্তর বলা চলে না। বরং এটা একটা নতুন স্তর যা তৈরি করা বাজারের ক্রমবর্ধমান তেষ্টা মেটাতে গিয়ে আগে যেসব বস্তু বিক্রয়যোগ্য না হয়ে সর্বসাধারণের ব্যবহার্য ছিল, সেসবকেও পণ্য করেছে। সর্বসাধারণের ক্ষেত্রের ওপর ব্যক্তি মালিকানার আক্রমণ গ্রাস করেছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন ধ্যানধারণা, জিন, বীজ, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর চিরাচরিত চিকিৎসা. গাছপালা, এমনকি মানুষের দেহকোষও। এবং জল।
২০০৫ সালেই বিশ্বব্যাঙ্ক ‘ভারতের জল অর্থনীতি’র রিপোর্টে বলে, ভারতের উন্নয়নকে স্থায়ী করতে জলসম্পদের ব্যবহার হওয়া উচিত আর্থিক হিসাবে। ২০০৬ সালে ‘কোকোকোলা’র স্পনসরশিপে ওয়ার্ল্ড ওয়াটার কাউন্সিলের অধিবেশন বসে। বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা জল-বাণিজ্য সংস্থাগুলির *মাল্টি ট্রিলিয়ন ডলার বিজনেস’-এর সম্ভাবনার কথা বলে জানায়, জল সরবরাহ মেটাতে জল সরবরাহের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে বেসরকারি সংস্থার হাতে ছেড়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে জলের পরিকাঠামো গড়তে তারা আর্থিক সহায়তা দেবে। এই ভাবেই এগিয়েছে বিশ্বব্যাঙ্ক। সরকার নগরোন্নয়নের জন্য ঋণ নিয়েছে জলকর বসানোর শর্তেই।
এবং জলকর বসানোর কথা উঠল বিশ্বব্যাংকের শর্ত মেনে। ওয়ার্ল্ড ওয়াটার কাউন্সিলের সভা কোকোকোলা’র স্পনসরশিপে। ‘কোকোকোলা’র স্পনসরশিপে বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত করে দিল আমাদের জলনীতি।
পুকুর-নদী-নালার দেশ পশ্চিমবঙ্গ। সুপ্রাচীন সময় থেকে পানীয় জল সংরক্ষণের যেসব পন্থা ছিল, সেসবও চিন্তায় আনা হলো না। কাকাসাহের কালেলকর তাঁর জীবনলীলা গ্রন্থে বলছেন, “বস্তুত পঞ্চমহাভূতের সংযোগেই জীবন। তথাপি আমরা যে শুধু জলকেই জীবন বলি, ইহার মধ্যে গভীর রহস্য আছে। পৃথিবীর চারিদিক ঘিরিয়া যতই বায়ুমণ্ডল থাকুক, যার বিনা আমরা যতই না কেন ক্ষণেকের জন্যও বাঁচিতে অসমর্থ হই, তথাপি পৃথিবীর মহত্ত্বের কারণ হইল উহার ‘উদাবরণ’, জলের আবরণ, যাহা উহাকে ঘিরিয়া আছে। জলের মধ্যে যে সরসতা ও নবীনতা আছে, যে জীবনতত্ত্ব আছে তাহা অগ্নিশিখায় নাই, পবনের মধ্যে অথবা ভীষণ ঝটিকার মধ্যে নাই। জল যেখান দিয়া বহিয়া যায় তাহা শীতল করিয়া যায়, মরুভূমিকেও উপবনে পরিণত করে। প্রাণীমাত্রেই যাহাতে জল নানা প্রকারে ব্যবহার করিতে পারে, এরূপ সুযোগ সুবিধা দান করে। জলের স্বভাবই এই তাহা চঞ্চল, তরল, ঊর্মিল; তাহা হইতেও অধিক, উহা বৎসল।”
‘জলকর’ বসানোর আপত্তি জানিয়েছে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দিচ্ছে, জলকর না বসানো হলে কেন্দ্র আর্থিক অনুদান বন্ধ করে দেবে। অনেকেই সরকারের সমালোচনা করছেন। কিন্তু কেউই প্রায় বলছেন না, জলকর বসানোর ক্ষেত্রে একটা পুঁজিবাদী আগ্রাসন, কর্পোরেট সংস্থার ভারতকে তার উপনিবেশ হিসাবে দেখার চিন্তাই কাজ করছে।
ভারত সরকার আজ আন্তর্জাতিক পুঁজির আজ্ঞাবহ। সুতরাং ভারতের কৃষি বৈচিত্র্য ও কৃষি পণ্যের বাজারও উন্মুক্ত করে দিতে হল আন্তর্জাতিক পুঁজির কাছে। ভারতকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রয়োজন, কৃষিজ পণ্যের ও দেশের খুচরো ব্যবসার ওপর নিয়ন্ত্রণ। কেননা সারা বিশ্বের ১৭ শতাংশ দুধ উৎপন্ন হয় ভারতে। বিশ্বের ৪১ শতাংশ আম, ৩০ শতাংশ ফুলকপি, ২৪ শতাংশ কাজু, ৩৬ শতাংশ মটরশুঁটি, ২৯ শতাংশ আখ, ২২ শতাংশ চাল, ২১ শতাংশ ডাল, ১৫ শতাংশ গম, ২৮ শতাংশ চা ভারতে উৎপন্ন হয়। এছাড়া আছে আরও নানাধরনের ফলমূল, ভেষজ উদ্ভিদ। গবাদি পশু উৎপাদনেও ভারতই প্রধান।
পৃথিবীর প্রধান জলবায়ু অঞ্চল আছে ২০ রকমের, তার ৮ টি ভারতে পাওয়া যায়। ভারত ভূখণ্ডে ৪৬ রকমের মাটিই আছে, ফলে এই দেশের ফসলে এমন অফুরান বৈচিত্র্য। বিশ্বের মোট আবাদযোগ্য জমির ১১ শতাংশই ভারতে। এই বৈচিত্র্যের জন্যই সারা ইউরোপ, আমেরিকা যখন ভয়াবহ আর্থিক সংকটে বিপর্যস্ত তখন ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল তুলনায় স্থিতিশীল।
আন্তর্জাতিক পুঁজির চাপে ২০০৫ সালেই আমেরিকার সঙ্গে ভারতের ‘ভারত মার্কিন কৃষিজ্ঞান চুক্তি, এ কে আই’ সম্পাদিত হয়েছিল। ভারতীয় শিল্পপতি রতন টাটা, মুকেশ আম্বানি, বাবা কল্যাণী, ওয়াই সি দেবেশ্বর, দীপক প্যাটেলদের সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আমেরিকা সফরে গিয়ে জর্জ বুশ-এর সঙ্গে ওয়াশিংটনে ১৮ জুলাই, ২০০৫ তারিখে যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন বীজ উৎপাদন, খুচরো ও পাইকারি ব্যবসা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, শিক্ষা গবেষণা, কৃষি উৎপাদন ও বন্টন, সর্বত্রই প্রযোজ্য হবে এ-কে-আই। চারটি মূল বিষয় বেছে নেওয়া হয়েছিল। এক-শিক্ষা, পাঠ্যতালিকা নির্বাচন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ। দুই- খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও জৈব জ্বালানির ব্যবহার। তিন- জৈবপ্রযুক্তি। চার- কৃষিতে জলসরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রকের অন্যতম উপদেষ্টা মোহন গুরুস্বামী হিসাব করে দেখিয়েছেন ওয়ালমার্টের মতো সংগঠিত পুঁজি প্রতিষ্ঠান যদি এদেশের শতকরা ২০ ভাগ বাজার দখল করতে পারে তাহলে কর্মসংস্থান হবে ৪৩,৫০০ জনের মতো, আর কাজ হারাবে ৮০ লক্ষ মানুষ।
আর্জেন্টিনায় খুচরো ব্যবসায় বিদেশি অনুপ্রবেশে ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশেরও বেশি ছোট ও মাঝারি দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চিলিতে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় ২০ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়ায় ২০০২-০৩ সালেই বন্ধ হয়ে যায় প্রায় ১ লক্ষ ৫৪ হাজার দোকান। লাতিন আমেরিকার ৬ টি দেশের খুচরো খাদ্যসামগ্রীর ব্যবসার ৬০ শতাংশ চলে গেছে সুপারমার্কেটগুলিতে।
ভারতে একচেটিয়া পুঁজির মালিকেরা আর শুধু শপিং মলের কথা ভাবছে না। প্রয়োজনে পাড়ায় পাড়ায় গুমটি দেওয়ার কথাও নাকি ভাবছে। ২০১৩ সালে খুচরো ব্যবসার ৩০ শতাংশ সংগঠিত ক্ষেত্রে চলে আসবে বলে হিসাব করা হচ্ছে, এর ফলে কাজ হারাবে ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ।
খুচরো ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বড় কোম্পানিগুলো খুলছে, রিটেল ম্যানেজমেন্ট, ইনভেনটরি ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি এ্যাকাডেমিক কোর্স। যেমন ফিউচার গ্রুপ। বিগ বাজার, প্যান্টালুন যারা চালায়। তারাই বাঙ্গালোর, আমেদাবাদ, কলকাতায় খুলেছে ফিউচার লার্নিং অ্যান্ড ডিভেলপমেন্ট অ্যাকাডেমিক্স। স্পেন্সার খুলছে প্রগতি। ভারতি ও বিশাল রিটেল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলছে, রিটেল ইনসটিটিউট। ভারতে যদি ৩৫টি শহরে ওয়ালমার্ট ব্যবসা শুরু করে, সেন্টার ফর অল্টারনেটিভ পলিসির সমীক্ষা অনুযায়ী জীবিকা হারাবেন ৪ লক্ষ ৩২ হাজার মানুষ, কাজ পাবেন ১০,১৯৫ জন।
ভুবন, ভুবনেরা আমাদের দেশের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদের ‘নিশ্চিন্ত নিরাপদ আশ্রয়’য়ের কোনো প্রতিশ্রুতি আর রাষ্ট্র বা কেন্দ্রীয় সরকার দিতে পারবে না।
১২
কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে আসীন দলগুলির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক সমীকরণেও ভিন্নতা স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। আগেও এটা ছিল, কিন্তু কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই রাজনৈতিক দল সরকারে থাকায়, খুব একটা বোঝা যেত না। কেন্দ্রে ও রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন দল যখন এল, বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থা বলবৎ হল, সরকারের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হল শুধু নয়, ভিন্ন মাত্রাও নিল।
দেশী বিদেশী বহুজাতিক সংস্থা এখন মনমোহন সিংয়ের গুণগ্রাহী। কেন্দ্রীয় সরকার আবার সব রাষ্ট্রিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে সচেষ্ট। সর্বভারতীয় ইংরাজি চ্যানেলগুলো আর মন্ত্রীসভাকে জনস্বার্থবিরোধী বলছে না। ব্রেকিং নিউজ, মনমোহন পুশ রিফর্ম। অপোজিশন ডিভাইডেড অন রিফর্ম ইস্যু। মমতা রিজেক্ট রিফর্ম।
মমতা রিজেক্ট রিফর্ম। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংস্কারের বিরুদ্ধে। সংস্কারের বিরুদ্ধেই কথা বলছে তৃণমূল কংগ্রেস। বলছে, কেন্দ্রীয় সরকার যেসব সংস্কার নিয়ে আসছে, সেই সব সংস্কার সাধারণ মানুষের পক্ষে যাবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
রিফর্ম শুরু হয়েছিল নরসিমা রাও আর মনমোহন সিংয়ের যৌথ কনসার্টে। সুর মিলিয়েছিল বাকিরা। রিফর্মে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, নতুন ভারত গড়ে উঠবে। প্রধান সঞ্চালক আইএমএফ। মনমোহন সিং ছিলেন আইএমএফেরই নীতি নির্ধারক কর্মচারী।
দীর্ঘ পথ অতিক্রমান্তে জানলাম, জানালো সেন্ট্রাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অর্গানাইজশন, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কমতে কমতে দাঁড়িয়েছে ৫.৩ শতাংশে। মনমোহন সিংয়েরা জানালেন, দরকার আরও রিফর্ম। বাজারি ব্যবস্থাই সভ্যতার শেষ গন্তব্য। স্বামীনাথনেরা জানালেন, প্রথম সবুজ বিপ্লব ব্যর্থ, শুরু করো দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব।
ভাবলে অবাক হতে হয়, যে পথে দেশ হচ্ছে নিঃস্ব, রিক্ত; সেই পথের মূল্যায়ন করার কথা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উঠল না। ভুলের সংশোধন না করে ‘দেশ’ বেচে, শেয়ার বাজারে ঢুকে পড়লেন ‘বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা’গণ।
শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অনেকটাই লেফট অ্যাজিটেটিভ রাজনৈতিক নেতা। অগোছালো। কিন্তু সরাসরি মানুষের হেঁশেলে। কথাবার্তায় অকুলীন। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস। রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে নয়, সেসময়কার নেতৃস্থানীয় কয়েকজন কংগ্রেসী নেতার আচার-আচরণ, দুর্নীতির প্রতিবাদে। একসময়কার কমিউনিস্ট পার্টির মতোই কৃষিজমির সমস্যাকেই পশ্চিমবাংলার অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসাবে তিনিও চিহ্নিত করলেন।
বামফ্রন্ট সরকার ভূমিসংস্কার কর্মসূচি বেশ কিছুটাই রূপায়িত করেছিল। কিন্তু ফাঁক ছিল বিস্তর। গ্রামে বড় চাষি যাঁরা ছিলেন, গ্রামটাকে সত্যিই যারা ভালবাসতেন, চাষে নজর দিতেন, স্থানীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, সবাই কেমন এক চাপিয়ে দেওয়া ভূমিসংস্কারের মহাযজ্ঞে অস্পৃশ্য হয়ে গেলেন।
কংগ্রেসের হাত থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে সরকার পরিচালনায় এসেছিল প্রথমে যুক্তফ্রন্ট তারপর বামফ্রন্ট। ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়ার পর পার্টির ছোট বড় মেজ, কৃষক সমিতির বড় মেজ সেজোদের হাতে চলে এল ক্ষমতা। পুলিশ, আড়তদার, ব্লক অফিস, মিনি কিট এবং যাবতীয় সালিশীসভায় সমঝোতাসূত্রের ভার নিল তারাই। কৃষি ও কৃষি সম্পর্কিত সমস্যা প্রকৃতপক্ষে উপেক্ষিতই থাকল। পরবর্তী সময়ে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের দায়িত্বও নিল তারাই।
সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে জোর করে কৃষিজমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। কৃষিজমিতে মোটর গাড়ির কারখানা গড়ে ওঠার বিরোধী ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। হরিপুরে পারমাণবিক চুল্লি বসানোর বিরুদ্ধেও ছিল এই দল। ডান থেকে বাম, সবাই যখন মুক্ত বাজার অর্থনীতির উপাসক, পাশ্চাত্য শিল্প সভ্যতাই যেখানে সভ্যতার চূড়ান্ত, নিউক্লিয়ার এনার্জি যেখানে গ্রিন এনার্জি, সেখানে কৃষিজমি রক্ষার নামে এক লাখের ন্যানো মোটরগাড়ির বিরোধিতা বা নিউক্লিয়ার থার্মাল পাওয়ারের বিরোধিতা শিক্ষিত সমাজের বড় অংশই মেনে নেননি। বাজার অর্থনীতির প্রতি অনুগত থেকেও নয়া অর্থনৈতিক উদারীকরণের বিরুদ্ধে যেতে গিয়ে, সংবিধানকে গুরুত্ব না দিয়ে গত দেড় বছরে আদালতে রাজ্য সরকার বারবারই হারছে।
সিঙ্গুর আইন অসাংবিধানিক ও অবৈধ বলে রায় দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যেতে হয়েছে রাজ্য সরকারকে।
সমবায় আইনের সংশোধনী এনেছিল সরকার, আদালতে খারিজ হয়ে গেছে।
সিপিআই (এম) নেতা লক্ষ্মণ শেঠের পরিচালনাধীন হলদিয়া মেডিকেল কলেজে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নেই বলে রাজ্য সরকার ওই কলেজের স্বীকৃতি বাতিল করে দেয়। আদালত সে সিদ্ধান্ত খারিজ করে দিয়েছে।
উচ্চশিক্ষিত সরকারি ডাক্তারদেরও ‘প্রত্যন্ত’ গ্রামীণ এলাকায় পোস্টিং সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশ অবৈধ বলে রায় দিয়েছে আদালত।
পণ্য প্রবেশ কর সম্পর্কিত যেসব শর্ত সরকার আরোপ করেছিল, তার সবগুলি শর্তে সায় দেয়নি আদালত।
পুলিশ ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল সরকার এই বছরের গোড়ায়, ১০ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে হাইকোর্ট জানিয়েছে, ওই নির্দেশ বেআইনী এবং সংগঠন করার অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে।
কলকাতা পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ সালের ১৩ মে থেকে ২০১২ সালের ৩১ মার্চ নতুন মন্ত্রীসভার প্রথম সাড়ে দশ মাসে শুধু কলকাতাতেই মহিলাদের ধর্ষণ, যৌননিগ্রহ ও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৩৭৩টি। এর মধ্যে ধর্ষণ-গণধর্ষণের ঘটনা ৬৪টি। রাজ্য পুলিশের পরিসংখ্যানও বলছে যৌন নিগ্রহের ঘটনা ক্রমবর্ধমান। এক বাঁকুড়াতেই ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছ ৩২টি। যৌন নিগ্রহের সংখ্যা ৫৬, অপহৃত হয়েছেন ৩৯ জন। সরকার যতই দাবি করুক যে নথিভুক্ত করার প্রবণতা বেড়েছে, ইত্যাদি এবং সেসব যদি সত্যও হয় তা হলেও এই সংখ্যা কোনো সুশাসনের কথা বলে না।
স্বভাবতই পশ্চিমবঙ্গের প্রধান প্রধান বাংলা ইংরেজি খবরের কাগজগুলো, কিংবা সর্বভারতীয় দৈনিক সংবাদপত্র এবং রিজিওনাল ও ন্যাশনাল টিভি চ্যানেলগুলোর অন্যতম ‘নিউজ’ই হলো পশ্চিমবঙ্গের হাল কত খারাপ হল সেটা জানানো। জানানো আরও বেড়েছে, যখন থেকে ‘মমতা রিজেক্ট রিফর্ম’।
১৩
পশ্চিমবঙ্গ ভালো নেই। সত্যিই ভালো নেই।
এই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ২৯ বছর বয়সী মেহতাব আলম তার ২২ বছর বয়সী বোন নিলোফারকে তলোয়ারের ঘায়ে মুণ্ডচ্ছেদ করে বাজারের মধ্যে দিয়ে এক হাতে তলোয়ার আর অন্য হাতে কাটা মুণ্ড ঝুলিয়ে থানায় আত্মসমর্পন করে। তার বোন নাকি তাদের পরিবারের মর্যাদায় আঘাত দিয়েছে।
বাংলার সজল স্পর্শ আমাদের সহমর্মী করে তোলে না। নাহলে কেমন করে পিংকি প্রামাণিককে দিনের পর দিন অপমানিত হতে হয়। ট্রেনে বাসে আমাদের কথাবার্তায় ‘মজা’ খেলা করে। অথচ খবর খুবই সাধারণ। পিংকি প্রামাণিক নাকি নারী নয়, পুরুষ। টেনিস তারকা মার্টিনা নাভ্রাতিলোভার মতোই ভাবা হতো পিংকি প্রামাণিককে। কিন্তু বিচিত্র এক আলোড়ন উঠল। সূত্রপাত একজন মহিলার অভিযোগ, পিংকি নাকি তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন যৌন সংসর্গে লিপ্ত এবং পিংকি নাকি তাঁকে ধর্ষণ করেছে। ফৌজদারি মামলা।
পিংকি আমাদের বাংলার মেয়ে। বাংলার গর্ব। কেউ এগিয়ে এসে বোঝার চেষ্টা করলেন না। সরকার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চাইলেন না বিশদে। পুলিশ আর মিডিয়ার সকৌতুক মহারণে, পক্ষে বিপক্ষের চমকলাগানো বিজ্ঞাপনী মোড়কে একটি মেয়েকে প্রকাশ্যে সর্বসমক্ষে লাঞ্ছিত হতে দেখলাম। অথচ অর্ধনারীশ্বর, শিখণ্ডীর কনসেপ্ট আমাদের দেশে নতুন নয় বরং বহু পুরোনো। রামায়ণ মহাভারতেও তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মেডিক্যাল বোর্ড পরীক্ষা করে বুঝতে পারে পিংকির শরীরে মেয়েলি চরিত্রের চেয়ে পুরুষালি চরিত্রই বেশি প্রকট। অন্তত গঠনগতভাবে। কিন্তু মানসিকভাবে তিনি ষোলো আনাই নারীসুলভ। সেক্স ক্রোমাজোমের বিন্যাস এক্স-ওয়াইয়ের সঙ্গে ডিএসডি। ডিসঅর্ডার অফ সেক্স ডেভলেপমেন্ট। মানে কোনো লিঙ্গসত্তাই পরিপূর্ণভাবে তৈরি হয়নি। তাই তিনি নারী নন, পুরুষও নন। বলা হল সিইডো-হার্মাফ্রোডাইট। পুরুষালি উভলিঙ্গ। চিকিৎসকদের মতে মানসিক ও সামাজিকভাবে নারীসুলভ হলেও, হরমোন, জিন, জননাঙ্গ-সহ নানা চিহ্নের নিরিখে তাঁর শরীরে আদতে পুরুষের লক্ষণই বেশি। সেক্স বা দৈহিক লিঙ্গসত্তায় পুরুষ। জেন্ডার বা সামাজিক ও আইনী লিঙ্গসত্তায় আদ্যন্ত নারী। দুই লিঙ্গের মাঝামাঝি সত্তার কনসেপ্ট এখন চিকিৎসাশাস্ত্রে স্বীকৃত। উভলিঙ্গ বা মধবর্তী লিঙ্গের মানুষ নেহাতই কম নয়, সংখ্যাটা এদেশে ১ কোটির কাছাকাছি। হয়তো কিছুটা জানতাম বা জানতাম না। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ এমন ছিল না।
এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে ২০১১ সালের ১৩ মে। এই লেখার সময়কাল জানুয়ারি, ২০১৩। এই মাত্র বছর দেড়েক সময়কালে একটি নতুন সরকারের কোনরকম মূল্যায়নই সম্ভব নয়। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে কথা-বিস্তারের উদ্দেশ্যও তা নয়। সময়কালের সমাজ-রাজনীতির পরিসরে ভুবন, ভুবনদের অবস্থানের খোঁজ নেওয়া।
আলিপুরদুয়ারের প্রত্যন্ত একটি এলাকা, ঢেলকাপাড়া থেকে অনাহারে মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে। এলাকার ১৫ জন মানুষ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানিয়েছেন, নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ১৫ জনের মধ্যে ১২ জনের পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই। সকলেই প্রাণ হারিয়েছেন অর্ধাহার-অপুষ্টিতে (আসলে অনাহারেই)। স্বাস্থ্যকর্মীদের দেখা পাওয়া যায়নি। গোটা এলাকাই বিদ্যুৎহীন। সন্ধে নামতেই হানা দেয় হাতির পাল। যাঁরা খানিকটা সমর্থ তাঁরা রেতি নদীতে পাথর ভাঙেন, মজুরি ৫০ টাকা। বিপিএল তালিকায় নাম নেই। এলাকার মানুষ প্রশাসন সম্পর্কে এতটাই বীতশ্রদ্ধ যে ৯ নভেম্বর ২০১২ মাদারিহাটের বিডিও পেম্বা শেরপা তাদের জন্যে মাথাপিছু ১২ কেজি চাল নিয়ে গেলে ঢেকলাপাড়ার বাসিন্দারা তাড়া করেন প্রশাসনের লোকজনদের, এমনকি ওই চাল বিডিও’র গায়েই ছুঁড়ে দেন।
সবার একটাই কথা, হয় পাকাপাকি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করুক প্রশাসন, নাহলে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন গৃহীত হোক। তাঁরা বেঁচে আছেন জংলি কচুর মোথা খেয়ে। গলা চুলকোয় বলে কলার থোড় পুড়িয়ে সেই ছাই মাখিয়ে তারপর কচু সেদ্ধ করে খান।
নভেম্বরের ১৯ তারিখ থেকে ৩০ নভেম্বর অব্দি মালদহ হাসপাতালে ৪৩ জন শিশু মারা গেল।। ১৯ থেকে ২৮ এর মধ্যে যে ৩৫ জন সদ্যোজাতকের মৃত্যু হয়েছিল, তার ২৯ জনই এসেছিল মালদহের বিভিন্ন এলাকা থেকে। ৪ জন ছিল দক্ষিণ দিনাজপুর, ১ জন উত্তর দিনাজপুর ও মাত্র ১ জনই এসেছিল লাগোয়া বিহারের বারসই থেকে। লাগাতার এই শিশুমৃত্যু সরকারকে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে ভাবানোর বদলে, মৃত্যুর দায় এড়াতেই সরকারি আমলারা ব্যস্ত। স্বাস্থ্য দফতরের টাস্ক ফোর্স কোনরকম গাফিলতি বা পরিকাঠামোর অভাবকে মানেনি। এমনকি, হাসপাতাল পরিষেবাকে ভালো বলেই সার্টিফিকেট দিয়েছেন।
প্রমোটরদের বাড়বাড়ন্ত কমেনি। কলকাতায় নিত্য নতুন ‘সাপ্লায়ার’, সাপ্লাই করবে ইঁট চুন বালি রড টাইলস। এদের কাছ থেকে ছাড়া অন্য কারুর কাছ থেকে বাড়ি থেকে রাস্তাঘাট তৈরির কোন মেটিরিয়ালই কেনা যাবে না। এক এক এলাকা এক এক জনের দখলে। একজনের বেশি হলেই মারামারি খুনোখুনি। প্রত্যেকেরই দাদা আছে।
গত ৯ মাস ধরে নোনাডাঙা বস্তির বাসিন্দারা তাঁদের দাবিদাওয়া জানিয়ে আসছেন। সরকার তার নিজের অবস্থান পরিষ্কারভাবে জানাচ্ছে না। ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন নোনাডাঙায় গেলে তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী সমর্থকেরা তাদের আক্রমণ করে। পুলিশে অভিযোগ জানাতে গেলে বলা হয়, এটা আক্রমণ নয়, জনরোষ। ২০ তারিখে কলেজ স্ট্রিট থেকে প্রতিবাদ মিছিল বের হতে দেয় না কলকাতা পুলিশ।
চিট ফান্ড সংস্থাগুলি বেশ কিছু বছর ধরেই এই রাজ্য থেকে টাকা সংগ্রহ করছে। এদের কার্যকলাপ ধোঁয়াশা। টাকা সংগ্রহের ‘এজেন্ট’, বেশিরভাগই কর্মক্ষম বেকার ভ্যাগ্যান্বেষী মধ্যবিত্ত ঘরের যুবক। অন্য ঘর তো বটেই, নিজের বাড়ির বাবা, কাকা, মা, মাসীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড বা অন্য কোন গচ্ছিত/জমানো টাকাও ফান্ডের ঘরে তুলে দিচ্ছে। আকর্ষণীয় রিটার্নেই আমানতকারীরা টাকা জমা রাখছেন, সবসময় তা নয়। চেনা ছেলেটি, ঘরের ছেলেটির একটা হিল্লে হয়ে গেল ভেবেও তারা আশ্বস্ত হচ্ছেন।
আমরা সাধারণভাবে এই সব নিত্যদিন গজিয়ে ওঠা সংস্থাগুলিকে চিট ফান্ড বলি বটে, বলা ভাল এই সব সংস্থাগুলো ‘মানি মার্কেট’এর কাজ করে। কোথাও একটা আইনী স্বীকৃতি থাকে একেবারে গোড়ায়, তারপর সে দ্রুত সেসব পার হয়ে যায় সমাজের নানান স্তরে প্রভাব খাটিয়ে। এইভাবেই একদিন গজিয়ে উঠেছিল ‘সঞ্চয়িতা’র মতো সব সংস্থা। প্রকাশিত হয়েছিল খবরের কাগজ ‘ওভারল্যান্ড’ ইত্যাদি। সাতের দশকের ঘটনা সব। একা ‘সঞ্চয়িতা’ই কত মানুষকে পথে বসিয়েছিল তা শেষ অব্দি জানা যায়নি, কেননা সঞ্চয়িতার মালিকের মৃত্যু ‘রহস্যজনক’। জানা সম্ভব হয়নি কারা প্রভাব খাটিয়ে সঞ্চয়িতার রমরমা ব্যবসা নিশ্চিত করেছিল।
এই দশকে এখন সঞ্চয়িতা শয়ের গুণিতকে। আমানতকারীদের আমানত নিশ্চিত করতে এখনও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। চিট ফান্ড ও মানি সার্কুলেশন প্রকল্পের ওপর কেন্দ্রীয় সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, ১৯৭৮ সালেই। পূর্বতন বাম সরকার আমানতকারীদের সুরক্ষা বিল বিধান সভায় পাশ করে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। ২০১০-১১ সালে, ঠিক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে এই ধরনের সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে বিশেষ অর্থনৈতিক দুর্নীতি দমন শাখা ও রাজ্য পুলিশকে দিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। বিষ গাছ ছেয়ে গেল রাজ্য জুড়ে। সরকার কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি এখনও।
অভিযোগ উঠেছে কলকাতা শহরে জল নিকাশী ব্যবস্থায় খরচপত্রের হিসাবে গোলমাল নিয়েই শুধু নয়, নিম্নমানের নির্মাণ মশলা ব্যবহার নিয়ে। দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে কলকাতা পুরসভা এলাকার, রাস্তা ও পার্কে সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্প ও ত্রিফলা বাতির বরাত দেওয়া হয়েছে টেন্ডার না ডেকেই।
পুরসভার এই বেনিয়মি কার্যকলাপ নিয়ে অবশ্য বিরোধী দলের তেমন কোন জোরালো প্রতিবাদ চোখে পড়ল না। পড়ল না, কারণ সিএজি রিপোর্ট একই দুর্নীতির কথা বলেছে পূর্ববর্তী বাম পুরসভা নিয়ে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাম পুরবোর্ড, বস্তিবাসীদের গৃহ নির্মাণ প্রকল্পে বরাত দিয়েছিল টেন্ডার না ডেকেই। টেন্ডার ছাড়া দুটি সংস্থাকে ৭৮ কোটি ৯৪ লক্ষ টাকা কাজের বরাত দেওয়া হয়েছে। ২০০৮ সালের গোড়ায় ম্যাকিনটশ বার্নকে নিয়ম ভেঙে ১১ কোটি টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছে। আগের বাম আমলে কলকাতা পুরসভার গড়িয়াহাট ট্রেজারির কোটি কোটি টাকা তছরুপের এখনও হদিশ হয়নি। তখন জানা গিয়েছিল পুরসভার নানা ট্রেজারিতে পুরকর সংগ্রহে যে কমপিউটার ব্যবহার করা হতো, তার প্রোগাম সফটওয়ার এমন ছিল যে, যে কোন অপারেটর পুরকর আদায়ের প্রমাণ লোপ করে দিতে পারে। বেসরকারি এই সব অপারেটরদের নিয়োগ করেছিল কলকাতা পুরসভাই।
১৪
১৪ আগস্ট ২০১২ বিধানসভার ৭৫ বছর পুর্তি উপলক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘আজকাল টাকা দিয়ে রায় কেনা যায়’। আদালত অবমাননার অভিযোগ ওঠে।
আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, কলকাতা পৌরসভার প্রাক্তন মেয়র ও আইনজীবী। বিচারকেরা এই মামলায় রায় দেওয়ার আগে বিকাশরঞ্জনকে বলেছিলেন, ‘সাধারণ মানুষের বিচারবিভাগের ওপর আস্থা অনেক দিন আগেই হারিয়ে গিয়েছে। যেখানে মানুষকে বিচার পেতে ২০ থেকে ২৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়, সেখানে আস্থা থাকে না।’ বিকাশরঞ্জন তাঁর দায়ের করা অভিযোগের যথার্থতা নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন, ‘আজ যদি মমতার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে বিচারব্যবস্থার ওপর সর্বত্র আক্রমণ শুরু হবে।’
বিকাশরঞ্জন আইন অবমাননার অভিযোগ এনেছিলেন নিশ্চয়ই ন্যায়-নীতির জন্য, ব্যক্তিগত কোনও স্বার্থে নয়। অথচ এই একই আইনজীবী, বিমান বসু যখন একজন বিচারপতির নামের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে পদো পদ্যে স্লোগান বেঁধেছিলেন, “অমিতাভ লালা, বাংলা ছেড়ে পালা”, সেটিকে সমর্থন করেছিলেন। আদালতে বিমান বসুর হয়ে সওয়াল করেছিলেন।
প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান মার্কণ্ডেয় কাটজু ২৫ নভেম্বর ২০১২ বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ধৈর্য নেই। উনি অন্যের কথা শুনতে রাজি নন। কিন্তু সমালোচনা শুনতে না পারলে রাজনীতিতে থাকা উচিত নয়। কারণ মানুষের সমালোচনা করার অধিকার আছে। মানুষের সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকারের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর কোনো শ্রদ্ধা নেই। কথাটা তেমন কোনো বেঠিক নয়।
মার্কণ্ডেয় কাটজু খেয়াল করেননি মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও অন্য মতামত ও ব্যক্তির প্রতি অশ্রদ্ধার এক উগ্র প্রকাশ বয়ে চলেছে। অনেকটাই একপেশে এবং সবরকমের ভদ্রসীমা অতিক্রম করেছে।
মেধা পাটকারদের সম্পর্কে বিনয় কোঙার বলেছিলেন, “ওরা নন্দীগ্রামে গেলে মহিলারা ওদের পাছা দেখাবে।” বিমান বসু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবর্তনের শ্লোগান নিয়ে বলেছিলেন, “মাথায় পরিবর্তন, পাছায় পরিবর্তন।” হুগলির বড় নেতা অনিল বসু বলেছিলেন, “সোনাগাছিতে যে-সব মেয়েরা থাকে, তাদের ঘরে যখন পয়সাওয়ালা বাবুরা বসে, তখন তারা ছোট বাবুদের দিকে তাকিয়েও দেখে না। মমতার বড় বাবু জুটে গেছে, ও এখন আমেরিকার টাকা পায়। চেন্নাই বাঙ্গালোরের টাকা নেবে কেন?” মেদিনীপুরের নেতা সুশান্ত ঘোষ বলেছিলেন, “উনি তো বিয়ে করেননি, সিঁদুর পরেন না। তাই লাল রঙ দেখলে ওঁর সহ্য হয় না।”
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন অসৌজন্য প্রকাশ না করলেও তিনি তাঁর মতামতের বিরোধীদের ক্রমাগতই ‘ইগনোর’ করে চলেছেন। অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে চলেছেন। এও ক্ষমতার ভাষা। ঔদ্ধত্যের ভাষা। বিরোধী মতকে মর্যাদা না দিলে, মর্যাদা পাওয়া যায় না। শ্রদ্ধা করেই শ্রদ্ধা পেতে হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সম্ভ্রম এখনও আদায় করতে পারেননি। সেটা ওনার ব্যর্থতা না বিরোধী রাজনীতির প্রকৃত মুখ ও সহবৎ তা হয়তো বলবে আগামী দিন। গত ২৬ ডিসেম্বর ২০১২ উত্তর দিনাজপুরের ইটাহার হাইস্কুলের মাঠে কৃষক সভার সম্মেলনে আনিসুর রহমান আবারও বললেন, “আমার দিদিমণি মেয়ে পেলেই নিয়ে গিয়ে রাইটার্সে বলে ধর্ষিতা হয়েছে। আমরা ঠাট্টা করে বলেছিলাম, এইসব হেলাফেলা মেয়ে দিয়ে হবে না। ভালো মেয়ে খোঁজেন। আপনার থেকে ভালো মেয়ে তো নাই। আপনি যদি একবার বলতে পারেন যে আপনাকেও ধর্ষণ করেছে, তা হলে আপনার ভোটটা পার হয়ে যাবে।”
ভারতীয় রাজনীতিতে পাঁচজন মহিলা দাপটের সঙ্গে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন। সনিয়া গান্ধী, জে জয়ললিতা, মায়াবতী, সুষমা স্বরাজ ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সনিয়া গান্ধী রাজনৈতিক ক্ষমতার উত্তরাধিকারী হয়েছেন পরিবারতন্ত্রের সুবাদে। যেমন এই উপমহাদেশে ক্ষমতায় এসেছেন শ্রীলংকায় সিরিমাভো বন্দরনায়েক, পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টো, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া। জে জয়ললিতার উত্থান এম জি রামচন্দ্রের সাহচর্যে ও প্রশ্রয়ে। কাঁসিরাম পাশে না থাকলে মায়াবতী বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রীপদে আসতে পারতেন না। সুষমা স্বরাজ সে অর্থে পরিবারতন্ত্রের প্রশ্রয় না পেলেও, পরিবারের আর্থ-সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তির সুযোগ পেয়েছেন প্রভূত। ব্যতিক্রম একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একটি অতি দরিদ্র পরিবারের ফার্স্ট জেনারেশন পলিটিসিয়ান শ্রীমতী বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রেস সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সোমেন মিত্রের কাছে হেরে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসেন। প্রায় একক কৃতিত্বে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করে সিপিআই (এম) দলকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
তাই তিনি বরাবরই পুরুষতন্ত্রের অঘোষিত রক্ষক বিমান বসু, অনিল বসু, সুশান্ত ঘোষ, মহম্মদ সেলিম, আনিসুর রহমানদের আক্রমণের নিশানা হয়ে যান এবং সেই আক্রমণ যা একজন মহিলার দিকেই ছুঁড়ে দেওয়া যায়। তাই আনিসুর রহমান ক্ষমা চেয়েও তার পরদিনই আরও কুরুচিকর মন্তব্য করেন, অনায়াস ভঙ্গিতে। মমতা যে একজন নারী। তার বিরুদ্ধে যেমন খুশি মন্তব্য করার অধিকার আছে ‘পুরুষ’ আনিসুর রহমানের। সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দী প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, মমতা যেভাবে সাবঅলটার্ন মানুষের কাছে পৌঁছেছেন, তা তথাকথিত ভদ্রলোক রাজনীতিকরা কল্পনাও করতে পারেন না। সেটাই ওদের গাত্রদাহের কারণ। এটা একধরনের মানসিক বিকৃতি।
তবে যেসময় কাটজু নাগরিক অধিকারের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর কোনো শ্রদ্ধা নেই বলে অভিযোগটি এনেছিলেন, সেটা হচ্ছে সেই সময়, যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস জমি বিল, পেনশন বিলের বিরোধিতা করার পর মাল্টি ব্র্যান্ড খুচরো ব্যবসায় ৫১ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত বিরোধিতায় ইউপিএ পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিল। সময়ের এই হিসাবটি মনে রাখলে মার্কণ্ডেয় কাটজু যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করবেন না, এটাই স্বাভাবিক।
১৫
১৯৭৭ পূর্ববর্তী সরকারি ক্ষমতা (যুক্তফ্রন্ট পরিচালিত সময়কালটি বাদ দিয়ে) ছিল মূলত আমলাতন্ত্রনির্ভর। বামফ্রন্টের সময় মধ্যবিত্ত শ্রেণি সরকারি ক্ষমতার অংশীদার হয়ে যায়। প্রথম দিকে ট্রেড ইউনিয়ন বা কৃষক সংগঠন থেকে উঠে আসা মানুষজনের পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছুটা গুরুত্ব থাকলেও, পরবর্তীকালে এইসব সংগঠনের নেতৃত্বেও মধ্যবিত্ত মানুষজনের প্রভাব চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এমনকি মধ্যবিত্ত মানুষজনই রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বে থাকায়, আমলাতন্ত্রের সঙ্গে এক ‘সম্প্রদায়গত’ যোগসূত্র স্থাপিত হয়। সরকারি প্রশাসন নির্ভরশীল হয়ে যায় ‘পার্টি’র ওপর। ক্ষমতায় ‘অবদমন করার শক্তি’র আস্বাদ পায় মধ্যবিত্ত সুযোগসন্ধানীরা। প্রচারে প্রচারে সরকার, ‘আমাদের সরকার’। অন্যদিকে সরকারি রাজনৈতিক পার্টি ক্রমাগতই বিচ্ছিন্ন হতে থাকে সাধারণ মানুষের থেকে। সরকারি সিদ্ধান্ত সে প্রথমদিকে মানলেও, সময় যত পার হয়, তার উপলব্ধিতে আসে এই সরকার ‘ওদের সরকার’।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে তৈরি হল এক অসীম প্রত্যাশা। মধ্যবিত্ত মানুষজনের মধ্যে যাঁরা মেনে নিতে পারছিলেন না, আগেকার সরকারের ঔদ্ধত্য আর স্বজন পোষণের দুর্নীতি, মেনে নিতে পারছিলেন না সরকারি পার্টির অনৈতিকতা, তাঁরাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে তাঁদের ‘নিজ নিজ’ প্রতিবাদের এক প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেন। এগিয়ে এলেন, পাশে দাঁড়ালেন আন্দোলনের, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বকে মর্যাদা দিলেন।
কংগ্রেস জনবিচ্ছিন্ন, অথচ তার একটি রাজনৈতিক ভিত বরাবরই রয়ে গিয়েছে বাংলার মাটিতে, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করলেন, সব প্রতিবাদ-আন্দোলনই তাকে ঘিরেই সংঘবদ্ধ হতে থাকে। এছাড়াও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যবিত্ত এলিটিস্ট ঘরানার মানুষ ছিলেন না বলে, ‘প্রান্তিক’ মানুষজন অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন তাঁর কাছে নিজেদের অভাব-অভিযোগ মেলে ধরতে।
শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস-ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের জোট সরকার ক্ষমতায় আসে ২০১১ সালের ১৩ মে। ৩৪ বছর ধরে জমতে থাকা ক্ষোভ একসময় প্রতিফলিত হল নির্বাচনে। পরাস্ত হয় মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত ‘বামফ্রন্ট’।
তৈরি হয়েছিল এক বিরাট উদ্দীপনা। সবাইয়েরই প্রত্যাশা ছিল। সবসময় অর্থনৈতিক প্রত্যাশা নয়, মুক্তি চেয়েছিল তারা নিজস্ব বিপন্নতা থেকে। ফলে এক আকাশছোঁয়া বিশ্বাস ছিল প্রাপ্তির। আশ্চর্য এই চাওয়া।
সরকার আমাদের সব ইচ্ছাপূরণ করবে এমন চাওয়া ১৯৭৭ সালেও ছিল না। চাওয়া মোটামুটি সীমাবদ্ধ ছিল ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরতান্ত্রিক অপশাসনের অবসান বা রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির মতো প্রসঙ্গে। ১৯৭৭ থেকে ২০১১- এই ৩৪ বছরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমনকি সামাজিক চাওয়াগুলোও সরকারের হাতে অর্পিত হল।
ভিন্ন ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যাশা। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাঁরা যুদ্ধঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন জেলে বন্দী তাঁদের কমরেডরা মুক্তি পাবেন। রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে তাঁরা বহুদিন ধরেই ছিলেন সরব। তাঁরা সরব ছিলেন জঙ্গলমহল ও অন্যত্র মাওবাদীদের দমনপীড়নের জন্যে নিয়োজিত আধাসামরিক যৌথ বাহিনী প্রত্যাহারের দাবিতে। তৃণমূল কংগ্রেসও প্রায় সেরকমই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
হয়নি। জঙ্গলমহল ও দার্জিলিং জেলার চরম অব্যবস্থার বেশ কিছুটা সুরাহা হলেও সন্ত্রাস বিরোধী কালা কানুন প্রত্যাহার ও বন্দীমুক্তির দাবি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, গণতন্ত্রের কথা বাস্তবে উপেক্ষিত
বহু মানুষ এই আশায় এই সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন যে সরকার পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত মানুষজন, অনেক অনেক মানুষের ভাবনা একত্রিত করার কথা ভাববে। সরকার পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের বক্তব্যে আসবে স্বচ্ছতা। সরকার পরিচালনায় বেশিসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত হবে। সরকার পরিচালনায় তার অবস্থান হবে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিনিধিত্বমূলক নয়।
হয়নি। বরং অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গচিত্র আপলোড করার দায়ে পুলিশি হয়রানির মুখে পড়লেন, এমনকি গ্রেপ্তারও হলেন। জনসভায় প্রশ্ন করার দায়েই গ্রেপ্তার হলেন যুবক। ধর্ষিত মহিলার প্রতিবাদ উপেক্ষিতই শুধু নয়, নতুন করে লাঞ্ছিত হন তিনি শাসকের বিদ্রুপ আর সন্দেহে। এমনকি ধর্ষিতা বোনের অভিযোগ পুলিশকে নিতে বাধ্য করাতে ভাইকে থানার সামনেই সারা গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করতে হয়। তবু ঘুম ভাঙে না পুলিশ প্রশাসনের।
বিশ্বাস ছিল বন্ধ রুগ্ন কারখানার জমিতে আবার শিল্পকর্মোদ্যোগ দেখা দেবে। রাজ্যে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে কমবেশি ৫০০টি বড় ও মাঝারি, বন্ধ ও রুগ্ন কারখানার জমির পরিমাণ প্রায় ৪১,০৭৮ একর। ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানুফ্যাকচারিং এবং বৃহৎ শিল্পের অনুসারী শিল্প গড়ে তোলা যেতে পারত এখানে। হয়নি। বাধার কারণ আইনী হতে পারে, শিল্পে ভাটার টানও হতে পারে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি হল রুগ্ন ও বন্ধ কারখানার জমিতে শিল্প গড়ে তোলায় গুরুত্ব না দেওয়া।
সরকারি সহায়ক মূল্যে পাট, ধান কেনার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, অভাব নাকি টাকার। সবজি মান্ডি তৈরির কাজ অসম্পূর্ণ। কোথাও কোথাও সবজি মান্ডির গৃহ তৈরি হয়ে গেলেও, কে কিনবে, কী দরে কিনবে, কীভাবে ঠিক হবে বাজার দর সবই এখনও অনিশ্চিত।
জল সংরক্ষণের একটা চেষ্টা চলছে। কিন্তু কর্মসংস্কৃতি এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে গ্রামাঞ্চলের পুকুর সংস্কার, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্যত কাগজে কলমেই। তবু শোনা যাচ্ছে হাজার কুড়ি পুকুর কাটা হয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি উন্নত করার চেয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে আরএসভিওয়াই প্রকল্পে স্বাস্থ্যবীমা করিয়ে দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার। ২৫-৩০ হাজার টাকার স্বাস্থ্যবীমার বেশিরভাগটাই লুঠপাট করে নিচ্ছে নার্সিং হোম। সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণই নেই। দলীয় রাজনীতির প্রাধান্য প্রকট।
দুর্নীতি, স্বজনপোষণ অব্যাহত। সরকারি চাকুরি নেই। তৃণমূল কর্মীদের ‘তোলা’ তোলা শুরু হয়ে গেল শুধু টিঁকে থাকতেই। কেন্দ্রিকতা না থাকায় একই এলাকায় বহু ‘দাদা’। সিপিআই (এম) দখলীকৃত জমিতে, সে প্রমোটরি হোক বা কারখানা হোক কিংবা বাজার বা শুধুই একটি দোকান, সবজায়গাতেই নতুন দখলদার এল। পুরাতন দখলদার রঙ বদলাল বা সমঝোতায় এল। আরেকটি সাম্প্রদায়িক বিভাজন এল– নতুন সাইনবোর্ডে পুরাতন দখলদার বনাম নতুন সাইনবোর্ডে নতুন দখলদার।
এমনকি যেসব কারখানায়, ক্যাজুয়াল শ্রমিকেরা কাজ করছিলেন, তাঁরা সিপিআই (এম) সমর্থক হওয়ায়, তাঁদের ছাঁটাই করে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সে পার্টির সমর্থকদের নিয়োগ করার চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। মেজিয়ার শোভা ইস্পাত এবং দুর্গাপুরের কারখানাগুলিতে এই নিয়ে শ্রমিকে শ্রমিকে তীব্র অশান্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
এসব অবশ্য নতুন নয়। কিন্তু বামফ্রন্টের শৃঙ্খলিত পার্টি কাঠামোয় সাধারণভাবে কেউ কারোর এলাকায় মাথা গলাতো না বলে এবং গোলমাল হলে পার্টির উচ্চতম কমিটির নির্দেশ মেনে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় বাইরে এই ‘মুখ’ সহজে ধরা পড়ত না। এবার সবকিছুই প্রকাশ্যে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। ক্যাওস, ডিসঅর্ডার।
বিগত ৩ দশক ধরে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক কর্মবিমুখ, নিজস্ব ঘর গোছানো মানসিকতা। সরকারের প্রজেক্ট রূপায়িত করাই হয়ে গেছে ‘স্বনির্ভরতা, স্বাবলম্বিতা’। কথা হয়েছে অনেক, রাজ্য হয়েছে নিঃস্ব। ঘি যেটুকু জুটেছে সবই ঋণ করে। কাগজ কলম পরিসংখ্যানে নির্মিত হয়েছে এক বাংলা। বাস্তব নয়, কল্পবাস্তবতার আঁধারে ঘেরা অথর্ব এক রাজ্য। সেই অভ্যাসই আয়ত্ত করল বর্তমান সরকার।
সেই সঙ্গে শুরু হল, কেন্দ্রের সঙ্গে নীতিগত বিরোধ ও সংঘাত। সংঘাতের সম্ভাবনা অনেক জায়গায়। যেমন ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে ক্যাবিনেট কমিটি অন ইকনমিক অ্যাফেয়ার্স বিদ্যুৎ সংস্কার বিল এনেছে। সেখানে বলা হচ্ছে আর্থিক সংকটে দীর্ণ প্রত্যেক রাজ্য সরকারকেই বাধ্যতামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্টন-সরবরাহের মধ্যেকার ব্যালেন্সের ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। প্রতি বছর ১ এপ্রিল থেকে ট্যারিফ সংশোধন করতে হবে।
ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড রেগুলেশন রুলস গোটা দেশে চালু হতে চলেছে। বলা হয়েছে মিষ্টি বানানোর জন্যে লোহার কড়াই, কাঠের খুন্তি ব্যবহার করা যাবে না। ব্যবহার করতে হবে স্টেনলেস স্টিলের কড়াই খুন্তি, ছানা মাখতে হবে যন্ত্রে, দোকানের বার্ষিক লেনদেন ১২ লক্ষ টাকার ওপরে হলেই মাইক্রো-বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরি বানাতে হবে, ছানার সঙ্গে চালের গুঁড়ো, ময়দা, অ্যারারুট, নলেন গুড় মেশানো চলবে না। এই আইন চালু হলে বাংলার মিষ্টির বৈচিত্র্য যাবে হারিয়ে। কর্মচ্যূত হবেন অনেক মানুষ। ক্যাওস, ডিসঅর্ডার।
তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা জানাল, তারা এখানে ব্যবসায় আগ্রহী, কিন্তু তাদের ‘এসইজেড’-এর সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। সরকার জানাল, তারা কর্মসংস্থানের জন্য সবরকমের সুবিধা দিতে প্রস্তুত, কিন্তু ‘এসইজেড’ নয়। ক্যাওস, ডিসঅর্ডার।
সমস্যা অন্যত্রও। ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ভোগ দাবি করায় সাধ আর সামর্থ্যের মধ্যে তফাৎ ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সাংগঠনিক পরিবারবোধ ভেঙে যাচ্ছে। সকলের কল্যাণ এবং সর্বসাধারণের সুখের চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বৃদ্ধি এবং সুবিধা ভোগ করার দাবি যখন বড় হয়ে উঠছে, তখন সমস্ত সৃষ্টিশীলতার মূল যে সামঞ্জস্যবন্ধন, সেই বন্ধনটাই ভেঙে পড়ছে। শুধু পৃথকই নয়, একে ওপরের শত্রু হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
পার্টি ও ক্যাডার যখন কেবলমাত্র নিজেদেরকেই জনমানুষের প্রতিনিধি ভাবে, নিজেদের চশমা দিয়েই সবটা দেখে, মানুষের চাওয়া ও না-পাওয়ার সন্ধান রাখে না, সে তখন মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং যতই বিচ্ছিন্ন হতে থাকে, ততই সে তার দৈহিক শক্তি পরাক্রম দিয়ে অন্যদের অবদমিত করার চেষ্টা করতে থাকে। বিঘ্নিত হচ্ছে আমাদের নিজস্ব ঘেরাটোপের নিরাপত্তা। ক্যাওস, ডিসঅর্ডার।
১৬
ভাবতে হবে নিশ্চয়ই অন্য কোনো পথের কথা। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সৃষ্টির আনন্দই যেখানে প্রধান। প্রচলিত ধর্মতত্ত্ব ধ্বসে পড়ছে। ফাটল ধরেছে রাজনৈতিক তত্ত্বে।
রাজনৈতিক দল বলতে তো দুটো, একটি ক্ষমতাধিকারী দল এবং একটি ক্ষমতাভিলাষী দল। উভয়ই ক্ষমতাপ্রেমী। ক্ষমতাপ্রেমী দল দিয়ে রাজশক্তিকে সংযত ও শুদ্ধ করা যায় না। সত্যাগ্রহ আন্দোলন এই সময়ের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক চেতনা হয়ে উঠতে পারে। জনজাগরণের চেতনা। ক্ষমতা দখলের জন্য নয়, শাসককে বাধ্য করা সংযত হতে, ক্ষমতাসীন শাসকের কাছে হাত পাতা না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চর্চায় মান্যতা দিতে হবে মানুষের বোধ, প্রয়োজন, পরিপার্শ্ব ও প্রেক্ষিতকে।
শাস্ত্রীয় বিচার, তত্ত্ব, তর্ক, বিজ্ঞান সবই অসার, যদি সেসব নৈতিকতা বর্জিত হয়, সমগ্র মানব সমাজের কল্যাণে না আসে। ৮০ শতাংশ মানুষকে প্রান্তিক, উদ্বৃত্ত করে সমাজ গঠন হয় না।
অন্যদিকে, আমরা যাদের বিশেষজ্ঞ বৈজ্ঞানিক হিসাবে মর্যাদা দিয়েছি তারা মানুষ, প্রকৃতি, সমাজ আর প্রেক্ষিত থেকে সরে গিয়ে নিজস্ব গণ্ডীতে চর্চারত। জ্ঞান খণ্ডিত হতে হতে হাজারে হাজারে বিভক্তি ঘটিয়ে প্রকৃত অর্থে প্রজ্ঞাহীন আজ। জীবন আর জ্ঞানে বহু ফারাক। বিশেষজ্ঞদের জ্ঞানের ভয়াবহ প্রকাশে সাধারণ মানুষ অসহায়। অজ্ঞ ভাবছেন নিজেদের। প্রতিদিন নতুন নতুন বিশ্বাস আর পুরাতন সংস্কার নতুন করে গেড়ে বসছে অজ্ঞানতার মাঝে। বাধ্য হচ্ছেন ‘না বোঝা বিজ্ঞান’ অথবা ‘শাস্ত্রীয় পুরোহিতদের কাছে আত্মসমর্পণে।
তথ্য পরিসংখ্যান নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয়। একই সঙ্গে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য। উপাত্ত জুড়ে জুড়ে জ্ঞাপনে, জ্ঞাপন জুড়ে জুড়ে জ্ঞানে পৌঁছতে প্রয়োজন হয় বোধের। এই বোধ সবটাই মেধা বা পাণ্ডিত্যের ফসল নয়, বোধ আসে সমগ্রের প্রেক্ষিতে নিজেকে দেখার মধ্য দিয়ে, নিজেকে চেনা ও আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে, স্বাধীনতার স্বরূপ সন্ধানের মধ্য দিয়ে, ইমানসিপেশন অফ আইয়ের মধ্য দিয়ে, আইকে শুধুমাত্র ‘মাই’ মানে ‘আমার’ মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা নয়। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর কথায়, ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় দ্য মিনিং অফ দ্য ওয়ার্ড আই ইজ অল ইনহেরিটেড ইন দ্য কনসেপ্ট অফ দ্য ওয়ার্ড মাই। ‘চতুরতা’ দিয়ে আর কতটুকু আড়াল করা যায়! নীতিহীনতা তেজষ্ক্রিয় দূষণের মতোই মারাত্মক।
প্রয়োজন জোয়াল থেকে মুক্তি। এই জোয়াল, সবকিছুর দাসত্বের জোয়াল থেকে মুক্তি। বলপূর্বক অধীনতায় রাখে এমন সবকিছু থেকে মুক্তি। চিন্তার অধীনতা থেকে মুক্তি। সবার সঙ্গে সবার সুর মিলিয়েই মুক্তি। আপনা আপনি নয়। অর্জন করতে হবে সে মুক্তি।
আমাদের দেশ আমাদের। আমাদেরই।
আমার দেশজ চিন্তায়, দেশ আমার মা।
জল বা নদী কেন মা? পৃথিবী যে কারণে মা। তিনি বুক জুড়ে, বুক খুঁড়ে শস্য বৃক্ষ অরণ্য ধারণ করে আমাদের পালন করে চলেছেন, তাঁকে মা বলে মানতেই হয়। শুধু অত্রি নয়, আমরা সবাই ভৌম, ভূমি পুত্র, ভূমি-মাতৃক, ভুঁইয়া। এবং সেই সঙ্গে নদীমাতৃক।
আমাদের সংস্কৃতিতেও দেখি এক সহজতা, সরলতা, নবীনতা, মহাশৈশব। চেতনার নিম্নতম থেকে তুঙ্গতম স্তর পর্যন্ত, বিহারিণী বাণীরা হল ‘অবসনা অনগ্নাঃ’, তারা বসন পরেনি, কিন্তু তাই বলে তারা নগ্নও নয়। তাদের ঢাকাঢুকিও নেই, খোলাখুলিও নেই। তারা নিরাবরণ— তাই বলে নিরাভরণ নয়।
সত্যের স্বচ্ছ দুরন্ত দামাল স্রোতধারা। আমাদের কবি একেবারে প্রাকৃত ভাষায় বলে ওঠেন,
কোন হিসাবে হর-হৃদে
দাঁড়িয়েছ মা পদ দিয়ে
আবার সাধ করে জিভ বাড়ায়েছো
যেন কত ন্যাকা মেয়ে।
জেনেছি জেনেছি তারা
তারা কি তোর এমনি ধারা
তোর মা কি তোর বাপের বুকে
দাঁড়িয়েছিল এমনি করে।
অনুভূতি যতই গভীরে যাচ্ছে, যত অন্তরঙ্গ হচ্ছে, বাকও ততই অবচেতনায় প্রবেশ করছে, টেনে টেনে বের করে আনছে গোপন সব শব্দ, তাদের লজ্জা-কলুষ-গ্লানি ঘুচিয়ে তাদের আলোকিত রূপটিকে ঝলমলিয়ে তুলছে।
এই সাধনাই আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য পরম্পরা।
এই সাধনায় ভুবনেরাই আমাদের আলো দেখান।
পঞ্চদশ শতাব্দীর বাংলাকে নিমাই একবার পথ দেখিয়েছিলেন। নিমাই (জন্মঃ ১৪৮৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি) ঘর থেকে বাহিরপথে টেনে নিয়ে এসেছিলেন কীর্তন। বদলে দিলেন কীর্তনের চরিত্রই। কীর্তনকে পথ সংকীর্তনে পরিণত করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন হরিদাস ও নিত্যানন্দকে। একজন মুসলমান আর অন্যজনা জাতপাত না মানা অবধূত। ভালবাসা দিয়ে জয় করে নিয়েছিলেন নবদ্বীপের দুই ত্রাস জগাই ও মাধাইকে। গড়ে তুলেছিলেন গণ আন্দোলন। মিছিল। একসাথে পথ চলা।
মানুষের মধ্যে বিপুল উত্তেজনা। হাজার হাজার মানুষের ভীড়। মহিলারাও অংশ নিয়েছেন সেই মিছিলে। পথের দুধারে বাড়িতে বাড়িতে প্রদীপ, দরজায় দরজায় কলাগাছ, মাঙ্গলিক ঘট। মিছিল যেন কার্নিভাল।
মিছিলের চেহারা দেখে সেদিন শাসক ভয় পেয়েছিল। চলা। অবিরাম চলা। নদীর মতো চলা। বাঁকে বাঁকে তার দেখা না দেখা। আন্দোলন, আন্দোলন নদীর মতো। নদীর প্রবহমানতার সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির নাড়ীর যোগ।
ভুবনের বাড়ি ডুলুং নদীর ধারে।
তিমির হননে তবু অগ্রসর হয়ে
আমরা কি তিমিরবিলাসী?
আমরা তো তিমিরবিনাশী হতে চাই ।
আমরা তো তিমিরবিনাশী।
(ভুবন খামরুই, মেথর নায়েক আর শ্রীদাম দণ্ডপাট, এই তিন চাঙগানের শিল্পী ‘ভ্রমরা’র সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে এসেছিলেন, লোকগান আসরে চাঙ পরিবেশন করতে। ১৭-১৯ অক্টোবর, ২০১২ পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রে এই অনুষ্ঠানটি হয়। ভুবনদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল, শেষদিন, লোকগান নিয়ে আলোচনা, “আমার লোকগান, আমার ভবিষ্যতে’র দিন, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১২।
কৃতজ্ঞতাঃ
(১) জীবনানন্দ দাশ, তিমিরহননের গান (সাতটি তারার তিমির)
(২) শিবব্রত কর্মকার, ভ্রমরা, ইনস্টিটিউট অফ ফোক কালচার
(৩) সুজিত সিনহা, কালধ্বনি, জানুয়ারি ১৯৯
(৪) মানেসরে শ্রমিক বিক্ষোভ, শিভম ভিজ, অনুবাদঃ পার্থসারথী, পূর্বালোক পাবলিকেশন, কলকাতা।
(৫) স্বাশ্রয়ভাবনা, সম্পাদনাঃ পথিক বসু, ডিসেম্বর, ২০০৫
(৬) গৌরী ধর্মপাল, পুরোনোতুন বেদের কবিতা
জানুয়ারি ২০১৩
(সম্পাদিত)
-রাইত ক’ত হ’ল? উত্তর মেলে না।
- হরপ্রসাদ তুমি !
-না, আমার প্রেতাত্মা।
হেরে গেছি আমি। সর্বস্বান্ত। নড়ি চড়ি আছি। বাজ’য়ে পোড়া তালগাছ।
প্রতিবাদ করেছিলাম। কার প্রতিবাদ! কীসের প্রতিবাদ! একটা দেওয়ালে দড়াম কইরা ধাক্কা খাইয়া,
একটা যাঁতাকলে অন্ধ হইয়া আষ্টেপৃষ্ঠে আটকাইয়া আছি।
কিন্তু হে পলাতক, কাপুরুষ! তুমি না পলাইছিলা। তোমার হেই দশা ক্যান?
দোদুল্যমান হইতে চাও।
আসল কথা কি জান, ভাইটি। ও প্রতিবাদই ক’র আর ল্যাজ গুটাইয়া পলাইয়াই যাও, কিছুতেই কিছু যায় আসে না। সব লোপাট।
আমরা সব নিরালম্ব, বায়ুভূত।
রাইত ক’ত হ’ল? খোঁজ নেবে না?
২
রাত কাটে। আঁধার কাটে না। ভোর আসে। সকাল হয় না। উদ্বাস্তু বাগদি বৌ এক স্টেশন থেকে আর এক স্টেশনে তাড়া খেতে খেতে অজানা এক স্টেশন-প্ল্যাটফর্মে মারা যান। মৃত্যু। অস্বাভাবিক নয়, স্বাভাবিক মৃত্যু। রোগে ভোগে অনাশ্রয়ে অনাহারে। সম্বলহীন এক মানুষ যেভাবে মারা যান সেভাবেই। মৃত্যু শাশ্বত সত্য। অজেয়। অ-বরণীয়ও নয়। বাগদি বৌয়ের এমন মৃত্যু কিন্তু অনভিপ্রেত। বাগদি বৌয়ের ভিটে মাটি শিকড়হীন হয়ে যাপনও অনীপ্সিত।
ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ সিনেমার বাগদি বৌ একদা তার বসত জনপদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চিমবাংলায় চলে আসতে বাধ্য হন, রাজনীতিবিদদের কূটকৌশলের স্বভাবগত খেলায়। তবু সেই উদ্বাস্তু বাগদি বৌয়েরা সঙ্গে পেয়েছিলেন গ্রাম-সমাজের বন্ধু-পরিজন। সম্মিলিত অংশগ্রহণে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন উদ্বাস্তু কলোনি। একক বাগদি বৌয়েরা স্টেশন প্ল্যাটফর্মে যেমন হারিয়ে গেছেন তেমনই সমষ্টি আবার মাথা উঁচু করে পার হয়ে এসেছে বাধা-বিপত্তি। স্মৃতি বিশ্রুত হননি। হারাননি নিজস্ব ভাষা-সম্পদ। এসব অবশ্য পুরোনো দিনের কথা।
নতুন দিনেও বিরামহীন, উদ্বাস্তু হওয়া। ওপার বাংলা থেকে আজও মানুষজনের চলে আসার ছেদ নেই। রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তরের সময় থেকে বিংশ শতাব্দী শেষ হওয়ার সময়কালেই, ভারত জুড়ে কম করে ৪.৩ কোটি একর জমি রাষ্ট্র তার নানান প্রকল্প রূপায়ণে দখল নিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, উচ্ছেদ হয়েছেন অন্তত ৬ কোটি মানুষ। ৪০ শতাংশ আদিবাসী মানুষ, ২০ শতাংশ দলিত আর ২০ শতাংশ অন্যান্য নথিভুক্ত সম্প্রদায়ের মানুষ। মোট ৮০ শতাংশ মানুষই উচ্ছেদ হয়েছেন, জীবিকাচ্যুত হয়েছেন সরকারি সন্ত্রাসে।
অব্যাহত সেই উচ্ছেদ। দেশের খনিজ সম্পদ স্বদেশি বিদেশি কোম্পানিদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। টাটা, মিত্তাল, জিন্দাল, এসার, পস্কো, রিও টিন্টো, বি-এইচ-পি বিলিটন, বেদান্ত এরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে মূলবাসী জনজাতি এলাকায় নানান ধরনের কোম্পানি খুলতে। ইস্পাত, খনি, থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট, বাঁধ, সিমেন্ট কারখানা, কি নয়। উচ্ছেদ হচ্ছেন, উচ্ছেদ হবেন হাজার হাজার মূলবাসী জনজাতির মানুষজন। কয়লা বা পাথর বা বক্সাইট বা লৌহ- ম্যাঙ্গানিজ-কপার-জিঙ্ক আকরিকের খনি কিংবা কারখানা নির্মাণে উচ্ছেদ হয়ে চলেছেন মানুষ লাখের হিসেবে।
কোথায় গেলেন, কোথায় যাচ্ছেন এই সব মানুষজন? এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃষি থেকে, গ্রামীণ শিল্প থেকে জীবিকা হারিয়ে অগণন মানুষের উচ্ছেদ। এলাকা ছেড়ে, উদ্বাস্তু হয়েই বা এঁরা যাবেন কোথায়?
ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই।
ঠাঁই-নাড়া বাগদি বৌয়েরা এখনও মারা যাচ্ছেন তেমনি ভাবেই।
অব্যাহত থেকেছে রাজনীতিবিদদের স্বভাব-কুশলী-কূটনীতি। হারিয়ে গিয়েছে শুধু সম্মিলনের সুখ দুঃখে অংশগ্রহণ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ।
হারিয়ে গিয়েছে গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে, হয়ে ওঠার একরোখামি।
সেসময়ও রাজনীতিবিদ ক্ষমতাশীলদের সমাজ ছিল অনেকটাই সমাজ-বিচ্ছিন্ন। বৃহত্তর সমাজ সংসার থেকে আলাদা। অভিজাতদের মজলিশ আর লোকসংস্কৃতির আসর ছিল স্ব-স্ব ভোক্তায় পূর্ণ। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনেই ছিল যা কিছু বেড়া ভাঙার ডাক। হয়েওছিল। স্বরাজ দাগ কেটেছিল।
আজ বৃহত্তর সমাজ থেকেই সমাজ-রাজনীতির অলিন্দে রাষ্ট্রিক-রাজনীতির প্রতিনিধি নির্বাচন। বৃহত্তর সমাজ থেকে প্রতিনিধি এসেছে দেশ পরিচালনায়। ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্য-সমাজ শক্তিমান হয়েছে। কায়েম হয়েছে নব্য-ব্রাহ্ম-কৌলিন্য। ‘পার্টি কালচার’ মান্যতা পেয়েছে। ‘বাবু সমাজ’ তরঙ্গায়িত হয়েছে।
সেদিন ছিল গরীবের দল বড়লোকদের লেঠেল।
এখন সব দল সবার। সব দলেই গরীব বড়লোক লেঠেল। সব দলেই ‘বাবু’, নামেতে ভিন্ন। বাবুদের ভাষা আলাদা, বাক্যবিন্যাস আলাদা। চারিয়ে যাচ্ছে সে ভাষা। নগরের নাটকে, গানে, টেলিভিশনের কূটতর্কের আড্ডায়, আলোচনায়। রাজনীতির অঙ্গন ছাড়িয়ে সংস্কৃতির দুয়ারে।
৩
ভাষা আলাদা। বাক্যবিন্যাস আলাদা। দল। রাজনৈতিক দল। রাজনীতির ভাষা। সরকার যাঁরা চালান, তাঁরা যে ভাষাতে কথা বলেন। সরকার চালাতে যাঁরা ইচ্ছুক, যাঁরা সরকারি ক্ষমতার প্রতিযোগী তাঁরা যে ভাষাতে কথা বলেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বুদ্ধি-বিচার, সব সবকিছুই নির্ধারণের অধিকারী বলে যাঁরা নিজেদের গণ্য করেন। আধিপত্যের ক্ষমতা। ক্ষমতা ধারণের নয় - অবদমনের। মানুষ থাকবে তাঁদের দাসানুদাস, চির অনুগত। রাষ্ট্র-পরিচালক সরকার এবং তার অনুগত পুলিশ-প্রশাসন ও এমনকি এই রাষ্ট্রটাকে যারা ভাঙতে চান তাঁরাও কমবেশি এই ভাষাতে কথা বলেন।
ক্ষমতা জাহির করার এই ভাষা বিশ্বজগতে অচল। সাধারণ মানুষজন যদি এই ভাষাতেই কথা বলতেন, তাহলে বিশ্বসংসারে টেঁকাই দায় হত। ক্ষমতা থেকে যাঁরা দূরে থাকেন বা আছেন, সেই সব অসংখ্য মানুষ, ক্ষমতার ধারণ করবার শক্তি, ক্ষমতার সদালাপশক্তিতেই তাঁরা বিশ্বাসী। তাঁরা ভালবাসেন সহমর্মিতা, সহযোগিতা। প্রতিদিনের যাপনে অন্য কোনো বিপ্রতীপ বোধে সময় সময় আচ্ছন্ন হলেও আন্তরিকভাবেই দেখতে চান, ‘ক্ষমতা’ মানে কাজ করার শক্তি, আত্মনির্ভরতার শক্তি, সৃজনের শক্তি, ভালবাসার শক্তি, সহিষ্ণুতা, ক্ষমা ও ধারণ করার শক্তি। তাঁরা ভয় পান ক্ষমতার হিংস্রতায়।
হিংস্রতারও একটা ভাষা আছে। সেও একধরনের ‘ক্ষমতা’র ভাষা। “আমাকে মান্যতা দিতে হবে’ এটাই তার প্রথম ও শেষ কথা। ক্রুরতার ভাষা। ‘ক্ষমতা’ এখানে অন্যকে কতখানি অবদমিত রাখা যায় তার প্রতিযোগিতা। রাষ্ট্রের ভাষা।
ব্যক্তিমানুষের মধ্যে যে ‘সেলফ’ থাকে, রাষ্ট্রের তা নেই। রাষ্ট্র হচ্ছে এক প্রাণহীন যন্ত্র। রাষ্ট্র কখনই হিংস্রতা পরিত্যাগ করতে পারে না কারণ তার অস্তিত্বের স্বার্থেই সে হিংস্রতার কাছে ঋণী। তাই বোধহয় ব্যক্তিগত মালিকানার হিংস্রতা রাষ্ট্রের হিংস্রতার চেয়ে কম ক্ষতিকারক।
রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান প্রতিনিধি সরকার। ক্ষমতা সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত। সরকারের শক্তি আজ যত বেড়ে গেছে, মনে হয় আগে সম্রাটের হাতেও সে শক্তি ছিল না। বর্তমান শাসন ব্যবস্থাকে আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলছি। সেই গণতন্ত্রের শেষ কথা যদি এই হয় যে সরকারের ওপরই সব নির্ভর করবে, তাহলে আমরা আরো বিপদেই পড়ব। ভাল করার ক্ষমতাও মাত্র কয়েকজনের হাতে ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
এখন গণতান্ত্রিক অধিকার মানে শুধু সরকার নির্বাচনে সমানাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, নিরপেক্ষ আইন ব্যবস্থা। এর সঙ্গে সামাজিক ন্যায়ের কোন ধারণা যুক্ত নয়। সামাজিক ন্যায়ের জায়গা নিয়েছে বাজারি ন্যায়-ধারণা। অর্থাভাবের কারণে কোন মানুষের মাথার ছাদ বা গায়ের জামা নাই থাকতে পারে। খাদ্য কেনার ক্ষমতা নেই বলে অনাহার অপুষ্টিতে মৃত্যু হতেই পারে। দেনার দায়ে কৃষক আত্মহত্যা করতেই পারে, তবু রাষ্ট্র থাকে নির্লিপ্ত। তার গণতান্ত্রিক চরিত্র কলঙ্কিত হয় না।
আমরা যে গণতন্ত্রের সঙ্গে অভ্যস্ত, সেখানে দেশে বা রাজ্যে এক বা একাধিক দলের কোন একটি জোট ক্ষমতায় থাকে আর থাকে এক বা একাধিক বিরোধী দল বা একাধিক দলের একটি বিরোধী জোট। আমরা ভাবি, বিরোধী দলের ভূমিকা ‘করেকটিভ’। ক্ষমতাসীন দলের কাজকর্মের একটা ‘চেক’। বিরোধী দল যতবেশি শক্তিশালী হবে, গণতন্ত্রের ভিত তত মজবুত হবে। কিন্তু হয় না। সব দলই হয় ক্ষমতাধিকারী অথবা ক্ষমতাভিলাষী, এককথায় ক্ষমতাপ্রেমী। ক্ষমতাপ্রেমী দল দিয়ে রাষ্ট্রশক্তির শুদ্ধিকরণ হয় না। কারণ বিরোধী দলকেও নির্বাচিত হতে হয়। নির্বাচনে সংখ্যাধিক্য লাভ করাই তার লক্ষ্য।
শুদ্ধির ভাবনা না থাকায়, জ্ঞানবুদ্ধির বিচার গৌণ হওয়ায় সংখ্যাবৃদ্ধির জন্যে রাষ্ট্রক্ষমতায় অবাঞ্ছিত লোকের প্রবেশাধিকার অবাধ। প্রতিপক্ষ দলের দোষ বিপক্ষ দলেও সংক্রামিত হয়। শাসকদলের প্রশ্রয় ও নিরাপত্তায় অভ্যস্ত অপরাধীরা দলবদল করে অনায়াস দক্ষতায়। তার মানে বিরোধী দল শক্তিশালী হলে বা ক্ষমতায় এলেই সরকারের শুদ্ধি হবে এই বিচার অপূর্ণ।
অবশ্য একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম দেখা গেল দিল্লিতে। সামান্য কয়েকজন নামহীন, রাজনৈতিক প্রভাবহীন, দলীয় পরিচিতিবিহীন নাগরিক একজোট হয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গড়ে তুলল একটি রাজনৈতিক দল, ‘আম আদমী পার্টি’। সদ্যোজাত এই রাজনৈতিক দল হয়ে উঠল প্রায় একটি রাজনৈতিক মঞ্চ। শুধুমাত্র সততা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতাকে রাজনীতির অ্যাজেন্ডায় ফিরিয়ে এনে প্রায় অসম্ভব এক সম্ভাবনাকে সম্ভব করে তুলল ‘আম আদমী পার্টি’।
দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে কোন দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কংগ্রেস দলটি প্রায় মুছে গিয়েছে। সিপিআই (এম) দল দিল্লিতে ৩টি কেন্দ্রে নির্বাচনে প্রার্থী দিলেও মাত্র ১টি কেন্দ্রে ১০০০টির বেশি ভোট পেয়েছে। একক দল হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে বিজেপি। প্রথমে না চাইলেও কংগ্রেস দলের সমর্থনে দিল্লিতে সরকার গড়েছে ‘আপ’।
সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে, মলিন পোশাকের সমর্থক ও আপ পার্টির নেতা-কর্মীরা অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন, ‘ঘুষ না নেওয়ার, ঘুষ না দেওয়ার’। আমাদের সংসদীয় রাজনীতিতে এই প্রথম।
8
ঘুষ দেবো না, ঘুষ নেবো না। কোনো রাজনৈতিক দলের একেবারেই ব্যতিক্রমী এক প্রয়াস, বিশেষত আমাদের দেশে, দুর্নীতি যেখানে লাগামছাড়া।
মাত্র কয়েকমাস আগে, ওয়েবসাইট কোবরাপোস্টের স্টিং অপারেশনের গোপন ক্যামেরায়, বিভিন্ন দলের ১১ জন সাংসদকে অনৈতিক অর্থনৈতিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা গেছে। এআইডিএমকে’র ২ জন, বিজেপি’র ৩ জন, জেডিইউ’র ৩ জন, কংগ্রেসের ২ জন ও বিএসপি’র ১ জন। একটি ভুয়ো অস্ট্রেলীয় তেল সংস্থার আধিকারিক সেজে সাংসদদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন কোবরাপোস্টের সাংবাদিক। উত্তর-পূর্ব ভারতে তেল উত্তোলনের বরাত পেতে এই ভুয়ো বিদেশি সংস্থাকে সুপারিশপত্র লিখে দিতে রাজি হয়েছিলেন এঁরা। সুপারিশপত্রের মূল্য ৫০ হাজার থেকে ৫০ লক্ষ টাকা। ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ নিয়ে ৬ জন সাংসদ চিঠি লিখেও দিয়েছিলেন।
চলতি লোকসভার ৫৪৩ জন এমপি-র মধ্যে ১৬২ জন বা ৩০ শতাংশের বিরুদ্ধে, রাজ্যসভার ২৩০ জন এমপি-র মধ্যে ৪০ জন বা ১৭ শতাংশের বিরুদ্ধে, রাজ্য বিধানসভাগুলোর ৪০৩২ জন বিধায়কের মধ্যে ১২৫৮ জন বা ৩১ শতাংশের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক মামলা আছে। দুর্নীতির অভিযোগ প্রায় সব শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। হয় তদন্ত চলছে বা আদালতে অভিযোগও দায়ের করা হয়ে গিয়েছে।
রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আগে থেকে সমঝোতা করে, সাধারণ শেয়ার হোল্ডারদের প্রতারিত করে কোম্পানির শেয়ারের দাম নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসা (ইনসাইড ট্রেডিং)। রিলায়েন্স পেট্রোলিয়ামের সঙ্গে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের সংযুক্তিকরণের সময় এটি ঘটেছিল। বর্তমানে শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ‘সেবি’ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে।
টু-জি স্পেকট্রাম বন্টন কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে অনিল ধীরুভাই আম্বানি গোষ্ঠী (এডিএজি)’র কয়েকজন শীর্ষ আধিকারিকের আদালতে বিচার চলছে। ‘সোয়ান টেলিকম’ নামের একটি সংস্থার মাধ্যমে স্পেকট্রাম কেনায় রিলায়েন্স টেলিকম কারচুপি করেছিল।
টু-জি স্পেকট্রাম বন্টন কেলেঙ্কারিতে টাটা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে। ইউনিটেক কোম্পানিকে স্পেকট্রাম কেনার জন্যে টাটা রিয়েলিটি ১৭০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল। বিষয়টি তদন্ত করছে ‘গুরুতর দুর্নীতি অনুসন্ধান অফিস’। ইউনিটেক ও সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টরের বিরুদ্ধে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মামলা চলছে। টু-জি স্পেকট্রাম বন্টন কেলেঙ্কারিতে মামলা চলছে এসার গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান ববি রুইয়া ও অংশুমান রুইয়ার বিরুদ্ধেও। এরা স্পেকট্রাম পাওয়ার জন্যে লুপ টেলিকম নামে একটি আলাদা সংস্থা খুলেছিল।
জিন্দল স্টিল অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড যুক্ত কয়লা ব্লক কেলেঙ্কারিতে। নিলামে অংশ না নিয়েই, মন্ত্রকের থেকে কয়লা ব্লক পেয়েছে। তৎকালীন কয়লা মন্ত্রী দশারি নারায়ণ রাওকে টাকা দিয়ে কয়লা ব্লক নিজের কোম্পানির নামে। লিখিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে নবীন জিন্দলের বিরুদ্ধে।
আদানি এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেআইনিভাবে লৌহ আকরিক উত্তোলন ও রপ্তানীর। ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টির তদন্তভার তুলে দেয় সিবিআই’য়ের হাতে। জেএসডবলু’র চেয়ারম্যান সজ্জন জিন্দল এবং চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার বিনোদ নওয়াল সমেত সংস্থার বেশ কিছু আধিকারিক এবং কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে খনন কার্য চালাবার অভিযোগ উঠেছে। ২০০৪ সাল থেকে বেআইনিভাবে আন্তর্জাতিক টেলিফোন পরিষেবা দেওয়ার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে সিংটেল, ভারতী এয়ারটেল এবং টাটা কমিউনিকশনের বিরুদ্ধে। বেআইনি পরিষেবা দেওয়ায় রাজস্ব বাবদ সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৪৮ কোটি টাকা।
ক্যাগের রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০০৮-০৯ অর্থবর্ষে জামশেদজি টাটা ট্রাষ্টের ১,৯০৫ কোটি টাকা, ২০০৯-১০ অর্থবর্ষে নওজভাই রতন টাটা ট্রাস্টের মুলধনী লাভ হয়েছিল ১২৩৪ কোটি টাকা। দু-সংস্থাকেই আয়করে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। ন্যূনতম হারে কর নেওয়া হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের আয় হওয়া উচিত ছিল ১০৬৬.৯৫ কোটি টাকা।
কর্পোরেট লবিস্ট, পাবলিক রিলেশন সংস্থা বৈষ্ণবী কমিউনিকেশনের মালিক নীরা রাডিয়ার কথোপকথনের টেপ থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতির সন্ধান পাওয়া যাবে বলে মনে করছে সুপ্রিম কোর্ট।
২০০৮ ও ২০০৯ সালে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অনুমতি নিয়ে নীরার সংস্থার বিরুদ্ধে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগের তদন্ত করতে আয়কর দপ্তর তাঁর ফোনে দুই পর্যায়ে ৩০০ দিনের জন্য আড়ি পাতে। সেই গোপন টেপের অনুলিখনে ব্যক্তিগত অনেক কথার সঙ্গে বেরিয়ে আসে ব্যক্তিগত মুনাফা ও স্বার্থের কারণে সরকারি আধিকারিক ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যেকার বেশকিছু কথাবার্তা। টুজি কেলেঙ্কারিতে নীরা রাডিয়ার ভূমিকা যে বেশ বড়সড়ই ছিল তাও প্রকাশ হয়ে পড়ে। সিবিআইয়ের হাতে যে ৫৮৫১টি কথোপকথনের রেকর্ড আছে তাতে আরও একাধিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অবৈধভাবে প্রভাব খাটানোর নিদর্শন রয়েছে। মনে করা হচ্ছে বিপদে পড়তে পারেন আরও অনেক নামজাদা ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।
রাডিয়া টেপের অনুলিখন বিচার করে দেখার জন্যে সুপ্রিম কোর্ট একটি কমিটি নিয়োগ করেছিল। সেই কমিটির তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ওই রেকর্ডিংয়ের মধ্যে অন্তত ১৪ টি নিয়ে সিবিআই’কে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আগামী ২ মাসের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করতে বলা হয়েছে।
নীরা রাডিয়ার টেপের কথোপকথনে নাম জড়িয়েছে টাটা টেলিসার্ভিস ছাড়াও মুকেশ অম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, অনিল আম্বানির এডিএজি গ্রুপের। এরা সবাই-ই নীরার ক্লায়েন্ট। কেলেঙ্কারিতে যে ৯টি সংস্থা লাভবান হয়েছে তাদের মধ্যে ৪টিকে সাহায্য করেছিলেন নীরা।
টেপে ইতিমধ্যেই নাম পাওয়া গেছে - প্রাক্তন টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা, ডিএমকে নেত্রী ও রাজ্যসভার সাংসদ কানিমোঝি, শিল্পপতি রতন টাটা, শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি, শিল্পপতি অনিল আম্বানি, সাংবাদিক বরখা দত্ত, সাংবাদিক বীর সাংভি, সাংবাদিক প্রভু চাওলা, অটলবিহারী বাজপেয়ীর জামাতা রঞ্জন ভট্টাচার্যর ব্র্যান্ড ম্যানেজার সুহেল শেঠ।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই ১৯৯৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বন্টন করা কয়লার ব্লকগুলি তদন্ত করে দেখছে সিবিআই। ২০০৫-২০১০, ২১৬টি কয়লা ব্লক বন্টন হয়েছে, যাতে কয়লার পরিমাণ ৪,৪০০ কোটি মেট্রিক টন। এর মধ্যে জুলাই ২০০৪ সাল থেকে মে ২০০৯ সাল অব্দি কয়লা মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন মনমোহন সিং। তাঁর সময় ১৪২টি ব্লক বন্টন করা হয়।
কয়লা ব্লক বন্টন কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে গত ১৫ অক্টোবর (২০১৩) শিল্পপতি কুমারমঙ্গলম ও প্রাক্তন কয়লা সচিব পিসি পারেখের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে সিবিআই। বিড়লার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতারণা, জালিয়াতি ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র। পারেখের বিরুদ্ধে দুর্নীতি (প্রতিরোধ) আইনে এফআইআর করা হয়েছে। সিবিআই-এর অভিযোগ, ২০০৫ সালের ১০ নভেম্বর ওড়িশার তালাবিরা-২ ব্লকটি আদিত্য বিড়লা গোষ্ঠীর সংস্থা হিন্দালকো’র নামে বেআইনিভাবে বন্টন করে দেওয়া হয়। ব্লকটি দেওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নেভেলি লিগনাইটকে। অথচ ২০০৫ সালে স্ক্রিনিং কমিটি বিড়লার বরাত খারিজ করে দেওয়ার পর তালাবিরা-২ কয়লা ব্লকটি হিন্দালকো’র হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন নবীন পট্টনায়ক। প্রাক্তন কয়লা সচিব পিসি পারেখ অবশ্য জানিয়েছেন, যদি সিবিআই মনে করে এর মধ্যে চক্রান্ত ছিল, তাহলে চার্জশিটে প্রধানমন্ত্রীর নামও থাকা উচিত। কারণ সেসময়ে প্রধানমন্ত্রীই ছিলেন কয়লা মন্ত্রকের দায়িত্বে। দশেরা নারায়ণ রাও ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। সব ফাইলই সই করেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। অভিযোগ, কংগ্রেস সদর দফতর থেকে চিরকূট আসত প্রধানমন্ত্রীর অফিসে, সেখান থেকে কয়লামন্ত্রক।
সিএজি’র প্রাথমিক অনুমান ছিল অবৈধভাবে এই বন্টনে সরকারের প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। পরবর্তীকালে ক্ষতির পরিমাণ বলা হয়েছে ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা। সিবিআই তদন্ত চলাকালীন প্রায় ১৫৭টি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল হারিয়ে গেছে। অনেকগুলি পাওয়া গেলেও, ১৮-২০টি ফাইল এখনও নিখোঁজ।
কয়লা বন্টনে কেন্দ্র অনুমোদন করলে খনির লিজ দেয় রাজ্য সরকার এবং কয়লা ব্লক কেলেঙ্কারিতে পশ্চিমবঙ্গেরও ৭ টি সংস্থার নাম রয়েছে। এই সংস্থাগুলিকে বর্ধমান, বাঁকুড়া ও বীরভূমের কয়লা ব্লক দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। বামফ্রন্ট সরকার। জয় বালাজি স্পঞ্জ, রেশমি সিমেন্ট, ভূষণ স্টিল, শোভা ইস্পাত, আধুনিক কর্পোরেশন, রামস্বরূপ লৌহ উদ্যোগ, ডিআরআই মাইনিং ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি এবং হিমাচল এমটা পাওয়ার।
কয়লা ব্লকঃ বাঁকুড়ার বিহারীনাথ, বর্ধমানের অন্ডাল ও রানীগঞ্জের কাছে গোরাঙডিহি এবিসি, ওহরিটেন্ড তল্লা, বীরভূমের ময়রা মধুজোড় এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের তিনটি ব্লক। সবচেয়ে বড় অন্ডাল ব্লক, এখানে কয়লার পরিমাণ ৭০০০ লক্ষ টন। রাজ্য সরকারের সুপারিশে এই ব্লকটি দেওয়া হয়েছে, জয় বালাজি, ভূষণ স্টিল ও রেশমি সিমেন্টকে। ওহরিটেন্ড তল্লাটিও পেয়েছে জয় বালাজি। বিলি হয়েছে ২০০৫ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে।
হিমাচল এমটা ছাড়া সবাই স্পঞ্জ আয়রন থেকে ইস্পাত তৈরি করবে বলেছিল। জয় বালাজি স্পঞ্জ আয়রন ছাড়াও দু’টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে বলে জানিয়েছিল। শিল্প হয়নি। শিল্পের জন্য জমি পেয়েছে, পেয়েছে কয়লা ব্লক।
রাজ্য সরকারি সংস্থা ওয়েস্ট বেঙ্গল মিনারেল ট্রেডিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনও কেন্দ্রের কাছ থেকে কয়লা ব্লক নিয়ে কুলটি, ইছাপুর ও সীতারামপুর ব্লক দিয়েছে সজ্জন জিন্দাল গোষ্ঠীর জেএস ডব্লু বেঙ্গল স্টিলকে (মোট পরিমাণ ৭৫৫০ লক্ষ টন)। জয় বালাজি পেয়েছে দু’টি ব্লক, জগন্নাথপুর এ এবং বি (৮০০০ লক্ষ টন) রঘুনাথপুরে ইস্পাত কারখানা গড়ার জন্যে।
১৯৪৮ সালের জিপ কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি অব্দি আনুমানিক ৭৩ লক্ষ কোটি টাকা লুঠ হয়েছে। কমনওয়েলথ গেমসের দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার তদন্ত রিপোর্টে সিবিআই, শ্রী সুরেশ কালমাডিকে দোষী সাব্যস্ত করেও অভিযুক্ত করার মত কিছু খুঁজে পায়নি!
রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ প্রশাসন। সরকারি প্রশাসন। বিবেক দেবরায় ও লাভিশ ভাণ্ডারির লেখা ‘করাপশন ইন ইন্ডিয়াঃ দ্য ডিএনএ অ্যান্ড আরএনএ’ বইয়ের লেখকেরা জানাচ্ছেন, ভারতে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারিরা বছরে প্রায় ৯২ হাজার ১’শ ২২ কোটি টাকা চুরি করেন।
আমাদের প্রশাসনিক প্রধান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেন, তাঁর সরকার দুর্নীতিতে ‘জিরো টলারেন্স’। কমনওয়েলথ গেমস সংক্রান্ত দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সুরেশ কালমাডিকে তিনি স্থান করে দিয়েছেন বিদেশ দফতরের সংসদীয় কমিটিতে আর টু-জি কেলেঙ্কারিতে যুক্ত এ রাজা ও কানিমোঝিকে শক্তি দফতরের সংসদীয় কমিটিতে! সুইস ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালো টাকা সেই ২০১০ সালেই ৬০ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
৫
ভারতের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপই। বাজেটের একটা বড় অংশই চলে যায় প্রতিরক্ষা খাতে। তাই বারেবারেই বিশ্ব আর্থিক সংস্থার কাছে হাত পাততে হয়। পরিকল্পনা খাতে ব্যয় সংকোচন করতে হয়। দেশের সম্পদ বিক্রি করে আয় (?) দেখাতে হয়।
আয় ব্যয়ে ঘাটতি কমাতে অর্জিত সম্পদ বিক্রি করে ‘আয়’ (?) বাড়াতে চেয়েছিল সরকার। চলতি অর্থবর্ষে সরকারি সংস্থার ‘শেয়ার’ বিক্রি করে আয় করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৫,০০০ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত কোষাগারে জমা পড়েছে ৩০০০ কোটি টাকা। সেটা এসেছে পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান কপার, ন্যাশনাল ফার্টিলাইজার এবং এমএমটিসি’র শেয়ার বিক্রি করে। এবার ইন্ডিয়ান অয়েল, ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া ও হেভি ইলেকট্রিক্যালসের শেয়ার বিক্রি করে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সংগ্রহ করা হবে ৪০,০০০ কোটি টাকা। এছাড়া কোল ইন্ডিয়া ও রাষ্ট্রীয় ইস্পাত নিগমের শেয়ার বিক্রি করা হবে।
অন্যদিকে ভারতে ‘সুপার রিচ’দের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যাদের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ১০ লক্ষ ডলারেরও বেশি, মানে টাকার অংকে মোটামুটি ৬ কোটি টাকারও বেশি, তাদের বলা হয় ‘সুপার রিচ’। ২০০৮ সালে সংখ্যাটা যেখানে ছিল ৮৪ হাজার, ২০১২ সালে ১ কোটি ৫৩ লক্ষ। শুধুমাত্র ২০১১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যেই ‘সুপার রিচ’দের সংখ্যাবৃদ্ধি হয়েছে ২২.২ শতাংশ। যেখানে ভারতে ২২.২ শতাংশ বেড়েছে সেখানে ‘প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে’ খ্যাত দেশ জাপানে বেড়েছে ৪.৪ শতাংশ। চিনে ‘সুপার রিচাদের সংখ্যা বেড়েছে ১৪.৩ শতাংশ। সিঙ্গাপুরে ১০.৩%, থাইল্যান্ডে ১২.৩%, ইন্দোনেশিয়ায় ১৬.৮%।
ভারতে ‘সুপার রিচাদের এই আয়ের ২৬.৫ শতাংশই এসেছে রিয়েল এস্টেট বিজনেস’ (জমি বাড়ির নির্মাণ বা দালালি), নগদ ও গচ্ছিত সম্পদ থেকে (তেজারতি কারবার) আয়ের ২২.৭%, স্থায়ী আয় (নিজের ব্যবসার বেতন) ১৭.৭%, শেয়ার লভ্যাংশ থেকে ১৭.৭% এবং অন্যান্য বিনিয়োগ থেকে এসেছে ১৫.৮%।
আয়ের প্রধান উৎস যেখানে উল্লেখযোগ্য কোনো ‘উৎপাদন শিল্প’ বা ‘প্রযুক্তি গবেষণা’ নয়, এবং ব্যক্তিগত সম্পদের বৃদ্ধি যেখানে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে, ‘দুর্নীতি’ সেখানে সম্পদ বৃদ্ধির এক অনিবার্য পদ্ধতি এবং আর্থিক দুর্নীতি সেখানে নানাবিধ ‘অপরাধমূলক কাজকর্মে’র আবাদভূমি।
দিল্লি, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্রিশগড়ের বিধানসভা নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই ‘দুর্নীতি’ একটি বড় রাজনৈতিক ইস্যু হয়েছিল। দিল্লিতে আম আদমী পার্টি যেহেতু বিষয়টি নিয়ে সংঘবদ্ধ প্রচার চালাতে পেরেছিল তাই শাসক দলের ‘খুশি মতো হ্যাঁ-কে না করা বা না-কে হ্যাঁ করা’র ঔদ্ধত্য আর অর্থনৈতিক দুর্নীতির প্রতিবাদও করেছেন মানুষ এবং শিক্ষিত পেশাজীবী সম্প্রদায় এই নীতি ভালভাবে মেনে নেননি।
ক্ষমতায় আসার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই, ‘আম আদমি পার্টি’ পরিবার পিছু দিনে প্রায় ৭০০ লিটার (মাসে ২০ কিলোলিটার) জল বিনামূল্যে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পালন করেছে। ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ মাশুল অর্ধেক করে দিয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থাগুলির আয়ব্যয়ের হিসাব পরীক্ষা করার জন্যে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলকে রাজি করিয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে, ৭ জানুয়ারি, জলবন্টন নীতি সুষ্ঠু রূপায়ণের জন্য জল বোর্ডের ৮০০ জন কর্মীকে বদলি করেছেন। পাইপ লাইনে জল যায় না এমন সব এলাকায় জলের ট্যাঙ্কার পাঠাবার ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করছে।
সরকারি বিদ্যালয় ঠিক মতো চলছে কিনা দেখবার জন্য ‘আপ’ ‘স্বেচ্ছাসেবক’ সংগ্রহ করেছে। ‘আপ’ সদস্যদের দেখা যাচ্ছে সরকারি হাসপাতালে। ‘রোগী কল্যাণ সমিতি’ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সদস্যরা সরাসরি রোগী ও তার আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে দেখা করে অভাব অভিযোগ নিচ্ছেন।
নেতা-মন্ত্রীরা কোনো নিরাপত্তারক্ষী বা যাতায়াতের পথে ‘পাইলট কার’, লালবাতি নিচ্ছেন না। সমর্থকদের উৎসাহ উদ্দীপনায় প্রশাসন চালানোয় এক নতুন ধারার প্রবর্তন হয়েছে।
দিল্লি খুবই ছোট রাজ্য। শহরবাসী মানুষ কোটিখানেক। শহর দিল্লির গড় বাৎসরিক উপার্জন ২ লক্ষ টাকা। তার ওপর ভারতের রাজধানী শহর। পুলিশ এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। কেন্দ্রীয় সরকারের নজরদারি যেমন আছে তেমনি কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান আয়োজনও অন্যান্য যে কোনো রাজ্যের চেয়ে একেবারেই অন্যরকম। এলাকার আয়তন আমাদের রাজ্যের মোটামুটি একটি জেলা। জনবিন্যাসের প্রকৃতি একেবারেই আলাদা। জনপদের মূলবাসী বা ভূমিপুত্র প্রায় নেই বললেই চলে।
এখানকার কোন স্থানিক সমস্যা সমাধানের সূত্রের সঙ্গে অন্য রাজ্যের তেমন একটি সমস্যার সমাধানে মিলের থেকে অমিলই হয়তো বেশি। কিন্তু যে কোনো বিষয়ে অভিঘাত অনেক বেশি। জলকর প্রত্যাহার কেন্দ্রীয় সরকার থেকে শুরু করে পশ্চিমবাংলার শিক্ষিত পেশাজীবী সম্প্রদায়, কেউই প্রায় নীতিগত ভাবে মেনে নেননি। গণমাধ্যম সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছিল।
বিশ্বব্যাঙ্ক ২০০৫ সালে ‘ভারতের জল অর্থনীতি’-র ওপর একটা রিপোর্ট পেশ করে। বলা হয়েছিল, ভারতের উন্নয়নকে স্থায়ী করতে জলসম্পদের ব্যবহার হওয়া উচিত আর্থিক হিসাবে। ২০০৬ সালে ‘কোকোকোলা’র স্পনসরশিপে ওয়ার্ল্ড ওয়াটার কাউন্সিলের অধিবেশন বসে।
বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা জল-বাণিজ্য সংস্থাগুলির ‘মাল্টি ট্রিলিয়ন ডলার বিজনেস’-এর সম্ভাবনার কথা বলে জানায়, জল সরবরাহ মেটাতে জল সরবরাহের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে বেসরকারি সংস্থার হাতে ছেড়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে জলের পরিকাঠামো গড়ে তুলতে তারা। আর্থিক সহায়তা দেবে। এইভাবেই এগিয়েছে বিশ্বব্যাঙ্ক। সরকার নগর উন্নয়নের জন্য ঋণ পেয়েছে জলকর বসানোর শর্তেই।
পুঁজির বক্তব্য, জল একটি পণ্য সুতরাং তা ব্যবহার করতে মানুষকে কর দিতেই হবে। এই যুক্তি মেনেই আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও সিপিআই (এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার জলকর চালু করেছিল।
পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের ‘জলকর না’ নীতি তেমন কোন আলোড়ন তুলতে না পারলেও, ‘আপ’ বিনামূল্যে জল সরবরাহের দাবি কার্যকর করার পর, গণমাধ্যমের ব্যতিক্রমী প্রচারে অন্য রাজ্যও জলকরের বিষয়টি নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু করছে। মুম্বই পুরসভা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জানিয়েছে, মুম্বইবাসীকে খুব শীঘ্রই বিনামূল্যে জল সরবরাহ করা হবে। হরিয়ানা সরকার বিদ্যুতের দাম শহরে ইউনিট প্রতি ১.৩০ টাকা এবং কৃষকদের জন্যে ইউনিট প্রতি দাম ২৫ পয়সা থেকে নামিয়ে ১০ পয়সা করতে চলেছে।
৬
বিনামূল্যে জল বা বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়ার মতো বিষয় ছাড়াও ‘আপ’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সে সততা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতাকে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় পরিণত করবে। এখানেই ‘আপ’ সংসদীয় রাজনীতির একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। প্রশাসন চালানোয় এক নতুন ধারা প্রবর্তনের কথা বলেছে।
জনলোকপাল বিল নিয়ে মহারাষ্ট্রের গান্ধিবাদী নেতা আন্না হাজারের দিল্লিতে আন্দোলনের সময় থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন বহু সংখ্যক মানুষ। এই আন্দোলনের সূত্র ধরেই অরবিন্দ কেজরিওয়াল বা মনীশ শিশোদিয়া বা কুমার বিশ্বাসেরা দুর্নীতি বিরোধী মানুষজনের আস্থা অর্জন করেন। একটি পর্যায়ের পর আন্না হাজারে যখন ‘অ-রাজনৈতিক মঞ্চকেই এই আন্দোলনের মূল শক্তি হিসাবে আঁকড়ে ধরলেন, সেই সময় অরবিন্দ কেজরিওয়ালেরা রাজনৈতিক দলগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। পথ হয়ে গেল ভিন্ন, কিন্তু আন্দোলনের ভিত্তিভূমি রইল একই।
দুর্নীতির প্রশ্নে কংগ্রেস শাসিত দিল্লি সরকার বা দিল্লি পুরনিগম নিয়ে বিজেপি’র বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে ক্ষোভ ছিল, তা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল, রাজধানী দিল্লিতে অবস্থানকারী ভারত সরকারের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের বল্গাহীন দুর্নীতিতে। দুর্নীতির অত ভার একা শীলা দীক্ষিত বহন করতে পারলেন না। ‘আপ’-এর নির্বাচনী জেহাদ বড় গণমাধ্যমের সমর্থন পেয়েছে।
নির্বাচনে গণমাধ্যম কতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারে সে বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও, দিল্লির রাজনীতিতে অনেকটাই প্রভাব ফেলতে পেরেছিল। শুধু তাই নয় আম আদমি পার্টির সমর্থকদের একটি অংশ যেমন দরিদ্র বা নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষজন, ছোট দোকানদার, ব্যবসায়ী, ঝোপড়িবাসী দিনমজুর; তেমনি আরেকটি অংশ সচ্ছল মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণী, বয়স ২০ থেকে ৩৫। মোবাইল-ল্যাপটপ ব্যবহারে পারদর্শী তাঁরা নির্বাচনে প্রযুক্তিকে নির্দিষ্ট অভিমুখে পরিচালনা করতে পেরেছেন। স্বতঃস্ফূর্ত মানুষজনকে একটি বিশেষ দিক নির্দেশ করতে সমর্থ হয়েছেন। সাংগঠনিক শক্তির সংগঠন ছাড়াই কংগ্রেস বা বিজেপি’র মোকাবিলা করতে পেরেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল দিল্লির সঙ্গে তুলনীয় নয়। গত নির্বাচনে এখানে ‘দুর্নীতি’ রাজনৈতিক ইস্যু থাকলেও অনেক বড় বিষয় ছিল, ‘কৃষি জমি রক্ষা আন্দোলন’ ও শাসকের ‘ঔদ্ধত্য’।
২০০৬ সালে মোটর গাড়ি তৈরির কারখানা গড়ে তোলার জন্যে টাটা শিল্পগোষ্ঠীর হাতে ১৯৯৭ একর চাষের জমি কৃষকদের বিনা সম্মতিতেই তুলে দেওয়া হয়েছিল। জমি অধিগ্রহণ বন্ধ করা ও অধিগৃহীত জমি কৃষকদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন।
শাসকের হুমকি ছিল। শাসক দলের হুমকি কার্যকর করার কর্মী ও গুণ্ডাবাহিনী ছিল। ২০০৬ সালে সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, টাটার কারখানার যারা বিরোধিতা করবে তাদের দেখে নেওয়া হবে। কেমনভাবে হবে, জানিয়েছিলেন রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান, শ্রী বিমান বসু। টাটার কারখানার যারা বিরোধিতা করবে তাদের চুলের মুঠি ধরে বাংলার বাইরে ফেলে দেওয়া হবে। পুলিশ, আগুন, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি ব্যবহার করেও কৃষকের জমি না দেওয়ার প্রতিরোধ সরকার ভাঙতে পারেনি।
একই ঘটনা ঘটে নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনে। এখানে জমির দখল নিতে কার্যত তাণ্ডব চালিয়েছিল সরকার। শুধু ১৪ মার্চ ২০০৭ তারিখের পুলিশ এবং সিপিআই(এম)-এর সংগঠিত বাহিনীর আক্রমণে আহত হয়ে ডাক্তারি চিকিৎসা করাতে হয়েছে, ১৯৬৮ জনকে। আহতদের তালিকায় ছিলেন ছেলে মেয়ে শিশু বুড়ো বুড়ি সব। অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল গুলি, লাঠি, শাবল, দা, কাটারি। ধর্ষণ, গণধর্ষণ। মানুষের প্রতিরোধে সিপিআই (এম) দলের সক্রিয় কর্মীবাহিনীকে অবশেষে এলাকা ছাড়তে হয়। কিন্তু নভেম্বর মাসে পুলিশ নিয়ে তারা আবার নন্দীগ্রাম এলাকায় ফিরে আসে। ৫ থেকে ১১ নভেম্বর ২০০৭ - এলাকা দাপিয়ে বেড়ায় পুলিশ আর সিপিআই (এম) দলের কর্মী ও ভাড়াটে গুণ্ডারা। এলাকায় সেই দিনগুলোয় সরকারের প্রত্যক্ষ প্রচারক সাংবাদিক ও বৈদ্যুতিন মাধ্যম ছাড়া অন্য কেউই ঢুকতে পারেনি। ঢুকতে দেওয়া হয়নি কোন নিরপেক্ষ প্রতিনিধিদলকে। ১১ নভেম্বর পালিত হয়েছিল বিজয় উৎসব। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু জানিয়েছিলেন, নতুন সূর্যোদয় হয়েছে নন্দীগ্রামে।
১৩ তারিখে মুখ্যমন্ত্রী প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলেন, দে হ্যাভ বিন পেড ব্যাক ইন দেয়ার ওন কয়েন। সেই সভাতেই এক সাংবাদিক নন্দীগ্রাম দখলের প্রশ্নে সরকার ও দলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করায়, মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন,
সকলে মনে করছে না। ওটা আপনার কাগজ মনে করছে। আপনারা যা ইচ্ছে লিখুন। আপনারা তো গত ১১ মাস ধরেই উস্কানি দিয়ে চলেছেন। অন্য কোন সরকার হলে ব্যবস্থা নিত। আমি নিইনি। কারণ ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে চাই না।
১৪ নভেম্বর, মুখ্যমন্ত্রী আবারও জানিয়ে দেন, যা বলেছি, তা থেকে সরে আসছি না। আই স্টিক টু দ্যাট। আমি দলের ঊর্ধ্বে নয়।... হ্যাঁ কাল আমি “আমরা” বলতে সিপিআই (এম) ছেলেদের কথাই বলেছি। বলেছি, যারা অস্ত্র ব্যবহার করেছিল, তাদের ঢিল সিপিএম ফেরত দিয়েছে।... আমি চিফ মিনিস্টার এবং সিপিএম নেতা। আমি আমার রাজনৈতিক চরিত্র অস্বীকার করতে পারি না... সূর্যোদয় হয়েছে তবে তার উত্তাপ পেতে একটু সময় লাগবে।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস মারা যান ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৭। রেনিগেড বলে তাঁর মরদেহ রবীন্দ্রসদনে রাখতে দেননি সেদিনের তথ্যমন্ত্রী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
৭
এই মানুষটিই গত ৫ মে, ২০১৩-য় উত্তর ২৪ পরগণার শ্যামনগরে দলের এক সভায় বললেন, ‘বলছে চমকে দেব, ওভার বাউন্ডারি মারব। ও বাবা এ কি ভাষা! একে মহিলা তায় মুখ্যমন্ত্রী। এই ভাষণ শুনতে মাথায় যন্ত্রণা হয়। শুনতে শুনতে শরীর খারাপ হয়। গা বমি করে। এটা সমাজবিরোধী ও লুম্পেনদের ভাষা। ওই ভাষাই উনি জানেন।’ ‘এত বক্তৃতা করছে। কিন্তু সিবিআই আসুক না, দেখা যাবে। সততা দেখাচ্ছে। কে কোথায় দাড়িয়ে আছে দেখা যাবে।’
সিবিআই তদন্তের শাসানি বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী প্রায়শই শোনাতেন যখন তিনি ছিলেন রাজ্যে শাসক-বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা। এখন শোনাচ্ছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে। রাজ্যে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা এবং দীর্ঘদিন রাজনীতি করার সুবাদে দুজনই জানেন সিবিআই দুর্নীতি-তদন্তে কোনো নিরপেক্ষ সংস্থা নয়। সিবিআই-প্রধানেরাও এই কথা স্বীকার করে নেন।
সিবিআই অধিকর্তা অমর প্রতাপ সিং, ৩০ নভেম্বর (২০১৩) অবসরের ঠিক আগে, জানিয়েই দিলেন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের স্বাধীন কোন ক্ষমতাই নেই। তদন্তের গতিপ্রকৃতির পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয় সরকার। ১৪ ডিসেম্বর আর এক প্রাক্তন সিবিআই অধিকর্তা ইউ এস মিশ্রও একই অভিযোগ তুলেছেন। প্রথম ইউপিএ সরকারের সময়, ২০০৩-এর ডিসেম্বর থেকে ২০০৫ সালের ডিসেম্বর অব্দি দায়িত্বে থাকা সিবিআইয়ের এই প্রাক্তন অধিকর্তা বলেছেন, উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রবল বিরোধিতার মধ্যে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, নামজাদা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে চালানো তদন্ত রিপোর্ট ঝুলিয়ে রাখা হয় বা বিশেষভাবে উপস্থাপনা করার জন্য সর্বদাই সিবিআইয়ের ওপর প্রভাব বিস্তার করা হয়।
এখন তো সিবিআই নিয়ে আরও অনেক প্রশ্ন। গত ৬ নভেম্বর গুয়াহাটি হাইকোর্টের বিচারপতি আই এ আনসারি ও ইন্দিরা শাহ’র বেঞ্চ সিবিআই’কে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য ওই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে।
আর ভাষার ঔদ্ধত্য! বড়ই কষ্টকর মেনে নেওয়া। ৫ অক্টোবর, ২০১৩, সরকারি বেশ কিছু অফিস হাওড়ার ‘নবান্ন’য় চলে যাওয়া উপলক্ষে গৌতম দেব, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানসিক স্থিতি ও বিলাসিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘কালকের দেড় আনার মেয়ে’ সম্বোধন করে বললেন, ‘নবান্নকে আমরা বলছি মমতার জলসাঘর’, ‘মাইথনের সরকারি অতিথি আবাসে মমতার ঘর পছন্দ হয়নি। টালির ঘরের মেয়ে। মমতার হ’লটা কি?’, ‘ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে মমতা’, ‘পুজোর ভাসানের পর মমতাকেও ভাসান দেব’, ‘স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীর কি চোদ্দ তলায় থাকা ঠিক? কখন কী করে বসে!’ ‘ক্ষমতায় এলে আমরা মমতাকে গ্রেপ্তার করব না। দেশের পাঁচ পাঁচটা সেরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দিয়ে ওর চিকিৎসা করাবো। তারপর ওকে যেখানে পাঠাবার পাঠাবো।’ ‘মমতা আমার টেলিফোন ট্যাপ করে। মমতার টেলিফোনও ট্যাপ হয়। মমতার টেলিফোন ট্যাপ করারও লোক আছে।’
প্রাক্তন এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধেই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব, অশোকমোহন চক্রবর্তী অভিযোগ করেছেন, আমলা ও প্রশাসনিক কর্তাদের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে মন্ত্রী একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ছেলে চন্দন বসুর সংস্থাকে বেহালায় জমি পাইয়ে দিয়েছিলেন। দক্ষিণ ২৪ পরগণার অতিরিক্ত রেজিস্ট্রারের হিসাব অনুযায়ী যে জমির মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা, ১৮ কোটি টাকায় সেই জমি হাতবদল হয়ে যায়।
ব্যতিক্রম নয় প্রাক্তন এই মন্ত্রী। গত ২৬ ডিসেম্বর, ২০১২, উত্তর দিনাজপুরের ইটাহার হাইস্কুলের মাঠে কৃষক সভার সম্মেলনে আনিসুর রহমান আবারও বললেন, (নির্বাচনের আগে) “আমার দিদিমণি মেয়ে পেলেই নিয়ে গিয়ে রাইটার্সে বলতেন ধর্ষিতা হয়েছে। আমরা ঠাট্টা করে বলেছিলাম, এইসব হেলাফেলা মেয়ে দিয়ে হবে না। ভালো মেয়ে খোঁজেন। আপনার থেকে ভালো মেয়ে তো নাই। আপনি যদি একবার বলতে পারেন যে আপনাকেও ধর্ষণ করা করেছে, তা হলে আপনার ভোটটা পার হয়ে যাবে।” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরের অবস্থা বলতে গিয়ে টেনে আনেন পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণ প্রসঙ্গ। বলেন, “দিদিমণি দূর থেকে বলে দিল, না না ধর্ষণ মর্ষণ হয়নি। আর যদি কোথাও হয়ও তো এমনি হতে পারে, তাতে কী যায় আসে। আমি মজুরি দিয়ে দেব। কত দেবে? কুড়ি হাজার? আমি দিদিমণিকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর ফি তো কুড়ি হাজার? আপনার ফি কত?”
৮
বর্তমানে রাজ্যের জনসংখ্যা ১০ কোটিরও বেশি। বিপিএল তালিকায় রয়েছে ৯২ লক্ষ পরিবার। সরকার ঘোষণা করেছে একাধিক জনপ্রকল্প ঃ রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বীমা যোজনা, ২ টাকা কেজি দরে চাল, বেকারদের ভাতা, কন্যাশ্রী প্রকল্প, কৃষকদের পাম্পসেট বৈদ্যুতিকরণে আর্থিক সহায়তা, অসংগঠিত শ্রমিকের জন্যেও একটি বীমা প্রকল্প ইত্যাদি। এই ধরনের একাধিক প্রকল্প ধরলে রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ৫০%-এর কাছাকাছি মানুষ এইসব সহায়তা প্রকল্পগুলির আওতায় চলে আসবেন। এমনকি আগামি ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই প্রথম পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও গ্রামীণ হাসপাতালে ১৪২ রকমের ভাইটাল ও এসেন্সিয়াল ড্রাগ বিনামূল্যে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে সরকার।
চালু হলেও কতটা বাস্তবায়িত হবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সরকারি পরিকাঠামোকে আর বিশ্বাস করেন না। সরকারি কর্মচারিদের কাজ না করার মানসিকতাও সরকারি প্রকল্প সম্পর্কে মানুষকে সন্দিহান করে দিয়েছে। এমনকি সরকারের আন্তরিকতাতেও মানুষ আর আস্থাবান নন।
যদিও বর্তমান সরকার ‘পশ্চিমবঙ্গ জনপরিষেবা আইন’ প্রণয়ন করেছে। এই আইনে একজন নাগরিক আবেদন করার কত দিনের মধ্যে তাঁর পরিষেবা পাবেন, তার সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। নতুন রেশন কার্ড, বাড়ির প্ল্যান, জন্ম ও মৃত্যুর শংসাপত্র, জমি সংক্রান্ত তথ্যাদি থেকে শিক্ষাঋণ বা তপশীলি জাতি, উপজাতি এবং ওবিসি শংসাপত্র ইত্যাদি পেতে কত দিন সময় লাগবে সেসব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
সরকারের এমন সব সংস্কার ভাবনায় বিরোধীরা ক্রমশই ‘বিরোধিতা’ করার জায়গা হারাচ্ছেন। সরকারি ক্ষমতায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠা বিরোধীরাই শুধু নয় সরকারি ক্ষমতায় কোনদিন না আসা বিরোধীরাও আন্দোলনের জমি খুঁজে পাচ্ছেন না।
যেমন ‘সেজ’ বিরোধী মঞ্চ। ‘সেজ’, স্পেশাল ইকোনমিক জোনের বিরোধিতা করার সূত্র ধরেই এই মঞ্চে একত্রিত হয়েছিলেন অনেক বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, ছাত্র যুবকেরা। তৈরি হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার মঞ্চ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ‘সেজ’ নিয়ে বিরোধিতা করেছিল তৃণমূল কংগ্রেসও। সরকারে এসে ঘোষণা করেছে, ‘সেজ’ না। মঞ্চ কর্মসূচী হারিয়েছে।
তৈরি হয়েছিল, একচেটিয়া আগ্রাসন বিরোধী মঞ্চ। প্রচার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল প্রধানত দুটি দাবি নিয়ে, খুচরো পণ্যে বিদেশী পুঁজি (এফডিআই) ও জিএম (জেনেটিক্যালি মডিফায়েড) বীজের বিরোধিতা করে। সরকার জানিয়েছে, এফডিআই ও জিএম বীজ পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে দেওয়া হবে না। সংগঠন ‘ইস্যু’ হারাচ্ছে। সরকার-বিরোধিতার মঞ্চ টিঁকিয়ে রাখতে না পেরে এঁরা ক্রমশই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছেন।
গত বছরের শেষ দিকে ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের সূচনা হয়েছে। সরকারিভাবে প্রকল্পের লক্ষ্য হল রাজ্যের নারীশক্তির বিকাশ। এই প্রকল্পে বার্ষিক ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকার কম আয়ভুক্ত পরিবারের ১৩-১৮ বছর বয়সী স্কুল ছাত্রীরা বছরে বার্ষিক ৫০০ টাকা করে সরকারি বৃত্তি পাবে। ১৮ বছরের পরও লেখাপড়া চালিয়ে গেলে এককালীন ২৫ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হবে। ২৪ লক্ষ মেয়ে এই প্রকল্পে আসবেন। টাকা নিশ্চয়ই একটি বিষয়, কিন্তু তার চেয়ে বড় ব্যাপার হল ‘ক্ষমতায়ন’। গরিব ঘরের একটি মেয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও নিজস্ব সেভিংস পাশবুক নিঃসন্দেহে তাকে সামান্য হলেও ‘বল’ যোগায়।
৯
জানুয়ারি মাসের ৯ তারিখ থেকে দিল্লিতে ‘আপ’ দুর্নীতিবিরোধী হেল্পলাইন চালু করেছে। প্রথম দিনেই অভিযোগ জমা পড়েছে ৪০০০-এর ওপর। প্রথম দিন কল সেন্টারে কল ধরার জন্যে ছিলেন ১১ জন কর্মী। সেটা আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। হবে ৩ গুণ। ৪০০০-এর মধ্যে ৫৩টি অভিযোগের গুরুত্ব বেশি হওয়ায় সেগুলির তদন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে।
শুধু তাই নয়, আপের হেল্পলাইনে স্টিং অপারেশন শেখানো হচ্ছে। দুর্নীতি রোধে মোবাইল ফোন কিভাবে যথেষ্ট কাজে আসতে পারে। যোগেন্দ্র যাদব জানিয়েছেন, মতাদর্শের দিক থেকে ‘আপ’ বামপন্থীও নয়, দক্ষিণপন্থীও নয়, আমরা বাস্তববাদী। আমরা সমস্যার সমাধান করতে চাই। আমরা মনে করি প্রতিটি বিষয়ের প্ল্যান অফ অ্যাকশনটাই জরুরি। আমরা “প্রবলেম সলভার’। আর সমস্যা সমাধানে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার। অবশ্য শুধু এই ভূমিকাতেই আপ তাদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ রাখেনি। এফডিআই চালু করতে অস্বীকার করেছে। ‘আপ’ কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের কথা বলেনি। তাদের কথায় ‘আমরা গরিবদের পক্ষে কথা বলি বলে সেটা যদি বামপন্থা হয়, তা হলে ভারতের সংবিধানও বামপন্থী’।
এই যে দুর্নীতি বিরোধী ব্যাপক কার্যকলাপ, সাধারণ মানুষকে দুর্নীতি বিরোধী ক্রিয়াকাণ্ডে যুক্ত করে নেওয়া, ভারতীয় রাজনীতিতে এ এক বড় এবং উল্লেখ্য সংযোজন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যা ভয়ঙ্করভাবে অনুপস্থিত।
প্রোমোটারদের দৌরাত্ম্য এতটুকুও কমেনি। দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদেরা এবং অপরাধীরা দলবদল করে এখন তৃণমূল কংগ্রেস পার্টিতে। সরকারের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতায় দৃশ্যত মানুষের ভয়াবহ আর্থিক দুর্গতির কিছুটা সুরাহা হলেও, মানুষের ব্যক্তিসত্তাকে ধ্বংস করছে, যদিও ব্যক্তিসত্তাই এগিয়ে যাওয়ার মূল। অস্ত্রের ঝঙ্কারে যা অর্জিত হয়, অস্ত্রের কাছেই তা হারাতে হয়।
দাসত্ব গ্রাস করেছে দলকে। বাইরের কর্তৃত্বের কাছে দাসত্ব এবং নিজের কৃত্রিম অভাববোধের কাছে দাসত্ব। দাসত্বে আচ্ছন্ন কোনো দল, মানুষের মুক্তির পুরোধা হতে পারে না। হয়নিও।
৩১ ডিসেম্বর, বছরের শেষ দিনে আর জি কর হাসপাতালে মারা গেলেন মধ্যমগ্রামের নিগৃহীতা কিশোরী। ধর্ষণের অভিযোগ তুলে নেওয়ার হুমকি মেনে নিতে না পেরে গত ২৩ ডিসেম্বর গায়ে আগুন লাগিয়ে দেন বলে প্রথমে জানা গেলেও পরে শোনা যায় মেয়েটি মৃত্যুর আগে পুলিশকে নাকি জানিয়ে দেয় দুষ্কৃতীরা তার গায়ে তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়, সে মোটেই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেনি। এখানেই শেষ নয়, মৃতার দেহ সৎকারে পুলিশের অতি সক্রিয়তা, পরিবারের কাছ থেকে ডেথ সার্টিফিকেট পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এয়ারপোর্ট থানার হুমকির অভিযোগ উঠেছে। এর আগেই নিগৃহীতা মেয়েটির পরিবার আর জি কর হাসপাতালে ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে না বলে অন্য হাসপাতালে পাঠানোর আবেদন করে।
মধ্যমগ্রামের ঘটনার মাত্র ৫ দিন পরেই, বাদুরিয়ায় একটি অটোরিক্সার মধ্যে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। বাদুরিয়ার দূরত্ব মধ্যমগ্রাম থেকে ৫০ কিমি মতো হবে। এখানেও মেয়েটির বয়স ১৬। মেয়েটি বোবা ও কালা।
ফালাকাটার কাঁঠালবাড়িতে তরুণী বধূর ওপর যে পাশবিক নির্যাতন হয়ে গেল, তা এককথায় মধ্যযুগীয় অত্যাচারকেও ছাড়িয়ে গেছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ২০১২ সালে মহিলাদের ওপর সংগঠিত অপরাধের সংখ্যা ৩০,৯৪২। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে সর্বাধিক। এটা সরকারের কাছে লজ্জা শুধু নয়, লুম্পেন ফোর্সের কাছে সরকারি প্রশাসনের পরাস্ত হওয়ার খবর, লুম্পেনদের কাছে প্রশাসনের আত্মসমর্পণেরও খবর।
তদন্ত শেষ না হওয়া মামলার সংখ্যার নিরিখেও গোটা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে পঞ্চম স্থানে। বিচার শেষে অভিযুক্তদের সাজা হয়েছে মাত্র ১৩.৫ শতাংশ ক্ষেত্রে। জাতীয় গড় ৪০.৪%। ২৮টি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ২৫। ত্রিপুরা, ওড়িশা এবং মহারাষ্ট্র রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পেছনে।
মহিলাদের ওপর সংগঠিত অপরাধের সংখ্যা বিচারে মনে হয় গোটা ভারতই ভালো নেই। ২০১১ ও ২০১২ সালে গোটা দেশে নথিভুক্ত ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ২৪,২০৬ ৩ ২৪,৯২৩। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের এক মার্কিন ছাত্রী তিন মাসের জন্যে ভারত ভ্রমণে এসে বেশ কয়েকবার শ্লীলতাহানির শিকার হন। তাঁর সেই বিভীষিকাময় ভারত ভ্রমণের ইতিবৃত্ত সিএনএন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন, ‘ইন্ডিয়া: দ্য স্টোরি ইউ নেভার ওয়ান্টেড টু হিয়ার’।
দিল্লির গণধর্ষণের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি হলেও ভারতের ৪টি মেট্রো শহরের কোথাও মেয়েদের ওপর যৌন নিগ্রহের সংখ্যা কমেনি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য ব্যবস্থা না নিলে মেয়েদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি সার্বিকভাবেই উপেক্ষিত হবে এটা যেমন সত্য, তেমনি বিষয়টি আইন, আদালত, সরকার, পুলিশের হাতে ছেড়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। প্রশ্নটি যদি শুধুমাত্র আইন শৃঙ্খলার হত তাহলে ইউরোপেও এই সমস্যা ভয়াবহভাবে উঠে আসত না।
যাঁরা মনে করছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ হওয়া উচিত, মিলিত প্রতিবাদ হওয়া উচিত তাঁদের আজ সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে অনেক অনেক বেশি এগিয়ে আসা প্রয়োজন। একা অথবা সম্মিলিত। জনসচেতনাতে সরকারও যদি এগিয়ে না আসে সেটা হবে এক অমার্জনীয় অপরাধ। আপাতত এখন অবধি সরকার ব্যস্ত তালি দিতে।
১০
জরুরি অবস্থা-পূর্ববর্তী সরকারি ক্ষমতা (যুক্তফ্রন্ট পরিচালিত সময়কাল বাদ দিয়ে) ছিল মূলত আমলাতন্ত্রনির্ভর। বামফ্রন্টের সময় মধ্যবিত্ত শ্রেণি সরকারি ক্ষমতার অংশীদার হয়ে যায়। প্রথম দিকে ট্রেড ইউনিয়ন বা কৃষক সংগঠন থেকে উঠে আসা মানুষজনের পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছুটা গুরুত্ব থাকলেও, পরবর্তীকালে এইসব সংগঠনের নেতৃত্বেও মধ্যবিত্ত মানুষজনের প্রভাব চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এমনকি মধ্যবিত্ত মানুষজনই রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বে থাকায় এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাই আইএএস বা আইএফএস বা আইআরএস বা আইপিএস হওয়ায়, আমলাতন্ত্রের সঙ্গে এক ‘সম্প্রদায়গত’ যোগসূত্র স্থাপিত হয়। সরকারি প্রশাসন নির্ভরশীল হয়ে যায় ‘পার্টি’র ওপর।
জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ২৬ জুন ১৯৭৫। জরুরি অবস্থার পটভূমি তৈরি হয়েছিল ১২ জুন। সেদিন এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহনলাল সিংহ নির্বাচনী বিধিভঙ্গের জন্য শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে ছ’বছরের জন্য তাঁর নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ করেন। তখন সুপ্রিম কোর্টের গ্রীষ্মকালীন অবসর। একমাত্র বিচারপতি কৃষ্ণ আয়ারের এজলাসই তখন চলছে। সেখানেই ইন্দিরা গান্ধীর আপিল উঠেছিল। বিচারপতি আয়ার ২৪ জুন রায় দেন। আপিলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া অব্দি ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।
মন্ত্রীসভার সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করেই ২৪ ঘন্টার মধ্যে বাংলাদেশে যুদ্ধের সময় থেকে যে জরুরি অবস্থা চলছিল তা আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও বাড়িয়ে দেন, শ্রীমতী গান্ধী। ২৬ জুন ১৯৭৫ দেশময় জরুরি অবস্থা জারি হয়। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে জরুরি অবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট।
জরুরি অবস্থার সময় সংবাদমাধ্যমের ওপর জারি হয় কড়া সেন্সরশিপ। বেশিরভাগ ন্যাশনাল সংবাদপত্রই মেনে নিয়েছিল সেই সেন্সরশিপ। সেই সময়ও কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ঘোষিত-অঘোষিত অবস্থানে ‘সমাজ-রাজনীতি সচেতন’ বেশ কিছু নাট্যদল শিল্পী ও কলাকুশলীদের বেতন ও নাটক প্রযোজনা বাবদ সরকারি অনুদানে’র আবেদন করে এবং মঞ্জুরও করে সরকার।
আর্থিক বর্ষ দলের নাম টাকা
১৯৭৩-৭৪ বহুরূপী ৫৪,৬৭০
১৯৭৪-৭৫ নান্দীকার ৩৬,৮০০
১৯৭৫-৭৬ বহুরূপী ৭২,৩৪০
নান্দীকার ৬৫,০০০
১৯৭৬-৭৭ বহুরূপী ৫৮.৬৬৬
নান্দীকার ৭৩,৮০০
১৯৭৭-৭৮ বহুরূপী ৭৪,২২০
নান্দীকার ৪৮,৬৩৯
পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১৯৭১ থেকে ১৯৮০ সালে এছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান পেয়েছে পিপলস লিটল থিয়েটার, থিয়েটার সেন্টার, সুন্দরম থিয়েটার ইউনিট ও বালুরঘাটের ত্রিতীর্থ। কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারগুলির মধ্যে দিল্লির সঙ্গীত নাটক আকাদেমির অনুদান পেয়েছে পিএলটি - ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭-৭৮ এই চার বছরে প্রতি বছর ১০,০০০ টাকা করে মোট ৪০,০০০ টাকা, অনামিকা - ১৯৭৪-৭৫ থেকে ১৯৭৮-৭৯ পর্যন্ত পাঁচ বছরে মোট ২৬,০০০ টাকা, চতুর্মুখ ও নান্দীকার যথাক্রমে ১৯৭৪-৭৫ এবং ১৯৭৬-৭৭ সালে ৩,০০০ ও ৬,০০০ টাকা প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম কেনার জন্যে।
এখনকার হিসেবে টাকার পরিমাণ কম মনে হলেও ১৯৭৪-৮০ সময়কালে ওই টাকা নেহাতই কম নয়। সেসময় আকাদেমির ভাড়া ছিল ৭৫০ টাকা, হাউসফুল হলে টিকিট বিক্রি করে পাওয়া যেত কমবেশি ৩,২০০ টাকা। রবীন্দ্রসদনের ভাড়া ছিল ১০০০ টাকা, হাউস ফুল হলে টিকিট বিক্রি বাবদ পাওয়া যেত ৫,৫০০ টাকা। (যুগান্তর পত্রিকা, ২৮/৪/১৯৮১)।
১১
জরুরি অবস্থার পর নির্বাচনে ভারতে একদলীয় কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার অবসান হল। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্রতর হল। ক্ষমতার কেন্দ্রে আসীন দলগুলির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক সমীকরণেও ভিন্নতা স্পষ্টতর হয়ে উঠল। আগেও এটা ছিল, কিন্তু কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই রাজনৈতিক দল সরকারে থাকায়, খুব একটা বোঝা যেত না। কেন্দ্রে এবং রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন দল যখন এল, বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থা বলবৎ হল, সরকারের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হল শুধু নয়, ভিন্ন মাত্রাও নিল।
প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব এই অবস্থানকেই আরও মজবুত করতে সচেষ্ট হয়। ক্ষমতার অবদমন করার শক্তির আস্বাদ পায় মধ্যবিত্ত সুযোগসন্ধানীরা। ইতিমধ্যে সাতের দশক থেকে প্রকাশ পেল সমাজতন্ত্রের সঙ্কট, বামপন্থী দলে দেখা দিল বিপর্যয় ও আত্মসমর্পণ। প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সরকারগুলি ব্যবসায়িক সঙ্কটের দায়ভার দরিদ্র নাগরিকদের ঘাড়ে চাপানো শুরু করে। আমাদের দেশেও, গত শতকের আটের দশক থেকে শুরু হয় অর্থনৈতিক সংস্কার। নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি।
রাজনৈতিক দলগুলি আর এক দফা লুঠপাট শুরু করল গ্রামাঞ্চলের ওপর। আর একটি ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। শহর সাজানো হতে লাগল গ্রামকে নিঃশেষ করে। শুধু আর্থিক দিক থেকেই গ্রামকে সর্বস্বান্ত করা হ’ল না, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও দূষিত করে দেওয়া হ’ল। কেড়ে নেওয়া হ’ল গ্রামের ‘স্বাবলম্বন’ শক্তি।
কৃষি সম্পদ ভারতের অন্যতম প্রধান সম্পদ। কেননা পৃথিবীর প্রধান ২০টি জলবায়ু অঞ্চলের ৮টি অঞ্চল ভারতেই। মাটিই আছে ৪৬ রকমের। ফলে এই দেশের ফসলে এমন অফুরান বৈচিত্র্য। বিশ্বের মোট আবাদযোগ্য জমির ১১ শতাংশই ভারতে।
সারা বিশ্বের ১৭ শতাংশ দুধ উৎপন্ন হয় ভারতে। বিশ্বের ৪১ শতাংশ আম, ৩০ শতাংশ ফুলকপি, ২৪ শতাংশ কাজু, ৩৬ শতাংশ মটরশুঁটি, ২৯ শতাংশ আখ, ২২ শতাংশ চাল, ২১ শতাংশ ডাল, ১৫ শতাংশ গম, ২৮ শতাংশ চা ভারতে উৎপন্ন হয়। এছাড়া আছে আরও নানাধরনের ফলমূল, ভেষজ উদ্ভিদ।
পশ্চিম আমাদের জানাল, শিল্প, বড় শিল্প, ভারী শিল্পের বিকাশ ছাড়া ভারতের উন্নতি সম্ভব নয়। ভারতের মাথাপিছু আয় বাড়বে না, যদি শিল্প উৎপাদন না বাড়ানো যায়। কৃষিতে পুঁজির ‘বৃদ্ধি’ ভাল নয়। কৃষি ছেড়ে শিল্প। আর কৃষির ওপর এত লক্ষ লক্ষ মানুষ নির্ভরশীল থাকায়, শিল্প উৎপাদনের পথ রুদ্ধ হয়ে আছে। শিল্প উৎপাদনের ‘ভোক্তা’ প্রয়োজন।
শুরু হয় গতির দৌড়। বিনিয়োগের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে দৌড়, বিদেশী সংস্থার লগ্নি পুঁজি আনার দৌড়, চোখ কান বুজে উদোম দৌড়।
পিছিয়ে থাকল না কেউই। ১৯৯৬ সালের ২৯ মার্চ গণশক্তি ‘শিল্পায়নে রাজ্য এগোচ্ছে প্রথম সারির দিকে’ শিরোনামে লিখল... বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক কোম্পানি। তারা সব কিছু খতিয়ে দেখেই বিনিয়োগ করতে আসছে। অনেকেরই সংশয় ছিল বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান হয়তো এখানে বিনিয়োগে কোন আগ্রহই দেখাবে না। কিন্তু তা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখানে আসছে সিমেন্স, ফিলিপস, আই সি আই, নালকো, রোলস রয়েস, ভিসুভিয়াস, ক্যালটেক্স, ট্রান্স আমেরিকান করপোরেশন, মোটোরোলা, সুমিতোমা, মাৎসুশিতা, মিৎসুবিশি... প্রভৃতি। প্রতিদিনই তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে।
এসব করেও শিল্প উৎপাদন দেশের সম্পদ বৃদ্ধিতে তেমন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেনি। শিল্প উৎপাদন নয়, বর্জ্যতে দেশ ভরে গেল। বিশেষত ই-বর্জ্য। ২০১৩ সালে ভারতই ছিল বিশ্বের ই-বর্জ্যের প্রধান গন্তব্যস্থল। অব্যবহৃত এবং ফেলে দেওয়া টিভি, কম্পিউটর, মোবাইল ফোন, রেফ্রিজারেটর, বৈদ্যুতিন খেলনা, ব্যাটারি, ইলেকট্রিক তার বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল জিনিষপত্রের মধ্যে রয়েছে শিসা, মার্কারি, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ। গত বছর বিশ্বে মোট ৪ কোটি ৮৯ লক্ষ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। প্রথম বিশ্বের আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র মাথাপিছু ২৯.৮ কেজি বা ব্রিটেন মাথাপিছু ২২ কেজি ই-বর্জ্য তৈরি করে। একা চিনই গত ২৯১২ সালে ১ কোটি ১১ লক্ষ টন ই-বর্জ্য উৎপন্ন করেছে।
ওদিকে চাষ! কৃষি উৎপাদন! ১৯৬৫ সালে দেশি বীজের বদলে যখন হাইব্রিড চাষের প্রচলন হয়, তখন একর প্রতি ২ কেজি ইউরিয়া লাগত আর এখন বিঘাতেই লাগে ২২-৩০ কেজি। অথচ উৎপাদন কমছে। উৎপাদন বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী। এ হিসেব ধানের ক্ষেত্রে। ডাল বা তৈলবীজের ক্ষেত্রে এখন আর শুধু নিম্নমুখীই নয়, ঋণাত্মক চাষের মধ্যে দিয়ে আগে সৃজনশীলতার যে প্রকাশ ঘটত, যে বৈচিত্র্য ছিল, শুধু বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চাষকে দেখার ফলে চাষ আর তেমন মনোযোগ সৃষ্টি করতে পারছে না। অন্যদিকে ফলনও কমছে। চাষি চাষে উৎসাহ পাচ্ছেন না। শহরে আসছেন কাজের খোঁজে।
আগে উচ্চফলনশীল লাল স্বর্ণ ধানের উৎপাদন ছিল ২২ মণেরও বেশি। অবশ্যই অঞ্চলবিশেষে, ক্ষেত্রবিশেষে। আর এখন নানান কৃষি উপকরণ, সুষম সার, কীটনাশক রাসায়নিক দ্রব্য এবং ডিজেল/কেরোসিন/বিদ্যুৎচালিত পাম্প দিয়ে মাটির নীচ থেকে অফুরান জলের জোগান নিশ্চিত করেও কোথাও কোথাও ফলন বিঘায় ১৪ মণও নেমে গেছে, কোথাও কোথাও অবশ্য ফলন ২৬ মণও আছে। মানে ফলন ১৪ থেকে ২৬ মণ বিঘায়।
বাড়তি উৎপাদন যেটুকু হ’ল, তার বিনিময়ে বেড়ে গেল টাকার হিসেবে উৎপাদন খরচ। নির্ভরতা বাড়ল রাষ্ট্রের ওপর, কেননা সার ও কীটনাশকের ওপর ভরতুকি না দিলে চাষের খরচ আরও বেড়ে যাবে। এমনকি কেরোসিন বা ডিজেল বা বিদ্যুতের দাম যত বাড়বে, চাষের খরচও বাড়বে। এইভাবেই ছোট কৃষক চাষ ছেড়ে অন্যান্য দিনমজুরিতে চলে যাচ্ছেন, বড় কৃষক চাষের খরচে ব্যতিব্যস্ত হয়ে চাষে উৎসাহ হারাচ্ছেন। জমি বিক্রি করে অন্যভাবে আয় বাড়াবার কথা ভাবছেন।
কয়েক বছর আগে বর্ধমানের ভাতারের বিঘড়া ও বামুনিয়া গ্রামে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিকল্পনা পর্যদের সমীক্ষায় জানা গিয়েছিল, গ্রাম দুটির বাসিন্দাদের দুবেলা ভাত খেতে যে পরিমাণ চাল লাগে এলাকার উৎপাদন অন্তত তার ৫ গুণ। অথচ, অর্ধেক মানুষকে বছরের অর্ধেক দিন এক বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। চাল কেনার পয়সা তাদের নেই।
বছরে পৃথিবীতে বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে ১০ কোটি করে। এখন পৃথিবীতে বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যা ১০০ কোটি। অপুষ্টির শিকার এই মানুষদের মোটামুটি এক তৃতীয়াংশই ভারতের বাসিন্দা। ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যার হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্যন্য রাজ্য থেকে পিছিয়ে নেই। (রাষ্ট্রপুঞ্জের এফ-এ-ও সংস্থার হিসাবে কারও ১ দিনের খাবার ১৮০০ কিলো ক্যালোরির কম শক্তি জোগালে তাঁকে বলা হবে বুভুক্ষু।)
১২
রাজ্যে ৩৮ হাজার গ্রাম। ১ কোটি ৪০ লক্ষ অসংগঠিত শ্রমিকের বড় অংশই কৃষিতে যুক্ত। অ-কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। মোট শ্রমিকের মাত্র ৭% সংগঠিত, ৯৩% অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। সুতরাং আর যাই হোক কৃষিকে অবহেলা করা উচিত ছিল না।
চূড়ান্ত অবহেলায় খাদ্য নিরাপত্তা, খাদ্য সুরক্ষা বিঘ্নিত হল। খাদ্য নিরাপত্তার মানে হ’ল চাষ করা ফসল দিয়ে সারা বছরের খাদ্যসংস্থান। কৃষিফলন বিনিময় করে চিকিৎসা, শিক্ষা বা অন্যান্য পরিষেবা পাওয়ার ক্ষমতা অর্জন।
খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হয় জৈব সম্পদের রক্ষা ও সঠিক ব্যবস্থাপনায়। সবুজ বিপ্লবের পরে শুধুমাত্র ধান ও গমকেই মূলত খাদ্য হিসাবে গণ্য করা হতে থাকে। বাদ পড়ে যায় মেটে আলু, শাক সবজি, ছত্রাক, সব। আগে ডাল ও তৈলবীজ রপ্তানি হত, এখন ভোজ্য তেল, ডাল আমদানি করতে হয়। চাষ করতে গিয়ে যেসব সার ব্যবহার করতে হয় সেসবও অনেকটাই আমদানি করতে হয়। যেমন ইউরিয়া আমদানি করতে হয় ৪০ শতাংশ, ফসফেট প্রায় ৯৭ শতাংশ, আর পটাশ ১০০ শতাংশই। সারে বিপুল পরিমাণ ভরতুকি দিয়ে আমরা বলি ভারত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
কৃষি ফসল শুধুই ধান। ধান আর গম। ধানের হিসেবও শুধু ওজনে। কুইন্টালের হিসেবে। হারিয়ে যেতে দিচ্ছি স্বাদের বৈচিত্র্য, খড়ের পরিমাণ। ধান-মাছ-গৃহপালিত পশু-জৈব সার বনাঞ্চল-পুকুর পাড়-লতাগুল্ম ফলবাগান-খেলার মাঠ ঘিরে নবান্ন থেকে আকাশ প্রদীপের সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ আমাদের পূর্বপুরুষরা যে সৃষ্টিবৈচিত্র্য গড়ে তুলেছিলেন একদা, সেই গ্রামকে আরও পরিচ্ছন্ন সুন্দর করে সমৃদ্ধশালী করার পরিবর্তে করে তুললাম বসবাসযোগ্যহীন নির্জীব এক মমত্বহীন ভূমি।
গ্রামীণ মানুষজনের খাদ্যের সংস্থান শুধুমাত্র কৃষিজাত উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কৃষিক্ষেত্রেই একই সঙ্গে চাষ হ’ত মাছের, যার জন্যে আলাদা পরিশ্রমের প্রয়োজন হ’ত না। সার ও কীটনাশক ব্যবহারে চাষের ক্ষেতে আর মাছ পাওয়া যায় না। এমনকি অবশিষ্ট কীটনাশক ক্ষেত থেকে কাছাকাছির পুকুর ডোবা বা অন্যান্য জলাশয়ে জমা হয়ে সেসব জায়গার ছোট ছোট মাছের উৎপাদন প্রায় শেষ করে দেয়। এর সঙ্গে আবার সেচের অবাধ ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ জলের জলাশয়ও দ্রুত শুকিয়ে যায়। পানীয় জল থেকে আরম্ভ করে নিত্যব্যবহারযোগ্য জলের অভাবে অসুখ-বিসুখ বেড়ে গিয়েছে।
নতুন নতুন কৃষিবীজে বাড়তি উৎপাদন করতে গিয়ে এদিকে আবার ধানগাছের দৈর্ঘ্য কমে যাওয়ায় গোখাদ্যে টান পড়ছে, ঘর ছাওয়ার খড় মিলছে না। বাড়িতে দুধের সংস্থান থাকছে না।
কত কত বছরের দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে একদা জলাজমিতে আমাদের সেই পূর্বপুরুষরা যত দিনের ধান তত দিন বয়সের হাঁস ছেড়ে দিতেন সেই জমিতে। হাঁস চরত ধানের সারির মধ্য দিয়ে দিয়ে। হাঁসের চলার ছন্দে ধান গাছ থেকে পোকামাকড় ঝরে পড়ত জলে, আর হাঁস ডুব দিয়ে দিয়ে জমি খুঁচিয়ে সেই সব খেত। জমির নিড়ানী হত, হাঁসের বিষ্ঠা সার হত। একই সঙ্গে বেড়ে উঠত ধান আর হাঁস।
আমন শেষে জলা জমিতে আউশ। বিন্নি ধান। বিন্নি ধানের খই। সেই খইয়ের মাড় দেওয়া হত তাঁতের শাড়িতে।
কেমন যেন একে অন্যের ওপর অনায়াস নির্ভরশীল এক সুসংবদ্ধ চক্র। ঋতু নির্ভর, প্রাকৃতিক উপাদান নির্ভর, উৎপাদন নির্ভর আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এক এক জনপদ, গ্রাম। কৃষি ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে চাষ ছাড়াও কত ভিন্ন ভিন্ন বৃত্তি! আউল বাউল। অপরিগ্রহ বা সঞ্চয় না করার চর্চাও ছিল। এমনকি নিজেকে নিজ সম্পত্তির মালিক না ভেবে সেই সম্পত্তির ‘অছি’ (ট্রাস্টি) হিসাবে নিয়োজিত করারও রেওয়াজ ছিল। লোভ ও দখলদারির ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠে সম্পত্তিবান হওয়া সত্ত্বেও, অন্যদের সঙ্গে শ্রম ভাগ করতেও দেখা যেত। ভিক্ষাও বৃত্তি ছিল।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের চর্চায় এসেছেন বহুদিন। তাঁকে নিয়ে, তাঁকে ঘিরে আমাদের ব্যাপক সাংস্কৃতিক আলোড়ন। গান, নাটক, চলচ্চিত্র, রবীন্দ্র চিন্তা নিয়ে বইপত্র কম নেই। মানুষটিকে নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই উৎসব। বাঙালির ‘আইকন’। সব আলোচনা থেমে যায়, প্রসঙ্গ যদি হয় রবীন্দ্রনাথের সমাজ-ভাবনা, পল্লীভাবনা অথবা শিক্ষাভাবনা।
ঘাটালের হরিসিংহপুরে ফিরে এসেছে এই শীতে শামুকখোল, সঙ্গে আরও চার প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। ফিরে এসেছে আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়ে। হরিসিংহপুর পার্কের পাশে প্রায় কিলোমিটার বিস্তৃত ধানজমি আর পুকুরের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে বসে আছে হাজার দুয়েক পরিযায়ী। পুকুর জুড়ে শুধুই ঝাপটা আর পালকের ওড়াউড়ি।
এলাকার মানুষ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আর বনদফতর একযোগে প্রচার চালাচ্ছে যাতে পাখিরা চোরাশিকারির শিকার না হয়, পরিযায়ীরা যেন নিরাপত্তার অভাব না বোধ করে।
অধিকারের প্রকৃত উৎস হল কর্তব্য। সকলেই যদি নিজের নিজের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়, কর্তব্য পালন করে, তাহলে অধিকারকে খুঁজে বেড়াতে হয়না। আর যদি কর্তব্য সম্পাদন না করে অধিকারের পেছনে দৌড়ই তাহলে সেই অধিকার মরীচিকার মতো আমাদের থেকে দূরে সরে যাবে।
রাষ্ট্র হিংস্র। রাষ্ট্র কেন্দ্রীভূত। সংগঠিত হিংস্রতার প্রতিনিধিত্ব করে সে। সে কমবেশি এই হিংস্রতার ভাষাতেই কথা বলে। মানুষকে সন্ত্রস্ত রাখা, উদ্বেগ অনিশ্চয়তায় রাখা। রাষ্ট্রের ভাষাতেই, রাষ্ট্রকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করে রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখল করলে, যে ক্ষমতা জন্ম নেবে, সে হচ্ছে সেই ক্ষমতা যাকে সে একদা পরাস্ত করতে চেয়েছিল। সুতরাং প্রয়োজন ক্ষমতার ভাষা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা এবং অবদমনের এই ভাষা বর্জন করা। এই প্রয়োজন কোনো কৌশলের জন্য নয়, নিজের শান্তির জন্য, স্বস্তির জন্য, সমাজ-সংসারের সুস্থিতির জন্য, পৃথিবীটাকে বসবাসযোগ্য রাখার জন্য।
যদি কিছু দেওয়ার থাকে, সুন্দর করে দেবে। শ্রদ্ধার সঙ্গে দেবে।
লজ্জার সঙ্গে দেবে। ভয়ে ভয়ে দেবে।
বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ
শ্রী অনুপম পাল
‘এই সময়’ দৈনিক সংবাদপত্র
জানুয়ারি ২০১৪
(সংক্ষেপিত)
আমি কি আগ্রহী তেমন কোনো ভাবনায়। আজ বা বিগত কোনো সময়কালে, সময়জুড়ে। যে আমি জন্ম নিয়েছি, এই বাংলায় - বাংলা ও বাঙালি পরিচয়ের সময় বা ভৌগোলিক সীমা-পরিসীমা বা নৃতাত্ত্বিক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও ব্যাপ্ত বিতর্কিত পরিসর এড়িয়ে - ইংরাজি ঊনবিংশ শতাব্দীর সময়কালে?
অস্থির সে সময়ও। অস্থির আজও। অবশ্যই ভিন্ন অস্থিরতার প্রকৃতি ও বিন্যাস, ভিন্ন পরিমাণ ও গুণগত মান। অস্থির - স্থির - অস্থির এমনটাই কি অতিক্রমণ পথ? নাকি সে পথের অনতিপূর্ব আদিতে ছিল কোনো এক স্থিরতা।
অবশ্য আদি অন্তহীন। স্থির বা অস্থিরতা সেও এক আপাত অবস্থান। সময় সাপেক্ষ অবস্থান।
সময় ও অবস্থান সাপেক্ষেই আমার চেতনা।
অংশত তর্কাতীত না হলেও, সত্য, চেতনা সাপেক্ষ। চেতনার রঙে পান্না হয় সবুজ।
সত্য স্রষ্টা নিরপেক্ষ নয়। স্রষ্টার চেতনায় সত্য নিরূপিত হয়। বিংশ শতাব্দীতে উচ্চারিত হয়, বস্তুর দ্বৈত অবস্থান। এমনকি নিশ্চিত জানার সম্ভাবনায়ও ছেদ পড়ে। ‘আমি জানি না কেননা আমার জ্ঞান-জগৎ সীমাবদ্ধ’, এই বাক্যবন্ধের সঙ্গে আজ উচ্চারিত, ‘জানা সম্ভব নয়’ এই সত্য বাক্যটিও।
‘কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্তে ইলেকট্রনের অবস্থান ও ভরবেগ একই সঙ্গে নিশ্চিতরূপে বলা অসম্ভব’। কথাটা অবশ্যই ভৌতবিজ্ঞানের। অনু পরমাণু কণা তরঙ্গ বস্তু শক্তি সম্পর্কিত অন্বেষণে। কিন্তু এইসব উদ্ভাবনে সমাজ-সংগঠনে সচলতা বেড়েছে গুণিতকে, বেড়েছে তার ক্রিয়াশীলতা। সমাজ-বিজ্ঞান অনুসন্ধানেও অপরিসীম তার প্রভাব। উৎপাদিকা শক্তির অভূতপূর্ব ক্রিয়াশীলতা উৎপাদন সম্পর্কের পূর্বতন ধ্যান-ধারণায় জিজ্ঞাসা এনেছে।
এমনকি পরিবর্তন এসেছে চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার সম্পর্কেও। আমার ‘চাহিদা’ এখন আর শুধু ‘আমার প্রয়োজন’ ভিত্তিক নয়। ‘উৎপাদিকা শক্তি’র ক্রিয়াশীলতায় এবং ‘পুঁজি’র ‘নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায়’ ‘বাজার’ সজ্জিত নব নব ‘উদ্ভাবিত পণ্যে’। ‘প্রয়োজন’ নির্মিত হচ্ছে। এবং অবশ্যই চাহিদাও। চাহিদার নির্মাণ অধিকাংশ সময়েই প্রয়োজন ও সামর্থ্যের সঙ্গে সংগতিবিহীন। সদালভ্য ‘উদ্ভাবিত পণ্যে’র বিপুল সম্ভার-সজ্জায় আকর্ষিত মানবমন বা ‘বিহেভিয়ারাল প্যাটার্ন’ ‘প্রয়োজন-সামর্থ্য’র বা মেটিরিয়াল সায়েন্সের ‘গাণিতিক ও লজিক্যাল’ সম্ভাবনাসূত্রের আধারে ‘বিধৃত’ নয়। ‘লিপ্সা লুব্ধতা প্রলোভন’। মায়ামুকুরে বিম্বিত ‘আমি’, আমার ‘অপর’। ব্যাপক ‘অনিশ্চয়তা’। যদিও একদা নিউটনের গতিশক্তি সম্পর্কীয় সূত্রের প্রভাব লক্ষিত হয়েছিল, ‘সমাজতন্ত্রের এবং সাম্যবাদের’ ‘নিশ্চয়তা’ ঘোষণায়, সমাজতন্ত্র আর সাম্যবাদে উত্তরণ ঘোষিত হয়েছিল, ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা-অবস্থান নিরপেক্ষে, সেই স্বপ্ন-উচ্চারণ-কথা আজ অপসৃয়মান।
আজ ‘প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি’র ‘সম্ভাবনা-আশঙ্কা’য় দোদুল্যমান জীবন-যাপন।
সংবেদী, সুবেদী, অনুভূতিপ্রবণ মনন অবিরাম ক্ষরণাক্রান্ত।
এক ‘বিপন্নতা”।
বাস্তব আর সত্য সবসময় এক, এমনটা নয়। বস্তুবাদী দার্শনিকের প্রজ্ঞায়ও, যা বাস্তব তাই সত্য নয়। যা সত্য তা সর্বদাই বাস্তব। বাস্তব অস্তিত্বের চেতনা নির্ভর। অন্যদিকে আবার আমার চেতনাই আমার অস্তিত্বের বোধ নির্মাণ করে। অস্তিত্ব যখন পরিবর্তনশীল সামগ্রিকতায় সম্পর্কিত, অস্তিত্বের অনুভবও ‘সচল’। সচল আমার অবস্থান। চেতনা, অবস্থান নির্ভর। জ্ঞান নির্ভর। জ্ঞান, স্রষ্টার সঞ্চিত/অবহিত/অর্জিত/ আরোহিত ‘জ্ঞাপন’ নির্ভর। জ্ঞাপন সংশ্লেষণের ক্ষমতা নির্ভর। ‘সংশ্লেষণ সক্ষমতা ব্যক্তির ‘মানসিক সচলতা’ নির্ভর। ‘জ্ঞাপন - জ্ঞান - প্রজ্ঞা’র সতত ক্রিয়াশীলতায়, মনন- উদ্ঘাটিত করে চলে ‘সত্য’র ‘সাময়িক স্থিতি’ থেকে ‘অনন্ত অখণ্ড স্থিতি’ সম্ভাবনা। অনন্ত অখণ্ডের অর্জন অসম্ভব। অনন্তে, ইনফাইনিটিতে ধাবন সম্ভব, পৌঁছানো সম্ভব নয়। ট্রেন্ডস টু ইনফাইনিটি, বাট নেভার ইক্যোয়াল টু ইনফাইনিটি।
সত্য শেষাবধি অধরা। অব্যক্ত।
‘সত্য’র ‘সাময়িক স্থিতি’, ‘রিফ্লেকটিভ ট্রুথ’, ‘প্রাতিভাসিক সত্য ।
শেষ কথা আমি বলি না। শেষ কথা আমি জানি না। ‘সত্য’র ‘সাময়িক স্থিতি’বা ‘রিফ্লেকটিভ ট্রুথ’য়ের আধারেই আমার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া।
২
ব্রিটিশ রাজত্বে ভারতে বার বার দুর্ভিক্ষ হয়েছে এবং সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলা। পলাশী যুদ্ধের পরপরই ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ। মারা যান অন্ততপক্ষে ১ কোটি মানুষ। বাংলার জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। মোগল শাসনে খাজনা ছিল কৃষিপণ্য উৎপাদনের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খাজনা আদায়ের স্বত্ব নেওয়ার পর ৫০ ভাগ খাজনা বাড়িয়ে দেয়। ১৭৭১ সালে দুর্ভিক্ষ চলাকালীনও খাজনা বেড়েছিল। খাজনা বেড়েছিল শুধু নয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কৃষকদের বাধ্য করেছিল নীল, পোস্ত ইত্যাদি ক্যাশ ক্রপ উৎপাদনে। ধান নয়। ঘরে, ক্ষেতে কোথাও অন্ন ছিল না। বড়সড় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল এরপর সে দশকেই; ১৭৮৩ ৷
পলাশী পরবর্তীকালে বাংলার বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ইউরোপীয়দের, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ তিন দশকে, বাংলার অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে ঔপনিবেশিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হতে থাকে। ইংল্যান্ডের অর্থনীতির স্বার্থে এদেশ থেকে একে একে রেশমবস্ত্র, সুতো, মাঝারি ও মোটা কাপড় রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। শিল্পবিপ্লবোত্তর ইংল্যান্ডের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের বাজার হয়ে যায়, আমার বাংলা। খাদ্য শস্য উৎপাদন কমাতে কৃষকদের বিভিন্নভাবে বাধ্য করে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কৃষিপণ্যের উৎপাদন, তৈলবীজ, পাট, শন, বাদাম, আখ, তুলো, নীল, আফিম।
কৃষিপণ্যের এই বাজার, শুধু ইংল্যাণ্ডের প্রয়োজনীয় কাঁচামালই জোগায় না, কলকাতার ব্রিটিশ শাসন নির্ভর ‘বাবু’ শ্রেণির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও সূচনা করে। ‘ভদ্র’ শ্রেণির, বঙ্গ-সংস্কৃতির এক নতুন নির্মাণও শুরু সেই সময়। শুরু অবশ্য সংস্কার আন্দোলনেরও। এবং বাংলা সমাজ গঠনে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত এড়াতে ব্রিটিশ শক্তি/ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, সেই সময় আইন-আদালত বা সরকারি অনেক দপ্তরেই কাজকর্ম ফারসি ভাষাতেই চালু রেখেছিল। এমনকি হেস্টিংসের উদ্যোগে, কোম্পানির আর্থিক আনুকূল্যে ১৭৮১ সালে আরবি-ফারসি ভাষা শেখার জন্য ‘কলকাতা মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠা হয়। পরে, হিন্দুদের জন্যে ভারততত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্যে ১৭৮৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি।
স্পেনের রানি ইসাবেলার কাছে কলম্বাসের মতোই বা তার চেয়েও বেশি প্রয়োজনীয় ছিলেন আন্তোনিও দ্য নেব্রিহা। তিনি জমা দিয়েছিলেন একটি ব্যাকরণ বইয়ের প্রকল্প। বই পড়ে প্রজারা যেন রানির হুকুমের ভাষা বুঝতে পারে, উত্তর দিতে পারে সেই ভাষাতেই।
একই প্রয়োজন কোম্পানিরও। কোম্পানির প্রয়োজন, ইংল্যাণ্ডের শিল্পের জন্যে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের স্থানীয় এজেন্ট, যারা উৎপাদনকারীদের সঙ্গে কোম্পানির যোগাযোগ রাখবে। এজেন্টদের জানা দরকার অন্তত কাজ চালানো ইংরেজি ভাষা। জানা দরকার কোম্পানির হুকুমের ভাষা। জানা দরকার এজেন্টদের ‘উত্তর দেওয়ার আদব-কায়দা’।
ব্রিটিশ বিশ্বাস করতে পারেনি, মুসলমান জনগোষ্ঠীকে। এক, দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে চলা জেরুজালেম দখলের ‘খ্রিস্টান-মুসলমান সংঘর্ষের’ ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড-স্মৃতি ও দুই, মুসলমান শাসকদের হাত থেকে সদ্য সাম্রাজ্যের দখল নেওয়ায়, আহত ও ক্রুদ্ধ ধর্মীয় অনুগত মুসলমান সম্প্রদায়ের খ্রিস্টান বিরোধিতা।
এজেন্ট দরকার হয়ে পড়ল মুখ্যত হিন্দু সমাজ থেকে। আবার হিন্দু সমাজ থেকেও দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব প্রমুখ দেশীয় অভিজাতদেরও দাবি ছিল, ইংরাজি শেখার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। ১৮১৭ সালে গড়ে উঠল, হিন্দু সমাজপতিদের উদ্যোগে, ‘হিন্দু কলেজ’। নিষিদ্ধ, অ-হিন্দুদের প্রবেশাধিকার।
কোম্পানির প্রয়োজন এক অনুকূল জনগোষ্ঠীর আনুগত্য সুতরাং, ১৮২৪ সালে, কোম্পানির উদ্যোগে বর্ণহিন্দু ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য সমাজের সংস্কৃত শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হলো, ‘সংস্কৃত কলেজ’। ১৮৩৫ সালে মেকলে জানালেন তাঁর পরিকল্পনা কথা, শিক্ষার যাবতীয় উদ্দেশ্য-কথা, সার কথা।
We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern - a class of persons Indian in blood and colour, but English in tastes, in opinions, in morals and in intellect.
শাসক, তার শাসনাধীন জনজাতিকে অধীনস্থ রাখার জন্যে, এক, একাধিক, যত পরিকল্পনাই গ্রহণ করুক না কেন, শাসিত মানুষজন তার মধ্য দিয়েও নিজস্ব মৌলিক চিন্তাধারার ব্যাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হয়।
১৮৪৯ সালে প্রকাশিত হল মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের শিশুশিক্ষা, ১৮৫৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয়। মুদ্রিত হল এই দুই পণ্ডিত বন্ধুর যৌথ মালিকানায় ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ মুদ্রণাগারে। অপরিসীম ছিল এই দুই পুস্তক ও মুদ্রণ যন্ত্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব। শুরু শিশুশিক্ষায় বাঙালি-হিন্দুর জীবনবেদ,
লেখাপড়া করে যেই
গাড়িঘোড়া চড়ে সেই।
চ্যুতি ঘটল, কৃষিভিত্তিক বাঙালি সমাজের সঙ্গে, বিদ্যা-শিক্ষার। ভেদ বাড়ল, গ্রাম-শহরের। উপেক্ষিত হল, গ্রাম। গুণের বিচার, অবস্থার বিচার, অবস্থানের বিচার, সব কিছুই ‘গোপালে-রাখালে’ ঊর্ধ্ব কমাবেষ্টিত হল। ভালো-মন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গল, সাদা-কালো। ‘চিহ্নক ও চিহ্নিত’ সবসময়ই ‘বাইনারি ডিভিশন’ আবদ্ধ।
শিক্ষা-বিস্তারে, কোম্পানির আগ্রহ-আতিশয্য বাঙালি-মুসলমান সমাজকে কোম্পানি-অভিজাত হিন্দু সমাজ সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলল। বাঙালি-মুসলমান সমাজের আপত্তি ছিল, ইংরেজি শিক্ষায়। এর সঙ্গে যুক্ত হল, ‘হিন্দু কলেজ’ নামকরণে এবং সেখানে অ-হিন্দুদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ঘোষণায়।
১৮৫৩’য় রেলগাড়ি। ১৮৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আর্ট কলেজ। এরই মধ্যে ১৮৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেথুন স্কুল, শুরুতে নাম ছিল ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল। বছর কুড়ির মধ্যেই, স্কুলে ছাত্রী পাওয়া যাচ্ছিল না। অভিভাবকদের উদ্দীপনা তখন স্তিমিত। অথচ ১৮৯৩ সালে মহাকালী পাঠশালা শুরু হয় ৩০ জন ছাত্রী নিয়ে। ১৯০৩ সালে সেই মহাকালী পাঠশালার ছাত্রী সংখ্যা ৪৫০। মহাকালী পাঠশালার প্রতিষ্ঠাত্রী মাতাজী মহারাণী তপস্বিনী। তাঁর শিক্ষাদর্শে মেয়েদের পড়ানো হত সাধ্বী সমাচার, শিব পূজা পদ্ধতি এবং এই ধরনের নানান বই। মাতাজীর শিক্ষাদর্শ কলকাতার সমাজে যথেষ্টই গ্রহণীয় হয়েছিল, এমনকি বিবেকানন্দেরও শংসাপত্র পেয়েছিল এই পাঠশালা। কেননা তাঁর মতে এই শিক্ষাদর্শ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এ এক বিভ্রান্তিকর অবস্থা। সাধ্বী সমাচার, শিব পূজা পদ্ধতি, এই ধরনের পুস্তক পাঠ্যসূচিতে না থাকায়, অভিভাবকেরা তাঁদের কন্যাদের বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন না এবং জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য বোধ হচ্ছে সাধ্বী সমাচার, শিব পূজা পদ্ধতি। জাতীয়তাবাদ রূপ নিচ্ছে হিন্দু-জাতীয়তাবাদের। ‘অ-হিন্দুদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ!
এমন সময়েই, অক্টোবর, ১৯০৩ সালে ‘মীর মশাররফ হোসেন প্রণীত ও ‘কলিকাতা-টালিগঞ্জ হইতে শ্রী মীর এব্রাহিম হোসেন দ্বারা প্রকাশিত হয়, মুসলমানের বাংলা শিক্ষা, প্রথম ভাগ। বইটির আরম্ভ-পাঠ,
আল্লা এক
আল্লা সকলের বড়
আল্লার কোন দোষ নাই। কোন বদনাম নাই।
বর্ণপরিচয়ে ঈশ্বর নেই। ঈশ্বর অনুপস্থিত। শিশুশিক্ষায় সনাতন হিন্দু ধর্মীয় অনুশাসন অনুপস্থিত, অন্যদিকে মুসলমান সম্প্রদায়ে পুস্তক শুরুই হচ্ছে ‘আল্লা’র অস্তিত্ব বর্ণনে।
সম্প্রদায়গত বিভাজন না স্বতন্ত্র অস্তিত্বের উদযাপন?
ইংরেজ বিদ্বেষ, হিন্দু অভিজাতদের প্রতি বিদ্বেষ একটি জনগোষ্ঠীকে নিজস্ব কুঠুরিতে ঢুকিয়ে দিল। সমাজ ও ধর্মীয় সংস্কার-আন্দোলনে ‘এনলাইটেনড’ ব্যক্তি-মানুষের উপস্থিতির অভাব প্রকট। হয়ত খানিকটা সরলীকৃত, তবু এমন একটি অনুমান করা অসঙ্গত হবে না যে, সংস্কার আন্দোলনের প্রাবল্য যদি থাকত, শিকড়ে যদি যত্নবান হত মুসলমান সমাজ তাহলে হয়ত সামাজিক বিধিনিষেধে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হত না। যেমনটি ঘটল তিন তালাকের ক্ষেত্রে।
সুপ্রীম কোর্ট, ২২ আগস্ট, ২০১৭, মুসলিম মহিলাদের বিবাহোত্তর অধিকার সুনিশ্চিত করতে, জানিয়েছে, সুন্নি মুসলিমদের তিন ভালাক বা তালাক-ই-বিদ্দত অসাংবিধানিক, অবৈধ এবং ১৪০০ বছর ধরে চলে আসা এই তাৎক্ষণিক তালাক প্রথা কোরাণের অংশও নয়। বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড । তাদের যুক্তি, মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করতে পারে না কোর্ট বা সরকার। পারে কিংবা পারে না, এমন প্রশ্ন ওঠার সঙ্গত যুক্তি থাকলেও কোনো প্রথা যদি ‘কু’ হয়, ব্যক্তি মানুষের মর্যাদা হানিকর হয়, তার বিলোপ কাম্য। এর আগে, হিন্দুদের দেবদাসী প্রথা বিলোপে তেমন কোনো আন্দোলন, সামাজিক আন্দোলন, হিন্দু সমাজের মধ্যে গড়ে না ওঠায়, কোর্টের হস্তক্ষেপে আইন করেই বন্ধ করতে হয়েছিল সেই ‘কুপ্রথা’।
৩
‘কু’প্রথার, কুকথার বিরুদ্ধতায় আমার, আমারই সরব হওয়ার কথা ছিল। হইনি। মূলত, ‘রাষ্ট্র’ বা ‘শাসক’ নির্ভরতায় থেকেছি নিশ্চিন্ত। কে জানে, আমার এই বোধ সঞ্চারিত হয়েছে কিনা, সেইদিন থেকে, যেদিন, আমি/ আমরা, আমাদের সমাজ, আমাদের কৃষ্টি, আমাদের দেশ যারা দখল করল, লুঠ করল, তাদেরকেই পরিত্রাতা ভেবে, তাদের কাছে সমর্পণ করলাম নিজেকে, নিজেদেরকে! সেদিন, নিজেদের উদ্যোগে আমাদের নিজস্ব কৃষ্টির সংস্কৃতায়নে তৎপর হতাম যদি, বাঙালি সমাজ এমনভাবে জাতপাত-ধর্মে বিভক্ত হয়ে যেত না। কেমন ভাবে যেন মেতে উঠলাম - এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক ভৌগোলিক অখণ্ডতার ইউরোপীয় তত্ত্বে। হিন্দু-মুসলমান ‘দ্বিজাতি’ তত্ত্বের ভিত্তি আমাদের মানস জগতেই যদি প্রোথিত না হতো, শাসকেরা বিচ্ছিন্ন করতে পারত না আমাদের।
বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম আমরা, বিচ্ছিন্ন করেছিলাম আমরা নিজেদেরকে, ‘চিড়’কে করেছিলাম ফাটল, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্যে, বৈশ্যে, শূদ্রে; উচ্চবর্ণে, দলিতে; হিন্দু, মুসলমানে। শিক্ষিতে, অশিক্ষিতে; প্রাচ্যে, পাশ্চাত্যে।
আমাদের ছিল মঙ্গলকাব্য। পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চারশো বছর ধরে রচিত। বিশেষ কোন যুগের রাজনৈতিক চেতনা এর মধ্যে আছে, এমনটি অবশ্য নয়। অনুমান করা যায়, মঙ্গলকাব্যের কাহিনী পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বেই গড়ে উঠেছিল। কাহিনীর মধ্যে ছিল অতীত ঘটনার চিত্রণ।
চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাংলার সংস্কৃতিতে এনেছিল অভাবনীয় সব পরিবর্তন। মানবতার প্রতি গৌরববোধ বেড়েছিল, দৈবশক্তিতে মানুষের আস্থা কমে এসেছিল। সপ্তদশ অষ্টাদশ শতাব্দীর কাব্যে ধরা পড়েছিল বাঙালির এই মানস পরিবর্তন। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব মঙ্গলকাব্যের আন্তঃধর্মে কোন পরিবর্তন আনতে না পারলেও সপ্তদশ অষ্টাদশ শতক দেবতায় সংশয় এবং অবিশ্বাসের সময়কাল।
ব্রাহ্মণ সন্তানেরাও তাদের পূর্ব সংস্কার ও আভিজাত্য গৌরব সরিয়ে রেখে অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের দেবতার মাহাত্ম্য কীর্তনে এগিয়ে এসেছেন। ধর্মমঙ্গলের কবি কাব্য রচনায় ধর্মঠাকুরের স্বপ্নাদেশের কথা নয়, গুণগান করেছেন বর্ধমান-রাজ কীর্তিচন্দ্রের। ভারতচন্দ্র, কৃষ্ণচন্দ্রের।
দৈব নির্ভরতা থেকে মানস মুক্তির নিদর্শন। এই পর্বে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সংযোজন ময়মনসিংহ গীতিকা। এই গীতিকাব্যে গীতিকা ও ছড়ার রচনাকাল ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দী। পূর্ব ময়মনসিংহে সেনরাজ প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের এবং সংস্কৃত শাস্ত্রের প্রভাব বা আনুগত্য ছিল প্রায় অনুপস্থিত। এই অঞ্চল স্বীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে এসেছে। রাজারা তাদের রাজত্ব চালাতেন হিন্দু ধর্মের প্রাচীন আদর্শে। সেই হিন্দু ধর্ম ছিল বৌদ্ধ কর্মবাদ ও হিন্দু নিষ্ঠার মিশ্রণ। কাব্যের নায়ক-নায়িকারা বেনে, সদগোপ, বৈশ্য, ব্যাধ, এমনকি ডোম জাতীয় । ব্রাহ্মণের টোলে বেনে ধর্মশাস্ত্র পড়ছে, গন্ধবেনে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে গলাধাক্কা দিয়ে সদর দরজা দিয়ে বার করে দিচ্ছে। যজন যাজন ও যজ্ঞের সময়েই যজ্ঞোপবীতের প্রয়োজন হত, পৈতা ব্রাহ্মণের অপরিহার্য অঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়নি। কোথাও যাওয়ার সময় উত্তরীয় ও উপবীত উভয়ই পোশাকি দ্রব্যের মতো খুঁজে বের করে পরতে হত।
ময়মনসিংহ গীতিকায় গৌরীদান প্রথা নেই। এমনকি সতেরো বছর বয়সী মেয়েদেরও অবিবাহিত দেখা যেত। এই পর্যায়ে আমরা পেলাম বাংলা ভাষা, সমাজের স্বরূপ। বহু শতাব্দী কাল পাশাপাশি বাস করার জন্য হিন্দু ও মুসলমানের ভাষা এক সাধারণ সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত বঙ্গবাসীর ভাষা। জাতিভেদ নেই। লেখকদের মধ্যে হিন্দুও আছেন, মুসলমান লেখকও সমপরিমাণ। এই সাহিত্যে হিন্দু নায়ক, মুসলমান নায়িকা; মুসলমান নায়ক, হিন্দু নায়িকা।
বাংলা ভাষাটাই প্রাকৃতের রূপভেদ। টোলের পণ্ডিতরা অপর্যাপ্ত সংস্কৃত শব্দ ঢুকিয়ে ভাষার রূপ বদলে দিতে চেয়েছিলেন। খাজনা হল, রাজস্ব। ইজ্জত, সম্মান। জবরদস্তি, বলপ্রয়োগ। দুস্তি, বান্ধবতা। জমি, মৃত্তিকা। বাস্যা, বর্ষা। মিডা, মিষ্টি। শাওন হল শ্রাবণ। আশমান, আকাশ। এমন শত শত শব্দ বাংলার আবহাওয়াতে দেশীয় রূপ ধারণ করেছিল। সে ঐতিহ্য অবহেলা করলাম।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এজেন্ট হওয়া ছিল অনেক লোভনীয়। সে দালালির পয়সায় রোজগারের টাকায় কলকাতা তখন কল্লোলিনী। অকর্মণ্য অলাল আলালদের বাবুগিরি, আবদেরে দুলালদের দুঃসহ ইতরামি।
অন্যদিকে, যে বাংলা থেকে একসময় কম করেও ৭০টি শিল্প দ্রব্য এবং ১০০টিরও বেশি কৃষিদ্রব্য ভারতের অন্যান্য অঞ্চল, এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকার নানান বাজারে রপ্তানি হতো, যে বাংলা ছিল ব্যবসায় উদ্বৃত্ত অঞ্চল - রূপো ও অন্যান্য দামী ধাতুর বিনিময়ে পণ্য কিনতে হতো বিদেশীদের, সেখানে অন্নের হাহাকার, দুর্ভিক্ষ।
বৃহত্তর বাংলার ত্রিহুত থেকে নাটোর পর্যন্ত ১ লক্ষ ৫৫ হাজার গ্রামে মৌখিক ও পাঠশালা মাদ্রাসা ভিত্তিক প্রায় ১ লক্ষ পাঠশালা মাদ্রাসা- চালু ছিল। গ্রামের মানুষের সম্পদে চলত বিদ্যালয়। উচ্চবর্ণের গুরু ছিলেন খুব বেশি হলেও শতকরা ১৫ শতাংশ, মেয়েদেরও পাঠশালা ছিল, জমিদারেরা ছিলেন কৃষক ও কারিগর পালক, অর্থনীতি ছিল বিকেন্দ্রীভূত সব, সবই একে একে শেষ হয়ে গেল।
এবং ব্রিটিশ রাজত্বের সময়কালে শেষ বড় দুর্ভিক্ষ ১৯৪৩-৪৪। মারা গিয়েছিলেন কমপক্ষে ৩০ লক্ষ মানুষ। খাদ্য, ওষুধ সবকিছু এখান থেকে তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধরত ব্রিটিশ সেনাদের জন্য। অপ্রয়োজনেও। দুর্ভিক্ষে অনেক অনেক মারা যাচ্ছেন এমন রিপোর্টেও চার্চিল, বলেছিলেন, দুর্ভিক্ষ বা না দুর্ভিক্ষ, ভারতীয়রা ইঁদুরের মতো জন্ম দেবে।
মৃত্যু, উপেক্ষিত প্রান্তিক মানুষজনের মৃত্যু, আমাদের গা-সওয়া। ডায়েরিয়া-কলেরা-ম্যালেরিয়া-এনকেফেলাইটিস, অপুষ্টি-অনাহার বা জলে ভেসে বা সাপে কেটে মৃত্যু, এতই স্বাভাবিক যে, এক সম্প্রদায়ের মানুষ যখন সমষ্টিবদ্ধ আক্রোশে, অন্য সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তিকে, প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে খুন করছেন, খুন করছেন রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে, ব্যাপক জনসমষ্টি আন্দোলিত হচ্ছেন না তেমনভাবে, যেভাবে প্রতিবাদে সোচ্চার হলে, এমন একটিও হত্যা সংঘটিত করতে সাহস পেত না একজনও দুর্বৃত্ত।
প্রতিবাদ হচ্ছে। শহরের আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত উদ্বিগ্ন মানুষেরা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। কিন্তু ব্যাপক জনসমষ্টি আন্দোলিত হচ্ছেন না তাদের কথায়। ব্যাপক মানুষের সুখে-দুঃখে এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাদের ক্রমাগত প্রান্তিক হয়ে যাওয়া, উদ্বৃত্ত হয়ে যাওয়া, উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া ঠেকাতে, নগর সভ্যতার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত আমি, আমার সমগোত্রীয়রা তেমনভাবে উদ্বিগ্ন হইনি কোনোদিন। বরং অবজ্ঞাই করেছি। হেয় করেছি, ব্যঙ্গ করেছি তাদের যাপন, তাদের সৃষ্টি, তাদের হাট-বাজার, গান-র পালা-শিল্পকলা। তাদের আবেগ, তাদের ভালোবাসা।
‘সপ্তকোটিকণ্ঠ-কলকল-নিনাদকরালে’, উচ্চারণকালে বঙ্কিমের বাংলা তখন বেঙ্গল - সুবা বাঙ্গালা, সুবা বিহার, সুবা ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ড - ওই সাত কোটির মধ্যে কমবেশি অর্ধেক ছিল মুসলমান। এছাড়াও ছিল বিহারী, ওড়িয়া ও অন্যান্যরা। হিন্দু বাঙালি মেরেকেটে দু কোটি। এই হিন্দুরা বাঙালি মনে করতেন, তারাই একমাত্র বাঙালি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। এল কার্জনের বঙ্গভঙ্গ। গঠিত হ’ল পূর্ববঙ্গ আর অসম নিয়ে মুসলমান প্রধান এক প্রদেশ।
রাখীবন্ধন। রবীন্দ্রনাথ। বাঙালি হিন্দু-মুসলমান এক জাতি। সোনার বাংলা দুই সম্প্রদায়েরই মাতৃভূমি। সবুজপত্র। প্রমথ চৌধুরীর ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবোধ, দেশভিত্তিক জাতীয়তাবোধ। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায়, নজরুলের ‘বিদ্রোহী’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্রদের, বাঙালি মুসলমান সমিতি। ‘শিখা’। বাঙালি জাতীয়তাবোধের পত্রিকা। কাজী আবদুর ওদুদ। কাজী মোতাহের হোসেন। কলকাতার পত্রিকা, ‘বুলবুল’। সম্পাদক, বেগম শামসুল নাহার আর হবীবুল্লাহ বাহার।
তবু দাঙ্গা! ১৯৪৬’র কলকাতাতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় খুন হয়েছিলেন ১০,০০০ মানুষ। ১৯৮০’র ভিওয়ান্দি দাঙ্গায় ২৫০; ১৯৮০’র মোরাদাবাদ দাঙ্গায় ৪০০; আসামের বাঙালি খেদাও আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৮৩’র ১৮ ফেব্রুয়ারি আসামের নেলী হত্যাকাণ্ডে সরকারি হিসেবে ২১৯১ জন আর বেসরকারি হিসেবে প্রায় দশ হাজার মুসলিম ধর্মাবলম্বী বাঙালি হত্যা, ১৯৮৪’র শিখ বিরোধী দাঙ্গায় ২৮০০-৩০০০, এক দিল্লিতেই ২১০০; ১৯৮৯’র ভাগলপুর দাঙ্গায় ১০০০; ১৯৮১’র কাশ্মীর দাঙ্গায় কেউ মারা যাননি ঠিকই, কিন্তু হাজারেরও বেশি মসজিদ থেকে চিৎকৃত ভাষণ আর কালানিশভ রাইফেল কাঁধে হিন্দু পণ্ডিত এলাকায় ক্রমাগত টহলে হিন্দু পণ্ডিতদের নেমে যেতে হয়েছিল জম্মুতে; ২০০২’র গুজরাট আমেদাবাদ দাঙ্গার ৩ দিনেই কয়েক হাজার মুসলমান মানুষ খুন হয়েছিলেন, রাজ্য-রাজধানীর অস্থায়ী শিবিরেই আশ্রয় নিতে হয়েছিল ১,১০,০০০ মানুষজনকে। তারপরও ২০০৬’র রামনবমীর দিনে আলিগড় দাঙ্গা; ২০১৩’র মুজফফরপুর দাঙ্গা। এবং আরো অনেক ধর্মীয় অসম্প্রীতির ত্রাস-সন্ত্রাস। ত্রস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত মূলত মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন।
৪
এখন, এই সময়ে, ঘটমান হিন্দু-মুসলমান অসম্প্রীতিতে, আর দাঙ্গায়, কোথাও যেন মস্ত বড় এক তফাৎ। মহম্মদ এখলাক থেকে জুনাইদ খান, আনোয়ার হোসেন হাফিজুল শেখরা দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, বাংলা -- খুন হলেন, খুন হলেন যখন, স্থানীয় এলাকাগত উত্তেজনা, অসম্প্রীতির সলতে পাকানোর স্থির শান্ত হিসহিসানি, ব্যক্তিমানুষকে মুণ্ডহীন সমষ্টিতে চালিত করা, ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধি, সম্পত্তি লুঠ ইত্যাদি প্রভৃতি প্রায় অনুপস্থিত।
বরং লক্ষণীয়, মতাদর্শগত কোনো এক সবিশেষ অভিব্যক্তির প্রায়োগিক রূপ। ডিএনএ পরীক্ষায় যারা ভারতীয় বলে গণ্য হবে না তাদের ভোটাধিকার থাকবে না।
এখন সুসময়। আমরা সবাই হিন্দু।
আমরা হিন্দু। আমরা ভারতবাসী। স্বচ্ছ ভারত গড়ে তুলতে এগিয়ে আসুন। মৌলবাদী জেহাদিদের বিতাড়নের জন্য আরএসএস-এর সভায় যোগ দিন। বিজেপির সদস্য হোন।
ওরা মুসলমান। ওরা মৌলবাদী। জেহাদি। অনুপ্রবেশকারী।
অথচ, ব্রিটিশ ‘ভারত ছাড়ো’, শ্লোগানের নির্মাতা ও প্রস্তাবক, সেই সময়কার মুম্বইয়ের মেয়র ইউসুফ মেহের আলি। গান্ধী, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা করেন ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট, মুম্বইয়ের গোয়ালিকা ট্যাঙ্ক ময়দানে। আওয়াজ তুলেছিলেন, ‘ডু অর ডাই’।
১৯২৮ সালে সাইমন গো ব্যাক শ্লোগানটিও ইউসুফ মেহের আলির। এ ছাড়াও জয়হিন্দ শ্লোগানটি তুলেছিলেন আবিদ হাসান সাফরানি। ইনকিলাব জিন্দাবাদ শ্লোগান মাওলানা হসরত মহানির। ইকবালের সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্থাঁ হামারা, এমনকি জাতীয় পতাকায় তিন রঙ সুরাইয়া তৈয়েবজির। অসংখ্য, অসংখ্য এমন সব ঘটনা।
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ অবধি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরণ রিজজুর সংসদে পেশ করা তথ্যানুযায়ী ২০১৭ সালে সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির মোট ঘটনা ঘটেছে ২১৬টি, মারা গেছেন ৪৪ জন।
মানুষের স্বাধীন মতামতের ওপর নিষেধাজ্ঞা নতুন নয়। ১৯৭০-এর দশকে জরুরি অবস্থা, ১৯৮১ সালে স্যাটানিক ভার্সেস নিষিদ্ধ করা, কয়েক বছর বাদেই এম এফ হুসেনকে মানুষের ধর্মানুভূতিকে আঘাত করা, ছবিতে অশ্লীলতা ইত্যাদির অভিযোগে অভিযুক্ত করা বা ২০১২ সালে রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট অসীম ত্রিবেদীর কারাদণ্ড, শাসকের সামগ্রিক অবস্থান বহির্ভূত বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
সত্য নির্মিত হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে নিয়ে তৈরি পরিচালক সুমন ঘোষের এক ঘণ্টার তথ্যচিত্র ‘দি আর্গুমেনটেটিভ ইন্ডিয়ান’ সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেল না। সেন্সর বোর্ডের আপত্তি মূলত চারটি শব্দকে নিয়ে। গোরু, গুজরাট, হিন্দু ও হিন্দুত্ব। তথ্যচিত্রের একটি অংশে দাঙ্গা প্রসঙ্গে গুজরাট শব্দটি ব্যবহার করায় সেন্সর বোর্ড জানিয়েছে এখানে কোন রাজ্যের নাম করা মানে সেই রাজ্যকে অপমান করা। সুতরাং গুজরাট শব্দটিকে মিউট করে দিতে হবে। আর এক জায়গায় অমর্ত্য উচ্চারণ করেছেন, হিন্দু-ইন্ডিয়া শব্দটি। আপত্তি তুলেছে সেন্সর বোর্ড। বোর্ড জানিয়েছে হিন্দু-ইন্ডিয়া বা মুসলিম-ইন্ডিয়া শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। এ ছাড়াও ‘গোরু নিয়ে যা চলছে’ বাক্যটি থেকে গোরু শব্দটি মিউট করে দিতে হবে।
২০১১-১২’র -এনএসএসওর সমীক্ষায়, ৬ কোটি ৩৫ লক্ষ মুসলমান, ১ কোটি ২৬ লক্ষ হিন্দু, ৬৫ লক্ষ খ্রিস্টান ও ৯ লক্ষ অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষজনের খাদ্যতালিকায় গোমাংস অন্তর্ভুক্ত। ২০১৬-১৭ সালে মাংস উৎপাদনে গোরুর মাংস, শতকরা মাত্র ৫ শতাংশ। কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, অরুণাচল, মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যাণ্ড, ত্রিপুরা ও সিকিম বাদে দেশের সব রাজ্যে গোহত্যা নিষিদ্ধ।
মেঘালয় রাজ্যের ৮০.৭% মানুষজনের খাদ্য তালিকায় গোমাংস অন্তর্ভুক্ত, নাগাল্যাণ্ডের ৫৭.২%, জম্মু কাশ্মীরের ৩০.৪%, কেরালার ২৫.৩%, অসমের ২১.৭%, পশ্চিমবঙ্গের ১৮.৭%, গোয়ার ১১.১%, উত্তরাঞ্চলের ১১%, উত্তরপ্রদেশের ৯.২%, অন্ধ্রপ্রদেশের ৮.৯%, মহারাষ্ট্রের ৫.৫%, গুজরাটের ৩.৯% খাদ্য তালিকায় রয়েছে গোমাংস। দেশব্যাপী গড় ৭.৫%। (২০১১-১২’র এনএসএসও’র সমীক্ষা রিপোর্ট)
কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস (রেগুলেশন অফ লাইভ স্টক মার্কেটস) রুলস, ২০১৭, জারী করেছে ২৩ মে, ২০১৭-য়। বলা হয়েছে চাষাবাদ বাদে অন্য কোন কাজের জন্য গোরু-মোষ-বলদ-বাছুর-উট বাজার থেকে কেনাবেচা করা যাবে না। শুধুমাত্র চাষের উদ্দেশ্যেই পশু কেনা নিশ্চিত করতে হবে। পশুদের প্রতি হিংসা বন্ধের জন্যই এই আইন। পাঁঠা-ছাগল, হাঁস-মুরগি, ইত্যাদি প্রাণীকূলের হত্যা/বিক্রি নিয়ে এই আইনে বিধিনিষেধ নেই! মাছ নিয়ে কিছু লেখা নেই।
প্রশ্নটি খুব সম্ভব, ‘ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস’ নিয়ে নয়, একদা, আরএসএস-এর তাত্ত্বিক নেতা, গোবিন্দাচার্যের কথায়, ভারতীয় সংবিধান বদলাতে হবে। গোরুর অধিকার শুধু নয়, জমি জল জানোয়ার জঙ্গল এসবগুলিকেও সার্বিকভাবে দেখতে হবে। গোরু, ভারতীয় সভ্যতার প্রাথমিক ভিত্তি। তাকে রক্ষা করার অর্থ হিন্দু সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখা।
উত্তরপ্রদেশে গোহত্যা নিষিদ্ধ। অথচ মোষের মাংস রপ্তানির অন্যতম বড় বাজার ওই রাজ্য। মোষের মাংস রপ্তানিতে ভারত ২০১৫-১৬ আর্থিক বর্ষে ৪০০ কোটি ডলার মূল্যের মাংস বিক্রি করেছিল। ২০১৫-১৬ আর্থিক বর্ষে ভারত থেকে ৫৯২ কোটি ডলারের চামড়া এবং চামড়া জাত দ্রব্য রপ্তানি করা হয়েছিল।
আমাদের রাজ্যে চর্মজ পণ্যের মোট উৎপাদন ১৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রপ্তানি হয় ৬.৫ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকার। রাজ্যের অন্তত ৫ লক্ষ মানুষ ও তাদের পরিবার রুজি রোজগারের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে রয়েছেন এই চর্মশিল্পের সঙ্গে। কসাইখানা ও মাংস বেচার সঙ্গে আর কত মানুষ যুক্ত তার কোন নির্ভরযোগ্য হিসেব নেই।
স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের কৃষি অর্থনীতি। ২০১২ সালের গৃহপালিত পশুসুমারি অনুযায়ী, দেশে মোট গবাদি পশুর সংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। মোষ ১০ কোটি ৮৭ লক্ষ। ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন চাষিরা। ক্রমে গবাদি পশুভিত্তিক অর্থনীতির দিকে সরে আসছেন। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গবাদি পশুর আর্থিক অবদান এখন খাদ্যশস্যের তুলনায় বেশি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পের যে ২৫টি শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে সেই তালিকায় দ্বাদশ স্থানে রয়েছে চর্ম ও চর্মজাত পণ্য। চর্মজ পণ্য উৎপাদনে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয়। বিশ্বের মোট চর্মজ পণ্য উৎপাদনের ১২.৯৩% তৈরি হয় ভারতে। চর্মজ পণ্য উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি রপ্তানি হয়। কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে মেক ইন ইন্ডিয়ার আওতায় দেশে চর্মশিল্পের উৎপাদন ২০১৫ সালের ৮৯ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা যেন ২০২০ সালে ১.৭৮ লক্ষ কোটি টাকা হয়। ভারতে চর্ম শিল্পে যুক্ত সংস্থার ৮০ ভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। কসাই ও চর্ম শিল্প মিলিয়ে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে নিযুক্ত প্রায় ৬০ লক্ষ কর্মী।
শ্রমিকদের অধিকাংশ দলিত, নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমান হলেও ‘বিফ’ রপ্তানীতে যুক্ত বড় কোম্পানি মালিকদের বেশির ভাগই হিন্দু। সবচেয়ে বড় ও আধুনিক কসাইখানা, ‘আল কবীর এক্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড’, তেলেঙ্গানার রুদ্রক গ্রামে, ৪৫০ একর জমিতে গড়ে উঠেছে। মালিক, সতীশ সাবেরওয়াল। গত বছরে ব্যবসার পরিমাণ, ৬৫০ কোটি টাকা। উত্তরপ্রদেশের ‘আল নুর এক্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড’ -এর মালিক সুনীল সুদ। এমনই সব। প্রথম ৬ জনের ৪ জন হিন্দু।
এবং ভারত হবে হিন্দু রাষ্ট্র। গো মাতা। গো হত্যা নিষিদ্ধ। আগস্টের মাঝামাঝি ছত্তিসগড়ের দুর্গ জেলার রাজপুর গ্রামের গোশালায় কম করে ২০০টি গোরু মারা গেছে, অসুস্থ হয়ে, অনাহারে। গোশালা-রক্ষক, বিজেপি’র পদাধিকারী, হরিশ ভার্মা।
সুবাতাস বহিতেছে অন্তরে বাহিরে।
রাজস্থান হাইকোর্টে জনৈক পুনমচাঁদ ভাণ্ডারি একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন। তাঁর আবেদন ছিল, রাজস্থান সরকার পরিচালিত হিঙ্গোনিয়া গোশালায় কমপক্ষে ৮ হাজার গোরু-মোষ থাকে। গত বছর এখানে অসুস্থ হয়ে কয়েকশো গোরু মারা যায়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও অযত্ন-অবহেলার অবসানের জন্যই তিনি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
৩১ মে (২০১৭) তারিখে, এই মামলার প্রেক্ষিতে বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মা, কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ দেন, গোরুকে ভারতের জাতীয় পশু ঘোষণা করে দেওয়া উচিত। রাজস্থান সরকারকে সুপারিশ করেন, গো হত্যার সাজা ১০ বছর থেকে বাড়িয়ে যাবজ্জীবন করে দেওয়া হোক।
তিনি আরও বলেছেন, নেপাল হিন্দু রাষ্ট্র। তারা গোরুকে জাতীয় পশু ঘোষণা করেছে। এ দেশেও গোরু যাতে জাতীয় স্তরে আইনি সত্তা পায়, তার উদ্যোগ নেওয়া উচিত রাজ্য সরকারের। এনডিটিভি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মা বলেছেন, এটা তাঁর অন্তরাত্মার আওয়াজ। এর আগে তিনি জানিয়েছিলেন, গোরু ও ময়ূর দুটিই ‘পবিত্র’ জীব। দাবি করেছিলেন, ময়ূর আজীবন ব্রহ্মচারী। ময়ূরীর সঙ্গে তার যৌনমিলন হয় না। ময়ূরের চোখের জল পান করেই গর্ভবতী হয় ময়ূরী!
৫
৯/১১’র সূত্র ধরে, আমেরিকা ও তার সহযোগী রাষ্ট্রসমূহের আগ্রাসী ইসলাম-বিদ্বেষের কানাগলি এড়িয়ে, সন্ত্রাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনের সমমর্মী হয়ে, বেশ কিছু মানুষ ও সংগঠন সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী মনন সম্পর্কীয় গবেষণা শুরু করেন। ২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর, ‘পপুলার রেজিস্ট্যান্স’ পত্রিকায় জেমস.এ.লুকাস একটি দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশ করেন। নিবন্ধটি মার্চ ৭, ২০১৬ তারিখে ‘গ্লোবাল রিসার্চ’-এ পুনরায় প্রকাশিত হয়।
মুখবন্ধে লেখা হয়, ৯/১১-র পরে আমেরিকানদের মানসিকতায় যে ক্ষোভ ও মরিয়া ভাব সঞ্চারিত হয়, তার সঙ্গত কারণ রয়েছে। সে সময় কিছু মানুষ সব দিক বিচার বিবেচনা করে বলেছিলেন, আমেরিকাও অন্যান্য অনেক দেশে এমনতরো ক্ষোভ সৃষ্টির জন্যে দায়ী। ফুৎকারে মিলিয়ে গিয়েছিল এসব কথা। তখন শুধুই ‘ওয়ার অন টেররিজম’।
নিবন্ধটির উদ্দেশ্য নিয়ে বলা হয়, এতদসত্ত্বেও আমরা সারা পৃথিবীতে সহমর্মিতার প্রকাশ দেখতে চাই, সমস্ত ভুল বোঝাবুঝির অবসান চাই। আশা করি, ‘How many September 11ths has the United States caused in other nations since WW?” এই প্রশ্নটি সামনে এনে নিবন্ধটি সেই কাজটিই করবে।
নিবন্ধটির শিরোনাম, US Has Killed More Than 20 Million People in 37 ‘Victim Nations’ Since World War II। ২০ মিলিয়ন মানে ২ কোটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ২০১৫ সাল অব্দি। লেখাটিতে হিসাব দেওয়া হয়েছে, কোরিয়ান ওয়ার, ভিয়েতনাম ওয়ার আর দু দুটো ইরাক যুদ্ধেই মৃতের সংখ্যা ১ থেকে ১.৫ কোটি। কোরিয়ান যুদ্ধে মারা গেছেন চীনা মানুষজনও এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে কাম্বোডিয়া ও লাওসের অধিবাসীরাও।
সরাসরি যুদ্ধ না করেও ‘প্রক্সি ওয়ার’ চালিয়ে গেছে আমেরিকা। আফগানিস্তান, অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো, ইস্ট টিমোর, গুয়াতেমালা, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান এবং সুদানে মারা গেছেন ১০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ১৪ লক্ষ মানুষ। বিশ্বের প্রায় সমস্ত প্রান্তেই আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি। কোথায় নেই! গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অজুহাতে, সারা বিশ্বে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে, কোথাও একা, কোথাও বা ন্যাটোর বাহিনি নিয়ে প্রাকৃতিক আর খনিজ সম্পদ আত্মস্থ করতে সর্বত্রই তার অবাধ ধ্বংসলীলা।
এদের মিলিত তাণ্ডবে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা চলে গেলেন। চলে গেলেন যাঁরা তাঁদের মৃত্যু সাধারণ বয়সকালের মৃত্যু নয়; অসময়ে রক্তাক্ত হয়ে মৃত্যু। আমার, আমাদের মতো এঁরাও সবাই বাঁচতে চেয়েছিলেন। আমেরিকা রাষ্ট্র এদের বাঁচতে দেয়নি। বাঁচতে দেয়নি ‘সভ্য’, ‘উন্নত’,‘সমরাস্ত্র সজ্জিত’ ইউরোপ, আমেরিকা। গণতন্ত্র সংজ্ঞায়িত তাদের প্রয়োজনের মাপে। গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে ইরানে যে গণ অভ্যুত্থানের কথা শুনিয়েছিল আমেরিকা, আমাদের সংবাদ-মাধ্যমগুলো - এতদিন জানা গেল, সেই অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছিল আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ!
আধিপত্য বিস্তারে পিছিয়ে নেই কেউ। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত দলিলপত্র সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পোলাণ্ড ১৯৪০ সাল থেকে দাবি করে আসছিল, সোভিয়েতের কাতিন বনাঞ্চলে বহু সংখ্যক পোলিশ মানুষজনকে হত্যা করা হয়েছে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি বরাবরই এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে এসেছে। প্রকাশিত দলিলাদি থেকে জানা গেল, ১৯৪০ সালের ৩ এপ্রিলের পর ২১,৮৫৭ জন পোলিশ নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল।
এমন সব নারকীয় খুন, জখম, হত্যার পরও যাঁরা বেঁচে রইলেন সেই সব পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন, পাড়া-পড়শি-বেঁচে রইলেন কেউ কেউ অশক্ত অথর্ব হয়ে, তাঁরা কী চাইলেন! কী চোখে দেখলেন প্রতিটি ভোর, প্রতিটি আঁধার! কোন সে বিশ্বাস ধারণ করে রইলেন তাঁরা! জাগ্রত থাকলেন তাঁরা, স্পর্শে, ঘ্রাণে কোন সে সত্য নিয়ে!
সত্যিই তো সেই সত্য আমি ভাবতে চাই না, দেখতে চাই না। আমি শুনতে চাই না লক্ষ মানুষের গোঙানি, স্ফুট হতে থাকা তাদের বাক, তাদের ভাষা।
এ কী ভয়াবহ এক সত্যের মুখোমুখী আমি!
৬
এ আমার ঘরের কথা নয়।
কিংবা এ আমারই ঘরের কথা। আমি তো বিশ্বায়ন চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম বিশ্ব নাগরিক হতে। আমি চেয়েছিলাম সীমান্তবিহীন এক গোটা পৃথিবী। আমার সামর্থের বাইরে গিয়েই গড়তে চেয়েছিলাম সে পৃথিবী।
আমি ঢালিব করুণাধারা,
আমি ভাঙিব পাষাণকারা,
আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
আকুল পাগল-পারা।
আমি, আমার বাস্তবতায় ছিল, রাষ্ট্রহীন এক বিশ্ব! আমি বর্তমান খুঁজেছি, ভবিষ্যতের স্বপ্নালোকে। আর অন্যদিকে লাখো লাখো মানুষ চেয়েছেন এক নিশ্চিত বর্তমান। স্বপ্ন দেখেছেন ভবিষ্যতের।
২০০১-এর ফেব্রুয়ারিতে মালাক্কা প্রণালীতে প্রায় ২০০ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয় যারা একটা নৌকা করে ২১ দিন ধরে সমুদ্রে ভেসে ছিলেন। মায়ানমার থেকে পালিয়ে এরা থাইল্যাণ্ড গিয়েছিলেন। থাই সেনারা এদের গ্রেপ্তার করে মাঝ সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, নাইজেরিয়ার নাগরিকেরা না হয় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চাইছেন। কিন্তু মায়ানমারের রোহিঙ্গারা?
মায়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা, সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধর্মকে হাতিয়ার করে বিভেদে ইন্ধন যোগাচ্ছে। মায়ানমারের বৌদ্ধদের মধ্যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
সেনা, পুলিশ ও অ-মুসলিম নাগরিকরা রোহিঙ্গাদের জীবন বিপন্ন করে তুলছে। প্রাণ হাতে করে রোহিঙ্গারা ভেসে পড়েছেন সমুদ্রে। যে মাটিতে আশ্রয় পাবেন সেখানেই তারা নতুন করে জীবন শুরু করবেন। কিন্তু এশিয়ার কোন রাষ্ট্রই এই শরণার্থীদের দায় নিতে রাজি নয়।
রোহিঙ্গা মুসলিমরা কয়েকশো বছর ধরে বার্মা তথা মায়ানমারে বাস করছেন। অথচ মায়ানমারের সামরিক সরকার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর চোখে এরা বহিরাগত। মুসলিম বিদ্বেষ আজ মায়ানমারের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এমনকি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ও নোবেল শাস্তি পুরস্কার জয়ী সু চি রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি কোন সমর্থন বা সহানুভূতি প্রকাশ করেননি।
এই বছরের ১ আগস্ট (২০১৭) কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপুঞ্জে শরণার্থী বিষয়ক কমিটিতে নাম নথিভুক্ত করা অন্তত ১৪ হাজার রোহিঙ্গা ভারতে আছেন। বেসরকারি মতে সংখ্যাটা ৪০ হাজারেরও বেশি।অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছেন জম্মু, হায়দরাবাদ, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান ও দিল্লি সংলগ্ন অঞ্চলে। তাঁর কথায়, রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদ যাই হোক না কেন, সব ক’জন রোহিঙ্গাকেই দেশে, মায়ানমারে, ফেরত পাঠানো হবে।
রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষজনকে না হয় পাঠিয়ে দেওয়া হল মায়ানমারে। ফেরত নেবে না, মায়ানমার। কোথায় যাবেন এই মানুষজন? কোথায় খুঁজবেন তাঁর একান্ত শ্রয়ণস্থল?
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মায়ানমারের উত্তর রাখাইনে (আরাকান) বসবাস করে। তাদের ভাষাও রোহিঙ্গা। তবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কবে থেকে আরাকানে বসবাস করছে এ বিষয়ে মত পার্থক্য আছে। রোহিঙ্গারা দাবি করেন তারা আরাকানের আদি বাসিন্দা। অনেক ঐতিহাসিকও এই মত পোষণ করেন। আবার কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন ১৮২৬-এ ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধের পর ইংরেজরা আরাকানকে তাদের সাম্রাজ্যভুক্ত করে এবং বাংলা থেকে কৃষি শ্রমিক নিয়ে যায়। বাংলা থেকে আগত কৃষি শ্রমিকরা ওখানেই চাষবাস করে তাদের বাসভূমি গড়ে তোলেন।
বাংলার নাম, আকৃতি ও সীমানার মানচিত্র বা সংশ্লিষ্ট ভূগোল একযুগ থেকে অন্যযুগে পরিবর্তিত হয়েছে বারবার। কারণ, মূলত প্রশাসনিক। এখন, এই সময়ে আমরা নিজেদের যে বাঙালি বলছি, ভূখণ্ডকে বলছি পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশ, আগে, এমন কোনো, সমসত্ত্ব ও অভিন্ন গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় না। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকে গৌড়, রাঢ়, পুণ্ড্র, বঙ্গ প্রভৃতি প্রাচীন জনপদে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মানুষের বসবাস ছিল। কিন্তু দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জর্জরিত গোষ্ঠীসমূহের সমন্বয়ে সমাজ গঠন হয়ে ওঠেনি।
আলেকজাণ্ডারের ভারত আক্রমণকালে (৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) আজকে যাকে বাংলা বলি সেই ভূখণ্ড-বঙ্গ (মধ্য-পূর্ববঙ্গ), পুণ্ড্র (উত্তরবঙ্গ), তাম্রলিপ্ত এবং সূহ্ম অথবা রাঢ় (পশ্চিমবঙ্গ) নামে পরিচিত ছিল। প্রাচীন গ্রিস ও লাতিন ভাষায় লিখিত কয়েকটি গ্রন্থে গঙ্গারিডি নামে এক রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে। অনেকে মনে করেন, এই গঙ্গারিডিই হল প্রাচীন বঙ্গদেশ।
পাল-সেন যুগে (আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত) বঙ্গের সীমানা ছিল, পশ্চিমে ভাগীরথী, উত্তরে পদ্মা, পূর্বে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এবং দক্ষিণে সমুদ্র। এর মধ্যে বাকরগঞ্জ এবং সংলগ্ন ফরিদপুর ও খুলনা জেলার অংশবিশেষ বঙ্গাল নামে পরিচিত ছিল। ইবন বতুতা, পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গকে বাঙ্গালা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। অর্থাৎ চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গ বাঙ্গালা ও অধিবাসীরা বাঙ্গালি নামে পরিচিত ছিল।
মোগল যুগে আবুল ফজল রচিত ‘আকবর নামা’য় বাংলার বিস্তৃতি ছিল, চট্টগ্রাম থেকে গর্হি, উত্তর ও পূর্ব সীমার পাহাড় থেকে পশ্চিমে বিহার। প্রান্তসীমায়, কামরূপ আর আসাম।
‘আইন-ই-আকবরী’তে (১৫৯০) বাংলার উত্তরে প্রসারিত হিমালয় পর্বতমালা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বসীমায় গারো, খাসিয়া, জয়ন্তিকা, ত্রিপুরা ও চট্টগ্রামের পর্বতরাজি, পশ্চিমে রাজমহল পাহাড় ও খরস্রোতা গঙ্গা, মহানন্দা ও এদের শাখা-প্রশাখা প্রবাহিত। পশ্চিম সীমানায় ঝাড়খণ্ড, বীরভূম, সাঁওতাল পরগণা, মানভূম, ময়ূরভঞ্জ।
এক অঞ্চলের বাঙালির ভাষা অন্য অঞ্চলের বাঙালির কাছে অনেক সময়েই দুর্বোধ্য। সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষা উপেক্ষিত। যদি ভাষা থেকে জাতির পরিচয় হয় আজকের বাঙলাতেও কারা তবে বাঙালি!
সুনীতি চট্টোপাধ্যায় বলছেন, বাঙালা এখন হইতে মাত্র হাজার বৎসর পূর্বে নিজ বিশিষ্ট রূপ নিয়েছিল। তাহার পূর্বে বাঙ্গালা সৃজ্যমান, তখন বঙ্গদেশের ভাষা অপভ্রংশ ও প্রাকৃত অবস্থায় রয়েছে।
অতুল সুর মহাশয় বলছেন, লিপি বিবর্তনে বাঙালা দেশের লিপিতে একটা সক্রিয়তা প্রথম দেখা যায় গুপ্তযুগে। এই স্বকীয় লিপি থেকেই বাঙালা লিপির উৎপত্তি। বাঙালির মাতৃভাষায় রচিত সাহিত্য খুব প্রাচীন নয়। সবচেয়ে পুরোনো সাহিত্য নিদর্শন, দোহা বা চর্যাগীতি। এগুলি খ্রিস্টিয় প্রথম সহস্রকের শেষের দিকে রচিত।
পুঁজি তৈরি করে ভাষার একক। নির্ণয় করে ‘মানক’ ভাষা। বানায় ব্যাকরণ বই। ভাষা আকাদেমি, ভাষাকে একটি নির্দিষ্ট বর্গে বিন্যস্ত করে মান্য ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা করে। ভাষা হারায় সচলতা। প্রান্তিয় অঞ্চলের মানুষজনের ভাষিক বিশিষ্টতা বর্ণ হারায়।
চট্টগ্রামের সীমানা শেষে বান্দরবান। বঙ্গোপসাগরের কোলে। এক সময় ত্রিপুরার অন্তর্গত ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নাকি আদিতে সেখানকারই বাসিন্দা। দেশভাগে বাংলাদেশ। একদা বাংলা।
কেমন এক চেনা, অস্পষ্ট তবু অচেনা নয় ওই জনপদ। বাংলার ই জনপদ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, নিজস্ব বসত-জনপদ হারাল প্রশাসনিক রাজনৈতিক হিসাব নিকাশে, নিজেদের অজান্তেই। রোহিঙ্গারা কি বাঙালি?
আমি কী আশ্রয় দিতাম, নিরাশ্রয় এক রোহিঙ্গা পরিবারকে? ওই পরিবারের কোনো শিশুকে। আমার বাড়িতে, আমার বাংলায়!
না। দিতাম না। আর গৃহ, আমার আশ্রয়। আমার পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট। রোহিঙ্গা পরিবারের কোনো সদস্যই, আমার স্বজন নয়।
৭
রোহিঙ্গা পরিবারের কোনো সদস্যই, আমার স্বজন নয়। অস্বীকারও না হয় করলাম আমার দেশবাসী নয় বলে। গরিব প্রান্তিক স্বদেশবাসীই কি আমার স্বজন? স্বজনের সংজ্ঞা বদলে গেছে বহু দিন।
প্রান্তিক, অচেনা মানুষজনের অস্তিত্ব তো ছিল বরাবরই ‘কল্পনাবৃত’, তাদের সুখ-দুঃখ-অভাববোধ আমার অনুভূতি-সঞ্জাত। তাদের চাওয়ার ‘পাঠ’, নির্মিত হতো আমার পূর্বধারণায়। আমার অস্তিত্ব - মানসিক ও শারীরিক - যাতে বিপন্নতায় না পড়ে, সে জন্যে যে কোনো বাস্তবতারই ‘অন্যপাঠ’য়ে মন দিই। ‘নিশ্চিন্ত পাঠ’, ‘সুখী পাঠ’। আমার নির্মিত চেতনায় কখনও রঙিন, কখনওবা সে বাতাস-রঙা।
বাতাস-রঙা।
বাতাস বর্ণহীন। বাতাস গন্ধহীন, স্বাদহীন। বাতাস না-দৃশ্যমান। পৃথিবী ঘিরে যে গ্যাসীয় আবরণ, যে পরিমণ্ডলে প্রাণের শ্বসন নিশ্বসন, অণুতে অণুতে উথাল-পাথাল আন্দোলন-সংঘর্ষে যার গতিময়তা, উপস্থিতি যার বোধে, বহমানতায়; সে তখনই দৃশ্যমান হয়, যখন আলোক তরঙ্গ-কণায় উদ্ভাসিত বাহিত অস্বচ্ছ উপাদান।
আমার স্থিতির দশ দিশ আলো-আঁধারী কম্পন। গূঢ়ৈষণা। ব্যাসকূট। বাতাস বহন করে চলে, অগণন ঘটনা একের পর এক, একের ওপর এক, ধীরে ধীরে, হুড়মুড়িয়ে। মনজুড়োনো সংবাদ, উচ্চণ্ড সংবাদ। প্রকাণ্ড এই বিশ্বচরাচরে বহমান নদী-নালা, আদিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত-খামার, পাহাড়-পর্বত, মরু-মেরু তুষার উজিয়ে তার আগমন বার্তা ধ্বনিত, উচ্চকিত লিপিমালায় বা শান্ত সমাহিত বিন্যাস-সৌকর্যে, দৃশ্য মাধ্যমের নিপুণ আঙ্গিকে দূষণও হয় রঙীন। যেমন বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার ওপর নিপাতিত আলোক তরঙ্গকণা সৃষ্টি করে নানান বর্ণমালা, তৈরি হয়, মিলিয়ে যায়, তৈরি হয়, মিলিয়ে যায়। অনুর ‘রেন্ডম (random) মুভমেন্ট’। “ম্যাক্রো স্কেল’-এ যেন এক ‘ব্রাউনিয়ান মুভমেন্ট (মোশন)’।
“ব্রাউনিয়ান মুভমেন্ট (মোশন)। বাতাসে জলে বহমান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (ধূলিকণা) সতত সংক্ষোভ বিধৃত জ্ঞাপন পর্বে। জ্বলে রঙ দিলে এক ফোঁটা, সে রঙ ব্যাপ্ত হয় সমগ্রে। রাসায়নিক ক্রিয়াহীন অনুতে অনুতে লক্ষ লক্ষ শিশুর অট্টরোলে সমাপ্ত হয় ব্যাপন প্রক্রিয়া।
আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে প্রকাশিত গবেষণা-পত্রে ‘Investigations on the theory of Brownian Movement’-এ অনুর উপস্থিতি, অনুতে অনুতে বিরামহীন সংঘর্ষ-কথাই জানালেন শুধু নয়, ব্যাপন হারের পরিমাপ-সূত্র (mean squared displacement) লিপিবদ্ধ করলেন। সেই প্রথম জানা গেল, অনুর (ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্ৰ যৌগিক পদার্থকণা) আনবিক বাস্তবতা পরিমাপযোগ্য বাস্তব।
আমাতে, আমার পরিপার্শ্বে, নিকট ও দূরে, আবিশ্বে ঘটমান বাস্তবতা কি পরিমাপযোগ্য? পরিমাপের মানকই বা কী? পরিমাণ না গুণ, প্রাধান্যই বা দেবো কোন চিহ্নককে? আমার রাষ্ট্রিক ভৌগোলিক সীমানার বাহিরে, মায়ানমারের পশ্চিম রাখাইনের রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন মুসলিম রোহিঙ্গা পরিবারের ৮০ হাজার ৫ বছরের কমবয়সী শিশুর মৃত্যু-মিছিল বা আমার দেশের স্বাধীনতার ৭০ বছরেও এই আগস্টের ৮ থেকে ১২ (২০১৭)’র ৫ দিনে উত্তরপ্রদেশের এক সরকারি হাসপাতালে ৬৪ জন শিশুর শ্বাসকষ্টে, অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু কি একই বন্ধনীভুক্ত! এই হাসপাতালে এর মাত্র কয়েকদিন পর, ১৪-১৫ আগস্ট মারা গিয়েছে আরও ৩৪ জন শিশু। এই আগস্টে (২০১৭) মাত্র একটি হাসপাতালেই, গোরক্ষপুরের বি আর ডি মেডিক্যাল কলেজে, শিশু মারা গেছে ২৯০ জন; ২১৩ জন নিও নেটাল আই সি ইউ ওয়ার্ডে, ৭৭ জন এনকেফ্যালাইটিস ওয়ার্ডে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, ভারতে প্রতি বছর, ৬ লক্ষ ৬০ হাজার শিশু মারা যায়, ‘প্রিভেনটেবল ডিজিসেই’।
পশ্চিম রাখাইনের অপুষ্টি, অনাহার অথবা হা ঘরে, হা ভাতে উঞ্ছ যাপনে এনকেফ্যালাইটিস বা ‘প্রিভেনটেবল ডিজিসে’ আক্রান্ত শিশু-মৃত্যু উভয়ই যে শ্রয়ণস্থলের অকিঞ্চনতা, এমন এক সরল সমীকরণে বিশ্বাস স্থাপনের পরও দুটি ঘটমানতার অসামঞ্জস্য বহু। কেমনভাবে দেখব আমি! প্রকাশ করতে পারব তো আমার দেখা?
১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ছত্তিসগড়ের বস্তারে কৈশোর অনুত্তীর্ণ ১৩ বছরের সোমারু পাত্তামকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুন করল ‘অ্যান্টি নক্সাল স্কোয়াড’য়ের জওয়ানরা। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, খুন করার পর ছেলেটিকে উলঙ্গ করে নক্সালাইটদের ইউনিফর্ম পরিয়ে দেওয়া হয়।
গোটা অঞ্চলে এমন সব অত্যাচারের নিদর্শন অসংখ্য। ছত্তিসগড়ে, ‘এনকাউন্টার কিলিং’-এর ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। বিরোধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, ‘ছত্তিসগড় স্পেশাল পাবলিক সিকিউরিটি অ্যাক্ট’-এ। সুপ্রিম কোর্ট ‘সালভা জুডুম’ নিষিদ্ধ করেছে। তৈরি হয়েছে বিকাশ সংঘর্ষ সমিতি, আদিবাসী একতা মঞ্চ, সামাজিক একতা মঞ্চ, ইত্যাদি ইত্যাদি। সবগুলির অস্তিত্বই পুলিশ প্রশাসন নির্ভর। গ্রামের পর গ্রাম, পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী, জনপদের মূল অধিবাসীদের মাওবাদী অভিহিত করে তাদের বাধ্য করছে আত্মসমর্পণে। মাওবাদীরা গ্রামবাসীদের ভাবছে পুলিশের চর। ভয়ে ভয়ে থাকেন, কখন বুঝি মাওবাদীদের আক্রমণের নিশানায় পরিণত হন!
ছত্তিসগড় শুধু নয়, যেখানেই মাটির গভীরে আকরিক - লোহা, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, সোনা, সীসা, কয়লা, পাথর - অথবা মাটির ওপরে দীর্ঘ বনানী, সেখানেই সরকার আর কর্পোরেটের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলছে আদিবাসীদের ওপর দমন-পীড়ন, খুন-হত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগের অগণন ঘটনা।
রূপকথার রাজকন্যা ভোররাতের আলোআঁধারিতে, নদীতে স্নানের পথে, ভাঙা মন্দিরে আবিষ্কার করলেন এক অপরূপ রাজপুত্র। সারা অঙ্গে সূচ। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মৃতপ্রায়। স্নান সমাপনে, রাজকন্যে সযত্নে একটা একটা করে সূচ তুলতে থাকেন। সব শেষে চোখের। পুত্র জাগে। কাঁপা ঠোঁটে বলে, কে তুমি!
সূচ রাজপুত্র, অভিশাপে অঙ্গে নিয়ে সূচ, ওই ভাঙা দেউলে শুয়েছিলেন অনেককাল ধরে। এর আগেও কন্যারা এসেছে। সূচ তুলেছে কিন্তু সেই যে সূচ তুলেছে, সেই যে উদ্ধার কর্ত্রী তা দেখাবার জন্যে ব্যগ্র কন্যারা, সর্বাগ্রে তুলেছিল চোখের সূচ।
চোখ খুলে পুত্র যেই বলতে গেছে কথা, ওষ্ঠে বেঁধা সূচ কইতে দেয়নি, প্রকাশ করতে দেয়নি কোন ভাষা। পুত্র আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখ বন্ধ হয়ে গেছে সূচের ফোঁড়ে।
রূপকথার এই গল্পের মানে কাহিনীকারের কাছে কী ছিল জানি না। কিন্তু এই গল্প মৃতের জীবিত হওয়ার গল্প, কিংবা জীবিতের মৃত। বারবারই মনে হয় চোখের দেখার আগে কি মনের প্রস্তুতি প্রয়োজন! প্রকাশের শর্ত পূরণের প্রয়োজন? দৃশ্যমান এই জগৎ যদি প্রকাশ না করতে পারি তবে কি দেখা অর্থহীন?
৮
অবিশ্রাম বিন্যস্ত-অবিন্যস্ত ঘটনাপ্রবাহ। সময়কালের স্রোতে ঘটনার ‘র্যা ন্ডম মুভমেন্ট’ নাকি ঘটনাগুলি সম্পর্কিত একের সঙ্গে অপরে। অবিন্যাসেও বিধৃত কি কোন এক ‘প্যাটার্ন’! চেনা নয়, অচেনাও একবারে নয়। তৈরি হচ্ছিল, ঘনিয়ে আসছিল সে মেঘ অনির্বচনীয় অনিবার্য নির্লিপ্ততায়, ধীরে ধীরে, গোচরে অগোচরে। আমি দেখতে চাইনি, অনপেক্ষিত সে আঁধার। সংলগ্নতা খুঁজেছি শুধুই নির্মিত নিকট পারিপাট্যে। দখিনের জানালা একটা একটা করে বন্ধ করেছি। এসেছে ঘূর্ণাবর্ত। আকাশ হয়েছে কালো। আকাশ ঘন কালো মেঘে সমাচ্ছন্ন। এমন সময় আমার বৃষ্টি চাওয়াটাই বোধহয় সঙ্গত। শাওনের ধারা স্নান। আতৃপ্ত। তৃপ্ত হব আমি। বৃষ্টি শুধুই বৃষ্টি। সে এক মুক্তিরও আস্বাদ।
রৌদ্র চাই যদি? যদি দেখতে চাই আলোকস্রোতে ঘটনার বর্ণ! বিচ্ছুরিত আলোয় ঘটনা। উজান বেয়ে সে যাত্রাপথ কি সন্ধান দেবে কোনো এক নতুন ‘প্যাটার্ন’? আবিষ্কার করবে নিজেকে আবার নতুন করে? যেমন ভাবে বেঁচে আছে আজও এই পৃথিবী, হাজার হাজার মানুষের রক্ত, ঘাম, ভালোবাসা মেখে! মানুষই তো অসীম সাগরে ভেলা ভাসানোর হিম্মত ধরে। খুঁজে ফেরে, পায়-ও সবুজ সে দ্বীপের সন্ধান। নোঙর ফেলে।
বাঁচার, বাঁচতে চাওয়ার টান বড় অমোঘ। আশায় বাঁচা। শুধু আশায় বলি কেন? মানুষ যেমন ভাবেই বাঁচুক না কেন, আনন্দ সে খুঁজে নেয়-ই। পায়-ও।
ঠিক এই মুহূর্তে, আমার ভারতে, মাসে কম বেশি ১০ লক্ষ যুবক চাকরির খোঁজে, অন্নের সংস্থানে বাজার অভিমুখী। বছরে ১ কোটি ২০ লক্ষ। এদের গড় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, প্রাইমারি উত্তীর্ণ। যোগ বিয়োগ আর মাতৃভাষায় পড়া, সবই একটু আধটু। সংখ্যাটা বাড়ছে। ‘ব্যাকলগ’। ক্রমেই বাড়ছে। যাচ্ছেন কোথায় তাঁরা? রাস্তায়-ঘাটে না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছেন এমন তো নয়। কোথাও কোনোভাবে, বেঁচে থাকার পথ বেছে নিচ্ছেন।
বিচিত্র সব পথ। টোটো, অটো, লোকের বাড়িতে গৃহকর্ম, ট্রেনে বাসে হকারি, পথপার্শ্বে গাড়ি ধোওয়া সব, সবই। কোথাও কোন সামাজিক সুরক্ষা নেই, এমন অনেক পেশা, যার কোন আইনি অনুমোদনও নেই।
আমার গভীর বিরক্তি, এদের অমার্জিত, অসংস্কৃত যাপনে।
আমার যাবতীয় অবহেলা, অশ্রদ্ধা এদের বাঁচার সহায়ক নয়। তারাও প্রত্যাখ্যাত করছেন আমায়, উপেক্ষা করছেন আমার ‘সংস্কৃত চাহিদা’। ওদের, আমার, আমাদের, সবার চলনই সাধারণভাবে বহির্মুখী। আমার বাসনা, আমার তৃষ্ণার সঙ্গে মিল নেই কোন, ওদের। সংকট আমার, মেনে নিতে পারি না, ওদের ওই অস্তিত্ব। অন্যদিকে, ওরা, ওদের নিজেদের সমাজ-সম্প্রদায়ের ‘অস্তিত্বের সংকট’, ‘বাসনার অতৃপ্তি’র জন্য দায়ী করে আমায়, যে আমি রাষ্ট্র-পরিচালকদের সঙ্গে কোন না কোন সম্পর্কসূত্রে জড়িত, অর্থনৈতিক সামাজিক বা রাজনৈতিক। আমার চাওয়ায় সমাজ-স্থিতাবস্থা। ওরা সে দায়ে মান্যতা দেয় না।
এই বাংলায়, এই বিভাজন ঘনিয়েছে সেই অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে, যখন থেকে গ্রামবাংলা নিংড়ে, ব্রিটিশ শাসকদের পরিকল্পিত সক্রিয়তায় কলকাতা কল্লোলিনী হতে থেকেছে। চ্যুতি ঘটেছে, কৃষিভিত্তিক বাঙালি সমাজের সঙ্গে, বিদ্যা-শিক্ষার। ভেদ বেড়েছে, গ্রাম-শহরের। উপেক্ষিত হয়েছে, গ্রাম। গুণের বিচার, অবস্থার বিচার, অবস্থানের বিচার, সব কিছুই ‘ভালো-মন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গল, সাদা-কালো’য় ঊর্ধ্বকমাবেষ্টিত। বঙ্গের একটা বড় সীমাবদ্ধতাই হল, তার কলকাতা কেন্দ্রিকতা। এখানকার প্রায় সবকিছুই কলকাতা কেন্দ্রিক বা ভিত্তিক। রাজনীতি সংস্কৃতি খেলাধুলা অর্থনৈতিক কাজকর্মের সিংহভাগ কলকাতা কেন্দ্রিক।
বিহারের মানুষজন, কর্মোপলক্ষে কলকাতা থাকাকালীন, বাড়িতে, টাকা পাঠাতেন সংসার খরচের। গ্রামে ক্ষেতি বাড়ি সারাতে, কিনতে ওড়িশার মানুষজনও তাই। দক্ষিণ ভারতে, নগরবাসী চাকরিজীবী যতদিন পর্যন্ত না, গ্রামের বাড়ি বসবাসোপযোগী করে উঠতে পারেন বা পূর্বপুরুষের গ্রামে নিজের বাড়ি তৈরি করে উঠতে পারেন না, সামাজিক মর্যাদাও তেমন ভাবে পান না। অন্যান্য প্রদেশেও কমবেশি এমনটাই রেওয়াজ। বাংলায় রেওয়াজ ভিন্ন। দ্রুত গ্রাম-সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে নগরবাসিন্দা হওয়া।
ভিটেমাটির পাট চুকিয়ে আমার কলকাতা যাত্রা। ভিটেমাটি বিক্রি করে আমার কলকাতা বাস। গ্রামে বড় আঁধার। রাত নামে বিকেলেই।
আমার ভাবনায়, লেখাপড়া করে যেই/গাড়িঘোড়া চড়ে সেই। লেখাপড়ার কেন্দ্র কলকাতা। লেখাপড়া শিখে কলকাতায় চাকরি।
এই লেখাপড়া মানে, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং এই, এইসবই। অথচ, এআইসিটিই নিজেই, দেশজুড়ে ৮০০টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বন্ধ করে দিতে চাইছে। কারণ প্রতি বছরই আসন খালি থাকে। গত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কলেজের ৩৫ হাজার আসনের অর্ধেকও ভর্তি হয় না। তিন বার কাউন্সেলিংয়ের পরও আসন খালি পড়ে থাকছে। বেসরকারি কলেজের ক্ষেত্রে ভর্তির হার মোট আসনের এক তৃতীয়াংশ।
প্রকাশিত সব রিপোর্ট, প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ভারতে প্রতি বছর যেসব যুবক যুবতী ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেরোচ্ছে তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই সুপ্রশিক্ষিত কর্ম-চাহিদায়, নিয়োগের পক্ষে অনুপযুক্ত।
নাগরিককে শিক্ষিত ও কর্মোপযোগী করে তোলার প্রাথমিক দায় ছিল, রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সেই কর্তব্য থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে গজিয়ে উঠছে এমন অজস্র বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যারা ন্যূনতম পরিকাঠামো ছাড়াই চালিয়ে যাচ্ছে স্নাতক উৎপাদনের ব্যবসা। এদের বেশির ভাগই, চাকরি পাওয়ার যোগ্যতামান অর্জনে অক্ষম। মানুষ চাকরি পাবে কি পাবে না, সেটা পুঁজির ভাবনার বিষয় নয়। পুঁজির কোনো সামাজিক দায় নেই। শ্রম প্রয়োজন। পুঁজি শ্রম নিয়োগ করে।
৯
স্বাধীনতা বলি বা ক্ষমতা হস্তান্তর, ১৯৪৭-এর পর থেকে ভারতের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভাষিক সাংস্কৃতিক চেহারা অনেকটাই বদলে গেছে। ভালো বা মন্দ, ভালো হলে কতখানি ভালো বা খারাপ হলে কতটুকু খারাপ, সেই তুলনামূলক বিচার নির্ভর করবে, যিনি সেই কাজটি সম্পাদন করবেন, তাঁর ওপর।
তবে একটা কথা, অনেকটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, শ্রীনরেন্দ্র মোদী পরিচালিত, বর্তমান ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি/ভাজপা) নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের সঙ্গে (নির্বাচিত হওয়ার প্রাককথন থেকে নির্বাচন পরবর্তী কার্যকলাপে) পূর্ববর্তী সব সরকারের পার্থক্য গুণগত। বর্তমান সরকার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যভেদে অনেক নিপুণ, অনেক ধ্বংসাত্মক।
অনেক নিপুণ, অনেক ধ্বংসাত্মক। ‘অনেক’ মানে, আগে কেন্দ্ৰে যে যে সরকার এসেছে, সেই সব সরকারের থেকে বেশি নিপুণ, বেশি ধ্বংসাত্মক। পার্থক্য তাহলে পরিমাণের, এমনটাই বলা উচিত ছিল। আমার মনে হয়, ‘পার্থক্য গুণগত’। পরিমাণের হ্রাস বা বৃদ্ধি, যদি একটি নির্দিষ্ট দিকেই এগোয়, একটা সময় আসবে যখন পরিবর্তন হয় গুণগত।
আলো হচ্ছে তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গমালা। প্রধান উৎস, সূর্য। যে আলো আমরা চোখে দেখতে পাই, তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার। আলোক তরঙ্গের ‘তরঙ্গ দৈর্ঘ্য’র হেরফেরে আমরা বর্ণচ্ছটায় দেখি ভায়োলেট, ইন্ডিগো, ব্লু, গ্রিন, ইয়োলো, অরেঞ্জ এবং রেড। প্রত্যেকটি রঙের সঙ্গে একটি বিশেষ ‘তরঙ্গ দৈর্ঘ্য’ রয়েছে। ‘লাল’ রঙের ‘তরঙ্গ দৈর্ঘ্য’ ‘বেগুনি’র চেয়ে অনেকটাই বেশি। সাদা, সব রঙের সংমিশ্রণ।
বর্ণ যদি আলোর বৈশিষ্ট্য হয়, পরিবর্তনের ‘মানক’ হয়, ‘তরঙ্গ দৈর্ঘ্য’র পরিবর্তনে, ‘তরঙ্গ দৈর্ঘ্য’ বাড়ায়, নীল হবে লাল।
রঙের পরিবর্তনকে ‘মানক’ ধরলাম না। ‘তরঙ্গ দৈর্ঘ্য’ আরো বাড়ল। পেলাম ‘ইনফ্রারেড’ আলোকরশ্মি। ‘তরঙ্গ দৈর্ঘ্য’ কমাতে থাকলাম। এবার পেলাম, ‘আলট্রাভায়োলেট’ আলোকরশ্মি। ‘ইনফ্রারেড’ বা ‘আলট্রাভায়োলেট’ আলোকরশ্মি, দুই-ই অদৃশ্য, দৃশ্যমান আলোকরশ্মি থেকে দুয়ের-ই ধর্ম আলাদা আলাদা।
পদার্থ বিদ্যায়, দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান সব ধরনের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গমালাকেই ‘আলো’ বলা হয়। ওই অর্থে, গামা-রে, এক্স-রে, মাইক্রোওয়েভস, রেডিও ওয়েভস - সব-ই আলো। ধর্ম আলাদা আলাদা।
১৯৪৭-এর অব্যবহিত পরেই, রাষ্ট্রনৈতিক নেতারা-অধিকাংশই ইউরোপ শিক্ষিত ও ইউরোপীয় ভাবধারায় প্রাণিত - ভাবলেন, দেশকে ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত করে তুলতে হবে। অতএব, সেচ, বিদ্যুৎ, স্টিল, ভারি ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প ইত্যাদির সমুচ্চ শীর্ষে আরোহণ করতে হবে।
১৯৪৮-এ হীরাকুঁদ বাঁধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী জবাহরলাল নেহরু। শেষ হলো ১৯৫৭য়। ৭২৭ বর্গ কিলোমিটার জমি, জঙ্গল, গ্রাম, ভিটে-মাটি বসত হারিয়ে গেল জলের তলায়।
উচ্ছেদ হলেন, সরকারি হিসেবে ১ লক্ষ ১০ হাজার মানুষ। এই হিসেব জমি-মালিকানার রেকর্ড ধরে। জমি-মালিকানার রেকর্ড যাদের ছিল না, সে হিসেব ধরলে, উচ্ছেদ হয়েছেন ১ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষ।
উচ্ছেদ অব্যাহত। এই আগস্ট (২০১৭) মাসেও সর্দার সরোবর বাঁধের উচ্ছেদ হওয়া মানুষজনের প্রকৃত পুনর্বাসনের দাবিতে মধ্যপ্রদেশে অনশন করছিলেন, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের প্রধান মুখ মেধা পাটেকর সহ অন্যান্যেরা, ক্ষতিগ্রস্ত মহিলা-পুরুষ-পরিবারের সদস্যেরা। ৭ তারিখে অনশন-মঞ্চ ভেঙে গুঁড়িয়ে, অনশন উঠিয়ে নিতে বাধ্য করে পুলিশ-প্রশাসন।
নর্মদা বাঁধ প্রকল্প তিনটি রাজ্য জুড়ে। মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট। ১৯৮৭ সালে নর্মদা নদীর ওপর সর্দার সরোবর বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। যখন শেষ হবে, ডুবে যাবে ২৪৫টি গ্রাম, ৪০০ বর্গ কিলোমিটার জলাধারে। উদ্বাস্তু হয়েছেন, হবেন, ৪০,০০০ মানুষ।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, বছর দশেক আগে ৫৪টি বড় বাঁধের হিসেব কষে দেখিয়েছিল, বড় বাঁধ পিছু উচ্ছেদ হন, গড়ে ৪৪,১৮২ জন মানুষ। ইন্ডিয়ান সোশ্যাল ইনস্টিটিউট, ২০০০ সালের গোড়ায় জানায়, দেশে উন্নয়নজনিত ক্রিয়াকর্মে বড় বাঁধের জন্য উদ্বাস্তু হয়েছেন ১ কোটি ৬৪ লক্ষ মানুষ, খনির জন্য ২৫ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ, শিল্প-কারখানা নির্মাণে ১২ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ এবং বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও জাতীয় উদ্যান গড়ে তুলতে ৬ লক্ষ মানুষ৷ এখনও খনি, বাঁধ, হাইওয়ে, স্মার্ট সিটি নির্মাণে অসংখ্য মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে চলেছেন।
১৯৪৭ থেকে ২০১৭, কংগ্রেস থেকে ভাজপা কোন সরকারই এর বিরোধিতা করেনি। এই জায়গা থেকে এ যাবৎকাল গঠিত সরকারগুলোর মধ্যে পার্থক্য শুধুই পরিমাণগত।
ভারতের এমনতরো এক উন্নয়ন যজ্ঞে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন তারা ছাড়াও বহু মানুষই এই সব উন্নয়নের কোন সফলতা পেলেন না।
এনারা ধ্বস্ত হলেন দেশের উন্নতির জন্যে, উন্নয়ন এদেরকেই এড়িয়ে গেল। এদের মধ্যে সব সময়ই কাজ করে গেছে একটি দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস । স্বাভাবিকভাবেই, ক্ষুব্ধ এঁরা। ক্ষুব্ধ, সরকারের ওপর। ক্ষুব্ধ, এলিট বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের ওপর। কেননা সরকার ও এলিট বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় মিলিত ভাবেই, এই উন্নয়নের পরিকল্পক এবং রূপায়ণকার। একসময় এঁরা প্রকৃত অর্থেই, লাভবান। লেখাপড়ার সুযোগ এঁদের ছিল। এঁদের ছেলেমেয়েরাও কোন সুযোগ থেকে বঞ্চিত হননি। সুযোগ পেয়েছেন, জ্ঞানচর্চার। এঁদের ঘর থেকেই, মন্ত্রী-আমলা-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-অধ্যাপক, বড়-মাঝারি সরকারি অফিসার। সবাই কেমন যেন এক-ই সম্প্রদায়ভুক্ত। অন্যান্য সামাজিক স্তর থেকেও নতুন যুবক-যুবতীরা এসেছেন, নিজেদের যোগ্যতায় পেশাজীবী হয়েছেন। ‘ইনক্লুশন’ হয়েছেন, ওই সম্প্রদায়েই। ঠিক যেমন করে গ্রামের ভিটে-মাটির পাট চুকিয়ে শহর কেন্দ্রিক যাপনে অভ্যস্ততা গড়ে তোলেন গ্রামের শিক্ষিত মানুষজন। বিচ্ছিন্ন গ্রাম সমাজ থেকে, অধিকাংশের থেকে। বর্তমানে সমস্যা এই সম্প্রদায়েরও। শহর মফস্সলের শিক্ষিত ছেলেদের চাকরির সম্ভাবনা হয়ে গেছে সুদূর। চাকরি কোথাও নেই, পূর্ববর্তী
সরকারও এর থেকে বেরিয়ে আসার কোন পথও দেখাতে পারেনি।
১০
ভাজপা নিয়ে এল ‘এক্সক্লুশন’ নীতি। ভারতে বসবাসকারী সবাই ভারতীয় নয়। মুসলমানরা ভারতীয় নয়। হিন্দু মুসলমানের সম্প্রদায়গত অসম্প্রীতি হল তার মূলধন। এটাই ছিল, আর এস এস-এর অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক ভিত্তি। তাদের কথায়, আরব থেকে আসা ধর্ম থেকে অন্য ধর্মের পার্থক্য রয়েছে। একই জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আচার-বিচারে পার্থক্য থাকলেও হিন্দু ধর্মের কিছু যায় আসে না। হিন্দু ধর্ম অনায়াসেই আরও কয়েকজন দেবদেবীকে নিজ ধর্মে আত্মস্থ করে নিতে পারে কিন্তু যে ধর্ম প্রকৃতি উপাসনামূলক ধর্ম পরিত্যাগ করে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়, তারা অবশ্যই আমাদের জাতীয় সত্তার পক্ষে বিপজ্জনক।
পূর্ববর্তী কংগ্রেস সরকারেরও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন সম্পর্কে রিজার্ভেশন ছিল। সেটা বোঝা যায়, সামরিক প্রতিরক্ষা বা অভ্যন্তরীণ আরক্ষা সম্পর্কীয় সংস্থানে মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজনের প্রায় না থাকায়। এই পরম্পরা কংগ্রেস নিয়েছে ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে। সিপাহী বিদ্রোহ বা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ব্রিটিশ শাসক, মুসলমানদের দেশের সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। ১৯৪৭-এর পর কংগ্রেস সরকারও সেই নীতিই বজায় রাখল ।
হুমায়ুন কবীর ছিলেন একজন বাঙালি শিক্ষাবিদ। জিন্নার তত্ত্বে অবিশ্বাসী। সেক্যুলার ভারতে বিশ্বাসী। দু-দুবার দেশের শিক্ষামন্ত্রীও ছিলেন। তাঁর নাতি ‘র’-এর (RAW) এয়ার উইংসের সব যোগ্যতা মান অতিক্রম করেও শুধু মুসলমান হওয়ায় নিয়োগপত্র পাননি। ১৯৬৯ সালে গড়া ‘র’-এর ১০ হাজার জন কর্মীর একজনও মুসলমান ধর্মাবলম্বী নয়। ভারতের সামরিক বাহিনীতেও মুসলমান মানুষের সংখ্যা মাত্র ২৯ হাজার।
এত সব সত্ত্বেও কংগ্রেসের নীতি ছিল “ইনক্লুশিভ’। অন্তর্ভুক্তিকরণ। সঙ্গে নিয়ে চলা। আর এই নীতিরই এক ধরনের কনটিনিউয়েশন বজায় রেখেছে, বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত তৃণমূল সরকার। ভাজপা-র নীতি বহিষ্কার করা, দূরে সরিয়ে দেওয়া। তৃণমূল সরকার ভাজপা’র ‘এক্সক্লুশন’ নীতির বিরোধী। তফাৎ গুণগত। আলো এখন গোলাপী থেকে লাল নয়, ইনফ্রা রেড, আলট্রা ভায়োলেট।
এই যে সঙ্গে না নেওয়া, বাদ দিয়ে দেওয়া, এত দিন অব্দি ভারতের মূল রাজনীতিতে কেউই চিন্তা করেননি। ভাজপা এটা একরকম ঘোষণাই করে দিল। এর স্বপক্ষে প্রচার অবশ্য দীর্ঘদিনের। আরএসএস, তার জন্মলগ্ন থেকেই মুসলমান বিদ্বেষ প্রচার করে আসছে। এর কারণ, আরএসএস-এর ব্রিটিশ শাসকের সখ্য।
মূলত, মূল ধারার রাজনীতিতে প্রচলিত, ‘সেকিউলারিজম’ বিরোধিতা, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুসলমান তোষণের অভিযোগ, হিন্দু ধর্মের বইপত্র, প্রচার-পুস্তিকার পাঠ-আলোচনা-বিক্রি, সাধু-সন্তদের সমাবেশ ও মুসলমান বিদ্বেষ প্রচার করতে করতেই ২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী সারা ভারতে আরএসএস-এর শাখা সংগঠন ৫১,৩৫৫, সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬০ লক্ষ। আমাদের রাজ্যে শাখা ১৪৯২। অন্যতম প্রধান তিন প্রচারক এখন রাষ্ট্রপতি (শ্রী রামনাথ কোবিন্দ), উপরাষ্ট্রপতি (শ্রী ভেঙ্কাইয়া নাইডু) এবং প্রধানমন্ত্রী (শ্রী নরেন্দ্র মোদী)। (২০১৭)
দেশ পার্টি মিলেমিশে একাকার। প্রথম ঘটেছিল ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর সময়কালে। এবার, আরও একবার। উত্তাল হুল্লোড়। রামনবমী, হনুমান জয়ন্তীতে সশস্ত্র মিছিল। ‘মুসলমান তোষণের অভিযোগ’।
ইমামদের মাসিক ভাতা দেওয়া চালু করেছে তৃণমূল সরকার। বোরখায় হিজাব পরে নামাজ পাঠের নাটক করে মমতাজ বেগম।
সত্যিই অস্বস্তিকর। অভ্যস্ত নই, আমি, আমার ধর্মীয় সামাজিক অবস্থান সাপেক্ষে। সমস্যা হয় না উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, যোগী আদিত্যনাথের পোশাকে। কাশ্মীরে ‘হজরত বাল’ মসজিদে, অমৃতসরের ‘স্বর্ণমন্দিরে’ ঢুকেছিলাম, মাথা ঢেকে। শুনেছি ‘আজমীর শরিফে’ও নাকি তেমনই রেওয়াজ। কোন ধর্মস্থানে গেলে সেখানকার আচার ব্যবহারকে সম্মান দেওয়াই আমাদের প্রথা।
চলতি প্রথা মানতে হবে এমন কথা নয়, মানলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে, এটাও নয়। বিশেষত, আমি যখন নিরীশ্বরবাদী নই। রাষ্ট্র যখন, ধর্ম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেবে, ব্যক্তি-মানুষের নিজস্ব ধর্মীয় আচরণের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে, তখন সেই ‘ভিন্ন’ পরিস্থিতিতে, দেখাও হবে ভিন্ন।
১১
সামগ্রিক অরাজকতার ছাপ রাজনীতিতে। এই শতাব্দীর শুরু থেকেই লক্ষণগুলো স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। সুরক্ষিত ও নিশ্চিন্ত জীবনের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একে একে। সহায়-সম্বলহীন মানুষ খুঁজছেন এক জন নেতা। একই সঙ্গে হিন্দু লোকমানসে বিছানো, ধর্মীয় এক স্নিগ্ধ চাদরের আচ্ছাদন, সম্ভবামি যুগে যুগে অথবা যখনই বিপদে পড়িবে, স্মরণ করিও আমায়....। দুয়ে মিলে, ত্রাতার ‘আবির্ভাব’ প্রত্যাশা। অবতার।
মুসলমান জনগোষ্ঠীর এমন কোনো বিশ্বাস নেই ‘অবতার আবির্ভাবের’। আল্লার কাছে সে নামিয়ে রাখে দুখের ভাণ্ডার। নেতা খোঁজে সেও। মানত করে...। সবাই। কৃষিকর্মে অথবা গ্রামীণ উৎপাদনের সংযুক্ত যারা, তারা ছাড়া সব্বাই আসে, ভিড় করে নগর-শহর-মফঃস্বলে। ঠিকে কাজ।
ধর্মীয় বিভাজনে বিশ্বাসী শহর-মানস। স্মৃতিতে তার ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বয়ে নিয়ে আসা ইংরেজ-সৃষ্ট ইসলাম-বিদ্বেষ, দেশভাগের যন্ত্রণা, ইউরোপের ‘মুসলিম-জেহাদ’। ঠিকে কাজের মেয়ে-বৌকে বদলাতে হয়, নাম। ধর্মীয় পরিচয়। ব্যতিক্রম নয়, পুরুষেরা। তবে কম। ঘরে ঢুকতে হয় না তাদের।
‘ধর্মীয় পরিচয়ে’ অভ্যস্ত সমাজবদ্ধ মানুষ মসজিদ-দরগায় খুঁজে পায়, ‘আইডেনটিটি’। উচ্চকিত হয় ‘নামাজ’।
ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়ায়, নির্মিত হতে থাকে অন্য এক সত্য। বাস্তবের মাটিতে, দুই সম্প্রদায়, এ ওর দিকে বাঁকা চোখে চায়। ‘এলিমিনেশন’, ‘এক্সক্লুশন’।
‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু’ মানুষ জানেন, তার এমনতরো বিশ্বাস সাজে না, বরং ‘সম্প্রদায়ের বাহির অঙ্গনে’, যতটা সম্ভব ‘ইনক্লুশন’ রপ্ত করতে চায় সে, কুণ্ঠিত সে, অপেক্ষায় থাকে কোনো এক নিজস্ব জয়ের আস্বাদনে। যেমনটি আমরা, সব হারিয়ে ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় এসে, প্রত্যাশায় থাকতাম, ‘ইস্টবেঙ্গল’ ক্লাবের জয়ে। উন্মুখ থাকতাম। জয়ের আনন্দে ফেটে পড়তাম, হারে হতাশা বা ক্রোধ। সোভিয়েত পিতৃভূমি, চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান। নবারুণের ‘এ আমার দেশ নয়...’, আমার আপন কবিতা-ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে।
অন্য দেশকে এভাবে আপন ভাবলেও, বোধ হয় হিন্দু বলেই সমাজ আমাকে ‘এক্সক্লুড’ করেনি। আমাকে ‘স্পেস’ দিয়েছে।
‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু’ একজন মানুষকে এই ‘স্পেস’ আমি দিই না। নিলে ‘দেশদ্রোহী’ ভাবি। এই ভাবনাটা আমার গোচর-অগোচরে অবিরাম কাজ করে যায়, এও এক ‘এক্সক্লুশন’ মানসিকতা। আমার মানসিকতায় কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাই না।
অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাই না, যখন রাজ্য সরকার গঙ্গাসাগরের হিন্দু পুণ্যার্থীদের জন্য সম্পূর্ণ কর মকুব করে। কপিল মুনির আশ্রম সংস্কার করতে ১৩৫ কোটি টাকা খরচ করে। দুর্গাপুজো হিন্দুদেরই উৎসব। সেই উৎসব-আয়োজনে, যখন, আর্থিকভাবে দুর্বল ৫০০টি পূজা কমিটিকে ১০,০০০ টাকা থেকে ২০,০০০ টাকা সাহায্য করা হয়, আমি তার মধ্যে ধর্ম গন্ধ খুঁজে পাই না। হিন্দুদের দুর্গাপুজোর প্রসারে সরকারী অর্থে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। হিন্দুদের তীর্থক্ষেত্র বেলুড়মঠ ও তারাপীঠে বড় অঙ্কের সরকারি সাহায্য মিলতে চলেছে। তারাপীঠে ৫০ বিঘা জমিতে ১৫০ কোটি টাকা খরচে ৫১ পীঠের আদলে ৫১টি মন্দির নির্মাণের প্রস্তাব পাশ হয়েছে।
প্রবল বিরোধিতা হওয়ার কথা ছিল। সরকারি কোষাগারের টাকা ধর্মীয় রীতি-নীতি-অনুষ্ঠান পালনে, মন্দির-মসজিদ গড়ায় ব্যয় করা হবে কেন? রাষ্ট্র কেন বিযুক্ত থাকবে না ধর্মীয় অনুষঙ্গ থেকে? এই সেদিনও গঙ্গার নীচ দিয়ে মেট্রো রেলের টানেল খোঁড়ার আগে গঙ্গা এবং টানেল কাটার যন্ত্র হিন্দু মতে আনুষ্ঠানিক পূজা করা হল। উদ্যোক্তা কেন্দ্রীয় মন্ত্ৰক!
ঠিক, এইখানেই ‘ভাজপা’ তার জমি খুঁজে পায়, সেচ-সার-নিড়েনে তার কাঙ্ক্ষিত ফসল বোনে। জমি আমার, ফসল তার।
তৈরি করা হয়েছিল জমি বহু দিন ধরে। ফসল তুলবে ঘরে। এলাহাবাদ, নাগপুরের বীজতলা থেকে জোগান গিয়েছিল চারা গাছ সারা ভারত জুড়ে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বপন করা হয়েছিল সে চারা, গোছা ধরে তৈরি ক্ষেতে।
ফসল তোলা যায় না যখন তখন। সময়ের সঠিক নির্বাচন জরুরী। ২০০২’র গুজরাট আমেদাবাদ দাঙ্গা। ৩ দিনে খুন হয়েছিলেন কয়েক হাজার মুসলমান মানুষ, রাজ্য-রাজধানীর অস্থায়ী শিবিরেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, ১,১০,০০০ মুসলমান মানুষজন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তখন, সঙ্ঘ প্রচারক শ্রী নরেন্দ্র মোদী, দেশের প্রধানমন্ত্রী, আরেক সঙ্ঘ প্রচারক শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী।
খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুঠে আমেদাবাদ কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল। ভয়ার্ত মানুষজনের ক্রন্দন-আর্তি-শোক-ক্রোধ-অসহায়তাযর গোঙানি।
১২
কোন এক ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া বর্ণন সবসময়ই বর্ণনাকারীর অবস্থান-নির্ভর। উপাত্ত থেকে বর্ণনাকারী তাঁর বোধ ও যোজকের প্রেক্ষিতে, একটি জ্ঞাপন নির্মাণ করেন। দ্রষ্টা এখন নির্মাতা। নির্মাণ উপযোগিতা নির্ভর। কাদের জন্য নির্মাণ, কাদের হয়ে নির্মাণ, নির্মাণ সময়কালীন স্থানিক সুবিধা-অসুবিধা বা বিধিনিষেধ, বর্ণন-মাধ্যম ইত্যাদি প্রভৃতি তাঁর জ্ঞান-চেতনা-বোধকে সীমায়িত করে। সীমায়িত সেই জ্ঞান-চেতনা-বোধ সাপেক্ষে নির্মিত, সেই বর্ণন থেকে পাঠক-শ্রোতা-দর্শক যে উপলব্ধিতে পৌঁছোলেন, সেই সত্য দ্রষ্টা সাপেক্ষে, বর্ণন-নির্ভর-খণ্ডিত এক সত্য। উপস্থাপিত/বর্ণিত সেই বাস্তব বর্ণনকারীর বর্ণন-নির্মাণ-দক্ষতায় সত্য হিসাবে প্রতিভাত হয়।
বর্ণন-নির্মাণ-দক্ষতা যেহেতু বর্ণনকারীর স্থানিক অবস্থান আড়াল করে, অন্য-বাস্তবতা/অভিপ্রেত-বাস্তবতা নির্মাণে সক্ষম। সুতরাং এই নির্মাণ-দক্ষতা বিপণনযোগ্য। বিপণনযোগ্য, কেননা নির্মিত বাস্তবতা ব্যক্তি ও সমাজ-চেতনায় অভিঘাত/অনুরণন/আলোড়ন আনতে সক্ষম।
আমেদাবাদ দাঙ্গা, সর্বস্তরে নিন্দিত হয়েও শাসক উপলব্ধি করল, রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে কিভাবে ‘মুসলমান’দের ত্রস্ত, সন্ত্রস্ত, পদানত রাখা যায়, বৃহত্তর সমাজ থেকে‘এক্সক্লুড’ করা যায়। অনুকূল ‘সত্য’ নির্মাণ করা যায়। সে পারে। সে সক্ষম। আর এস এস-এর হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান, মুসলমান বর্জিত ভারত, মনোলিথিক ভারত গড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।
‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট’ পরবর্তী ঠিকানা।
দরজা খোলা সব শিল্পপতির জন্য। যে কোন শিল্পে, যে কোন শর্তে। জল জমি নিঃশর্ত। সেজ এলাকা। শিল্পপতি-ব্যবসায়ীর কথাই শেষ কথা। জমির কোনো উর্ধ্বসীমা নেই। বসত জমি হোক অথবা চাষ জমি। উচ্ছেদের দায়িত্ব নেবে গুজরাট সরকার, নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং। স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারক মাত্র! গুজরাট, একমাত্র গুজরাটেই আছে, প্রাকৃতিক সমুদ্র বন্দর। এক নয়, একাধিক।
আমেদাবাদ দাঙ্গার পর প্রতিষ্ঠিত হলো, আর এস এস ও ভারতীয় জনতা পার্টির ওপর শ্রী নরেন্দ্র মোদীর সর্বময় কর্তৃত্ব। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ-দাঙ্গা সংগঠিত করার জন্য পুলিশ-প্রশাসন-দাঙ্গাকারীদের সুনিপুণ সমন্বয় সাধনের দক্ষতা।
বেহুলা-লখীন্দরের লোহার বাসরেও ছিদ্র ছিল। মনসা দেবী ওই ছিদ্র করিয়েছিলেন ধাতু-বিশারদ কুশলী-নির্মাণশিল্পী, বাসর-নির্মাণকারী বিশাই কামারকে দিয়ে। ভয় দেখিয়ে বাধ্য করিয়েছিলেন।
আমেদাবাদ দাঙ্গা হল, গুজরাট দাঙ্গা। অকল্পনীয় বীভৎসতা। জ্বলন্ত-রক্তাক্ত-আহত-নিহত, শিশু-নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-যুবক-যুবতী। বারবার ঘুরেফিরে অগণন মৃতের ছবি। ধ্বস্ত, ত্রস্ত, বিধ্বংস সমাজ-সংসার, নগরের চিত্রমালা। প্রিন্ট মিডিয়ায় সাক্ষাৎকারের বিবরণ, টেলিভিশনের পর্দায়, ‘লাইভ’।
জানা যাবে না কোনও দিন, সাম্প্রদায়িক এই বীভৎস ছবি, গুজরাট সরকারই দেখাতে চেয়েছিল কিনা, সরকার-প্রধান শ্রী নরেন্দ্র মোদীই চেয়েছিলেন কিনা, এমন এক ভয়াবহতার সম্প্রচার, যা কিনা ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু’ বিশেষ ভাবে মুসলমান সমাজের মধ্যে সৃষ্টি করবে ‘নিরাপত্তাহীনতা’, ভাববে ‘এই দেশ, ভারত, আমার স্বভূমি নয়, এখানে বসবাস করতে হলে, করতে হবে, হিন্দু ভারতের ‘টার্মস অ্যান্ড কনডিশন’ মেনেই। হিন্দু ভারত, একমাত্র হিন্দু ভারতই তাকে দেবে, দিতে পারে নিরাপত্তা। ‘সেকিউলারিজম’ অর্থহীন শব্দ মাত্র।
অথবা সাংবাদিকেরা ‘সত্য’ ‘নিরপেক্ষ’ সংবাদ প্রকাশের স্বার্থেই অমন ভাবে পরিবেশন করেছিলেন, ‘একটি দাঙ্গা বিবরণ’। বিপণনযোগ্য নির্মাণ-দক্ষতার সক্ষমতার পরিচয় দিতে নয়, ‘দাঙ্গা বিরোধী সচেতনতা নির্মাণে, হানাহানির দ্রুত অবসানে।
এবং অবশেষে ‘সত্য’ অভিধায় ভূষিত হল এক ‘ত্রাস’।
এমনটাই কি ‘সত্য’ কথন।
ছোটোবেলায় একটা বিশেষ শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। পোস্ট অফিসের খামের চিঠির ওপর পত্রপ্রেরক ওটা লিখে দিতেন। চিঠিতে এমন কোনো গোপন কথা থাকত, যে কথা পত্রপ্রেরক, উদ্দিষ্ট প্রাপক ছাড়া অন্য কেউ জানুক, চান না। যদি পড়েন, তার ওপর ‘পাপ’ অর্শাবে, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ মণ ওজনের ‘পৈতেধারী’ রাজপুত ব্রাহ্মণ হত্যার। মেবারের যুদ্ধে মুসলমান সম্রাট যতজন রাজপুত ব্রাহ্মণ হত্যা করেছিলেন, তাদের পৈতের ওজন ছিল, ‘সাড়ে চুয়াত্তর মণ’! এমন ‘অলৌকিক, অযৌক্তিক’ কথা প্রচার করতেন, এলাকার চারণ কবিরা, উদ্দেশ্য, ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমান সম্প্রদায় যে নৃশংস, এমন এক ধারণার জন্ম দেওয়া। চারণ কবিদের ওই সব প্রচারকেই মূল উপাদান করে একদা রচিত হয়েছিল, টড সাহেবের ‘ভারত (রাজস্থান) ইতিহাস’। উনবিংশ শতাব্দীর ‘বাঙালি হিন্দু’ অভিজাতদের ‘সুখপাঠ্য ভারত ইতিহাস’। শাসকের অত্যাচার, অতিরঞ্জিত হয়ে, সংজ্ঞায়িত হল, ‘ইসলামের অত্যাচার’, ‘মুসলমানের অত্যাচার’। ইংরেজরা, হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষের বীজ বুনে যেতে সফল।
শোনা যায়, সম্রাট অশোক, চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিবর্তিত হওয়ার পরও, সাম্রাজ্য বিস্তারে, যে রাজ্য তিনি অধিগ্রহণ করতে চান, আগে পাঠাতেন, চারণ দল। ওই চারণেরা, সম্রাট অশোকের বন্দনা গীতিতে প্রথমে বর্ণনা করতেন, অশোকের কলিঙ্গ জয়ের নৃশংস অত্যাচার কথা। অতিরঞ্জিত, বিস্তারিত নৃশংসতার বিবরণ। তারপর জানাতো, অশোকের, চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে আসার কথা। আর তিনি যুদ্ধ চান না। শান্তি চান। আবেদন, সম্রাট অশোকের অধীনতা মাত্র।
হয়ত, গল্প কথা। কিন্তু ‘সত্য’ কেমন ভাবে নির্মিত হতে পারে, সে কথাও।
আমেরিকার অন্যতম বিশিষ্ট বিজ্ঞানী স্যার থমাস আলভা এডিসন। ফনোগ্রাফ থেকে মোশন পিকচার্স ক্যামেরা, বিদ্যুতের অত্যাধুনিক বহু প্রযুক্তির আবিষ্কারক। সেই থমাস যখন ছোটবেলায় ইস্কুলে পড়তেন তখন একদিন তার ইস্কুল টিচার তাকে একটি চিঠি দিয়ে বললেন, এই চিঠিটা তুমি তোমার মাকে গিয়ে দেবে। মা ছাড়া আর কাউকে দেবে না।
সেই কথা মতো থমাস চিঠিটা নিয়ে এসে তার মায়ের হাতে দেয়। যা চিঠিটা খুলে, গোটা চিঠিটা এক ঝলক দেখে নিয়ে পড়ে শোনান ছেলেকে। ‘আপনার ছেলে খুব বিদ্বান, মেধাবী ও বুদ্ধিমান। ওকে ভালভাবে পড়ানোর কোনো শিক্ষক বা পরিকাঠামো আমাদের ইস্কুলে নেই। তাই আপনি ওকে অন্য কোন ভালো ইস্কুলে ভর্তি করুন অথবা আপনি নিজেই ওকে পড়ান।’ চিঠি পড়া শেষ হলে থমাস দেখে মায়ের চোখে জল।
এরপর কেটে গেছে বহু বছর। থমাস এখন বড়। সে এখন স্যার থমাস আলভা এডিসন। পৃথিবীখ্যাত এক বিজ্ঞানী। তাঁর ইনভেনশন, স্কুল কলেজে পাঠ্য। একদিন তিনি, মায়ের ঘরে কাজ করতে করতে হঠাৎ খুঁজে পেলেন, এক টুকরো ভাঁজ করা কাগজ। চিনতে পারলেন, এটা তাঁর ছোটবেলায় ইস্কুল থেকে টিচারের দেওয়া সেই চিঠিখানা থমাস আস্তে আস্তে চিঠিটা পড়তে থাকেন। চিঠিতে লেখা ছিল। ‘আপনার ছেলে স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন ও বোকা। ওর দ্বারা কোন শিক্ষা, কোন উন্নতি করা কোনদিনই সম্ভব নয়, তাই ওকে আর কোনদিনই স্কুলে পাঠাবেন না।’ তাঁর চোখে তখন অঝোর ধারায় জল ।
থমাস প্রতিদিনই ডায়েরি লিখতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ডায়েরি পড়ে দেখা যায় তিনি লিখেছেন, প্রত্যেক স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন বোকা ছেলের একজন মা থাকে যে তাকে স্নেহ মায়া মমতা দিয়ে মানুষ করে তোলে। সত্য উন্নীত অন্য এক প্রজ্ঞায়, প্রতিবিম্বিত বাস্তবতায়।
১৩
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসায় অথবা বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় এনে মন্ত্রী-আমলা-আইন-প্রশাসন কার্যত তাদের ব্যবসার ‘রিসোর্স ইনপুট’, ‘উৎপাদনী মূলধন’হয়ে গেল।
সব ধরনের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গমালাই ‘আলো’। গামা-রে, এক্স-রে, মাইক্রোওয়েভস, রেডিও ওয়েভস-সব-ই আলো। ধর্ম আলাদা আলাদা। মিথ্যাচার, দুর্নীতি, ম্যানুপুলেশন, তঞ্চগ্রস্ত পুঁজি তরঙ্গক্ষোভে ‘ক্রোনি ক্যাপিট্যাল’। সরকার-আমলা-প্রশাসনের যোগসাজসে গড়ে ওঠা পুঁজি। একসাথে পথ-চলা, এক পথে চলা।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মস্কো গেলেন। সেখানে থাকাকালীনই, রাশিয়ার যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনকারী একটি সংস্থার সঙ্গে অনিল আম্বানি গোষ্ঠীর রিলায়েন্স ডিফেন্সের ছয় বিলিয়ন ডলারের একটি যৌথ উদ্যোগ সূচিত হয়। মোদী ফ্রান্সে, অনিল আম্বানি রিলায়েন্স গ্রুপ, র্যাফায়েল ফাইটার জেট চুক্তির পরে দাসী-র সঙ্গে চুক্তি হল। মোদী অস্ট্রেলিয়া পরিদর্শন কালে আদানির অস্ট্রেলিয়ায় কয়লা খনি কেনা সংক্রান্ত পরিকল্পনা চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। মোদীর বাংলাদেশ পরিদর্শন কালে আদানি, রিলায়েন্স পাওয়ার, এনটিপিসি, পেট্রোনেট বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। মোদীর আমেরিকা সফর কালে রিলায়েন্স ডিফেন্স যুদ্ধ জাহাজ মেরামতি চুক্তি সম্পাদন করে ইউএস নেভির সঙ্গে। মোদীর ইজরায়েল পরিক্রমা কালে আদানি এবং ইজরায়েলের এলবিট কোম্পানির মধ্যে চালকহীন বিমান প্রস্তুতির একটি যৌথ উদ্যোগ গড়ে ওঠে।
আদানির গুজরাটে ৭০০ একর সেজ এলাকা জুড়ে তৈরি হওয়া মুদ্রা পোর্ট ও ‘ওয়াটারফ্রন্ট ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্ট’ ঘিরে পরিবেশ ধ্বংস সহ একাধিক অভিযোগে গুজরাট হাইকোর্ট ২০১২ সালে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে এক সদস্যের একটি কমিটি, সুনীতা নারায়ণ কমিটি গঠন করে। কোর্ট কমিটির সুপারিশক্রমে প্রোজেক্টের ‘নর্থ পোর্ট’ ‘ব্যান’ করে দেয় এবং ২০০ কোটি টাকা জরিমানা (প্রোজেক্ট কস্ট-এর শতকরা ১ ভাগ) ধার্য করে। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসভা জরিমানা উঠিয়ে দেয়। শুধু তাই নয় আদানি পোর্ট ও সেজ-এর কাজকর্মের ওপর ২০০৯ সালে যেসব বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছিল সেসবও তুলে নেওয়া হয়েছে।
২০০৫ সালে এসইজেড অ্যাক্ট তৈরি হওয়ার সময়ে কাস্টমস ডিউটি বা অন্যান্য সব করে ছাড় দেওয়ার কোনও নিয়ম ছিল না। ২০১৬ সালের অ্যামেন্ডমেন্টে ছাড় দেওয়ার কথা ওঠে। আদানি পাওয়ার লিমিটেড এই অ্যামেন্ডমেন্ট অনুযায়ী ৫০৬ কোটি টাকা ছাড় দাবি করে। এপিএল দাবি করে কয়লা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানিতে কোম্পানি প্রায় ১০০০ কোটি টাকা কর দিয়েছে, যে টাকাটা সে আদৌ দেয়নি।
EPW’র সম্পাদক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা একটি নিবন্ধে জানিয়েছেন, আদানি ও এসার গোষ্ঠী মালয়েশিয়া থেকে কয়লা ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রপাতি আমদানি করার সময় ‘ওভার ইনভয়েস’ করে ৫০ হাজার কোটি টাকার ‘স্ক্যাম’ ঘটিয়েছে।
আদানি গ্রুপ সরকারের মদতে কেমন করে ব্যবসা করছে, মুনাফা অর্জন করছে, সেই লেখার প্রেক্ষিতে আদানি গ্রুপের পক্ষ থেকে তাঁর এবং পত্রিকা পরিচালন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কেন মানহানির মামলা দায়ের করা হবে না, এমন আইনি নোটিশ আসে। পরঞ্জয় আইনি নোটিশের জবাব দেন। ১৮ জুলাই ২০১৭ ট্রাস্টের সভায় কর্তৃপক্ষ পরঞ্জয়ের ওপর শর্ত আরোপ করল, পরঞ্জয় নিজের নামে কোনও লেখা লিখতে পারবেন না, পরঞ্জয়ের সঙ্গে একজন সহ সম্পাদক নিযুক্ত করে দেওয়া হবে, পরঞ্জয় এবং ট্রাস্টি বোর্ডের মধ্যেকার সম্পর্কের একটি নর্ম তৈরি করে দেওয়া হবে ইত্যাদি। পরঞ্জয় পদত্যাগ পত্র পেশ করতে বাধ্য হন। ২০১৬ সালের সমীক্ষা ট্রাস্টস পরিচালনাধীন EPW’র প্রধান সম্পাদক হন।
মিটিংয়ে ট্রাস্টের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন চেয়ারম্যান দীপক নায়ার, ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার, সমাজতত্ত্ববিদ দীপঙ্কর ঘোষ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজীব ভার্গব এবং আম্বেদকর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যাম মেনন। এঁদের কেউ বিরোধিতা করেছিলেন এমন কোন খবর জানা যায়নি।
পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা কিন্তু থেমে থাকেন নি। আগস্ট মাসের ২৫ তারিখে একটি ‘ওয়েবসাইট’ লঞ্চ করেছেন। আদানি ও তার গোষ্ঠীর ব্যবসার যাবতীয় দুর্নীতি সম্পর্কিত সবিশেষ গোপন তথ্য এই ‘ওয়েবসাইট’-এ সাধারণ মানুষের অবগতির জন্য রাখা থাকবে। ঘটনাচক্রে, ‘ওয়েবসাইট’ লঞ্চ করার মাত্র দু দিন আগেই, Directorate of Revenue Intelligence কর্তৃপক্ষ পরঞ্জয় উল্লিখিত সমস্ত অভিযোগের তদন্ত বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
১৪
৫ সেপ্টেম্বর (২০১৭) খুন হতে হল, বাঙ্গালোরে, নিজের বাড়িতে, কন্নড় ভাষায় প্রকাশিত ‘গৌরী লঙ্কেশ পত্রিকে’র সম্পাদক গৌরী লঙ্কেশকে। যুক্তিবাদী, ধর্মীয় উগ্রতা বিরোধী। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন নিতেন না। দু’জন বিজেপি কর্মীর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ করায়, মানহানির মামলা করেছিলেন স্থানীয় বিজেপি সাংসদ। সোশ্যাল মিডিয়ারও অকথা কুকথা। আদালতে জেল ও জরিমানা দুই-ই হয়। জামিনে ছিলেন।
আদানির ‘আইনবিরুদ্ধ’ ব্যবসার বিরুদ্ধে লেখায়, পরঞ্জয় পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। গৌরী খুন হলেন। রামচন্দ্র গুহ, খুনের জন্যে সঙ্ঘ-পরিবারের যোগাযোগের সম্ভাবনা- কথা বলায়, বিজেপি’র যুব সংগঠন প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলেছে, মানহানির মামলার হুমকি দিয়েছে।
পরঞ্জয় আদানি গোষ্ঠীর ব্যবসার যাবতীয় দুর্নীতি সম্পর্কিত গোপন তথ্য প্রকাশ্যে আনতে ‘ওয়েবসাইট’ লঞ্চ করেছেন। গৌরীকে হত্যা শুধু নয়, সেই খুনকে ‘অনিবার্য’ আখ্যায় শাসক ও মিডিয়ার একাংশের সমর্থনের বিরোধিতায় সরব রাজ্যে রাজ্যে সাধারণ মানুষ। শাসক, মুসলিম বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু ভারত গড়ার যে প্রচেষ্টাই নিক না কেন, ইসলাম ধর্মীয় মানুষকে উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচার করে প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লাগানোও অসম্ভব।
কর্মসংস্থান বাড়ছে না, বরং কমছে। বাড়ছে, বিরোধ, বিক্ষোভ। এমন সব খণ্ড খণ্ড অসংখ্য সত্য কখনও ধীর লয়ে, কখনও-বা ঝড় হয়ে আছড়ে পড়ছে অন্তর্জাতে। জ্ঞাপন বিন্যাসে উদ্ঘাটিত ‘সত্য’ আরো আলো চায়। আপতিত আলোর তীক্ষ্ণতায় দৃশ্যমান হবে, অনির্দিষ্ট অসম গতি ও ভর সম্পন্ন জ্ঞাপন। সংঘর্ষে সংঘর্ষে প্রতিবিম্বিত হবে বর্ণময় ‘সত্য’। আপাতত খুঁজে পাই না শ্রয়ণ। নোঙর-জমি। সময়স্রোতে ভাসমান শিকড়হীন আমি, স্মরণ করি, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ পড়ে ২৭ মাঘ ১৩৩৩, রবীন্দ্রনাথের সেই লেখা, ইংরেজরাজ ক্ষমা করবেন এই জোরের উপরেই ইংরেজরাজকে আমরা নিন্দা করব সেটাতে পৌরুষ নেই। ...
রাজশক্তির আছে গায়ের জোর। তার বিরুদ্ধে কর্তব্যের খাতিরে যদি দাঁড়াতেই হয় তাহলে অপরপক্ষের থাকা উচিত চারিত্রিক জোর। অর্থাৎ আঘাতের বিরুদ্ধে সহিষ্ণুতার জোর। কিন্তু আমরা সেই চারিত্রিক জোরটাই ইংরেজরাজের কাছে দাবী করি, নিজের কাছে নয়।
শক্তিকে স্বীকার করেই কলম চলবে।... রাজবিরুদ্ধতা আরামে নিরাপদে থাকতে পারে না। শক্তিকে আঘাত করলে তার প্রতিঘাত সইবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই কারণেই সেই আঘাতের মূল্য-আঘাতের গুরুত্ব নিয়ে বিলাপ করলে সেই আঘাতের মূল্য একেবারেই মাটি করে দেওয়া হয়।
প্রতিবাদেরও দণ্ড আছে এবং মনে করি তারও পুনরায় প্রতিবাদ আবশ্যক। নইলে গায়ের জোরকেই প্রকারান্তরে ন্যায্য বলে স্বীকার করা হয়।
ঋণস্বীকার :
অবভাস, চতুর্থ বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা, ২০০৪
বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী, এই সময়, ২৬ এপ্রিল ২০১৭
সেপ্টেম্বর ২০১৭
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)
আপনাকে স্বাগত। স্বাগত এই আর্যাবর্তভূমে। বাম হস্ত কনুই বরাবর ভাঁজ করে স্পর্শ করেছি আমার দক্ষিণ স্কন্ধদেশ। কণ্ঠে এনেছি দৃঢ় সুস্পষ্ট উচ্চারণ, হেইই আর্যাবর্ত। আপনার আমার দুজনেরই হাতে উল্কিসদৃশ পরিচয়জ্ঞাপক চিহ্ন। খোদিত রাষ্ট্র-বিন্যস্ত নিজ নিজ নাগরিক-স্তর। জলসত্র, সরকারি অফিস-কাছারি-আদালত, বেসরকারি মল-মার্কেট-টয়লেট-বিশ্রামাগার, স্কুল-কলেজ-উদ্যান-বিনোদনগৃহ, ট্রেন-বাস-বিমান-উড়ান- ভ্রমণ-অপেক্ষাগার, সিসিটিভি আচ্ছাদিত এবং সুশৃঙ্খল প্রহরাবৃত। প্রবেশপথ উন্মুক্ত হয় রক্ষিত ‘স্ক্যানার’ আমার পরিচয়জ্ঞাপক চিহ্ন স্ক্যান করে প্রবেশ-উপযুক্ত ছাড়পত্র মঞ্জুর করলেই। ‘শুদ্ধ’ রক্ত প্রবাহিত ‘বিধিসম্মত’ আর্যরাই একমাত্র ‘নিষেধাজ্ঞা বহির্ভূত’ সর্বত্র প্রবেশাধিকারে উপযুক্ত বিবেচিত হলেও, অপ্রয়োজনীয় ঘোরাফেরা রাষ্ট্র সঠিক মনে করে না। সর্বত্র পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত পথ ও প্রহরী। সকল দেশের সেরা এই আমাদের আর্যভূমি। একে রক্ষা করা আমার আপনার পবিত্র কর্তব্য। হেইই আর্যাবর্ত।
আমাদের বেশ-ভূষণ ‘স্মার্ট ট্র্যাকার কার্ড’ শোভিত। অভ্যন্তরস্থ ‘ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ’ সযত্নে রক্ষা করে আমার গমন-বিচরণ ক্ষেত্র। রাষ্ট্রের নিয়মিত নিরীক্ষণ ও নির্দেশাবলী দ্বারা আমাদের সুখ-অসুখ, শুভ-অশুভ, করণীয়-অকরণীয় কার্যাবলী সুনির্দিষ্ট। রাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ ও উপদেশ ‘অডিও টেপে’ সংকলিত। আমার কর্তব্য প্রত্যহ প্রাতঃকালে, রেডিও আর্যাবর্ত নিঃসরিত বাণী শ্রবণ-অবশেষে ‘অডিও টেপে’ মনোযোগ নিবিষ্ট করা। হেইই আর্যাবর্ত।
বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্র এখনও অমীমাংসিত। দলিত মূলবাসী গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের সামাজিক স্তরবিন্যাসে ‘সংখ্যক অবস্থান’ নির্দিষ্টকরণ। সর্বনিম্ন ‘ক্যাটিগরি’ সংরক্ষিত ‘ইসলাম’ ধর্মাশ্রিত মুসলমান জনগোষ্ঠীর। আর্যাবর্তে তারা ‘লেবার’, অবশ্যই ‘শুদ্ধিকরণ’ অন্তে। বৌদ্ধ জৈন শিখ ধর্মাবলম্বী জনসম্প্রদায় আর্যাবর্তের ‘হিন্দু’ ধর্মের অনুসারী বিবেচনায় উচ্চ ‘ক্যাটিগরি’। ‘ক্যাটিগরি’ ২/৩। আর্যাবর্তে খ্রিষ্টধর্ম স্বীকৃত ‘আন্তর্জাতিক ধর্ম’। আর্যাবর্ত আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী। বিশ্বাসে তার ‘নেশন স্টেট’। একক ধর্মানুসারী ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী’। হেইই আর্যাবর্ত।
রাষ্ট্রীয় প্রধানেরা আপাতত ব্যস্ত ‘স্কাইডোম’ নির্মাণ যজ্ঞে। সূর্যালোকের ক্ষতিকারক ‘আলট্রাভায়োলেট’ ও ‘ইনফ্রারেড’ রশ্মি প্রতিরোধক তন্তুজালে আর্যাবর্ত আচ্ছাদিত করা হবে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের ভাসমান তত্ত্ব-তথ্যাদির সব দূষিত বাতাস প্রতিহত করবে বিশেষ তন্তু নির্মিত জালিকা। অভ্যন্তরস্থ কার্বন-সালফার-নাইট্রোজেনের ভিন্ন ভিন্ন অক্সাইড গ্যাসসহ সিলিকন সমৃদ্ধ ভাসমান ধূলিকণারাশি, আধুনিক প্রযুক্তি-প্রধান শিল্পোন্নত দেশ-নির্মিত বিশেষ-শক্তিশালী-পাম্প দ্বারা অষ্টপ্রহর ‘স্কাইডোম’ বহিরস্থ অঞ্চলে নিক্ষিপ্ত হবে। সম্পন্ন হবে আনুসাঙ্গিক কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ক্রিয়াদি সহ দুটি আশু এবং সুদূরপ্রসারী কর্মকাণ্ড। প্রথমত, পাম্পসকল সর্বগাত্রে ফ্লুয়োরেসেন্ট রঞ্জক দ্বারা ‘আর্যাবর্তে নির্মিত’ অক্ষরমালায় অলঙ্কৃত থাকায়, আর্যাবর্ত জনপথবাসী, রাষ্ট্রের ক্ষমতায় নিজেদের গৌরবান্বিত বোধ করবেন ও ক্ষমতাকেন্দ্রের বিরোধিতা করার দুঃসাহস কেউ যদি পোষণ করেন অন্তরের গভীরে, তারা ভীতসন্ত্রস্ত হবে। দ্বিতীয়ত, উৎক্ষিপ্ত উত্তপ্ত বাতাসে আর্যাবর্তের বাহির প্রদেশে স্বাতন্ত্র্যবাদী মুসলমান-দলিত-মূলবাসী অধ্যুষিত ব্যাপ্ত বিস্তীর্ণ জনপদ অগ্নিগ্রাসে দগ্ধ হবে। আগ্রাসন-আশংকা মুক্ত হবে আর্যাবর্ত। জেনোফোবিয়া ও হেইট। হেইই আর্যাবর্ত।
২
বিগ ব্যাং। মহা বিস্ফোরণ। আনুমানিক ১৩৫০ কোটি বছর পূর্বে অস্তিত্বে এল, পদার্থ শক্তি সময় আর স্থান । পদার্থ বিজ্ঞানের বিচরণভূমি। কেটে গেল কম করে আরও প্রায় ৩ লক্ষ বছর। পদার্থ আর শক্তি, পরিমণ্ডলের চাপে তাপে তৈরি করল জটিল সব কাঠামো, অণু পরমাণু। মিথোষ্ক্রিয়ার অনুসন্ধান রসায়নবিদ্যায়। সময় গড়িয়ে গেল বহু শত লক্ষ কোটি বছর। আরো জটিল হল অণুর গঠন। স্পন্দিত হয় প্রাণ। জীববিজ্ঞান। আধুনিক মানুষের মতো দেখতে প্রাণীদের আবির্ভাব ঘটলো ২৫ লক্ষ বছর আগে।
হোমো সেপিয়েন্স। ৭০ হাজার বছর আগে। এই প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে ক্রমশ পরিলক্ষিত, জটিল এক কাঠামো। সংস্কৃতি, ইতিহাস।
সেদিন থেকে আজ। সংঘটিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব, নির্ধারণ করল ইতিহাসের গতিপথ। কগনিটিভ বা বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব, কৃষিবিপ্লব যে বিপ্লব গতি পেয়েছে ১২ হাজার বছর আগে আর বৈজ্ঞানিক বিপ্লব, বয়স কমবেশি ৫০০ বছর।
বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের ফলশ্রুতি আমাদের ভাষা। ভাষাগত দক্ষতা অর্জন। বিস্ময়কর নমনীয়। সীমিত সংখ্যক শব্দ ও সংকেত ব্যবহার করে সসীম সংখ্যক বাক্য গঠন। প্রত্যেকটির অর্থ স্বতন্ত্র। কগনিটিভ বিপ্লব পরবর্তী সময় থেকে হোমো সেপিয়েন্স চাহিদা অনুযায়ী তাদের আচরণকে সংশোধন ও পরিবর্তন করতে সক্ষম। সক্ষম, পরিবর্তিত আচরণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মে হস্তান্তর করতে, এবং কোনপ্রকার জেনেটিক বা পরিবেশগত পরিবর্তন ছাড়াই এই হস্তান্তর। হোমো সেপিয়েন্সের সামাজিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য গঠিত হয়েছিল কৃষিপূর্ব যুগেই। মস্তিষ্ক ও মানসিকতা, শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ, জীবনযাত্রায় অভিযোজিত।
শারীরিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা ডিএনএ দ্বারা চূড়ান্ত হয়। হোমো সেপিয়েন্সের অবস্থান শিম্পাঞ্জির সঙ্গে তুলনীয়। তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য ১৫০ জনের সীমারেখায়। গোষ্ঠী ১৫০ পার করলেই, যূথবদ্ধতায় বিশৃঙ্খল। অন্যদিকে, হোমো সেপিয়েন্স সেখানে এক, দুই, দশ হাজারের গণ্ডিও অতিক্রম করে অবলীলায়। শৃঙ্খলাপূর্ণ বহুতর বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। গোষ্ঠী-সম্প্রদায়, ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক, গণ উৎসব, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বহুবিধ কর্মকাণ্ড। অপরিচিত মানুষও, আকৃষ্ট হন, গোষ্ঠী-সম্প্রদায়-সমাজ ভুক্ত হয়ে যান, তার ভালোলাগার, পছন্দের কোনও এক প্রতীক-শব্দ-বাক্য-আচরিত যাপন বা কোনও এক নৈতিক বিধিমালায়।
তৈরি হয় মিথ, দেবতা এবং ধর্ম। অলীক কাহিনী বলার ক্ষমতাই হল সেপিয়েন্স ভাষার সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্য। গল্পে গল্পে আর বিশ্বাসের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক অপরিচিত মানুষ একে অপরকে সফলভাবে সহযোগিতা করে। গল্পে-বিশ্বাসে গড়ে ওঠা নেটওয়ার্ক – অ্যাকাডেমিক বৃত্তে ফিকশন, সামাজিক নির্মাণ, কাল্পনিক বাস্তব। এক দ্বৈত বাস্তবতা। একদিকে বস্তুগত বাস্তবতা অপর দিকে কল্পিত বাস্তবতা।
কাল্পনিক বাস্তবতার অপরিমেয় বৈচিত্র্য, আচরণের প্যাটার্নের বৈচিত্র্য আমাদের ‘সংস্কৃতি’র প্রধান উপাদান। সংস্কৃতির উদ্ভবের পর থেকে এর পরিবর্তন ও বিকাশ কখনো বন্ধ হয়নি। বিরতিহীন এই পরিবর্তনই ‘ইতিহাস’।
৩
দুটি ঠোঁট হয়ে এসো এ আস্যে বলো মধু, মধু বলো,
দুটি বুক হয়ে আমাদের মুখে প্রাণরসসুধা ঢালো।
দুটি নাসা হয়ে বাঁচাও মোদের এই তনু-কলেবর,
হয়ে দুটি শ্রুতি আনো সুশ্রুতি, শুনি যেন সুন্দর
(ঋগ্বেদ ২/৩৯, গৌরী ধর্মপাল পুরোনতুন বেদের কবিতা)
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে একদল ভ্রাম্যমান জনগোষ্ঠী সিন্ধু নদী অববাহিকায় প্রবেশ করে। কর্মঠ, উন্নত যুদ্ধাস্ত্রে বলীয়ান ও যুদ্ধবিগ্রহে পারদর্শী, যাযাবর এই জনগোষ্ঠীর পরিচিতি, ‘আর্য’। ধর্মে, বহু ঈশ্বর পূজারী। ভাবনা জুড়ে, প্রকৃতি। দেবতা, প্রাকৃতিক শক্তির রূপ – সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি, পবন, বারি, বসুধা। পূজা-পদ্ধতি, মুক্ত আকাশে অগ্নিকুণ্ড ঘিরে যাগযজ্ঞ। স্বভাবে, কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন বা বৈরাগ্য – নৈব নৈব চ। খাদ্যতালিকায় বৃষসহ প্রাণীমাংসাদি, পানীয় তালিকায় সুরা সোমরস। তাদের ভাষা থেকেই জন্ম, সংস্কৃত ভাষা। আচরিত ধর্মের পরিচয়, বেদে, ঋগ্বেদে।
সিন্ধু নদী-অববাহিকায় তখন, এক পরিকল্পিত ও উন্নত নগর সভ্যতা। লিপি, শিল্পকলা, ভাস্কর্য, নগর-পরিকল্পনার জ্ঞান, বিচিত্র কারুশিল্প, ধাতু ও খনিজ পদার্থ - সোনা, রুপো, তামা, টিন, সীসা আর ব্রোঞ্জের ব্যবহার-সমৃদ্ধ এক নাগরিক-জীবন। লৌহ অজানা।
খ্রিষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর পূর্বে সযত্ন নির্মিত সেই সভ্যতার ধ্বংসস্তূপে প্রাপ্ত মূর্তিসমূহের কয়েকটি, বর্তমানের ‘পশুপতিনাথ শিব’ মূর্তি সদৃশ্য। অলঙ্কার শোভিত একাধিক নারীমূর্তি। বৃক্ষ, সর্প, পশু পূজার অভিজ্ঞান অস্পষ্ট হলেও বিদ্যমান। দেবী ও শক্তি আরাধনার চল। জনগোষ্ঠীর খাদ্যতালিকায়, গম, যব, ফল, মাংস, মাছ। উৎপাদিত হতো তুলো। তুলো হতে কাপড়। কাপড় রঙ করার প্রচলন ছিল। ধর্ম চর্চায়, যাগযজ্ঞ নয়, পুণ্যস্নান। ছিল তীর্থক্ষেত্র, মিলনক্ষেত্র। খুব সম্ভব একাধিক জন-জাতি গোষ্ঠীর সম্মিলন, প্রাকবৈদিক, এই সভ্যতার রূপটানে। সভ্যতাটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল হয় আর্যদের আক্রমণে না হয় উপর্যুপরি নদী-বন্যায়, নদী-বাঁধ নির্মাণের অনুপযোগিতায়।
পৃথক দুই সভ্যতা। পৃথক, ধর্মাচরণ।
খ্রিস্টপূর্ব সহস্রাব্দের সূচনায় ধর্মীয় ঐতিহ্যের এই দুই ধারার সম্মিলনই বৈদিক ধর্মের সূচনাপর্ব। উদ্ভবস্থল, বর্তমান ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীক সীমারেখায় ভারতভূমি নয়, পাকিস্তান। সৃষ্ট হল, এক বহুজাতিক সমাজ, তাতে নানা গোষ্ঠী, নানা ধর্মবিশ্বাস, নানা জীবনবোধ, নানা জীবিকা।
উপনিষদ রচিত হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০, তারও কয়েক শতক পর গীতা, আবির্ভাব ঘটেছে বেদ-বিরোধী জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ভারতবর্ষ অনেকাংশেই বৌদ্ধ হয়ে গেলেও পরে আবার হিন্দু ধর্ম আধিপত্য বিস্তার করে। মধ্যবর্তী কালসীমায় পৌরাণিক কাহিনির বৈচিত্র্যে, সংস্কৃতির বিস্তারে, নৈতিক আচরণবিধিতে বৌদ্ধধর্মের স্থায়ী প্রভাব বিস্তৃত হয় হিন্দুধর্মে। প্রসারিত হয় প্রেম ও বৈরাগ্যের হিন্দু-আদর্শ। এবং এই কালপর্বেই (৮০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব) শুরু হচ্ছে কথিত হিন্দুধর্মের।
হ্যাঁ। কথিতই। বেদ পুরাণ উপনিষদ রামায়ণ মহাভারত মনুস্মৃতি গীতা ইত্যাদি মৌলিক সংস্কৃত কোন গ্রন্থে হিন্দু শব্দটিই নাকি নেই। ‘হিন্দু’ ফারসি ভাষার অন্তর্গত। অর্থও খুব একটা সম্ভ্রান্ত কিছু নয়। হিন্দু কোন ধর্মের নাম নয়, খুব সম্ভব একটি জোটের নাম। উন্নত বস্তু-সভ্যতার অধিকারী না হলেও বিজেতা হিসেবে আর্যরা ছিল বেশি শক্তিশালী। দেবলোক নিয়ে গোষ্ঠী-চেতনার বিস্তৃত মানস-জগতের সঠিকতায় নিঃসন্দিহান। বিজেতা আর্যদের হাতে উদ্ভূত নূতন উচ্চশ্রেণি, প্রচলিত বর্ণভেদ প্রথার পরিবর্তন ঘটিয়ে তৈরি করল এক কট্টর বর্ণভেদ-ভিত্তিক সমাজ কাঠামো। ভগবদ্গীতা হল সেই হিন্দুধর্মের জীবননীতি, নৈতিক আদর্শ। রূপরেখা পেল ধর্মের ভাবী গতিমুখ।
অনুসারী সামাজিক ঐতিহ্য আকর্ষণ করে মিথ-পুরাণের কোনও এক দেব-দেবী। জনগোষ্ঠীতে পূজিত হন তিনি রূপাতীত অশেষ রূপে। অসংখ্য ছোট-বড় ঝর্নাধারা মিশ্রিত হয় এক বিপুলতায়। বহু লোকাচার আর সংস্কৃতির সমাহারে বিন্যস্ত হয় হিন্দুধর্ম। লোকাচার স্বীকৃত সামাজিকভাবে, সাধারণ আচরণবিধি - সততা, নিঃস্বার্থ কর্ম, দয়া, প্রেম ইত্যাদি শাস্ত্রীয় অনুমোদনের সঙ্গে অসম্পর্কিত।
বহু বহু জনগোষ্ঠীর এই ভূখণ্ডে কেউ করে নদীর পুজো, কেউ বা পাহাড় কিংবা গাছের। আবার কেউ বা প্রাণীর পুজো। এর প্রত্যেকটি ধর্ম বিশ্বাসই প্রভাবিত করল হিন্দু ধর্মকে। লৌকিক আচার অনুষ্ঠান অঙ্গীভূত করে নেওয়া ছাড়াও সনাতন হিন্দু ধর্ম ক্রমশ বহু লৌকিক দেবদেবীকেও গ্রহণ করে নিল।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শেষ পর্যায়ে অবতারবাদের বিকাশ। ঈশ্বর অবতার হয়ে আসেন রাম, কৃষ্ণ কিংবা বুদ্ধে। ভগবদ্গীতা সহ রামায়ণ মহাভারতে এই ভাবনার স্বীকৃতি। স্বীকৃতি কিন্তু উপনিষদে নেই। বেদে তো নেই-ই। মহাকাব্যে রাম এবং কৃষ্ণ মানুষ। যদিও ঈশ্বরের অবতার হিসাবে তাঁরা দেবোপম। এই যুগে যাগযজ্ঞ জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে নৈতিক আচরণবিধিকে। বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের জায়গায় দেখা দিয়েছে জ্ঞান ও ভক্তির প্রতি আগ্রহ।
কৃষ্ণ কিংবা রাম। ব্যক্তিরূপে ঈশ্বর প্রেম। নিরাকার ঈশ্বর, সাকার বিষ্ণু শিব কালী। রূপাতীত রূপসাধনা। ভক্তি আন্দোলন। ভক্তিসাধনার ঐতিহ্য বৈদিক যুগে দেখা গেলেও, মোটামুটি অনার্য ঐতিহ্যের অন্তর্গত। অধিকাংশ মানুষের দেব-আরাধনা, ভক্তির চিরাচরিত সোজা পথেই, আচার-অনুষ্ঠান, কর্মের সঙ্গে যোগে, বিশুদ্ধ জ্ঞানের সঙ্গে অসম্পর্কিত।
শাস্ত্রীয় অনুমোদন ছাড়াই অসবর্ণ বিবাহের দৃষ্টান্ত। রচিত সাহিত্যেও তার উল্লেখ। মহাকাব্য, মহাভারত। আদিপর্বে রাজা যযাতি আর ব্রাহ্মণ-কন্যা দেবযানীর কাহিনি। যযাতি, দেবযানীকে বিবাহে অসম্মতি প্রকাশ করেন, কেন না – ‘‘আমি ক্ষত্রিয় আর তুমি ব্রাহ্মণ। তোমাকে বিবাহ করার যোগ্য আমি নই।” দেবযানী মানতে পারলেন না এ-কথা। যুক্তি দেখিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন, তাঁর প্রস্তাব রীতিমতো সংগত। যযাতি যুক্তিজাল বিস্তার করেও তাঁর মত প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হলেন এবং শেষ পর্যন্ত বিয়ের প্রস্তাব মেনে নিলেন। দেবযানীর বাবা, ব্রাহ্মণগুরু শুক্রাচার্যও এই অসম বিবাহে সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন।
হিন্দু সাহিত্যের বহু বহু পরিচিত এবং শ্রদ্ধেয় চরিত্রগুলিই বর্ণসংকর। মহাভারতের প্রখ্যাত প্রাজ্ঞ পুরুষ বিদুর শূদ্রাণীর পুত্র। বিদুরকে বলা হয়েছে মূর্তিমান ধর্ম; বলা হয়, ধর্মই বিদুর হয়েছেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র ধর্মোপদেশের জন্য বিদুরের শরণ নিতেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ এক গণিকার গর্ভজাত। ব্যাস এক ধীবরকন্যা আর পরাশর চণ্ডালিনীর সন্তান।
পরস্পরকে প্রভাবিত না করে বিশ্বাসী যাপন, সংস্কৃতি পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে না। ভারতেও এই ধারাবাহিক গতিশীলতা অক্ষুণ্ণ পরবর্তীকালে, মোগল শাসনকালে, ভারতে হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির মধ্যেও প্রভূত আদান-প্রদান। মুঘল রাজপুত কাংড়া গাড়োয়াল চিত্রকলায়, ভাস্কর্য আর স্থাপত্যে, ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতে এমনকি ধর্মান্দোলনেও ভারতীয় ভক্তি আন্দোলন ও ইসলামের সুফি ধর্মের ধারায়, এক সহজ আদান প্রদান।
সুফি গুরু মুইনুদ্দিন চিস্তি বসবাস করতেন হিন্দু তীর্থ পুষ্করে। হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই তাঁর শিষ্য। পঞ্চদশ শতকে অন্যতম খ্যাতিমান সাধক, মুসলমান তন্তুবায় কবীর। ধর্মবোধে, ইসলাম ধর্মের সুফি আর হিন্দু ধর্মের ভক্তি সাধনার ঐতিহ্য সমন্বিত। কবীর গান রচনা করেছিলেন সাধারণ মানুষের জন্যে। ভাষা সংস্কৃত নয় হিন্দি। তিনি বলতেন সংস্কৃত হল কূপজল আর সাধারণ মানুষের ভাষা হল বহতা নদী। বলছেন আল্লাই বলি কিংবা রাম, তোমার নাম নিয়েই বেঁচে আছি।
কোই রহিম কোই রাম বখানৈ
কোই করে আদেস।
নানা ভেষ ধনীয়ে সথে মিল
ঢুঁর ফিরে চহুঁ দেস।
কহৈ কবীর অন্ত না পৈছো
বিনা সত্য উপদেশ।
মহাকাব্যের রামের কথা গেয়েছেন, মুসলমান ঘরের সন্তান কবীর। গৃহস্থ সন্ন্যাসী। না দ্বৈতবাদী না অদ্বৈতবাদী। ভিক্ষা করতেন না। অন্নসংস্থান, কাপড় বুনে। বলতেন, ব্রহ্মা সকল সীমা পূর্ণ করে সীমার অতীত। সমস্ত জগৎ তাঁহার রূপ। সব বৈচিত্র্যেই অরূপের লীলা। কোথাও যাওয়া আসার প্রয়োজন নেই, ঠিক যেমনটি আছে তেমনটিতে প্রবেশ করাই সাধনা৷
মো কো কঁহা গুঁড়ো বন্দে
মৈতো তেরে পাসমেঁ।
না মৈ দেবল না মৈ মসজিদ
না পাবে কৈলাস মেঁ।
না তৌ কৌন ক্রিয়াকৰ্ম্ম মেঁ
নহী যোগ বৈরাগ মেঁ
খোজী হোয় তো তুরলে মিলি হৌ
পল ভরযী তালাস মেঁ।
কহৈ কবীর শুনো ভাই সাধে
সব স্বাঁসো কী স্বাঁস মেঁ।
শিখ ধর্মের প্রবক্তা নানক, কবীরের শিক্ষায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। কবীরের অনুগামীদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন, দাদূ (১৫৪৪-১৬০৩)। একজন ধুনুরি। মুসলমান পরিবারে জন্ম। দাদূর সঙ্গে মোঘল সম্রাট আকবরের ধর্মীয় প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। চল্লিশ দিনেরও বেশি চলেছিল সেই আলাপ। আকবর প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে চেষ্টা করেছিলেন দীন-ই-ইলাহি গ্রন্থে সমস্ত ধর্ম বিশ্বাসকে একত্রিত করতে। লক্ষ করার বিষয় ভারতে ভক্তি আন্দোলন তরঙ্গায়িত হয়েছে মুসলমান শাসন পর্যায়ে।
বাংলার ভক্তি আন্দোলনের সর্বাধিক পরিচিত ব্যক্তিত্ব চৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩)। আগে বাংলার মানুষকে প্রভাবিত করেছিলেন জয়দেব, বিদ্যাপতি আর চণ্ডিদাস। বাংলার বৈষ্ণব পদাবলীর জন্ম জয়দেবের গীতগোবিন্দে। বাংলা, মিথিলা এবং আসামেই শুধু নয়, গুজরাট, পঞ্জাব, রাজস্থানেও। ভাষা, খাঁটি বাংলা ও ব্রজবুলি। গোড়া থেকেই গান। দু-ছত্র বা চার-ছত্রের ‘ধুয়া’ পদ। ভাব সংহত, নিটোল। কবি-স্বাক্ষর শেষ পদে। ‘ভণই বিদ্যাপতি শুন বরনারী’।
পদাবলী সাহিত্য, প্রধানত কৃষ্ণের ব্রজপ্রেমলীলা। জনগোষ্ঠীতে, কৃষ্ণের কংসবধের শ্রব্য কথকথা বা ছৌ নাচের মতো দৃশ্যরূপের প্রয়োগ সুদীর্ঘকালের। বিষ্ণুর রাখালগিরির ইঙ্গিতও ঋকবেদে। বাংলায় কৃষ্ণ-উপাসনা, প্রধানত বালগোপালের ভাবনার পথে। ভক্তের দৃষ্টিতে। উপাস্যের সঙ্গে সম্পর্ক মধুর ভাবের। সখ্যরসের পদাবলী ছিল, হৃদয়ের উত্তাপ তাতে অপ্রতুল।
বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য। রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলায়, অভিসার আর বিরহ। প্রাণের স্পর্শে উষ্ণ। চৈতন্য, জাতিভেদ-বিরোধী ভক্তিধর্মকে এক শক্তিশালী ধর্মীয় আন্দোলনে পরিণত করলেন। লৌকিক রতিবিলাসকলা স্তর থেকে রাধাকৃষ্ণ কাহিনি একদিকে আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হল এবং একই সঙ্গে রাধার মহিমা, কৃষ্ণের মহিমাকে ছাপিয়ে গেল। কৃষ্ণ-বিরহ-উন্মাদনা জ্ঞানমার্গের মানুষজন ছিলেন, বর্ণবিভাগের সমর্থক। শাস্ত্রজ্ঞান চর্চা, প্রকৃতিগত কারণে উচ্চশ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। চৈতন্য শাস্ত্রজ্ঞ - নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণ – কেটে দিলেন সেই বাঁধ। প্লাবন, মহাপ্লাবন।
সহজিয়া সাধনার বাউল। ভিন্নধর্মী, কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান, বেশির ভাগই নিরক্ষর। তাদের ভাষায়, সহজপন্থী। পিছনে কোনো চিহ্ন রেখে যেতে চান না। নদীতে যখন স্রোত, সে তো কোনো দাগ রেখে যায় না। যারা নিজেদের ছোট ছোট প্রয়োজনে কাদার উপর দিয়ে নৌকো নিয়ে টানাটানি করে, তারাই লম্বা আঁচড় রেখে যায় পেছনে। এটা সহজ পথ নয় । ভক্তদের জীবনের মধ্য দিয়ে যে ভক্তিরসের স্রোত বয়ে চলেছে তাতে নিজের ভক্তিরসের ধারাকে মিশিয়ে দিয়ে ভেসে চলাই আসল কাজ। বাউল ভক্তরা হিন্দু ও মুসলমান সমাজের নিম্নবর্গ থেকে আসা। দেহতত্ত্বের সাধনা।
এই দেহ ইস্টিমার নূর নবী প্যাসেঞ্জার
খোদ খোদায় টিকিট মাস্টার জাহাজের মাঝার গো।।
আরে দুই মুড়া দুই হাইনা ছাওয়া
আছে দুইডা ডাইনা বাওয়া
ঘোরতে আছে নিত্য নেওয়া চক্ষু দূরবীনদার গো।।
উপরে হাওয়া নীচে পানি মাঝখানে আগুনের খনি
জ্বলতে আছে দিন-রজনী পূবেরই হাওয়ায় গো।
আরে যে মালেক নেয় জবান সব খালাসী পেরেশান
ভেঙে জাহাজ খানখান হইরে কোরান গো।।
মনসা, ধর্মঠাকুর, চণ্ডী, শীতলার মতো লৌকিক দেবদেবী বাদ দিলে বাঙালীর আরাধ্য কালী আর শিব। চৈতন্যের কৃষ্ণনাম। বৈষ্ণব পদাবলি। রাধাকৃষ্ণের প্রেমগাথা। কীর্তন। সেই সূত্রে বিষ্ণু। রামচন্দ্র বিষ্ণু অবতার। সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতিতে, হিন্দু-মুসলমান মিলিত সংস্কৃতি।
শুধু কি আল্লা বলে ডাকলে তারে
পাবি ওরে মন পাগলা
যে ভাবে আল্লাতালার বিষম লীলা
ত্রিজগতে করছে খেলা।
কতজন জপে মালা তুলসীতলা
হাতে ঝোলে মালার ঝোলা
আর কতজন হরি বলি মারে তালি
নেচে গেয়ে হয় মাতেলা।
কতজন হয় উদাসী তীর্থবাসী
মক্কাতে দিয়েছে নেলা
কেউ বা মসজিদে বসে তার উদ্দেশে
সদায় করে আল্লা আল্লা। (পাঞ্জু শাহ)
৪
উপনিষদের দার্শনিক এবং কল্পিত বাস্তবতা প্রধানত সমাজের উচ্চকোটি মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বৌদ্ধ আর জৈনরা তাদের নিজস্ব ব্যবহারিক নীতিশাস্ত্র অনুযায়ী মানুষকে বৈদিক দেবদেবীর জায়গায় বসিয়েছিল। নাথ, যোগী আর সিদ্ধাচার্য সম্প্রদায় আরও এক ধাপ এগিয়ে দাবি জানিয়েছিল মানব শরীরের মধ্যেই নিহিত, ধর্মের যাবতীয় রহস্য। দেহস্থ স্নায়ুতন্ত্র। ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না ।
আর কেন মন ভ্রমিছ বাহিরে
চল না আপন অন্তরে।
তুমি বাহিরে যারে তত্ত্ব কর,
অবিরত সে আজ্ঞাচক্রের উপরে।
কুলকুণ্ডলিনী-শক্তি রয় মূলাধারে,
প্রণয়ের যোগে জাগাও তাহারে,
শক্তি চেতন হলে পূর্ণানন্দ মিলে
তোমার সদানন্দ স্বরূপ একবার দেখ না।।
বামে ইড়ানাড়ী, দক্ষিণে পিঙ্গলা
রজঃ-তমঃ-গুণে করিতেছে খেলা,
মধ্য বিরাজে সুষুম্না, তাকে ধর না কেন সাদরে।।
তখন আত্মকথা জ্ঞানে
উদয় হবে প্রাণে
তুমি যারে খোঁজ সদাই বাহিরে।।
বহু বহু শতক পার করে আমরা লক্ষ করি, প্রাচীন এক তান্ত্রিক ধর্ম-বিশ্বাস কেমন করে জানি কথাসরিৎসাগর হয়ে ফল্গুধারার মতো অন্তঃসলিলা, প্রায়-নিরক্ষর বাংলার বাউলে। ধর্মের গুহ্য রূপ। দেহতত্ত্ব। বাউল তার একতারায় নিবিষ্ট হন,
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মনবেড়ি দিতাম তার পায়।
আটকুঠুরি নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝলকা কাটা
তার ওপর আছে সদর কোঠা
আয়না মহল তায়।
মন তুই রইলি খাঁচার অংশে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে
কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে
লালন কয় খাঁচা খুলে সে পাখি কোনখানে পালায় ৷৷
মন্দির মসজিদ বা অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিম্নবর্গের মানুষজনের প্রতি থাকে নানান বিধিনিষেধ। প্রান্তিক মানুষ সৃষ্টি করে চলেন তাদের প্রেম-ভক্তি আন্দোলিত নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতি।
সন্ন্যাসী বানাইলো তোরে কে রে
সোনার বরণ গৌর চান রে।
গৌর রূপ দেখিয়া হইয়াছি পাগল
ঔষধ আর মানে না
চল সজনী যাই গো নদীয়ায়।
রাই রূপে শ্যাম অঙ্গ ঢাকা
কি হেরিলাম ভঙ্গী বাঁকা কি হেরিলাম
কি হেরিলাম কি হেরিলাম ভঙ্গী বাঁকা।
প্রেম কল্পিত-বাস্তবতাতেই নয়, বাস্তবের রুখা-ফাটা জমিতেও। সে যে জাত মানে না, মানে না ধর্ম। জাত-ধর্ম লীন হয়ে যায় মানুষে। সবার ওপর মানুষ সত্য। ব্যক্তি প্রেম, ঈশ্বর প্রেম, প্রকৃতি প্রেম মিলে মিশে একাকার, অরূপরতন সন্ধানী।
প্রেম করাইছেন ইউসুফ নবী
তার প্রেমে জুলেখাবিবি গো
ও তারা এক মরণে দুইজন মরে সই গো
এমন মরে কজনা
ডুব দিলাম না।
চণ্ডীদাস আর রজকিনী
তারাই প্রেমের শিরোমণি গো
ও তারা এক মরণে দুইজন মরে সই গো
এমন মরে কজনা
ডুব দিলাম না। (বাউল (ফিকিরি)
শহরকেন্দ্রিক ‘ভদ্র’ বর্ণহিন্দু সমাজের সাংস্কৃতিক কৌলিন্য, সমাজের নমশূদ্র বাঙালী, মূলবাসী জনগোষ্ঠী, দলিত ও নিম্নবর্গীয় মানুষজনদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিল। বিচ্ছেদ ঘটল, হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠীর।
‘হিন্দুধর্ম’ গ্রন্থের ভূমিকায় ক্ষিতিমোহন সেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, খ্রিস্টান, ইসলাম বা বৌদ্ধ এইসব ধর্মের যেমন এক - একজন প্রবর্তক আছেন, হিন্দু ধর্মের তেমন কোনও প্রবর্তক নেই। প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে ভারতের সমস্ত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সাঙ্গীকরণ ও স্বীকরণের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ গড়ে উঠেছে এই ধর্ম। ফলত মতান্তরের মীমাংসার জন্য এর কোন বাইবেল, কোরাণ বা ধম্মপদ নেই। বেদ, উপনিষদ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, তথাকথিত ষড়দর্শন-বিষয়ক গ্রন্থাবলী, ভক্তিধর্মান্দোলনের পদাবলী সাহিত্য, মরমীয়া সাধকের গান – এ সমস্তই প্রামাণ্য আকর, কিন্তু কোনওটিই এককভাবে নয়।
সূচনাপর্বেই উল্লেখ করছেন, এই ধর্ম গড়ে উঠেছে সুদীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে, চিন্তাজগতের অজস্র বৈচিত্র্য নিয়ে। তথাকথিত আর্য আক্রমণের পূর্বেকার দ্রাবিড় সংস্কৃতি, অদ্রাবিড়ীয় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, যথার্থ সংস্কৃতায়িত আর্য সংস্কৃতি, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ধর্ম এবং বাইরে থেকে আসা ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম – হিন্দুচিন্তার বিবর্তনের নানা ধাপ হিসেবে এ সমস্তই অনুসন্ধানের বিষয়।
বস্তুত হিন্দু ধর্মকে নির্দিষ্ট অর্থে রিলিজিয়ন বলা যায় না। হিন্দু শব্দটি এসেছে সিন্ধু (নদী) থেকে, কেননা পারস্যবাসীরা ভারতের কথা বলতে গিয়ে বলতেন সিন্ধুর ওপারের দেশ। শব্দটিতে জাতিগত ইঙ্গিতই স্পষ্ট, সিন্ধুতীরের বা ভারতের মানুষের ধর্ম। হিন্দু সমাজ বহু জাতি আর বহু সংস্কৃতির মিশ্রণ। সমাজ ধর্ম সবেতেই গতিময়তা। ধর্মের ইতিহাস যেন এক সভ্যতার ইতিহাস। একমাত্রিক সরলরৈখিক নির্দিষ্ট কোন অবয়ব-আকৃতির চলন নয়, অন্তঃসলিলা অনির্দিষ্ট অনাকৃতি এক ভাব কল্পনারাজির অনায়াস অবিন্যস্ত যৌগিক বিচরণ, বহুমাত্রিক তার বিস্তার। স্ব স্ব গোষ্ঠী-সম্প্রদায়-জনপদবাসীর আচার-আচরণ-ধর্মীয় বিশ্বাস-অবিশ্বাস-ন্যায়-নৈতিকতার স্বাতন্ত্র্য বিঘ্নিত না করে সহিষ্ণু সিঞ্চন। বহু বর্ণ রঞ্জিত এক সাধনার আসন। ছোট বড় টুকরো টুকরো এলোমেলো বহু বর্ণ রঞ্জিত বাউল-ফকিরি পোশাক কি বাংলার ‘সাংস্কৃতিক বহুত্বের’ প্রতিনিধিত্বকারী কোনও ইঙ্গিত?
বাংলার ভক্তি আন্দোলনের কৃষ্ণ, কুরুক্ষেত্রের সুদর্শন চক্রধারী কৃষ্ণ নন, যশোদানন্দন। বালগোপাল। বাংলার রামও রাক্ষস নিধনকারী ধনুর্ধর বীর নয়, সংসারী বনবাসী। বাঙালী কাঁদত সীতাবিরহে। অগ্নিপরীক্ষায়। সীতার পাতালপ্রবেশ। ময়মনসিং গীতিকায়, পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে কবি চন্দ্রাবতীর রামায়ণে, প্রধান চরিত্র রাম নয়, সীতা।
বাঙালির এই রাম শ্রী হারিয়ে কোণঠাসা হয়ে গেলেন। রামানন্দ সাগরের টেলিসিরিয়ালের রাম ঘরে ঘরে ঢুকে গেল। এই রাম শস্ত্রধারী। তবু আজও দশেরার রাবণ বধ নিয়ে বাঙালির মাতামাতি নেই। বিশাল কুশপুত্তলিকায় আগুন লাগিয়ে উল্লাস প্রকাশ নেই। রামানন্দ সাগরের শস্ত্রধারী ‘রাম’, হিন্দু বাঙালির ‘মুসলমান বিদ্বেষ’ আর বিজেপি’র দাঙ্গা সংস্কৃতি মিলিয়ে নেওয়া হল।
এই সময়কালে এমত পরীক্ষাগার গুজরাট।
গণকবর। লাশ, লাশ, লাশের স্তূপ।
৫
রাম মন্দিরের গুজরাটি করসেবকদের ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে আগুন লাগিয়ে হত্যা করা হয়েছে। খুন করেছে নাকি মুসলমানেরা। অতএব প্রতিশোধ। প্রতিহিংসা।
‘জয় শ্রীরাম’ রণহুঙ্কারে রাষ্ট্র-(অ)-নৈতিক ক্ষমতাপুষ্ট অসামাজিক অধার্মিক যুথবদ্ধ একদল মানুষ শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে অনিয়ন্ত্রিত এক পরিস্থিতি তৈরি করল। খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুঠে আমেদাবাদ কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল। ভয়ার্ত মানুষজনের ক্রন্দন-আর্তি-শোক-ক্রোধ-অসহায়তায় গুঁঙা। অকল্পনীয় বীভৎসতা। জ্বলন্ত-রক্তাক্ত-আহত-নিহত, শিশু-নারী- পুরুষ-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-যুবক-যুবতী। বারবার ঘুরেফিরে অগণন মৃতের ছবি। ধ্বস্ত, ত্রস্ত, বিধ্বংস সমাজ-সংসার, নগরের চিত্রমালা। প্রিন্ট মিডিয়ায় সাক্ষাৎকারের বিবরণ, টেলিভিশনের পর্দায়, ‘লাইভ’। প্রথম তিন দিনেই খুন কয়েক হাজার মুসলমান মানুষ, রাজ্য-রাজধানীর অস্থায়ী শিবিরে, সংখ্যায় ১,১০,০০০ মুসলমান মানুষজন। সংঘর্ষ-দাঙ্গা সংগঠিত করার জন্য পুলিশ-প্রশাসন-দাঙ্গাকারীদের সুনিপুণ সমন্বয় সাধনের দক্ষতা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তখন, সঙ্ঘ প্রচারক শ্রী নরেন্দ্র মোদী। দেশের প্রধানমন্ত্রী, আরেক সঙ্ঘ প্রচারক শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। ২০০২’র গুজরাট আমেদাবাদ দাঙ্গা। ‘জয় শ্রীরাম’।
আমেদাবাদ দাঙ্গা, সর্বস্তরে নিন্দিত হয়েও শাসক উপলব্ধি করল, রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে কিভাবে ‘মুসলমান’দের ত্রস্ত, সন্ত্রস্ত, পদানত রাখা যায়, বৃহত্তর সমাজ থেকে ‘এক্সক্লুড’ করা যায়। অনুকূল ‘সত্য’ নির্মাণ করা যায়। সে পারে। সে সক্ষম। আরএসএস-এর হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান, মুসলমান বর্জিত ভারত, মনোলিথিক ভারত, শুধু কিছু সময়ের অপেক্ষা ‘জয় আর্যাবর্ত’। ‘জয় শ্রীরাম’।
অবতারবাদের বিকাশে, ঈশ্বর অবতার হয়ে আসেন রাম অযোধ্যাকাণ্ডের শুরুতে বর্ণনা করা হয়েছে, রাম সনাতন বিষ্ণু। তিনি রূপবান, বীর্যবান, অসূয়াশূন্য। তিনি সর্বদা প্রশান্তচিত্ত, মৃদুবাক্যে কথা বলেন, পরুষ উত্তর দেন না। কেউ একটু উপকার করলেও তিনি তুষ্ট হন, উদার স্বভাববশত শত অপকারও মনে রাখেন না। তাঁর মতি কুলোচিত, ক্ষাত্রধর্মকে তিনি অতিশয় শ্রদ্ধা করেন। অশ্রেয়স্কর ও ধর্মবিরুদ্ধ কথায় তাঁর রুচি নেই। বিচার ক্ষেত্রে তিনি বৃহস্পতির ন্যায় উত্তরোত্তর যুক্তি দেখাতে পারেন। তিনি নিরোগ, তরুণ, বাগ্মী, বিশালবপু, দেশকালজ্ঞ, লোকচরিত্রে অভিজ্ঞ, জগতে তিনিই একমাত্র সর্বগুণান্বিত রূপে সৃষ্ট।
এই রামের কথা বলেছেন হিন্দুধর্মের, ভক্তি-আন্দোলনের প্রধান পুরুষেরা। আন্দোলিত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। জনগোষ্ঠী সম্প্রদায়। হিন্দু মুসলমান। খুনী, লুঠেরা, ধর্ষণকারীদের ‘জয় শ্রীরাম’য়ের রাম, হিন্দুধর্মের ‘রাম’ হতে পারে না।
খুনী, লুঠেরা, ধর্ষণকারীরা গুজরাটিও নন। গুজরাটের অধিকাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। জৈন প্রভাব স্পষ্ট। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় পর্যটক লুডোভিকো ডি ভার্থেমা গুজরাট ঘুরে এসে জানিয়েছিলেন, জৈন ধর্মের প্রভাব এখানে এত বেশি যে রক্ত আছে এমন কোনো প্রাণী তারা ভক্ষণ করেন না। কোনো জীবিত প্রাণী খুন করেন না। এরা না মুসলমান, না হিন্দু। সদাচরণে বিশ্বাসী।
হিন্দু ধর্মের ভক্তি আন্দোলনেও গুজরাটের অবদান অনস্বীকার্য। অন্যতম প্রধান উৎসব রাধা-কৃষ্ণের রাসলীলা। এক সময়ের সূর্য উপাসক, বৈদিক ও লোকধর্মের সচল প্রবাহে এবং জনগোষ্ঠী সমূহের ওপর জৈন ধর্মের প্রভাবে নিরামিশাষী। সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব স্পষ্ট। মহাত্মা গান্ধি এই জনপদেরই সন্তান। মহাত্মা গান্ধির রাম, মহাকাব্যের রাম, হিন্দুধর্মের ‘রাম’, ‘জয় শ্রীরাম’য়ের রাম নয়।
এই জনপদবাসীদের আর এক বৈশিষ্ট্য আছে। সমুদ্র তীরবর্তী একাধিক প্রাকৃতিক বন্দর-সমৃদ্ধ এই দেশের মানুষ বাণিজ্য-সূত্রে ছড়িয়ে আছেন বিশ্বজুড়ে। আনুমানিক সাড়ে পাঁচ কোটি। ৭০০ বছরেরও বেশি সময়কাল জুড়ে পুষ্ট গুজরাটি ভাষাভাষী মানুষের ব্যাপক প্রভাব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এবং আফ্রিকায় বিশেষ করে কেনিয়া, উগাণ্ডা, তানজানিয়া, জাম্বিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায়। আমেরিকা ও কানাডায় এই ভাষাভাষী জনসমষ্টি দ্রুতবর্ধমান। ইউরোপে বৃটিশ-দক্ষিণ-এশিয়া ভাষাগোষ্ঠীর দ্বিতীয় স্থানেই গুজরাটি ভাষাভাষী মানুষ। লণ্ডনে চতুর্থ ভাষাগোষ্ঠী। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানে ৩০ লক্ষাধিক গুজরাটি ভাষাভাষী মানুষের বাস, করাচি শহরেই সংখ্যা লক্ষাধিক। জাতিসঙ্ঘে নথিভুক্ত ১৯০টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ১২৯টি রাষ্ট্রে গুজরাটি ভাষাভাষী মানুষের বাস। গোটা বিশ্বে অনাবাসী ভারতীয়ের এক-তৃতীয়াংশই গুজরাটি।
অভিবাসী গুজরাটি ভাষাভাষী মানুষেরা তাদের নিজেদের মধ্যে এবং ভারতীয় স্বজন-পরিজনদের সঙ্গে নিকট সম্পর্কসূত্র বহন করে চলেন। এমনকি মালয়ালি ভাষাভাষী অভিভাবকদের ৮০ শতাংশ, কন্নড় ভাষী অভিভাবকদের ৩৬ শতাংশ যেখানে মনে করেন তাদের সন্তানেরা মাতৃভাষা নয়, ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত হয়ে উঠুক, সেখানে শতকরা ৮১ জন গুজরাটি অভিভাবকই বিশ্বাস করেন ইংরেজি নয়, গুজরাটি ভাষা-সংস্কৃতিই তার সন্তানের বিকাশ পথ হোক। এমনকি ২০০৬ সালে জুনাগড়ের কৃষকেরা National Highway authority-র একটি বিজ্ঞপ্তি হিন্দি ভাষায় প্রচারিত হলে এর বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের হয় সেই প্রসঙ্গে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে গুজরাট হাইকোর্ট জানায় ‘Hindi is a foreign language for Gujraties’ (TNN, January 1, 2012)
ভাষা-সংস্কৃতি-ব্যবসায়িক সম্পর্কসূত্র সৃষ্ট গুজরাটি অস্মিতা জন্ম দিল গুজরাটি জাতিসত্তার ‘জাতীয়তাবোধ’ নয় এক দর্পিত ‘জাতীয়তাবাদ’। ‘ব্যাক টু সয়েল’, ‘ব্যাক টু মাদার’ মানসিকতা যেমন ‘ইনক্লুসিভ জাতীয়তাবোধ’ জন্ম দেয়, ঠিক তেমনই ‘জাতিসত্তার এক্সক্লুসিভ অস্তিত্ব ও একক নিয়ন্ত্রণ আকাঙ্ক্ষা’রও জন্ম দেয়। খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতকের মুসলমান শাসকের আধিপত্যকামী শাসন হয়ত গুজরাটি জাতিসত্তার ‘অন্তর্গত রক্তে ক্রিয়াশীল বর্তমান। গুজরাট নয়, বিদেশে বসবাসকারী অথচ গুজরাটি একাত্মবোধ-মনস্কতা যে ‘হিন্দু’ ধর্মীয় বোধ নির্মাণ করে তা স্থিত হয়, হেগরেওয়ার-সাভারকারের ‘রাম’ কল্পনায়। হেগরেয়ারের ‘রাম’, হচ্ছেন এমন এক ‘নির্মিত বলশালী অবতার’, যিনি মুসলমান-রূপ রাক্ষস নিধন করেন।
গান্ধির ‘রাম’ ছিলেন, ঈশ্বর। তাঁর জন্ম সুখে দুখে আনন্দে। ধর্ম, লোকাচার, যাপন, মূল্যবোধ, নৈতিকতায়। অনুভবের দৃশ্যমানতায়। যা মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক। উত্তর ভারতের ‘রাম’ রামচরিত মানসের ‘রাম’। রামায়ণের ‘রাম’। ভক্তিবাদের ‘রাম’, মহাকাব্যের নায়ক ‘রাম’। অপ্রাতিষ্ঠানিকই মঞ্জুরেকর-হেগরেওয়ার-সাভারকারের ‘রাম’ জন্ম নেয় ফৈজাবাদে। ‘রাম’ই হচ্ছেন আদর্শ পুরুষ। ‘রাম’য়ের পতাকাই সংঘের পতাকা। মুসলমানেরা তার ওপর গড়েছে ‘বাবরি মসজিদ’। ‘বাবরি মসজিদ’ ধ্বংস করে উদ্ধার করতে হবে, ‘রাম জন্মভূমি’। হিন্দুদের ‘টাস্ক’! ‘কর্তব্য’!
১৯২৮ সাল। কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন। মতিলাল নেহরু সভাপতি। জিন্নাহ তখন কংগ্রেস সদস্য। অধিবেশনে জিন্নাহ্ তাঁর বক্তব্যে বললেন, হিন্দু আর মুসলমান, এই দুই সম্প্রদায় হাতে হাত না মেলালে ভারতের উন্নতি সম্ভব নয়।
কংগ্রেস সদস্য, মঞ্জুরেকর। সটান দাঁড়িয়ে জানালেন, এত সাহস! মুসলমান একটা সম্প্রদায় মাত্র। হিন্দু, মহাজাতি। জাতি কখনও সম্প্রদায়ের স্তরে নিজকে নামিয়ে আনতে পারে না। অধিবেশন মঞ্চ চুপ। জিন্নাহ্ সভাস্থল ছেড়ে বের হয়ে উত্তরপ্রদেশের এক মুসলিম লীগ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানালেন, ভারতীয় মুসলমানদেরও তিনি ‘জাতি’ পরিচয়ে নির্মাণ করবেন। দ্বিজাতি তত্ত্বের আগ্রাসী বাড়বাড়ন্তের সূচনা।
মঞ্জুরেকর ছিলেন মারাঠি ব্রাহ্মণ। হিন্দু মহাসভার সদস্য। হেগরেওয়ারের বন্ধু। হেগরেওয়ার ইতিমধ্যেই ১৯২৫ সালে গড়ে তুলেছেন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, আর-এস-এস। বৃটিশ বিরোধিতা বা ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা নয়, বরং ইংরেজদের মুসলমান বিরোধিতা কাজে লাগিয়ে, তাদের সহযোগিতায় মুসলিম বিতাড়ন।
এই ভাবমানস যুক্ত করল অর্থনৈতিক বিত্তশালী ব্যবসায়ী ‘অভিবাসী’ গুজরাটি ভারতীয়দের সঙ্গে দেশস্থ গুজরাটিদের। সামাজিক নির্মাণের এক কল্পজগৎ। গুজরাট হবে সেই নতুন ভারতের পথপ্রদর্শক। ‘জয় শ্রীরাম’ তার নিশান, তার রণহুঙ্কার।
মূলত ব্যবসায়ী, গুজরাটি নাগরিক-সমাজ। ব্যবসায়িক স্বার্থ তার চলনে-মননে। পুঁজির স্বাস্থ্য-সুরক্ষা-সচেতন। আশ্বাস দিল সরকার। শিল্পপতিদের উদ্দেশে প্রশাসন যথার্থই হাত বাড়িয়ে দিল। হাত বাড়িয়ে দিল আর একটু বেশি, গুজরাটি শিল্পপতিদের উদ্দেশে।
গুজরাটি অস্মিতা। গুজরাটি অহমিকার প্রকাশ ঘটুক। সরকার, সরকারি প্রশাসন, সবরকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।
দরজা খোলা সব শিল্পপতির জন্য। যে কোনও শিল্পে, যে কোনও শর্তে। জল জমি নিঃশর্ত। সেজ (SEZ) এলাকা। শিল্পপতি-ব্যবসায়ীর কথাই শেষ কথা। জমির কোনো উর্ধ্বসীমা নেই। বসত জমি হোক অথবা চাষ জমি। উচ্ছেদের দায়িত্ব নেবে গুজরাট সরকার, নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং। স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারক মাত্র! গুজরাট, একমাত্র গুজরাটেই আছে, প্রাকৃতিক সমুদ্র বন্দর। এক নয়, একাধিক। ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাট’। অবশ্য অনেক আগে থেকেই আম্বানি-আদানিদের ব্যবসায়িক উত্থান অনেকটাই সরকার-প্রশাসন- আমলা-উৎকোচ পোষিত।
অতএব, আর্থিক সচ্ছলতা ‘সামাজিক মিথ নির্মাণ’ প্রকল্পে। মুসলমান বর্জিত আর্যাবর্ত। ভারত হবে আর্যাবর্ত।
বীজ বোনা হয়েছিল আগেই। বিজেপির একাধিক রাজনৈতিক নেতা, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, প্রকাশ্যে এনেছিলেন তাদের মনোভাব, মুসলিমদের এদেশে থাকা উচিত নয়। থাকতে দেওয়া উচিত নয়। ওরা জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেশকে বিভক্ত করেছে তবুও তারা এদেশে। কী প্রয়োজন! ওদের ভূখণ্ড আলাদা। আর-এস-এস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দলের শ্লোগানই ছিল, ‘মুসলমান কি জায়গা, ইয়া পাকিস্তান ইয়া কবরস্তান’। গোধরায়, ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে আগুন লেগে/লাগিয়ে গুজরাটি করসেবকদের মৃত্যু/হত্যার ঘটনা সেই জমিতে জল সিঞ্চন করল। মুসলমান-নিধন-যজ্ঞ।
যজ্ঞের ভয়াবহতার এমনই এক সম্প্রচার চেয়েছিলেন গুজরাট-সরকার-প্রধান শ্রী নরেন্দ্র মোদী। এমনই এক সম্প্রচার যা কিনা ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু’ বিশেষভাবে মুসলমান সমাজের মধ্যে সৃষ্টি করবে ‘নিরাপত্তাহীনতা’, ভাববে ‘এই দেশ, ভারত, আমার স্বভূমি নয়, এখানে বসবাস করতে হলে, করতে হবে, হিন্দু ভারতের ‘টার্মস অ্যান্ড কনডিশন’ মেনেই। হিন্দু ভারত, একমাত্র হিন্দু ভারতই তাকে দেবে, দিতে পারে নিরাপত্তা। দাঙ্গা বিবরণ সরবে সম্প্রচারিত হয়েছিল ‘লাইভ’ টিভি পর্দায়, দৈনিক পত্র-পত্রিকায়।
কোন এক ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া বর্ণন সবসময়ই বর্ণনাকারীর অবস্থান-নির্ভর। উপাত্ত থেকে বর্ণনাকারী তাঁর বোধ ও যোজকের প্রেক্ষিতে, একটি জ্ঞাপন নির্মাণ করেন। এটা এখন নির্মাতা। নির্মাণ উপযোগিতা নির্ভর। কাদের জন্য নির্মাণ, কাদের হয়ে নির্মাণ, নির্মাণ সময়কালীন স্থানিক সুবিধা-অসুবিধা বা বিধিনিষেধ, বর্ণন-মাধ্যম ইত্যাদি প্রভৃতি তাঁর জ্ঞান-চেতনা-বোধকে সীমায়িত করে। সীমাবদ্ধ জ্ঞান-চেতনা-বোধ সাপেক্ষে নির্মিত সেই বর্ণন থেকে পাঠক-শ্রোতা-দর্শক যে উপলব্ধিতে পৌঁছোন, সেই সত্য দ্রষ্টা সাপেক্ষ, বর্ণন-নির্ভর-খণ্ডিত এক সত্য। উপস্থাপিত/বর্ণিত সেই বাস্তব বর্ণনকারীর বর্ণন-নির্মাণ-দক্ষতা, সত্য হিসাবে প্রতিভাত হয়। বর্ণন-নির্মাণ-দক্ষতা যেহেতু বর্ণনকারীর স্থানিক অবস্থান আড়াল করে, অন্য-বাস্তবতা/অভিপ্রেত-বাস্তবতা নির্মাণে সক্ষম – নির্মাণ-দক্ষতা বিপণনযোগ্য। বিপণনযোগ্য, কেননা নির্মিত বাস্তবতা ব্যক্তি সুতরাং এই ও সমাজ-চেতনায় অভিঘাত/অনুরণন/আলোড়ন আনতে সক্ষম।
সাংবাদিকেরা হয়ত ‘সত্য’ ‘নিরপেক্ষ’ সংবাদ প্রকাশের স্বার্থেই, ‘দাঙ্গা বিরোধী’ সচেতনতা নির্মাণে, হানাহানির দ্রুত অবসানের নিমিত্তই অমনভাবে পরিবেশন করেছিলেন, ‘দাঙ্গা বিবরণ’। কিন্তু রাষ্ট্রও অনুমোদন দিয়েছিল। বড় বড় সংবাদ মাধ্যম ব্যবসায়িক স্বার্থেই পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সরকার ও রাষ্ট্রের সঙ্গে অবৈরী সম্পর্কে আবদ্ধ।
যুগপৎ প্রচারিত হল, প্রচার মাধ্যম কলঙ্কিত করেছে গুজরাটের মানুষকে। কলঙ্কিত করেছে সারা ভারতে, সারা বিশ্বে। যেন, সমস্ত গুজরাটি ভারতীয়রা ক্রিমিনাল। আমেদাবাদে এমন কিছু হয়নি। গোধরায়, ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে, হিন্দু করসেবকদের হত্যার প্রতিবাদে গুজরাটি জনতার স্বতঃস্ফূর্ত রোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, তাও শুধু আমেদাবাদে মাত্র! সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। বাড়াবাড়ি যদি কিছু হয়েও থাকে, প্রশাসন দুঃখিত। কিন্তু তার জন্যে সমস্ত গুজরাটিদের দায়ী করা অন্যায়। গুজরাটি ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এই সময়ে। ভাইয়োঁ আউর বহিনো, ডাক পাঠাও চতুর্দিকে, দিক দিগন্তে, ভারতে, ভারতের বাহিরে, এক হও, গুজরাট বাঁচাও, ভারত বাঁচাও। গুজরাট পথ দেখাবে ভারতকে, বিশ্বকে ।
এবং অবশেষে ‘সত্য’ অভিধায় ভূষিত হল এক ‘ত্ৰাস’। জয় আর্যাবর্ত। জয় শ্রীরাম।
৬
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, আরএসএস বা এমনতর কয়েক’শ সংগঠনের রাজনৈতিক প্রতিনিধি ভারতীয় জনতা পার্টি আদপেই ‘হিন্দুধর্মে’ বিশ্বাসী নয়। বিশ্বাসী নয় ভারতীয় ঐতিহ্যে। ভারতীয় সমাজ-কাঠামো অনুসন্ধানে আগ্রহীও নয়। জনপদের প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, বিবিধ জনগাষ্ঠীর আচার-বিচার-বিশ্বাস-যাপন বৈচিত্র্য অস্বীকার করে, ধ্বংস করে ইহুদি-খ্রিষ্টিয় ‘ধর্মীয় জাতি-রাষ্ট্র’ গঠনের, নির্মাণের ধারণা তার বহুদিনের। সংগঠন-কাঠামোও তাই ইহুদি-খ্রিস্টিয়। হিন্দুধর্মের বিকেন্দ্রীত কাঠামো নয়।
হিন্দুধর্মে যখনই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচার ব্যক্তি বা সমাজ বিকাশের যাত্রাপথে বেড়ি পরিয়েছে, তখনই লোকায়ত ধর্ম, আচার-বিচার- বিশ্বাস-যাপনের খোলা হাওয়া বাধ্য করেছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচারকে আলগা করে দিতে। ফলত ধর্ম নিয়ে, ঈশ্বর নিয়ে, ধর্মীয় আচার-উপাসনা -রীতি-পদ্ধতি নিয়ে হাজারো সম্প্রদায়, ব্যক্তি বিশ্বাস। মুক্ত হাওয়া। একেবারেই বিপ্রতীপ অবস্থান, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, আরএসএস ইত্যাদি সংগঠনের। কংক্রিটের চাঙড়। ধর্মকে ভাগ করে দেওয়া হল বিশ্বস্ততা আন্তরিকতা সততা ও শ্রেণি বা ব্যক্তির চিন্তাধারা, মতাদর্শ ভাবধারা থেকে। বিশ্বাস, ধর্মীয় বিশ্বাস মানে যাপন পদ্ধতি, একটি ঐতিহ্য বা পরম্পরা যা নিশ্চিতভাবে অনড় কোনো চাঙড় নয়, বহুত্বে কার্যকরী।
বাংলায় মানুষ বেড়ে উঠেছে অনেক বেশি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সঙ্গে সংম্পৃক্ত থেকে। বৈচিত্র্য তাকে মুগ্ধ করেছে। ব্যক্তির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নানানভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি ধর্ম পরিচয়েও বহুবিধ ভিন্নতা। ফলত হিন্দুধর্ম এখানে কোনও জাতি পরিচয়ে পূর্ণতা পায়নি। পূর্ণতা পাওয়ার কথাও নয়। মনুষ্যত্বের বিকাশ তখনই পূর্ণতা পায়, যখন আর সব কিছুকে ছাপিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের আলোয় উদ্ভাসিত মানুষ একক ও অদ্বিতীয় ভূমিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে।
মুসলিম সমাজেও এমনটি হওয়া উচিত ছিল। হয়নি। বরং মুসলিম সমাজ দাঁড়িয়ে থাকতে চাইল ইসলামের ওপর। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য যখন আধুনিক সমাজের চালিকাশক্তি, সেখানে মুসলিম সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অস্বীকৃত। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবোধ। মুসলিম সমাজে ধর্মসংস্কার আন্দোলন হয়নি, এমন নয়, তবুও অনেকটাই স্থবির, অচল, সরে আসেনি তার প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মশক্তির উৎসভূমি থেকে, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচার থেকে।
এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্য সূত্রে, বাংলায় ইসলাম আসে ১০০০ থেকে ১২০০ খৃষ্টাব্দ সময়কালে। বাংলায় তখন পাল বংশের শাসন। গৌড় বিক্রমপুর পাটলিপুত্র। গোপাল ধর্মপাল দেবপাল। যুদ্ধপটু। প্রায় অজেয় হস্তিবাহিনী। বিস্তৃত সাম্রাজ্য। সম্পন্ন গৃহস্থালি। বাণিজ্য– ভূখণ্ড ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া। মহাযান আর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম ছিল রাজধর্ম। রাজভাষা, সংস্কৃত পালি প্রাকৃত। বাংলা ভাষার সচলতা বা আদি লিপির উদ্ভবকাল। বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদ।
পাল বংশের শাসন শেষে এসেছে কর্ণাটক থেকে সেনবংশ। লক্ষ্মণ সেন। ১১৭৮ থেকে ১২০৬। রাজধানী নবদ্বীপ। বখতিয়ার খিলজি সেনরাজাদের পরাস্ত করে নবদ্বীপের দখল নেন ১২০৩ সালে।
ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী বাংলা-বিহার-ওড়িশা শাসন করেছিল পাশতুন (আফগানিস্তান) সম্প্রদায়। পাশতুনদের অনেক সম্প্রদায়। প্রধান দুটি, নাশাল আর দিয়ান। দিয়ান থেকে দেওয়ান। নাশালরা পরিচিত ছিল সরাসরি পাঠান হিসাবে আশরাত শ্রেণিভুক্ত। দেওয়ানরা ছিল ধর্মান্তরিত রাজপুত ও ভূমিহার।
১৫২৬ সালে বাবরের হাত ধরে প্রথম মোগল সাম্রাজ্য তৈরি হলেও বাংলা-বিহার-ওড়িশা মোগল সাম্রাজ্যের অধীন হয় ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে আফগান শাসকদের পরাস্ত করে।
মোগল-আফগান রাজত্বকালেই, পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চারশো বছর ধরে বাংলায় রচিত হয়েছিল মঙ্গলকাব্য। বিশেষ কোনও যুগের রাজনৈতিক চেতনা না থাকলেও অনুমান করা হয় মঙ্গলকাব্যের কাহিনি পঞ্চদশ শতাব্দীর আগেই গড়ে উঠেছিল।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাঙালা সাহিত্যে আসবে মিথিলার কবি, দ্বারভাঙ্গার বিদ্যাপতির বৈষ্ণব পদাবলী। ভাষা পুরোপুরি বাংলা নয়, তবু জনপ্রিয় বৈষ্ণব পদাবলী। পাবো বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। চণ্ডীদাসের ‘সবার উপরে মানব সত্য, তাহার উপরে নাই’। এরও পরে সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদ মালাধর বসুর ভাগবত পুরাণ, কৃত্তিবাসের রামায়ণ।
চৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলন বাংলার সংস্কৃতিতে এনেছিল অভাবনীয় সব পরিবর্তন। মানবতার প্রতি গৌরববোধ বেড়েছিল, দৈবশক্তিতে মানুষের আস্থা কমে এসেছিল। সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকে ব্ৰাহ্মণ সন্তানেরাও তাদের পূর্ব সংস্কার ও আভিজাত্য গৌরব বিস্মৃত হয়ে অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের দেবতার মাহাত্ম্য কীর্তনে এগিয়ে এসেছেন। এই সময়ের কাব্যে ধরা পড়েছে বাঙালির এই মানস পরিবর্তন। পূর্ব ময়মনসিংহে সেনরাজ প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের এবং সংস্কৃত শাস্ত্রের প্রভাব বা আনুগত্য প্রায় অনুপস্থিত থাকায় কাব্যের নায়ক নায়িকারা বেনে, সদগোপ, বৈশ্য, ব্যাধ, এমনকি ডোম জাতীয়। ব্রাহ্মণের টোলে বেনে ধর্মশাস্ত্র পড়ছে, গন্ধবেনে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে গলাধাক্কা দিয়ে সদর দরজা দিয়ে বার করে দিচ্ছে। যজন যাজন ও যজ্ঞের সময়েই যজ্ঞোপবীতের প্রয়োজন হত, পৈতা ব্রাহ্মণের অপরিহার্য অঙ্গীয় হয়ে দাঁড়ায়নি। কোথাও যাওয়ার সময় উত্তরীয় ও উপবীত উভয়ই পোশাকি দ্রব্যের মতো খুঁজে বের করে পরতে হত।
নায়ক নায়িকাদের কারোরই গৌরিদান তো নয়ই, বাল্যকালে পরিণয়ও হয়নি। চোদ্দ, পনেরো এমনকি সতেরো বছর বয়সী মেয়েদেরও অবিবাহিত দেখা যেত। ময়মনসিংহ গীতিকায় বাংলা ভাষা, সমাজের স্বরূপ। বহু শতাব্দী কাল পাশাপাশি বাস করার জন্য হিন্দু ও মুসলমানের ভাষা এক সাধারণ সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত বঙ্গবাসীর ভাষা। জাতিভেদ নেই। লেখক, হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই। এই সাহিত্যে হিন্দু নায়ক মুসলমান নায়িকা আবার মুসলমান নায়ক হিন্দু নায়িকা।
উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিতে বাঙালি ছিল ‘নিম্নবর্গীয়’। ইংরেজ আনুকূল্যে, বৃটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণে ‘ইংরাজি’ জানা ও শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু বাঙালি ছড়িয়ে পড়ল সারা ভারতে। ‘প্রশাসনিক উচ্চপদ’ বাঙালির মান্যতা তৈরি করল, যে মান্যতা প্রাচীন হিন্দু সমাজ তাকে দেয়নি। ‘বাঙালি উচ্চবর্ণীয় হিন্দু’, বৃটিশ শক্তির কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ রইল। ইংরেজদের মুসলমান সংস্কৃতির বিরোধিতায় নিষিক্ত হল, জারিত হল।
ভাষাতে তার প্রতিফলন হল। বাংলা ভাষা ছিল প্রাকৃতের রূপভেদ। গীতিকাগুলি থেকে বোঝা যায় বাংলা ভাষা সংস্কৃত নয়, প্রাকৃত হতেই তার উদ্ভব। খাজনা, ইজ্জত, জবরদস্তি, শাওন, আশমান এমন সব বহু বহু আরবী-ফার্সী শব্দ, দেশীয় রূপ ধারণ করেছিল। টোলের পণ্ডিতেরা অপর্যাপ্ত সংস্কৃত শব্দ ঢুকিয়ে ভাষার রূপটিই বদলে দিলেন। অন্যদিকে মৌলবীরাও বেশি বেশি আরবী-ফার্সী শব্দ ব্যবহার শুরু করলেন। পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষায়, কথ্য ও লিখিত রূপে বড় ধরনের পার্থক্য এসে গেল। পরবর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক বিভাজন, প্রাতিষ্ঠানিক-ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক বিভাজনে পরিণত হওয়ার প্রেক্ষিতে ভাষাগত এই ভিন্নতাও খুব সম্ভব প্রভাব ফেলেছিল। বিভাজন অস্পষ্ট থেকে স্পষ্ট হয়ে স্পষ্টতর হতে শুরু করেছিল, বৃটিশ শাসনকালে।
পলাশী পরবর্তীকালে বাংলার বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ইউরোপীয়দের, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায়। ইংল্যাণ্ডের অর্থনীতির স্বার্থে এদেশ থেকে একে একে রেশমবস্ত্র, সুতো, মাঝারি ও মোটা কাপড় রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। ১৮০০ সালেও বাংলায় ছিল, উদ্বৃত্ত অর্থনীতি। সেই বাংলা, শিল্পবিপ্লবোত্তর (১৭৬০ থেকে ১৮২০-৪০এর মধ্যবর্তী সময়) ইংল্যাণ্ডের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের বাজার হয়ে যায়, খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমিয়ে কৃষকদের বাধ্য করা হয় বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কৃষিপণ্যের উৎপাদনে। তৈলবীজ, পাট, শন, বাদাম, আখ, তুলো, নীল, আফিম।
কৃষিপণ্যের এই বাজার, শুধু ইংল্যাণ্ডের প্রয়োজনীয় কাঁচামালই জোগায় না, কলকাতার ব্রিটিশ শাসন নির্ভর ‘বাবু’ শ্রেণির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও সূচনা করে। ‘ভদ্র’ শ্রেণির, বঙ্গ-সংস্কৃতির এক নতুন নির্মাণও শুরু সেই সময়।
কোম্পানির প্রয়োজন, ইংল্যাণ্ডের শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের স্থানীয় এজেন্ট। এজেন্টদের জানা দরকার অন্তত কাজ চালানো ইংরেজি ভাষা।
ব্রিটিশ বিশ্বাস করতে পারেনি, মুসলমান জনগোষ্ঠীকে। ফলে এজেন্ট দরকার হয়ে পড়ল মুখ্যত হিন্দু সমাজ থেকে। আবার হিন্দু সমাজ থেকেও দেশীয় অভিজাতদেরও দাবি ছিল, ইংরাজি শেখার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। গড়ে উঠল, হিন্দু সমাজপতিদের উদ্যোগে, ‘হিন্দু কলেজ’। নিষিদ্ধ, ‘অ-হিন্দুদের’ প্রবেশাধিকার। কোম্পানির প্রয়োজন ছিল এক অনুকূল জনগোষ্ঠীর আনুগত্য। বর্ণহিন্দু ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য সমাজের সংস্কৃত শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হল, ‘সংস্কৃত কলেজ’। ‘অ-হিন্দুদের’ প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। জাতীয়তাবোধ রূপ নিল হিন্দু-জাতীয়তাবাদের।
কষ্টের বিষয় বাংলায় যদি ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ রাজশক্তিকে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি ও আমাদের পরিত্রাতা না ভেবে নিজেদের উদ্যোগে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কৃষ্টিতে তৎপর হতাম বাঙালি সমাজ এমনভাবে জাতপাত ধর্মে-প্রাতিষ্ঠানিকতায় বিভক্ত হয়ে যেত না।
কয়েক দশক আগেও একটা বিশেষ শব্দবন্ধ প্রচলিত ছিল। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। পোস্ট অফিসের খামের চিঠির ওপর পত্রপ্রেরক ওটা লিখে দিতেন। চিঠিতে এমন কোনো গোপন কথা থাকত, যে কথা পত্রপ্রেরক, উদ্দিষ্ট প্রাপক ছাড়া অন্য কেউ জানুক, চান না। যদি পড়েন, তার ওপর ‘পাপ’ অর্শাবে, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ মণ ওজনের ‘পৈতেধারী রাজপুত ব্রাহ্মণ’ হত্যার। মেবারের যুদ্ধে মুসলমান সম্রাট যতজন রাজপুত ব্রাহ্মণ হত্যা করেছিলেন, তাদের পৈতের ওজন ছিল, ‘সাড়ে চুয়াত্তর মণ’! এমন ‘অলৌকিক, অযৌক্তিক’ কথা প্রচার করতেন, এলাকার ‘চারণ’ কবিরা, উদ্দেশ্য, ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমান সম্প্রদায় যে নৃশংস, এমন এক ধারণার জন্ম দেওয়া। চারণ কবিদের ওই সব প্রচারকেই মূল উপাদান করে একদা রচিত হয়েছিল, টড সাহেবের ‘ভারত (রাজস্থান) ইতিহাস’। ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘বাঙালি হিন্দু অভিজাত’দের ‘সুখপাঠ্য ভারত ইতিহাস’।
শাসকের অত্যাচার, অতিরঞ্জিত হয়ে, সংজ্ঞায়িত হল, ‘ইংরেজরা’, হিন্দু-মুসলমান ‘ইসলামের অত্যাচার’, ‘মুসলমানের অত্যাচার’। বিদ্বেষের বীজ বুনে যেতে সফল।
কলকাতা কেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক কৌলিন্য এমনই বিপজ্জনক হয়ে গিয়েছিল যে, বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পরও কলকাতার এক দল এলিট প্রতিনিধি ১৯১২ সালে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন। যুক্তি ছিল, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে, সে হবে বাংলারই অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং পূর্ববাংলায় অধিকাংশই মুসলমান কৃষক, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও প্রয়োজন নেই। এর পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হওয়ায় কলকাতায় বিদ্বৎসমাজ ঠাট্টা করে বলত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়।
বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার আন্দোলনের নেপথ্যে যেমন এক গভীর ‘বাঙালি’ ভাবাবেগ কাজ করেছিল, তার চেয়ে অনেকের মধ্যে গভীরভাবে ক্রিয়াশীল ছিল, সাম্প্রদায়িক বিচারে মুসলমানদের ওপর, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর হিন্দু এলিট গোষ্ঠীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রাখার ভাবনা ও দুর্ভাবনার টানাপোড়েন।
মুসলমানদের ওপর হিন্দু এলিট গোষ্ঠীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার রাজনীতিই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ-বিভাজনের প্রেক্ষিত রচনা করেছে। ছেচল্লিশের দাঙ্গা, সাতচল্লিশের দেশভাগ, ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে আসা লক্ষ লক্ষ হিন্দু মানুষজনের অবিরাম স্রোত, ওপার বাংলায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর চলতে থাকা অন্যায়-অবিচার বিদ্বেষ-বিভাজনকে জিইয়ে রেখেছে।
ধর্মীয় বিভাজনে বিশ্বাসী শহর-মানস। স্মৃতিতে তার ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বয়ে নিয়ে আসা ইংরেজ-সৃষ্ট ইসলাম-বিদ্বেষ, দেশভাগের যন্ত্রণা, ইউরোপের ‘মুসলিম-জেহাদ’। অন্যদিকে, মুসলিম সমাজও ব্যর্থ হল আত্মবিশ্লেষণে, নিজস্ব পরিচয় উন্মোচনে। সমস্ত স্তর ও পেশার মানুষজন নিয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিজেদের সুসংগঠিত করতে সক্ষম হলেন না। একজন মানুষের ধর্মীয় পরিচয় যেমন থাকতে পারে, তেমনি এটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। আত্মপরিচয় এক নির্মাণ। দেশ-কাল-সময়, ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের, পরম্পরার নির্মাণ। বাঙালি মুসলমান নয়, মুসলমান বাঙালি। প্রাথমিক পরিচয় বাঙালি, ধর্মীয় পরিচয় দ্বিতীয়। যেমন প্রবাসী বাঙালি। একান্তই যদি দিতে হয়, সে নির্মাণ না করতে পারার পাপ যেমন এড়িয়ে যেতে পারে না ওই সময়ের সামাজিক রাজনৈতিক নেতৃত্বদানকারী দল ও ব্যক্তিবর্গ, তেমনই সেই দুঃস্বপ্ন বহন করে আজও বিদ্বেষ-বিভাজনকে অন্তরের অভ্যন্তরে পোষণ করা অর্থহীন। লালন করা বা ইন্ধন জোগানো অনৈতিক শুধু নয়, অপরাধ।
ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়ায়, নির্মিত হতে থাকে অন্য এক সত্য। বাস্তবের মাটিতে, দুই সম্প্রদায়, এ ওর দিকে বাঁকা চোখে চায়। ‘এলিমিনেশন’, ‘এক্সক্লুশন’। কুয়াশাচ্ছন্ন হয় মানুষে মানুষে বিশ্বাস।
৭
শ’তেক ধর্মাচরণেও একদা বিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল দৃঢ়। সম্পর্কে বিশ্বাস, যাপনে-উৎসবে বিশ্বাস। উদার ধর্মমতে বিশ্বাস। ধর্মমতের উদারত্বে বিশ্বাস । এই বিশ্বাসবোধ থেকেই গড়ে ওঠে সহনশীলতার পাঠ। ন্যায়-নৈতিকতা বোধ। বহুত্বে বিশ্বাস। এমনই মনে হয় শুধু বাংলা কেন, প্রাচ্যের বিশ্বাসী মনোজগৎ। তরল পদার্থের মতো আধারের আকারে, ধর্মীয় বহুত্ববাদ।
গোটা গ্রামের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সর্বজনীন শীতলা পুজো। শীতলার গান। মনসার ভাসান। মাঘই ছিল গ্রামবাংলার প্রকৃত উৎসব কাল। অগ্রহায়ণে ধান, পৌষ কলাই, আখের নতুন গুড়, লোকের হাতে পয়সা-কড়ি, পিঠে-পুলি নতুন জামা-কাপড়, তখনই তো উৎসব। গ্রাম-সমাজ বিচ্ছিন্ন, নগর-মানুষ নির্মাণ করল নিজস্ব উৎসব, দুর্গাপুজো। স্মৃতিতে, ঐতিহ্য পরম্পরায়, বাঙালির মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা পার্বতীকন্যা, যিনি শারদীয় দুর্গোৎসবে ছেলেপুলে নিয়ে চারদিনের জন্যে বাপের বাড়ি আসেন। বাংলার আগমনী গান, এখন নাগরিক কণ্ঠে,
যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী
উমা নাকি বড় কেঁদেছে
দেখেছি স্বপন নারদ বচন
উমা মা মা বলে কেঁদেছে
সোনার বরণী গৌরী আমার
ডাঙর ভিখারী জামাই তোমার
মায়ের আমার যত আভরণ
তাও বেচে নাকি খেয়েছে।
নগর ফিরে গেল না উৎসভূমিতে, বিযুক্ত হল সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ধারণকারী লোক-সমাজ থেকে। বরং নগর-চলন বিস্তৃত হল ভিন্ন অর্থনীতির গ্রাম-বাংলায়। অ-সমৃদ্ধ হল নগর, নিরক্ত হল গ্রাম। সভ্যতা সংজ্ঞায়িত হল নাগরিক বিত্তের ধ্যান-ধারণায়। সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য হল একমাত্রিক, একমুখী ধনসম্পদ আহরণ। মুখে মুখে প্রবাহিত সংস্কৃতি হয়ে গেল অজ্ঞ- অশিক্ষিত-সংকীর্ণমনাদের সংস্কৃতি। বিচারশক্তি ও প্রজ্ঞা বা ধীশক্তি, মেধা, চৈতন্য ও বুদ্ধি, বুদ্ধিমত্তা হয়ে গেল বুদ্ধ্যঙ্ক (IQ)। যদিও বুদ্ধ্যঙ্ক, বুদ্ধিমত্তার খুব স্থূল এক পরিমাপ। নির্ণায়ক সূচি পরিবর্তন করলেই, মাপ যায় বদলে।
গ্রামবাংলা গোচরে-অগোচরে, জ্ঞানে-অজ্ঞানে, পরিকল্পনায়- অপরিকল্পনায় অসমৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক বহুত্ত্বে, ধর্ম-বিশ্বাসী গ্রামসমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকল রাষ্ট্রীয় ধর্মীয় ভাবাদর্শ, বিশ্বাসী ধর্ম নয়। রাজনৈতিক বা সমাজ অর্থনৈতিক স্বার্থে গ্রন্থিত, সুসংবদ্ধ এক রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ। ‘বিশ্বাসী-ধর্মের’ বিপরীতার্থক এক ভাবাদর্শ,আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা।
একসময় জনপদের মূলবাসীদের মধ্যে লোকতন্ত্র বিরাজ করত। বিরোধ-মীমাংসা সভায় সব পরিবার থেকেই কেউ না কেউ যেতেনই। অংশ নিতেন আলোচনায়। সকলে একমত হলেই, সভা সেই মত গ্রহণ করতো। নাহলে যতক্ষণ না সবাই একমত হতো, সভা চলতো।
জীবনদর্শনে জীবনচর্যায় গণতান্ত্রিক বোধ প্রসঙ্গে একদা গান্ধি উচ্চারণে এনেছিলেন, ‘অধিকতর মানুষের কল্যাণ’ – এই মতবাদে আমি বিশ্বাস করি না। এর অর্থ প্রায় নগ্নভাবে বুঝিয়ে দেওয়া যে, ৫১ শতাংশ মানুষের কল্যাণের জন্যে ৪৯ শতাংশ মানুষের স্বার্থ বিসর্জন দিতে হতে পারে বা দেওয়া উচিত। এই হৃদয়হীন মতবাদ, মানবতার ক্ষতি করছে। তাই প্রকৃত মর্যাদাসম্পন্ন মানবিক তত্ত্ব হল, সর্বজনের সর্বোত্তম কল্যাণ।
বিনোবা ভাবে জানিয়েছিলেন, আমাদের গণতন্ত্র সম্পর্কীয় সাধারণ ধারণায়, পঞ্চায়েত থেকে রাজ্য-কেন্দ্র শাসন-নিয়ন্ত্রণে এক বা একাধিক রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের কোনও এক জোট ক্ষমতায় থাকে আর থাকে এক বা একাধিক বিরোধী দল বা দলের জোট। বিরোধী দলের ভূমিকা হবে সংশোধনকারী। ক্ষমতাসীন দলের কাজকর্মের ওপর যাতে একটা রাশ টানা যায়। পাশ্চাত্যের এমন এক ধারণায় অবশ্যই চিন্তা ও বিচারধারার সংঘর্ষ ও বিনিময়ে কিছু একটা শুদ্ধি উঠে আসে। কিন্তু ফাঁক বা অসম্পূর্ণতা থেকেই যায়। বিশেষভাবে ক্ষমতায় যখন একটি পক্ষ ক্ষমতাধিকারী, অপর পক্ষ ক্ষমতাভিলাষী। উভয়ই ক্ষমতাপ্রেমী। সকলেরই লক্ষ্য নির্বাচনে সংখ্যাধিক্য অর্জন। জ্ঞানবুদ্ধির বিচার হয় না। শুদ্ধির ভাবনা থাকে না। যারা একই দেবীর উপাসক তারা একই অ-গুণের অধিকারী হয়ে যায়। বরং আমাদের দেশের পাঁচ বোলে পরমেশ্বর - ঐতিহ্য অনেক ভিন্ন এক সম্পূর্ণ চিন্তাধারার পরিচায়ক।
৮
এই সুপ্রাচীন আধুনিক রাষ্ট্র, রাষ্ট্রব্যবস্থা পছন্দ করে সেকিউলারিজম। সেকিউলারিজম জানালো ভারতীয় ধর্ম এবং সংস্কৃতি, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও আধুনিকতা বিরোধী। সুতরাং সমাজ জীবনে ধর্মের প্রবেশ নিষিদ্ধ। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ভাবনা, বিজ্ঞান, সর্বজনীন সত্য।
জনপ্রিয় ধারণা অবশ্য ভিন্ন। পশ্চিমী ভাবাদর্শে নিজেদের সাজানো। একেবারে অনুকরণ নয়, নিজেদের সংস্কৃতিতে যেসব চিহ্ন বর্তমান, যার দ্বারা পশ্চিম আজ উন্নত সেসব অনুসরণ করা।
‘সেকিউলারিজম’ শব্দটি ইউরোপ থেকে বাংলায় এসেছিল উনবিংশ শতাব্দী থেকে। আদৃত হল মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিতে। সংস্কৃতি সম্পর্কে তার বলার কিছু ছিল না। সংজ্ঞানুযায়ী ‘সেকিউলারিজম’, ‘জাতিবিদ্বেষী’ - এবং সময় সময় জাতিহন্তারক। যদি না সেই জাতি, তার দ্বারা নির্মিত এবং সংজ্ঞায়িত সংস্কৃতি ও আধুনিকতা না মেনে নেয়। ধর্ম যেমনভাবে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসকে যুক্ত করতে পারে বা যাপনের ভিন্নতাকে গ্রহণ করতে পারে তেমন কোনো নমনীয়তা সেকিউলারিজমের নেই।
বহুত্ববাদের বিপ্রতীপে সেকুলারিজম, নিজ-অস্তিত্বের এক একমাত্রিক ‘খ্রিষ্টিয় মতাদর্শ’র ধারণা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হল। ১৮৫০ সালে, শব্দটির নির্মাণ-কালে, সেকিউলারিজমে ধর্ম, বৈচিত্র্য এবং বিশ্বাসের সহাবস্থান আদৃত ছিল। সমসাময়িক অন্য এক বিচারধারায় সেকিউলারিজমে ধর্ম অস্বীকৃত, এবং বিজ্ঞান, ‘উপাস্য দেবতা’।
সেকিউলারিজমের পশ্চিমী আধিপত্যবাদী ভাষ্যে বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, চিরায়ত ধর্মীয় সহিষ্ণুতার আদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আধুনিকতার ও উন্নয়নের যে নতুন ভাষ্য নির্মাণ করলেন সেখান থেকে জন্ম নিল ভিন্ন এক ধর্মীয় হিংসাশ্রয়ী ভাবাদর্শের। রাষ্ট্রকাঠামো, গণমাধ্যম, জাতীয় নিরাপত্তার ভাবাদর্শ, উন্নয়ন এবং আধুনিকতার যে ভাষ্য নির্মিত হল সেখানে বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় একটি নির্ধারক ভূমিকা নিল।
সেকিউলারিজম নিয়ে সামাজিক স্তর-বিন্যাসে একাধিক বোধ সব ধর্মকে সমান চোখে দেখা, শ্রদ্ধা করা। মানে সমাজ জীবনে ধর্মের অনুপ্রবেশ বন্ধ না করতে পারলেও কথোপকথন চলুক সব বিশ্বাসের মধ্যে অবশেষে সব ধর্মমত নির্বিশেষে বিলুপ্ত হোক রাষ্ট্রে।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের অন্য একটি ব্যাখ্যা, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য সহ বিকাশ ভাবনা সমর্থন করে। সেখানে সে ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে না বরং বলে শতাব্দী জুড়ে যে পরম্পরাগত যাপন চলে আসছে, সহিষ্ণুতা লক্ষিত যে যাপনে সেই ধারাকে যুক্ত করা হোক আধুনিক রাজনীতির সঙ্গে।
ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা সব কিছু গ্রহণের পক্ষপাতী। নেহরু জনসমক্ষে ও ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মকে বিশ্বাস করতেন না। ইন্দিরা জনসমক্ষে বিশ্বাস করতেন না, ব্যক্তিগতভাবে ধর্মবিশ্বাসী। জিন্নাহ্ ও সাভারকর জনসমক্ষে বিশ্বাস করতেন, ব্যক্তিগতভাবে নয়। সংঘ-পরিবারের সব সদস্যরাই জনসমক্ষে ও ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মকে বিশ্বাস করেন। নেহরু ছাড়া সবাই-ই ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছেন।
রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও নির্মিতি, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ‘আত্মনির্মাণ’, মধ্যবিত্ত সমাজের খুবই পছন্দ। ঔপনিবেশিক পরবর্তী মধ্যবিত্তদের ধারণা, পশ্চিম এতটা এগিয়ে গেছে কেননা ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে আরো ভালো বোঝাপড়া সে অর্জন করেছে। আধুনিক ভারত নির্মাণে মধ্যবিত্তদের অবস্থান যেখানে ধর্মকে কোনো পরিসর না দিতে চাওয়া সেখানে সাধারণ মানুষ তার যাপনে ধর্মকে আলগাভাবে হলেও জড়িয়ে রেখেছেন।
এই যে দু’ভাবে দেখা, ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দেখার পরিসর খুঁজে নেওয়া, দৃষ্টিভঙ্গিগত আলাদা। বিশ্বাসী যেখানে যুক্তি বুদ্ধি ক্ষমতা ও তার এ যাবৎ অধীত বিশ্বাসকে অতিক্রম বা ছাড়িয়ে যেতে পারে, নির্দিষ্ট মতাদর্শ – একাধিক নির্মিত ও সূত্রায়িত ভাষ্য সত্ত্বেও - অমননীয় অনড় সংকুচিত আচার আচরণে সুসংবদ্ধ। আধুনিকতা নির্মাণে বহুত্বে বিশ্বাসী ধর্ম বাধা, বাধা ছোট ছোট জনপদগোষ্ঠী, মূলবাসী-আদিবাসী জনসমাজ। এমনকি বড় বড় জাতিসত্তাও। স্বকীয় ভাষাসত্তা বিলুপ্ত হতে থাকে ক্রমশ। এমনভাবেই পাঞ্জাবী ভাষা, হিন্দি হয়ে যায়। মুছে যায় শিখ ও হিন্দু ধর্মের পার্থক্য। নিজের বৈশিষ্ট্য বিলোপ করে নিজেকে নির্মাণ।
রাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক ধারণা ক্রমাগত সমাজ অভ্যন্তরে ধারণ করতে করতে, ন্যাশান্যালিস্টিক রাষ্ট্র নিজেই ঔপনিবেশিকদের চরিত্র অনুসরণ করে। তাদের ধ্যানধারণায় পুষ্ট হয়। এক নির্মিত আধুনিকতা।
এই আধুনিকতা-নির্মিত ভাষ্য, আর ছোট ছোট গোষ্ঠী আর শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর মধ্যেই নয়, বহু সংখ্যক মানুষের মধ্যে চারিয়ে গেছে। এরা দেখতে পাচ্ছেন, তাদের ‘পরিচিতি’ আক্রান্ত – নিজস্ব পরিচিতি -বিশ্বাসী মানুষজন মনে করছেন তারা হেরে গেছেন, তাদের আর কিছু করার নেই। একেবারে কোণঠাসা এই সব মানুষজনের মধ্যে থেকে উঠে আসছে এক হিংসাশ্রয়ী অবস্থান। সমৃদ্ধ কোনো যাপন নয়, ইনক্লুশন নয় এক্সক্লুশন, রাষ্ট্রাধীন ঔপনিবেশিক ধর্মীয় এক যাপন-পদ্ধতি অনুসরণ। অসহিষ্ণু এই দর্শন নির্মাণে, রাষ্ট্রব্যবস্থার কোন নৈতিক অধিকার নেই ।
হিন্দু-জাতি-রাষ্ট্রে বিশ্বাসী ধর্মোন্মাদদের উদ্দিষ্ট লক্ষ্য পশ্চিমকে হারাতে হবে। হারাতে হবে তাদের জাতি-রাষ্ট্রের নির্মাণ-পদ্ধতি অনুসরণ করেই। প্রাচীন ধর্মীয় শাস্ত্রবিধির প্রতি অন্ধ বিশ্বাস রেখে, উগ্র অযৌক্তিক উন্মাদনায় ভেসে বা ধর্মীয় নবজাগরণে সওয়ার হয়েই সেই চলা।
হিন্দু ধর্মমতের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য সহ অন্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি-মুক্ত, সাভারকর নির্মিত বৈদান্তিক বিশ্বাসের সঙ্গে পশ্চিমী প্রযুক্তি ও রাষ্ট্রনীতিতে দাঁত নখ তীক্ষ্ণ করে সব বহির্শক্তি ও আভ্যন্তরীণ শক্তিকে পিষে মারা। হিন্দুধর্মের বহুত্ববাদী ধ্যানধারণাকে বিনাশ করে পশ্চিমী ভাবাদর্শকে অনুসরণ করা। ধর্মীয় ভাষ্য উদ্ধৃত করে তাকে বিজ্ঞানসম্মত বলে প্রচারে আনা।
হিন্দুধর্ম আর হিন্দুত্ব, দেশপ্রেম ও সামরিক-স্বৈরতান্ত্রিক- জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যেকার গুণগত তফাৎ অস্পষ্ট করে, হিংস্রাশ্রয়ী ধর্মীয়-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত নির্মাণ করে, সমস্ত দেশকে সাদা-কালোয় বিভাজিত করে এই বিরাট, বিশাল, ঐতিহ্যবাহী ভারত বলদর্পে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, সম্ভব নয়।
ভারতীয় সহনশীলতার ভিত্তি বিশ্বাস। বিশ্বাস তুলসীদাস, কবীর, চৈতন্যে। বিশ্বাস উদার বৌদ্ধধর্মে, বিশ্বাস উদার ইসলামে, বিশ্বাস সত্যপীরে। সহনশীলতার ভিত্তিভূমি এখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় বোধ, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ, সমৃদ্ধ ভক্তিগীতি আর লোকসাংস্কৃতিক অঙ্গন। এখানেই সে স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক তার অবাধ বিচরণ ও ভাবাশ্রয়। ইতিহাসেও অনুসন্ধান হোক একমাত্রিকটা নয়, সাংস্কৃতিক বহুত্ব।
ব্যক্তি অবস্থান! আমি আছি, সব স্বাঁসো কী স্বাঁসো মেঁ – মন্দিরে নয়, মসজিদে নয়, কাবা তীর্থে নয়, ক্রিয়া-কর্মে নয়, যোগে-বৈরাগে নয় - আমি সকল নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে তোমার পাশে আছি।
কৃতজ্ঞতা ও তথ্যসূত্র :
১. ক্ষিতিমোহন সেন : হিন্দু ধর্ম
২. ক্ষিতিমোহন সেন : কবীর (প্রথম খণ্ড)
3. Deepa Mehta: Leila - A Web Series (Netflix)
8. Ashis Nandy: The Politics of Secularism and the Recovery of Religious Tolerance
5. Yuval Noah Harari: Sapiens - A Brief History of Mankind
৬. গৌরী ধর্মপাল : পুরোনতুন বেদের কবিতা
৭. লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করে দিয়েছেন শ্রী শিবব্রত কর্মকার (ভ্রমরা)
৮. সুকুমার সেন সংকলিত বৈষ্ণব পদাবলী
৯. শিবব্রত কর্মকার
সেপ্টেম্বর, ২০১৯