সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
ভোরের প্রথম আলো ফোটার সাথে সাথে মেসেঞ্জারের টুং শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তনুজার। রোজই। কয়েকমাস হোল এই রুটিন হয়েছে। যবে থেকে অতনুর সাথে ফেসবুকে আবার যোগাযোগ হয়েছে দুদশক পরে। পরিমল পাশে শুয়ে অঘোরে ঘুমায় তখন। মোবাইল নিয়ে আস্তে করে বাইরে বেরিয়ে আসে তনুজা। গুড মর্ণিং মেসেজ। তারপর টুকটাক আলাপচারিতা চলে। বেশিরভাগ দিনই ফেলে আসা কলেজের দিনের স্মৃতি নিয়ে আলোচনা চলে। কেবির ক্লাসে পরেশ কেমন ঘুমাত আর বকা খেত, কিম্বা অতসী কেমন অরুণকে কাটিয়ে দোজবরে বড়লোক বরকে বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেল…… এইসব! সবশেষে অতনুর আক্ষেপ থাকবেই, “তুই তো হাত ধরলি না! ধরলে জীবনটা অন্যরকম হত!” তখনই তনুজার বুকের ভেতর হাড় পাঁজরগুলো গলতে শুরু করে, গলতে গলতে পুরোপুরি দ্রব হয়ে যেতে যেতে উত্তর দেয়, “আচ্ছা, এখন তো ধরলাম!” কলেজে পড়তে অতনু প্রপোজ করলে তনুজা বলেছিল, “তোকে বন্ধুর মত দেখি।“ তারপর কত কত দিন কেটে গেছে। চব্বিশ বছর প্রায়।
দুপুরের দিকেও একবার অনলাইনে আসে অতনু। বেশিরভাগ দিনই একটা দুটো কথার পরই বলে, “তোকে চাই। নিজের করে। কবে পাব?” দ্বিধায় পড়ে তনুজা। একদিকে দীর্ঘদিনের সংস্কার, পরিমলের প্রতি কমিটমেন্ট, অন্যদিকে অতনুর ডাক যেন নিশির মত টানতে থাকে। এটা ওটা বলে কাটিয়ে দেয় তনুজা। অতনুর বৌ ওকে ছেড়ে গেছে। যে কদিন ছিল, ভালও নাকি বাসে নি। অতনু একথা বললেই বড় মায়া হয় তনুজার। মনে হয় দুহাতে আগলে রাখে, সব বেদনাগুলো মুছে নেয়। জিজ্ঞেস করেছিল তনুজা, “আবার বিয়ে করলেই পারতিস!” অতনু বলেছিল, “আবার! যা সব চার্জ দিয়ে কেটে পড়েছিল! আরেকটা কেমন আসত কে জানে!” মায়া আরো বাড়ে তনুজার। তনুজা পরিমলের একমাত্র মেয়ে পুনেতে থেকে ম্যানেজমেন্ট পড়ে। বাড়িতে তাই পরিমল আর তনুজাই। পরিমল অফিস চলে গেলে তনুজার হাতে অঢেল সময়।
অতনু বলে, “একদিন দুপুরে আসতে পারিস তো আমার ফ্ল্যাটে। কেউ তো থাকে না। তোকে আদর করব আর আদর খাব।“ তনুজা শুনে কেমন যেন হয়ে যায়। মাঝবয়সী হরমোনের প্রভাবে? পরিমল তো সেভাবে কোনকিছুরই অভাব রাখে নি! তাহলে এমন হচ্ছে কেন? নাকি দীর্ঘদিন পরিমল ওকে আলাদা করে দেখা, আরো ভালো করে বললে আবিষ্কার করে নি বলে? আর কারো চোখে আবিষ্কৃত হচ্ছে ভেবে রোমাঞ্চ হচ্ছে? কুড়ি বছরের পুরোনো বিবাহিত সম্পর্কে প্রতিদিন নতুন আবিষ্কার আসবে কোথা থেকে? স্বাভাবিক, জানে তনুজা। কিন্তু অতনু যখন বলে, “তোকে আমি কি চোখে দেখেছি প্রথম দিন থেকেই তুই জানিস! এতদিন তো আমায় মেরে রেখেছিলি, এবার তো আয়!” পারলে তখনই ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে তনুজার। কিন্তু পিছু টেনে ধরে সংস্কার। দীর্ঘদিনের মধ্যবিত্ত মনে লালিত সংস্কার। সতীত্ব নারীজীবনে সবচেয়ে বড়, এই শিক্ষাই বাড়ির বড়রা দিয়ে এসেছেন। এখন চাইলেই সেসব ঠেলে ফেলে চলে যাওয়া যায়? তনুজা অতনুকে বোঝায়। অতনু বলে, “ওসব মানি না। দুজন নরনারীর পারস্পরিক সম্মতিতে শারীরিক মিলনে বাধা কোথায়?“ মানতে পারে না তনুজা। পরিমল কি দোষ করেছে? তাকে ঠকাবে কি করে? পরিমল জানলে কতটা কষ্ট পাবে! এটা ঠিকই বরাবরই পরিমল কেমন থেকেও নেই হয়ে থেকেছে…… তবু, পরিমল জানলে তাদের সম্পর্ক আর জোড়া লাগবে? তাছাড়া মেয়ে বড় হয়েছে। যদি বুঝতে পারে? তাহলে মেয়েকে আর কিছু বলার অধিকার থাকবে তনুজার? ভেবে কুল পায় না তনুজা। তাছাড়া সমাজ বলেও তো একটা বিষয় আছে! অতনু শুনে বলে, “ধুর! ছাড় সমাজ! সমাজ আমাদের ভালো রাখে? তাহলে আমরা নিজেদের ভালো থাকার ব্যবস্থা করে নেব না কেন? কেউ না জানলেই তো হচ্ছে! “ মানতে পারে না তনুজা। কেউ না জানলেই হচ্ছে? নিজের কাছে কি জবাবদিহি করবে?
কিন্তু অতনু বলেই চলে প্রতিদিন নতুন নতুন কিছু। “তোর গালের টোলটা কাছ থেকে দেখব। তুই আমার ফ্ল্যাটে না যাস, তোর ফ্ল্যাটে আমাকে ডেকে নিস পরিমলদা না থাকলে। সেই কবে থেকে তোকে চেয়ে আসছি বলত! তুই হাতটা ধরলে জীবনটা অন্যরকম হত!” তনুজা আবার চোরাবালিতে ডুবতে থাকে। কিন্তু ডাকতে পারে না! কি করে ডাকবে! ফ্ল্যটের দারোয়ান আছে, লিফটম্যান আছে, কি ভাববে! এতদিন ধরে তারা তনুজাকে চেনে! শেষে অতনু বায়না শুরু করে, “তাহলে চল, পুরী ঘুরে আসি। নিয়ে চল, প্লীজ, অনেক আবদার করব……” তনুজা ডুবতে থাকে! পুরী! পরিমল যাবে না, ও একা? তা আবার হয় নাকি? কিন্তু অতনুর আহ্বানে মনে মনে পুরীর সি বিচে দৌড়াতে থাকে কিশোরীবেলার মত! পরিমল আর তনুজা বেড়াতে যায় না কোথাও তেমন একটা। পুরীও নয়। মনে হতে থাকে, এটুকু যদি দেওয়া যেত অতনুকে! ও যে সারাজীবনে কিছুই পেল না! লুকিয়ে কাঁদে তনুজা।
এইরকমই চলছিল। প্রায়ই গল্প হত, কোন কোন মহাপুরুষ পরকীয়া করেছেন। অতনু বলত, পরকীয়া, আবার নিরামিষ! সে আবার পরকীয়া নাকি! তনুজা গান্ধীজীর রেফারেন্স দিতে গেলে বলত, “ওসব গান্ধী ফান্ধী ছাড়, আমি বাপু সিংহ, আমার মাংস চাই বুঝলি!” অতনুর পদবী সিংহ। এতটা কাঁচা রসিকতা তনুজা একেবারেই পছন্দ করে না, কিন্তু তনুজার যে কি হয়েছে, অতনুর কোনকিছুতেই অসুবিধা খুঁজে পায় না। শুধু মনে হয় আহা! এতদিন ধরে একটা মানুষ কিছুই না পেয়ে একটা মেয়েকে এভাবে চাইতে পারে তা তনুজার ধারণার বাইরে ছিল। নিজেকে এলেবেলে ভাবতে অভ্যস্ত তনুজার নিজেকে হিরের চেয়েও দামী মনে হয়। যৌবন প্রান্তে এসে রূপ কি আর প্রথম যৌবনের মত আছে? তবু যাই যাই করেও বসন্ত যেটুকু আছে, চুপিচুপি আয়নার সামনে সেটুকু দেখে তনুজা। এটুকুতে কেউ মুগ্ধ হচ্ছে ভাবলে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পায় তনুজা। পরিমল কোনওদিন এভাবে মুগ্ধ হয়েছে? ডালভাতের জীবনে আলাদা করে মনে পড়ে না তনুজার। মাঝে মাঝে কল্পনা করে সেই সময় অতনুর হাত ধরলে কি হত…… আর যাইহোক, ডিভোর্স হত না। বিয়ে করলে তনুজা আগলে রাখত ঠিক। অতনুর জীবনটা মাঝবয়সে এমন চালচুলোহীন হয়ে যেত না। চাকরিবাকরি তো ভালোই করে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে বড় পোস্টে চাকরি। প্রচুর বেতন, সুযোগ, সুবিধা। একদিন বলতে এসেছিল তনুজাকে, তনুজা বলেছিল, “আমাকে এসব বলে কি লাভ, বল! তোর পে স্কেল শুনে কি করব, তোর সম্পত্তি জেনেই বা কি করব!” তনুজা তো সম্পত্তি টম্পত্তির ধার ধারে না! তনুজা শুধু এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে বসবাস করছে ইদানীং। না, তনুজা পরিমলকে ডিভোর্স করে অতনুর হাত ধরার কথাও ভাবতে পারে না। তনুজা পরিমলের সাথে কাটানো নিতান্ত ডালভাতের জীবনে স্বচ্ছন্দ। সেকথাও অতনুকে বলে দিয়েছে তনুজা। তাহলে কি চায় তনুজা অতনুর থেকে? বন্ধুত্ব? প্রেম? ভালবাসা? মুগ্ধতা? তনুজা সঠিক বুঝতে পারে না। অতনু কি চায় তনুজা জানে। শুধু তনুজাকে। চব্বিশ বছর ধরে শুধু তনুজাকেই চেয়ে এসেছে। এইখানটায় বড্ড মোহ তনুজার।
পথ চলতে চলতে কোথায় বাঁক নেয়, কেউ বলত পারে না। সকালে গুড মর্নিং মেসেজ আসতে বেলা আটটা বেজে যেতে লাগল। প্রথম প্রথম সেভাবে খেয়াল করে নি তনুজা। পরের দিকে তনুজা অনুযোগ করতে লাগল, “কি রে, সকালে গুড মর্ণিং এত দেরিতে হচ্ছে আজকাল! মর্ণিং গুলো কি আর গুড নেই? অতনু বলে, “ম্যাডাম, আপনি তো দেখলেন না! আর গুড থাকে কি করে! উঠতেই ইচ্ছে করে না!” তনুজা ভাবল, আহা, উঠতে ইচ্ছে করে না, রাত জেগে অফিসের কাজও তো করে! তনুজা বলল, “আচ্ছা, তোকে পাঠাতে হবে না, আমিই পাঠাব। একটু কথাও লিখে দেব, তাহলে কি লিখেছি তোর দেখার ইন্টারেস্ট হবে!” অতনু বলল, “জ্যায়সা ম্যাডাম কি মর্জি! আপনিই তো আমার বিশ্ব!” সকালে মেসেজ পাঠাতে গিয়ে তনুজা দেখে অতনু মেসেঞ্জারে অনলাইন। তনুজা মেসেঞ্জারে ঢুকেই বলে, “কি? বাবু? আমি মেসেজ পাঠাব শুনেই হাজির? ফার্স্ট হবার নেশাটা তোর গেল না!” পরেরদিন অতনুকে হারাবার ছেলেমানুষি ইচ্ছায় চারটের সময় উঠল তনুজা। মেসেঞ্জারে ঢুকেই অতনু অনলাইন। হেসে ফেলে তনুজা। লেখে, “নাঃ তোকে নিয়ে আর পারা গেল না! ভাবলাম আজ তোকে হারাবই! কিন্তু তুই তা হতে দিবি না, তাই না? সোনাছেলে!” এবার তনুজা ভাবল রাত্রে অতনুকে মেসেজ করে চমকে দিতে হবে। বলবে, “এই! এবার যাব তোর ফ্ল্যাটে! আর কষ্ট দেব না!” তনুজা জানে অতনুর কষ্টের কারণ সে, কষ্ট কমাবার ভার তাই তারই। রাত বারোটায় মেসেঞ্জারে ঢুকেই দেখে অতনু অনলাইন। তনুজা লেখে, “কি ব্যাপার? এত রাত্রে কার অভিসারে, শুনি? ওপাশ থেকে উত্তর আসে, “ কি মুশকিল, আমি কি মেসেঞ্জারে থাকতে পারব না?” ধাক্কা খায় তনুজা। বলে, “না, না তা কেন! দেখি নি তো কখনও! তাই মজা করলাম।“ বেরিয়ে আসে মেসেঞ্জার থেকে। বলা হয় না যে তনুজা অতনুর ফ্ল্যাটে যাবে ভাবতে পেরেছে।
পরেরদিন রাত্রে শুয়ে পড়ল তনুজা। কিন্তু কি যেন অস্বস্তি মনটা ছেয়ে আছে! ঘুমাতে পারল না। রাত আরো বাড়লে তনুজার কেমন কৌতুহল হোল। অতনু কি করছে, দেখি। মেসেঞ্জারে ঢুকে দেখে, হ্যাঁ অতনু অন। রাত দুটো। তনুজা ঢুকে বলল, “হাই! ক্যান আই চ্যাট উইথ ইউ, ম্যান! নাইট ইজ টু ইয়ং!” অতনু খুব বিরক্ত হয়ে বলল, “হ্যাঁ, তো? তোর আর কাজ নেই?” তারপরই বলে, “আরে, ম্যাডাম, কর, কর, চ্যাট কর। তোর জন্যই তো বসে আছি!” প্রথম একটা ধাক্কা খাবার অনুভূতি হোল তনুজার। কেমন মনে হল ঠিক বলছে না। দিনের মধ্যে অসংখ্যবার মেসেজ করা অভ্যাস হয়ে গেছিল। এখন মেসেজ করলেও উত্তর আসে না সময়মত। তনুজা অনুযোগ করে, “কি রে! মেসেজ দেখছিস না?” অতনু বলে, “মিটিং ছিল।“ মিটিং আগেও থাকত, তনুজা জানে, কিন্তু মেসেজের উত্তর সঙ্গে সঙ্গে চলে আসত। কি যেন নেই, কি যেন নেই অনুভূতিতে ডুবল তনুজা। কেমন বদলে যাচ্ছে অতনু। তনুজার মনে পড়তে লাগল অতনু কি কি বলত…… তার দাবী নিয়ে তনুজার কনফিউশন থাকলে বলত, “দূর! ঠাকুর প্রণাম করে নিবি, তাহলেই পাপ কেটে যাবে। আর দান ধ্যান, পুণ্যকাজ করলেই তো হয়! পুণ্যের ভাগে বেশি পড়লেই হোল!” তনুজার মনে হত, এত সহজ! মানুষ যে কোন অন্যায় করে পুণ্যকাজ করে ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে যাবে!
অতনুর ব্যবহারে তনুজা কেমন যেন অনুভব করতে লাগল কি যেন নেই, কি যেন নেই। অথচ সেরকম নয়। অন্যকেউ দেখলে দেখবে তাতে তনুজার আদরের নামেই সম্বোধন করা আছে, তীরবিদ্ধ হৃদয় আছে, তবু তনুজার মনে হচ্ছে হৃদয়টা নেই! তনুজা মনকে বোঝাতে বসে। বসেই ইচ্ছে হয় মেসেঞ্জার চেক করতে। হ্যাঁ মেসেঞ্জারে অতনু অন। কেমন রোখ চেপে যায় তনুজার। অতনুকে বলে, “তুই কার সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাট করিস?” অতনু বলে, “বিধান, অরূপ, শাশ্বত, বিকাশ…… কেন? তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে?” তনুজা উত্তর করে না, কিন্তু অতনুর ফেসবুকে ঢুকে দেখে ওদের মধ্যে তিনজনের নামই ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে নেই। অতনু মিথ্যে বলল? কেন? আর অতনুর বন্ধু সংখ্যা বেড়েছে। অতনুর বন্ধু খুব বেশি নয়, তবে নতুন বন্ধু কে, এটা বোঝাও খুব সহজ কাজ নয়। তনুজা ফেসবুক আর মেসেঞ্জার ঘেঁটে অস্থির করে ফেলল। তনুজা খুব টেক স্যাভি তাও নয়। কিন্তু গুগল সার্চ দিয়ে অতনুর ফ্রেন্ডলিস্ট বার করে তাতে অ্যাভারেজ ইন্ট্যার্যাকশন টাইম অনুযায়ী প্রথমেই তনুজার নাম, তারপরই আর একটা নাম। কেমন জ্বালা ধরে তনুজার শরীরে! “কি কথা তাহার সাথে? তার সাথে?”
সেই নতুন বন্ধুর টাইমলাইন চষে ফেলে তনুজা। খুব সুন্দরী। হরিণের মত চোখ। খুব গুণী। খুব ভালো গান গায়। খুব আলগা লাগে পায়ের তলার মাটি। বারবার মনে করতে থাকে অতনু কবে কবে কি কি ভাবে বিরক্ত হয়েছিল। একদিন তো মেসেঞ্জারে কথা হতে হতে মাঝপথেই কিছু না বলে চলে গেল, আর ফিরে এল না। পরেরদিনও কিছু বলল না। তারমানে অতনু এড়াতে চাইছে? অতনু ঠকাল? এটা ভাবলেই সারা শরীরে আগুন ধরে যাচ্ছে তনুজার। বলে দিলেই পারত! তনুজা কি কিছু বলত? তনুজা রাগের মাথায় বলেছিল, “কোথাও যাব না আমি, হয়েছে?” তাহলে এরকম বলেছিল বলে? অতনুও বলেছিল, “জানি। কিন্তু এই বয়সে আমি কোথায় যাব?” তাই খুঁজে নিল অন্য ঠিকানা? ঐসব ভালবাসা টাসা কিছু নয়? তুইই আমার বিশ্ব, কিছু নয়! “চব্বিশ বছর ধরে প্রতীক্ষা করে আছি” ছেলে ভোলানো কথা! তারপরই তনুজার মনে হয় ওই আভারেজ ইন্টার্যাকশন টাইম দিয়ে কি প্রমাণিত হয়? কিচ্ছু না! কিন্তু তনুজা ভুলতে পারছে না! তনুজা প্রকাশ করে ফেলে তার অনুভূতি। অতনু বিরক্তি চেপে রাখতে পারে না! বলে, আমি মেসেঞ্জারে কতক্ষণ থাকব, তাও তুই ঠিক করে দিবি?” আর ওরকম কোন ব্যাপার হয় নি। তুই ভুল ভাবছিস।ওভার থিঙ্ক করিস কেন এত? তনুজা ভাবে তাই হবে হয়ত! ওভার পজেসিভ হয়ে যাচ্ছি!
তারপর থেকে অতনুর প্রতি কথায় তনুজার মনে হতে থাকে তাকে ভোলানোর জন্য বলছে। আদরের ডাকে মনে হয় মেকি সুর… তনুজা খুব ক্লান্ত বোধ করে। ঘুমিয়ে পড়তে চায়। গভীর ঘুম। যুগান্তের অভিমান বুকে নিয়ে যেমন গভীর ঘুমানো যায়! তনুজার মনে হতে থাকে তাহলে সত্যিই আটচল্লিশ বছর হেরে যায় ছাব্বিশের কাছে! হবেই তো শেষ সূর্যের আলোর থেকে প্রভাতী সূর্যের আলো ও উত্তাপ দুইই বেশি! নাকি জাগতিক দেওয়া নেওয়ার একটা অলিখিত শর্ত মনের গোপনে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে? মেসেজে উচ্ছ্বাসের ফানুষ ছাড়া আর কিছুই দেওয়া নেওয়া হয় নি তাদের। তনুজা ভাবে, কমপ্লেক্স নয়ত? অতনু বারবার বলেছে, “তুই তো আমাকে সেই কলেজের ব্যাক বেঞ্চার ছাড়া কিছুই ভাবতে পারিস না! আমি কিন্তু এখন একটা কোম্পানীর প্রায় দণ্ডমুণ্ডের কর্তা! অনেক ক্ষমতা রাখি! কতজনকে চাকরি দিয়েছি, জানিস?” হয়ত নতুন বান্ধবী মেয়েটার কাছে অতনু ভগবানের মত হয়ে উঠছে! তাছাড়া মেয়েটি যা সুন্দরী! যে কোন পুরুষ মানুষের মাথা খারাপ হতে বাধ্য! তনুজারই মনে হচ্ছে আদর করে দেয়!
পরেরদিন সকাল থেকে নিজের মধ্যে অস্থির উথালপাথাল চলতে থাকে তনুজার। পরিমল বেরিয়ে গেলে খুব যত্ন করে সাজে তনুজা। আয়নায় বারবার নিজেকে দেখে। মন খুঁত খুঁত করতে থাকে! কি যেন নেই, তার কি যেন নেই মনে হতে থাকে। অথচ জানে যা নেই, বিস্তর সেজেও তাকে আনা যাবে না। তারুণ্য। সমস্ত শক্তি দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে। দুম করে আওয়াজ হয়। সেকেন্ড ফ্লোরের সিকিউরিটি অবাক হয়ে তাকায়। একটা ওলা ডেকে রওনা হয়। অতনুর ফ্ল্যাটের সামনে এসে বেল বাজায়। তনুজা জানে অতনুর এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে। অতনুকে বিরাট সারপ্রাইজ দেবে তনুজা। দরজা খুললেই অতনুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। উত্তেজনায় ভেতরে ভেতরে থির থির করে কাঁপছে তনুজা। দরজা খুলল না। আবার বেল। আবার অপেক্ষা। দরজা খুলল না। পরপর তিনবার বেল দিয়েও দরজা যখন খুলল না, তনুজা পাগলের মত সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। নামতে নামতে ভাবতে থাকল যদি এভাবেই পাতালে পৌঁছে যাওয়া যায়! কোনওরকমে বাড়ি এসে বিছানায় ছুঁড়ে দিল নিজেকে। যতবার চোখ বোঁজে, ততবার কল্পনায় ভেসে উঠতে থাকে এক আদিম অরণ্য, যেখানে সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্টই শেষ কথা! একটা সুন্দর সাজানো ঘর তনুজার কল্পনায় ক্রমেই আদিম অরণ্য হয়ে ওঠে। সবুজ ঘাসের গালিচায় একটা ছোট্ট নরম হরিণশিশু ক্রমেই সিংহের খাদ্য হয়ে উঠছে। তৃপ্ত সিংহ আস্তে আস্তে থাবা চাটছে। তনুজা আগ্নেয়গিরির গরম লাভাস্রোতে যেন পুড়ে যেতে থাকে। প্রতিটি কোষ দগ্ধ হতে থাকে…
কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানে না তনুজা। তনুজার মনে আদিম অরণ্যের দৃশ্য সর্বশক্তিমান হয়ে কোনও যুক্তিবোধকে ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। পরিমল টুরে গেছে, তনুজা একাই থাকবে বাড়িতে। অনেক রাত্রে তনুজা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। খোলা চুল, বিস্রস্ত সাজের তনুজাকে বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে প্রেতিনীর মত মনে হয়। তনুজারও নিজেকে প্রেতিনীই মনে হয়। যার একটা ধারণার সদ্যমৃত্যু হয়েছে। চব্বিশ বছর ধরে তাকে ভেবে বেঁচে আছে কেউ, এই ধারণার মৃত্যু। ফ্ল্যাটের ওধারের জলা থেকে জোনাকিরা উঁকি দিয়ে যায়, নাইটগার্ডের বাঁশি রাত্রের নিস্তব্ধতা এ ফোঁড়, ও ফোঁড় করে দেয় তনুজার হৃদয়ের মত। তনুজা পুড়তে থাকে। শিকড় উপড়ে যাওয়া গাছের মত অনায়াসে পুড়তে থাকে। ভোরের দিকে ঠান্ডা বাতাস যখন দগ্ধ ক্ষতে হাত বুলিয়ে দেয়, তখন তনুজার মনে হয়, পুরোটাই ভুল নয়ত? তনুজার ভাবার ভুল! দরজা খোলেনি মানেই তনুজা যেমন ভেবে নিল তেমন নাও হতে পারে। অতনু হয়ত ফ্ল্যাটে ছিল না। তনুজা বলে যায় নি তো! হয়ত ভুল! কিন্তু ভুল হলেও তনুজার মন থেকে সব ছবি মোছে না। অতনু যে শেষদিকে তনুজাকে চাইছিল না, সেই ছবি মোছে না।
আরো কিছুক্ষণ পরে সূর্যের নরম আলো তনুজার কপালে ঠোঁট রাখলে তনুজার দুগাল বেয়ে শ্রান্ত বর্ষণ শুরু হয়। বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি! তনুজা স্নিগ্ধ হতে থাকে, স্নিগ্ধ হতে থাকে। তনুজার মনে হয়, বেশ তো, যদি হয়ই, ক্ষতি কি! দেয়ার ইজ নাথিং আনফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার! যদি সত্যিই ওকে নিয়ে অতনু সুখী হয়, তবে ক্ষতি কি? সারাজীবন একটু ভালবাসার আশায় ভ্যাগাবন্ড হয়ে যাওয়া ছেলেটা যদি একটু আশ্রয় পায় তবে তার থেকে ভালো আর কি হতে পারে? তনুজার পোড়া গাছের শরীর থেকে বাকল খসে পড়ে। দাবানলে দগ্ধ অরণ্যে উঁকি মারে নতুন কচি পাতা। ভালবাসার নিবিড়তায় সবুজ।