সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
ইহুদিবাদ আর জায়নবাদের পার্থক্য হ’ল, ইহুদিবাদ একটি ধর্মবিশ্বাস, আর জায়নবাদ হলো ইহুদিদের একটা ছোট্ট অংশ দ্বারা পরিচালিত একটি জাত্যাভিমানী আন্দোলন। এতে যুক্ত হবার জন্য কারো ইহুদী হওয়া শর্ত নয়। পশ্চিমের অনেক খ্রিষ্টান বিভিন্ন কারণে এ আন্দোলনের সমর্থক এবং তাদের কেউ কেউ নিজেদেরকে জায়নাবাদী হিসেবে পরিচিত করে।
জেরুজালেমের যে টিলায় ইসরাইল বংশীয় বাদশা ও নবী হযরত দাউদ (আঃ) এর কবর রয়েছে, সেটাই জায়ন পর্বত। বিশেষভাবে এই টিলা সংলগ্ন অঞ্চলের অধিকার নেওয়ার লক্ষেই ইহুদিদের ফিলিস্তিনে ফেরার যে আন্দোলন, এটাই জায়োনিজম।
ইসলাম, খ্রিষ্টান আর ইহুদিবাদ - এই তিন ধর্মই আব্রাহামিক ধর্ম। কারণ, তিনটি ধর্মই আব্রাহাম তথা ইব্রাহিম (আঃ) এর সন্তানদের হাত ধরেই শুরু। তার আগে ছিল মিল্লাতে ইব্রাহিম (আঃ)। ইব্রাহিম (আঃ) এর সন্তান ইসমাইল (আঃ) মক্কা ও তার আশপাশে এই ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছিলেন।
মক্কার বাসিন্দারা মূলত হযরত ইলমাইল (আঃ)-র বংশধর। মক্কার গোত্রপতি ‘আমর বিন লুহাই’, ‘শামদেশ’ (বর্তমানে সিরিয়া, জর্ডন, লেরানন ও ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড) ঘুরতে গিয়ে পৌত্তলিকতা ও বহুশ্বেরবাদের প্রচলন দেখতে পান। সেখানেই তিনি মূর্তি পুজোর অনুষ্ঠান দেখে প্রভাবিত হন এবং ফিরে এসে মক্কাতেও মূর্তিপূজার প্রচলন করেন। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত তথ্যমতে, এই মূর্তিপূজাসহ সকল প্রকার অংশিবাদ ও সামাজিক অবিচার-অনাচার থেকে আরব জাতি ও সারা বিশ্ববাসীকে মুক্তি দিতে মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠিয়েছিলেন।
ইব্রাহিম (আঃ)-এর জন্ম ইরাকে হলেও তিনি মহান আল্লাহর নির্দেশে তার দুই স্ত্রীর প্রথমজনকে ফিলিস্তিনের হেবরনে এবং দ্বিতীয়জনকে পবিত্র মক্কায় সেটেল্ড করেন। কুরআনী তথ্যমতে, ওনার বৃদ্ধা প্রথম স্ত্রী সারার ঘরে অলৌকিকভাবে জন্ম নেন হযরত ইসহাক (আঃ)। আর ইসহাক (আঃ) এর ঘরে জন্ম নেন ইয়াকুব (আঃ), যিনি ইসরাইল নামেও প্রসিদ্ধ ছিলেন।
ইহুদিদের আদি ধর্মগ্রন্থ হলো তাওরাত, যা ইংরেজিতে ওল্ড টেস্টামেন্ট নামে পরিচিত। তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছিল মুসা (আঃ)-এর উপর। তাওরাতকে ইহুদিদের আইনগ্রন্থ হিসেবে ধরা হয়, যেখানে তাদের জীবনযাপন করার সকল নির্দেশনা বিস্তারিত দেওয়া ছিল। তবে পরবর্তী সময়ে ইহুদি রাজন্যবর্গ এতে অনেক বিকৃতি এনেছেন বলে ‘কুরআন মাজিদ’-এ উল্লেখ আছে।
বনী ইসরাইল’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুজন নবী হলেন মূসা (আঃ) ও ঈসা (আঃ)। জেরুজালেমে জন্মগ্রহণকারী নবী ঈসা (আঃ)-র উপর নাজিল (অবতীর্ণ) হয়েছিল ইঞ্জিল, যা ইংরেজিতে নিউ টেস্টামেন্ট নামে পরিচিত। ঈসা (আঃ) ‘বনী ইসরাইল’র নবী হলেও সম্প্রদায়ের এক বিশাল অংশ তাঁকে প্রত্যাখান করে এবং তাঁর বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্র করে।
ওই সময় জেরুজালেম শাসন করতো রোমানরা। ঈসা (আঃ)-এর ওপর ইহুদিদের চেয়ে রোমানদের আস্থা অনেক বেশি ছিল। পরবর্তীতে ইমানদার রোমানদের মাধ্যমেই পার্শ্ববতী অঞ্চল ও ইউরোপে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রসারিত হয়।
মূলত বনী ইসরাইলের লোকেরাই হলো ইহুদি ধর্মের অনুসারী। তবে তাদের বাইরে পূর্ব ইউরোপ ও পূর্ব আফ্রিকার কিছু লোকও ইহুদিবাদে দীক্ষিত হয়েছে।
ইব্রাহিম (আঃ) এর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরার পুত্র মক্কায় বসবাসকারী হযরত ইসমাইল (আঃ)-এর বংশে শেষনবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (আঃ) এর আবির্ভাব হয়। তিনি ইহুদি, খ্রিষ্টান ও আরব উপদ্বীপের মিল্লাতে ইব্রাহিমির অনুসারীসহ পৃথিবীর সকল মানুষকে ইসলাম গ্রহণের জন্য আহবান করেন। বিকৃতির শিকার ওসব ধর্মের যে রীতি-নীতি মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আনীত একেশ্বরবাদী ইসলামের রীতি-নীতির সঙ্গে সাঙ্ঘর্ষিক ছিল, সেগুলো পরিত্যাগ করতে বলেন। ফলে আরবদের অধিকাংশই, খ্রিষ্টানদের অনেকেই এবং সেই সাথে কিছু ইহুদিও ইসলাম গ্রহণ করে।
কুরআন মজিদে ইহুদিদেরকে ‘বনী ইসরাইল’ (ইসরাইলের সন্তানবর্গ) নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইসরাইল ও ইয়াকুব (আঃ) একই মানুষ। ওনার জ্যৈষ্ঠ সন্তানের নাম ছিল ইহুদা। এই ইহুদার সাথে সম্পৃক্ত করেই ‘বনী ইসরাইল’কে ইহুদি বলা হয়।
ইয়াকুব (আঃ)এর সন্তান ইউসুফ (আঃ)-এর মিশরে রাজত্বকালে ইহুদিরা ফিলিস্তিন থেকে মিশরে সেটেল্ড হয়েছিলেন। পরে তাঁরা ফেরাউনের অত্যাচারের শিকার হন। নবী মূসা (আঃ) এসে ফেরাউনের মোকাবেলা করে তাদেরকে সেই জুলুম থেকে মুক্তি দেন। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! যে ‘বনী ইসরাইল’ একসময় ফেরাউনের জুলুমের শিকার হয়েছিল, সেই ‘ বনী ইসরাইল’ এখন পশ্চিমা খ্রিষ্টানদের সহায়তা নিয়ে ফেরাউনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ফিলিস্তিনের মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়ের উপর জুলুম করছে এবং তাদেরকে বাস্তুচ্যুত করে ও তাড়িয়ে দিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিনে সেটেল্ড করছে। সহীহ হাদীস মতে, কেয়ামতের আগে ‘শাম’ অঞ্চলে মুসলমানদের সাথে ইহুদি ও খ্রিষ্টনাদের চূড়ান্ত যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হবে। পশ্চিমা খ্রিষ্টানদের মদতে ‘শাম’-র মূল ভূমি ফিলিস্তিনে দখলদার ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও টিকে থাকার রহস্য নিশ্চয় সেই যুদ্ধের নিকটবর্তীতা প্রমাণিত করে।
জায়নবাদ
তাওরাতে উল্লেখিত শেষনবী বিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণীতে প্রভাবিত হয়ে ইহুদিরা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আগমনের অনেক বছর আগে ফিলিস্তিন ছেড়ে আরব উপদ্বীপের ইয়াসরিব (পরবর্তীতে মদীনা) নামক পল্লীতে সেটেল্ড হয়। কিন্তু শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন সত্যি এলেন এবং মদীনায় হিজরত করলেন, তখন ইহুদি নেতারা ওনাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
শেষনবীর প্রতি মদীনবাসী আরবদের আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখে ইহুদিরা মৌখিকভাবে চুক্তি ও শান্তিতে বসবাসের কথা বললেও ভিতরে ভিতরে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তাদের হিংসাত্মক ষড়যন্ত্রে মদীনাকে মুসলমানমুক্ত করার উদ্দেশ্যে পঞ্চম হিজরীতে জঙ্গে আহযাব বা খন্দক (পরিখা) যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধে ইহুদি ও তাদের মিত্র মক্কার পৌত্তলিকরা পরাজিত হয়।
এই ঘটনার পর মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) চুক্তি ভঙ্গকারী ইহুদি গোত্রগুলোকে মদীনা থেকে বিতাড়িত করেন। তখন তারা মদীনা থেকে ১৫৩ কিলোমিটার উত্তরে খাইবারের দিকে চলে যায়, যেখানে আগে থেকেই কিছু ইয়াহুদি গোত্র বসবাস করতো। দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রঃ)-এর আমলে ইহুদিদেরকে খায়বার থেকে বিতাড়িত করা হলে তারা সিরিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। অতঃপর তাদের অনেক গোত্র মিসর, উত্তর আফ্রিকা, স্পেন ও পূর্ব ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে।
১৮ শতকের দিকে দেখা যায়, ইহুদিরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বিশেষ করে রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, জার্মানী, সুইজারল্যান্ড। সেখানে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের সাথে ইহুদিদের দ্বন্দ্ব লাগে এবং রাশিয়ায় অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের সাথে ইহুদিদের সংঘাত শুরু হয়। তখন থেকেই অনেক ইহুদি বুদ্ধিজীবী তাদের পূর্বপুরুষদের একদা বাসস্থানে একটি ইহুদি রাষ্টের কল্পনা করেন। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে আন্দোলন সেটাকেই জায়নাবাদী আন্দোলন বলা হয়।
জায়নবাদের উত্থান
ইহুদিরা যখন ফিলিস্তিনে আসতে শুরু করে, তখন সেই জনপদ ছিল উসমানী সাম্রাজ্যের অধীনে। ১৮ এবং ১৯ শতকে ইহুদীদের মধ্যে হাসকালা (Haskala) নামে একটি বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলন শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ও সংস্কৃতির সাথে ইহুদি ধর্মীয় শিক্ষার একটা মেলবন্ধন সৃষ্টি করা। এই আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল বার্লিন (জার্মানী)। সেই সময়ে ইহুদিদের অধিকাংশই ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিচরণ করতেন। তারা মনে করেন যে তাদের এখন একসঙ্গে থাকা উচিত এবং নিজেদের একটা সংস্কৃতি তৈরি করে একটি জনপদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
এই চিন্তারই একটি রাজনৈতিক ধারণা দেন অস্ট্রিয়ান সাংবাদিক থিওডর হেজেল। তিনি ইহুদিদের উপর বৈষ্যমের কথা তুলে ধরে ইহুদি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। পরবর্তীতে ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ড প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নেতারা বলেন, “জায়োনিজম এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে একটা নিরাপদ আবাস নির্মাণ করা যেটি আইন দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে।”
এভাবে প্রতি দুই বছর অন্তর জায়োনিস্ট কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়া শুরু হয়। কিন্তু তারা ফিলিস্তিনে আইনগতভাবে সেটেল্ট হতে চাইলে সেটা উসমানী শাসকরা নাকচ করে দেন। এরপর তারা ব্রিটিশদের কাছে যায়। ব্রিটিশরা সেটেলমেন্টের জন্য বর্তমান আফ্রিকার উগান্ডাকে প্রস্তাব করে, কিন্তু তারা ফিলিস্তিনের জন্যই গোঁ ধরে বসে থাকে। এটা ১৯০২-০৪ সময়ের কথা। এরপর প্রেক্ষাপট দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে।
জায়নবাদীরা ইহুদিদের সামান্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করতো। তাদের বেশির ভাগই ছিলো রাশিয়ান ইহুদি। তবে আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলো অস্ট্রিয়ান ও জার্মান ইহুদি। এই জায়নবাদীরা সুসংগঠিত ছিল। তাদের নিজস্ব পত্রিকা ছিলো, তারা নিজেদের কার্যক্রমকে ইহুদি রেনেসাঁ বলে প্রচার শুরু করে।
১৯০৫ সালে রাশিয়ার বিপ্লবের পর অনেক ইহুদি দেশ ছেড়ে ফিলিস্তিনের দিকে চলে আসে। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯১৭ সালে জায়োনিস্ট আন্দোলন রাশিয়ান ইহুদিদের হাতে চলে যায়। ইংল্যান্ডে অবস্থানকারী দুই জায়োনিস্ট নেতা চেইম ওয়াইজম্যান এবং ন্যাহুম সকোলোর প্রচেষ্টার ফলে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর ইহুদিদেরকে লেখা এক পত্রে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। সেটি পরে ১৯২২ সালে তৎকালীন জাতিসংঘের (লিগ অব নেশন-এর) ম্যাণ্ডেটের অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর ফিলিস্তিনে ইহুদি সেটলারদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৯২৫ সালে ফিলিস্তিনি ইহুদীর সংখ্যা ছিল যেখানে ১০ লাখ, সেটা ১৯৩৩ সালে হয় ২৩ লাখ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তি পরাজিত হবার পর ১৯১৯ সালে ফ্রান্স সিরিয়া ও লেবানন দখল করে নেয়। ১৯২০ সালে ব্রিটিশরা দখল করে নেয় ফিলিস্তিন ও পূর্ব জর্ডান। বিশ্বযুদ্ধে উসমানী সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি ও বুলগেরিয়ার সঙ্গে কেন্দ্রীয় জোটে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ সরকার জাত্যাভিমান মন্ত্রে উজ্জীবিত করে আরবদেরকে উসমানীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উস্কে দেয় এবং তাদেরকে উসমানী সাম্রাজ্য থেকে আলাদা করে ফেলে।
এই অবস্থায় উসমানী সাম্রাজ্য সমর্থক সিরিয়ান আলিম ইজ্জুদ্দীন আল-কাসাসম (১৮৮২-১৯৩৫) মুসলিম যুবকদেরকে নিয়ে ফরাসী দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে গড়ে তোলেন। দামেস্ক ও আলেপ্পোতে তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে না পারায় পরে (১৯২০) তিনি ফিলিস্তিনের হাইফা শহরে চলে যান এবং সেখানে ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করে লোকজনকে ইহুদি সেটেলারদের বিরুদ্ধ সংগঠিত করতে থাকেন। তিনি ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসন এবং জায়নবাদীদের আধিপত্য উৎখাতের জন্য নৈতিক, রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রাম অপরিহার্য মনে করতেন। তিনি সেখানে আল-কাফ আল-আসওয়াদ (কালো হাত) নামে একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলেন এবং ইহুদি সেটেলারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেন। ১৯৩৫ সালের ৮ নভেম্বর শেখ জায়েদ পল্লীর একটি গুহায় ব্রিটিশ দখলদারদের পুলিশ আল-কাসসামকে ঘিরে ফেলে। ঘেরাও হওয়ার পর তিনি তার লোকদের শহীদের মত মৃত্যুবরণের আহবান করে গুলি বর্ষণ শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে শাহাদত বরণ করেন। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখার নাম রাখা হয়েছে ইজ্জুদ্দিন আল-কাসসাম ব্রিগেড এবং তারা নিজেদের প্রস্তুতকৃত ও ব্যবহৃত স্বল্পপাল্লার রকেটের নামও আল-কাসসাম রেখেছে।
এরপর জার্মানিতে হিটলারের উত্থান হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তার সৈন্যরা ইহুদিদের উপর গণহত্যা চালায়। এর ফলে বিশ্ববাসীর কাছে ইহুদিদের প্রতি একটি সহমর্মিতার জায়গা তৈরি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদিরা দলে দলে ফিলিস্তিনে এসে আবাস গড়তে শুরু করে।
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক প্রস্তাবে ফিলিস্তিনকে দুইভাগে বিভক্ত করার কথা বলা হয়। এতে পক্ষে ভোট পড়ে ৩৩টি, বিপক্ষে ১৩টি। দশটি দেশ ভোটদান থেকে বিরত থাকে।
প্রস্তাব অনুযায়ী ফিলস্তিনের ৫৭.৭% জায়গা নিয়ে গঠিত হবে ইসরাইল। বাকী ৪২.৩% জায়গা পাবে আরবরা। আর আরবদের জায়গাতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেম ও বেথেলেহাম শহর থাকবে জাতিসংঘের অধীনে।
তাছাড়া ওই প্রস্তাবে ইসরাইলের সীমানা এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে ইসরাইলের পক্ষে বাকী ৪২.৩% দখলে নেওয়া সহজে সম্ভব হয়। ইসরাইল জাতিসংঘের এমন প্রস্তাবে সমর্থন জানায় এবং মিসর ও সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলো তার বিরোধিতা করে।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ঘোষণা করা হয়। পরের দিন (১৫ মে) মিশর, জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া এবং ইরাক বাহিনী ইসরায়েল আক্রমণ করে। এতে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির সমর্থন পাওয়া ইসরাইলিরা বিভক্ত আরবদের উপর জিতে যায় এবং তারা জাতিসংঘ প্রস্তাবিত ৫৭.৭% এর পরিবর্তে ফিলিস্তিনিদের ৭৮% ভূমি দখল করে নেয়। এই যুদ্ধের ফলে সাত লাখ আরব তাদের বাড়িঘর ত্যাগ করে শরণার্থী হয়ে পড়ে।
এরপর ১৯৬৭ সালের জুন মাসে ইসরাইল মিসর ও সিরিয়ায় হামলা করে এবং আরবদের জন্য জাতিসংঘের বরাদ্দকৃত ফিলিস্তিনের বাকী ৩২% অংশও (জর্ডানের অধীনে থাকা পশ্চিমতীর ও মিশরের অধীনে থাকা গাজা) দখল করে নেয়। সেই সাথে মিশরের বিশাল সিনাই উপত্যকা ও সিরিয়ার গোলান মালভূমির দুই তৃতীয়াংশও দখল করে নেয়। ১৫ বছর পরে (১৯৮২ সালে) আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় অনেক শর্ত সাপেক্ষে ইসরাইল সিনাই উপত্যকা ফেরত দিলেও গোলান মালভূমি আর ফেরত দেয়নি।
পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের মিত্রদেশগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে গৃহীত বিভিন্ন প্রস্তাবে ইসরাইলকে ১৯৬৭ সালে দখল করা আরবভূমি ছেড়ে দিতে বলা হলেও ইসরাইল এসব প্রস্তাবকে সবসময় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছে। বরং সরকারি অফিস ও সেটেলম্যানদের জন্য আবাস নির্মাণের অজুহাতে দিনের পর দিন ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ও পাড়া-গ্রাম দখল করে নিচ্ছে। সেই সাথে ইহুদিদেরকে মসজিদে আকসায় প্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে এবং প্রতিবাদকারী মুসলমানদের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে।
আরব দেশগুলোর মাঝখানে তাদের জায়গা-জমি জবরদখলের মাধ্যমে ভয়ঙ্কর একটি জায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার অর্থ হলো মুসলমানদের ঐক্য ও আত্মমর্যাবোধে ভয়ঙ্কর ফাটল ও অসহনীয় দুর্বলতার প্রকাশ।