সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
শক্ত হাট্টাকাট্টা মানুষটা তিন মাসে কেমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুকিয়ে গেল। ধনঞ্জয়ের চোখগুলো পর্যন্ত বসে যাওয়া গালের পিছনের কোটর থেকে যেন বেরিয়ে আসছে। চোখ বুজলেই ও দেখে বাতাসে ভারী ধুলো ভাসছে, চারপাশে বুড়ো কুকুরের পিঠের ঘায়ের মতো গোলাপি ধুসর এবড়ো খেবড়ো পাথর খাদানের গর্ত থেকে পোকার মতো সাদা সাদা ধুলো মাখা মানুষ বেরিয়ে আসছে। ঘড় ঘড় করে বিশ্রী আওয়াজে বড় বড় দানোর মতো গোল হয়ে দাঁড়িয়ে এক দল ক্রাশার বড় বড় পাথর চিবিয়ে ছোট করছে। কখনো শুনতে পায় ঘরের ভিতর কেউ হাপরের মতো শোঁ শোঁ আওয়াজে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করছে মঝে মাঝে ঘং ঘং কাশির আওয়াজ। ভয়ে ও ঘুম থেকে উঠে বসে।
গোলাপি অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে, পুরুলিয়ার বড় ডাক্তারও অনেক পরীক্ষা করে দেখেছে কোন রোগ নাই অথচ এমন শক্ত মানুষ ঘরে বসে বসে শুকিয়ে যাচ্ছে। যে লোকটা মাঠ আর চাষ ছাড়া কিছু জানত না আজকাল সে মাঠে যেতে পর্যন্ত চায় না। পাশের বাড়ির কানু যে ধনঞ্জয়ের ভরসায় চাষ করত সে পর্যন্ত সেদিন নিজে এসে ওকে ডাকল, বলল- এবার তো সর্ষে ফেলার সময় হয়েছে চল ধনঞ্জয় দুজনে সর্ষেটা লাগিয়ে আসি, ধনঞ্জয় বোকার মতো ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল – না আমি এবার আর সর্ষে দেবো না। ইচ্ছা করছে না।
গোপালির কানে একথা যেতেই সে ভিতর থেকে রেগে দৌড়ে এসে বলল –তাহলে তুমি কি করবে? চুপ মেরে বসে থাকবে? কি হয়েছে কি তোমার? তোমার এমন মরন ক্যানে?
ধনঞ্জয় শূন্য দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে গোপালির দিকে।
২
রাস্তার ধারের উঁচু পাথুরে ডাঙা জমিটার নীচে বড় ঝাঁকড়া মহুয়া গাছটার পর থেকে বড় ধান জমিটা হঠাৎ শুরু হয়েছে, চারিদিকে এক অদ্ভুত শান্তি। গাছটার ছায়ায় দাঁড়িয়ে, সকালের হাওয়ায় ধনঞ্জয় মাঠের কচি সবুজ ধান গাছগুলোর দোলা দেখতে দেখতে ভাবছিল, বছর চারেক আগেও এই টাঁড় জমিটার কি হাল ছিল? জমিটাকে ঠিক করতে কটা বছর ওকে কি খাটনিই না খাটতে হয়েছে! তার শ্বশুর দিনু মানকি কোনদিন ভাবেনি তার পাথুরে ডাঙার ধারের এই পতিত টাঁড় জমিতে কোনদিন ধান হবে।
হঠাৎই সকালের শান্ত নির্জনতাকে খান খান করে কর্কশ ঘড়ঘড় আওয়াজে রাস্তার উপর ধুলো উড়িয়ে বড় কালো গাড়িটা এসে দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়িটা দেখতে দেখতে ও ভাবল গাঁয়ে কোথাও শান্তিতে বসার জো নেই। বছর পাঁচেক ধরে ও দেখছে বান্ধাডিহ আর আশপাশের গ্রামে গাড়ি আর মোটর সাইকেলের দৌরাত্মে টেঁকা দায়। ভাবে বছর দশ আগেও গাঁয়ে সবার বাড়িতে সাইকেলও ছিল না।
গাড়ি থেকে জনা তিনেক ছেলের সঙ্গে নামল চোখে কালো চশমা পড়া ওর বয়েসী একটা লোক। কালো লোকটা গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়াল, পড়নে তার সাদা প্যান্ট আর বুকের বোতাম খোলা লাল সবুজ জামার ভিতর দুর থেকে ধনঞ্জয় মোটা সোনার হারটা দেখতে পেল। তিনটে মস্তানের মতো ছেলে ওর দিকে কিছুটা হেঁটে এসে ওকে হাত নেড়ে ডাকল, ও লুঙ্গিটা হাতে ধরে হাঁটা দিল ওদের কছে এলে, একটা ছেলে ওকে বলল- এই ডাঙ্গা জমিটা কার বটে?
ও বুঝল বয়েসে ওর থেকে ছোট এই ছেলেগুলো সব আদিবাসী ছেলে, এরকম আদিবাসী ছেলে দেখলেই ওর এখন রাগ হয়। ও একটু ভারী গলায় জিজ্ঞাসা করল- ক্যানে?
একটা ছেলে একটু খেঁকিয়ে ওঠে– তাতে তোমার কি? জমিটা কার বটে?
ধনঞ্জয় একটু রেগে বলে- জমিটা আমার বটে, ক্যানে?
ডাঙ্গাটার দিকে তাকিয়ে লোকটা ওদিকে একটা সিগারেট বার করে ধরাল। এই এক হয়েছে, আদিবাসীর ব্যাটা সব সাহেব হ্যইছে। সাহেব না দালাল।
-ইদিকে এসো, দাদা, তোমার লগে কথা কইবে।
ও রেগে বলে ওঠে-কি কথা বলো না।
ওদিক থেকে আওয়াজ এলো – কি বলছে রে? খবর পেলিক?
-এই মালিক বটে।
ওকে নিয়ে ছেলেগুলো দাদার দিকে এগোয়।
লোকটা বলে- কি নাম?
ধনঞ্জয়ের চোয়াল শক্ত হয়, বলে- ধনঞ্জয় মুড়া।
-বান্ধাডিহ বাড়ি? সে মাথা নেড়ে বলে –হাঁ।
লোকটা মুখটা ওর কাছে নিয়ে এসে বলে- জমিটা বেচবে?
ভালো দাম পাবেক।
ধনঞ্জয় বলে কোন জমিটা বটে?
লোকটা আঙ্গুল তুলে বড় পাথুরে ডাঙ্গা জমিটা দেখায়। ধনঞ্জয়
একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে –তোমারা কারা? কোথা হতে আসছ বটে?
ছেলেগুলো বলে দাদা বান্দোয়ানের মা দুর্গা ক্রাশার কোম্পানির
মালিক। ধনঞ্জয়ের বুক ছ্যাঁত করে ওঠে, ও বুঝে গেছে, পাথর খাদানের লোক। সে জানে এই ডাঙ্গার সিকি ভাগ কানুদের, তবু গম্ভীর গলায় বলে ওঠে এ জমি বিক্রি নেই।
লোকটা চোখ নাচিয়ে বলে ওঠে এই পতিত পাথুরে ডাঙ্গা জমির অনেক দাম পাবে।
ও শক্ত স্বরে বলে – শোন নাই নাকি, এ জমি বিক্রি নাই বটে,
বলে ওদের মুখের উপর হাঁটা দেয়। লোকটা ভ্রু কুঁচকে ওকে একটু দেখে গাড়িতে উঠতে উঠেতে বলে। লোকটা কে বটে?
একটা ছোঁড়া বলে- ইটা বান্ধাডিহর দিনু মানকির ঘরজামাই গো
দাদা। ধুলো উড়িয়ে কালো গাড়িটা হুশ করে চলে যায়।
ধনঞ্জয় ভাবে আপদ গেছে তবে কানুকে নিয়েই যা একটু ভয়,
ও খবর পেলে হয়ত লোভে পরে ওর ভাগটা বেচে দেবে। ও চিন্তিত মুখে ভাবতে ভাবতে ও ফেরার পথ ধরে। ঝোড়ার ধারের কানুর ধান জমিতে জল নেই দেখে, ও দাঁড়াল। কানুটার এতো ভালো জমি অথচ দিন রাত হাঁড়িয়া খেয়ে পরে আছে, মাঠের দিকে হাঁটেই না। হঠাৎ ওর চোখ পরে আলের পাশের ধান গাছের পোকাটার দিকে, সব্বোনাশ মাজরা পোকা লেগেছে, কানুকে খবর দিতে হবে। একবার গাছের ভিতরের মাজায় চলে গেলে দাঁড়ানো ধানগাছ শেষে, একেবারে মাঝের থেকে খেয়ে গাছটার মাজা ভেঙ্গে দেয়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফলন্ত গাছ শুকিয়ে যায়। তাড়াতাড়ি এর বিহিত না করলে সারা মাঠে ছড়িয়ে পড়বে।
৩
একটু পর মনটা একটু হালকা হতেই লতিকার মুখটা মনে পড়ে গেল, মেয়েটা বড় হচ্ছে এবার ক্লাস নাইনে উঠবে। একটাই মেয়ে, গোপালিতো মেয়ে বলতে পাগল, বাবুদের মেয়েদের মত সে মেয়েকে বাড়ির কোন কাজ করতে দেয় না, সে কেবল পড়াশোনা করে, ধনঞ্জয়ও খুশী। আদিবাসী মেয়ে বাড়ির কাজ না করে পড়ছে এমন এ তল্লাটে কটা আছে? প্রথম ছেলে মারা যাবে বছর তিন পর লতিকা হয়। তার স্বপ্ন মেয়ে বড় হয়ে ইস্কুলের দিদিমনি হবে, তার কাছেই থাকবে আর সেও একটা খাটিয়ে চাষিঘর মুন্ডা ছেলে দেখে বিয়া দিবে। কত খেটে আজ ও এখানে এসেছে, ওর বাপ মা মরেছে কোন ছোটবেলায়। মামার বাড়ীতে মানুষ, তাই মেয়েকে ছাড়ার কথা ও ভাবতে পারে না।
পনের বছর আগে দিনু যখন গোপালির সাথে বিয়ে দিয়ে ওকে
নিয়ে আসে তখন গ্রামের সবাই ঘর জামাই বলে পিছনে হাসত, পাহাড়িটোলার রতনকে নিয়েও কানাঘুষো ও শুনেছে। এখনো ঈর্ষায় আড়ালে আবডালে ওকে নিয়ে নানা কথা হয়। তবে সেদিনও গাঁয়ের লোকের কথা গায়ে মাখে নি আর আজ তো ওর গোলা ভরা ধান, কেন্দু পাতার ব্যবসা, এখন সবাই ওকে সমীহ করে।
আজকাল রাত পর্যন্ত গোপালির আর মেয়ের অনেক টিভি
দেখার বাতিক হয়েছে দেখে ধনঞ্জয় একটু বিরক্ত হয়। দুজনেই আর আগের আগের মতো আর সকালে উঠতে পারে না। গোপালি তখন মেয়েকে ইস্কুলে পাঠিয়ে গোয়ালের গরু কটাকে বাইরের সজনে গাছ তলায় বাঁধতে গিয়ে দেখল পাশের বাড়ির মালতি কঠিন মুখে হাঁসগুলোকে বাসী পান্তা দিচ্ছে।
ও জিজ্ঞাসা করে- কিরে কানু ফিরেছে?
মালতি বিরক্ত স্বরে বলে- সারাদিন হাঁড়িয়া খাচ্ছে আর
ঘুমুচ্ছে, এদিকে বাড়িতে আনাজ নাই, চাল, ডাল নাই, ছেলে মেয়েগুলোর মুখে কি যে দেবো? বলে গজ গজ করতে করতে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
আগে মালতি আর গোপালি খুব বন্ধু ছিল, কিন্তু এখন দুজনের
আর তত ভাব নাই। গোপালির মনে পরে ধরণী মুড়া আর ওর বাপ দিনু মানকি খুব বন্ধু ছিল। সেই সময় কানুদের কি অবস্থা খুব ভালো ছিল! কুড়ি বিঘে ঝোরার ধারের ধানের জমি, বাড়িতে তিনটে হাল, গাই,বলদ, ছাগল, ধানের গোলা, জমজমাট অবস্থা। সেই সময় বরং ওদের অবস্থা তত ভালো ছিল না, বিঘে বারো জমির অনেকটাই ট্যাঁড় ডাঙ্গা জমি, দিনু চাষবাস করত কিন্তু যতটা না করলে নয় ততটা।
ওর বাবা দিনু আর তার বৌও মারা গেছে বছর পাঁচেক হলো। দিনু খুব ভালো মানুষ ছিল, গাঁয়ের সবাই খুব মানত, ভালো বাঁশি বাজাত, জঙ্গলের অনেক জড়ি বুটি চিনত, গাঁয়ের লোকের নানা রোগ সারাত সে, জঙ্গলের জড়ি বুটি দিয়ে হাঁড়িয়া বানাত, সেই হাঁড়িয়ার জন্য এদিককার লোকে সব পাগল ছিল। চার ছেলেমেয়ে মারা যাবার পর গোপালি হয়, লতিকার মতো সেও বাপ মায়ের খুব আদরের মেয়ে ছিল। দিনু ওকে বান্দোয়ানের কাছে চিরকুন্দায় ওর মামার বাড়ির গ্রামে পাঠিয়ে দেয় ইস্কুলে ভর্তি করার জন্য। দিনু তখন অন্য স্বপ্ন দেখত। গোপালি সেখানকার হাই স্কুলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়ে।
বাড়িতে ঢুকে উঠোনের রোদে ধানগুলো শুকতে দিতে দিতে
ভাবছিল, ধরণী মারা যাবার চার বছরের মধ্যে সব কেমন শেষ হয়ে গেল। বড় দুই ভাই জমি ভাগ নিয়ে অন্য পাড়ায় চলে গেছে আর কানু বাড়ি আগলে মালতি আর ছেলে মেয়ে নিয়ে এখানে পড়ে আছে। এখন গোপালিদের অবস্থা অনেক ভালো, লোকটাও খাটতে পারে! সারাদিন মাঠে ঘুরছে, চাষ বলতে পাগল, জঙ্গলের কেন্দু পাতা আর বাবুই ঘাসে কারবারও করে। ধনঞ্জয় খুব হিসেবি লোক ওর শ্বশুর দিনুর মতো নয়। এদিকে গোপালি ওদের পাড়ার মা সারদা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সভাপতি। হিসাব পত্র, খাতা লেখা ব্যাঙ্কে যাওয়া সব তাকেই করতে হয়, পাড়ার সব মেয়েরাও ওকে মান্য করে। সবাই বলে গোপালির খুব দেমাক হয়েছে, সে ভাবে, হবে না কেন? কি নেই ওদের? এই সেদিন গাঁয়ের প্রথম টিভি কিনলো ওরা।
৪
রান্না করে ছাগলগুলোকে ঘাস দিতে দিতে ও দুর থেকে দেখে
জমির আল ধরে ধনঞ্জয় ফিরছে। ধনঞ্জয় পাড়ার পুকুরে চান করে বাড়ি ঢুকতে গিয়ে দেখে কানু মাথা নিচু করে বসে আছে তার বাড়ির সামনে, তাকে দেখে একটু নরম সুরে বলে – কানু তোদের ঝোরার পশ্চিমের জমিতে মাজরা পোকা লেগেছে, তাড়াতাড়ি ওষুধ দে না হলে সব ধান শেষ করে দেবে। কানু চুপ করে মাথা নামিয়ে বসে থাকে।
ধনঞ্জয় বাড়ি ঢুকে গোপালিকে বলল– ভাত দে, বান্দোয়ান যাব।
দুলালি ভাত বাড়তে বাড়তে বলল– বান্দোয়ান কেন যাবে আজ?
সে বলল – ডিলারের থেকে সার আর ওষুধ নিয়ে আসবো। বলে সে খেতে শুরু করল।
এমন সময় ওদের কানে এলো পাশের বাড়ি থেকে মালতি আর কানুর ঝগড়ার আওয়াজ। ধনঞ্জয় ভাতের গ্রাসটা নামিয়ে রেখে গোপালির দিকে তাকায়। দুজনে দুজনকে দেখে তারপর ধনঞ্জয় আবার খেতে শুরু করে। ঝগড়া কমে আসে, মালতির ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ আসছে।
ধনঞ্জয় খেয়ে বেরিয়ে গেছে, লতিকা একটু পরে ইস্কুল থেকে ফিরবে। সামনের সজনে গাছটায় দুটো শালিক এসে একে ওপরের গা ঘেঁষে বসেছে। গোপালির ছোট বেলার নানা কথা মনে পরতে থাকে, ধরণী আর দিনু দুই বন্ধু মিলে বড়শালঘাটির জঙ্গল থেকে বরা শিকার করে নিয়ে এলে, ওদের গোটা পাড়ায় পরব লেগে যেত। পাহাড়ি টোলার রতনের কথা ভেবে গোপালির মনটা খারাপ হয়ে যায়, কতই বা বয়েস ছিল তখন? আজকের লতিকার মতই উটতি বয়স। যেদিন জঙ্গলে ছেলেটা ওকে বলেছিল- তোর চোখদুটো খুব সোন্দর। তুই যখন চুল বেঁধে তোর মায়ের সাথে যাস তখন কি যে লাগে তোকে। সেদিন ও লজ্জায় হেসেছিল, আজও ভাবলে ওর গা শিরশির করে ওঠে।
ছেলেটা ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিল লতিকারও ইচ্ছা ছিল বিয়ে করার। কিন্তু রতনরা ভুমিজ বলে তার বাবা রাজি হয় নি মুন্ডা মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে। ওদের মেলা মেশা বন্ধ হয়ে যায়, রতনের বাবা জোড় করে ওর বিয়ে দেয়।
দিনুও এর কিছু দিন পর দিনু শিলদায় কুটুমবাড়ি গিয়ে মা বাপ মরা ধনঞ্জয়কে দেখে। ছেলেটার বাবা মা লাতপাড়ার পাথর খাদানে কাজ করতে গিয়ে অল্প বয়েসে মারা যায়। বাপ মা মরা ছেলেটাকে ওর মামা শিলদায় নিয়ে আসে। ছেলেটাকে দিনুর ভালো লাগে ওদের জাতের, মামার চাষ সেই দেখে, ঝাঁকাল শাল গাছের মতো সুন্দর পেটানো চেহারা। দিনু ওর মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে ওকে ঘর জামাই করে নিয়ে আসে। সেই থেকে ধনঞ্জয় বান্ধাডিহতে। ছোটবেলায় পাথর খাদানে বাবা মায়ের মৃত্যু, তারপর মামার বাড়ীতে অনাথের মতো বড় কোন রকমে হওয়ার পর ও এখানে গোপালির প্রেম আর দিনুদের স্নেহ ভালবাসায় এক স্বপ্নের জীবন পায়।
গোপালি পরে শুনেছিল রতন বাড়ি ছেড়ে বান্দোয়ানে গিয়ে পার্টির নেতা শীতল কুণ্ডুর ঠিকেদারি কাজের দেখভাল শুরু করে। এখন নাকি সে নাকি অনেক বড়লোক, বড় বাড়ি করেছে সিমলাপানিতে।
লতিকা পিঠে ব্যাগ নিয়ে হাসি হাসি মুখে বাড়ি ঢোকে। গোপালি বলে যা তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে আয় খেতে বসব। লতিকা কলতলায় যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করে – তুমি এখনো খাও নি?
উত্তর আসে না, তুই তাড়াতাড়ি আয় আমি ভাত বাড়ছি দুজনের।
কিশোরী লতিকার তখন চোখে ভাসছে সিনেমার হিরোর মতো ছেলেটার কথা। কি দারুন মোটর সাইকেল, তেমনি জামা প্যান্ট, চোখে কালো চশমা, গাঁয়ের ছেলেদের থেকে একদম আলাদা। টিভির সিরিয়ালের হিরোদের মতো। ছেলেটা স্কুল থেকে ফেরার রাস্তায় মোটর সাইকেলে হেলান দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। আড়চোখে দেখে ও ভীষণ খুশী হয়েছিল। ভাবতে ভাবতেই ফিক হেসে গামছায় নিজের মুখ মুছতে শুরু করে। ভাবে ছেলেটার নাম কি? কাল স্কুলে খবর নিতে হবে। ওদিক থেকে গোপালির আওয়াজ আসে কি রে হোল?
বেলা পড়ে আসছে পুকুর পাড়ের তাল গাছের ছাওয়াটা ধান খেতের অনেক দুর পর্যন্ত চলে গেছে। সজনে গাছে বসে ঘুঘুটা একটানা ঘুউউউ ঘুউউউ করে ডাকছে।
ছেলেটা তখন ওদের পাকা বাড়ির দোতলায় তার ঘরে নতুন দামি মোবাইলে ওর বন্ধুকে ফোনে জিজ্ঞাসা করছে - মেয়েটা কে রে?
ওর মা নীচে থেকে চেঁচায় - বাবা মিহির খাবি আয়। বেলা হোল।
সে কথা বলে চলে বন্ধুর সঙ্গে।
৫
খবরটা যখন ধনঞ্জয় জানে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ও মাঠ থেকে ফিরছিল রাস্তায় কানুর সাথে ওর দেখা। ওকে দেখে কানু বলল- কিরে, ব্যাপারটা কি বটে? তোর বিটিকে তো বড়লোকের এর ব্যাটার ভটভটির পিছনে বড়শালঘাটির জঙ্গলের রাস্তায় ঘুরতে দেখলাম।
ধনঞ্জয় প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না, কানু মদ খেয়ে উল্টো পাল্টা বলছে না তো? ওর অন্য কোন মতলব নেই তো? সে ধমকের সুরে চেঁচিয়ে বলে– বাজে বকছিস ক্যানে?
কানু সরল ভাবে বলে- নারে সত্যি বলছি আমি বান্দোয়ান যাবার সময় দেখলাম একটা বড় লোকের ব্যাটার সাথে লতিকা ভটভটিতে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। আমি তো ছ্যালেটারে চিনি নাই। আমার সাথে সিমলাপানির গদাই ছিল ও বললে ওটা রতন সিং এর ব্যাটা মিহির।
তারপর খুব হতাশ গলায় বলে- শুনলাম ঠিকাদার বাপের মতো ছেলেটাও নাকি সুবিধের নয় রে। সে কানুকে অনেক বছর চেনে ও বোঝে কানু মিথ্যা বলছে না। এক অজানা ভয়ে ধনঞ্জয়ের হাত পা কাঁপতে থাকে। আর একটু হলে সে পড়ে যেত কানু ওকে ধরে ফেলে বলে- কি হোল রে ধনঞ্জয়, এমন করছিস ক্যানে? চ বাড়ি।
ধনঞ্জয় কোন রকমে কানুকে ধরে এসে বাড়ির দাওয়ায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। ধনঞ্জয়ের সাথে এত বছরে একবারও গোপালির ঝগড়া হয় নি। আজ প্রথম সে তাকে চিৎকার করে বলে- ঘরে বসে করিস কি একটা বিটি ছেলে তাও সামলাতে পারিস না? বলতে বলতে সে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। ঘটনার আকস্মিকতায় গোপালি অবাক, নিজেকে সামলে জিজ্ঞাসা করে- কি হয়েছে?
ততক্ষণে দু হাতে মুখ ঢেকে ধনঞ্জয় কানুর কথাগুলো তাকে বলে। শুনে গোপালি স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে। সেও কিছুদিন ধরে দেখছিল লতিকার চাল চলন বদলে যাচ্ছে। ইস্কুল থেকে এখন রোজ দেরি করে ফেরে বলে টিউশন ছিল। ওর ভয় হচ্ছিল উটতি বয়েসের মেয়ে তার মতো কারো সঙ্গে জড়িয়ে গেলে কি হবে? তা বলে রতনের ছেলে! তার বুকের ভিতর ভয়, রাগ, বিদ্বেষ সব কিছুর মিলে মিশে ঝড় বইতে থাকে। গোপালি আর ধনঞ্জয় থম মেরে মুখোমুখি বসে রইল।
সেদিন লতিকা ফিরেছিল অনেক দেরি করে, দুজনে ওকে চেপে ধরতেই সে মিহিরকেই বিয়ে করবে বলে জেদ ধরে। ওরা কেঁদে, ভালবেসে ভয় দেখিয়ে মেয়েকে কত বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু মেয়ের এক গোঁ। গোপালির ভিতর একটা চাপা কষ্ট গুমরে ওঠে, আর কেউ নয় রতনের ছেলে, কি হবে এখন? ধনঞ্জয়ের বুকটা হু হু করে ওঠে। লতিকাকে ওরা ঘরে বন্ধ করে রাখল, বাড়ীতে সবার নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠেছে।
তৃতীয়দিন সাঁঝের সময় বাড়ির সামনে পাড়া কাঁপিয়ে তিনটে মোটর সাইকেল ধনঞ্জয়ের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। মিহিরের সঙ্গে সেই তিনটে মস্তান ছেলে, দুর থেকে দেখেই ধনঞ্জয় তাদের চিনতে পারে। তাদের সাথে মিহির ধনঞ্জয়ের বাড়ি ঢুকে জোড় গলায় হাঁক দিল – লতিকাআ-
ধনঞ্জয়ের মাথায় রাগ চড়ে গেছে দৌড়ে তার সামনে এসে বলল- কি হয়েছে? লতিকাকে কি দরকার?
মিহির একই রকম বেপরোয়া গলায় উত্তর দিল- ওকে বিয়ে করব, তোমরা রাজি হলে ভালো, না হলে ওকে তুলে নিয়ে যাবো ।
ধনঞ্জয় রেগে মিহিরেকে মারতে এগোতেই, হঠাৎই পকেট থেকে একটা দিশি পিস্তল বার করে মিহির ধরল ধনঞ্জয়ের বুকে, হিসহিস করে বলে- জোর করে কোন লাভ নাই। বিয়ে আমি লতিকাকে করবোই, তোমরা বিয়ে না দিলে অরে তুলে নিয়ে যাব। কে আটকায় দেখি?
ঘটনার আকস্মিকতায় ধনঞ্জয়, গোপালি আর লতিকা হতবাক। ধনঞ্জয় বিশ্বাস করতে পারছিল না, পিস্তল দেখে শরীর মাথা কেমন পঙ্গু হয়ে গেল।
ঘটনা দ্রুত এগোতে থাকে। খবর পেয়ে পরের দিন মা দুর্গা ক্রাশার কোম্পানির মালিক রতন সিং সেই বড় কালো গাড়ি নিয়ে এসে হাজির ওদের বাড়ি। হাসি হাসি মুখে ছেলের বেয়াদপির কথা ভুলে যেতে বলে, বিয়ের কথা পাড়ে, এমন ভাব যেন গোপালিকে প্রথম দেখছে। আদর করে ওদেরকে সিমলাপানির বাড়ি নিয়ে যায়, খুব খাওয়া দাওয়া হয়। গোপালিও রতনের দোতলা পাকা বাড়ি, গাড়ি, বড় টিভি দেখে খুব খুশী লতিকার মতই, তার মনে হয় যাই হোক, বান্ধাডিহতে কার বিটির এমন বড়লোকের ঘরে বিয়ে হইছে!
কেবল ধনঞ্জয়ের মুখে কোন কথা নেই, তার বুকের ভিতর তখন হাজার মাজরা পোকা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সে দেখে পোকা গুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে চারি দিকে।