সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
বাংলা লোকসংগীতের অন্যতম প্রাচীন চর্চাকেন্দ্র ভ্রমরা এবছর তার ৬০ বছরে পদার্পণ করেছে। কলকাতা শহরে এই ধরনের এত প্রাচীন লোকসংগীত চর্চার প্রতিষ্ঠান সম্ভবত আর নেই। নাগরিক মানুষের কাছে বাংলার নিজস্ব শিকড়ের সংস্কৃতি পৌঁছে দেওয়া, তাদের লোকসংগীত ও লোকশিল্পে আগ্রহী করে তোলা মোটেও সহজ কাজ নয়। তথাপি এই কঠিন কাজটিই ধৈর্য ও নিষ্ঠার সাথে ভ্রমরা এত বছর ধরে করে এসেছে। গড়ে তুলেছে ভ্রমরার এক বৃহৎ পরিবার ও গোষ্ঠী, যারা নিয়মিত লোক সংগীত চর্চায় নিজেদের জড়িয়ে রেখেছে। এদের কেউ কেউ তিন পুরুষ যাবদ এই সংস্থার সাথে যুক্ত, এরা কেউ কেউ কণ্ঠ শিল্পী; কেউবা পরম্পরাগত লোক যন্ত্রের (যেমন সারিন্দা, দোতারা, বাংলা ঢোল, বাঁশি ইত্যাদি) বাদক। বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা লোকগান, তার সুর এবং লোকসংস্কৃতির ধারক বাহকের কাজ করে চলেছে ভ্রমরা ও তার পরিবারের সদস্যরা। এরই ফলশ্রুতি ১৯৯৩ সালের প্রকল্প ‘শিকড়ের সন্ধানে’ অডিও ক্যাসেটের সিরিজ যাতে ধরা আছে বাংলার প্রান্তপ্রান্তরের লোকসংগীত শিল্পী গান এবং বাজনা, রয়েছে প্রায় হারিয়ে যাওয়া গানের সম্ভার।
ভ্রমরার এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং লোকসংগীতের আরও প্রসারের লক্ষ্যে বর্ষব্যপী হীরকজয়ন্তী বর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানের সূচনা হয় উত্তরবঙ্গের মালদহ জেলার মানিকচক ব্লকের ধরমপুর গ্রামে। এই গ্রামে এবছরের (২০২২) ২৫, ২৬ ও ২৭ মার্চ ভ্রমরা তার অনুষ্ঠান কর্মসূচী সফলতার সাথে সম্পন্ন করে। এযাবৎকাল ভ্রমরার কর্মসূচী ছিল মূলত কলকাতা শহর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাকেন্দ্রিক। যদিও গ্রামীণ শিল্পীরা ভ্রমরার অনুষ্ঠানে বহুবছর ধরেই অংশগ্রহণ করছেন। গ্রামবাংলার লোকশিল্পের সাথে যুক্ত গুণীজনের সমাবেশ ঘটত ভ্রমরার লোক উৎসবে। কিন্তু হীরকজয়ন্তী বর্ষ উদযাপনের উদ্দেশ্য ছিল কিছুটা ভিন্ন। এটি স্থির করা হয় যে ভ্রমরা শহরকেন্দ্রিক চর্চা থেকে বেরিয়ে এসে গ্রামগ্রামান্তরের মানুষ এবং লোক শিল্পীদের কাছে পৌঁছাবে। তাদের নিজেদের ভূমিতে গিয়ে তাদের শিল্পী ও শিল্পীদের সাথে একাত্ম হবে। কাজটি আদপেও সহজ ও মসৃণ ছিল না। তথাপি এই উদ্যোগের ঝুঁকি নেওয়া হয় এবং প্রাথমিক বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে এধরনের অভূতপূর্ব কর্মসূচীকে সফলতার সাথে বাস্তবায়িত করতে সমর্থ হয়। ধরমপুর গ্রামের ঝা পরিবারের এবং স্থানীয় গ্রামবাসীদের অকুণ্ঠ সহযোগিতায় মহা ধুমধাম করেই এই অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হয়; মূলত গ্রামবাংলার গ্রামগ্রামান্তরের ছড়িয়ে থাকা মণিমুক্তের মত গুণী অথবা ভীষণই অখ্যাত লোকশিল্পী ও লোকশিল্প দলের যোগদান এবং প্রদর্শন ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য, এছাড়া দোতারা, ঢোল, সারিন্দা, বাঁশীর মত পরম্পরাগত বাংলার নিজস্ব লোকবাদ্য যন্ত্রের প্রতি আরও উৎসাহবৃদ্ধি করাও ছিল অপর একটি উদ্দেশ্য।
২৫শে মার্চ সকাল ১১টায়, মঞ্চসংলগ্ন মাঠে (যেটি আসলে একটি আমবাগান) দোতারা কর্মশালা শুরু হয়। পরিচালনা করেন ভ্রমরার সদস্য এবং বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী শ্রী তীর্থদেব ভট্টাচার্য। পরপর তিনদিন (২৫, ২৬, ২৭ মার্চ) বেলা ১১টা থেকে ৩টে পর্যন্ত এই কর্মশালা চলে। প্রায় ১৫জন উৎসাহী ব্যক্তি এই কর্মশালায় যোগদান করেন। যাদের মধ্যে কলকাতা থেকে আগত অংশগ্রহণকারীরাও ছিল যাদের কেউ কেউ শিক্ষাজগতের সাথে যুক্ত।
এই দিন বিকেল ৫টার অনুষ্ঠানের খোলামঞ্চে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন পর্বের মধ্য দিয়ে তিনদিনের কর্মসূচীর সূচনা হয়। ভ্রমরার সম্পাদক দলের প্রশিক্ষকে প্রবীন লোকসংগীত শিল্পী শ্রী শিবব্রত কর্মকারের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠান সুমম্পন্ন হয়। ধামসা বাজিয়ে (শঙ্খ ও উলুধ্বনি সহযোগে) অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করেন বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী ও স্থানীয় প্রবীন গ্রামবাসী শ্রী বাসুদেব মণ্ডল মহাশয়। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ এবং স্থানীয় মানিকচক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শ্রী জ্যোতিভূষণ পাঠক মহাশয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর স্থানীয় কাহালা সম্প্রদায় সমেবেত বাদ্যযন্ত্রসংগীত পরিবেশন করে। এই কাহালা সম্প্রদায় প্রধানত লোহার কারিগর অর্থাৎ কর্মকার সম্প্রদায়। কাহালা সম্প্রদায় কোথাও লোহার সম্প্রদায় নামেও পরিচিত। বাংলা সানাই, ঢোল, কুড়কুড়ি সহযোগে সমবেত ‘চেরাপেটা’র ঐকতান বাদন উপস্থাপন করেন তাঁরা। উত্তরবঙ্গের যেকোন শুভ অনুষ্ঠানে বিশেষত বিবাহ অনুষ্ঠানে পরম্পরাগত ‘চেরাপেটার’ ঐকতানবাদন খুবই পরিচিত এক দৃশ্য। এই দিনের সর্বশেষ অনুষ্ঠান ছিল ‘বিষহরী’ পালা। ‘মনসা’ সমগ্র বঙ্গ দেশে (অবিভক্ত বঙ্গভূমি) বহু যুগ ধরে আরাধ্য দেবী। সাপের পুজো তথা মনসাদেবীর আরাধনার প্রচলন হওয়া থেকে আজ অবধি নানাভাবে, ভঙ্গিমায় ও আঙ্গিকে দেবীর আরাধনা করা হয়েছে। মনসাদেবী এবং বেহুলা লখিন্দরের কাহিনী থেকে সৃষ্টি হওয়া মনসামঙ্গল কাব্য বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়, তৈরি হয়েছে লোক শিল্পের নানা ধারা বা আঙ্গিক। উত্তরবঙ্গে মনসামঙ্গলের বিশেষ এক আঙ্গিক হল ‘বিষহরী’ পালা। দক্ষিণ বঙ্গে কোথাও জাগগান কোথাও বা জাতগান, তেমন রাঢ়বঙ্গে ঝাপান ও বিষহরার গান আবার পূর্ববঙ্গে রয়ানি নামে পরিচিত। এই সবকটি পালারই মূল বিষয় দেবীমনসা ও সাপ। কোথাও কেবলমাত্র গানের মাধ্যমে আবার কোথাও দলগতভাবে অভিনয়, গান ও কথকথার মাধ্যমে মনসা কাহিনী বর্ণনা করা হয়। কোথাও এককভাবে চামর হাতে কথক তার গানের মাধ্যমে ঐ পালা বর্ণনা করেন এবং সাথে দোহার ও যন্ত্রীরা তাকে সঙ্গত করেন। স্থানীয় ছোট ধরমপুর গ্রামের নবজাগরণ মনসামঙ্গল নাট্যসংস্থা পরিবেশন করে মনসামঙ্গলের ‘বিষহরী’ পালা। পরিচালনা করেন শ্রী বাসুদেব মণ্ডল যিনি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধক ছিলেন। রূপসজ্জার মাধ্যমে চরিত্র নির্মাণ করে, গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে ‘বিষহরী’ পালার প্রথম অংশ ঐ দিন পরিবেশন করা হয়।
পরেরদিন ২৬ মার্চ বিকেল ৫টায় অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে বাংলার প্রসিদ্ধ একান্ত নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র ঢাকের একক অনুষ্ঠান প্রদর্শন করেন মুর্শিদাবাদের ডোমকলের বিশিষ্ট লোকযন্ত্র বাদক শ্রী খোকন দাস। এরপর পরিবেশিত হয় সারিন্দা এবং ঢোলের যুগলবন্দী। সারিন্দা পরিবেশন করেন উত্তর ২৪ পরগণার হাবড়ার বিশিষ্ট যন্ত্রশিল্পী শ্রী গোবিন্দ দে। ঢোলে সঙ্গত করেন খোকন দাস ও সুবীর বিশ্বাস। বাংলার যাত্রাপালা কিংবা পালাগানের ক্ষেত্রে যে বাদ্যযন্ত্র অঙ্গ তার নাম হল ক্ল্যারিওনেট বা স্থানীয় ভাষায় কালোবাঁশি। এই কালোবাঁশি ও ট্রামপেটের সমবেত যুগলবন্দী উপস্থাপন করেন স্থানীয় লোকসংগীত শিল্পী সুভাষ রুইদাস ও সম্প্রদায়।
এরপর শুরু হয় পরপর তিনটে প্রযোজনা। প্রথমে স্থানীয় লৌকিক সৃজনী পরিবেশনা করে ডোমনী। ডোমনী মালদহ জেলার স্থানীয় সংস্কৃতির অভিন্ন অংশ। বিহার থেকে বহুকাল আগে প্রব্রজন হয়ে আসা মানুষেরা মালদহ জেলায় এক উপনিবেশ গড়ে তোলেন। তাদের সাথে বয়ে আসা ভোজপুরী আর স্থানীয় বাংলাভাষার মিশ্রণে তৈরি হয় এক বিশেষ মিশ্রভাষা, যার স্থানীয় নাম ‘খোট্টা’ ভাষা। বহুগান ও পদরচিত হয়েছে এই খোট্টাভাষায়। এই পালায় পুরুষেরা মহিলা সেজে নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। এদের বলা হয় ছুকড়ি। এজন্য কখনও কখনও এদের লম্বা চুলও রাখতে হয়। পরবর্তী পালা ছিল নাটুয়া, স্থানীয় মথুরাপুর গোয়ালপাড়া নাটুয়াগান সংস্কৃতিমঞ্চ পরিবেশন করে নাটুয়া। এই নাটুয়া পালাও খোট্টাভাষাতেই হয়ে থাকে। ডোমনী ও নাটুয়া উভয়পালাতেই রূপসজ্জা করে চরিত্র নির্মাণের মাধ্যমে অভিনয় ও গানের মধ্য দিয়ে কাহিনীকে দৃশ্যায়িত করে বর্ণনা করা হয়। ডোমনীর বিষয়বস্তু প্রধান পারিবারিক বা দাম্পত্যকেন্দ্রিক। নাটুয়ার ক্ষেত্রে সমসাময়িক বিষয় বা ঘটনা প্রাধান্য পায়। নাটুয়াতে অবশ্য ছুকড়ি থাকে না। ঐ দিনের শেষ পালা ছিল ঝাড়নী। স্থানীয় রসুলপুর মারসিয়া গানের দল ঝাড়নী পরিবেশন করে। কারবালার প্রান্তরের সেই দুঃখজনক ঘটনার শোকাহত বর্ণনা এই ঝাড়নী গান। এই বিশেষ শোকের ঘটনার বর্ণনার নানা ভঙ্গি সারা বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলন আছে। বঙ্গ দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের জারি গান ও জারিসুর খুবই পরিচিত একটি আঙ্গিক। মহরম মূলত সুন্নি সম্প্রদায়ের পার্বণ। এই পার্বণেরই এক লোকশৈল্পিক প্রকাশ ঝাড়নী পালায়, মুর্শিদাবাদে ঐ ধরনের পালাকে ঝাণ্ডিগান বলে। বাঁশ থেকে তৈরি এক ধরনের ঝাড়ু হাতে, তার থেকে সৃষ্টি শব্দ প্রক্ষেপণ ও তালের মধ্য দিয়ে এই গান গাওয়া হয়। আঙ্গিকের দিক দিয়ে গুজরাটের গরবার সাথে এই নাচের মিল পাওয়া যায়। পোষাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে স্থান বিশেষে পার্থক্য লক্ষণীয়। ঐ দিন অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে লোকসংগীত পরিবেশন করে ভ্রমরা।
শেষ দিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ সকাল ৭টায় সর্বস্তরের সমবেত শিল্পী সহযোগে ধরমপুর গ্রাম পরিক্রমণ করা হয়। ঐ দিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান কিছু আগেই শুরু হয়। বিকেল ৪টার সময় তিন দিনের দোতারা কর্মশালা শেষে শিক্ষার্থীরা মঞ্চে প্রদর্শন করেন দোতারার সমবেত বৃন্দবাদন। এরপরে প্রথমে অনুষ্ঠান মঞ্চে প্রথমদিনের মনসামঙ্গল বিষহরী পালার দ্বিতীয়ভাগ ‘জীয়নপর্ব’ অর্থাৎ লখীন্দরের জীবন ফিরে পাওয়ার গল্প পরিবেশন করে নবজাগরণ নাট্য সংস্থা। এরপর বাউলসংগীত পরিবেশন করেন বীরভূমের জয়দেবের বিশিষ্ট শিল্পী লক্ষণদাস বাউল এবং বাঁকুড়ার ধনঞ্জয় ধীবর। এরপর ঝাপান গান অর্থাৎ সাপধরার গান পরিবেশন করেন বীরভূমের বিশিষ্ট লোকশিল্পী সৃষ্টিধর বাদ্যকর এবং নারায়নবাদ্যকর ও সম্প্রদায়। ঝাপান গানে কণ্ঠ শিল্পীর হাতে থাকে ‘িবষম ঢাক’, যা এই গানের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখানে অবশ্য কোন অভিনয় নেই কেবলমাত্র গানের মাধ্যমেই ঘটনা বর্ণিত হয়। সাথে থাকে ঢোল আর কাঁসি। অনেক সময় প্রতীক হিসেবে থাকে ‘মনসা কাঁটা গাছ’। এরপর গম্ভীরা পালা পরিবেশন করে স্থানীয় কুতুবপুর গম্ভীরার দল। গম্ভীরা মালদহের লোকসংস্কৃতির একান্ত নিজস্ব ধারা। গমীরা কথার অর্থ শিব। চৈত্র সংক্রান্তির দিন সমগ্র মালদহ জুড়ে গৃহস্থ বাড়ির উঠোনে এই শিব স্থাপন করা হয়। যেখানে একে স্থাপন করা হয় তাকে গমীরার স্থান বলে। এই দিন থেকে এক বছরের জন্য গম্ভীরা পালা অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। সূচনা পর্বে অর্থাৎ শিব (গমীরা) প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে দুদিন ধরে (ঢাক ও কাঁসি বাজিয়ে) মুখোশ নৃত্য হয়। প্রথম দিন (৩০ চৈত্র) ছোট তামাশা এবং পরের দিন (৩১ চৈত্র) বড় তামাশা হয়। এক সময় মাটির মুখোশ প্রচলন ছিল। এখন মুখোশের প্রচলনটাই নেই, মুখোশ নির্মাণে ও নৃত্য পরিবেশনে মালদহের দুজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিরা হলেন প্রয়াত রামপণ্ডিত এবং প্রয়াত বিশ্বনাথ পণ্ডিত। এখানে পণ্ডিত অর্থে মৃৎশিল্পী বর্তমানে এই প্রথা হারিয়ে যেতে বসেছে। গম্ভীরা এসেছে এই গমীরা থেকেই। এর প্রধান চরিত্র শিব, থাকে জনপ্রতিনিধির প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা হয় এবং তার কাছে সম্বৎসরের সুবিচারের আশায় অভাব অভিযোগ পেশ করা হয়, গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে। গম্ভীরার উৎপত্তি অবিভক্ত বঙ্গের নবাবগঞ্জে। তবে সেখানে এখন শিবের পরিবর্তে নানা ও নাতি— এই দুই চরিত্রের সৃষ্টি করা হয়েছে, এখানেও রূপসজ্জার মধ্য দিয়ে চরিত্র নির্মাণ ও অভিনয়ের মাধ্যমে কাহিনী বর্ণনা করা হয়। গম্ভীরা গান একেবারেই সমসাময়িক বিষয় নিয়ে রচিত হয়। প্রায়শই এর বিষয় এবং বক্তব্যের প্রেক্ষাপট হয় রাজনৈতিক। সমাজের প্রান্তিক মানুষের সামাজিক অবস্থান ও অভাব অভিযোগ দূর্দশার কাহিনীর বর্ণনা থাকে গম্ভীরা পালায়। গম্ভীরার চারটি পর্যায়— বন্দনা, চারইয়ারি, ডুয়েট ও রিপোর্ট।
উত্তরবঙ্গের বিয়ের মত নানা শুভ অনুষ্ঠানে গম্ভীরা ও মনসা গানের দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কখন একমাস বা পনেরো দিন বা সাতদিন, কখনও বা এক দুদিন ধরে এই পালাগান বলে। বিবাহ অনুষ্ঠানে মনসার গানই অধিক প্রাধান্য পায়। এখানে প্রদর্শিত সমস্ত পালাগানেই এটা লক্ষণীয় যে যেসকল লোক শিল্পী এই পালাগানে অংশগ্রহণ করেন তারা সকলেই সমাজের প্রান্তিক অংশের কৃষির কাজে নিযুক্ত শ্রমজীবি মানুষ। এদের প্রায় সকলেই ভূমিহীন কৃষক। এরাই এই সর পালাগানের ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন। এরা আবার একই সাথে একাধিক পালায় অংশগ্রহণ করেন। যেমন একজন বিষহরীদলের সদস্য গম্ভীরা দলেরও শিল্পী। বিয়ের অনুষ্ঠানে মনসা গানের আমন্ত্রণ অধিক থাকায় অন্যান্য পালা বিশেষ করে গম্ভীরার প্রদর্শন অনেক কমে এসেছে। বস্তুত গম্ভীরাপালা এখন কিছুটা অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে। উত্তরবঙ্গে ব্রতগানের যথেষ্ট প্রচলন ছিল যা এখন প্রায় অবলুপ্তির পথে। এই পর্যায়ে ব্রতগানের অনুষ্ঠান রাখা সম্ভবপর হয়নি। পরবর্তী পর্যায়ের অনুষ্ঠানে একে রাখা হবে।
ঐ দিন সবশেষে সমবেতভাবে লোক সংগীত পরিবেশন করে ভ্রমরা, এভাবেই ২৭শে মার্চ রাত ১২টায় ৬০ বছর উদযাপনের প্রথম পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে। সামনে এগিয়ে চলার অঙ্গীকার নিয়ে, নতুন যাত্রাপথের অনুসন্ধানের লক্ষ্য নিয়ে এই পর্বের সমাপ্তি ঘটে।
#Reisist Deucha Pachami Coal Mine Projet
উন্নয়ন তথা বিকাশের অর্থ যদি হয় পরিবেশ দূষণ এবং হাজার হাজার মানুষের উচ্ছেদ, তাহলে প্রথম যে প্রশ্ন আসে তা হল, এই উন্নয়ন কার স্বার্থে? বীরভূম জেলার দেওচা-পাচামিতে আদিবাসী ও মূলবাসীদের জমি দখল করে রাজ্য সরকার কয়লা তুলতে চাইছে, বৃহৎ শিল্পের স্বপ্ন ফেরি করা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী দিচ্ছেন লক্ষ লক্ষ চাকরির প্রতিশ্রুতি। আদতে তা স্থানীয় মানুষের কোন্ উপকারে লাগবে? সারা বিশ্ব যখন জীবাশ্ম জ্বালানীর বিরুদ্ধে পথে নেমেছে, তখন নতুন করে ‘মৃত্যুদূত’-কে আবাহন করা, কার স্বার্থে? দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, সরকার জনগণের জীবনের মানোন্নয়নের নাম করে যে সমস্ত প্রকল্প গ্রহণ করে, সেখানে জনগণ পায় শুধুমাত্র বাইরের খোসা। এই উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর আসল শাঁস খেয়ে পুষ্ট হয় বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠী। দেওচা-পাচামিও ব্যতিক্রম নয়। আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি, বীরভূমের মুহম্মদবাজার ব্লকের ১১.২২২ একর এলাকা জুড়ে এই কয়লা ব্লক। যার পরিমাণ বলা হচ্ছে ২.২ বিলিয়ন টন। প্রথমে ইস্টার্ন কোলফিল্ডকে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু তারা কোন উদ্যোগ নেয় না। ২০১৪ সালে কেন্দ্র সরকার পশ্চিমবঙ্গ সহ ছয়টি রাজ্যকে এটি নেবার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। মূলত তা লাভজনক নয় বলেই। অবশেষে ২০১৮ তে কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে এই খনি দেয়।
ইতিমধ্যেই বীরভূমের এই অঞ্চল পাথর খাদানের দূষণে দূষিত। পাথর খাদান তাঁদের জীবনে কোন আর্থিক উন্নতি ঘটায়নি। উপরন্তু ক্ষতি করেছে তাঁদের চাষবাস, তাঁদের সমাজ ও সংস্কৃতির। খনিজ ছাড় সুবিধা আইন, ১৯৬০ এবং খনিজ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন আইন ১৯৮৮-র ২০০৩ সালের সংশোধনী অনুসারে খাদান বুজিয়ে ফেলা সংক্রান্ত বিধি এখনও অবধি দেওচা-পাচামিতে মানা হয়নি। খনন-উত্তর জমি, জলের মান উন্নয়ন, বায়ুর মান উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মৃত্তিকার উপরিভাগ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সংক্রান্ত নির্দেশিকা পালন করা হয়নি। এখানে অতি গভীর খাদান ও অন্যদিকে বর্জ্য ও ধুলোর পাহাড়গুলো পড়ে আছে বহুদিন। সেখানকার রাস্তা মানেই চার পাঁচ ইঞ্চি পুরু ধুলোর চাদর, যা মানুষের শরীর ও প্রকৃতির ক্ষতি করে আসছে কয়েক দশক ধরে। চারদিকে সবুজহীন ধূসর প্রান্তর, এই সবুজহীনতা আর ধুলোও কিন্তু আদিবাসী সংস্কৃতি বা গ্রামীণ সংস্কৃতির পরিচ্ছন্নতার পরিপন্থী, যা এঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ‘এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ব্লক’ থেকে কয়লা উত্তোলনের আস্ফালন।
একটু তথ্য ও ইতিহাসে চোখ রাখা যাক!
আমরা জানি, জলবায়ুর বর্তমান আপৎকালীন অবস্থার প্রধান কারণ জীবাশ্ম জ্বালানী, যা বিশ্ব উষ্ণায়নের অন্যতম হেতু। সেই শিল্পবিপ্লবের কাল থেকে কার্বন নিঃসরণের ৮০ শতাংশ উৎস হল কয়লা, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস। কয়লা উত্তোলন সম্পর্কিত যাবতীয় কাজ খনন, ধৌতিকরণ থেকে পরিবহণ, শিল্পে ব্যবহার অর্থাৎ কয়লার দহন ক্রিয়া--- এসবই বায়ুমণ্ডলে বাড়ায় কার্বন-দূষণের মাত্রা, বাতাসে মেশায় বিষাক্ত গ্যাস। খোলামুখ বা মাটির নিচে খনন, সমস্ত ধরনের কয়লা খনিই দূষণের আধার। খোলামুখ কয়লা খনিতে লক্ষ লক্ষ বছরে সৃষ্টি হওয়া মাটির স্তর (টপ সয়েল) চিরতরে হারিয়ে বর্জ্য পাহাড়ে পরিণত হয়। শুধু ধ্বস নয়, এর ফলে স্থলজ ও জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হয় ব্যাপক। বর্ষার সময়ে সেই মাটির স্তূপ ধুয়ে গিয়ে ভরাট হয় ওই অঞ্চলের নদনদীর তলদেশ, ডেকে আনে অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা। এ-বছর বর্ধমানে বন্যা-পরিস্থিতির অন্যতম কারণ আসানসোল অঞ্চলের খোলামুখ খনির পাশে জড়ো করা মাটির স্তূপ। ওই মাটির স্তূপ থেকে ভূগর্ভস্থ জল প্রবাহের ব্যাঘাত ঘটিয়ে শুধু ওই এলাকার নয়, এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিজ-বনজ উৎপাদন ও নদী-পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করবে।
সরকারি ভাষ্যে বলা হচ্ছে
'দেওচা-পাচামিতে কয়লাখনি থেকে পাওয়া কয়লার জন্য কমবে রাজ্যে বিদ্যুতের দাম',
'দেওচা-পাচামিতে কয়লা উত্তোলন শুরু হলে গড়ে উঠবে বহু শিল্প, যা রাজ্যে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি করবে,
'দেওচা-পাচামির অধিবাসী মানুষ যারা বাস্তুচ্যুত হবে তাদের জন্য ঘোষিত হয়েছে সেরা প্যাকেজ',
'রাজ্যে বিদ্যুতের যোগান না থাকলে উন্নয়নটা হবে কী করে?'
'খনির ফলে জঙ্গল হয়তো নিশ্চিহ্ন হবে, কিন্তু সরকার প্রচুর গাছ লাগিয়ে সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেবে'।
এবার এই বক্তব্যগুলো যুক্তি দিয়ে একটু খতিয়ে দেখা যাক :
১. দেওচা-পাচামিতে কয়লার স্তর রয়েছে ব্যাসল্ট পাথরের স্তরের অনেক নিচে। এই পুরু পাথরের স্তর কেটে এবং তা তুলে ফেলে তার নিচে থেকে কয়লা উত্তোলন বিপুল খরচ-সাপেক্ষ। এর ফলে এখানে উত্তোলন করা কয়লা দিয়ে তৈরি বিদ্যুতের দাম অনেকটা বাড়তে বাধ্য। সেই বাড়তি দামের চাপ নিতে হবে বিদ্যুৎ গ্রাহককেই। বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের নিজস্ব চালু খনিগুলিতে আগামী তিরিশ বছরের জন্য পর্যাপ্ত কয়লা আছে। সেগুলি থেকে কয়লা তোলার খরচ অনেক কম। এই মুহূর্তে রাজ্যের বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম সেই কয়লা ব্যবহার করে এ রাজ্যের এনটিপিসি বা ডিভিসির বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির থেকেও কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বিসিসিএল বা ইসিএল-এর কাছ থেকে যে কয়লা কেনা হয় তার দামও দেওচার থেকে অনেক সস্তা হবে।
২. কয়লা উত্তোলন কোনো শিল্প নয়। আর দেওচা-পাচামিতে কয়লা উত্তোলনের বরাত মূলত পাবে বেসরকারি সংস্থা। সেই সংস্থা স্থানীয় বাসিন্দাদের এই কাজে নিয়োগ করবে না। কারণ, এই ধরনের কয়লা উত্তোলন মূলত পরিশ্রমসাধ্য কায়িকশ্রমের ওপর নির্ভরশীল যেমন, তেমনি পূর্ব অভিজ্ঞতার ওপরেও নির্ভরশীল। ওই অঞ্চলের মানুষের সেই অভিজ্ঞতা কতটুকু? বরাত পাওয়া সংস্থা নিজেদের পদ্ধতি অনুসারে নিয়োগ করবে কর্মীবাহিনী। ফলে স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা খুবই কম।
৩. এই রাজ্যে বর্তমানে বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই। অনেক ক্ষেত্রে এ রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশেও বিদ্যুতের রপ্তানী করা হচ্ছে। বিদ্যুতের যথেষ্ট যোগান থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে এ-পর্যন্ত ক'টা শিল্পোদ্যোগ গড়ে উঠেছে এ-রাজ্যে? সুতরাং, দেওচা-পাচামিতে কয়লা উত্তোলন শুরু হলেই রাজ্যে কর্মসংস্থানের বান ডাকবে বলে যাঁরা বলছেন, তাঁদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে!
৪. হাজার হাজার বছর ধরে চাষাবাদ এবং জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল ওই অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ, বিশেষত আদিবাসীদের উৎখাত করে যে 'সেরা প্যাকেজ'-এর ঘোষণা হয়েছে। এমন বহু প্যাকেজ অতীতেও প্রতিটি 'উন্নয়ন' প্রকল্পে আদিবাসী-উচ্ছেদের আগে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সব 'উন্নয়ন'-এ কারা লাভবান হয়েছে আর কারা সর্বস্ব হারিয়েছেন তা অতীত ইতিহাস খুঁজলেই পাওয়া যাবে। সর্বত্রই লাভবান হয়েছে কর্পোরেট, রাজনীতির কারবারী আর মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ! ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে সব রকমভাবে বঞ্চিত হয়েছেন ভূমিপুত্র-কন্যারা।
৫. আগেই আমরা বলেছি রাজ্যে পর্যাপ্ত বিদ্যুতের যোগান থাকা সত্ত্বেও শিল্পের বান ডাকেনি! সুতরাং, রাজ্যের উন্নয়ন দেওচা-পাচামির কয়লার ওপর নির্ভর করে আছে এমন নয়! বরং, ফসিল পুড়িয়ে বাতাসে কার্বনের মাত্রা বাড়িয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের অপচয়ের সংস্কৃতিতে রাশ টানা হোক্। আর, পুনর্নবিকরণ যোগ্য অপ্রচলিত উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দেওয়া হোক পুরো মাত্রায়।
৬. প্রচুর গাছ লাগিয়ে পরিবেশের যে ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা এক কথায় হাস্যকর! লক্ষাধিক বছর ধরে গড়ে ওঠা ওই অঞ্চলের বনজ সম্পদ, মৃত্তিকা, বন্যপ্রাণের যে ক্ষতি হবে তা শুধুমাত্র কিছু গাছ লাগিয়ে পূরণ করার কথা যাঁরা ভাবতে পারেন, তাঁদের 'পরিবেশ-জ্ঞান' অবাক করার মতো! প্রস্তাবিত এই কয়লাখনি আগামী বহুবছর ধরে যে পরিমাণ কার্বন উদ্গিরণ করবে, সেই কার্বন বিশ্ব উষ্ণায়নে যে ভূমিকা নেবে তার ক্ষতি কীভাবে পূরণ করবেন?
ভারত সহ কয়লা উৎপাদক দেশগুলির ওপর সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, বিষাক্ত দূষক যা কয়লা থেকে নির্গত হয় তা হল, ভারী ধাতুর মধ্যে কঠিন বর্জ্য হিসাবে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, সীসা, পারদ এবং বায়ুমণ্ডলীয় কণার মধ্যে সালফার ডাইওক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং গ্যাসীয় নির্গমনের মধ্যে ওজোন। পিপলস কালেকটিভ ইন্ডিয়া একটি সমীক্ষা চালায় খোলামুখ কয়লাখনি এলাকায়। ফেব্রুয়ারি, ২০২১-এ সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা চিকিৎসক ও গবেষকদের দল সমীক্ষা করেন কয়লা এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পের ৩ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলার প্রত্যন্ত চারটি গ্রামে। রামগড়েই আছে সেন্ট্রাল কোলফিল্ড এবং টাটা ষ্টীলের খোলামুখ কোলিয়ারি।
তাদের সর্বমোট ২৩৫৩ টি সমীক্ষিত স্বাস্থ্য তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে এখানের মানুষের প্রধান দশটি রোগের কথা। সেগুলি হল, ব্রঙ্কাইটিস (হাঁপানি সহ); সিওপিডি/ কার্ডিওভাসকুলার (নিশ্বাসের সমস্যা); যক্ষা; ত্বক(কালো/সাদা দাগ, চুলকানি, আলসার); চুল (পতন/হ্রাস, বিবর্ণ); চোখ (জল পড়া ও লাল)পা/পায়ের পাতা(ফাটা, আলসার); কোমরে ব্যাথা, বাত এবং পেটের অসুখ। এই এলাকার বায়ু, জল, মাটি আর পলি পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে মারাত্মক দূষণ, বিভিন্ন বিষাক্ত ভারী ধাতু। বায়ু দূষণ (পিএম ২.৫) যা ভারতীয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন নিয়ন্ত্রক নির্দেশিকার সীমা অতিক্রম করেছে। বাতাসে যে পরিমাণ ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল ও সিলিকন পাওয়া গেছে তা স্বাস্থ্য নির্দেশিকার নির্দিষ্ট মাত্রার অতিরিক্ত। মাটিতে যে পরিমাণ ক্রোমিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, আর্সেনিক, ক্যাডিয়াম পাওয়া গেছে, তা পরিবেশ রক্ষায় নির্দেশিত কানাডীয় মৃত্তিকা নির্দেশিকার মাত্রা অতিক্রম করেছে। বিষাক্ত ক্রোমিয়াম ও নিকেল পাওয়া গেছে পলিতে, ফলে জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব সংকটে। অ্যালুমিনিয়াম, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া গেছে জলে, যা ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড নির্দেশিত মাত্রা ছাপিয়ে গেছে।
মানুষের জীবন আর কতটা দুর্বিষহ করলে থামবে রাষ্ট্র? জানতে চাইছেন ওই অঞ্চলের মানুষ। দেওচা-পাচামিতে যেন এক অঘোষিত কার্ফু জারি করা হয়েছে! কিছু 'বিশিষ্টজন' ওই অঞ্চলের মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব পেয়েছেন এই প্রকল্পের 'সুফল'! তাঁদের গতিবিধি ওই অঞ্চলে অবাধ। অথচ সমীক্ষক দল হোক বা অন্যদের প্রবেশ ‘নিষিদ্ধ’! প্রতিবাদীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো এবং নানা রকম প্রলোভন আর হুমকি দেওয়ার খবর আমরা পাচ্ছি। নবান্ন থেকে ঘোষিত প্যাকেজ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, 'শ্রেষ্ঠতম প্যাকেজ'। এর সঙ্গে সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে আমরা দেখলাম সরকারের পক্ষে, 'উন্নয়ন'-এর পক্ষে শাসকের জন্য সেই নিদান, দরকার হলে কড়া হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে! শাসক দলের মোটরসাইকেল মিছিল, নবান্নে শিল্পপতিদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। গ্রামবাসীদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ, প্রতিবাদীদের ওপর 'ইউএপিএ'- ‘রাষ্ট্রদ্রোহ আইন’ চাপানো এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ‘সংঘর্ষ মৃত্যু’-ও হয়তো ওঁত পেতে আছে! এসব সত্ত্বেও ওই অঞ্চলের মানুষ প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। ক্রমশ সংগঠিত হচ্ছে প্রতিবাদ। ইতিমধ্যেই দেওচা-পাচামির প্রস্তাবিত কয়লাখনি রুখে দেওয়ার শপথ নিয়েছেন ওই অঞ্চলের আদিবাসী সমাজের মানুষ। বছর দুয়েক আগে, ২০১৯-এর ১৯ শে ডিসেম্বর দেওচা-পাচামি কয়লা প্রকল্পের উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল রাজ্যের মুখ্যসচিবের উপস্থিতিতে। সেই উদ্বোধন পরিকল্পনা বাতিল হয় হাজার হাজার আদিবাসী সমাজের মানুষের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে। 'কয়লাঞ্চল বাঁচাও মঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গ'-র তথ্যানুসন্ধানী দলকে ওই অঞ্চলের মানুষ জানিয়েছেন, ছত্রিশটি গ্রামের আদিবাসী মানুষের মধ্যে সমন্বয় রেখেই তাঁরা প্রত্যেকে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হচ্ছেন। ইতিমধ্যেই আদিবাসী সমাজ গণ কনভেনশন করে এই ধ্বংসাত্মক কয়লাখনি প্রকল্প রুখে দেওয়ার শপথ নিয়েছেন।
অতীতে নর্মদা-বাঁধ, ডিভিসি বাঁধ এবং অন্যান্য বড় প্রকল্পে উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের পুনর্বাসন দেওয়ার নামে তাঁদের সমন্বিত জীবন ও সংস্কৃতিকে ধংস করে দেওয়া হয়েছে। অথচ তাঁদের স্বর্গ সৃষ্টি করার স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। গ্রামের মানুষেরা ছন্নছাড়া হয়ে গেছেন। শাসকের সমস্ত প্রতিশ্রুতি যে শুধু কথার কথা, তা 'উন্নয়ন'-এর নামে প্রতিটি উচ্ছেদের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়ে গেছে।
আমাদেরও সময় এসেছে প্রতিবাদ করার। দেওচা-পাচামির প্রকল্প শুধু ওই অঞ্চলের মানুষের জন্যই বিপজ্জনক নয়, বিশ্ব উষ্ণায়নের এই সময়ে তা আমার আপনার প্রত্যেকের জন্যই, বিশেষ করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তা প্রবলভাবে বিপজ্জনক! আমাদের সীমাহীন লোভের মাসুল যেন আমাদের সন্তানদের না গুনতে হয়, তার জন্যও আমরা চাই এই আত্মঘাতী প্রকল্প বন্ধ হোক্!
পরিতাপের বিষয় এটাই, যে রাজনৈতিক দল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে বলপূর্বক জমি দখলের লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় এলো, সেই দলই ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আজ আদিবাসী এবং সমাজের নিম্নবর্গের জমি নানা কৌশলে দখল করে তাদের উৎখাত করতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছে!
পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ আন্দোলনকর্মী, নদীকর্মী, অধিকার আন্দোলনকর্মী, সামাজিক আন্দোলনকর্মী, রাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে অবিলম্বে এই প্রকল্প বন্ধ করার দাবী জানাচ্ছি।
পশ্চিমবঙ্গের সরকার ও তার প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবী :
১. দেওচা-পাচামিতে ওই অঞ্চলের কোনো গ্রামবাসীকে কোনোভাবেই উচ্ছেদ করা চলবে না।
২. জীবাশ্ম জ্বালানী আর নয়। আর নয় কার্বন। খোলা মুখ হোক বা বন্ধমুখ পরিবেশ দূষণকারী কয়লাখনি চাইনা। দেওচা-পাচামি প্রকল্প বন্ধ হোক।
৩. মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করো, হুমকি বন্ধ করো।
৪. মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ‘উন্নয়ন’ চাইনা।
৫. বর্তমানে চালু খনিখাদান নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে বন্ধ করার প্রক্রিয়া অবিলম্বে শুরু করতে হবে।
৬. পরিবশ-বান্ধব শক্তির ব্যবহারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। খতিয়ে দেখতে হবে সমস্ত সম্ভাবনা।
৭. প্রাকৃতিক সম্পদ অপচয়ের সংস্কৃতি অবিলম্বে বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হোক্। বিদ্যুতের অকারণ অপচয় বন্ধ হোক্।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পরিবেশ বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হোক্ সর্বস্তরে!
আমরা অঙ্গীকার করছি :
১. পরিবেশ ধ্বংসকারী এবং বিপুল সংখ্যক মূলবাসী ও আদিবাসী মানুষকে উৎখাত করে প্রস্তাবিত দেওচা-পাচামির কয়লাখনির বিরুদ্ধে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে থাকবো।
২ . পরিবেশ ধ্বংসকারী এই 'উন্নয়ন'-এ শুধু পুঁজিপতিদেরই বাড়বাড়ন্ত হয়নি, উচ্চ মধ্যবিত্তেরও হয়েছে। তাই তাঁদের অধিকাংশের দৃষ্টিতে আত্মঘাতী এই উন্নয়নই 'প্রকৃত উন্নয়ন'। তাই তাঁরা প্রক্রিয়ার প্রতিরোধে শামিল হন না।পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে যদি একই ভোগবাদী সমাজ আমরা বজায় রাখি তাহলে প্রকৃতির বিপর্যয়কে ভবিষ্যতে রোখা যাবে না।
আমাদের এই পৃথিবী, তার পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই পরিবেশ-সংবেদী যাপনের সংস্কৃতি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হলাম।
আমরা-এক সচেতন প্রয়াস ও অন্যান্য অনেক গণসংগঠন ও সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মী কর্তৃক প্রচারিত প্রতিবেদন
কৃতজ্ঞতা : দ্য ওয়্যার (The Wire) অনলাইন সংবাদসূত্র
এই ফিল্ড রিপোর্টটি, ১৬ই মে ২০২০ তারিখে “দ্য ওয়্যার” অনলাইন নিউজ পোর্টালে সাংবাদিক হিমাদ্রি ঘোষের কলমে ইংরেজিভাষায় লিখিত এবং প্রকাশিত সংবাদের বাংলা অনুবাদ। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ যে এই অনুবাদটি প্রকাশ করছে তার উদ্দেশ্য দুটি - সত্যের প্রকাশ এবং শান্তিপ্রিয় বাংলাবাসীর সামনে একটা বড়সড় সামাজিক সঙ্কটের কথা সোজাসুজি তুলে ধরা। কী সেই সঙ্কট? ইদানীং আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার লক্ষ্যে বিশেষ এক রাজনৈতিক লুঠেরাবাহিনী তাদের পরিকল্পিত আক্রমণ সাজিয়ে বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভয়ের আবহাওয়া সৃষ্টি করতে চাইছে। বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের লোকেদের তারা টার্গেট করছে, খুন করার চেষ্টা করছে, বাড়ি ভাঙছে, সম্পত্তি লুঠ করছে এবং শেষে আবার এই পুরো চক্রান্তের রং বদলে, ধর্মীয় উস্কানিভরা গুজব ছড়িয়ে, আহত, আক্রান্ত সম্প্রদায়কেই আক্রমণকারী বলে দোষারোপ করছে - আরো বড় আগুন রাজ্যে ছড়ানোর জন্য। এহেন যাবতীয় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক কার্যকলাপ যা সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে, সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে, সন্দেহের বিষে আমাদের সহজ সহাবস্থানকে বিঘ্নিত করে (দাঙ্গার প্ররোচনা দিয়ে আমাদের রুটি-রুজি কেড়ে নেয়) এবং আসলে আমাদের আরো বেশি করে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। এই অনুবাদ তার মিথ্যের মুখোশ খুলে আসল হিংস্র মুখটা প্রকাশ করার সদিচ্ছা। ঘটনাস্থল থেকে, কী ঘটেছে তারই সরাসরি বিবরণ। সেই সাথে এটি একটি সতর্কবার্তা বাংলার সাধারণ মানুষের প্রতি - সচেতন থাকুন, সতর্ক থাকুন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানিদাতা শকুনদের দূর করে সুরক্ষিত থাকুন। পরের অংশে আমরা সোজা চলে আসি ইংরেজি রিপোর্টের অনুবাদে।
ঘটনাস্থল তেলিনিপাড়া। হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বর শহরের লাগোয়া এক ছোট্ট জনপদ। সারা পৃথিবী যখন নোভেল করোনা ভাইরাস নিয়ে নাজেহাল এবং যুদ্ধে ব্যস্ত, কলকাতা থেকে ৪০ কিমি উত্তরে এই মফস্বল শহর তখন লড়াই দেখেছে সাম্প্রদায়িক টানাপোড়েনের। গত ১২ই মে থেকে সেই জনপদ আতঙ্কে কাঁটা হয়ে আছে।
তেলিনিপাড়া, গঙ্গা নদীর পশ্চিম পাড়ে একদা পাট প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের জন্য পরিচিত এক মফস্বল। হুগলী সংসদীয় ক্ষেত্রের অন্তর্গত। গত ১০ মে, রবিবার, বিকেলে এলাকায় প্রথমে কিছু তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি হয় দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে, যা পুলিশি মধ্যস্থতায় শেষমেশ মিটেও যায়। ১১ মে, সোমবার, ছিল নির্ঝঞ্ঝাট। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে গেল ১২ মে, মঙ্গলবার থেকে। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে, হঠাৎ এলাকায় দলে দলে ভিড় বাড়াতে দেখা যায় কিছু লোককে, তাদের মাধ্যমেই শুরু হয়ে যায় সুপরিকল্পিত এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আক্রমণ। একতরফা সেই হামলায় এলাকা নিমেষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরিস্থিতির বিপদ বুঝে জেলাশাসক সেদিনই এলাকায় জারি করেন ১৪৪ ধারা, তড়িঘড়ি ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করা হয় পার্শ্ববর্তী দুই মহকুমা শ্রীরামপুর এবং চন্দননগরের সাথে। এই দুই মহকুমার মাঝবরাবরই ভদ্রেশ্বর এবং তেলিনিপাড়ার অবস্থান।
১৫ই মে বৃহস্পতিবার, ‘দ্য ওয়্যার’ এর সংবাদ প্রতিনিধি সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন আক্রান্ত এলাকা। কলকাতা থেকে গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক (জিটি) রোড বরাবর এগিয়ে এলাকায় পৌঁছোনোর পথেই ভদ্রেশ্বরের বাবুবাজার মোড়ে নজরে পড়ে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত দোকান। এরপরেই ডানদিকে বেঁকে রাস্তা গেছে তেলিনিপাড়ার দিকে। আধপোড়া কয়লা হয়ে যাওয়া দোকানের নামফলকে “সাদ” শব্দটি তখনও স্পষ্ট পড়া যায় (অর্থাৎ কোনো মুসলিম দোকানীর বিপনী এটি)। ভদ্রেশ্বর ফায়ার ব্রিগেডের উল্টোদিকেই নজরে আসে ভাঙচুর করে লণ্ডভণ্ড একটি মাজার (মুসলিম সমাধিসৌধ এবং প্রার্থনাস্থল), রাস্তা থেকেই দিব্যি নজরে আসে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে থাকা ইট, প্লাস্টার, টাইলস আর ছিন্নভিন্ন করে মেঝেতে ছড়িয়ে দেওয়া মুসলিমদের ধর্মীয় পতাকা।
ভদ্রেশ্বরের বাজার পেরোনোর সময় কানে আসে হাওয়ায় ভাসা গুঞ্জন আর আলোচনা। সেসব এই তেলিনিপাড়ার ঘটনা নিয়েই। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতিতে কোনো উত্তেজনা নেই। সেই শান্ত পরিবেশ থমথমে নিষ্প্রাণতায় পাল্টে গেল ডানদিকে বেঁকে দিনেমারডাঙা স্ট্রিট বরাবর তেলিনিপাড়া ঘাটের দিকে এগোতেই। পথ আটকালো পুলিশের ব্যারিকেড। গাড়ি আর যাবে না। এবার পায়ে হেঁটে তাই পৌঁছোনো আক্রান্ত এলাকার অলিগলিতে। রাস্তায় লোকচলাচল প্রায় নেই। যে দু একজন কাজের তাড়নায় বাইরে বেরোতে বাধ্য হয়েছেন, আতঙ্ক আর অসহায়তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে রয়েছে তাঁদের চোখেমুখে।
দেখা গেল, তেলিনিপাড়া ঘাটের ঠিক আগেই, রাস্তার শেষমাথায় স্পেশালাইজড ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ব্যাটেলিয়নের (SIRB) জওয়ানরা পাহারায় রয়েছেন। এক জওয়ান ‘দ্য ওয়্যার’ প্রতিনিধিকে জানান, তাঁরা রয়েছেন সংখ্যায় প্রায় জনা তিরিশ এবং চলছে সারাদিন সারারাত ধরে টহলদারি।
দিনেমারডাঙা রাস্তার মোড় থেকে বাঁদিকে রাস্তা গেছে ইদানীং পরিত্যক্ত গোঁদালপাড়া জুটমিলের দিকে। দু বছর হলো বন্ধ এই চটকল। একটু এগিয়েই বাঁদিকে আবার সরু গলি, ফেরিঘাট স্ট্রিটের দিকে নিয়ে যায় এই পথ। পথ থামে তেলিনিপাড়া ঘাটে এসে। জিটি রোড থেকে টানা দিনেমারডাঙা স্ট্রিটের এই মোড় অবধি পুরোটাই মূলত হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকা। সেখানেই প্রথম পা রাখা।
নাহ্, এখানে আগাগোড়া তেমন কোনো ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের চিহ্ন নেই। দিনেমারডাঙা স্ট্রিটের শুরুতে শুধু দুটো জ্বালিয়ে দেওয়া গাড়ির দেখা মিলেছিল। সরকারি ওয়েবসাইটে তারই একটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর যাচাই করে ‘দ্য ওয়্যার’ জানতে পেরেছে যে, এর মালিকের নাম গুলাম সারওয়ার আনসারি। বাকী গাড়িটা যেভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তার দেহে রেজিস্ট্রেশন নাম্বার প্লেটের কোনো অবশেষ এবং তার মালিকের সনাক্তকরণ করা যায় নি।
তবে এই এলাকায় কিছু লোকজনকে ১২ মে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রসঙ্গে ‘ঠিক কী হয়েছিল’ জিজ্ঞেস করার পরে, সবারই কেমন সিঁটিয়ে থাকা অনীহায় উত্তর এসেছে “আমরা ওসব ব্যাপারে কিছু জানি না”, এমনকী এক স্থানীয় মুদি দোকান সামলানো এক মহিলার গলাতেও সেই তোতাপাখির বুলি। প্রশ্ন করা হয়েছিল - “এই পুড়ে যাওয়া গাড়িগুলোর মালিক কারা জানেন?” উত্তর এসেছে “আমি জানি না”.... “১২ ই মে কখন ঘটেছিলো এই হানাহানি?” সে প্রশ্নেও গৎবাঁধা একই উত্তর দিয়েছেন মহিলা।
সব মিলিয়ে একটা পরিকল্পিত নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে নিশানা করার ছবিই উঠে এসেছে বারবার। দিনেমারডাঙা মোড় থেকে গোঁদালপাড়া মিলের দিকে যেতে যেতে পার হতে হয় মুসলিম বসতি প্রধান এলাকা। এই পথের আশেপাশে একের পর এক চোখে পড়েছে দরজাভাঙা, জানালাভাঙা ঘরবাড়ি, পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া টেলিভিশনের কেবল, তাপে গলে গিয়ে কঙ্কাল বেরিয়ে পড়া বৈদ্যুতিক তারের জটলা, এবং দেখা গেছে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত কিছু ছোটো ছোটো বাড়ি - যাদের ছাদ উড়ে গেছে এবং দেওয়াল ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। আর বাড়িগুলো এভাবেই তছনছ হয়েছে প্রচণ্ড আগুনের আঁচে বিস্ফোরিত গ্যাস সিলিন্ডারের আঘাতে। চোখে পড়েছে দুটি বাড়ির থেকে, ঘটনার তিনদিন পরে, তখনও বেরোচ্ছে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী।
তাণ্ডবে আক্রান্ত এলাকার পথ বেয়ে এগোতে এগোতে চোখ টেনেছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাঙা সামগ্রীর স্তূপ, প্রচুর পাথর, লোহার রড, বাঁশের লাঠি আর অনেক অনেক আস্ত বা গুঁড়িয়ে যাওয়া বোতল, যাদের শরীর এখনো কেরোসিনের তীব্র গন্ধে মাখামাখি।
কী আশ্চর্য! দেখে অবাক লেগেছে, মুসলিম দোকানদারের ফোটোকপি কিংবা মুদিসামগ্রী কিংবা মাংসের দোকান আগুনে জ্বলে পুড়ে আংড়া হয়ে গেছে অথচ তার পাশেই হিন্দু দোকানিদের মুদি বা দর্জির দোকান দিব্যি নিজের চকচকে চেহারা নিয়ে ফিটফাট দাঁড়িয়ে। এদের গায়ে যেন আঁচড়ও পড়েনি। দেখা গেছে রাস্তা জুড়ে ইতিউতি দলা পাকিয়ে থাকা জ্বলে যাওয়া ব্যাটারিচালিত রিকশা, সাইকেল, মোটরবাইক, ছোটো মালবাহী গাড়ির স্তূপ।
তারই মাঝে একটা হিন্দুবাড়ি, দরজায় ‘ওঁ’ লেখা, তারও একদিকের দেয়াল আগুনে কালো হয়ে ধ্বসে গিয়েছে দেখে বিস্ময় জাগে। অথচ অন্যদিক যথাযথ রয়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় মানুষ জানালেন - ধ্বসে যাওয়া দেয়ালের পাশের বাড়িটিই এক মুসলিম পরিবারের। তাদের বাড়িতে আগুন ধরানোয় এবং গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্ফোরণেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওই প্রতিবেশী হিন্দু বাড়ির একাংশে।
অকুস্থলেই তদন্তকারী এক পুলিশ অফিসারের দেখা মিললো। প্রশ্ন করা হল “এই হিংসাত্মক আক্রমণ কী পরিকল্পিত এবং একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করেই হয়েছে?” নাম না প্রকাশের শর্তে উত্তর এল - “পাশাপাশি হিন্দু মুসলিমের দোকানগুলো দেখুন, বেছে বেছে মুসলিমদের দোকানগুলোকেই ধ্বংস করা হয়েছে। এই কাজে এই এলাকার স্থানীয় লোকজনের কেউ অবশ্যই জড়িত, নাহলে এত নিখুঁতভাবে এলাকার মুসলিম বাসিন্দাদের বাড়ি ও দোকান শনাক্ত করা কোনো বহিরাগতের একার পক্ষে সম্ভব হতো না। মুড়ি মুড়কির মতো যে পরিমাণ পেট্রল বোমা ব্যবহার হয়েছে এই আক্রমণে তাতে এটাও স্পষ্ট যে হানাদাররা পূর্বপরিকল্পনাসহ পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল।” তবে তিনি এও জানালেন যে ১২ মে’র পর থেকে আর কোনো আপত্তিজনক ঘটনা ঘটে নি। পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।
বিভীষিকায় বাকরুদ্ধ কিছু ব্যক্তির বয়ান
মহ. মুস্তাক (৫৩), এলাকায় কেবল্ টিভির ব্যবসায়ী এবং একটি ফোটোকপির দোকান আছে তাঁর। ১২ মে বিকেলে নিজের চোখের সামনে দেখেছেন মুখোশপরা একদল মানুষ কীভাবে জ্বালিয়ে দিচ্ছে তাঁর দোকান, লুঠ করছে ঘরবাড়ি। নিজের কানে শুনেছেন হানাদারদের উল্লাসধ্বনি - “জয় শ্রী রাম”। বললেন - “ওরা এসেছিল অগুন্তি লোহার রড, লাঠি, পেট্রল বোমা নিয়ে। এসেছিল আমাদের ধ্বংস করতে”... তাঁর নতুন কেনা ফোটোকপি মেশিন বরবাদ হয়ে গেছে আগুনে। বারবার হাত জোড় করে মিনতি করেছেন হানাদারদের, যাতে এভাবে বাড়িঘর দোকান ভেঙে জ্বালিয়ে ক্ষতি না করে। কেউ শোনে নি। এখন তাঁদের পরিধেয় বস্ত্রটুকু ছাড়া আর কিচ্ছু নেই ... বলতে বলতে কান্নায় গলা ধরে এসেছে মুস্তাকের।
মুস্তাকের ৮৩ বছরের অশক্ত বাবা বসে আছেন, পথের কিনারে। ভেঙেপড়া ভঙ্গিমায় হাত জড়িয়ে ধরেছেন সাংবাদিকের, গলায় কান্না আটকে ছিল দলা পাকিয়ে ... কথা বলতে পারেন নি।
শাবানা খাতুন, মুস্তাকের স্ত্রী। অল্প কথায় শুধু বলেছেন - ‘ফোটোকপি’। সেন্টারের পাশেই ওনাদেরই আরো দুটো দোকান আছে। ভাড়ায় দিয়েছেন দুই হিন্দু ভাইকে ... সেই দোকানের গায়ে আক্রমণের আঁচ পর্যন্ত লাগেনি। এরপরেও কী কোনো প্রমাণ দরকার যে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশানা করেই, পরিকল্পনামাফিক ঘটানো হয়েছে এই হিংসা? সঠিক প্রশ্ন তুলেছেন শাবানা।
স্থানীয় বহু লোকের অভিযোগ, ঘটনার দিন এলাকায় পুলিশ পৌঁছোতে দেরী হয়েছিল অনেক। তার মধ্যেই অনেকখানি ক্ষতি হয়ে গেছে। মহ. আনসারি, যাঁর নিজের বাড়িও পেট্রল বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত, নিজে সহ্য করেছেন দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পাথরের আঘাত, জানালেন - বেলা ১২.৩০ থেকে ১টা নাগাদই খবর আসে, একদল বাইরের লোক গোঁদালপাড়া মিলের দিক থেকে মুসলিম অধ্যুষিত পাড়ায় ঢুকছে। তাদের হাতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে এবং তারা মুসলিমদের বাড়ি লক্ষ্য করে পেট্রল বোমা ছুঁড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পুলিশের ১০০ নম্বরে ফোন করেন, ভদ্রেশ্বর থানাতেও ফোন করে পরিস্থিতির দুরবস্থা জানান। তাঁর ভাই ফায়ার ব্রিগেডে ফোন করেন। কিন্তু পুলিশ এসে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বেলা ২.৩০ বেজে যায়। তাও প্রথমে আসে মাত্র ১০-১২ জন পুলিশের একটি দল, দুর্বৃত্তরা পুলিশকেও পাথর ছুঁড়ে আক্রমণ করে। যতক্ষণে পুরো বাহিনী নিয়ে পুলিশ আসে বিকেল চারটে বেজে গেছে, যা ক্ষতি হওয়ার ইতিমধ্যে তা ঘটেই গেছে।
ছোট ঘটনা বড় ষড়যন্ত্র
এস কে শামসুদ্দিন, জুটমিলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী জানালেন, ১০ েম রবিবার সন্ধেবেলায় ঘটা সেই ছোট বচসার কথা। তেলিনিপাড়া ঘাটের জনশৌচালয় ব্যবহার করা নিয়ে হয় সেই বচসা। শামসুদ্দিনের প্রতিবেশী রাজকুমার রায় সাংবাদিকদের জানালেন - মুসলিম এলাকায় কারো করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে এমন একটা খবর কানাঘুষো উড়ে বেড়াচ্ছিল এলাকায়। সেই শুনে হিন্দুদের একাংশ ওই জনশৌচালয় ব্যবহার করতে মানা করে মুসলিমদের। দুই সম্প্রদায়ের লোকের মধ্যে এ নিয়ে হাল্কা বচসা, কথা কাটাকাটিও হয়। আরেক স্থানীয় দিনেশ সাউ জানালেন যে সেই সমস্যা স্থানীয় পুলিশের হস্তক্ষেপে মিটেও যায় একটু পরেই। এরপর ১১ মে নির্বিঘ্নেই কাটে। কিন্তু ১২ মে এভাবে সেই ছোটো ঘটনার অজুহাতে যে দাঙ্গা লাগানোর ষড়যন্ত্র করা হবে, সেটা সত্যিই বিস্ময়কর। দিনেশ বাবুর ভাষায় - এখন দুই সম্প্রদায়ের মানুষই অশান্তি আর আতঙ্ক নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। এটা মোটেই কাম্য নয়।
শামসুদ্দিন বাবু নিজেও হানাদারদের আটকাতে গিয়ে আহত হন। তবে তিনি দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন - এখানে বসবাসকারী হিন্দু দুগ্ধ-বিক্রেতা সম্প্রদায় এই বহিরাগত দুর্বৃত্তদের রুখে দিতে সদলবলে এগিয়ে না এলে, পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে আরো খারাপ হতো।
গোঁদালপাড়া থেকে পরের গন্তব্য ফেরিঘাট স্ট্রিট (ভদ্রেশ্বর পুরনিগমের ৯নং ওয়ার্ডের অংশ)। পথিমধ্যে সরু কালভার্ট। দিনেমারডাঙা মোড় আর মসজিদ রোডের যোগসূত্র। সাংবাদিকরা দেখতে পেয়েছেন কালভার্টের নীচে মুখথুবড়ে পড়ে থাকা গ্যাস সিলিন্ডার, মোটরবাইক, আরো কিছু গৃহস্থ সামগ্রী ... লুণ্ঠনকারীর ছেড়ে যাওয়া পায়ের দাগ।
কালভার্টের পাশেই বসা দুই SIRB জওয়ান। গত ১১ ঘন্টা ধরে ডিউটি করে চলেছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্ন শুনে সহজ সত্যিটাই বলে ফেললেন - “আপনারা সাংবাদিক, খবর সংগ্রহে এলাকায় এসেছেন, এবার স্বচক্ষে দেখে নিন, কোন সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে। এত পেট্রলবোমা ব্যবহার হয়েছে সেদিন যে সারা রাস্তার আনাচ কানাচ পর্যন্ত কাচের টুকরোয় ভরে যায়। মনে হয় সেই সাথে অ্যাসিডও ছিল, দেয়ালে দেয়ালে যেখানে পড়েছে, দেখুন রং চটে গেছে।” দ্বিতীয় জওয়ান বললেন - “আমাদের সম্বল বলতে শুধু লাঠি। কোনো প্রতিরক্ষক বা প্রাণঘাতী অস্ত্রও নেই। সেই নিয়ে ওই ৫০০-৬০০ উন্মত্ত হানাদারদের লাঠি, রড, ঢাল, পেট্রলবোমার আক্রমণ কী ঠেকানো যায়, না যোঝা যায়?”
এক ওষুধের দোকানে খবরকাগজ পড়ছিলেন বিশ্বনাথ শিকদার, ‘দ্য ওয়্যার’কে জানিয়েছেন - “ছোটোখাটো গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা সাম্প্রদায়িক চাপানউতোর আগেও তেলিনিপাড়ায় হয়েছে, কিন্তু এভাবে, এরকম পরিকল্পিত দাঙ্গার পরিস্থিতি, নৈব নৈব। এখন সব সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষই অকথ্য বিভীষিকার ভোগান্তি পোয়াচ্ছেন।”
এলো ওরা নদীর ওপার থেকে
এম ডি সেলিম, পুড়ে ঝলসে যাওয়া বাড়িটাকে দেখিয়ে বলছিলেন - “এখানে পাঁচটা বাড়ি একসাথে একগোছা। একই দেয়ালের এপিঠ-ওপিঠে। ওরা সেদিন এতজন এত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করেছে যে আমরা রুখতে পারিনি। এই বাড়িগুলো সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। একটা ঘরে গ্যাস সিলিন্ডারও ছিল। তখন দাউ দাউ আগুন চারিদিকে। কোনো মতে সিলিন্ডারটা বাইরে এনে বালি চাপা দেওয়া গেছে। আর পাঁচ মিনিট দেরী হলেই আরো বড় বিপদ হতো।
তেলিনিপাড়ার একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গার নিম্নগতি। এখানে গঙ্গার নাম হুগলী নদী। নদীর অপরপারেই “জগদ্দল”। জেলা উত্তর ২৪ পরগণা, ব্যারাকপুর সংসদীয় ক্ষেত্র। এই কেন্দ্রের সাংসদ বিজেপির অর্জুন সিং। সেলিমের সোজাসুজি অভিযোগ, অর্জুন সিং-এর দলবলই সেদিন ছোটো ছোটো নৌকো বেয়ে অস্ত্রশস্ত্র মজুত করে এসেছে নদীর ওপার থেকে। গোঁদালপাড়া জুটমিলের পাশ দিয়েই তারা তেলিনিপাড়ায় ঢুকেছে দাঙ্গা বাধাতে।
ফেরিঘাট স্ট্রিটের গায়ে লাগোয়া একটি বাড়ি পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর
এম ডি নিহাল’এর। ভাঙচুর চলেছে তাতেও। পাশের বাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে এই বাড়ির দেয়ালে চিড় ধরেছে জায়গায় জায়গায়। বাড়ি তালাবন্ধ পড়ে আছে। স্থানীয়রা জানালেন - ইন্সপেক্টর নিহাল চাকুরিসূত্রে বদলি হয়ে এখন বসিরহাট থানায় কর্মরত। সেইজন্যই এই বাড়িতে তালা। সপরিবার বসিরহাটেই রয়েছেন পুলিশবাবু। নিজেরা বেঁচে গেছেন, কিন্তু বাড়িটা ছাড় পায়নি পুলিশেরও।
গলির ঠিক মাথায় মুখোমুখি মহম্মদ আনসারির সাথে। গোঁদালপাড়া জুটমিলের প্রাক্তন কর্মী। পাশেই বাড়ি ছিল। দোতলার ঘরে ওনার বৃদ্ধ বাবা থাকতেন। আনসারির বাড়িটিও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আনসারির পাশের বাড়িতেই তাঁর প্রতিবেশী এলাকার পুরপ্রতিনিধি চিত্রা চৌধুরী স্বয়ং। হিংসাত্মক হানাদারির সময় কেউ একবার পাশে পর্যন্ত এসে দাঁড়ায়নি, সাহায্য তো দূরস্থ। জানাচ্ছিলেন আনসারি। বলছিলেন ওঁর বয়স্ক বাবাকে কিভাবে বারবার আঘাত করেছে দুষ্কৃতীরা। পায়ে পড়ে হাত জোড় মিনতিতেও শয়তানরা কর্ণপাত করেনি। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ। আনসারির পোষা গোরুটিকে পর্যন্ত নিয়ে গেছে হানাদার বাহিনী। ওটাই তঁার রোজগারের একমাত্র সহায় ছিল। এখন কীভাবে হবে অর্থাগম? উত্তর নেই আনসারির কাছে।
পুরপ্রতিনিধির সাফাই
জাতীয় কংগ্রেসের প্রতীকে নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং আনসারির প্রতিবেশী শ্রীমতী চিত্রা দেবীর স্বামীও কংগ্রেস নেতা। স্বামী-স্ত্রী দুজনে পরপর এই এলাকার কাউন্সিলর পদে আছেন বিগত ২৫ বছর ধরে। আনসারির বিপদে তাকে বাঁচাতে গেলেন না কেন? ... চিত্রা চৌধুরীর পাল্টা প্রশ্ন - ঘরে এখন আমার পুত্র এসে রয়েছে, আমি তাকে বাঁচাবো, নিজে বাঁচবো, নিজের পরিবার আগে বাঁচাবো না প্রতিবেশীকে রক্ষা করতে যাবো? ... আর ওই মারাত্মক বোমাবাজিতে দুই যুযুধান পক্ষের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি কীই বা করতে পারতাম? ... বেশ, এলাকাবাসীর বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া যদি কাউন্সিলরের প্রথম নৈতিক দায়িত্ব নাও মনে করেন, ক্ষতিগ্রস্ত এবং আক্রান্তদের পাশে এই ঘটনার পরেও একবার গিয়ে দাঁড়াননি কেন? ... চিত্রা দেবীর নির্লিপ্ত, নিরুৎসাহিত, দায়সারা উত্তর ছিল - “আমার কী কিছু করার ক্ষমতা আছে! তাহলে আমি গিয়েই বা কী করতাম আর যাবোই বা কেন?”
শুধু কাউন্সিলর নন। স্থানীয় মানুষ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, বিপদে তাঁদের পাশে এসে কোনো রাজনৈতিক নেতাই দাঁড়াননি। এমনকী তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় বিধায়ক, রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, তিনিও না। অবশ্য জনতা এও জানিয়েছে যে ভোটের আগেই একমাত্র বিধায়কমশাই এই কেন্দ্রে বারবার পায়ের ধুলো ছড়াতে আসেন। দ্য ওয়্যারের তরফেও মন্ত্রী মশাইকে বহুবার ফোনে ও টেক্সট মেসেজে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় (১৬ মে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা অবধি)। সাড়া মেলেনি।
চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেটের অধীনে পড়ে তেলিনিপাড়া। পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবির দ্য ওয়্যার’কে জানিয়েছেন - রবিবারের (১০ েম) বচসা বিরোধ খানিক স্বতঃস্ফূর্ত হলেও, মঙ্গলবারের (১২ মে) ঘটনাটি সুপরিকল্পিত, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং নিয়ম অনুযায়ী সংগঠিত। পুলিশ এ পর্যন্ত এই হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে ঘটনার ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৯১ জনকে গ্রেপ্তার করে কোর্টে পেশ করেছে এবং কোর্ট তাদের ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনার পরেপরেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ৩৫ জনকে।
রোপণ খনন সাজানো সহানুভূতি সঞ্চয়ের চেষ্টা এবং ভুয়ো খবরের ভাঁওতাবাজি
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে হগলী সংসদীয় আসনের বর্তমান সাংসদ লকেট চ্যাটার্জির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে দ্য ওয়্যার। তাঁর কাছ থেকেও এখনো কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় নি।
বরং বিজেপি নেতা কৈলাস ভিজয়বর্গীয় ১২ মে বিকেলের দিকে যে ট্যুইট বার্তাটি প্রকাশ করেছেন তাতে লকেট মহাশয়াকে একটি ভিডিওয় বলতে শোনা যাচ্ছে - হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি প্রচুর বিপন্ন স্থানীয় মানুষের ফোন পাচ্ছেন। এটা একতরফা যুদ্ধের সমতূল।
তিনি রাজ্যসরকারী প্রশাসনকে দোষারোপ করেও ক্ষিপ্ত হয়ে জানাচ্ছেন - রাজ্য সরকারী শাসনযন্ত্র এই পরিস্থিতিতে নীরব দর্শক। তেলিনিপাড়ায় আগুন জ্বলছে।
একই ভাঁওতাভাষ্য রোপণ করে সমাজমাধ্যমেও প্রচুর মিথ্যে সংবাদ আগুনের মতো ছড়িয়ে দেওয়া হয় মানুষের মধ্যে। উগ্র হিন্দুদের পক্ষে সহানুভূতি সঞ্চয় করতে এই মিথ্যাচারে বলা হয় - তেলিনিপাড়ায় হিন্দুরা বিপন্ন। উইকিনিউজ পেজে ১২ মে, ২০২০ এই ভুয়ো সংবাদটির শীর্ষক হয় - ‘2020 Telinipara Anti-Hindu Pogrom’
এখানেই শেষ নয়। দ্য ওয়্যার লক্ষ্য করেছে - পাশাপাশি “আনন্দবাজার পত্রিকা” নামের আড়ালে একটি ভুয়ো অনলাইন নিউজ পোর্টাল খুলে সেখানেও একইভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক মুসলিম বিরোধী উগ্র হিন্দু মন্তব্য প্রকাশ করা হচ্ছে। তেলিনিপাড়ায় হিন্দুদের বিপন্ন আক্রান্ত বলে মিথ্যে প্রচার চালানো হচ্ছে। লক্ষ্যণীয় যে পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকের নাম করে এই ভুয়ো সংবাদ সূত্রটি ৭ এপ্রিল অ্যাক্টিভেট করা হয় এবং ঘটনার কদিন কাটিয়ে ধরা পড়ার পরে তা বন্ধও করে দেওয়া হয়। (প্রসঙ্গত : বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ এ বিষয়ে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর মূখ্যসম্পাদককে অবগত করে এবং তাঁরা জানিয়েছেন ইতিমধ্যেই তাঁরা এই ভুয়ো পোর্টালের প্রচারকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছেন। এ নিয়ে বা.স.ম ফেসবুক পেজে ইতিমধ্যেই আমরা বিস্তারিত জানিয়েছি দুদিন আগেই)।
এই ভাঁওতাবাজির মুখোশ খুলে দিয়ে “ইন্ডিয়া ট্যুডে - ফ্যাক্ট চেক” থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে যে, তেলিনিপাড়া নিয়ে এই ভুয়ো তথ্য আর বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ যা একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং অন্যান্য সমাজমাধ্যমে ছড়াতে চাইছে, তার ব্যবহার করা ছবিগুলিও পাকিস্তানের কোনো হিন্দু বিরোধী ঘটনার থেকে আমদানি করা। যার সাথে তেলিনিপাড়ার দূরদূরান্তেরও সম্পর্ক নেই।
শেষকথা
দ্য ওয়্যারের পক্ষ থেকে তিন ঘন্টারও কিছু বেশি তেলিনিপাড়ার আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যে ফিল্ড সার্ভে করা হয়েছে, তাতে স্থানীয় বাসিন্দা, পুরপ্রতিনিধি, পুলিশকর্মী প্রমুখের সাথে কথা বলে এবং ঘটনাস্থলের আসল অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে, নিশ্চিতভাবে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় -
১. মুসলিমপ্রধান বসতি এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি ও মারাত্মক ক্ষতি করা হয়েছে
২. একটি হিন্দু এলাকাতেও (রাজাবাজার) কিছু গৃহসামগ্রীর অংশত ক্ষতি দেখা যাচ্ছে
৩. যে হিংসাত্মক ধ্বংসাত্মক আক্রমণ ১২ মে তেলিনিপাড়ায় ঘটেছে, প্রাথমিক মূল্যায়নে তা অবশ্যই পূর্বপরিকল্পিত এবং সুকৌশলে সংঘটিত।
৪. ঘটনাস্থলের প্রামাণ্য পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী মুসলিমদের বাড়িঘর এবং দোকানপাট বেছে বেছে আক্রমণ করা হয়েছে। যা সুনির্দিষ্টভাবে ছক কষেই করা সম্ভব
৫. স্থানীয় মানুষদের অভিযোগ এই আক্রমণের কাজ করেছে বহিরাগত একদল দুর্বৃত্ত কিন্তু তাদের আক্রমণের আগে নিশানার খুঁটিনাটি তথ্য তাদের সরবরাহ করেছে এই এলাকাবাসী কিছু সহযোগী।
This is the ground report at Telipara Riots Published at “The Wire” by Himadri Gosh Today after proper investigation. Please go through the following link:
https://m.thewire.in/article/communalism/ground-report-what-really-happened-in-violence-hit-telinipara-west-bengal
হোয়াটসঅ্যাপ থেকে সংগৃহীত
একটি সংযোজন
করোনাভাইরাস : মুসলমানরাই রোগ ছড়াচ্ছে বলে হিন্দুদের টিটকিরি থেকে পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা
অমিতাভ ভট্টশালী
বিবিসি বাংলা, কলকাতা
তেলেনিপাড়ায় দোকান ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।
করোনাভাইরাস পরীক্ষা এবং লোকজনকে কোয়ারেন্টিনে নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের হুগলীতে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের খবর এসেছে।
হিন্দু আর মুসলমান - উভয় সম্প্রদায়ের দোকান, বাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ আর বোমাবাজি হয়েছে।
রবিবার প্রথম উত্তেজনা তৈরি হলেও পুলিশ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করার পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। কিন্তু মঙ্গলবার দুপুর থেকে নতুন করে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। গঙ্গা পাড়ের ওই এলাকায় বোমাবাজি আর আগুনের ধোঁয়া নদীর অন্য দিক থেকেও দেখা গেছে।
স্থানীয় সূত্রগুলি বলছে, কয়েকদিন আগে করোনাভাইরাস পরীক্ষার একটি শিবির করা হয়েছিল তেলেনিপাড়া এলাকায়। পরীক্ষায় প্রথমে একজন আর তারপরে আরও কয়েকজনের পজিটিভ রিপোর্ট আসে। ঘটনাচক্রে তারা সকলেই মুসলমান।
চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেট এলাকার অধীন তেলেনিপাড়া এবং লাগোয়া ভদ্রেশ্বর আর চন্দননগরের উর্দিবাজার এলাকায় বুধবার নতুন করে সংঘর্ষ হয় নি, কিন্তু উত্তেজনা রয়েছে এলাকায়।
গঙ্গা তীরের এলাকাটিতে বোমাবাজি আর আগুনের ধোঁয়া নদীর অন্য দিক থেকেও দেখা গেছে।
এখনও পর্যন্ত তিন দফায় মোট ১১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চন্দননগরের পুলিশ কমিশনার হুমায়ূন কবীর।
ওই অঞ্চলে চটকল আছে আর সেখানে হিন্দু এবং মুসলমানদের বসবাসের এলাকা মোটামুটিভাবে আলাদা।
এক স্থানীয় বাসিন্দা বলছিলেন, “ক্যাম্পটা মুসলমান প্রধান এলাকায় হয়েছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই পজিটিভ এলে মুসলমানদেরই হবে। কিন্তু সেটা নিয়ে হিন্দুদের একাংশ মুসলমান বিদ্বেষ ছড়াতে থাকে। মুসলমানরাই করোনা ছড়াচ্ছে বলে টিটকিরি দেওয়া হয়।”
তবে গোটা ঘটনার আরেকটা বর্ণনাও পাওয়া গেছে হিন্দুত্ববাদীদের কাছ থেকে। তারা বলছেন করোনা সংক্রমিতরা কোয়ারেন্টিনে যেতে অস্বীকার করছিলেন বলেই হিন্দু প্রতিবেশীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন সংক্রমণ তাদের মধ্যেও ছড়াতে পারে এই আশঙ্কায়।
তাদের বক্তব্য সেজন্যই ব্যারিকেড করে দেওয়া হয় ওই এলাকাটি। কিন্তু এলাকার মুসলিমরা জানায় মুসলিম প্রধান এলাকাটি কেউ ব্যারিকেড তুলে বন্ধ করে দিয়েছিল, ফলে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়।
তার পরেই উত্তেজনা চরমে পৌঁছায় মঙ্গলবার দুপুরে। ব্যাপক বোমাবাজি চলে, দোকান বাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
চটকল অধ্যুষিত এলাকাটিতে হিন্দু এবং মুসলমানদের বসবাসের এলাকা মোটামুটিভাবে আলাদা।
যেসব ছবি নানা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে হিন্দু-মুসলমান - উভয় পক্ষেরই দোকান বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে।
তবে বোমাবাজির ব্যাপারে একে অন্য পক্ষের ওপরে দায় চাপাচ্ছেন।
ওই অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে যাতে কেউ গুজব ছড়িয়ে অশান্তি না বাড়াতে পারে।
বিজেপির স্থানীয় সংসদ সদস্য লকেট চ্যাটার্জি পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল বলে অভিযোগ করেছেন।
হোয়াটসঅ্যাপ থেকে সংগৃহীত