সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
প্রথম পর্ব
১৯৪৫ সাল। কৃষ্ণনগরে ছিলাম। কলেজে পড়তাম। তখন শহরে আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা বলতে একটা সিনেমা হল ছিল। গোয়ারিতে - চিত্রমন্দির সিনেমা হল। কিন্তু রোজ তো সিনেমা দেখা যায় না।
সে সময় শো আরম্ভ হওয়ার আগে সিনেমা হল থেকে লাউডস্পিকারে গান বাজানো হতো। রবীন্দ্র সংগীতই বাজত। সেই গান শোনাটাই ছিল বিশেষ তৃপ্তিলাভের ব্যাপার। আমি থাকতাম মাতুলালয়ে। সেটা ছিল সিনেমা হলের কাছেই - সিংদরজার মোড়ে। বিকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওই হলের সামনে এসে দাঁড়াতাম। আরো অনেক জন এভাবেই সেখানে দাঁড়াতেন, ওই গান শোনার জন্য।
ওই চিত্রমন্দির হল এর কাছেই এখন যে বাড়িটায় ইউনাইটেড ব্যাংক - এটা ছিল জোহা সাহেবের বাড়ি - সামসুজ্জোহা। কুষ্টিয়ার মানুষ। এখানে ওকালতি করতেন। এছাড়া তিনি ছিলেন জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান, তার চেয়েও তখন তাঁর বড় পরিচয় ছিল যে - তিনি মুসলিম লীগ দলের নেতা। নদিয়া জেলায় লীগ দলের কর্তা। বঙ্গদেশে তখন মুসলিম লীগ দলের শাসন - মন্ত্রিসভা। ফলে জোহা সাহেব অতিশয় শক্তিমান ব্যক্তি। তার বাড়িতে মানুষের ভিড় লেগেই থাকতো। বিকালে সেই ভিড় উপচে পড়তো। ছাত্র আর যুবকদের ভিড়ই বেশি।
মাঝে মাঝে ওই বাড়ি থেকে বিকেলে বেরিয়ে আসতো কয়েকজন যুবক। তাদের সাইকেলে মুসলিম লীগের পতাকা লম্বা ডাণ্ডার সঙ্গে বাঁধা। হাতে সড়কি। সাইকেল চড়ে, হাতে সেই সড়কি উঁচিয়ে তারা বার হত, এখানে পথ পরিক্রমায়। জোরে সাইকেল চালাত, হাওয়া লেগে পতাকা উড়ত পত পত করে, হাতে উদ্ধত ভঙ্গির সড়কি - যেন হিটলারের ঝটিকাবাহিনী। মুখে তাদের স্লোগান -
শের কা বাচ্চা মুসলমান
লাড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।
এই পরিবেশে গান শোনার তৃপ্তি হারিয়ে যেত। মনে হতো সমস্ত শহর যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেল। বিকালে নেমে এলো বিষন্ন সন্ধ্যা। সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগতো না। ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে আসতাম।
কলেজেও তখন এই দশা। অধ্যাপকদের মধ্যে বিভাজন ঘটেছে। হিন্দু অধ্যাপক মুসলমান অধ্যাপক। ছাত্রদেরও দুই দল - হিন্দু ছাত্র, মুসলমান ছাত্র। দ্বন্দ্ব চলছেই।
আমার বাড়ি ছিল মেহেরপুর। তখনকার নদিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার সদর শহর সেটা। সেখানে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় ছিল একটি। সেই স্কুলেই পড়েছিলাম। সেখানে আমার সহপাঠী ছিল আবুল হায়াত নামে একটি ছেলে। গ্রামে বাড়ি ছিল। তাকে আমার খুব ভালো লাগতো। কারণ সে ছিল ভদ্র, শান্ত, মিশুকে। সেও কৃষ্ণনগর কলেজে পড়তে এসেছিল। কলেজের মুসলিম হোস্টেলে থাকতো। কিছুদিন পরে দেখলাম সে মুসলিম লীগের ছাত্র শাখার একজন নেতা হয়ে গিয়েছে।
কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন হবে। কলেজে তখন প্রধানত তিনটি দল - ফরওয়ার্ড ব্লক, কমিউনিস্ট পার্টি আর মুসলিম লীগ। ফরওয়ার্ড ব্লক দলের নেতা কাশীকান্ত মৈত্র। ওদের দলের বলাই সেন (মনোরঞ্জন) আমার সহপাঠী। তিনি আমাকে বললেন, ভাই, আবুল হায়াতের সঙ্গে কাশীর একটু পরিচয় করিয়ে দাও। শুনলাম আবুল হায়াত তোমার বন্ধু। আমি অবাক হয়ে বললাম, আবুল হায়াতের সঙ্গে পরিচয় করা কেন? বলাই সেন বললেন, আবুল হায়াত লীগের ছাত্র নেতা কলেজের। প্রভাবশালী নেতা।
আমি খুবই অবাক হলাম। গ্রামের গোবেচারী ছেলে আবুল হায়াত ছাত্রনেতা - লীগের! কাশীকান্ত মৈত্র তখন কলেজের বিশিষ্ট নেতা। তিনি পরিচয় করতে চান আবুলের সঙ্গে! আবুলের অবস্থানটা বুঝে বেশ অবাক হলাম।
কাশীবাবুকে নিয়ে মুসলিম হোস্টেলে গেলাম। কলেজেরই একাংশে ছোট একতলা একটা বাড়ি। সেখানে তখন ছোটখাটো একটা ভিড় যেন।
একজন বলল, কাকে চান?
আমি বললাম, আবুল হায়াত।
—কি দরকার?
—তাকে আমার দরকার।
—আপনার নাম?
আমি খুবই অবাক হলাম। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হলো। এরপরই দেখি হায়াত বেরিয়ে এসেছে।
—কি ব্যাপার, তুই!
—তোর সঙ্গে দরকার। কাশীবাবু এসেছেন, পরিচয় করবেন তোর সঙ্গে।
হায়াত আমাদের দুজনকে তার ঘরে নিয়ে গেল। চেয়ারে বসালো। আমি কাশীবাবুর সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলাম। হায়াত বলল, এখন তো আর কিছু করা যাবে না। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়ে গিয়েছে।
কাশীবাবুকে সেখানে বসিয়ে রেখে আমি পালিয়ে এলাম। যেন বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেলাম।
কলেজে লীগের ছাত্ররা ছিল সংখ্যালঘু। কিন্তু তারা ছিল সংঘবদ্ধ - এক কাট্টা। একটা না একটা গণ্ডগোল লাগাতে চাইতো। নানা দাবি তুলত আর সেটা আদায়ের চেষ্টা করত। কলেজে ছাত্র সংসদের সংস্কৃতি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রতিবছর একখানা নাটক মঞ্চস্থ করা হতো। ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক ছিলেন বিনায়ক সান্যাল মহাশয়। । লীগপন্থী ছাত্ররা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলল যে তিনি মুসলমান ছাত্রদের অভিনয় করার সুযোগ দেন না। কলেজে আমরা যে সংখ্যক ছাত্র আছি - সেইমতো আমাদের নিতে হবে।
বিনায়ক বাবু অপমানিত, অসম্মানিত হলেন। তার প্রতি এই অবিশ্বাস বা অনাস্থার কারণে তিনি এই দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। শেষে বাধ্য হয় একটা কমিটি তৈরি হল অভিনেতা নির্বাচনের জন্য। কোন একটা ঐতিহাসিক নাটক অভিনীত হয়েছিল সেবার। দেখি আমার বন্ধু আবুল হায়াতও অভিনয় করছে। বাদশার নোকরের অভিনয় তার। কোন কথা নেই। কুর্নিশ করতে করতে মঞ্চে প্রবেশ করলো, আবার কুর্নিশ করতে করতে প্রস্থান।
পরদিন আবুল হায়াতকে বললাম, তোর অভিনয় দেখলাম। আর কোন ভূমিকা পেলিনে? সে বলল, না। আমাদের ভাগে পড়েছিল তিনটি চরিত্র। কিন্তু নির্বাচনী পরীক্ষায় পারা গেল না।। প্রায় সবাই বাতিল হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের তিনজন থাকতেই হবে। তাই ভাই ওই ভূমিকাটাই নিলাম।
হায়াতের কথাবার্তা শুনে আমি আর বিস্মিত হলাম না। ওরা এখন অন্য জগতের মানুষ।
শুধু হায়াত কেন? অধ্যাপকদের মধ্যেও এই দশা। হিন্দু অধ্যাপক, মুসলমানর অধ্যাপক - দুই দল। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেন না। আমার প্রিয় অধ্যাপক ছিলেন মোহাম্মদ আব্দুল হাই (পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক)। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। আমাকে সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করতেন। গল্প লিখতে বলতেন, গ্রাম সমাজের গল্প। আমার লেখাগুলো নিয়ে তিনি সংশোধন করে দিতেন। আমি তার বাসায় যেতাম।
কিন্তু ক্রমে তিনিও অন্যরকম হয়ে গেলেন। যেন এড়িয়ে চলতে চান। আমি ব্যথিত হলাম। মনে দুঃখ পেলাম।
রাজনীতি বুঝতাম না. তাতে আকর্ষণ বোধ করতাম না। তাই ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছিলাম। বিশেষ করে মুসলমানদের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আচরণ মনকে পীড়িত করছিল। ভাবছিলাম সবাই ওই রকম হয়ে গেল? ব্যতিক্রমী কেউ নেই! একজনকে পেয়ে গেলাম। সহপাঠী একজন। তার নাম আব্দুল হাই। তার পোশাক পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ - কথাবার্তা - সবই ছিল ব্যতিক্রমী।
তখন বঙ্গদেশে মুসলিম লীগের রাজত্ব। জেলাশাসক, পুলিশ সুপার - সকলেই মুসলমান। পুলিশ সুপারের ছেলে মেয়ে এবং শ্যালক ছিল আমাদের সহপাঠী। পুলিশ সুপার ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস অনুরাগী। কলেজিয়েট স্কুলে আমরা রামকৃষ্ণ জন্মোৎসব করেছিলাম। তাতে তিনি নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। সভায় সপরিবারে উপস্থিত হয়েছিলেন। ছেলেমেয়েরাও গিয়েছিল। পুলিশ সুপার বক্তৃতাও করেছিলেন। কিন্তু কলেজে দেখলাম ছেলে মেয়েরা লীগপন্থী। তবে তার প্রকাশ তেমন নয়। শ্যালক আহমেদ একটু বেশি প্রকট ছিলেন। তবে এরা কেউই আমার বন্ধু আবুল হায়াতের মতো মত্ত ছিল না। তখন কলেজ ছাত্রদের মধ্যে হিন্দুদের পোশাক ছিল ধুতি পাঞ্জাবি বা ধুতি শার্ট। এই পোশাকেই তারা ফুটবল হকি ক্রিকেট খেলতো। মুসলমান ছাত্ররা পড়তো পাজামা পাঞ্জাবি কিংবা শার্ট। সুপারের ছেলে এবং শ্যালক সকলেই পাজামা পরত।
আব্দুল হাই- এর পোশাক ছিল ভিন্ন। সে পরতো ফুলপ্যান্ট, ফুলহাতা শার্ট, জুতো, মোজা। আর হাতে একটি ছাতা। যাকে বলে জেন্টলম্যানের পোশাক। শুধু পোশাক নয়, তার চলন বলন আচার- আচরণ - সবকিছুতেই একটা সংযত ভাব - চুরুচির প্রকাশ। সে অশালীন কথা বলত না। হিন্দু-মুসলমান, জাত পাত, সাম্প্রদায়িকতা এবং রাজনীতি বিষয়ে কোন কথা বলতো না। পড়াশোনার বাইরে সে বলতো, আত্মমর্যাদার কথা, সামাজিক সম্মানের কথা, বাবা মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধার কথা, পারিবারিক সম্মান রক্ষার কথা ও মহৎ জীবনের কথা। শুনে আমি অভিভূত হতাম। ভাবতাম এ কোন মুসলমান! আমি সাধারণ ঘরের ছেলে। অভিজাত বনেদি পরিবারের মুসলমান দেখিনি। গ্রন্থে তাদের কথা পড়েছি - সেসব বড় ভাবনা খানদানি ব্যাপার। আব্দুল হাইয়ের ভেতর যেন তারই প্রকাশ। তার বাবা সেশান জজ। কৃষ্ণনগরে ছিলেন। অন্যত্র বদলি হয়ে যাওয়ায় আব্দুল এখন একজন সাব-জজের পরিবারে আশ্রিত। গোয়াড়ির স্বর্ণময়ী পুকুরের পশ্চিম দিকে সে বাড়িটা। এক মুসলমান ভদ্রলোকের বাড়ি। সাবজজও মুসলমান। আব্দুল সেই বাড়িতে থাকতো। তার উচ্চরুচির কথাবার্তা শুনে মাঝে মাঝে মনে হতো- আহা- হলেই যদি ওই রকম হতাম!
একদিন তার কপালে দুর্ভোগ নেমে এলো।
ক’ দিন ধরে লক্ষ্য করছিলাম তার বিমর্ষ ভাব। প্রশ্ন করলাম, কি হয়েছে তোমার?
সেদিন কলেজের গাছ তলায় সে তার দুঃখের কথা শোনালো।
আমাদের এক সহপাঠী ছিল। পদবী গাঙ্গুলী। দর্শনার কাছে মুড়লগাছি গ্রামে তার বাড়ি। গাঙ্গুলীরা ওখানে জমিদার, বনেদী। সেই বংশের ছেলে সে। রূপবান, পোশাকে জৌলুস ছিল। কিন্তু সেইসঙ্গে সে ছিল একজন বখে যাওয়া ছেলে। দুষ্ট প্রকৃতি। বাইরে তার প্রকাশ ছিল না। ভদ্রজন বলে মনে হতো।
সাবজজের একটি মেয়ে ছিল- কিশোরী। সে দোতলার বারান্দায় দাঁড়াতো কখনো সখনো। গাঙ্গুলী সেটা দেখেছিল। এরপরই সে আবদুলের সঙ্গে যেচে আলাপ-পরিচয় করে। তারপর সে একদিন সেই বাড়ির সামনে উপস্থিত। আব্দুল তাকে দেখে, সৌজন্যবশত ঘরে আসতে বলে। সে ঘরে গিয়ে বসেছে। আব্দুল তাকে চা বিস্কুট খাইয়েছে। চা দিতে এসেছিল সাবজজের মেয়ে। সেই সময় গাঙ্গুলী কিছু আপত্তিকর ভঙ্গি আর বাক্য প্রয়োগ করে। মেয়ের মা-ও শুনেছেন সে কথা আর মেয়েও অপমানিত বোধ করেছে। আব্দুল বিব্রত বোধ করেছিল। এর পরপরই আব্দুল আরও বিপন্ন হয় যখন সাবজজের স্ত্রী বলেন, তুমি কাকে ঢুকিয়েছিলে ঘরে? ওই সঙ্গে মিশছ এখন? আমার বাড়িতে আশ্রিত থেকে আমার মেয়েকে নষ্ট করছো, আমার মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। এখন তার মন যদি দূষিত হয়, যদি মনের পবিত্রতা হারায়, তাহলে সব ক্ষতি হবে আমাদের। তোমার বাবাকে জানাচ্ছি তোমার কীর্তিকলাপ।
আব্দুল হাউ হাউ করে কেঁদে বলল, ভাই আমি ভাবতেই পারিনি যে গাঙ্গুলী ওরকম করবে। সহপাঠী শিক্ষিত ভদ্রলোকের ছেলে বলে বিশ্বাস করেছিলাম ওকে। এখন বাবাকে জানালে- বাবার মনের অবস্থা কেমন হবে? আমার সম্পর্কে তার ধারণা কেমন হবে? আমি কেমন করে বাবার সামনে, মায়ের সামনে মুখ তুলে দাঁড়াবো? তারা ভাববেন, আমাদের পারিবারিক মর্যাদা ছেলে নষ্ট করে দিল! কিন্তু ভাই আমি তো কোন অনৈতিক কাজ করার কথা ভাবতে পারিনে।
কলেজ বন্ধ ছিল। কিছুদিন আব্দুলের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। একদিন সকালে পথে দেখা। হাত ধরে বলল, চল, বাসায় গিয়ে বসি। আমি বললাম, না ভাই, ‘ তুমি আবার বাসায় যেতে বলছ’?
আব্দুল বললো, না, সেই বাসায় আর থাকিনে। ওখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হলাম।
—কোথায় আছো?
—মকফুলউদ্দীন সাহেবের বাসায়। আমার অবস্থা জেনে স্যার বললেন, আমার কাছে থাকো।
মকফুলউদ্দীন আহমেদ ছিলেন কৃষ্ণনগর কলেজে দর্শনের অধ্যাপক। লীগপন্থী অধ্যাপকদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বলে শুনতাম। তাই বললাম, না ভাই, - স্যারের বাড়ি আর যাব না। কী মনে করবেন!
আব্দুল বলল, যাবে তো আমার কাছে। আর স্যার খুব ভালো মানুষ।
বাসাটা ছিল পাত্রবাগানের উত্তরে খ্রিস্টান পাড়ার মুখে। আব্দুলের সঙ্গে গিয়ে বৈঠকখানা ঘরে বসলাম। স্যার একবার ঘরে এসে আমাদের দেখে বললেন, তুম - বস, বস।
আব্দুল আমার সঙ্গে বসে গল্প করছিল। ভেতর থেকে কেউ ডাকলো। খানিক পরে সে ফিরে এলো। তার হাতে প্লেট ভর্তি খাবার। আর এক হাতে জল ভর্তি কাঁচের গ্লাস। সেগুলো টেবিলে রেখে বলল, খাও। আমি বললাম, ওসব আবার কি?
সে বলল, একটু খাবার।
—ওসব আবার কেন?
—খাও। বাড়িতে তৈরি। আন্টির নিজের হাতে। আমরা দোকানের খাবার খাইনে। খেয়ে নাও। সবই পনির আর ছানার।
এই সময় মনে একটা ঝড় বইছিল।মনে পরল সেই ছড়াটা,
পড়েছ মোগলের হাতে
খানা খেতে হবে এক সাথে।
কতকাল আগের এই ছড়ার কাল থেকে এ তাবৎ কালের মধ্যে আমাদের কি কোনও অগ্রগতি ঘটেছে? কোন মৌলিক পরিবর্তন!
আমরা বর্ণাশ্রমী হিন্দু। জাত পাত, ওপর নিচ, স্পৃশ্য অস্পৃশ্য ভেদের বেড়া দিয়ে ঘেরা আমাদের সমাজ। মুসলমান বা খ্রিস্টান তো দূরের কথা, হিন্দু সমাজেই কি ঐক্য আছে- পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদান আছে- বারো পুতের তেরো হাঁড়ির দশা তো সেখানে। ছুঁলে জাত যায়, জল পান, অন্ন গ্রহণ তো দূর কথা, ঘ্রাণেই অর্ধভোজনের তত্ত্ব প্রচারিত সমাজে। বিধর্মী খাদ্যের ঘ্রাণ নাকে গেলেই পতিত হতে হয়।
বাল্যকালে বড়দিনের ছুটিতে কৃষ্ণনগরে আসতাম। মাসিমা বললেন, চল তোকে নিয়ে যাই এক জায়গায়। তোর মার গুরুমার কাছে নিয়ে যাবো। প্রিয়াদির কাছে।
আশ্চর্য ব্যাপার। এখন আব্দুলের পাশে যে ঘরে বসে আছি- তার উত্তরে পথের ওপাশের বাড়িটাই সেই প্রিয়াদির। মা’র শিক্ষয়িত্রী প্রিয়বালা বিশ্বাস। পাশের দোকানটি তাঁর ভাই নিবারণ বিশ্বাসের। বাড়িও। ওরা প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান। এটা খ্রিস্টান পাড়া। মাসিরা আমাকে এই বাড়িতে এনেছিলেন। বড়দিনের উৎসবে বাড়িটা সাজানো হয়েছিল। কালো মোটা সুসজ্জিতা প্রৌঢ়া রমণী, প্রিয়দিদি। মাসিরা আমার পরিচয় দিতেই তিনি আমাকে কোলের মধ্যে টেনে নিলেন। আমি প্রণাম করলাম। তিনি আমাকে আশীর্বাদ করলেন। তারপর কমলালেবু, বিস্কুট, কেক খেতে দিলেন। আমি বসে বসে সেসব খেলাম।
আমার দেশের বাড়িতে ফিরে সেই আনন্দময় ঘটনার কথা প্রতিবেশী বন্ধুদের কাছে বলতেই তারা যেন আঁতকে উঠল। খেরেস্টানের বাড়ি গিয়েছিস, তাকে ছুয়েছিস তার হাতের থেকে খেয়েছিস? তুই ম্লেচ্ছ হয়েছিস, আমাদের ছুঁসনে। তারা তাদের মাকে বলল। তাদের মা ঘর থেকে একটা ছোট বাটি বার করে এনে, গঙ্গাজল ছিটাতে লাগলেন আমার গায়ে মাথায়। আমি অপ্রস্তুতের এক শেষ। কেঁদে ফেললাম। বাড়ি ফিরে মাকে বলতেই, মা বললেন, ওরা গেঁয়ো, মূর্খ- আমরা ওসব জানিনে। আমার গুরুমার কেক খেয়েছিস- বেশ করেছিস। তিনি কি আমাদের পর মানুষ?
সত্যিই তো- আব্দুল কি পর, মকফুলউদ্দীন আহমেদ স্যার কি পর- যতই লীগ নেতা হন তিনি?
প্রিয়দিদি তখন লেডী কারমাইকেলের শিক্ষিকা। তাঁর বাড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে আব্দুলের দেওয়া খাবারগুলো খেয়ে নিলাম। খানিক পরে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। আবদুল আমার সঙ্গে এল বিদায় জানাতে। তখন সে বলল, আন্টি তখন ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যে ছেলেটি এসেছে তোমার বন্ধু– হিন্দু?
বললাম, হ্যাঁ।
তিনি বললেন, তাহলে আর হলো না।
—কী?
—কাল খাবারগুলো করেছি – ভাবছিলাম দেব। ওতো হিন্দু – খাবেনাতো আমাদের খাবার।
আমি বললাম, কেন খাবে না? তাহলে আমার সঙ্গে মিশত না, বন্ধু হতো না। তুমি খেলে। আন্টি খুব খুশি হবেন।
আমি আব্দুলের দিকে তাকালাম। মনে হলো– সে যেন সুসভ্যতা আর সরলতার প্রতীক। সহসা সে আমার হাত দুটো ধরে বলল, আর বোধহয় দেখা হবে না। আমি বাবার কাছে চলে যাচ্ছি।
একা পথ হাঁটতে হাঁটতে আমার মন গাইতে থাকল-
আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে।
অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতার যে ঝড় উঠেছে তাকে ঠেকাবে কে? কৃষ্ণনগর রাজবংশের উদ্ভব ১৬০৬ খৃষ্টাব্দে, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সনদ বলে। মোগল সম্রাট অকারণে ভবানন্দ মজুমদারকে সনদ দেননি।
যশোহরের প্রতাপাদিত্যকে উচ্ছেদ করতে পারলেই সমগ্র বঙ্গদেশের ওপর মোগলশক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করা কঠিন হচ্ছিল। ভবানন্দ এককালে যশোহরে ছিলেন প্রতাপের কর্মচারী হিসাবে। পরে কোন কারণে প্রতাপ তাঁর প্রতি বিরূপ হলে তিনি যশোহর থেকে পালিয়ে আসেন।
তিনি যশোহর যাওয়ার পথঘাট এবং প্রতাপের সামরিক দুর্বলতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন। সুযোগ বুঝে তিনি মোগল সেনাপতি মানসিংহর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। মানসিংহর যশোহর অভিযানের সময় তাঁর সঙ্গী হলেন। প্রতাপের পরাজয় ঘটল। এরই পুরস্কারস্বরূপ মানসিংহর সুপারিশক্রমে রাজসনদ পেয়ে কৃষ্ণনগরে রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করলেন।
তারপর থেকে এই রাজবংশ মোগলের বশংবদ প্রিয়পাত্র হয়ে থেকেছে। নবাবের অনুগত থেকেছে। ইংরাজ শানকালেও কৃষ্ণনগরের মুসলমান সমাজ রাজবাড়ির ঘাটে মহরম উৎসব পালন করে আসছিল। হঠাৎ মহারানী জ্যোতির্ময়ী তাঁর ঘাটে মহরম উৎসব করতে নিষেধ করলেন। কেন? যতদূর জানা যায় যে – মুসলমান সমাজ রাজবাড়ির ঘাটকে তাঁদের দখলে আনতে চেয়েছিল।
সে বছর দোল আর মহরম একই সময়ে পড়েছিল। ওই ঘাটে এবার দোলের মেলা বসবে। মুসলমানরা বলল, আমরা নিষেধাজ্ঞা মানব না– ঘাটেই মহরম হবে।
অশান্তির হাঙ্গামার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। উত্তেজনায় টানটান হয়েছিল শহরবাসী। ভীতির ভাবও ছড়িয়ে পড়েছিল। মহারানী সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে কিছু বিশেষ পুলিশ কি সেনা দল আনিয়েছিলেন। ফলে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নি।
কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল হিন্দু মুসলমান– উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে। মানসিক ভাবে শহর দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
কৃষ্ণনগরে অনেক মুসলমানের বসবাস ছিল। অনেক মুসলমান পাড়া ছিল। আবার এমন অনেক পাড়া ছিল যেখানে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস করত।
আমাদের পাড়াটা ছিল এইরকম মিশ্রিত পল্লী। মনে যাই থাক, বাইরে তার প্রকাশ ছিল না কোথাও। মেলামেশা চলাচলে কোন অসঙ্গতি দেখা যেত না। শুধু লীগ দলের কর্মীদের হুংকার আতঙ্ক ছড়াত।
এছাড়া সবকিছুই স্বাভাবিক। জজকোর্টের উত্তরে ইসমাইল শেখের সাইকেলের দোকানে কাজ চলত যথারীতি। বেঁটে মোটাসোটা ভুঁড়িওয়ালা ইসমাইল মামা সাইকেল মেরামত করে চলেছেন সমানে।। পরনের ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা, গায়ে গেঞ্জি। তাঁর ড্যাম হাউন্ড কুকুর ঘিরে অনেক কটা ছোট আকারের কালো রঙের বাচ্চা কুকুর খেলা করত সেই দোকান ঘরে। বিকেলে ইসমাইল মামা ধুতি কোঁচা দিয়ে পরে, গায়ে আর্দির পাঞ্জাবি চাপিয়ে, পায়ে নিউ কাট জুতো গলিয়ে ওইসব কুকুর নিয়ে বেড়াতে বের হতেন। আমাকে বললেন, ভাগ্নে- এই কুকুর তোমার ভালো লাগে- একটা নাও। মুখে সেই হাসি।
সিং দরজার বাইরে নাতি শেখের পাউরুটির দোকান। অল্পবয়সী নাতি শেখ দোকানের সামনে বেঞ্চি পেতে বসে আগের মতই রাজা উজির মারছে। তার দোকানের সামনের গলি দিয়ে উকিলপাড়ায় যেতে স্যার মোহাম্মদ আজিজুল হকের বাড়ি। অবিভক্ত বাংলায় উনি একসময় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। পরে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন লন্ডনে। সেই সময় তিনি দেশেই ছিলেন। মাঝে মাঝে তাঁকে কৃষ্ণনগরের বাড়িতে দেখতাম। একদিন সকালে তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখলাম তিনি তাঁর বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোকের- সম্ভবত জেলাশাসকের সঙ্গে গল্প করছেন। আমি খানিক দুরে দাঁড়িয়ে তাকে ভালো করে দেখেছিলাম। কারণ আমার মাতুল পরিবারে তার কথা খুব শুনতাম। দিদিরা বলতেন, সুরেন মারা গেলে, হক সাহেব আমাদের খুব উপকার করেছিলেন।
সুরেন- আমাদের ছোট কাকা। ২৬ বছর বয়সে মেনিনজাইটিস হয়ে মারা যান। আমার বড় মামা ছিলেন জেলা বোর্ডের কর্মী। তিনি তখন চুয়াডাঙ্গায় কর্মরত। হক সাহেব জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান। মামার বাড়িতে আর কোনো পুরুষ মানুষ ছিল না।
হক সাহেব বড় মামাকে সত্বর কৃষ্ণনগরে বদলি করে আনেন। আর অসহায় পরিবার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতেন নিয়মিত। স্বাধীনোত্তর কালে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন স্মরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার বাড়ি হক সাহেবের বাড়ির কাছেই।
স্মরজিতবাবু আমার কাছে হক সাহেব সম্পর্কে অনেক কথা বলতেন। একদিন আক্ষেপ করে বললেন, ভাবতে গেলে খুব দুঃখ হয়। আমাদের যা করা উচিত ছিল তার অনেক কিছুই করা গেল না। আমরা আমাদের কাছের মানুষ আজিজুল সাহেবের কথা ভুলে গেলাম। তিনি খুব বড় শ্রদ্ধার পাত্র, বিবেকবান অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন। এখানে কতবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু দাঙ্গা লাগানো সম্ভব হয়নি শুধু হক সাহেবের জন্য। তিনি ছিলেন আমাদের গৌরব, গর্ব। কিন্তু তাঁর জন্য আমরা কী আর করলাম!
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিন্তা তখন প্রধান। কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় একটি সাহিত্য সংস্কৃতি আলোচনা সভা ডাকলেন। প্রধান বক্তা রেজাউল করিম সাহেব। করিম সাহেবের তখন খুব খ্যাতি – অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী হিসাবে। বঙ্কিমচন্দ্রকে সাম্প্রদায়িক হিসাবে চিহ্নিত করে তাঁর বিরুদ্ধে প্রবল বিষোদ্গার চলছে সমাজে। বিশেষ করে তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস নিয়ে চলছে বিতর্কের ঝড়। সেই সময় রেজাউল করিম আনন্দমঠ ও বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষ নিয়ে বিতর্কে নেমেছিলেন, গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাঁকে দেখিনি, তাঁর বক্তৃতা শুনিনি – তাই আমরা উৎসাহিত হয়ে গোলপট্টির বারোয়ারি তলায় চলে গেলাম সময় মত। বারোয়ারি ঘর তখন শ্রোতায় পরিপূর্ণ। বিকাল পাঁচটায় সভা আরম্ভ হওয়ার কথা। পাঁচটা বাজল। সভা আরম্ভ হলো না। খানিক পরে ঘোষণা করা হল – সভা হতে একটু দেরি হবে। করিম সাহেব এসেছেন। বিশেষ কারণে তাঁর সভায় আসতে দেরি হচ্ছে।
রেজাউল করিম সাহেব সভায় এলেন ছটার পর। পরনে খদ্দরের ধুতি, গায়ে গেরুয়া পাঞ্জাবী, মুখে লম্বা সাদা কাঁচা দাড়ি।
বিষয়টা এবার বললেন। করিম সাহেব বহরমপুর থেকে এসে বেলা সাড়ে চারটের সময়েই কৃষ্ণনগর স্টেশনে নেমেছেন। কিন্তু দুঃখের কথা হল এই যে লীগপন্থী ছাত্রদল তাঁকে স্টেশনের বাইরে আসতে বাধা দিয়েছেন– তাঁকে শহরে ঢুকতে এবং সভায় এসে বক্তৃতা করতে তাঁরা দেবেন না। তাঁকে বহরমপুরে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল। তাঁকে যথেষ্ট হেনস্থা করা হয়েছে। দৈহিক আঘাতও লেগেছে। বহু চেষ্টায় তাঁদের কবল থেকে করিম সাহেবকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে। এইসব কারণে সভা আরম্ভ করতে দেরি হয়েছে বলে, আমরা দুঃখিত।
১৯৪৫ সালে আমি কৃষ্ণনগর থেকে চলে এলাম মেহেরপুরে। মেহেরপুর ছোট্ট শহর। নিরিবিলি, শান্ত, গ্রামীণ পরিবেশ। কিন্তু মুসলীম লীগ তখন এখানেও বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
বাবা বললেন, রহিম লীগে যোগ দিয়েছে। এখন লীগের মস্ত নেতা। বাড়িতে সকাল সন্ধ্যা মানুষের ভিড় লেগেই আছে। খূব ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বাবা বিরক্ত। পাড়া ঘরের ব্যাপার বলে বাবা সব দেখতে পান বলেই ওই বিরক্তি। পাড়া ঘর বলতে ঠিক পাড়া নয়, পাশের পাড়ার ব্যাপার।
মেহেরপুরের পশ্চিম দিকে ভৈরব নদ। উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। শহরও সেভাবে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রসারিত। আমাদের বাড়ি উত্তর পশ্চিম প্রান্তে। নদীর কাছে। আমাদের বাড়ির উত্তরে নদীর ধারে শেখ পাড়া। দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রসারিত। তার পূবে তাঁতি পাড়া। মাঝে একটা পথ দুই পাড়ার সীমারেখা। শেখ পাড়াই মেহেরপুর শহরের শেষ পল্লী। ওই পাড়ার দক্ষিণে প্রথম বাড়িটা রহিম শেখের। পাকা বাড়ি। ওই বাড়ি পাশের পাড়ায় হলেও আমাদের বাড়ির কাছেই। দূরত্ব খুব কম– আর খোলামেলা পরিবেশ।
রহিম শেখকে আমি কাকা বলে ডাকি। তিনি আমাকে স্নেহ করেন। কেন জানি না– বাল্যকাল থেকে ওই ব্যক্তিটিকে আমার ভাল লাগে। তাই তাঁর সম্পর্কে আমার কৌতূহল বরাবর। ব্যক্তিটি ঠিক যেন সাধারণ নন। তাঁর জীবনের নানা কথা জানতে ভাল লাগে– তা নিয়ে ভেবেছিও। জীবনটা বিচিত্র বৈকি। শেখ পাড়ার মানুষ পাঠান সম্প্রদায়ভুক্ত। আচার আচরণ, চলন বলন এখানকার অন্য মুসলমান পল্লীর মানুষ থেকে ভিন্ন। বিশেষ আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, ভদ্র শান্ত চাষী সমাজ। রহিম শেখ টুকটুকে ফর্সা– রূপবান পুরুষ। বাবা জব্বার শেখ ছিলেন চাষী, দরিদ্র ব্যক্তি।
আমাদের পাড়ার খানিক দূরে ছিল তিলি পাড়া। ডাঃ রামকৃষ্ণ পাল ছিলেন সেই পাড়ার মানুষ। তিনি ছিলেন ডাক্তার। মন ছিল সমাজ সেবার দিকে। সকলকে ধরে ধরে বলতেন, ছেলেকে লেখাপড়া শেখাও, ইস্কুলে দাও। জব্বার শেখ সম্ভবত তাঁর জমি দেখাশোনা করতেন। তাঁকে ডাঃ পাল বলতেন, রহিমকে ইস্কুলে দাও। সেকালের গৃহস্থরা ছেলেদের লেখাপড়া শেখার বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দিত না। ইস্কুলে দেবার মত আর্থিক সঙ্গতিও অনেকেরই ছিল না।
ডাঃ পাল বললেন, রহিমকে আমি পড়াব। ছেলেকে আমার হাতে দাও। ডাঃ পালের নিজের বড় ছেলে ললিত। তিনি রহিমেরই সমবয়সী।
রহিম গিয়ে জুটলেন ললিতের কাছে। দুজনে পড়তে লাগলেন। ওঁরা দুই বন্ধু, খাওয়া পরা থাকা শোওয়া– সব একসঙ্গে। রহিমের সারা দিনটাই কেটে যায় ললিতের সঙ্গে।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে স্কুলে টেস্ট পরীক্ষা হয়। তাতে অঙ্কে কম পেলেন রহিম। হেডমাস্টার মশাই ডাঃ পালকে ডেকে বললেন, কোনো শিক্ষককে দিয়ে যদি রহিমকে অঙ্কটায় তালিম দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, তাহলে ওর নাম পরীক্ষার জন্য পাঠাই।
ডাঃ পাল বললেন, তাই হবে। তখন মেহেরপুর স্কুলের ছাত্রদের ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে হত কৃষ্ণনগরে এসে। রহিম ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে কৃষ্ণনগরে, সঙ্গে ললিত। বিদায় কালে ডাঃ পাল বললেন– রহিম, জুতো পরিস নি?
রহিম বললেন, জুতো নেই।
—সেকী! খালি পায়ে সেই কৃষ্ণনগর শহরে যাবি পরীক্ষা দিতে? জুতো নেই– বলিসনি কেন? তখন মেহেরপুর শহরে তৈরি জুতোর দোকান ছিল না। মুচিকে অর্ডার দিয়ে তৈরি করাতে হতো। ডাঃ পাল ভেবে পান না কী করবেন। সহসা মনে পড়ে গেল তাঁর একজোড়া জুতোর কথা। রহিমকে বললেন, দেখ তো আলমািঁরর মাথাটা।
রহিম সেখান থেকে একজোড়া জুতো বের করলেন। নতুন জুতো।
পায়ে দে। ডাঃ পাল বললেন।
রহিমের পায়ে ফিট করে গেল। হেসে উঠলেন ডাঃ পাল। বা:, বেশ হয়েছে। ভগবান জুটিয়ে দেন।
ডাঃ পালের স্ত্রী ক্ষুণ্ণ স্বরে বললেন, ওই জুতো জোড়া তুমি পরলে না! রহিমকে দিলে?
ডাঃ পাল বললেন, বলছ কী গো – এটা কত বড় কাজে লেগে গেল। রহিম পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, মানুষ হতে যাচ্ছে– তার পায়ে লাগল।
ডাঃ পালের স্ত্রীর আপত্তির পিছনে একটি ঘটনা আছে। তিনি অকারণে আপত্তি জানান নি।
মেহেরপুর স্কুলের সামনে দুটো প্রাচীন তেঁতুল গাছ ছিল। তার নীচে ছিল এক মুচির ঘর। একদিন ঝড়ে সেই বাড়ি মুখ থুবড়ে পড়ল। মুচি গেল ঘরামির কাছে। ঘর তুলে দাও। হিন্দু ঘরামি বলল, না গো, তোমার ঘর তুলতে পারব না। মুচির কাজ করব না।
মুচি গেল মুসলমান ঘরামির কাছে। সে বলল, হিন্দু ঘরামি তুলল না, তোমার ঘর। আমি কি তার চেয়ে নীচু? আমি যাব না।
মেহেরপুর শহরের কাছে বল্লভপুর, ভবাপাড়া গ্রাম। সেখানে খৃস্টান সমাজের মানুষের বাস। সেখান থেকে পাদরী সাহেব চলে এলেন মুচির কাছে। তিনি মুচিকে বললেন, প্রভু যীশুকে ভজনা করো। তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করো– তিনি তোমাকে উদ্ধার করবেন। আমরা তোমার ঘর তুলে দেব। যদি আমাদের গ্রামে যাও, তাহলে জমি দেব, ঘর দেব। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেব, তোমাকে ভালো কাজ দেব। তোমার স্ত্রীকেও কাজ দেব।
নিরুপায় মুচির মন কিছুটা টলেছিল। কিন্তু তার স্ত্রী কেঁদে খুন। জাত ধর্ম, আত্মীয় কুটুম্ব সব ছাড়তে হবে ঘরের জন্য? কিন্তু উপায় কী?
খবরটা ডাঃ পালের কানে গেল। তিনি ছুটে এলেন মুচির কাছে। সব শুনে বললেন, তুমি কিছুদিনের জন্য শ্বশুর বাড়ি চলে যাও। আমি খবর দিলে আসবে। কোনোও চিন্তা নেই তোমার। মুচি সপরিবারে শহর ছেড়ে চলে গেল।
কদিন পর ডাঃ পাল ঘরামিকে ডেকে বললেন, এই জমিটা নিয়েছি। ওখানে একটা ঘর তুলে দাও দেখি। একটা বাড়ি তৈরি করে দাও। ঘরামি লেগে পড়ল বাড়ি তৈরি করতে। মাসখানেক পর সেই নতুন ঘরে প্রবেশ করল মুচি, সপরিবারে।
কিছুদিন পর মুচি একদিন ডাঃ পালের বাড়ি গিয়ে একজোড়া জুতো দিয়ে বলল, পায়ে দেয়ে দেখুন তো। ডাঃ পাল জুতো পায়ে দিয়ে দেখলেন। ঠিক ফিট করেছে। দামী চামড়ার জুতো।
ডাঃ পাল বললেন, কত দাম?
মুচি জিভ কেটে, হাত জোড় করে বলল, ওকথা বলবেন না। যদি আমার পিঠের চামড়া দিয়ে আপনার জুতো তৈরি করে দিতে পারতাম, তাহলে আমার মনের সাধ মিটত। সেই জুতো পরল রহিম শেখ।
তিলি পাড়ার পাশেই মুখার্জী পাড়া। মুখোপাধ্যায় জমিদারদের বাড়ি। এই সঙ্গে তাঁদের আত্মীয়দের বাড়ি ঘর নিয়ে মুখার্জী পাড়া। সেই পাড়ার জমিদার বংশীয় যুবকরা কলকাতার নাট্যচর্চার প্রভাবে মেহেরপুরে নাট্যাভিনয় শুরু করলেন। ফ্রেণ্ডস ইউনিয়ন, আর অপেরা ক্লাব নামে নাট্যদল গড়ে উঠল। থিয়েটারের জন্য দৃশ্যপট চাই। জমিদার বংশীয় পাঁচুগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় দৃশ্যপট আনতে লাগলেন একের পর এক।
তিলি পাড়ায় ওঠাবসা করা রূপবান শিক্ষিত যুবক রহিম শেখ ভিড়ে গেলেন নাটকের দলে। অচিরেই সু-অভিনেতা হিসাবে পরিচিত হলেন শহরে। কিন্তু মুখার্জী পাড়ার উদ্যোগী যুবকরা একে একে মেহেরপুর ছেড়ে চলে গেলেন জীবিকার সন্ধানে। নাট্যদল ভেঙে গেল। দৃশ্যপটগুলো জমিদার বাড়ির দেউড়ির পিছনে ছোট কুঠুরিতে পড়ে থাকল অকেজো হয়ে।
পাঁচু বাবু তবলা বাজান। ধুতি পাঞ্জাবি পরে, হাতে রূপো বাঁধানো লাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়ান পথে। মস্ত বড় গোঁফ জোড়ার দিকে লোকে তাকায়। বাবা বলেন, আমাদের ড্রয়িং মাস্টার, স্কুলে অংকন শিক্ষক ছিলেন।
রহিম শেখ মোক্তার হয়েছেন। আইন ব্যবসায়ী।
মেহেরপুর থানার অধীন বল্লভপুর গ্রাম। কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের বাড়ি ছিল এখানে। মোগল সেনাপতি মানসিংহ এই গ্রামে এসেছিলেন ভবানন্দের বাড়িতে।
বল্লভপুরের দক্ষিণের গ্রামে ছিল ভবানন্দের পিতার বাড়ি। ভৈরব নদ তখন নাব্য ছিল। আর সেই গ্রাম ছিল সমৃদ্ধ। মোগল সৈন্যদের আস্তানা গড়ে উঠেছিল এখানে। তারা এখান থেকেই নৌকা যোগে প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালাত। এর ফলে এই গ্রামে অনেক বিশিষ্ট মুসলমানের বসতি গড়ে উঠেছিল। তাদেরই এক বিশিষ্ট পরিবারের কন্যার সঙ্গে রহিম শেখের বিবাহ হল। যেন বাংলার এক গভীর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেল তাঁর জীবন।
রহিম শেখ চাইলেন সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভের পথে চলতে। তখন একটাই পথ। মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার হওয়া। তিনি কমিশনার পদপ্রার্থী হয়ে নির্বাচনে দাঁড়ালেন। এবং পরাজিত হলেন।
সাহিত্যিক দীনেন্দ্রকুমার রায়ের বাড়ি মেহেরপুরে। তিনি তখন মেহেরপুরেই ছিলেন। তিনি এই নির্বাচন নিয়ে রঙ্গ-ব্যঙ্গ ছড়া লিখে ছাপিয়ে শহরের নানা স্থানে সাঁটিয়ে দিয়েছিলেন। ছড়ায় প্রথমেই রহিম শেখের নাম –
পেহের পুরে ভোট যুদ্ধের কী মহিমে
গজ কচ্ছপে লড়াই যেন খাঁ মধু আর করিমে।।
(পেহের পুর = মেহেরপুর)
নির্বাচনী লড়াই – মধুসূদন খাঁ বনাম রহিম শেখ। মধুসূদন খাঁ, তাঁতি পাড়ার বাসিন্দা– প্রৌঢ়, প্রভাবশালী ব্যক্তি। রহিম শেখ যুবক মোক্তার, জব্বার শেখের ছেলে– এই মাত্র পরিচয়। ছড়ায় তাই মধু খাঁকে তুলনা করা হয়েছে গজ অর্থাৎ হাতির সঙ্গে। সে তুলনায় রহিম হচ্ছেন কচ্ছপ, অর্থাৎ বিসম লড়াই। বলা বাহুল্য, রহিম শেখ পরাজিত হয়েছিলেন। শেখ পাড়ার মানুষই অনেকে রহিমকে ভোট দেননি।
তখন এই নির্বাচনী এলাকা ছিল শেখ পাড়া, তাঁতি পাড়া, বারুই পাড়া, কলু পাড়া, হাড়ি পাড়া ইত্যাদি পাড়া নিয়ে। এরপর নির্বাচনী এলাকায় রদবদল হলো। শেখ পাড়ার পরে মেহেরপুর সীমানার বাইরে কালাচাঁদপুর গ্রাম। সেই গ্রামটিকে মেহেরপুর মিউনিসিপ্যালিটির ভিতরে এনে, শেখ পাড়ার সঙ্গে জুড়ে একটা নতুন নির্বাচনী এলাকা তৈরি হল। কালাচাঁদপুর মুসলমান গ্রাম, শেখ পাড়া মুসলমান পল্লী। ফলে ওটা হল মুসলমান নির্বাচনী এলাকা। রহিম শেখ সেখানে নির্বাচনী লড়াইতে একটা পক্ষ। কিন্তু প্রতিপক্ষে আর কেউ নেই। কালাচাঁদপুর প্রায় নিরক্ষর চাষী, ক্ষেতমজুর দিনমজুরের গ্রাম। শেখ পাড়াও চাষীদের পাড়া, সেখানে অবশ্য কিছু শিক্ষিত পরিবার আছে কিন্তু তারা ঐসব নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামায় না। ফলে রহিম শেখ নির্বাচিত প্রতিবারই। মিউনিসিপ্যালিটিতে একমাত্র মুসলমান প্রতিনিধি। অতএব স্থায়ী ভাইস চেয়ারম্যান।
রহিম শেখ এরপর নামলেন রাজনীতিতে। প্রথমে কংগ্রেস, তারপর কৃষক প্রজা পার্টি। তারপর মুসলীম লীগ। তিনি মোক্তার। তাঁর মক্কেল সবই গ্রামের মুসলমান চাষী। মিউনিসিপ্যালিটিতে তিনি মুসলমান এলাকার প্রতিনিধি। তাঁর ভাগ্য– তাঁর নিয়তিই বুঝি তাঁকে ঠেলে দিয়েছে মুসলীম লীগের দিকে।
ডাঃ রামকৃষ্ণ পালের পুত্র ললিতও ডাক্তার হয়েছেন। কিন্তু তিনি কলকাতাবাসী। সেখানেই ডাক্তারি করেন। ডাঃ পালের আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন, আরেক মানুষ রহিম শেখ মেহেরপুরের সমাজ সংস্কৃতি, সাহিত্য তথা ইতিহাসে আশ্রয়প্রাপ্ত জননায়ক– আজ শহরের বিশিষ্ট জন। তাঁর এদিকটা কেউ তলিয়ে দেখেন না!
আমাদের বাড়ির পরিচারিকা সাবিত্রী পিসি বলে, রহিমদাদা খুব ভালো লোক। আমার ভাই দুলাল রাজমিস্ত্রী হয়েছে। কিন্তু বড় মিস্ত্রীর অধীন ছাড়া কেউ কাজে নিতে চায় না; কমবয়স, ছেলেমানুষ বলে। বড় মিস্ত্রীর সঙ্গে কাজে গেলে পুরো মজুরী পায় না। বড় মিস্ত্রী দু আনা কেটে নেয়, কাজ দিয়েছে বলে। রহিমদাদা জানে, তাই ওকে ডেকে কাজ দেয়। কে করবে এমন? একটা পয়সা চাইলে কেউ দেয় না।
প্রতিবেশী কিশোরী বসাক ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, বেটা সুধীর পরামানিক – নাপিত! তাকে ডেকে ডেকে হয়রান – কিছুতেই আসে না! কিন্তু সকালে যাও রহিমের বাড়ি– দেখবে বেটা বসে আছে।
—দাড়ি কামাচ্ছে। আমরা কি পয়সা দিইনে? রহিম এখন বড় হয়েছে, নেতা হয়েছে, পয়সা হয়েছে– লোকের মাথা কিনছে– সেখানে মাথা কুটছে বেটা নাপিত।
বললাম, আপনি কি নগদ পয়সা দেন?
—তা দেব কেন? আমাদের বছর চুক্তি। সারাবছর বাড়ি এসে চুল ছাঁটবে– বছর শেষে নেবে দুটাকা নগদ আর একজোড়া নারকেল।
—রহিম শেখ যে নগদে পয়সা দেয়।
—বছর ফুরান বলে আমাদের পয়সার কি দাম নেই?
—তা আছে। কিন্তু লোকটার প্রতিদিনের সংসার চলবে কিভাবে? আপনি নগদে পয়সা দিয়ে দেখুন আপনার ডাকেও ঠিক আসবে।
—তা দেব কেন? যা চুক্তি – তা চুক্তি –
—তাহলে সে রহিমের বাড়িতেই যাবে।
চটে গেলেন কিশোরী দাদা। বললেন, রহিমের হয়ে খুব ওকালতি করছ – যাও লীগে যোগ দাও গে – ওই ললিত বিশ্বাস উকিল লীগে যোগ দিয়ে জেলাবোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন – ওই রকম তুমিও একটা কিছু হয়ে যাবে।
এদিগরে রহিম শেখ-এর মতো মানুষ আর কেই বা আছে? শেখ পাড়া, তাঁতি পাড়া, বারুই পাড়া, কলু পাড়া, তিলি পাড়া– কোথাও নেই। বারুই পাড়ায় ওদের মোড়লের ছেলেও মোক্তার। মানুষ ভালো। মোক্তারি করেন, অবসর সময়ে নিজেদের পানের বরজ দেখেন – জমিজমা, বিষয় সম্পত্তি দেখে বেড়ান। তিনি রহিম শেখের বন্ধু, কিন্তু রহিমের বিকল্প নন। তাঁর বিকল্প নেই। তাহলে? তাঁকে মানতেই হবে। এখন দেখতে হবে তিনি নিজেকে এবং মেহেরপুরকে কোথায় কতদূর নিয়ে যান।
শেখ পাড়ার বিশিষ্ট জন ছিলেন দেওয়ানজী– আজিজ দেওয়ান। পূর্বপুরুষের কেউ হয়তো দেওয়ান ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি পথ চলতেন, মনে হতো মোগল সম্রাট বৃদ্ধ শাহজাহান চলেছেন। রূপবান দীর্ঘদেহী বৃদ্ধের পরণে থাকত লুঙির মতো করে পরা ধুতি, গায়ে আদ্দির পাঞ্জাবি, পায়ে নিউকাট জুতো, হাতে লাঠি। চলে যেতেন জমিদার ভূপতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের বৈঠক খানার দাবার আসরে। লোকে সমীহ করত এঁকে। তাঁতি পাড়ায় তাঁর বিচারকেই মেনে নিত সকলে।
এঁর পুত্র উলফাৎ হোসেন ছিল আমার স্কুলজীবনের সহপাঠী। পরনে কোঁচা দেওয়া ধুতি, পায়ে চটি, মাথায় ঘন চুল, শ্যামবর্ণ।
তখন আমি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। জ্বর হয়েছে, স্কুলে যাই নি। ঘরে শুয়ে জ্বর ভোগ করছিলাম। শনিবার। দুপুরে বাইরে থেকে কে যেন আমাকে ডাকল। ঘর থেকে বেরিয়ে সদর দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি, আমাদের বাড়ির বকুলতলার ছায়ায় উলফাৎ দাঁড়িয়ে আছে।
বললাম, কী রে?
সে বলল, হাফইয়ার্লি পরীক্ষার বাংলা খাতা বেরিয়েছে। তোর খাতাটা আমি এনেছি। নে–
খাতাটা আমার হাতে দিতে দিতে সে বলল, পাশ করতে পারিস নি – বাঙালির ছেলে হয়ে বাংলায় ফেল করলি?
সে আমাদের বকুলতলার ছায়া পেরিয়ে নির্জন পথে তাদের পাড়ার দিকে চলে গেল। আমি কতক্ষণ যে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম! তার কথাটা আমার মর্মকে এমন ভাবে বিদ্ধ করেছিল যে আজও তার সেই কন্ঠস্বর যেন স্থায়ীভাবে আমার কানে বাজে।
বাল্য কালে আমাদের পাড়া ঘরে একটা কথা খুব শুনতাম। মুসলমানরা বাঙালি নয়। বলত, না না – ওরা তো বাঙালি নয়, ওরা মুসলমান। শুনে অবাক হতাম। তাৎপর্য বুঝতাম না বলে।
বলতাম, শুধু আমরা – হিন্দুরা বাঙালি?
—হ্যাঁ।
কেউ কেউ বলতেন, আমরা বামুনরাও বাঙালি নই। আমরা কান্যকুব্জ থেকে এসেছি। আমার মাথা ঘুলিয়ে যেত।
তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের এক সহপাঠী ছিল– ব্রাহ্মণ– অত্যন্ত রক্ষণশীল এবং দাম্ভিক। ইতিহাসের ক্লাস। শিক্ষক আবদুল ওয়াহেদ। পড়ান হচ্ছিল কোনও এক মুসলমান শাসকের উৎপীড়নের কথা। সহসা ছাত্রটি উঠে বলল, স্যার – মুসলমানরা তো বিদেশী। তারা নিজেদের দেশে ফিরে গেলেই তো শান্তি ফিরে আসে।
ওয়াহেদ স্যার একটু গম্ভীর হলেন। তারপরে বললেন, তোমার প্রস্তাব সুন্দর। বিদেশীরাই যত গণ্ডোগোলের মূল। কাজেই যে বিদেশীরা আগে এসেছে তাদের আগে ফিরে যেতে হবে। তা যদি হয়, তাহলে আর্যরা– তোমরা তো আগে এসেছ– তোমাদের আগে যেতে হবে। মুসলমানরাও তার পরে এদেশ ছেড়ে যাবে।
ওয়াহেদ স্যারের এই সংযম, বিচক্ষণতা এবং বক্তব্য আমাদের কী আনন্দ যে দিয়েছিল!
উলফাৎকে একদিন বলেছিলাম, তোরা তো পাঠান, বাঙালি বলিস কেন?
সে বলেছিল, জানি, আফগান – কাবুলিওয়ালা – কিন্তু আমাকে দেখে কী তাই মনে হয়? জন্মাবধি দেখছি এই শেখ পাড়ায় বাড়ি, ভৈরবের ধারে, মেহেরপুরে; খাই ডাল ভাত ডাঁটা চচ্চড়ি, কথা বলি বাংলা ভাষায়, পরি ধুতি শার্ট, পড়ি তোদের সঙ্গে। আমিতো জানি – আমি বাঙালি। আর কী হলে বাঙালি হওয়া যায় বল।
অনেক দিন পর উলফাৎ-এর সঙ্গে দেখা হলো। বিকালবেলা শেখ পাড়ার পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেও পথে বেরিয়েছিল। বলল, কিরে, কবে এলি?
—এই তো কদিন আগে। তুই কেমন আছিস?
—চলছে।
—মোক্তারের দলে ঢুকেছিস নাকি?
--না। ওখানে আমরা যেতে পারি! ওসব রাজা বাদশা হওয়ার ব্যাপার। আমাদের নেবে কেন?আমি পাঠশালায় একটা শিক্ষকতা পেয়েছি। সেই কাজ করি। আর একটা কাজ করছি।
—কী কাজ?
—ফকিরী তত্ত্ব শিখছি। ফকিরী গান সংগ্রহ করছি। ওসবতো হেঁয়ালি গান – তার প্রকৃত অর্থ খুঁজে বার করছি। এখন সেই ফকিরদের আসরে যাচ্ছি– কাছেই এক গাঁয়ে। সেখানে অনেক ফকির আসে। সে একটা জগৎ-- দারুন ব্যাপার – মোক্তারের কথা মনেই থাকেনা।
উলফাৎ-এর এই সব কথাবার্তা শোনার পর আমার মনে অন্য একটা চিন্তা জাগল।
রহিম শেখ কংগ্রেস ছেড়ে গেলেন কৃষক প্রজাপার্টিতে, শেষে মুসলীম লীগ দলে। এ যেন মুসলমান জীবনের পরিণতি। উলফাৎ নিজেকে বাঙালি বলে, বাঙালির মতই থাকে। সে রাজনীতি করে না, লীগ দলে যায় নি। কিন্তু মানসিক তৃপ্তি পেতে চলেছে গ্রামের দিকে – মুসলমান ফকিরদের আসরে বসতে। ফকিরী তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় বুঁদ হবে। সে মেহেরপুর শহর সমাজে যায় না। শহরের সঙ্গে তার যেন কোনও যোগই নেই।
শহর সমাজে বিনোদনের কিছু ব্যবস্থা আছেই। কৃষ্ণযাত্রা, যাত্রা দল, থিয়েটার দল, গান বাজনার দল। আশ্চর্য কথা – তার ভিতর কোথাও মুসলমান সদস্য নেই। অথচ মুসলমান পল্লীগুলো মেহেরপুরের প্রান্তসীমাকে মালার মত ঘিরে আছে। তারা কেউ শহর-সংস্কৃতির অংশীদার নয়।
উলফাৎ-এর মতই তারা আছে তাদের নিজেদের সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে। তাদের সেই সংস্কৃতির কি কোনো স্বীকৃতি আছে শহর সমাজে? তাদের জারি, ধুয়ো জারি কিম্বা বোলান কিম্বা অন্য কিছুর আসর বসে শহরে, তখন সেখানে ভীড় জমে গ্রামের মানুষের– মুসলমানদের।
শহর সমাজ থাকে উদাসীন। তাদের কাছে ওসব গুরুত্বহীন। তাদের আসর জমে শ্যামাসংগীত, কীর্তন কিম্বা কৃষ্ণযাত্রায়।
স্পষ্ট বিভাজন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে। এখন রাজনৈতিক ডামাডোলে সেটা ক্রমেই হয়ে উঠছে বিপজ্জনক।
হিন্দু সমাজেই কি ঐক্য আছে? যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল তাঁর তপশীল সম্প্রদায়কে নিয়ে যোগ দিয়েছেন মুসলীম লীগের পক্ষে। হিন্দু নেতৃত্ব তাঁদের ধরে রাখতে পারেনি নিজেদের পক্ষে। কিন্তু তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলেছে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ – চাপান উতোরের পালা।
হিন্দুরা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে বলছেন, যোগেন আলি মণ্ডল। কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্যরা পালটা জবাব দিচ্ছেন, আজাদ বাবু কেমন আছেন?
যোগেন্দ্রনাথ লীগ পক্ষে তাই যোগেন আলি। তাহলে মৌলানা আজাদ কংগ্রেস সদস্য হওয়ায় আজাদ বাবু নন কেন?
কম্যুনিস্ট পার্টির মতে কংগ্রেস হচ্ছে হিন্দুদের দল। মুসলিম লীগ হচ্ছে ভারতীয় মুসলিমদের দল– মুখপাত্র। একমাত্র ধর্ম নিরপেক্ষ দল হচ্ছে কম্যুনিস্ট পার্টি।
সমাজ জুড়ে চলেছ – এই রাজনৈতিক কার্যকলাপ।
মেহেরপুর সমাজেও এই হাওয়া বেশ প্রবল।
(ক্রমশ)