সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
দেশ যখন বিভিন্ন এবং বিবিধ সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এবং সামনে লোকসভার নির্বাচন ২০২৪ আগত, তার আগে চমক সৃষ্টি করতে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের জুড়ি মেলা ভার। কর্পোরেট ব্যবস্থায় সংস্কৃতি হচ্ছে সবকিছু চক চকে মোড়কে হাজির করা। বিষয় বস্তু অসার এবং নতুনত্ব কিছু নেই এমনই এক সংস্কৃতিকে নির্ভর করে বর্তমানের কর্পোরেট পরিচালিত সরকার তিনটি বিলের খসড়া মানুষের কাছে উপস্থিত করলেন। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে সমস্তটাই আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আরেকটি প্রচার পাওয়ার চেষ্টা যা আক্ষরিক অর্থেই নতুন বোতলে পুরোনো মদ।
তিনটি বিল হল (১) ভারতীয় সাক্ষ্য বিল (২) ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (৩) ভারতীয় নয়া সংহিতা। আদতে যা হচ্ছে ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট ১৮৭২, কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিউয়ার ১৯৭৩ ও ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১৮৬০। সবই ব্রিটিশ সাহেবদের করে যাওয়া আইন। কোড অফ ক্রিমিনাল প্রসিডিউয়ার ১৯৭৩ সালের হলেও আদতে এই আইনটি ১৮৯৮ -এ সাহেবদের করা আইন। ভারতীয় সাক্ষ্য বিল ২০২৩ ব্রিটিশদের করে যাওয়া ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট ১৮৭২ এর প্রায় হুবহু নকল। প্রতিটি বিলকেই উত্তর ভারতের ভাষার অনুকরণে নামকরণ করা হয়েছে, যা আসলে সনাতন ধর্মের পুরোনো আইনের সংহিতা। যেমন – মনুসংহিতা, পরাশর সংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা ইত্যাদি। কুড়িজন মুনি কথিত বা রচিত আইন যেটি হিন্দু শাস্ত্রের একটি বড় অংশ। সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত শব্দ হল সংহিতা । নামকরণের মধ্যেই উদ্দেশ্য পরিষ্কার।
‘ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট’ বা ‘ভারতীয় সাক্ষ্য আইন’ ১৮৭২ সালে সাহেবরা এদেশে চালু করে। নতুন শাসন ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে। এই আইন একই সঙ্গে মানুষের ওপর অবিচার ও আইনের পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে । ব্রিটিশ এই দেশ থেকে চলে যাওয়ার পরে এই দেশের শাসকরা হুবহু ব্রিটিশ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে। আসলে ব্রিটিশ আইনি ব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত করার কোন পদ্ধতি বা যোগ্যতা দেশীয় শাসকদের হাতে ছিল না। তাঁরা মূলত ইউরোপীয় ধাঁচায় সংবিধান তৈরি করে ব্রিটিশদের পদ্ধতি গ্রহণ করে। পরবর্তী ক্ষেত্রে দেখা গেল যে ব্রিটিশদের করে দেওয়া আইনকে বদল করাটা খুবই দুরূহ এবং এর জন্য যে ধরনের কেরামতি বা মেধা প্রয়োজন তা এই শাসককুলে মজুদ নেই । অথচ আজ আমরা স্বীকার করি বা না করি, এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে এই আইনি ব্যবস্থা মানুষের আশা-আকাঙক্ষা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। দিনের পর দিন চলতে থাকা মামলার সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি হয়ে গেল । কিন্তু উপায় তো নেই, সুতরাং পুরোনো আইন নতুন কলেবরে । সঙ্গে চলবে প্রচার যে আমরা ব্রিটিশ আইন বাদ দিয়ে দিয়েছি।
সাধারণভাবে যদি ব্রিটিশদের করা ‘এভিডেন্স অ্যাক্ট’ আর বর্তমান সরকারের ‘সাক্ষ্য বিল ২০২৩’ পাশাপাশি রেখে পড়া যায়, তাহলে দেখা যাবে দুটো আইন-ই হুবহু এক। বিভিন্ন পরিভাষায় সংজ্ঞা দেওয়া থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত সাক্ষীর সাক্ষ্যদান পর্যন্ত একই রকম। শুধুমাত্র কিছু ধারার নাম্বারে অদল বদল করা হয়েছে এবং কিছু কিছু জায়গায় বাক্যগঠনের জায়গা পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন যা কিছু সংযোজন করা হয়েছে তা হল ইলেকট্রনিকস বা ডিজিটাল পদ্ধতি সাক্ষ্য আইনের মধ্যে সংযোজন করা। যেমন ‘ডকুমেন্ট’ বা নথি বা প্রমাণ পত্রের উদাহরণের সঙ্গে ইলেকট্রনিকস ও ডিজিটাল রেকর্ডও স্থান পেয়েছে। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন, মেসেজ বা বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে ই-মেল, সারভার লগ, ইত্যাদি এই মামলার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় রোমান হরফের জায়গায় ইংরাজি হরফ স্থান পেয়েছে। কোনও কোনও জায়গায় বাক্যের অর্থ এক রেখে পুনর্গঠন করা হয়েছে ।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে একটা বা দুটো শব্দ যোগ করা হয়েছে। যেমন, নতুন আইনে ‘কনফেশন’ বা স্বীকারোক্তির গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে ‘কোয়ার্শন’ বা ‘জবরদস্তি‘ শব্দটা যুক্ত করা হয়েছে নতুন আইনের
২২ নং ধারায়। কিছু জায়গায় আবার অনেকগুলো ধারাকে একসঙ্গে যুক্ত করে একটি ধারায় আনা হয়েছে। যেমন - ‘পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি’ পুরনো আইনে ২৫, ২৬, ২৭ নং ধারা, নতুন আইনে
২৩ নং ধারায় একসঙ্গে বর্ণনা করা হয়েছে । অনুরূপভাবে, চাপের মুখে স্বীকারোক্তির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পুরনো আইনের ২৪ নং ধারা এবং ২৮ নং ধারা, একসঙ্গে নতুন আইনের ২২ নং ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে ।
নতুন আইনের ২৪ নং ধারায়, পুরোনো আইনের ৩০ নং ধারায় গৃহীত এক অভিযুক্তর স্বীকারোক্তি অন্য অভিযুক্তর ওপর বর্তাবে কিনা তাই নিয়ে নতুন সংযোজন করা হয়েছে। যেখানে এই স্বীকারোক্তি পলাতক অভিযুক্তের ওপরেও আরোপিত হবে। এটি নতুন সংযোজন। অর্থাৎ, একজন অভিযুক্তের যিনি ফেরারি তাকে যুক্ত করা হচ্ছে সেই অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি দ্বারা। নিজের বক্তব্য শোনার সুযোগ নেই ।
আরো সংযোজন প্রাথমিক সাক্ষ্যর সংজ্ঞায় যা নতুন আইনে ৫৭ নং ধারা এবং পুরোনো আইনে ৬২ নং ধারা। এখানে ইলেকট্রনিক এবং ডিজিটাল রেকর্ডকে প্রাথমিক সাক্ষ্য বা প্রাইমারি এভিডেন্স হিসেবে ধরা হয়েছে। ইলেক্ট্রনিক ও ডিজিটাল রেকর্ডের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সরলীকরণ করা হয়েছে। পুরোনো আইনে ৬৫ বি ধারায় আদালতে গ্রহণযোগ্যতায় যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে যাতে জাল নথিকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা না হয়, কিন্তু নতুন আইনের ৬১ নং ধারায় সেসব আর নেই । আজকের আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ আই)-এর যুগে এর প্রয়োগ যে কী হবে তা বাস্তবতাই বলতে পারবে। একটা কথা বলা যেতে পারে যে, যার হাতে প্রযুক্তির ক্ষমতা থাকবে তিনি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারবেন ।
নতুন আইনে কিছু কিছু শব্দ বাদ দেওয়া হয়েছে এবং সেটা সংগত কারণেই যেমন পুরোনো আমলের রাজা, রানি, ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ইত্যাদি । যেগুলোকে বাদ দেওয়ার জন্য নতুন নতুন নামধারী আইনের কোনও বাস্তবিক প্রয়োজনীয়তা ছিল না ।
সাক্ষ্য আইনের শেষের দিকে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণের অধ্যায়ে ‘সাক্ষী জেরা’, পুনরায় সাক্ষীর যে পুরোনো ধারায় ১৩৭ নং-এ ছিল, তা নতুন আইনের ১৪২ নং ধারায় বলা হয়েছে এবং শুধুমাত্র শিরোনাম বদলানো হয়েছে। অনুরূপভাবে, লিডিং প্রশ্নের ব্যাখ্যায় নতুন বাক্য সংযোজন হয়েছে যাতে বলা হয়েছে সেই প্রশ্ন ‘লিডিং’ হবে যে প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর বলে দেওয়া আছে। যদিও এই প্রশ্নে আদালত ‘লিডিং প্রশ্ন’ এর ব্যাখ্যা বিভিন্ন রায়দানের মধ্যে দিয়ে ইতিমধ্যে বলে দিয়েছে। নতুন আইনের ১৬৫ নং ধারা এবং পুরোনো আইনে ১৬২ নং নথি বা ডকুমেন্ট নথি বা ডকুমেন্ট আদালতের সামনে আনার কথা বলা হয়েছে। পুরোনো এবং নতুনে কোনও তফাৎ নেই শুধু নতুন আইনে মন্ত্রিদের এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যেকার বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত যোগাযোগের নথি আদালতে আনা যাবে না। এর ফল কী হবে তা ভবিষ্যতই বলতে পারবে, কিন্তু তথ্য জানার অধিকার সংকুচিত হল।
এই নতুন আইনটিকে আর যাই হোক নতুন বলা যায় না । শুধুমাত্র সময় উপযোগী কিছু পরিভাষাযুক্ত হয়েছে বা পরিমার্জনা হচ্ছে যেটা পুরোনো আইনের সাধারণ সংশোধন দিয়েই করা সম্ভব ছিল , বা নতুন আইনের কলেবরের প্রকৃত প্রয়োজন একেবারেই নেই ।
এই আইনগুলি নিয়ে সরকার পক্ষ নিজেও দ্বিধাগ্রস্ত । অথচ নির্বাচনের আগে যে করে হোক এই আইন পাশ করিয়ে নিয়ে আগামী নির্বাচনে শোরগোল ফেলতে চাইছে সরকার পক্ষ। সুতরাং এই তিনটি বিল সংসদে পেশ করেও তুলে নেয় , পরে আবার বিলগুলি পেশ করে।
এই বিষয়ে আলোচনার সময়ও রেখেছে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। সিলেক্ট কমিটির বহু সদস্য আইনগুলির নাম বদলানোর বিরোধিতা করেছে। কিন্তু জল যেদিকে গড়াচ্ছে সংখ্যাধিক্যের জোরেই সরকার বিলগুলো পাশ করিয়ে নেবে বলেই মনে হয়, আগামি দিনগুলোতে মানুষ আরও বিভ্রান্ত হবেন। আইন আদালতের কাজকর্ম বিঘ্নিত হবে, জটিল হয়ে উঠতে পারে। বিলম্বিত বিচার আরও বিলম্বিত হবার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে প্রবলভাবে।