সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
মহাবিশ্বের অন্য কোনো গ্রহে প্রাণের চিহ্ন আছে কিনা তা নিয়ে অনুসন্ধান চলছে অবিরাম, কিন্তু আমাদের এই গ্রহটির প্রতি অণু-পরিমাণ স্থানেও যে প্রাণের বিপুল প্রবাহ তরঙ্গিত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত, তা প্রকৃতপক্ষেই বিস্ময়কর। প্রতি নিশ্বাসে নেওয়া হাওয়াতে হোক, ফেলে রাখা এক গেলাস জলে হোক, বা বিস্তীর্ণতর কোনো পরিসরে হোক – সর্বত্র তার স্বাক্ষর। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই কেমন সে প্রবাহে স্নানের আনন্দ পাওয়া যায়, সেই নিয়েই কিছু কথা এখানে রইলো।
বাড়ির বাগান অনেকের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শহর বা শহরতলী অঞ্চলের বাড়িতে জায়গা অপ্রতুল হওয়ায় এখন অধিকাংশ বাগান, বাড়ির ছাদে ঠাঁই পেয়েছে। আমারও তেমনই একটা ছোট্টো বাগান আছে, বাড়ির ছাদে। নিয়মিত সেই বাগানের দেখাশোনা করা আমার অবসর সময় কাটানোর একটি অন্যতম অংশ। একদিন বাগানের পরিচর্যা করার সময় দেখলাম, আমার ছোট্টো জবাফুলের গাছটায় প্রচণ্ড পিঁপড়ের উপদ্রব হয়েছে। বিভিন্ন রকমের, বিভিন্ন রঙ ও আকারের পিঁপড়েতে ছেয়ে গেছে গোটা গাছটা। কিন্তু ওরা জবা গাছের কোন অংশটা ভক্ষণ করছে? সময়টা শীতকাল, ফুলও তেমন ফুটছে না যে ফুলের মিষ্টি মধুর টানে ওরা একত্রিত হয়েছে। শুরু হলো তদন্ত।
লক্ষ্য করলাম গাছটির পাতা এবং কচি ডালগুলো এক রকম সাদা সাদা পোকায় ছেয়ে গেছে। পিঁপড়েরা তাদের চারপাশেই ঘোরাঘুরি করছে। আশ্বস্ত হলাম, এবার পিঁপড়েগুলি ঐ পোকাদের খেয়ে শেষ করে ফেলবে। তবে, মনে একটা প্রশ্ন ছিল শুধুমাত্র জবাগাছেই না কি আরও কোনো গাছে ওই পোকাদের আক্রমণ হয়েছে? খুঁজতে গিয়ে দেখি সিমগাছটারও ওই একই অবস্থা, তবে সেখানে পোকাগুলি কালো রঙের। আবার, টবের কোনায় বীজ পড়ে কতগুলো সর্ষের চারা হয়েছে। তাদের মধ্যেও ঈষৎ-সবুজ-হলুদ বর্ণের পোকা লেগেছে। বাকী গাছগুলো সুস্থ। পোকাগুলির নাম তো জানতে হয় এবার! জানতে পারলাম, সাদা পোকাগুলি মিলিবাগ আর কালো ও সবুজাভ পোকাগুলি এ্যাফিড (aphid)। কয়েকদিন পরে আবার আক্রান্ত গাছগুলোর কাছে গেলাম, দেখলাম পোকাগুলো কমেনি তো বটেই বরং সংখ্যায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে কি পিঁপড়েগুলো ওদের খাচ্ছে না? শুরু হলো অনুসন্ধান। না, পিঁপড়েগুলো ওদের খাচ্ছে না! ওরা গায়ের থেকে একধরনের রস ক্ষরণ করছে আর পিঁপড়েরা ওই রস মহানন্দে সংগ্রহ করছে। আমরা যেমন গরু-ছাগল প্রতিপালন করি দুধ পাওয়ার জন্য, কিন্তু গরু ছাগলের কোনো ক্ষতি করি না – ব্যাপারটা তো কিছুটা সেই রকমই! কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতে পোকাগুলোর কী লাভ? বিনা কারণে তো এই প্রকৃতিতে কিছু হয় না। যাই হোক, বিরক্ত হয়েই কয়েকটা মিলিবাগকে হাত দিয়ে টিপে মেরে ফেলতে গেলাম। দেখি, সব পিঁপড়েগুলো ক্ষেপে গিয়ে আমাকে আক্রমণ করেছে। বুঝতে অসুবিধে হলো না, আত্মরক্ষার জন্যই ওরা পিঁপড়েদের ঘুষ দিয়ে চলেছে। কিন্তু শুধু কি মানুষ? মানে, মানুষের হাত থেকে বাঁচতেই কি ওরা পিঁপড়ের সঙ্গে সহজীবিতা গড়ে তুলেছে? এটা কী করে সম্ভব?
শুরু হলো মিলিবাগ কলোনী পর্যবেক্ষণ। প্রথম কয়েকদিন উত্তর মিললো না। তারপর লক্ষ্য করলাম, কিছু পোকা যা পিঁপড়ের থেকেও অনেক ছোটো, প্রায় ১-২ মিলিমিটারের মতো, তারা ওই মিলিবাগগুলোর পিঠে বসছে, আর তখনই মিলিবাগরা তাদের শরীরের পিছনের দিকের অংশটা উত্থিত করছে। সঙে সঙ্গে পিঁপড়েরা দলে দলে ঐ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পতঙ্গগুলিকে আক্রমণ করছে। প্রসঙ্গত, পতঙ্গগুলো বোলতার সমবর্গীয়। যাই হোক, পিঁপড়েদের আক্রমণের ফলে ওরা ওই কলোনী ছেড়ে যেখানে পিঁপড়েদের ঘনত্ব কম এমন মিলিবাগ কলোনীতে গিয়ে বসছে। কিন্তু ওই পতঙ্গগুলির সঙ্গেই বা মিলিবাগদের সম্পর্ক কেমন? আবার শুরু পর্যবেক্ষণ। কি বিস্ময়কর! বোলতার মতো পতঙ্গগুলি তাদের পেটের শেষভাগ থেকে একটা সূক্ষ্ম সূঁচের মতো অংশ বের করে মিলিবাগগুলোর শরীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আর ব্যথায় মিলিবাগরা পিঁপড়েদের কাছে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠাচ্ছে। তখনই পিঁপড়ের দল ঐ পতঙ্গদের আক্রমণ করছে। কিন্তু ঐ ইঞ্জেকশন দেওয়ার ব্যাপারটা আসলে কী? একটি মিলিবাগ যে ওইভাবে হুলবিদ্ধ হয়েছে, তাকে ট্যাগ করলাম। দেখলাম, ২-৩ দিন পরে ঐ মিলিবাগটি স্থবির হয়ে পড়েছে। একটা সরু পাখির পালকের অংশ দিয়ে ওর শরীরের উপর বুলিয়ে দিলাম। না, প্রাণের কোনো স্পন্দন খুঁজে পেলাম না। কী মনে হলো, জবাগাছের ডালসমেত মিলিবাগটাকে কেটে এনে একটি কৌটোর মধ্যে সংগ্রহ করলাম। বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে গেলো, নতুন কিছু দেখতে পেলাম না। তবু আশা ছাড়িনি, কারণ মিলিবাগটা মরে গেলেও তা তখনও শুকিয়ে যায় নি। আরো কয়েকদিন (মোট ৮-৯ দিন) অপেক্ষা করার পর ফল পাওয়া গেলো – দেখলাম, একটা ছোট্টো পতঙ্গ ঐ মিলিবাগটির শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। মুক্ত করে দিলাম ঐ ছোট্টো প্রাণটিকে। বুঝলাম, ঐ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বোলতাগুলি আসলে মিলিবাগদের ডিম পাড়বার স্থান হিসাবে নির্বাচন করে এবং ওই মিলিবাগদের মধ্যেকার জীবিত অংশই ডিম-ফোটা বাচ্চাদের প্রথম খাদ্য। এই ঘটনাকে বিজ্ঞানের ভাষায় Parasitoidism বা পরজীবিতা বলে।
এবার সিম ও সর্ষে গাছের গায়ে লেগে থাকা যথাক্রমে কালো ও হরিদ্রাভ aphid-দের বর্ণনায় আসা যাক। এদের ঘটনাও কিছুটা একইরকম। তবে এক্ষেত্রে বোলতাবর্গীয় পতঙ্গগুলি ভিন্ন প্রজাতির। তবে এক্ষেত্রে আরও কিছু চমকপ্রদ ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করেছি এবং পরবর্তী অংশে রইলো তারি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।
বোলতারা ছাড়াও, কিছু মাছি (Hoverfly) ওই এ্যাফিডদের সঙ্গে যুক্ত। Hoverfly-রা আসলে মৌমাছি-সদৃশ একটি পতঙ্গ এবং এই মাছিগুলি পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় ফুলের মধু খায় ও ফুলের পরাগমিলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। একটি প্রতিবেদন পড়ে জেনেছিলাম, এই Hoverfly ও অনুবর্গীয় কিছু মাছি ফুলের পরাগমিলনের ক্ষেত্রে মৌমাছির থেকেও বেশী দক্ষ। যাই হোক, প্রসঙ্গে ফেরা যাক। এই Hoverfly-রা ঐ Aphid কলোনীর মধ্যে গিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমগুলি থোকায় থোকায় পাড়তে দেখেছি। মজার ব্যাপার হলো, যখন ঐ ডিম ফুটে ম্যাগট (মাছির লার্ভাকে ম্যাগট বলে) বেরিয়ে আসে, তখন ওই রাক্ষুসে ম্যাগটগুলি সরাসরি এ্যাফিডগুলোকে জীবিত খেতে থাকে, যেন তারা এ্যাফিড সংহারের মেশিন। এক্ষেত্রেও আরও একটা গুরুতর ব্যাপার আমি দেখেছি। এক্ষেত্রেও কিছু বোলতার ভূমিকা আছে, যারা ১-১.৫ মিলিমিটার, কিম্বা কিছু ক্ষেত্রে আরও কম, লম্বা। এদের মধ্যে কিছু পতঙ্গ সরাসরি এ্যাফিডের শরীরকে বিদ্ধ করে তাদের মধ্যে ডিম ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কিছু আবার এ্যাফিডগুলিকে চোয়ালে চেপে ধরে উড়ে যাচ্ছে। প্রথম ঘটনাটি আগে মিলিবাগদের ক্ষেত্রে বর্ণনা করা অংশটির মতোই। কিন্তু যারা এ্যাফিডদের উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের ব্যাপারটা কী? মুশকিল হচ্ছে, ওরা এতোটাই ছোটো যে মুহূর্তের মধ্যে দৃষ্টির অগোচরে হারিয়ে যায়। ফলে ওদের পিছু নেওয়া অসম্ভব। রহস্য একটা রয়েই গেলো।
একদিন সকালে ঘরে বসে আছি। দেখলাম, আমাদের অ্যাকোয়ারিয়ামের পাশে প্রচুর লাল পিঁপড়ে জড়ো হয়েছে। একটা পালকের ঝাড়ু ব্যবহার করে ঝেঁটিয়ে বিদায় করলাম ওদের। ৪-৫ ঘন্টা পরে আবার একই অবস্থা। কী ব্যাপার? কোনো খাবারের টুকরো তো পড়ে নেই! তাহলে পিঁপড়েগুলো কী করছে? এবার তদন্ত শুরু। বহুসংখ্যক ছোটো ছোটো এ্যাফিড পড়ে আছে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে, এবং সবাই মৃত। ওই এ্যাফিডগুলিকে সংগ্রহ করতেই পিঁপড়েরা দলবদ্ধ হয়েছে। বসে রইলাম কিছুক্ষণ, কে ঐ এ্যাফিডগুলো এখানে আনছে তা জানতে। বেশীক্ষণ লাগলো না – দেখলাম, যে বোলতাগুলো এ্যাফিডদের উড়িয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল, এটা তাদেরই কম্মো। আমার অ্যাকোয়ারিয়ামটা যে প্লাইউডের ওপর রাখা তার গায়ে অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ছিদ্র করে তারা বাসা বেঁধেছে। কিন্তু সেই বাসার মুখ এতই সূক্ষ্ম যে একটু বড়ো আকারের এ্যাফিডও তার মধ্যে ঢুকছে না। তাই যেগুলো ঢুকছে, তাদের ওই প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করাচ্ছে, বাকীদের বাইরে ফেলে দিচ্ছে। অর্থাৎ, ঐ প্রকোষ্ঠে যে এ্যাফিডগুলো ঢুকছে, তারা ঐ বোলতাদের লার্ভার খাদ্য হচ্ছে ও তাদের জৈবচক্র সম্পূর্ণ হচ্ছে। অবাক হলাম ঐ পিঁপড়েগুলোর কথা ভেবে – যে এ্যাফিডগুলির জীবিত অবস্থায় ওরা আগলে রেখে রক্ষা করছে, মরে গেলে তাদেরই খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করছে। সত্যি, পৃথিবীতে কোনোকিছুই নষ্ট হয় না। যাই হোক, এখন যদি ধরে নিই মিলিবাগ আর এ্যাফিডরা আমাদের শত্রু পতঙ্গ যেহেতু তারা আমাদের শখের গাছগুলোর ক্ষতি করে, তবে ওই বোলতাবর্গীয় পতঙ্গরা তো আমাদের বন্ধু পতঙ্গ হবে। এমনকি ঐ হোভারফ্লাই-এর ম্যাগটরাও আমাদের বন্ধু। এক্ষেত্রে বলা দরকার, আমি এমন কিছু বোলতাও দেখেছি যারা ঐ ম্যাগটগুলির শরীরে তাদের ডিম প্রোথিত করে ও জীবনচক্র সম্পন্ন করে। সুতরাং বোলতামাত্রেই আমাদের বন্ধু এমন সিদ্ধান্তেও আসা যাচ্ছে না। কী জটিল একটা অবস্থা! এমন জটিলতার অনুধাবন থেকেই কি তবে ‘সৃষ্টি-রহস্য’ কথাটি আমাদের ধারণায় এসেছে!
এবার একটা অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। আমাদের গায়ে পিঁপড়ে বা মৌমাছি কামড়ালে বা শুঁয়োপোকা লাগলে যেমন প্রদাহ হয় ও জায়গাটা ফুলে ওঠে, ঠিক তেমনই গাছের যে অংশে এ্যাফিড আক্রমণ করে সেই অংশটাও তেমনই ফুলে ওঠে। বিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম Gall। শুধু এ্যাফিডের আক্রমণই নয়, কিছু বোলতার ডিম পাড়া, মাকড়ের আক্রমণ, কৃমির বা ছত্রাকের আক্রমণ বা অন্যান্য পতঙ্গের আক্রমণেও Gall তৈরী হতে পারে। এই Gall হলো নিজেই একটা জগৎ। আমি এখানে এ্যাফিড দ্বারা সৃষ্ট Gall নিয়েই কিছু পর্যবেক্ষণ রাখবো। Gall সাধারণত দুরকম দেখেছি – নিরেট ও ফাঁপা। ফাঁপা Gall-এর মধ্যে সচরাচর কোনো পতঙ্গের অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থা অতিবাহিত হয়। তবে কিছু কিছু বোলতা আছে যাদের জীবনচক্র সম্পূর্ণভাবে ওই Gall-দের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ Gall না থাকলে তারা পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাবে। দেখেছি বোলতাগুলি তাদের ডিম ওই Gall-এর মধ্যে প্রোথিত করে। মনে রাখতে হবে, নিরেট Gall-এ, বোলতার লার্ভাগুলি গাছেরই রসালো অংশ ভক্ষণ করে বড়ো হয় ও জীবনচক্র সম্পূর্ণ করে। বিপরীতে, ফাঁপা Gall-এ, ওর মধ্যে যে অপ্রাপ্তবয়স্ক পতঙ্গ রয়েছে তার শরীরের অংশ খেয়ে বোলতার লার্ভাটি বড়ো হয়। Gall-এর মধ্যে আমি প্রায় পাঁচটি বিভিন্ন প্রজাতির বোলতার জীবনচক্র দেখেছি। তা ব্যতীত আরও কতপ্রকার এমন জীবনপ্রবাহ চলে তা নিবিড়তর
পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষ।
বোলতা-কথা তো অনেক হলো। এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। আমি আমার গাছগুলির খাদ্য হিসেবে সর্ষের খোল আর গোবর সার পছন্দ করি। তাই একটা বস্তায় ভরে গোবর সার ছাদের এক কোণায় মজুত রাখি। একদিন মনে হলো, ছাদটা একটু পরিষ্কার করা দরকার। কুঁড়েমি করে প্রায় বছরখানেক ছাদটা পরিষ্কার করি নি। আমার ছ’বছরের ছেলে জানালো সে আমাকে সাহায্য করবে। ছাদ পরিষ্কার প্রায় শেষ, গোবর সারের বস্তাটা সরালাম। দেখি একধরনের কালো পিঁপড়ে বস্তার তলায় বসতি গড়েছে। বস্তাটায় নাড়া পড়তেই ওবা চঞ্চল হয়ে উঠলো। মুখে নিজেদের ডিম উঠিয়ে নিয়ে ওরা উন্মাদের মতো এদিক-ওদিক ছুটে চললো। কিন্তু এর মধ্যেও তো আছে অন্য এক জীবন-মরণ খেলা! শুধুমাত্র পিঁপড়ে ন্য, একধরনের মাকড়সাও তো রয়েছে ওদের বাসায়! খুব ছোটো, পিঁপড়েরই আকারের। দেখলাম, ঐ পিঁপড়েদেরই শিকার করছে মাকড়সাটি। কিছু ছবি তুললাম। জানলাম ঐ মাকড়সার পরিচিতি – Zodarion sp; এরা পিঁপড়ের কলোনীতে থাকে আর তাদেরই ভক্ষণ করে। কিন্তু পিঁপড়েরা তাদের শত্রুকে কেন তাদের কলোনীতে ঠাঁই দেয়? আসলে পিঁপড়েরা (অধিকাংশ প্রজাতি) অন্ধ, তারা ফেরোমোন নামে একধরনের গন্ধযুক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে বার্তালাপ করে। আর এই সু্যোগের সদব্যবহার করে মাকড়সাটি। পিঁপড়েদের বোকা বানাতে সেও একই রকমের ফেরোমোন নির্গত করে। এতে পিঁপড়েরা তাকে আলাদা করে চিনতে পারে না। ফলে মাকড়সাটি পিঁপড়ে-কলোনীতেই খাদ্য, আশ্রয় ও সুরক্ষা সব একসাথে পেয়ে যায়। ওদিকে আমার ছেলে আবার চেঁচিয়ে উঠলো, “বাবা, দ্যাখো এখানে একটা ছোট্ট কাঁকড়াবিছে”। দৌড়ে গেলাম। সত্যিই তো! অবিকল কাঁকড়াবিছে। শুধু তফাৎ হলো লেজটা নেই, আর আকার প্রায় একটা সর্ষেদানার মতো। ওকে জানালাম – এটা কোনো কাঁকড়াবিছে নয়। তবে, তার মতোই। এর নাম সিউডোস্করপিয়ন বা নকল কাঁকড়াবিছে। এরা গাছের পচা অংশ ও খুব ছোটো কীট-পতঙ্গ খেয়ে বাগান পরিষ্কার রাখে। ও বললো, “তবে তো এটা খুব কাজের, ওকে ছেড়ে দাও”। আদেশ পালন করা হলো।
তাহলে আমাদের চারপাশেই, বাগানে, ঘরের কোণে বা পুকুরপাড়ে কান পাতলেই শোনা যায় এতো এতো জীবনের গল্প! একবার ভাবুন, শুধু বাগানটাই এতো বিস্ময়কর হলে একটা জঙ্গল বা মাঠ বা বিশাল সমুদ্র ও তার তটভূমি কতোটা বিস্ময়কর হতে পারে! কতকিছু সেখানে লুকিয়ে থাকতে পারে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে!
তবে তাই হোক, চলুন একটু সমুদ্রতটে ঘুরতে যাই। আমরা তো প্রায় প্রত্যেকেই সমুদ্রে গেছি। বালুকাবেলা, শত-সহস্র ঢেউ, পাশে সারি দিয়ে ঝাউবন, কত অজানা মানুষ, আর অনেক দোকান। নির্জন সমুদ্র সৈকতে অবশ্য দোকানপাট প্রায় থাকেই না। আমাদের অধিকাংশেরই, সমুদ্রে যাওয়ার মূল আকর্ষণ হলো আদিগন্ত বেলাভূমিতে সুর্যোদয়-সূর্যাস্তের অরূপ-খেলা দেখা, সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে স্নান করা আর হাজার হাজার ঢেউএর আসা-যাওয়ার অনন্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। কিন্তু এটাও ভেবে দেখার মতো, প্রতিদিন এই যে লক্ষ লক্ষ ঢেউ হাজার হাজার সৈকতে কোটি কোটি বছর ধরে আছড়ে পড়ে চলেছে – এই বিশাল আয়োজন আবার স্মরণাতীত কাল থেকে প্রবহমান অযুত জীবনের আধারও বটে। তার নিতান্ত অল্প কিছু নমুনা দেখতে দেখতে সৈকতে ঘুরবো আমরা এখন।
আমরা নিশ্চয়ই দেখেছি, সাবুদানার মতো অজস্র বালির বল ঘন-সন্নিবিষ্ট হয়ে কেমন সমুদ্রতট ছেয়ে আছে।। জলের কাছে পৌঁছতে গেলে ওদের মাড়িয়েই যেতে হয়। যাওয়াই দস্তুর। কিন্তু একটু দাঁড়িয়ে খেয়াল করলে ওরাই আবার নক্সীকাঁথা। কতো যে নক্সা আমি দেখি ওদের বিন্যাসে — সূর্য, নারকেলগাছ, নীহারিকাপুঞ্জ, আরও কতো কিছু। কে করেছে এই sand art? একটা ছোট্টো কাঁকড়া, আকারে একটা মটরদানার মতো বা তার থেকেও ছোটো। নাম ডটিলা (Dotilla sp.)। অনবরত তারা বালির দানা দিয়ে নকশা বানিয়ে চলেছে। এই নকশার মাঝখানে থাকে একটি ছিদ্র। সেটাই ওদের বাসা। শুধু ভেজা বালিতে এরা বাসা তৈরী করে। জোয়ার আসার ঠিক আগে বালি-কাদা দিয়ে ওরা নিপুণভাবে গর্তের মুখটা বন্ধ করে দেয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রত্যেকের বাসার ডিজাইন অন্যের থেকে আলাদা। কিন্তু কেন? এটা কি তাদের নিজেদের বাসা চিনতে সাহায্য করে, নাকি গভীরতর কোনো উদ্দেশ্যে প্রকৃতি তাদের এই দক্ষতা দিয়েছে? জানি না। ডটিলাদের কলোনী পিছনে ফেলে আরো এগিয়ে গেলাম যেখানে মানুষের যাতায়াত একটু কম, দেখলাম হাজার হাজার লাল ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে আছে সৈকত জুড়ে। কিন্তু কাছে যাওয়ার জো নেই। গেলেই, টুপ করে বালির গর্তে ঢুকে পড়ছে। আমরা অনেকেই এই লাল কাঁকড়াদের দেখেছি। এরাও ডটিলাদের মতো বালির বল তৈরী করে, তবে তার আকার বেশ বড়ো। আরেকটা কাঁকড়া আছে, ফিডলার ক্র্যাব। এরা ডটিলা ও লাল কাঁকড়ার মধ্যবর্তী আকারের এবং এদের তৈরী বলগুলিও আকারে মধ্যম। তবে ডটিলাদের ক্ষেত্রে যেমন একজনের বলের বিন্যাস অন্যের থেকে আলাদা, অন্যদের ক্ষেত্রে তেমন হয় না। এবার প্রশ্ন হলো থাকার জায়গা নিয়ে এদের একপ্রজাতির সঙ্গে অন্যের লড়াই হয় না? না, কারণ খেয়াল করলে বোঝা যাবে সে লড়াই হওয়ার কথাই নেই, কারণ তাদের তাদের থাকার অঞ্চলটাই আলাদা আলাদা। জোয়ারের সময় সর্বোচ্চ যে পর্যন্ত জল ওঠে সেই রেখা থেকে, ভাঁটায় সর্বনিম্ন যতদূর পর্যন্ত জল নেমে যায় সেই রেখা অবধি অঞ্চলটিকে Intertidal zone বলে। লাল কাঁকড়ারা ঐ মধ্যবর্তী অঞ্চলে শুধু খাদ্য অন্বেষণ করে, আর বাসা বাঁধে তার উপরের অঞ্চলে, শুকনো বালিতে। ডটিলাদের খাদ্যান্বেষণ ও বাসা বাঁধা সবই ঐ মধ্যবর্তী অঞ্চলের বালিতে। আর ফিডলার ক্র্যাবরা জোয়ার-ভাঁটার মধ্যবর্তী অঞ্চলে খাদ্যান্বেষণ ও বাসা তৈরী করলেও তাদের সঙ্গে বালির কোনো সম্পর্ক নেই, বরং কাদা ও পলিযুক্ত অংশে ওদের বসবাস। নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়াতে ও সংঘর্ষ থেকে দূরে থাকতে নিজেদের বসতি এলাকা ভাগ করে নিয়েছে ওরা। আমরাও যদি এমন পারতাম!
কাঁকড়ার কথা আর একটু আছে। ধরা যাক, Intertidal zone-এ একটা ছোটো গর্তে কিছু জল জমে আছে আর তাতে একটা বড়ো পাথর বা কাঠের টুকরো পড়ে আছে। এইরকম একটা অংশে আমরা তিন রকমের কাঁকড়া খুঁজে পেতে পারি। এক ধরনের কাঁকড়া শুধু পাথর বা কাঠের গা-বেয়ে ঘুরে বেড়ায়, মোটে জলে নামে না। ওরা রক ক্র্যাব। এক ধরনের কাঁকড়া জলের ধারে ঘুরে বেড়ায় আর বিপদের আভাস পেলেই নরম বালিতে ঢুকে যায়। এরা মার্শ ক্র্যাব। তৃতীয় ধরনের কাঁকড়া বেশ বড়ো। এরা পাথর বা কাঠের খণ্ডের তলায় ঢুকে থাকে। এদের নাম মাড ক্র্যাব। এরা মানুষের খাদ্যও বটে। এছাড়াও সমুদ্রের ঢেউএর সাথে একধরনের কাঁকড়া পাড়ে চলে আসে। এরা বেশ রঙীন এবং এদের শেষ পা-জোড়া সাঁতার কাটবার জন্য রূপান্তরিত হয়ে ডানার মতো অংশ গঠন করেছে। ওরা হলো মুন ক্র্যাব।
সমুদ্রে গিয়ে শঙ্খ বা ঝিনুক কুড়োয়নি এমন মানুষ বেশ বিরল। কিন্তু যে শঙ্খ আমরা সংগ্রহ করি তাকে উল্টে দিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাবো ভিতরে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। কিছুক্ষণ ফেলে রাখলে ওগুলো আবার চলতে থাকে। পা, একজোড়া চোখা শুঁড়, সবই আছে। তবে কি ওটা শঙ্খটারই অংশ? না, ওটাও একধরনের কাঁকড়া। নাম সন্ন্যাসী কাঁকড়া। ওরা মৃত শঙ্খের খোলসটিকে আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যবহার করে। আর, ওটা নিয়েই ঘোরাফেরা করে। বৃদ্ধির সাথে সাথে, যখন ঘরটি ছোটো হয়ে যায়, তখন ওরা ছোটো খোলকটিকে ছেড়ে বড়ো খোলকের মধ্যে আশ্রয় নেয়।
কাঁকড়ার কথা তো অনেক হলো। এবার যার কথা পাড়বো সে হলো রাজ কাঁকড়া (Horseshoe crab)। তারামাছ যেমন মাছ নয়, রাজ কাঁকড়াও তেমন কাঁকড়া নয়। বঙ্গোপসাগরের তটে আমরা দুই ধরনের রাজ কাঁকড়া দেখতে পাই – Carcinoscorpius rotundicauda আর Tachypleus gigas। কিন্তু সে তো শুধু তথ্য, এদের তাৎপর্য অন্য জায়গায়। এরা হলো জীবন্ত জীবাশ্ম, এরা ডাইনোসর যুগেরও আগে পৃথিবীতে এসেছে। বর্তমানে দূষণ, শিকার ও আশ্রয়হীনতার কারণে এরা অবলুপ্তির পথে।
একদিন বকখালি সৈকতে হেঁটে চলেছি, সঙ্গী আমার পুত্র। ভালো লাগছিলো সমুদ্রের সান্নিধ্য আর অজস্র ঢেউএর অবিরাম আছড়ানি। আছড়ে পড়া ঢেউএর শব্দ শুনতে আমার খুব ভালো লাগে, অসীমের হৃৎস্পন্দন বলে মনে হয়। হাঁটতে হাঁটতে দেখি কিছু শুকিয়ে যাওয়া লবণাম্বু গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কমবয়সী কয়েকজন দৃশ্যপটে গাছগুলিকে রেখে নিজেদের ছবি তুলছেন নানান কায়দায়। তার অনতিদূরে একদল দাঁড়কাক কি যেন ঠুকরে চলেছে। আমরা এগিয়ে গেলাম কাকেদের দিকে। স্বাভাবিকভাবে ওরা তাদের আগ্রহের বিষয়টি ছেড়ে উড়ে পালালো। কিন্তু, কী ওটা? – পুত্রের কৌতুহল, আমারও। দেখলাম, একটা গোলাপী রঙের পটল, কিন্তু তার শরীর থেকে মাঝে মাঝে ফোয়ারার মতো জল বেরিয়ে আসছে। ভাবলাম, কোনো খোলকহীন কম্বোজ প্রাণী হবে হয়তো। আমাদের এখানে চেটো (Slug) যেমন হয় আর কি। কাছে গিয়ে দেখলাম কোনো কম্বোজ প্রাণী নয় ওটা। একটা বড়ো কাঠিকে মচকিয়ে চিমটের মতো তৈরী করলাম, আর তাতে ঐ বস্তুটিকে ধরে তুলে নিয়ে ঐ মরা গাছগুলোর তলায় জমে থাকা জলে ছেড়ে দিলাম। এবার অপেক্ষার পালা। সুবিধে হলো যে, ঐ ফটো-শিকারীরা ততক্ষণে অন্য ছবির খোঁজে চলে গেছেন। কিছুক্ষণ পরে দেখি প্রাণীটির একপাশ থেকে ছোটো ছোটো আঙুলের মতো উদ্ভিদ বেরিয়ে এসেছে। বইএর ছবিতে নয়, প্রকৃতির পাতায় পুত্রকে চেনানো গেলো সমুদ্র শসা কেমন হয়। সমুদ্রের মেঝেতে থিতিয়ে পড়া যত জৈব আবর্জনা, এমনকি জোয়ারে ধুয়ে নিয়ে যাওয়া বিভিন্ন মৃত প্রাণীর দেহাংশ, মল – এরা খায় ও সমুদ্রকে পরিচ্ছন্ন থাকতে সাহায্য করে। এবার নজরে এলো গাছগুলো। সব গাছ তো মরে যায়নি, তবে ওইগুলো কেন? লক্ষ্য করলাম, গাছগুলোর গুঁড়ি জুড়ে ছোটো ছোটো গর্ত রয়েছে। তবে কি গাছগুলোর মৃত্যুর সঙ্গে ওই ছিদ্রগুলির কোনো সম্পর্ক রয়েছে? কয়েকটি ছবি তুললাম। পরে সামাজিক মাধ্যমে ছবিগুলি পোস্ট করে জেনেছি, গুবরেপোকা জাতীয় একধরনের পোকা ঐ গাছগুলিতে ডিম পেড়েছিল। পরে তাদের লার্ভা গাছের মজ্জা অংশটি খেয়ে তাদের মেরে ফেলেছে। কালের মন্দিরা দুই হাতে বেজেই চলেছে সৃষ্টি জুড়ে।
সমুদ্রতটের আরেকটি বিস্ময় হলো বার্নাকল (Barnacle)। খেয়াল করলে আমরা সৈকতে পুরোনো কাঠ, পাথর, প্লাস্টিকের টুকরো বা অন্য কোনো শক্ত বস্তুর গায়ে ছোটো ছোটো তারকাকৃতি কিছু গঠন দেখতে পাই যা প্রচণ্ড ধারালো। এগুলোই বার্নাকল। ভাবতে অবাক লাগে পৃথিবীতে এই বার্নাকলের প্রায় ১৪০০ রকমের প্রজাতি পাওয়া যায়। এরা কোনো শক্ত স্তরের সঙ্গে এমনভাবে আটকে থাকে যেখান থেকে তাদের আলাদা করা অসম্ভব। যে পদার্থ দিয়ে ওরা স্তরটিকে ধরে রাখে তা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী আঠা। এছাড়াও গবেষণায় দেখা গেছে, একটি বার্নাকল ২৪ ঘন্টায় প্রায় ৫৫ গ্যালন সমুদ্রের জল শোধন করতে পারে। জোয়ারের সময় যখন বার্নাকলগুলি জলের তলায় চলে যায়, তখন তাদের মুখের প্লেটগুলি খুলে যায় এবং ভিতর থেকে শুঁড়ের মতো Cirriped-গুলি বেরিয়ে আসে ও জলে ভাসমান ছোটো ছোটো প্রাণী ও শ্যাওলা তাতে ধরা পড়ে যায়।
সমুদ্র থেকে ফিরেছি কিছুদিন হলো। আমার ছেলে কিছু ঝিনুক, শামুক, শঙ্খ কুড়িয়ে এনেছিলো। কড়া রোদে ওদের ফেলে রাখলাম কিছুদিন। এরপর সাবানজলে ঘষে ওদের পরিষ্কার করছিলাম। দেখলাম, কিছু ঝিনুকে ছোটো ছোটো একধরনের জিনিস লেগে আছে। ঠিক যেন ছোটো ছোটো সুতির কাপড়ের টুকরো আঠা দিয়ে আটকানো রয়েছে। কিন্তু, এতো ছোটো ওরা যে চোখে ঠাহর করাই দায়। একটা আতসকাঁচ ওর ওপর ধরলাম। বিস্ময়! অতিক্ষুদ্র একধরনের জীবের কলোনীর অবশিষ্টাংশ লেগে রয়েছে ওর উপর। নাম সী ম্যাট (Bryozoa)। সমুদ্রের খাদ্যতন্ত্রে এদের ভূমিকা বিশাল। ওরা না থাকলে গোটা বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়বে আজই।
দেখে অবাক লাগলো, সমুদ্র থেকে এতো দূরে এসেও ওর শুধু টিকে থাকবার দায়; এবং প্রাণের একটি প্রকাশ যেহেতু অন্য বহুতর প্রকাশের অবলম্বন, প্রতিটি স্পন্দনকে টিকিয়ে রাখাই তবে জীবনের দায়! শুধু মানুষেরই তবে সবকিছু মাড়িয়ে তছনছ করে এগিয়ে চলা! বিশ্ব-উষ্ণায়ন, অতিবৃষ্টি, খরা, বন্যা, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি – সবকিছুর মাধ্যমেই প্রকৃতি কিন্তু বারংবার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমি যাকে ধ্বংসের দিকে ক্রমাগত ঠেলে দিচ্ছি, সেও আমাকে ঐ ধ্বংসের দিকেই টানছে। এতটাই অলজ্জ আমাদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা যে, পাহাড় অরণ্য সমুদ্র-সৈকত সর্বত্র বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আমাদের জানাতে হয় – “প্লাস্টিক ব্যবহার ও যত্রতত্র বর্জন থেকে বিরত থাকুন”, “বৃক্ষচ্ছেদন ও বন্যপ্রাণের ক্ষতিসাধন থেকে বিরত থাকুন” ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলো মূক উপহাস হয়ে বোর্ডে রয়ে যায় শুধু, রপ্ত অভ্যাস বদলায় না! চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কিন্তু এখন, এই মুহূর্ত। কেমন সে পৃথিবী, কেমন সে জীবন, যার উত্তরাধিকার আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাবো! আমরা পারি হৈ-হৈ করে আত্মধ্বংসের পথে এগিয়ে যেতে, আবার আমরাই পারি জগৎজোড়া এই বিপুল প্রাণতরঙ্গের অংশ হয়ে তাকে লালন করতে।