সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
জষ্ঠির এই দুপুরে সূয্যি যেন একহাত নীচে নেমে এসেছে! এত তাতে চাঁদি ফাটা তো সাধারণ কথা, লোহার রেল লাইনও যে গলে আলকাতরা হয়ে এদিক ওদিক গড়িয়ে আসছে না, একথা ভেবে রেবতী অবাক মানে! ওরে রোদ্দূর রে রোদ্দূর! আর এই ব্রহ্মতালু-তাতানো রোদে মাকড়াগুলোকে দেখো, হর্ন বাজিয়েই চলেছে! যেন বাবার বিয়ে লেগেছে! হাসিও পায় ওর! বাজা তোরা যত ইচ্ছে বাজা তোদের হর্ন, তাতে কার কী, রেবতী মণ্ডলের আঙুল উঠবে না তোদের কথায়! ও জানে, কখন স্যুইচে আঙুল রাখতে হয়, কখন তুলতে হয়! চাকরির বয়স এই শ্রাবণেই দুই বছর পুরো হবে ওর! বাইরে থেকে ভেসে আসা খিস্তি এই দু’বছরে অনেক শুনেছে ও! তাতে ওর কিচ্ছুটি যায় আসে না! ওদের মতো সক্কাল সক্কাল সে নিজে মুখখারাপ করবে না!
আজ নিয়ে চারদিন হল, মর্ণিং শিফট করছে রেবতী। মানে আর দুদিন। তারপর দুটো-দশটায় আসবে। মেয়েছেলে বলে ওকে নাইট দেয় না। কিন্তু নাইটেই আরাম ডিউটি করে, বিশেষ করে এই গরমের দিনে। সারারাতে এই লাইনে একটাও প্যাসেঞ্জার ট্রেন যায় না, কখনো সখনো একটা মালগাড়ি হয়ত টানল এই লাইনে। নাহলে তেইশটা বত্রিশের শেষ আপ ট্রেনকে পার করিয়ে হারান দা বা সাদিকুলরা ক্রশিং এর বার তুলে শুয়ে পড়ে ক্যাম্প খাটে! মোবাইলে মুভি চালিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়ে নিজেরাই টের পায় না, ঘুম ভাঙে সেই ফার্স্ট ট্রেনের খবর নিয়ে টেলিফোনটা ঝনরঝন করে মাথায় বাড়ি মারলে! ক্রশিং বার নামিয়ে ওরা রেললাইনের ধারে পেচ্ছাপ করতে দাঁড়ায়, যদিও লেভেল ক্রশিং এর গুমটি ঘরে টয়লেট আছে, রেবতী সেটাতেই যায়।
রেবতী মণ্ডল। সাকিন মনসাতলা, জিলা উত্তর চব্বিশ পরগণা। পিতা ঈশ্বরীয় গোপাল মণ্ডল। মাতা সবিতা মণ্ডল। গোপালের এক ছেলে, এক মেয়ের মধ্যে রেবতীই বড়। ভাই নেপাল মণ্ডল ওর চেয়ে তিন বছরের ছোট। ওর বউ সোনা মণ্ডলকে রেবতী সেই বাচ্চাবেলা থেকে চেনে। বা, চেনে না, চিনল না! বুঝল না সেই মেয়ের পেটে পেটে এত! ভাইয়ের সঙ্গে ভাব ভালোবাসা চলেছে কতদিন ধরে ভগবান জানে, হঠাৎ একদিন ভাইয়ের হাত ধরে এ বাড়িতে একেবারে বউ হয়ে হাজির! ধ্যাবড়া করে কপালে, সিঁথিতে সিঁদূর ল্যাপটানো , আনকোরা একটা শাড়ি গায়ে লেপটানো! ওদের বাড়ির দরজায় তখন যাত্রা দেখার ভিড়! বেরো ঘর থেকে, মায়ের আগে রেবতীই বলেছিল। বলবে না কেন? ন্যায্য কথা বলতে রেবতীর কোনোদিনই বুক কাঁপেনি। আর এ তো মায়ের পেটের ভাই। বাবার মৃত্যুর একবছর পেরিয়েছে তখন সবে, কোন আক্কেলে তুই বলা নেই, কওয়া নেই, একেবারে বিয়ে করে বউ নিয়ে ঘরে ঢোকার সাহস করিস! এক বছরেই বাপকে ভুলে মেরে দিলি! মায়ের চোখে, দিদির চোখে জল তখনও ভালো করে শুকোলো না, ওই ধিঙ্গি মেয়েটার জন্যে হেদিয়ে গেলি! রেবতীর চণ্ডালে রূপ দেখে সেদিন সোনার কী কান্না! সত্যি কথা বলতে কী, মায়ের দিব্যি, ভাইয়ের জন্য নয়, ওই পুঁটুলি বাঁধা মেয়েটার দিকে তাকিয়েই সেদিন রেবতীর মন গলেছিল। দিয়েছিল ওদের ঢুকতে। কিন্তু ঢুকলেই তো হল না, ঘর তো সেই কুললে একটা। সামনের একফালি জায়গাটাকে যদি বারান্দা বলো তো বারান্দা। একটা সিঙ্গেল ক্যাম্প খাট কোনোরকমে পাতা। পিলু, মানে রেবতীর ভাই নেপাল মণ্ডল, ওখানেই শোয়। এখন ওরা দ্যাবা দেবী কোথায় শোবে, সে হুঁশ আছে! বাধ্য হয়ে মা-মেয়েতে ওই ক্যাম্প খাটে জড়ামড়ি করে শোয়। গরমের দিনে এ ভাবে ঘুম হয়! রেবতী তাই মেঝেতে নেমে আসে।
অথচ রেলের কোয়ার্টারে থাকতে কত হাত পা ছড়িয়ে থেকেছে ওরা! হলই বা সিঙ্গেল কোয়ার্টার। সামনে পেছনে বারান্দা, আর যে উঠোন পেরিয়ে বাথরুম পায়খানা যেতে হত, সেই উঠোন-- সব মিলিয়ে সে তো জমিদারি! দিনে রাতে মিলিয়ে চার পাঁচ বার জল আসে। উঠোনের জামগাছটার কথা তো পিলু আজও বলে! রসগোল্লার মত বড়, কুচকুচে কালো জাম, খেতে খেতে জিভ ভারী হয়ে যেত, তাও আশ মিটত না! আশেপাশের কোয়ার্টারে বাটি ভরে মা জাম পাঠাতো! কতজন বলেছে, এত সুন্দর জাম, বাজারে ভালো দাম পেতে! মা জিভ কাটত! ‘গাছ কি আমাদের দিদি, যে বাজারে বেচব! ছেলেপুলে আনন্দ করে খায়, এতেই আমার দাম পাওয়া হয়!’ তখন বাবা সন্ধে হব হব সময়ে ঘরে ফিরত, সাইকেলটা কোয়ার্টারের পাঁচিলের গায়ে হেলান দিয়ে ঘরে ঢুকত। মা বলত, সাইকেল ভেতরে ঢোকালে না কেন! সন্ধের দিকে কিন্তু প্রায়ই চোর ঘুরছে, এই তো… মা বেত্তান্ত শুরু করার আগেই বাবা সাইকেল ভেতরে টেনে নিত, আর উল্টোদিকের পোস্টের আলোয় দেখা যেত, ওদের পাঁচিলের দেওয়ালে কালো আলকাতরার ওপর সাদা দিয়ে লেখা, জি. মণ্ডল। বি বাই ইলেভেন।
একটা সিলিং, একটা টেবিল, দুটো ফ্যান চালিয়ে বাবা টান হয়ে শুয়ে পড়ত বিছানায়, আর রেবতীকে বলত, টিভি টা ছাড় তো মা। খবরটা শুনি। রান্নাঘর থেকে মা বলত, আটটায় আমি কিন্তু সিরিয়াল দেখব! বাবা বলবে, কি এক সিরিয়াল দেখো রোজ রোজ! বলত বটে, কিন্তু সিরিয়াল শুরু হলে সময়ে সময়ে বলে উঠত, এ কি! ওদের ডাইভোর্স হয়ে গেছে নাকি! রেবতী হেসে উঠত, এই তো নাক ডাকাচ্ছিলে, হঠাৎ আবার কার ডিভোর্স দিয়ে দিলে! বাবা বলত, আজকালকার কারবার বুঝি না সব! ভাব হতেও দেরী নেই, ছাড়াছাড়ি হতেও দেরী নেই! মা বিরক্ত হয়ে বলত, থামো না বাপু! একটা সিরিয়াল দেখব, তখনই তোমাদের বাপবেটিতে যত বকরবকর শুরু হয়! রেবা, গ্যাসটা ছোট করে দে মা! তরকারিটা লেগে যাবে!
মা আসলে ওই ছাড়াছাড়ির কথাটা এগোতে দিত না। জানত, কথাটা কোথায় গিয়ে লাগবে। গ্যাস ওভেনের সামনে দাঁড়িয়ে, আগুনের তাতে কি না কে জানে, রেবতীর চোখ দুটো জ্বলে উঠত! আজও ও ভাবে, সত্যিই কি ও মানুষ চিনতে চিরটা কাল ভুল করে এল! নাকি ও নিজেকেই চিনতে পারল না আজও।
সোমনাথকে এতটা ভুল ভাবল! পরেও একবার দেখা হয়েছিল ওর সাথে। রেবতী লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিল! লজ্জা পাওয়ার কথা তো ছিল সোমনাথের। রেবতীর যেটা হওয়ার কথা তা তো, ঘৃণা! কেন ও সোমনাথকে ঘেন্না করতে পারল না তারপরেও, ভাবলে নিজের ওপরেই ঘেন্না হয় ওর! যে ভাবে ঘটনাগুলো ঘটে গিয়েছিল পরপর, তাকেই তো নিয়তি বলে! কপালের লিখন আর কী!
এমনিতে বিয়েবাড়ি টাড়ি কোনোদিনই খুব একটা যেতে পছন্দ করে না রেবতী। বান্ধবী বলতে সেই ইস্কুলের মুনমুন। রেবতী মুখরা বলেই সম্ভবত, সবাই ওকে এড়িয়ে চলত। এখন তো আরও! তো সেই মুনমুনের বিয়েতে যেতেই হবে। না বলা যাবে না! মা আগেই গেয়ে রেখেছিল, ওসব অসভ্যতা একদম করবে না! আমরা যাব, আর তুমি যাবে না, তা তো হয় না! আর তাছাড়া তুমি কোথাও না গেলে তোমার বিয়েতেই বা অন্যরা আসবে কেন! মোট কথা, ও মুনমুনের বিয়েতে গিয়েছিল। শুধু যায়নি, মুনমুনের ঝুলোঝুলিতে ওকে সকাল থেকেই থাকতে হয়েছিল। বাসরে ছিল। সেখানেই দেখা হল সোমনাথের সঙ্গে। তখন সোমনাথ দা। বিধাতার লিখন সেই রাত্রেই লেখা হয়ে গেল রেবতী মণ্ডলের! সোমনাথ দা মুনমুনের বরের বন্ধু। একাই বাসর জমিয়ে দিল! কাউকে দু”চোখের পাতা এক করতে দিল না সারারাত! রূপকথার সেই নায়কের দিকে তাকিয়ে রেবতী মণ্ডল ভুলে গেল, ও রেলের ডি গ্রুপ স্টাফ গোপাল মণ্ডলের মেয়ে, পাড়ার মোড়ে ছোট্ট মুদির দোকান চালানো নেপাল মণ্ডলের দিদি!
নিমন্ত্রিতরা সব চলে গেছে, বিয়েবাড়ির আলোয়, পরিত্যক্ত ফুলের গন্ধে ভাড়া-করা বিরাট বিয়েবাড়ি হা হা করছে! রেবতীর কেমন মাথা ধরে যায়! সোমনাথ নামে ছেলেটা বারবার যেন ওর দিকেই অদ্ভূত ভাবে তাকাচ্ছিল! রেবতীর বিরক্ত লাগছিল, অস্বস্তি হচ্ছিল, আবার কিছু সময় পরপর, কিসের টানে কে জানে, ও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছিল, ছেলেটা ওর দিকে আর তাকাচ্ছে কি না! মুনমুনের বর, অলোক দা পরিচয় করিয়ে দিল, আমার বন্ধু সোমনাথ। এরপর সোমনাথ নামে ছেলেটা বাসরে ঝড় বইয়ে দিয়েছিল। হাসি, ঠাট্টা, গানে। রেবতী স্রেফ উড়ে গিয়েছিল।
সোমনাথ দা সম্ভবত সিগারেট খেতে বাইরে এসেছিল। রেবতীও তখন কেমন ভুতে পাওয়ার মত বাসর ঘর ছেড়ে উঠে এসেছিল। খাওয়া-দাওয়া হয়েছিল যেখানে, সেখানেই একটা চেয়ারে বসেছিল সোমনাথ। সিল্কের পাঞ্জাবি গায়ে লেপটে আছে। মুখটা চকচক করছে ঘামে। ও যেন জানত, রেবতী আসবে! অথচ রেবতীই জানত না! সোমনাথ একটা চেয়ার ওর দিকে আলতো ঠেলে দিয়ে বলল, বোসো! চেয়ারটা রেবতীকে টেনে নিল! সোমনাথ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট করে বলল, তোমাকে একটা কথা বলবার চান্স পাচ্ছিলাম না! বলে, কথাটা না বলে ও লম্বা করে সিগারেটে টান দিল। রেবতী ওর দিকে তাকিয়েই রইল। রেবতীর কী জ্বর এসে গেল! ওর কাঁপুনিটা কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না কেন!
আজকে সেসব কথা মনে পড়লে রেবতীর মনে হয়, ও কী আদৌ সেই রাতে বেঁচে ছিল? সোমনাথ কী ওকে জোর করেছিল বিয়েবাড়ির ওই ছোট ঘরটাতে যে্তে? না ওর নিয়তিই ওকে টেনে নিয়ে গেছিল ওখানে? সন্ধে থেকে পরিবেশিত নানা খাবারের গন্ধ তখনও ঘরময় লেগেছিল। বড্ড গা- গোলানো সে গন্ধ! এখানে ওখানে ছড়ানো ফুলের গন্ধও মিশে ছিল তাতে! মুনমুন কি খোঁজ করেছিল ওর, কোথায় গেল রেবতী? কিছুই কি মাথায় এলো না ওর? কালই মুনমুন চলে যাবে ওর স্বামীর সঙ্গে। রেবতী আবার একা হয়ে যাবে! ইস্কুলের পাট শেষ হয়ে গেছে কবে, কলেজে যাওয়া হয়নি। এখন মায়ের সঙ্গে কুটনো কোটা, ভাতের ফ্যান গালা, বাপ, ভাইয়ের কাপড় কাচা আর সন্ধে হলে টিভি সিরিয়াল দেখা, এতেই আটকে গেছে ও। বাবা অফিস থেকে ফিরলে দুটো কথা হয়। মা ওকেই বলে, সময় নষ্ট না করে পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপনগুলোতে দাগিয়ে রাখতে! হাত অবসর হলে মা ওগুলো নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলবে! এর মাঝে সোমনাথ এলো বিজ্ঞাপনের খুদি খুদি কালো অক্ষরগুলোকে ছড়িয়ে, ছিন্নভিন্ন করে! জ্বরে কাবু হয়ে গেল রেবতী মণ্ডল!
মনে ঠাঁই দেবে না দেবে না করেও সেই অভিশপ্ত রাতের কথাই নানাভাবে তাড়া করে বেড়ায় ওকে! ওর মনে হয়েছিল, ওর সারা শরীরের গ্লানি, সমস্ত ক্ষত সকলের সামনে বে-আব্রু হয়ে গেছে! এ কী হয়ে গেল! আর মুনমুনের সামনে গিয়ে দাঁড়াবার শক্তি ছিল না রেবতীর! ও শরীর খারাপের কথা বলে রাত থাকতে কোয়ার্টারে ফিরে এল! ডান হাতের রক্ত-ভেজা তর্জনী মায়ের ঘুম জড়ানো চোখের আড়াল করতে সমস্যা হল না! যেন আঙুলের ডগায় ও সোমনাথের একটা দাঁতই তুলে নিয়ে এসেছে! ঝরতে থাকা নিজের রক্তকে রেবতী চিনতে পারছিল না! এ অসম্ভব! একই সঙ্গে এক অনাস্বাদিত অনুভূতি, অপরাধবোধ, গ্লানি, যন্ত্রণা, আনন্দ বা আরো কতকিছু দলা পাকিয়ে ভার হয়ে রেবতীর চোখে চেপে বসেছিল। ভোরের দিকে এক গভীর ঘুমের মধ্যে রেবতী হারিয়ে গেল! মা যখন ডেকে তুলল, তখন গায়ে জ্বরের তাপ ওর নিজেকে লুকোনোর বর্ম হয়ে ওকে বাঁচিয়ে দিল! মা মুনমুনদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে খবর দিল, মেয়েটা খুব কান্নাকাটি করছিল। তুই একবার গেলে পারতিস!
মুনমুনের বাড়ি রেবতী গিয়েছিল ও অষ্টমঙ্গলায় বাসায় আসার পর। অভিমান হয়েছিল মুনমুনের। তাই নিজের আসার খবর রেবতীকে জানায়নি ও।
মা বলল, মুনমুন এসেছে?
জানি না।
ফোন করেনি?
না।
মা বুঝেছিলেন। বলেছিলেন, এসেছে নিশ্চয়ই। তুই যা একবার। মেয়ের অভিমান হয়েছে। সেদিন তুই শরীর খারাপের পর চলে এলি। আর তো গেলি না! সেটা যে রেবতী বোঝেনি, তা নয়। তবু কেমন যেন এক জেদ চেপে বসে ওর! কেন ও নিজে থেকে যাবে! আবার ভাবে, মুনমুন এখন সোমনাথের দেশের মেয়ে। মুনমুনের সঙ্গে কথা মানে, সোমনাথের খবর পাওয়া। সে মানুষ কী করে, কোথায় থাকে, বাড়িতে কে কে আছে, কিছুই তো জানা হয়নি সেদিন! এইসব ভাবনা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল মুনমুনের বাসায়।
মুনমুনকে দেখে রেবতী অবাক হয়ে গেল! মাঝখানে মোটে কয়েকটা দিন, মুনমুনটা কেমন দূরের মানুষ হয়ে গেছে! রেবতীর সঙ্গে ওর কথাবার্তা যেন দুই বন্ধুর কথা নয়, এক বিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে এক অবিবাহিতা মেয়ের কথা! অথচ আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই! এই ব্যবধান যেন প্রাকৃতিক, অনিবার্য!
দুপুরে রেবতীকে কিছুতেই ছাড়ল না মুনমুন। সবাই একসঙ্গে খাবে ওরা! রেবতী আপত্তি করেছিল। অলোক দা বলল, আমরা এমন কিছু খারাপ লোক না! বিশ্বাস করতে পারেন! কথাগুলো হুবহু মনে আছে রেবতীর!
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর মুনমুন আর রেবতী যেন বন্ধু হয়ে ফিরে এল! দুই সখী ভেতরের ঘরে কলকল করছিল। মুনমুনই বেশি! রেবতী কিছু কথা শুনছিল, কিছু কথা হারিয়ে ফেলছিল। ভাবছিল, একবারও সোমনাথের কথা উঠছে না তো! মরিয়া হয়ে রেবতীই তোলে কথাটা! হালকা পরিহাসে মুনমুনই বলে, খুব মনে ধরেছে যে! রেবতীকে তখন কথায় পেয়েছে! এখান থেকে একটু কিছু শুনে যাওয়ার পরে ও মা’কে বলবে, এবার বিজ্ঞাপন দেখা বন্ধ করো, মা!
সবটা কি বলতে পেরেছিল রেবতী? এখন সত্যিই মনে পড়ে না! বন্ধুর কাছে নাকি সব বলা যায়? সওওব? সত্যিই? রেবতী জানে না! তবে সদ্যবিবাহিত মুনমুনকে সবটা বলতে হয়নি! ও কয়েক মুহূর্ত কেমন ভাবে যেন তাকিয়েছিল রেবতীর দিকে, তারপর নিজেই কেঁদে ফেলেছিল ঝরঝর করে! রেবতীর সালোয়ার মুঠো করে ধরে ওকে টেনে তুলে বলেছিল, সোমনাথের একটা ছেলে আছে রে রাক্ষসী! তুই এ কী করলি! তোর অলোক দা শুনলে….
শুনতে পায়নি রেবতী আর কিছু! ওর গলা দিয়ে একটা আওয়াজ বেরোয়নি, বেরোয়নি চোখ দিয়ে একফোঁটা জল! ও যেন কোথাও নেই! না মুনমুনের বাসায়, না নিজের ! ওর বাবা, মা, ভাই কেউ আছে? সোমনাথ? সোমনাথ বলে সত্যিই কেউ আছে পৃথিবীতে? রেবতী? রেবতী বলে কেউ আছে? ওর এখনও মরণ হচ্ছে না কেন? মুনমুনরা তো ওকে মারছে না! কেন? তাড়িয়ে দিচ্ছে না তো বাড়ি থেকে? অলোক দা বিশ্বাসের কথা বলেছিল, অলোক দা কি ওকে বিশ্বাস করতে পারবে? মুনমুন নিজে? কোথায় চলে গেল মুনমুন? আলোক দা’র কাছে? এ কি ওকে চলে যেতে বলা নয়?
চোরের মত সেদিন মুনমুনের বাসা থেকে চলে এসেছিল রেবতী। ফিরেওছিল নিজের বাসায়। জি. মণ্ডল, বি বাই ইলেভেন নামাঙ্কিত কোয়ার্টারে। কিন্তু ওর মনে হচ্ছিল, এই আশৈশব আস্তানাতেও ও অনাহূত হয়ে পড়েছে। কেউ কিছু বলেনি, কাউকে কিছু বলতে হয়নি, বাড়ির অন্যদের এই নিস্পৃহ উদাসীনতা রেবতীকে আরও ভয়ের গর্তে ঠেলে দিয়েছে! হয় সকলে ওর বাইরে, বা ও সকলের সামনে একটা পাঁচিল তুলে দিয়েছে। রেবতী এখন একা! এই অসহ্য একাকীত্বই ওর কাঙ্ক্ষিত ছিল কি না, রেবতী বুঝতে পারে না!
আরেকটা বড় ঝড় না এলে আগের ঝড়ের স্মৃতি মানুষ ভুলতে পারে না। কথাটা বলেছিলেন রেবতীর ইস্কুলের বাংলার দিদিমণি। সেই দিদিমণি, যিনি ভালো মুখ করে রেবতীকে বলতেন, প্রায়ই বলতেন, পড়াশোনাটা একটু ভালো করে কর। তোরা তো রিজার্ভড। চাকরির পরীক্ষায় টেনেটুনে দশ পেলেই তোরা পাস! কথাটা কতবার, কতরকম করে যে রেবতীকে বলেছেন চৈতালি ম্যাম! ব্রাহ্মণ বাড়ির বউ চৈতালি মুখোপাধ্য্যায় এরপরই সকলের সামনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতেন, আমাদেরগুলোর যে কী হবে, কে জানে!
আজ, এতদিন পরে, সেই চৈতালি ম্যামের কথাগুলো মনে পড়ল। এই ঝড় কি ও চেয়েছিল? নাকি ঝড় ঘনিয়ে এনেছিল ও নিজেই?
বাবা গোপাল মণ্ডল ছিল গ্যাংম্যান। বড্ড পরিশ্রমের চাকরি। সারাবছর, রোদে জলে লাইনের ওপর কাজ। সবিতা, রেবতী দুজনেই মনে করিয়ে দিত, সাবধান হওয়ার কথা। দুদিকে ভালো করে দেখে নিতে হবে, ট্রেন আসছে কি না! গোপাল হাসত, ওদের ছেলেমানুষী উদ্বেগ দেখে! একটা লাইনের কাজ কত লোকের নজরদারিতে হয়, জানিস? সবই জানে রেবতীরা। তবু এসব কথা বলা। একসময় এসব নিয়ে আর কথা হত না। হত অফিসের অন্য কলিগদের নিয়ে, সাহেবদের নিয়ে গল্প। ছেলে দোকান আগলিয়ে এসব শোনার সময় পায় না। অথচ ছেলের জন্য কোন সাহেবের কাছে তদবির করা হয়েছে, তার কথাই বেশি করে বলত গোপাল। সবিতা বলত, ছেলেটা তো তবু যা হোক, একটা দোকান করছে। ঠাকুরের আশীর্বাদে দুটো পয়সার মুখ দেখতে পারছে। তুমি রেবার কথাটা ভাবো। চাকরি থাকতে থাকতে ওর একটা কিছু নাহলে, রিটায়ার করার পর সে দম থাকবে! রেবতী শক্ত মুখে প্রতিক্রিয়া দিত, আমার কথা ভাবতে হবে না, মা। এক কথা বারবার বলবে না! এরপর এক কথা, দু’কথায় মা- মেয়ের তুমুল লেগে যেত! সবিতা লড়াইয়ের শেষ অস্ত্র হিসেবে ঠারে ঠারে ওর কপালের কথা, ওদের কপালের কথা তুলত। সেই এক কথাতেই জোঁকের মুখে নুন পড়ত। গোপাল আস্তে আস্তে সেখান থেকে উঠে যেত! এক ভারী নৈঃশব্দ্যের চাদর মুড়িয়ে বি বাই ইলেভেন রেল কোয়ার্টারে সন্ধে নেমে আসত। অনেক পরে সবিতা তিনবার শঙ্খে ফুঁ দিয়ে সেই নীরবতাকে খানখান করে দিতে চাইত!
এরকমই এক সন্ধেয়, ফোনে নয়, এক রেলকর্মচারী মারফৎ গোপালের অ্যাকসিডেন্টের খবর এসেছিল। বলা হয়েছিল, সিরিয়াস! ওদের জানানো না হলেও গোপাল তখনই সমস্ত ঘটন-অঘটনের ওপরে চলে গেছে! সমস্ত কিছু মিটিয়ে গোপালের নিথর, দলা পাকানো দেহ যখন কোয়ার্টারের বারান্দায় আনা হল, তখন একমাত্র রেবতী এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি! হাজার বার বলা সত্ত্বেও একবারের জন্যও বাবাকে দেখতে বাইরে এসে দাঁড়ায়নি! পারোলৌকিক কাজে সারাক্ষণ পিলুর পাশে বসে থেকেছে। ওড়না দিয়ে বাবার ছবি মুছে দিয়েছে মাঝে মধ্যেই, যেন বাবার চোখের জল কেউ না দেখে ফেলে!
গোপালের অফিসের লোকেদের, ইউনিয়নের উদ্যোগে রেবতীর চাকরি হল রেল দপ্তরে। গেটম্যানের কাজ। সোজা কথায় লেভেল ক্রশিং তোলা নামানো। সময় লেগেছে অনেক, ছোটাছুটি হয়েছে বিস্তর। কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে হয়েছে এর মধ্যে। হাত পা ছড়িয়ে থাকতে অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত পরিবারটির ঠাঁই হয়েছে এক কামরার অপরিসর ভাড়া বাসায়। গুটিয়ে ছোটো হয়ে গেছে গোটা পরিবারটাই। সবিতা থম মেরে গেছে, পিলু দোকানের কাজে বা অন্য অকাজে বাইরেই কাটায় বেশি সময়। ঘরের সঙ্গে তার সম্পর্ক খাওয়া আর ঘুমের! এ যেন বাকিদেরও স্বস্তির! কী কথা বলবে, ওরা নিজেরা? তার চেয়ে যে যার মত সময়গুলো পার করে যাচ্ছে, এই ভালো! বিয়ে করে আনার পর ছেলে ঘরমুখী হয়েছে তাও।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে রেবতীর। চাকরি পেয়ে আর্থিক সুবিধা হয়েছে গোটা পরিবারের, কিন্তু এই চাকরি রেবতীকে যেন প্রত্যেকটা মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়, এ ওর বাবার ক্ষতবিক্ষত দেহের বিনিময়ে পাওয়া! আর সেই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য দায়ী রেবতী মণ্ডল! এ চাকরি ও নিজের যোগ্যতায় পায়নি, এমনকি চৈতালি ম্যাম ওকে যে কারণে খোঁটা দিয়ে গেছে তার জন্যও পায়নি! এ চাকরি ওর নিজের অভিশপ্ত জীবনের শাস্তি! এই চাকরির ভার ওকে বহন করে যেতে হবে সারাজীবন!
আজ, এতদিন পরে, বন্ধ লেভেল ক্রশিং এর দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনের অস্থির অপেক্ষাতে রেবতী এক অদ্ভূত আমোদ অনুভব করে! এদের প্রত্যেকের নিয়তি এখন বাঁধা পড়ে আছে রেবতী মণ্ডলের তর্জনীর ওপর! কারা আছে বাইরে, ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে, অপেক্ষায়? সোমনাথ, অলোক দা, মুনমুন, চৈতালি ম্যাম, পিলু, সোনা, এরা? আর কারা? রেবতী ওর দষ্ট আঙুলের দিকে যত্ন করে তাকায়! তাকিয়েই থাকে! ও পারে, এই আঙুলের চাপে এতগুলো আটকে থাকা লোককে শাস্তি দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে! আবার এই আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ওর পুরোনো ব্যথাটা যেন জেগে ওঠে! ব্যথাটা ওই আঙুল থেকে পুরো শরীরে চারিয়ে যায়! সেই ব্যথাই রেবতীর সামনে গোপাল মণ্ডলকে এনে দাঁড় করায়! এই আঙুল কি গোপাল মণ্ডলের মরণচিহ্ন হয়ে থাকেনি ওর শরীরে? রেবতীর চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে যায়! ওর দু’চোখে প্লাবন নামে। রেবতী আস্তে আস্তে স্যুইচে ওর আঙুল ছোঁয়ায়। দুই ধারের লেভেল ক্রশিং এর লোহার দণ্ড ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে আস্তে আস্তে। যেন রেবতী মণ্ডলের দুই হাত আকাশের দিকে আঙুল উঁচিয়ে কিছু বলতে চায়। অদৃশ্য, অথচ রেবতীর কাছে দৃশ্যমান কাউকে!
রেবতী সকলকে মুক্তি দেয়!