সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
‘অরণ্য’ শব্দটা আমার ছেলের নামে আছে। ভারতের সংবিধানও এই শব্দের একরকম মানে করেছে। তবে সংবিধানের একটা মজা আছে, সুবিধেও– শব্দের অর্থ সেখানে স্থায়ী নয়, সরকারের সুবিধেমতো পালটে পালটে যায়। কখন কোন অঞ্চলকে অরণ্য হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হবে, কখন অভয়ারণ্য, কখন ডিমড ফরেস্ট (deemed forest) হিসেবে চিহ্নিত করা হবে সেসবের একচ্ছত্র অধিকার সরকারের অথবা প্রশাসনের। একটু অতীতচারণ করা যাক। ১৮৬৫ সাল। তৈরি হল ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট। ভারতে তখন রেল লাইন পাতার কাজ শুরু হয়েছে। রেল লাইনের স্লিপারের জন্য চাই হাজার হাজার টন কাঠ। সুতরাং জঙ্গলকে প্রশাসনের আওতায় নিয়ে আসার প্রয়োজন। নাহলে তার সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার সম্ভব নয়। এখানে মনে রাখা দরকার, ভারতের প্রিন্সলি স্টেট অর্থাৎ বিভিন্ন রাজার অধীনে সে সময় প্রচুর জঙ্গল ছিল, যা তাঁরা শিকার এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার করতেন এবং প্রশাসনকে তার ভাগ দিতে বাধ্য ছিলেন না। আরও কয়েক দশক পার করে ১৯২৭ সালে তৈরি হয় নতুন ফরেস্ট অ্যাক্ট– যা অরণ্যকে রাজ্যের এক্তিয়ারে নিয়ে আসে। আরও পরে, ১৯৭৬ সালে, ৪২তম সংবিধান সংশোধন অ্যাক্টে অরণ্যের অধিকার রাজ্য়ের সঙ্গে কেন্দ্রের হাতেও চলে আসে। ভারত তখন নব্য যুবা। বিপুল তার উন্নয়ন প্রকল্প। বাঁদ চাই, বিদ্যুৎ চাই,ফ্যাক্টরি চাই, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার মুখে খাবার তুলে দিতে চাষের জমি চাই, এবং ইত্যাদি। বাকি পৃথিবীর মতো এখানেও প্রকৃতির এবং বিশেষত অরণ্যের সম্পদ নয়ছয় করেই দেশ গড়ে তোলা হয়। কিন্তু সত্তরের দশকে পরিবেশ আন্দোলনের ইতিহাসে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রায় পরপর ঘটে যায়। অধুনা উত্তরপ্রদেশের (বর্তমান উত্তরাখণ্ড) একটা ছোট গ্রামের মহিলারা হঠাৎ বেঁকে বসে– যে জঙ্গল ঘিরে তাদের বাস, তার গাছ কেটে হকি স্টিক বানানোর কারখানায় চালান করা যাবে না। শয়ে শয়ে মহিলা গাছ জড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। গড়ে ওঠে চিপকো আন্দেলন। সারা পৃথিবীর পরিবেশ আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রায় একই সময়ে কেরলের পালাক্কড় জেলার জঙ্গুলে মানুষ রেইনফরেস্ট কেটে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ রুখে দেয়। তৈরি হয় সাইলেন্ট ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক। এর কয়েক বছর পর, ১৯৮০ সালে তৈরি হল ফরেস্ট কনজারভেশন অ্যাক্ট। এই লেখায় এরপর থেকে যাকে আমরা এফসিএ ১৯৮০ নামে ডাকব। আরও বছর কুড়ি পরে, ২০০২ সালে এর দোসর হিসেবে আনা হয় বায়ো ডাইভারসিটি অ্যাক্ট (বিডিএ ২০০২)।
ভূমিকা শেষ, এবার আসল কথায় আসা যাক। যথাক্রমে ২৫ এবং ২৬ জুলাই ২০২৩, লোকসভায় বায়ো ডাইভারসিটি অ্যাক্ট (বিডিএ) এবং এফসিএ ১৯৮০-এর নতুন সংশোধন পাশ করা হল। এফসিএ ১৯৮০ তে বলা হয়েছিল জঙ্গল কেটে পাম তেলের চাষ, চা-কফি, মশলা, রাবার, ইত্যাদির চাষ করা চলবে না। কোনও ব্যক্তি এবং / অথবা বেসরকারি সংস্থাকে 'অরণ্য'-এর অংশ বিক্রি করা বা লিজ দেওয়া যাবে না। এই প্রসঙ্গে আমরা মনে করব বেদান্ত পর্ব। ২০১০ সালে ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড় এলাকার জনজাতি বেদান্ত রিসোর্সেস নামক সংস্থার বক্সাইট খনন প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। প্রকল্পটি এফসিএ ১৯৮০ লঙঘন করে অরণ্যের জমি দখল করছে এই ভিত্তিতে সেটাকে বাতিল করা হয়। একই কারণে ২০১৪ সালে বাতিল হয় ওড়িশার পসকো প্রকল্পটিও।
এবার নজর দিই বিডিএ ২০০২ এর দিকে। বায়ো ডাইভারসিটি বলতে গেলে বলা যায়, ছোটবড় গাছ, জীবজন্তু, পোকামাকড়, পাখি এবং সেখানে বসবাসকারী মানুষ– এই সবকিছু নিয়েই জীববৈচিত্র্য। জীবনধারণের জন্য একে অন্যের ওপর নির্ভর করে। অরণ্যে বসবাস করে যেসব মানুষ, তারা জ্বালানির জন্য কাঠকুটো জঙ্গল থেকেই সংগ্রহ করে। জঙ্গলের ঘাস দিয়ে তারা মাদুর বোনে, ঘরের চাল দেয়, প্রয়োজনমতো ফলমূল, লতাগুল্ম তুলে আনে। জঙ্গলকে ধ্বংস না করেও কীভাবে জঙ্গলের সম্পদ ব্যবহার করা যায়, এই শিক্ষা তারা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে নিয়ে চলেছে। এর উল্টো পথে, লোভের শিকার হওয়া মানুষ কি নেই? নিশ্চয়ই আছে। তবে যেমন দস্যু বিরাপ্পন। বিরাপ্পনের কথায় আসার আগে আরও কয়েকটা কথা বলে নেওয়া দরকার। কাঠ ছাড়াও বেশ কিছু জিনিস জঙ্গলে পাওয়া যায়, যা চড়া দামে বাজারে (মূলত কালোবাজারে) বিক্রি হয়। যেমন হাতির দাঁত, বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর ছাল ও চামড়া, তাদের দাঁত, নখ, ইত্যাদি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ভারতের ক্রমবর্ধমান আয়ুর্বেদ নির্ভর পণ্যের বাজার। বিভিন্ন ভেষজ ওষুধ ও ত্বকচর্চার উপাদান যেমন ঘৃতকুমারী, অশ্বগন্ধা, ভৃঙ্গরাজ, ইউক্যালিপটাস, অর্জুুন গাছ– এর মূল উৎস জঙ্গল। এর খানিকটা এখন চাষ করা হলেও, তার পরিমাণ নগণ্য। এইসব পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থা নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করেই সেসব সংগ্রহ করে আনছে।
এবার আসা যাক বিরাপ্পনের প্রসঙ্গে। নেটফ্লিক্সে কিছুদিন আগেই ওই নামে একটা তথ্যচিত্র প্রকাশ পেয়েছে। দস্যু বিরাপ্পনের উত্থান থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এতে ধরা আছে। বিরাপ্পনের ছিল হাতির দাঁতের চোরাকারবার। তথ্যচিত্রে তার এক সঙ্গী ক্যামেরার সামনে স্পষ্ট করেই বলছে, বিরাপ্পনের আমলে কর্ণাটক-তামিলনাডুর সীমানায় এম এম হিলস অরণ্যে দাঁতাল হাতি নিঃশেষ হয়ে গেছিল। প্রায় এক হাজার হাতি বিরাপ্পনের দলের গুলিতে প্রাণ দিয়েছে। এছাড়াও তার ছিল চন্দনকাঠের কারবার। দক্ষিণ ভারতের ওই অঞ্চলের অরণ্যের মহার্ঘ সম্পদ চন্দনকাঠ; যার মালিকানা সরকারের। এই কাজ অবশ্যই বিরাপ্পন একা করত না। বেশ বড়সড় একটা দল ছিল যার প্রত্যেকটি সদস্য জঙ্গলের নাড়িনক্ষত্র চিনত। এরা সকলেই স্থানীয় মানুষ, জঙ্গলের আশেপাশেই এদের জন্ম, বেড়ে ওঠা। ফলে পুলিশকে নাকাল করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। দীর্ঘ পনের বছর ধরে তামিল নাডু এবং কর্ণাটকের পুলিশ চেষ্টা করে চলে বিরাপ্পনকে ধরতে। বেশ কিছু পুলিশকর্মীকে বিরাপ্পন এবং তার দলবলের হাতে খুনও হতে হয়। শেষমেশ ১৮ অক্টোবর ২০০৪, পুলিশ এনকাউন্টারে বিরাপ্পন এবং তার তিন সঙ্গীর মৃত্যু হয়।
তথ্যচিত্রটা বিরাপ্পনের মৃত্যুতে শেষ হয়। তার পর এই জঙ্গলের কী হল সেটা একটু দেখি। লোকটা মরার পরপরই হুহু করে বাড়তে থাকে ওখানকার জঙ্গলের নিষিদ্ধ জমির দাম। গত ১৫ বছরে কর্ণাটক সরকার ৫০৪৮ হেক্টেয়ার জঙ্গলের জমি কয়লাখনি, গ্র্যানাইট খনি, হোটেল ইত্যাদি প্রকল্পের জন্য 'divert' করেছে। অর্থাৎ সেসব জমি অরণ্যের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে চিহ্নিত করেছে 'উন্নয়ন'-এর স্বার্থে। বীরাপ্পনের জীবদ্দশায় যা ছিল কল্পনাতীত। বিরাপ্পনের ব্যবসা যেহেতু ছিল হাতির দাঁত আর চন্দন নিয়ে, জঙ্গলের অন্য কোনও সম্পদের প্রতি এদের আগ্রহ ছিল না। আর জঙ্গলে, বিরাপ্পনের ছিল একাধিপত্য। অন্য চোরাশিকারি বা জমি হাঙরদের সেখানে আধিপত্য বিস্তার করা ছিল অসম্ভব।
এবারে গোটা ভারতের দিকে নজর ঘোরাব। সংসদে পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, গত পনের বছরে ভারতের তিন লক্ষ হেক্টেয়ার জমি এফসিএ ১৯৮০-এর অধীনে ‘ডাইভার্ট’ করা হয়েছে, অর্থাৎ অরণ্যের প্রয়োজন বহির্ভূত কারণে ব্যবহার করা হয়েছে। ৮৯ হাজার হেক্টেয়ার গত পাঁচ বছরেই। খনি, পর্যটন, ফ্যাক্টরি, রাস্তা, রেল লাইন, সবই আছে। এবারে প্রশ্ন হচ্ছে, এফসিএ ১৯৮০ তো জঙ্গল সংরক্ষণের জন্য তৈরি আইন, এর সাহায্য নিয়ে এসব করা গেল কীকরে? ভারতের সংবিধানের বিশেষত্ব হচ্ছে এই আইনের ফাঁক। প্রকল্পের জন্য চিহ্নিত জমির ওপর যেহেতু কেন্দ্র এবং রাজ্য দুইয়েরই এক্তিয়ার রয়েছে, সেই প্রক্রিয়া খানিকটা জটিল এবং দীর্ঘ। সোজা কথায়, হুট বলতে খনি কোম্পানিকে জমি দিয়ে দেওয়া যায় না। যত্র তত্র একর একর জঙ্গল পাম তেলের চাষের জন্য লিজ দিয়ে দেওয়া যায় না। চাইলেই প্রতিরক্ষা বা উন্নয়নের নামে অরণ্যে বসবাসকারী সম্প্রদায়দের উচ্ছেদ করে ফেলা যায় না। বেশ কয়েক ধাপ পেরিয়ে তবে আইনি অনুমতি মেলে। বড় পুঁজির সংস্থাদের কাছে যা খানিক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই যেমন নাগপুরের কাছে গোন্দখইরিতে আদানি পাওয়ারের ৮৬৩ হেক্টেয়ার জঙ্গলের জমি চাই। কয়লা তোলার জন্য। কিন্তু সেখানকার লোকজন বেঁকে বসেছে, গত জুলাইতে প্রথম পাবলিক হিয়ারিং ভেস্তে গেছে। কিন্নর জেলার গ্রামবাসীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছে ১৪৩ হেক্টেয়ার জঙ্গল ডুবিয়ে তৈরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প আমাদের লাগবে না। সরকারি আর কর্পোরেট ভাষায় এসব ঝামেলাকে বলে রোডব্লক। উন্নয়নের ঘোড়ায় সওয়ার শাইনিং ভারত যেসব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চায়।
শেষ করার আগে দু’লাইন অপ্রিয় কথা বলতে হয়। আমাদের পরবর্তী লোকসভা ভোট আর কয়েকমাস পর। জনমত নির্মাণের জন্য আজকাল যে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়, যার পোশাকি নাম ভোট প্রচার, তার সিংহভাগ আসে কর্পোরেট সংস্থার তহবিল থেকে। বেদান্ত, আদানি, পসকোর মতো সংস্থারা স্বাভাবিকভাবে সেই দলেই বিনিয়োগ করতে চাইবে, যারা নির্বিচারে প্রকৃতির সম্পদ তাদের হাতে তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দেবে। আগামি ভোটের আগেই তাই এই আইনদুটো পাশ হওয়া খুব দরকার। জঙ্গলের অধিবাসীরা কি পারবে, এদেশের কৃষকদের মতো করে ছিনিয়ে নিতে নিজেদের অধিকার? ক্ষীণ আশা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে থাকি। ভাবি, যে ছেলের নামের মধ্যে ‘অরণ্য’, সত্যিকার অরণ্য দেখতে তাকে কতদূর যেতে হবে?