সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
এটা সমীর দা, মানে শিল্পী সমীর ভট্টাচার্যর ছবি অথবা জীবন নিয়ে কোনো আলোচনা নয়। এটা সমীর ভট্টাচার্য, অর্থাৎ সমীর দা সম্পর্কে কোনো স্মৃতিচারণও নয়। হয়তো এটা,সমীর দা-কে নিয়ে ভবিষ্যতের কোনো আলোচনা বা কথাবার্তার প্রাথমিক খসড়া, অথবা তা-ও নয়। কিন্তু এটা সমীর দা-কে নিয়েই, আমার দেখা ভালোবাসার সমীর দা সম্পর্কে কয়েকটা আটপৌরে কথা।
কুমোরটুলি অঞ্চলে মৃৎশিল্পীদের একটা বড়ো অংশের পরিচিতি পাল হিশেবে। গত শতকের মধ্যভাগ পেরিয়ে বিভিন্ন সময়ে কুমোরটুলির সেই পাল পরিবারের কয়েকজন শিল্পী বিভিন্ন আর্ট কলেজে প্রশিক্ষণের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন। সেদিক থেকে ভাবতে গেলে সমীর দা-র আগেও একাধিক শিল্পী, এই কুমোরটুলি অঞ্চল থেকে প্রথাগত প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
কিন্তু, এখনও পর্যন্ত খোঁজখবর নিয়ে যেটুকু জানতে পেরেছি, শিল্পী সমীর ভট্টাচার্যর হাত ধরেই এই কুমোরটুলি অঞ্চলে শিল্পচর্চায় আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটেছিল। ওঁর আগে রিয়ালিজম বলতে মোটামুটিভাবে যেটা হচ্ছিল তা মৃৎশিল্পীদের ভাস্কর্যে বাস্তববাদী চেহারার প্রতিফলন, এবং দেওয়ালচিত্র বা ম্যুরাল-এ বাস্তবের প্রতিচ্ছবি, ল্যান্ডস্কেপ বা অবয়ব নির্মাণে অতিকৃতি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এসব নিয়ে শিল্পচর্চার ইতিহাসকার ও গবেষকরা ঠিকঠাক বলতে পারবেন। কিন্তু ঐ অঞ্চলে বড়ো হয়ে ওঠা, শিল্পী হতে চাওয়া কমবয়সীদের স্বপ্ন ডানা মেলতে পেরেছিল সমীর দা-র সশব্দ দৃপ্ত উপস্থিতির কারণে। মৃৎশিল্পীদের যে পরিচিতি সীমাবদ্ধ ছিল প্রতিমা নির্মাণের কৃৎশিল্পে, ফরমায়েশি ভাস্কর্য বা দেশি বিদেশি মূর্তি তথা ভাস্কর্যের অনুকৃতি নির্মাণ কৌশলে, সমীর দা ওঁর জীবন ও শিল্পচর্চার এক ব্যতিক্রমী যাপনে সেখানে নিয়ে এসেছিলেন বিমূর্তের ভাবনা। বাস্তববাদী ছবির গঠন কীভাবে সময়ের অভিঘাতে পাল্টে যেতে পারে, তার প্রকরণ ও বক্তব্যে কীভাবে আধুনিকতার চিহ্ন লেগে থাকতে পারে, সমীরদা শিল্পী না হলে কুমোরটুলি অঞ্চলে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা ছিল না। নিতান্ত বাস্তব থেকে ছবি কীভাবে বিমূর্তের সন্ধানে যেতে পারে, কীভাবে ছবির সঙ্গে নিজস্ব ভাষায় সম্পৃক্ত হয়ে যায় কোনো কবিতা বা গান, কীভাবে একজন ছবি আঁকিয়ে একটা প্রতিকৃতি বা নিসর্গের গভীরে চিহ্নিত করে দেন ব্যাপকতর ভাবনার বিস্তার, সেই পাঠ উত্তর কলকাতায় অন্য অনুজ শিল্পীদের গড়ে ওঠার সময়ে সংক্রমিত হয়েছে যে ক'জন শিল্পীর কারণে, তার অন্যতম সমীর দা।
এমনকি নিকটবর্তী অঞ্চলে একাধিক বিখ্যাত ভাস্কর ও শিল্পী থাকা সত্ত্বেও এটা ঘটতো না, কারণ সেইসব বিখ্যাতদের তেমন কোনো প্রভাব সামাজিকভাবে পরবর্তী প্রজন্মের ওপরে পড়েনি, যাতে তারা শিল্পকে তথা ছবি আঁকাকে শুধুমাত্র পেশা হিশেবে না ভেবে ব্যাপকতর সংস্কৃতিচর্চার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিশেবেই ভাবতে শেখে।
উত্তর কলকাতায় শিল্পচর্চার ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে এখানেই শিল্পী ও মানুষ সমীর ভট্টাচার্যর অবিস্মরণীয় স্থান।
এর পরের যে কথাটা আমি খুব স্পষ্ট করে বলতে ইচ্ছুক, সেটা হলো, কেউ কিছু মনে করলেও আমার কিছু করার নেই, শিল্পীদের (যে কোনো বিভাগের) মধ্যে সুবিধাবাদী তথা সুবিধাবাদী (শুদ্ধ বাঙলায় বললে, ধান্দাবাজ) লোকের অভাব নেই। সৎ মানুষের সংখ্যা খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। এই মন্তব্য অনেকেরই পছন্দ হবে না, অনেকেই আমার দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতা নিয়ে আপত্তি করবেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করছি, সমীর ভট্টাচার্যর মতো খাঁটি মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি।
একটা লোক তার অগোছালো জীবনযাত্রার জন্য পারিবারিকভাবে অসফল হতে পারে, টাকাপয়সা খ্যাতি অর্জন করতে ব্যর্থ হতেই পারে, কিন্তু সে যে কাজটা করার চেষ্টা করে, করতে চায় ও করে, সেই কাজটা যদি তার মেধা ও মননের সৎ বহিঃপ্রকাশ হয়, তাহলে সে সম্মানযোগ্য তো বটেই,আদরণীয়ও বটে।
শৈশব থেকে মা-র কাছে বিভিন্ন কবিতা গান ও অন্যান্য ধরনের লেখা শুনে শুনে সমীর দা-র কান তৈরি হয়ে গেছিল, স্বরযন্ত্রের ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে সেই শ্রবণশক্তি আক্রান্ত হলেও বোধের ভেতরে প্রোথিত হয়ে থাকা রুচিমনস্কতা আমৃত্যু জীবন্ত ছিল। সমীরদা দেবব্রত বিশ্বাসের ভক্ত ছিল, ঋত্বিক ঘটকেরও। রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ, দু'জনের সঙ্গেই যাপন ছিল ওর। গান কবিতা ছাড়াও এঁদের গদ্য প্রবন্ধে অনায়াস যাতায়াত ছিল।
ভারতীয় শিল্পচর্চা শুধু নয়, আমাদের বহুমুখী সংস্কৃতি, এমনকি উনিশ-বিশ শতকে বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের উন্মেষের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে সমীর দা-র এই শৈশব ও কৈশোরের দীক্ষা এতটাই ছাপ ফেলেছিল যে সদ্য যৌবনের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও তৎকালীন অতি বিপ্লবী ভাবনা সত্ত্বেও সেই সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান চিরদিন অক্ষুণ্ন ছিল। এবং তার পাশাপাশি সমীর দা লালন করেছেন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা,যা আমার কাছে ওঁকে আরও সম্মানীয় করে তুলেছিল।
বেশ কয়েক বছর আগে আমার আরেক প্রিয় মানুষ ও শিল্পী বাঁধনদা মারা যাওয়ার পরে বাঁধন দার ঘনিষ্ঠ অনুরাগীদের (যাদের মধ্যে আমিও ছিলাম) মনে হয়েছিল, আমরা বাঁধনদা-কে যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি। আমরা মানে আমি বলছি,যারা প্রশাসনের কর্তৃত্বে না থেকেও আদর্শগতভাবে বামপন্থী বা মার্ক্সবাদী,তারা এই ধরনের শিল্পীদের, বিশেষত যাঁরা নিজেদের শিল্প ও সত্তাকে বন্ধক রাখতে রাজি হননি, মাফিয়াদের কাছে নিজেদের বিক্রি করেননি, তাঁদের জন্য কিছুই করে উঠতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় আমাদের সমাজের,যে সমাজের সৌন্দর্য ও সাম্যের লক্ষ্যে সমীরদা-র মতো মানুষ ও শিল্পী আমৃত্যু দায়বদ্ধ ছিলেন।