সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
(চন্দ্রযান ৩ এর সফল অবতারণ ঘিরে এই গল্পের সব চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক)
মোবাইলটা একনাগাড়ে বাজছিল, ইজি চেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ ডাঃ কপিলেশ্বর মিশ্র, হঠাৎ পাশের টেবিলে ফোনটার আওয়াজ খেয়াল হতেই তাড়াতাড়ি মোবাইলটা ওঠালেন। ওদিক থেকে স্ত্রী সুমিতার চিন্তিত গলা, “অনেকক্ষণ ফোন করছি তোমাকে, পাচ্ছি না, কি ব্যাপার? মুঙ্গেরে সব ঠিক তো? তোমার শরীর ঠিক আছে?”
কপিল মিশ্র কম কথার মানুষ, শান্ত স্বরে বললেন, “ভালো আছি, আজ একটু পরেই মুঙ্গের থেকে বেরোচ্ছি।” ওদিক থেকে সুমিতার প্রশ্ন, “তোমার ফ্লাইট ক’টায়?”
তিনি একটু অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দেন, “পাটনা থেকে ফ্লাইট বিকেল পাঁচটায়, দিল্লী পৌঁছাতে সাতটা হয়ে যাবে।” সুমিতা বলে, “সাবধানে এসো, গোপাল গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে থাকবে, রাত্রে বাড়িতে খাবে।”
এদিক থেকে কপিল মিশ্রর শান্ত স্বরের উত্তর, “আমার দেরি হলে তোমরা খেয়ে নিও।”
ফোনটা রেখে ঘড়ির দিকে তাকালেন, গাড়ি আসতে এখনো কিছু দেরি, গাড়ি এলে তিনি জানেন চাচাতো ভাই রামেশ্বর তাকে ডাকবে, তার চিন্তার কিছু নেই। গতকাল বেইজনাথপুর থেকে ফিরে এসে অবধি নানা চিন্তা তার মনে ভাসছিল,কেন জানি তার চোখে বার বার ভাসছিল চাঁদের দক্ষিণ মেরুর বিখ্যাত শকলটন গহ্বরের ছবি, ঘন কালো অন্ধকার অতলান্ত এক গহ্বরকে ঘিরে সারি সারি উজ্জ্বল উচু পর্বত চুড়োরা দাঁড়িয়ে। সেই গহন অন্ধকারে সূর্যের আলো পৌঁছায় না, বছরের পর বছর উজ্জ্বল আলোকিত শৃঙ্গরাজি ঘিরে থাকে সেই তমসাচ্ছন্ন গহ্বরকে।
এর ঠিক মাস খানেক আগের ঘটনা, চন্দ্রযান ৩-এর চাঁদের মাটিতে সফল অবতরণ মাত্র ব্যাঙ্গালোরের ইসরোর কন্ট্রোলরুম হাততালি আর উল্লাসে ভরে উঠল। সেই বিশাল হলঘরে উপস্থিত বৈজ্ঞানিক, ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মীবৃন্দ একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন সাফল্যের আনন্দে। এই সাফল্য অসংখ্য বৈজ্ঞানিক, ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মীদের, বিগত চার পাঁচ বছরের নিরলস গবেষণা ও পরিশ্রমের ফল। চাঁদে অবতরণে ভারত চতুর্থ সফল দেশ হলেও চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামার সাফল্য একমাত্র ভারতেরই। এই অঞ্চলে নামা খুবই কঠিন, তাই চন্দ্রযানের এই অবতরণ ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানীদের সফলতাকে এক নূতন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর বিশেষত্ব হচ্ছে যে এই অঞ্চলকে পৃথিবী থেকে দেখা যায় না এখানে সূর্যের আলো সরাসরি পড়েনা, এ এক স্থায়ী ছায়া অঞ্চল, এখানে কেবল উঁচু পাহাড়ের চুড়ারা সূর্যরশ্মির আলোয় জ্বলজ্বল করে। এই বিশেষ স্থানে নামার জন্য ইসরোর বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী জ্যোতির্পদার্থবিদ ডঃ কপিলেশ্বর মিশ্রর অবদান প্রভূত। কন্ট্রোলরুমে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইসরোর ডেপুটি ডিরেক্টর, চাঁদের মাটিতে বিক্রম ল্যান্ডার নামার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কপিল মিশ্রকে জড়িয়ে ধরলেন আনন্দে। আমেরিকার NASA থেকে ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, সর্বত্র এই পঞ্চাশোর্ধ ভারতীয় জ্যোতির্পদার্থবিদ এক অতি পরিচিত নাম, তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা ও নির্ভুল গানিতিক গণনাই ভারতের এই সাফল্যের অন্যতম কারণ।
দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতারা এই সাফল্যে ইসরোর সকল বৈজ্ঞানিক ও কর্মীদের অভিনন্দন জানালেন, এরই সঙ্গে দেশ বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে অভিনন্দনের বন্যা বয়ে গেল। দেশের মাটিতে আনন্দের জোয়ার, ভারতের এই বিশাল সাফল্যকে নানা জায়গায় বড় বড় টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হয়, চন্দ্রযানের সাফল্যে গ্রামে শহরে আতস বাজি পোড়ানো হয়। হাসিমুখ একঝাঁক বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের দূরদর্শনের পর্দায় হাত নাড়ার ছবি দেশের মানুষের উন্মাদনা বাড়িয়ে দেয়। এরই মধ্যে বিহারের মুঙ্গের শহরে আজ বিশেষ উল্লাস ও উত্তেজনা, শহরের মানুষের মধ্যে আজ প্রবল উৎসাহ। চন্দ্রযান প্রকল্পে যে সব প্রথম সারির বিজ্ঞানীরা জড়িত, তারই একজন মুঙ্গেরের ডঃ কপিলেশ্বর মিশ্র, যদিও বহু বছর ধরে তিনি মুঙ্গেরের বাইরে, তবুও ঘরের ছেলের সাফল্য কে না দেখতে চায়। চাঁদে চন্দ্রযানের অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে মুঙ্গেরের মানুষ ফেটে পড়ল উল্লাসে। মুঙ্গেরে এ এক নতুন জিনিস, নির্বাচনে প্রার্থীর জয় আর ক্রিকেটে ভারতের জয় ছাড়া অন্য বিষয়ে শহরের মানুষের মধ্যে এরকম উৎসাহ আগে কেউ কখনো দেখে নি।
অবশ্য সকলে যে একই রকম উৎসাহী তা নয়, শহর ও তার আশে পাশে অনেক মানুষই আছে যাদের কাছে বিষয়টার তেমন গুরুত্ব নেই। এই সব মানুষদের বেশির ভাগই অবশ্য স্মার্টফোন আর সমাজ মাধ্যমের মুঠির বাইরে। বাজারের সাইকেলের টিউব সারানোওলা বছর পনেরোর ছেলেটা পাশের চায়ের দোকানে কাজ করা বারো বছরের আদিবাসী ছটুকে জিজ্ঞাসা করে, কি হয়েছে রে, এতো বাজি ফাটছে কেন? ভারত জিতেছে? ছটু চা খেতে আসা মানুষের কথা শুনে তার বিদ্যা ফলায়, আজ মুঙ্গেরের ছেলে চাঁদে দেশের পতাকা উড়িয়েছে। বলতে বলতে তাদের সামনে দিয়ে চার পাচটা ছেলে মোটর সাইকেলে তিরঙ্গা পতাকা লাগিয়ে ভারত মাতা কি জয় চিৎকার করতে করতে দ্রত রাস্তা দিয়ে চলে যায়। বয়স্ক একজন মানুষ সাইকেলে মাল নিয়ে যাচ্ছিল, সে ভয়ে তাড়াতাড়ি সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়ায়।
বিভিন্ন সম্বর্ধনা ও আভিনন্দন পর্বের অনুষ্ঠানশেষে ক্লান্ত ডাঃ মিশ্র দিন পনেরো পর দিল্লিতে তাঁর বাড়ি ফিরলেন। অনেকদিন বাড়ির বাইরে তিনি, একটা লম্বা ছুটি চাইছিলেন, চাইছিলেন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে। এরই মধ্যে পাটনার মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বেশ কয়েকবার তাকে আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছে তাকে বিশেষ সম্বর্ধনা দেবার জন্য। শান্ত স্বভাবের মানুষ ডঃ মিশ্র এই সব হুজুগ ভালোবাসেন না, তা ছাড়া স্কুলের পর থেকেই তিনি বিহারের বাইরে, কেবল ছুটিতে মাঝে মাঝে মুঙ্গেরে বাড়ি ফিরতেন। কপিল মিশ্র ভাবলেন অনেকদিন মুঙ্গের যাওয়া হয় নি, এই বাহানায় গেলে ক’দিন বিশ্রাম হবে আর এই সব রাজনীতির লোকেদের কিছুটা শান্তও করা যাবে। তিনিও মুঙ্গেরে তাদের পৈতৃক বাড়িতে যান নি বহুদিন। বাবা দ্বারকেশ্বর মিশ্র বছর দশেক আগে মারা যান। তার পর থেকে তিনি আর মুঙ্গেরে যান নি। মা বাবা মারা যাবার বছর খানেক আগে মারা যান, ফলে তাঁরও আর তেমন গরজ ছিল না, সঙ্গে কাজের চাপ তো ছিলই।
তার চাচার ছেলে রামেশ্বর তাদের মুঙ্গেরের বাড়ি ও তাদের দেশের সম্পত্তি দেখাশোনা করে। চন্দ্রযানের সাফল্যে রামেশ্বরের গুরুত্বও বেশ বেড়ে গেছে আশেপাশের লোকজনের কাছে। সেও এর মধ্যে বেশ কয়েকবার দিল্লিতে সুমিতাকে ফোন করে জানতে চেয়েছে, ভাইয়া কবে মুঙ্গের আসছে।
কিছুদিন পর বিহারের গর্ব কপিলেশ্বর মিশ্রকে পাটনায় রাজকীয় সম্বর্ধনা দিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। সভায় ঘোষণা করলেন আগামী দিনে ডঃ কপিলেশ্বর মিশ্রই আধুনিক বিহারকে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে দিশা দেখাবেন। এর পর মুখ্যমন্ত্রী সচিবালয়ে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করলেন এবং শেষে অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়ে তাঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ আলোচনা হল নানা বিষয়ে, কি ভাবে বিহারের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো ভালো করা যায়। অভিজ্ঞ কপিল মিশ্র ঘাড় নাড়ছেন, তিনি জানেন এসবই সংবাদ মাধ্যমের খবরের জন্য। তিনি যখন মিটিং শেষে সেখান থেকে বেরোচ্ছেন হঠাৎই একজন ষণ্ডাগণ্ডা চেহারার সাদা প্যান্টশার্ট পরা লোক তাঁর সামনে হাসি মুখে হাত জোর করে বলে, “স্যার, অধমের নাম বিক্রম ঠাকুর, খড়গপুরের বিধায়ক, আপনি একবার বৈজনাথপুর আসুন, আমরা খুব খুশি হবো।” কপিল মিশ্র একটু অবাক হলেন, তাঁর গ্রামের অঞ্চলের এম এল এ দেশের খবরও জানে দেখে, কিন্তু তিনি হাত জোর করে স্মিত হেসে ঘাড় নেড়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।
পাটনার পর তিনি মুঙ্গের এলেন। মুঙ্গেরেও সরকারি উদ্যোগে তাঁকে বিশেষ সম্বর্ধনা দেওয়া হল। অনেক দিন পর দিল্লী, ব্যাঙ্গালোর হায়দরাবাদ ছেড়ে নিজের এই ছোট শহরে ফিরে তাঁর ভালোই লাগছিল। একদিন বাঙালিটোলার সেন্ট জেভিয়ারস স্কুল তাদের জগতবিখ্যাত প্রাক্তনীকে বড় করে সম্বর্ধনা দিল। ছোটবেলার স্কুলের নানা স্মৃতি তাঁর মনে আসছিল। সেন্ট জেভিয়ারস স্কুলের পর বেশিরভাগ সময় বাইরে কাটানোর কারণে তাঁর ছোটবেলার বন্ধুদের কারুর সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ নেই। শহরটা অনেক বদলে গেছে, চারিদিকে বাড়ী আর দোকান, ফাঁকা জায়গা প্রায় নেই। রাস্তায় গাড়ির ভিড় খুব বেশী, বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত রিক্সার সংখ্যা অগণিত।
অনেকটা জায়গা নিয়ে তাঁদের পুরোনো দোতলা বাড়িটার চারপাশে বড়বাগান, সকালসন্ধ্যে বাগানটা পাখির আওয়াজে ভরে থাকে। বাড়ীতে এখন কেউ নেই, চাচা অনেক আগে ব্যবসার কারণে পাটনায় চলে গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত বাবা মা থাকতো, তারা দুজনেই এখন আর নেই। রামেশ্বর তার পরিবার নিয়ে এই বাড়ির একতলায় থাকে আর তাঁদের দেশের জমিজমা দেখে। মুঙ্গেরে দু তিনদিনের মধ্যেই তাঁর সম্বর্ধনার রেশ কেটে যেতেই লোকের মধ্যেও ধীরে ধীরে চন্দ্রযানের উৎসাহ থিতিয়ে এলো।
সেদিন সকালে কপিল মিশ্র উপরে বারান্দায় বাবার ইজিচেয়ারে বসেছিলেন, হাতে একটা বই, আর দিনকয়েক পর দিল্লী ফিরে যাবেন। বেশ কয়েকদিন ঝুট ঝামেলার পর এই শান্ত সকাল তাঁর ভালোও লাগছিল। দোতলার ঘরে ইজিচেয়ারে বসে থাকতে থাকতে অনেক পুরোনো দিনের স্মৃতি মনে ভিড় করে আসছিল, এমন সময় উপরের ঘর থেকে দেখলেন, তাঁদের বাড়ির সামনে একটা ব্যাটারি রিক্সা এসে দাঁড়িয়েছে। অতি সাধারন জামাকাপড় পরা এক যুবক, সাদা ধুতি ফতুয়া পড়া একজন বয়স্ক মানুষকে ধরে ধরে রিক্সা থেকে নামাল।
তাদের দেখে রামেশ্বর বেরিয়ে গেটের কাছে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে কিছু বলছিল, তাঁর কানে এল সে বলছে, “চাচা, কপিল ভাইয়া আর বাচ্ছা নেই এখন খুব বড় নামকরা লোক, তার মন্ত্রী এম এল এদের সঙ্গে দেখা করার সময় নেই আর তোমাদের সঙ্গে কথা বলবে।”
বৃদ্ধ হতাশ চোখে রামেশ্বরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল। রামেশ্বর কিছু বলার আগেই কপিল মিশ্র উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “রামেশ্বর কি হয়েছে?”
বৃদ্ধ ও যুবক দুজনেই উপরে তাঁর দিকে তাকাল, দুজনের চোখেই আশার আলো, রামেশ্বর বিরক্ত চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচা কোন খবর না দিয়ে বেইজনাথপুর থেকে এসেছে ভাইয়া, আপনার সঙ্গে কথা বলতে।” তিনি উপর থেকে বললেন, “ওদের বসাও, আমি আসছি।”
রামেশ্বর বিরক্ত হয় কিন্তু কিছু বলে না, সে দুজনকে নিচের বসার ঘরে বসাতে বসাতে কপিল মিশ্র উপর থেকে নেমে এলেন। ওদের নমস্কার করে চেয়ারে বসতেই রামেশ্বর পরিচয় করিয়ে দিল, বলল, “দীননাথ যাদব, বেইজনাথপুরে থাকে,” তারপর যুবকের দিকে তাকিয়ে বলল, “গোপেশ্বর ওনার নাতি, আমাদের জমি সব এনারাই দেখাশোনা করে।”
কপিল মিশ্র ওদের দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলেন, “আপনিই তো দীননাথ চাচা! বৃদ্ধের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বলেন, “তোমার মনে আছে?”
তিনি বলেন, “ছোটবেলায় আপনি বাবার কাছে আসতেন, আপনি এলে মা বাবা কত খুশি হতো! তারপর জিজ্ঞাসা করেন, “বলুন চাচা কি ব্যাপার?”
ওরা কিছু বলার আগেই রামেশ্বর কিছুটা ব্যঙ্গের সুরে বলে ওঠে, “চাচা আপনাকে বেইজনাথপুর নিয়ে যেতে চায়।” কপিল মিশ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকালে, দীননাথ যাদব আস্তে আস্তে বলেন, “বেটা তোমাকে কত ছোট দেখেছি, তুমি দ্বারকেশ্বরজীর ছেলে, আজ কত বড় মানুষ হয়েছো, সারা দেশ তোমার কথা বলছে, তুমি আমাদের গর্ব, তাই খুব দেখার ইচ্ছা হোল। তোমার পিতাজী আর আমি বন্ধুর মতো ছিলাম, আমরা খুব কাছের মানুষ ছিলাম।”
তারপর একটু থেমে বললেন, “তোমার পিতাজী হঠাৎ চলে না গেলে আজ কত খুশি হতেন, তুমি ওর স্বপ্ন সফল করেছ।”
তরুণ গোপেশ্বর মাথা নিচু করে নীরবে বসে ছিল, তিনি বলে চললেন, “তোমার পিতাজি জানতেন যে তুমি একদিন আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করবে। তোমার কথা খুব বলতেন। তাঁর কাছেই তোমার পাটনা যাওয়া, দিল্লী, ব্যাঙ্গালোরে পড়তে যাওয়া, তোমার বিদেশ যাওয়া সব কথাই আমি শুনেছি।
কপিল মিশ্র বলেন, “এ কি চেহারা কি হয়েছে আপনার?”
বৃদ্ধ বলেন, “অনেক বয়েস হল, তোমার বাবা আর আমি একই বয়েসী, উনি সেই কবে চলে গেছেন, আমি এখনো রয়ে গেছি। শেষের দিকে আমাদের দেখাও কম হত, যে গ্রামকে তিনি এত ভালোবাসতেন সেই গ্রামেই তিনি শেষ কবে গেছেন তাও মনে নেই।
বৃদ্ধ আপনমনে স্মৃতিচারণ করে চলেন, “সে সব কি দিন ছিল! বেইজনাথপুর থেকে জামুনিয়া পর্যন্ত খড়গপুর পাহাড়ির ভিতরের নানা গ্রামে তোমাদের অনেক সম্পত্তি ছিল। সে সময় কিসব মানুষ ছিল, স্বাধীনতার পর তোমার ঠাকুরদা মহাবীরপ্রসাদ মিশ্র বিনোবা ভাবের ভূদান আন্দোলনে সোনাবাঁধ, লছিমপুর, বান্দরগাঁও-এর অনেক জমি দান করে দেন, আমরা তখন অনেক ছোট। গ্রামে আমরা ক’ঘর যাদব, বাকি সব আদিবাসী আর মুশাহার। আমি যাদব হলেও আমার পড়াশোনার ইচ্ছা দেখে তিনি আমাকে মুঙ্গেরে তোমাদের বাড়িতে রেখে পড়ান। তোমার পিতাজি, চাচা আর আমি এক সঙ্গে ইস্কুলে, কলেজে গেছি।”
একটু থেমে বলেন, “দ্বারকেশ্বরজি আর আমি একদিকে বন্ধু ছিলাম আবার অন্যদিকে যেন ভাই। মুঙ্গেরে থাকলেও কলেজে পড়ার সময় থেকেই তোমার পিতাজি গ্রামের উন্নতির কাজে লেগে পড়েন, তখন আমারও বয়স কম, আমিও ওনার সঙ্গে জড়িয়ে যাই। ওনার চেষ্টাতেই পঁচাত্তর সালে বেইজনাথপুরে ঐ অঞ্চলের প্রথম ইস্কুল আর স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয়, তখন আমরা দুজনে অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছিলাম। তখন স্কুল চার ক্লাস পর্যন্ত ছিল, এখন সেই ইস্কুল হাই ইস্কুল হয়েছে, এইট পর্যন্ত পড়ানো হয়। গ্রামের স্কুল রাস্তা এসবের জন্য আমরা দুজন কত দৌড়াদৌড়ি করেছি, পাটনায় মন্ত্রীর কাছে পর্যন্ত গেছি।”
কথা শুনতে শুনতে কপিল মিশ্রর তাঁর রাশভারী বাবার কথা মনে পড়ছিল। তিনি ছোটবেলা থেকে পিতাজিকে ভয় পেতেন, অথচ তিনি কখনো তাঁকে বকেনও নি। তাঁর পড়াশোনার প্রতি পিতাজির সবসময় সজাগ দৃষ্টি থাকত, কিছু না বললেও তাঁর সকল প্রয়োজনে পিতাজির উপস্থিতি তিনি সব সময় অনুভব করতেন। তিনি তাঁর মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলেন তাঁর গান্ধীবাদী বাবা বিহারের খুব পিছিয়ে পড়া অঞ্চল বলে খড়গপুর পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জন্য খুব ভাবতেন। তিনি খুব মন দিয়ে বৃদ্ধের কথা শুনছিলেন।
দীননাথ চাচা বললেন, “সেই যে আশিতে মুঙ্গেরে জাতি দাঙ্গা শুরু হল তাতেই সব শেষ হয়ে গেল, তোমার বাবা, আমি, আমরা সব হেরে গেলাম।”
বলে চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন পুরোনো আবেগকে বশে আনার জন্য। তাঁর মনে পড়ল তিনি যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়েন তখন মুঙ্গেরে ভীষণ ঝামেলা চলছিল, প্রায়শই গোলাগুলি চলত, অনেক লোক খুন হয়েছিল বলে বাবা তাঁকে পাটনায় চাচার কাছে পাঠিয়ে দেন, তিনি সেখানকার স্কুলে ভর্তি হন।
রামেশ্বর খাবার নিয়ে এসে গিয়েছিল, সে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আজ ভাইয়াকে নিতে এসেছ, অথচ বড় চাচাই তো শেষ পনেরো বছর গ্রামে যান নি।
দীননাথ যাদব মাথা নিচু করে নিজের আবেগকে যেন কিছুটা বশে এনে বলেন, “কি করবো বলো বেটা, যেদিন থেকে কিষাণ চলে গেল সেইদিন থেকে দ্বারকেশ্বরজী আর গ্রামে আসেননি, আমারও আর আসা হতো না।এরপর দুজনে নীরবে খাবার খেতে লাগলেন।
খাওয়া হয়ে গেলে যাবার আগে তিনি কপিল মিশ্রর হাত দুটো ধরে বললেন, “এখন তো নকশালদের ঝামেলাও কমেছে, একবার তোমাদের গ্রাম দেখতে যাবে না? তুমি একবার বেইজনাথপুরে এলে গ্রামের মানুষ খুব খুশি হবে। তোমরা না দেখলে গ্রামের মানুষদের দেখবে কে?”
কপিল মিশ্রর ভীষণ কৌতূহল হোল, ভাবলেন একবার ঘুরে এলে ক্ষতি কি? এত বছর দূরে দূরে থাকতে থাকতে তিনি পিতাজির সম্পর্কে এত কম জানেন। মুখে বললেন, “চাচা, খুব ব্যাস্ত তো, আবার দিল্লী ফিরতে হবে, দেখি যদি সম্ভব হয়, না হলে পরে একবার নিশ্চয়ই যাবো।”
দীননাথ চাচা কাতর কন্ঠে বলেন, “তুমি বড় মানুষ, ফিরে গেলে আর সময় পাবে না, এবার একটু চেষ্টা করে দেখো।”
কপিল মিশ্র সহানুভূতির সঙ্গে বললেন, “আপনাদের কোন মোবাইল নম্বর থাকলে দিয়ে যাবেন, যাবার চেষ্টা করব, যাওয়ার যদি ঠিক হয়, তাহলে খবর দেবো।”
গোপেশ্বর তাড়াতাড়ি বলল, “রামেশ্বর চাচার কাছে আমাদের নম্বর আছে।”
দিন দুয়েক পর একটা গাড়ি ভাড়া করে তিনি আর রামেশ্বর বেইজনাথপুরের উদ্দেশ্যে সকাল সকাল রওনা দিলেন। রামেশ্বরের ইচ্ছা ছিল মুঙ্গেরের বিধায়ককে খবর পাঠানোর, তাহলে ডিসট্রিক্ট কালেক্টরসহ অফিসাররা থাকত। কিন্তু কপিল মিশ্র চাইছিলেন না কোন সরকারি আড়ম্বর, আগের রাতে কেবল দীননাথ যাদবকে রামেশ্বর খবর দিয়েছিল গোপেশ্বরের মাধ্যমে যে পরের দিন তারা যাচ্ছে। যেতে যেতে তিনি ভাবছিলেন, সেই কোন ছোটবেলায় বাবা, মা, চাচা, চাচীর সাথে এসেছিলেন বেইজনাথপুর, এখন আর তেমন মনে নেই। তিনি ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় ভীষণ ভালো ছিলেন, সব পরীক্ষায় তিনি প্রথম হতেন বলে পিতাজি তাঁকে কখনো সংসার জমি জায়গা এসবের মধ্যে নিয়ে আসেননি। তিনিও ডুবে ছিলেন পড়াশোনার মধ্যে, স্কুল শেষ করে কলেজ হোস্টেল, তারপর থেকে তো ব্যাঙ্গালোর দিল্লিতেই বেশি সময় কেটেছে। তিনি জানতেন বৈজনাথপুর ঠিক তাঁদের দেশ নয়, সেটা তাঁদের জমিদারি, তাঁদের পৈতৃক বাড়ি মুঙ্গেরেই, কিন্তু তবুও তাঁর বাবা ঠাকুরদা ও তাঁদের পরিবার এক অদৃশ্য সুতোয় ঐ দুরের গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। দীননাথচাচার কথা শুনে অনেক বছর পর তাঁর মনে হল এখনো যেন অনেক কিছুই জানা বাকি রয়ে গেছে।
মুঙ্গের থেকে ৫০ কিমি দক্ষিণে খড়গপুর পাহাড়ের কোলে বৈজনাথপুর, যেতে যেতে রামেশ্বর বলল, “ভাইয়া বেইজনাথপুর যাবার পথে ঋষিকুণ্ডে গরম পানির কুণ্ড আছে, যাবেন?
অনেক দিন এরকম হঠাৎ বেরোন হয় নি, কপিল মিশ্র বাইরের দিকে তাকিয়ে নীরবে ঘাড় নাড়লেন।
মুঙ্গের শহর গঙ্গার দক্ষিণ কোলে, শহর ছাড়ার পরই সবুজ আনাজপাতির খেত দু’পাশে। এরকম সহসা বেরিয়ে পরা তাঁর ধরাবাঁধা জীবনে একটা অস্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর ভালই লাগছিল। গাড়ি রাস্তা ধরে যত দক্ষিণে যেতে লাগল, দিগন্তে সারি সারি খড়গপুর পাহাড়ের চুড়া দেখা যেতে লাগল, দু’পাশে চাষের জমি। ঘণ্টা দেড়েক পর গাড়ি একটা বড় নালা পেরিয়ে পাহাড়ের কোল ঘেঁসে তাঁদের গ্রাম বেইজনাথপুরে পৌছোল, এর পরই পাহাড় আর বড় গাছের জঙ্গল শুরু। গ্রামে ঢোকার বেশ কিছুটা আগে একটা উঁচু জায়গা কাঁটা তারের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘিরে বিরাট সি আর পি এফের ক্যাম্প। তিনি গাড়ি থেকে দেখলেন দু জন জওয়ান কাঁধে আধুনিক বন্দুক নিয়ে ক্যাম্পের গেটে দাঁড়িয়ে।
ওঁদের গাড়ি ধুলো উড়িয়ে গ্রামে ঢুকতেই বাচ্চা ছেলে মেয়ের দল গাড়ির পিছনে হই হই করে দৌড়োতে লাগল। গাড়ি তাঁদের পুরানো বাড়ির সামনের খামারে থামতেই গ্রামের লোকজন এসে গাড়ি ঘিরে ধরল। তাঁদের পুরোনো দিনের চুন সুরকির বাড়ির নানা জায়গায় ইট বেরিয়ে এসেছে, সামনের কাঠের কালো দরজায় বড় পুরোনো দিনের তালা ঝুলছে, বাড়িও ব্যবহার না হবার কারণে ভেঙে পড়ছে, আর বাসযোগ্য নেই। তাঁরা গাড়ি থেকে নামতেই চাচা আপ্যায়ন করে পাশেই নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসালেন, সেখানে তাদের আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল। গ্রামের অনেক লোকজন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য বাড়ির উঠোনে, বাইরে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল। আপ্যায়ন পর্ব চুকতেই কপিল মিশ্র বললেন, তিনি একবার গ্রামের স্কুল দেখতে চান, শুনে দীননাথ চাচা খুশি হয়ে তাঁকে বাইরে নিয়ে এলেন।
বাইরে এসে চাচা উপস্থিত গ্রামের বাসিন্দাদের তাঁর সম্বন্ধে খুব করে বললেন, আর গ্রামের দু একজনের সঙ্গে চাচা তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন। উপস্থিত গ্রামের বাচ্চা ছেলেমেয়েদের আর মানুষ জনের চেহারা, পোশাক আশাক দেখে কপিল মিশ্র বুঝলেন, গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁর সামনেই একটা ছয়-সাত বছরের বাচ্চা হাফপ্যান্ট পরে খালি গায়ে কোলে একটা বছর খানেকের দুর্বল শিশুকে নিয়ে তাঁর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। বেশিরভাগ বাচ্চারই ছেঁড়া জামা খালি গা। তাঁর উচ্চ মধ্যবিত্ত শহুরে জীবনে এই সব মানুষজনের দেখা খুব একটা মেলে না। এই পরিবেশ তাঁর অচেনা অথচ এ তাঁদেরই গ্রাম।
ততক্ষণে গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক মানুষ তাঁকে ঘিরে ধরে বলছিল তাঁর বাবা আর ঠাকুরদার কথা, তাঁদের পরিবারের কত অবদান আছে এই গ্রামের জন্য। দীননাথ চাচা তাঁকে সেখান থেকে নিয়ে গিয়ে গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার আর এক শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, দুজনেই কম বয়েসী। তারা বছর পাঁচেক হল এই স্কুলে এসেছে নকশালদের ঝামেলা কমার পর, দুজনেই আদিবাসী, এম এ পাস। কপিল মিশ্র তাদের দেখে একটু আশ্বস্ত হলেন।
তারা কপিল মিশ্রকে ইস্কুলে নিয়ে যেতে যেতে বলল, স্কুলের ছেলেমেয়েরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে।
তাঁরও কৌতূহল হচ্ছিল বাবার তৈরি স্কুল দেখার জন্য। দল বেঁধে যেতে যেতে দীননাথ চাচা বললেন, “ইস্কুলের জমিও তোমাদের, তোমার বাবার চেষ্টায় যখন স্কুলের অনুমতি পাওয়া যায় তখন জমির দরকার ছিল। দ্বারেকশ্বরজির কথায় তোমার ঠাকুরদা এই জমি স্কুলের আর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য দান করেন।
স্কুল যাবার পথে রাস্তার ধারে একটা বড় অশ্বথগাছের নিচে একটা টিনের চালের ঘরে তাঁকে নিয়ে গোপেশ্বর ঢুকল, সাথে স্কুলের দুই মাস্টার। ভিতরে জনা বারো-চোদ্দ-পনের বছর বয়েসী ছেলেমেয়ে তাঁদের দেখে মেঝেতে শতরঞ্জি থেকে উঠে হাত জোর করে দাঁড়াল। সেখানে একটি বাইশ তেইশ বছরের ছেলে তাঁকে দেখে হাতজোড় করে নমস্কার করতেই গোপেশ্বর বলল, “স্যার এই রামদয়াল, এইসব এইট পাশ ছেলে মেয়েদের ও-ই পড়ায়।” তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “টিউশন?”
গোপেশ্বর হেসে বলল, “টিউশন পড়ানোর মতো পয়সা এরা কোথায় পাবে? আসলে গ্রামের হাই স্কুলে তো ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ানো হয়, এরা সব এইট পাশ করে গেছে, পরের বছর দূরের গ্রামে হায়ার সেকেন্ডারি ইস্কুলে নাইনে ভর্তি হবার চেষ্টা করবে, তাই ওরা যাতে সব ভুলে না যায়, তাই রামদয়াল ওদের দেখায়।”
উনি জিজ্ঞাসা করে জানলেন সব থেকে কাছের হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল এখান থেকে ১০ কিমি দূর। খোঁজ নিয়ে জানলেন রামদয়ালের মাইনে মাসে তিন হাজার টাকা, সেটা আসে দীননাথ চাচার বাড়ি থেকে। গোপেশ্বর তাঁকে বলছিল যে এখানকার বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই খুব গরিব আর সুযোগের অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়, তাই যারা একটু আগ্রহী তাদের সাহায্য না করলে এরাও পড়া ছেড়ে দেবে। ডঃ কপিলেশ্বর মিশ্র ধীরে ধীরে সেই ভাঙ্গাচোরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এই সহসা অ্যাডভেঞ্চার তাঁর সামনে এক নতুন অজানা অচেনা দেশকে ধীরে ধীরে খুলে ধরছে।
দোতলা স্কুলের সামনে বড় মাঠ। সেখানে ছেলেরা তাঁদের জন্যে সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, চারিদিকে বড় বড় গাছ। স্কুল লাগোয়া একটা বড় দোতলা বিল্ডিং, দেখলে বোঝা যায় অনেকদিন ব্যবহার হয় নি, বাইরে একটা চটা ওঠা বোর্ড।
তিনি দীননাথ চাচাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই বাড়িটা কিসের?”
চাচা বললেন, “এটা গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, তোমার বাবার চেষ্টায় শুরু হয়। প্রথমে একজন ডাক্তার মাঝে মাঝে আসত, তারপর ১৯৯৯ সালে একজন সরকারি ডাক্তারের পোস্টিং হয়। কিন্তু দু বছর থেকে সেই যে সে চলে যায়, তারপর আজ তেইশ বছর এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সরকার কোন ডাক্তার পাঠায় নি।”
কপিল মিশ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “তাহলে লোকে শরীর খারাপ হলে কি করে?”
গোপেশ্বর পাশ থেকে বলে, “ঐ পঁচিশ কিলোমিটার দূরে খড়গপুরের গঞ্জে একজন হাতুড়ে ডাক্তার বসে, তার কাছে যায়।”
তাঁদের আগে আগে তখনো সেই ছোট ছেলেটা কোলে শিশুটাকে নিয়ে হাঁটছিল, তাদের দেখিয়ে গোপেশ্বর বলল, “এইতো ছয় মাস আগে এদের মা কলেরাতে মারা গেল, কিছুই করা গেল না।” কপিল মিশ্রর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে এই দুটো দুর্বল শিশুর মা-ও নেই। তাঁদের কথা হচ্ছে বুঝে বাচ্চাটা অবাক চোখে তাঁদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, কাঁধের শিশুটি দাদার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে আঙ্গুল চোষে। ধীরে ধীরে ডাঃ কপিল মিশ্র যেন ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিলেন এক গভীর অন্ধকারে, নিজেকে এই রকম অসহায় আগে কখনো মনে হয় নি।
স্কুলে অফিস, হেডমাস্টারের ঘর আর শিক্ষকদের ঘর নিয়ে সাকুল্যে গোটা বারো ঘর, ছাত্রছাত্রীরও অভাব নেই কিন্তু সব মিলিয়ে শিক্ষক চার জন, যদিও পোস্ট আছে ৮ জন শিক্ষকের, তার মধ্যে একজন অস্থায়ী শিক্ষক, ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গে হেড মাস্টার দীনেশ কোডার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে। তাঁর বুঝতে অসুবিধা হল না যে এই প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষা আর স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল কি ভয়াবহ।
গোপেশ্বর তাকে বলল, “সেই ২০০০ সালে যে কজন শিক্ষক ছিল, আজও তাই আছে, বাকি পোস্ট ভরা হয় নি।”
তাঁকে নিয়ে শিক্ষকরা স্কুলের সব ক্লাসে ঘুরিয়ে দেখালো। ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করে বুঝলেন, বেশিরভাগ ছেলে মেয়েই অপুষ্টিতে ভুগছে, সব গরীব আদিবাসী পরিবারের ছেলে মেয়ে।
হেড মাস্টার যুবকটি বলে, “স্যার বেশিরভাগই ইস্কুলে আসে মিড ডে মিলের জন্য, পড়াশোনা করার মতো বাড়ির অবস্থা খুবই কম। যাদের অবস্থা একটু ভালো, তারা অনেক আগেই ছেলেদের দূরের একলব্য ইস্কুলে দেয়, নাহলে মুঙ্গেরের ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলে পাঠায়, যেমন গোপেশ্বর ভাইয়ার ছেলে মুঙ্গেরে পড়ে।”
তিনি গোপেশ্বরের দিকে তাকাতে সে বলে, “স্যার, আপনি তো দেখছেন এখানে শিক্ষার অবস্থা। আমার ছেলে মাত্র আট বছরের সে গ্রামে থাকতে চায় মায়ের কাছে নানির কাছে, কিন্তু কি করব বলুন।”
ডঃ মিশ্রর মনে পরে গেল মাস ছয়েক আগে আই আই টি মাদ্রাজে উজ্জ্বল মেধাবী একঝাঁক সদ্যযুবার সামনে দেওয়া তাঁর আধুনিক ভারত ও বিজ্ঞান শিক্ষার উপর বক্তৃতার কথা। সেখানে তিনি তুলে ধরেছিলেন একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক ভারতবর্ষের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার কথা। তাঁর সেই বক্তৃতা এখনো নাকি সমাজ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে আছে। তিনি এই পরিবেশে অসহায়ের মতো ভাবছিলেন সেই ভারতবর্ষের সঙ্গে এই সব শিশুদের কি সম্পর্ক? এরা বড় হচ্ছে কোন ভারতবর্ষে?
ভাবতে ভাবতে তিনি একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলেন, এমন সময় হেডমাস্টার দীনেশের কথা কানে এল। সে বলছিল, “স্যার, কিছু যদি মনে না করেন, তাহলে একটা অনুরোধ করি। তিনি ঘাড় নাড়লেন, সে বলল, “ধরমবীর মানে যে এখানে কন্ট্রাক্টের শিক্ষক সে ছয় মাস কোন মাইনে পায় নি।”
তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন?”
দীনেশ মাথা নামিয়ে বলে, “এরকমই হয় এখানে।”
বললেন, “কত টাকা?”
দীনেশ বলে, “আট হাজার টাকা মাসে পায়, তাও মুঙ্গের থেকে পাঠায় না। আর আমাদের স্কুলতো হাই স্কুল, সব সেকেন্ডারি, হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের মাইনে যাবার পর আমাদের টাকা ছাড়ে। কন্ট্রাক্টের টিচারদের কেউ দেখার নেই, আপনি যদি একটু উপরে বলে দিতেন তাহলে ওর মাইনেটা এসে যেত।”
কপিল মিশ্র অসহায়ের মতো জিজ্ঞাসা করেন,”তাহলে ওর চলে কি করে?”
পাশ থেকে অন্য শিক্ষকটি বলে ওঠে, “স্যার, গ্রামে আছি আর গোপেশ্বর ভাইয়া আর দীননাথ চাচাজি আছে বলে কোন রকমে চলে যায়।”
কপিল মিশ্রর মনে পড়ে না তিনি কখনো এতো খারাপ অবস্থা আগে দেখেছেন, এত অপুষ্টি, এতো অশিক্ষা, এতো কখনো তাঁর একান্ন বছরের জীবনে চোখেও পড়ে নি। নিজেকে কিছুটা শক্ত করে তিনি গোপেশ্বরকে বলেন, “এখানকার বিধায়কের সঙ্গে পাটনায় দেখা হয়েছিল, কি যেন ঠাকুর, সে কি করে? তার কাছে গিয়েছিলে?”
কপিল মিশ্রর কথা শুনে গোপেশ্বর মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয় আর কপিল মিশ্র অবাক হয়ে খেয়াল করলেন, বিধায়কের প্রসঙ্গ উঠতেই সকলে চুপ করে গেল। দীননাথ চাচা প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন, “চলো এবার আমরা যাই।” তিনিও কিছু না বলে ফেরার পথ ধরলেন। ফেরার সময় তাঁর দুটো হাত ধরে দীননাথ চাচা বললেন, “তুমি এলে আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে, পারলে আবার এসো, তোমার পিতাজি চলে গেলেন, আমারও সময় হয়ে এসেছে, গোপেশ্বর একা চেষ্টা করছে, যদি পার তাহলে গ্রামটাকে দেখো।”
গাড়ি ফিরে চলেছে মুঙ্গেরের পথে। কপিল মিশ্র চুপচাপ বসে তাঁর গ্রাম আর গ্রামের মানুষদের কথা ভাবছেন। এখানকার শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য দুটোর অবস্থাই বর্ণনার অতীত, অথচ এ একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক ভারতবর্ষেরই অংশ। তাঁর মনে পড়ল ২০০০ সালে ভারতের চাঁদে যাবার প্রস্তুতির জন্য ‘মুন মিশন’ শুরু হয় আর ২০২৩ সালে তাঁরা চাঁদে ভারতের যান নামাতে সক্ষম হন। অন্য দিকে তাঁর বাবার তৈরি ৫০ বছর আগের স্কুল আর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের হাল এখনো সেই একই রকম। সহসা কেন জানি মনে হলো তাঁর থেকে পিতাজি অনেক বেশী দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন।
এমন সময় রামেশ্বর ভয়ে ভয়ে আস্তে আস্তে বলল, “ভাইয়া আপনি বিধায়কের কথাটা না তুললেই ভালো করতেন।” কপিল মিশ্র একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন?”
তখন রামেশ্বর কিছুটা আহত স্বরেই বলতে শুরু করল, “আমরা যখন খুব ছোট, ১৯৮৩ সালে ঠাকুর আর যাদবদের মধ্যে যে জাতি দাঙ্গা বেধেছিল তার রেশ এখনো চলছে। এখানকার এই খড়গপুরের বিধায়ক বিক্রম ঠাকুরের পরিবার দীননাথ চাচারা যাদব বলে তাদের দেখতে পারে না। কিন্তু এই অঞ্চলে বড় চাচা আর দীননাথ চাচা অনেক দিন কাজ করেছেন বলে গ্রামের মানুষ দীননাথ চাচাকে খুব মানে, তাই ঠাকুররা কিছু করে উঠতে পারে নি। এরপর দীননাথ চাচার ছেলে, গোপেশ্বরের বাবা কিষাণ ভাইয়া, আপনার বয়সীই, তিনিও মুঙ্গেরে পড়া শেষ করে গ্রামের মানুষের জন্য উঠে পড়ে লাগেন। কিষাণ ভাইয়া ১৯৯৮এর ভোটে সি পি আই পার্টির থেকে দাঁড়ায় আর জেতেও। তখনই গ্রামের এই প্রাইমারি স্কুল হাই স্কুল হয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার আসে, গ্রাম পর্যন্ত রাস্তা হয়। বড় চাচা খুব খুশি হয়েছিলেন, তিনি কিষাণ ভাইয়াকে খুব ভালোবাসতেন। যে কাজ বড় চাচা আর দীননাথ চাচা শুরু করেছিল, সেই কাজ কিষাণ ভাইয়া এগিয়ে নিয়ে যায়, গ্রামের লোকেও খুব খুশি ছিল।”
একটু থেমে সে আবার বলে চলে, “কিন্তু এতে খড়গপুরের ঠাকুরদের খুব অসুবিধা হয়। অনেক দিন ধরে বিক্রম ঠাকুরের ইচ্ছা এখানকার বিধায়ক হওয়ার কিন্তু দীননাথ চাচা আর কিষাণ ভাইয়া থাকায় তা সম্ভব হচ্ছিল না। যখন ২০০০ সাল নাগাদ গিরিডি কোডারমা থেকে নকশালরা এদিকে আসে তখন বিক্রম ঠাকুর আরো ভয় পায়। তখন সে ভয়ে বৈজনাথপুরের পরের পাহাড়ি গ্রামে ঢুকতে পারত না। এই সময় এক সন্ধ্যায় কিষাণ ভাইয়া মোটর সাইকেলে মুঙ্গের থেকে ফিরছিল, বিক্রম ঠাকুরের গুণ্ডারা সেই সময় তাকে গুলি করে মেরে ফেলে গ্রামের বাইরে, গোপেশ্বর তখন দুই তিন বছরের বাচ্চা।”
আবার একটু থেমে বলে, “বিক্রম ঠাকুর এক ঢিলে দুই পাখি মারে, দোষ যায় নকশালদের উপর আর তার বিধায়ক হবার পথের কাঁটা কিষাণ ভাইয়াকেও সরানো হয়। বিধায়ক মারা যাওয়ায় চারিদিকে হৈ চৈ শুরু হয়, এখানে সি আর পি এফ ক্যম্প হয়। ধীরে ধীরে নকশালরাও এদিক ছেড়ে চলে যায়, এখন তো আর প্রায় নেই। এতে সব থেকে সুবিধা হয়েছে বিক্রম ঠাকুরের, সে এদিককার বাহুবলী হয়ে উঠেছে। গ্রামের ডাক্তার বহুদিন আগে চলে গেছে, গ্রামের অবস্থা তো আপনি দেখলেন।”
গাড়ির ইঞ্জিনের একটানা আওয়াজ সন্ধ্যার আধা আলোয় ভাসে, দুপাশের ক্ষেত অন্ধকারে ঢাকা পড়ছে ধীরে ধীরে, তাঁর কানে ভাসছে দীননাথ চাচার কথা, তাঁকে তাঁরই গ্রামে ফিরে আসার আমন্ত্রণ আর গভীর অন্ধকারে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে মা হারা অসহায় নিরপরাধ বাচ্চা দুটোর অবাক হওয়া চোখ।