সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
একটা গল্প লিখে জমা দেওয়ার জন্য খুব তাড়া দিচ্ছিলেন সন্দীপ। খুবই তাড়া যাকে বলে। ধরুন খেতে বসব, ভাতের থালায় দু-হাতা ডালের পাশে টুং। শব্দটা থালা-হাতা সংঘাতজনিত নয়। মোবাইলের। একটিমাত্র শব্দ অনেকটা গভীর বাণীর মতো হয়ে উঠতে পারে। মোবাইলের আলোকিত পর্দায় ভেসে ওঠে, গল্পটা কবে দিচ্ছেন?
এমন চলে। আমার মতো অলস অপদার্থ অথচ উচ্চাশায় ভরপুর প্রাণীকে প্রায়শই বন্ধুরা তাগাদা দেন। বন্ধুরাই দেন। কারণ, বন্ধুদের তাড়ায় যদি বা লিখি, বন্ধুভাবাপন্ন বা শত্রু-হতেও-পারে সন্দেহে কিংবা ঘোষিত শত্রুদের তাড়া বা তাগাদা কিছুই থাকে না। অতএব, লেখাও হয় না। কিঞ্চিৎ পরিমাণ বন্ধুদের এই ‘গল্প’ চাওয়ার পদ্ধতি চলতে থাকে।
সারা বছরই এমন চলে। আমার জন্য কোনও পুজোসংখ্যা, বিশেষ সংখ্যা, বারোয়ারী সমিতি, ক্লাবের স্যুভেনির, ব্যায়ামাগারের বার্ষিকী, নাচের ইস্কুলের বর্ষবরণ বা বাচিকশিল্পী সংগঠনের পত্রিকা ধরা নেই। লেখা ছাপানোর অপরিসীম ক্ষমতাসম্পন্ন দাদা-স্থানীয় যাদের চিনি, তাদের প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধাবশত কোনওদিন ত্রিসীমানায় পৌঁছনোর চেষ্টা করিনি। অনেকে করেন। তাদের দেখেছি, দেখি। তাদের ক্ষমতার প্রতিও আমার অপার বিস্ময়। তারা কত সহজে ভিড় গলে টুক করে সামনে গিয়ে দাদাকে তাদের বই, পত্রিকা ইত্যাদি দেন, এবং গদগদস্বরে কত কী বলেন। আশ্চর্য প্রতিভা। শুধু লেখার নয়, এগোনোর, পৌঁছনোর, বলার। আমি অপদার্থ বলে তারা কেন একই নৌকোয় উঠবেন? উঠলেও দেখেশুনে বুঝে নিয়েই তো উঠবেন। ফলে, সারা বছরভর যেটা চলে, সেটা ওই বন্ধুদের ডাকাডাকি।
এতক্ষণ অবধি যারা ধৈর্য ধরে পড়লেন, তাদের মনে হতে পারে, এটা কী হচ্ছে ভাই? এটা কি গল্প? পত্রিকার সম্পাদক নেমন্তন্ন করে খানিকটা বসার, মানে লেখার জায়গা দিয়েছেন বলে যা-খুশি-তাই হিজিবিজি লিখে পাতা ভরাতে হবে?
বিশ্বাস করুন। আমি তেমন মানুষ নই। আমি হিজিবিজি কিছু লিখতে চাই না। একটা গল্পই লিখতে চাই। আসলে গল্প লেখা আমার মতে একটা বেশ জটিল অথচ সহজ ব্যাপার। জটিল, কারণ চতুর্দিকে রাশি রাশি গল্প তৈরি হয়, অথচ আমরা ধরতে পারি না। সকালে উঠে কানে আসছে পাশের বাড়িতে পড়ানো চলছে তারস্বরে। ইংরেজি মিডিয়াম, চাপ বেশি। তিন বছরের কচি শিশুকে মায়ের আপ্রাণ ফার্স্ট করে তোলার চেষ্টা। গল্পটা এখান থেকে শুরু হতে পারত। শিশুটি পড়ছে না। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখছে একটা কাক জানলার বাইরে বসে খুঁটে খাচ্ছে তার ফেলে-দেওয়া আধখাওয়া বিস্কুট। খেতে খেতে উড়ে গিয়ে বসল ইলেকট্রিকের তারে। দোল খেল দু-বার। পাশে একটা ফস করে উড়ে যাওয়া চড়াইকে দেখে গোমড়ামুখে বলতে চাইল, এত ছটফট করিস কেন বাপু? শিশুটি এমন সময়ে ডান গালে সপাটে একটি চড় খেয়ে ভ্যাঁ, আর আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে ভাবি, এ গল্প ছেলেমানুষের। শিশু-কিশোর পত্রিকায় দেওয়াই ভাল।
নিচে ভাড়াটেদের ঝগড়া। কারণ হতে পারে কলের জল আসেনি বা মাসের শেষে পিসতুতো বোনের বিয়েতে কী উপহার দিলে সম্মান বজায় থাকবে... এখান থেকে গল্পটা স্বচ্ছন্দে চমৎকার বাঁক নিতে পারে। হ্যাভ-নটসদের গল্প। জীবনের অপ্রাপ্তি বঞ্চনা বিষয়ে এক দীর্ঘ ডিসকোর্স। যাকে গোল-গল্প বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়। কিংবা পাশের বাড়িতে এখন যে দম্পতি সদ্য ঘুম থেকে উঠে মোবাইলে পৃথিবীর খবর খুঁজছে, তাদের আশেপাশে উপরে-নিচেও অনেক গল্প। তাদের কর্পোরেট অফিস, অফিসে সহকর্মীর ঈর্ষা, বস এবং ক্লায়েন্ট এবং টার্গেটের হিসেব, তাদের রাত করে ফেরার সময়ে বিরক্তি আর অজানা ভয়, জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়া কোনও অন্য সম্পর্ক -- এমন যে কোনও একটা প্লট নিয়ে শুরু করা যায়। এগুলো একটু চৌকো গল্প। ওই যে বললাম, গল্প লেখা খুব সহজও বটে। দাঁড়ান, লিখে ফেলব এর মধ্যে একটা কিছু। একটু ক্লান্তি ছাড়িয়ে নিই। কত মানুষের কত গল্প তো রেডি। শুধু লিখে ফেললেই...।
দেখতে পাচ্ছি খবরের কাগজ দিতে এল ভোম্বল, ওর পুরনো সাইকেলের চাকার ছাপে মিশে আছে ওর জীবনের গল্প। বাবা মরে গেছে কোন ছোটবেলায়, অভাবী মায়ের বড় ছেলে হয়ে জন্মানো বিষয় নিয়ে লেখা গল্প পাবলিক খাবেই। আগেকার কাল হলে আর্ট ফিল্ম হতে পারত। অথবা ওই যে ওর সাইকেল, সেই চাকায় লেগে থাকা পথের ধুলো-কাদা নিয়ে একটা রূপকধর্মী। নাঃ। সেটা ক্লাস টেনের রচনা হয়ে যাবে। একটি সাইকেলের আত্মকথা। বাজে ব্যাপার। গল্প এখন অনেক এগিয়ে গেছে।
আমিও এগিয়ে যাই।
বারান্দা থেকে ঘরে। কাজলদি-র বাসন মাজার শব্দ, স্নান করছে কেউ। ঝরঝর করে জল পড়ছে। পাশের একটা ফ্ল্যাটে গলা সাধার আওয়াজ পেতাম আগে, এখন মেয়েটি বড় হয়ে গেছে বলে আর গান করে না। ধুপধাপ কলেজে উঠে গেল, কলেজে শ্লোগান বেশি। ওর দিকে তাকালে আগে হাসত, এখন চোখ সরিয়ে নেয়, ভুরু কুঁচকে থাকে। খুব বিরক্ত। সব পালটে দেবার নেশা জেঁকে বসেছে মাথায়। ওকে নিয়ে গল্প হয় না, মিছিল হলেও হতে পারে। গল্প হলে সেটা অণু। মনে পড়ল, আমাদের কাজলদির দুটো ভোটার কার্ড ছিল। একটা গ্রামে। একটা এই শহরের পাড়ায়। যেখানে তার ভাড়াবাড়ি। যেখানে থেকে তার বর রিকশা টানে, ছেলে মুরগির দোকানে খাটে, মেয়ে দুপুরে ইস্কুল যায় আর বিকেলে খুচরো একটা প্রেম করে। এইসব ছোট ছোট জীবনের মধ্যে আসল গল্পটা খুঁজতে হয়। ঘেয়ো কুকুরেরা যেমন শুঁকে দেখে পাড়ার ডাস্টবিন। এঁটোকাঁটায় মিশে থাকা জীবন পরিবেশন করতে হয় এলিট সমাজে। কী নির্মম বাস্তব! কী অবিশ্বাস্য লিখেছেন। এমন করে তখন নীল আকাশে সাদা মেঘের মতো প্রশংসাবাক্য ভেসে বেড়ায়। আমি দেখেছি রবিবার দিন জুড়ে ফেসবুকের মধ্যে আহা কী লিখেছেন দাদা, মন ছুঁয়ে গেল, নাড়িয়ে দিলেন ভাই, আপনার কলম অক্ষয় হোক, অসাধারণ, অপূর্ব, অভিনন্দন, আদরবাসা জাতীয় প্রশংসা উপচে পড়ছে কোনও লেখার শেষে। লেখাটি আর খুঁজে পাই না। অত লক্ষ লক্ষ প্রশংসার ভিড়ে আসল গল্পটাই কোথায় যেন...।
আমি বাড়ি থেকে বেরোই। স্টেশন কাছেই। আরেকদিকে বাস স্ট্যাণ্ড। পাশে অটো দাঁড়ায়, অন্যদিকে রিকশা। জমজমাট বাজার একটা। অনেক গুঁড়ো গুঁড়ো কথা, অনেক মানুষ। দোকানপাট। অনেক গল্প। যেভাবে গোয়েন্দার চোখ খুঁজে বেড়ায় অপরাধী, আমিও খুঁজে বেড়াই। বিশুর লটারির দোকানে টিকিট কাটে যে পল্টুদা, ওদের দুজনের কথাবার্তা নিয়েই তো একটা দারুন... কিংবা লতুর কাতলা মাছের বঁটির পাশে আয়েসী বিড়াল, তার পাশে বুড়ো আঙুলে ন্যাকড়া জড়িয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে কুচো মাছের আঁশ ছাড়িয়ে যাওয়া মাসির বুক থেকে সরে যাওয়া আঁচলের ফাঁকে ঘামাচি ভরা চামড়া নিয়ে গল্প হয়। সে গল্পে নিশ্চিত কোনও সমাপন বিন্দু থাকে না। ছাই-মাখা মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরে কলের জলে ধুয়ে যায় সমাপ্তিচিহ্ন। যে ট্রেন কোনও স্টেশনে দাঁড়ায় না, সেই ট্রেনে উঠে পড়তে ইচ্ছে করে। দারুণ হাওয়া, যদি জানলার ধারে বসতে পারি, তবেই। না হলে হই হই করে উঠে পড়বে অনেক লোক, বসে-দাঁড়িয়ে শুরু হবে তাস খেলা, মুখে মুখে হোক কলরব, বঞ্চনা, প্রতিবাদ রাজনীতি আর অনেক হকার এসে বিক্রি করে যাবে হজমি, শসা আর সেফটিপিন। জুড়ে যাবে শব্দ, কিন্তু সময় ফুরোবে। বাক্য সম্পূর্ণ হবার আগেই সন্দীপ জিগ্যেস করবে, “লেখা হল?”
“কোন লেখা?”
“কেন, সেই যে বলেছিলাম...”
“কী বলেছিলেন বলুন তো?”
“আপনাকে তো গল্প লিখতে বললাম, মনে নেই?”
“আমাকে? আমি কি গল্প লিখি?”
“লেখেন তো। এই যে পড়লাম...”
“আপনার ভুল হচ্ছে কোথাও। আমি নই, সে অন্য কেউ।”
“অসম্ভব। হতে পারে না। আপনার নাম দেখলাম...”
“ভুল দেখেছেন। অমন ভুল হয়, হয়েই থাকে। আমার বাড়ির লোকেরও ভুল হয়।”
“বাড়ির লোকের কথা তো হচ্ছে না...”
“বাড়ি বাদ দিলে আর থাকে কী? প্রথমে তো বাড়ি, সেখান থেকে পাড়া, তারপর গলির মোড়, বাসস্ট্যাণ্ড, পাশের শহর, গ্রাম পেরিয়ে মফঃস্বল, সব পেরোলে রাজ্য, সেখান থেকে দেশ...’
“আরে! আপনি তো অন্য লাইনে চলে যাচ্ছেন, কথা হচ্ছে গল্প নিয়ে...”
“গল্প নিয়ে কথা হবে কী করে? আলাদা করে শুধু গল্প নিয়ে... গল্প পড়ে না কেউ। গল্প বলে, গল্প শোনে, গল্প হয়। পড়ালেখা খুব বড় ব্যাপার। আমাকে দিয়ে হয় না ওসব।”
সন্দীপ খুব গম্ভীর। মাস্টারমশাই তো। পুরনো দিনের ভারিক্কি মাস্টারমশাই। সাদা খাতা আর টাকার বাণ্ডিলে পাশ করে আসা নয়। যাদের নিয়ে দু-রকম গল্প ফাঁদা যেতে পারত। যারা পেল, যারা পেল না। যারা পেতে পারত, যারা চেষ্টা করেও... এই প্রতিটি পরিবার নিয়ে একটার পর একটা ধারাবাহিক গল্প হতে পারে। সিরিজ। মেয়েদের গল্প, বঞ্চনার গল্প, রহস্য গল্প, অলৌকিক গল্প। ছেলেদের আর দমফাটা হাসির গল্প বলে কিছু হয় না। ছেলেরা গল্পে থাকে হিরো কিংবা ভিলেন হয়ে, আর চারপাশ কালো করে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি এলে তারা সাপ-লুডো খেলে। কে এগোল। কে কতদুর। ব্যালান্স শিট মেলানোর সময় একটা কর্পোরেট গল্প হতে পারত। লিখলে হবে না, পরিবেশন করতে হবে।
সন্দীপ গম্ভীর হয়ে বলল, “তাহলে লিখবেন না?”
“কী লিখব?”
“ওই যে বললাম, গল্প।”
“আছে তো এতকিছু, গুছিয়ে নিলেই হয়। পারবেন না?”
“পারব না বলছি না। আমিও পারব। শুধু খুনিদের ধরা পড়ার অপেক্ষায় আছি, বুঝলেন। কারা মিলে মারল... একবার নামগুলো পেলেই... গল্প লিখতে কতক্ষণ?”
আমি হা হা করে হেসে উঠি। আমিও এমনটাই ভাবছিলাম।