সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
১. ভাণ/ ভণিতা
আরম্ভেরও আগে বলে রাখা ভালো, যে এই লেখার সবটা আমার নিজের নয়। সমীরদা সম্বন্ধে কতটুকুই বা আমার জ্ঞানের পরিধিতে থাকার কথা? আমার কথার মধ্যে তাই, বিনা আয়াসে এসে যেতে পারে অন্যদের কথা, যারা সমীরদাকে বহুদিন ধরে দেখছে, বা ওর সাথে ছোটবেলা থেকে কাটিয়েছে।
এছাড়া, লেখা আরম্ভ করা যেত বিবিধ উপায়ে; যেমন, সমীরদাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কত কথাই না মাথায় আসছে, বা সমীরদাকে নিয়ে লিখতে বসলে ঠিক করা মুশকিল কী নিয়ে বলা যায়, কারণ ওর ব্যক্তিত্ব আর প্রতিভার বহু দিক আছে, বা, মাথায় কোনও কথা ঠিক আসছে না। এই সময়টা জুলাইয়ের এই সপ্তাহগুলো খুব জমাটবাঁধা ও বদ্ধ হয়ে গেল; মাথার ভেতরটাও থমথমে হয়ে আছে, হাওয়া চলছে না।
তাও, আরম্ভ করতে হয়। এবং সেটা আমার নিজের বাড়ি, পরিবার, এসব দিয়ে করাটা যেহেতু সুবিধের, আমি সেটাই করছি। খুব অল্প কথায় বললে আমাদের পরিবারে কালচার বলতে যা বোঝায় তা আসার কথা ছিল না দু’জন ব্যক্তির আবির্ভাব না হলে। অতিকথন নয়, কিন্তু শ্রী দীপেন সেন, এবং শ্রী সমীর ভট্টাচার্য না থাকলে কোনও কোনও অভিজ্ঞতা আমার বাবার বা আমার হতো না। হয়তো অন্যভাবে হতো, অন্য কোনও ব্যক্তি না সমষ্টির সংস্পর্শে এসে হতো। কিন্তু তা হয়নি। অতএব, ঋণস্বীকার করতে হয়।
২. সোজা বা ফ্ল্যাট ইতিহাস
ক: ভৌতিহাসিক (অর্থাৎ জিওহিস্টোরিক্যাল) কনটেক্সট
হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রীটে আমাদের আমাদের ভাড়া বাড়িটায় ছত্তিরিশটা ফ্ল্যাট। বাড়িটা তিনতলা। একতলায় বেশ লম্বা-চওড়া উঠোন। সমীরদার বন্ধু সমীর পাঠকের (টুটুদা) মুখে শুনেছি আমাদের গলি দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি বিবিধ পণ্য নিয়ে যেত। গাড়ির চাকা দেওয়ালে লেগে চুন সুরকি যাতে খসিয়ে না দিতে পারে, সেজন্য দেওয়ালে লোহার পাত লাগান থাকত। সে পাত বোধহয় আমিও দেখেছি। বছর আট আগে, সমীরদা ওর ট্যাবে আমায় সেগুলোর ছবি তুলেও দিয়েছিল। বাবার মুখে শুনেছি আগে আমাদের বাড়ির একতলাটা নাকি আস্তাবল আর দোতলাটা গুদাম ছিল। আমাদের ফটকের ওপর বাড়ির নামের পাশে খোদাই করা ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ, অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায় ওই বছর থেকে বাড়িটা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। আমাদের গলির ভেতরের অঞ্চলটার বাসিন্দাদের অন্যতম ব্যবসা ও জীবিকা হচ্ছে গেঞ্জির কল। এছাড়া আরও বিভিন্ন জিনিসের গুদাম আছে। জায়গাটা মানুষের বাসস্থান আর ব্যবসার মাল জমা রাখার ছোট-মেজো জায়গার অদ্ভুত জগাখিচুড়ি। আগে আসতো ছোটখাটো লরি বা ভান, এখন গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে টাটা কোম্পানির ছোট হাতি।
হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রিট শোভাবাজার স্ট্রিট থেকে উত্তর-উত্তর-পশ্চিমে ঢুকে গঙ্গার ধারে পড়ে জয় মিত্র ঘাট লেন বা, কুমোরটুলি পৌঁছে পীতাম্বর মিত্র লেন হয়ে গেছে। উত্তরদিকে মুখ করে হাঁটা দিলে গলির বাঁদিকে রাস্তা ও গঙ্গা, ডানদিকে বাড়ি। রাস্তা আর গলির মধ্যে আগে মালগাড়ির লাইন ছিল, আর খাটাল। সেই লাইন উঠে গিয়ে চক্ররেলের লাইন হলো টালা ইয়ার্ড থেকে প্রিন্সেপ ঘাট। সেই লাইনও জুড়ে দেওয়া হলো লোকাল ট্রেনের লাইনের সঙ্গে। রেল লাইনের গায়ে খাটাল উচ্ছেদ হয়েছে, রয়ে গেছে ঝুপড়ি। সেগুলোর পাশে চায়ের দোকান ও অন্যান্য খাবারের স্টল। লরি, ভ্যান, ও অন্য মালবাহী গাড়ি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কারুর মুখ গঙ্গার আর উল্টোদিকের পাড়ের দিকে, কারুর রেললাইন আর জরাজীর্ণ বাড়িগুলোর দিকে। জয় মিত্র ঘাট লেনের ওপরই সমীরদার বাড়ি।
এই বাড়িটার দেওয়ালে কোনও চুনকাম বা পলেস্তারা নেই, রঙ তো দূর অস্ত্। লাল আর কালচে ইটের দেওয়াল। দেখে মনে হয় ঝলসে গেছে। এরকম কেন কারুর মুখে তার ব্যাখ্যা শুনিনি। বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বোমারু বিমান বোধহয় হাতিবাগান পর্যন্ত এসেছিল। সমীরদারা বলতো ভূতের বাড়ি। এই বাড়িতে সমীরদার পরিবার ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আছে।
সমীরদার বাবা শ্রী গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, মা শ্রীমতী কল্যাণী ভট্টাচার্য; সেযুগের নিয়মে জেঠিমা নিশ্চয় কল্যাণী দেবী লিখতেন। আমি সমীরদার বাবাকে কোনওদিন দেখিনি। সমীরদার মা’কে বোধহয় দু’বার দেখেছি। ওর ভাইবোনেদের মধ্যে ওর দাদা শ্রী অশোক ভট্টাচার্য পাড়ায় রীতিমতো পরিচিত ছিলেন। অশোকদা দীপেন জেঠুর মতোই বোহেমিয়ান প্রকৃতির ছিলেন। তবে ধরনটা অন্যরকম। ছোটবেলা থেকেই যখন তখন উধাও হয়ে যেতেন। একবার ফিরলেন খ্রীষ্টান হয়ে। সমীরদার দিদা আবার ধরে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনলেন। এই দিদার ভূমিকা সমীরদাদের ভাইবোনেদের ওপর অপরিসীম। সেই সময়টা ছিল যাত্রার যুগ। অশোকদা রূপবান ছিলেন ও ভালো আবৃত্তি করতে পারতেন বলে যাত্রার দলে ওঁর ডাক পড়ত। কিন্তু কোনও জায়গাতেই টানা থিতু হওয়া ওঁর ধাতে ছিল না।
সমীরদার ব্যাপারটা আরও অন্যরকম। ওর নিজের মুখেই শুনেছি প্রয়োজনাতিরিক্ত দুরন্ত টাইপের ছিল। উত্তম মধ্যমও কপালে জুটত। ওর বোন কৃষ্ণাদি বলেছিল সমীরদা আর ওর সেজোভাই শান্তনুদা ছোটবয়সে আরশোলা ধরে ঘরের চৌকাঠে বলি দিত। সেসব মরা আরশোলার ভূত ওদের ঘুমের মধ্যে দেখা দিত কী না, বলতে পারব না। খুব কম বয়সেই আগুনখোরদের দলে ভিড়ে যায়। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। সঙ্গদোষে বা গুণে, ওর ওপর চিরস্থায়ী ছাপ পড়ে যায়। সেজন্য বাইরের অস্তিত্বে ওর কোনও লাভ হয়নি বলেই আমার মনে হয়। কিন্তু ওর মনের মধ্যে যে ছাপটা পড়েছিল, সেটা গভীরে, আর সেক্ষেত্রে ওর আত্তীকরণের ক্ষমতার অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল। সেটা গেলানো মতাদর্শের কোনও ব্যাপার নয়।
ও যখন আর্ট কলেজে পড়ার কথা বাড়িতে বলে, সেটা বিলাসিতাই ছিল। কিন্তু ওর মামাদের সেপথে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহই ছিল। সেটাও আমার মতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সেটা না ঘটলে সমীরদা কী করত, কারখানায় কাজ করত না অন্য কোনও দিকে চলে যেত বলতে পারব না। সত্তরের ও আশির দশকের সামাজিক ও আর্থ-সামাজিক রিয়ালিটি কী ছিল তা এখনও বহু মানুষের মনে আছে। আশির দশকেও খুব কম ছেলেমেয়েই প্রতিভা আছে বলেই সেটা নিয়ে চর্চা করার উৎসাহ বা স্পেস পেত।
৩. সোজা বা ফ্ল্যাট ইতিহাস
খ: শৈশবের ইডেন উদ্যান
১৯৮৪ সাল থেকে সমীরদা আমায় আঁকা শেখাতে আসছে। শ্রী হরপ্রসাদ দত্ত, সমীরদার বন্ধু, আমার ও আমার দিদি-দাদাদের পাড়ার দাদা, অভিভাবক, বন্ধুদের পেট্রন, হঠাৎ বাবাকে বললো ভাইকে আঁকা শেখালে ভালো হয়। হরপ্রসাদদা-র আসল বাড়ি কিন্তু হাওড়ায়। ওরাও আমাদের মতো নৈকষ্য ঘটি কিন্তু অধিকাংশ বন্ধু-বান্ধব বাঙাল। ও শোভাবাজার কুমোরটুলী-র মায়ায় গোঁসাইপাড়ার বলরাম মজুমদার স্ট্রিটের ভাড়া বাড়িতে পড়ে রইল। এখান থেকেই চিরদিনের মতো বিদায় নিল ২০০৫ সালে। কোনওদিন ছবি আঁকেনি, আধুনিক কবিতা লেখেনি, গান গায়নি, তবে তবলাটা শিখেছিল। হরপ্রসাদদা-র বন্ধুদের মধ্যে বাদলদা থাকত আমাদের উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে, সুবলদা এখনও আছে আমাদের ওপরে তিনতলার ফ্ল্যাটে। ওর প্রাণের বন্ধু সমরেন্দ্রদার বাড়ি ছিল আমাদের গলি দিয়ে দক্ষিণ দিকে পিছিয়ে গেলেই হরচন্দ্র মল্লিক সেকেণ্ড লেনে। আর সমীরদা, টুটুদা, এরা তো ছিলই। সমীরদাদের গ্রুপটা হরপ্রসাদদা-র নামটা শর্ট করে করে দিয়েছিল হ.প. বা নেহাত হপ। হপদা আমার বাবাকে মামা বলত এবং যে কোনও বিষয়ে কথা বলতে রাত দশটাতে-ও নির্দ্বিধায় এসে পড়ত। তাই হপদা যখন বললো আমায় আঁকা শেখালে ভালো হয়, বাবা ওর কথায় মত দিল, এবং জিজ্ঞেস করলো ওর চেনা কেউ আছে কী না। হ দা বললো, যে ওর বন্ধু সমীর আঁকা শেখায়। বাবা শুনেই হ্যাঁ করে দিল।
এ হলো চল্লিশ বছর আগের ঘটনা।
সেসব দিনের কথা আজ ঝাপসা হয়ে গেছে। কিন্তু তার মধ্যেও কোনও কোনও ছবি মনে থেকে গেছে। থেকেই যায়, এরকম সবারই হয়। তবে স্মৃতিতে আমার মনের রঙ আস্তর চাপাতে পারে। হয়তো চাপিয়েছেও। আমি বলছি না আমার স্মৃতি ও বিবরণ নিখাদ।
আরম্ভের দিকে ক’দিন সমীরদা আমাদের বাড়ি আসত রবিবার বিকেলে। হাতে ধরে আঁকা শেখান হয়তো কোনওদিনই আমার ক্ষেত্রে হয়ে ওঠেনি, কারণ আমি ছিলাম আজন্ম অমনোযোগী, আর অলস, আর সমীরদা বাচ্চাদের জোর করে আঁকানর বিরোধী। আমাকে আঁকার কোনও কোনও টেকনিক, অত্যন্ত বুনিয়াদি কিছু শিখিয়েছিল, এবং সেগুলো আমি রপ্তও করেছিলাম। কিন্তু তার ওপরে আমার ওঠা হয়নি। সমীরদা আমায় উচ্চতর স্কীলগুলো শেখানর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমি সেগুলো নিতে পারিনি। তার ওপর আমার কাগজে চাপ দিয়ে লেখা ও আঁকার প্রবণতা, আমায় প্যাস্টেলে ছবি আঁকায় সীমাবদ্ধ করে দেয়। কারণ সেক্ষেত্রে মনের আনন্দে বেচারা কাগজে রঙ ঘষে ঘষে ছবি আঁকা যেত। জলরঙ করার কায়দাই আমার রপ্ত হয়নি, তো তেলরঙ!
প্রতি রবিবার ছবি আঁকা শেখানর জন্য আসতে আসতে মাসদুই কেটে গেল। তখন রবিবার আসা বন্ধ হলো। বোধহয় সোমবার করে সমীরদা আমাদের বাড়ি সকাল দশটা নাগাদ চলে আসা আরম্ভ করল। বাবা ও মা তখন অফিস বেরবে। তখন আমার প্যাস্টেলের যুগ। সমীরদা কিন্তু আমায় লেবু, আপেল, আনারস বা চায়ের কাপ আঁকিয়ে আখের গোছান শিক্ষা দিতে চায়নি। আমি যা আঁকতে চাই, ও আমায় সেটাই আঁকতে বলত। আমার ছবি আঁকা হয়ে গেলে খাতাটা টেনে নিয়ে ও আঁকত। সাধারণ ছবিই সেগুলো। কুঁড়েঘর, পুকুর, গাছ, মাঠ এইসব। ঠিক পরিষ্কার মনে নেই। আঁকার সঙ্গে যেটা ও করে যেত সেটা হলো গান গাওয়া। এই ব্যাপারটা এইভাবে ঘটতে পারে আমার ধারণা ছিল না। সমীরদার গান গাওয়ার মধ্যে স্বাধীন, উদাত্ত কী যেন ছিল। সেটা আমি নামকরা শিল্পীদের মধ্যে হাতে গোণা ক’জনের গানে পেয়েছি। ও দেবব্রত বিশ্বাসের অন্ধ কপি গায়ক ছিল না। ও গানটা নিজেই গাইত। তাছাড়া ওর গলার টোন আর স্বরক্ষেপণ দেবব্রত বিশ্বাসের থেকে অন্য রকম ছিল। ছবি কী আঁকছে সেটার ভেতরটা আমি সে বয়সে বুঝতাম না, কিন্তু ওর ছবিটা দেখতে স্বাভাবিক কারণেই খুব ভালো লাগত। আমাদের দুটো ঘরের কোনও ঘরেই তেমন আলো ঢুকত না। আমার চোখেও জন্মগত পাওয়ার। আমি ও আঁকতে বসলে ওর আর কাগজের মধ্যে মাথাটা ঢুকিয়ে দিতাম। প্রাণপণে ওর আঁকা দেখতাম, প্রতিটা মুহূর্ত দেখতাম। ফলে ও কাগজটা দেখতে পেত না। ও বলতো, “বাবু সরে যাও,” মোটেও মাস্টারমশাইদের মতো গলায় নয়। তখন আমি অন্যদিকে থেকে মাথাটা ঢুকিয়ে দিতাম। দুমিনিট বাদে সমীরদা আবার ওই কথাটাই বলতো। তখন আমি ওর পাশে ছোট ডিভানটায় উঠে ওর কাঁধের পাশ থেকে আঁকা দেখতাম।
বোধহয় ১৯৮৫-তেই সমীরদা আর ওর বন্ধুরা মিলে, হপ দার উৎসাহে, আমাদের পাড়ায় আঁকার স্কুল খুলল, নাম “বন্দনা”। শোভাবাজার স্ট্রীটে গঙ্গার দিকে যেতে হেমনলিনী কে. জি. স্কুলে। স্কুলটা ছিল বাড়ির সবচেয়ে ওপরের তলায়। দিনটা ছিল রবিবার। পাড়ার প্রচুর বাচ্চা, আমার বয়সী, হলঘরে বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় ছবি আঁকল। কিন্তু সমীরদা আমায় ওদিক মাড়াতে দেয়নি। আমি ঘুরঘুর করছিলাম পেছন দিকের ঘরটায়, যেখানে সমীরদা আর ওর বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছিল, আর সেখানে ডাঁই করে রাখা ছিল য়ুরোপের নামকরা সব শিল্পীদের ছবির বই। ওরা যখন যেটা চাই আমায় হাতে নিয়ে দেখতে দিচ্ছিল। কোনও ছবি নিষিদ্ধ ছিল না। দেবাদা, শৈবালদা, প্রবীরদা সবাই-ই বোধহয় ছিল। আর প্রশান্তদা আর সনাতনদা।
৪. হলঘরের আলোয়
১৯৮৮ থেকে সমীরদারা অকাদেমিতে এগজিবিশন করছে। ২০১৮য় এই পরিক্রমার অন্ত। আমি ব্যাপারটা মাইক্রো-স্টেটমেন্টের পর্যায়ে নামিয়ে আনলাম, কারণ এখানে বিস্তারিত বিবরণের জায়গা নেই। দীর্ঘ বায়োগ্রাফিক্যাল লেখা লেখার প্রবণতাও এই মুহূর্তে আমার নেই।
কিন্তু না লিখলে বেইমানি হবে, যে সমীরদাদের এগজিবিশনে যতবার গেছি, আমার ৩৮ বছর বয়স হয়ে আধবুড়ো হওয়া পর্যন্ত, অকাদেমি হোক বা জি. সি. লাহা সেন্টিনারি হল, বা অন্য কোথাও, এত আনন্দ পেয়েছি, যা অন্য কোথাও বোধহয় পাইনি। আমি ছবি আঁকার জগতের মানুষ নই। আমার মুখ্য ভালো লাগার জায়গা ভারতীয় মার্গসঙ্গীত, তা-ও নাচ আমি বুঝি না। কিন্তু কোনও গানের আসরে, আমি বলতে চাইছি কনফারেন্সে, এত খোলামেলা পরিবেশ থাকে না। ঘরোয়া আসরে থাকে, কিন্তু আমার শহরে ঘরোয়া আসরের স্বর্ণযুগ আমার জন্মের আগে ফুরিয়ে গেছে। মুম্বই যাওয়ার আগে, আর সেখান থেকে ফিরে, যতবার ওরা অকাদেমিতে ছবি ঝুলিয়েছে বাবা, মা আর আমি ততবারই গেছি। বোধহয় বার দুই বাদ গেছিল, আমার পরীক্ষা থাকতে পারে বা অন্য কোনও কারণ। বাবা গত হওয়ার বছরে, ২০০০ সাল, ওরা এগজিবিশন করেছিল কী না মনে নেই। অকাদেমিতে আর যে ক’বার হলো, আমি আর মা যাইনি। আমি বোধহয় গেলাম যেবার “চার্নিং” নাম দিয়ে হলো। জি. সি. লাহা সেন্টিনারি হলে যতবার হয়েছে গেছি।
২০১৮তেই বোধহয়। সেবারই সারা পৃথিবীতে সামাজিক ডামাডোল নিয়ে সমীরদা কাজ করেছে। ছোট ছোট কাজ। সমাজের বিবিধ ক্লেদময়তা আর তার চারপাশে নির্লজ্জ ভয়ারিজম, এই নিয়ে কাজগুলো করা। স্যাটায়ারিক্যাল ধরনের। ঢুকে সোজাসুজি হলটায় শৈবালদা, বাঁদিকের ঘরটায় শ্রী শৈবাল দত্ত, মাঝের ঘরটায় দেবাদা, আর তার পাশে সমীরদা। এই এগজিবিশন হওয়ার আগেই আমাদের বাড়ি এসে নিজের ছবি নিয়ে বললো, যেটা থেকে পুনরাবৃত্তির সংলাপ তৈরি হলো।
৫. ছবি, যাপন ও না বলা কথা
সমীরদাকে যখনই ছবি নিয়ে কথা বলতে বলেছি, ও চুপ করে থেকেছে। অন্য বহু বিষয় নিয়ে, মার্কসবাদ, রাজনীতি, লেখা, সমরেশ বসু, রামকিঙ্কর বেজ, সোভিয়েত রাশিয়া, পিকাসো, ভ্যান গঘ, সব নিয়েই ওর কোনও না কোনও কথা বলার ছিল। সোচ্চার। গলা তুলে ও বলত। যখন ছোট ছিলাম দেখতাম বাবার সঙ্গে সমীরদা তর্ক করছে। আমার কৈশোর কেটে যাওয়ার সাথে সাথে ও আমাকে তর্কের পরিধিতে টেনে নিল। তখন বাবার আর মা’র সামনেও আমার মতামত দেওয়ার অধিকার হয়েছে।
আমি এখানে ছবি বলতে ওর নিজের ছবির কথা বলছি। ছবির বিষয়, আঙ্গিক, সেটার পেছনে ভাবনা, এসব নিয়ে প্রশ্ন করলে ও চুপ করে থেকেছে। বা ওর উত্তর আমার কেমন যেন মনে ধরেনি। মনে হয়েছে ও ব্যাপারটা এড়িয়ে যাচ্ছে। অথবা অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে।
আমার মনে হয় ছবি না থাকলে ওর যাওয়ার অন্য রাস্তা ছিল না। সত্তর-আশির সন্ধিক্ষণে, যখন আন্দোলন স্তিমিত বা ক্ষমতার হাত ধরছে, ধনতন্ত্র সংগঠিত, তখন পথ খুঁজে নিতে হতো। কিন্তু রাস্তা কোথায় যেতে পারে ওর ধারণা ছিল কী? সব জিনিসটাই বৃহৎ হয়ে গেল। ও যখন সেটা দেখতে পেল, সেটা উপলব্ধি করলো, ও কী ভেবেছিল?
ওর যাপন হয়তো এখান থেকেই এসেছিল, বা সেটা মিমিক্রি ছিল। এখন এত অনায়াসে বলা যাবে না বা উচিত নয়। অর্থাৎ সমীরদার সামনে যে বৃহৎ ব্যাপারটা খুলে গেল, আমি কোনও স্পিরিচুয়াল অর্থে বলছি না, কিন্তু সবটা, আর্ট, সেটার ভেতরের ব্যাপারস্যাপার, সেটার আসপাশের লেনদেন, পলিটিক্স, এগুলো। সেগুলোর সাইকোলজিক্যাল এফেক্ট আছে। বা, অন্যদিক থেকে দেখলে এই যাপন কী মিমিক্রি ছিল? শিল্পী বলে ওর কোনও কোনও কাজ, বা অকাজ করা উচিত ছিল বলে ও মনে করত? য়ুরোপীয় শিল্পীদের বায়োগ্রাফি, যেখানে যাপনকে ম্যাগনিফাই করে দেখান হচ্ছে, সেটার প্রভাবে ও এগুলো করত কি? এরকম তো হয়েছে, যে প্রশান্তদা (ওর ছাত্র) ওর জন্য অপেক্ষা করছে, ও কীভাবে, বাসে উঠে, বারাসাত না কোথায় পৌঁছে, সারারাত কারর বাড়ির দাওয়ায় শুয়ে ঘুমিয়েছে! সকালে নিজেই নিজেকে আবিষ্কার করেছে। কিন্তু আরও অনেক ঘটনা ছিল। নিজের শরীর ও মনকে ও অর্থহীন এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে ফেলত।
যতবার জিজ্ঞাসা করেছি, সমীরদা এত সব নিয়ে বলার চেষ্টা করেছে, হয়তো। কিন্তু বলে ওঠা হয়নি। ও জললিপি লিখল, শ্রী প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় সেটা ছেপে বের-ও করলেন। অনর্গল, খুব ফ্লুইড লাইনগুলো বয়ে যাচ্ছে। তরল সিগনিফায়ার। পাশের পাতায় আলো-আঁধারী ছবি। কিন্তু এসব নিয়েও ও কথা বলতে চায়নি। মনে হতো, ও ব্যাখ্যা দিতে চাইত না। ২০১৮-য় যেদিন বললো, এখন মনে হয় ওই বাক্যবন্ধতেই জোরটা পড়েছিল, “মানুষ ছাড়া ছবি হয় না।” সেটার হাজারো ব্যাখ্যা হয়। তবে প্রচুর না বলা রয়ে গেল।
৬.. পরিচ্ছেদটির শিরোনাম নেই
২০১৫-য় সেরিব্রাল হলো। হওয়ার ক’দিন আগে, সমীরদার নতুন স্টুডিওয় ও, বাবুলদা আর আমি আড্ডা দিচ্ছিলাম। বাবুলদার ভালো নাম সুজিতরঞ্জন ভট্টাচার্য। রাত দশটার আসেপাশে বেরলাম। বাবুলদা শীল’স গার্ডেনের দিকে বেরিয়ে গেল। সমীরদা আর আমি ভূপেন বসু এভিন্যু দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরলাম। তমোনাশদার বাড়ির গলির মুখটা থেকে রুটি কিনলাম। কুমোরটুলি দিয়ে ঢুকে ও উড়েপাড়া দিয়ে ঘুরে গেল। বাবুলদার সাথে মধ্যে আর কথা হয়নি; দিন দুই বাদে ও-ই ফোন করলো। সাঙ্ঘাতিক নয়, কিন্তু বিপদ। সমীরদা ভর্তি। দেখে বেরিয়ে আসছি, প্রবীরদা আমার মাকে ডেকে বললো, “ও কিন্তু কলেজে বন্ধুদের নেশা ছাড়াতো। এসব মাতালের অভিশাপ!”
আস্তে আস্তে ভালো হচ্ছে, কথা হলেই প্রতিশ্রুতি, মদ ছাড়বে, সিগারেট ছাড়বে। সেরে উঠতেই ধরে ফেলল। তবে মদ খাওয়াটা কমে গেছিল। এগজিবিশন হলো। সেরিব্রাল ডান হাতটা দুর্বল করে দিল। কিন্তু ও ছবিতে ফিরে এল। ছবি এঁকে গেল।
সময় কাটছে, চারপাশে সব ঘটনা ঘটছে, বিবিধ টেনশন, উদ্বেগ; এর মধ্যে সবাই লক্ষ্য করছি সমীরদার গলা বসে যাচ্ছে। ২০২০, হঠাৎ-ই লক ডাউন, সারা পৃথিবী থেমে গেল। ২০১৫ থেকে অধিকাংশ সময় দেখা হতো সমীর পাঠক (টূটুদা)-র বাড়িতে। সেটা বন্ধ হলো। ২০২০-তে ওর বন্ধু প্রোফেসর সুনন্দ কুমার সান্যালের সম্পাদনায় সমীর বইটা বেরল। তখনই ওর হঠাৎ আসা, মাথায় টুপি, গলায় মাফলার, কালচে রঙের সোয়েটার ও প্যান্ট। হাতে আমায় উপহার দেওয়ার জন্য বইয়ের কপি।
সবাই খবর পায়, মুখে মুখে, বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ২০২০-তেই। অসুখ ধরা পড়া, চিকিৎসা, কৃষ্ণাদি-র অমানুষিক দৌড়াদৌড়ি। ইতিমধ্যে ওরা গঙ্গার ধারের জয় মিত্র ঘাট লেনের বাড়ি থেকে সাময়িকভাবে উঠে গেছে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের পেছনে নবকৃষ্ণ স্ট্রীটের ফ্ল্যাটে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে দুটো ঘর, বাথরুম। ২০২৩-এর ৫ই ফেব্রুয়ারি সনাতনদা নিজের জন্মদিনে সমীরদাকে “বেহালা আর্ট ফেস্ট”-এর তরফ থেকে জীবনকৃতি সম্মান জ্ঞাপন করলো। মে মাসে অবনীন্দ্র পুরষ্কার। আরও পুরষ্কার। আরও সম্বর্ধনা।
এ বছর আবার এগজিবিশনের কথা হচ্ছিল। আঁকা বন্ধ হয়নি। অসুখ ফিরে এল। এবার কেমোথেরাপি নিতে হবে... কিন্তু শরীর ভেঙে পড়ল। ১৮ই জুলাই টুটুদা ফোন করে খবরটা দিল। হয়তো ভেতরে তৈরি ছিলাম। কেমন ঘোরের মধ্যে মা’কে নিয়ে সমীরদার এখনকার বাড়িতে গেলাম। গলির মুখে প্রবীরদা আর সনাতনদা দাঁড়িয়ে। ঘরে কৃষ্ণাদি সমীরদার পায়ের দিকটায় বসে অঝোরে কাঁদছে। টুটুদা গলিতে দাঁড়িয়ে। একলব্য এসে গেল। তমোনাশদার ছেলে। সায়ন এল। তমোনাশদা এসে সার্টিফিকেট দিল। আরও কত মানুষ! চেনা, অচেনা মুখ।
লেখা এবার ফুরোলেই ভালো। কারণ বাকিটা ব্ল্যাঙ্ক। শাদা ক্যানভাসের মতো। আমরা খালি ভাবতে পারি। ফাঁকা জায়গা, বা শাদা ক্যানভাস মনগড়া অসম্ভব গল্প আর ছবি দিয়ে ভরাতে পারি।
সমীরদা এবার কী করবে? ওর প্রিয় লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের যে স্যাটায়ারটি ওর পছন্দ ছিল, সেটির মতোই কি কোনও ঘটনা ঘটাবে? অর্থাৎ সমীরদা কোন লেখক বা শিল্পীকে নরকে যেতে ঠেলা দেবে? কার স্যানিটাইজ্ড দেবত্ব ও নষ্ট করবে? সন্দীপন কি নিজেই আসবেন, সমীরদাকে স্বাগত সম্ভাষণ করতে, ঘণ্টাটা নিয়ে, সেই ঘণ্টাটা, যেটা বইমেলার মাঠে ওরা নিয়ে পালিয়েছিল! ওর প্রিয় শিল্পীরা, কেউ স্বর্গে, কেউ নরকে। পিকাসো, ভ্যান গঘ, দালি, ক্লী, ক্যাথে কলউইজ, রাম কিঙ্কর, রবীন্দ্রনাথ। ওর প্রিয় কবিরা, জীবনানন্দ, ট্রামলাইনে বিড়বিড় করে কী বলতে বলতে হাঁটছেন, অন্ধকার আকাশের নীচে বিনয় মজুমদার, সঙ্গে ক্যামেরা হাতে শঙ্কর কর্মকার, ওদিকে অনন্য ও নবারুণ। তাঁদের কেউ কি ওর জন্য প্রতীক্ষারত? জেঠু ও জেঠিমা কি নেমে আসবেন নিজেদের সন্তানকে নিতে? আর দেবব্রত বিশ্বাস? তিনি কি তাঁর বহুদিন গান না গাওয়া শিষ্যকে মুখরিত হয়ে উঠতে বলবেন?