সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
অনুবাদের কৈফিয়ত
সম্পাদক মশাই কৈফিয়ত তলব করেছেন। হাক্সলের অনুবাদ কেন? ‘কেন’ অতি জটিল প্রশ্ন। তবু, কৈফিয়ত দাখিল করতেই হয়। ভদ্রজনোচিত না শোনালেও।
সমস্যা তো হাক্সলে সাহেবকে নিয়ে নয়, গান্ধীবাবাকে নিয়েই যত ঝামেলা। রামচন্দ্র গুহ বলছিলেন, ১৯১৭ সালের পর থেকেই নাকি আমাদের দেশে একটু আধটু চিন্তাভাবনার বাতিক আছে এমন সবার মধ্যে একজন গান্ধীবাদী আর একজন মার্কসবাদীর আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলছে। হবেও বা। তবে বঙ্গদেশ যে এর ব্যতিক্রম সে কথাটা গুহ মশাই বলেন নি। লক্ষ্য করেন নি এমন হয়তো নয়। গবেষণা জীবন শুরু করেছেন বঙ্গীয় মার্কসবাদী মহলে, এমন কি মট লেনে সমর সেনের সঙ্গলাভও করেছেন বেশ কিছুদিন, তাই রামচন্দ্রের অজানা থাকার কথা নয়, যে, সারা বিশ্বে বন্দিত হলেও বঙ্গের প্রগতিবাদী মহলে গান্ধী নিন্দিত। গল্পও বলেছেন, তাঁর প্রতিভাবান সুহৃদ হিতেশরঞ্জন সান্যাল নিজের গান্ধী অনুরাগ নিয়ে যতটা সম্ভব নীরব থাকতেন পণ্ডিতমহলে “আওয়াজ খাওয়া”র (হস্টেল সমাজের এই অনবদ্য লব্জের সুচারু প্রতিশব্দ আপাতত মনে পড়ছে না) ভয়ে। সে আশ্চর্যের কিছু নয়। বঙ্গদেশে গান্ধীর ভাবনাকে কেউ গুরুত্ব দিয়ে ফেললে বৌদ্ধিক সমাজে তাঁর মর্যাদাহানি হবে, নৈতিক চরিত্রও সন্দেহের মুখে পড়তে পারে। দুর্ভাগ্যের হলেও, কথাটা সত্যি। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মনে হয়েছিল, অনাগত প্রজন্ম বিশ্বাসই করতে পারবে না যে এই রকম একজন মানুষ রক্তমাংসের শরীরে এই পৃথিবীতে হেঁটে চলে বেড়িয়েছেন। বঙ্গদেশের জঙ্গি মাকর্সবাদীরা প্রকাশ্যে বলে বেড়াতে দ্বিধান্বিত নন যে গান্ধী স্রেফ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অনুচর। দালাল।
অবিশ্যি অল্ডাস হাক্সলের অনুবাদের কৈফিয়ত সেটা নয়। মোহনদাস গান্ধীর, আর যাই হোক, অপবাদ স্খালনের জন্য উকিল ধরার প্রয়োজন নেই। শুধু তাই নয়। সংকীর্ণ চিন্তার বিকৃত কুৎসা মত হিসেবে অশ্রদ্ধেয়, আলোচনার জন্য বিবেচিত হওয়ার অযোগ্য। উদ্বেগের কারণ অন্যত্র। চিন্তার জগতে সমাজভাবনার দুই ধারার যে চিত্তাকর্ষক প্রতিযোগিতার কথা রামচন্দ্র গুহ বলছিলেন একুশ শতকে কি আর সেটা চোখে পড়ছে? গান্ধী বা মার্কস, কেউই কি আর এখন চিন্তার গোড়া ধরে তেমনভাবে নাড়া দিচ্ছেন? মানুষের যাপনের, সমাজের যেসব সংকটের গভীরে যেয়ে তাঁরা ভাবছিলেন, উত্তরণের পথ খুঁজছিলেন সে সংকটগুলো জটিলতর হয়েছে। ওঁদের চিন্তা উত্তরণের রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে কিনা তারও মীমাংসা হয়েছে এমন বলা মুশকিল। কিন্তু, পথ এখনো কি কেউ খুঁজছেন?
ওপর ওপর দেখলে সমাজে এই দুজনের চিন্তা নিয়ে উৎসাহে ভাঁটা পড়েছে বলেই তো মনে হয়। এটাকেই কি প্রাসঙ্গিকতা বলে? চলতি মত হয়তো তাই। কিন্তু কোন চিন্তা, দর্শনের প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নটা নিশ্চয়ই ভোটবাক্সের জনপ্রিয়তা বা হাল ফ্যাশানের ‘ট্রেন্ড’ এর প্রশ্ন থেকে স্বতন্ত্র। যে সব সমস্যা আর সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি ওঁরা সেগুলো নিয়ে ভাবছিলেন কিনা, যে পথে উত্তরণ আশা করছিলেন আমাদের সেগুলো এখনো যুক্তিসঙ্গত, ন্যায়সঙ্গত মনে হচ্ছে কিনা, এই তো সহজ প্রশ্ন।
তবে কিনা সহজ প্রশ্নগুলো ঘেঁটে গেছে। তার হয়তো অনেক কারণ। সে সব জটিল দার্শনিকতার গহীনে যেয়ে সত্য সন্ধান অধমের এলেমে কুলোবে না। তবে গুহমশাই যাকে একটু মজা করে গান্ধী আর মার্কসের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই বলছিলেন তার শেষ আঁচের উত্তাপ আমরাও একটু আধটু পুইয়েছি গত শতকের শেষ দিকে। আমরা বলতাম মতাদর্শের লড়াই। ধর্মীয় উত্তেজনার মতো এই মতের লড়াই চলছিল বিশ শতক জুড়ে। সেটা ইতিহাসের “অনিবার্যতা” কিনা জানি না তবে অসহিষ্ণু সংকীর্ণতার সেই গোলমালে মার্কস বা গান্ধী কাউকেই সহজভাবে দেখা মুশকিল ছিল। দেখার দরকারও ছিল না! মতই যেখানে আদর্শ দেখা তো সেখানে আপদ বিশেষ। যাই হোক, গোদা বুদ্ধিতে মনে হয় সহজ প্রশ্নগুলো ঘেঁটে যাওয়ার এটা একটা কারণ।
তবে, মতাদর্শের উন্মাদনায় আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না মানে কেউই দেখতে পাচ্ছিলেন না এমন নয়। হাক্সলে অনুবাদের এটা একটা কৈফিয়ত।
আরো আছে। মার্কসের চিন্তাকে, অন্তত গত শতকে, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দিশা মনে করা হয়েছে, তার অভিঘাত অনুরণিত হয়েছে সারা পৃথিবীতে। গান্ধী আসমুদ্রহিমাচল সাধারণ মানুষের হৃদয়ে পৌঁছতে পেরেছেন, শান্তির দূত হিসেবে বন্দিত হয়েছেন সারা বিশ্বে। কিন্তু গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাও ওঁর দার্শনিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ভাবনা গ্রহণ করেন নি। অবিশ্যি তার জন্যে একশো বছর পর ওঁর হয়ে ওকালতি করতে হবে এমন নয়। তবে, যাঁদের কাছে বাপু অবিসংবাদিত নেতা, সুখে দুঃখে আশ্রয়, তাঁদের সাথেও ভাবনার দূরত্ব থেকে গেছে এটা চিত্তাকর্ষক। সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হচ্ছে, এই দূরত্ব রচিত হওয়ার কারণটা এখনো প্রাসঙ্গিক। অর্থাৎ কিনা, গান্ধীকে প্রাসঙ্গিক মনে করি বা নাই করি, গান্ধীর ভাবনার সাথে তাঁর শিষ্যরাও কেন একমত হতে পারছিলেন না সেই সমস্যাটা এখনো প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে! কথাটা উদ্ভট শোনাচ্ছে। তাই এই কৈফিয়ত নিয়ে দু’টো কথা সহ্য করতে হবে।
গত শতকের গোড়ায় আমাদের শিক্ষিত সমাজের কাছে এই খবরটা পৌঁছে গেছে যে ইউরোপ আঠারো শতকে নতুন আলোর সন্ধান পেয়েছে। সে অবশ্য এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এ নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছে, এখনো হচ্ছে, আমার মতো অল্পবুদ্ধি লোকের এ নিয়ে বাগবিস্তার করা ধৃষ্টতা। তবে কিনা, সংসারে দেখা গেছে আলো সব সময় যে শুধু পথেই পড়ে তা নয়, চোখের ওপরও এসে পড়ে প্রায়শই, আর তাতে রাস্তা দেখার খুব একটা সুবিধে হয় না, পা গর্তে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ে। ইউরোপ যেমন জ্ঞান চর্চার নতুন দিক খুলে দিয়েছে তেমনি আধুনিক সংস্কারও তৈরি করেছে। ইউরোপ এগিয়ে, আমরা পিছিয়ে। ইউরোপ যন্ত্র ব্যবহার করছে, নিত্য নতুন ভোগের সামগ্রী এনে দিচ্ছে। এতেই নাকি চিত্তেরও প্রসার ঘটে। উল্টোদিকে আমাদের গ্রাম সভ্যতা অন্ধকারের আখড়া কারণ আধুনিক যন্ত্রের বদলে ধর্মের সাধনা করে এসেছে। শুনতে খারাপ লাগলেও আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষার এই ছিল অভিজ্ঞান। বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় মহাযুদ্ধের পটভূমি হিসেবে জানাচ্ছেন, যখন একদিকে “ভূমিপথে আসিল মোটরগাড়ি, আকাশে পক্ষবিস্তার করিল এরোপ্লেন এবং বায়ুতরঙ্গে স্পন্দিত হইল বেতারযন্ত্রের ধ্বনি” তখন “প্রাচ্যের বৈরাগ্য ও নেতিবাচক জীবনদর্শন পরকালের স্বর্গসুখ প্রচার” করছিল। মুখুজ্জে মশাইয়ের ঔদ্ধত্যে রাগ করবেন না। স্বয়ং মার্কস প্রাচ্যের সভ্যতাকে “নীচু সভ্যতা” বলতে দ্বিধান্বিত হন নি। আমাদের দেশের মানুষ গান্ধীর মধ্যে কেন মুক্তির বাণী খুঁজে পেয়েছিলেন তার ব্যাখায় আমাদের আদি মাকর্সবাদী মানবেন্দ্রনাথ রায় বলছিলেন দেশের লোকে যে ভাষা বোঝে গান্ধী সে ভাষায় কথা বলতে পারতেন। তবে, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের বোধবুদ্ধি এখনও খুব নীচু”। ইত্যাদি।
এরই মধ্যে, ১৯১৭ সালে, নেভা নদীর পাড়ে আছড়ে পড়ল দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন। রাশিয়া ছাড়িয়ে তার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল সাত সমুদ্দুর তের নদীর পাড়ে। দুনিয়াসুদ্ধ লোকের প্রত্যয় গেল, মার্কস সাহেব সমাজ বিজ্ঞানের এমন একটা ফর্মুলা আবিষ্কার করেছেন যেটা প্রয়োগ করতে পারলে গরীব মানুষের সব দুঃখ দুর্দশার দিন চিরতরে ঘুচে যাবে। ফর্মুলা প্রয়োগটা কেমনভাবে হবে সে অবিশ্যি আরো অনেকগুলো জটিলতর ফর্মুলার ব্যাপার। তবে মোদ্দা কথা হল, বিপ্লব করতে হবে। সেও যার তার কর্ম নয়। শ্রমিকশ্রেণী করবে। শ্রমিক মানে যারা কারখানায় কাজ করে। কিন্তু দেশে যদি কলকারখানা তেমন না থাকে? তাহলে যত শিগগীর সম্ভব কারখানা বানাতে হবে। না হলে তেনারে বধিবে যে সেই শ্রমিকশ্রেণী গোকুলে বাড়বে কোথায়! সে দিক থেকে দেখলে কারখানাই মুক্তির সিঁড়ি, কারখানা বিনে গতি নেই। আর হ্যাঁ, বিপ্লব মানে শুধু ভালো ভালো কথা নয়। মেরে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে হবে। তাতে অন্যায়টা কি, শুনি? মায়ের পেট থেকে বাচ্চা বের করতে হলেও ছুরি চালানোর দরকার পড়ে না? তেমনি। বিপ্লব হল, নতুন সমাজের দাই। তাই নতুন সমাজের জন্য শ্রমিকদের জঙ্গী করে তুলতে হবে। আর যে ব্যাটা, শান্তির কথা বলে, ধর্মের কথা বলে সে শুধু ন্যাকা নয়, পেটে পেটে বদমাইশ, বিপ্লব ভন্ডুল করে দিতে চায়।
হেনকালে, ১৯১৫ সালের এক শীতের সকালে, এস এস আরাবিয়া জাহাজে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বোম্বাইয়ে এসে নামলেন সস্ত্রীক মোহনদাস গান্ধী। পরনে অদ্ভুত পোষাক। হাঁটু অব্দি জোব্বা, গোড়ালি অব্দি ধুতি আর মাথায় ঢাউস পাগড়ি। সমুদ্রযাত্রা আনন্দেই কেটেছে। সঙ্গে উদ্বেগ, আশঙ্কাও। বিরাট পরীক্ষা অপেক্ষা করছে সামনে। কীভাবে তৈরি করছিলেন নিজেকে, আরবসাগরকূলে পা রাখার জন্য? প্রতিদিন নিয়ম করে ভাগবত গীতা পড়ছিলেন। আর রামায়ণ। কখনো গাইছিলেন, সংকটের সময় তাঁর ভরসার গান, “আঁধার যখন ঘনিয়ে আসে, তোমার আলোর পরশ পড়ুক পথে …” (Lead, Kindly Light, amid the encircling gloom, ..”)।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমাদের দেশেও যখন প্রগতি চিন্তার আলো এসে পড়ছে তখন এমন লোক জাহাজ থেকে নেমে সত্য আর অহিংসার ধর্ম, রামনাম আর ভাগবত গীতা সম্বল করে জাতীয় আন্দোলনে ঢুকে পড়লে বেখাপ্পা, বেমানান মনে হবে না?
গান্ধী অবশ্য বারবারই বলছিলেন, যে, তিনি নতুন কোন কথা বলছেন না। এ সবই প্রাচীন সত্য। তা, কথাটা মিথ্যে নয়। আড়াই হাজার বছর আগে এক শাক্যপুত্রও অক্রোধ দিয়ে ক্রোধকে জয় করার কথা বলছিলেন। তিনিও বলতেন, কোন ধর্মমত প্রচার তাঁর উদ্দেশ্য নয়, জগতের যে নিয়ম তিনি লক্ষ্য করেছেন তাই বলছেন। তাই ধম্ম। কী সেই ধম্ম? বারাণসীর উপকণ্ঠে ঈশিপত্তনে পাঁচজন শ্রমণ থেকে সমগ্র এশিয়ায় যে ধর্ম যাত্রা করেছিল তার বলার কথা, জগতে দুঃখ আছে। দুঃখের কারণ আছে। (কোসাম্বির ধারণা, ইতিহাসে causality-র কথা এত সুস্পষ্টভাবে এই প্রথম বলা হল)। কী সেই কারণ? বাসনা। মুক্তির উপায়? সত্যের পথে চলা।
আমাদের আদি কবিরও প্রথম উচ্চারণ, মা হিংসি।
এই তো প্রাচ্যের নীচু সভ্যতা। নেতিবাচক জীবনদর্শন।
প্রাচ্য পাশ্চাত্যের দর্শনভাবনা নাহয় আপাতত থাকুক। কথা হচ্ছিল, গান্ধীর সাথে তাঁর সহযোগীদের সম্পর্ক। মোটের ওপর বলা চলে রাজনৈতিক অনুগামীরা তাঁর দর্শনকে গুরুত্ব দেন নি, অর্থনৈতিক ভাবনাকে বর্জন করেছেন, রাজনৈতিক ভাবনার সাথেও দূরত্ব ছিল। ওনার আশ্রমজীবনের সহযোগীদের কথা স্বতন্ত্র। জে সি কুমারাপ্পা, মহাদেব দেশাই, কাকা (দত্তাত্রেয়) কালেলকরের মতো অনেকে গান্ধীর দর্শন নিজেদের জীবনে গ্রহণ করেছেন। রাজনৈতিক অনুগামীদের মধ্যেও আবদুল গফফর খানের মতো ব্যতিক্রম আছেন। তবে সাধারণভাবে রাজনৈতিক অনুগামীদের সাথে গান্ধীর সম্পর্ক ভারি অদ্ভুত। এ প্রসঙ্গে দু একটা গপ্পোগাছা হয়তো সম্পাদকমশাই অ্যালাউ করবেন।
বল্লভভাই তখনো সর্দার হয়ে ওঠেন নি। আহমেদাবাদের গুজরাত ক্লাবে গান্ধী নিয়ে তুমুল চর্চা চলছে। কিন্তু ব্রিজ চ্যাম্পিয়ন বল্লভভাই খেলার টেবিলেই মগ্ন। কেউ খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলে তাস থেকে চোখ না সরিয়েই বলতেন, কে, ওই পাগলটা? যে নাকি চাকি ঘুরিয়ে গম ভেঙ্গে আর শৌচাগার সাফ করে স্বরাজ আনবে! চম্পারনের পর অবশ্য বিশ্বস্ত সহযোগী, একনিষ্ঠ শিষ্য হয়ে উঠতে দেরি হয় নি। কিন্তু তাঁর প্রিয় বাপুর দর্শন, রাজনীতি, ভাবনাকে দেখার বেলায় প্রাক্তন ব্রিজ চ্যাম্পিয়ন থেকেই গেছলেন সর্দারের মধ্যে। দুষ্টু লোকে বলে মৃত্যুর সপ্তাহ দুয়েক আগে গান্ধীর শেষ অনশন আসলে তাঁর চেলাদের, বিশেষ করে প্যাটেলের উদ্দেশে। গান্ধী জোর গলায় সেটা অস্বীকার করলেও (ওঁর পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক) বল্লভভাইও জনশ্রুতি বিশ্বাস করেছিলেন। জানুয়ারি মাসের ১৩ তারিখে পদত্যাগও করতে চেয়েছিলেন। জানতেন, মুখে যাই বলুন, পাকিস্তানকে ৫৫ কোটি টাকা ফেরত না দিতে গোঁ ধরে বসে থাকার জন্য বাপু ওঁর ওপর বিরক্ত হয়েছেন। ১৪ তারিখ ক্যাবিনেট এক রকম বাধ্যই হল টাকা ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু তার আগে কথিত লৌহপুরুষ প্যাটেল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন।
সর্দার মিতবাক মানুষ, লেখালেখি করতেও তেমন পছন্দ করতেন না, তাই অন্তত প্রকাশ্যে বাপুর সাথে দ্বিমতের কথা তেমন বলতেন না। কিন্তু নেহরু এ ব্যাপারে খোলামেলা, অকপট। ’৩১ সালের কথা। উইলিয়াম শিরার এসেছেন গান্ধী দর্শনে। (ফিশার চোদ্দ বছর স্তালিনের রাজত্বে কাটিয়ে এসেছিলেন গান্ধী দর্শনে আর শিরার গান্ধী দর্শন সেরে তারপর গেছলেন হিটলারের রাজত্বে।) কথা প্রসঙ্গে নেহরুকে বলছিলেন, “মিস্টার গান্ধীকে শুধোচ্ছিলাম, ওই যে ইন্ডিয়ান হোম রুল নামে একটা বই লিখেছেন, ওটা পড়ে নিশ্চয়ই আপনার দেশসুদ্ধ লোক হতবাক হয়ে গেছে। তা, আপনি কি এখন মত পালটেছেন? শুনে ভদ্রলোক তো হেসেই উঠলেন। বলেন, এক বিন্দুও না। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার কুফল নিয়ে আমার মত একই আছে। কালকেই যদি বইটা আবার প্রকাশ করি তাহলে একটাও শব্দ পাল্টাবো কিনা সন্দেহ। … আশ্চর্য লোক মশাই! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না”। শুনে, নেহরু এতটুকু বিচলিত হলেন না। শিরারকে আশ্বস্ত করলেন, “আরে না না, গান্ধীজী ও রকম অনেক কিছুই বলে থাকেন। হয়তো ওনার মনে হয়েছে মানুষকে জাগানোর জন্য এসব বলা দরকার। আমার তো মনে হয় না উনি সত্যিই ওগুলো বিশ্বাস করেন বলে”। অর্থাৎ কিনা গান্ধী স্রেফ বাজে বকছেন! এই হল তাঁর নিজের নির্বাচিত উত্তরাধিকারীর সাথে গান্ধীর সম্পর্ক। নিজেদের মতের, এমন কি দর্শনের, পার্থক্য ওঁরা স্বীকার করেছেন, বোঝার চেষ্টা করেছেন। ঝগড়াও করেছেন রীতিমতো। বেশ কয়েক মাস ইউরোপে কাটিয়ে _ তার মাঝে চারদিন মস্কোতে _ ’২৭ সালে নেহরু দেশে ফিরলেন পুরোদস্তুর সমাজতন্ত্রী হয়ে। ওঁরই উৎসাহে ডিসেম্বর মাসে মাদ্রাজ কংগ্রেসে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র দাবী গৃহীত হল। দীপ্ত বক্তৃতায় জওহরলালের আহ্বান ঃ সামন্ত্রতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক; শ্রমিক, কৃষক, ছাত্রসমাজ এক হও। ইত্যাদি। শুনে গান্ধী ভারি বিরক্ত। প্রকাশ্যে কড়া সমালোচনা করলেন। পত্রিকায় লিখলেন, আমি এই “স্বাধীনতা” কথাটার মানে বুঝি না। কিছু না ভেবেচিন্তেই এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বক্তৃতা যত বীরত্বব্যঞ্জক হোক না কেন, কোন মানেই নেই যদি তার উপযুক্ত কাজের কোন পরিকল্পনা না থাকে। আসলে, আমাদের ইংরেজি শিক্ষিত সম্প্রদায়, যাঁদের খুঁজতে হলে অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগবে তাঁরা ভেবে বসেন যে তাঁরাই সমগ্র ভারতবর্ষ। … ইত্যাদি।
সম্পাদক মশাই বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, কিন্তু প্রিয় শিষ্যদের সাথে গান্ধীর এইসব ঝগড়াও হাক্সলের অনুবাদের একটা কৈফিয়ত। আমাদেরও তো সে ছিল একদিন, বই পড়েছিলাম বলেই সবার কিনেছিলাম মাথা। তাই দিব্যি বুঝতে পারি, মহাত্মাকে নিয়ে নেহরুর বিড়ম্বনা। প্রায় হতাশ হয়ে বলবেন, “উনি তো একটা সমস্যা হয়ে উঠেছেন। রীতিমতো ধাঁধার মতো। শুধু ব্রিটিশ সরকারের কাছে নয়, নিজের মানুষদের কাছে, এমন কি নিজের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের কাছেও!” একশো বছর পরও গান্ধী সমস্যাই থেকে গেছেন, অন্তত আমাদের মতো বাকসর্বস্ব “বুদ্ধি”জীবীদের কাছে। অধমের মনে হয়েছে, নেহরু যে “রীতিমতো ধাঁধা”র কথা বলছিলেন হাক্সলে তার ওপর কিছুটা আলোকপাত করেছেন।
হাক্সলেও এসেছিলেন গান্ধী দর্শন করতে। ১৯২৫ সালে। আশা করে এসেছিলেন রূপকথার ঋষির মতো একজনকে দেখবেন। উন্নত ললাট। উজ্জ্বল, আয়তচক্ষু। তরঙ্গায়িত কেশরাশি, ধবধবে সাদা হলে আর ভালো। কিন্তু কানপুর কংগ্রেসের অধিবেশনে জমকালো সিল্কের শাড়ি পরিহিত সরোজিনী নাইডু আর রাশভারি ব্যক্তিত্বের মতিলাল নেহরুদের - যাঁদের মুখ দেখলেই বোঝা যায় তাঁরা কেউ একটা হবেন - পাশে ধুতি পরা ছোটখাটো, কৃশকায় লোকটিকে চট করে চোখেই পড়বে না। মাথা কামানো, বড়ো বড়ো কান, কেমন যেন শেয়ালের মতো মুখ। … শান্ত মানুষটিকে অসামান্য মনে হবে একমাত্র তিনি যখন হাসেন। শিশুর মতো প্রাণখোলা হাসি। তো, যাই হোক, হাসি ছাড়াও অন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হাক্সলের চোখে পড়েছিল সে কথা উনি নিজেই বলবেন অনূদিত এই প্রবন্ধে। আপাতত আর এক ব্রিটিশের কথা মনে পড়ছে। যে সে নয়, ভাইসরয় ইরউইন। মহাত্মার সাথে প্রথম সাক্ষাতের পর বাবাকে লিখছিলেন, “অদ্ভুত মানুষ, প্র্যাক্টিক্যাল রাজনীতি থেকে অনেক দূরে, … মনে হচ্ছিল যেন অন্য গ্রহ থেকে সপ্তাহ দুয়েকের জন্য এই পৃথিবীতে আসা একজনের সাথে কথা বলছি, যাঁর মতিগতি যে মর্ত্যলোকে তিনি নেমে এসেছেন তার কোন নিয়মকানুনের সাথে মেলে না”।
বড়লাট কিন্তু মোক্ষম কথা বলেছেন। গান্ধীকে নিয়ে সমস্যার গোড়ার কারণ বোধহয় এই যে তাঁর মতিগতি অন্য গ্রহের বাসিন্দার মতো। ওঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নেহরুর সাথে কি ওনার বিচ্ছেদ হতে চলেছে? বলেছিলেন, মতের কোন পার্থক্য, বিরোধিতাই জওহরলালের সাথে বিচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট নয়। শুধু জওহরলাল নয়, মতের বিরোধিতার কারণে কারুর সাথেই ওনার বিচ্ছেদ ঘটা অসম্ভব ছিল। এ আবার কেমন কথা! আমরা তো জানি মতাদর্শের সংগ্রামটাই আসল। মতটাই হল আদর্শ। মতই পথ। কিন্তু যত মত তত পথ নয়, ওগুলো পেটি বুর্জোয়া ভাবালুতা, ন্যাকামো। পথ একটাই, মার্কসের নির্দেশিত পথ। তবে সে তো আজকের কথা নয়। সেই রাইন নদীর দেশ থেকে এই ভাগীরথীর পাড়, চাট্টিখানি কথা? তাই মার্কসের পথকে এই পোড়া দেশে আবাহনের জন্য ভগীরথের প্রয়োজন হয়। কিছুটা পথ বাতলে দেন লেনিন, তারপর স্তালিন, তারপর মাও। পাশাপাশি অন্য ঘরানার ভগীরথরাও আছেন। রোজা লুক্সেমবার্গ, লিও ট্রটস্কি, লিউ শাও চি। আরো অনেকে। এঁদের প্রত্যেকের নিজের নিজের মত আছে। এই সব নানা মতের পারমুটেশন, কম্বিনেশন আছে। তাই পথ একটা হলেও মত অনেক। আর, মনে রাখতে হবে এই নানা মতের কেবলমাত্র একটাই সঠিক পথে গেছে, বাকি সব্বাই বিপথগামী। তাই, পথিক তুমি মত হারাইয়ো না। নিজের মতে অবিচল থাকো। অন্য সব মতকে হারিয়ে দাও। নিরন্তর পোলেমিক আর প্রোপাগান্ডার ছেনি আর হাতুড়ি দিয়ে নিজের মত অন্যের মাথায় ঢোকানোর চেষ্টা করে যাও। তবু যারা বিশ্বাস করে নাকো তাদের কি তুমি ক্ষমা করবে? কভি নেহি। ওরা তোমার সাথে একমত হচ্ছে না কেন? মানুষের চিন্তা কে নির্ধারণ করে? শ্রেণী। মার্কস বলে গেছেন। মানব চরিত্র বলে কোন ব্যাপার নেই, ওটা পেটিবুর্জোয়া মরীচিকা। সব চরিত্রই শ্রেণী চরিত্র। আমার মতটাই ঠিক কারণ ওটা শ্রমিক শ্রেণীর চিন্তার প্রকাশ। আর সবাই যারা আমার সাথে একমত হচ্ছে না তাদের সবার চিন্তাই অন্য কোন শ্রেণী স্বার্থের প্রকাশ। এইজন্য আমার সাথে যে দ্বিমত হচ্ছে সে আসলে আমার শত্রু। মানুষ হিসেবে সে কেমন, আমার খুব কাছের জন কিনা সেসব প্রশ্ন অবান্তর। আমার কর্তব্য, তিনি যেমন মানুষই হোন না কেন তাঁকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা। সুযোগ থাকলে তেমন শত্রুর বিনাশও বিপ্লবী কর্তব্য। কমরেড স্তালিন তো এ ব্যাপারে উজ্জ্বল নিদর্শন স্থাপন করে গেছেন। দীর্ঘদিনের সহকর্মী বা বন্ধুরাও দ্বিমত হলে কর্তব্যের প্রেরণায় তাদের ধরে ধরে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছেন। মনে করে দেখুন, লেনিনের সময় যাঁরা পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন - সে অর্থে যাঁরা বলশেভিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলা যায় - কর্তব্য বিবেচনায় তাঁদের প্রত্যেককে হত্যা করতে স্তালিন সাহেবের হাত কাঁপে নি। অবিশ্যি ট্রটস্কি দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। আর, ট্রেড ইউনিয়নের পুরোধা টমস্কি ফাঁকি দিয়েছিলেন। কমরেড স্তালিনের চরিত্রে কালিমালেপনের অভিপ্রায়ে বিচারের আগেই টমস্কি আত্মহত্যা করেন।
সে যাক গে। কথা হল, গান্ধী এসব আধুনিক, বৈজ্ঞানিক বিচারধারায় মোটে বিশ্বাস করতেন না। বলতেন, দ্বিমত হলে যদি শ্ত্রু হয়, তাহলে আমার চরমতম শত্রু আমার স্ত্রী। জগতের প্রায় সবকিছু নিয়েই ওঁর নিজের সুস্পষ্ট মত আছে। সে নিয়ে অক্লান্ত কথা বলবেন, পত্রিকায় লিখবেন, চিঠি লিখবেন। কিন্তু মতের লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার জন্য নয়। মানুষগুলিকে জয় করে নেওয়ার জন্য। মত নয়, মানুষই ওঁর কাছে আসল কথা - আমরা যদিও উল্টোটাই শিখেছিলাম, মতাদর্শটাই আসল, ব্যক্তি মানুষ খরচের খাতায়। নির্মলকুমার বসু গান্ধীর লেখা থেকে ভারি সুন্দর সংকলন করেছিলেন। সোদপুরে ওঁদের যখন দেখা হল, গান্ধী বললেন তুমি কয়েকদিনের জন্য সেবাগ্রামে এসো। নির্মলবাবু বলেন, ওখানে আমি আপনাদের কোন কর্মে লাগবো? লেখাপড়া ছাড়া তো আর কিছু করতে জানি না। সেবাগ্রামে গেলে আপনার আশ্রমের লোকেরা ভাববে, এ কেমন লোক এসেছে যে দিনরাত শুধু বই মুখে দিয়ে বসে থাকে, আর আমার মনে হবে এ কোথায় এলাম যেখানে লোকে দিনরাত শুধু চরখা কাটে। বাপু বেশ খানিক হেসে বলেন, তা কেন? ওখানে মেথরের কাজ আছে, তোমাকে লাগিয়ে দেবো। এই সব বাক্যালাপের পর, গান্ধী বললেন, দ্যাখো, তুমি তো শুধু আমার লেখার সংকলন করছো না, সেগুলো বোঝার চেষ্টাও করছো। তাই শুধু লেখা পড়লে হবে না, আমি কেমন করে কাজ করছি সেটাও তোমাকে দেখতে হবে। শুধু আমার কাজ নয়। আমার সহকর্মীদের, যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা আমাদের আদর্শ বাস্তবে পেতে চাইছি সেই সংগঠন তাকেও তোমাকে দেখতে হবে। ফিশার যখন সপ্তাহখানেকের জন্য ওয়ার্ধায় এসেছিলেন গান্ধী বলেন, এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে তুমি আমার শ’খানেক দোষত্রুটি খুঁজে পাবে। না পেলে ব’লো আমি তোমাকে সাহায্য করবো।
আত্মজীবনীতে গান্ধী বলছিলেন, “মানুষ আর তার কাজ সম্পূর্ণ আলাদা দুটো ব্যাপার। একটা ব্যবস্থাকে প্রতিহত করা, আক্রমণ করা ন্যায়সঙ্গত হতেই পারে। কিন্তু সে ব্যবস্থা যাঁর তৈরি তাঁকে আক্রমণ করা আর নিজেকে আক্রমণ করা একই ব্যাপার। কারণ আমরা সবাই এক তুলিতে আঁকা। আমরা সবাই এক স্রষ্টার সন্তান। তাই আমাদের মধ্যে অনন্ত স্বর্গীয় ক্ষমতা। কোন একজন মানুষকেও অবমাননা করার অর্থ সেই অনন্তকে অবমাননা করা। …”
অদ্বৈতকে গান্ধী এভাবেই বুঝেছিলেন সম্ভবত।
“সত্য তাহলে কী?” উত্তরে বলেছিলেন, “প্রশ্নটা সহজ নয়। আমি আমার মতো সমাধান করেছি এই বলে, যে, তোমার অন্তর থেকে যা শুনতে পাচ্ছো তাই তোমার সত্য। জানি, তুমি বলবে, নানা লোকে তো নানা পরস্পর বিরোধী সত্যে বিশ্বাস করে। … ঈশ্বরও কি ভিন্ন মানুষের কাছে ভিন্ন রূপে প্রকাশিত হন না? কিন্তু আমরা তো জানি তিনি এক। … তাই এতে ভুল কিছু নেই যে সবাই নিজের উপলব্ধি মতো সত্যের অনুসরণ করবেন”। কবি হলে হয়তো বলতেন, “আমরা চলব আপন মতে, শেষে মিলব তাঁরি পথে, …”। র্যাশনালিষ্টরা খুশি হবেন না শুনে। কি আর করা যাবে। মানুষ যাকে যুক্তি বলে মনে করে বিশ্ব সংসারকে সেই মতোই চলতে হবে? মানুষ নিজেই চলে নাকি যুক্তি মেনে? “পশ্চাদপদ প্রাচ্য” লোকজনদের কথা নাহয় ছাড়ান দিন। স্বয়ং বারট্রান্ড রাসেলকেও বলতে শোনা গেছে, “মানুষ নাকি যুক্তিশীল প্রাণী। অন্তত আমি তো তেমনই শুনেছি। (অ্যারিস্টটলের কাছে শুনে থাকবেন)। আমার দীর্ঘ জীবন ধরে তিনটে মহাদেশ ঘুরে আমি এই কথার সপক্ষে সাক্ষ্য খুঁজে বেড়িয়েছি। এখনো পর্যন্ত কোন প্রমাণ খুঁজে পাওয়ার সৌভাগ্য হয় নি”। এখনো পর্যন্ত মানে, তখন রাসেল সাহেবের বয়স একাত্তর বছর। পরিণত বয়সে এসে আধুনিক সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের এই ধারণা হয়েছিল। ‘বিসর্জন’ নাটক লেখার সময় কবির বয়স তিরিশও হয় নি কিন্তু অন্ধকার মুছতে মানুষের জ্ঞান কেন ঝামেলায় পড়ছে দিব্যি শুনিয়ে দিচ্ছেন। (অল্প বয়সের রবীন্দ্রনাথকে কৃষ্ণ কৃপালনী বলেছেন, precaucious genius. তা উনি বলতেই পারেন, নাতজামাই বলে কথা!) অনেক দিন তো পড়েন নি, তাই না হয় আর একবার শুনুন রাজা গোবিন্দমানিক্যের কথা ঃ “ক্ষীণ দীপালোকে গৃহকোণে থেকে যায় ছায়া/ অন্ধকার; সব পারে, আপনার ছায়া/ কিছুতে ঘুচাতে নারে দীপ। মানবের/ বুদ্ধি দীপসম, যত আলো করে দান/ তত রেখে দেয় সংশয়ের ছায়া। …”। আপনার ছায়া নিয়ে এই সচেতনতা, সতর্কতা কি ভারতীয় দর্শনেরই স্বকীয় বৈশিষ্ট্য? তথাগতের সেই সময় থেকে? গান্ধীকেও বলতে শোনা যেত, “সত্যিকারের বিনয়ী যে হতে পারে নি সে কোন দিন সত্যের সন্ধান পাবে না। সত্যের গভীরে ডুব দিতে হলে নিজেকে শূন্য করে দিতে হবে”। কিম্বা, “যে ঈশ্বরের আবেদন শুধু বুদ্ধির কাছে তিনি ঈশ্বরই নন। ঈশ্বরকে ঈশ্বর হতে হলে হৃদয়ে আসন পাততে হবে, …”।
সর্দার বা পন্ডিতজীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এমন লোককে নিয়ে রাজনীতি করা সত্যিই মুশকিল। দেখুন, রাজনীতি ব্যাপারটা তো আসলে _ এখনকার লব্জে, “দিনের শেষে” - কিছু লোকের ক্ষমতার কুর্সিতে বসা। সে জাতীয় স্বাধীনতা বলুন বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। জানি, কথাটা ওভাবে বলতে নেই, বললে ভালো শোনায় না। তবে, এ তো মানবেন যে সব ক্ষমতা আসলে রাষ্ট্রের হাতে। কিছু পাজি লোকের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আছে বলেই তো যত সমস্যা। তাই মানুষের দুঃখ দুদর্শা দূর করতে গেলে বা প্রগতি আনতে গেলে ভালো কিছু লোককে - এই যেমন ধরুন আমাদের মতো লোকদের - রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে হবে। অবিশ্যি আমরা তো নিমিত্ত মাত্র। আমরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবো জাতীয় প্রতিনিধি হিসেবে। কিম্বা, শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে। কিম্বা, ভার্সেই চুক্তির অবমাননা থেকে জার্মানিকে উদ্ধার করার জন্যে বিশুদ্ধ নর্ডিক জার্মান জাতির প্রতিনিধি হিসেবে।
গান্ধীকে নিয়ে ঝামেলা হল, উনি এসব কিছুই মানবেন না। বলবেন, আইন সভাই সব ক্ষমতার উৎস এমন ধরে নেওয়া একটা মস্ত ভ্রান্তি। ভ্রান্তির কারণ আর কিছু নয়, আমাদের মানসিক জড়তা আর ওপর ওপর ইউরোপের ইতিহাস পড়া। বোঝো কান্ড! তাহলে, ক্ষমতার উৎস কোথায়? ব্যক্তি মানুষ। “চূড়ান্ত বিচারে ব্যক্তিই শেষ কথা”। ভারি মুশকিল! আমরা তো জানি ব্যক্তি মানুষই যত ঝামেলার মূলে। তার বিচ্যুতি, অপরাধপ্রবণতা ইত্যাদি সামলে রাখার জন্যই তো আইন, রাষ্ট্র, পুলিশ পেয়াদা, সংগঠনের কাঠামো, কমিউনিষ্ট পার্টির লৌহ শৃঙ্খলা। কিন্তু গান্ধী বলবেন, “মানব চরিত্রকে সন্দেহ করতে আমি অস্বীকার করি”। এটা শুধু ওঁর অদ্বৈতের ধারণার জন্যই নয়। কারণ ওরই সাথে বলবেন, “সহৃদয় যে কোন মঙ্গল কাজে [মানব চরিত্র] সাড়া দেবেই”। এই আশা। এই কারণে, “স্বরাজের দিকে প্রথম পদক্ষেপ ব্যক্তির মধ্যে দিয়ে”। এই জন্যই কি, স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের চেয়ে স্বরাজ শব্দটাই বেশি ব্যবহার করতেন? স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র তো “দিনের শেষে” রাষ্ট্রিক ধারণা। কিন্তু গান্ধীর স্বরাজের ধারণা ক্ষমতাকে, রাষ্ট্রকে অস্বীকার করার ধারণা। “আমার আশা, আমি দেখাতে পারবো যে, কিছু মানুষের ক্ষমতা দখলের পথে নয় স্বরাজ আসবে যখন সব মানুষ পারবেন ক্ষমতার যে কোন অপব্যবহারকে প্রতিহত করতে”। লক্ষ্য করুন, কী করিতে হইবে বলে দিচ্ছেন না। বলছেন, উনি নিজে করে দেখাবেন। দেখাতে পারবেনই এমনও নিশ্চয়তা দিচ্ছেন না। আশা করছেন মাত্র। তবু, কোন রাজনীতিবিদের আর আহ্লাদ হবে এমন কথা শুনে, যে, “স্বশাসন মানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসার নিরন্তর চেষ্টা, তা সে বিদেশী বা দেশী যে সরকারই হোক না কেন”। আরো বিপদের কথা, “কিছু লোক, তা সে তাঁরা যত ভালো লোকই হোন না কেন, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে স্বরাজ বা মুক্তি আনবেন মনে করলে দুর্দশার অন্ত থাকবে না”।
এই সতর্কবার্তা তো অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। এটা অনুবাদকের আর একটা কৈফিয়ত।
অবিশ্যি, রাষ্ট্রকে যে শুধু গান্ধী অস্বীকার করছিলেন এমন নয়। পাশ্চাত্যের নৈরাজ্যবাদীরাও (anarchists) রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে অস্বীকার করার, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলতেন। কিন্তু ডেভিড হার্ডিম্যান মনে করিয়ে দিয়েছেন গান্ধী তাঁর সমকালের নৈরাজ্যবাদীদের চেয়ে ভিন্ন ধাতুতে গড়া। নৈরাজ্যবাদীরা ছিলেন নিরীশ্বরবাদী (ওঁদের ধারণা রাষ্ট্রই ধর্মকে খাড়া করে রেখেছে ক্ষমতা টিঁকিয়ে রাখার জন্য), মনে করতেন এক ধাক্কায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন বিনে মুক্তি নেই। ওদিকে গান্ধী গভীর ঈশ্বরবিশ্বাসী - ঈশ্বর ওঁর কাছে সত্যের আর এক নাম - স্থায়ী কোন পরিবর্তনই রাতারাতি হয় বলে মনে করেন না। সে সব তো আছেই। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল, নৈরাজ্যবাদীরা শুধু রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণ নয়, কোন নিয়ন্ত্রণই স্বীকার করেন না। আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ! ব্যক্তিগত জীবনে বোহেমিয়ান, যৌন সংযমের রেয়াত করেন না। (দোহাই আপনাদের, অপরাধ নেবেন না! হার্ডিম্যান সাহেব এসব বলছেন, অধম অনুবাদক মাত্র)। আর গান্ধী রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণের বিরোধী হলেও নিয়ন্ত্রণের বিরোধী নন। ওনার বলার কথা এই, যে, রাষ্ট্র ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণের অধিকারী হতে পারে না। কিন্তু উনি নিজের এবং অনুগামীদের জন্য এমন কঠোর আত্ম-নিয়ন্ত্রণ দাবী করবেন কোন রাষ্ট্রই অত দূর যেতে পারবে না।
গান্ধী অবশ্য দাবী করতেই পারেন যে আত্মনিয়ন্ত্রণই মুক্তির পথ এই ধারণাও “হিমালয়ের মতো প্রাচীন”, ওঁর নিজের আবিষ্কার নয়। প্রাক-বৈদিক শ্রমণদের সময় থেকে ভারতীয় ঐতিহ্যের পরতে পরতে ভয় মুক্ত হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে “আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়” এর ধারণা। এ প্রসঙ্গে ভারি সুন্দর গল্প শুনিয়েছেন আচার্য ক্ষিতিমোহন। ১৯১৫ সাল। সস্ত্রীক গান্ধী এসেছেন শান্তিনিকেতনে। বেশ ভাব হয়ে গেছে “বড়ো দাদা” দ্বিজেন্দ্রনাথের সাথে। একদিন দুজনে বসে আছেন ‘নিচুবাংলা’র দাওয়ায়, পোষা কাঠবেড়ালিরা অবাধে বিচরণ করছে বড়ো দাদার ঘাড়ে মাথায়, কথায় কথায় দ্বিজেন্দ্রনাথ বললেন, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়” এই বক্তব্যের “স্ব” কে সংকীর্ণ অর্থে বুঝলে ভুল হবে। এই স্বধর্ম অন্তঃস্থলের ধর্ম, অস্তিত্বের ধর্ম। বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া অনুশাসনের দাসত্বের ধর্ম নয়, অন্তরের মুক্তির ধর্ম। নিজেকে জয় না করে মানুষের সত্যিকারের প্রকাশ নেই বলেই উপনিষদ বলেছেন, স্বরাজই - নিজের ওপর রাজত্বই - স্বপ্রকাশ। স্বাধীনতা কথাটাকে ইংরেজি independence এর অনুবাদ হিসেবে না দেখে স্বরাজ্য হিসেবে বুঝতে হবে। যে অর্থে কৌশীতকী ব্রাহ্মণে সারা বিশ্বের ওপর আধিপত্যের চেয়ে স্বরাজ্যই শ্রেয় বলা হয়েছে (“সর্বেসাং ভুতানাম শ্রেষ্ঠয়ং, স্বরাজ্য আধিপত্যম পর্যয়ন্তি”) সেই অর্থে স্বরাজকে বুঝতে হবে।
ভালো কথা। তা, এই স্বরাজ লাভের জন্য গান্ধীর প্রেসক্রিপশন কী? উনি আবার প্রেসক্রিপশন করেন না। বার বার মনে করিয়ে দিতেন যে গান্ধীবাদ বলে কোন পদার্থ নেই। বেশ, তা নাহয় হ’লো, কিন্তু তাহলে ওই একশো ভল্যুম রচনাবলীতে কী এত লিখছিলেন? সে আর এক গল্প। একবার দেখুন না, দু পাতা উল্টে। বোর হয়ে যাবেন। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিনের রচনাবলী উল্টেছেন? ভল্যুমের পর ভল্যুম রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, দর্শন ইত্যাদি নিয়ে তত্ত্ব, বিশ্লেষণ, আলোচনা, সমালোচনা। আর গান্ধীর রচনাবলীতে? অধিকাংশই ব্যক্তিগত কথাবার্তা। কার কী খাওয়া উচিত সে নিয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা। কার শরীর কেমন আছে সে নিয়ে তত্ত্বতালাশ। অসুখের চিকিৎসা নিয়ে পরামর্শও। পুত্র বা কন্যের বিবাহ প্রসঙ্গে পরামর্শ। কিম্বা, বিবাহউন্মুখ প্রেমিক প্রেমিকার হৃদয়হীন পিতাদের বশীভূত করা নিয়ে শলাপরামর্শ। কী নেই সেখানে? ফিশার ১৯৪৬ সালের “হরিজন” পত্রিকার একটা সংখ্যার কথা বলেছেন। ক্যাবিনেট মিশন এসেছে। দু মাস ধরে জাতীয় নেতাদের সাথে কথাবার্তার শেষে ১৬ই মে জাতীয় সংবিধান আর জাতীয় সরকার নিয়ে তাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এখন কথা হল, ভারতীয়রা কি এই প্রস্তাব মেনে নেবেন। আসল প্রশ্ন হল, মহাত্মা গান্ধী কি এই প্রস্তাব মেনে নেবেন? চারদিন ধরে “গভীর পর্যালোচনা”র পর গান্ধী হরিজন পত্রিকায় সোয়া এক পাতার প্রবন্ধ লিখলেন ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব নিয়ে তাঁর মত জানিয়ে। ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক প্রস্তাবের বিশ্লেষণের নিচেই পত্রিকার দ্বিতীয় নিবন্ধ “আম আঁটির শাঁস”। লেখক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। বিষয়, আম আঁটির শাঁসের খাদ্যগুণ। তৃতীয় নিবন্ধ, “প্রাকৃতিক চিকিৎসা”। লেখক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। আলোচ্য বিষয়, গরুর দুধ আর মোষের দুধের পুষ্টিগুণের বিচার। এই লেখকের ধ্যেয় কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য নয়। তাঁর দেশবাসী। দেশবাসীর যাপনের খুঁটিনাটি সব কিছু।
১৯১৪ কি ’১৫ সালে সাইবেরিয়ার নির্বাসন থেকে টিফলিসে স্তালিন একটা চিঠি লিখেছিলেন। ভাবী শ্বশ্রুমাতা ওলগা আল্লিলুয়েভকে। চিঠিতে আল্লিলুয়েভ পরিবারের সহৃদয় আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। জানিয়েছেন, পার্সেলটা পেয়েছেন কিন্তু তাঁর জন্য আর যেন খরচ না করা হয়। শুধু জর্জিয়ার পাহাড়ের ছবি দেওয়া কিছু পোষ্টকার্ড পাঠালে ভালো হয়। এখানে সবকিছু একঘেয়ে, তুষারাবৃত। স্তালিনের এই একটাই চিঠি পাওয়া যায় যেটা নেহাত ব্যক্তিগত, রাজনীতির কোন প্রসঙ্গ নেই।
গান্ধীর তাত্ত্বিক রচনাও অবিশ্যি আছে একখান। এ দিক থেকে মহাত্মা গান্ধীর সাথে হের হিটলারের ভারি মিল! হিটলারও সাকুল্যে একখানাই তাত্ত্বিক পুস্তক রচনা করেছিলেন। জার্মানির ক্ষমতায় আসার বছর আটেক আগেই। লিখেছিলেন মানে ১৯২৫ সালে ল্যান্ডসবার্গ দুর্গে খাঁচাবন্দি বাঘের মতো পদচারণা করতে করতে মুখে মুখে বলছিলেন আর ভক্ত হনুমান রুডলফ হেস লিখে নিচ্ছিলেন। সে যাই হোক, মেইন ক্যাম্ফ এ হিটলার সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছিলেন তাঁর উদ্দেশ্য বিধেয় কী। আর তারপরই কাজে নেমে পড়েছিলেন, দ্বিতীয়বার আর তাত্ত্বিক রচনার প্রয়োজন পড়ে নি। গান্ধীও হিন্দ স্বরাজ লিখেছিলেন ভারতে ফেরার আগেই। ১৯০৯ সালে লন্ডন থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরার সময়, জাহাজে। সে জাহাজেরও নাম কিলদোনান দুর্গ! আর গান্ধীরও ওই একটি বই লেখার পর আর দ্বিতীয়বার তাত্ত্বিক রচনার প্রয়োজন হয় নি। তবে এ বাবদে ফ্যুরার আর মহাত্মার ইতিহাসের তফাতটাও চোখে পড়ার মতো। হিটলারের তত্ত্ব (যদি অবশ্য জার্মান জাতিকে সামরিক শক্তিতে অজেয় করে তোলা, ইহুদীদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলা আর জার্মানদের পর্যাপ্ত ‘বাসভূমি’ - lebensraum-র জন্য স্লাভদের দেশ দখল করার পরিকল্পনাকে তত্ত্ব বলা চলে) তাঁর দেশে বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল বললে কম বলা হয়। আধুনিক সভ্যতায়, বিজ্ঞান চর্চায়, দর্শন চর্চায় অগ্রণী জার্মান জাতি (মার্কসেরও বড়ো আশা ছিল তাঁর প্রদর্শিত পথে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবটা জার্মানরাই শুরু করবে) হিটলারের কথামতো যুদ্ধযাত্রায় আর নরসংহারে উন্মত্ত হয়ে উঠল। তবে কিনা ‘হাজার বছরের রাইখ’-এর পাগলামো বারো বছরেই অবর্ণনীয় নৃশংসতার মধ্যে চুকেবুকে গেল। ওদিকে গান্ধীর ‘হিন্দ স্বরাজ’-এর ধারণা যে তাঁর অনুগামীদের কাছেই গুরুত্ব পায় নি সে কথা তো হচ্ছিল। ১৯৪৫ সালেও এতটুকু মত পালটান নি শুনে নেহরু আশ্চর্য হচ্ছেন।
ধুরন্ধর সম্পাদকমশাই অবিশ্যি ধরে ফেলবেন ওকালতি করবো না বললেও এটা ঘুরিয়ে গান্ধীবাবার ওকালতি। তর্কটা যেন এইরকম যে হিটলারের তত্ত্ব, মার্কসের তত্ত্বের রীতিমতো বাস্তব প্রয়োগ হয়েছে, সে বারো বছর হোক বা একশো বছর ধরে হোক। ফল কী হয়েছে তার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য সব চোখের সামনেই রয়েছে, দেখবো নাকি চোখ বুজে থাকবো সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র। কিন্তু বেচারা গান্ধীর তত্ত্বকে যখন কেউ পাত্তাই দিল না, তখন প্রয়োগের আগেই বাতিল করে নেওয়া কি ধর্মে সইবে? তর্কের অভিসন্ধি অনুবাদক অস্বীকার করবে না। তবে নিবেদনটা একটু অন্য রকম। মার্কস, গান্ধী, হিটলার এই তিনজন সম্পূর্ণ ভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছতে চাইছিলেন বলে কোন একজনের অবস্থান বিন্দু থেকে অন্য একজনকে দেখা নিতান্ত অসঙ্গত হবে। কথাটা প্যাঁচালো রকমের হয়ে গেল তবে নিতান্ত দায়ে পড়ে। দু ধরনের নিন্দে প্রায়ই শোনা যায় কিনা।
একটা কথা খুব চলে যে নেহাত ব্রিটিশ ভারত বলে গান্ধী পার পেয়ে গেলেন, হিটলারের পাল্লায় পড়লে …। তা যদি বলেন তবে মানতেই হবে যে একটি গুলিতে গান্ধীকে স্তব্ধ করে দিতে হিটলারের বেগ পেতে হতো না। স্তালিনকে হয়তো একটু কাঠখড় পোড়াতে হত। কিন্তু কথা হ’ল, সমস্যাটা কার? আমাদের তো? মানুষের যে গভীর অসুখ ওই প্রতিভাবান উন্মাদের হাতে পড়ে ওই রকম একটা মতাদর্শ হয়ে উঠেছিল সেই অসুখ সেরে গেছে বলে নিশ্চিন্ত হতে পারছি কি আমরা? এখনও? আমাদের বিশ্রম্ভালাপের অলস রাজনীতি চর্চায় সমকালীন সময়েও হিটলারের পদধ্বনি আমরা মাঝেমধ্যেই শুনতে পাই না? তা, মানুষের আদিম সেই অসুখ বাড়াবাড়ি হয়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ক্যান্সারে না দাঁড়ায় এই তো আমাদের উদ্বেগ হওয়ার কথা। গান্ধী ভাবছিলেন মানুষের সেই অসুখের একটা নিরাময়ের কথা, অন্তত শুশ্রূষার কথা। নিরাময় ব্যর্থ হলে, গেস্টাপো বাহিনীর জহ্লাদের সামনে সত্য আর অহিংসার বার্তা কাজে আসবে না ঠিকই। কিন্তু ক্যান্সার ছড়িয়ে গেলে কোন চিকিৎসাই কাজে আসবে না বলে দেশ থেকে হাসপাতাল সব আমরা তুলে দিয়েছি নাকি?
আরেক ধরনের নিন্দে মাকর্সবাদীরা করে এসেছেন। যেটা শুরু হয়েছে রজনী পাম দত্ত সাহেব নিদান ঘোষণার পর থেকে যে গান্ধী বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি। তর্কে আর অন্যের দোষ, ত্রুটি, বিচ্যুতি বিশ্লেষণে ওঁরা যে দিগ্বিজয়ী বীর সে তো মানতেই হবে। এই প্রসঙ্গে নিবেদন শুধু এটুকু যে মাকর্স আর গান্ধী দুটো ভিন্ন লক্ষ্যের সন্ধান করছিলেন। গান্ধী খুঁজছিলেন ব্যক্তির উদ্বোধনের পথ। মাকর্স চাইছিলেন অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন। এটা ঠিকই যে মার্কসও - অন্তত ১৮৪৮ সালে - এমন বিপ্লবের কথা আলোচনা করছিলেন যে মানবতাকে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দেবে। এমনও বলছিলেন, র্যাডিক্যাল হওয়া মানে মূলে পৌঁছনো আর, মানুষের মূল তো মানুষই। কিন্তু যে সব বাঁধন মানুষের অবমাননার কারণ সেই সব সম্পর্কের বাঁধন ছিঁড়ে না ফেললে তো মানুষের মুক্তি নেই। আবার, সব বাঁধন যতক্ষণ না কাটছে ততক্ষণ কোন বাঁধনই কাটবে না। বস্তুগত কাঠামোকে ছুঁড়ে ফেলতে তো বস্তুগত শক্তিই লাগবে। তাই শুধু সমালোচনার অস্ত্র নয়, অস্ত্র দিয়ে সমালোচনাও চাই। মার্কসই বলছিলেন। নিজের যুক্তির ঝোঁকে মানবতার শীর্ষবিন্দু সন্ধান করতে যেয়ে অস্ত্রের ঝংকার পর্যন্ত চলে গেলেন। আর শিষ্যদের ওই বস্তুগত কাঠামো ভেঙ্গে ফেলা আর অস্ত্র দিয়ে সমালোচনার কথাটাই মনে ধরলো, মনে থাকলো। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই মাপকাঠি দিয়েই দত্ত সাহেব, রায় সাহেব এবং তস্য চেলারা গান্ধীর প্রতিটি পদক্ষেপ মাপতে থাকলেন। সে নাহয় ওঁরা যা ভালো বোঝেন তাই করবেন। মাপজোকের শেষে মাপকাঠি ছাড়া অন্য কিছু হাতে থাকলো কিনা সেও ওঁদের শিরঃপীড়া। অধমের বলার কথা শুধু এই যে এ প্রসঙ্গে অম্লান দত্ত একটা জরুরী কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন যেটা এই তালেগোলে মনে থাকে না। অধ্যাপক দত্ত বলছিলেন, ধনতন্ত্রের শক্তিশালী সমালোচক দু জন। মার্কস এবং গান্ধী। এই দুজনের মধ্যে গান্ধীর সমালোচনা অনেক বেশি র্যাডিক্যাল। মাকর্স ধনতন্ত্রের উৎপাদন সম্পর্কটা ভেঙ্গে বদলে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু ধনতন্ত্র যে উৎপাদন পদ্ধতি, প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে তাকে গ্রহণ করেছিলেন। গান্ধীর সমালোচনা কেন্দ্রীভূত, প্রযুক্তি নির্ভর ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার একেবারে মূলে।
রামচন্দ্র গুহ শুধু সুলেখক নন, সুবক্তা। ওঁর বক্তৃতার একটা প্রিয় বিষয়, মহাত্মা গান্ধী কেন আমাদের সময়ে প্রাসঙ্গিক। বক্তৃতার শুরুতেই বলবেন, গুনে গুনে এগারোটা কারণ দেখাবো। এগারোটা কেন? কারণ একটা ক্রিকেট দলে এগারো জন খেলোয়াড় থাকে! ভালো কথা। কিন্তু এই এগারোটা কারণের মধ্যে গ্রাম পুনর্গঠন কাজের জায়গা হয় নি। ক্রিকেট দলে আরো জনাদুয়েক খেলুড়ে থাকলে গান্ধীর অর্থনৈতিক ভাবনাও প্রাসঙ্গিকতার তালিকায় নির্বাচিত হত কিনা জানি না। তবে ইউরোপে গান্ধীকে যাঁরা পরিচিত করিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই এ নিয়ে নীরব থেকেছেন। নির্মলকুমার বসু একদিন কথা প্রসঙ্গে গান্ধীকে বলছিলেন, রঁল্যা শুধু আপনার ভাঙ্গার কাজটাই দেখেছেন, গড়ার কাজ বোধহয় লক্ষ্য করেন নি। গান্ধী বললেন, উনি তো দূর থেকে দেখেছেন। ভারতে আসবেন ভেবেছিলেন কয়েকবার …। ফিশারের গান্ধী গবেষণা এক মূল্যবান সম্পদ। দুবার ভারতে এসে কিছুদিন গান্ধীর সাথে কাটিয়েও গেছেন। কিন্তু গান্ধীর অর্থনৈতিক ভাবনার সাথে, বিশেষ করে প্রযুক্তির প্রশ্নে, একমত হতে পারেন নি।
অলডাস হাক্সলে গান্ধীর ভাবনার গুরুত্বপূর্ণ আর অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এই দিক লক্ষ্য করেছন। এই অনুবাদ তাই হাক্সলে সাহেবের প্রতি সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা।
শুধু একটা ব্যাপারেই কোন কৈফিয়তের দরকার হবে না। অনুবাদের চেয়ে অনুবাদের কৈফিয়ত বহরে আড়াইগুণ! এর জন্য কৈফিয়ত লাগবে না। শুধু শূন্য কলসীর প্রবাদ স্মরণ করলেই হবে।
ইংরেজ সাহিত্যিক, দার্শনিক, শান্তিকামী চিন্তাবিদ।
প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী থমাস হাক্সলের পৌত্র অলডাসের শিক্ষার হাতেখড়ি বাবার উদ্ভিদবিদ্যার গবেষণাগারে। দুই ভাই খ্যাতনামা জীববিজ্ঞানী। কিন্তু সতের বছর বয়সে চোখের অসুখে দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলায় অলডাসের বিজ্ঞান সাধনার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় নি।
ক্ষীণ দৃষ্টি নিয়ে কষ্ট করেই পড়াশোনা করেছেন। আর গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে দেখেছেন প্রযুক্তি হয়ে উঠছে আধুনিক মানুষের শেষ ভরসাস্থল। রাষ্ট্রিক রাজনীতি আর আধুনিক প্রযুক্তির যুগলবন্দী আমাদের কোন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেই উদ্বেগ থেকেই তাঁর কল্পবিজ্ঞান আশ্রিত বিখ্যাত উপন্যাস, ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড। সারা বিশ্ব জুড়ে তখন একটাই রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রে সবই নিয়ন্ত্রিত। মানুষও। সুশৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণের খাতিরে মানুষও উৎপাদিত হচ্ছে কারখানায়। প্রয়োজন মতো, অর্ডার মাফিক, উৎপাদন হচ্ছে আলফা বিটা গামা এপসাইলন অর্থাৎ কিনা এলিট থেকে শ্রমিক সব শ্রেণীর মানুষ। গবেষণাগারের অধ্যক্ষ বলছেন, প্রাচীন কালে একটি ডিম্বাণুর সাথে একটি শুক্রাণুর নিষেকে একটাই মাত্র ভ্রূণ আর সেখান থেকে একটিই মাত্র মানুষ তৈরি হত। আর এখন দেখুন আমরা একটি মাত্র নিষেক থেকে উৎপাদন করছি একশো ছিয়ানব্বইটা ভ্রূণ, মানে একশো ছিয়ানব্বইটা মানুষ। এই হল দক্ষতা। প্রগতি।
গান্ধীজীর মরদেহ অস্ত্রবাহী যুদ্ধ শকটে চিতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। শেষযাত্রায় ছিল ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি, সৈন্য বাহিনী, পুলিশ বাহিনী। মাথার ওপর চক্কর দিচ্ছিল ভারতীয় বায়ু সেনার যুদ্ধ বিমান। অহিংসা আর চিৎশক্তির যিনি প্রতিভূ তাঁর সম্মানে কুচকাওয়াজ করছিল নিপীড়নের হিংস্র এইসব সরঞ্জাম। এই পরিহাস অবশ্যম্ভাবী। কারণ, নেশন মানেই তো এক সার্বভৌম গোষ্ঠী যার অন্য সার্বভৌম গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সব বন্দোবস্ত আছে। তাই কোন একজন ব্যক্তিকে - এমনকি তিনি গান্ধীর মতো মানুষ হলেও - কোন নেশনের সম্মানজ্ঞাপন সমরশক্তি আর নিপীড়নশক্তির প্রদর্শনীই তো হয়ে উঠবে।
প্রায় চল্লিশ বছর আগে, "হিন্দ স্বরাজ"-এ গান্ধী তাঁর স্বদেশবাসীদের জিজ্ঞেস করছিলেন, "স্বায়ত্ত শাসন" বা "হোম রুল" এর মতো কথাগুলো দিয়ে তাঁরা কী বোঝাতে চান? তখন যে রকম সমাজ ব্যবস্থা ছিল সেটাই চলবে, শুধু ইংরেজের পরিবর্তে ভারতীয় রাজনীতিবিদ আর প্রসাশকদের হাতে থাকবে? তাই যদি হয় তাহলে তাঁরা স্রেফ বাঘের হাত থেকে নিষ্কৃতি চাইছেন আর বাঘের স্বভাবটা সযত্নে নিজেদের জন্য রেখে দিচ্ছেন। নাকি, গান্ধী নিজে স্বরাজ বলতে যা বোঝেন সেটা তাঁরা মেনে নিতে রাজি আছেন? এই স্বরাজের অর্থ, ভারতীয় সভ্যতার উচ্চতর সম্ভাবনাগুলোর বিকাশ, এমন মানুষদের হাত ধরে যাঁরা নিজেরা নিজেদের পরিচালনা করতে আর সত্যাগ্রহের আদর্শে, পদ্ধতিতে যৌথ কাজের দায়িত্ব নিতে শিখেছেন।
যুদ্ধের জন্য সংগঠিত বিশ্বে ভারতের পক্ষে আর পাঁচটা রাষ্ট্রের মতো হয়ে ওঠা ছাড়া উপায় ছিল না, অন্য রকম হওয়া প্রায় অসম্ভবই ছিল। যে মানুষগুলি বিদেশী নিপীড়নের বিরুদ্ধে অহিংস সংগ্রাম পরিচালনা করছিলেন হঠাৎ একদিন তাঁরা দেখলেন হিংস্র নিপীড়নের সব সাজসরঞ্জামে সজ্জিত একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র এখন তাঁদের দখলে। একদা-কারাবন্দী এবং একদা-শান্তিকামীরা রাতারাতি কারাধ্যক্ষ আর সেনাধ্যক্ষে পরিণত হলেন, সে তাঁরা চান বা না চান।
ইতিহাসের সাক্ষ্যও তেমন কিছু আশা দেখাচ্ছিল না। স্পেনের উপনিবেশগুলোর স্বাধীন জাতি হিসেবে মুক্তিলাভের পর কী হল? নতুন শাসকরা সেনাবাহিনী তৈরি করে একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিল। ইউরোপে ম্যাজিনি আদর্শবাদী, মানবতাবাদী জাতীয়তাবাদের কথা শেখালেন। কিন্তু নিপীড়নে অবদমিতরা স্বাধীনতা পেয়ে নিজেরাই এক একটি আগ্রাসনকারী, সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠল। এর অন্যথা হওয়ার কথা ছিল না। কারণ একজন যে রেফারেন্স ফ্রেমে চিন্তা করেন তাঁর তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক সিদ্ধান্তগুলোও সেই মতোই হবে। ইউক্লিডের ধারণা মেনে নিলে ত্রিভুজের তিনটে কোণ দুই সমকোণের সমান এই সিদ্ধান্তে না পৌঁছে উপায় নেই। তেমনি নেশনের ধারণা থেকে শুরু করলে অস্ত্রসম্ভার, যুদ্ধ আর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণে পৌঁছতেই হবে।
চিন্তার মূল কাঠামো আর অনুভূতির ধরণ শিগগির পাল্টানোর নয়। নেশনের রেফারেন্স ফ্রেম থেকে বেরিয়ে নেশনের বাইরে কোন রাজনৈতিক ধারণায় আসতে সম্ভবত অনেক সময় লাগবে। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রযুক্তি এগিয়ে যাবে তার নিজের গতিতে। নেশনের ধাঁচে ভাবনার অভ্যেস এমন গেড়ে বসে আছে যে মানসিক এই জড়তা কাটিয়ে উঠতে দুটো প্রজন্ম বা এমনকি দুটো শতাব্দী লেগে যেতে পারে। ওদিকে যুদ্ধবিদ্যায় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রয়োগের কল্যাণে এই বিরাট পরিবর্তনের জন্য আমাদের হাতে সময় আছে দুটো বছর। এত অল্প সময়ের মধ্যে কাজটা করা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হয়।
গান্ধী জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন কিন্তু সব সময়ই আশা করছিলেন তার চরিত্র পালটে দিতে পারবেন। প্রথমত, হিংসার পরিবর্তে সত্যাগ্রহ অবলম্বন করে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক আর অর্থনৈতিক জীবনে বিকেন্দ্রীকরণের নীতি প্রয়োগ করে। এখনো পর্যন্ত তাঁর আশা পূরণ হয় নি। নতুন রাষ্ট্রকে অন্তত হিংস্র নিপীড়নের আয়োজনের দিক থেকে অন্য রাষ্ট্রের মতই লাগছে। তাছাড়া, তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার লক্ষ্য চূড়ান্ত শিল্পনির্ভর একটা রাষ্ট্র; ধনতান্ত্রিক বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে বড়ো বড়ো কারখানা; ক্ষমতার ক্রমাগত কেন্দ্রীকরণ; অন্যন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর মতো জীবনযাত্রার মান বাড়িয়ে তোলা; নিউরোসিস আর অন্যান্য স্নায়ুজনিত রোগে অবশ হওয়া বাড়িয়ে তোলা। গান্ধী তাঁর দেশ থেকে বিজাতীয় বাঘটাকে তাড়াতে সফল হয়েছিলেন কিন্তু জাতীয়তাবাদের আদত যে ব্যাঘ্র চরিত্র তাকে পরিবর্তনের চেষ্টা সফল হয় নি। আমাদের কি তাহলে নিরাশ হওয়া ছাড়া আর গতি নেই? আমার তা মনে হয় না। ঘটনাক্রমের তাড়না বেদনাদায়ক, তবে আমরা আশা করতে পারি তা অপ্রতিরোধ্য। আজ হোক বা কাল, আমরা বুঝতে পারবো এই স্বপ্নদর্শীর পা মাটিতেই দৃঢ়ভাবে ছিল। আদর্শবাদী এই মানুষটিই ছিলেন সবচেয়ে বাস্তববাদী। তাঁর সামাজিক আর অর্থনৈতিক ভাবনার পেছনে ছিল মানুষের চরিত্র আর বিশ্বের সাথে তার সম্পর্কের বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন। তিনি জানতেন, সামাজিক সংগঠন আর প্রযুক্তিতে মানুষের সম্মিলিত সাফল্য যাই হোক, প্রাণী হিসেবে সে মোটেই বড় নয়। সামর্থ্যও অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুবই সাধারণ। আর, অন্য দিকে তিনি জানতেন, মানুষের শারীরিক আর বুদ্ধিবৃত্তির সীমাবদ্ধতার সাথে তার আত্মিক বিকাশের অনন্ত সম্ভাবনার কোন বিরোধ নেই। গান্ধীর সমসাময়িক অনেকেই ভুল করেছিলেন ধরে নিয়ে যে প্রযুক্তি আর সামাজিক সংগঠন সাধারণ মনুষ্য প্রাণী থেকে অতিমানব তৈরি করে ফেলবে। আত্মিক উত্তরণের অসীম সম্ভাবনার কথা ওঁরা বাতিল করে দিয়েছিলেন। আত্মিক অস্তিত্বকে অস্বীকার করাটাই ছিল প্রচলিত গোঁড়ামি।
পাশবিক আর আত্মিক অস্তিত্বের সীমান্তে বসবাসকারী এই উভচর প্রাণীর জন্য কীরকম সামাজিক, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যথাযথ হবে? এই প্রশ্নে গান্ধী একটা সহজ আর ভারি যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মানুষ এমন গোষ্ঠীর মধ্যে বসবাস করবে, কাজ করবে যে গোষ্ঠীর আয়তন তার শারীরিক, মানসিক সামর্থ্যের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হবে। গোষ্ঠীর আয়তন এমন ছোট হবে যাতে সত্যিকারের স্বায়ত্তশাসন সম্ভব হয়, গোষ্ঠী পরিচালনায় প্রত্যেকে ব্যক্তিগত দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে। অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে যৌথ ভাবে বড় একটা ফেডারাল সংগঠন গড়ে তুলবে কিন্তু গোষ্ঠীগুলোর আন্তঃসম্পর্ক এমন হবে যে বড় কোন ক্ষমতা প্রলুব্ধ হবে না। গণতন্ত্র আয়তনে যত বড় হবে জনগণের শাসন সেই অনুপাতে তত কম সত্যি হবে, ব্যক্তি মানুষের বা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নিজেদের ভাগ্য নিজেরা নির্ধারণ করার সুযোগ তত কম হবে। তাছাড়া, স্নেহ, ভালোবাসা একেবারেই ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপার। তাই সেন্ট পল যে অর্থে করুণার কথা বলেন সেই করুণার প্রকাশ ছোট জনগোষ্ঠীতেই সম্ভব। বলাই বাহুল্য, গোষ্ঠীর ক্ষুদ্রায়তন তার সদস্যের মধ্যে করুণার সঞ্চারের গ্যারান্টি দেবে না; কিন্তু করুণার সম্ভাবনা অন্তত তৈরি হবে। একটা বড় গোষ্ঠীর মধ্যে সেই সম্ভাবনাটুকুও থাকে না, স্রেফ এই কারণেই যে সদস্যদের একে অন্যের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ ঘটে না। "যে ভালোবাসে নি সে ঈশ্বরকে জানতে পারে নি, কারণ ঈশ্বর নিজেই ভালোবাসা"। করুণা একই সাথে আধ্যাত্মিকতার পন্থা এবং লক্ষ্য। মানুষের নানা কর্মকান্ডকে জুড়ে যে সামাজিক সংগঠন এমনভাবে বানানো হয়েছে যাতে করুণার উন্মেষ অসম্ভব সেটা নিঃসন্দেহে একটা বাজে সংগঠন।
রাজনীতির বিকেন্দ্রীকরণের সাথে অর্থনীতিরও বিকেন্দ্রীকরণ চাই। জমি আর প্রয়োজনীয় উপকরণের মালিকানা থাকবে ব্যক্তি, পরিবার আর ছোট সমবায়ের হাতে যাতে নিজেদের প্রয়োজন আর স্থানীয় বাজারে সরবরাহের মতো উৎপাদন সম্ভব হয়। উৎপাদনের উপকরণ বলতে গান্ধী চান শুধু হাতে ব্যবহার করা যাবে এমন যন্ত্রপাতি। বিকেন্দ্রীকরণপন্থী এমন অনেকে আছেন - আমিও যেমন তাঁদের সাথে একমত - যাঁরা বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রেও আপত্তি করবেন না যদি ছোট সমবায় আর তার সদস্যের সামর্থ্যের সাথে সেটা সাযুজ্যপূর্ণ হয়। বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র উৎপাদনের জন্য অবশ্যই বড় আর বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন কারখানা প্রয়োজন হবে। ব্যক্তি আর ছোট গোষ্ঠী উৎপাদকের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতির যোগান দেওয়ার জন্য সম্ভবত সমগ্র উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশই এই রকম কারখানায় হবে। বিকেন্দ্রীকরণের সাথে যান্ত্রিক দক্ষতার যোগসাধনের স্বার্থে এটা হয়তো খুব চড়া মূল্য নয়। তবে, যন্ত্রের অত্যধিক দক্ষতা স্বাধীনতার শত্রু কারণ এর অবশ্যম্ভাবী ফল নিময়শৃঙ্খলার কড়াকড়ি, স্বতঃস্ফূর্ততার সর্বনাশ। যন্ত্রের অদক্ষতাও স্বাধীনতার শত্রু কারণ তার ফল দারিদ্র্য আর নৈরাজ্য। এই দুই চরমপন্থার মাঝখানে অবশ্য ভারসাম্যের মধ্যবিন্দু আছে যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা চড়া সামাজিক বা মানসিক মূল্য না দিয়েও আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় সুবিধে গ্রহণ করতে পারি।
এখন ভাবলে মনে হয়, পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের মহান প্রবক্তাদের পরামর্শ শোনা হলে আজ যুক্তরাষ্ট্র আটচল্লিশটা প্রদেশের না হয়ে কয়েক হাজার স্বশাসিত অঞ্চলের ফেডারেশন হতে পারতো। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জেফারসন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যতটা সম্ভব বিকেন্দ্রীকরণের জন্য তাঁর দেশবাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। "আমার সব মতামতের সাথে আমি এই কথাটা বলতে চাই, দেশকে অনেকগুলো ওয়ার্ডে ভাগ করে ফেলো”। অধ্যাপক জন ডিউয়ি বলেছেন, ওঁর উদ্দেশ্য ছিল, "ওয়ার্ডগুলোকে ছোট্ট প্রজাতন্ত্র বানিয়ে ফেলা, যেখানে একজন করে ওয়ার্ডেন থাকবেন, ... সরকারের সামরিক, অসামরিক সব কাজ স্থানীয় মানুষরা সরাসরি তত্ত্বাবধান করবেন, কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এলে সেইদিনই ওয়ার্ডের সবাইকে ডেকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পরিকল্পনাটা গৃহীত হয় নি। কিন্তু এটা জেফারসনের রাজনৈতিক দর্শনের জরুরী অঙ্গ।" এটা জেফারসনের রাজনৈতিক দর্শনের জরুরী অঙ্গ ছিল কারণ গান্ধীর মতো তাঁর দর্শনও ছিল আসলে নৈতিক আর ধর্মীয়। তাঁর দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান কারণ সবাই ঈশ্বরের সন্তান। ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে তাদের কিছু অধিকার আছে, দায়বদ্ধতা আছে। ওয়ার্ড থেকে রাজ্য হয়ে ফেডারেশন পর্যন্ত স্তরে স্তরে বিন্যস্ত স্বশাসিত একটা প্রজাতন্ত্রেই এই অধিকার আর দায়িত্বের পূর্ণ বিকাশের সুযোগ।
অধ্যাপক ডিউয়ি লিখছেন, "অন্য দিনে অন্য শব্দ আসবে। অন্য শব্দের ভেতর অন্য মত আসবে। জেফারসন যে ভাষায় তাঁর ভাবনার কথা বলেছিলেন, কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল্যায়নের জন্য যে নৈতিক মাপকাঠির কথা বলেছিলেন, স্বশাসিত প্রজাতন্ত্রকেই একমাত্র কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা বলে তাঁর যে বিশ্বাসের কথা বলেছিলেন এখন সেগুলোর চল নেই। তা সত্ত্বেও, গণতন্ত্র এখন যে আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে তার প্রতিরোধ নির্ভর করছে জেফারসন যে নৈতিক ভিত্তি আর উদ্দেশ্যের কথা বলেছিলেন তাদেরই ওপর; হয়তো গণতন্ত্রের নৈতিক আদর্শের কথা বলার জন্য আমাদের অন্য শব্দবন্ধ খোঁজ করতে হবে। বস্তগত সাফল্যের ফিরিস্তি দিয়ে বা কিছু আইনি আর রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পবিত্র জ্ঞানে পুজো করে একনায়কতন্ত্রের উত্থান কিন্তু ঠেকানো যাবে না। মানব চরিত্রের ওপর, তার বিকাশের অনন্ত সম্ভাবনার ওপর, যুক্তি আর সত্যে তার সংবেদনশীলতার ওপর বিশ্বাসই পারে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিশ্চিত প্রাচীর গড়ে তুলতে।"
জেফারসনের মতো গান্ধীও রাজনীতিকে দেখতেন নৈতিক আর ধর্মীয় মাপকাঠিতে। এই জন্যই তাঁর প্রস্তাবিত সমাধানের সাথে এই মহান আমেরিকানের প্রস্তাবের এত সাদৃশ্য। গান্ধীর ভাবনা অবশ্য জেফারসনের চেয়েও আরো এগিয়ে। যেমন, তিনি শুধু রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ নয়, অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণেরও প্রস্তাব দিচ্ছিলেন। বা, জেফারসনের 'বুনিয়াদী মিলিশিয়া সক্রিয়তা'র পরিবর্তে গান্ধীর পদ্ধতি ছিল অহিংস সত্যাগ্রহ। এর কারণ জেফারসনের তুলনায় তাঁর নৈতিকতা ছিল আরো র্যাডিক্যাল, তাঁর ধর্ম ছিল আরো গভীর বাস্তবসম্মত। জেফারসনের পরিকল্পনা গৃহীত হয় নি, গান্ধীরও না। আমাদের আর আমাদের উত্তরসূরিদের জন্য এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কি হতে পারে।