সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সময়টা ২০১৫ অথবা ২০১৬। তবে তারিখটা যে ছিল ২২শে আগস্ট, সে বিষয়ে ভুলচুক হওয়ার নয়। কারণ ঐ বিশেষ সন্ধ্যায় দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মদিন উপলক্ষে শিশির মঞ্চে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। যতখানি প্রার্থিত ছিল প্রিয়তম গায়ককে ঘিরে আলোচনায় গানে মজে ওঠা, হয়তো আগ্রহ খানিক বেশিই ছিল অসমবয়সী এক বন্ধুত্বের মুখোমুখি না-হওয়ার দূরত্ব নিরসনে। পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী অনুষ্ঠান শেষে প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে বৃষ্টিস্নাত মুক্ত চত্বরে বেরিয়ে এসে ফোন করলাম—“সমীরদা, কোথায় আপনি?” উত্তর এল—“তোমার পেছনেই তো, প্রিয়...!” আসলে তার আগে কেবলমাত্র ফেসবুক প্রোফাইলে দেখা ছবিতেই প্রাথমিক পরস্পর পরিচিতি। তাই ঠিকঠাক মুখটুকু চিনে নেওয়ার দায়টা তো ছিলই। এবং শেষমেশ ছিপছিপে চেহারা আর লেনিন-সুলভ টাক এবং দাড়ি নিয়ে তাঁর দ্রুত এগিয়ে এসে আমাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে বেঁধে নেওয়া—“তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে তোমাকে কোলে তুলে নিতাম। এখন যা চেহারা বাগিয়েছ, বরং আমাকেই কাঁধে তুলে নাও!...”
বিষয়টা আদপে এই যে, সমীরদার সঙ্গে আমার সান্নিধ্যের গোড়াকার মাধ্যম যে ফেসবুক বলয়, তা নয়। শ্যামপুকুরের রাজবল্লভ পাড়ায় থাকতেন একসময় আমার ছোটপিসির পরিবার। ঐ এলাকায় সমীরদার আঁকার স্কুলের ছাত্রী ছিল পিসতুতো দিদি। হয়তো মাঝেমধ্যে ঢুকে পড়তাম সেখানে, সেই সূত্রেই, নেহাতই বালকোচিত কৌতূহলে। তাছাড়া নিজেরা থাকতাম তখন হাতিবাগানে এবং বাবা অমলেন্দু চক্রবর্তীর পরিচিত মহলের অন্তর্ভুক্ত গোটা উত্তর কলকাতার প্রায় অধিকাংশ মানুষই। সমীর ভট্টাচার্যও তেমন গোত্রেই বিরাজমান ছিলেন, অর্থাৎ পিতৃবান্ধবও। সব মিলিয়ে তাই আমার এই পঞ্চাশোর্ধ্ব জীবনে সমীরদার কাছাকাছি আসার পর্যায় মোটামুটি দু’টো। সেই সাতের দশকের শেষ বা আটের শুরুতে, আর এই বিগত প্রায় এক দশক। মাঝে যদিও সময়ের বিস্তর ব্যবধান।
দ্বিতীয় পর্যায়ে সমীরদার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, আড্ডা সবকিছুই ঘটত গঙ্গার ধারে, কাশী মিত্র ঘাট এলাকার নানান ঠেকে। ঘাঁটিও গেড়েছিলেন যে ওখানেই। প্রাচীন সে ঘাটের পার ধরে ভাঙাচোরা পাঁচিল, আধা গলে যাওয়া কবেকার বিসর্জিত প্রতিমা, খড়ের ছইঢাকা ডিঙিনৌকো, ছড়িয়ে থাকা শবযাত্রীদের ইতিউতি আনাগোনা, লালুর চায়ের দোকানে নিত্যদিনের গেঁজিয়ে ওঠা ঠেক—সবমিলিয়ে ব্যস্ত শহরের প্রান্তে অবহেলিত গোটাগুটি এক নদী, যেন ‘আরেকটা কলকাতা’-র সেপিয়া রঙিন কোনও চলচ্ছবি। আর আমাদের মতো অনুজ বান্ধববর্গের কাছে সে দৃশ্যপটে সদাসম্পৃক্ত সমীর ভট্টাচার্য। উজ্জ্বল দু’চোখ মেলে তুলতেন অজস্র ছবি, মোবাইল ক্যামেরায়। ‘ঘাটের কথা’, ‘সেই গঙ্গার ধারেই’ ইত্যাদি বিভিন্ন শিরোনামে সে-সব ছবি পোস্ট করতেন নিজের ফেসবুক ওয়ালে। বছর আট-নয় আগে আমাকে তাঁর ঐ আলিঙ্গন আসলে জোয়ারের টানে সেই গঙ্গার ঘাটের কাছে আবারও ‘ফিরে আসার হাওয়া’-র গল্পের মতো। ছিটকে সরে যাওয়া এক প্রাচীন পর্বকে হঠাৎ-ই নতুন করে খুঁজে পাওয়া। অনেকটা সমীরদার রেখাচিত্রের মতো, যা আদপে হিজিবিজি জীবনের পৌনঃপুনিক বাতাবরণ ছড়াতে ছড়াতে শেষমেশ কোথাও যেন আবারও থিতু হওয়ার বার্তা জোগায়, ‘তোমায় আমি হারাই যদি তুমি হারাও না’-সুলভ অপার কোনও প্রত্যয়ে।
জীবনচক্রের সামগ্রিক পর্যটনে পর্ব-পর্বান্তরের বিবিধ অভিজ্ঞতায় সিঞ্চিত সমীর ভট্টাচার্য আসলে এমন এক বর্ণময় চরিত্রে বিভূষিত, যাঁকে নিয়ে আলোচনা কিম্বা স্মৃতিচারণায় আবেগবর্জিত হয়ে ওঠা বড়ই মুশকিল। বিশেষত যদি ঘটনাচক্রে নৈকট্য গাঢ় হয়ে ওঠে। তবু যেহেতু চারিত্রিক আঙ্গিকে মুখ্যত তিনি চিত্রশিল্পী, সৃজনসত্তায় মথিত নিরন্তর, সেক্ষেত্রে তাঁকে ঘিরে কিছু কথাবার্তায় শিল্পের শরীর জুড়ে জীবনের ছায়ার মাত্রা কতটুকু, তা মেপে নেওয়ার মধ্যে হয়তো নিজেকেই খানিক গুছিয়ে নিতে চাওয়ার অভীপ্সা বজায় থাকে।
শিল্পী সমীর ভট্টাচার্য, আজীবন খ্যাপাটে-বাউন্ডুলে-তার্কিক-চিরতরুণ সমীরদা—আমাদের চোখে এ-হেন তাঁর বহুমুখী সত্তা। আর এমনতরো বহুমুখীনতার প্রেক্ষিতের নাগরিক শিকড় তো মৃত্তিকার অভ্যন্তরে বহুদূর প্রোথিত হতে বাধ্য। ২০১৫-তে ‘সেদিন কথা হচ্ছিল একজনের সঙ্গে’ শীর্ষক একটি রচনায় সমীরদা নিজেই লিখেছিলেন—‘...যেহেতু একদিন ঘর থেকে শুরু করে বিশ্বের সব জায়গাকেই মুক্তাঞ্চল ভাবতে শিখেছিলাম...’, ভেবে ওঠার সেই ঝোড়ো দিনগুলোর বৈভবে সামিল ছিল আর্ত-দুর্গতদের বঞ্চনা-হাহাকার থেকে সাহেবসুবোদের আঁতলেমি-মাতলামি, এঁদো বস্তির ঘাম থেকে গগনচুম্বী অট্টালিকার ‘বিজলি পাখায় তোলে ভ্রমরের সুর’। ‘পায়ের তলায় সর্ষে’ আর ‘মাথায় অগ্নিশলাকা’ বয়ে তাই চিত্রশিল্পী হিসাবে নিজেকে উন্মুক্ত করার পন্থা হিসাবে কষ্টার্জিত কোনও অন্বেষণ নয়, বরং পাবলো পিকাসোর ডায়েরিতে লেখা সেই উদ্ধৃতি—‘আমি খুঁজি না, আমি পাই’, খানিক তেমনই যেন ছিল সমীরদার সৃজন-অনুরাগের বরাভয়! প্রগাঢ় অথচ নিভৃত কোনও জীবন আসক্তি যেখানে সদাজাগ্রত অনুঘটক, অনেকটা হেমন্তকণ্ঠে সলিল চৌধুরীর একটি চলচ্চিত্রসঙ্গীতের ভাষ্য অনুগামী—
...এ জীবন সাগরে মোর চেতনা এক দ্বীপের মতো,
রেখে যায় দুঃখ সুখের ঢেউয়ের ওঠা-পড়া কত...
......
নিশিদিন বর্ষ চলে যায় মনে হয়,
এ আমার অনন্ত প্রেম
মুহূর্তেরই মাঝেই ধরা থাক না।।
সমীরদাকে তুমুলভাবে কাছে পাওয়ার পরিধিটুকু, আমার ক্ষেত্রে, মাত্রই তাঁর জীবনের শেষ এক দশকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এবং এই কালপর্বে রাজ্য বা দেশের সার্বিক পরিস্থিতির যে ক্রমান্বয় অবনমন, দুর্নীতি তস্করবৃত্তি কিম্বা বিভেদ-রাজনীতির সার্বিক আবহে, সেখানে পারস্পরিক বাক্যালাপের বিষয় হিসাবে এই দেউলিয়া সমকাল পেরিয়ে কখনোই তা গিয়ে পৌঁছয়নি তাঁর যৌবনের দিনগুলোতে, বোধচেতনা গড়ে ওঠার অনুশীলনে। সম্প্রতি এ-বিষয়ে কথা হচ্ছিল চিকিৎসক এবং সাহিত্যকর্মী তমোনাশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে, আমার তুলনায় যিনি সমীরদার ঘনিষ্ঠ অন্তত আরও আড়াই দশক আগে থেকেই।
বুঝতে চাইছিলাম মোটামুটি যেন এ-ভাবেই—ষাট-সত্তর দশকে উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি এলাকায় বামপন্থী মতাদর্শের বড়সড় তো প্রাধান্য ছিলই। এবং সাতষট্টি-পরবর্তী নকশাল অভ্যুত্থানের আঁচে ঐ অঞ্চল ততোধিক উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল একাধারে সত্যানন্দ ভট্টাচার্য, মুকুর সর্বাধিকারী প্রমুখ তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক নেতৃবৃন্দের সমাগমে, পাশাপাশি বিভিন্ন ‘অ্যাকশান স্কোয়াড’-এর সমাজপরিবর্তনকামী সশস্ত্র রাজনীতির অনুশীলনে। সমীর ভট্টাচার্য, তাঁর প্রথম যৌবন ঐ পরিপার্শ্বেই সম্পৃক্ত। ‘বজ্রনির্ঘোষ’-এর টালমাটাল সেইসব দিনেই ছাত্র হিসাবে তাঁর ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে প্রবেশ। যেহেতু শিল্পী হিসাবে আবেগপ্রবণ সত্তায় তিনি প্রথম থেকেই জারিত, তাই অচিরেই সমকালের রাজনৈতিক বৃত্তে জড়িয়ে পড়া ছিল রীতিমতো অনিবার্য। ফলে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মানসিকতার ঝোঁক ভালোমতোই প্রোথিত হয়ে উঠেছিল মননে-দর্শনে, প্রহরবৃত্তের আলিঙ্গনে। অথচ, মজার কথা এই যে, হাড়েমজ্জায় র্যাডিক্যাল লেফটিজমের অনুসারী হয়েও চেতনায় বৈপরীত্যের ইঙ্গিত তিনি নিজেই দিয়ে গেছেন পরবর্তীকালের নানান কথাবার্তার মধ্যে, নিজেকে উন্মুক্ত করার পরিসরে। হাতের কাছেই যেমন আছে সরোজ দত্ত প্রসঙ্গে গ্রন্থ ‘মরণে মেলেনি ছুটি’, যার প্রচ্ছদে সরোজবাবুর মুখাবয়বের অসাধারণ পোর্ট্রেট সমীরদাই আঁকা। যে গ্রন্থের প্রকাশকাল ২০১৪, সরোজ দত্তের জন্মশতবর্ষে। প্যাশনটুকু সেতাবৎ বুকে বেঁধে রেখেও সেই তিনিই আবার একসময়ের প্রবল আলোচিত ‘মূর্তিভাঙার রাজনীতি’-কে যে পুরোপুরি গ্রহণ করে উঠতে দ্বিধান্বিত, তাও কোনও রাখঢাকে বুজিয়ে রাখতে চাননি কোনোদিনই। বাল্যবয়স থেকে বঙ্গীয় রেনেসাঁসকুলের পথিকৃতদের সম্পর্কে জেনেবুঝে ওঠার প্রাথমিক পাঠ, বিদ্যাসাগর-মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ প্রসঙ্গে গেঁথে যাওয়া ঐতিহ্য-অনুগামী ভাবনাচিন্তার ওজন সমান্তরালে তাঁর মগজকে ঔদার্যে ভূষিত রেখেছিল চিরকালই। নিজেই তো লিখেছেন—‘শূন্য ভেবে যাকে আমরা পরাক্রমী ‘ক্ষমতা’র হাতে ধরতে চেয়েছি এত কাল, তা যে আমাদের মহাশূন্যতায় ছুঁড়ে দেবে, তা ভুলে গিয়েছিলাম আমরা।’ আর এই ‘মহামুদ্রাদোষ’-জনিত খেদেই সমীরদার কাছে বড় প্রিয় ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের কালজয়ী সেই উক্তি—‘বাঙ্গালী আত্মবিস্তৃত জাতি।...বাঙ্গালার ইতিহাস চাই, নইলে বাঙ্গালার ভরসা নাই...।’ আপাদমস্তক শৈল্পিক মননে স্নাত তেমন মনস্তত্ত্বে তাই হয়তো ‘ডেস্ট্রাকশন উইদাউট ক্রিয়েশন’-এর জাত্যর্থ ঠিকমতো খাপ খায় না। একধরণের দোলাচল, শিল্প-সাহিত্যের দূরদর্শী রাজনীতি বনাম প্রত্যক্ষ সংগ্রামের তাৎক্ষণিক রাজনীতির মধ্যে দোটানার মানস চলাচল—এই-ই সম্ভবত হয়ে উঠেছিল সমীর ভট্টাচার্যের বাকি জীবনের অন্তরাত্মার ভবিতব্য। যে দোটানায় বিরোধিতার বুনন যতটুকু, সম্পূরক ভারসাম্যের আর্তি তার চেয়েও খানিক বেশিই।
অবশ্য ১৯৯২-এর বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত পর্ব ও তৎ-পরবর্তী হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসী উত্থান সম্ভবত সমীর ভট্টাচার্যের চিন্তাচেতনায় একধরনের বাঁক নিয়ে এসেছিল। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিহত্যার রাজনীতি সম্পর্কে মোহমুক্তি আর আসন্ন বিপদের সম্যক উপলব্ধিতে কালেক্টিভ আন্দোলনের গুরুত্ব ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলছিল তাঁর ব্যক্তিসত্তা এবং শিল্পকেও। চিত্রশিল্পী হিসাবে জীবিকান্বেষণে মাঝে পাড়ি দিয়েছিলেন বোম্বে, যদিও জমাতে পারেননি নিজেকে। ঝুঁকলেন মেধা পাটেকরের নেতৃত্বাধীন ‘নর্মদা বাঁচাও’ আন্দোলনে, নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে সামিল করে। অনুরাগী হয়ে উঠলেন জয়া মিত্রের মতো মানুষদেরও। ফলে একদিকে শিকড়াশ্রিত বামপন্থা, অন্যদিকে গান্ধিবাদী ধারার প্রতি অনুরক্তি—দু’য়ের মধ্যিখানে মানবিক হয়ে ওঠার ক্রমাগত অনুশীলন নিশ্চিতই জারি ছিল তাঁর মধ্যে। টানাপড়েন নিয়ে আজীবন জিইয়ে থাকলেও নিভৃতচর্চায় কোথাও যেন একটা থিতু হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এভাবেই অভ্যাসের অঙ্গাঙ্গী করে নিচ্ছিলেন তিনি। ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও তেমন ভাবনার প্রকোপ তো অবশ্যম্ভাবী। আর্ট ক্রিটিকের মতো তলানি থেকে ছবির সারবস্তু তুলে আনার ক্ষমতা আমার আয়ত্তে নেই। তবে যতটুকু দেখেছি সরল অবলোকনে, মনে হয়েছে বারে বারেই শিল্পী সমীর ভট্টাচার্য, তাঁর তুলি-পেন্সিল মগ্ন হয়ে ছুটে বেড়িয়েছে সামগ্রিকের মাত্রায় সমকালীন বাস্তবতার প্রতিফলনে। এবং তিনি এও জানতেন, এই সমগ্রের অভিলাষে গোচরে বা অগোচরে থেকেই যাবে অধরা কিছু মাত্রা। থাকবে নানান হোঁচট খাওয়ার গর্ত। তবুও জারি রাখা এই পর্যটন—ভেঙেচুরে, নান্দনিক থেকে বীভৎসায় উত্তরণে, লোকায়ত এবং নাগরিক বিশ্বাসের দূরত্ব মোচনে। গঙ্গার ধার ধরে ফেলে রাখা প্রতিমার অবহেলিত উলঙ্গ কাঠামোগুলোর মতো। যার মাঝে সমীর ভট্টাচার্যের রাজত্ব, মুক্ত অক্সিজেনের বিস্তার।
এঁকেছেন অজস্র ছবি খেয়ালে বেখেয়ালে। শেষের দিকের বছরগুলোয় নিয়মিত সে-সব তুলেও ধরতেন সমীরদা, ফেসবুকের আঙিনায়। আগেই বলেছি, ছবির নিগূঢ় অর্থ উপলব্ধির ক্ষমতা আমার সীমিত। তবু তারই মাঝে বিশেষত চোখ টানত আত্মপ্রতিকৃতিগুলো। বহু বছর আগে অপরিণত মননে যখন প্রথম দেখেছিলাম ১৯৩৪-এ আঁকা রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত সেল্ফ-পোর্ট্রেট, চুল আর দাড়ির প্রান্তিক রেখাগুলো বাদে অবশিষ্ট মুখাবয়ব ঘন ঘন হিজিবিজি দাগে প্রায়ান্ধকার, ভাবতাম এ কেমনতরো আক্রোশ নিজের ওপর! পরবর্তীতে অবশ্য নিজের মতো করে একধরনের ব্যাখ্যায় নিজেকেই সন্তুষ্ট করেছি—সর্বনাশা ফ্যাসিজমের স্বরূপ অনুধাবনে এক সত্তা যখন ‘সভ্যতার সংকট’ লেখায় প্রস্তুত হচ্ছেন, সমকালের সেই করাল ছায়ায় তিনিই আবৃত করছেন নিজেকেই। আসলে প্রতিকৃতি সেখানে শুধুই আত্ম নয়, বরং সময়কে শুষে নেওয়ার কোনও নির্ভরযোগ্য আধার। সমভাবনার অনুসরণে সমীর ভট্টাচার্যের সেল্ফ-পোর্ট্রেটগুলোও আমাকে নিশ্চিতই ভাবিয়েছে। ভাবিয়েছে, কারণ মানুষটাকে সময়বিচ্ছিন্ন হতে দেখিনি কখনোই, অন্তত নিজের অভিজ্ঞতায়। সৃজনবোধে ক্রমাগত নিরীক্ষক, সময়ের ছেঁড়া সুতোগুলো আঁতিপাঁতি খুঁজে বেড়ানোর বিবিধ ভঙ্গিমা—হিরণ মিত্রের ভাষায় যেখানে রেখারা কলকলিয়ে উঠে নিজেকেই বিদ্ধ করে নিজেরই হননে—কখনও বক্র শিরদাঁড়ায় ঝুঁকে, চিৎপটাং হয়ে, কখনও বা ঘাড় উঁচিয়ে উঁকি মেরে, কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে, বিস্ফারিত অক্ষিগোলকে, রুধির প্রেক্ষিতে নিজেকে কোণঠাসা করে তুলে, চশমায় ঝাপসার আস্তরণে, এমনকী হায়নার দাঁতের সামনে ঝোলানো নরমুণ্ডে—নিজেকে কেটেকুটে ভেঙে টুকরোগুলো দুর্ভার কালপ্রহরে মিশিয়ে দেওয়ার আর্তি। খানিক জীবনানন্দীয় ভঙ্গিমায়, যিনি নিজেকে খুঁড়ে ‘বেদনা জাগাতে’ ভালোবাসেন। অথবা নিজেকেই যেন তর্জনী উঁচিয়ে সমঝে দেওয়া নিজ-অস্তিত্বের জাগতিক মর্ম, নিশীথ ভড়ের কবিতার ভাষায়—
ভাঙো, ভেঙে যাও তুমি, টুকরো টুকরো টুকরো হয়ে যাও
বাদাম খোসার মতো, আমি তারপর মেনে নেব
তোমার কাঙাল মুখ...
......
প্রেম ও প্রণাম যত দিয়েছিলে, সযত্নে কুড়োব।
ছবি আঁকার পাশাপাশি একসময় লিখেছেনও প্রচুর, বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং কবিতাও। কিছু কিছু তেমন পুরনো লেখাপত্র পড়েছি, ফেসবুকের পাতায়, সমীরদার আনুকূল্যেই। যদিও অধিকাংশেরই নাগাল পাইনি। আসলে নিজেকে মেলে ধরার আর্তি তাঁর স্বভাবজাত, তাই মুখ্যত ছবি আঁকার মধ্যে তেমন আশ্রয় খুঁজে নিলেও অন্যান্য বিকল্প মাধ্যমগুলোও মাঝেমধ্যে পরখ করে নেওয়ার একধরনের আলগা অনুরাগ তাঁর জারি ছিল। ২০২১-এ দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে যখন কণ্ঠস্বর দ্রুত রুদ্ধ হয়ে আসছিল, লেখালেখির এই অভ্যাস যেন আরও বেড়ে উঠছিল। গতবছর, অর্থাৎ ২০২৩-এ লিখতে শুরু করেছিলেন ধারাবাহিকভাবে ‘সঙ্গ নিঃসঙ্গতার কথা’। লিখছেন—‘সঙ্গ বলতে আমি নিজেই নিজের একটা সঙ্গ। নিঃসঙ্গতা বলতেও তাই। কারণ আমি অরব।’ লিখছিলেন কমিউনিকেট করার স্বর হারিয়ে ‘ছবি যাপন’-এ বাক্যালাপের পক্ষান্তর। যদিও খেয়ালদোষেই সে লেখাও সম্পূর্ণ করেননি। তবু নির্বাক একজন মানুষ কী ভাবতে পারেন বা ভাবতে পারেন না, উপলব্ধি-অনুভূতির যাবতীয় সেই স্তরকে নিঃশব্দ রেখার আঁচড়ে বিছিয়ে দেওয়ার কিছু ইঙ্গিত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সে-সব বাক্যবন্ধে। রোগভোগের চূড়ান্ত পরিণতিকে অনিবার্য মেনেই নিজেকে নিয়ে রসিকতাতেও খামতি ছিল না—‘আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবার আর দরকার নেই! কবে আছি কবে নেই বলতে পারছি না!’ কিম্বা ‘আমার তো দেশ বিদেশে ঘোরার ক্ষমতা নেই, মাঝে মাঝেই মেডিক্যাল কলেজেই ঢুকে পড়ি…’। যেন আবারও ফিরে ফিরে আসা আত্মপ্রতিকৃতিরই বিক্ষিপ্ত কিছু শাব্দিক ক্যানভাস। পার্থক্য একটাই—আত্মকে দিগন্তে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিবর্তে এবার পারিপার্শ্বিক পরিধিকে আত্মকেন্দ্রে গুটিয়ে নিয়ে আসার প্রাণপণ অভিপ্রায়।
হয়তো এই সব ‘সঙ্গ নিঃসঙ্গতার কথা’-র বুননগুলো গড়ে ওঠার পেছনে আমরাও, যাদের সমীরদা ভালোবাসতেন অকৃপণ, তারাও খানিক অনুঘটক। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ মারফৎ দেখা করার প্রবল আকুতি তাঁর, আর আমাদের শুধুই কাজের দোহাই! সমীরদার অন্তিমপর্বের ইচ্ছেকে সেভাবে মান্যতাই দিতে পারিনি। বরং ২০২৩-এ যখন অবশেষে ‘অবনীন্দ্র পুরস্কার’-এর মতো সরকারি সম্মান পেলেন, পুরস্কার গ্রহণের ছবিগুলো দেখতে দেখতে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় মনে হচ্ছিল—এ রাজ্যে ক্ষমতার দাক্ষিণ্যে করেকম্মে খাওয়া ঐ ‘ভিআইপি’ সমাগমের মঞ্চে আজীবন আপোষহীন সমীরদাকে ঠিক মানাচ্ছে না। কিন্তু পরে অনুভব করেছি, এভাবে বিষয়টা দেখার অধিকারই আমাদের নেই। কারণ, তাঁর নিঃসঙ্গতা মোচনে অথবা চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনে আমাদের তরফে উদ্যোগ আদৌ কি কিছু ছিল? মৃত্যুর বছরখানেক আগে এই প্রাপ্তি শুধু সম্মানের নিরিখেই নয়, সেই মুহূর্তে পুরস্কারের অর্থমূল্যটুকুও যথেষ্টই জরুরি ছিল তাঁর নিজের জন্য, নিজেকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই। সামাজিক প্রতিষ্ঠার বৃত্তের বাইরে সৃজনের নিভৃত চয়নে বেঁচে থাকা এই ধরনের মানুষেরা হয়তো সমকালের চোখে আংশিক অবহেলিতই থেকে যান। একেবারে অন্তিমেপর্বে গৃহীত এই স্বীকৃতির ওপর তাই কোনও মালিন্যের আঁচড় দাগিয়ে দেওয়া কেবল অসংগতই নয়, অন্যায্যও।
কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়েছিল কিছু বছর আগেই। গত ১৮ই জুলাই গোটাগুটিই নিথর হয়ে গেলেন সমীর ভট্টাচার্য। কয়েকদিন পর থেকে প্রায় গোটা আগস্ট মাসই উত্তাল হয়ে উঠল শহর কলকাতায়, গোটা রাজ্যে—একটি মারাত্মক অমানবিক হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ন্যায়বিচারের দাবিতে নাগরিক প্রতিবাদ-আন্দোলনের অভূতপূর্ব উত্থান, আর অন্যদিকে নানান প্রাতিষ্ঠানিক ফিকিরে সত্যকে বুজিয়ে রাখার অপচেষ্টা! মাত্রই কয়েকদিন যদি আয়ু বেড়ে যেত, নিশ্চিতই সমীরদা অশক্ত শরীরেও পথে নামতে চাইতেন, মানুষের মিছিলে পা মেলাতে। এখনও যারা, বুদ্ধিজীবী অথবা প্রসাদজীবী, এই চরম দুর্দিনেও খোলসে গুটিয়ে থাকা শামুক, ঐ সেল্ফ-পোর্ট্রেটের ভঙ্গিমায় বক্র গ্রীবায় উঁকিঝুঁকিতে খুঁজে টেনে বের করে আনতেন তাদের। স্বভাবসিদ্ধ ঠোঁটচাপা হাসিতে নিক্ষেপ করতেন বিদ্রুপ-বাণ, বহুদিন আগে লেখা নিজেরই কবিতার ভাষায়—
আমাদের কেউ কেউ তখন
বিপ্লবে
লং মার্চ
শ্রীমান ঋত্বিক কুমার ঘটক ও
ব্যস্ত নায়ক
রামকিঙ্কর
আমাদের কেউ কেউ এখন
উন্নয়নে
লং মার্চ
হাসছেন তাঁরা
গোধূলি গগনে মেঘে
ঢেকেছিল তারা…