সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমীর, সমীর ভট্টাচার্য কতদিনের চেনা এখন আর সেভাবে মনে করতে পারি না । ওর নামটাই শুনেছিলাম প্রথমে। শিয়ালদহ স্টেশন দিয়ে সেই সময় আমার ছিল নিত্য যাত্রা। শিয়ালদহ প্লাটফর্মে গাড়িটা ঢোকার একটু আগে চোখে পড়ত ডান দিকের একটা পাঁচিল বরাবর নকশালবাড়ি আন্দোলনের সমর্থনে এক দেওয়াল-লেখ। চোখ পড়লেই অবাক হতাম। কোনদিন দেখতাম বর্ণের গড়ন, কোনদিন অবাক হতাম অক্ষরের বিন্যাস-শৈলী দেখে, কোনদিন-বা রেখার দ্রুতি খেয়াল করে। এমনকি এও ভাবতাম কতটা সময় নিয়েছেন আর্টিস্ট এই গোটা শ্লোগানটি দেওয়ালে লিখতে, পুলিশের নজর এড়িয়ে। এমনই সব। আসলে তখন শ্লোগানে শ্বাসের দ্রুত ওঠাপড়া ছিল অনেকটাই স্তিমিত। সময় ছিল, সময় নিয়ে নিজেদের শ্লোগান আবার ফিরে দেখার। খোঁজ নিয়ে জানলাম শ্লোগান-লিখন, সমীর, সমীর ভট্চাজের।
দেখলামও একদিন। খুব সম্ভব সাতের দশকের একেবারে শেষের দিকে। ইউনিভার্সিটি ল’কলেজের বারান্দা দিয়ে ব্যস্ত সমীর দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে, মুহূর্তেই অদৃশ্য। ছোটখাটো চেহারার সমীরের এটাই চলার ধরন, এই সেদিন অব্দি, অসুস্থ হওয়ার আগে। তফাতের মধ্যে ইদানিং কাঁধে উঠেছিল ছোট আকারের সাইড ব্যাগ, লেদার কিংবা সিনথেটিকের, কাপড়ের নয়।
আমাকে চিনিয়েছিল ল‘কলেজের পরিচিত এক ছাত্র। সে ছিল সমীরে মুগ্ধ। সমীরকে খুব শ্রদ্ধা কর’ত। নকশালবাড়ির রাজনীতি তখন বহু বিভক্ত। সংগঠনও বহু। এমনই একটি অংশের সঙ্গে সমীরের যোগ ছিল সাংগঠনিক। ও ওই কলেজে ছাত্রদের মধ্যে রাজনীতি প্রচার করত নিজেকে অপ্রকাশ্য রেখে। তবে নাকি, বেশি কথা হ‘ত সাহিত্য, সিনেমা, ছবি-আঁকা, রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে। বিপ্লবী উদ্দীপনায় সেলুলয়েডের ফিতায় আইজেনস্টাইনের ব্যাটলশিপ পটেমকিন বা চার্লি চ্যাপলিনের দি গোল্ড রাশ, দ্য গ্রেট ডিকটেটর বা ভিত্তোরিওর বাইসাইকেল থিভস বা কুরোসাওয়ার রশোমন সবই ছিল তার আলোচনার বিষয়বস্তু। বাদ যেত না সত্যজিতের পথের পাঁচালী বা ঋত্বিকের অযান্ত্রিক বা মেঘে ঢাকা তারা।
চিত্রশিল্পী সম্পর্কে কৌতূহলের উত্তরে পরিচিত ছাত্রটি জানিয়েছিল, সমীরদার প্রিয় চিত্রশিল্পী, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ। প্রতিকৃতি, ল্যান্ডস্কেপ, সূর্যমুখী ফুল বা গমের ক্ষেত অমন করে আর কেউ নাকি দেখেননি। অবশ্য তারা পাবলো পিকাসোর গ্যোয়ের্নিকা ছবিটির কথাও শুনেছে স্পেনের গৃহযুদ্ধের প্রক্ষিতে। বিবরণ শুনেছে পল সেজান, পল গোঁগা, হেনরি মাতিসদের আঁকা ছবিরও। শুনেছে জয়নুল আবেদিন, সোমনাথ হোড়, রামকিঙ্কর বেইজ, অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ এবং সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা।
সমীরের সঙ্গে সামনাসামনি আলাপ খুব সম্ভব কলেজ স্ট্রিট বাজারের ভেতরের বসন্ত কেবিনে। শিল্পী গণেশ পাইন তখন বসন্ত কেবিনেই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। ওই টেবিলেই মাঝে মাঝে সমীর আসত। সময়টা আটের দশকের মাঝামাঝি। কালধ্বনি পত্রিকার প্রথম সংখ্যা সবে বের হয়েছে, পত্রিকার কাজ চালানোর জন্যে একটা অফিস-ঘরও পাওয়া গেছে শুকিয়া স্ট্রিট এলাকায় আশুতোষ শীল লেনে, প্রস্তুতি চলছে শিল্প সাহিত্য সম্পর্কিত আর একটি পত্রিকা বের করার।
নতুন পত্রিকার নাম দিয়েছিল, সন্দীপন, সন্দীপন ভট্টাচার্য। ‘পট’। জানতাম না, কয়েক বছর আগে, ‘পট’ বের করত আর্টিস্টদেরই একটা প্রুপ, ‘পেইন্টার্স ইউনিটি’। সম্পাদক ছিল সমীরই। সন্দীপনও ছিল। ১৯৮২ সালে বের হওয়া পত্রিকাটি দু’টো সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পরই নিজেদের মধ্যে মতবিরোধে বন্ধ হয়ে যায়। ‘পেইন্টার্স ইউনিটি’র ‘পট’ ছিল সরকারি দফতরে অনথিভুক্ত একটি পত্রিকা, এবার সন্দীপন নিজের নামেই নথিভুক্ত করে নিল ‘পট’।
সমীরের ব্যস্ত জগত পত্রিকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ‘পেইন্টার্স ইউনিটি’ তখন তাদের আঁকা ছবি রাস্তায় রাস্তায় পার্কে পার্কে প্রদর্শন কর’ত। সমীর সেখানে।
সমীরের কলেজ, লেনিন সরণির, ইন্ডিয়ান কলেজ অফ আর্টস এন্ড ড্রাফ্টসম্যানশিপ। কলেজ বিল্ডিংয়ের তখন ভগ্নদশা। মূলত, কলেজ সংস্কার ও সরকার কর্তৃক কলেজ অধিগ্রহণের দাবি নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে থেকে গড়ে তোলা হ’ল স্টিয়ারিং কমিটি। অন্যতম মূল কাণ্ডারী সমীর। ছাত্রদের দাবির সমর্থনে, কলেজে আয়োজিত সেমিনারে উপস্থিত হয়েছিলেন মীরা মুখোপাধ্যায়, পরিতোষ সেন, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, বিকাশ ভট্টাচার্য, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, ভিক্টর ব্যানার্জি ও আরো অনেকে। ছাত্রদের আন্দোলনের একটা পর্যায়ে কলেজ স্থানান্তরিত হয় দমদম সুরের মাঠে। সমীরদের ধারণা ছিল এই স্থানান্তর অস্থায়ী। লেনিন সরণির বিল্ডিং সারানো হলে কলেজে আবার সেখানেই চলে যাবে। রাজ্য সরকার আর এসএফআই-এর সঙ্গে যুক্ত ছাত্ররা চাইলো দমদমে স্থায়ীভাবে কলেজে স্থানান্তর করা হোক। সেটাই হ‘ল। আন্দোলনে সমীর ও ওর বন্ধুরা কার্যত একঘরে হয়ে গেল। এবং সমীর আর তার এক বন্ধুকে কলেজের শেষ পরীক্ষায় বসতেই দেওয়া হ‘ল না।
সত্যি সত্যি সমীরকে নিয়ে, সমীর ভট্টাচার্যকে নিয়ে ভাবতে বসে এই সব কথাই বেশি বেশি করে মনে পড়ছে। আসলে সমীরকে কোন সময়ই আমি একা ভাবতে পারিনা । সমীর মানে একত্রে বেশকিছু মানুষ অনেকটা সামাজিক কাজে ব্যস্ত থাকা। ইষৎ টেনসড্। সে ছবি আঁকা হোক অথবা বন্দী মুক্তি আন্দোলন, সাহিত্যসভা বা বন্যাত্রাণ। সর্বত্র একই উদ্যম নিয়ে হাজির সমীর।
সমীর তো হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষা দেওয়ার পর বছর পাঁচেক নিজের কেরিয়ার শিকেয় তুলে বেরিয়ে পড়েছিল মাঠ ঘাট রাস্তায়। ডাক শুনেছিল সত্তরের নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলনের। ডাক শুনেছিল পৌষের। পরানে ছড়ায় আবীর গুলাল। ওর চারদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা। চলার ছন্দে পথ চলা। ভালোবেসে পথ চলা। রবীন্দ্রনাথ যে ওর ভালোবাসা। রবীন্দ্রনাথ ওর অন্তরে। রবীন্দ্রনাথের গান, সমীর গাই’তও ভারি সুন্দর।
মনে পড়ে যায় একটা দিনের কথা। সে এক শীতের সকাল। সকাল নয় ভোর। ঘুমের রেশ কাটেনি তখনও। দূরের পাহাড়ি পথ ধরে অবিকল বাংলার চেনা সুরে ঢোলবাদ্যি বাজিয়ে নদীমুখী বহু মানুষ। অস্পষ্ট থেকে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে তাদের আগমনবার্তা। সমীর প্রবীর আর বাবুলের সঙ্গে আমি সেই দিন ছিলাম নর্মদারই তীরে এক কুটিরে।
অনেকটা নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নর্মদা। সে নদী সেখানে ধীরগামিনী। সর্দার সরোবর বাঁধে, বাঁধা হবে সে নদী। নর্মদায় বাঁধের বিরুদ্ধে সোচ্চার এই জনপদ। কেননা সর্দার সরোবর বাঁধ হলে ডুবে যাবে এই জমি, এই কুটির, এই সমৃদ্ধ জনপদ।
উচ্ছেদ হবে হাজারে হাজারে মানুষ, গৃহপালিত প্রাণী। জলের তলায় তলিয়ে যাবে বনজঙ্গল, আবাদভূমি। তারই প্রতিবাদে সারা ভারত থেকে বহু মানুষ জড়ো হয়েছেন এই নর্মদা কূলে। ডাক পাঠিয়েছে নর্মদা বাঁচাও কমিটি, মেধা পাটেকার। সামিল আমরাও। অনেকটা জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে সভাস্থল। সভাস্থল, রান্না ও স্নানের জায়গায় নর্মদা থেকে জল তুলে বড় বড় পাত্রে ভরছিলেন গ্রামের মহিলারা। হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে কয়েকজন মহিলা এগিয়ে দিচ্ছিলেন জলভরা বালতি। মেধাও সে দলে। এক হাত থেকে অন্য হাতে উঠে আসছে জল নদী থেকে তীরে। সমীর আর বাবুলও নেমে গেল জলে।
গান ধরলো,
আগুনের পরশ-মণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পূণ্য করো দহন-দানে।
সবিস্ময়ে খেয়াল করি, বাবুলে সমীরে সুর মিলিয়েছেন সবাই, সব্বাই, জল তোলাও চলছে একই ছন্দে। সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি-। কখন যেন সমীর নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে। সে আন্দোলন অবশ্য সর্দার সরোবর বাঁধ হওয়া আটকাতে পারেনি। আইনী পথে এগিয়ে উচ্ছেদ হওয়া মানুষজনের কিছুটা সুরাহা হলেও, কালক্রমে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের সঙ্গে সমীর যুক্ত হয়েছিল খুব সম্ভব ১৯৯৯ সালে।
১৯৯৬ সালে ও গিয়েছিল মুম্বাই। সেখানে ওর পেইন্টিং যথেষ্ট প্রশংসা পেয়েছিল। ভাল মূল্যেই বিক্রি হয়েছিল। কলকাতায়ও ১৯৮৮ থেকে ওর ছবির অনেকগুলো এক্সিবিশনও হয়েছে। অকাদেমি অফ ফাইন আর্টস, বিড়লা অকাদেমি, জিসি লাহা গ্যালারি থেকে বিক্রিও হয়েছে খুব একটা কম নয়। তা সত্ত্বেও সমীরের ছবি তেমনভাবে আলোচিত নয়।
সেভাবে আলোচিত নয় সমীরের কবিতাও। অথচ সমীরের বহু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে চারুকলা সম্পর্কিত একাধিক প্রবন্ধ। অবশ্য সবই অপ্রাতিষ্ঠানিক অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায়। একমাত্র কবিতার বই, ‘জললিপি’ প্রকাশিত হয়েছিল কালধ্বনি পত্রিকা থেকে। ১৯৯৯ সাল থেকে আজ অব্দি কালধ্বনি পত্রিকার গোটা তিন চার সংখ্যা বাদে সব সংখ্যার ও কালধ্বনি প্রকাশনার বেশিরভাগ বইয়ের প্রচ্ছদ সমীরের আঁকা। অলঙ্করণও সমীরের।
একনাগাড়ে এতবছর সমীর অন্য কোনো সংগঠনে যুক্ত থাকেনি। কালধ্বনির সঙ্গে ওর কোনো বিরোধিতা হয়নি বা ছিল না, তা নয়। এখানে সে ছিল স্বচ্ছন্দ। সমস্যা ছিল একটা। ও যে মূলত ছবি-আঁকিয়ে। ছবি নিয়ে চর্চা এখানে অনিয়মিত। সেই চর্চার তাগিদেই বা ওর আঁকা ছবি অনেককে দেখানোর তাগিদ থেকেই সম্ভবত ২০১৪ সাল নাগাদ ফেসবুকে নবারুণ ভট্টাচার্যের একটা পোর্টেট পোস্ট করে। তার পর থেকে ফেসবুকে সমীরের উপস্থিতি নিয়মিত।
অনেক অনেক বন্ধু। অজস্র ‘লাইক’ আর ‘কমেন্ট’। স্কেচধর্মী ছবি আর পেইন্টিং শুধু নয়, পোস্ট করতে থাকে ‘ফোটোগ্রাফ’। ফুটে ওঠে ওর দেখার চোখ। মোবাইল-ক্যামেরায় যে অমন ছবি তোলা যায়, বিশেষত গঙ্গা নিয়ে, প্রায় অবিশ্বাস্য। প্রশংসার বন্যা।
আর এই বন্যায় অন্য কোথা থেকে পলি এসে জমা হয় না ওর নিজস্ব আবাদ-ভূমে। বরং আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন ফেসবুক-চর্চায় ওর পেইন্টিং-চর্চা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এখানে চিত্তপ্রসাদ, রামকিঙ্কর, নিখিল বিশ্বাস আর পাশ্চাত্যের ভ্যান গঘ, কেথে কোলউইজ, গোইয়া, রেমব্র্যান্টের নিশ্চিত ছায়ায় আলো-আঁধারির বর্তমান বিশ্বকে রঙ-তুলিতে প্রতিবিম্বিত করার খোঁজ হারিয়েছিল বেশ কিছুটা। দিনান্তে ছায়া বড় হয়েছিল।
ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে এক দিনের আলো থাকতে থাকতেই সমীর ভট্টাচার্যকে ঢেকে নিল।
… … …আমারে ফিরায়ে লহো
সেই সর্ব-মাঝে যেথা হতে অহরহ
অঙ্কুরিছে মুকুলিছে মু়ঞ্জরিছে প্রাণ
শতেক সহস্র রূপে, গুঞ্জরিছে গান
(সুনন্দ কুমার সান্যাল কর্তৃক পরিকল্পিত ও সম্পাদিত, ‘সমীর’ নামাঙ্কিত বইয়ে এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল কিছুকাল আগে, সমীর তখন চিকিৎসাধীন। একেবারে শেযের দিকের দুটি লাইন ছাড়া সেই লেখাটিই এখানে আবার প্রকাশ করা হ’ল। কৃতজ্ঞতা জানাই পূর্ববর্তী প্রকাশককে।)