সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
আমি তো বরাবরের গাধাই ছিলাম। আর গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করবার দায় মাস্টারমশাই হিসেবে সমীরদা কোনোদিন নেননি। কিন্তু বনবন করে আমরাউত্তর কলকাতা ঘুরেছি। হঠাৎ হঠাৎ এক একটা লোককে দেখে সমীরদা বলে উঠছেন ‘ওই দেখো চলে যাচ্ছে বাংলার জলজ্যান্ত ইতিহাস’ তারপর সমীরদা তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। এই অব্দি। এর থেকে বেশি আর কিছু না। সমীরদার
চলে যাওয়াটা আমি এখনো বসে ডিকোড করার চেষ্টা করছি। বুঝতে পারছি না।
কোন এক সময়ে মানুষ চলে যায়। কোনো এক সময়ে মানুষ হেসে ওঠে, কোনো
একসময়ে মানুষ কেঁদে ফেলে। সমীরদার সম্ভবত সবকটা অবস্থাই আমি কিছু কিছু
করে দেখেছি। সেসব আমার মতো করে ডিকোড করেছি। কিন্তু চলে যাওয়াটা ডিকোড
করতে সময় লাগছে। হয়তো পেরে যাব কোনো একদিন। কোনো এক আহিরীটোলার বিকেলে।
অনেক বছর আগে একদিন তখন আমি কলেজে পড়ছি আমার হল ছবি আঁকার ইচ্ছে। ছবি আঁকতাম বরাবরই কিন্তু শিখতে চাই আরো। কে শেখাবেন? পরিচিতজনেদের থেকে খবর পেয়ে উপস্থিত হলাম সমীরদার সিঁথির মোড়ের স্টুডিওতে। দেখলাম একটা গোল চোখের লোক ছাত্র ছাত্রী
পরিবৃত হয়ে বসে রয়েছেন। আর চলছে দুপুরের রান্না। কারোর খাওয়া হয়নি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন…’খাবে তো?’ বললাম ‘না’…বলেলেন…বোসো। সেই শুরু। বাইরে অঝোরধারায়
বৃষ্টি চলছে। পুরো বিটি রোডে ধোঁয়াশা। তার মধ্যে রংতুলির গন্ধের মধ্যে আমারা কজন ছবি আঁকার পাঠ নিচ্ছি সমীরদার কাছে। তারপর যত দিন গেছে তত বুঝেছি সমীরদা মানুষটা আত্মমগ্ন ও খুব স্থির নন। কিন্তু ওঁর কথায়, ওঁর অনর্গল অভিনিবেশে যা পেয়েছি তার তুলনা নেই।
লাঙে পড়ল মাছি
বললাম ‘বিড়ি দিন’। সমীরদা অবাক। ‘আরে তোমার লাঙে প্যাচ ধরা পড়েছে না?’ ‘আরে দিন তো!’ দিলেন। শ্যামবাজারের আশেপাশের কোনো একটা গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সমীরদার বিশেষ ব্র্যান্ডের বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে বললাম ‘গেছি এপেন্ডিক্স অপারেশান করাতে, সেখানে চেস্ট এক্সরে করাবার কি দরকার? তাও করে বাবার হাতে দেবার কি দরকার?’ সমীরদা অবাক দাঁড়িয়ে পড়েছেন ‘আরে!’ ‘আরে মানে? আমার লাঙের বিড়ি দরকার কি দরকার নেই সেটা আপনি ঠিক করে দেবেন? আপনি তো নিজের দেওয়া শিক্ষাই নিজে ফলো করছেন না সমীরদা?’ ‘বেশি বাড়াবাড়ি কোরোনা অর্ঘ্য, মনে রাখবে তোমার বাবা কিন্তু আমার ওপর তোমার ভার দিয়ে গেছেন!!’ আমি হাঁ করে দোর্দণ্ডপ্রতাপ সমীর ভট্টাচার্যকে দেখছি। হয়তো মুচকি হাসছিও। বললেন ‘ছাড়তে না পারো তো কম খাবে। দিনে দুটোর বেশি না’ লোকটা কাত ছিল ভালবাসার কাছে। আর ঝুঁকেছিল রবীন্দ্রনাথের দিকে। আর বঙ্কিমের দিকে। আর নবারুণের দিকে। আর মানিকের দিকে। আর দস্তভস্কির দিকে। আর পিকাসোর দিকে। গঘের দিকে। দেব্ব্রত বিশ্বাসের দিকে। আরো কত কত দিকে…আর কিছুটা আহিরিটোলার দিকেও। অনেকটা বিকেল ধার করেছি ওঁর কাছে আমি। শোধ দেওয়া হল না। একেকদিন আমরা বাগবাজার, আহিরীটোলা এই চত্বরে কাক স্টাডি করতাম। কোন কাক তেঁদরামো করছে, কোন কাক খুব ভদ্রসভ্য, কোন কাক বেশ সংসারী টাইপ এসব আমরা খুঁজে বের করেছিলাম। এবং ভাটার পর নদীর ঢাল খালি হয়ে গেলে, কাকেদের একটা মিটিং বসে ঠিক বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। সেটাও গবেষণার বিষয় ছিল আমাদের। পরের বার গিয়ে সব কাকের আলাদা আলাদা করে খোঁজখবরও নিয়েছি আমরা। ঘাটের কাছে একটা দুরন্ত লিট্টী পাওয়া যেত। লিট্টি সাঁটিয়ে ভাল চায়ের খোঁজে বেরোতাম। দেখতাম সদ্য নামা সন্ধে কলকাতার দিকে কিছুটা খয়েরি, আর হাওড়ার দিকে কমলা। মাথায় ঘুরছে ভ্যান গঘের গল্প। আর ঠ্যালাওয়ালা দেখলে মনে হচ্ছে বেস্ট কম্পজিশান কোনটা হবে… ঠিক তখনই সন্ধ্যে নামে। হাওড়ার দিকের আলোগুলো জ্বলে ওঠে, নদীর জলে পড়েছে তার ঝলমলানি। আর চেঁচিয়ে উঠি ‘সমীরদা ডাচ পেন্টিং!!!’…বলেন ’হু!’
দূর গগন কে ছাও মে!
একবার বললেন ‘চলো সুইজারল্যান্ড যাবে?’ আমি ভুরু কুঁচকে…’আরে চলোই না’ বলে উঠে পড়লেন একটা বাসে । বগলে একটা ছবি। আমিও উঠলাম। সেই ভাঙ্গাচোরা বাস গোঁ গোঁ আমাদের নামিয়ে দিল প্রায় সুইজারল্যান্ডের দোরগোড়ায়। দু পা হেঁটে সুইজারল্যান্ডের বর্ডার।‘ বললাম ‘এবার পাসপোর্ট ভিসা দেখান’। ‘আরে ধুর’। পাসপোর্ট ভিসা দুটোই সমীর ভটচাজ!’ গেটে সিকিউরিটিকে একটা নাম বললেন, তারপর বললেন ‘বলুন সমীর এসেছে’। দুমিনিট পরে খুলে গেল দরজা, একটা লিফট, একটা করিডোর। ঢুকলাম একটা বিরাট কেবিনে। একদিকে দেওয়াল জুড়ে কাঁচ। দূরে দূরে বাড়ি লোকালয়, শহর। সুন্দর ঝকঝকে যেন ইউরোপের মত আলো হয়েছে বিকেলের। দারুণ লাগছে। আমি তো মোহিত। দেখি বসে আছেন সঞ্জয়দা। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। বিখ্যাত মাস্টারমশাই। রূপকলা কেন্দ্রের তৎকালীন ডিরেক্টর। বললেন ‘সমীর? এসো! এটি কে?’ বললেন ‘আমার ছাত্র!’ যাইহোক, সেই ছবিটা দিলেন, অনেক কথা বললেন, সব আমার মাথার ওপর দিয়ে গেল। রাস্তায় বেরিয়ে সমীরদা বললেন। ‘দেখলে? সুইজারল্যান্ড’?’ বললাম ‘হু!’ সমীরদার মুখে বিজয়ীর হাসি। বললেন ‘চলো চা খাওয়া যাক!’
মধুসূদন মাই লাভ
লোকটা টই টই করে ঘুরত। হই হই করে মদ খেত। আমাকে বগলদাবা করে একদিন ঢুকলেন এক কুখ্যাত জায়গার বস্তির ভেতর এক বাংলার ঠেকে। ছোট্ট জায়গা। একটা মাচা। বসলেন, বসতে বললেন তারপর কাঁচা ছোলা আর বাংলা। আমার তখনও ওনার সমানে গজিয়ে ওঠার সময় হয়নি। তাই চুপ করে বসে আছি। দেখছি। একটা হলুদ বাল্বের আলো জ্বলছে। মাটিতে বসে দু একজন বিটনুন দিয়ে বাংলা খাচ্ছেন। তাদের ঘোলাটে চোখ। তো এইভাবে চলল কিছুক্ষণ, এটা ওটা কথা, ছবি, কবিতা ইত্যাদি কিন্তু মধুসূদন দত্তর কথা উঠতেই গেল ঝপ করে আবহাওয়া গেল বদলে। সমীরদা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। কিছুটা নেশার চোখ, কিছুটা প্রেমের চোখ নিয়ে হঠাৎ কাঁদতে আরম্ভ করলেন তারপর শুরু করলেন মেঘনাদ বদ কাব্য। পুরোটা। মুখস্থ। গড়্গড় করে বলে যাচ্ছেন, ঝর ঝর করে কেঁদে যাচ্ছেন…সে যে কি এক কাণ্ড হচ্ছে। বাংলার ঠেক। হলদে বাল্বের আলো। একদিকে চট ঝুলছে। অন্যদিকে বাঁশের মাচা। নীচে মাটির ঠান্ডা মেঝে। বাইরে নোংরা খাল, তার কুলকুল জলের শব্দ। তারমধ্যে গায়ে কাঁটা দেওয়া বাংলা ভাষা। যে কজন নীচে বসে খাচ্ছিলেন তাঁরা দাঁড়িয়ে পড়লেন যেন জাতীয় সঙ্গীত হচ্ছে…বা একটা বম্ব এখুনি ফেটে যাবে আর দৌড়ে পালাতে হবে। কিন্তু পালানোও যাচ্ছে না, আটকে গেছেন। মধুসূনের বাংলায় নাকি সমীর ভট্টাচার্যের উচ্চারণে নেশায় কিছুই ঠাহর হচ্ছে না ভাল করে। পুরোটা শেষ হল, কিছুক্ষণ স্তব্ধ। তারপর বললেন। ‘চলো বেরোব’। তারপর দাম মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লেন কলকাতা টহল দিতে।
আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি
তখন আমরা ওঁর কাছে আঁকা শিখতে যেতাম মঙ্গলবার
করে। প্রথমদিকে ক্লাস হত ওঁর সিঁথির মোড়ের স্টুডিওতে,
পরের দিকে শিমলে পাড়ার রাজীবদার বাড়ি। পুরনো উত্তর কলকাতার বাড়ি যেমন হয় আর কি। তার টঙে। একটা স্টুডিও। কি টং রে বাবা, ঊঠতে একেবারে দম বেরিয়ে যেত। সারা দুপুর আঁকার ক্লাস হত। তারও ওপরে ছিল ছাদ সেখানে হাসি, কত ইয়ার্কি, কত আড্ডা। তখন সমীরদার একটা কালো ব্যাগ ছিল। সেটা থেকে নানা সময়ে নানা জিনিস বেরোত। কখনো রং, কখনো পেন্সিল, কখনো চিরুনি, কখনো একটা চামচ বেরোলো। আমরা ছাত্রছাত্রীরা মজা করে মাঝে মাঝেই জিজ্ঞেস করতাম ‘কালো ব্যাগে কি আছে?’ তখন সমীরদা একটু অস্প্রস্তুত হয়ে বলত ‘বিড়ি’! একটা বিশেষ ব্র্যান্ডের বিড়ি খেত সমীরদা। আমরাও টুকটাক করে মেরে দিতাম। শেষ হলেই হেব্বি হল্লা চিল্লা। তারপর আবার রাজীবদাকে বিড়ির ব্যবস্থা করতে হতো। আমাদের আঁকতে দিয়ে সমীরদা লাঞ্চ করে ঘুম দিতেন। আর আমরা ছবি শেষ করে বসে থাকতাম কখন ঘুম থেকে উঠবেন দেখাব বলে। এদিকে বিকেল গিয়ে সন্ধ্যে। সমীরদার ঘুম চলছে। শেষে কোনোরকমে নটা নাগাদ ওঁকে ঘুম থেকে তুলে, কাজ দেখিয়ে তারপর বাসে করে বাড়ি ফেরা। তখন আমি থাকতাম বিরাটিতে। ফলে ফিরতে অনেকটাই রাত হয়ে যেত। আমি ওঁর ছাত্র হিসেবে মুলত কলকাতার আদাড়েবাদাড়ে ওঁর সাথে ঘুরেই বেরিয়েছি। ছবি খুব কম সময়ের জন্য এঁকেছি। কিন্তু ওই ঘুরে বেড়াতে গিয়েই যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতেই ছবি নিয়ে, ফাইন আর্টস নিয়ে আমার একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হয়েছে। আমাকে বলতেন ‘তুমি এত ভদ্র ছেলে তো, তোমাকে আমি নষ্ট করে দেব। যাতে তুমি ছবিটা দেখতে শেখ’ কতটা নষ্ট হয়েছি সেটা উনি থাকলে বলতে পারতেন, কিন্তু এখন মনে হয় আমার তো কোনো ক্যালকাটা ইউনিভারসিটি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ছিলনা, সেগুলো সাধারণত লোকের থাকে, লোকে বুক বাজিয়ে বলে। সমীর ভট্টাচার্যই ছিলেন আমার ইউনিভার্সিটি। পোষ্ট গ্র্যাজুয়েশন কোর্স। যেখানে ছবিটা আমি দেখতে শিখেছি।
যখন কাক ওড়ে। গঙ্গায় সন্ধে নেমে বসে থাকে অথবা কলকাতা শহরের কোল জুড়ে বসে থাকে একটা শীতের রাত। আমার মনে পড়ে যায় ঘুম জড়ানো সেই সময়টাকেই। যখন আড় ভাঙছিল আমাদের জীবন। কিছুটা আগে পরে। আমি, শ্রাবণীদি, রাজীবদা, সাহেবদা। এখন হয়তো সবাই অনেক দূরে দূরে। কিন্তু সেই সময়টার ভেতর সবাই ছিলাম সমীরদার ছাত্র। কখনো কোথাও আউটডোর বা কোথাও ঝিম ধরা সকালে কচুরী খেতে যাওয়া। সব কিছুর মধ্যে যেন একটা ছন্দ ছিল। সবকিছুর ভেতর ছিল একটা হয়ে ওঠার ইচ্ছে। একটা বিরাট বড় শহর কলকাতার পাকস্থলীর ভেতর সমীরদার সাথে আমাদের এত স্বাভাবিক পদচারণা ছিল যে আমরা সবাই হেঁটেছি নিরন্তর আমাদের মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। বাগবাজার থেকে আহিরীটোলা, সেখান থেকে বিকে পাল, তারপর উল্ট ডাঙ্গা, শ্যামবাজার, রাজবল্লভপাড়ার মোড়, উত্তর কলকাতাটা। ওই ক্লাস হত, হয়ত একদিন একাডেমি থেকে ময়দান, ঘাসের ওপর বসে গল্প হচ্ছে খুব। তখন হয়তো হিম বাতাসে। একটা দোতলা বাস টার্ন করছে হালকা রোদ্দুরে। তখন বসে সমীরদা দেবব্রতর একটা গান বিশ্লেষণ শুরু করলেন। গাইছেন আর আর একটু একটু করে খোসা ছাড়িয়ে বোঝাচ্ছেন গানটা কিভাবে কিভাবে চলেছে তার গন্তব্যে। রবীন্দ্রনাথের গান ছিল লোকটার প্রাণ। বোঝাতে বোঝাতে নিজেই গেয়ে গেয়ে চলেছেন। এরম অনেকদিনই হয়েছে। ছবি নিয়ে বলছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমরা মুগ্ধ শ্রোতা। আর ছবির গল্প বলছেন, মেলাচ্ছেন, ভ্যান গঘ, পিকাসো, দেবব্রত, চারু মজুমদার, উত্তমকুমার এই সব দিয়ে সেলাই করছেন আমাদের অবচেতনকে। আমরা সেই শীতের শহরে বসে বুঝতে পারছি আমরা ওঁর ছায়ায় একটু একটু করে বেড়ে উঠছি। একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে আমাদের ছবি আঁকার চোখ।