সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
NATIONALISM – Sir Rabindranath Tagore, San Francisco, The Book Club of California, MDCCCCXVII. গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত Nationalism in India শীর্ষক ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত রচনার বঙ্গানুবাদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমেরিকায় থাকাকালীন Nationalism বিষয়ে তার বক্তৃতামালার পরিপূরক হিসাবে এটি রচনা করেন।
ভারতের প্রকৃত সমস্যা রাজনৈতিক নয়। সামাজিক। এই পরিস্থিতি যে শুধু ভারতে দেখা যায় তা নয়, বিশ্বের অন্য সব দেশেরও একই অবস্থা। যে কোন বিষয়ের শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থের দিকে আমার আস্থা নেই। পাশ্চাত্যে আদর্শের উপর প্রভুত্ব করে রাজনীতি। আর ভারতে আমরা তার অনুকরণ করার চেষ্টা করছি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ইউরোপে জনগণের মধ্যে শুরু থেকেই জাতিগত একতা বর্তমান এবং প্রাকৃতিক সম্পদ তাদের অধিবাসীদের তুলনায় অপ্রতুল। ফলত, তাদের সভ্যতা, রাজনীতি এবং বাণিজ্যিক আগ্রাসনকে নিজস্ব চরিত্র হিসাবে গ্রহণ করেছে। একদিকে এই রাষ্ট্রগুলির কোন অভ্যন্তরীণ জটিলতা ছিল না, অন্যদিকে তাদের শক্তিশালী লোলুপ প্রতিবেশীদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই সমস্যার সমাধান হিসাবে নিজেদের মধ্যে সঠিক সংযোগ বা সম্মিলন রাখার পাশাপাশি পরস্পরের প্রতি শত্রুসুলভ সতর্ক পর্যবেক্ষণ বজায় রাখা হত। আগেকার দিনে তারা সংঘবদ্ধ হত এবং লুঠতরাজ চালাত, আর বর্তমানে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে সারা পৃথিবীকে শোষণ করে।
কিন্তু ইতিহাসের আদিকালের শুরু থেকেই ভারতবর্ষকে সদাসর্বদা তার ভিতরের যে একান্ত নিজস্ব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে – সেটি হল তার জাতি বা প্রজাতি সমস্যা। পাশ্চাত্যের প্রতিটি দেশ (নেশন) তার উদ্দেশ্য বিষয়ে সচেতন, কিন্তু আমাদের অর্থাৎ ভারতীয়দের বোঝা উচিত যে আমরা রাজনীতির ক্ষেত্রে সবসময় অপারঙ্গমতার নজির রেখেছি, কেননা দূরদৃষ্টির সঙ্গে এখনো আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে পারি নি।
আমেরিকাতে আপনারা যেমন জাতিগত একতার ক্ষেত্রে এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, আর আমরা বহু বছর ধরে তার সমাধান করার চেষ্টা করছি। জাতিভেদ প্রথা নিয়ে ভারতে কি ঘটছে তা নিয়ে এই দেশের বহু মানুষ আমার কাছে জানতে চেয়েছেন। আর যখনই এই প্রশ্ন আমাকে করা হয়েছে, তা যেন উচ্চতর অবস্থান থেকে করা হয়েছে। আমি একই প্রশ্ন একটু পালটে নিয়ে আমাদের আমেরিকান সমালোচকদের একটি প্রশ্ন করবার লোভ হচ্ছে, “রেড ইন্ডিয়ান এবং নিগ্রোদের প্রতি আপনারা কি করেছেন?” তাদের প্রতি তো আপনারা জাতি-ভিন্নতার বোধের উপরে উঠতে পারেন নি। অন্য জাতি কে ব্রাত্য রাখার জন্য আপনারা হিংসার অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনারা আমেরিকাতে এই প্রশ্নের মীমাংসা করছেন ততক্ষণ অবধি আপনাদের ভারতকে সেই প্রশ্ন করবার অধিকার নেই।
তবুও ভারত এই ভয়ংকর জটিলতার সমাধানে কিছুটা এগোতে পেরেছে। ভারতবর্ষ এই জাতি-গোষ্ঠীগুলির সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছে। তাদের মধ্যে যেখানে প্রকৃত ভিন্নতা আছে তা স্বীকার করেও একতার মূল উপাদানগুলি খোঁজবার চেষ্টা করেছে। এই উপাদানগুলির সন্ধান ভারতে আমরা পেয়েছি নানক, কবীর, চৈতন্য এবং অন্যান্য ঋষি-প্রতিম মহামানবদের – তাদের সব জাতির এক ঈশ্বর, এই প্রচারের মাধ্যমে।
আমরা আমাদের সমস্যা সমাধানের অনুসন্ধানের পথে বিশ্ব সমস্যার সমাধানে সাহায্যকারী হব। আজ যেখানে ভারত পৌঁছে গেছে, সারা পৃথিবী এখন সেই অভিমুখে। বৈজ্ঞানিক সৌকর্যের পরিপ্রেক্ষিতে সারা পৃথিবী এখন একটি দেশে পরিণত হচ্ছে। এখন সেই সময় প্রত্যাসন্ন যখন আপনাদেরও একতার এমন উপাদান খুঁজে নিতে হবে যা রাজনৈতিক নয়। যদি ভারতবর্ষ পৃথিবীকে সেই সমাধান পৌঁছে দিতে পারে, সেটা হবে মানবতার প্রতি তার অবদান। সারা পৃথিবীতে আসলে একটাই ইতিহাস আছে, তা হলো মানুষের ইতিহাস। আর সমস্ত জাতীয় ইতিহাস বিশাল মানুষের ইতিহাসের এক একটি অধ্যায় মাত্র। এই মহান নিমিত্তের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও ভারতবর্ষে আমরা তৃপ্ত।
প্রতিটি মানুষ নিজেকে ভালবাসে। তাই তার নির্দয় সহজাত প্রবৃত্তি শুধুমাত্র তার নিজের স্বার্থের জন্য তাকে অন্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বে সামিল করে। কিন্তু তার সঙ্গে মানুষের উচ্চতর প্রবৃত্তি যথা সমবেদনা বা পারস্পরিক সহযোগিতার প্রবৃত্তিও থাকে। যে মানুষের এই উচ্চতর মূল্যবোধের ক্ষমতা থাকে না, যে অন্যের সঙ্গে বন্ধুত্বের বাঁধনে নিজেকে জড়াতে পারে না তার ধ্বংস অনিবার্য অথবা তাকে মূল্যবোধের অধঃপতন নিয়ে বাঁচতে হয়। যাদের মধ্যে সহযোগিতা বা সহমর্মিতার চেতনা প্রবল তারাই কেবল টিকে থাকতে পেরেছেন এবং সভ্যতা অর্জন করতে পেরেছেন। সেইজন্য ইতিহাসের শুরু থেকেই মানুষকে লড়াই ও সহযোগিতা এবং নিজ-স্বার্থ ও সকলের স্বার্থের মধ্যে কোনটা গ্রহণীয় তা বেছে নিতে হয়েছে।
আমাদের প্রাচীন কালের ইতিহাসে যখন প্রত্যেকটি দেশের ভৌগলিক সীমা খুব বড় ছিল না এবং যোগাযোগের সুবিধা তুলনামূলকভাবে অনেক কম ছিল, তখন সমস্যার মাপও অনেক ছোট ছিল। সেই সমস্যা অতিক্রম করে তাদের নিজস্ব গণ্ডীবদ্ধ এলাকার মধ্যে ঐক্যের ধারণা গড়ে তোলা কঠিন ছিল না। সেই সময় তারা নিজেদের যূথবদ্ধ ক’রে অন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করত। যৌথ থাকার এই মূল্যবোধের চেতনা তাদের বৃহৎ শক্তি হবার সত্যিকারের মূল ভিত্তি ছিল, যা তাদের শিল্প, বিজ্ঞান এবং ধর্মকে লালন করতে সাহায্য করেছে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সেই শুরুর সময়ে মানুষকে মনে রাখতে হয়েছে যে এক জাতির মানুষ অন্য জাতির মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসছে। যারা এই বিষয়টা প্রকৃত অনুধাবন করতে পেরেছে তাদের উন্নত চেতনা ইতিহাসে ছাপ রাখতে পেরেছে।
বর্তমান কালের সব থেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যে বিভিন্ন জাতির মানুষেরা এখন পরস্পরের নিকটাবদ্ধ হয়েছে। তা সত্বেও আবার আমরা দুটি বিকল্পের সামনাসামনি হয়েছি। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষেরা কি পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধই করে যাবে, নাকি নিজেদের মধ্যে সমন্বয়সাধন ও পারস্পরিক সহযোগিতার সত্যিকারের ভিত্তি খুঁজে বার করবে; অন্তহীন প্রতিযোগিতার মধ্যে থেকে যাবে, নাকি পারস্পরিক সমবায়ে উপনীত হবে।
আমার এ কথা বলতে কোন দ্বিধা নেই যে, ভালবাসার নৈতিক শক্তি এবং আধ্যাত্মিক ঐক্যের দর্শন ইশ্বর যাদেরকে দিয়েছেন; বহিরাগত বা বিদেশীদের প্রতি শত্রুতাবোধ যাদের ন্যূনতম; যারা সহানুভুতিশীল অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে নিজেদের অন্যের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে পারে, তারাই আগত যুগে স্থায়ী অবস্থান অধিকার করবার যোগ্যতম বলে বিবেচিত হবে। আর যারা ক্রমাগত যুদ্ধ করবার প্রবৃত্তি এবং বহিরাগত বা বিদেশীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা লালন করে চলবে তারা নির্মূল হয়ে যাবে। এই সমস্যা আমাদের সামনে বিরাজমান, আমাদের মনুষ্যধর্মের উচ্চ মৌলিক শক্তির সাহায্যে এই সমস্যার সমাধান করে আমাদের মানবতাকে প্রমাণ করতে হবে। অন্যদের আঘাত করা, তাদের প্রত্যাঘাত নিবারণ করার বিশাল সংগঠন-যন্ত্র, অর্থ উপার্জনের জন্য অন্যদের টেনে পিছনে ফেলা এই সমস্যার ক্ষেত্রে কোনভাবেই সাহায্যকারী হবে না। পক্ষান্তরে, এর জন্য বিপুল খরচ ও সেই খরচের পিষে ফেলার মতো চাপ এবং তার মানবতাকে বিনাশের দিকে ঠেলে দেওয়া প্রভাব নিয়ে আমাদের উচ্চতর সভ্যতার বৃহত্তর জীবনের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে গুরুতর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
জাতিগুলির বিবর্তনের সময় ভ্রাতৃত্বের নৈতিক সংস্কৃতি ভৌগলিক পরিধিতে সীমাবদ্ধ ছিল, কেননা সেই সময় সীমানার অস্তিত্ব প্রতীয়মান সত্য ছিল। এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকৃত প্রতিবন্ধকতার সম্পর্ক-রহিত এক কাল্পনিক রেখা মাত্র। মানুষের নৈতিক প্রকৃতির, এই মহান সত্যকে প্রকৃত গুরুত্ব সহকারে মোকাবিলা করবার সময় এসেছে নতুবা এখন ধ্বংসের মুখোমুখি সময়। পরিস্থিতি পরিবর্তনের ধাক্কায় মানুষের লোভ এবং নিষ্ঠুর ঘৃণার প্রতি প্রবল উৎসাহ মন্থিত হয়েছে। এই অবস্থা যদি অনির্দিষ্ট কাল চলতে থাকে, মানবতাবিরোধী এই উপকরণগুলি যদি ক্রমাগত নিজেদের অতিরঞ্জিত করতে করতে অকল্পনীয় অযৌক্তিকতায় পৌঁছে যায়, যদি এই উপকরণগুলি তার ধুলো ধোঁয়া আর কর্দযতায় এই সুন্দর পৃথিবীকে আবরিত করে ফেলে, তাহলে এই পৃথিবী এক বিপুল আত্মহত্যার ধ্বংসলীলায় অবসিত হবে। সুতরাং মানুষকে তার সমস্ত ভালবাসা এবং দৃষ্টির স্বচ্ছতাকে কাজে লাগিয়ে এক নৈতিক সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে যা জাতিগুলিকে আরো ভগ্নাংশে ভেঙ্গে ফেলার পরিবর্তে পৃথিবীর সমস্ত জাতিগুলিকে একত্রে অন্তর্ভূক্ত করবে। বর্তমান কালের প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের কাছে আজ এই ডাক এসেছে যে সকলকে নিজেদের এবং তার পরিপার্শ্বকে আজ এই নতুন যুগের ঊষালগ্নে মানবতার আধ্যাত্মিক একতার মধ্যে নিজের আত্মাকে খুঁজে নেবার জন্য প্রস্তুত করতে হবে।
নিচের ধাপ থেকে মানবতার আধ্যাত্মিক শিখর ছোঁয়ার এই জটিল সংগ্রামে যদি আদৌ কোন ভূমিকা পাশ্চাত্যের থেকে থাকে, সেক্ষেত্রে আমার ভাবতে দ্বিধা নেই যে মানুষ এবং ইশ্বরের এই প্রত্যাশা পূরণ করবার দায়িত্ব আমেরিকার উপর বর্তায়। আপনারা সেই প্রত্যাশার দেশ যাদের কাছ থেকে বর্তমানের যা পরিস্থিতি তার থেকে অন্য কিছু আকাঙ্ক্ষা করা যায়। ইউরোপের মনে নিগূঢ অভ্যাস এবং দেশাচার কাজ করে। কিন্তু আমেরিকাতে এখন পর্যন্ত সে চিহ্ন নেই। অতীত ঐতিহ্য থেকে আমেরিকা কতটা অনর্থক নিগড়-হীন তা আমি হৃদয়ঙ্গম করেছি। আমেরিকার যুবসমাজের পরীক্ষা করে দেখবার প্রবণতাকে আমি তারিফ করি। আমেরিকার মহিমা-গৌরবের ভিত্তি অতীতে নয়, ভবিষ্যতে; এবং যার দূরদৃষ্টি আছে সে এই আমেরিকাকে ভালোবাসতে পারবে।
প্রাচ্যের নিকট পাশ্চাত্য সভ্যতার ন্যায্যতা প্রতিপাদন করবার জন্য আমেরিকার ভূমিকা পূর্বনির্দিষ্ট। ইউরোপ মানবতার উপর বিশ্বাস হারিয়েছে এবং অবিশ্বাসী ও অসুস্থ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে আমেরিকা বিগতস্পৃহ বা দুঃখপীড়িত নয়। সাধারণ মানুষ হিসাবে আপনারা জানেন যে, জ্ঞানচর্চা আপনাদের চালনা করছে এবং তাকেই আপনারা মহত্তম হিসাবে মানেন। কিছু কিছু অভ্যাস আছে যা শুধু জড় প্রকৃতির নয় বরং আক্রমণাত্মকভাবে উদ্ধত। এই অভ্যাসগুলি প্রাচীরের মত নয়, বিছুটির বেড়ার মত। যখন থেকে তারা পরিধিতে বৃহত্তর, সংবদ্ধ, শক্তিশালী ও উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন হয়েছে তখন থেকে ইউরোপ এই অভ্যাসের বেড়াগুলিকে লালন করেছে। তাদের ঐতিহ্যের গর্বের শিকড় তাদের হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করেছে। তা যুক্তিহীন বলে আমি তর্ক করতে চাই না। কিন্তু গর্ব বা দম্ভ সবক্ষেত্রেই অন্ধত্বের জন্ম দেয়। যেমন যে কোন কৃত্রিম উত্তেজকের প্রথম প্রতিক্রিয়া হচ্ছে চেতনাকে তীব্রতর করা, এবং তারপর অতিরিক্ত মাত্রার প্রয়োগে বিহ্বলতা সৃষ্টি করা ও এমন উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করা যা বিভ্রান্তিকর। ইউরোপ তার সমস্ত অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক অভ্যাসের ক্ষেত্রে উত্তরোত্তর ঔদ্ধত্ব জমাটবদ্ধ করেছে। সে শুধুমাত্র ভুলতে পারে না যে সে পাশ্চাত্যের প্রতিভূ; শুধু তাই নয় প্রত্যেকটি সুযোগে অন্যদের অপমান করতে তা জাহির করে। সেই কারণে, ইউরোপ তার নিজস্ব মহত্ব প্রাচ্যে প্রদান করতে ক্রমশ অক্ষম হয়ে পড়ছে এবং প্রাচ্যের শতাব্দী প্রাচীন জ্ঞান ভান্ডার সঠিক মর্মার্থে গ্রহণ করতে পারছে না।
আমেরিকাতে জাতীয় অভ্যাস ও প্রথার শিকড় তার হৃদয়ের চারিদিকে জাঁকিয়ে বসার সময় নেই। যখনই আপনাদের যাযাবরের অস্থিরতার সঙ্গে ইউরোপের অধিষ্ঠিত স্থায়ী ঐতিহ্যের তুলনা করেছেন, তখনই আপনারা সর্বদা অনুভব করেছেন এবং অভিযোগ করেছেন এই প্রথা ও অভ্যাসের থেকে অসুবিধার বিষয়ে। ইউরোপ সর্বোচ্চ সুবিধার মহত্তম ছবি দেখাতে পারে কারণ তারা সেটা অতীতের প্রেক্ষাপটে ঠিক করে নিতে পারে। কিন্তু বর্তমান অবস্থান্তর বা উত্তরণের যুগে, যখন নতুন সভ্যতার প্রত্যাসন্ন যুগ পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে তার অমিত ভবিষ্যতের তূর্যধ্বনি পাঠাচ্ছে, তখন অসংলগ্ন থাকবার এই স্বাধীনতা আপনাদের সেই প্রত্যাসন্ন যুগের আমন্ত্রণ গ্রহণ করার এবং লক্ষ্য পূরণ করার ক্ষমতা দেবে, যার জন্য ইউরোপ তার উদ্যোগ শুরু করলেও মাঝপথে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কারণ তার ক্ষমতার দম্ভ এবং দখলের লিপ্সাতে প্রলুব্ধ হয়ে সে পথভ্রষ্ট হয়েছে।
ব্যক্তিমানসের নিছক অভ্যাস থেকে মুক্তি শুধু নয়, ভবিষ্যত সভ্যতার জয়পতাকা তুলে ধরার বৃত্তিতে সমস্ত রকমের অশুচি জটিলতায় জড়িয়ে পড়ার ইতিহাস থেকে মুক্তি পেতে হবে। ইউরোপের সমস্ত সফল বড় জাতিগুলির শিকার পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে বিদ্যমান। যার ফলে শুধুমাত্র নৈতিক সহানুভুতিই ধ্বংস হয়েছে তা নয়, বৌদ্ধিক সহানুভুতিও লুপ্ত হয়েছে। যে সহানুভুতি অন্য জাতিকে বোঝার জন্য অত্যন্ত জরুরী। কোন ইংরেজের পক্ষে ভারতবর্ষকে কোনদিন যথার্থরূপে অনুধাবন করা সম্ভব নয় কেননা তারা কখনো তাদের নিজেদের স্বার্থচিন্তা ছেড়ে বেরোতে পারে নি। আপনি যদি জার্মানি বা ফ্রান্সের সঙ্গে ইংল্যান্ডকে তুলনা করেন তাহলে দেখতে পাবেন যে সবথেকে কম সংখ্যক ইংল্যান্ডবাসী বিদ্বান ব্যক্তি, সামান্যতম অন্তর্দৃষ্টি বা পূর্ণাঙ্গতার সঙ্গে ভারতীয় সাহিত্য বা দর্শন অধ্যয়ন করেছেন। যেখানে সম্পর্ক অস্বাভাবিক এবং জাতীয় স্বার্থপরতা ও অহঙ্কারের উপর প্রতিষ্ঠিত সেখানে এই ধরনের অবজ্ঞা এবং ঘৃণা মিশ্রিত আচরণই স্বাভাবিক। অথচ সেখানে আপনাদের ইতিহাস ঐ জাতীয় স্বার্থপরতা ও অহঙ্কারের প্রতি আগ্রহহীন এবং সেই কারণেই জাপানকে তার পাশ্চাত্য সভ্যতার পাঠে সাহায্য করতে পেরেছেন; সেই কারণেই চীন ভরসা করে তার বিপদের অন্ধকারতম মুহূর্তে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আপনাদের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পেরেছে। বাস্তবিক আপনারা এক মহান ভবিষ্যতের দায়িত্ব বহন করছেন কারণ আপনারা অতীতের কদর্য কৃপণতার কবল থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছেন। সুতরাং পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্রের মধ্যে আমেরিকাকে এই ভবিষ্যতের জন্য সম্পূর্ণ সজাগ থাকতে হবে। তার দূরদৃষ্টি যেন কোনভাবেই অষ্পষ্ট না হয়ে পড়ে এবং যুবশক্তির সাহায্যে মানবতার উপর তার আস্থা যেন অটল থাকে।
ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে এক ধরনের সমান্তরালতা আছে, যে ধরনের একসাথে বেঁধে রাখার সমান্তরালতা তাদের বিভিন্ন জাতিকে একরাষ্ট্রে বেঁধে রেখেছে।
আমাদের দেশে আমরা সমস্ত জাতির ভিতর কিছু সাধারণ প্রকৃতি বা গুণ খোঁজার চেষ্টা করছি যা তাদের প্রকৃত ঐক্য প্রমাণ করবে। যে কোন নেশন যারা ঐ ঐক্য শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ভিত্তিতে খোঁজার চেষ্টা করছে তারা প্রকৃত ঐক্যের সন্ধান পেতে পারে না। চিন্তাবিদ এবং ক্ষমতাশালী মানুষেরা আধ্যাত্মিক ঐক্য আবিষ্কার করবে, উপলব্ধি করবে এবং তা প্রচার করবে।
ভারতবর্ষে কোন দিনই জাতীয়তাবোধের বাস্তব অনুভুতি ছিল না। যদিও ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হয়েছে যে ঈশ্বর এবং মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের চেয়ে জাতীয়তার সাকার উপাসনা অনেক বেশি ভাল, আমার বিশ্বাস আমি সেই শিক্ষা অতিক্রম করেছি এবং এটা আমার বিশ্বাস যে আমার দেশবাসী তাদের ভারতবর্ষ প্রকৃতভাবে অর্জন করবে, সেই শিক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করে, যে শিক্ষা মানবতার আদর্শের থেকে দেশ বড় বলে শেখায়।
আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ভারতীয়রা বর্তমানে আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকে শিক্ষাগ্রহণের পরিবর্তে ইতিহাস থেকে কিছু শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করছেন। প্রাচ্য, প্রকৃতপক্ষে, একটি ইতিহাস গ্রহণ করার চেষ্টা করছে যা তার নিজের জীবনযাত্রার ফলাফল নয়। উদাহরণস্বরূপ, জাপান মনে করে যে সে পাশ্চাত্য পদ্ধতি অবলম্বন করে শক্তিশালী হচ্ছে, কিন্তু তার উত্তরাধিকার নিঃশেষ হবার পরে, তার কাছে কেবল সভ্যতার ধার করা অস্ত্রই থাকবে। সে আর নিজেকে ভেতর থেকে বিকশিত করবে না।
ইউরোপের অতীত আছে। ইউরোপের শক্তি তার অতীতে নিহিত আছে। আমরা, ভারতে, আমাদের মনস্থির করতে হবে যে আমরা অপর জনগণের ইতিহাস ধার করবো না এবং তবুও যদি আমরা নিজেদের কন্ঠ রোধ করি, সেক্ষেত্রে তা আত্মহত্যা করার সামিল হবে। যখন আপনি এমন বস্তু ধার করলেন যা আপনার জীবনের অন্তর্গত নয়, তা শুধুমাত্র আপনার জীবন ধ্বংস করতে সাহায্য করবে।
এবং সেইজন্য আমি বিশ্বাস করি যে পাশ্চাত্যের সভ্যতার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া ভারতের পক্ষে ঠিক নয়। বরং শত অপমান সহ্য করেও যদি আমরা নিজেদের ভাগ্য অনুসরণ করি, তাতে আমাদের ক্ষতিপূরণ অনেক বেশী হবে।
এমন অনেক পাঠক্রম আছে যা আমাদের বৌদ্ধিক সাধনার জন্য তথ্য যোগান দেয় এবং আমাদের মনকে প্রশিক্ষিত করে। এগুলো সহজে, সুবিধার সঙ্গে অর্জন এবং ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু আরো এমন কিছু পাঠক্রম আছে যা আমাদের নিজস্ব প্রকৃতিকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে এবং আমাদের জীবনের দিক পরিবর্তন করে দেয়। সেগুলি গ্রহণ করে এবং আমাদের নিজস্ব উত্তরাধিকার বিক্রি করে তাদের মূল্য পরিশোধ করবার আগে, আমাদের অবশ্যই বিরতি দিতে হবে এবং গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। মানুষের ইতিহাসে যুগে যুগে চোখ ধাঁধাঁনো সময় আসে; তাদের শৌর্য এবং গতি আমাদের মুগ্ধ করে। তারা শুধুমাত্র আমাদের ঘরের অনুজ্জ্বল আলোকে উপহাস করে তাই নয়, তারা আকাশের অনন্ত তারাকেও সেই চোখেই দেখে। কিন্তু সেই উসকানির দ্বারা আমরা যেন প্ররোচিত না হই এবং আমাদের প্রদীপ বিসর্জন না দিই। আসুন ধৈর্য সহকারে আমাদের বর্তমান অপমান সহ্য করি এবং উপলব্ধি করবার চেষ্টা করি যে এই আতশবাজির জাঁকজমক আছে, কিন্তু স্থায়ীত্ব নেই। কেননা, চরম বিস্ফোরকতাই তাদের বর্তমান ক্ষমতার কারণ এবং এটাই তাদের ক্লান্তিরও কারণ হবে। তারা তাদের লাভ ও উৎপাদনের তুলনায় বস্তু ও শক্তি অত্যধিক বেশী মাত্রায় ব্যয় করছে।
যেভাবেই হোক, আমাদের আদর্শ বিকশিত হয়েছে আমাদের নিজস্ব ইতিহাসের মধ্য দিয়ে। এমনকি আমরা চাইলেও সে আদর্শের জমকালো প্রদর্শন করতে পারি না বা কম মাত্রায় পারি। কেননা আমাদের আদর্শের উপকরণ ও তার নৈতিক উদ্দেশ্য আপনাদের থেকে আলাদা। যদি আমরা আমাদের সমগ্র দিয়ে একটি রাজনৈতিক জাতীয়তা লাভ করার ইচ্ছা পোষণ করি, তা ততটাই অযৌক্তিক হবে, যতটা সুইজারল্যান্ড যদি ইংল্যান্ডের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য তার সমগ্র দিয়ে নৌশক্তি গড়ে তোলার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। আমরা যে ভুলটা করি, সেটা ভাবনায়। আমরা মনে করি মানুষের মহত্বের গতিমুখ একমুখী, যে গতিমুখ ঔদ্ধত্যের গভীরতায় বেদনাদায়কভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে আমাদের সামনে আমাদের ভবিষ্যত অপেক্ষা করে আছে এবং সে ভবিষ্যত যারা নৈতিক আদর্শে সমৃদ্ধ তাদের জন্য, যারা শুধুমাত্র ধনদৌলতে ধনী তাদের জন্য নয়। তাৎক্ষণিক নাগালের বাইরে যে ফল তার জন্য কাজ করা মানুষের সৌভাগ্য। বর্তমান সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবার মানসিক দাসত্ব বা বিচক্ষণ অতীতের আকাঙ্ক্ষায় সীমাবদ্ধ না রেখে মানুষের কাজ করতে পারা তার সৌভাগ্যের লক্ষণ, যে কাজ আমাদের সর্বোচ্চ প্রত্যাশাময় আদর্শ হৃদয়ে বহন ক’রে অসীম ভবিষ্যতের জন্য সংঘটিত হয়।
তবে আমাদের অবশ্যই জানা উচিত যে পাশ্চাত্য ভারতে এসেছে বিধিনির্দিষ্টভাবে। তবুও কাউকে প্রাচ্যের বিষয়ে পাশ্চাত্যকে দেখাতে হবে এবং সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচ্যের অবদান কতটা তা বোঝাতে হবে। ভারত পাশ্চাত্যের কাছে ভিক্ষুক নয়। এবং তবুও যদি পাশ্চাত্য সে কথা ভাবে, আমি তাদেরকে খোঁচা দিতে চাই না বা স্বাধীনোত্তর সময়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে চাই না। যদি বিধির নির্বন্ধ হয় যে ইংল্যান্ড সেই যোগাযোগের বা গভীর ভাবানুষঙ্গের মাধ্যম হবে, সেক্ষেত্রে আমি সবার সাথে তা নম্রভাবে মেনে নিতে রাজি আছি। মানুষের প্রকৃতিতে আমার অগাধ বিশ্বাস এবং আমি মনে করি পাশ্চাত্য তার আসল লক্ষ্য খুঁজে পাবে।
আমি পাশ্চাত্য সভ্যতা নিয়ে কটু কথা বলি যখন আমি বুঝতে পারি যে তারা নিজেদের বিশ্বাসভঙ্গ করছে এবং নিজেরাই নিজেদের উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করছে। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য ক্ষমতা ব্যবহার করে পাশ্চাত্য নিশ্চয় নিজেকে পৃথিবীর অভিশাপ করে তুলবে না। বরং অজ্ঞকে শিক্ষাদান করে, দুর্বলকে সাহায্য করে, তাকে চরমতম বিপদ থেকে রক্ষা করে, ক্ষীণকে শক্তিধর করে তুলবে যাতে সে অনধিকার প্রবেশ রুখতে পারে। কেননা মহাশক্তিশালীদের তাই কর্তব্য। এবং পাশ্চাত্য নিশ্চয় বিষয়াসক্তিকে চরম প্রাপ্তির বিষয় করে তুলবে না, বরং উপলব্ধি করবে যে বস্তুর স্বেচ্ছাচারতন্ত্র থেকে আধ্যাত্মিক মননকে মুক্ত করতে সে পরিষেবা দিচ্ছে।
আমি বিশেষ কোন একটি জাতির বিরুদ্ধে নই, কিন্তু সমস্ত জাতির (নেশন) সাধারণ ধারণার বিরুদ্ধে। নেশন কি?
এটি নিজেকে সংগঠিত শক্তি হিসাবে দেখতে চেয়ে সমগ্র জনগণের অন্যতম দৃষ্টিভঙ্গি। যে সংগঠন-যন্ত্র অবিরাম জনগণকে শক্তিশালী এবং দক্ষ হিসাবে গড়ে তোলবার জন্য জেদ বজায় রাখে। কিন্তু শক্তি এবং দক্ষতার এই কঠোর প্রচেষ্টা মানুষ যখন আত্মত্যাগী ও সৃজনশীল হতে চায় তখন তার মানবতার উচ্চতর প্রকৃতি থেকে কর্মশক্তি নিষ্কাশিত করে দেয়। এর ফলে মানুষের আত্মত্যাগের ক্ষমতা, যা অত্যন্ত নৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য থেকে যান্ত্রিক সংগঠন রক্ষার দিকে সরে যায়। তবু সে এর থেকে সমস্ত রকমের নৈতিক মহত্বের সন্তুষ্টি অনুভব করে, যা মানবতার কাছে অত্যন্ত বিপজ্জনক। সে বিবেকের তাগিদ থেকে স্বস্তি বোধ করে যখন সে এই সংগঠন-যন্ত্রের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পারে যা প্রকৃতক্ষেত্রে তার নৈতিক ব্যক্তিত্যের সৃষ্টি নয় বরং বুদ্ধিবৃত্তির সৃষ্টি। এই যন্ত্র-সংগঠনের সাহায্যে স্বাধীনতা-প্রেমী জনতা পৃথিবীর একটি বিরাট অংশের উপর দাসত্বের স্থায়ী বন্দোবস্ত করে এবং বিশ্বের দায়িত্ব পালন করবার আরামপ্রদ গর্বানুভুতিতে মগ্ন থাকে; যারা স্বভাবতই ন্যায়বান তারাও তাদের কাজ ও চিন্তা উভয় ক্ষেত্রেই নিষ্ঠুরভাবে ন্যায়বিরুদ্ধ মানুষ হইয়ে উঠতে পারে; যদিও তারা ভাবতে থাকে যে বিশ্বের উষরতাকে সিক্ত করতে তারা সাহায্য করছে; যারা সৎ তারাও স্ব-উন্নতির জন্য অন্ধভাবে অন্যদের মানবাধিকার হরণ করতে পারে; এই ব্যক্তিরা বঞ্চিতদের, তারা ভালো ব্যবহারের উপযুক্ত নয় বলে সব সময় গালাগালি করে। এমনকি যে কোন ক্ষুদ্র সংগঠন বা পেশাতে নিযুক্ত ব্যক্তিদের ভাবলেশহীন অনুভূতিহীনতা আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দেখতে পাই যদিও তারা প্রকৃতিগত ভাবে খারাপ মানুষ নন; তাই সমগ্র জনতা যেখানে দৌলত এবং ক্ষমতা লাভের জন্য ক্ষিপ্ততার সঙ্গে নিজেকে প্রস্তুত করছে তখন আমরা খুব ভালোভাবে কল্পনা করতে পারি তা এ পৃথিবীর কতখানি নৈতিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে।
জাতীয়তাবাদ এক ভয়াবহ বিপদ/শাসানি। এটি সেই বিশেষ ধারণা যা বছরের পর বছর ধরে ভারতের সমস্যার মূলে রয়েছে। এবং যে কারণে কোন একটি নেশন, যা চরিত্রের দিক থেকে কঠোরভাবে রাজনৈতিক, যখন আমাদের উপর প্রভুত্ব করেছে বা শাসন করেছে; আমাদের নিজেদের অতীতের উত্তরাধিকার ও পরিণামগত রাজনৈতিক ভবিতব্যের উপর বিশ্বাস সত্ত্বেও তখন আমরা শুধু নিজেদের মধ্যে বিকশিত হবার চেষ্টা করেছি।
বিভিন্ন আদর্শ অনুগমনকারী বিভিন্ন দল বা পার্টি ভারতে আছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। অন্যদের মতে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সময় এখনো আসে নি, তবুও তারা বিশ্বাস করে যে ইংল্যান্ডের অন্যান্য উপনিবেশের মত সমান অধিকার ভারতের পাওয়া উচিত। যতখানি সম্ভব স্বাধিকার অর্জনের পক্ষে তারা।
ভারতে রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসের শুরুতে বিভিন্ন দল বা পার্টির মধ্যে আজকের মতো দ্বন্দ্ব ছিল না। সেই সময় ভারতীয় কংগ্রেস নামে একটি দল ছিল, যদিও তাদের কোন প্রকৃত কর্মসূচী ছিল না। তাদের শাসকের কাছে কিছু অভিযোগ ছিল প্রতিকারের জন্য। তারা কাউন্সিল হাউসে অধিক প্রতিনিধিত্ব এবং পৌর প্রশাসনে আরো স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। তাদের দাবি ছিল অতি ক্ষুদ্র অংশের জন্য কিন্তু তাদের কোন গঠনমূলক আদর্শ ছিল না। সুতরাং তাদের ঐ কার্যপদ্ধতিতে আমার কোন উৎসাহ ছিল না। আমার বিশ্বাস ছিল যে ভারতের সবচেয়ে প্রয়োজন তার ভিতর থেকে উঠে আসা গঠনমূলক কাজের।
এই কাজে আমাদের অবশ্যই সব ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে, সেই দায়িত্ব পালন সঠিকভাবে করা আমাদের কর্তব্য এবং অধিকার; যা নিপীড়নের যাঁতাকলের মধ্যে, প্রতিটি পদক্ষেপে নৈতিক জয় সামনে রেখে, আমাদের ব্যর্থতা এবং কষ্টকে মেনে নিয়ে করতে হবে। আমাদের উপরে যারা আছে তাদেরকে অবশ্যই দেখাতে হবে যে আমাদের নিজেদের মধ্যে নৈতিক শক্তির পরাক্রম আছে, সত্যের জন্য কষ্ট সহ্য করবার ক্ষমতা আছে। যেখানে আমাদের এরকম কিছু দেখাবার নেই, সেখানে আমাদের শুধু ভিক্ষা করতে হবে। আমরা যে উপহার চাই তা যদি এখনই আমাদের দেওয়া হয়, তা অনিষ্টজনক হবে। আমি আমার দেশবাসীকে বারংবার বলেছি, আমাদের আত্মত্যাগের চেতনার উদ্গমনের সুযোগ তৈরি করবার জন্য একত্রিত হবার কথা, ভিক্ষার উদ্দেশ্যে একত্রিত হওয়া নয়।
মানুষ শীঘ্রই বুঝতে পেরেছিল যে ওই দলের গৃহীত অর্ধেক-নীতিগুলি কতটা নিরর্থক ছিল এবং যার ফলে তারা ক্ষমতা হারায়। পার্টি বিভক্ত হয়, সেখানে চরমপন্থীরা আবির্ভূত হয়। তারা প্রচার করেছিল কর্মের স্বাধীনতা এবং তারা ভিক্ষা চাওয়ার পদ্ধতি বাতিল করে, যে পদ্ধতি দেশের প্রতি একজনের দায়িত্ববোধ থেকে তার মনকে খুব সহজে নিশ্চিন্ত করে।
তাদের আদর্শের ভিত্তি ছিল পাশ্চাত্যের ইতিহাস। ভারতের বিশেষ সমস্যার প্রতি তাদের কোনো সহানুভূতি ছিল না।
ভারতের স্পষ্টত প্রতীয়মান প্রকৃত অবস্থা তারা স্বীকার করতে চান নি। আমাদের সামাজিক সংগঠনের ধারা অনুযায়ী বিদেশীদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ভারতবাসীরা অক্ষম ছিল। যদি কোন কারণে ইংল্যান্ড আমাদের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়, আমরা কি করব? আমরা তখন হয়তো অন্য জাতির শিকার হব। একই সামাজিক দুর্বলতা বিরাজ করবে।
(শেষাংশ পরবর্তী সংখ্যা,
জানুয়ারি, ২০২৫-এ প্রকাশিতব্য)