সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
আমার স্মৃতি
(কালধ্বনি জানুয়ারি ২০২৪ সপ্তবিংশ বর্ষ তৃতীয়-চতুর্থ সংখ্যার পর)
মেহেরপুর শহরের ভিতর আমাদের একটা ছোট বাঁশবাগান ছিল। চারপাশেই মুসলমান পল্লী। অধিকাংশই কুঁড়ে ঘর। দরিদ্র শ্রমজীবী পরিবারের বাস। তাদের সঙ্গে আমাদের শর্ত ছিল যে ওপাড়ার কারোও মৃত্যু হলে তাকে গোরস্থানে নিয়ে যাবার জন্য একখানা বাঁশ কেটে নিতে পারবে। সে জন্য অনুমতি দিতে হবে না। যদি কারও ঘর ভেঙে যায়, যদি সে দুঃস্থ হয়, তাহলে পাড়ার মোড়লের সুপারিশক্রমে দুখানা থেকে তিনখানা বাঁশ পাবে। অনুমতি নিতে হবে। এরা ছিল অত্যন্ত সৎ, নির্ভরযোগ্য। বাইরের কারও পক্ষে একখানা বাঁশও চুরি করা সম্ভব ছিল না। এখানেই ছিল সুলেমানদার বাড়ি। তাঁর বাবা ছিলেন একজন দর্জি। বাজারে একটা রোয়াকে বসে খাটের গদী, টমটম ঘোড়ার গাড়ির গদী সেলাই করতেন। কালো, মোটাসোটা মানুষ। পরনে মার্কিন কাপড় সেলাই করা লুঙি, লোকে বলত চয়ন। একদিন তাঁদের পাড়ার পুকুরে স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে মারা যান।
সেই মানুষটি একদিন সকালে আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত, বাবার খোঁজে। বাবা সামনে গেলে তিনি বললেন, আপনার কাছে এলাম। বাড়ির থেকে ছেলে পাঠাল। আমাদের সুলেমান এবার ইস্কুলে নাইন ক্লাসে উঠেছে। বলছে একজন মাষ্টার না দিলে আর পারব না। অংক আর ইংরেজিটা পারছে না। সে আপনার নাম করছে। আমার অবস্থা তো জানেন। পয়সা দিয়ে কি পড়াতে পারি? ইস্কুলে না হয় ফ্রি হয়েছে। বাড়িতে তো তা হবে না। মেয়ে বলল, উনি তো আমাদের নিজেদের লোক, তুমি যাও, গিয়ে বল, একটু আবদার করো।
বাবা বললেন, রোজ তো পারব না। রবিবার দুপুরে যেন বাড়িতে আসে। সপ্তাহে একদিন, তাতেই তার কাজ হবে। ওতো ছেলে ভালো।
গামছায় মুখ মুছতে মুছতে সুলেমানদার বাবা বললেন, বাঁচলাম। ছেলের মা ঠিকই বলেছিল। আমাদের কতকালের ভাব ভালোবাসা-
সুলেমানদার কুচকুচে কালো রোগা লিকলিকে চেহারা, রবিবার দুপুরে আমাদের বাড়ির বৈঠকখানায় এসে বসতেন। নাইন-টেন দুবছর পড়েছেন।
এই সময় এইভাবে আরেকজন পড়তেন। তাঁর নাম প্রণব মল্লিক। ডাকনাম গোরা। মেহেরপুরের মল্লিক (বৈদ্য) জমিদারদের এক শরিক পরিবারের ছেলে। গোরাদা অতি রূপবান। মাথায় কোঁকড়া চুল, মৃদু মধুর গলার স্বর। মেধাবী ছাত্র। তাঁর জ্যাঠামশায় ছিলেন অক্সফোর্ডে দর্শনের অধ্যাপক। গোরাদার বাবা গোপাল মল্লিক ছিলেন মেহেরপুরের কংগ্রেস নেতা। ১৯৩০ সালে মেহেরপুরে কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে যে অসহযোগ আন্দোলন করা হয়েছিল- তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গোপাল মল্লিক। মল্লিক পরিবারের মহিলারা ছিলেন মেহেরপুরে অন্তঃপুরবাসিনী। শহরের কেউ তাঁদের মুখ দেখতে পেত না। এটাই ছিল তাঁদের ঐতিহ্য।
গোপাল মল্লিক এই পারিবারিক প্রথা ভাঙলেন। মা এবং স্ত্রীকে নিয়ে পথে নেমে এলেন। অসহযোগ আন্দোলনে সত্যাগ্রহ করতে। তার মা এবং স্ত্রী সাধারণ গৃহস্থ বাড়িতে গিয়ে মহিলাদের বলতে থাকলেন অসহযোগ আন্দোলনের মাহাত্ম্য এবং প্রয়োজন সম্পর্কে। আর বলতে লাগলেন, আমরা বেরিয়েছি, আপনারাও আসুন। এতেই কাজ হতে লাগল মন্ত্রের মতন। নারীরা বেরিয়ে আসতে থাকলেন বাড়ি থেকে। মিছিলের দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকল। মেহেরপুরে সে আন্দোলন এমন প্রবল আকার ধারণ করেছিল যে কলকাতা থেকে সুভাষ চন্দ্র বসু ছুটে এসেছিলেন সত্যাগ্রহীদের অভিনন্দন জানাতে এবং প্রেরণা জোগাতে।
আমাদের সৌভাগ্য হয়নি এই ঘটনার সাক্ষী হওয়ার। তখন নিতান্তই শিশু ছিলাম। বাবার মুখে এর উচ্ছ্বাসিত বিবরণ শুনেছি। মেহেরপুর স্কুলের সম্পাদক ছিলেন গিরীশ চন্দ্র সেন। স্কুলের পাশেই তাঁর বাড়ি ছিল, তাঁর বাড়িতে সত্যাগ্রহী বাসিন্দাদের সভা থেকে সুভাষচন্দ্র ভাষণ দিয়েছিলেন।
এই সময় সুভাষচন্দ্র কয়েকটি কাজ করেছিলেন। মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ী হরদরিয়া মল আগরওয়ালা ম্যাঞ্চেস্টারে তৈরি বিলাতি কাপড়ের ব্যবসা করতেন। সুভাষচন্দ্র তাঁর গুদাম থেকে বিলাতি কাপড়ের গাঁট তুলে বাজারের চৌরাস্তার মোড়ে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।
হরদরিয়া মল প্রথমে কাপড় দিতে রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, আমি সামান্য ব্যবসায়ী, গাঁটগুলো দাম দিয়ে কিনে নিয়ে পুড়িয়ে দিলে ভালো হয়! এতে সুভাষচন্দ্র ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। শেষে জনসাধারণের চাপে হরদরিয়া গাঁট বার করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই ব্যাপারটা পরবর্তীকালে আমাদের মধ্যে বিতর্কের সূচনা করেছিল। এই ভীতি প্রদর্শন, জবরদস্তি যুক্তিযুক্ত কাজ কিনা। একদল বলতেন, যাঁরা মুনাফালোভী তাঁদের লোকসানভোগীও হতে হবে। বিষয়টা খুবই বিতর্কিত।
সেই আন্দোলনের ফলে গোপাল মল্লিক আর তাঁর মা ও স্ত্রীকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। মা ও স্ত্রী মুক্তি পেয়েছিলেন তখনই। কিন্তু গোপাল মল্লিক কারাবাসকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারামুক্তির কিছুদিন পরে তাঁর অকাল মৃত্যু হয়।
তাঁর একমাত্র নাবালক সন্তান গোরাদা। বসন্তকুমার মল্লিক অকৃতদার। তিনি বাইরে থাকেন। গোপাল মল্লিকের শবদেহ সৎকারের সময় তিনি অবশ্য মেহেরপুর শ্মশানে উপস্থিত ছিলেন। গোপাল মল্লিকের মৃত্যুর পর পরিবারটি অভিভাবকহীন এবং অসহায় হয়ে পড়েছিল। শুনেছি জমিদারীর অবস্থাও তখন সুবিধাজনক ছিল না। ছেলের পড়াশোনার ব্যাপারে একজন অভিভাবকস্বরূপ কারও প্রয়োজন ছিল। বাবাই তাকে ডেকে নিয়েছিলেন।
সুলেমানদা আর গোরাদা দুপুরে পড়তে আসতেন। একসঙ্গে বাবার কাছে পড়ার তালিম নিতেন। অনেকসময় বাবা বৈঠকখানায় আসতে দেরি করতেন বা পড়িয়ে দিয়ে উঠে যেতেন, বা কিছু কাজ করতে দিয়ে উঠে যেতেন, তখন আমি সেখানে ঢুকে পড়তাম। ওরা আমাকে ডেকে নানা রকম হাসির কথা বলতেন। বালক বয়সে তাতে আমি খুব মজা পেতাম। এক-একদিন গানের প্রতিযোগিতা হত ওদের মধ্যে। গোরাদা ছিলেন সু-গায়ক। মাজদিয়ার কাছে ভাজনঘাটের… পরম বৈষ্ণব। এবং পদাবলী কীর্তন গানে সুবিখ্যাত। গোরাদার মা ছিলেন এখানকার এই রায় পরিবারের কন্যা। শুনেছি তিনিও কীর্তন গানে পারদর্শিনী ছিলেন। গোরাদা তাঁর মার কাছ থেকে গানের তালিম পেয়েছিলেন।
গোরা সুললিত কণ্ঠে মৃদু স্বরে কীর্তন গাইতেন। সুলেমানদা তারপর ধরতেন তাঁর গান। তাঁর গলা ভালো ছিল না। কিন্তু আবেগ ছিল। আবেগের টানে তিনি যা গাইতেন তাকে তখন বলা হত মুসলমানী গান। আমার তখন বালক বয়স। তলিয়ে কিছু বুঝতাম না। মজা পেতাম। বাঙালির দুই সংস্কৃতির ধারা গঙ্গা-যমুনার মিলনের মত যেন আমাদের মনখানাকে পবিত্র করে দিত।
সুলেমানদার কাকা ছিলেন আব্দুল কাদের--কাদের মিঞা। কালো, পরণে পাজামা-সার্ট। পায়ে নিউকাট জুতো। স্বল্প শিক্ষিত মানুষ। প্রথম জীবনে দর্জি হয়েছিলেন.। তারপর সে কাজ ছেড়ে হলেন চশমা ব্যবসায়ী। সাইকেলের পিছনে ক্যারিয়ারে চশমার বাক্স বেঁধে গ্রামে গ্রামে ঘুরে চশমা বেচতেন।
১৯৪৪ সালে একদিন পথে তাঁর সঙ্গে দেখা। একখানা নতুন র্যালে সাইকেল নিয়ে হেঁটে চলেছেন। আমার ধারণা ছিল, চশমার ব্যবসায় ভালো উপার্জন হচ্ছে। তাই প্রশ্ন করলাম, সাইকেল কিনলেন?
তিনি একগাল হেসে বললেন, না-না পেলাম।
-তার মানে? কে দিল?
-আমিতো এখন পার্টি করছি। সর্বক্ষণের কর্মী।
-চশমার ব্যবসা?
-ওটায় খুব খাটুনি। সেইমত আয় হয় না। লীগ আমাকে সর্বক্ষনের কর্মী করে নিল। আমি চশমার ব্যবসা ছেড়ে দিলাম। এখন আমাকে টাউন সেক্রেটারী করেছে। জনসংযোগ করা কাজ। তাই সাইকেলটা দিল পার্টি থেকে। দামী সাইকেল, চড়ে বেশ আরাম। আর একটা দলের মধ্যে থাকা। কাজটা খুব ভালো লাগছে।
কাদের মিঞা এখন শহরের বিশিষ্ট জন হয়ে উঠেছেন। খুব ব্যস্ত মানুষ। এভাবেই ওঁরা লীগদলকে অবলম্বন করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন।
শহরে মুসলমান নেতা আরও অনেক আছেন। সকলে আমার পরিচিত নন। লীগ দলের এম.এল.এ আছেন আব্দুল হান্নান--উকীল। প্রাক্তন এম.এল.এ. মহসীন আলী। তিনি ছিলেন কৃষক প্রজাপার্টির দলভুক্ত। দু'জনেই উকীল। দু'জনই বহিরাগত। গ্রামের মানুষ। এখানে আইন ব্যবসা সূত্রে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন। এঁদের রাজনৈতিক কার্যকলাপের বহিঃপ্রকাশ কম।
এঁদের মধ্যে আব্দুল হান্নানের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল। ম্যাট্রিক পাশ করলাম। বাবা বললেন, এখন লীগের রাজত্ব। লীগের এম.এল.এ. হান্নান মিঞার কাছ থেকে একখানা ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট নিয়ে এসো।
আমি বললাম, তিনি আমাকে চেনেন নাকি?
বাবা বললেন, আমাদের ওয়াছেদ মিঞার ভাই। আমি ওয়াছেদ মিঞাকে বলেছি। রবিবার সকালে তুমি যাবে। তখন তিনি ভাই-এর সঙ্গে থাকবেন। তিনি ভাইকে বলে দেবেন। তোমার চিন্তা নেই।
পিতার নির্দেশমতো আমি গেলাম। হান্নান মিঞার বৈঠকখানায় মানুষের ভীড় ছিল। আমি পিছনে বসলাম। ওয়াছেদ স্যার এলেন একটু পরে।
ভিড় কমলে হান্নান মিঞা বললেন, আপনার কি দরকার?
ওয়াছেদ স্যার আমার পরিচয় দিয়ে বললেন, ওকে একটা ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিন। ওয়াছেদ স্যার চলে গেলেন।
ভিড় ফাঁকা হয়ে গেলে হান্নান মিঞা আমাকে বললেন, তুমি এক কাজ করো। তোমার যেমন ইচ্ছা একটা সার্টিফিকেট লিখে আনো, আমি সই করে দেব। তোমার যা মন চায় লিখবে। আমি আমাদের স্কুলের কেরানী বৈদ্যনাথ কুণ্ডুর কাছে গিয়ে সব বললাম। শুনে উনি হেসে বললেন, সার্টিফিকেট মানে সুপারিশপত্র। সেতো ওই রকমই হয়। এম.এল.এ. ওই রকমই বলেছেন--তোমার কপাল ভালো।
তিনিই একখানা সার্টিফিকেট টাইপ করে দিলেন। আমি সেটা নিয়ে গিয়ে এম.এল.এ.-কে দিলাম। তিনি বললেন, পড়ে দেখেছ-ঠিক আছে তো? এরপর তাঁর নাম স্বাক্ষর করে সিলমোহর করে দিলেন। বললেন, দেখ যদি কাজে লাগে। যদি উপকার হয় খুশি হবো। তোমাকে তো চিনতাম না। পরিচয় হলো। নিজেদের লোক-দাদার ছাত্র। তোমার যখন প্রয়োজন হবে, আমার কাছে চলে আসবে। তোমাদের সাহায্য করতে পারলে তো আনন্দই হয়।
মুসলিম লীগের কার্যকলাপ ক্রমেই প্রকাশ্যে আসতে থাকল। ওদের শ্লোগান যেমন ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’, তেমন সকন্ঠ আমরা নই। যেন ‘যুদ্ধং দেহি’ ভাব। প্রথম থেকেই মুসলমানরা এসে শহরের পথে পথে মিছিল করতে থাকল। সেই সঙ্গে শুরু হল, মিটিং জনসভা।
মেহেরপুর মিউনিসিপ্যালিটির অফিস বাড়ির পিছনের মাঠটা ছিল জনসভার মাঠ। পরিচিতি ছিল তেঁতুল তলার মাঠ নামে। মাঠের পশ্চিমে পথের পাশে দুটো প্রাচীন তেঁতুল গাছ ছিল। মিউনিসিপ্যালিটি গাছ দুটিকে রেখেছিল ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসাবে। মুর্শিদাবাদের নবাব এখানকার এক গোয়ালা পরিবারকে জমিদারি দিয়ে রাজা বানিয়ে ছিলেন। গোয়ালা চৌধুরী নাম ছিল সে রাজবংশের। কিন্তু তাঁরা টিকতে পারেননি। মারাঠী ঠগীর দল ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে মেহেরপুরে এসে সেই রাজবংশকে ধ্বংস করেছিল। সেদিনের সেই ধ্বংসলীলার সাক্ষী ওই গাছদুটি। তাই ওদের রক্ষা করা হয়েছে। তাই মাঠের নাম তেঁতুল তলার মাঠ।
ওখানে একজিবিশন হয়। ঘর তুলে অস্থায়ী সিনেমা চলে। ছেলেরা ফুটবল খেলে। আর জনসভা হয়। কংগ্রেসের সভা হতো, তারপর কম্যুনিষ্ট পার্টির সভা। এখন চলছে মুসলিম লীগের জনসভা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিবর্তনের ছবি যেন দেখা যাচ্ছে এই জনসভার মাঠে।
একটা বড় জনসভা হলো। মুসলিম লীগের বাইরে থেকে কিছু বড় মাপের নেতা এলে গ্রাম থেকে শত শত মানুষ এসে মাঠ ভরে ফেলল।
মাঠের কাছেই বাজার। বাজারের দোকানীরা ভীত হয়ে পড়েছিল অঘটনের আশঙ্কায়। সভায় রহিম সেখ, কাদের মিঞা, হান্নান মিঞা সকলেই উপস্থিত।
একজন বক্তার নাম খুব প্রচার করা হয়েছিল। তাঁর নাম মৌলানা রহমান ব্যানার্জী।
এঁদের বক্তৃতা শোনার জন্য কৌতূহল জেগেছিল। তাই মিউনিসিপিল্যাটির সামনের মাঠে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেখানে অনেক হিন্দু শ্রোতাই ছিলেন। মাইকের ব্যবস্থা ছিল, তাই শোনার অসুবিধা হচ্ছিল না। রহমান ব্যানার্জী মঞ্চে উঠলেন। কুচকুচে কালো, মধ্যবয়সী ব্যক্তি। দেখে হাবসীদের কথা মনে পড়ে। তিনিও হিন্দু ছিলেন। সেটা প্রমানের জন্য সংস্কৃত শ্লোক মুখস্থ বললেন। তারপর তিনি কেন ইসলাম ধর্মকে বরণ করলেন-অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম কতো মন্দ সেটা বলে শুরু করলেন, গোস্ত কথার তাৎপর্য।
এই সব কথা শুনতে শুনতে কান পচে গিয়েছিল। কত যে মামুলি এইসব কথা। তখন স্কুলে পড়তাম আমার এক সহপাঠী ছিল আজিজুল হক। তার বাড়ি ছিল বুড়িপোঁতা গ্রামে। তার পরনে ধুতি, গায়ে সার্ট, খালি পা। গ্রামের চাষী পরিবারের ছেলে। হঠাৎ সে শোনাতে থাকল গোমাংসের গুণাগুণ ও স্বাদের কথা।
বাবা শুনে বলেছিলেন, গ্রামেও তাহলে বিষ ছড়ান শুরু হয়েছে।
কৃষ্ণনগরে কলেজে আমার সহপাঠী একজন মুসলমান ছাত্র, সহপাঠিনী রূপসী এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে প্রণয়লিপি পাঠিয়েছিলো। রেজিস্ট্রি ডাকে কলেজের ঠিকানায়। ফলে বিষয়টা জানাজানি হয়েছিল দ্রুত। সেটি অধ্যক্ষ এবং দুপক্ষের ছাত্র নেতারাই পড়েছিলেন। আমিও পড়েছিলাম। সে চিঠির বেশিরভাগ অংশ ছিল-- হিন্দু ধর্ম বিষয়ে কুৎসা। লিখেছিল তোমাদের ভগবান-ভগবতী গরুকে আমরা কেটে খাই। তোমাদের পবিত্র গঙ্গা নদীতে আমি প্রস্রাব করি। এই রকম সব উক্তিতে ভরা ছিল সে চিঠি।
সে সহপাঠী আমার পরিচিত ছিল। গ্রামের চাষীর ছেলে। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তুমি প্রেমপত্রে এসব ধর্ম নিয়ে লিখলে কেন?
সে বলেছিল-ওটাতো আমাদের জেহাদ। আমরা দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাস করি। আমাদের ধর্ম উঁচু। তাই ওকে বলেছি তোমাদের নোংরা ধর্ম ছেড়ে আমাদের ঘরে চলে এসো।
মৌলানা রহমান ব্যানার্জীর বক্তব্যের সেই কথা। স্পষ্টভাবেই দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা বললেন। সোজা বললেন, আমরা মুসলমান। আমরা পাকিস্তান চাই। কেউ রুখতে পারবেনা আমাদের। আমরা বীরের জাতি। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।
তারপর কত বক্তা বললেন, কত রকম ভাবে-ওই একই কথা--দ্বিজাতি তত্ত্ব। হিন্দু-মুসলমান দুটি পৃথক জাতি। এক সঙ্গে কেন থাকব? আমরা মুসলমান রাষ্ট্র চাই।
দুরে বসে এসবের ভালো মন্দ বিচার করা যায় কিন্তু সেদিন সেই স্থানে শ্রোতা হিসাবে দাঁড়িয়ে কত যে মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। ওরা পাকিস্তান চাচ্ছেন। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে হিন্দু সমাজ। ওরা বলছেন লড়াই করে আদায় করবেন। কার সঙ্গে লড়াই?
এখানেই মনে কেমন এক ভীতির সঞ্চার হয়।
এই সময়ে একদিন কাশীকান্ত মৈত্র মেহেরপুরে এসে উপস্থিত। কার সূত্রে এসেছিলেন আজ আর সেকথা ঠিক মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে তিনি এসে উঠেছিলেন ডা: কানাই লাল চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। তাঁর দৌহিত্ররা- বিজয়, অজয়, জয় স্কুলের ছাত্র ছিল। তারা কংগ্রেস দলভুক্ত ছিল। কংগ্রেস তখনও দুটি দলে বিভক্ত তাই ফরোয়ার্ড ব্লক-এর ছাত্র সংগঠন গড়ার চেষ্টা হচ্ছিল। সে সময় হিন্দু ছাত্রদের অধিকাংশই ছিল কংগ্রেস পন্থী। যারা প্রকাশ্য রাজনীতি করত না, তারা সমর্থক ছিল। কাশীবাবু এই ছাত্রদের নিয়ে একটি ছাত্র সংগঠন খুলেছিলেন। তার সম্পাদক করা হয়েছিল আবদুল কুদ্দুশ ফারুককে। তার নামটা ছিল অনেক বড়। আমি ফারুক বলেই ডাকতাম। সে ছিল আবার রহিম কাকার বড় ছেলে। তখন সে বোধহয় দশম শ্রেণীতে পড়ে কিম্বা ম্যাট্রিক দিয়েছে। ফারুক ছিল বুদ্ধিমান, রুচিশীল এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিল কিন্তু সংযত ছিল। তাকে আমি ভালোই চিনতাম। সে আমার সঙ্গে শান্তিনিকেতন ভ্রমণে গিয়েছিল একবার। সে সময় তার কাছে জল চাওয়ায় সে অবাক হয়েছিল। তাকে জল আনতে বলেছিলাম। সে বলল, আমি আনব? আমি বললাম, হ্যাঁ তোমাকেই তো বলছি।
সে জল আনল, আমি পান করলাম। সে বলল, আমিতো এটা জানতাম না। আপনাকে নতুন করে জানলাম।
তার এই অবাক হওয়ার কারণ তখন মেহেরপুরের সমাজে জাত-পাত, ছোঁয়াছুঁয়ি-রক্ষণশীলতা ছিল প্রবল।
বাবা ভাইস-চেয়ারম্যান এবং লীগ নেতা হওয়ায় শহরে হিন্দু সমাজেও ফারুকের বিশেষ খাতির ছিল। তবু সেই ফারুককে ছাত্র সংগঠনের সেক্রেটারী করায় আমি কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম। আমি ওই দলে ছিলাম না। আমি কাশীবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সে সময় প্রশ্ন করেছিলাম--ফারুককে সেক্রেটারী করা হল কেন? দলে তো আরও প্রভাবশালী ভালো সংগঠক সদস্য ছিল। মুসলমান বলে কি?
-হ্যাঁ তাই। কাশীবাবু বলেছিলেন। দলে মুসলমান ছেলেদের বেশী করে টানা দরকার। বিচ্ছিন্নতার মনোভাবের কালে মিলনের পরিবেশ পরিস্থিতি গড়ে তোলা বিশেষ প্রয়োজন। তা করতে গেলে এই রকমইতো করতে হবে। নানা কারনে যারা আসতে চায় না, এড়িয়ে চলতে চায়-তাদের বিশেষ মর্যাদা দিয়ে কাছে টানা দরকার।
ঠিক এই রকম চিন্তার কথাই বলেছিলেন কাশীবাবু। আমার মনে ধরেছিল কথাগুলো। কিন্তু মনে সংশয় ছিল, ধরে রাখা যাবে তো? ফারুককেও ধরে রাখা যায়নি। সংকটটা যে ছিল ধর্মের। মেহেরপুর শহরে কম্যুনিষ্ট পার্টি করতেন যাঁরা-তাঁরা সকলেই ছিলেন হিন্দু। তাঁরা বলতেন যে তাঁদের দলই ধর্মনিরপেক্ষ-কিন্তু গ্রামে চাষীদের মধ্যে মুসলমান সদস্য থাকলেও শহরে সকল নেতৃস্থানীয় সদস্যই ছিলেন হিন্দু এবং উচ্চবর্ণের।
পরিবেশটাই তখন এই রকম। অনৈক্যের প্রবল হাওয়ায় ঐক্যের বাতাবরণ তৈরী করা ছিল কঠিন কাজ। তা করবার পথই বা কি হতে পারে--এটাই খুঁজে বার করা ছিল দুরূহ কর্ম।
হিন্দু সমাজে মৌলবাদীদের অভাব ছিল না। তাঁদের একটা বিশ্বাস ছিল যে মুসলিম লীগ যতই চীৎকার করুক-পাকিস্তান পাবেনা তারা। দেশ বিভাগ হবে না। কত রাজনৈতিক হল্লাই তো হয়। তার ফল কি হয়? কংগ্রেসের মত শক্তিশালী দল বলল, ইংরাজ ‘ভারত ছাড়’। কি হলো? ইংরাজ কি ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাল? কিন্তু দেশ জুড়ে একটা অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হল। সাধারণ মানুষ কিছু দিন কষ্ট পেল। লীগের ওইসব চিৎকার কিছুটা অরাজক অবস্থা তৈরী করছে। হিন্দুদের সংহতি দরকার। শক্ত হওয়া উচিত।
শহরে কিছু উকীলবাবু ছিলেন যাঁরা হিন্দু মহাসভার সমর্থক। কাজে কিছুই করতেন না। শুধুই সমর্থক। এই রকম এক উকীলবাবুর বাড়িতে তাঁরা একটা সভা ডাকলেন। আমাকেও ডাকা হয়েছিল। গেলাম। বলা হলো মুসলিম লীগের উত্থান আমাদের কাছে অশনি সংকেত। হিন্দুদের সতর্ক হতে হবে। কিন্তু তাদের নির্দিষ্ট স্পষ্ট কোন কর্মসূচী ছিল না বলেই মনে হলো। উকীলবাবুরা কিছুক্ষণ ধরে বক্তৃতা করলেন। লীগের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেন। তারপর একটা কর্মসূচী বার করলেন। কোন হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করা হলে সে যদি আবার পূর্ব ধর্মে ফিরে আসতে চায়, তাহলে তাকে গ্রহণ করা হবে।
যদি কোন নারী ধর্ষিতা হয়, বলপূর্বক অপহৃতা হয়, তাদের বর্জন করা হবে না। সমাজে সসম্মানে তাদের গ্রহণ করা হবে। শুধু তাই নয়, যদি অন্য ধর্মের কেউ হিন্দু হতে চায়, তাহলে তাকে গ্রহণ করা হবে, হিন্দু করে নেওয়া হবে।
এই খানে আমি প্রশ্ন তুললাম, হিন্দু সমাজতো বর্ণাশ্রমী। অন্য ধর্ম থেকে যে আসবে তাকে কোন বর্ণে স্থান দেওয়া হবে?
এক উকীলবাবু বললেন, সে যে বৃত্তিতে ছিল এখানে সেই বর্ণে ঠাঁই পাবে।
আমি বললাম, একজন শিক্ষক যদি হন তিনি?
আরেকজন উকীলবাবু বললেন, তিনি ব্রাহ্মণ হবেন। আরেকজন বললেন, ওসব জাতপাতের প্রশ্ন উঠছে কেন আগেই। আগে হিন্দু হোক, তারপর আপনিই একটা ব্যবস্থা হবে।
আমি বললাম, প্রশ্নটা এই কারণে যে, যদি কেউ সপরিবারে ধর্মান্তরিত হন তাহলে তাঁর ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে হবে তো। যদি তিনি অবিবাহিত হন, তাহলে তিনি সংসারী হতে চাইবেন, তখন?
উত্তর হল, যাকে ব্রাহ্মণ করা হবে-তিনি ব্রাহ্মণ সমাজেই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করবেন।
-ব্রাহ্মণরা কি সম্মত হবেন?
-আমরা বলব, যিনি সম্মত হবেন, তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক হবে।
আমি প্রশ্ন করলাম, তাহলে যেসব অব্রাহ্মণ হিন্দু শিক্ষকতা করছেন, তাঁদের ব্রাহ্মণ সমাজে প্রবেশ করতে হলে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে, তারপর আবার হিন্দু হতে হবে? এসব প্রশ্নের মীমাংসা না হলে প্রচার করা যাবে কি ভাবে?
উকীলবাবুরা ক্ষিপ্ত হলেন। বললেন তুমি আমাদের সভা ভেঙে দিতে এসেছো। আমি বললাম, আপনারা ডেকেছেন।
তাঁরা সভা ভেঙে দিলেন।
দুর্ভিক্ষ, আকাল-অনাহার কাতারে কাতারে মানুষের মৃত্যু; লঙ্গরখানা-সামান্য খিঁচুড়ি বিতরণ, কন্ট্রোল, কালোবাজারি, ভেজাল। বাতাস ধ্বনিময় - কংগ্রেসের ধ্বনি, কম্যুনিষ্টদের ধ্বনি, আজাদহিন্দ ফৌজের ধ্বনি, মুসলিম লীগের ধ্বনি। কে কার কথা শোনে। জনজীবন বিপন্ন, অসহায়, সব কিছুই গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে তাদের। জানে না কোথায় চলেছে তারা, কোন পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের।
১৯৪২ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ৯ আগষ্ট তারিখে ঘোষণা করেছিল ‘ইংরাজ ভারত ছাড়ো’। মুসলিম লীগ ঘোষণা করল ১৯৪৬ সালের ৯ আগষ্ট তারা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালন করবে। তাদের দাবী পাকিস্তান রাষ্ট্র। এজন্য তারা আবেদন নিবেদন করবে না। তারা লড়াই করে তাদের দাবী আদায় করবে। তাদের স্লোগান-- ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’।
কিন্তু এই ঘোষণা অস্পষ্ট, হেঁয়ালির মতো। এই যে সংগ্রাম-এটা কার বিরুদ্ধে?
ইংরাজ শাসক তো ভারত ভাগ করে পাকিস্তান দিতেই চায়। বাধা কংগ্রেস, বাধা হিন্দু সমাজ। তবে কি হিন্দুর বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম, এ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।
8
সকাল বেলা। বাজারের থলি হাতে বাড়ি থেকে বার হলাম। দেখি সামনের বাড়ি থেকে তাঁর বড় ছেলে অনিরুদ্ধ বাগচি--নালু, আমার পাড়াতুতো কাকা বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। তাঁর হাতে একটা সুটকেস, ছোট।
নালুকাকা P.W.D.'র ওভারসিয়ার। দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন। অনেক চেষ্টার পর এবার বদলি হয়েছেন। চেষ্টা করেছিলেন নদীয়াতে আসতে। তা হয়নি। কলকাতার সদর দপ্তরে বদলি হয়েছেন। দিনাজপুর থেকে বাড়ি এসে দেখলেন, তাঁর একটি কন্যা সন্তান জন্মেছে কদিন আগে। এটাই তাঁর প্রথম সন্তান। মেয়ে জন্মাল আর তিনি বদলি হলেন। খুব পয়মন্ত মেয়ে। বাড়িতে আনন্দ স্রোত বইছে। মা বলছিলেন, সবাই মিলে আমরা ধরলাম নালুকে, ভোজ দাও। সন্দেশ খাওয়াও। নালুকাকা বললেন, সব হবে। সন্দেশ দেব। ভোজ দেব। আগে কলকাতায় যাই, কাজে যোগ দিই। কলকাতা থেকে ফিরে সব হবে।
নালুকাকা আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাছে গিয়ে দুজনে পাশাপাশি চলতে লাগলাম কথা বলতে বলতে।
নালুকাকা বললেন, শুনলাম তুমি স্কুলে মাস্টারিতে ঢুকেছ? বাবা-ছেলে দুজনেই এক জায়গায় দুজনেই মাষ্টার, খুব ভালো। তোমাদের বাড়িটা মাষ্টারবাড়ি হয়ে গেল। আর তোমাদের ওই কাজই ভালো। বদলি নেই। বাড়ি বসে চাকরী। আমি কতদিন ধরে চেষ্টা করে-তবে বদলি হতে পারলাম।
-শুনলাম মেয়ের কপালে বদলি-
-হ্যাঁ, ব্যাপারটা সেই রকমই।
-বাড়িতে সবাই খুশির ভোজ চাইছে, মার কাছে শুনলাম।
-হ্যাঁ গো। নালু কাকা হাসলেন। আমিতো বলেছি ভোজ দেব। কলকাতায় গিয়ে চাকরীতে যোগ দিয়ে ফিরে এসে সব হবে। আজ কলকাতায় যাচ্ছি, অফিসে যাব, জয়েন করব-
-আজই ফিরবেন?
-দেখি। না পারলে, কাল সন্ধ্যায় ফিরব।
-আজ কলকাতায় যাচ্ছেন?
-কেন বলোতো-
-আজ ১৫ আগষ্ট। মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস।
-তাতে কি হয়েছে? অমন কত আন্দোলনই তো হয়। আন্দোলন হল্লা তো দেশে লেগেই থাকছে। কি আর হবে? বড়জোর অফিসগুলো বন্ধ করে দেবে। কাজ হবেনা। জয়েন করা হবে না। থাকতে হবে আজ কলকাতায়। কাল জয়েন করতে হবে। যাই গিয়ে দেখি। তেমন বুঝলে, একটা হোটেলে থেকে যাব। একটা মিছিল বেরোবে, চেঁচাবে, ট্রাম-বাস বন্ধ হবে, কলকাতায় যা হয়ে থাকে।
দুজনে গল্প করতে করতে বাজার পর্যন্ত এলাম। মেহেরপুরে রেলস্টেশন ছিলনা। আমাদের রেলস্টেশন ছিল চুয়াডাঙ্গা। মেহেরপুর থেকে আঠার মাইল দূরে। যাত্রীবাহী মটর গাড়ি চলত। বাজারের চৌমাথার মোড়ে এসে নালুকাকা গাড়ি ধরতে চলে গেলেন। আমি বাজার করতে গেলাম।
বাজারের কেনাকাটা সেরে সেই চৌরাস্তার মোড়ে এসে দেখি কাদের মিঞা ব্যস্তভাবে ঘোরাঘুরি করছেন। তার র্যালে সাইকেলটা একটা দোকানের দেওয়ালে হেলানো আছে।
কাদের মিঞা সুরজমল আগরওয়ালার কাপড়ের দোকান থেকে একটা টুল এনে মাঝ পথে রাখলেন। তারপর তার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে কাঁধে ঝুলান টিনের ছোট চোঙটা হাতে নিয়ে মুখের সামনে ধরলেন। তারপর হাতে একটা কাগজ নিয়ে সেটা দেখে পড়তে থাকলেন। তিনি যা বললেন, তার মোদ্দা কথা হচ্ছে-আজ মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস। আমাদের দাবী পাকিস্তান। সেই দাবী আদায়ের জন্য আমাদের এই সংগ্রাম। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম-ডাইরেক্ট অ্যাকশান। দাবী না মেটা পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলবে। এরপর ওদের দলের ধ্বনি দিতে থাকলেন।
আমি পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। তিনি টুল থেকে নামতেই আমি বললাম, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কার বিরুদ্ধে?
তিনি বললেন, তুমি আবার আমার পিছনে লাগলে?
আমি বললাম, আপনি সংগ্রামের কথা বললেন। কার বিরুদ্ধে তাতো বললেন না।
তিনি বললেন, এই দেখ ভাই। যা লেখা আছে আমি তাই বলেছি।
-সংগ্রাম কি আমাদের বিরুদ্ধে? তাহলে মারুন, আমরা কি পালাব?
কাদের মিঞা হেসে বললেন, তুমি শিক্ষিত ছেলে, ওসব কথা বলছ কেন? তোমার সঙ্গে আমার কি সেই সম্পর্ক? হিন্দুস্থান-পাকিস্তান যাই হোক আমরা সবাই একই রকম থাকব। নবাব বাদশার রাজত্বে কি থাকিনি? আজ আমি খুব ব্যস্ত-অনেক কাজ। আরও অনেক জায়গায় যেতে হবে ঘোষণা করতে।
এরপর কাদের মিঞা দোকানে টুল ফিরিয়ে দিয় সাইকেলখানা টেনে নিয়ে তাতে চড়ে ব্যস্তভাবে জলে গেলেন। আমি দু'পাশের দোকানীদের দিকে তাকালাম। তারা হাসাহাসি করছিল। একজন আমাকে প্রশ্ন করল, কাদের কি বলছিল? খুব বড় নেতা হয়েছে।
কাদের মিঞা একদিন এই বাজারে দর্জি ছিলেন। দোকানীদের কাছে সেই কাদেরই থমকে আছে। তাই কাদের মিঞা গুরুত্বহীন। রসিকতার পাত্র।
কাদের মিঞা যাই বলুন, তাঁর আর তাঁদের উদ্দেশ্যকে যতই গোপন করুন, আমাদের অনুমান আর আশঙ্কাই সত্য হলো।
মেহেরপুরে টেলিফোন, রেডিও ছিল না। সংবাদপত্রই ছিল প্রধান সংবাদ মাধ্যম। আর ছিল ডাকঘরের টেলিগ্রাম। সরকারি জরুরী বার্তাও আসত টেলিগ্রামে।
তখন এখানকার পোস্ট মাস্টার ছিলেন যুগলপদ বসাক--আমাদের প্রতিবেশী। তিনি রাত্রিবেলা জানালেন, কলকাতার অবস্থা খুব খারাপ। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছে। কলকাতা থেকে এস.ডি.ও.'র কাছে ফোন এসেছে।
পরদিন সকালে অল্প সংখ্যক সংবাদপত্র এলো। তাতেই দাঙ্গা সম্পর্কে সংবাদ ও ছবি মিলল। দাঙ্গার ভয়াবহতার কিছু বিবরণও মিলল। মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের লক্ষ্য কি ছিল সেটা স্পষ্ট হলো। ওরা তো বলছেই লড়াই করে পাকিস্তান নেব। ওরা তো ইংরাজ শাসকের বিরুদ্ধে কোন লড়াই করেনি কোনদিন। ইংরেজ শাসক তো ওদের পক্ষভুক্ত।
পরদিন থেকে সংবাদপত্র আর মিলল না, কয়দিন ট্রেন চলাচল বন্ধ। কলকাতার জনজীবন বিপর্যস্ত। কদিন পর অবস্থা কিছুটা শান্ত হলে, সংবাদপত্র আসতে শুরু করল। কলকাতার খবর মিলতে থাকল। মেহের পুরের পরিবেশ শান্ত। কিছুটা থমথমে ভাব। কারণ এই গ্রামীন পরিবেশে বসে কোন পক্ষই পরিস্থিতি ও পরিণতি ঠিক বুঝতে পারছে না। কারণ কলকাতায় কোন পক্ষই কম যাচ্ছে না। মার ও তার পাল্টা মার চলছে।
কিন্তু আমাদের নালুকাকা ফিরলেন না। তাঁর অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে তিনি সেদিন অফিসে যাননি, কাজে যোগ দেননি। নানাভাবে খোঁজাখুঁজি, তল্লাসী শুরু হলো। সংবাদপত্র, পুলিশ এবং আত্মীয়স্বজন তৎপর হলো।
সংবাদ এলো জবাকুসুম তেল কোম্পানীর মালিক তাঁর পুরাতন ভৃত্য কর্তৃক নিহত হয়েছেন। মালিকের নাম সম্ভবত সি.কে. সেন। তিনি কলকাতার মানুষ। কিন্তু মেহেরপুরের জমিদার মল্লিক পরিবারের বড় তরফ রাম মল্লিকের জামাই।
শোকাভিভূত রামবাবু মেহেরপুরের স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানালেন এই স্কুলের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী মুসলমান ছাত্রদের ভিতর যে সর্বোচ্চ নম্বর পাবে অর্থাৎ প্রথম হবে তাকে জামাই-এর নামে স্মারক স্বর্ণপদক দেওয়া হবে।
স্থানীয় কোন এক মুসলমান নেতা এই প্রস্তাব সম্পর্কে মন্তব্য করলেন, মুসলমান প্রজার রক্ত চোষা জমিদার এমন কি বেশি দিয়েছেন।
নালুকাকার সংবাদ মিলল না। তিনি ফিরেও এলেন না। বাড়ীতে শোকের করুণ পরিবেশ। নবজাত শিশুকন্যার পরিচয় হয়েছিল পয়মন্ত। এখন নাম হয়েছে ডাইনি, বাপখাকী। মা নবজাত কন্যাকে কোলে নিয়ে আঁতুড় ঘরে বসে নীরবে চোখের জল ফেলছেন। নালুকাকার মায়ের হৃদয়ভেদী কান্নার স্বর বিষণ্ণ করছে পাড়ার বাতাসকে।
বাড়ির কাছে নদী। সেই নদীর ঘাটে স্নান করি। ঘাটে স্নানার্থী পুরুষদের বেশ ভীড় হয়। দেখি সেই ভীড়ের মধ্যে জলে দাঁড়িয়ে রহিম কাকা স্নান করছেন। আমি জলে নেমে তাঁর পাশে চলে গেলাম। তিনি বললেন, তোমার কথাই ভাবছিলাম। আজ দেরী করে ফেলেছ। বললাম, ভাবছিলাম আজ আর ঘাটে নামব না। বাড়িতে কুয়োর জলেই স্নান করব। মনটা ভালো নয়।
-কেন?
-প্রতিবেশী রাইপদ বসাকের ছেলেটা কলকাতায় গেল। আর খোঁজ নেই, আর ফিরল না, ফিরবেও না।
-নালুর কথা শুনেছি। নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।
মানুষের প্রাণ অমূল্য সম্পদ। সেই প্রাণ যদি অকালে চলে যায় তাহলে সেটা খুবই দুঃখের। কিন্তু অঘটন তো সকল সময়েই হাতের বাইরে। তার ফল ভোগ মানুষকে করতেই হয়।
সেই কারণেই দ্বিজেন্দ্রলাল লিখেছেন--“গিয়াছে দেশ, দুঃখ নাই/আবার তোরা মানুষ হ।"
দ্বিজেন্দ্রলাল বড় কবি। আমার খুব ভালো লাগে তাঁর লেখা। অভিনয় করতাম, তখন তাঁর নাটক পড়েছি। মন অন্য জগতে চলে যায়। কী লেখাঃ
"আমার এই দেশেতেই জন্ম
যেন এই দেশেতেই মরি।"
নালুকে খুব চিনতাম। ভলো ছেলে ছিল। খুবই দুঃখের কথা।
পথে কাদের মিঞার সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখে সাইকেল থেকে নামলেন।
-তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম।
-কেন?
-আমি তো শহর বুথ কমিটির একজন সদস্য। আমার ওপর দায়িত্ব বর্তেছে-আমার এলাকার মধ্যেকার দুঃস্থ অসহায় মহিলাদের তালিকা জমা দেওয়ার। আমি সুপারিশ করলে তারা বিনা মূল্যে চাল, গম পাবে। কাপড় পাবে, কম্বল পাবে। তোমাদের পাড়ার সকলকে তো চিনিনে। তুমি ভাই একটা নামের তালিকা করে দাও। আমি সেটা জমা দিয়ে দেব। তুমি দিলে আমার আর চিন্তা থাকবে না। বিশ্বস্ত লোক না হলে তো বলা যায় না। আর আমরা থাকতে গরীব মানুষগুলো কষ্ট পাবে-সেটা তো খারাপ। বুথ কমিটিতে গেছি-দায়িত্বপূর্ণ পদ।
কলকাতার দাঙ্গার পর হিন্দুদের মনে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল-সেটা তাদের মনে কাজ করে চলছিলই। মুসলমানদের এড়িয়ে চলার প্রবনতা আরও বেড়ে গেল। জেগে উঠল তাদের প্রতি অবিশ্বাস, সন্দেহ। বাইরের জীবনযাপন ধারা আগের মতই চলছিল। কলকাতায় গান্ধীজী এলেন। প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দী গান্ধীজীর প্রার্থনাসভায় গিয়ে বলতে থাকলেন, এতে লোকের মনে আশার সঞ্চার হলো। যাক, মিটে গেলো, ভালো হলো।
কিন্তু অক্টোবরে নোয়াখালিতে জ্বলে উঠল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন। (ক্রমশ। পরবর্তী সংখ্যা, জনুয়ারি, ২০২৫)