সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
বাঙালীর ইতিহাস, আদিপর্বে নীহাররঞ্জন রায় দেখিয়াছেন লাউ এর খোল আর বাশের ডাঁট বা দণ্ড তন্ত্রী বা তার লাগিয়ে একদল মানুষ ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর এই বক্তব্যের সমর্থনে তিনি এমন মন্তব্যও করেছেন যে এই গানগুলি ছিল নীতিকবিতাধর্মী। সেখানে ছিল প্রাণের আবেগ। প্রাচীন বাংলার কৃষিনির্ভর জীবনের সমৃদ্ধি ও অভিজ্ঞতা ছিল পরিমিত। মন্দিরস্থাপত্য বা ভাস্কর্য স্থাপত্যের ক্ষেত্রে কোনও দুঃসাহসিক স্থায়িত্ব রেখে যায় নি।
নীহাররঞ্জনের এই ভাবনাটুকু সম্বল করে যদি আমাদের ভাবনাটুকুকে এগিয়ে নিয়ে যাই, তা হলে একটাই প্রশ্ন উঠবে, এই বৈতালিকের দল কি কেবল রাগরাগিনী চিহ্নিত সুরকাঠামোয় গড়ে উঠেছিল? তাহলে মৌখিকসাহিত্যের হাত ধরে নতুন কোনও ব্রাত্যজনের গান গড়ে উঠেছিল? তাহলে আমাদের মেনে নিতে হয় যে উচ্চকোটির শিষ্টসাহিত্যের সঙ্গে নিম্নকটির শিল্পসাহিত্যসঙ্গীতেরও বিকাশ ঘটে। এই দিক থেকে দেখতে গেলে আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার ভূসীমা, নৃতাত্বিক, ভাষাতাত্বিক পরিচয়, বিভিন্ন ধর্ম আন্দোলনের প্রভাব যা দিয়ে আমরা বাংলা ও বাঙালীকে চিহ্নিত করব। সুতরাং বাঙলা ও বাঙালীর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমরা বাঙালী বলতে কাদের বোঝাই। মোটামুটি ভাবে আমরা দুই বাংলার বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ইত্যাদির কথা ভাবি। এর মধ্যে আছে শিষ্টসাহিত্য এবং লৌকিক সমাজউদ্ভূত মৌখিক ঐকমত্যর ধারা। এই দুইয়ে মিলে বাংলা লোকগানের বিরাট ভাঁড়ার তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এরই সঙ্গে বাংলা লোকগানের আর একটি বর্গীকরণ করতে পারি। পূর্ববর্তী বর্গীকরণ ছিল মূলত ভৌগলিক কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখি আর একটি বর্গীকরণ। তা হল ধর্মীয় সামাজিক বর্গীকরণ। এই বর্গীকরণের দুটি প্রকার। এক উল্লম্ব এবং অার একটি আনুভূমিক। উল্লম্ব অর্থাৎ বর্ণাশ্রম প্রথা এবং অন্যদিকে আনুভূমিক অর্থাৎ জাতপাতভিত্তিক। মনে রাখতে হবে এই দুই ধরনের বর্গীকরণের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে ব্রাহ্মণ্যশ্রী। বাংলার লোকগান তাই ব্যপ্তিতে বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে।
সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে, গোটা হিন্দু সমাজই এই কাঠামো মেনেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু পাশাপাশি আর একটা কথাও মনে রাখতে হবে। তা হল ভারত আসলে একটি বিশাল জনপদ। এই বিশাল জনপদের ভিতরে অনেকগুলি স্থানিক জনপদ যেগুলির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলি একটু একটু করে আলাদা। ফলে সমগ্র হিন্দু সমাজের একটি সামাজিক গঠন হলেও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ভিন্ন ভিন্ন। বর্তমান এই আলোচনায় আমি উদাহরণ হিসেবে বাংলা লোকগান নিয়ে চর্চা করলেও এর অনেক উপাদানই অন্যান্য সমকালীন ভিন্ন গানের সঙ্গে মিলে যায়। আবার অনুরূপ ভাবে উল্টোটাও সত্যি।
যাই হোক আমরা আসলে বাংলা লোকগানকে বিভিন্ন বর্গে ভাগ করে বিশ্লেষণ করি। এই বর্গবিভাজনগুলি মূলত জাতপাতভিত্তিক। কাজেই যে কোনও গান শুনলেই আমরা তাকে কোনও একটা জাতপাতের সঙ্গে জুড়ে দিই। যেমন মইষলির গান, জেলের গান, কোঁড়াদের গান, কাহারদের গাম্পইওর গান ইত্যাদি। যদিও এটা মানতে হবে যে এইসব জাতপাতভিত্তিক সমাজের মধ্যেও কিছু সামাজিক তারতম্য দেখা যায়।
এই সঙ্গে আরও একটা কথা মনে রাখা দরকার। এই সব জাতপাতভিত্তিক সমাজগুলি দুইরকম ভাবেই দেখা যায়। যেমন কখনও একটা ভৌগোলিক অঞ্চলে, আবার নানান এলাকায়। যেমন ধরা যাক ভাটিয়ালি গান। নৌকো বাইচ বা ভাটিয়ালি গান উত্তর পূর্ব অংশে প্রচলিত। কিন্তু বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নদী থাকলেও সর্বত্র নদীর গান পাওয়া যায় না। এর কারণ হিসেবে হয়তো অনুমান করা যায় প্রত্যেকটি ভৌগোলিক অঞ্চলে গান তৈরি হওয়ার মতো উপাদান থাকে না। সেই সঙ্গে এই কথাটাও বলা যেতে পারে একেকটা অংশে সুরের চলন একই রকম। যেমন রাঢ় বঙ্গে (পুরুলিয়া বাঁকুড়া-বীরভূম বর্ধমান) ঝুমুর গানের চেহারা নিয়ে উঠে এসেছে। গোটা উত্তরবঙ্গ এবং বর্তমানে আসামের অন্তর্গত গোয়ালপাড়ার গান ভাওয়াইয়া ভিত্তিক।
প্রশ্ন ওঠে, লোকগান কাকে বলে? লোকগানের কথা ছেড়ে লোক শব্দটির ব্যৎপত্তি খুঁজতে গেলে একটি বৃহত্তর পরিমণ্ডলে দেখা দরকার। যেমন ১৯৫২ খৃষ্টাব্দে folk Lore এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে গ্রাম্য সাহিত্যকে বোঝানো হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে লোক একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। folk এর প্রতিশব্দ হিসেবে লোক-এর ব্যবহার সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে।
সুতরাং লোকগানও লোকসহিত্যের অন্তর্গত একটি অংশ এবং লোকসাহিত্য যেভাবে সমাজ সম্পর্কে একটি বুনিয়াদি ধারণা দেয়, লোকগানও তেমনি সমাজ সম্পর্কে একটি বুনিয়াদী ধারণা দেয়। কিন্তু স্পষ্টত মনে রাখতে হবে এই শিক্ষা কোনও একাডেমিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়। অনেকেই লোকগানকে শ্রমজীবীদের গান হিসেবে ধরে নিয়েছেন। বিশেষত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, শক্তিনাথ ঝা খুবই জোরের সঙ্গে এই তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন।
কিন্তু লোকগান সম্পর্কে আমরা ঠিক কি বুঝি? অনেক সময় আমরা বাদ্যযন্ত্র যেমন একতারা, দোতরা এইসব দিয়ে চিহ্নিত করার চেষ্টা করি। সেই সঙ্গে কিছু প্রচলিত সুরের ছক। কিন্তু এইভাবে গানকে চিহ্নিতকরণ ঠিক নয়। বিশেষত বিংশ শতকে নানান পাশ্চাত্য বাজনা, রেডিও, গ্রামাফোন, টিভি ইত্যাদি নানান যন্ত্রপাতির জনপ্রিয়তা আমাদের ক্রমশ ধন্দে ফেলে দিল।
কোন গানকে কোন বর্গে ফেলব? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা এক কথায় খুব কঠিন। বিশেষত, লোকগান বলতে আমরা একতারা কি দোতরা বাজিয়ে গানগুলিকে বুঝি, বিশেষত একটা না দেখা ছবি যে ছবিতে আছে, মাঠ-ঘাট-নৌকো বাওয়া মাঝি, দুঃখ দারিদ্র্যসিক্ত জীবনযাপনের কাহিনী। কেন জানি মনে করা হয় গ্রামীণ জীবনের এ জাতীয় সহজ ও সরলভাবে সঙ্গীত সৃষ্টি ও পরিবেশনাই লোকগীতি। উপরিউক্ত এই সংজ্ঞাটির দিকে তাকালে আমাদের দুটি ধারণা চোখে পড়বে। প্রথমত, গ্রামীণ এবং দ্বিতীয়ত সহজ সরল। কিন্তু আমরা জানি যে প্রচুর গান আছে যেগুলির মধ্যে সে ধাঁধা আছে, তাকে খুব সহজ মন দিয়ে বোঝা মুশকিল। আবার দ্বিতীয়ত গ্রামীণ। কারণ একদিকে গ্রাম যেমন বদলাচ্ছে তেমনি তার বৈশিষ্ট্যও হারাচ্ছে। সুতরাং প্রাথমিক ভাবে অামরা যদি ধরে নিই বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, জাতীয়তা লৌকিকতা অলৌকিকতা, মতাদর্শ ও জীবনদর্শন, সে সব কিছুই কালের গতিতে বদলাতে থাকে। সুতরাং লোকগানের কোনও সমাজতাত্তিক অধ্যয়ন করতে গেলে এই পরিবর্তনের কথা মাথায় রাখা দরকার।
লোকগানের এই যে বিপুল সম্ভার দেখতে পাই তার কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তরে আমাদের একটু পিছন দিকে তাকাতে হবে। ভারতের হিন্দু সমাজের গঠনের দিকে তাকালে দেখতে পাব সামাজিক স্তরায়ন বলতে আমরা বুঝি বর্ণাশ্রমপ্রথা এবং অনুভূতি বলতে বুঝি জাতপাতের বিভাজন যা মূলত পেশাগত অবস্থানকে নির্দেশ করে। তবে এ কথাও মানতে হবে, যে এই সব জাতপাতের মধ্যেও অনেক বিভাজন আছে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় এই বৃহৎ বাংলার ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে বেদ পূর্ববর্তী আর্য-পূর্ববর্তী সাস্কৃতিক ধারাকে বহন করে আসছে। এখানেই লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে যে রাঢ় অঞ্চল এবং পূর্ববঙ্গীয় অঞ্চলের ভৌগোলিক এবং আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যর কারণে উভয় জনপদের চেহারা ভিন্ন ভিন্ন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর এলাকায় সুরের কাঠামো ঝুমুর আবার পূর্ববঙ্গীয় জনপদের সুর অনেক বেশি কোমল। যেমন ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া। অর্থাৎ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বৃহৎবঙ্গের বিস্তৃত জনপদ যেমন পশ্চিমাঞ্চলে পাথুরে তেমনি পূর্বও উত্তরাঞ্চলে অনেক উপলব। তবে বৃহৎবঙ্গের সামগ্রিক চেহারা প্রাক্আর্য সংস্কৃতির দেশ এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
প্রাথমিকভাবে এই দুই বিভাজন মেনে নিয়ে যদি আমরা ভারতীয় হিন্দু সমাজের দিকে তাকাই, তাহলে বাংলা গানের সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। তবে এরই সঙ্গে মনে রাখতে হবে গত ১৯৮১ সালের আদমসুমারী অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীদের মধ্যে ৫.৬৩ শতাংশ আদিবাসী, যারা আলোচিত এই স্তরায়নের বাইরে। তাছাড়াও আছে মুসলিম সম্প্রদায় যাদের এই হিন্দু সামাজিক স্তরায়নের বাইরে রাখতে হবে। কারণ এই আদিবাসী সম্প্রদায়কে উচ্চকোটির মানুষরা সেভাবে তাদের আলোচনায় সাধারণভাবে আনেন না। কিন্তু সংস্কৃতির মূলধারা বলতে আমরা যেহেতু এই উচ্চকোটিকে বোঝাই তাতে লোকমানসকে আমরা খুব কম বুঝি।
এখানে একটা বিষয় একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সেটা হল বাউল গানকে কিন্তু এই লোকগানের মধ্যে আনতে চাই না। তার মূল কারণ হল বাউল দর্শনের সূচনা ও বিকাশে বর্ণহিন্দু ও শরীয়তি মুসলমান সমাজের বিরোধিতা গোড়া থেকেই ছিল। এই দুই সম্প্রদায়ের হাতে বাউলরা নিগৃহীত হয়েছে। এমনকি তঁারা গ্রামসমাজের বাইরে আখড়া তৈরি করে থাকতেন। দ্বিতীয়ত তাদের গানের মর্মাথ উদ্ধার করা কঠিন। কারণ এক ধরনের বিশেষ- রহস্যাবৃত ভাষা ছিল যাতে তাদের বাণীর মর্মার্থ সহজে উদ্ধার করা কঠিন কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশেষ ধর্মসাধনা। তবে আমরা পরবর্তীকালে লক্ষ্য করেছি বাউলগান বলে এক ধরনের গান খুব জনপ্রিয় হয়েছে। তাঁদের বাউল না বলে বাউলশিল্পী বলাই ভালো। অর্থাৎ ভেকধারী বাউল।