সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সাড়ে তিন শতকের কলকাতার ইতিবৃত্ত রচিত হয়েছে নাগরিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে কাব্য কবিতায় কলকাতার কথা। বাংলা লোকগানে, প্রবাদে, ছড়ায় দেখা লোক সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে নগর-কলকাতা। এই কলকাতার জাঁকজমক, জারিজুরি, হুজুক-হুল্লোড় মেকি পালিশ দেখে গাঁয়ের মানুষ যেমন কৌতূহলী, তেমনি ভীত সন্ত্রস্ত; সেই অনুভূতি ধরা পরেছে লোক গানে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জেলাস্তরে। তুলে আনা যাক আঁজলা ভরে এক দুই করে
(১) যেমন পুরুলিয়ার ঝুমুর গানে—
কলকাতা দানের নানি গো
দলানপুরে পুরে এমন সুন্দর বাড়িগো।।
(২) ২৪ পরগণার লোকগানে মশক সংগীত শোনা যায়—
কলকাতার থ্যা আল রে মশা যেন সোনা বাঁধা ঠোঁট
যেখানতে দ্যায় রে কামড় যেন তরালিরই চোট।।
(৩) বাঁকুড়ার ভাদুগানে জিলিপর গন্ধ ভেসে আসে—
হে দারোগা পথ ছেড়ে দাও ভাদু যাবেন কলকাতা
কলকাতা যে গেছছিল ভাদু কী কী সন্দেশ এন্যেছে
এড়া বেড়া জিলিপি খাবা ফুলান তেলে ছেঁক্যেছে
(৪) মেদিনীপুরের টুসু গানে — গয়নায় সাজানোর কথা বলা হয়েছে—
কটকে গড়াব গয়না, ঢাকাতে চট করাব
কলকাতাকে রঙ করাব টুসু ধনকে সাজাব।।
(৫) ওই জেলার আরো এক টুসু গানে জামি জরিপের কথা শোনা যায়
আমার টুসু কলোকাতা যাবে জমি জরিপ করিতে
ডান হাতে কলমের খড়ি কানে চাঁপার ফুলাছে।।
(৬) অন্য এক টুসু গানে সন্তানের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের অাকাঙ্ক্ষার করা হয়েছে।
আমার টুসুর এক ছেলেকে পাঠালো কলোকাতা
ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো থানে দিব জোড়া পাঁঠা।।
(৭) কলকাতা শহরের বন্দনা গাওয়া হয়েছে অন্য এক লোক গানে—
শহর শহর ভালো কলোকাতা শহর ভালো
যেখানে মন বার সেখানে মরণ ভালো গো।
(৮) পুরুলিয়ার গান বাজে মাদলের তালে তালে—
আমার বেটার বিহা দিব সময় হয়েছে
কোহইলকাতার পুলিশেতে কাম মিলেছে
বাজারে মাদলে বোল ধিতাং ধিতাং
ধিন্তা ধিতাং ধিতাং।।
(৯) ছেলে মেয়ে, মদ্দা-পুরুষের চরিত্র নিয়েও রচিত গ্রাম্য গীতি—
কলকেতার পোলাপান
বাপরে কয় হুক্কা আন।।
(১০) আবার এ শহরের বাড়ি-ঘর পুরুষ মেয়ের চরিত্রচিত্রও স্থান করে নিয়েছে কোনও কোনও গানে—
কইলকেতার গাড়ি
মস্ত মস্ত বাড়ি
মদ্দাগুলায় ঘুইর্যা বেড়ায়
মাগি গুলার বাড়ি।।
(১১) নগর কলকাতার এক অনবদ্য চিত্র এঁকে রেখেছে জেলে পাড়ার সঙে—
এমন যে এই কলকাতা
কত লক্ষ লোকের অন্নদাতা
এখনও সকলের জোটে না পেটভাতা
কে নেতা, কি ভ্রাতা,
ছাতা দিয়ে মাথা রেখেছেন কার
চিনলে না মোদের?
মোরা আমড়াকাঠের ঢেঁকি
কলিকাতায় নৃত্য করে
রঙিলা ন্যাকা নেকি।।
অল ইন্ডিয়া আর্ট হিস্ট্রি কংগ্রেস এবং নরেন্দ্রপুরের চিন্তামনি কর ফাউন্ডেশনের (ভাস্কর ভবন) চেয়ারম্যান ডঃ শ্যামলকান্তি চক্রবর্তীর মূল কর্মজীবন কেটেছে ভারতীয় জাদুঘরে। ১৯৬৫-তে সেখানে যোগ দেন কিউরেটর হিসাবে। পরে ভারতীয় জাদুঘরের অধিকর্তা হন। এ ছাড়াও ছিলেন জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রাক্তন অধিকর্তা। নানা সময় যুক্ত ছিলেন কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক, আইকম, গুরুসদয় সংগ্রহশালা, বারাকপুর গান্ধী স্মারক সংগ্রহশালা, ভাষা স্মারক সমিতি, বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন, ক্যালকাটা আর্ট ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের রাজশাহী বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম প্রভৃতির সভাপতি, পরামর্শদাতা, পরিচালনমণ্ডলীর সদস্য প্রভৃতি হিসাবে। ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক।
বাংলাদেশে জন্ম শ্যামলবাবুর। শৈশবেই চলে আসেন কলকাতায়। চেতলা কর্পোরেশন স্কুল হয়ে চেতলা বয়েজ থেকে ১৯৫৮-তে স্কুল ফাইনাল উত্তীর্ণ হওয়ার পর আশুতোষ কলেজ। সংস্কৃতে স্নাতক, পুরাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর। পিএইচডি-র বিষয়, ‘পত্রবিলাস’। বেশ ক’টি বই লিখেছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় একসময় নিয়মিত লিখতেন ‘শ্যাম কাশ্যপ’ নামে। ঘুড়ি ওড়ানোর ইতিহাস থেকে মিশরের মমি— লিখেছেন হাজারো বিষয়ে।
গত মে, ২০২২-এ কালধ্বনি পত্রিকার জন্যে এই লেখাটি তাঁর দক্ষিণ কলকাতার বাড়ি থেকে সংগ্রহ করি। লেখাটি তাঁর মনের মতো হয়নি। বারবারই অশক্ত শারীরিক অবস্থার উল্লেখ করছিলেন।
প্রয়াত হ’ন, ২১ জুলাই, ২০২২। বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
একজন দক্ষ লেখক, কবি, বক্তা, প্রশাসক এবং সর্বোপরি একজন দরদী ও গুণী মানুষকে আমরা চিরতরে হারালাম।
আমাদের স্মৃতিতে মর্যাদার আসনেই থেকে যাবেন ডঃ শ্যামলকান্তি চক্রবর্তী মহাশয়।
(তথ্যসূত্র: ‘আমরা মনভাসি’ হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে সংগৃহীত ২২/০৭/২২-র অশোক সেনগুপ্ত’র পোস্ট)