সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
গতকাল, ২৬শে জুন, ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী ভারতীয়দের একটি ঘরোয়া জমায়েতে ভারতের সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন. ভি. রমন্নার সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। সেখানে আমি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম এই চিঠি। উনি অনুগ্রহপূর্বক চিঠিটি গ্রহণ করেছেন এবং পড়ে দেখবেন বলে কথা দিয়েছেন।
প্রিয় বিচারপতি
এন. ভি. রমন্না
সমীপেষু,
মুক্তির দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আপনাকে স্বাগত। আমরা যখন এখানে সমবেত আপনার কথা শুনবো বলে, তখন হোয়াইট হাউসের বাইরে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টের বাইরে এবং গোটা আমেরিকার বিভিন্ন জমায়েত স্থলে মহিলারা, সমকামী নারী ও তাদের সহযোগী জোটের মানুষেরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। তাঁরা সুপ্রীম কোর্টের ‘রো বনাম ওয়েড’ সংক্রান্ত অধিকার বাতিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
এই মুহূর্তে সিয়াটলে চলছে স্থানীয় ভারতীয়দের প্রতিবাদ। গত সপ্তাহে ভারতীয়-আমেরিকানদের বিক্ষোভ চলেছিল হাউস্টন, ডালাস, সানফ্রান্সিসকো এবং অন্যান্য বহু স্থানে। তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন কারণ তাঁদের জন্মভূমি ভারতবর্ষে ক্রমবর্ধমান ইসলামবিদ্বেষে তাঁরা মর্মাহত।
কিন্তু আপনার কাছে তো এমন প্রতিবাদ-আন্দোলন অভিনব কিছু নয়। আপনি এবং আমি যে-দেশের মানুষ, সেখানে বিক্ষোভ, ধর্ণা এবং আমৃত্যু-অনশন যাপনের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট প্রায়। এমনকি আমাদের প্রিয় ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যেও আমরা সেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ-আন্দোলনের কাছে ঋণী, যার পথপ্রদর্শক ছিলেন মহাত্মা গান্ধী।
যাই হোক, আমেরিকা ও ভারতের এই দুই দেশের প্রতিবাদ-আন্দোলন এবং আপন আপন বিশ্বাসের স্বপক্ষে চীৎকার করার জন্য দুদেশের প্রতিবাদীদের যে-মূল্য চোকাতে হবে – সে বিষয়ে একটা গভীর পার্থক্য আছে। হোয়াইট হাউস/সুপ্রীম কোর্টের বাইরের প্রতিবাদীদের এই দুশ্চিন্তা নেই যে এবার তাদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে, এই ভয় নেই যে তাদের হাজতে পোরা হবে বা রাষ্ট্র-প্ররোচিত জনতার হাতে খুন হয়ে যেতে হবে।
সুতরাং আজ যখন আপনি আমি দুজনেই ভারতের বাইরে দাঁড়িয়ে, এবং যখন আপনি এই গ্রহের ১.৩৮ বিলিয়ন মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য বিচারকের আসনে নেই, তখন আমি আপনার সঙ্গে খোলামেলাভাবে কথা বলার স্বাধীনতা নিচ্ছি এবং আপনাকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাইছি। আমি উৎসাহিত হয়েছি যখন আপনি ফিলাডেলফিয়াতে বলেছেন, “যে স্বাধীনতা, মুক্তি এবং গণতন্ত্রের জন্য আমাদের পূর্বপুরুষরা সংগ্রাম করেছেন, তাকে টিকিয়ে রাখা এবং প্রসারিত করার লক্ষ্যে নিরলস পরিশ্রম করাই বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কর্তব্য”।
আমি আতঙ্কিত হয়েছি ভিডিয়োতে দেখে তিস্তা শেতলাবাদকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, জানা গেছে বিনা সমনে, তাঁকে উকিলের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি না দিয়ে। সে আতঙ্ক এখনও সজীব। তিস্তা তাঁর সারাটা যৌবন, সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন সেইসব মানুষদের জন্য সুবিচার আদায়ের সংগ্রামে, ২০০২ সালে যাদের শারীরিকভাবে, সামাজিকভাবে এবং মানসিকভাবে দগ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। যে কোনও দিন তিনি সরে যেতে পারতেন, অনেকের মত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারতেন, পুনরাবৃত্ত লাঞ্ছনা ও হুমকির কাছে মাথা নোয়াতে পারতেন। কিন্তু কিছুতেই তিনি নিরস্ত হননি, কারণ এই দৃঢ়চেতা মহিলা তাঁর বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ।
তিস্তার পরেই গ্রেফতার হয়েছেন পুলিস অফিসার আর-বি-শ্রীকুমার যিনি প্রধানমন্ত্রী মোদী এত শক্তিধর হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই তাঁর এক বিরোধী কন্ঠস্বর। প্রাক্তন আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভাট ইতিমধ্যেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত এমন একজনকে হত্যা করার অপরাধে যার সঙ্গে তাঁর কখনো সাক্ষাৎই হয়নি। বিচার চলাকালীন তিনি সরকারপক্ষের সাক্ষীদের জেরা করার বা স্বপক্ষে সাক্ষী পেশ করার, এমনকি আত্মপক্ষ-সমর্থনে চূড়ান্ত সওয়াল (concluding remark) পেশ করার অনুমোদন পাননি। এই তিনজনের হাজতবন্দী থাকাটা ২০০২ সালে গুজরাতে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় যুক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্তদের নিঃসন্দেহে সুবিধাজনক, কারণ অন্য সাক্ষীদের অধিকাংশই মারা গেছেন, বাকীরা অদৃশ্য হয়ে গেছেন বা তাঁদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া গেছে। কেন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে অধিষ্ঠিত ক্ষমতাবানদের খুশী রাখতে ভারতের বিচারব্যবস্থা এতখানি উদগ্রীব?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন জাকিয়া জাফরির কথা, যিনি ২০০২ সালে নিজের বাড়িতে তাঁর স্বামী এবং আরও বহু মানুষের খুন হয়ে যাওয়ার বিচার চেয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। দু-একদিন আগেই তাঁর আবেদন খারিজ করা হয়েছে। অভিঘাতটা আসলে দ্বিগুণ, যেহেতু জাকিয়া জাফরির খারিজের এই রায়ের প্রেক্ষিতেই তিস্তার অনৈতিক গ্রেফতারী। সর্বোচ্চ আদালতই নির্দেশ দেয় জাকিয়াকে যারা সমর্থন যুগিয়েছেন তাঁদের বিষয়ে তদন্ত করতে। জাকিয়ার হতাশ পুত্র জানিয়েছেন, ন্যায়বিচারের জন্য তাঁরা ঈশ্বর, আল্লার উপরেই ভরসা রাখছেন। ইতিমধ্যেই তাঁদের অপেক্ষার বিশ বছর অতিক্রান্ত। এ-বছরের এপ্রিল মাসে আপনি বলেছিলেন, এই চটজলদি চাউমিনের যুগে মানুষ চটজলদি বিচার চায়। এনারা কিন্তু ‘চটজলদি চাউমিন’ আশা করেন নি; এই হতভাগ্য পরিবারটির কাছে তা ছিল দীর্ঘ, যন্ত্রণাময়, অবমাননাকর, বিপজ্জনক কুড়ি বছর। ব্যক্তিগতভাবে আমি নাস্তিক, তাই বিশ্বাস করি না স্বর্গ থেকে নেমে এসে কোনও ঈশ্বর সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। আপনি কি মনে করেন জাকিয়া জাফরি সুবিচার পেয়েছেন?
প্রতি সপ্তাহে ভারতবর্ষে রাষ্ট্র-প্রণোদিত হিংসার নতুন নতুন কুনাট্য মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে। দু-সপ্তাহ আগে সারা বিশ্ব দেখল নবীন সমাজ-আন্দোলন কর্মী আফ্রিন ফাতিমার মায়ের বাড়ি প্রকাশ্য দিবালোকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁর বাবার নামে জারি হওয়া জাল, অচল আদেশের বলে। বহু বহু মুসলিম বাড়ি ও ব্যবসাস্থল গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশে। সরাসরি মাথায় গুলি চালিয়ে, কাউকে কাউকে একাধিকবার, পুলিস হত্যা করেছে মুসলিম বিক্ষোভকারীদের। বহু পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে; শিশুদের, এমনকি যারা কথা বলা শুরু করে নি তাদেরও, ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে এমন এক নিষ্করুণ অন্ধকার দারিদ্র-প্রকোষ্ঠে যেখান থেকে তারা আর কখোনো বেরোতে পারবে না। কিছু মানুষ ট্যুইটারে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে কিছু কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট সবটা নীরবে দেখে গেছে শুধু। আপনাদের এই নীরবতা কি শাসকের শক্তিকে অনুমোদন করা নয়? মৌনতা কি সম্মতি নয়?
এটা নিশ্চয়ই আপনার নজর এড়ায় নি যে, আমাদের তথাকথিত গণমাধ্যমগুলি নিজেদের দর্শকবহুল সময়ে বিচারসভা বসিয়ে দেয় এবং বিস্ময়কর দৃঢ়তার সঙ্গে রায়ও ঘোষণা করে দেয়। সেখানে কে বলবেন, কী বলবেন, কতটা বলবেন সবটাই ঠিক করে দেন সরকারের স্নেহধন্য সঞ্চালকেরা। তাদের আলোচনায় যা বলা হয় তার অধিকাংশটাই উস্কানিমূলক বক্তব্যের হুবহু নিদর্শন। দিল্লী হাইকোর্টে আপনার মাননীয় সহকর্মীদের মধ্যে একজন বলেছেন, “যদি আপনি হাসিমুখে কিছু বলেন, তাহলে তার মধ্যে অপরাধযোগ্যতা থাকে না; আর যদি আক্রমণাত্মকভাবে বলেন, তাহলে (তার মধ্যে) অপরাধযোগ্যতা থাকে”। আপনি কি তাঁর সঙ্গে সহমত? যখন অসহায় মুসলিমদের বাড়িগুলো ধূলিসাৎ করে দেওয়া হচ্ছিল, এমনকী কিছু মূল্যবান সামগ্রী উদ্ধারের জন্য জড়ো হওয়া মানুষজন পুলিসের তাড়া খেয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন একজন বরিষ্ঠ সাংবাদিক পরিহাসছলে ট্যুইটারে বরিস জনসনকে প্রশ্ন করেছিলেন বুলডোজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা মাথায় রেখে তিনি একটি নতুন জেচিবি নির্মাণ-কারখানা গড়ার কথা ভাবছেন কিনা। চলতি বছরের গোড়ার দিকে ‘Genocide Watch’ ভারতে মুসলিম-গণহত্যার সম্ভাবনা-সম্পর্কিত সতর্কবার্তা জারী করেছে। সারা বিশ্বে স্বীকৃত এই গণহত্যা-প্রতিরোধী সংস্থাটির পরিচালক ডঃ গ্রেগরী স্ট্যানটন রোয়াণ্ডা গণহত্যার সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। ভারতের পরিস্থিতি নিয়ে ইতিপূর্বে অন্তত দুবার তিনি এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাহলে গণহত্যার আবাহন এবং সিদ্ধিও মেনে নেবো তো, যদি তা হাসিমুখে করা হয়?
খালিদ সৈফী একজন সমাজকর্মী এবং আমাদের চেনা সেই খুচরো মুসলিম ব্যবসায়ী যাঁকে মিথ্যা অভিযোগে—যে অভিযোগের কোন তদন্ত হয় নি এখনো—কারারুদ্ধ করে রাখা যায়। তাঁর স্ত্রী নার্গিস সৈফী, তিন নাবালক সন্তানের জননী, বলছেন তাঁর কন্যা প্রশ্ন করে কেন সে বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারে না, আর কেনই বা তার সঙ্গে দেখা হলেই পুলিস বাবাকে টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে নেয়ে যায়। দু-বছরের বেশী সময় ধরে খালিদ জেলবন্দী। যখন তাঁকে বন্দী করা হয় তখন কন্যা মরিয়মের বয়স ছিল ছয়। গৃহবধু নার্গিস ঘরের দায়িত্ব সামলে এসেছেন এতদিন; তাঁর স্বামীর উপার্জন এখন বন্ধ। বেঁচে থাকার সামান্যতম চাহিদা পূরণও তাই তাঁর পক্ষে দুরূহ। খালিদ জেলের মধ্যে নির্যাতনের শিকার। আপনি বলতে পারেন নার্গিস মরিয়মকে ঠিক কী বলবে? আপনি কি খালিদের মামলাটি পড়ে দেখার অবকাশ পেয়েছেন, নেহাৎ কৌতুহলবশেও? আপনি কি পারেন মরিয়মকে আশ্বস্ত করতে যে তার বাবা সুবিচার পাবে?
আপনি কি উমর খলিদের কথা শুনেছেন—সেই ঝলমলে যুবকর্মী সবসময় যার মুখে থাকে হাসি আর হাতে বই? একটা জাল ভিডিও’র ভিত্তিতে তাঁকে প্রায় দু-বছর যাবৎ জেলে আটক করে রাখা হয়েছে। একটি প্রভাবশালী গণমাধ্যম ভিডিওটি বিকৃত করেছিল। মূল ভিডিওটি দেখলে আপনি তাঁকে নিয়ে গর্বিত হতেন, কারণ সেখানে তিনি প্রশংসা করছিলেন সেই দলিলের, ভারতীয় সংবিধানের, যাকে তিনি পবিত্র মনে করেন, যার কথা আপনি এবং আপনার সহকর্মীরা উল্লেখ করেন আপন আপন কর্তব্যপালনকালে। অথচ উমর জেলবন্দী—হাসছেন, পড়ছেন, আর সুবিচারের প্রতীক্ষা করছেন। আপনি তো একসময় ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, হয়তো তাই আপনি নিজেকে মেলাতে পারবেন তাঁর প্রেরণা, উদ্দ্যম এবং ইতিবাচক থাকার ক্ষমতার সঙ্গে। আপনার কি মনে হয় ওনার কোনো আশা আছে? আমি যদি আপনাকে মিনতি করি ওনার জামিনটুকু, অন্তত, মঞ্জুর করুন, সেটা কি চটজলদি চাউমিন দাবী করার মত হবে?
যেহেতু আপনি এখন গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে অবকাশ-ভ্রমণ করছেন— যা আপনার অধিকার—আপনি হয়তো অবগত নন যে এমনকি এখন, যখন আমরা সমবেত হয়েছি গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার নিয়ে কথা বলবো বলে, গৌতম নওলাখা, রোনা উইলসন, ভারভারা রাও, আনন্দ তেলতুম্বদে, জি। এন। সাইবাবা, সুধীর দাভে, সোমা সেন, হানি বাবু এবং আরও বহু মানুষ-- যাঁদের নাম লিখতে গেলে পাতার পর পাতা ফুরিয়ে যাবে—তখন জেলবন্দী। সারা বিশ্ব তাঁদের বলছে ‘বিবেকের দায়ে বন্দী’। যেসব তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাঁরা কারাবন্দী সেগুলো পরিশীলিত স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে তাঁদের কম্পিউটারে স্থাপন করা হয়েছিল—এটা প্রমাণিত। ফাদার স্ট্যান স্বামী, একজন জেসুইট পাদ্রী, জেলখানায় ‘স্ট্র’ ব্যবহারের অনুমতিটুকুও পাননি, যে স্ট্র-দিয়ে চুমুক দেওয়াই ছিল তাঁর পারকিনসন্স-বিধ্বস্ত শরী্রে ন্যুনতম পুষ্টি-আহরণের একমাত্র উপায়। গত জুলাই মাসে জেলখানাতেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। বিচারের মর্যাদা নিশ্চিত না-করতে পারার লজ্জায় সারা বিশ্বের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
বড়-হয়ে-ওঠার সময়ে ভাবতাম চীন, রাশিয়া প্রমুখ স্বৈরাচারী দেশগুলোই শুধু বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ মানুষদের বন্দী করে রাখে; আর ভারতবর্ষে জন্ম নেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা অনুভব করতাম। কেননা স্বাধীনতার আর কী অর্থ হতে পারে ভিন্নমত পোষণের স্বাধীনতা ছাড়া, শক্তিধর মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের দিকে আঙুল তোলার স্বাধীনতা ছাড়া? ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রীডম (USCIRF) বর্তমানে ৪৪জন ভারতীয়কে ধর্মীয়-রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে চিহ্নিত করেছে। আপনার কি মনে হয় অন্যদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে ফাদার স্ট্যানের দুর্ভাগ্যের শরীক হবার জন্য, শিকার হবার জন্য? সুপ্রীম কোর্ট কি এই অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারে?
আপনি তো একজন সাংবাদিক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। আপনি কি ব্যথিত হন যখন রিপোর্টারস উইধাউট বর্ডার (RSF) ২০২২ সালের বিশ্ব স্বাধীনতা সূচকে ভারতকে ১৭০টি দেশের তালিকায় ১৫০তম স্থান দেয়? অথবা যখন শোনেন ২০১৪ থেকে ২২ জন সাংবাদিককে জেলবন্দী করা হয়েছে, যার মধ্যে সাতজনকে বন্দী করা হয়েছে শুধু ২০২১-এ? বেদনাদায়কভাবে, বা হয়তো তাও না, ভারতে ২০১৪ থেকে আজ অবধি ২২ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। তাঁরা কেউ অবশ্য বৃহৎ পুঁজির বাণিজ্যিক গণমাধ্যম সংস্থার সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁরা হলেন (ছিলেন বলাই ভাল, কারণ খুন হয়ে গেছেন তো তাঁরা) সেইসব প্রান্তিক রিপোর্টার, পেশাগত দায়িত্ব পালন যাঁদের কোনোমতে বেঁচে থাকার অবলম্বন। আসিফ সুলতান, গুলফিসা ফাতিমা, ফাহাদ সাহ, সিদ্দিক কাপ্পান, সাজাদ গুল, সার্জিল ইমাম, বহু নামের আরও একটা ক্লান্ত সারি, শুধু নাম যারা শিরোনামে আসে ‘ভারতবিরোধী’ কাহিনী-নির্মাণের দায়ে জেলবন্দী হওয়ার কারণে।
আপনি যখন সাংবাদিক ছিলেন, আপনিও কি প্রশিক্ষণ পাননি কীভাবে সাংবাদিকতার কালজয়ী লক্ষ্যে—অসহায়ের শক্তি হওয়া আর শক্তিকে অসহায় করার লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হয়? আজ যদি কোনও সাংবাদিক বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ পান, আপনি কি তাকে ওনাদের প্রিয় খাবার বা বলবর্ধক পানীয় নিয়ে কথা বলার পরামর্শ দেবেন, নাকি আপনি তাকে উৎসাহ দেবেন শক্তিধর মানুষটিকে প্রশ্ন করতে ২০০২ সালে ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ সময়কালে গুজরাতে ঠিক কী ঘটেছিল? গত সপ্তাহে কর্ণাটক হাইকোর্ট অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে তফশিলী জাতি এবং উপজাতি (Prevention of Atrocities) আইনটি প্রকৃত অর্থে বাতিল করে দিয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, কোনো জাতি-বর্ণমূলক অবমাননা শুধু জনসমক্ষে ঘটলে তবেই তা আইন মোতাবেক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। সুবিধাভোগী হিন্দুদের হাতে থাকা ক্ষমতা এবং জাতিবৈষম্য-জর্জরিত সমাজে যখন দলিতদের খুন হতে হয় ঘোড়ায় চড়া বা উচ্চবর্ণের লোকদের জন্য নির্দিষ্ট কুয়ো থেকে জল তোলার জন্য, বা, আরও পরিতাপের, ‘উচ্চবর্ণের’ কোনো মানুষের প্রেমে পড়লে—আপনার কি মনে হয় আমরা এই তফশিলী জাতি ও উপজাতি আইন অবলুপ্তির জন্য প্রস্তুত? আপনার কি মনে হয় দলিতদের জীবনের কোন অর্থ আছে?
ভারতে সংখ্যালঘুদের জীবনের কী কোনও গুরুত্ব আছে? আমি আর্জি জানাচ্ছি, উত্তর দেওয়ার সময় আপনি স্মরণ করবেন ট্রেনের মধ্যে খুন হওয়া কিশোর জুনাইদকে, মন্দিরের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা আসিফাকে, গোহত্যার মিথ্যা অভিযোগে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত আখলাককে, তাবরেজ, যাকে উল্লসিত জনতা পিটিয়ে খুন করার সময় বাধ্য করেছিল ‘জয় শ্রীরাম’ মন্ত্রপাঠে, মোহাম্মদ সালিম(৫৫), মোহাম্মদ খলিল আলম(৩৫), সমীর শাহপুর(১৯), মুশারফ(৩৫), বাব্বু(৩০), মেহতাব(২২), জাকিব সইফি(২৮), আকিব(১৯)—এদের সবাইকে, যারা খুন হয়েছে হিন্দু সন্ত্রাসবাদীদের হাতে; হত্যাকারীদের কারও কোনো সাজা হয়নি অবশ্য।
দীর্ঘদিন যাবৎ ভারতীয় খৃষ্টানরা একব্যাগ-চালের জন্য ধর্মান্তরিত—এমন বিদ্রূপের শিকার। কিন্তু এখন ধর্মান্তরণ-বিরোধী আইন বলবৎ হওয়ায় সে-নিপীড়ন আইনসিদ্ধ হলো। ছমাস আগে ক্রিসমাসের দিনে, যখন ভারতের খৃষ্টানরা খুশীর পোষাক পরে গীর্জায় যাচ্ছিলেন, ভারতের বেশকিছু জায়গায় হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা তাঁদের উপর আক্রমণ চালায়। আমি নিশ্চিত আপনি গুরগাঁও-এর একটি গীর্জার বাইরে যীশুখৃষ্টের ভাঙামূর্তির মর্মছেঁড়া ছবিটি দেখেছেন, বিতৃষ্ণ হয়েছেন সান্তাক্লসের কুশপুত্তলিকা দাহ করার ভিডিওগুলি দেখে। ভারতে যাজকদের যেকোনো জায়গায়, যেকোনো সময়ে আক্রমণ করা যায় সম্পূর্ণভাবে দায়মুক্ত থেকে। আপনি কি খৃষ্টানদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, নাকি বিশ্বাস রাখেন ‘ঘর ওয়াপসি’তে?
ভারত কি ইতিমধ্যেই এক হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে উঠেছে? বাবরি মসজিদ ধ্বংসের রায়ে উৎসাহিত ভারতে আজ মসজিদ/দরগা/উপাসনাস্থল আপবিত্র করে, ধ্বংস করে সেখানে হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি স্থাপন নিতান্ত সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩৫০ বছর আগে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানবাপী মসজিদ বর্তমানে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশানুসারে আংশিকভাবে অব্যবহার্য হয়ে রয়েছে। কুতুব মিনার, তাজমহল, প্রমুখ স্থাপত্যশিল্পের বিস্ময়কর নিদর্শনগুলিকেও হয়তো এখন খুঁড়ে দেখা হবে বা মন্দিরে রূপান্তরিত করা হবে। এই গণহত্যাকেও কি আপনি ক্ষমাসুন্দর চোখেই দাখবেন?
কর্ণাটক হাইকোর্টের যে রায়ের ফলে মেয়েদের হিজাব পরে স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়েছে, তার বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে শুনানির আবেদন করা হয়েছিল। সুপ্রীম কোর্ট সে আবেদন খারিজ করেছে। এই হিজাব-পরা ছাত্রীদের প্রতি আপনার বার্তা কী হবে?
আমি আন্তরিকভাবে আপনার কাছে জানতে চাইছি, আমার কি ভারতের বিচারব্যবস্থার ওপর ভরসা রাখা উচিত?
সবশেষে বলি, নাজিবের মায়ের মত আপনিও কি কখনো ভাবেন নাজিব কোথায়? অথবা, বিচারক লোয়াকে কে হত্যা করল? নাকি, এসবই তুচ্ছ কিছু প্রশ্ন?
ভারভারা রাও-ও তো একটা তুচ্ছ প্রশ্নই করেছিলেনঃ
কোন পথে, বলো
কথা বলা যায়
নির্মম, তোমার সঙ্গে?
আন্তরিকতাসহ,
সরিতা পাণ্ডে
একজন উদ্বিগ্ন প্রবাসী ভারতীয়
ওয়াশিংটন, ডি.সি.
জুন ২৬, ২০২২
সূত্র: https://livewire.thewire.in