সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
ছোটবেলা কাটতেই—ঘরের দেওয়ালে দেবদেবির ছবিতে চোখ টানতো। ভালো লাগতো। — কপি করতাম। একটি ছবি—
তো কী ধাক্কা তাতে!— ওঁ—এর রাধাকৃষ্ণ—যুগলমূর্তি।
অনেক পরে রবীন্দ্রনাথের গানেও তাকে পেয়ে গেলাম—
‘মূর্তি তোমার যুগল সম্মিলনে সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে।’ কি এক বিস্ময়! গানের সঙ্গে ছবি মিলে কি প্রকাশআনন্দ বল!
শাকসব্জি, ধান, ঘাস—
এর সবুজ রঙ—
কি সত্যির দেখা — তাই না? আমায় খুব টানতো।
এই রঙের সঙ্গে লালমাটি, মশলা হিসেবে হলুদ ব্যবহার করে — ছবিতে লাগাতাম।
একদিন বৃষ্টির পর মোরাম ধুয়ে বেরিয়ে পড়ল ভেতর—
ওমা! তার যে নীল রঙ ! খাবলা মেরে তুলে তা দিয়ে পুতুল তৈরি করায় সে দিনটা আমার হয়ে গেল।
নন্দলাল বাবুর সাহস নিয়ে একদিন বাইরের মূর্তি গড়ে ফেললাম। তারপর কি দুরু দুরু ভয় — রবি ঠাকুর (গুরুদেব) ডেকে পাঠালেন। ‘সমস্ত আশ্রম বড় মুর্তি গড়ে ভরে দে…’ — ছুট্টে বেরিয়ে এলাম। এ কি বিস্ময়ের আনন্দ!
অনেক নিরিবিলি সময়ে — ছবিগুলি আমাকে বলছে খুশিতেই তো — কিঙ্কর, তোমাকে কিন্তু আমরাও চিনি…
#
সে শোনায় অন্যমনস্ক কিঙ্কর। সামনের কাগজে রঙে আঁচড় কাটছেন।
তখন তো একটা সূর্যমুখী।
কত কম বয়সে একদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা।
সকালের দিকে বসে আছেন ইজি চেয়ারে। ঈষৎ ন্যুব্জ।
আরেক দিন — মনে পড়ে। সেদিন উত্তরায়ণের জানালায়
তার শোকাহত মুখ —
টেবিলেই ঝুঁকে বসে। আঃ এন্ড্রুজ স্যার মারা গেছেন…।
পড়ন্ত আলোয় গুরুদেবের শোকাহত মুখ —
মাথার ভিতর কেমন তালগোল পাকিয়ে দিল।
ঘরে ফিরে অনভ্যাসের তাড়ায় এক এক স্কেচ করলাম —
পরে তা ব্রোঞ্জের মূর্তিও হোল। কবেকার রামকিঙ্করকে শোনা।
কলাভবনের দোতলায় রামকিঙ্করের সে-রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হোল গত পৌষমেলার কিছু আগে—
ফেরার পথে উত্তরায়ণের জানালায় কি খোঁজার ছলে—
দুচোখই বাড়িয়েছিলাম।
সেদিন সে আবার রতনপল্লিতে। জীর্ণ মলিন চেহারার বাড়িটুকু —
একটি ভগ্নস্তূপ যেন। কংক্রিটের তৈরি একটা উড্ডীন পাখি – এখানেও। লাল মাটির দেয়াল একা দাঁড়িয়ে—তাতে শ্যাওলাও।
এখানে রামকিঙ্কর এখন নেই — দূরে কুড়ি নম্বর কোয়াটার্সে।
কিছু দূরে এগোতেই ‘সাঁওতাল পরিবার’, ‘ধান ঝাড়া মূর্তি’ সন্ধ্যার শীত গায়ে মেখেই— দাঁড়িয়ে।
কাছে অন্ধকার ক্রমশ।
কিছু ভীত বিহ্বলতাও।
কুড়ি নম্বরেই— এন্ড্রুজ পল্লিতে দেখা মিললো রামকিঙ্করের।
দেখি— তক্তপোষে বসে। মলিন গরম পোষাকে গা ঢাকা।
সরানো লেপের কাছে বিড়ির বাণ্ডিল, জবা ফুল,….অসমাপ্ত বোতল। কুপি জ্বলছে।
ঘরে কোনো ছবি নেই।
এখন চোখে দেখতে পাই না কিছুই। কেউ পড়ে দিলে শুনি,
কেউ ধরলে — হাঁটি।…পঙ্গু হয়ে গেছি।
মাথার ভিতর কত কিছু ক্রশ-পাজল খেলে।...
কিন্তু কিছু করার নেই। থেমে থেমে বলা — শুনছি কিঙ্করকে।
শূন্য দেয়াল — ছবি টাঙানো নেই তো।
নিজের শিল্পকর্ম চোখের সামনে না থাকলে নতুন ভাবনা কি ফিরে যায়?
জানা হয় কই !
রামকিঙ্করকে আর একবার পড়ে এলাম। আর একবার।
কত আগের শোনা গল্পটা পুরনো ভিড় ঠেলে আবার যে সামনেই। সেবার নাট্যঘর মঞ্চের দুধারেই মূর্তি গড়ার পরিকল্পনা —
দায়িত্বে সেই মানুষটি — কিঙ্কর।
তাতে বাম দিকের মূর্তি গড়া একরকম শেষ হতেই — ডান দিকের লালন ফকিরের কাজ শুরু। ন্যাশনাল স্কলারশিপ নিয়ে এই কাজের সাথে পৌঁছে গেলেন এক ছাত্রও। কাজের আগে মূর্তির নানা স্কেল স্থির করে রাখা তার স্বভাব তো। কিন্তু টাইফয়েডে আক্রান্ত কিঙ্কর এত সময়ে হাসপাতালে ভর্তি যে …
হাসপাতালে প্রতিদিন তাকে দেখতে গিয়ে সে আরেক দেখার সুন্দর সেখানে। বিছানা ছেড়ে রোগী নাচছেন—
পরে নাচের ভঙ্গিটি ততক্ষণে স্কেচ করেও রাখছেন।
সেই স্কেচ সাজিয়ে লালন ফকির — মূর্তি হয়ে গেল।
অনেক বছর পর রামকিঙ্করের এ-গল্পটুকু জানিয়েছিলেন তাঁর এক ছাত্র। শান্তিনিকেতনের খোলা আকাশের নীচে নিঃসঙ্গ দরাজ রামকিঙ্করকে পিয়ার্সন পল্লির খোয়াইয়ের কাছে —
ঈশ্বরের পাশে ঘুরতে দেখেছিলেন কতজন।
তাঁকে ‘আমার রামকিঙ্কর’ বলতে কতবার যে ইচ্ছে জেগেছে প্রাণে …
বিনোদবিহারী বলছেন – রামকিঙ্কর …
শান্তিনিকেতনেই একদিন বিনোদবিহারীর কাছ থেকে শোনা কথা —
শিল্পী প্রভাস সেন, তাঁকে রামকিঙ্করের একটি গদ্য পড়ে শুনিয়েছিলেন।
বলেছিলেন — ‘এরকম লেখা রঁদার সঙ্গে তুলনা করা যায়।
‘আমি কি বলেছিলাম জানো — ( বিনোদবিহারী বলছেন ): এ লেখাটি পেলে রামকিঙ্করবাবুর আর জীবনচরিত লেখার দরকার হবে না’। কিঙ্করের লেখায় এক জায়গায় —
: জীবনের উদ্যানে যেটি দেখি। চোখের সামনে দিনের আলোয় তা ছবিতে আঁকি। আর যা টাচ করি অন্ধকারে, তা স্কাল্পচার করি।
নিজেকে এমন করে নিজে চেনা — কি অপরূপ সত্য। আর কোন্ রামকিঙ্করকে দেখব তখন নির্মাণের বিমূর্ততায় না মূর্ততায় শুধু।
কী এক উৎসবে —খোয়াই-এর কাছাকাছি পথে ভাস্কর্যশিল্পী সোমনাথ হোড়ের সঙ্গে দেখা। চারপাশে সাদা রোদ। আলাপ নেই। কাছে পৌঁছে বলি — আপনার কথা শুনবো একটু। তর সইছিল না।ইচ্ছাটা জানিয়ে ফেললামঃ একটু রামকিঙ্কর বলুন না।
মানুষটির কোথায় যেন নাড়া পড়লো। শুনছি —
: রামকিঙ্কর দেবশিশু ছিলেন। পরিণত বয়সে দেবতা হতে পারেননি। কুটিলতা, পরশ্রীকাতরতা … কোনটিই তাঁর আয়ত্ত্বে আসেনি। এমন নির্মল স্বভাবের মানুষ কোটিকোটিতে একজন আসে।
একটু থেমে চোখে কি গোপন করে মুছলেন।
আর একদিনের চোখে। পি.জি. হাসপাতালের হিমঘরে শিল্পী গণেশ হালুই অবশেষের রামকিঙ্করের দিকে চেয়ে। ভেতরটা মরমর করে ভাঙছে —নিজের ভেতরটা । অনুভব গড়িয়ে পড়ে —
: লোকটা মারা গেল। ভরা হাঁড়িটা কাত হয়ে গেছে। ভেজা মাটির রঙ আরও গাঢ় হয়েছে। এই গ্রন্থিতেই তাঁর শক্তি।
একজন নিঃস্ব মানুষ। মাতাল সমীরণের নীচে ঘুমিয়ে পড়েছে।