সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
তিনটে পরিবারের মিল অনেকটাই, চালচলন, জীবনযাপন সবই। হয়ত সেই কারণেই ওদের নিজেদের মধ্যে মেলামেশাটা বেশি। এক জায়গায় চাকরি করলে রেষারেষির যে চালু গল্পটা শোনা যায়, তা এদের এখনো পর্যন্ত ছোঁয়নি। তিনজনেই ‘হাম দো, হামারা এক’, তবু তফাৎ যদি করতেই হয়, তা এখানেই। চয়নের মেয়ে বাকি দুজনের থেকে অনেকটাই ছোট, তিন্নি পাঁচ পূর্ণ করল সবে। সেখানে নিখিল আর অরুণাংশুর দুটো পিঠোপিঠি, নিখিলের মেয়ে মৌলি আইসিএসসি পার করেছে গতবার, অরুণাংশুর ছেলে রেহান সামনের বার দেবে।
কথাটা তুলেছিল অরুণাংশুর বউ শুভ্রা, তিন্নির পাঁচ বছরের পার্টিটা রেস্টুরেন্টে দাও চয়নদা। বাড়িতে আ্যরেঞ্জ করতে গেলে ঋতুর ওপর অহেতুক প্রেশার হবে। কথাটা লুফে নিয়েছিল ঋতুপর্ণা! সত্যি কথা বলতে ও এই কথাটা চয়নকে আগেই বলেছিল। এইটুকু ফ্ল্যাটে দুটো লোক বেশি এলে ঠাসাঠাসি লাগে। কোথায় বসাবে, কোথায় কী করবে, ঋতুপর্ণার পাগল পাগল অবস্থা হয়! হোক না ফেব্রুয়ারির থার্ড উইক, গরম কিন্তু ভালোই পড়ে যায় তখন। আর তাছাড়া, ঋতুপর্ণা চয়নকে বুঝিয়েছিল, রেস্টুরেন্টে সেরে ফেলতে পারলে আ্যপার্টমেন্টের কাকে বলব, কাকে না, এসব ঝক্কি থাকে না! নিজেরা নিজেরা চলো, আনন্দ ফুর্তি করো, কড়ি ফেলো, তারপর তেল মাখো, কী ছড়িয়ে ফেলো, ব্যাপারটা ওখানেই শেষ, তার রেশ বাড়ি পর্যন্ত বয়ে আনতে হচ্ছে না!
এরপর খুব ঝটপট গুগল খুলে দেখে নেওয়া হল কয়েক গণ্ডা রেস্টুরেন্টের নাম, তাদের স্পেশাল অফার কী চলছে, বিডে স্পেশাল কিছু আছে কী না, সমস্ত কিছু। তিন্নির জন্মদিনটা ফেব্রুয়ারির তেইশে, ওরা দুদিন পরে রোববার দেখে প্রোগ্রামটা ঠিক করল, সবক্ষেত্রে এটাই করা হয়। ওদের শহর থেকে একটু দূরে, গঙ্গা পেরিয়ে একটা নতুন রেস্টুরেন্ট হয়েছে, নাম ভোজবাজি, সেটাকেই চুজ করল ওরা। এদের অফার টফারগুলো্র মধ্যে নতুনত্ব আছে! নিখিল বলেছিল, আগে থেকে টেবিল বুক করার কথা, কিন্তু বাকিরা বাধা দিল। ওখানে পৌঁছেই দেখেশুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
শেষ ফেব্রুয়ারির এক রোববারের দুপুরে তিন পরিবারের ন’টি প্রাণী একটা ভাড়া করা স্করপিওয় চেপে , বহুবার নিজেদের মধ্যে করা রসিকতা, খুনসুটিগুলোকে ঝালিয়ে নিতে নিতে, ভোজবাজির উদ্দেশ্যে চলল। নতুন বলতে, প্রত্যেকে তিন্নিকে একবার করে ‘হ্যাপি বার্থ ডে বেটা’ বলে উইশ করল, আর প্রত্যেকবার ঋতুপর্ণা মেয়েকে মনে করিয়ে দিল, থ্যাংকু বলে দাও! মূল জন্মদিনেও এই অনুশীলন একবার হয়ে গেছিল যদিও!
ভোজবাজির সামনে এসে ওরা প্রথমটায় একটু থতমত খেয়ে গেল! বাইরে এত ভীড় কেন! রেস্টুরেন্ট বন্ধ নাকি! জানা গেল, আজ রোববার, চাপ বেশি, ভেতরে সিট সব ফুল, এরা বাইরে অপেক্ষা করছে! চয়নরাও এখন এই অপেক্ষমানদের দলে। নিখিল বলল, ডিসগাস্টিং! পয়সা দিয়ে খাবো, তাও লাইন দিতে হবে! এর চেয়ে অনলাইনে আনিয়ে নিলে ঝামেলা চুকে যেত! শুভ্রা ফোড়ন কাটল, দুয়ারে লাঞ্চ? এই রসিকতা পাকিয়ে ওঠার আগেই রিমি, নিখিলের স্ত্রী, নিখিলের দিকে চোখ পাকায়! আজকে ট্রিট দিচ্ছে চয়ন-ঋতুপর্ণা, ওদের সামনে এরকম বিরক্তি দেখালে সেটা মোটেই ভালো দেখায় না! নিখিল বউএর এই নীরব বার্তা আদৌ পড়তে পারল কী না, পারলেও কতটা পাত্তা দিল, সে সন্দেহ থেকেই গেল!
বাইরে কোথাও বসার ব্যবস্থাও নেই। রোদটাও এই সময় বেশ চড়া। ওরা প্রত্যেকেই উশখুশ করতে লাগল। ধোপদুরস্ত পোশাক-আশাক পরে, এই ভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে প্রত্যেকেরই বাধো বাধো ঠেকে! রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া লোকজন কেউ কেউ এই জটলার দিকে তাকায়! এতে ওদের আরও অস্বস্তি বাড়ে! ওরা নিজেদের মতো করে সময় কাটিয়ে পরিস্থিতি এবং নিজেদের স্বাভাবিক রাখতে চায়।
নিখিল আর অরুণাংশু একটু তফাতে গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। শুভ্রা আর রিমি প্লাস টু তে কোন কোন টিচারের টিউশন বেশি কার্যকরী হতে পারে, সেই নিয়ে নিবিড় আলোচনায় মত্ত। রেহানের চোখে ভারী চশমা। সেই চশমার ওজন ওকে সকলের থেকে বরাবরই আলাদা করে রাখে। সে মুখে কথা বলে কম, আর তার চশমার ওপারে চোখের ভাষা পড়া যায় না! হয়ত সে জন্যেই ওকে তফাতে রেখেই মৌলি আর তিন্নি মোবাইলে গেম নিয়ে মত্ত থাকে। তিনজনেরই মা , আপন আপন সন্তানকে ‘রোদ থেকে সরে এসো না’ পরামর্শ দিলেও এই একটা জায়গায় তিনজনের আচরণে মিল পাওয়া যায়। তিনজনই নিজেদের অবস্থান থেকে একটু নড়ে ওঠে, কিন্তু তাকে পূর্বোক্ত পরামর্শের প্রতি সুবিচার বলা যায় না!
বেশ কিছুক্ষণ পরে শুভ্রার গলা পাওয়া যায়। অরুণাংশুর দিকে তাকিয়ে বলে, কী গো, তিন্নিটা তো ছোট, নাকি! কতক্ষণ না খেয়ে থাকবে! দেখো না অন্য কোথাও যাওয়া যায় কী না! শুধু সিগারেট ফুঁকলে হবে এই গরমে! গা জ্বলে যায় একেবারে! এই উদ্বেগ এবং গাত্রদাহ সকলকেই স্পর্শ করে, ঋতুপর্ণাকে তো করেই! ও চয়নকে ঠেলা দেয়, একবার দেখো না, কতক্ষণ লাগবে আর! বাচ্চাগুলোর তো খিদে পেয়ে গেছে! চয়ন গম্ভীর গলায় বলে, মিনিমাম এক ঘন্টা! আমাদের সিরিয়াল একত্রিশ!
সিরিয়াল! নাম লেখাতে হয়েছে নাকি! ঋতুপর্ণার বিস্ময়ের উত্তরে চয়ন চুপ করে থাকে।
রেস্টুরেন্টটা রাস্তার যে ধারে, ওরা তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষারত সকলেই তাই। কত লোক অপেক্ষায় আছে , চয়ন আন্দাজ করার চেষ্টা করে। জনা চল্লিশ তো হবেই! আজকাল মানুষ বাড়িতে রান্নাবান্না করে না নাকি! নাকি এদের সবারই বার্থ ডে পার্টি আজ এখানে হবে! ভারতবর্ষে একদিনে কত শিশুর জন্ম হয়? চাকরি পাওয়ার আগে এরকম কিছু তথ্য ওকে মনে রাখতে হয়েছিল, এখন সেসব পাট চুকেছে। এখন ওদের সমস্ত সাধারণ জ্ঞানের আহরণ একটি শিশুকে ঘিরেই! এই ভিড়টায় ছোট ছেলেমেয়ে সংখ্যায় কম নেই, তাদের সকলেরই খিদে পেয়েছে ভেবে চয়নের অবশ্য সেই গুণিতকে উদ্বেগ বাড়ে না! চয়ন দেখে, পাশেই একটা নির্মীয়মান বহুতলে কর্মরত শ্রমিকদের একটা দল ওদের একটু দূরেই বাড়ি থেকে আনা টিফিন বাক্সো খুলে বসে। দূর থেকে ভাত আর নধর কাঁচালঙ্কা দেখা যায়। একটা বাটিতে তরকারি গোছের কিছু একটা! দলটির এই স্বাধীনতা-উদযাপন দেখে চয়নের সম্বিত ফেরে, ওর মনে হয়, রেস্টুরেন্ট-কর্তৃপক্ষকে একবার তাড়া দেওয়া দরকার। ও রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে যায়।
কাঠের পেল্লাই দরজা ঠেসে বন্ধ করা। ভেতরে কী হচ্ছে, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। বিশাল চকচকে , মসৃণ দরজার ওপর চারটে বাক্স-কাটা ডিজাইন। সেই বাক্সের মধ্যে একটা করে ঢাল উঁচু করে বসানো, যার মধ্যে আবার কোণাকুণি দুটো করে তরোয়াল! সবই দামি কাঠের। চয়নের একঝলক দেখে মনে হয়, রেস্টুরেন্ট তো নয়, একটা দুর্গ যেন ! অথবা কোনো সম্ভ্রমমাখা সরকারী অফিস, যার সব কাজকর্মই দরজার ওপারে হয়, বাইরের মানুষদের জন্য থাকে শুধু বিমূঢ় বিস্ময়! বাইরে একজন সিকিউরিটির লোক দাঁড়িয়ে। এই লোকটাই রেস্টুরেন্টে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করছেন। হাত খাদ্যপ্রত্যাশী মানুষের তালিকা। একে একে ডাকছেন, যেমন যেমন ফাঁকা হচ্ছে ভেতরে। লোকটার পরনে জলপাই রঙের পোশাক। মাথায় টুপি। ম্যাজিশিয়ানের হাতের ওপর ছড়িয়ে থাকা তাসের মতো একরাশ পালক সেই টুপির ওপর সাজানো। মুখ ভাবলেশহীন। লোকটাকে দেখে চয়নের কয়েক বছর আগে ঘুরে আসা ওয়াঘা সীমান্তের সেই সেনা জওয়ানদের কথা মনে পড়ল, যাঁরা সীমান্তের অনেক ভেতরে, নিজেদের বসতভিটায় অনেকটা মায়া ছেড়ে রেখে এসে ওখানে কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করেছিল!
চয়ন ‘আর কত দেরী’ জিজ্ঞাসা করার পরিবর্তে লোকটাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘আপনার খিদে পায়নি?’ রোদতপ্ত দুপুরে, এই কার্যকারণ সম্পর্কহীন প্রশ্নে নিরাপত্তা আধিকারিকটি কতটা ঘাবড়ে গেলেন বোঝা গেল না ওর নির্লি্প্ত মুখ দেখে, কিন্তু ভদ্রলোক অতিরিক্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে উত্তর করলেন, আপনাদের সময় হয়ে এসেছে স্যার! আর একটু ওয়েট করুন প্লিজ! অগত্যা চয়ন ওর প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে উল্টোমুখে ফিরল!
মুখ ঘুরিয়ে চয়ন দেখল, ঋতুপর্ণা কতগুলো চিপসের প্যাকেট কিনে প্রত্যেকের হাতে দিচ্ছে, আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে। একটা আইসক্রিমের ঠেলাগাড়ি ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে। জড়ো হওয়া লোকজনের কেউ কেউ কিনছেনও । লেবু লজেন্স নিয়ে একটা ছেলে ওদের পাশ দিয়ে হাঁক পেড়ে চলে গেল। চয়ন ভাবতে চেষ্টা করল, একেই কী অনুসারী শিল্প বলে! এই রেস্টুরেন্ট না থাকলে কী এদের এখানে দেখা যেত! ও আবার এও ভাবল, সকলে যদি ঠিক ঠিক সময়ে এসেই রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়তে পারত, তাহলে কী এরা আদৌ এখানে আসত! সত্যিই অর্থনীতি বড়ই জটিল বিষয়!
চয়ন রাস্তা পেরোনোর উদ্যোগ করল। যাঁরা খেতে দেবেন, তাঁদের প্রান্ত থেকে, যাঁরা খেতে পাবেন, তাঁদের কাছে এসে পৌঁছোতে যে চব্বিশ ফুট রাস্তাটা পেরোতে হবে, সে রাস্তা চয়নের অনন্ত বলে মনে হল! উল্টোদিকের ভিড়ে যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে, তা আর চাপা নেই, বেশ কোলাহলের রূপ নিয়েছে। চয়ন দেখল, উল্টো প্রান্ত থেকে অরুণাংশু এদিকে আসছে। সকলেই অস্থির হয়ে পড়েছে। শুধু যাঁদের কাছে ভেতরের ডাক এসে পৌঁছোচ্ছে, তাঁদের ক্ষোভের উদ্গতপ্রায় আগুনে মুহূর্তে বারিসিঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে, ওঁরা ওই প্রান্তের শিবিরভূক্ত হয়ে পড়ছেন! পদ্ধতিটি চলমান, তাই আলাদা আলাদা করে কাউকে নির্দিষ্ট শিবিরের বলে চিহ্নিত করাও অসম্ভব! চয়ন ভাবে, আচ্ছা, যাঁরা এখনও পর্যন্ত খাবার না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়েছেন, তাঁরা কী সত্যিই এতটা ক্ষুধার্ত, যে একটা ভাঙচুরের সম্ভাবনা তৈরী হতে পারে! ওরা নিজেরা যেমন যথেষ্ট ভারী জলখাবার খেয়ে এসেছে, এবং চয়ন অনুমান করতে পারে, ওর দলের তো বটেই, এমনকি এই জমায়েতের কেউই সেই মাত্রায় বুভুক্ষু নয়, যাতে এই মুহূর্তে কোনো অভাবিতপূর্ব ঘটনা ঘটে যেতে পারে! অথচ সবার ক্ষোভটাও সৎ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আচ্ছা, ওই বহুতলের যে শ্রমিকরা একটু আগে পেট ভরে ভাত খেয়ে আবার কাজে ফিরে গেছে, তারা এই অবস্থায় পড়লে কী করত! এইসব আগডুম বাগডুম ভাবতে ভাবতে চয়ন রাস্তা পেরোচ্ছে, এই সময় অরুণাংশু ওকে ক্রশ করতে করতে বলে গেল, দেখি সিকিওরিটির মালটাকে ম্যানেজ করি গে!
ম্যানেজ! মানে সিকিওরিটির লোকটাকে ঘুষ দেবার কথা ভাবছে অরুণাংশু! বেশ খানিকটা অবাক হল চয়ন! তারপর ভাবল, সত্যিই তো, ভেতরে ঢুকে পড়া কেউ কেউ যে এ পন্থা অবলম্বন করেনি, তাই বা কে জানে! এভাবে ভাবতে পেরে চয়নের মনের অস্বস্তি ভাব খানিকটা কমে এলো! ইতিমধ্যে ও ওর দলের কাছে চলে আসতে পেরেছে। ওর আশঙ্কা ছিল, নিখিল হয়ত ইতিমধ্যে রেগে টং হয়ে আছে! কিন্তু ও দেখল, নিখিল বেশ শান্ত হয়েই বাকিদের সঙ্গে কথা বলছে! চয়ন ওদের মাঝে গিয়ে কৈফিয়তের সুরে বলল, এক্ষুণি ডাকবে বলল। ঋতুপর্ণা বলল, কখন থেকে তো এক্ষুণি এক্ষুণি শুনছি! এরপর তো একবারে ডিনার সেরে গেলেই চলে। বাকিরা এ কথায় হাসল। চয়ন লক্ষ করল, ঋতুর মন্তব্য বা বাকিদের হাসিতে একধরনের নিস্তেজ ভাব! ঠিক এই সময়েই শুভ্রা বলল, সবাই মিলে গিয়ে প্রোটেস্ট করা উচিত! এ কী ধরনের অসভ্যতা রে বাবা! পয়সা দিয়ে খাব, তার জন্য এইভাবে কাউকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখে! সকলে এই কথাতেও সায় দিল। নিখিল বলল, দাঁড়াও,অরুণ গেছে তো সিকিওরিটিকে পটাতে। ও আসুক। চয়ন জিগ্যেস করল, ছেলেমেয়েগুলো কোথায় গেল! যে কোনো সময় ডাকবে তো! তখন দেরী করলে লাইন ফস্কে যাবে! রিমি হাই তুলতে তুলতে জবাব দিল, তিনটেতে মিলে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। কাছাকাছিই আছে। কোথায় আর যাবে! ঋতুপর্ণা সমর্থন করল, তাই তো! আমরা, বড়রাই অস্থির হয়ে যাচ্ছি। ওদের কাঁহাতক ধৈর্য থাকে!
চয়ন দেখল, সামনের রাস্তায় লোকজন বা যান চলাচল বেশ কমে এসেছে। রোদও মরে এসেছে অনেকটা। অপেক্ষমানদের ভিড়ও ছোট হয়ে গেছে। রাস্তার ওপারে ঢাল-তরোয়াল খচিত বন্ধ দরজাটাকে আরও বড়, আরও চকচকে দেখাচ্ছে! দরজাটা বড় হতে হতে ওপারের অনেকটা ঢেকে যাচ্ছে ক্রমশঃ। ঢেকে গেল সেই সিকিওরিটির মানুষটা! এরপর ওটা প্রসারিত হতে হতে সেই নির্মীয়মান বহুতল, ওখানে কর্মরত শ্রমিক সবাইকেই ঢেকে দেবে আস্তে আস্তে! তারপর দরজাটা কী এদিকে চলে আসবে! ঢেকে দিতে চাইবে ওদের সবাইকে! আজকের দিনে যার জন্ম হয়েছে, সেই পাঁচ বছরের পৃথিবী দেখা মেয়েটাকেও! চয়ন অস্থি্র হয়ে পড়ে! কেমন যেন অসহায় বোধ করে ও! অবিশ্বাস্য জোরে ডাক দেয়, তি…ন্নি! ঋতুপর্ণা ওর হাত ধরে টান দেয়, আরে, এই তো! তিন্নি তো আমার সঙ্গে ! ওরা তো চলে গেল! কখন থেকে ডাকছে, চয়ন মিত্র এণ্ড ফ্যামিলি চলে আসুন। শুনতে পারছ না! তোমার শরীর খারাপ করছে নাকি!
চয়ন ধাতস্থ হয়ে বলে, না না ঠিক আছে। চলো। ও মেয়ে আর বউয়ের হাত ধরে হাঁটতে থাকে ধীর গতিতে। বাকিরা সেই গিলে খেতে আসা দরজা দিয়ে একে একে ভেতরে ঢুকছে। একটু দূর থেকে, দরজার ফাঁকে ভেতরের মায়াবী আলোয় যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তা কেমন অলৌকিক মনে হচ্ছে চয়নের! এখানে তিন্নির জন্মদিন পালিত হবে ভেবে, কেন কে জানে ওর মধ্যে এক গোপন বিমর্ষতার জন্ম হয়!
ঠিক এই সময়েই চয়ন ওর হাতে ঋতুপর্ণার চাপ টের পায়। ঋতুর দিকে তাকালে ও ওর বাঙ্ময় দৃষ্টি বিনিময় করে চয়নের সঙ্গে। তিন্নি মুখ উঁচু করে এই দৃষ্টিবিনিময় প্রত্যক্ষ করে।
ওরা দুজন তিন্নির হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে, এ ভাবনা চয়নকে তিন্নির প্রথম পৃথিবীর আলো দেখা দিনটির কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেয়! চয়ন রাস্তা পার হওয়ার গতি বাড়িয়ে দেয়!