সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
মৃত্যুকে উপেক্ষা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন লোকশিল্পীরা। করোনা তাদের অনেকের প্রাণ কেড়েছে, কাহিল করেছে কিন্তু বাতিল করতে পারেনি। সময় কতটা কঠিন তা আমাদের মত তুলনায় অনেক নিশ্চিন্তে থাকা মানুষজনেরা প্রতি পদেই বুঝছি। তবে গ্রামগঞ্জে যারা স্থানীয় উপকরণ, দর্শক-শ্রোতা এবং ক্রেতাদের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকেন তাদের টিঁকে থাকার লড়াইটা আরও কঠিন। অতিমারি সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গিয়েছে। মাটির কাছাকাছি থাকা লোকশিল্পীদের সম্পূর্ণ অনলাইন হওয়া কিংবা কোয়ারেন্টাইনে চলে যাওয়া দুটোই অসম্ভব। কারণ জীবন তাদের জন্য সে পরিসর বরাদ্দ করেনি। তাদের কাজের ধাঁচ এবং বেঁচে থাকা দুটোই অন্যরকম। প্রত্যক্ষ সংযোগ সব লোকশিল্পেরই একটা জরুরি ভিত্তি, ছবি আঁকাই বলুন বা নাচ-গান, চারপাশে মেঘের মত মানুষ ভিড় করে না এলে সে শিল্প বাঁচে না। অ্যান্টিউসের মত সেও তো মাটির সন্তান। মাটির সংযোগ ছাড়লে সে বাঁচবে কি করে!
রোগ-বালাই মারি মন্বন্তর সবকিছুই মানুষকে তার জীবিকা থেকে বিযুক্ত করে কেড়ে নেয় লোকশিল্পীদের জীবনের ছন্দ। এই সময় তার কাছে মানুষ আসে না, মুখ ফেরায় স্বজন, কেউ জিনিস কেনে না, শিল্পের উপকরণ সংগ্রহ করাও যোগাযোগের সমস্যার কারণে কঠিন হয়ে পড়ে। এতকিছুর পরেও দেখা যায় শিল্পীরা টিঁকে আছেন। শুধু তাই নয়, দুঃসময়ের ইতিহাস, ভূগোল, অভিজ্ঞতা সবকিছুর দেখা পাওয়া যায় তাদের শিল্পকর্মে ও কাজে। মৃত্যুর চোখরাঙানি সেগুলিকে স্পর্শ করতে পারে না। বরং তা হয়ে ওঠে এক ঝরা সময়ের দলিল। লেখা-রেখা-ছড়া-গান-পাঁচালিতে জেগে থাকে একটা ধ্বস্ত সময়। দেখা যায়, মৃত্যু যঁাকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল, সেই লোকশিল্পই দিচ্ছে তার গতিবিধি এবং আসা যাওয়ার যাকে বলে গ্রাফিক ডেসক্রিপশন। বাংলার লোককথা, ঝুমুর গান, ভাওয়াইয়া গান, কবি গান, পটচিত্র ও পটের গান, মঙ্গলকাব্য, লোকচিত্র কলায় লোকশিল্পীরা মারি ও মন্বন্তরের ছবি ধরে রেখেছে। সবই তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল। এবারেও তাই ঘটেছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার পটে আমরা দেখা পেয়েছি করোনা দেবীর। ভাটিয়ালি আর ঝুমুর গানে উঠে এসেছে বিধ্বস্ত মানুষের যন্ত্রণা। মধুবনী শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন মুখোশে, সতর্কতা হয়ে উঠেছে শিল্পিত।
মারি ও মন্বন্তরে মানুষের দুর্দশার কথা আমরা গণ কবিয়াল রমেশ শীল, সোমনাথ হোড়ের তেভাগার ডায়েরি কিংবা চিত্তপ্রসাদের ছবিতে পাই। কে ভুলবে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বাংলা’? সেগুলি সবই সচেতন মানুষের বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ। সেসব কাজ তো ইতিহাসে ঢুকে গেছে। কিন্তু লোকশিল্পীদের কাজগুলি একেবারে অন্যরকম। এসব ছবি গান কিংবা শিল্পকর্ম সবই তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার বর্ণনা। সেখানে কোথাও সে কাতর কণ্ঠে এই অবস্থা থেকে মুক্তি চেয়েছে। এই অতিমারির জন্য দোষ দিয়েছে নিজের ভাগ্যকে, কোথাও ক্ষিপ্ত হয়ে দিয়েছে ভগবানকে অভিসম্পাত। সবসময় যে তা একটা যুক্তিগ্রাহ্য বিশ্লেষণ হয়েছে মোটেই নয়। কিন্তু তাতে পাওয়া যায় একটা মানুষের ব্যক্তিগত অনুভব। এই অনুভব প্রতিষ্ঠিত করে একটা সাধারণ সত্যকে। অতীতে মারি মন্বন্তরের সময় গাছে গাছে ঝুলতো বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ার পোড়ামাটির শিল্পীদের তৈরি করা মানত পুতুল। রোগ-ব্যাধি সহ যাবতীয় আপদ বালাই থেকে মুক্ত করার কামনায় গ্রাম্য লোকদেবদেবীদের থানে পবিত্র বৃক্ষের ডালে ঝোলানো এই মানত পুতুল এবারও দেখা গিয়েছে। জ্বর ওলাওঠা বসন্ত থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষ ছুটতেন শীতলার মন্দিরে। শীতলার গানে ধরা পড়েছে সেই আর্জি। গ্রামের মন্দির বা থানে মন্বন্তর পীড়িত অভাবী মানুষ দেবতার কাছ থেকে অন্ন প্রার্থনা করতেন। বাংলার লোকসাহিত্য আর গানে তার ছবি এসেছে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় অন্ন দে গো মা অন্নদা গানে আদতে ধরা পড়েছে বাংলার সাধারণ মানুষের অন্নাভাবের কথা।
বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, বিভুতিভূষণের আরণ্যক কিংবা রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গে আমরা বসন্ত, কলেরা, প্লেগের বর্ণনা পাচ্ছি। কিন্তু সেটা অনেকটা বাইরে থেকে দেখা। আলোকপ্রাপ্ত মানুষদের প্রান্তজনেদের দুঃখের বর্ণনা। তা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল নয়। কিন্তু লোকশিল্পী, লোকগায়ক কিংবা লোককবিদের বর্ণনায় মারি-মন্বন্তরের একটা অন্যরকম ছবি পাই আমরা। সেখানে সরাসরি মানুষের দুরাবস্থাকে প্রত্যক্ষ করি। চল মিনি আসাম যাব, দেশে বড় দুখ রে - ঝুমুর গানে ফুটে উঠেছে মানুষের দুঃসময়ের বর্ণনা। ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠের সুবাদে পুরুলিয়ার ঝুমুরিয়াদের গাওয়া এই ঝুমুর তো নিজেই একটা ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। গানে বলা হয়েছে মন্বন্তরে এক অভাবী মানুষের মেয়েকে নিয়ে দেশান্তরী হওয়ার কথা। সৃষ্টিধর মাহাতোর ঝুমুর গানে আছে ‘‘মাঘ-ফাগুন মাসে / চৈত-বৈশাকে ধুম / অন্ন বিনা মরে লোক, সৃষ্টিধর ভাবে।’
লোকশিল্পীদের সবাই মাঠেঘাটে কাজ করা মানুষ। বয়স কিংবা অসুস্থতা কিংবা কোন পারিবারিক কারণে যারা কাজ করেন না তাদের সঙ্গেও বয়ে চলা জনজীবনের একটা নিবিড় যোগাযোগ থাকে। মারি মন্বন্তরের দাগ স্বাভাবিক ভাবেই পড়ে তাদের কাজ ও শিল্পকর্মে। এই ব্যাপারটা আমরা এবারের অতিমারির সময়েও দেখেছি। ২০২০-তে কোভিডের প্রথম পর্বে এপ্রিল থেকে জুন মাস ছিল গ্রামীণ শিল্পীদের কাজের মরশুম। ভক্তিগীতি, কীর্তন যাত্রা, ছৌ নাচ, ঝুমুর গান সহ বহু গ্রামীণ আসরই তখন বাতিল হয়েছে। বাউল-ফকিরি, ছৌ-পটুয়া, নাটুয়া রায়বেঁশে, পুতুল নাচ এই সব শিল্পীরাও এই সময় কোন অনুষ্ঠান পাননি। ছৌ নাচের আসর বন্ধ হওয়া মানে ছৌ মুখোশের কারিগরদের কাজ কমা। কারণ এই মুখোশ তো শুধু ঘর সাজানোর জিনিস নয়, এটা একটা লোকনাচের অপরিহার্য অঙ্গ। অনুষ্ঠান বাতিল হলে মুখোশের অর্ডারও কমবে। চাহিদার অভাবে শিল্পীরা যদি নতুন ছৌ পালা না বঁাধেন তাহলে নতুন মুখোশ তৈরির কোন প্রশ্নই নেই। ছৌ মুখোশের কারিগরদের ৪০ শতাংশ ব্যবসা কমে গিয়েছিল এই সময়ে।
শহরের থিম পুজোতে এখন বাংলার হস্তশিল্পীদের দাপট। বিভিন্ন জেলার বহু শিল্পী একাজে অংশ নেন। গোটা শীত জুড়ে চলে উৎসব, মেলা, প্রদর্শনী সহ নানা অনুষ্ঠান। এই সময় করা কাজই এখন গ্রামীণ লোকশিল্পীদের রোজগারের সবচেয়ে বড় জায়গা। এসময়ে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই পেরিয়ে বিদেশ থেকেও এখন ডাক পান পটুয়া, ছৌ নাচ, বাউল-ফকিরি গানের শিল্পীরা। চলতি বছরে অবস্থা একটু বদলালেও গত দু-বছর ধরে তাদের কাজকর্ম বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হল এতে তাদের আত্মবিশ্বাস কমেছে। এর কারণটা শুধু আর্থিক নয়। এর ফলে তাদের মনে আশঙ্কা জেগেছে কাজের ভবিষ্যৎ নিয়েই। নতুন স্বাভাবিকতায় এটাই সবচেয়ে অস্বাভাবিক দিক। তার কারণ এই মানুষগুলি বাঁচেন তাদের শিল্প ও পরম্পরাগুলিকে ঘিরে। সেটাই তাদের আনন্দ, গর্ব এবং জীবন। সেটা না পেলেই মুষড়ে পড়েন লোকশিল্পীরা। নিজেদের ভালবাসার জিনিসটাকে ধরেই জীবিকা গড়তে চান লোকশিল্পীরা। তা না পেলেই তারা হীনমন্যতা আর মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন। কোভিড সে কাজটাই করেছে। কাজের বরাত, সুযোগ, সর্বোপরি তাদের কাজের প্রতি মানুষের মনোযোগ এই অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারে তাদের।
সারা পৃথিবীর লোকশিল্পীদের ৬১ শতাংশ অসংগঠিত শিল্পের অংশ। এদের প্রায় ৪০ শতাংশই মহিলা। কোভিড ধাক্কা দিয়েছে তাদের জীবন ও জীবিকায়। বলা হচ্ছে অনলাইন অনুষ্ঠান ও বাণিজ্যের কথা। তত্ত্বগতভাবে হয়তো কথাটা খুব ভুলও নয়। এটাও ঘটনা কোভিডের সময়ে নদীয়া, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার লোকশিল্পীরা অনেক সফল অনলাইন অনুষ্ঠান করেছেন। সেইসব অনুষ্ঠানের দর্শক প্রতিক্রিয়া খুব ভাল। অভিজ্ঞ শিল্পীদের প্রাপ্তিযোগও মন্দ নয়। একই অভিজ্ঞতা উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জের ভাটিয়ালি শিল্পীদের। গরীব গ্রামীণ শিল্পীদের এটা একটা বড় সাফল্য। পরিবেশন-প্রযুক্তি-বিষয় সবদিক থেকেই এই অনলাইন অনুষ্ঠানকে উন্নত হতে হবে, এটা শুধু কোন দুঃসময়ের মোকাবিলার প্রস্তুতি নয়। বরং এর শিক্ষাটা আত্মস্থ করেই বাংলার লোকসংস্কৃতিকে আরও সফলভাবে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার রাস্তা খুঁজতে হবে। অতিমারির ধাক্কা অনেক গ্রামীণ শিল্পীকে অনলাইনে নিয়ে এসেছে। খারাপ অবস্থা কেটে গেলেও আগামী দিনে এই অভ্যাস ধরে রাখতে হবে। মারি-মন্বন্তর- প্রাকৃতিক বিপর্যয় এসব সঙ্গী করেই মানুষ বাঁচে। এগুলি পৃথিবী থেকে রাতারাতি বিলুপ্ত হবে এমন ভবিষ্যৎ বাণীও কেউ করছেন না। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও কীভাবে বেঁচে থাকা যায়, ধরে রাখা যায় নিজেদের ঐতিহ্যমন্ডিত পরম্পরা, পৌঁছনো যায় আরও বেশি মানুষের কাছে সেকথা ভাবতেই হবে।
অনলাইন একটা বড় অবলম্বন। বড় অবলম্বন বলতে আসর-মঞ্চ- মেলা-অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে শুধু ডিজিটাল সড়ক ধরে চলা নয়। কারণ লোকশিল্প-সংস্কৃতি চরিত্রগতভাবেই প্রত্যক্ষ সংযোগের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু অনলাইন হতে হবে শুধু বিপর্যয়ের সময়েই নয়, নিজেদের ভাবনা ও কাজকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তাতেই বাড়বে লোকশিল্পীদের কাজের বাজার। আরও অনেক বেশি অনুষ্ঠানের ডাক আসবে নানা দেশ থেকে। সঙ্গত কারণেই তাদের আর্থিক অবস্থার চেহারাটা অনেকটা ভদ্রস্থ হবে। শুধু আর্থিক অবস্থাই ভাল হবে এমন নয়, এতে বাড়বে শিল্পীদের আত্মবিশ্বাস। এটা খুব দরকার। এটা কেমন হয় তা বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, কোভিড ও আমফান বিধ্বস্ত সুন্দরবন সংলগ্ন উত্তর ২৪ পরগণার হিঙ্গলগঞ্জে ৬৮ জন ভাটিয়ালি শিল্পীর বাস। লকডাউনের সময়েই তাদের অনুষ্ঠান দেখেছে ৪৫০০ মানুষ। গ্রামীণ লোকশিল্পীদের জীবনে এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এটা আমরা কেউ বুঝতে পারবো না। চিরকাল অফলাইন হয়ে থাকা বাংলার লোকশিল্পীদের এবারের কোভিড সেই শিক্ষা দিয়ে গেল।