সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
এখানে আমি বিবেচিত হয়েছি লোকনাট্য নিয়ে কিছু লেখার জন্য। এক্ষেত্রে আমার অপারগতার কথা প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো। আসলে এরকম একটা ঐতিহ্যপূর্ণ লোকশিল্পধারা নিয়ে লিখতে গেলে জানা বোঝার জগত, লেখাপড়ার পরিসর যতোটা বড় হওয়ার দরকার তা আমাতে অর্জিত হয়নি। কিন্তু প্রথানুগ দেখাশোনার বাইরে আমার একটা পরিসর ছিল যা কোনো গবেষণা বা লেখালেখির কারণে নয়। তা ছিল তথ্যচিত্র তৈরির সুবাদে, থিয়েটারের সামান্য এক কর্মী ও একজন কালচারাল অ্যাক্টিভিস্ট হওয়ার কারনে। সেক্ষেত্রে পড়তে হয়নি যে তা নয়, ইতিহাস ও গবেষণায় চোখ রাখতে হয়নি যে তা নয়। কিন্তু সে দেখা আর শোনা ছিল ভিন্ন, খানিক অন্তরঙ্গ হয়তোবা!যেখানে বইয়ের ভাষা থেকে অনেকানেক গুরুত্বপূর্ণ হল সরাসরি বুঝে নেওয়া দেখে নেওয়া। কোনো হাইপথিসিস নয়। একটা জলজ্যান্ত অনুষ্ঠান আর জীবনের পাঠশালায় যে ধুলোখেলা অবিরত চলছে, চলে আসছে তাকে তারই মাটিতে, তারই আকাশে চিত্রিত করা, চিহ্নিত করা।
এখানে শুরু করতে চাই লোক ও নাট্য শব্দদুটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ থেকে। বেদে “লোক” শব্দটির উপস্থিতিই প্রাথমিকভাবে বুঝিয়ে দেয় এর অপার গাম্ভীর্য। আবার অন্যদিকে সংস্কৃত ভাষায় “দর্শন”। ধাতুগত অর্থে দর্শনক্ষম ব্যক্তি। এর সঙ্গে আবার ইন্দ্রিয়কে যোগ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরাণের আখ্যান তথা লোকজীবনের কাহিনীর সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিকতায়, স্বতস্ফূর্ত উচ্চারণে সাধারণত মুখে মুখে নির্মিত অভিনয়কে লোকনাট্য বলা হয়। যার মধ্যে বাচিক ছাড়াও থাকে দেহভঙ্গির ভাষা। যা শুরু হয়েছিল শ্রুতির হাত ধরে (অরাল ট্র্যাডিশন থেকে)। এর সংলাপ নিবদ্ধ থাকে সংহত ও গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের প্রত্যন্তে এবং এই আঞ্চলিক উপভাষা হল লোকনাট্যের অন্যতম উপাদান। যা রচিত হয় ঐতিহ্য ও বর্তমানের সংমিশ্রণে, নিজস্ব ভৌগোলিক পরিমণ্ডলের সমাজমানস থেকে। কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রাথমিক চর্চা ক্রমে এক যৌথ পরিবেশনার আকার নেয়। সেই অর্থে সমস্ত লোকনাট্যই হল যৌথ শিল্পকর্ম। গান ও নাচ যার অপরিহার্য সহায়ক।
বাংলায় এই লোকনাট্যের নানা আঙ্গিক আছে। জেলা থেকে জেলায় তার রূপ বদলেছে। যেমন ধরা যাক যাত্রা। তা নিজেই বদলে গেছে। যাত্রার মধ্যে ছিল লোকনাট্যের সামগ্রিক রসদ। কিন্তু পরবর্তীতে নগরনাট্যের দিল লাগিতে সে সস্তার বিনোদনে পর্যবসিত হয়েছে। আমরা যখন যাত্রা নিয়ে কাজ করতে গেছি তখন অবশিষ্ট তেমন কিছু আর নেই। সমস্তটাই গ্রাস করে নিয়েছে নগরায়নের প্রমোদামোদ। কিন্তু “আলকাপ” তেমনটা নয়। যদিও তারও বিবর্তন ঘটেছে। মুর্শিদাবাদ, মালদা ও বীরভূম জেলায় একসময় “আলকাপ” দেখা যেত। এর কোনো পূর্বনির্ধারিত কাহিনী থাকত না। পুরোটাই তাৎক্ষনিক, মঞ্চে নির্মিত। মুখে মুখে।
মুর্শিদাবাদের স্বনামধন্য মোহতাবের “আলকাপ” দেখেছি রাত জেগে। রঙ্গ-রসিকতা ও তির্যক সমালোচনা এই অনুষ্ঠানের মূল উপজীব্য। আরবি শব্দ থেকে আসা “আলকাপ”এর সঙ্গে একধরনের মুসলমানির যোগ ছিল। প্রকাশ্যে মোল্লা- মৌলবিদের কঠোর সমালোচনা করার জন্য বহু আলকাপ শিল্পীদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে, ঘরবাড়ি তছনছ করে দেওয়া হয়েছে মৌলবাদিদের সহায়তায়। হিন্দু মৌলবাদিরাও বাদ যায়নি।”আলকাপ” শিল্পীরা ছেড়ে কথা বলেনি পন্ডিত-ব্রাহ্মণদেরও। তার ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। আলকাপের অর্থই হলো ধারালো ও তীক্ষ্ম। কিন্তু তা ক্রমশ “পঞ্চরস” নামের আড়ালে অনেকটাই হালকা চটুলতায় পর্যবসিত হয়েছে। বীরভূমের কোথাও কোথাও একে “ছ্যাঁচড়া” নামেও অভিহিত করা হয়।
লোকনাট্য একইসঙ্গে দৃশ্য, শ্রাব্য ও অভিনয়। দিনাজপুর জেলায় যেমন “খনের গান”কে লোকনাট্যের অন্তর্গত ধরা হয়। পালাকাররা
বছরভর সামাজিক ও পারিবারিক নানা বৈপরীত্য, কলহ ও বিবাদ নিয়ে গান রচনা করেন। সেগুলোই অভিনীত হয় খনের গানে। খন অর্থে ক্ষণ বা তাৎক্ষনিক। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার অঞ্চলে “পালাটিয়া” অভিনীত হতে দেখেছি। যেখানে খনের মতো তাৎক্ষনিক গান নয়। এখানে পালাকাররা ধারাবাহিক ভাবে পল্লীগীতির সুরে গান রচনা করে। এই নাট্যে প্রধান গায়কের সঙ্গে দোহার ও বাদ্যকররা অভিনয় করে। ধনী দরিদ্র, সার্থক ও দেউলিয়ার গল্প বলা হয় পালাটিয়ায়। জলপাইগুড়ি, কোচবিহারসহ দার্জিলিং জেলায়ও দেখেছি “রঙ পাঁচালি”। এও এক মারাত্মক হাস্যরসাত্মক নাট্যাভিনয়। হাসি দিয়ে শুরু আবার হাসিতেই শেষ। প্রান্তিক সমাজসংসারের লঘু দিক নিয়ে তৈরি হয় এর কাহিনী। যার ভেতর থেকে উঠে আসে সমাজ ঘনিষ্ঠ কথাছবি।আবার মালদা অঞ্চলের গম্ভীরা সম্পূর্ণত ভিন্ন লোকনাট্য। এই নাটক শিবের মাহাত্ম্যমূলক প্রচারের গাননাচে বাধা। এই নাট্যে কৃষকসমাজের ফিবছরের জীবন-পর্যালোচনা উপস্থাপিত করা হয় শিবমাহাত্ম্যের আধারে। এই রকম কতো লোকনাট্যের মুখোমুখি হয়েছি তা আজ সব মনেও নেই।যেমন এই লিখতে লিখতে মনে পড়লো হাওড়া, বর্ধমান ও বীরভূমে দেখেছি “লেটো”।এই নাটকও সংলাপনির্ভর এবং নাচে গানে ভরপুর এক হাস্যরসাত্মক গ্রামীণ জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ অভিনয়ের সুরে বাঁধা। আবার হাস্যরসের বাইরে গিয়ে দেখেছি “ছৌ”। পুরুলিয়ার ছৌ নাচ অত্যন্ত গাম্ভীর্যপূর্ণ পৌরানিক আখ্যাননির্ভর। ইদানিং কিছু সামাজিক পালা তৈরি করার চেষ্টা চলছে। তবে একটা কথা লেখা দরকার যে এই বিভিন্ন ধারা ও আঙ্গিকগুলির মধ্যে একটা অন্তঃশীল যোগসূত্র থেকেই গেছে। যা লোকনাট্যকে সমৃদ্ধ ও প্রসারিত করেছে।
এবার একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন উত্থাপন করতঃ এই লেখা শেষ করবো। সেটি হলো বাউল প্রসঙ্গে। লোকসংস্কৃতির গবেষকরা লোকনাট্যে বাউলকে অধিকাংশই ব্রাত্য করেছেন। অথচ এই বাউল গান, নাচ ও কথার মধ্যে রয়েছে অযুত থিয়েট্রিকস। বাউল কখনো একা কখনো সমবেত ভাবে অনিবার্য কিছু নাট্যকর্ম ঘটিয়ে তোলে। বাউলের পাল্টাপাল্টির গান, প্রশ্ন উত্তরের গান তো মূলতঃ নাটকেরই বিস্তার বা সম্প্রসারণ। লোকভাষায় বলাই হয় যে, বাউল গান দেখতে-শুনতে হয়। চোখ বুজে বাউলের মর্ম উদ্ধার সম্ভব নয়। বাউল তার অনুষ্ঠানের সূত্রে একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করে। যাকে আমরা নাটকে, সিনেমায় ব্যাকড্রপ বলি। এবার পরিব্রাজক, চলমান বাউল এই প্রেক্ষাপট নিরন্তর পাল্টে দিচ্ছে। এই যে মনের আধারে মানুষ খোঁজা! এহেন প্রেমকথা থেকে বিরহ বা বীরত্বের ভাব ও দেহভঙ্গি? আমি সনাতন দাস বাউলকে দেখেছি তার একতারাকে লাঠিয়ালের ভঙ্গিতে ব্যবহার করতে।
এতো গেলো আমার প্রাথমিক উপলব্ধি। দ্বিতীয়ত বিশ্ব নাটকের দিকে তাকালেই দেখতে পাবো যে গত বেশ কয়েক দশক ধরে নগরনাট্যের মহলায় ঢুকে পড়েছে লোকনাট্যের নানা আঙ্গিক, শতেক ভাষা। কর্মশালায় বাউলের এনার্জি ও স্পিরিটকে কাজে লাগিয়ে নাট্যঋষি জেরসি গ্রোটস্কি তার নাট্যত্বত্ত্ব থিয়েটারের সন্ধান চালিয়েছিলেন (থিয়েটার অফ সোর্সেস)। পিটার ব্রুক তার নাটকে বাউলদের নিয়ে একটা বড় পরিসর তৈরি করেছেন। এই তো কিছুদিন আগে পার্বতীর সাথে দেখা হলো প্যারিসে। ওর মুখে শুনলাম ইউজেনিও বারবা এখন তার প্রযোজনায় বাউল নিয়ে কাজ করছেন।
আসলে বলতে চাইছি যে,বাউলের থিয়েটার বাংলা লক্ষ্য করতে না পারলেও সারা বিশ্ব নজর রাখছে। আমরা কখনো আবহ সঙ্গীত হিসেবে বাউল গান ব্যবহার করছি, কখনো তাদের পোশাকের রঙ দৃশ্য পরিকল্পনায় গুঁজে দিচ্ছি, এই পর্যন্তই।