সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে জার সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটতে থাকে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউক্রেন জার সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ইউক্রেন একসময়ে ছিল পোল রাজতন্ত্রের অধীনে। ১৩৮৫ সালে লিথুয়ানিয়া ও পোলান্ডের মধ্যে ‘ক্রেভো ঐক্যচুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে লিথুয়ানিয়া ও ইউক্রেনীয় অঞ্চল পোল রাজতন্ত্রের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। মিখাইল শলোখভের ‘কোয়ায়েট ফ্লোস দ্য ডন’ (১৯৩৫) বা নিকোলাই গোগোলের উপন্যাস ‘তারাসবুলবা’ রচিত হয়েছে কসাক জনগোষ্ঠীকে নিয়েই।
কসাক একটা তুর্কী শব্দ। কসাক জনগোষ্ঠী ডন ও নীপার নদীর তীরে চতুর্দশ-পঞ্চাদশ শতাব্দী থেকে বসবাস শুরু করে। মধ্য ও উত্তর-পূর্ব এশিয়া থেকে তাতাররা রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে। রাশিয়া ও ইউক্রেনে শ্লাভ জনগোষ্ঠীর বাস। এই দুই শ্লাভ জনগোষ্ঠীর ভাষা ছিল ভিন্ন। রুশীরা কীভাবে ইউক্রেনীয়দের ভাষা ও সংস্কৃতিকে গত কয়েক শতাব্দী ধরে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার এক দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন বিপ্লব নায়ক, আলোচ্য ‘ইউক্রেনের ইতিকথা’য়।
পোল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কসাকরা বারবার বিদ্রোহ করেছে। আবার যুদ্ধের সময় কসাকদের একটা অংশ অর্থের বিনিময়ে রাজার হয়ে অস্ত্র ধারণ করত। ১৬৩০-এ পোল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কসাক বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। এই বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করা হয়। ১৬৫১ থেকে ১৬৫৩-র মধ্যে ৩ বার পোল-কসাক যুদ্ধ হয়। ১৬৫৪-তে কসাকরা রাশিয়ার জারের কর্তৃত্ব মেনে নেয়। জার আলেক্সেই রোমানভ পোলদের অধীন থেকে ইউক্রেনকে মুক্ত করেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়া্র্ধে ক্ষমতায় আসেন জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথেরিন। তিনি ইউক্রেনকে জার সাম্রাজ্যের অংশ হিসাবে ঘোষণা করেন ও ইউক্রেনে ভূমিদাস ব্যবস্থা চালু করেন। জারিনা রুশদের ইউক্রেনের উর্বর কৃষ্ণমৃত্তিকা অঞ্চলে বসবাস করার জন্য উৎসাহিত করেন। ১৮৮৬ সালে এক ডিক্রির মাধ্যমে ইউক্রেনীয় ভাষা চর্চা ও প্রকাশনী নিষিদ্ধ করা হয়। ইউক্রেনীয়দের রুশ ভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয়। ১৯০৫ সালে ইউক্রেনীয় ভাষার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
১৯১৭-তে জারতন্ত্রের পতনের পর ইউক্রেন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিল। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে ইউক্রেন স্বশাসন ঘোষণা করে। ডিসেম্বরে লালফৌজ ইউক্রেন আক্রমণ করল। ১৯১৮-র ফেব্রুয়ারিতে লালফৌজ কিয়েভের দখল নেয়। ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদীদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। ইউক্রেনীয় ভাষায় কথা বললেই তার শাস্তি গুলি করে হত্যা। ইউক্রেনের কৃষকদের ঘর থেকে ফসল বাজেয়াপ্ত করা হতে লাগল। এরপর বলশেভিকরা জার্মানদের সঙ্গে ব্রেস্ত-লিতভস্ক চুক্তি করে। চুক্তির শর্তানুযায়ী ইউক্রেনকে জার্মানদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। নেস্তর মাখনোর নেতৃত্বে ইউক্রেনীয় কৃষকেরা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ১৯১৮-র নভেম্বরে জার্মান সেনা ইউক্রেন থেকে চলে যায়। এরপর ইউক্রেন দখলে রাখার জন্য শুরু হয় লড়াই। ইউক্রেনের জারতন্ত্রীদের সঙ্গে লালফৌজের লড়াইয়ে জারতন্ত্রীরা পরাজিত হয়। এরপর ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদী মাখনোভিস্টদের সঙ্গে বলশেভিকদের যুদ্ধ শুরু হয়। মাখনোভিস্টরা পরাজিত হয়। ১৯২০-র ডিসেম্বরে ইউক্রেনের বলশেভিকরা সোভিয়েত ইউক্রেন সরকার গঠন করে। ১৯২২ সালে ইউক্রেনকে সোভিয়েট সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অংশ বলে ঘোষণা করা হয়।
১৯২৮-২৯ সালে ইউক্রেনে ফলন ভালো হয়নি। অনাহারে মানুষের মৃত্যু ঘটে। অথচ রাষ্ট্রের আধিকারিকরা ফসল সংগ্রহের জন্যে কৃষকদের বাড়ি বাড়ি তল্লাসী শুরু করে। রাষ্ট্রের চাহিদা মতো ফসল না দিতে পারায় কৃষকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এমনকি গৃহপালিত পশুদের নিয়ে চলে যায়। নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে কৃষকেরা উচ্ছেদ হয়ে গেল।
কৃষকদের ওপর রাষ্ট্রের এই নিপীড়নের নাম দেওয়া হয়েছিল, ‘শ্রেণি হিসাবে কুলাকদের নিশ্চিহ্নকরণ’। রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কৃষকরা বিদ্রোহ করেছে। ফসলের গুদাম ভেঙে ফসল নিয়ে এসেছে। মহিলারা দলবদ্ধ ভাবে গ্রামে গ্রামে গুদামে হানা দিয়েছে। মহিলাদের খাদ্য গুদাম আক্রমণকে রাষ্ট্র আখ্যা দিয়েছে ‘মাগীদের দাঙ্গা’। কিন্তু রাষ্ট্রের নির্মমতার কাছে কৃষকরা হার মেনেছে। ১৯৩০ সালের এপ্রিলে বিদ্রোহী কৃষক বাহিনীর সাথে রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর সরাসরি সংঘর্ষ হয়। দুই দিন ধরে এই সংঘর্ষ চলে। সংঘর্ষে অনেক কৃষক মারা যান। অনেককে গ্রেপ্তার করার পর হত্যা করা হয়। বন্দী শিবিরে যাদের পাঠানো হয়েছিল তারা আর ফিরে আসেননি। ইউক্রেনের গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি গৃহকোণ রাষ্ট্রের নজরদারির আওতায় থাকল। ১৯৩২ সালে ইউক্রেন থেকে শস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয় ৭৭ লক্ষ টন। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার জন্য কৃষকদের ঘরে ঘরে চলল তল্লাসী আর সাথে অত্যাচার। কারোর বাড়িতে এক বস্তা আলুও পাওয়া গেলে, সেই বাড়ির পুরুষদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হত। ১৯৩২-৩৪ এই সময় ইউক্রেন জুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মারা যায় প্রায় ৪০ লাখ নানুষ। রাষ্ট্রের পরিকল্পনা সফল করার জন্যই মানুষ। রাষ্ট্রই প্রধান, মানুষ নয়। রাষ্ট্র নেতা ও তাদের অনুগামীরা এভাবেই ভাবেন।
মিখাইলো হ্রুসেভস্কি ছিলেন ইতিহাসের গবেষক। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল, ইউক্রেনের ইতিহাস। ১৯৩১ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর গবেষণাকে ভুল ও বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। ইউক্রেনের বাইরে ককেশাসে তিনি নির্বাসিত জীবন কাটান ও সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
১৯৩৩ সালে ইউক্রেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউক্রেনীয় ভাষা ও ইতিহাস পাঠ নিষিদ্ধ করা হয়। ওই বছরই ইউক্রেনীয় ভাষায় লিখিত সমস্ত স্কুলের বই বাতিল হয়ে গেল। ইউক্রেনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা নিকোলো স্ক্রিপনিক ইউক্রেনীয় ভাষা চর্চার একজন উদ্যোগী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁকে পার্টির মধ্যে ‘ভেক ধরা শত্রু’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি আত্মহত্যা করেন। হাজার হাজার গবেষক, শিক্ষক, ছাত্র ও লেখককে গ্রেপ্তার করা হয়। ইউক্রেনীয় সঙ্গীত নিয়ে সেসময় গবেষণা করতেন ক্লিমেন্ট খ্বিতকা, হ্যাট খোতকোভিচ ও কাতেরিনা ক্রুভেলস্কা। কাতেরিনাকে ১৯৩৪-এ গ্রেপ্তার করা হয় ও ১৯৪৩-এ তিনি গুলানের বন্দীশিবিরে মারা যান। ১৯৩৮-এ খোতকোভিচকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ক্লিমেন্ট খ্বিতকাকে প্রথমে বন্দীশিবিরে আটক রাখা হয়, পরে মস্কোতে নজরবন্দী থাকাকালীন ১৯৫৩-তে তাঁর মৃত্যু হয়।
১৯৩৯-এ ‘রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি’ সম্পাদিত হয়। সেসময় সোভিয়েত বিদেশ মন্ত্রকের কমিশনার ছিলেন ম্যাক্সিম লিটভিনভ। তিনি ছিলেন ইহুদি। আলোচনা শুরু করার আগে হিটলারের দাবিতে লিটভিনভকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওই পদের দায়িত্ব পান মলোটভ। ২৩ আগস্ট জার্মান বিদেশমন্ত্রী রিবেনট্রপের সঙ্গে মলোটভ আলোচনায় বসলেন। সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হ’ল। ১ সেপ্টেম্বর, জার্মানি উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে পোলান্ড আক্রমণ করে। ১৭ সেপ্টেন্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্বদিক থেকে পোলান্ড আক্রমণ করে, পোলান্ডের দখলে থাকা পশ্চিম ইউক্রেন ও বেলারুশ দখল করে নেয়। ১৯৩৯-এর ‘রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি’ অনুযায়ী এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
১৯৪১-এই জুনে জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। ইউক্রেন জার্মানির দখলে চলে যায়। ইউক্রেনের হাজার হাজার ইহুদিকে জার্মান সৈন্যেরা হত্যা করে। ১৯৪৪-এ সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউক্রেন পুনর্দখল করে। জার্মান সৈন্যদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে যে সমস্ত ইহুদি মানুষজন পালিয়ে গিয়েছিলেন, তারা আর ফেলে যাওয়া নিজেদের ঘরবাড়ি ফিরে পাননি।
ক্রিমিয়ায় তাতার জনগোষ্ঠীর বাস। ১৯৪১ সালে জার্মারা ক্রিমিয়া দল করে। ১৯৪৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রিমিয়া পুনর্দখল করে। তাতাররা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বিশ্বস্ত নয়, এই অভিযোগে ক্রিমিয়া থেকে তাতারদের উচ্ছেদ করা হতে থাকে। তাতারদের ট্রেনবন্দী করে নিয়ে গিয়ে মধ্য এশিয়ার জনহীনপ্রান্তরে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়। ক্রিমিয়ায় তাতারের ঘরবাড়িতে রুশদের বসনো হয়। পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চল ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভারীশিল্পের অন্যতম কেন্দ্র। খনি ও ইস্পাত, রাসায়নিক দ্রব্য, সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের কারখানা ছিল ডনবাস অঞ্চলে। খনি ও কারখানায় কর্মরতদের অধিকাংশই ছিলেন রুশ। রাশিয়া থেকে তাদের এখানে নিয়ে আসা হয় এবং তারা এই অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান। এভাবেই ক্রিমিয়া ও ডনবাস অঞ্চল রুশ অধ্যুষিত অঞ্চল হয়ে ওঠে।
১৯৮৯ থেকে এস্তোনিয়া, লাতভিয়া ও লিথুয়ানিয়াতে স্বাধীনতার দাবী উঠতে থাকে। ১৯৮৯ সালের ২৩ আগস্ট রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির ৫০তম বর্ষে এই তিন বাল্টক দেশ ৫২০ কিমি দীর্ঘ এক মানবশৃঙ্খল তৈরি করে সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলদারীর অবসান চায়। ঐ একই দিনে ইউক্রেনেও এক মানবশৃঙ্খল তৈরি করা হয়। সোভিয়েত শাসন থেকে ইউক্রেনও মুক্তি চাইছিল। ১৯৯০ সালের মে মাসে এস্তোনিয়া, লাতভিয়া ও লিথুয়ানিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৬ জুলাই ইউক্রেন সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে। সার্বভৌমত্ব ঘোষণার তিন মাস পরে অক্টোবরে ছাত্ররা রাস্তায় নামেন। দাবী ছিল - সার্বভৌমত্বের ঘোষণাকে কার্যকরী করতে হবে, চাই অর্থনৈতিক সংস্কার ও কমিউনিস্ট আধিপত্যের অবসান। কিয়েভের রাস্তায় তাঁবু তৈরি করে ছাত্ররা অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। তাদের দাবী মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে আন্দোলন তুলে নেওয়া হয়।
১৯৯২ সালে স্বাধীন ইউক্রেনে প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন লিওনিদ ক্রাভচুক। ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন লিওনিদ কুচমা। সোভিয়েত শাসনকালে কুচমা ছিলেন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি কারখানার ডিরেক্টর। ১৯৯৯ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কুচমার বিরোধী প্রার্থী ছিলেন ভিয়াচেস্লাভ চোরনোভিল। তার জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু নির্বাচনের আগেই এক গাড়ি দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। কুচমা আবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের শেষের দিকে কুচমার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে।
ইউক্রেনের সংবিধান অনুযায়ী দুইবারের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়া যায় না। কুচমার রাজনৈতিক দল এসপিপিইউ-এর প্রার্থী হলেন ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ। বিরোধী প্রার্থী ভিক্তর ইউশ্চেঙ্কো। নির্বাচনের আগে ইউশ্চেঙ্কোকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। প্রাণে বেঁচে গেলেও তার সারা দেহে ক্ষতের চিহ্ন থেকে যায়। নির্বাচনে ইয়ানুকোভিচ জয়লাভ করেন। নির্বাচনের ফল ঘোষণার আগেই ভ্লাদিমির পুতিন অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়ে দেন ইয়ানুকোভিচকে।
নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে, পুনরায় নির্বাচন করতে হবে - এই দাবীতে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নামেন। সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন বাতিল বলে ঘোষণা করল। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে পুনরায় নির্বাচন হল এবং ইউশ্চেঙ্কো ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন।
***
ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী নব্য অভিজাত শ্রেণির বড় একটি অংশ ইয়ুশ্চেঙ্কোর পক্ষে ছিল এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম ইয়ুশ্চেঙ্কোর পক্ষে ও ইয়ানুকোভিচের বিপক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছিল। ইয়ানুকোভিচের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই রাজনৈতিক আন্দোলন 'কমলা বিপ্লব' নামে পরিচিতি লাভ করে, কারণ ইয়ুশ্চেঙ্কোর দলের নির্বাচনী রং ছিল কমলা।
কমলা বিপ্লবে'র সময় ইয়ুশ্চেঙ্কোর সমর্থকদের তীব্র আন্দোলন ও পশ্চিমা বিশ্বের তীব্র চাপের মুখে ইউক্রেনীয় সরকার ২০০৪ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ঘোষণা করে এবং ডিসেম্বরে পুনরায় নির্বাচনের আয়োজন করে। তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলন ও প্রচারণার ফলে এসময় জনমতের পাল্লা সরকারবিরোধীদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। ফলশ্রুতিতে এই নির্বাচনে ইয়ুশ্চেঙ্কো ৫১.৯৯% এবং ইয়ানুকোভিচ ৪৪.২% ভোট লাভ করেন, অর্থাৎ ইয়ুশ্চেঙ্কো জয়যুক্ত হন। ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে ইয়ুশ্চেঙ্কো ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
নতুন ইউক্রেনীয় সরকার দাবি করেছিল যে, ইয়ানুকোভিচ যে নির্বাচনে কারচুপি করেছেন এই ব্যাপারে তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে এবং এর ভিত্তিতে তারা পূর্ববর্তী ইউক্রেনীয় সরকারের কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কাউকেই বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।
ইয়ুশ্চেঙ্কোর অধীনে নতুন ইউক্রেনীয় সরকার তীব্র রুশবিরোধী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইয়ুশ্চেঙ্কো ইউক্রেনকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রচেষ্টা চালান, রুশ ভাষাকে ইউক্রেনের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, ক্রিমিয়ায় অবস্থিত রুশ নৌঘাঁটির ইজারার মেয়াদ বর্ধিত করার বিরুদ্ধে মত দেন, ইউক্রেনে সোভিয়েত শাসনের তীব্র সমালোচনা করেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেসব ইউক্রেনীয় জার্মানদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল তাদেরকে গৌরবান্বিত করে। কিন্তু ২০০৮ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট ইউক্রেনে আঘাত হানে এবং ইউক্রেনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে ওঠে। তদুপরি, 'কমলা বিপ্লবে'র সময়কার ইয়ুশ্চেঙ্কোর রাজনৈতিক মিত্র ও ইউক্রেনীয় প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া তিমোশেঙ্কোর মধ্যে তীব্র ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতে ইয়ুশ্চেঙ্কোর জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
২০১০ সালের জানুয়ারিতে ইউক্রেনে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ইয়ুশ্চেঙ্কো শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং ইয়ানুকোভিচ বিজয়ী হয়ে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন।
কিন্তু ২০১৩–১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ইউক্রেনে নতুন একটি বিপ্লব/অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেন একটি প্রলম্বিত রাজনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত হয়, যেটি এখন পর্যন্ত চলমান।