সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
ঘন অন্ধকারের গভীরে লাল আলোর বলয় একবার উগ্র হয়ে ওঠে নরশুয়ার মুখের কাছে, আবার মিলিয়ে যায়। তোবড়ানো মুখের ওপর থেকে আলো গুটিয়ে পুনরায় জেগে ওঠে টিকনার মুখে। টিকনা সোঁ শব্দে টান দেয়। মন্দির লাগোয়া শুনশান চত্তরে নরশুয়া আর টিকনার টানের শব্দে কৃত্রিম ঝড়ের স্বর যেন নিস্তব্ধ রাতে একবার ওঠে আর একবার নামে। শীতের রাত। খাটো কম্বলের নীচে গুটিয়ে থাকতে চায় দুটি শীতার্ত মানুষ। একটি কুকুর পায়ের কাছে যতটা সম্ভব কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসতে চায় কম্বলের ওপর।
নরশুয়ার মৌতাত হতে সময় লাগে। সে পাকা নেশাখোর। টিকনার হাতে কলকে ফটফট শব্দ করছে। নরশুয়া অভ্যস্ত কায়দায় হাত বাড়িয়ে বলে, আমাকে দে, তোর হাত কাঁপছে, বিছানায় আগুন পড়লে সর্বনাশ। টিকনা ছোট শ্বাসে ধোঁয়া টেনে কলকেটা নরশুয়ার হাতে এগিয়ে দেয়। নরশুয়া উঠে বসে আধশোয়া অবস্থা থেকে। কলকেটা দুহাতে ধরে টান দেয় কলজের শেষমাথা পর্যন্ত । আংরার লাল আলো মন্দিরের ছাউনি ভরিয়ে সিঁড়ির কাছ বরাবর পৌঁছলে নরশুয়া হঠাৎ লক্ষ্য করে ছায়ামূর্তির মতো কেউ যেন দাঁড়িয়ে।
কিছু ভুল দেখল নরশুয়া! বাইরে চেন দিয়ে বাঁধা রিক্সা। চোর ? চোর হলে এভাবে মন্দিরমুখো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? ভক্ত কেউ? এত রাতে! নরশুয়া ভাবতে ভাবতে কুকুরটাকে পা দিয়ে ঠেলা দেয়। কিন্তু সে নড়ে না। নেশা তার হয়নি। নিশ্চিত হবার জন্য আর একবার কলকেতে টান দেয় দ্বিগুণ শ্বাসে। ঠিক তাই! টান দেবার সাথে সাথেই রাঙা আলোয় দেখা গেল চাদর মুড়ি দিয়ে কেউ একজন ঠায় দাঁড়িয়ে।
নরশুয়া বসে বসেই হাঁক দেয়- হেই কে’রে? কে ওখানে? আচমকা কথা বোবা রাতকে যেন আছাড় মেরে জাগায়। কুকুরটা ধড়মড় করে উঠে বসে নরশুয়ার বলা কথারই যেন অন্য তর্জমা করে ঘেউ ঘেউ শব্দে। ছায়া মুর্তি এবারে যেন একটু এগিয়ে আসে, বলে, আমি রে নরেশ, তোর বাপ।
তা এখানে কি চাই? যা শুগে যাহ্। এইটুকু বলে বাকিটা সে বিড়বিড় করে, বাড়িতে নতুন বউ রেখে এসে এখানে সোহাগ লাগাচ্ছে। আবার গলা তুলে বলে, যা এখান থেকে! টিকনা চাদরের নীচ থেকে সব শুনেও ঘাপটি হয়ে থাকে। তাঁর কান-মাথা দুটো টান দেওয়া ইস্তক ভোঁ ভোঁ করছে। শরীর তুলতে সাড় হয়না। মনে মনে ভাবে, মরুক শালা বাপ-ব্যাটা কিচাইন করে। কিছু একটা এসপার ওসপার হোক। আজ তিনদিন ধরে, ওর বিছানায় ভাগ বসিয়েছে। কিছুতেই বাড়ি যাচ্ছেনা শালা!
ছায়ামূর্তি দু’পা উঠে আসে, চল, গুস্যা উস্যা বাদ মে হবে, এখন চল। তোর লতুন মা মন খারাব করছে, চল ঘর চল। অন্ধকারে নরশুয়া যেন নেভা আগুন! সে বাপের কথার উওর না দিয়ে হাতের কলকেটা আগুন সমেত ছুঁড়ে মারে ছায়ামূর্তিকে উদ্দেশ্য করে। ফসকে যায় লক্ষ্য। আগুনের ফুলকি ছিটকে কলকেটা ভেঙে গেলে কুকুরটা দৌড়ে মন্দিরের বাইরে গিয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে। তার সাথে আরও কুকুরের সমবেত শব্দে রাতের নৈঃশব্দ্য খানখান হয়ে যায় কলকের মতো।
টিকনা কম্বলের ভেতর থেকে বলে, যা মিলমিশ করে লে, ঘর যাহ্। অচেনা কণ্ঠস্বরের প্রশ্রয়ে ছায়ামূর্তি খানিক এগিয়ে এসে নরশুয়ার হাত ধরতে চায় বুঝি। বলে, চল বেটা চল, হামি সব ...। কথা শেষ করতে দেয়না নরশুয়া। কলকের আগুনের মতো গনগন করছে সে। অন্ধকারে আন্দাজ মাফিক হাত ছুঁড়ে সে বলে, হাট বে, হাট ! ছায়ামূর্তি সরে দাঁড়ায় । হনহন করে মন্দির চাতাল থেকে নেমে কুকুরের ভিড় কাটিয়ে সে নিজের রিক্সার চেন খুলে,চড়ে বসে তাতে। তারপর ধুধু ফাঁকা রাস্তা দিয়ে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। কুকুরগুলো কিছুদূর এগিয়ে থমকে যায়। চিৎকার করে শুধু।
#
শীতের নৈঃশব্দ একটু বেশি মাত্রায় নিস্তেজ করে রাখে মফস্বল। আলোজ্বলা বাড়িগুলো দ্রুত জনমানবহীন অস্তিত্ব হয়ে রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থকে শুধু। এই সময় রিক্সা নিয়ে বেপরোয়া গতিতে চালিয়ে যাওয়াটা নরশুয়ার অনেকদিনের নেশা। নিজেকে শহরের ডন বলে মনে হয় তখন। সে ডনের মতোই বাঁচতে চায়। সামনের ইলেকশনে তার হাতে দুটো বুথ। এলাকার পার্টি অফিস থেকে দুবেলা ডাক আসে। কৃষ্ণবর্ণের পেশিবহুল বেঁটেখাটো চেহারার নরশুয়া যখন নেতাদের দেওয়া শার্ট-প্যান্ট পড়ে অ্যাকশনে নামে তখন তাকে চেনা যায়না। প্রথম মিউনিসিপ্যালিটির ভোটে তার হাতেখড়ি। সেবার তিনটে বুথে ভোট করার পর কাউন্সিলর তাকে রিক্সাটা দিয়ে বলেছিল, তোকে চাকরি দেবার কথা ভাবা হচ্ছে। মিউনিসিপ্যালিটিতে মজদুরের কাজ। যতদিন না হয় এই রিক্সাটা চালিয়ে যা। কিন্তু হ্যাঁ, পার্টির কাজে ডাকলেই রিক্সাটা নিয়ে চলে আসবি। অবশ্যই পয়সা পাবি তার জন্য। সেই থেকে নরশুয়া রিক্সা চালায়। নিজের রিক্সা , নিজের রোজগার, আর পার্টির দরকারে অ্যাকশনে লেগে যাওয়া।
কিন্তু আজ? আজ এই জনশূন্য রাস্তায় নিজেকে ডন বলে ভাবতে পারছেনা নরশুয়া। খালি রিক্সার ঝনঝন শব্দ নিজের কানে আগে বেশ সুরেলা ঠেকত। কিন্তু আজ বিরক্ত লাগছে। মনে হচ্ছে একলাথি মেরে শালার ঝনঝনানি লোপাট করে দেয়! ক’দিন বাদে ইলেকশন। ভেবেছিল মাথা গরম করবে না নরশুয়া। তবু শালার বাপটা সব বিগড়ে দিল! লোকাল কমিটি থেকে জানিয়েছে, কটা’দিন একটু মাথা ঠান্ডা রেখে পার্টির কাজটা করে দে তারপর তোর ফ্যামিলি ম্যাটারটা নিয়ে আমরা আলোচোনায় বসব। লোকাল কমিটি মাথা না গলালে নরশুয়া নিজেই একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলত এতদিনে। কমিটির বাচ্চুদা খবর পেয়েছিল সবার আগে। নরশুয়ার মনে হয় এটা নির্ঘাত টিকনার কাজ। এখন নরশুয়ার হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
নরশুয়ার রিক্সা ছোটে অন্ধকার রাতের শহরে। তার চোদ্দপুরুষ বিহার থেকে কবে এসেছিল সে জানেনা। তার জন্ম এখানেই। এই শহর, শহরের মানুষ, মানুষের ভাষা সবই সে জন্ম থেকে এখানেই পেয়েছে। শুধু মা ছাড়া। শুনেছে তার মা নাকি এখানকারই মেয়ে। নরশুয়া তাকে চোখেই দেখেনি।
চার নম্বর পোলের তলা দিয়ে ইটভাটায় যাবার পথ। দিনের আলোয় দেখা যায় নতুন ইটের ধুলোয় লাল হয়ে আছে টানা পথ। নরশুয়া সকাল সাড়ে দশটায় একবার আর বিকেলে সুয্যি ডোবার মুখে এই ইটভাটায় আসে। কদিন আগেও ঘুরে গেছে নিয়ম করে। নরশুয়ার শেষবার আসা সূর্য ডোবার সময়টা মনে পরে। আকাশের লাল রঙে ইটভাটার চারপাশ যেন হারিয়ে গেছে। কেবল হলুদ রঙের শাড়ি পড়া মইনার পাখির মতো শরীরটা জেগে ছিল। চারিদিকে লাল রঙের মাঝখানে হলুদ রঙটা হারাবার পথ পায়না। এলোমেলো হাওয়ায় ধুলো ওড়ে। নরশুয়া দূর থেকে দেখতে পায় মইনা থাক দিয়ে সাজানো ইটের লম্বা প্রাচীর ভেদ করে যায় আসে, মনে হয় রাজার কেল্লায় এক রাজকুমারী। রিক্সার হ্যান্ডেলে একটা মোচড় দিয়ে নরশুয়া রথারোহী যুবরাজের মতো সিটে আসীন থেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকায় এবং হর্ণ টিপে দুবার পঁকপঁক শব্দে চারপাশের পাখপাখালি আর গাছপালায় ঝিরঝির একটা শব্দতুলে মইনার দৃষ্টি টেনে আনে ছোঁ মেরে। মইনা হাসে। নরশুয়া রিক্সায় বসে দু’হাত মাথার ওপর তুলে পাখির ডানার মতো নাড়িয়ে ইশারা জানায় হাসি মুখের মইনাকে। ইশারার মানে আশপাশের কেউ না বুঝলেও মইনা বোঝে। এরমানে হল বাপের সাথে পাকা কথা হয়েছে তার মরদের।
ইটভাটার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তার ওপর নরশুয়ার রিক্সা থামে। শুনশান অন্ধকারে চত্তরটা পুরনো কেল্লার মতো মনে হয়। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসা নরশুয়া তাকিয়ে দেখে, কবেকার এক রাজকুমারীর ভাঙা প্রাসাদের মাথায় চাঁদ উঠেছে। প্রাসাদের ওই পারে গঙ্গার দিক থেকে ধুলো উড়িয়ে আনছে হাওয়া। মিনারের মতো নেভা চুল্লির মাথায় নিকিয়ে রাখা আকাশের গায়ে থালার মতো চাঁদ। মইনার মুখের মতো উজ্জ্বল। নরশুয়া রাতের নির্জনতা ভেঙে আচমকা হর্ণ বাজায়। ঘুম ভাঙা পাখিদের ডানার ভৌতিক শব্দে নরশুয়া দেখে কেল্লার মাঠ দুলছে হাওয়ায়। রিক্সা থেকে নেশায় হালকা হয়ে যাওয়া শরীরটাকে সে নামিয়ে আনে মাঠে। পা টলছে তার। দাঁড়াতে পারেনা। মাঠের মাঝ বরাবর এসে শরীর এলিয়ে সে শুয়ে পরে। দুহাতে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে ওঠে সে, মইনা, মইনারে।
ভোরের ফুটি ফুটি আলো আর হাওয়ায় গা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে। দূরে মাঠের প্রান্তে দুএকটা মেয়েলি কন্ঠস্বর কানে আসতেই লাফ দিয়ে ওঠে নরশুয়া। তার পরনের লুঙ্গি কোমড় ছাড়িয়ে বুকের ওপর জড়ো হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি করে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। রাস্তার ওপর কুয়াশার চাদরে ঢাকা রিক্সাটা দেখা যাচ্ছে। মাঠ পেরিয়ে সেদিকে হাঁটা দেয় নরশুয়া। বুঝতে পারে দূরে মেয়েমানুষগুলো নিজেদের মধ্যে তাকে নিয়ে গা ঠেলাঠেলি করে হাসছে।
শিশির ভেজা রিক্সায় উঠে নরশুয়া প্যাডেলে পা রাখে। মইনাকে তার বাপ ঘুটিয়া নতুন বউ করে ঘরে নিয়ে গেছে তিনদিন হল। মইনা এখন তার নতুন মা। নরশুয়া মইনার মুখ দেখেনি তারপর থেকে। টিকনার সাথে মন্দিরে শুয়ে থাকার নামে রাত জাগে সে। চোখ বুজে এলেই মইনা তার স্বপ্নে নেমে আসে ইটভাটার মাটির ঢিবি থেকে। এই গলদ স্বপ্ন দেখা পাপ। চোখ টান করে থাকে সে।
#
রিক্সায় ঊঠে নরশুয়ার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে একবার। তার মনে পরে সিটের নিচে রাখা রিভাল্ভারের কথা। এভাবে রিক্সাটা ফেলে রেখে যাওয়া তার উচিত হয়নি। তাড়াতাড়ি সিটের নীচে হাত ঢূকিয়ে ঠান্ডা হয়ে থাকা বস্তুটা একবার আন্দাজ করে নেয় সে। এই প্রথম তার মনে হল অস্ত্রটা যেন বড় বেশি ঠান্ডা হয়ে আছে। কোনদিন এমনটা মনে হয়নি তার। সে নিজেও যেন কেমন ঠান্ডা অনুভব করছে। চারদিকে একবার তাকিয়ে সে অস্ত্রটা বার করে সিটের নীচ থেকে। লোকাল কমিটি থেকে ভোটের কিছুদিন আগে বাচ্চুদা তার হাতে দিয়ে বলেছিল, দরকার হলে চমকাবি, তাতেই কাজ হবে। নরশুয়ার হাত কাঁপছিল তখন। বাচ্চুদা ধমক দিয়েছিল, ন্যাকামো করিস না! নরশুয়া যন্ত্রটা নিজের কোমড়ে গুঁজে নেয় সাবধানে।
বাচ্চুদার মুখের ওপর কথা চলেনা। নরশুয়া বলতে চাইছিল অন্যকথা। মইনাকে বিয়ে করার কথা। মইনার টিয়ারঙ শাড়ির গায়ে ঝলমল করছিল রোদ। নরশুয়ার গায়ের ঘামে তখন চোলাইয়ের গন্ধ। খানিকটা তফাতে রিক্সা থেকে নেমে সে হাত নাড়িয়ে মইনাকে ইশারা করে জানিয়েছিল তার বাপ আসবে বিয়ের কথা কইতে। মইনা বুক সমান ইটের পাঁজায় ঠেসান দিয়ে হাসছিল। নরশুয়ার ইচ্ছে করছিল কাছে গিয়ে মইনার নাকে দুলে ওঠা নোলকের ছিলায় ঠিকরে ওঠা আলো ছুঁয়ে দেখে। কিন্তু ইটভাটার মালিকের কড়া হুকুম, কাজের সময় বাইরের লোকের সাথে কথা বললে কাজ চলে যাবে।
নরশুয়াকে বিমনা লাগে বাচ্চুদার। সে আচমকা নরশুয়ার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, কিছু বলবি, পকেট থেকে একশটা টাকা বার করে এগিয়ে দেয়, এটা রাখ, লাগলে বলবি আবার দেব, কাজটা ঠিক করে কর, এবারের ভোটটা খুব ইমপর্টেন্ট।
একটা কথা ছিল।
কী?
আমার বিয়ে।
তাতে কী হয়েছে? ভোট মিটে গেলে বিয়ের দিন দেখে টোপর পড়ে নিবি। মেয়েটা কে?
ইটভাটার মইনা। বাপ গেছে কথা কইতে।
আচ্ছা! ওই কারণে তোকে মাঝে মাঝেই ইটভাটার ওখানে দেখা যেত।
নরশুয়া মাথা নামিয়ে হাসে।
তা তোর বউ তো রোজগেরে । বিয়ের পর কী করবে?
ওকে আর কাম কাজ করতে দেবনা।
কেন? দু-পয়সা ঘরে আনলে তোরই তো ভাল।
নরশুয়া চুপ করে থাকে।
নরশুয়ার রিক্সায় আজ কোন আওয়াজ নেই। কুয়াশায় ভিজে সেও চুপ করে থাকে। নরশুয়ার ভাবতে সুবিধে হয় পেছনের কথাগুলো। তার মনে হয় এই রিক্সা চালিয়ে যদি সে নগর প্রান্তর পার হয়ে চলে যায় ভিনদেশে! সেখানে তাকে কেউ চিনবেনা। ভোটের কাজে তার উৎসাহ নেই আর। একবার একবার মন করছে বাড়ি যায় সে। মাকে সে কোনদিন চোখেই দেখেনি। এমনকি ছবিও দেখেনি। মায়ের নামটাও শুনেছে বলে মনে পড়ে না। মনে মনে মইনাকে মায়ের মতো ভাবতে গিয়ে তার কেমন যেন সব গুলিয়ে যায়। রাগ গিয়ে পরে বাপের ওপর। বাচ্চুদার সেদিনের কথাও নরশুয়ার ভাল লাগেনি। বলেছিল বিয়ের পর মইনাকে আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিবি, আমি কাজ দেব। কমিটির সবাই কথাটা শুনে খুব হাসছিল। নরশুয়ার এই তামাশা ভাল লাগছিল না। যদিও চুপ করে ছিল সে।
নেশার আচ্ছন্নতা কাটলে নরশুয়া ক্লান্ত বোধ করে। সে কতক্ষণ রিক্সা চালিয়ে চলেছে সে নিজেই জানে না। ততক্ষণে রোদ উঠেছে, শীতের সকালে হালকা রোদে তার শরীরে বিনবিন করে ফুটে উঠেছে স্বেদবিন্দু। চারপাশে তাকালে সে চিনতে পারেনা জায়গাটা। কোনোদিন এসেছিল বলে মনে হয়না তার। যেমন খুশি চালাতে চালাতে এ কোথায় এল সে! এটাই কী তবে ভিনদেশ, যেখানে সে আসতে চাইছিল? তবে সে যদি আর ফিরে না যায়! পার্টি অফিসের বাচ্চুদা তাকে ভোটের কাজে ব্যবহার করার জন্য খোঁজ নেবে। থানায় খবর যাবে নিশ্চয়। আর মইনা? মইনার কথা মনে হতে একবার নরশুয়ার মনে হয় বাড়ি ফিরে যাবে সে। বড় ইচ্ছে করে মইনাকে বুক চিরে দেখাতে তার কষ্ট।
একটা ভাঙা একতলা বাড়ি। নরশুয়া বাড়িটার সামনে রিক্সা থামায়। জায়গাটা সুনসান। বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে তার। পরিত্যক্ত ইটভাটার মতোই বাড়িটার চারপাশে মাটির ঢিবি আর ইটের পাঁজা। নরশুয়া আগাছা সরিয়ে সামনের ভাঙা বারান্দায় বসে। বারান্দার সামনে একটা নিমগাছ। গাছের গায়ে হেলান দেওয়া একটা টিনের ছাউনি। পেছনে ঘরে ঢোকার মুখটা হাঁ হয়ে আছে, দরজা নেই। ভেতরে একটা ভাঙা জানলা থেকে রোদ এসেছে শুকনো পাতা আর জঞ্জালে ভরা মেঝের ওপর। নরশুয়া চারপাশ দেখতে দেখতে বারান্দাতেই গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। শুয়ে পড়তেই খিদে তেষ্টা আর ক্লান্তিতে তার দুচোখের পাতা ভারি হয়ে আসে।অদ্ভুত একটা শীতলতা অনুভব করে সে। স্যাঁতস্যেঁতে ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে মায়ের কথা মনে পড়ে তার। তার যে সত্যিই কোন মা ছিল এককালে, সেকথা এই প্রথম তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল। এখন তার খুব ইচ্ছে করছে মইনাকে মা বলে ডাকতে। মুখটা মনে করে একবার সে অস্ফুটে উচ্চারণ করল’ আহ্’ শব্দটা। একটা স্বস্তির নিশ্বাস এল ভেতর থেকে। তারপর নিজের কোমড়ে গুঁজে রাখা যন্ত্রটা বার করে নিজের কপালে ঠেকাল পরম শান্তিতে।
এইমাত্র এক ধাতব শীতলতা তার কপালে যেন অলৌকিক চুম্বন এঁকে দিল।