সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
(দুজন সুফী কবির অল্প কয়েকটি পদ ও কাব্যাংশ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা)
পশ্চিম এশিয়া থেকে উত্তর-মধ্য ভারত হয়ে সুফি ধর্ম যখন বাংলায় এসে পৌঁছল তখন স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে, স্থানীয় ধর্ম ও চিন্তাধারার সঙ্গে তার একটা সংশ্লেষণ হল। বিশেষ করে যোগতন্ত্র নাথ, বৈষ্ণব ধর্মের কিছু কিছু উপাদানের সঙ্গে সুফিবাদ কিছু ঐক্য খুঁজে পেল। স্থানীয় অমুসলিম জনসাধারণের মধ্যে সুফিধর্ম বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল এই কারণে যে বৌদ্ধ নাথ, সহজিয়া বৈষ্ণব, নিম্নবর্গের মতবাদের অনেকেই সুফী সাহিত্যে এদের প্রভাব সন্ত প্রচারক থেকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। সৈয়দ সুলতানের ‘নবী বংশ’ থেকে কিছু বিবরণ পাওয়া যায় —
‘আলিমে কিতাব পড়ি বাখানে যে কালে
হিন্দুয়ানী কবি যদি না বাখনি বোলে।
বঙ্গদেশী সকলেরে কিরূপে বুঝাইব?’
রক্ষণশীলদের কাছে হিন্দু উপাদান ব্যবহারের জন্য কবি নিন্দিত হয়েছিলেন উদ্ধৃত অংশটি তারই উত্তর
‘যে সবে আপনা বোল না পারে বুঝিতে
পাঁচালী রচিলাম করি আছএ দুষিতে।
মুনাফিকে বোলে আক্ষি কিতাবেতু কাড়ি
কিতাবের কথা দিল হিন্দুয়ানী করি।’
‘সুফি কবির কাব্যাংশটি মো: জহির রায়হান-এর ‘সৈয়দ সুলতানের জ্ঞানচৌতিশা’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত। যাতে সাধারণ লোক বুঝতে পারে সে কারণে প্রচলিত হিন্দু পরিভাষা ও পুরানের কাহিনীর অংশ সুফি কবিরা ব্যবহার করতেন।
বাংলা ভাষায় ধর্মকথা বর্ণনার কারণে সামাজিক বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন সৈয়দ সুলতান। এর প্রধান কারণ হয়তো ছিল এই যে কবি বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিকে ব্যবহার করেছেন। ফলত বিভিন্ন ধর্মের বিশেষত হিন্দুধর্মের পরিভাষা স্বাভাবিক ভাবেই ঢুকে পড়েছে। যেহেতু ভাষা ব্যাপারটি সাংস্কৃতিক, তাই এ অনুপ্রবেশ ছিল খুব স্বাভাবিক। (মো: জহির রায়হান ঐ)
আলি রাজার একটি কবিতা —
গুর্জ্জরী
বিরহ
শুন সখি সার কথা মোর। কুল বধূ প্রাণি হরে সে কেমন চোর। সে নাগর চিত্ত চোরা কালা যার নাম। জিতা রাখি প্রাণি হরে বড় চৌর্য্য কাম॥ মোর জীউ সে কি মতে লই গেল হরি। শূন্য ঘরে প্রেমানলে পুড়ি আমি মরি॥
গুরু পদে আলি রাজাগাহে প্রেম ধরে। প্রেম খেলে নানারূপে প্রতি ঘরে ঘরে॥
যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য সংকলিত আলি রাজার এই পদটির আলোচনা করে শশিভূষণ দাসগুপ্ত লিখেছেন— ‘‘এখানে লক্ষ্য করিতে পারি, ব্রজের নাগর ‘কালা’র যে ‘কুলবধূপ্রাণি’ হরণ করা লীলা তাহা যে পরব্যোমের ওপারে কোনো অপ্রাকৃত বৃন্দাবনেই সংঘটিত হইতেছে তাহা নহে, প্রতি ঘরে ঘরে অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই চলিতেছে ‘নগর কালা’র এই প্রেমলীলা, গুরুপদ আশ্রয় করিয়া চিত্তবিশুদ্ধির সাধনায় অগ্রসর হইলেই এই সত্য উপলব্ধি করা যাইবে।’’ শশিভূষণ দাশগুপ্ত : ১৩৮১ বঙ্গাবদ, ৩৬৭)
দেখা যায় কোনও কোনও ধর্মের ভাবধারা তাহার ব্যাপক ও গভীর প্রসারের দ্বারা তাহার একটি সাম্প্রদায়িক ধর্মের রূপ পরিত্যাগ করিয়া সমগ্র জাতির একটি চিত্তপ্রবণতা রূপে একটি সাংস্কৃতিক রূপ পরিগ্রহ করে। কোনও একটি বিশেষ-জাতীয় সাহিত্যও যখন এইরূপ ব্যাপক ও গভীর প্রসারের দ্বারা জাতীয় চিত্তপ্রবণতারই নিয়ন্ত্রক হইয়া দাঁড়ায় তখনই সাহিত্য সংস্কৃতির গভীর রূপ ধারণ করে। সাংস্কৃতিক রূপে পরিণত এই-জাতীয় ধর্ম ও সাহিত্যকে জাতি অনেক সময় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া একটা সামাজিক উত্তরাধিকার রূপে গ্রহণ করিতে থাকে।
বাংলাদেশের কয়েকটি ধর্মমত এবং তদাশ্রিত সাহিত্য এইরূপ একটা সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রূপে বৃহৎ বাঙালী সমাজে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার লাভ করিয়াছে যে সমাজ তাহার সম্বন্ধে এই কথাটি স্পষ্ট মনে রাখিতে হইবে যে তাহা একটা বড় ‘বাঙালী সমাজ’; তাহা ‘বাঙালী সমাজ’ এই জন্য যে সেই সমাজের অন্তর্ভুক্ত জনগণ তাহাদিগকে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীষ্টান রূপে অত্যন্তভাবে পরস্পরবিরোধী শ্রেণীতে ভাগ করিয়া লয় নাই; অর্থাৎ ধর্মবিশ্বাস রূপে যে সম্প্রদায় যে মতই গ্রহণ করিয়া থাকুক না কেন সাংস্কৃতিক জীবনে আভ্যন্তরীণ চিত্ত-প্রবণতার বিচারে তাহাদের একটা অখণ্ড ‘বাঙালী’ পরিচয় ছিল। বাংলাদেশের প্রাচীন ও মধ্যযুগের বৈষ্ণব-ধর্ম ও সাহিত্য, নাথ-ধর্ম ও সাহিত্য ও বিভিন্ন সহজিয়া-ধর্ম ও সাহিত্য এইরূপে বাংলার সমগ্র সাংস্কৃতিক জীবনের উপরেই প্রভাব বিস্তার করিয়াছে; তাহার ফলে বৃহৎ বাঙালী সমাজ যখন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীষ্টান আদি রূপে নিজেদের ধর্মের ক্ষেত্রে পৃথক বলিয়া মনে করিতে লাগিল তখনও তাহার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে কেহই পরিত্যাগ করিল না, তাহারা সেই সংস্কৃতি-প্রভাবিত চিত্তপ্রবণতাকে পৃথক পৃথক ধর্মের ক্ষেত্রেও সক্রিয় করিয়া লইল। সেই কারণে দেখিতে পাই বাংলাদেশের হিন্দু যেমন ‘বাঙালী হিন্দু’ বাংলাদেশের মুসলমানও তেমনই ‘বাঙালী মুসলমান’, বাংলাদেশের বৌদ্ধ-খ্রীষ্টানগণেরও তাই একটা বিশেষ বাঙালী পরিচয় আছে।’’
(শশিভূষণ দাশগুপ্ত ১৩৮১ : ৩৫৪ - ৫৫)
‘‘সুফীমতের ইসলামের সঙ্গে বাঙ্গালার সংস্কৃতির মূল সুরটুকুর তেমন বিরোধ নাই। সুফীমতের ইসলাম সহজেই বাংলার প্রচলিত যোগমার্গ ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক সাধন মার্গের সঙ্গে একটি আপোষ করিয়া লইতে সমর্থ হইয়াছিল।’’
(সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ২০০৯, ২৩২-তে উদ্ধৃত)
সুফিমতের আংশিক সাদৃশ্যই রয়েছে রাধা-কৃষ্ণ লীলায়। তাই একেশ্বরবাদী ও অবতারবাদে আস্থাহীন মুসলমান কবিগণের কল্পনায় সাধারণত রাস, মৈথুন, বস্ত্রহরণ, দান, সম্ভোগ, বিপ্রলব্ধা প্রভৃতি প্রশ্রয় পায়নি। কেবল রূপানুরাগ, অনুরাগ, বংশী, অভিসার মিলন, বিরহ প্রভৃতিকে গ্রহণ করেছেন তাঁরা জীবাত্মা-পরমাত্মা সম্পর্কসূচক ও ব্যঞ্জক বলে। তাঁদের রচনায় অনুরাগ, বিরহবোধ এবং জীবন জিজ্ঞাসাই (আত্মবোধন) বিশেষ রূপের প্রকট। (আহমদ শরীফ, ২০০৯, ২৩৩)। কয়েকটি সুফীপদ এখানে উদ্ধৃত হল—
আলি রাজা
শ্যাম কিরূপে দেখিমু তোরে, কালা কিরূপে পাইমু ভোরে ধু
দূর দেশীর সখি, করিলাম পিরীতি, অবলা গোপালের নারী।
দূর দেশী ছিল, ঘর চলি গেল, না চাহিলাম নয়ান ভরি॥
পিরীতির আনলে, সর্ব অঙ্গ জ্বলে, না দেখি শ্যামের মুখ।
এ তিন ভুবনে, কালাকানু বিনে, কোন কুলে নাহি সুখ॥
মোর দুঃখ ভার, গুরুপদ সার, কহে আলি রাজা হীনে।
ভাই পাড়াপড়ি, ইষ্ট ধন কড়ি, সার না দেখি তুয়া বিনে॥ ৩৮
মারহাটি
বিরহ
সই না লো হে, আমার দুঃখ সাক্ষী পীতাম্বর॥ ধু।
সর্ব জগ দেখি ধান্ধা।
অই চতুর্ভূজ বিনে, আনরে না মানে মনে,
সে রাধা চরণে প্রাণি বান্ধা॥
বিষ লাগে বসন্তের যাও, নগরে বেড়াও তুমি,
কুলবতী বধূ আমি,
অবলাকে দেখা দিয়া যাও। রহিতে না দিলা সুখে॥
আমি রাজা গাহে কালা,
সহন না যায় জ্বালা, বিষানল দিলা মোর বুকে॥ ৩৯
পূর্বরাগ
সখিগণে লয়ে সঙ্গে, রাধিকা চলিলা রঙ্গে,
যায় রাধা যমুনার ঘাটে।
কদম্বের তলে বসি, কানাই বাজায় বাঁশী,
ধবলী শাউলি চরে মাঠে॥
কানাই বসিয়া বাটে, রূপ দেখি প্রাণ ফাটে,
আজ মোর কি হয় না জানি।
চল সখি ঘরে যাই, কদম্ব তলে সে কানাই,
প্রাণ ফাটে তার বাঁশী শুনি॥
অধীন রাজার বাণী শুন রাধা সুবদনী,
বন্ধুয়া না দিব তোমা ছাড়ি’।
চতুরালী দূরে যাবে, পশরা ভাঙ্গিয়া খাবে,
বলে ছলে লৈব ঘট কাড়ি’॥
দেখিয়া মথুরা-পতি স্থির নহে তোর মতি,
এই বাটে কেন আইলা পুনি।
তুঁই যে অবলা নারী, কানাই প্রাণের বৈরী
এইভাবে হারাইবে পরাণী।৪০
কানড়া
বিরহ
সতত বধূর লাগি জ্বলে অবলার চিত। ধু
দূরদেশী সনে প্রেম বাড়াইনু অতি।
সেই ধরি হৈল মোর অনলে বসতি।
প্রেমের ঔষধ খাই হইলুম উদাস।
জগলোকে কলঙ্কিনী বোলে বারমাস।
শাশুড়ী ননদী বৈরী স্বামী হৈল ভিন্।
আর জ্বলা কালার সহিমু কত দিন।
গুরুপদে আলি রাজা গাহিল কানড়া।
চিত্ত হন্তে প্রেমানল না হউক ছাড়া।৪১
কামোদ
যমুনাতীরে মিলন
সদায় রাধার মনে জ্বালা শুন লো সই। ধু
কি দিয়া বান্ধিমু হিয়া, মাধবেরে না দেখিয়া,
প্রাণি মোর গেল যার সনে।
না দেখিলে চক্রপাণি, নিরোধ না মানে প্রাণি,
দহে তনু কালা কাম বাণে।
না দেখি হরির মুখ, বিদরে দারুণি বুক,
সহিতে না পারি প্রেমানল।
হই লাজ মান ছাড়া, কাঁখেত কলসী রাধা,
নিঃসরিল ভরিবারে জল।
হীন আলি রাজা বোলে, গেল রাধা নন্দীকূলে,
দেখিল যমুন তীরে হরি।
বংশী বাহে গাহে গীত, মজিল রাধার চিত,
কেলি হৈল কায়-প্রাণে জড়ি॥ ৪২
রামকেলী
বিরহ
সহন না যায় দুঃখ আর বন্ধুর লাগি। ধু
হাহা হরি কি করিলা, অবলারে ভুলাইলা,
ভঙ্গিমা করিয়া প্রেম ছলে।
নানাগীত যন্ত্র শুনি, কূলবধূ উদাসিনী,
হইয়া পড়িনু তোর ভোলে॥
তোমার কঠিন প্রাণি, তাজি ভজমান রাণী
ছাপাইলা কোন দোষ নাই।
কামিনীর কান্ত বিনে, লক্ষ্য নাই ত্রিভুবনে,
বেয়াকুল কানুরে হারাই॥
হীন আলি রাজা গায়, ভজ রাণী রাঙ্গা পায়, উর্দেশয়া পূজ কায়লা হেন প্রভু অধিকার,
সেবক না ত্যজে যার নিজ দাস রাখিব চরণে।
(যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য, ১৯৮৫, ৫৪-৫৫)
ভারতে এসেই ভারতীয় যোগ, দেহতত্ত্ব প্রভৃতির প্রভাবে পড়েছিলেন ইরাণী সূফীরা। সূফী সাধনার সঙ্গে যোগ ও দেহতত্ত্বের সমন্বয় সাধন করেই তাঁরা শুরু করেন নতুন সূফী চর্যা। পাক-ভারত মুসলিমের অধ্যাত্ম সাধনা যোগ-দেহতত্ত্ব বিহীন নয় এই কারণেই...। অতএব সঙ্গীত, যোগ, রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব প্রভৃতিই রচনা করেছে বাঙালী মুসলমানের অধ্যাত্ম তথা মরমীয়া সাধনার ভিত্তি। (অাহমদ শরীফ : ২০০৯, ২১৯) বাংলায় লিখিত বিশেষ ভাবে সূফী প্রভাবান্বিত গ্রন্থ আলিরাজার ‘জ্ঞান সাগর’। ইহাতে সূফীধর্মের অনেকটা প্রেমের রূপ আমরা পাই কিন্তু উহার মধ্যে নর-নারীর যুগল-প্রেম, যোগ-সাধনা ও ফকিরী-ধর্মের গোপনীয়তা সম্বন্ধে অনেক উল্লেখ আছে :
প্রথমে আছিল প্রভু এক নিরঞ্জন।
প্রেমরসে ডুবি কৈল যুগল সৃজন॥
প্রেমরসে ডুবি প্রভু জাহাকে সৃজিলা।
মোহাম্মদ বুলি নাম গৌরবে বা খিলা॥ (২৪)
যুগল না হইলে কেহ না পারে চলিতে।
যুগ ভিনে প্রেমরস না পারে ভুগিতে॥
একাত্রকি প্রেম না হন কদাচন।
যুগল হইলে যোগ্য পিরীতি ভজন॥ (২৫)
তারপরই এই আল্লা - মহম্মদের যুগল - প্রেম যে নরনারীর প্রেমে রূপান্তরিত হইল এবং নারী ব্যতীত যে সাধনা সম্ভব নয়, তাহার বহু দৃষ্টান্ত দিয়েছেন (আমরা কয়েকটি উদ্ধত করছি)
পরম সুন্দরী ছিল কৈবর্ত কুমারী।
নবী ছোলেমান ভক্ত পাই সেই নারী॥
গঙ্গা গৌরী যুগ নারী রাখি দিগম্বর।
ভস্মযোগে সাধি সিদ্ধ হইল মহেশ্বর॥
আছিল আয়েসা বিবি পরম সুন্দর।
সেই রূপে মোহাম্মদ ভক্ত পয়গম্বর॥ (৩০-৩১)
তারপর আলি রাজা বলিতেছেন :
স্বকীয়ার সঙ্গে মহে অতি প্রেমরস।
পরকীয়া সঙ্গে যোগ্য প্রেমের মানস॥ (৮০)
এই সব বর্ণনা বৈষ্ণব গোস্বামিগণের পরকীয়া - গ্রহণ বর্ণনার ন্যায়। তারপর যোগের কথা এবং যোগপথ যে শ্রেষ্ঠ। এ-কথাও নানা স্থানে।
‘‘মিশাই পরমহংস পবনের সনে।
পূরক রেচক সঙ্গে হৃদের কম্মনে।
পূরক রেচক সঙ্গে রাখি মহাহংস।
এক যুগ সাধনে যে শরীর নহে ধ্বংস॥ (৫৫)
তন মধ্যে সরোবর ত্রিবেনীর ঘাট।
. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
পূরক রেচক হয়ে ত্রিবেণীর মাঝ॥’’
তারপর নর-নারীর যুক্তযোগ পন্থার কথা বলা হইযাছে ‘‘কোরানে কহিআছে জগত ঈশ্বরে।
যোগপন্থে নরনারী সব চলিবারে॥
নরনারী সব যদি ফকিরী না করে।
পুণ্যবলে স্বর্গে গেলে না দেখিবে মোরে॥
যুক্তযোগে নর-নারী করিতে গমন।
সকলের নিজ ঘটে প্রভুর আসন॥ (১২৩)
(উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য; ১৪২২ : ৫১৩ -১৪)
আবার আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিকা প্রশ্ন রেখেছেন, হিন্দু ও নাথ ধর্মের প্রভাবের ফলে মুসলমানদের মধ্যে এক ধরনের সূফী মতবাদের সৃষ্ট হয়েছিল। একদল অর্ধ-শিক্ষিত মুসলমান সাধক এবং কবি নাথ ধর্মের নিরঞ্জনবাদ, নাথ-তন্ত্র-শাস্ত্র, হিন্দু-তন্ত্র-শাস্ত্র এবং ইসলামের কিছু ভাবধারার জগাখিচুড়ি বানিয়ে এক ধরনের সুফী মতবাদ সৃষ্টি করেছিল, সেটা অাদতে যে কি ধর্ম তা বলা কঠিন (২০০৯ : ১৩৩)। কিন্তু অনেক বাঙালি সুফি কবির মধ্যে প্রচুর পাঠচর্চার পরিচয়।
বাংলা সুফি সাহিত্যে আলি রাজা যেমন এক অগ্রগণ্য তাত্ত্বিক কবি সেরকম সৈয়দ সুলতানও এক তাত্ত্বিক কবি, পদকর্তা। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ সুলতান একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি, আলি রাজা ও সৈয়দ সুলতান বাংলা সুফি সাহিত্যে দুজন প্রধান কবি। এঁদের সাহিত্যে বাংলা প্রচলিত বৈষ্ণব ও নাথ সাহিত্য ও যোগ সাধনার একটা আত্তীকরণ দেখা যায়। এখানে সৈয়দ সুলতানের পাঁচটি পদ দেওয়া হল। সৈয়দ সুলতান সম্পর্কে নিবন্ধ এ সংকলনে মুদ্রিত হয়েছে।
সৈয়দ সুলতান
রাগ বসন্ত
শ্রীকৃষ্ণের রূপ
কত কত মোহন মোহানি জান। ধু
কুটিল কুন্তল ফান্দ, বেড়ি আছে মুখ চান্দগুলি
গণে বাজাইতে আস।
জেহেন নির্মল শশি ঢাকিছে জলদে আসি,
দেখা দিলে তিমির বিনাশ॥
সুগন্ধি তিমির কেশ রহিছে মোহোন ভেস
মুখ চান্দ রহিছে ছাপাএ।
একেবারে অনুপাম, নিশি দিশি একহি ঠাম
লক্ষি বারে লক্ষ্যণ ন জাএ
কিবা রাত্র কিবা দিন, নহে রূপ ভিন্ন ভিন
এ চান্দ সুরজ নহে তার।
ছৈঅদ ছোলতানে কহুঁ, সেই সে আহ্মার পহুঁ
দেখা না দে বিদিত সভার॥ ১
আত্মবোধন
কত পন্থ কুল অন্ত নাই। চৌদিকে করিলঘোর,
পন্থের না পাইলাম ওর,
ওরে বিবাদে লাগিল কাল দেবা রে॥
কহে সৈয়দ সুলতানে, নৌকাখানি আনিলাম পানে,
না করিলাম কোন ব্যবহার।
আগেগাছে না শুনিলাম, মায়াজলে বন্দী হৈলাম
ওরে জিজ্ঞাসিলে কিদিব উত্তর॥ ২
আশোয়ারী বা গৌরী
মিলন
নন্দ আসি জয় দেওরে, আমার গোপাল আইসে ঘরে। ধু
মনেতে আনন্দ অতি ঘরে কেহ নাই।
আজু রাধার শুভ দিন মিলিল কানাই।
অপরূপ বিপরীত কি বলিব কারে।
নানা রূপে করে কেলি ভ্রমরা না ছাড়ে।
জল নাহি কলসে যমুনা বড় দূর।
চলিতে না চলে রাধার চরণে নূপুর॥
ভৃঙ্গারের জল দিয়া পাখাল দুই পাও।
গঙ্গার জল সাঁচরি’ বন্ধেরে করি বাও॥
কহে সৈয়দ সুলতানে মনেতে ভাবিয়া।
পর কি আপনা হয় পিরীতি লাগিয়া॥ ৩
প্রার্থনা
শ্যাম মোরে করিও দয়া, একেবারে না ছাড়ো মায়া;
ও কালা চান্দ পরদেশী!
প্রেমসাগরে ডুবি, হর-ঘড়ি তোমারে সেবি।
মন বান্ধ্যাছ শিলার ডোবে, পাসরি রহিলা মোরে।
পিরীতি তোমার সনে, আড়া পাড়া সবে জানে,
দৈবে কলঙ্কিনী হৈলাম, নয়ান ভরি না চাহিলাম।
সুজনে পিরীতি করি, একেবারে না যায় ছাড়ি।
জনমে জনমে পালে, সঙ্গে থাকে নিদান কালে।
কহে সৈয়দ সুলতানে, রাখ প্রাণি দেখা দানে॥ ৪
রাগ মালসী
অনুরাগ
সই বোলম মুই জীব না রে কানু আনিয়া দে।
কালার ভাবে চিত্ত ব্যাকূল আকূল করিছে॥ ধু
চিড়া নহে কলা নহে দধি মাখি খাইতুম।
ঝলক দাপন নহে নয়ান ভরি চাইতুম॥
কাম সিন্দুর নহে তুলিয়া দিতুম শষে।
বন্ধুর ভাবে চিত্ত ব্যাকূল অঙ্গ ছাইছে বিষে॥
চান্দ বঁাকা কানু বঁাকা ঐ কদম তটে।
চম্পার কলিকার ফুল প্রতি ঘটে ঘটে॥
কহে সৈয়দ সুলতান শুন গুণিগণ।
ধড়ের ভিতর মূদ্রা করিছে রোসন॥ ৫
(যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য; ১৯৮৪; ৩৩৪-৩৩৫
উদ্ধৃত পদগুিলতে, ‘শ্যাম, কালা, অবলা গোপালের নারী, কালাকানু, পীতাম্বর, চর্তুভূজ, কানাই, ধবলী, শাওলি, শাশুড়ী, ননদী, কাঁখেতে কলস, যমুনাতীর, বেয়াকুল (আলিরাজা) প্রভৃতি বৈষ্ণব পদাবলীর শব্দ, পিরীতির অনলে অবলা গোশলের নারী, রাঙ্গা চরণ, কানাই বাজায় বাঁশী, কদম্বতলে সে কানাই, যমুনা তীর প্রভৃতি পদাবলীর অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হয়েছে। একই ভাবে সৈয়দ সুলতানের পদগুলিতে ব্যবহার হয়েছে ‘কুটিল কুন্তল’ গোপাল, রাধা, যমুনা, নন্দ, পিরীতি, কালাচান্দ, চিড়া, নহে কলা দধি পদাবলীর শব্দও অনুষঙ্গ। বৈষ্ণবপদাবলীর স্বরন্যাস এসেছে সূফী পদাবলীতে। একে আমরা বললে পারি সাংস্কৃতিক অন্তর্বয়ন। সূফীবাদ, ভক্তিবাদ ও চৈতন্যদেবের বৈষ্ণববাদের পার্থক্য থাকলেও যেগুলির মানবতাবাদ, ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার বিরোধিতার মধ্যে ঐক্য আছে। রবীন্দ্রনাথের উক্তি, ‘যে তাঁহাদের সেই সমস্ত বাণী, সমস্ত সঙ্গীত কেবলমাত্র শিক্ষিত পণ্ডিতমণ্ডলীর জন্য নহে, তাহা গ্রামে গ্রামে নিরক্ষর নরনারীর আদরের ধন, তখন বুঝিতে পারি দর্শন বস্তুটি কি গভীরভাবে আমাদের সাধারণের মগ্নচৈতন্যলোকে প্রবেশ করিয়াছে ও সমস্ত জীবনকে ওতপ্রোত ভাবে পরিব্যপ্ত করিয়াছে।’ (রবীন্দ্রনাথ, ১৩৩২, ২৫) এ ভাবেই বাংলার সূফী পদাবলীগুলি হয়ে উঠেছে শুধু সূফী ধর্মেরই নয় বঙ্গধর্মের দলিল। (উদ্ধত পদগুলি যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের ‘বাংলার বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবির পদমঞ্জুসা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৪ থেকে সংকলিত)
পাঠপঞ্জী — অঞ্জন সেন ও সন্দীপ পাল (স) সুফিবিশ্ব, জাতীয় সাহিত্য, আহমদ শরীফ, ২০০৯ বাংলার সূফীসাধনা, রায়হান রাইল সম্পাদিত ‘বাংলার ধর্ম ও দর্শন’, সংবেদ, ঢাকা। আবুল কালাম মোহম্মদ যাকাকিয়া, ২০০৯, ধর্ম, রায়হান রাইন সম্পাদিত পূর্বোক্তগ্রন্থ।
উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ১৪২২ : বাংলার বাউল, ওরিয়েন্ট, কলকাতামেআ জাহির রায়হান, ২০২১, পূর্বোক্ত ‘সুফিবিশ্ব’ গ্রন্থ
যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, ১৯৮৪ : বাংলার বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবির পদমঞ্জুষা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯২৫ : ভারতবর্ষীয় দার্শনিক সঙ্ঘের সভাপতির অভিভাষণ, প্রবাসীতে ১৩৩২ এ বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়। রায়হান রাইন সম্পাদিত পূর্বোক্ত গ্রন্থে সংকলিত।
শশিভূষণ দাশগুপ্ত, ১৩৫৯ : শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ - দর্শনেও সাহিত্যে, ৪র্থ সংস্করণ, কলকাতা।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ২০০৯ : আহমদ শরীফের বাংলার সূফী সাধনা’তে উদ্ধৃত, রায়হান রাইন সম্পাদিত পূর্বোক্ত গ্রন্থে সংকলিত।