সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
মৃত্যু বিষয়ে ল্যানসেট কমিশনের রিপোর্টঃ
একবিংশ শতাব্দীতে মৃত্যু-আলোচনা নতুন এক তর্কের জন্ম দিয়েছে। একদিকে মানুষ যখন অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় হাসপাতাল নির্ভর চিকিৎসার কারণে সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়ছে ; ঠিক তখন অনেক বেশিসংখ্যক মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা কিংবা মুমূর্ষু অবস্থায় কষ্ট-দুর্ভোগ, ব্যথা উপশমের ন্যুনতম পরিষেবা পাচ্ছে না। সম্প্রতি ল্যানসেট পত্রিকার তরফে ‘ Report of the Lancet Commission on the Value of Death: bringing death back into life’ প্রকাশিত হয়েছে। কমিশনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল, মৃত্যু ও মৃত্যুকালীন অবস্থার ভারসাম্যহীনতা,পরস্পর বিরোধী চিত্র খুঁজে বের করা। সাম্প্রতিককালে মারা যাওয়ার স্থান ও ধরনের আমূল পরিবর্তন এসেছে। মানুষ বেশিদিন বাঁচছে, মারা যাচ্ছে দেরিতে ; আগে পরিবার পরিজনদের মাঝে বাড়িতে মানুষ মারা যেত, এখন মৃত্যু ঘটছে কোনও হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে। জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত নিরর্থক চিকিৎসা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া স্বাস্থ্য- পরিষেবার এক প্রচলিত অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে। পরিবার পরিজনের ভূমিকা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে ; এখন অন্তিম অবস্থার পরিষেবা দেওয়ার মতো উপযুক্ত দক্ষতা ও জ্ঞান তাদের তেমন আর নেই।
ল্যানসেট কমিশন মৃত্যু ও মৃত্যুকালীন ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের কথা বলেছে ; যা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক,ধর্মীয় আন্তঃসম্পর্কিত নানা বিষয়ের সাথে যুক্ত। বর্তমানে ‘মৃত্যু ব্যবস্থা’কে খন্ডিত,রৈখিক, একমাত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্লষণের চেষ্টা করা হয়; ফলে এর গভীরতা ও জটিলতা অনুধাবন করা যায় না এবং প্রয়োজনীয় ভারসাম্য অর্জনে কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়া যায়না । কোভিড-১৯ অতিমারি পরিস্থিতিতে চিকিৎসা-ব্যবস্থার এই বিষয়ে ভারসাম্যহীনতা প্রকটভাবে ধরা পড়েছে।
কমিশন মূলত পাঁচটা নীতির ওপর জোর দিয়েছে - মৃত্যুর সামাজিক নির্ধারক, মৃত্যু ও শোকের মোকাবিলা; মৃত্যুকে শুধু শারীরবৃত্তীয় ঘটনা না ভেবে সম্পর্কনির্ভর ও আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা ; মুমূর্ষু অবস্থার উপযুক্ত সেবার জন্য সাহায্যকারী নেটওয়ার্ক ; মৃত্যু, মৃত্যুকালীন অবস্থা, শোক, বিষাদকে প্রতিদিনকার আলাপ-আলোচনা, কথাবার্তার সাধারণ বিষয় করে তোলা; মৃত্যুর মূল্যকে স্বীকৃতি দেওয়া।
উল্লিখিত সবকটা বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। তবে চিকিৎসক থেকে সমাজবিজ্ঞানী অনেকেই বিশ্বাস করেন, মৃত্যু নিয়ে খোলামেলা আলোচনা অত্যন্ত জরুরি যা মৃত্যুকালীন সমস্যা ও সংকট দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। মৃত্যু সম্পর্কিত ধর্মীয় ও দার্শনিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এই ধরনের আলোচনাকে সম্পূর্ণ ও সমৃদ্ধ করে।
মৃত্যুভাবনায় ধর্মচিন্তা
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে এসেছে মৃত্যুবিষয়ক দার্শনিক ভাবনা, প্রথা, লোকাচার । ধর্ম ও দর্শনে জীবন ও মৃত্যুকে একটা চক্রের অংশ হিসেবে ভাবা হয় ; মৃত্যুকে ‘শেষ’ না ভেবে, দেখা হয় জীবনের পরবর্তী পর্বের প্রবেশদ্বার হিসেবে। ‘সংসার’ ধারণায় জন্ম, জীবন, মৃত্যু ও পুনর্জন্ম –সব মিলে এক অবিরাম চক্র। জীবনের অর্থ মৃত্যুতে শেষ হয়ে যায় না, মৃত্যুর পরেও থেকে যায়। মৃত্যু থেকে পুনরায় জীবনে ফিরে আসার পথকে সুগম করার আকাঙ্খায় মানুষ নানা আচার-অনুষ্ঠান সংগঠিত করে। হিন্দু, জৈন, শিখ এবং বৌদ্ধ ধর্ম এই ধারণাকে মান্যতা দেয়। হিন্দুধর্ম মতে, ব্যক্তির জন্ম মৃত্যু , সুখ-দুঃখভোগ সবই কর্মফল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত,মরণ দেহের ধ্বংস,যা আত্মাকে স্পর্শ করে না, আত্মার জন্ম নেই, মরণ নেই। বেদের যুগে ঋষি-কবিরা মৃত্যুকে কখনও খন্ড দৃষ্টিতে দেখেছেন,আবার কখনও সামগ্রিক দৃষ্টিতে জীবন-মৃত্যুর স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন।বেদের পরবর্তীতে উপনিষদের যুগে এসে তাদের মনে নানা দার্শনিক প্রশ্ন জেগেছে, মৃত্যু কী, তার উদ্দেশ্যই বা কী !
বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম, হিন্দুধর্মের আচারপরায়ণতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সৃষ্টি হয়েছে, তারা বেদবিরোধী। উভয় ধর্মই ইশ্বর স্বীকার করে না। বৌদ্ধ ধর্ম স্পষ্টভাবে কষ্ট-দুর্ভোগ ব্যাখ্যায় জরা,ব্যাধি, মৃত্যুর কথা বললেও বেঁচে থাকার কথাও বলেছে। তবে বৌদ্ধ ধর্মে আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও জৈনধর্ম তা করে। জৈনধর্ম মতে প্রত্যেক চেতন পদার্থেরই আত্মা আছে, তবে সকল আত্মার চৈতন্য সমান নয়। জৈনধর্মে জীবনধর্ম বা চেতনধর্মকে আত্মা বলা হয়েছে। সেই আত্মা দেহ থেকে স্বতন্ত্র এবং অনুভববেদ্য। আত্মা শাশ্বত, অবিনশ্বর ; জীব তার কর্মফল অনুযায়ী দেবতা, মানব, মানবেতর প্রানী কিংবা নরকের অধিবাসীরূপে বাস করে। জীবের চিন্তাভাবনা ও কর্ম, এই দুই মিলে কর্মফল তৈরি হয় এবং এই কর্মফল জন্ম জন্ম ধরে প্রবাহিত হয়। জন্মজন্মান্তরের সাধনার মধ্যে দিয়ে আত্মা বিশোধিত হয়ে গেলে মোক্ষলাভ ঘটে। মৃত্যু দুইজন্মের মধ্যবর্তী এক সোপানমাত্র।
চার্বাকপন্থীরা জন্মান্তরবাদ বা কর্মফলবাদে বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে, দেহ থেকে আত্মার স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই। চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই আত্মা। ক্ষিতি,অপ,তেজ ,মরুৎ চারটে উপাদানকেই কেবল স্বীকার করা হয় ,তারা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশ্রিত হলে চৈতন্যের সৃষ্টি হয়। ‘আমার দেহ’ এই কথার মধ্যে দিয়ে সেই ভাবনাই প্রকাশ পায়, ‘আমি’ ও ‘দেহ’ পৃথক কিছু।‘আমি’ ও ‘দেহ’ শুধু কথার কথা, এদের পার্থক্য করা এক অবান্তর ভাবনা। দেহ ছাড়া আত্মার পৃথক অস্তিত্ব নেই। মৃত্যুর পর দেহ ভস্মীভূত হলে সে আর ফিরে আসে না।
ইহুদি ধর্ম, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম, সকলেই পরকাল এবং পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে। ইহুদি ধর্ম শিক্ষা দেয়, মৃত্যু মুহূর্তে শরীর এবং আত্মা আলাদা হয়,শরীর বিচ্ছিন্ন হতে পারে, কিন্তু আত্মা চিরন্তন। খ্রিস্টধর্ম পরকাল প্রচার করে, ‘দিনের শেষ বিচার’-এ, সারা জীবনের কাজের হিসেব অনুযায়ী নির্ধারিত হয় যে ,‘পুণ্যবান’ বা ভালো মানুষেরা অনন্তকাল স্বর্গে বাস করবে ; আর পাপীরা স্থান পাবে নরকে । ইসলাম ধর্মেও যে ‘ছয় বিশ্বাস’ আছে ,তার একটা হল ‘পরকাল’ বিশ্বাস ; সেখানে মৃত্যুর পর আত্মা এবং দেহের বিচ্ছেদ হয়। তিনটে ধর্মই বিশ্বাস করে, জীবন ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া এক পবিত্র উপহার ।
কনফুসিয়ান বিশ্বাস, সরাসরি মৃত্যুর কথা না বললেও , যা বলে তা হল, জীবনকে দীর্ঘায়িত করতে চাওয়া আসতে পারে ‘ren’ অর্থাৎ উপকার, বা সর্বোচ্চ গুণের ব্যয়ের ফলে ; আর ‘ren’ পেতে গেলে মৃত্যুকে মেনে নিতে হবে। দাওবাদে, মৃত্যু আলোচনায় প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসরণের কথা এসেছে ; মৃত্যু আমাদের জীবনের পুরো প্রক্রিয়াকে অনুভব করতে এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করতে সাহায্য করে। মৃত্যু জীবনের অভ্যন্তরীণ বিষয় ; প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী যা জীবনের একটা প্রয়োজনীয় অংশও বটে।
আফ্রিকার দেশজ ভাবনায় , মৃত ব্যক্তির সাথে জীবিতদের নিয়মিত যোগাযোগ থাকে এবং তার ফলে তাদের আধ্যাত্মিক জীবন সমৃদ্ধ হয়। পূর্বপুরুষরা কখনও দেবদেবীতে রূপান্তরিত হয় না , মৃত্যুর পরে জীবিত ব্যক্তির সংস্করণ হিসেবে রয়ে যায়। জীবিত এবং মৃতের মধ্যে আন্তঃসংযুক্তি আফ্রিকার মৃত্যুব্যবস্থার এক প্রধান বৈশিষ্ট্য। নিউজিল্যান্ডের মাওরি ঐতিহ্যে একজন মৃত ব্যক্তি অবগুন্ঠনের আড়ালে থাকে,যা পার্থিব জগতকে আধিভৌতিক জগত থেকে পৃথক করে রাখে। পরিবারের লোকজন অন্তিম অবস্থার রোগীদের সেবার সময় এমন অবকাশ তৈরি করে যাতে তারা পূর্বপুরুষের পৃথিবীতে জায়গা করে নিতে পারে ।
দার্শনিকদের ভাবনায় মৃত্যু
প্রতিটা যুগই পূর্ববর্তী যুগচিন্তা দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত হয়েছে এবং তাকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে নানা দার্শনিক চিন্তা ভাবনা। ভারতীয় দর্শনে, বেদ ও উপনিষদের ভাবনার অনুসরণ করেই মৃত্যু কিংবা পুনর্জন্মের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।রাধাকৃষ্ণণ ‘ Indian Philosophy’ তে বলেছেন, উপনিষদের যুগ থেকে পুনর্জন্মের ভাবনা দানা বেঁধেছে।
পাশ্চাত্য দর্শন মৃত্যুকে চূড়ান্ত শেষ বিন্দু হিসেবে গণ্য করেছে। মৃত্যুকালীন অবস্থায় সক্রেটিসের শিক্ষা তাঁর একনিষ্ঠ ছাত্র প্লেটোকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল । পাশ্চাত্য দর্শনে প্লেটোই সেই অর্থে প্রথম মৃত্যুবিষয়ে আলোকপাত করেন। তাঁর যুক্তিতে, ‘..... সঠিকভাবে যারা দর্শনচর্চা করে তারা মৃত্যুকালীন অবস্থা এবং মারা যাওয়া ছাড়া আর কিছুই অধ্যয়ন করে না।' প্লেটো ‘ Phaedo’ গ্রন্থে দর্শনকে ভিত্তি করে মৃত্যুর প্রস্তুতি গ্রহণে অনুশীলন ও কর্মপন্থার বর্ণনা করেছেন । মাইকেল দি মন্টাইগনে ‘That to Study Philosophy is to Learn to Die’ রচনাতে একই কথা বলেছেন , মৃত্যুভয় দূর করতে হলে মৃত্যুকে প্রতিবেশী করতে হবে, তবেই মৃত্যুকে পোষ মানানো যাবে। এপিকিউরাস এ প্রসঙ্গে সুন্দর যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘মৃত্যু, খারাপ জিনিসের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, আমাদের কাছে কিছুই নয় ; যেহেতু, আমরা যখন জীবিত, মৃত্যু তখন অনুপস্থিত, আর মৃত্যু যখন উপস্থিত, আমাদের তখন কোনও অস্তিত্ব নেই।’ স্পিনোজা প্লেটোর ভাবনার বিরোধিতা করে বলেন ,‘ মুক্ত মানুষের উচিত মৃত্যু নিয়ে কম ভাবা, কেননা আধুনিক যুগে জ্ঞান, জীবন সম্পর্কে চিন্তাভাবনার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মৃত্যুর ওপর নয়।’ স্পিনোজার এই ভাবনা ‘মৃত্যুকে অস্বীকার’ করার ভাবনার দার্শনিক ভিত্তি বলা যেতে পারে।নীটশেও মৃত্যু নিয়ে চিন্তা না করার কথা বলেছেন। তিনি মৃত্যুর চেয়ে জীবন সম্পর্কিত চিন্তাভাবনাকে অনেক বেশি পছন্দ করতেন।
ফ্রয়েডের ভাবনায় ‘ সব জীবনের লক্ষ্য হল মৃত্যু’, ‘......সব জীবই মরতে চেষ্টা করে ; প্রকৃতপক্ষে তা সকলের কামনার বিষয় ।' তাঁর মতে, 'যখনই আমরা আমাদের মৃত্যুকে কল্পনা করার চেষ্টা করি তখনই আমরা প্রতিফলনে বুঝতে পারি, আমরা সত্যিই দর্শক হয়ে বেঁচে আছি।' আসলে ফ্রয়েড মৃত্যুকে অনিবার্য, স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখেছেন,এর থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে তার ওপর বিশেষ আলোকপাত করেননি। যুদ্ধ,গণহত্যার মতো ঘটনাবলি পরবর্তীতে ফ্রয়েডীয়দের মৃত্যুসম্বন্ধীয় ভাবনায় পরিবর্তন আনে,তাঁরা দেখানোর চেষ্টা করেন এসব মানুষের মৃত্যু সম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনাকে কতটা প্রভাবিত করেছিল।
জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার মৃত্যুকে মানব অস্তিত্বের তাত্ত্বিক কাঠামো এবং গঠনমূলক উপাদান হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি মৃত্যুর সাথে আমাদের সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করেছেন।তাঁর মতে, আমরা নিজেদের মৃত্যু থেকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিতে না পারলেও এর আসন্নতা আমরা অনুভব করতে পারি। মৃত্যু এমন একটা ঘটনা যা অস্বীকার করা অসম্ভব। তাঁর যুক্তিতে এটা এমন একটা ঘটনা যার দায় অন্য কেউ নিতে পারে না , অন্য কেউ আমার হয়ে মরতেও পারে না, আমাকেই এর মুখোমুখি হতে হবে। মৃত্যুই আমাদের বুঝতে সাহায্য করে আমরা কে, জীবনের মূল্য কি ! জাঁ পল সার্ত্রে অবশ্য হাইডেগারের মৃত্যু-ভাবনার সীমাবদ্ধতার কথা বলেন।
একুশ শতকের আমেরিকান দার্শনিক টমাস ন্যাগাল মনে করেন, মানুষের মৃত্যুকে নিয়ে ভয় পাওয়া বা দুঃখিত হবার অন্যতম কারণ হচ্ছে মৃত্যু হলে অনেক ভবিষ্যৎ অভিজ্ঞতার সুযোগ থেকে সে বঞ্চিত হবে তা অনুধাবন করা। আমাদের মৃত্যুর পর অনেক ভালো ঘটনা ঘটবে, এটা যেমন সত্য ; জন্মের আগেও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যখন আমরা পৃথিবীতে ছিলাম না। আগের ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলো নিয়ে আমাদের যদি খেদ না থাকে, মৃত্যুর পরের ব্যাপার নিয়ে কেন আমরা দুঃখিত হব ; কোনোটার সময়ই তো আমরা পৃথিবীতে ছিলাম বা থাকব না।
অনেক সম্প্রদায় এমনটাই বিশ্বাস করে , অসুস্থতা, মৃত্যু ও শোকের সময় আমাদের পারস্পরিক সংযোগ শক্তিশালী হয় । জুলুরা বিশ্বাস করে , ‘কোনও ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি হয়ে ওঠে’। আর এটাই হল ‘উবুন্তু’ দর্শনের মূল কথা ; বলা যেতে পারে মানবতাবাদ সম্পর্কে আফ্রিকার দেশজ ধারণা।কেনিয়ার দার্শনিক জন এমবিতির ব্যাখ্যায় ‘উবুন্তু ’ বা মানবতা হল, ‘ আমি কারণ আমরা আছি এবং যেহেতু আমরা আছি,তাই আমি আছি।’ অবশ্য ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত এর বিপরীতে বলেন , ‘আমি মনে করি ,তাই আমি।’এরই প্রতিফলন ঘটে যে ভাবনায় তা হল, ‘ ব্যক্তি যা কিছু ঘটবে সমগ্র সম্প্রদায়ের সাথেও তা ঘটে এবং সম্প্রদায়ের সাথে যা ঘটবে, তা অবশ্যই ঘটবে ব্যক্তির ক্ষেত্রে ।’ একজন ব্যক্তি যখন মারা যায়, তখন তার মৃত্যুর সাথে অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে গোটা সম্প্রদায়।
মৃত্যু প্রসঙ্গে সুফি ও বাউল দর্শন
সুফিবাদ হচ্ছে ইসলামের আধ্যাত্মিক তাপসদের মরমীবাদ। সুফি কোনও সম্প্রদায় নয়, বরং এটা এক ইসলামিক শিক্ষা, যা মানুষের স্বীয় অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধতার সাথে সম্পর্কযুক্ত। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন হল এই মতবাদের মর্মকথা। ইসলামি পরিভাষায় সুফিবাদকে ‘তাসাওউফ’ বলা হয়, যার অর্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান । আরবের রাজশক্তির প্রতিঘাতে জন্ম নেয় সুফি মতবাদ ,আর একে লালন করেছে পারস্য। ইরান ও মধ্য এশিয়ায় বিকাশের পর পূর্ব দিকে অগ্রসর হলে সেই অঞ্চলের ভাবধারার সঙ্গে সুফি মতবাদের সম্মিলন ঘটে ; দক্ষিন এশিয়ায় এসে আধ্যাত্ম সঙ্গীত চর্যাগীতিতে এর রূপান্তর হয়। সুফি দর্শন অতি সহজে বৌদ্ধদের কাছে গ্রহনযোগ্য হয় এবং বৌদ্ধ মানবতাবাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে মরমী ভাব সাধনা।
সুফি মতবাদের নানা সাহিত্যকর্মে ‘মৃত্যু’ বিষয় হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। যে মূল প্রশ্ন সেখানে ঘুরে-ফিরে এসেছে তা হল- মৃত্যু কি? এটা কি ধ্বংস, নাকি জীবনের অপরিহার্য রূপান্তর ? তের শতকের ফার্সি ভাষার কবি রুমিকে সুফি জগতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর এক কবিতায় সুফি দর্শনের সুন্দর প্রতিফলন ধরা পড়ে ;
মৃত্যু পান করে আমি পাথর হয়ে ছিলাম
আবার পুঁই মেলেছি তরু লতায়,
গাছটি আবার ঢলেছি মৃত্যুর শয়ানে
আবার এসেছি একটি প্রাণীর খাঁচায়
জীবটি আমি লুকিয়েছি ফের মরণের অন্তঃপুরে
ফিরেছি আবার মানুষের রূপ ধরে।
কেন ভয়, কিসের ডরে আঁখি করে ছলোছলো
মৃত্যু আমার কী কেড়ে নিয়েছে বলো?
(‘পাথরে নিমজ্জন’ – অনুবাদঃ বদরুজ্জামান আলমগীর )
সুফি মতবাদে, আমাদের জীবন অনেক অধ্যায় বা স্তরের সমন্বয়ে গঠিত এবং সমগ্রের সাথে একীভূত। মৃত্যু বলে কিছু নেই। প্রতিটা 'মৃত্যু' পরবর্তী অধ্যায় বা স্তরের একটা ভূমিকামাত্র। অস্তিত্বের উপলব্ধির ওপর ভিত্তি করে সত্তার উৎপত্তি। রুমির কবিতায় কোরানের স্তোত্র, ‘আমরা ইশ্বরের কাছ থেকে এসেছি, ইশ্বরের কাছে ফিরে যাবো’– এর প্রতিধ্বনি শুনতে পাই।
সুফিবাদে বিশ্বাসীদের কাছে মৃত্যুর আগে যে চারটে সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে বাঁচিয়ে রাখা ও লালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; তারা হল নিজের সাথে, সমাজের সাথে, প্রকৃতির সাথে এবং পবিত্র অতি-প্রকৃতির সাথে। সুফিবাদ শেখায়,পার্থিব অস্তিত্বের এই চার উপাদানের সাথে আমাদের একটা ন্যায়সঙ্গত ও গঠনমূলক সম্পর্ক থাকা দরকার। মরার আগে আমরা কীভাবে বেঁচে আছি এবং পরে কীভাবে বেঁচে থাকব তার মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সম্পর্কগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সমাজের সাথে সম্পর্ক, সমাজের সাথে আমাদের সম্পর্ক যদি ন্যায় ও কল্যাণের ওপর নির্মিত হয় তাহলে সত্তার পরবর্তী স্তরে এর প্রতিফলন হবে। আমরা যদি সমাজ বা মানুষের প্রতি অন্যায় আচরণ করি, তাহলে আমাদের ওপর তার প্রতিঘাত ফিরে আসবে ।নিজেদের কর্মের স্বর্গ বা নরক আমরা তৈরি করি, এই আচরণই নির্ধারণ করে আমাদের বেদনা বা আরাম, যখন আমরা পার্থিব সত্তা অতিক্রম করে পরবর্তী অধ্যায়ে যাই। বর্তমান জীবন এবং পরবর্তী জীবনের মধ্যে গভীর সংযোগ সংঘটিত হয় অস্তিত্বের ঐক্যের মৌলিক উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে। প্রতিটি মানবজীবন তার থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে ঐশ্বরিক ঐক্যের এক প্রকাশ, যা আমাদের পরিচয় গঠন করতে এবং স্ব, সমাজ, প্রকৃতি ও দৈবের ঐক্য অনুসারে জীবনযাপনের উপায় বেছে নিতে সাহায্য করে। সেই অর্থে সবকিছু একেরই প্রকাশ, মানবতার প্রচুর বৈচিত্র্যের মধ্যে কোনও বিভাজন নেই ।
অস্তিত্বের সবচেয়ে নীচের স্তর বা অবস্থার প্রকাশ হল বস্তুজগতের। জড় জগত হল অস্থায়ী এক অবস্থা ; সুফি উপলব্ধিতে তা 'বাস্তব' নয় , কেবলমাত্র আমরা তার প্রকাশ জানি, ‘বাস্তব’ মেনে বিশ্বাস করি। এই বিশ্বাস ব্যক্তি আমিকে অবনমিত করে, বস্তুগত লাভের অনুশীলনে ব্যস্ত রাখে।এর অনিবার্য পরিণতিতে যুদ্ধ, সংঘাতের চিন্তা, শারীরিক অস্তিত্ব প্রমানের আকাঙ্খা।আসলে মানুষ সত্তার এই সর্বনিম্ন অবস্থা থেকে মুক্ত হতে পারে না ,ফলে তার নিজস্ব সময় ও পরিসরে অন্ধকার চিরস্থায়ী হয়। সুফিবাদে ‘হৃদয়’ হল মানবজাতির সারমর্ম ,যা পবিত্র ,আলো দান করে।জীবনযাপনে আমরা অন্ধকারের মুখোমুখি হই, আমাদের আচরণ অন্ধকার আনতে পারে,কিন্তু আলো হল ঐশ্বরিক মৌলিক উপাদান, যা চিরন্তন। হৃদয়ের বিশুদ্ধতা আমাদের সেই অন্তর্দৃষ্টি দেয়, যা নিজেদের অন্ধকার দেখতে ও বুঝতে এবং তা থেকে আলোয় ফিরিয়ে আনতে সমর্থ করে।
সুফিবাদে সুখ হল এক প্রকার যোগাযোগ। জীবনের উল্লিখিত মূল চারটে উপাদানের সাথে যোগাযোগ এবং শেষ পর্যন্ত সৌন্দর্য, জ্ঞান ও ঐশ্বরিক শক্তির সাথে যোগাযোগ। আমরা যদি সেই সংকল্পে কাজ করি তবে তা সমস্ত অস্তিত্বের ঐক্যের অংশ ইতিবাচক শক্তি তৈরি করবে, যা সমাজে এবং অন্যদের মধ্যেও স্থানান্তরিত হবে। সুফি ভাবনায় এই আলো কেবল জীবনকেই সংজ্ঞায়িত করে না মৃত্যুর ধারণাকেও অস্বীকার করে।
ইমাম আল-গাজ্জালী মৃত্যু-স্মরণ প্রসঙ্গে তিনটে দিকের কথা বলেছেনঃ
* জগতের সাথে যুক্ত উদাসীন ব্যক্তির স্মরণঃ পৃথিবীর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে সে মৃত্যুকে অপছন্দ ও ঘৃণা করে ।
* অনুতাপকারীর স্মরণঃ এই স্মরণে ভয় আরও বেশি আধিপত্য বিস্তার করে, অনুতাপ আরও দৃঢ় হয়। অতীতের ভুলত্রুটিকে সংশোধন করতে তার চেতনা তীব্র হয়ে ওঠে, যার আধ্যাত্মিক প্রতিদান অপরিসীম।
সর্বজ্ঞের স্মরণঃ মৃত্যুর পর সে প্রেমাস্পদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাকে দেখতে পায় এবং বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের সম্ভাবনা কখনও বিস্মৃত হয় না।
এইসব ছাড়াও আরও একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় রয়েছে, যখন তুমি মৃত্যুকে আর অপছন্দ করবে না, মৃত্যু ত্বরান্বিত হওয়া অথবা বিলম্বিত হওয়া কোনও আকাঙ্খাই তোমার থাকবে না ,তুমি তখন শুধু প্রিয়জনের আদেশকেই প্রাধান্য দেবে। কেবলমাত্র তখনই তুমি পরিপূর্ণতা ও আত্মসমর্পণের জায়গায় উপনীত হবে।
সুফিরা প্রায়শই নবী মুহাম্মদের একটা হাদিসের উল্লেখ করে থাকে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘ মানুষ ঘুমিয়ে থাকে এবং যখন মারা যায় তখন সে জাগ্রত হয়।’ রুমির ব্যাখ্যায় এই কথার অর্থ হল, নবী অনন্তকালের প্রভাত আলোর আগমনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে আমরা আমাদের বর্তমান জীবনে স্বপ্নদর্শীর মতো যে সমস্ত কাজ করেছি তার যথাযথ ব্যাখ্যা করা হবে। তখন আমরা স্বপ্নের অবয়বগুলোকে আর অস্পষ্ট দেখবো না, বরং তা বাস্তবতা হিসেবে উন্মোচিত হবে। তিনি উপদেশ দিয়েছেন ‘ মৃত্যুর আগেই মৃত্যুবরণ করতে’, যাতে আমরা যখন মারা যাবো তখন যাতে আসলে মারা না যাই। সুফিরা জীবনের প্রতি আকর্ষণের জন্য মৃত্যুবরণ করতে সচেষ্ট হন, একইভাবে জীবনের আকর্ষণে নিজেদেরকে উন্মোচিত করেন। মৃত্যুর প্রতি সুফিদের দৃষ্টিভঙ্গি যেভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে তা হল, মারা গেলে তারা আল্লাহর সাথে থাকবে, আর বেঁচে থাকলে আল্লাহ তাদের সাথে থাকবেন ; অর্থাৎ জীবনে বা মৃত্যুতে তারা সবসময় বন্ধুর সাথেই থাকে। বিশিষ্ট সাধক শায়খ আব্দুল কাদির জিলানী তাই বলেন, ‘ মৃত্যুকে স্মরণ করাই হল আত্মের সব অসুস্থতার সর্বোত্তম চিকিৎসা।’ মৃত্যু সচেতনতাই সুন্দর জীবন যাপনের অন্যতম উপায় এবং মৃত্যুর স্মরণ হল পরকালের জন্য আগাম প্রস্তুতি। শুদ্ধ জীবনচর্চা একজন ব্যক্তিকে মৃত্যুর ভয় থেকে মুক্তি দেয়।
সুফিদের কাছে মৃত্যু কোনও অন্ধকারে ঝাঁপ দেওয়া নয়, তা এক অন্তিম যাত্রা, যা বন্ধুর কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু কবে তা আসবে কেউ জানে না। পাতা ঝরে পড়ার, ফুল ঝরে যাওয়ার এবং নক্ষত্র অস্ত যাওয়ার একটা সময় আছে ; কিন্তু মৃত্যুর কোন ঋতু নেই, সে নিজস্ব নিয়মে চলে। সুফিদের কাছে মৃত্যু স্বাভাবিক, সার্বজনীন এবং প্রয়োজনীয়। তারা মরে, যাতে আর মরতে না পারে। তাদের কাছে বেঁচে থাকাটাই মরণ আর মরে যাওয়াটাই বেঁচে থাকা !
চতুর্দশ শতাব্দীর সুফি সাধক শরফ আল-দীন মানেরি মানুষকে তিন শ্রেনিতে ভাগ করেনঃ এক, ইর্ষাপরায়ণ ও লোভী ; দুই, যারা সৃষ্টিকর্তার মুখাপেক্ষী; তিন,যারা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উচ্চস্তরে উন্নীত হয়েছে। তিনি বলেছেন, প্রমোদপ্রিয় মানুষ মৃত্যুর কথা ভাবে না, ভাবলেও তা জাগতিক লাভের জন্য ভাবে।সৃষ্টিকর্তার স্মরণ এই ধরনের মানুষের কোনও কাজে আসে না বরং এতে তারা সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আরও দূরে সরে যায়। দ্বিতীয় ধরনের মানুষ সৃষ্টিকর্তার মুখাপেক্ষী হয়, মৃত্যুকে স্মরণ করে, হৃদয়ে মৃত্যুভীতি পোষণ করে এবং সৃষ্টিকর্তার নিকটবর্তী হয়। সৃষ্টিকর্তার দিকে ফেরার আগেই হয়তোবা তাদের মৃত্যু চলে আসে। তৃতীয় শ্রেনির মানুষ, যারা আধ্যাত্মিকতার উচ্চস্তরে পৌছায়, তারা মৃত্যুকে সবসময় স্মরণ করে, কেননা মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই কাঙ্খিতের কাছে যাওয়ার সুযোগ আসে। মানেরির মতে, সাধারণ মানুষ মৃত্যুকে এড়িয়ে চলতে চায়, অপরদিকে সুফিরা মৃত্যুকে ভালোবাসে ও মৃত্যু কামনা করে। জালালউদ্দিন রুমির অন্য এক কবিতায় -
‘যখন আমার কফিন নিয়ে যাবে, তুমি কখনো এটা ভেবোনা-
আমি এ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছি!
চোখ থেকে অশ্রু ফেলোনা,
মুষড়ে যেওনা গভীর অবসাদে কিংবা দুঃখে-
আমি পড়ে যাচ্ছি না কোন অন্তহীন গভীর ভয়ংকর কুয়ায়!
যখন দেখবে আমার মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে, তুমি কেঁদোনা-
আমি কোথাও যাচ্ছি না,
আমি কেবল পৌঁছে যাচ্ছি অনন্ত প্রেমে।
আমাকে যখন কবরে শোয়াবে, বিদায় বলো না –
জেনো, কবর কেবল একটা পর্দা মাত্র, এটা পেরোলেই স্বর্গ। ’
( ‘যখন আমার মৃত্যু আসবে’ - অনুবাদঃ রেজা রিফাত )
অনেকের মতে, বাংলায় প্রবেশের আগে সুফিরা উত্তর ভারতে যোগী ও অন্যান্য তান্ত্রিক সাধকদের সাহচর্যে এসেছিল। সপ্তদশ শতক থেকে সুফিবাদ বাংলায় একটা নতুন রূপ গ্রহণ করল এবং পরবর্তী দেড় শতকের মধ্যে বিশ্বাস ও চর্চায় স্থানীয় ভাবধারা এত বেশি গ্রহণ করে ফেলল যে তা কেবল আদি কুলীন রূপ ও স্বাতন্ত্র হারাল তাই নয়,তার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব, অন্তর্নিহিত শক্তি ও অকপট চরিত্রও হারাল। এসব কিছু হারানোর ফলে বাংলায় সুফিবাদ তান্ত্রিকতা, যোগীবাদ, নাথতন্ত্র ও এই ধরনের নানা লোকজ বিশ্বাস ও সাধনচর্চায় একাত্ম হয়ে গেল। সুফি মতবাদে বিশ্বাসী অনেকে মনে করে, মুহাম্মদ স্বয়ং সুফিদর্শনের প্রবর্তক। হজরত মুহাম্মদের মতে মানবদেহে একটা বিশেষ অঙ্গ আছে, যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে, আর অসুস্থ হলে সারা দেহ অপরিশুদ্ধ হয়।এই অঙ্গটা হল ‘কল্ব’ বা হৃদয়। আল্লাহর স্মরণে কল্ব কলুষমুক্ত হয় ; কল্বকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেমার্জন সুফিবাদের উদ্দেশ্য। সৃষ্টির প্রতি প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রেমার্জন, সুফিবাদের এই আদর্শে প্রভাবিত হয়েছে বৈষ্ণবধর্ম, লৌকিক মরমীবাদ, বাউল ধর্মমত ও অন্যান্য ভক্তিবাদ। গবেষকরা মনে করেন, বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল নদীয়াতেই। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে বখতিয়ার খিলজির হাত ধরে বাংলায় মুসলিম শাসন চালু হয়। সুফি প্রভাব তখন বাংলার সর্বত্র। সুফিচিন্তা ও ভাববাদের মধ্যে গ্রামবাংলার অত্যাচারিত ও দিকভ্রান্ত মানুষ দিশা খুঁজে পেতেন।এমনকি অনেক গবেষক মনে করেন চৈতন্যদেবের ভাবধারাতেও সুফিপ্রভাব ছিল। ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এর লেখক জয়ানন্দ বলেছেন, সেইসময় অনেক ব্রাহ্মণেরাই জালালউদ্দীন রুমির লেখা পড়ত। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে চৈতন্যর সঙ্গে পীর-দরবেশদের সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ আছে।
প্রচলিত ধর্মমতের বাইরে, বাংলা সংস্কৃতিতে আরো দুই সম্প্রদায়, বাউল ও বৈষ্ণবদের জন্ম-মৃত্যু নিয়ে পৃথক কিছু বিশ্বাস রয়েছে। বাউল ধর্ম-দর্শনে ইশ্বর হল ‘মনের মানুষ’,ইশ্বরের সাথে প্রেমের সম্পর্ক পাতিয়ে তারা সাধনা করে,তারা বিশ্বাস করে দেহের মধ্যেই পরমাত্মা বা সাঁই বাস করে। রস–আস্বাদনের জন্য তিনি নিজেকে প্রকৃতিরূপে দ্বিধাবিভক্ত করেছেন।তারা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে বহু জন্মের মালায় গাঁথা অনন্তপ্রবাহ। বৈষ্ণবের দৃষ্টিতে নিত্যকাল ধরে রাধাকৃষ্ণের লীলা চলছে; রাধা ও কৃষ্ণ ভিন্ন নন, আত্মোপলব্ধির জন্য এক দুই হয়েছেন।জন্মজন্মান্তর ধরে ভক্ত এই লীলার আনন্দ প্রত্যক্ষ করতে চায়, দেখবার চোখ থাকলেই তা দেখা যায়। বৈষ্ণবের কাছে মোক্ষ কাম্য নয়,ভক্তিই তারা চান, ভক্তির মধ্যে দিয়ে জ্ঞানের উন্মেষ আপনিই ঘটে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে অদ্বৈতবাদের মধ্যে দিয়ে চৈতন্যবাদ বিকশিত হয়। ভাগবতধর্ম, আদি রামধর্ম ও কৃষ্ণধর্মে বৈষ্ণবধর্ম আত্মপ্রকাশ করে। বৈষ্ণবী সাধন পদ্ধতির মধ্যে অনিবার্য রূপে সামিল হয় প্রাচীন মরমীবাদ,যা বাউল নামে অভিহিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেন, বৌদ্ধদের মহাযান পন্থী থেকে বাউলদের উদ্ভব। বাউলেরা উদার ও অসাম্প্রদায়িক ধর্মসাধক, তারা মানবতার বাণী প্রচার করে। আর বাউল সঙ্গীত হল বাউলদের আধ্যাত্মচেতনা ও জীবনচর্চা প্রকাশের আধার। বাউল দর্শনে বৈষ্ণবধর্ম ও সুফিবাদের যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়। বাউল শিল্পী ও সাধকরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় আত্মাকে। তাদের মতে আত্মাকে জানলেই পরমাত্মা বা সৃষ্টিকর্তাকে জানা যায়। আত্মা দেহে বাস করে তাই তারা দেহকে পবিত্র জ্ঞান করে। বাউলসমাজ দেহতত্ত্ব সাধনার মাধ্যমে পরমাত্মার সাধনা করে।তাদের গানগুলোতে খাঁচা, মানুষ, মনের মানুষ, অচিন পাখি ,মনুরায় ইত্যাদি রুপক ও প্রতীকী ভাষায় তারা পরমাত্মাকে অভিহিত করে। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও বাউলরা জীবনদর্শন সম্পর্কে অনেক গভীর কথা বলেছেন। অনিবার্যভাবে ‘মৃত্যু’ তাদের গানের বিষয় হয়ে উঠেছে। বাউলদের ‘মনের মানুষ’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’, ‘অন্তর্যামী’ একই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ বিশ্বদেবতা আছেন, তাঁর আসন লোকে লোকে ,গ্রহ- চন্দ্র-তারায়।জীবন-দেবতা বিশেষভাবে জীবনের আসনে, হৃদয়ে হৃদয়ে তাঁর পীঠস্থান, সকল অনুভূতি সকল অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে ।বাউল তাকেই বলেচে মনের মানুষ।’ কিংবা, মুহম্মদ মনসুরুদ্দীনের ‘হারামণি’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “ .......বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। .... “অন্তরতর হৃদয়মাত্মা” উপনিষদের এই বাণী এদের মুখে যখন “মনের মানুষ” বলে শুনলুম, আমার মনে বড় বিস্ময় লেগেছিল...”।
সুফি মতবাদে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে একধরণের দ্বান্দ্বিকতা রয়েছে ; এই দুই বিচ্ছিন্ন সত্ত্বা যখন মিলিত হয়, তখন ব্যক্তি যে কেবল পরিপূর্ণতা পায় তা নয়,সে মানুষের শারীরিক সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে উঠে যায়। একই ভাবে, লালন ফকিরের বিশ্বাসের জগতেও দেখি সাধকের সঙ্গে যখন ‘অচিন মানুষ’-এর মিলন ঘটে, তখন সাধক মানুষটি পরিণত হয় ‘মানুষরতন’–এ,এক উন্নততর মানবসত্ত্বায়। লালন বিশ্বাস করেছেন একজন মানুষ শুধু সাধারণ মানুষ নয়, প্রতিটি মানুষই ‘মানুষরতন’ হওয়ার সম্ভাবনাময়—”এই মানুষে আছে রে মন যারে বলে মানুষরতন”। লালন বলেন, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায় ।....খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার কোন খানে পালায় ...।’ অর্থাৎ, শরীর বিনষ্ট হবে কিন্তু ‘আত্মা’ রয়ে যাবে , দেহ থেকে দেহান্তরে ‘ অচিন পাখি’র আনাগোনা চলতেই থাকবে।
পরিকথা
অনেকেই স্বীকার করেন দার্শনিক চিন্তাভাবনা মানুষকে মৃত্যু-বিষয়ে প্রকৃত শিক্ষিত করে তুলতে কার্যকরি ভূমিকা নিতে পারে।ষাটের দশক থেকে আমেরিকা, ইউরোপ জুড়ে‘ প্রত্যেকের জন্য মৃত্যুশিক্ষা’ বা ‘মৃত্যুশিক্ষা’কে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।হারমান ফেফেলসের লেখা বই ‘The meaning of Death’ আন্দোলনকারিদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর মতে, মৃত্যুশিক্ষা দু'ভাবে হতে পারে, বিশুদ্ধ এবং ফলিত। একজন মৃত্যুকে কেমনভাবে গ্রহণ করবে, নিজেকে প্রস্তুত করবে, শৈশবে মৃত্যু- পাঠের ধরন কেমন হবে, স্বেচ্ছামৃত্যু কিংবা আত্মহত্যার মতো বিষয়গুলোকে কী চোখে দেখা হবে – এসব যখন বিশুদ্ধ মৃত্যুশিক্ষার অংশ হচ্ছে ; তখন ফলিত মৃত্যুশিক্ষার বিষয় হয়ে ওঠে মুমূর্ষু রোগী ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের লোকজনকে প্রশিক্ষিত করে উদ্ভূত সমস্যা ও সংকট কিভাবে সামলানো যাবে। ধর্ম ও দর্শনের নানা পাঠ ‘মৃত্যু’, ‘মৃত্যু ব্যবস্থা’র সামগ্রিকতা অনুধাবনে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদেরকে সঠিক দিকে পরিচালিত করতে ও দিশা দেখাতে সাহায্য করে। মৃত্যুশিক্ষাকে জনস্বাস্থ্যনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা আজ অনেক দেশই ভাবছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল সাধারণ মানুষ কিংবা স্বাস্থ্যপরিষেবার সাথে যুক্ত চিকিৎসক,নার্স,স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যেকের যেমন পৃথক পৃথক শিক্ষাক্রমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তেমনই প্রয়োজন মৃত্যুকে ‘সুন্দর’ ও মর্যাদাপূর্ণ করার জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্যবিধি।
তথ্যসূত্র
Sallnow L. et.al. (2022) ‘ Report of the Lancet Commission on the Value of Death: bringing death back into life’; Lancet ; 399: 837-884.
Chishti (2018) ‘Sufis about Death’, The Sufi Tavern ; 20 March 2018; https://sufi-tavern.com/sufi-doctrine/sufis-about-death/ .
হোসেইন আনোয়ার মঞ্জু (২০২১) ‘জীবন তো তোমাকে ছেড়েই যাবে’ মৃত্যু সম্পর্কে সুফি ভাবনা, বার্তা ২৪, ১২ আগষ্ট ২০২২ ;https://barta24.com/details/arts-literature/123225/life.
রায় সুমিত (২০২২) ‘লালনের দর্শন বা বাউলতত্ত্ব এবং সুফিতত্ত্ব এর মধ্যে মিল ও পার্থক্য’, বিবর্তন পথ, ২৮ জানুয়ারি ২০২২; https://www.bibortonpoth.com/10371.
ঘোষ শান্তিদেব (২০১০) ‘ বাউলদের মনের মানুষ ও গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ’ (পুনর্মুদ্রিত), হৃদয়, জানুয়ারি ২০১০ (লীনা চাকী সম্পাদিত বিশেষ সংকলনঃ রবীন্দ্রনাথ ও বাউল); পৃষ্ঠা ১২-১৫।