সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সুজিত কুমার সিনহা
শিল্পসভ্যতার কী হবে?
আজ থেকে ১১৩ বছর আগে, ১৯০৯ সালের নভেম্বর মাসে গান্ধিজি তাঁর ছোট্ট পুস্তিকা ‘হিন্দস্বরাজ’-এর ষষ্ঠ অধ্যায় ‘সভ্যতা’-তে লিখছেন ‘এই (আধুনিক) সভ্যতা এমনই, নীরবে একটু ধৈর্য ধরলে এটি নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে”। ৩৬ বছর পর ৫ অক্টোবর ১৯৪৫-এ গান্ধি, নেহরুকে লিখছেন– ‘এই ভেবে ভয় লাগে যে,দুনিয়া যে ভুল পথে হাঁটছে, ভারতবর্ষও হয়ত সেই ভ্রান্ত পথেই যাবে – এ যেন প্রবাদ বাক্যে বলা সেই পতঙ্গের মতো, যে অগ্নিশিখা ঘিরে তার উদ্দাম নৃত্য, তাতেই সে পুড়ে মরবে। ’সম্প্রতি ৭ নভেম্বর ২০২২-এ মিশরে আয়োজিত COP 27 এর সভার উদ্বোধনী বক্তৃতায় রাষ্ট্রসংঘের মুখ্য সচিব আন্টোনিও গুটেরেস বলছেন ‘আমরা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছি। আমরা জল বায়ুর নরকের দিকে ধাবমান এবং
আমাদের পা যেন অ্যাক্সিলেটারের ওপর চেপে আটকে গেছে।
শিল্প সভ্যতার উদ্দাম নৃত্যের আর বেশিদিন নেই।
২
গান্ধিজির স্বরাজ
একশ বছর আগে গান্ধিজি শিল্প সভ্যতার বিকল্প নিয়ে কিছু পরীক্ষা আর লেখালিখি আরম্ভ করেন। এককথায় সেই বিকল্পের নাম দিয়েছিলেন ‘স্বরাজ’। আজকের দিনে গান্ধিজির মানসের সঙ্গে মানানসইস্বরাজকে এই ভাবে বলা যেতে পারে।
বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে ও ছোট শহরে বসবাস করবে। তাদের জীবন জীবিকা হবে সমবায়ভিত্তিক। চাষ-পশুপালন- মাছচাষ– জঙ্গল থেকে সংগ্রহ, হস্তশিল্প–পরিষেবা ইত্যাদির বেশির ভাগটাই হবে স্থানীয় অর্থনীতির জন্যে। আর থাকবে আদর্শ গ্রামীণ সমাজবাদ, যেখানে সব কাজের সমান আয় ও মর্যাদা হবে। বেশি মাত্রায় স্থানীয় স্বয়ং-সম্পূর্ণতার ফলে অনেক দূরে পণ্যের আদানপ্রদান খুবই কমে যাবে। এরকম জীবনজীবিকা এবং পরিবেশের সঙ্গে মানানসই যে উপযুক্ত প্রযুক্তি চাই, তা তৈরি করা হবে বিজ্ঞানের একটি প্রধান কাজ। সবরকম সামাজিক বৈষম্য ও আধিপত্য (লিঙ্গ, ধর্ম,বর্ণ, জাত...) কমানোর নিরন্তর চেষ্টা চলতে থাকবে। এরকম অর্থনীতি, এরকম প্রযুক্তির ওপর ভর করে তৈরি সমাজের সঙ্গে মানানসই রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, গ্রাম এবং শহর হবে বেশিমাত্রায় স্বয়ং-শাসিত; মানুষ মুখোমুখি, সহভাগী গণতন্ত্রের মাধ্যমে বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত নেবে। উচ্চস্তরের রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের ক্ষমতা ও ভূমিকা খুবই কমে যাবে। প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে সবার একাত্মবোধ থাকবে। গান্ধিজির বিখ্যাত উক্তি ‘মানুষের ন্যায্য চাহিদার জন্য পৃথিবী যথেষ্ট, কিন্তু লোভের জন্য নয়’ কে মেনে, পরিমিত জিনিসের ব্যবহার, সবকিছুকে ফের ব্যবহার এবং ব্যথিত প্রকৃতির – দুষিত পরিবেশকে আবার সুস্থ করে তোলাই হবে জীবনের মুলমন্ত্র। এরকম হলেই মানুষের মধ্যে ‘সত্য ও প্রেম’ সম্ভব
১৯১৫ সালে গান্ধিজির স্বনির্বাচিত গুরু গোপালকৃষ্ণ গোখলে এবং ১৯৪৫ সালে তাঁর স্বনির্বাচিত উত্তরাধিকারি নেহরু এই ‘স্বরাজ’ কে একেবারেই উড়িয়ে দিলেন। বিংশ শতাব্দীতে শিল্পসভ্যতার এক্সপ্রেস ট্রেনের বেগ বাড়তেই থাকলো। আর অধিকাংশ মানুষে রকাছে, বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং তাদের চালিত সব রাজনৈতিক দল- বাম বা ডান, শ্রমিক, চাষি, শিল্পপতি, বৈজ্ঞানিক, অধ্যাপক – সব্বার কাছে গান্ধিজির স্বরাজ হয়ে গেল এক আজগুবি–খামখেয়ালি-বোকামিতে ভরা ভাবনা। তাই যত তাড়াতাড়ি এসব ভুলে যাওয়া যায় ততই মঙ্গল। হলোও তাই। সেটাই ছিল যুগের স্বাভাবিক গতি।
৩
রাষ্ট্র ও সংবিধান
উনবিংশ শতাব্দী থেকেই পৃথিবী জুড়ে এক নতুন ধরনের সমাজচালনার ইঞ্জিন বানিয়ে তাকে আরো পোক্ত করা চলছে। এই ইঞ্জিন হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্র-সরকার। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ভারতের জনতা উদগ্রীব হয়েছিল এরকম একটি ইঞ্জিন বানানোর জন্য। যাতে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীন হয়েই, খুব তাড়াতাড়ি তাদের শিল্পসভ্যতার ট্রেন ছুট্টে গিয়ে, এই দৌড়ে যারা এগিয়ে,তাদের ধরে ফেলে (এটা বুঝেই গান্ধিজির হিন্দস্বরাজ লিখেছিলেন)। স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই চাই ইঞ্জিন চালানো উৎকৃষ্ট নিয়ম ও পদ্ধতি, মানে একটি ‘সংবিধান’। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯, তিন বছরে ভারতে রসংবিধান ও তৈরি হয়ে গেল। সেই সংবিধান ধরে, শিল্পসভ্যতার ট্রেন স্বরাজের গরুগাড়িকে গুড়িয়ে তরতর করে ছুটতে শুরু করল। এখন একই ভাবে ১৯২টা রাষ্ট্র ছুটছে সেই পতঙ্গের মতো আগুনের দিকে।
আমরা অনেকেই জানিনা যে ১৯৪৫-৪৬ সালে আমাদের দেশের জন্য একটি সংবিধান বানিয়েছিলেন গান্ধিবাদি সমাজবিজ্ঞানী শ্রীমান নারায়ণ আগরওয়াল। তবে উনি বলেছিলেন, এটা ঠিক সংবিধান নয়, সংবিধানের রূপরেখা মাত্র। গান্ধির এই সংবিধান ছিল স্বরাজের ধারণার সঙ্গে মানানসই এবং কিছু মৌলিক দিক থেকে ভারতরাষ্ট্রের সংবিধানের বিপরীত। যদি আমরা মনে করি, এই ২০০-২৫০ বছরের শিল্পসভ্যতা আর চলবেনা, অতিশীঘ্রই এর বিকল্প চাই, তাহলে গান্ধির সংবিধান একটু উল্টেপাল্টে দেখলে ভালোই হবে মনে হয়।
৪
কী চলবে না
কিন্তু তার আগে দেখা যাক, শিল্পসভ্যতা ধ্বংসের কথা যে বারবার উঠছে, তার মানে কী হতে পারেঃ
প্রথমেই খনিজ জ্বালানি, পেট্রোলিয়াম ও কয়লার ব্যবহার অনেকটা খুব তাড়াতাড়ি কমে যাবে বা কমিয়ে আনতে হবে; তার মানেই এই বিপুল উৎপাদন, পরিবহন ব্যবস্থা অনেক কমে যাবে। রাসায়নিক চাষ ও মাংসের জন্য বিশাল খামার চলবে না। পৃথিবী জোড়া বাজার বিপণন ব্যবস্থা অনেক সঙ্কুচিত হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির দিন শেষ। বিশাল কোম্পানি – প্রাইভেট কিম্বা সরকারি –আর টিকবে না। বড়বড় রাষ্ট্রের ইতি, কোনো দরকার নেই। শিল্পসভ্যতার চাকরি–জীবিকা দ্রুত কমতে থাকবে। এই লেখার বেশিরভাগ পাঠক এবং এই লেখকেরও চাকরি-ব্যবসা-মাইনে-পেনসন-ব্যাঙ্কের সেভিংস সব বানচাল হয়ে যাবে। রাষ্ট্রীয় মুদ্রা অকেজো হয়ে পড়বে।পৃথিবীর প্রায় ৫০০টি বড় শহর চুপসে যাবে, যার প্রথম ৫০-এর মধ্যে আছে কলকাতা। এখনকার বেশিরভাগ স্কুল ও কলেজ বন্ধ হয়ে যাবে; শিল্পসভ্যতা উঠে গেলে তাকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শিক্ষা আর সার্টিফিকেটের কোনো দরকার থাকবে না।
৫
শিল্পের সংবিধান বনাম গান্ধির সংবিধান
এবারে আজকের শিল্পের সংবিধান, যেটা ২৬জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে আরম্ভ হল, তার সঙ্গে ১৯৪৫-৪৬-এ লেখা গান্ধির সংবিধানের তুলনা করা যাক। এখানে আমরা খুব বিস্তারিত ভাবে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখব না। শিল্পসভ্যতার সংবিধান ও স্বরাজের সংবিধানের মূল পার্থক্য এবং তারা যে অনেকক্ষেত্রেই প্রায় বিপরীত সেটা বুঝলেই যথেষ্ট।
৬
৬.১ সংবিধানের গঠন
শিল্পের সংবিধানঃ ২২টিভাগ (Part); ৪৪৮টি অনুচ্ছেদ (Articles); ১২টি তফসিল (Schedule)। এপর্যন্ত ১১৩টি সংশোধনী (Amendment) হয়েছে। প্রথম দিকে অনুচ্ছেদ ছিল ৩৯৫ ও তফসিল ছিল ৮টি।
গান্ধির সংবিধানঃ ২টি ভাগ (Part); ২২টি অধ্যায় (Chapter); ২৯০টি অনুচ্ছেদ (Articles)।
৬.১ গান্ধির সংবিধানের ভুমিকা (ভাগ ১)
এখানে বলে রাখা দরকার যে ভাগ ১ হচ্ছে এই পুস্তিকার অর্ধেকটা এবং সেটা ঠিক সংবিধান নয়। এই অংশে যে চারটি অধ্যায় আর ৯৮টি অনুচ্ছেদ আছে তার পুরোটাই ভুমিকা। সেখানে বলা আছে, আমরা কেবল পশ্চিমি দেশের সংবিধানগুলি নকল করবো না; তবে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ নয়, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা অবশ্যই শিখবো।
তারপর আছে আড়াই হাজার বছর ধরে নানা ধরনের শাসনব্যবস্থার ইতিহাস; বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন দেশের দার্শনিক এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের পণ্ডিতরা গণতন্ত্রের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে কী বলেছেন। বিংশ শতাব্দীতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের বেহাল দশা–ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্র, সোভিয়েত দেশের গণতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ-একনায়কতন্ত্র, অতিকেন্দ্রীকরণের প্রবণতা, গণতন্ত্রের নামে ছোট্ট গোষ্ঠীর রাজ, সংগঠিত গুন্ডাবাহিনির রাজ ইত্যাদি। এসবের বিপরীতে আছে নৈরাজ্যবাদ বা অ্যানার্কিজমের উল্লেখ–এমন ব্যবস্থা যেখানে কোথাও বা কারোর কাছেই ক্ষমতা জমতে পারবে না। ধন ও ক্ষমতার দিক দিয়েও সবাই সমান।
এরপর আছে ১৯১৯ সাল থেকে ভারতের সংবিধান তৈরির নানা পদক্ষেপ।
লেখক উল্লেখ করেছেন, ১৯৩৯ সালে আউন্ধ নামের একটি ছোট রাজার এখন মহারাষ্ট্রের পুনে জেলার অন্তর্গত) গান্ধিজির পরামর্শ নিয়ে একটি সংবিধান বানিয়ে রাজ্য চালানোর চেষ্টা।
প্রাচীন ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে রামায়ণ, মহাভারত, মনুস্মৃতি, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, শুক্রাচার্যের নীতিসার, ঋগ্বেদ, জাতকের গল্পে, বৌদ্ধ সঙ্ঘে কী হত–এইসবের উল্লেখ। ইউরোপে শিল্পসভ্যতার আগে কী ধরনের গ্রামীণ গণতন্ত্র ছিলো তাই নিয়ে ক্রোপোতকিনের লেখা। জাপানও চিন কীরকম ছিল তাও আছে সেখানে। এই প্রসঙ্গে দুই বাঙালি পণ্ডিত ভ্রাতৃদ্বয়ের বইয়ের কথা বলেছেন। এই বই দুটি হল, ১৯১৯-এ প্রকাশিত রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়ের ‘Local Government in Ancient india’ এবং ১৯২৩-এ প্রকাশিত রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের ‘Democracies of the East’।
চরম ব্যক্তিবাদ ও চরম সমষ্টিবাদের বিপদ নিয়ে বেশ খানিকটা এখানে আলোচনা করা হয়েছে। এবং বলা আছে, এই দুই বাদ-এর একটা সুন্দর মীমাংসা ঘটানো ভালো সংবিধানের একটি প্রধান কাজ হবে। বড়দেশের আইনসভার প্রতিনিধি বাছাই করার নির্বাচন প্রক্রিয়া, লাখ লাখ মানুষের একজন প্রতিনিধি –এর নানা দুর্নীতি ও অন্যান্য অসুবিধের বিশেষ উল্লেখ আছে। আর আছে প্রতিনিধি বাছাই করার অন্য কিছু পদ্ধতি।
কলা ও সৌন্দর্যর ব্যাপারে বলেছেন, শিল্পসভ্যতায় আঁকা, কবিতা, গান ,নৃত্য, নাটক, সাহিত্য ইত্যাদির –মাপকাঠি হয়ে গেছে টাকা। গ্রামীণ জীবনে এইসবই ছিল কাজের সঙ্গে, জীবনচক্রের এবং প্রকৃতির সঙ্গে জড়িত। সেই বোধ কীভাবে জাগানো যায় – সেই প্রশ্নটা রেখেছেন।
শেষে আছে গান্ধিজির ভাবনা। গ্রামীণসভ্যতা, সাদামাটা ও আনন্দময় জীবন, সবার শারীরিক শ্রম, আর্থিক সাম্য এবং বিকেন্দ্রীয়করণ, যান্ত্রিক সরলতা ও প্রযুক্তিগত বিকেন্দ্রীয়করণ। এর স্বপক্ষে হেনরি ফোর্ড, লুইস মমফোর্ড, আইনস্টাইনের উক্তি। জোর দিয়ে বলা হয়েছে এটা পুরনো যুগে ফিরে যাওয়া নয়; এখানে কোনো রকম সামাজিক ভেদাভেদ ও অসহিষ্ণুতা থাকবে না। এরকম আর্থিক ও প্রযুক্তিগত বিকেন্দ্রীকরণ হলেই দরকার হবে রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের। স্বশাসিত গ্রাম হবে এর ভীত। এটা এক নতুন সভ্যতার স্বপ্ন যেখানে সত্য ও প্রেম বিরাজমান। তারজন্যইএই সংবিধান। একে লেখক ‘বিকেন্দ্রীয় গ্রামীণ সমাজবাদ’ (Decentralized Village Communism) নাম দিয়েছেন।
৬.২ সরকার
শিল্পের সংবিধানঃ প্রথমেই কেন্দ্রীয় সরকার (ভাগ ৫), তার ১০০টি অনুচ্ছেদ। তারপর রাজ্য সরকার (ভাগ ৬), তার ৮৫টি অনুচ্ছেদ। তারপর কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক (ভাগ ১১) ১৯টি অনুচ্ছেদ। তারপর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (ভাগ ৮) ৮টি অনুচ্ছেদ। খেয়াল করবেন যে প্রায় অর্ধেক সংবিধান (৪৫০-র মধ্যে ২১২টি অনুচ্ছেদ) কেন্দ্র আর রাজ্যসরকারকে নিয়ে। এর বেশির ভাগটাই সংসদ, বিচার ব্যবস্থা নিয়ে।
মনে রাখবেন, সংবিধান তৈরির সময় গ্রাম ও শহরের স্থানীয় সরকারকে পাকা পোক্ত করা, আলোচনার পর নাকচ হয়ে যায়। এটা রাখা হয়েছে ভাগ ৪-এর ‘নির্দেশাত্মকনীতির মধ্যে’। যারা প্রাণপণে চাইছেন শিল্পসভ্যতার ট্রেনের গতি বাড়াতে তাদের কাছে গ্রাম ও নগর সরকার তো অবান্তর। বিশাল কারখানা, খনি, বিদ্যুৎকেন্দ্র , বাঁধ, রাস্তা, রেল, এরোপ্লেন, জাহাজ, আইআইটি– এসবে গ্রাম সরকার কী করবে?
প্রায় ৪২ বছর অপেক্ষা করার পর ১৯৯২সালে, ৭৩ ও ৭৪তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত (ভাগ ৯-এ ১৬টি অনুচ্ছেদ)এবং নগরপালিকা (ভাগ ৯ক-এর ১৮টিঅনুচ্ছেদ) স্থান পেল সংবিধানে!
গান্ধির সংবিধানঃ আমরা আগেই দেখেছি যে ভাগ ১ পুরোটাই কেবল ভুমিকা। আসল সংবিধান হচ্ছে ভাগ ২, অধ্যায় ৫-২২, অনুচ্ছেদ ১৯২টি।
প্রথমেই (অধ্যায় ৬) প্রত্যেক গ্রামে পঞ্চায়েত এবং তার গঠন ও কাজ।২৫টি অনুচ্ছেদ।
তারপর (অধ্যায় ৭) ব্লক ও জেলাপঞ্চায়েত ও নগরপালিকা। ১৯টি অনুচ্ছেদ।
তারপর (অধ্যায় ৮) রাজ্যসরকার। ২০টি অনুচ্ছেদ।
সবশেষে (অধ্যায় ৯) কেন্দ্রসরকার। ২১টি অনুচ্ছেদ। প্রথমেই আসছে গ্রাম, শেষে রাষ্ট্র। অনুচ্ছেদের সংখ্যার দিকে দেখি তো চারটে স্তরের প্রায় সমান গুরুত্ব। স্বরাজের সংবিধানে এটাই স্বাভাবিক। এবং স্বাভাবিকভাবেই সেটা শিল্পসভ্যতার সংবিধানের ঠিক উল্টো।
এখানে ন্যায়ালয়/বিচারসভাটি একটি আলাদা ১০ নম্বর অধ্যায়ের অন্তর্গত। যেহেতু বেশিরভাগ মানুষ গ্রামেই থাকবে, জীবিকা গ্রামকেন্দ্রিক হবে, তাই গ্রামেই হবে সবচেয়ে প্রধান বিচারব্যবস্থা। গুরুত্বর দিক দিয়ে তারপর হচ্ছে জেলা ন্যায়ালয়। তারও পরে রাজ্য (হাইকোর্ট) ও শেষে কেন্দ্রস্তরের ন্যায়ালয়। সুপ্রিম কোর্ট কেবল হাইকোর্টের দেওয়া কেস বা আন্তর-রাজ্য বিবাদ বিচার করবে। প্রত্যেক স্তরের বিচারকদের সেই স্তরের পঞ্চায়েত বাছাই করে বসাবে। তাদের মেয়াদ মৃত্যু অবধি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা আছে যে, ব্রিটিশ আমলের আইনের অনেকগুলি অত্যন্ত খারাপ, অনেকগুলি খুবই জটিল এবং বেশিরভাগের ভাষাই বড়ই খটোমটো। এসবগুলির বেশিরভাগটাই সংশোধন এবং বাতিল করে সব আইন সহজ সাধারণ ভাষায় আবার লেখা হবে।
বিচারব্যবস্থাতেও শিল্পসভ্যতার যুক্তিকে উল্টে দিচ্ছে গান্ধির সংবিধান।
৬.৩ নির্বাচন
শিল্পের সংবিধানঃ ভাগ ১৫তে ৭টি অনুচ্ছেদ। আজকে একজন নাগরিক বিভিন্ন স্তরের সরকারে প্রতিনিধির জন্য ভোট দেয়। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত বা নগরপালিকা, তারপর রাজ্যের জন্য ভোট; তারপর কেন্দ্রের জন্য ভোট। গণতন্ত্র মানেই দাঁড়িয়েছে কেবল ভোট-ভোট-ভোট আর তার অজস্র রকম দুর্নীতি এবং হিংসা। আর এটাই সাধারণ মানুষেরর মুখ্য আলোচনার বিষয়। মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এখন একটি নিরর্থক খেলা বা সার্কাসের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিনিধিদের মেয়াদ – ৫ বছর।
গান্ধির সংবিধানঃ অধ্যায় ১১তে ৯ টি অনুচ্ছেদ। সাধারণ নাগরিক শুধু একবার ভোট দেবেন –নিজের গ্রাম পঞ্চায়েত বা নগরপালিকার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে! বাকি চারটে স্তরে হবে পরোক্ষ নির্বাচন। গ্রামস্তরের পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা ব্লকস্তরের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে নিজেদের মধ্য থেকে। একই ভাবে জেলা, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েতের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন তার নিচের স্তরের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এবং নিজেদের মধ্য থেকে!
প্রত্যেক স্তর নিজেদের মধ্যে কাউকে সভাপতি বানাবে। দেবতুল্য নেতার কোনো জায়গা নেই।
কোনো রকম প্রচার করলে নির্বাচনে তার প্রতিনিধিত্ব বাতিল হয়ে যাবে। এবং কোনো সংরক্ষণ নেই।
রাজ্য বা কেন্দ্রীয় স্তরে কেবল একটি আইনসভা থাকবে। মানে আলাদা লোকসভা ও রাজ্যসভা বাতিল।
প্রতিনিধিদের মেয়াদঃ ৩ বছর, এবং এই মেয়াদকালে তাদের সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা!
মোদ্দা কথাপৃথিবীজুড়ে রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের নির্বাচন নামের ভয়ঙ্কর দানবকে সংহার করার সংবিধান।
৬.৪ স্তরগুলির আকার ও গঠন
শিল্পের সংবিধানঃ আজকের গ্রাম পঞ্চায়েতে আছে একাধিক গ্রাম; এবং কিছু রাজ্যে অনেক গ্রামপঞ্চায়েতের জনসংখ্যা ২০,০০০ এরও বেশি। একটি ব্লকে সাধারণভাবে ১০০ টিরও বেশি গ্রাম। জেলার সাইজ ও তার মধ্যে ব্লকের সংখ্যা খুবই এলোমেলো।
স্বাধীনতার সময় ১০টি রাজ্য ছিল। বহু আন্দোলনও হিংসার মধ্যে দিয়ে সেগুলি ভেঙে আজকের রাজ্য হয়েছে।
আর যে অঞ্চলগুলি ভারতরাষ্ট্রের অঙ্গ হতে চায়না, সেখানে রাষ্ট্র সেনা রেখে বীভৎস অত্যাচার, মৌলিক অধিকারের দফারফা করে, একটি হিংস্র – অসভ্য পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে সত্য ও প্রেমের কোনো লক্ষণ নেই।
গান্ধির সংবিধানঃ পঞ্চায়েত বলতে একটি গ্রাম – একাধিক নয়। ২০-২৫টি গ্রাম আর আনুমানিক ২০,০০০ মানুষ নিয়ে একটি ব্লক। এখনকার ব্লক থেকে অনেক ছোট। ১০-১৫টি ব্লক নিয়ে একটি জেলা। আমাদের এখনকার জেলা থেকে অনেক ছোট।
রাজ্য নিয়ে বলা আছে যে, এখনকার (১৯৪৫) রাজ্যগুলির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।এগুলিকে ভেঙে ভাষা ভিত্তিক ছোট রাজ্য বানানো হবে।
রাষ্ট্র নিয়ে বলা আছে, যে রাজ্যগুলি স্বেচ্ছায় ভারতরাষ্ট্রে অন্তর্গত হতে চায়, তারাই মিলে হবে ভারত নামের রাজ্যের সঙ্ঘ। কারোর ওপর জোর ফলানো হবেনা। এমনকী যারা বেরিয়ে যেতে চায়, তাদেরকে শান্তিতে যেতে দিতে হবে !!
৬.৫ বিভিন্ন স্তরগুলির কাজ
গান্ধির সংবিধানঃ গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজ অনেক– কৃষি, কুটিরশিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রাথমিকশিক্ষা, সংস্কৃতি, বয়স্কশিক্ষা, লাইব্রেরি, ক্রীড়া, নাচ–গান, শৌচব্যবস্থা, সাধারণচিকিৎসা, গ্রামসুরক্ষা, ন্যায়, ট্যাক্স ও হিসেব।
ব্লক, জেলা ও রাজ্যস্তরের একটি কাজ হচ্ছে তার তলার স্তরের কাজের অডিট ও সমন্বয়করা। এই তিন স্তরেই নিজস্ব এলাকার জন্য সমবায় ব্যাঙ্ক এবং উৎপাদিত সামগ্রী বাজারজাত করার ব্যবস্থা থাকবে; আর থাকবে আপৎকালীন বাহিনী।
ব্লক স্তরে মাঝারি হাসপাতাল এবং মাতৃক্লিনিক; জেলা স্তরে বড় হাসপাতাল; এবং রাজ্য স্তরে বিশেষ হাসপাতাল।
জেলা স্তরে মাঝারি ও রাজ্য স্তরে বড় সেচব্যবস্থা। ব্লক স্তরে গ্রামের বাইরের রাস্তা।
রাজ্য স্তরে থাকবে পরিবহন ও যোগাযোগ, বড়শিল্প, ত্রাণ, প্রাকৃতিক সম্পদের বিকাশ।
কেন্দ্র স্তরের কাজ হচ্ছে রাজ্যের মধ্যে পরিকল্পনার কিছুটা সমন্বয়। মুদ্রা – কাস্টম – বিদেশিবাণিজ্য। সেনা – পুলিস (একই, আলাদা নয়)। রাষ্ট্রীয় স্তরের পরিবহন ও যোগাযোগ।অল্প কিছু রাষ্ট্রীয় চাহিদার বড়শিল্প।
খেয়াল করেবেন যে কেন্দ্র স্তরের কাজ কিন্তু অনেক কম।
আরেকটি কথাঃ যে স্তরের যা দায়িত্ব, তা নিয়ে ওপরের স্তর পরামর্শ দিতে পারে, কিন্তু নিজেদের মত চাপাতে পারবে না।
৬.৬ শিক্ষা
শিল্পের সংবিধানঃ সংবিধানে শিক্ষার জন্য আলাদা কোনো ভাগই নেই। ৬-১৪ বছর বয়সিদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামুলক স্কুলশিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে আলোচনা হলেও পরে তা নাকচ হয়ে যায়। স্থানীয় সরকারের বিষয়টির মতোই এইবিষয়কেও সংবিধানের নির্দেশাত্মক নীতির মধ্যে রাখা হয়।
৫২ বছর অপেক্ষা করার পর ২০০২ সালে – ৮৬তম সংশোধনের মাধ্যমে ৬-১৪ বছর বয়সিদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামুলক স্কুলশিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় (অনুচ্ছেদ ২১ক) সংবিধানে!
গান্ধির সংবিধানঃ শিক্ষার জন্য আছে আলাদা অধ্যায় ১৮ এবং তাতে আছে ৮টি অনুচ্ছেদ।
বুনিয়াদি শিক্ষার (১৪ বছর বয়স অবধি) দায়িত্ব হচ্ছে গ্রাম পঞ্চায়েতের; হাইস্কুল ব্লক পঞ্চায়েতের; কলেজ জেলা পঞ্চায়েতের; ইউনিভার্সিটি রাজ্য সরকারের। কেন্দ্রের হাতে কেবল অল্প কিছু বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
আর বলা আছে স্বরাজের সঙ্গে মানানসই ‘নই তালিম’ পদ্ধতির কথা; স্কুলশিক্ষায় মাতৃভাষা ব্যবহার; এবং এক বছর সামাজিক সেবার কাজ করার পর ই-কলেজের ডিগ্রি পাবে।
৬.৭ মন্ত্রী ও আমলা
শিল্পের সংবিধানঃ নির্বাচিত আইনসভার সদস্যরাই সবস্তরের মন্ত্রী হবে। কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরের মন্ত্রীদের দায়িত্ব সংবিধানে বলা আছে। আইনসভা বছরে আনুমানিক ১২০ দিন বসবে।
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের স্থায়ী উচ্চপদস্থ আমলাদের অনেক দায়িত্ব। তাই কেবল এই বিষয়েই সংবিধানের ভাগ ১৪তে ১৮টি অনুচ্ছেদর য়েছে।
শিল্পসভ্যতার ট্রেন বিশাল, তার ইঞ্জিন ও খুবই জটিল। তাই রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাপক সমন্ব য়দরকার। এর জন্য কেন্দ্রীকরণ ছাড়া উপায় নেই। ফলে রাজ্য এবং কেন্দ্রের মন্ত্রী ও আমলাদের প্রচুর দায়িত্ব ও ক্ষমতা। সেটাই সংবিধানে নিশ্চিত করতে হয়েছে। এটা না হলে শিল্পসভ্যতা যে গতিতে এগিয়েছে সেটা সম্ভব হতো না।
গান্ধির সংবিধানঃ আইনসভার নির্বাচিত সদস্যরা কেউ মন্ত্রী হবে না। তারা বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রণী ও বিশেষ দক্ষ, তাদের বাছাই করে মন্ত্রী বানাবে। এরা এক অর্থে উচ্চপদস্থ আমলারা যা কাজ করেন, সেটাও খানিকটা করবেন। আবার বলে রাখা দরকার যে এরা নিজ নিজ বিষয়ে পারদর্শী হবেন, ICS/IAS দের মতো নয়।
মন্ত্রীদের সংখ্যা ৫-১০জনের মধ্যে হবে।
কেন্দ্র ও রাজ্যের আইনসভার নির্বাচিত সদস্যরা বছরে তিনবার অল্প কিছুদিনের জন্য বসলেই হবে।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
স্বরাজ যে শিল্পসভ্যতার বিপরীত, এটাও তারই প্রতিফলন। স্থানীয় স্বয়ং-সম্পূর্ণতা এবং স্ব-শাসন এর মানেই এখানে ব্যাপক সমন্বয়ের দরকার খুব কম। আজ পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মন্ত্রী এবং আমলাদের রমরমা, তা আর থাকবে না। তাই এই স্বরাজের সংবিধানে কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরে মন্ত্রী ও আমলাদের সংখ্যা এবং দায়িত্ব খুব কম।
৬.৮ মৌলিক অধিকার ও কর্তব্য
শিল্পের সংবিধানঃ ভাগ ৩-এর ২৪টি অনুচ্ছেদে নানা ধরনের মৌলিক অধিকারের কথা আছে।
মৌলিক কর্তব্য যোগ হয়েছে ১৯৭৬সালে ৪২তম সংশোধনের মাধ্যমে (ভাগ ৪ক)
শিক্ষা যোগ হয়েছে ২০০২ সালে।
গান্ধির সংবিধানঃ ৫ম অধ্যায় (আসল সংবিধানের প্রথম অধ্যায়) তে আছে মৌলিক অধিকারের সঙ্গে মৌলিক কর্তব্য।
মৌলিক অধিকারের মধ্যে আছে ১৪ বছর অবধি শিক্ষা।
আর আছে সুস্থজীবনের জন্য চাকরি বা মজুরির থেকে ন্যূনতম আয়ের মৌলিক অধিকার !!
৭
কত জনের বসত নিয়ে রাষ্ট্র?
আধুনিক রাষ্ট্রবাদ আর শিল্পসভ্যতা একে অন্যের পরিপুরক। প্রশ্ন হচ্ছে এবারে কি হবে?
আজ পৃথিবীতে ১৯৩টি রাষ্ট্র। মোট জনসংখ্যা ৮০০ কোটি।
৩ লাখের কম জনসংখ্যার ২০টি রাষ্ট্র; আমাদের ব্লকের মতো।
৫০ লাখের কম ৮০টি রাষ্ট্র; আমাদের জেলার মতো।
৮ কোটির বেশি জনসংখ্যার বড়ো রাষ্ট্র কেবল ১৯টি। চিন, ভারত প্রায় ১৫০ কোটি করে, তৃতীয় নম্বরে আমেরিকা। জনসংখ্যা ৩৩ কোটি। আমাদের থেকে অনেক পেছিয়ে। তারপর ক্রমশ ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, পাকিস্তান, নাইজিরিয়া, বাংলাদেশ, রাশিয়া, জাপান , মেক্সিকো, ফিলিপিন্স, ইথিওপিয়া, ভিয়েতনাম, ইজিপ্ট বা মিশর, জার্মানি, কঙ্গো, ইরান, তুরস্ক বা টার্কি। আলাদা দেশ হলে এই তালিকাতে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ যুক্ত হত।
গত ৫০ বছরে ভেঙে গেছেঃ পাকিস্তান ( ২), সোভিয়েত রাশিয়া (১২), ইয়ুগোস্লাভিয়া (৮) , চেকস্লভাকিয়া (২), ইথিওপিয়া (২)
প্রশ্ন হচ্ছে বড় রাষ্ট্র ও রাজ্যের কী রূপ হবে এবার?
৮
উপসংহার
আমাদের রাষ্ট্রের সংবিধান তৈরির জন্য যে আইনসভা গঠিত হয়েছিল (Constituent Assembly) সেটা বসতে আরম্ভ করার আগেই শ্রীমান নারায়ণ আগরওয়াল গান্ধির সংবিধান লিখে ফেলেন- ১৯৪৫-৪৬এ।
লেখক একে ‘অহিংস’ সংবিধানও বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে কেবল বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে এটা সম্ভব। এবং এটাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তিন রকম বিকেন্দ্রীকরণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত – অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই নতুন ‘বন্ধুতার অর্থনীতি’, ‘প্রকৃতি বান্ধব উপযুক্ত প্রযুক্তির’ খোঁজ চলছে। তবে এসব নিয়ে আরো বেশি বেশি পরীক্ষা করতে হবে।
এই সংবিধানের ভিত হচ্ছে স্বয়ং-সম্পূর্ণ (অনেকটাই) এবং স্ব-শাসিত গ্রামীণ সম্প্রদায়।
এই মানস বা স্পিরিটকে যদি আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যাই তাহলে বলতে হয় যে – এখানে গণতন্ত্র হবে মুখোমুখি, সবাই অংশগ্রহণ করবে, কোনো প্রতিনিধি নয়। তার জন্য সবাইকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।সবাইকে সহযোগিতা করতে অভ্যস্ত হতে হবে।
এটা একেবারেই পুরনো দিনের গ্রামে ফিরে যাওয়া নয়। সেখানে অনেক ভয়ানক ত্রুটি ও অন্যায় ছিল এবং আছে। এই স্বপ্নের গ্রামকে বানাতে হবে। সেটাই কাজ।
ভালো সমাজ মানে সীমিত উৎপাদন, সীমিত ভোগ, আর্থিক ও ক্ষমতার সাম্য, দূষণহীন পরিবেশ, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্বতা, নাচ-গান-কলাকৃতি বিভিন্ন সংস্কৃতিযুক্ত, প্রেম বন্ধুতায় ভরা আনন্দময় জীবন।
তার জন্য প্রায় ৮০ বছর আগে লেখা গান্ধির সংবিধানকে প্রথম খসড়া মেনে আমাদের আজকের স্বরাজের সংবিধান বানাতে হবে।