সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
কেন সিধু করেছ লহুতে স্নান?
কানু কেন হাঁকো হুল হুল… ?
বেপারী চোরের জন্য
যারা লুটেছে মোদের দেশ
(William Archer সংগৃহীত সাঁওতাল বিদ্রোহের গান।)
আশ্বিন মাসেও নদীতে জল বেশ কম, বালি আর কালো কালো ব্যাসল্ট পাথরের মাঝখান দিয়ে চওড়া জলের ধারা বয়ে চলেছে, নদীর দুই পাড়ে বড় বড় গাছ, এই দুপুরেও নদীতে হাল্কা ছায়া। বাসটা নদীর উপর সরু ব্রিজটা পেরিয়ে একটু আগে গিয়ে বাজারের আগে বাঁদিকের স্ট্যান্ডে ধুলো উড়িয়ে দাঁড়াল, ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে আমি বাস থেকে নামলাম, নতুন জায়গা। রাস্তাটা একটু এঁকে বেঁকে উত্তরে চলে গেছে লিটিপাড়া হয়ে সাহিবগঞ্জের দিকে। বাজারটা গড়ে উঠেছে চওড়া রাস্তার দুপাশে। বাঁশলোই নদী পশ্চিম থেকে পুবে, রাজমহল পাহাড়ের মাঝ বরাবর চলে গিয়ে গঙ্গায় মিশেছে। আমড়াপাড়া তারই ধারে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একটা বড় গঞ্জ। রাজমহল পাহাড়ে জীবাশ্ম গবেষণার কাজে এখানে আসা, জিওলজি পড়তে গিয়ে এরকম অচেনা অজানা ভারতবর্ষে পৌঁছে যাই বারবার। জানতাম আমড়াপাড়াই ক্যম্প করার জন্য সুবিধাজনক তাই এখানে আসা। বেলা হয়েছে, বেশিরভাগ দোকানে আদিবাসীরাই খদ্দের। বাজার বেশ ফাঁকা, বুঝলাম সকালে ভিড় বেশি ছিল বেলায় অনেকেই গ্রামে ফিরেছে। আদিবাসী মানুষজন দেখলে বোঝা যায় যে এই দিকের আদিবাসী পরিবারগুলির অবস্থা বেশ খারাপ।
ঘুরতে ঘুরতে একটা ছোট খাবারের দোকানে চা আর পকোড়া খেতে খেতে বাজারের লোকজন দেখছিলাম। রংচটা ময়লা প্যান্ট পরা একটা সাঁওতাল ছেলে টেবিল সাফ করছিল দোকানে, ফরসা গোলগাল চেহারার মালিক ক্যাশ গুনছিল কাউন্টারে। ভাবলাম আজ এখানে একটা থাকার ব্যবস্থা না করতে পারলে ব্যাগ কাঁধে চারটার বাসে পাকুড় ফিরতে হবে, তাই কথা জমাতে দোকানিকে জিজ্ঞাসা করলাম এখান থেকে নিপানিয়া, কুমারভজা, নুনপাড়া এইসব জায়গা কতদূর? সে মুখ তুলে বলল আমড়াপাড়া থেকে ২০-২৫ কিমি এর মধ্যেই হবে কিন্তু গ্রামগুলো বড় রাস্তা থেকে অনেক ভিতরে, আর সেখানে যাবার কোন বাস বা অন্য কোন ব্যবস্থা নেই। রাস্তা ভালো, মোটর সাইকেলে যেতে হবে বা গাড়ি ভাড়া করতে হবে। থাকার হোটেলের কথা জিজ্ঞাসা করায় বলল এখানে তো পাকুড়ের মতো কোন হোটেল পাবেন না। তারপর একটু ভেবে বলল ঐ বট গাছের নীচে শিব মন্দিরের সামনের ধরমশালায় থাকার জায়গা হতে পারে, কিন্তু আপনি শহরের লোক ওখানে কি থাকতে পারবেন? আমি হাতে চাঁদ পেলাম, তার কাছ থেকে গেলাম পুরানো ধরমশালায়, সেখানে সহজেই থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। বড় ঘর, ঘরে একটা শোবার তক্তা আর তোশকের উপর চাদর আর বালিশ ছাড়া আর কিছু নেই। ধরমশালা লাগোয়া দুটো বাথরুম পাশপাশি, একটু দূরে তাদের সামনে একটা বাঁধানো কুয়ো, বুঝলাম ওখানেই স্নানের ব্যাবস্থা।
মধ্যবয়স্ক হরিরাম পাণ্ডে ধরমশালার দেখাশোনা করে, কথা বলতে ভালোবাসে। কথায় কথায় সে জানাল তারা কয়েক পুরুষ আগে এসেছে আর ধরমশালার পিছনের পাড়ায় তার বাড়ি, বাজারে তার ছেলে ছোট মুদিখানার দোকান চালায়। আমড়াপাড়ার কথা উঠতেই হরিরাম এখানকার ইতিহাস শুরু করে, এদিকের জঙ্গলে সাহেবরা নাকি আসে দুশো বছরেরও বেশি আগে তখন এই অঞ্চলে কেবল পাহাড়িয়ারা রাজমহল পাহাড়ের উপরে বাস করত, তারা সাহেবদের ভয় পেত না, কোন চাষবাসও করত না, খাজনাও দিত না, সাহেবরা ওদের ভয় পেত। সাহেবরাই নাকি আশেপাশের বীরভূম দুমকা থেকে সাঁওতালদের নিয়ে এসে বসিয়েছিল, সেই জন্তু জানোয়ার ভর্তি ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি করার জন্য। এর সঙ্গে বেশি কথা চালালে বাকি সব কাজ বন্ধ তবে এটা বুঝলাম যে আমাকে খাবার ব্যবস্থা নিজে করতে হবে সে কোন সাহায্য করতে পারবে না।
একটু গুছিয়ে, চান টান করে বাইরে তাকিয়ে দেখি সূর্য ডুবছে, পাহাড়ের ওপরের জঙ্গল পড়ন্ত সূর্যের সোনালি আলোয় ঝলমল করছে, দূরে আবছা ঢেউ খেলানো পাহাড়ের ছায়া দিগন্তে ভেসে। ভাবলাম একটু ঘুরে সকালের খাবারের দোকানে চা খেতে যাব। আমাকে বেরোতে দেখে হরিরামও সঙ্গ ধরল। যেতে যেতে ওকে সাঁওতালরদের কথা জিজ্ঞাসা করায় সে বলল এদিকের আদিবাসীরা খুব গরীব। দুবেলা খাবার পয়সা নেই। ওদের রোজগার তো চাষ থেকে আর চাষ তো বর্ষার বৃষ্টির উপর নির্ভর করে। বর্ষায় পানী পড়লে আদিবাসীদের কিছু রোজগার হল, না হলে অবস্থা খারাপ। বছর বছর এখানকার সব গ্রাম থেকে কত আদিবাসী কাজের খোঁজে বাইরে যাচ্ছে। আমি বললাম হ্যাঁ, চাষের সময় বাংলায় সাঁওতালরা অনেকদিন থেকে যায়। হরিরাম হেসে বলল এখন বাংলা ছাড়াও এরা সব যায় গুরগাঁও, ফরিদাবাদ, ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাইয়ে ঠিকাদারের লেবার হিসাবে। আর বলবেন না এদিকে তো এখন লেবার পাওয়া মুশকিল। আমার মনে পড়ল পাকুড় স্টেশনের ছবি - মাথায় বস্তা নিয়ে, কোলে বাচ্ছা নিয়ে মা পিছনে হাঁটছিল সামনে মাথায় বস্তা নিয়ে বাবা, হয়ত কোথাও থেকে তারাও ফিরছিল।
হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা ধরে পাহাড়ের দিকটায় গিয়ে দেখলাম রাস্তার দুই পাশে বেশ কিছু বড় ট্রাক আর ডাম্পার দাঁড়িয়ে আছে, কিছু বড়ো গাড়ি আর টায়ার সারানোর গুমটি, মোটর পার্টসের দোকান। একটা চওড়া রাস্তা আমড়াপাড়া লিটিপাড়ার রাস্তাকে কেটে পুব পশ্চিমে চলে গেছে। হরিরাম বলল ‘আর বলবেন না কয়লার খাদানের জন্য আমড়াপাড়া শেষ হয়ে গেল, আমড়াপাড়ায় এখন কেবল কয়লার ধুলো, ট্রাক আর ঠিকাদার। আমি তো এখানে জন্মেছি, আগে বাঁশলোই-এর জল ছিল কাঁচের মতো পরিষ্কার, আমরা ঐ জল কত খেয়েছি, এখন সেই জল কালো হয়ে আসছে, তার সঙ্গে শুরু হয়েছে নদী থেকে বালি তোলা। আগে চারিদিকে কত গাছপালা, ফলের গাছ, তখন গরমের সময়ও গরম লাগত না, এখন গরমের সময় এখানে থাকা মুশকিল’ বলে সে চুপ করল। হয়ত অতীতের দিনের কথা ভাবছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল ‘এই সাঁওতাল পরগনা আর রাজমহল পাহাড় সব শেষ হয়ে গেল খাদানে। যবে থেকে আলুবেড়ার কয়লা খাদান শুরু হোল, সারা দিন গোঁ গোঁ করে ট্রাক চলছে আর চারিদিক কালো ধুলোয় ভরে আছে।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ‘এতো কয়লার খনি তো এ দিকে নেই।’ সে হেসে বলল ‘কয়লা তো এই ক বছর শুরু হল। কিন্তু পাথর খাদান? সেই সাহেবগঞ্জ থেকে দুমকা পর্যন্ত কেবল পাথর খাদান, পুরো ভারতবর্ষের রাস্তা আর বাড়ি তৈরির গিট্টি পাথর আর লেবার এখান থেকে যায়, কয়েক বছর পর এদিকে কোন বড় পাহাড় আর আপনি দেখতে পাবেন না। এদিকার যত বাঙালি আর বিহারি ঠিকাদার পয়সা করছে ঐ পাথর আর কয়লা খাদান থেকে। ঐ যে আমড়াপাড়ার বনোয়ারি ভগত, বাজারে তিনতলা বাড়ী, সে আগে ফরেস্টের ঠিকাদার ছিল এখন কয়লা খাদানের মজুরের ঠিকাদারি আর পাথর খাদান করে কোটিপতি। আমি তাকে হাঁটতে হাঁটতে সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা জিজ্ঞাসা করি। সে একটু থমকায়, বলে আমড়াপাড়া নিয়ে সে সব অনেক গল্প কথা আছে, বেশিরভাগই মনগড়া। ঐ তো বনোয়ারিরা বহুদিন থেকে এখনকার বাসিন্দা, ওদের পরিবার নিয়েই তো নানা সত্যি মিথ্যা কাহিনী আছে।
সন্ধ্যে নামছে, সামনে সারি দিয়ে কয়লার ট্রাক চলছে, কালো ধুলো, বিরক্ত হয়ে ফিরে চললাম খাবার দোকানের দিকে, ফেরার পথে হরিরাম ওর বাড়ির পথ ধরল। দোকানে বিকালে খুবই অল্প ভিড়, দোকানদার একা আমাকে দেখে হাসল, জিজ্ঞাসা করল স্যার জায়গা পেয়েছেন? আমি শুধু ঘাড় নাড়লাম, বলল কেমন লাগছে? আমি বললাম ঠিকই আছে। ওর দোকানে একটা কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে কিছু খাচ্ছিল, কালো চাপা চেহারা, পরনে একটু ময়লা প্যান্ট শার্ট, একমাথা এলোমেলো রুক্ষ চুল। সে ওর কথা শুনে একবার আমার দিকে তাকাল, পরিষ্কার ঝকঝকে দৃষ্টি, বিহারি বা বাঙালি নয় আদিবাসী চেহারা।
ওকে দেখে মনে পড়ে গেল ফিল্ড গাইডের কথা, দোকানদারকে বলতেই সে ছেলেটাকে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলো কি রে সিংরাই তোর বাড়িতো কুঞ্জবোনার দিকে, ওখানে কেউ আছে নাকি? সে খুব ঠাণ্ডা গলায় সাঁওতালী ভাষায় কিছু জিজ্ঞাসা করল। দোকানদার বলল, ও জিজ্ঞাসা করছে কি কাজ আর কতো টাকা দেবে। সে সব কথা বলতেই কি ভেবে সাঁওতালীতে কি একটা বলে হেঁটে দোকান থেকে বেরিয়ে মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিলো। দোকানদার গজগজ করতে করতে বলল খেতে পায়না কিন্তু কী মেজাজ দেখছেন, বলছে ‘ভাবছি, কাল জানাবো’। যেদিন থেকে ঝাড়খণ্ড আলাদা হোল আর আদিবাসীদের সরকার তৈরি হয়েছে সেদিন থেকে এরা নিজেদের রাজা ভাবছে। ধীরে ধীরে সন্ধে নামছে, ছোটদিনের বেলা, নিজের আস্তানায় ফিরছিলাম। সময় কম, কাল সকাল সকাল ফিল্ডে বেরোতে হবে, ভাবছিলাম স্থানীয় কোন আদিবাসীকে ধরতে হবে, ভাবতে ভাবতেই সিংরাই-এর মুখটা মনে পড়ল।
দুই
সূর্য পশ্চিমে ঢলছে। বাড়ির বাইরে বড় অশ্বথ গাছটার নিচে ছোট বড় নানা আকারের ধান আর আনাজ মাপার বাঁশের ধামা সাজানো রাখা আছে, তার পাশের একটা কাঠের তক্তার উপর কেনারাম বসে হুঁকোয় মৌতাত করে টান দিচ্ছে। শীত পড়তে শুরু করেছে। এই জঙ্গল ভর্তি পাহাড়ি অঞ্চলে শীত একটু বেশিই পড়ে। ভাই বেচারাম গেছে তাদের কামিয়া শিবু মুরমুকে নিয়ে বাঁশলোই নদীর ধার থেকে গরুগুলোকে নিয়ে আসতে, বড় বাঘ না এলেও নেকড়ের ভয় আছে। তা ছাড়া এই সময় ভালুও চলে আসে নদীতে। দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে তাদের আমড়াপাড়ায় বসতি করার, আগে এই অঞ্চলে রাত্রে বাঘের ভয় ছিল খুব।
বছর পঁচিশ আগে কেনারাম, বেচারাম আর তাদের জ্ঞাতি গনেশ ছেলে বউ আত্মীয় স্বজন নিয়ে পালিয়ে এসে এখানে ঘন জঙ্গলের ভিতরে আমড়াপাড়ায় নদীর কাছে রাস্তার পাশের বড় একটা পুকুর পাড়ে বসতি করে। তবে এটা সম্ভব হয়েছিল ভানু সোরেনের জন্য, সে তখন থাকত পুকুরের অন্য পাড়ে জঙ্গলের দিকটায়। ভানুরা আদিবাসী, সাঁওতাল, ওর বাবা এখানে পালিয়ে এসেছিল। ওরা আসারও বছর কুড়ি আগে ইংরাজি সন ১৮১০ নাগাদ সিউড়ি থেকে সেখানকার বাঙালি জমিদারের অত্যাচারে। তারাই প্রথম আমড়াপাড়ায় জঙ্গল কেটে গ্রাম বসাতে শুরু করে। সেই সময় এদিকে কেবল ঘন জঙ্গল, জঙ্গলে হাতি, বাঘ, নেকড়ে সবই ছিল, তার মধ্যে দু একটা সাঁওতাল গ্রাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
কেনারাম হুঁকোয় টান দিতে দিতে ভাবে সাঁওতালরা খুব পরিশ্রমী, এই কয়েক বছরেই বারহাইত থেকে দুমকা পর্যন্ত আশপাশের জঙ্গল সাফ করে জায়গাটাকেই বদলে দিয়েছে। সারাদিন কাজ করে, তারপর ওদের বাঁশুরি, তিরিওয়াতে বাজায় আর রাতে মহুয়া খেয়ে মরদ মেয়েতে নাচে। কিন্তু লোকগুলো খুব বোকা, হিসেব জানে না। সারা বছর মাঠে এতো খেটেও ওদের ঘরে কিছু থাকে না, লেখাপড়াও জানে না, কাগজপত্র বোঝে না, সেইজন্যই তো তার মতো মহাজনদের কারবার রমরমিয়ে উঠেছে।
কেনারামের মনে পড়ে বক্সারের কাছে বাশুলি গ্রাম থেকে সেখানকার রাজপুত জমিদারের ছেলের ভয়ানক অত্যাচারের কথা। যেদিন ঐ বদমাস কুমার বাহাদুর ওর প্রতিবেশী হরিপ্রসাদ চৌবের সুন্দরী বোন কুমুদকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে যায় সেই রাতেই কেনারামরা সবাই ভয়ে পরিবার নিয়ে ঘর ছাড়ে। ওর এক চাচাতো ভাই ভাগলপুরে পন্টে সাহেবের সঙ্গে কাজ করত, সে সাহেবের সেরেস্তায় শুনেছিল যে সাহেবরা নাকি পাকুরের জঙ্গলে রাজ্য বসাচ্ছে, সবটাই থাকবে সাহেবদের কব্জায়, একে ওরা বলে দামিনি, এখানে কোন জমিদারের ঝামেলা নেই। তার কথায় ওরা এদিকে পালিয়ে আসে, ওদের দেখাদেখি ওদের আশপাশের গ্রামের আরো চার পাঁচ ঘর জমিদারের অত্যাচারে এদিকে চলে আসে। পরে ও জেনেছে দামিনির আশপাশে ওদের মতো অনেক উঁচু বর্ণের বিহারি আর বাঙালি পরিবার হয় ভয়ে না হলে নতুন জায়গায় পয়সার লোভে এই অঞ্চলের নানা গ্রামে আস্তানা গেড়েছে তাদের মতো।
এখন আমড়াপাড়ায় অনেক বাড়ি, দেখতে দেখতে এখন সাঁওতাল নিয়ে ষাট সত্তর ঘর লোকের বাস। মহাজনি করে কেনারাম এখন এই তল্লাটে সব থেকে ধনী ব্যাক্তি, তদের অনেক জমি, গরু বাছুর আর সোনা রুপোও কম নেই। হবে নাই বা কেন, সাঁওতালদের ষোল আনা আসলে ও সুদ নেয় চব্বিশ আনা। ওইতো বাড়ির পাশের দেওয়ালের ধারে হাড় বার করা ভানুর নাতি ভিগু, খালি শুকনো মকাই-এর ফল থেকে বসে বসে একমনে হাতে ঘসে ঘসে মকাই ছাড়াচ্ছে, হাতে কড়া পড়ে গেছে। ভানু ওর কাছ থেকে ১৫ বছর আগে ধার নিয়েছিল দু’টাকা আর সে ধার আজও শোধ হয় নি। সে কবেই মরে গেছে তার জমি জায়গা সবই কেনারামের কব্জায়, সুদের টাকাও কম পায়নি, ওদের পরিবার এখন কেনারাম বেচারামের সারা জীবনের বাঁধা লোক, কামিয়া। গত বছর ভানুর ছেলে লখনও মরল জ্বরে, এখন নাতি ভিগুটাই বেঁচে আছে। আর কেনারাম করবে নাই বা কেন মহেশপুরে, পাকুড়ে, বারহাইতে ওর মতো যতো মহাজন বা বানিয়া বেপারি এসেছিল সবাই প্রচুর পয়সা কামিয়েছে।
এইতো তার গাঁ সম্পর্কের ভাই রামশরন পেয়াদার নোকরি করে সাহেবেদের কাছের লোক হয়েছে। রামশরনই তো খাজানা আদায় করে বড়লোক হয়ে গেল। সাহেবদের খাজনা এক পয়সা হলে রামশরন সাঁওতালদের কাছ থেকে তিন পয়সা নেয়। সাহেবরাও খুশী, আগে তো এখান থেকে কোন খাজনাই পেত না এখন হাজার হাজার টাকা খাজনা পায়। দিঘির দারোগা মহেশ দত্তকে এ তল্লাটে সবাই বাঘের মতো ভয় পায়, সে কেনারামের খুব কাছের লোক। রামশরনও ওর কথার বাইরে যায় না। সাহেবরা অবশ্য এদিকে কম আসে, জমিদারও নাই তাই কেনারামই এদিককার মুরুব্বি। দারোগা আমড়াপাড়া এলে ওদের বাড়িতেই থাকে, তার জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে, মহুয়া পান করে বটে লোকটা, কিন্তু তার নজর কেবল কামিয়া সাঁওতাল মেয়েদের দিকে। কেনারাম অবশ্য দারোগার প্রস্তাবে কোনদিন রাজি হয়নি। এখনো সে কোন কামিয়াকে রাতে ওর কাছে পাঠায়নি, ওর কানে পঁচিশ বছর আগের কুমুদের কান্না আর চিৎকার ভেসে আসে।
হুঁকোয় একটা বড় টান দিতে গিয়ে দেখল আগুন নিবে গেছে। সে চেঁচিয়ে ভিগুকে বলল আগুন আনতে। ও যদিও নিচু জাত বলে সাঁওতালদের ছোঁয়া খায় না কিন্তু আগুনে দোষ নাই। ওদিক থেকে বেচারাম আসছে, কামিয়া শিবু গরুগুলোকে পিছনের গোয়ালে নিয়ে গেল। হুঁকোয় আগুন এসে গেছে, বেচারাম এসে দাদার পাশে বসে বলে ‘ও পাড়ার দুলিয়ার স্বামীটা তো মরেছে সাপের কামড়ে। ও নদীতে এসে পায়ে ধরছিল ধান না নেবার জন্য, ওর ছেলে মেয়েরা না খেয়ে মরবে’। কেনারাম হুঁকোয় লম্বা টান দিয়ে আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি বল? বেচারাম সব সময় দাদার কথা শুনে চলে, সে কোন কথা বলে না, সে জানে মেয়েদের ব্যাপারে দাদা দুর্বল, কেবল বলল এখনকি জমি নেওয়া ঠিক হবে। কেনারাম ওর ভয়টা ধরতে পেরে বলল ‘এমনি এমনি একশ বিঘা ঝোরার ধারের ভাল জমি হয়নি! সাঁওতালদের কাছ থেকে কব্জা করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আমার অত কাছের লোক ভানুকে ছাড়িনি তো দুলিয়াকে?’ বেচারাম চুপ করে থাকে। কেনারাম জিজ্ঞাসা করে সাহেবদের আসার কোন খবর পেয়েছ? ভাই ঘাড় নাড়ে, কেনারাম আদেশ করে রামশরনকে জিজ্ঞাসা কর। সব ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে, পন্টে সাহেব গতবার খুব একটা খুশী হয়নি, এবারের ব্যবস্থা ঠিক হওয়া চাই। হাওয়া খুব একটা ভাল নয় ওরাই এখন দেশের মালিক, ওদের হাতে রাখতে হবে।
তারপর দুজনেই চুপ। ও জানে আজ বেচারাম কেন ও কথা বলল কারণ কিছুদিন ধরেই দুই ভাই লক্ষ্য করছে আদিবাসীদের হাবভাব ভালো নয়, সাঁওতালদের মধ্যে একটা কেমন একরোখা ভাব। সে খবর পেয়েছে বারাইতে সাঁওতালরা জমায়েত হয়েছিল কিছু দিন আগে। আজকাল মাঝে মাঝে সাঁওতালদের তিরিয়াওতের আওয়াজও কেমন যেন আলাদা শোনায়, আশেপাশের পাহাড়ে ধামসা মাদল বেজে ওঠে। গেল মাসে যখন দারোগা মহেশ দত্ত এসেছিল তখন তার কথায়ও ওরা বুঝেছিল সাঁওতালরা আর আগের মতো নেই। কেনারাম তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল বৈজুলের কিছু ব্যবস্থা করা যাবে? দারোগা বলল ঐ শালাকে ধরব আগে এদিকটা সামলাই, সাঁওতালদের খুব বাড় বেড়েছে ওরা নাকি সাহেবদের সঙ্গে ভাগলপুরে দেখা করতে গিয়েছিল মহাজন আর নায়েব দারোগার অত্যাচারের বিচার চাইতে। বারহাইত, লিঠিপাড়া, মহেশপুরের সাঁওতালরাই বেশি লাফাচ্ছে। দারোগা গজরাতে গজরাতে বলেছিল শালাদের জুতিয়ে লম্বা করতে হয়, ভালো করে কথা বলতে পারে না, আর গেছে সাহেবের কাছে নালিশ করতে। কেনারাম চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে ‘আমড়াপাড়ার কেউ ছিল নাকি?’ দারোগা বলল ‘না’।
তিন
পরের দিন সকালে দেখি মোটরসাইকেলের গায়ে হেলান দিয়ে সিংরাই দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম ও আমার সঙ্গে যাবে। আমিও সুযোগ হারাতে চাইলাম না পয়সার কথা সেরে উঠে পড়লাম ওর মোটরসাইকেলে। যেতে যেতে সে খুটিয়ে আমার কাজের ব্যাপারে খবর নিয়ে যেন নিশ্চিত হয় যে আমি এখানে কয়লার খোঁজে আসিনি। মোটরসাইকেল চলল রাস্তা ধরে আমড়াপাড়ার পাশের জঙ্গল ঢাকা পাহাড়টা ফেলে। দুপাশে ধানের ক্ষেত দু-একটা নেড়া টিলা পেরিয়ে এগিয়ে চললাম। দুরের সারি সারি পাহাড়ে জঙ্গলের সবুজ আভাস। ঢেউ খেলানো জমির মধ্যে দিয়ে উতরাই চড়াইএর রাস্তা ধরে গাড়ি চলছে, পাশে গাছে ঢাকা দু একটা করে গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ধারে মেয়েরা কাজ করছে, বাচ্চার দল রাস্তার ধারে দৌড়াচ্ছে, কোথাও নদীর ধারে ছেলেরা মাঠে কাজ করছে। একজায়গায় দেখলাম রাস্তার পাশে একটা উঁচু জমিকে কেটে মাঠ বানান। মাঝখানটা বাঁধানো সাদা দাগ দেওয়া। জিজ্ঞাসা করায় সিংরাই বলল কয়লাখাদানের সাহেবদের হেলিকপ্টার নামার জায়গা, ক্রমশ ওর কথাবার্তায় বুঝতে পারছিলাম ছেলেটা অশিক্ষিত নয়।
সাধারণত সে চুপচাপ থাকে, কোন তাড়া নেই, সিংরাই এখানকার আর পাঁচটা আদিবাসী মানুষের মতো নয় ওর মধ্যে একটা আলাদা কিছু আছে। একদিন আমি লিটিপাড়ার রাস্তার ধারে একটা বড় শুকনো নালায় কাজ করছিলাম, ফিরে এসে দেখি সিংরাই নদীর পাশের একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে একটু দুরের একটা লম্বা মাটির ঢিবির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। ওর তাকানোয় একটা অদ্ভুত কিছু ছিল, আমার ডাক শুনেই সে মোটরসাইকেলে এসে আমাদের পরের গন্তব্যে চলতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সিংরাই-এর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বাড়তে লাগল আমিও ওর কথা জানতে পারছিলাম। একদিন দুপুরে রাস্তার ধারে একটা ছোট ধাবায় খেতে খেতে ও যখন বলল যে ও দুমকার মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেছে তখন আমি খুব একটা অবাক হইনি, আমিও এরকমই আশা করেছিলাম।
একদিন পড়ন্ত বেলায় ফিল্ড থেকে ফেরার সময় সেই নালার উপর রাস্তার ধারের ব্রীজে আমরা বসেছিলাম, দূরে সেই লম্বা মাটির ডিবি। কথায় কথায় সিংরাই তার নিজের কথা বলতে শুরু করে, বাড়িতে তার স্ত্রী ঝিমলি আর বাচ্ছা ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। তার আসল বাড়ি ছিল তালঝরির কাছে পুষরে গ্রামে, আতিখেদ পাথর খাদানের কাছে, ছোটবেলায় সেখানেই বড় হয়েছে। পাহাড়ের উপর খাদানের কাছে ওদের বাড়ি ছিল। ছোটবেলায় দেখেছে পাথর খাদানটা পাহাড়ের একপাশ থেকে ধীরে ধীরে পাহাড়টাকে খেয়ে ফেলছিল। গাঁয়ের অনেক মানুষ পাথর খাদানে পয়সার লোভে কাজ করতে গেলেও ওর বাবা ওদের পাহাড়ের উপরে ঝোরার পাশের জমিতে চাষ করত তার মায়ের সঙ্গে, তাতেই কোন রকমে ওদের চলে যেত। ওর ছোটবোন আর ও খেলে বেড়াত পাহাড়ের উপর মাঠে, ঝোপে। ও শুনেছে ওর বাবার কাছে যে আগে এই অঞ্চলের পাহাড়ে খুব মকাই, সর্ষে, মাড়ুয়া আর পাহাড়ি সিমের চাষ হত ঝোরার জমিতে ধানচাষ হত, জঙ্গল অনেক ঘন ছিল, সেখানে বরা খরগোশ সব পাওয়া যেত।
সন্ধে নামছিল, ও এক নাগাড়ে বলে চলে আগের কথা। যেসব মানুষ খাদানে কাজ করতে যেত তাদের বেশিরভাগই দশ পনের বছরের বেশি খাদানে কাজ করতে পারত না। কাজ করতে করতে শুরু হত কাশি তারপর জ্বর, ধীরে ধীরে মানুষগুলো মারা যেতে বুকের রোগে। খাদানও ধীরে ধীরে অতো বড় পাহাড়টাকে খেতে খেতে ওদের গ্রামের কাছে এসে গেল। ওদিকে জঙ্গল কমতে কমতে আর পাথর খাদান বাড়তে বাড়তে পাহাড়ের উপরের মাটি ধুয়ে পাথর বেরিয়ে যাচ্ছিল, জলও কমছিল।
কিছুদিন আগে তাদের টোলার থেকে দূরে গ্রামের জাহির থানও খাদানে চলে গেল। ওর তখন আট নয় বছর বয়স একদিন রাজমহলের বড় ঠিকাদার, পাথর খাদানের মালিক চাঁদ চৌধুরী ওদের গ্রামে এলো বড় কালো গাড়িতে, গলায় মোটা সোনার হার, সঙ্গে অনেক লোক। মাঝিথানে মাঝি হারামকে ডেকে সে বলল এই গ্রাম ছেড়ে সবাইকে যেতে হবে, সরকার বলেছে এদিকে পাথর খাদান হবে। গ্রামের লোক অবাক, তারা গ্রাম ছেড়ে কোথায় যাবে? বহু পুরুষ ধরে তারা এই গ্রামে বাস করছে, খাদানের অনেক আগে থেকে। গ্রামের বুড়ো মাঞ্ঝি হারামের সঙ্গে তার বাপও রুখে দাঁড়িয়েছিল, বলেছিল মরে গেলেও তারা গ্রাম ছাড়বে না, দরকার হলে সরকারের কাছে যাবে কোর্ট কাছারি করবে। ঠিকাদারের গুণ্ডারা ওদের শাসিয়ে যায় ১৫ দিনের মধ্যে গ্রাম না ছাড়লে ওরা খাদানের মেশিন দিয়ে সব ঘর ভেঙে দেবে।
গ্রামে সভা বসে, বেশিরভাগ মানুষই দুর্বল, না ছিল শারীরিক ক্ষমতা না ছিল মনের জোর, কেউ ভয় পায় তো কেউ রাগে চেঁচায়, আবার কেউ গ্রামে চৌধুরীর দালাল তারা ভয় দেখায়। ওর বাবা বলে পঞ্চায়তে যাই চল আমারা ওদের ভোট দি ক্যানে? ওরা সরকারকে বলুক। সবাই মিলে প্রধানের সঙ্গে দেখা করে কিন্তু চৌধুরী প্রধান সমেত পঞ্চায়েতের সব মেম্বারকে কিনে নিয়েছে, সে ঠিকাদারের হয়ে ওদের বোঝাতে আসে। ওরা বাবারা কয়েকজন মিলে রাজমহলের উকিলের কাছে যায়, কিন্তু উকিল আদালতের পয়সা কেউ দিতে চায় না। ওর বাবা মাঞ্ঝি হারামের সঙ্গে খুব চেষ্টা করছিল গ্রামটা বাঁচাতে ।
এরই মধ্যে ওদের গ্রামে হঠাৎ পুলিশ এসে ওর বাবা আর দুজনকে নকশাল বলে তুলে নিয়ে চলে যায় সাহেবগঞ্জে। ওর মা কান্নাকাটি করে মাঝি হারামের সঙ্গে ওরা সাহেবগঞ্জ যায়। উকিল, আদালত, জেল করতে করতে ওদের সব জমানো পয়সা শেষ, জমি বন্ধক রাখতে হয়। একদিন রাতে ওদের ঘরের দরজা ভেঙে ঠিকাদারের গুণ্ডারা ওর মাকে তুলে নিয়ে যায়। ভয়ে কোন রকমে রাতের অন্ধকারে ওরা ভাই বোন গ্রামের বাইরের একটা বহু পুরানো চার্চে আশ্রয় নেয়। পরের দিন সকালে চার্চের পাদ্রী ওকে দুমকাতে মিশনারি অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। ও জানে না ওর মায়ের কি হোল, ওর বোন কোথায়। আমি স্তব্ধ হয়ে ওর কথা শুনছিলাম। সিংরাই-এর চোখে কোন জল নেই চোখটা পাথরের মতো ভাবলেশহীন। সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে তখনো সেই মাটির উঁচু ঢিবির দিকে।
সূর্য ডুবে গেছে দিগন্তে ঘন লালের ছোঁয়া, একজন বয়স্ক সাঁওতাল মানুষ এক পাল গরু সামনে দিয়ে নিয়ে গেল, গরুর গলার ঘণ্টার আওয়াজ আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে। আমি ধীরে জিজ্ঞাসা করলাম তার পর? সে মোটরসাইকেল থেকে জলের বোতল নিয়ে গলায় ঢালল। তারপর আবার ব্রীজের উপর বসে শান্ত চোখে বলল, সে দুমকার মিশন স্কুলে পড়াশোনা শুরু করে, এরই মধ্যে মিশনে সে কখন খ্রীশ্চান হয়ে যায় তার মনে নেই তার নাম হয় মাইকেল সিংরাই। স্কুল শেষ হতেই সে মিশনের কাজে যোগ দেয় তখন সে প্রতিদিন রাত্রে শোবার আগে যীশুর কাছে প্রার্থনা করত যেন তার মতো তার বাবা মা আর বোনও বেঁচে যায়, ভাল থাকে। ধীরে ধীরে সে সব ভয়াবহ দিনকে ভোলার চেষ্টা করে।
ও দুমকায় যখন কলেজে পড়ে তখন চার্চের কাজে ওকে পাঠানো হয় লিটিপাড়া মিশনে। ওখানকার ফাদার একদিন স্বাস্থে্যর কাজে ওকে পাঠিয়েছিল পাহাড়ের উপর কুঞ্জবোনা গ্রামে। তখন ওকে প্রায়ই সেখানে যেতে হত, একদিন ওখানে ওর দেখা হয় বুড়ো বীরসিং হাঁসদা আর ওর নাতনী ঝিমলির সঙ্গে, বুড়ো ওকে ধরে জিজ্ঞাসা করে ওর কি নাম, ও বলেছিল ‘মাইকেল’, বুড়ো জিজ্ঞাসা করেছিল মাইকেল কি, ও বলেছিল মাইকেল সিংরাই, বুড়ো ওর মুখের কাছে কান নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে ‘কি?’ সে চেঁচিয়ে বলে সিংরাই। ও দেখে বূড়ো অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুড়ো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওর বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করে, ওর কাছে সব শুনে বুড়ো অবাক হয়ে কি দেখে তারপর ধীরে উঠে চলে যায়। তারপর কিছুদিন ওর আর বুড়োর সঙ্গে দেখা হয়নি, কিন্তু ও বুড়োকে ভুলতে পারেনি।
একদিন গ্রামের ভিতর কাজে ও বীরসিং এর বাড়ি গিয়ে দেখে সে খুব অসুস্থ, তার নাতনী ঝিমলি ছাড়া আর তার কেউ নেই। ও বীরসিং এর পাশে বসতেই সে ওর হাত দুটো ধরে চুপ করে তাকিয়ে থাকে, ওর নাতনী ঝিমলি ওর জন্য এক ঘটি জল নিয়ে এসে ওকে দেয়, ওর ঝিমলিকে ভালো লাগে। সে বেরিয়ে গেলে ও বুড়োকে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে? সেদিন বীরসিং ওকে সাঁওতালদের এক অদ্ভুত গল্প বলে, যে গল্প আজও ওকে এই রাজমহলের পাহাড়ে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। তারও কয়েক মাস পর সে মিশনের কাজ ছেড়ে দেয়। বুড়োর কাছে কুঞ্জবোনায় থাকতে শুরু করে, কিছুদিন পর বুড়ো মারা যায়। সে ঝিমলিকে বিয়ে করে তাদের জমি জায়গা দেখতে থাকে, চাষের সময় ছাড়া অন্য সময় নানা জায়গায় কাজ করে পয়সা রোজগার করে আর ঘুরে বেড়ায় ওর মোটর সাইকেল নিয়ে সাঁওতাল পরগনার নানা প্রান্তে।
চার
কেনারামের অনেকদিন ধরে চোখ ছিল লিটিপাড়ার বৈজুল মাঞ্ঝির জমি আর সম্পত্তির উপর। লোকটা যখন বছর পাঁচেক আগে ওর কাছে বারো ঝুড়ি ধান ধার নিয়েছিল তখনই ও সব কাগজ তৈরি করে রাখে। লোকটা ওকে এই ক’বছরে ধার শোধের জন্য এক’শ ঝুড়ির বেশি ধান দিয়েছিল তা সত্ত্বেও গেল বছর কেনারাম সেই পুরোন কাগজের জোরে ধার না-শোধের মামলা করে ভাগলপুরের দেওয়ানী আদালত থেকে ডিক্রি নিয়ে আসে। তারপর বৈজুলের জমি দখল করার জন্য আদালতের শমন নিয়ে রামশরন লিটিপাড়ায় যায় পেয়াদা নিয়ে । সেখানে ওর দুই জোয়ান ছেলে চাঁদরাই, সিংরাই আর গ্রামের লোকে মিলে রামশরন আর পেয়াদাদের ঘিরে ধরে মারতে যায়, বৈজুল তাদের শান্ত করলে রামশরনের বেঁচে ফেরা হত না।
সেই থেকে কেনারামের ঘুম উড়ে গেছে। এরকম চললে তো মহাজনি কারবার বন্ধ হয়ে যাবে। গেল মাসে ও লিটিপাড়ায় গিয়ে বৈজুল মাঞ্ঝির ক্রোক করা জমি বাড়ি দখল নেবার কথা ভেবে ওখানকার বড় মহাজন ঈশরী ভগত আর বাগসীসার জিতু কালুর সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে গিয়েছিল। কিন্তু দুজনাই বারণ করেছিল, বলেছিল এখন লিটিপাড়ায় কিছু না করতে, হাওয়া ভাল নয়। লছিমপুরের বীরসিং ইতিমধ্যেই দু তিন জন মহাজনকে শাসিয়ে গেছে। যবে থেকে মহাজনদের কথায় অম্বরের দেওয়ান জগবন্ধু রায় লছিমপুরের পরগনাইত বীরসিংকে পাকুড়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে মহাজনদের সামনে জুতো পেটা করে, সেদিন থেকে সে মহাজনদের উপর ক্ষেপে আছে। বীরসিং নাকি বড় দল গড়েছে, কোন মহাজন সাঁওতালদের জমি অন্যায় ভাবে দখল করলে দিখু মহাজনদের বাড়ি চড়াও হচ্ছে। কেনারামের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সাঁওতালদের এতো বাড় বেড়েছে। কিন্তু ওর আর সাহস হয়নি বৈজুলকে ওরই গ্রামে ওর বাঘের মতো দুই ছেলের সামনে ঘাঁটাতে।
কেনারামও কম নয়, সে তক্কে তক্কে ছিল যেদিন ওর লোকেরা খবর দিল বৈজুল নাকি কুটুমবাড়ি এসেছে ডুমারচীরে, ও সঙ্গে সঙ্গে রামশরনের সঙ্গে ওর পোষা কটা লেঠেল পাঠায় ওকে ধরে আনার জন্য। জঙ্গলে লোকটাকে একা পেয়ে রামশরন আর লেঠেলের দল তাকে তুলে নিয়ে আসে কেনারামের বাড়িতে। লোকটার চোখটা রাগে বাঘের মতো জ্বলছিল। সে কেনারামের মাটির বিশাল বড় বাড়ীর সামনে ওকে মুখের উপর চেঁচিয়ে বলে দিল সে লুটিয়া সাঁওতালদের সঙ্গে কেবল লুকাচুরি করে। কেনারাম অবাক, সাঁওতালটার এতো সাহস তাকে চোর বলছে, এই প্রথম কোন আদিবাসী তার বাড়িতে তাকে চোর বলছে।
তার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো, সে হাত চেপে ধরে চড় মারতে গিয়েছিল কিন্তু মাঝবয়েসি ছোটখাটো চেহারার সাঁওতালটার গায়ে খুব জোর, এক ধাক্কায় হাত ছাড়িয়ে নিল আর সেই ধাক্কায় মোটা কেনারাম ধান ভর্তি বস্তার মতো মাটিতে ছিটকে পড়ল। সে চেঁচাতেই পাশ থেকে রামশরন আর তার পেয়াদারা লোকটাকে জাপটে ধরে, আশেপাসের বিহারি বাড়িগুলো থেকে ছেলে ছোকরারা বেরিয়ে এসে লোকটাকে মারতে শুরু করল। লোকটার চোখগুলো রাগে জ্বলছিল কিন্তু এতগুলো লোকের সামনে সে হাল ছেড়ে দাঁড়িয়ে মার খেতে লাগলো। ভিগুর সঙ্গে কামিয়া সাঁওতালরা দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। সকলে তাকে মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে যখন লোকটাকে ছাড়ল তখন সে মাটিতে পড়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে, তার ধুতি ছিঁড়ে গেছে, সারা গায়ে রক্ত। কেনারাম গর্জন করছিল কামিয়াদের এতো সাহস দিখুদের গায়ে হাত তোলে? মামলা করে শালাদের সব জমি দখল নেবো।
ছেলেগুলো আর রামশরন লোকটাকে পিছনের খালি ধানের ঘরে লোকটাকে বন্ধ করে রাখল। মাঞ্ঝির বয়েস হয়েছে, মার খেয়ে ঝিমিয়ে পড়লেও নিয়ে যেতে অনেক বেগ দিল। দূর থেকে ভিগুর সঙ্গে অন্য কামিয়া সাঁওতালরা এক দৃষ্টিতে দেখছিল, তাদের চোখেও যেন রাগ। কেনারাম মনে মনে হিসাব করে নিয়েছে এটাই সময় ব্যটাকে চুরির অপরাধে দারোগাকে দিয়ে ভাগলপুরে সাহেবদের জেলে পুরতে হবে। সে রামশরনকে তখনই পাঠাল দারোগাবাবুকে খবর দিতে। সন্ধে নামছে একটু দুরেই কয়েকটা ময়ূর খুব কর্কশ স্বরে ডেকে উঠল, ভিগু আর কামিয়া সাঁওতালরা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল হঠাৎ অন্ধকারে তারাও মিলিয়ে গেল। কোথায় যেন তিরাওতের একটা অস্বস্তিকর সুর বাজছে, রাত বাড়লে শুরু হল ধামশা মাদলের রাগী আওয়াজ। এত বছরেও কেনারাম জংলী মানুষগুলোর এইসব আওয়াজের মানে বুঝতে পারে না।
সকালে মহেশ দারোগা বেশ কয়েকজন বিহারি আর বাঙালি পেয়াদা নিয়ে এসে বৈজুল মাঞ্ঝিকে সাঁওতালদের সামনে মারতে মারতে ভাগলপুরের জেলে নিয়ে গেল। কেনারাম অবাক হয়ে লক্ষ করল এই প্রথম গাঁয়ের দুজন সাঁওতাল ছেলে দারোগাকে আটকাতে এল। তারা বলছিল সব দোষ কেনারামের, শুনে দারোগা তো রেগে আগুন, মেরে তাড়িয়ে দিল ওদের। ও এত বছরে এই প্রথম দেখল আমড়াপাড়ার সাঁওতালদের চোখে প্রতিবাদ।
বৈজুল মাঞ্ঝিকে ভাগলপুরে ধরে নিয়ে যাবার খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল মহেশপুর, লিটিপাড়া, বারাইত, পাকুড়ে। বৈজুল মাঝির দুই ছেলে চাঁদরাই আর সিংরাই আগেই খবর পেয়েছিল লছিমপুরের বীরসিং চান্দো, বোঙ্গার আদেশ পেয়েছে তাদের দেশ থেকে দিখু মহাজন, দারোগা, নায়েব আর ফিরিঙ্গিদের তাড়াতে। সে সাঁওতাল দল বানিয়েছে। ওরা দুই ভাই বাপকে লুকিয়ে আগেই দেখা করেছিলো বীরসিং-এর সঙ্গে, ঠিক করেছিল লিটিপাড়া, আমড়াপাড়া, মহেশপুর থেকে তাড়তে হবে অত্যাচারী মহেশ দারোগা আর কেনারামের মতো অত্যাচারী মহাজনদের কিন্তু ওদের আটকে রেখেছিল বৈজুল মাঞ্ঝি। আজ সেই বৈজুল মাঞ্ঝিকেই মহেশ দারোগা আর কেনারাম চক্রান্ত করে আমড়াপাড়া থেকে মারতে মারতে ধরে নিয়ে গেছে ভাগলপুর।
খুব তাড়াতাড়ি রাতের মধ্যেই লিটিপাড়ার মাঞ্ঝিথানে মশাল জ্বালিয়ে সভা হল। আশপাশের গ্রাম থেকে হাজার খানেক মানুষ তীর ধনুক, কুড়ুল নিয়ে জড়ো হল, মশালের আলোয় সবার চোখ বাঘের মতো জ্বলছে, রাগের গনগনে কথার আঁচ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে রাতের অন্ধকারে। চাঁদরাই বড় হলেও সে তার ছোট ভাইকে তার বুদ্ধির জন্য সম্মান করে। সে তাকেই কথা বলতে বলল। সিংরাই সবাইকে শান্ত হতে বলল। সে বলল ‘আমাদের মাথা ঠাণ্ডা করে এগোতে হবে, কোন রকম মাথা গরম করা যাবে না। এখনো বৈজুল মাঞ্ঝীই মাঝি হারাম, তারা কাল যাবে ভাগলপুর সেখানে তার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবে, জানবে সে কি চায়।’ কিন্তু পরের দিন সিংরাই ও আরো দুজন সাঁওতাল যখন ভাগলপুরে পৌঁছায় ততক্ষণে বৈজুল মাঞ্ঝি পুলিশ চৌকিতে মহেশ দারোগার অত্যাচারে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে।
সেটা চৈত্র মাস। সন্ধের ঠিক আগে কেনারাম, বেচারাম বাড়ির বাইরে বসেছিল, আজ চারিদিক খুব শান্ত, একটু বেশিই শান্ত, কেবল পাশের বড় মহুয়া গাছে পাখির আওয়াজ অন্য দিনের থেকে কম। আজ কোন কামিয়ার দেখা নেই, ভিগুটাকেও দেখা যাচ্ছে না। আজই ওরা খবর পেয়েছে যে বৈজুল মাঞ্ঝি ভাগলপুরে পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে। কেনারাম ভাইকে বলল এবার আদিবাসীদের ভয় বাড়বে আর সাহস পাবে না ওদের সঙ্গে লাগতে। ঠিক সেই সময় হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের পাহাড়িয়া লেঠেল এসে হাজির। তার চোখেমুখে আতঙ্ক, সে বলল কর্তা তোরা তাড়াতাড়ি পালা, সাঁওতাল মাঝিরা ক্ষেপেছে, আমাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে বলেই সে দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে বাঁশলোই-এর দিকে চলে গেল। দুজনেই ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক, তখনই বাড়ির পিছনের বড় পুকুরপাড়ে সরসর করে ঝোপের মধ্যে কি চলে গেল। কেনারামের মনে হল ভিগু, সে চেঁচাল ভিগু ভিগু বলে, আর কোন আওয়াজ নেই, বেচারাম বলল শিয়াল বোধ হয়। এই প্রথম এতদিন পর দুই ভাই ভয় পেলো।
দুজনে তাড়াতাড়ি উঠে বাড়ির ভিতরে গেল, বেচারাম বলল ‘পাহারার জন্য ভিগুর সঙ্গে বাকি কামিয়া সাঁওতালদের ডাকি’। পোড় খাওয়া কেনারাম হাত দিয়ে ওকে থামাল, ভাবল এই সময় জঙ্গলের রাস্তায় সাঁওতালদের চোখ এড়িয়ে পালান অসম্ভব। বাড়ির মেয়েদের জড়ো করে সন্ধে হতেই চুপিচুপি পাশের চৌবের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল, আশপাশের ছেলেদের তৈরি হতে বলল। ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে দুদিন আগে পূর্ণিমা গেছে, লালচে ঘোলাটে চাঁদ বড় বড় শাল আর মহুয়া গাছের মাথা ছাড়িয়ে আকাশে উঠল। দূরে ধামসা মাদলের আওয়াজ আরো স্পষ্ট হচ্ছে মানুষের কথা বলার আওয়াজ আর গনগনে সাঁওতালী গানের আওয়াজ এগিয়ে আসতে থাকে আমড়াপাড়ার দিকে। ততক্ষণে বিহারি পাড়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
কেনারাম ভাবছে কী করে সে মহেশ দত্তকে খবর পাঠাবে। আজ যদি সে কোনরকমে বাঁচে তাহলে যত পয়সা লাগুক সাঁওতালদের জব্দ করতে ভাগলপুর থেকে সাহেবদের ধরে সে কোম্পানির সৈন্য নিয়ে আসবে। হঠাৎ আশপাশের গাছ অগুনতি মশালের আলোয় জেগে উঠল চারদিক থেকে সাঁওতালী ভাষার কোলাহল। দেরি না করে কেনারাম দ্রুত বাড়ির পিছনের বড় পুকুরে চুপি চুপি নেমে পুকুর ভর্তি বড় বড় পদ্ম পাতার আড়ালে কেবল মাথাটা তুলে লুকলো। ওর মনে হল ঝোপের পিছনে একটা চোখ যেন শিয়ালের মত তাকে দেখছে।
পরের দিন মহেশ দত্ত যখন এল তখন কেনারামের শরীর পদ্মবনে ভাসছে, সারা শরীরে অসংখ্য তীর। কেনারামের এত বড় বাড়ি পুড়ে ছাই তার থেকে তখনও ধোঁয়া বেরচ্ছে, উঠনের সব ধানের গোলা লুট হয়ে গেছে। মহেশ দত্ত তার সঙ্গের জনা দশেক বিহারি পালোয়ান নিয়ে প্রথমেই সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে দেখল সব খালি। দুজন বয়স্ক অসুস্থ সাঁওতাল শুয়ে ছিল তাদের চেঁচিয়ে লাথ মেরে জিজ্ঞাসা করতেই তারা বলেছিল যে সিংরাই আর বীরসিং তাদের দলবল নিয়ে ভগনাডিহির দিকে গেছে।
সে সময় নষ্ট না করে পেয়াদার দল নিয়ে চলল উত্তরে বারহাইত ভগনাডিহির দিকে। বেলা পড়ে এসেছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড় পেরিয়ে মহেশ দত্তর দল সমতলে জঙ্গলের মধ্যে গুমানি নদীর পাড়ে এসে পৌছাল, একটু গেলেই ওরা ভগনাডিহি পৌঁছে যাবে। একটানা হেঁটে দারোগা ও সঙ্গের পেয়াদারা বিশ্রাম নিতে নদীর জল খেয়ে একটু দাঁড়াল, কাছেই ভগনাডিহি, এরপরই শুরু হবে সাঁওতালদের ধর পাকড়। ধূর্ত মহেশ দত্ত ভেবেছিল সাঁওতালরা একজোট হাবার আগেই হঠাৎ গিয়ে সিধু কানুর চার ভাইয়ের সঙ্গে ঐ বীরসিং আর সিংরাইকে ধরতে হবে। ও জানে এই কটা মাথাকে ধরলেই কাজ শেষ।
হঠাৎ মহেশ দত্ত দেখল একটু দুরেই ভিগু নদীতে জল খাচ্ছে, ওর মাথা গরম হয়ে গেল। এই শালারাই মেরেছে কেনারামকে। দৌড়ে পেয়াদারা ঘিরে ধরল ভিগুকে। মহেশ দত্ত তার ঘাড় ধরে তুলতেই আকাশে হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আওয়াজ করে উড়তে শুরু করল। ও বুঝতে পারল নদীর চারধারের জঙ্গল থেকে পিলপিল করে মানুষ নামছে দেখতে দেখতে তীর ধনুক, কুড়াল, দা হাতে তাদের ঘিরে ধরেছে অসংখ্য সাঁওতাল। মহেশ দত্তর বুঝতে সময় লাগল না তার জন্যই এখানে ফাঁদ পাতা হয়েছিল। সে জানে সাহস হারালে চলবে না, আর এখানে তার জোর দেখান বোকামি। দারোগা চেঁচিয়ে বলল আমরা খবর পেয়েছি সিংরাই আর ভিগু, কেনারাম ভগতকে মেরে এখানে লুকিয়েছে। আমরা সরকারের আদেশে ওদের ধরে নিয়ে ভাগলপুর যাব তোদের কিছু করব না। কিন্তু কখন ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে খালি গায়ে তীর ধনুক হাতে কালো পেশীবহুল চেহারার দুই সাঁওতাল জোয়ান, সে ওকে কিছু বলল, মহেশ দত্ত ভয়ে কেবল শুনতে পেল, হুল হুল…।
পরের দিন ভাগলপুরে সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে খবর এলো দারোগা মহেশ দত্তর সাথে দশজন কোম্পানির পেয়াদার ছিন্ন ভিন্ন দেহ পড়ে আছে বারহাইতে যেখানে গুমানি আর মোরেল নদী মিশেছে।
পাঁচ
সেদিন পাকুড় থেকে ট্রেন ধরব কলকাতার, অনেক রাতের ট্রেন। এই কদিনে সিংরাই আর আমার ঘনিষ্ঠতা অনেক বেড়েছে এখানকার সাঁওতাল জীবন সম্পর্কে আমার একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। সিংরাই বলল সে আমার সঙ্গে পাকুড় যাবে, আমি রাজি হয়ে গেলাম। বিকালে আমড়াপাড়া থেকে দুজনে পাকুড়ের বাসে রওনা দিই। বাস ফাঁকা, আমি কৌতূহল সামলাতে না পেরে বাসে উঠে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম বুড়ো বীরসিং-এর কথা, সে ওকে কি বলেছিল যে সিংরাই মিশনের কাজ ছেড়ে ওর নাতনী ঝিমলিকে বিয়ে করে কুঞ্জবোনায় আস্তানা গেড়েছে? ও বলল, বুড়ো বীরসিং ওকে দেড়’শ বছর আগের সাঁওতালদের যে কাহিনী বলে তা ওকে আজও তাড়া করে নিয়ে ফেরে, ও নানা জায়গায় অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখে, নানা মানুষের কথা শোনে, সে ঘুমাতে পারে না। ও ঝিমলিকে খুব ভালোবাসে, সেই বাড়িঘর সব সামলায়, বাড়িতে মাঠের কাজে ঝিমলি আর ছেলে কানুর সঙ্গে সে খুব ভালো থাকে, কিন্তু বেশিদিন সে বাড়িতে থাকতে পারে না। বাসের জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের মুখের উপর বয়ে যাচ্ছিল, কেন জানি আজ আমার ওকে দেখে মায়া লাগছিল।
সিংরাই বলে সে কলেজে থাকতে সাঁওতাল হুল নিয়ে কিছু লেখা পড়েছিল, তখন ওর ভাল লেগেছিল, বিদেশী ইংরেজদের বিরুদ্ধে ওদের পূর্বপুরুষরা কী বীরত্বের সঙ্গে স্বাধীনতার জন্য লড়েছিল সিপাহী বিদ্রোহেরও আগে। কিন্তু ওর সঙ্গে যখন বীরসিং-এর প্রথম কথা হয় তখন সে শুনিয়েছিল সাঁওতালদের স্বপ্নের দেশের কথা, যা তারা তৈরি করতে চেয়েছিল জঙ্গল পাহাড় ঘেরা দামিনিতে, কিন্তু কেমন করে তাদের পরিশ্রমের জমি ফসল লুটেছিল দিখু জমিদার, মহাজন, দারোগা, নায়েবরা আর সাহেবরা শুনেছিল তাদের কথা। ও সেই বিদ্রোহী সাঁওতালদের উত্তরসূরি ওকে লড়তে হবে সাঁওতালদের জন্য নিয়ে যেতে হবে তাদের স্বপ্নরাজ্যে। সিংরাই-এর তখন মনে হয়েছিল বুড়ো ভুল বকছে।
মিশনে ফিরেও তার মাথায় সেই সব গল্প ঘুরতে থাকে। একদিন সে আমড়াপাড়া গিয়েছিল মিশনের কাজে, ফেরার সময় সন্ধে হয়ে গিয়েছিল, আমড়াপাড়ার বাজারের ঠিক বাইরের উঁচু পাড় দেওয়া পুকুর পাড়ে এসে ওর মনে হয় কেউ ওকে ডাকছে, সিমাবোঙ্গা পাওয়া মানুষের ডাক। ও পুকুর পাড়ে উঠতেই হঠাৎ সব বদলে গেল। ও দেখল গাছপালা ঘেরা পুকুর পাড়ে খালি গাঁয়ে দাঁড়িয়ে রাগে গা জ্বলছে ওর পাশে ওর দাদা চাঁদরাই আর তাদের সাথীরা মশালের আলোয় কেনারামকে তার বাড়িতে পাড়ায় খুঁজছে। এক এক করে ওরা কেনারামের সব ধানের গোলা লুট করল সঙ্গে বিহারি পাড়ার সব বাড়ির গোলা, বিহারি পাড়ার লোকজন ভয়ে অন্ধকারে এদিক সেদিক পালানোর চেষ্টা করছে।
ওরা কেনারামকে খুঁজে না পেয়ে ওর বড় বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে, সেই আলোয় ওর চোখ যায় পুকুর পাড়ের ঝোপের পাশে দাঁড়ান হাড় বার করা ভিগুর দিকে, তার চোখের ইশারায় সে সব বুঝে নেয়, সঙ্গে সঙ্গে ওর সাথী সাঁওতালরা সার দিয়ে তীর ধনুক নিয়ে পুকুর ঘিরে দাঁড়ায়, আগুনের আলোয় পুকুরের সব পদ্ম ঝলমল করছে। মাঝখানে ভিগু আঙ্গুল তুলে দেখাতেই এক সঙ্গে সবাই সেদিকে তীর ধনুক তাক করে, কোথা থেকে আওয়াজ ওঠে ‘সিকে এউশুল’ সিকি শোধ, সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক তীর পদ্মপাতা ফুঁড়ে যেতেই চিৎকার করে জলের উপর ছিটকে উঠল কেনারামের তীর বেঁধা মোটা রক্তাক্ত শরীর। আবার একসাথে সব ধনুকে গুণ লাগাতেই আওয়াজ উঠল ‘আধা উশুল’ অর্ধেক শোধ, একসাথে আরও একঝাঁক তীর গিয়ে বেঁধে সেই আধা ভাসমান তীর বেঁধা শরীরে। তৃতীয় বারের জন্য ধনুকে গুণ পড়ল সম্মিলিত আওয়াজ উঠল ‘ফারখত’ সব ধার শোধ। তারপর ওর আর কিছু মনে নাই। পরের দিন সকালে ও দেখে ঐ পুকুর পাড়ে ও মোটরসাইকেলের পাশে ঘাসের উপর শুয়ে। ওর মনে হল ওকে বোঙ্গায় ধরেছে, কিন্তু ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। ও কোন রকমে মিশনে ফিরে ঘটনাটা ভোলার চেষ্টা করে।
এর কয়েক মাস পর ও একদিন সন্ধ্যের ঠিক আগে মোটর সাইকেল নিয়ে ফিরছিল বারহাইত থেকে লিটিপাড়া মিশনে। মাঠ পেরিয়ে ও যখন গুমনি নদীর নতুন ব্রিজে উঠে মোটরসাইকেলটা রেখে পেচ্ছাপ করতে দাঁড়িয়েছে আবার সেদিনকার মতো হঠাৎ সব বদলে গেল। দেখল নদীর পাড়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ওরা সব খালি গায়ে শ্বাপদের মতো দাঁড়িয়ে আছে, ওর এক পাশে বীরসিং অন্য পাশে ভগবান সিধু আর কানু দাঁড়িয়ে। কানু ওকে আস্তে জিজ্ঞাসা করল তুই ঠিক জানিস দারোগা আসবে? তার চোখ অন্য পাড়ে। সে কেবল ঘাড় নাড়ল, ঠিক সেই সময় ঐ পাড়ের ঝোপের থেকে ময়ূর ডাকার মতো আওয়াজ, ওরা বুঝল সেই সঙ্কেত, দারোগা এসে গেছে। দারোগা তার পেয়াদার দল নিয়ে নদীতে নামতেই সে চোখের ইশারা করে ভিগুকে, সেও জল খাবার ভান করে নদীতে নামে।
ওরা নিঃশব্দে দারোগার দলকে ঘিরে ধরে, ও হাসে দারোগার ভয় দেখানো দেখে। দারোগার সামনে দাঁড়িয়ে সিধু আর কানু আর দারোগার পিছনে কুঠার হাতে দাঁড়িয়ে দাদা চাঁদরাই। সিধু গর্জন করে ‘দারোগা তুই মেরেছিস বৈজুল মাঝিকে?’ দারোগা কিছু বলার আগেই পাশ থেকে এক সঙ্গে জঙ্গল কাপিয়ে আওয়াজ উঠল হ্যাঁ, দারোগা আর মহাজন মিলে মেরেছে মাঞ্ঝিকে, চারিদিক থেকে আওয়াজ উঠল হুল হুললল, অমনি চাঁদ রাই-এর কুঠারে দারোগার মাথা ছিটকে পড়ল শরীর থেকে। মশালের আলোয় আর চারিদিকের হুল হুল গর্জনের মধ্যে বালি দিয়ে দারোগার দলের রক্তধারা চুইয়ে চুইয়ে মিশছে গুমনির জলে। ওরা দল বেঁধে নদী থেকে যায় ভগনাডিহির ঠাকুরবাড়ি সেখান থেকে গ্রামে গ্রামে ‘গির’ পবিত্র শাল গাছের ডাল পাঠান শুরু হয়, সঙ্গে দেশজুড়ে হুলের ডাক দেওয়ার সংকেত হিসাবে যায় শাল পাতার বাটিতে আতপ চাল, তেল আর সিঁদুর। শুরু হয় ইংরাজি ১৮৫৪ সনের সাঁওতাল হুল। অনেক রাতে নদীর ধারে ওর জ্ঞান ফেরে।
বাসটা পাকুড় স্ট্যান্ডে পৌঁছেছে, আমরা বাস থেকে নেমে খাবার খেতে পাশের একটা ছোট দোকানে ঢুকলাম। কোন রকমে খাবার অর্ডার দিয়েই আমি সিংরাইকে জিজ্ঞাসা করি তারপর। মিশনে ফিরেই ও যায় কুঞ্জবোনায়। ওকে দেখে অসুস্থ বীরসিং কাঁদতে থাকে। সে তার অবস্থার কথা বলে শুনে বুড়ো ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। শান্ত হলে বুড়ো বলে সত্তর আশি বছর আগে ও যখন ছোট ছিল ওর বাবা মারা যাবার পর কুঞ্জবোনা এলাকার পুরানো পরগনাইত ওকে দূরে নিয়ে গিয়ে বলেছিল ‘যে ওর কাজ এখনো শেষ হয় নাই’। সেও সেদিন বুঝতে পারেনি তার মানে। তাকেও সেদিন সেই পরগনাইত সাঁওতাল হুলের নিজেদের গল্প বলেছিল। শেষে বলেছিল সাহেবদের সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইতে সাঁওতাল বিদ্রোহের সব বড় বড় নেতারা মারা গিয়েছিল কেবল দুজনের কথা কেউ জানে না এক লছমিপুরের পরগনাইত বীরসিং আর বৈজুল মাঞ্ঝির ছেলে সিংরাই।
দুজনেই হারিয়ে যায় রাজমহলের পাহাড়ে জঙ্গলে। কেবল তার মতো কিছু পরগনাইত জানত যে ঐ দুজনে দু’দিকে চলে যায়, সিংরাই যায় উত্তরের পাহাড়ে আর বীরসিং লুকোয় লিটিপাড়ার কাছের কোন পাহাড়ে পাহাড়িয়া এলাকায়। লোকে বিশ্বাস করে একদিন এরা ফিরে আসবে সাঁওতালদের জঙ্গল পাহাড় ঘেরা স্বপ্নের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে যেখানে বাইরের লোকের অত্যাচার নাই সহজ সরল সাঁওতাল মানুষদের কেউ ঠকাবে না, তাদের জমি বাড়ি চুরি করে গোলাম বানাবে না। ও আর ফিরতে পারেনি মিশনে।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে পাকুড় স্টেশনে পৌঁছে গেছি সন্ধে আটটা হবে, স্টেশনের প্লাটফর্মে সারি সারি আদিবাসী জোয়ান ছেলে মেয়ে, বাচ্চা বুড়ো, বাক্সপেঁটরা বস্তা নিয়ে অপেক্ষা করছে বিভিন্ন ট্রেনের জন্য। আমি সেই ভিড়ের দিকে তাকিয়ে, বেশির ভাগ রোগা মায়ের কোলে অপুষ্টিতে ভোগা শিশু, তারই মধ্যে মাথায় বস্তা আর পেঁটরা নিয়ে বসে, কোন কোন বাচ্চার হাতে কুড়কুড়ে বা চিপস্-এর ছোট প্যাকেট। আমি দেখছিলাম অভাবের তাড়নায় গ্রাম ছেড়ে সাঁওতাল পরিবারেরা লেবার ঠিকাদারের লোকের সঙ্গে যাচ্ছে কাজের আশায়। চলেছে ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে কলকাতা, বর্ধমান, দিল্লি, চেন্নাই।
আমার ট্রেন আসতে এখনো অনেক দেরি, আমরা প্লাটফর্মের শেষে নীচে একটা বাঁধানো জায়গায় বসলাম, এদিকে আলো একটু কম। সিংরাই কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই সারি সারি মানুষের দিকে, মনে পড়ছে বুড়ো বীরসিং ওর হাত ধরে অসহায় ভাবে ওকে বলছে ‘আজ সাঁওতালদের অবস্থা আগের থেকেও খারাপ, সেদিন আমাদের জমি আর ধান গিয়েছিল আজ আমাদের দেশ, পাহাড় জঙ্গল সব চলে যাচ্ছে, আমারা ওদের গোলাম হয়ে পড়ছি। সে আবার ফিরে আসবে, ততদিন সিংরাই যেন চেষ্টা করে যায় সাঁওতালদের বাঁচাতে’। সিংরাই-এর মনে পড়ে ওর বাবা মা আর ছোট বোনের কথা, ওর গ্রাম আর পাথর খাদানের কথা। সে ভাবতে থাকে যেমন করেই হোক তাদের ফিরতে হবে তাদের শান্তির দেশে ঝিমলি আর ছোট্ট কানুকে নিয়ে।
তথ্য সুত্রঃ
১) সাঁওতাল গণসংগ্রামের ইতিহাস- ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে।
২) Hul Hul - Peter Stanley
৩) The Story of an Indian Upland- by F B Bradley Birt
4) Bengal District Gazetteers, Santal Par ganas - By L S S O'Malley
5) Census of India 2011, Pakur, Series-21, Part-XIIB