সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সাধন চট্টোপাধ্যায়
গল্পের পাতা থেকে , শব্দটি ছাপার পোষাক বদলে ,আমার বুকের অতলে ঢুকে গেল।
বইটা রেখে, জানলা ধরে তাকিয়ে রইলাম। তা-কি-য়ে-ই রইলাম। আমার নাকের রন্ধ্রপথে স্মৃতির নিঃশ্বাস।
বিস্ময় হল, কত যুগ পর একটা পরিচিত, মুখে মুখে ঘোরা শব্দ, বইয়ের পাতায় হঠাৎ আমার নজরে এল। একটা নাম।
ব্যথায়, শিহরণে, রহস্যে, ভেতরটা ক্রমাগত মোচড়াতে থাকে।
একটি নদীর নাম। কালিজিরা।
গল্পটির লেখক একজন প্রবীন। ঘনিষ্ঠ ছিলাম। এক কি দেড় দশক আগে গত হয়েছেন। কোনো ‘স্টার’ লেখক কিংবা মিডিয়ানন্দিত ছিলেন না। হতেও চাননি, কোনো আপশোস ছিল না। খোলামেলা, দৃঢ়চেতা দায়বদ্ধ মানুষ একজন। তরুণ লেখকদের গভীর মমতায় দেখতেন। তাঁরাও কাছে বসে থাকলে বটের ছায়ার মতো স্নিগ্ধ শান্তি বোধ করত।
গল্পটি পড়তে পড়তে ভাবছিলাম,অদ্ভূত! তালে তিনিও নদীটিকে চিনতেন? তাহলে পূরাণ কিংবা রূপকথার নদী নয় কালিজিরা! খাঁটি বাস্তবের!
আখ্যানটি শেষ করে বুঝলাম, তিনিও জীবনের কোনো পর্বে কালিজিরার তীরের কোনো গ্রামে ছিলেন। অবশ্যই আমাদের ভিটে গ্রাম নয়। গল্পে যে-গাঁ-গুলোর উল্লেখ পেলাম, আমাদেরটি ছিল না। লেখক নাকি কালিজিরার স্মৃতিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোপন কান্নায় দেশ ত্যাগ করেছিলেন। নিজদেশে পরবাসী হয়ে পড়ার সাথে সাথেই। সেইসব স্মৃতি ও চাপা অভিমানের গল্প এটি। যেমন, ‘...তোমাদিগের মন এবং দেহের যাবতীয় দুষিত বর্জ্য পদার্থ আমি পূর্বের ন্যায় এখনও বহিয়া লইয়া যাইতেছি কালিজিরা নদীতে, যে তাহা লইয়া যায় কীর্তনখোলা নদীতে, কীর্তনখোলা সে-সব তুলিয়া দিতেছে...’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
গল্পটির বিষয় একটি নদীর আত্মকথা। সন্ধ্যা নামের নদী। এ নামটি আমার পরিচিত নয়। বুঝতে পারলাম, শৈশবে ছেড়ে আসা আমার জন্মভিটার আশপাশ দিয়ে অনেক নদী ছিল। জটাজালের মতো। সন্ধ্যা, কালিজিরা বা কীর্তনখোলা-রা স্নায়ুজালে জড়িত স্বচ্ছ পানিবহা আত্মীয় নদী। যেমন পারিবারিক ভিটায় জ্ঞাতিসহ পিতামহ, প্রপিতামহদের দিনগুলো বয়ে গেছে।
বইটির পাতা আবার খুললাম, চোখ বোলালাম, বন্ধ করলাম ফের। ততক্ষণে বুকের তলায় ‘কালিজিরা’ শব্দটি চোরাডুব দিতে দিতে আমার চোখের ঢাকনা দুটি ভিজিয়ে দিল। জীবনের দীর্ঘ বছরে যা শুখা, খরখরে হয়ে আছে।
দেশ ছেড়েছিলাম তিন কি সাড়ে তিন বছরে—সেসবের স্মৃতি ঝাপসা। ঝাপসাটুকুও এখন উই-য়ে কেটে রেখেছে।
এ দেশে ভাসতে ভাসতে এসে টিপ টিপ মনে পড়ছে, বাপ মায়ের সঙ্গে ভুখা সংসারে, আমার যখন উপোসী কৈশোর, মা একদিন ম্লান হেসে আমার মাথায় হাত রেখে, স্নেহের ছোঁয়ায় বুঝিয়েছিলেন, কি করবি আর বল? কালিজিরা নদীই আমাদের সংসারের বিপর্যয়ের মূল!
সেদিনও টের পাইনি, মায়ের চোখমুখে একটু বাঁকা হাসির অভিনয় থাকলেও, আমার মাথায় স্নেহের আড়াল দিয়ে, কেন চোখের জল লুকোবার চেষ্টা করেছিল।
কালিজিরা! কালিজিরা!
সেদিন নদীর নামটিকে নিছক রূপকথার মনে হয়েছিল।
পার্টিশনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নাকি প্রাণ হাতে, রাতারাতি এক-কাপড়ে কালিজিরা বেয়েই, কীর্তনখোলায় পড়ে, লুকিয়ে বরশাল শহরে পাড়ি জমাতে হয়েছিল। য়াজ অত গভীর স্মৃতি ভেদ করার ক্ষমতা মরে গেছে। তবে ঐ অতিসুদূর অস্পষ্ট, উইয়ে কাটা দু-চারটে টুকরো খুঁজে পেতে পারি।
একটা স্যাঁতস্যাঁতে, ছায়াছায়া বাসার একতলায় আমরা ঠাসাঠাসি। কীর্তনখোলার তীর। দরজায় দাঁড়ালেই নদী, এবং ওপারটায় দাউদাউ আগুন। শ্মশান। দেশের বুলিতে সরকখোলা।
অতিসুন্দরী, আমার জ্ঞাতিবৌদিটির একটুকরো হাসির ঝিলিক, চোখ বুজলে, সরকখোলার আগুনের মতো চোখে ভাসে। রাস্তার কাকে যেন ত্যাগের হাসি দিয়ে বলছে, আজ আমাদের অরন্ধন!
...গান্ধীজি খুন হয়েছেন যে!
ঐ বউদিটিকে সেদিন খুবই সুন্দরী লাগছিল। কথা বললেই চোখদুটি কেমন ঝলমল করে!
এ-দেশে জ্ঞাতিবন্ধন ছিঁড়ে যে-যার ছিটকে গেলেও, বিচ্ছিন্নতা ও বোধবুদ্ধি জন্মানোর পর মুখটা মনে ভাসলে একটু লজ্জা লজ্জা লাগত ভেতরে। গোপনে কল্পনা করতাম, আমার ওরকমই একজন আসবে হয়তো!
বিচ্ছিন্নতার পর, কৈশোর-যৌবনের সন্ধিজুড়ে একটানা অভাব ও ব্যর্থতার দিনগুলোয়, আমাদের ঝমঝমে এক বৃষ্টির বিকেলে, আমার অবিবাহিতা আঠাশ বছরের দিদি, মা-কে বেআব্রু থ্রেট দিয়ে বলে উঠেছিল, যে-দিকে দুচোখ যায়, চইল্যা যামু!
ছিঃ! ছিঃ! মা দাঁত ঘষে বলেছিল, লজ্জার মাথা খাইছ!
আমার বুঝি শরীর নাই?
ততোধিক চাপা হুঙ্কারে মা, এ সন্তানরে ক্যান আঁতুরঘরে মুখে লবণ দিলাম না!
দিদি দৌড়ে দা-খানা মা-র হাতে দিতে দিতে ফুঁসেছিল, মারো! মারো!
গলাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল ফের, এখন কোপ দিয়া শান্তি পাও!
পরমুহূর্তেই দুজন দুজনকে জড়িয়ে আকুল কান্না! ফোঁপানি। আমি স্তম্ভিত।
কালে খাঁ নামের মুসলমান অনুচরটি আমাদের----বাবার একান্ত অনুগত----ঝুকঝুকে ভোরের কুয়াশায় একদিন আমাদের শৌখিন কাঠের দোতলা বাড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে অশুভ কণ্ঠে ডেকে উঠেছিল, ওঠেন কত্তা! ওঠেন! সব্বোনাশ হইয়া গ্যাছে!
বিপর্যয়ের নাকি শেই শুরু।
বাবার মালিকানায় গড়ে তোলা কন্ট্রোল দোকানটির চাল-চিনি-কাপড়-কেরোসিন বোঝাই দুটি নৌকোর জলসমাধি হয়েছে কালিজিরায়। অন্তর্ঘাত। বাবার তখন হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ। গ্রামের অনেক হিন্দু প্রতিবেশীর ঈর্ষা। উপরন্তু আগের বছর শ্রাবণে কলকাতায় মহাদাঙ্গা ঘটে গেছিল।।
শুনেছি, যুদ্ধের পিরিয়ডে বাবা ছিলেন এ-পারে। বর্ধমান জিলায়। বাঁকুড়াতেও থাকতেন মাঝে মাঝে। দু হাতে অর্থ কামিয়েছিলেন। সিভিল কনট্রাক্টরির কাজ। বর্ধমানের জনৈক জোতদার বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে।
হঠাৎ যুদ্ধ থেমে গেলে , জোতদার বন্ধুটি নাম আজও ভুলিনি, শিবশঙ্কর গড়াই, নাকি পরামর্শ দিয়েছিলেন, মিতা, কি হবে দেশে গিয়ে? এ-পারে থেকে যাও!...জমিজিরেত, পুকুর-বাগান সস্তায় কিনিয়ে দেবখন… বাকি জীবন লপচপিয়ে কেটে যাবে… যা সব খবর আসছে, কালনেমির লঙ্কা ভাগ হবেই!
বাবা হাসতে হাসতে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। মেজাজি মানুষ ছিলেন তো!
মিতা, তোমার এ-দেশে পোস্ত আর বিউলির ডাল খেতে? আমার ছ’পুরুষের ভিটে!... একবার তো দেখে এসছ!
বুঝলুম ভাই!...দেশটা ভাংলে? পার্টিশন হয় যদি, যা শুনছি?
এ-সব বড় হয়ে আমার মায়ের কাছে শোনা। বাবা ফিরে এসে জমির পর জমি, পুকুর, কন্ট্রোল কিনলেন।
এর কিছু পরই শেষ রাতে একদিন ঝুপসি ভোরের কুয়াশায় কালে খাঁ-র কণ্ঠ । সারাদিন ঘরে লুকিয়ে, রাতের অন্ধকারে, কালে খাঁর নির্দেশিত পথে কালিজিরার ঘাটে আসা। কপর্দখীন, এক- কাপড়ে সব কিছু পিছনে ফেলে বাবার প্রাণটুকু রক্ষা করতে কালে খাঁ মরিয়া। ভাগ্যবিপর্যয়ের ছিল ওটাই শুরু।
আজ বার্ধক্যে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাই। মনে পড়ে, সব খুইয়ে এ পারে মাথা গুঁজলেও, বাবার রুক্ষ বেপরোয়া মেজাজে ঘাটতি ছিল না। আমাকে অকারণে শাসন করত। হুকুমের পানটি থেকে একটূ চুন খসলেই কান ধরে একপায়ে রোদে আধঘন্টা। কৈশোরের সামান্য চপলতা দেখলেই হল! ভাঙা কাঠের চ্যাপ্টা ছোট্ট একটি ব্যাট বানিয়ে পাড়ায় আমি গাম্বিল বল দিয়ে ক্রিকেট খেলতাম। আমার প্রিয় খেলা। একদিন শীতের খুব সকালে উঠিয়ে, ঘরের দা খানা তুলে দিয়ে হুকুম দিলেন, নিজের ব্যাট নিজেকেই ফালাফালা করতে হবে। শেষে কাঠগুলো উনুনে গুঁজে দিলেন। আগের রাতে, কিছু জোটাতে পারেনি বলেই নির্জলা উপোস।
শেষে আমার বয়ঃসন্ধিতে, স্বপ্নদোষের ভয় কেটে যাওয়ার পর যখন জ্ঞান হল, দারিদ্র ও ক্ষুধার হাত থেকে সংসার বাঁচাতে উনি অক্ষম, আমি প্রবল জেদে বাবাকে উপেক্ষা করতে শিখলাম। তত বেশি তিনি আমাকে অভিশাপ দিতে থাকলেন। গায়ে হাত কিংবা রোদে দাঁড় করিয়ে রাখার হুকুম দিতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তাঁর প্রতি আমারও কোনো সহানুভূতি ছিল না, উপরন্তু অসমর্থ শরীরে বাবার নখদন্তহীন স্তিমিত গর্জনকে আমি ব্যঙ্গ করতে শিখলাম।
মনে আছে, একবার সংসারের ঘটি-বাটি এটা-ওটা বিক্রিবাট্টার পরও, টানা দুদিন উপবাসে। দিদির ঐ সংসারত্যাগের অবুঝ হুমকির কিছুপর, বাবা একদিন ভিক্ষে করতে নামলেন। যথাযথ ভিক্ষে যাকে বলে। খাড়া দুপুর গড়িয়ে বাড়ি ফিরতে , বাবার ম্লান শুকনো মুখটা দেখেমজা হয়েছিল আমার। কাঁপা কাঁপা হাতে ঝুলিটা তুলে দিতে, মা নাকের আড়ালে শাড়িটা তুলে, থলিটা নিল। তখন উঠে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। মার মুখটা দেখতে চাইনি। পরে, সবাই গোল হয়ে বসলে, বাবাকে শুনিয়ে বলেছিলাম,ভিক্ষের ভাত আমি খাই না। মর! মর তুই! বাবা দুর্বলভাবে রুখে উঠলেও, ভাতের থালা ছেড়ে গেলেন না। দেহের শক্তি , মনের জোর হারিয়ে গেছে। সেদিন আর কি কি বলেছিলাম,এতদিনে কিছু মনে নেই। তবে, পেট ভরে খেয়ে, লুকিয়ে লক্ষ করেছিলাম, বাবা গোপনে কাঁদছেন। দাপুটে, স্বৈরাচারী মানুষের চোখের জল তৃপ্তি এনেছিল।
বাবা বিদায় নেবার আগেই সংসারের দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছিল। তবে অভাব আমার ভেতর যে-দাগ টেনে দিয়েছিল, স্বাচ্ছল্যে বেপরোয়া হতে দেয়নি। মিতব্যয়ী ছিলাম। তবে দরজায় এসে কেউ হাত পাতলে ভিক্ষে দিতে ছুটে যেতাম, বুকটা গুরুগম্ভীর হয়ে যেত। বাবা কিছুটা অথর্ব, কিন্তু স্বমেজাজটুকু শেষদিকে উগ্র হয়েছিল কেবল মায়ের ওপর। মাকে সইতে হত। আমিও জীবনের কোনো গভীর সত্যের কথা ভেবে , বিচারক সাজতে যেতাম না।
বিয়ে করিনি তখনও কল্পনায় তবে, সুন্দরী জ্ঞাতিবৌদির মতো আমার বউ জোটার য়াত্মরতি অনেক আগেই মিলিয়ে গেছল। সাংসারিক বুদ্ধিতে শান পড়ছিল প্রচুর। রাষ্ট্রের কাছে রিফিউজি বনবার অধিকার ফলাতে পোক্ত হয়ে গেছলাম। নতুন কোনো ইতিহাস তৈরি হবে , এই সব সংকল্প ধারালো হয়ে উঠছিল। তবু আচমকা কখনো পশ্চিম আকাশে চোখ গেলে, ডগডগে ঢলন্ত সূর্যটাকে দেখে মুগ্ধ চোখে স্থির থাকতাম। আহাঃ! একটা মোচড় হৃৎপিণ্ডে অনির্বচনীয় হত।
এক ছুটির বিকেলে মায়ের উদ্বিগ্ন মুখ থেকে বাবার রক্ত-পাইখানার খবর এল। স্বাভাবিক উঁকি দিয়ে দেখি, বাবার মুখটা নীচে। মেঝেমুখীন। আগের মতো ভাঙা ঘরে জল পড়ে না। আমি ঝকঝকে, তকতকে করে দিয়েছি। অনিচ্ছাতেই, কারণ মা আমার পেছনে এঁটুলির মতো লেগে থাকত।
অ্যাম্বুলেন্স জুটিয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে কলকাতার বড় একটা হাসপাতালে নিয়ে গেছলাম। সেকালে তখনও নার্সিং হোম গজিয়ে ওঠেনি। সাধারণের জন্য হাসপাতালের সুযোগ মিলতে কথায় কথায় মন্ত্রী-সান্ত্রীদের পাকড়াও করতে হত না, কিংবা দালালরাজ! হাসপাতালে কারও হয়ে রাত কাটানো ছিল যৌবনের ধর্ম।
বাবাকে ভর্তি করিয়ে আমরা ফিরে এলাম। কেউ আমাদের জানায়নি, সেখানে রাতকাটানো প্রয়োজন। পরদিন দুপুরে স্থানীয় থানার একটা কনস্টেবল খবর দিয়ে গেল। গিয়ে দেখি, বেড ফাঁকা। সাদা চাদরে ঢেকে বাবাকে পর্দার ঘেরে শুইয়ে রাখা। উঁচু পেটটা অস্বাভাবিক ফোলা। একজন মাঝবয়সী পেসেন্ট আমাদের বলল, আপনাদের মধ্যে পুটু কে? বললাম, আমি! পেসেন্টটি বলল, মাঝরাতে পুটু! পুটু! বলে খুব নাকি ছটপট করেছিল।
দিদির প্রসঙ্গ তুলব না আর; আত্মগ্লানির হাতুড়ি হৃৎপিণ্ডে আমার ঘা মারতে থাকবে। এইসব ঘটনার দু’দশক পর মা গত হল। কোমরের হাড় ভেঙে দু”দুটি বছর শয্যাগত কাটিয়ে, বেডপ্যান এবং আমার স্ত্রীর সেবাযত্নের ধমক-ধামক শুনে, আয়া রেখে দিলেও বা কী হয়, একদিন সকালে চাক্ষুষ দেখলাম প্রাণবায়ু কীভাবে উড়ে যায়। রেডিওতে তখন ফিরোজা বেগমের পরিচিত একটি নজরুলগীতি বাজছিল। অসুস্থতার শেষ দিকে মার কোনো বিবেচনাবোধ ছিল না। বাড়ির সকলের কাছে হাত পাতত খাওয়ার জন্য। ভেতরে একটা ধিকিধিকি ধারণা জেগে থাকত, তাকে খেতে দেয়া হয়নি। অথচ, ঘনঘন বিছানা ময়লা হোত। মনে আছে, তিন বছরের নাতনিটাকে দেখে হাত পাততে, সে লূডোর ছক্কাটা দিয়েছিল, অমনি মা টপ করে মুখে। ভেবেছিলাম ঐ-ছক্কার কারণেই হয়ত মা মরে যাবে, কিন্তু দিব্যি বেঁচে ছিল। অথচ ফিরোজার গানের সকালে তার মরণে কোনো ইঙ্গিতই ছিল না।
সব কিছুরই জন্মের চেয়ে মৃত্যুর কারণ অধিক অজানা। তা প্রাণবায়ু হোক, কালিজিরায় কোনো কিছুর জলসমাধি, কেবিনেট মিশন, কিংবা ইতিহাসের কোনো সম্ভাবনাময় মৃত্যুর। তা জন্মভিটাও হতে পারে।
আখ্যান ছেড়ে, কালিজিরা শব্দটি উঠে এসে আমার বুকের অতলে সাঁতরাতেই থাকল, ওটি কোনো বাস্তবের নদী ছিল কি না!