সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
২০১৫-এর প্যারিস জলবায়ু চুক্তির পর সারা বিশ্ব নতুন আশায় উদীপ্ত হয়েছিল। দীর্ঘ আলোচনা ও বাগবিতণ্ডার পর সিওপি-২১-এর অধিবেশনে গৃহীত এই চুক্তিতে ২০২০ সাল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের (climate change) প্রতিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এটা ঠিক হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলি অঙ্গীকার করে গড় ভূ-তাপমাত্রার (average global temperature) বৃদ্ধি শিল্পায়নের আগের স্তর থেকে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে বেঁধে রাখা হবে। এটাও ঠিক হয় যদি সম্ভব হয় তাহলে ভূ-তাপমাত্রার বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে বেঁধে রাখা হবে। এই চুক্তি পৃথিবীর মানুষকে উদ্দীপনা জুগিয়ে ছিল। মানুষ ভেবেছিল ভূ-উষ্ণায়নের (global warming) মোকাবিলায় একটা সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া গেল। পৃথিবীর সব প্রান্তের কোটি কোটি মানুষ তাই অন্তর থেকে এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছিল।
তারপর থেকে যত দিন যাচ্ছে ততই মানুষ বুঝতে পারছে ভূ-উষ্ণায়নের মোকাবিলায় চুক্তি করে ভাল ভাল কথা বলা সহজ। কিন্তু তাকে কাজে পরিণত করায় বিস্তর বাধা। ভূ- উষ্ণায়নের দাপটে মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষয়ক্ষতি হতেই থাকছে। একের পর এক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগে (disaster) মানুষের জীবন ছারখার হয়ে যাচ্ছে। শুধু মৃত্যু ও আঘাতজনিত ক্ষয়ক্ষতিই নয়, ক্ষতি হচ্ছে জীবিকার, সম্পদের, পরিবেশের, সভ্যতার ও সংস্কৃতির। ধীরে ধীরে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে পৃথিবীর তাবড় তাবড় রাষ্ট্রনেতারা মুখে যতই জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় প্রতিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলুন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার গালভরা প্রতিশ্রুতি দিন, আসলে সবটাই ফাঁকা, অন্তঃসারশূন্য। জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগে এত কুটিল, নোংরা বিশ্ব রাজনীতি কাজ করছে, এত জটিল রাষ্ট্রীয় ও ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে, যে তার কানাগলি থেকে এরকম উদ্যোগকে বার করে, বসুন্ধরার প্রকৃতি ও পরিবেশকে বাঁচানো বোধহয় অসম্ভব। সিওপি-২১-এর ঐতিহাসিক চুত্তি সম্পাদনের পর প্রতি বছরই সাড়ম্বরে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটা যেন সাংবাৎসরিক একটা উৎসব পালনের মতো হয়ে গেছে। মানুষে জেনে গেছে এখানে এসে বাঘা বাঘা সব রাষ্ট্রনেতারা পরিবেশের জন্য মড়াকান্না কাঁদবেন, গালভরা প্রতিশ্রুতি দেবেন, ‘টেক্সট’ লিখতে দিস্তা দিস্তা কাগজের অপচয় হবে। পরিবেশবাদীরা মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে, পরিবেশের রক্ষার তাগিদে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করবেন। ‘টেক্সট’ লিখতে কতরকম ভাষার শৈলী, কতরকম প্যাঁচ-পয়জার ঘটানো যায়, তার প্রতিযোগিতা চলবে। এভাবে অধিবেশনের শেষে প্রচুর দড়ি টানাটানি করে কথার ফুলঝুরি ভরা ‘টেক্সট’ প্রকাশিত হবে। তারপর যে কে সেই। একটা অধিবেশন শেষ করে, আর একটা অধিবেশনের অপেক্ষা চলবে বছরভর ধরে।
সিওপি-২১-এর পর থেকে আরও পাঁচটি বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হয়েছে বিগত ছয় বছরে। কিন্তু প্রাপ্তির ছবিটার খুব বড় রকম হেরফের ঘটে নি। এই আনুষ্ঠানিকতার ধারা বজায় রেখেই এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের আসর বসেছিল মিশরের শর্ম এল-শেখ (Sharm El-Sheikh) শহরে ৬-১৮ নভেম্বর, ২০২২-এর দুটো সপ্তাহ জুড়ে। দেখা গেল নির্দিষ্ট সময়ে অধিবেশন শেষ করা যাচ্ছে না। দুদিন বাড়াতে হল অধিবেশনের মেয়াদ। এতও করেও প্রত্যাশা যা ছিল, তার কিছুটা পূরণ হল। বেশীটাই অধরা বা না-পাওয়া থেকে গেল। তবে যা পাওয়া গেল, তা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের শিকার হচ্ছে এমন গরীব রাষ্ট্রগুলোর জন্য কিছু প্রাপ্তির আশার সঞ্চার করল বৈকি। এই পটভূমিতেই এই নিবন্ধের রচনা। আলোচনার বিস্তারে যাওয়ার আগে গোড়ার কথাগুলো একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।
গোড়ার কথা
চিন্তাভাবনা শূন্য বেলাগাম উন্নয়নের পথে ছুটতে গিয়ে পৃথিবীর যে ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, এটা গত শতকে মানুষ বেশ ভালই টের পেয়েছিল। বল্গাহীন গতিতে জীবাশ্ম জ্বালানীর (fossil fuel) ব্যবহারের ফলে পরিবেশে গ্রীণহাউস গ্যাসের (greenhouse gas) নিঃসরণ (emission) বহুগুণে বাড়ছিল। এর সাথে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নির্বিচারে বনজঙ্গল ধ্বংস করায় ও নদী এবং ভূগর্ভস্থ জলসম্পদের বেহিসাবি খরচ করায় পরিবেশের ভীষণ ক্ষতি হচ্ছিল। পৃথিবীতে বাড়ছিল অতিবৃষ্টি, বন্যা, ভূমিধস, অনাবৃষ্টি, খরা, সমুদ্রঝড় প্রভৃতির মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনা (extreme weather events)। ভূ-উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের জলস্তরের বৃদ্ধি ঘটছিল। সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চল ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলির অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছিল। বাদাবন ধ্বংসের, অবলুপ্তির মুখোমুখি হচ্ছিল। পৃথিবীর শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, পরিবেশ কর্মী, মানবাধিকার কর্মী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রনায়কেরা, বিশেষত বিপন্ন দেশগুলোর রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনেতারা ভাবছিল কিছু একটা করা দরকার। শিল্পোন্নত ধনী রাষ্ট্রগুলি (industrialized rich countries) ২০০ বছর ধরে জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়িয়েছে, নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করেছে। আর তার খেসারত গুণতে হচ্ছে শিল্পে পেছিয়ে থাকা উন্নয়নশীল গরীব দেশগুলোকে। এইসব মানুষদের চাপে ১৯৯২ সালের জুন মাসে (3 to 14 June, 1992) ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরোতে (Rio de Janerio) রাষ্ট্রপুঞ্জের (United Nations) উদ্যোগে পরিবেশের ও উন্নয়নের এক বিশ্ব সম্মেলন (United Nations Conference on Environment and Development, বা সংক্ষেপে UNCED) অনুষ্ঠিত হয়। এর চলতি নাম ধরিত্রী সম্মেলন (Earth Summit)। এই সভায় ১৫২ টি দেশের স্বাক্ষরিত এক আন্তর্জাতিক চুক্তি তৈরী হয়। এই চুক্তির পোশাকী নাম United Nations Framework Convention on Climate Change বা সংক্ষেপে UNFCCC বা FCCC. এফসিসিসি-এর উদ্দেশ্য ছিল বাতাসে গ্রীণহাউস গ্যাসের পরিমাণকে এমন এক স্থিতিশীল মাত্রায় নিয়ে আসা, যাতে আবাহাওয়া ব্যবস্থায় মনুষ্যসৃষ্ট ক্রিয়াকলাপ যে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তাকে রোধ করা যায়। জলবায়ু নিয়ে গবেষণা, নিয়মিত মিটিং, আলোচনা, ভবিষ্যৎ নীতি প্রণয়ন প্রভৃতির সংস্থান রাখা হয় এই চুক্তিতে। এসবের উদ্দেশ্য ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে (ecosystem) মানিয়ে নিতে (adaptation) সহায়তা করা, খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া যাতে কোন ভাবে বিঘ্নিত না হয় তা নিশ্চিত করা, অর্থনীতি যাতে সুস্থিতভাবে (in a sustainable manner) বিকশিত হয় তার ব্যবস্থা করা। এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর অবশ্য চুক্তি মেনে চলার কোন আইনী বাধ্যবাধকতা ছিল না। এই চুক্তি গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণের কোন উর্ধসীমা দেশগুলোকে মানতে হবে এমন কথা বলে নি। এই মেনে চলার ব্যাপারটা লাগু করার কোন সংস্থানও তৈরী করে নি। চুক্তিতে স্থির হয় দেশগুলো নিজেদের জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্য (emission inventories) এফসিসিসি-কে জানাবে।
এটা কিন্তু কোন মতেই খুব নগণ্য একটা কাজ ছিল না। সদস্য দেশগুলোর নিঃসরণ সংক্রান্ত তথ্য এফসিসিসি-এর হাতে এলে, কোন দেশ কতটা নিঃসরণ ঘটাচ্ছে তা জানা যাবে। আর এর ভিত্তিতেই হয়ত ভবিষ্যতে দেশগুলোর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নিঃসরণের মাত্রা নির্ধারণ করা যাবে। তাই ব্রাজিলের ধরিত্রী সম্মেলন নিঃসরণে রাশ টেনে ভূ-উষ্ণায়ন কমানো ও পরিবেশকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে প্রথম কিছু সদর্থক পদক্ষেপ করেছিল বৈকি।
এফসিসিসি-এর চূড়ান্ত নির্ণায়ক পরিষদ হল Conference of Parties বা COP (সিওপি)। ১৯৯৪ সালের ২১ মার্চ সিওপি কার্যভার গ্রহণ করে। যে দেশগুলি কনভেনশনের সদস্য বা Parties তারা সকলেই সিওপি-তে অন্তর্ভুক্ত হয়। সিওপি-র কাজ হল কনভেনশনের লক্ষ্যগুলোর বাস্তবায়ন করা। এই লক্ষ্যগুলোর প্রয়োগের বিষয়ে পর্যালোচনা করা এবং সেই সংক্রান্ত আইনী দিকগুলো খুঁটিয়ে দেখে বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। সদস্য দেশগুলো তাদের নিজেদের নিঃসরণের যে তথ্য পরিষদে পেশ করে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করা ও দেশগুলোর সাথে এ নিয়ে চিঠিচাপাটির (communications) চালচালি করাও পরিষদের কাজের মধ্যে পড়ে। এইসবের মধ্য দিয়ে কনভেনশনের মূল লক্ষ্যগুলোর পূরণে কি অগ্রগতি ঘটছে তার নিরন্তর মূল্যায়ন করে পরিষদ।
এবারের সম্মেলনটি নিয়ে পৃথিবীতে এযাবৎ সাতাশটি সিওপি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিওপি-র সেক্রেটারিয়েট প্রথমে জেনেভাতে হলেও, পরে ১৯৯৬ সালে জার্মানির বন (Boon) শহরে স্থানান্তরিত হয়। সিওপি-র সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য একটি ব্যুরো (Bureau) রয়েছে। একজন সভাপতি (President), সাতজন সহ-সভাপতি (Vice President), বিভিন্ন উপ-সমিতিগুলোর প্রধানরা (Heads of Subsidiary Bodies) এবং একজন প্রতিবেদক (Rapporteur) – এই নিয়ে ব্যুরো গঠিত। রাষ্ট্রপুঞ্জের পাঁচটি স্বীকৃত অঞ্চল যথা, আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারেবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম ইউরোপ ও অন্যত্র, এদের দেশগুলোর মধ্যে ঘুরেফিরে সভাপতিত্বের (Presidency) দায়িত্ব বর্তায়। সিওপি-র সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্সির প্রভাব (বা কুপ্রভাব) যে কতটা, তা বিশেষ করে এবারের সম্মেলনে মানুষ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে। সে কথায় পরে আসব।
কি হল এত সম্মেলনের শেষে?
এবারে সিওপি বা বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনায় আসার আগে আগের সম্মেলনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো একবার খতিয়ে দেখে নেওয়া যাক। এই লেখকের আগের একটি লেখায় ২০১৭ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ২৩ টি সিওপি-র সংক্ষিপ্ত আলোচনা আছে। উৎসাহী পাঠক তা একবার দেখে নিতে পারেন। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের প্রথম অতি গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনটি (সিওপি ৩) হয় জাপানের কিয়োটো শহরে, ১৯৯৭-এর ডিসেম্বরে। সভায় এই প্রথম গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের ব্যাপারে দেশগুলি একমত হয় এবং একটি অঙ্গীকার করে। এই অঙ্গীকার ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ নামেখ্যাত। ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ কনভেনশনের নীতি এবং সংস্থানের (principles and provisions) ভিত্তিতে তৈরী এবং কনভেনশনের লক্ষ্যগুলি কাজে রূপান্তরিত করাই (operationalization) প্রোটোকলের উদ্দেশ্য। প্রোটোকল শিল্পোন্নত দেশগুলোকে গ্রীণহাউস গ্যাস বা জিএইচজি (greenhouse gas or GHG) নিঃসরণ হ্রাসের ক্ষেত্রে তাদের নিজেদেরই স্থির-করা লক্ষ্যমাত্রা (target) পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ করায়। এই অঙ্গীকারের ভিত্তি হল এই যে বর্তমানের অত্যন্ত বেশী পরিমাণে জিএইচজি নিঃসরণের জন্য দায়ী প্রধানত শিল্পোন্নত দেশগুলো এবং তার দায় তাদেরই নিতে হবে (…… the Protocol ‘only binds developed countries, and places a haviour burden on them under the principle of “common but differentiated responsibilities and respective capabilities”, because it recognizes that they are largely responsible for the current high levels of GHG emissions in the atmosphere’)। এই প্রোটোকলের গঠন (structure) সংযুক্তি-মূলক (annexure based)। এই প্রোটোকলে প্রস্তাবিত অঙ্গীকারে দেশগুলো যে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি (ratification) দেয় তার প্রক্রিয়া বড় জটিল। এই জন্য ১৯৯৭-এর ১১ জানুয়ারিতে এই প্রোটোকল গৃহীত হলেও, এটা কার্যে পরিণত হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫-এ। এখনও পর্যন্ত ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-এ সম্মত পার্টির সংখ্যা ১৯২। প্রোটোকলের অ্যানেক্সার – বি (Annexure-B) -তে, শিল্পোন্নত দেশ, রুপান্তারশীল অর্থনীতির দেশ (Economies in Transition or EIT) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) মিলিয়ে ৩৭ টি দেশের জন্য নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা (emission reduction target) নির্ধারিত হয় । মোটের উপর ১৯৯০ সালে নিঃসরণের যে মাত্রা ছিল, গড়ে তার প্রায় ৫% নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয় ২০০৮ থেকে ২০১২ সময়কালের (first commitment period) জন্য (সারণী -১)।
‘কিয়োটো প্রোটোকল’ সদস্য দেশগুলোকে অ্যানেক্সার ১ (Annexure 1) এবং নন-অ্যানেক্সার-১ (Non-Annexure 1) পার্টিস (parties) – এই দুইভাগে বিভক্ত করে। অ্যানেক্সার – বি -এর অধীন যেসব দেশ প্রোটোকলে প্রস্তাবিত অঙ্গীকারে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি (ratification) দেয় এবং আইনগত ভাবে নির্ধারিত নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা মেনে চলতে বাধ্য থাকে, তারাই অ্যানেক্সার ১-এ অন্তর্ভুক্ত হয়। পক্ষান্তরে, নন-অ্যানেক্সার-১ পার্টিস হল মূলত উন্নয়নশীল দেশসমূহ। তাদের জন্য নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কোন আইনী বাধ্যবাধকতা রাখা হয় না। তাদের জন্য কেবল নিঃসরণের তথ্য রিপোর্ট করলেই চলবে, এমনটা ঠিক হয়। এই ভাগাভাগি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা ভারত ও চীনের মতো দেশগুলো উন্নয়নশীল বলে, নন-অ্যানেক্সার-১ (Non-Annexure 1) পার্টিসের দলভুক্ত হয়। যদিও তারা বিশ্বের সর্বোচ্চ জিওজি নিঃসরণের দেশগুলোর অন্যতম। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ভারত ২০২০ সালে CO2 নিঃসরণের (আয়তনের ভিত্তিতে) নিরিখে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। যদিও জনপিছু নিঃসরণ ধরলে ভারত বিশ্বের গড় নিঃসরণের এক তৃতীয়াংশেরও কম নিঃসরণ সৃষ্টি করে। শিল্পায়ন পরবর্তী কালে অর্থাৎ ১৮৫০ থেকে ১৯৯০ এই সময়ের মধ্যে ভারতের মোট নিঃসরণ (cumulative emission) সম সময়ের বিশ্বের নিঃসরণের মাত্র ৩%; আমেরিকা ও ইইউ-এর ক্ষেত্রে এই নিঃসরণের মান যথাক্রমে ২৫ ও ১৭%। শক্তির জন্য ভারতকে অধিকমাত্রায় কয়লার উপর নির্ভর করতে হয়। পশ্চিমী ধনী দেশগুলো কম নিঃসরণের জ্বালানী বলে তেল ও গ্যাসকে ছাড় দিয়ে এই কঠিন জীবাশ্ম জ্বালানীকেই নিঃসরণের জন্য প্রধান অপরাধী হিসাবে দাগিয়ে দিতে বহুদিন ধরেই চেষ্টা করে আসছিল। কিয়োটো সভার পরে ভারত ক্রমাগত এর তীব্র প্রতিবাদ করে এবং মূলত ভারতের চাপেই কয়লার সাথে তেল ও গ্যাসকেও নিঃসরণের জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানী বলে স্বীকার করে নিয়েই পরবর্তী কালে আলোচনা চালাতে হয়। সে যাই হোক, এই ভাগাভাগির ব্যাপারটা আমেরিকা মোটেই ভালোভাবে নেয় নি। এবং মূলত এই কারণেই আমেরিকা ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ -এর অঙ্গীকারে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে অসম্মতি জানায়। এই বিষয়টাই ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-এর সময়সীমা (২০১২) উত্তীর্ণ হওয়ার পর এই চুক্তির কি পরিণতি হবে, তা নিয়ে গভীর বিতর্কের সূত্রপাত করে।
কিয়োটোর সভায় ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ ছাড়াও আরও একগুচ্ছ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। এরা ‘কিয়োটো মেকানিজম’ নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে জিএইচজি নিঃসরণ কেনাবেচা (emission trading), স্বচ্ছ উন্নয়ন মেকানিজম (clean development mechanism), যৌথ রুপায়ণ, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নিঃসরণ কেনাবেচার ব্যবস্থা থেকেই এক নতুন মুদ্রা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। এই মুদ্রার নাম ‘কার্বন মুদ্রা’ (carbon credit)। কার্বন মুদ্রার একক হল এক টন কার্বন। কোন দেশ যদি এক মিলিয়ন (দশ লক্ষ) একক কার্বন মুদ্রার অধিকারী হয়, তাহলে সেই দেশ এক মিলিয়ন টন কার্বন (CO2 হিসাবে) বাতাসে ছাড়তে পারবে। তেমনি কোন দেশ যদি এক মিলিয়ন একক কার্বন ঋণী হয়, তবে সেই দেশকে এক মিলিয়ন টন কার্বন (CO2 হিসাবে) বাতাস থেকে সরাবার বা শুষে নেওয়ার (carbon sequestration) বন্দোবস্ত করতে হবে। বাতাস থেকে কার্বন সরাবার বা শুষে নেওয়ার প্রযুক্তি অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়বহুল। উন্নয়নশীল এবং গরীব দেশগুলো এই অত্যাধুনিক ব্যয়বহুল প্রযুক্তি কোথায় পাবে? বিকল্প ব্যবস্থার তাই সংস্থান রাখা হয়। ঠিক হয় কার্বন ঋণী দেশগুলোর কাছে এই প্রযুক্তি না থাকলে, তারা ডলারের মূল্যে কার্বন মুদ্রা অন্য দেশ থেকে কিনতে পারবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে এই ব্যবস্থা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। কিয়োটোর পরবর্তী বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (সিওপি-৬; ১৩-২৫ নভেম্বর, ২০০০, দ্য হেগ, নেদারল্যান্ড) এই নিয়ে আকচাআকচি ন্যাক্কারজনক পর্যায়ে চলে যায়। আমেরিকা তার বনভূমি ও কৃষিক্ষেত্রের জন্য কার্বন মুদ্রা দাবি করে। এবং এই অর্জিত কার্বন মুদ্রার বিনিময়েই সে জিএইচজি হ্রাসের প্রতিশ্রুতি পালনের দাবি করে। তার এই অন্যায্য দাবি ইইউ ও অন্যরা মেনে নেয় নি। ফলশ্রুতিতে আমেরিকা ২০০১ সালে ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ মানার ব্যাপারে তার অসম্মতি জানায়। তবে এ সত্ত্বেও আমেরিকা প্রতিনিধি না হয়ে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করবে বলে সম্মত হয়। ধনী দেশগুলোর চাপে পরের সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টাকাপয়সা দিয়ে সহায়তা দেবে, যাতে তারা কার্বন মুদ্রা ক্রয়ের মাধ্যমে নিঃসরণ হ্রাসের অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারে। আর, ধনী দেশগুলো এই টাকাপয়সা দেওয়ার বিনিময়ে তাদের নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে ছাড় পেয়ে যাবে। আরও ঠিক হয় কার্বন মুদ্রার কেনাবেচার কোন সর্বোচ্চ সীমা থাকবে না। এইসব ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয়, যাতে শিল্পন্নোত ধনী দেশগুলোর নিঃসরণ ছড়ানো বজায় থাকবে। আর উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের অর্থনীতিকে উন্নত করার জন্য নিঃসরণ ছড়ালে তাদের ডলারের মূল্যে তার দায় চোকাতে হবে। কালক্রমে ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ লাগু হওয়ার প্রথম সময়সীমা (first commitment period; 2008-2012) এসে যায়। ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-এর চুক্তিমত নিঃসরণ কমাতে অ্যানেক্সার-১-ভুক্ত বহুদেশই রাজী হয় নি। অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগার ভয়ে ও প্রতিযোগিতা (competition) হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কায় বহুদেশই আলোচনায় নিঃসরণ কমানোর প্রসঙ্গ সতর্কভাবে এড়িয়ে চলে। রাজনৈতিক স্বার্থ ও বৈজ্ঞানিক প্রয়োজনের মধ্যে চূড়ান্ত ফারাক (disconnect between political processes and scientific imperative) লক্ষ্য করা যায়।
এইভাবেই নানা দোটানার মধ্যে দিয়ে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন এগুতে থাকে। এরই মধ্যে সিওপি-১৮-এর সভায় (সিওপি-১৮, ২৬ নভেম্বর-০৭ ডিসেম্বর, ২০১২, দোহা, কাতার) ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-এর সংশোধনী গৃহীত হয়। ঠিক হয়, ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ ২০১২’র পরও ২০২০ পর্যন্ত চালু থাকবে। এই সভার আর একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই সভাই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল সম্বন্ধীয় ভাষ্যের চূড়ান্ত রূপ দেয়। গরীব রাষ্ট্রগুলো দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিল, ভূ-উষ্ণায়নের ফলে সংঘটিত চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলির (বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ, দুর্ভিক্ষ, সমুদ্র ঝড় প্রভৃতি) তারই বারংবার শিকার হচ্ছে। অথচ, ভূ-উষ্ণায়ন ঘটার পিছনে নিঃসরণ ছড়ানোয় তাদের ভূমিকা অতি সামান্য। প্রায় দু শতকেরও বেশী সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে নিঃসরণ ছড়িয়ে ধনী ও উন্নত রাষ্ট্রগুলো ভূ-উষ্ণায়ন ঘটিয়েছে। তাই তার দায়ও তাদেরই নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল ও গরীব রাষ্ট্রগুলোকে তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। এটাই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিলের ধারণা। দোহার সভায় একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, নিঃসরণ হ্রাসের সংশোধনীটি আটকেই থাকে।
এরপর বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলার ব্যাপারে খুব বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয় সিওপি-২১-এর সভায় (সিওপি-২১, ৩০ নভেম্বর-১২ ডিসেম্বর, ২০১৫, প্যারিস, ফ্রান্স)। এই সভায় ২০২০ সাল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া হবে, এই মর্মে এক চুক্তি হয়। এই চুক্তি প্যারিস চুক্তি নামে খ্যাত। ‘ডারবান প্ল্যাটফর্ম’-এর (সিওপি -১৭, ২৮ নভেম্বর-০৯ ডিসেম্বর, ২০১১, ডারবান, দক্ষিণ আফ্রিকা) ভিত্তিতে যে কাজকর্মের সূচনা হয়েছিল, প্যারিস চুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। চুক্তিতে ভূ-উষ্ণায়ন নিয়ে এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। চুক্তিবদ্ধ দেশগুলো অঙ্গীকার করে ভূ-তাপমাত্রার বৃদ্ধি শিল্পায়নের পূর্ববর্তী পর্যায়ের থেকে ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে রাখা হবে। এটাও ঠিক হয় যদি সম্ভব হয়, ভূ-তাপমাত্রার বৃদ্ধি বেঁধে রাখার লক্ষ্য হবে ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। দেশগুলো আরও অঙ্গীকার করে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তহবিল (green climate fund) এবং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার অর্থ বা ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল (loss and damage fund) দুটো আলাদা বিষয় হিসাবে ধরা হবে।
প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সারা বিশ্বের মানুষ আশা করেছিল জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় একটা সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া গেছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ কিন্তু সমানেই চলছে। আর এরই আবহে বিশ্বের বিপন্ন মানুষ খুঁজে চলেছে পরিত্রাণের উপায়। এরই মাঝে বড় বড় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ঘটনা ঘটছে। ঘটেছে কভিড অতিমারির মতো ঘটনা। তার ফলে সংঘটিত দীর্ঘ লকডাউনের মতো ঘটনা বিশ্বের অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে মানুষের জীবন, জীবিকা, সম্পদের। এ সম্পদ তার শারীরিক, মানসিক ও বৌদ্ধিক সম্পদ। ইউরোপে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলেছে। মধ্য এশিয়ায় সংঘর্ষ অব্যাহত। জ্বালানীর দাম বেড়েছে হু হু করে। এ সবেরই প্রভাব পড়ছে জলবায়ুর উপর। এতসবের মাঝেও চেষ্টাও চলেছে নিরলস এই সবুজ গ্রহটিকে কি করে ভূ-উষ্ণায়নের মতো সাংঘাতিক সংকট থেকে বাঁচানো যায়। সেই চেষ্টায় অগণিত মানুষ সামিল হয়েছেন। তাদের অনেকেই সরকারী প্রতিনিধি নন। আবার অনেক মানুষ চেষ্টা করছেন যাতে সব ভাল চেষ্টা বানচাল করে দেওয়া যায়। প্রাধান্য পায় রাষ্ট্র ও কর্পোরেট স্বার্থ। এই সদিচ্ছা ও অনিচ্ছার লড়াই, স্বার্থ ও নিঃস্বার্থের সংঘাত এবং সর্বোপরি ধনী ও দরিদ্রের সংগ্রামে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের প্রতিটি অধিবেশনই কমবেশী বিশিষ্ট হয়ে থাকে। এবারের সম্মেলনেও এই ধারার কোন ব্যতিক্রম হয় নি। তবুও মাঝে মধ্যে কোন কোন বিশ্ব জলবায়ু সভা যেমন ঐতিহাসিক কিছু পদক্ষেপের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে, এবারের সভাও তেমনি মানুষের মনে হয়ত এক নতুন আশার উদ্রেককারী হিসাবে দাগ কেটে যাবে, যে দাগ মিলিয়ে যাবে না কোনদিন। অন্তত যতদিন মানুষের সভ্যতা বেঁচে থাকবে,ততদিন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ছোবল চলছেই
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট চরম আবহাওয়ার ঘটনার কিন্তু বিরাম নেই। এবছরেই পাকিস্তানে ভয়ঙ্কর বন্যা হয়েছে। সে দেশের এক তৃতীয়াংশ বন্যা প্লাবিত হয়। মৃতের সংখ্যা ১৭৩৯, আহত হয়েছেন ১২,৮৬৭ জন। আমেরিকাতে এযাবৎ ঘটা সবচেয়ে ক্ষতিকারক তিনটি সমুদ্র ঝড়ের (hurricane) একটি হয়েছে এবারে। এবারেই আফ্রিকা দেখেছে খরা-জনিত ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ (famine)। ইউরোপ ও চীন প্রত্যক্ষ করেছে ভয়াবহ খরা (draughts)। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র প্রভাব পড়েছে অসহনীয় তাপপ্রভাবের (heat waves)। এ বছরই ইউরোপ প্রত্যক্ষ করেছে প্রায় ৫০০ বছরের মধ্যে উষ্ণতম গ্রীষ্ম (hottest summer)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ইউরোপে তাপপ্রবাহের কারণে মৃতের সংখ্যা ১৫,০০০।
বার্লিনের উন্নয়ন ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা, জার্মানওয়াচ (Germanwatch), ফি বছর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট চরম আবহাওয়ার ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ন করে একটি রিপোর্ট বের করে। কোন দেশের বা কোন অঞ্চলের কতটা ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তা বোঝানোর জন্য সংস্থাটি একটি ইনডেক্সিং ব্যবস্থা চালু করেছে। এই ব্যবস্থার নাম ‘বিশ্ব আবহাওয়ার ঝুঁকির অঙ্ক’ বা ‘Global Climate Risk Index (GCRI)’। সংস্থাটির শেষ প্রতিবেদনটি বের হয় ২০২১ সালে যার নাম Global Climate Risk Index -2021. ‘আবহাওয়ার ঝুঁকির অঙ্ক’ (Climate Risk Index বা CRI) দিয়ে চরম আবহাওয়ার ঘটনার প্রভাবকে পরিমাণগতভাবে বিশ্লেষণ (quantitative analysis) করা হয়। এই প্রভাবের মধ্যে জীবনহানি (fatalities) ও আর্থিক ক্ষতি (economic loss), দুইই বিবেচিত হয়। এই বিবেচনার আওতায় আনা হয় – (১) জলবায়ু জনিত ঘটনা বা weather-related events (ঝঞ্ঝা (strom), চরম তাপমাত্রা (temperature extremes), তাপপ্রবাহ (heat wave) এবং শৈত প্রবাহ (cold wave), ইত্যাদি), (২) জীবনহানি (number of deaths), (৩) বীমাকৃত ক্ষতি (insured damages) এবং (৪) মোট আর্থিক ক্ষতি (total economic damages)।
কোন দেশের সিআরআই (CRI) নির্ণয় করার জন্য চারটি প্যারামিটার হিসাব করা হয়। প্রতিটি প্যারামিটার আবার স্থান-নির্ভর (rank based), অর্থাৎ, ঐ বিশেষ প্যারামিটারের ক্ষেত্রে ঐ দেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে কততম স্থানে (rank) রয়েছে সেই সংখ্যা। প্রতিটি প্যারামিটারের জন্য একটি মূল্যমান (weightage) নির্ধারণ করা হয়।
জীবনহানি বা মৃত্যুর ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ঘটনায় মৃতের সংখ্যার নিরিখে ঐ বিশেষ দেশ কত তম স্থানে আছে (rank) সেই সংখ্যা হল একটি প্যারামিটার (পি১) যার weightage হল ১/৬; প্রতি ১ লক্ষ জনসংখ্যায় মৃত্যুর নিরিখে ঐ বিশেষ দেশ কত তম স্থানে আছে (rank) সেই সংখ্যা হল দ্বিতীয় একটি প্যারামিটার (পি২) যার weightage হল ১/৩; আর্থিক ক্ষতির ক্ষেত্রে ক্রয় ক্ষমতার সমতা বা Purchasing Power Parity (PPP)-এর ক্ষতির নিরিখে ঐ বিশেষ দেশ কত তম স্থানে আছে (rank) সেই সংখ্যা হল তৃতীয় একটি প্যারামিটার (পি৩) যার weightage হল ১/৬; আবার জিডিপি-এর ক্ষতির ক্ষেত্রে প্রতি একক জিডিপি-তে (per unit Gross Domestic Product বা per unit GDP) ক্ষতির নিরিখে ঐ বিশেষ দেশ কত তম স্থানে আছে (rank) সেই সংখ্যা হল চতুর্থ একটি প্যারামিটার (পি৪) যার weightage হল ১/৩;
এখন, দেশটির সিআরআই (CRI) = পি১ × ১/৬ + পি২ × ১/৩ + পি৩ × ১/৬ + পি৪ × ১/৩
যেমন, ২০০০-২০১৯ এই সময়কালে বাংলাদেশ চরম আবহাওয়ার কারণে বার্ষিক মৃত্যুর নিরিখে পৃথিবীতে নবম স্থানে (9th) রয়েছে। প্রতি এক লাখে মৃত্যুর নিরিখে পৃথিবীতে সাইত্রিশতম (37th) স্থানে রয়েছে। ক্রয় ক্ষমতার সমতার ক্ষতির নিরিখে তেরতম (13th) স্থানে রয়েছে। আবার প্রতি একক জিডিপি-তে ক্ষতির নিরিখে সাইত্রিশতম (37th) স্থানে রয়েছে। তাই,
বাংলাদেশের সিআরআই (CRI) = ৯ × ১/৬ + ৩৭ × ১/৩ + ১৩ × ১/৬ + ৩৭ × ১/৩ = ২৮.৩৩
কোন দেশের সিআরআই যত কম হয়, তত বেশীমাত্রায় সে দেশটি যে চরম আবহাওয়ার কারণে দুর্যোগপীড়িত হয়েছে তা বোঝা যায়। ২০১৯ সালে চরম আবহাওয়া জনিত কারণে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দেশের আলোচনা করলে এটা বোঝা যাবে। বোঝা যাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিরন্তর কেমন করে ছোবল মেরে চলেছে। এই ১০ টি দেশের ৫টি আফ্রিকার (মোজাম্বিক (সিআরাই স্কোর=২.৬৭), মালাভি (সিআরাই স্কোর=১৫.১৭), জিম্বাবুয়ে (সিআরাই স্কোর = ৬.১৭), নাইজার (সিআরাই স্কোর=১৮.১৭) ও দক্ষিণ সুদান (সিআরাই স্কোর=১৭.৩৩)), ৩ টি এশিয়ার (আফগানিস্তান (সিআরাই স্কোর=১৬.০০), জাপান (সিআরাই স্কোর=১৪.৫০) ও ভারত (সিআরাই স্কোর=১৬.৬৭)), ১টি দক্ষিণ আমেরিকার (বলিভিয়া (সিআরাই স্কোর=১৯.৬৭)) এবং ১টি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে (দ্য বাহামাস (সিআরাই স্কোর=৬.৫০))। ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি ঝড় ইডাই (Idai) ২০১৯-এর মার্চে মাদাগাসকার (Madagascar), মোজাম্বিক (Mozambique), মালাভি (Malawi) এবং জিম্বাবুয়ে (Zimbabwe)-য় সাংঘাতিক বন্যা ঘটায়। দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট এই ঘূর্ণিঝড়েকে আফ্রিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষতিকর চরম আবহাওয়ার ঘটনা বলে মনে করা হয়। প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েন। প্রচণ্ড বৃষ্টি ও সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৯৫ কিমি বেগে বইতে থাকা ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে বন্যা ও ভূমিধসে প্রায় ১৬০০ মানুষের মৃত্যু হয় এবং প্রায় ২.২ মিলিয়ন ডলার মূল্যের আর্থিক ক্ষতি হয়।
ইডাই-এর দেঢ় মাস পর আর একটি ঘূর্ণিঝড়, কেনিথ (Kenneth), আছড়ে পড়ে উত্তর মোজাম্বিকে। এটিকে আফ্রিকার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বলা হয়, বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২২০ কিমি। ২৫ লক্ষ মানুষ বন্যাক্রান্ত হন, ২ লক্ষ বাড়ী ঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন ডলার, যা মোজাম্বিকের জাতীয় বাজেটের প্রায় অর্ধেক। ২০১৯-এর জুন থেকে বছরের শেষাবধি অতিবৃষ্টির কারণে দক্ষিণ সুদানে সাংঘাতিক বন্যা হয়। ৯ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হন, ৭৪০০০ হেক্টর কৃষিজমি জলমগ্ন হয়ে পড়ে। নষ্ট হয় প্রায় ৭০০০০ মেট্রিক টন খেতের ফসল। অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা হয় আফ্রিকার আর একটি দেশ নাইজারে। ২ লক্ষের বেশী মানুষ আক্রান্ত হন, ১৬০০০ বাড়ীঘর বিনষ্ট হয়। মৃত্যু হয় ৫৭ জনের।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপানে ২০১৯-এর অক্টোবরে ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী টাইফুন, হাগিবিস (Hagibis), আছড়ে পড়ে। এর দাপটে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিমি। ৭২ ঘণ্টা ধরে একনাগাড়ে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৭৫০-১০০০ মিমি, যা জাপানের গড় বৃষ্টিপাতের ৫০-৭০% বেশী। ১০০ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ২৩০ জন। ১৩০০ বাড়ীঘর ধ্বংস হয়। পরের মাসে আবার একটা টাইফুন, ফাসাই (Faxai)-এর কবলে পড়ে জাপান। এই দুই টাইফুনে সে দেশের মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার। এরপরই বলতে হয় ভারতের কথা। ভারতে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বর্ষা সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ২০১৯-এ বর্ষা সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। স্বাভাবিকের ১১০% বৃষ্টিপাত হয়। এই অতিবৃষ্টির কারণে ১৪ টি রাজ্য জুড়ে হওয়া বন্যায় ১৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়। ১ কোটি ১৮ লক্ষ মানুষ বন্যা কবলিত হন। ১৮ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। এশিয়ার আর একটি দেশ আফগানিস্তানও পুরো ২০১৯ জুড়েই কয়েক দফা বন্যা ও ভূমিধ্বসের মোকাবিলা করে। এর মধ্যে মার্চের বন্যা ছিল অতি প্রবল। ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত হন। ১২০০০ ঘরবাড়ী বিনষ্ট হয়। ১৫০ জন মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়াও আছে জানুয়ারি ও ডিসেম্বরের ভূমিধসের ঘটনা। এতে প্রাণ হারান আরও ৩৫ জন।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়ায় সাঙ্ঘাতিক দাবানল (forest fire) দেখা যায় ২০১৯-এ। এর ফলে ২ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি ও ঘাসজমি (grass land) পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। জীববৈচিত্র্যের (bio-diversity) যে ক্ষতিসাধন হয় তা পূরণ হতে ৩০০ বছরেরও বেশী সময় লেগে যাবে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে। এছাড়াও বলিভিয়া গোটা ২০১৯ ধরেই নাগাড়ে বৃষ্টি ও তার ফলে বন্যার প্রকোপের মোকাবিলা করে। ৩৪ জন মানুষ প্রাণ হারান। ২৩০০ পরিবার গৃহচ্যুত হন।
ক্যারেবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশ বাহমাস এই দ্বীপরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যারিকেন ডোরিয়ান (Dorian)-এর দাপট প্রত্যক্ষ করে ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৩০০ কিমি। কয়েক ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৯১০ মিমি, যা ছিল দেশটির গড় বৃষ্টিপাতের প্রায় ৮০%। ৭৪ জন মানুষ প্রাণ হারান, ১৩০০০ ঘরবাড়ী বিনষ্ট হয়। সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩.৪ বিলিয়ন ডলার।
এই তথ্য শুধু ২০১৯-এর, আলোচনার স্বার্থে সংযোজিত হল। এরকম প্রতি বছরই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটে চলা চরম আবহাওয়ার ঘটনায় বিপর্যস্ত হচ্ছে পৃথিবী। ‘জার্মানওয়াচ’-এর ‘গ্লোবাল সিআরাই -২০২১’ প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ২০০০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সময়ে সারা পৃথিবী জুড়ে ১১০০০-এর বেশী চরম আবহাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু হয়েছে ৪৭৫০০০ জনের, আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২.৫৬ ট্রিলিয়ন ডলারের। উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের সইতে পারার ক্ষমতা ( coping capacity) কম বলে উন্নত দেশের চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এর উপর কোভিড-১৯ অতিমারি দেখিয়েছে ঝুঁকি (risk) এবং সংকটাপন্নতা (vulnerability) একে অন্যের সাথে কিভাবে যুক্ত। তবুও পৃথিবীর চৈতন্য নেই। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ধারাবাহিকভাবে আয়োজিত হয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিরোধে যা করনীয়, সেই কাজ হচ্ছে কোথায়? এই পটভূমিতেই সিওপি-২৭-কে দেখা দরকার। সুইডিশ পরিবেশবিদ গ্রেটা থুনবার্গ (Greta Thunberg) এই সম্মেলন বর্জন করেন এই বলে যে এই সম্মেলন বাস্তবে হচ্ছে ‘গ্রীণ ওয়াশিং’ (Greenwashing) – ‘The COPs are mainly used as an opportunity for leaders and people in power to get attention, using many different kinds of greenwashing’………. সিওপি সম্মেলনগুলো ‘are not really meant to change the whole system’…. খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কথা। তবুও দুনিয়ার অগণিত মানুষ চেয়ে থাকে এই সম্মেলনগুলোর দিকে, প্রতিবারই বুক বাঁধে নতুন আশায়। এবারের সিওপি-২৭-ও এর কোন ব্যতিক্রম নয়
সিওপি সাতাশ
এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের ১৯০টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এবারের সম্মেলনের আলোচিত বিষয়গুলির অন্যতম ছিল গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো, জীবাশ্ম জ্বালানী বর্জন করা, সামগ্রিক ভূ-তাপমাত্রার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা, ‘লস এ্যান্ড ড্যামেজ’ এর প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি।
জীবাশ্ম জ্বালানী বর্জনের প্রসঙ্গে উন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন সুবিদিত। ধনী রাষ্ট্রগুলি তাদের প্রাচুর্যময় জীবনযাত্রার জন্য তেল ও গ্যাসের উপর ভীষণ নির্ভর করে। আর এই জ্বালানী যারা জোগান দেয়, তারা আবার তাদের আর্থিক লাভের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারে কোন পরিবর্তন আসুক এটা মোটেও চায় না। তাই, জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারকারী ও উৎপাদনকারী ধনী দেশগুলো, সুকৌশলে জীবাশ্ম জ্বালানী বর্জন সংক্রান্ত আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে কোন কার্যকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে দূরে থাকার চেষ্টা এযাবৎ কাল করে এসেছে, এবারও করেছে। তাদের অবস্থানটা হল, জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারে ধাপে ধাপে যদি পরিবর্তন আসে আসুক, কিন্তু যেটা দরকার, তা হল, পরিবেশের পক্ষে সুস্থিত (sustainable) পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির (renewable energy) ব্যবহার ভীষণভাবে বাড়াতে হবে। এ প্রসঙ্গে যেটা বাস্তব তা হল, এই পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির প্রযুক্তির প্রায় সবটাই শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলির করায়ত্ত। তাই পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহারের বৃদ্ধিতে তারা তাদের বাণিজ্যিক প্রসার ও বিপুল আর্থিক লাভের সম্ভাবনাকে দেখতে পাচ্ছে। এই কৌশল নেওয়ার ফলে তাদের এক ঢিলে দুই পাখি মারার বন্দোবস্ত একেবারে পাকা। জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারের নিশ্চিত ব্যবস্থায় তাদের প্রাচুর্যপূর্ণ জীবনযাত্রা যেমন চলছিল তেমনটাই চলতে থাকবে, আর আর্থিক মুনাফার বাড়বাড়ান্ত যেমন চলছিল তেমনটাই চলবে। আবার পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার ভূ-উষ্ণায়ন প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকারী এই অজুহাত দেখিয়ে এর আন্তর্জাতিক বাজারের প্রসার ঘটিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকা লাভের ধারাটাকেও অক্ষুন্ন রাখা যাবে। তাই আলোচনায় জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহারের বিলোপ প্রসঙ্গে সদর্থক অগ্রগতি না হলেও, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহারে জোর দেওয়ার বিষয়টি ভীষণ গুরুত্ব পায়।
এ প্রসঙ্গে এক প্রতিশ্রুতির কথা না বলেই নয়। সলতে পাকানোর কাজটা শুরু হয়েছিল ২০০৯-এর সিওপি-১৫-এর সম্মেলনে (সিওপি-১৫, ৭-১৮ ডিসেম্বর, ২০০৯; কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক)।এই সম্মেলনের আগে সংবাদপত্রে খবর হয় যে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডন্ট বারাক ওবামা ও বিশ্বের তাবড় নেতারা জলবায়ু পরিবর্তনের চুক্তিতে উপনীত হওয়ার প্রয়াস ঝেড়ে ফেলতে চলেছেন। তার পরিবর্তে তাঁরা কোপেনহেগেন সম্মেলনে চাইছন রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অথচ কিছুটা কম লক্ষ্যপূর্ণ (less specific) একটা মিশন (missiomn) গোছের কিছু নিয়ে আলোচনা চালাতে ও জটিল ও কঠিন ইস্যুগুলিকে ভবিষ্যতের জিম্মায় ঠেলে দিতে। ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-উত্তরকালে (২০১২ সালের পর) আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তি (global climate agreement) প্রতিষ্ঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যপূরণ কোপেনহেগেনের সভার মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও, ‘কিয়োটো প্রোটোকল’-এর চুক্তিমত নিঃসরণ কমাতে বহু অ্যানেকসার ১-ভুক্ত দেশই রাজী হয় নি। এই সভা (কিয়োটো চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর) দীর্ঘ-মেয়াদী কার্যক্রমের কোন চুক্তি তৈরী করতে পারে নি। কিন্তু এসবের মধ্যেও পঁচিশটা দেশ (যার মধ্যে চীন ও আমেরিকাও ছিল) একটা সমঝোতায় এসেছিল। এই সমঝোতার মাধ্যমে ধনী দেশগুলি নতুন করে অতিরিক্ত অর্থ জোগাতে রাজী হয়। এই অর্থে বনসম্পদ গড়ে তোলা হবে ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধী কাজে বিনিয়োগ করা হবে এমনটাই ঠিক হয়। এই উদ্যোগের পরম্পরায় সিওপি-১৬-এর সম্মেলনের (সিওপি-১৬, ২৮ নভেম্বর – ১০ ডিসেম্বর, ২০১০, কানকুন, মেক্সিকো) সভায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের ‘সবুজ জলবায়ু তহবিল’ (green climate fund) গড়ার ব্যাপারে সহমত হওয়া গেল। চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে (formally) স্বাক্ষরিত না হলেও, এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলি শিল্পে পিছিয়ে থাকা গরীব দেশগুলিকে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থসাহায্য দেবে। ঠিক হয় এই অর্থে গরীব দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মানিয়ে নেওয়ার জন্য (to adapt climate impacts) কার্যকরী ব্যবস্থা নেবে, কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যের বাস্তবায়ন করবে, এবং এজন্য প্রযুক্তিগত এবং সক্ষমতা নির্মাণের ক্ষেত্রের বুনিয়াদ শক্ত করবে। বাস্তবে অবশ্য দেখা গেল, কোন বছরেই ধনী দেশগুলো প্রস্তাবিত ১০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থসাহায্য জোগাড় করে উঠতে পারে নি। এ ব্যাপারে সাম্প্রতিক কয়েকটা বছরে সবুজ জলবায়ু তহবিল সংগ্রহের কিছু পরিসংখ্যান দিলে বোঝাটা আরও সহজ হবে। ২০১৩, ২০১৫ এবং ২০২০ সালে এই তহবিলের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫২.৫, ৪৪.৬ এবং ৮৩.৩ বিলিয়ন ডলার। এই সংখ্যাই দেখাচ্ছে প্রতিশ্রুতি পূরণে কি পরমাণ ফাঁক থাকছে।
শুধু তাই নয়। সবুজ তহবিলের মাধ্যমে গরীব দেশগুলিকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ায় নানা গোঁজা মিলেরও সাহায্য নিচ্ছে ধনী দেশগুলি। নেপালের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে যে আর্থিক সহায়তা ধনী দেশগুলি বিগত কয়েক দশক ধরে করে আসছে, যার বেশীটাই দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ, তাকেই ঘুরিয়ে সবুজ তহবিলে অনুদান (contribution) হিসাবে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই প্রতিশ্রুতি তাই পূরণই হয় নি। অথচ গত এক দশকের বেশী সময় ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমশ তীব্রতর হয়েছে। এবারের সভায় তাই উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাছে সবুজ তহবিলে অতিরিক্ত অর্থের জোগানের জোরালো দাবি জানায়। দাবি উঠে অতিরিক্ত অর্থের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের ছয় থেকে এগারো গুণ হতে হবে। সবুজ তহবিলে অতিরিক্ত অর্থ জোগানর প্রশ্নে দড়ি টানাটানির সময় উন্নয়নশীল দেশগুলো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানায়, প্যারিস চুক্তি মোতাবেক উন্নয়নশীল দেশগুলো রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে কার্বন নিঃসরণের যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে, তাকে কাজে পরিণত করতে গেলে এই আর্থিক সাহায্য তাদের দিতে হবেই। এ ছাড়াও চাই প্রযুক্তি ও সক্ষমতা নির্মাণের ক্ষেত্রে বৈদেশিক সহায়তা। এইসব বিষয়ের তপ্ত আলোচনায় সভা সরগরম হয়ে উঠে।
এই সভায় সবুজ তহবিলকে কেন্দ্র করে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে টানাপোড়েনের কারণে জলবায়ুর মূল সংকটের প্রশ্নটি উপেক্ষিতই থেকে যায়। গ্রীণহাউস গ্যাস (জিএইচজি) নিঃসরণের হ্রাসকে কেন্দ্র করেই এই প্রশ্ন। কিয়োটো চুক্তির (সিওপি-৩, ১-১১ ডিসেম্বর, ১৯৯৭, কিয়োটো, জাপান) সময় থেকেই গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণের অঙ্গীকার বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়। অ্যানেক্সার -বি এর অন্তর্গত ৩৭ টি শিল্পোন্নত দেশগুলোর এক গোষ্ঠী সামগ্রিক ভাবে ১৯৯০-কে ভিত্তি বৎসর ধরে ২০০৮-২০১২ সালের মধ্যে গড়ে ৪.২% নিঃসরণ হ্রাসের অঙ্গীকার করে (সারণী-১)।
ইইউ এবং তার সদস্য দেশগুলো অবশ্য প্রথম অঙ্গীকার সময়কালে তাদের নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশী পরিমাণেই নিঃসরণ কমাতে সক্ষম হয়। ১৯৯০-কে ভিত্তি বৎসর ধরে এই সময়কালে তাদের সামগ্রিক নিঃসরণ হ্রাসের পরিমাণ ছিল ১৯ % ( ২৩.৫ বিলিয়ন মেট্রিক টন ইকুইভ্যালেন্ট কার্বন ডাই অক্সাইড (billion metric ton equivalent CO2)। বৃহৎ নিঃসরণ সৃষ্টিকারী দেশের মধ্যে আমেরিকা কিয়োটো প্রোটোকলের অঙ্গীকারে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় নি। তেমনি কানাডা কিয়োটো প্রোটোকলের সদস্য দেশ থাকতে অসম্মতি জানায়। তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার। ২০০৭-২০০৮ সালে বিশ্ব জুড়ে হওয়া আর্থিক মন্দার কারণে কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হতে থাকে। পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীন দেশগুলো ১৯৯০-এর প্রথমে ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার জন্য নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারার কারণে জিএইচজি-এর নিঃসরণ কমাতে সক্ষম হয়। এই সমস্ত কিছু ইতিবাচক ব্যাপার বাদ দিলে, ১৯৯০ থেকে ২০১০ – এই পর্যায়ে বিশ্বের সামগ্রিক জিএইচজি-এর নিঃসরণ বাড়তেই থাকে। জিএইচজি-এর নিঃসরণে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) গ্যাসের অবদান সর্বাধিক। গোটা বিশ্বের জিএইচজি-এর নিঃসরণে জীবাশ্ম জ্বালানী ও কলকারখানার উৎপাদন (fossil fuel and industrial processes) এবং বনভূমি ও ভূমির ব্যবহার (forestry and land use) - এই দুই খাতে CO2-এর পরিমাণ যথাক্রমে ৬৫ এবং ১১ শতাংশ। ১৯৯০ থেকে বিগত কয়েক দশকে CO2-এর মাত্রা লক্ষ্য করলেই সহজেই বোঝা যায় জিএইচজি-এর নিঃসরণ কি পরিমাণে বেড়ে চলেছে (সারণী -২)। ১৯৯০ থেকে ২০২১ এই সময়কালে CO2-এর বৃদ্ধি ঘটে প্রায় ৬০%। বিষয়টা যথেষ্ট উদ্বেগের।
এবারের সভার যে ইস্তাহার প্রকাশিত হয়, তাতে নিঃসরণের জন্য দায়ী তেল ও গ্যাসের কোন উল্লেখই নেই। শক্তির জন্য তেল ও গ্যাস ব্যবহারকারী শিল্পন্নোত ধনী রাষ্ট্রগুলো কম নিঃসরণের শক্তির উৎস বলে তেল ও গ্যাসকে আলোচনার বাইরে রাখতে গোড়া থেকেই সচেষ্ট হয়। এসব থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে সিওপি-২৭ তেল ও গ্যাসের উৎপাদক ও ব্যবহারকারী দেশগুলোকে কোন বার্তা তো দিলই না, বরং এই উল্লেখ না করার ফলে জীবাশ্ম জ্বালানীর লবি বাড়তি খানিকটা উৎসাহ পেয়ে গেল। এর প্রতিফলন দেখা যায় আমেরিকার সাম্প্রতিক ব্যবহারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসাবে বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের দাম আকাশছোঁয়া। নিজের দেশে এর প্রভাবে প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে পারে। এই আশঙ্কায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তেল ও গ্যাসের অধিকমাত্রায় উৎপাদনের উপর জোর দেন, যাতে বাড়তি উৎপাদনের মাধ্যমে তেল ও গ্যাসের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই প্রেসিডেন্টই আবার সিওপি ২৭-এর সভায় বিশ্ব নেতাদের কাছে ভূ-উষ্ণায়নের মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানীর পূর্ণ বর্জনের জন্য জোরালো সাওয়াল করে। এহেন দ্বিচারিতাই জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটের অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জ। মনে রাখতে হবে, এবারের জলবায়ু অধিবেশন, সিওপি-২৭, স্পন্সর করেছে কোকাকলা (Coca-Cola)-এর মতো কোম্পানি, যারা বিশ্বে অন্যতম প্ল্যাস্টিক পলিউটার (plastic polluter) হিসাবে কুখ্যাত।
যেহেতু এবারের সম্মেলন আফ্রিকার একটা দেশে (মিশরে) হচ্ছে, তাই আশা করা গিয়েছিল জলবায়ুর খামখেয়ালীপনায় বিধ্বস্ত আফ্রিকার গরীব দেশগুলোর প্রতিনিধি হয়ে মিশর আফ্রিকার মুখ হয়ে উঠবে। গোটা আফ্রিকা মহাদেশ মিলে বিশ্বের গড় জিএইচজি-এর নিঃসরণের তিন শতাংশের কম নিঃসরণ ঘটায়। অথচ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটা চরম আবহাওয়ার মত ঘটনার (খরা, বন্যা, ভূমিক্ষয়) জন্য জিডিপি-এর ১৫%-এর মত ক্ষতির মুখোমুখি হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল মিশরের প্রেসিডেন্ট, যিনি আবার এই সম্মেলনে সভাপতি পদেও আসীন ছিলেন, সভায় সদস্য দেশগুলোর কাছে আহ্বান জানান এহেন ত্রুটিপূর্ণ ইস্তাহার মেনে নেওয়ার। অবশ্য তাঁর মতো সব স্বৈরাচারী শাসকের থেকে এমন ব্যবহারই আশা করা যায়। তাঁর বিরুদ্ধে মানবাধিকার (human rights) লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রতিবাদীরা সোচ্চারে মুখর। এই সভাপতি পরিবেশ নিয়ে কাজ করে এমন অনেক প্রতিবাদী বেসরকারি সংস্থাকে (NGO) মিশরে ঢুকতে দেন নি, যাতে তারা সিওপি-২৭-এর অধিবেশনে অংশ নিতে না পারে। এমন ব্যক্তিরাই জলবায়ু সঙ্কটের থেকে পরিত্রাণের আলোচনায় মুখ্য ভূমিকা নেবেন, এটাই তো স্বাভাবিক!
নিঃসরণ কমানো ও জীবাশ্ম জ্বালানী বন্ধের প্রসঙ্গে এমন কথাও বলা হয়েছে যে সিওপি-২৭-এর সফলতা বা ব্যর্থতা নির্ভর করছে, জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারের সমানাংশ হারে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার (equitable phasing out) ব্যাপারে সহমত হওয়ার প্রশ্নে। এবারের সভায় ছোট ছোট দেশ, যেমন, ভানুয়াটু (Vanuatu) এবং তুভালু (Tuvalu) এবং বৃহৎ শিল্পন্নোত দেশ, যেমন, নরওয়ে, আমেরিকা, কলম্বিয়া এবং ইইউ কিছুটা হলেও উদ্যোগ দেখিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে যেটা দরকার তা হল, বিশ্বের সব দেশকেই এগিয়ে এসে এ ব্যাপারে সহমত হয়ে কাজ (climate action) করতে হবে। এবং তা করতে হবে, রাষ্ট্রের স্বার্থ, কর্পোরেটের স্বার্থ, ব্যক্তির স্বার্থকে পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে, শুধুমাত্র এই সবুজ গ্রহের স্বার্থকেই বড় করে দেথে, তাকে বাঁচানোর আন্তরিক তাগিদ থেকেই। তবেই এই সবুজ গ্রহকে বাঁচানো যাবে।
এই বাঁচার ও বাঁচানোর তাগিদ যে কত বড়, সেই প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়। তুভালু প্রশান্ত মহাসগরীয় একটি দ্বীপরাষ্ট্র। ভূ-উষ্ণায়ন জনিত কারণে সমুদ্রের জলস্তরের বৃদ্ধি এই দেশের অস্তিত্বের সঙ্কট ডেকে এনেছে। সমস্ত রকমের জীবাশ্ম জ্বালানীর উৎপাদন ও ব্যবহারে পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবিতে তুভালুর প্রধানমন্ত্রী সোচ্চার হন। সভায় উনি দাবি তোলেন পারমাণবিক জ্বালানীর ক্ষেত্রে যেমন অ-বিস্তার চুক্তি (nuclear non-proliferation treaty) রয়েছে, তেমনি অ-বিস্তার চুক্তি লাগু হোক জীবাশ্ম জ্বালানীর উৎপাদন সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করার উদ্দেশ্যে। ভানুয়াটু আর একটি প্রশান্ত মহাসগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র যার অস্তিত্বেরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে একই কারণে। এই সমস্ত ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলি একজোট হয়ে দাবি তোলে জীবাশ্ম জ্বালানী পুরোপুরি বন্ধের এবং এ ব্যাপারে অ-বিস্তার চুক্তি বলবৎ করার। কয়লা, তেল ও গ্যাসের উৎপাদন ও ব্যবহারে রেশ টানতে অ-বিস্তার চুক্তি বলবৎ করার ধারণা নতুন কিছু নয়। এ ব্যাপারে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলি অনেকদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে। এমন কি সেই একই দাবিতে সামিল হয়েছিল ধর্মীয় সংগঠন ভ্যাটিকানের ধর্মগুরুও। তুভালু ও ভানুয়াটুর জোরালো বক্তব্য এই দাবিকেই আন্তর্জাতিক স্তরে দৃঢ়-প্রতিষ্ঠ করল।
এখানে খেয়ালে রাখতে হবে, যে গত বছর সিওপি-২৬-এর সম্মেলনে (সিওপি-২৬, ৩১ অক্টোবর-১৩ নভেম্বর, ২০২১; গ্লাসগো, ইউকে) ভূ-তাপমাত্রার হ্রাসের ব্যাপারে ২০১৫-এর প্যারিস চুক্তির অঙ্গীকারকেই পুনরায় সমর্থন জানানো হয়। ধীরে ধীরে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। অরণ্যনিধন (deforestation)-এর প্রবণতা রুখে বনসৃজনের (forestation) কথাও বলা হয়। এবারের সভাতেও অনেকটা যেন নিয়মমাফিকই এই সব অঙ্গীকারের পুনরাক্তি করা হয়। প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অর্থাৎ গড় ভূ-তাপমাত্রার বৃদ্ধি শিল্পায়ন পূর্ববর্তী সময়ের ২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে বেঁধে রাখা, তা পূরণ করতে হলে বিশ্বকে জিএইচজি নিঃসরণকে ২০৩০-এর মধ্যে বর্তমানের চেয়ে অর্ধেক করতে হবে। আর নেট-জিরো (net-zero) পর্যায়ে ( অর্থাৎ যেটুকু জিএইচজি মানুষের কারণে সৃষ্টি হবে, তা প্রকৃতিতে কাজে লেগে, পরিবেশে জিএইচজি-র মাত্রা অপরিবর্তিত থাকবে) আসতে হবে ২০৫০-এর মধ্যে। বর্তমানে নিঃসরণের উর্ধগামী প্রবণতা ও ভূ-তাপমাত্রার বৃদ্ধির হালচাল দেখে এই লক্ষ্য পূরণের আশাকে দুরাশা বলেই মনে হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের দাপটে সঙ্কটাপন্ন দেশসমূহের (vulnerable countries) ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তির ঘটনা ঘটল সভার একাবারে অন্তিমলগ্নে। সভার শেষদিন ১৯০টা দেশের প্রতিনিধিরা সম্মত হয়ে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গড়ার ব্যাপারে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই তহবিল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল ও গরীব রাষ্ট্রগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করার সংস্থান রয়েছে। এই তহবিলের জন্য গরীব রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিল। ২০১৭ সালে বনে অনুষ্ঠিত সিওপি-২৩-এর (সিওপি-২৩,৬-১৭ নভেম্বর, ২০১৭, বন, জার্মানি) অধিবেশনে সভাপতিত্ব করে ফিজির প্রধানমন্ত্রী জোরালো সওয়াল করে বলেন যাদের কাজের কারণে জলবায়ু পরিবর্তিত হয়েছে, তাদেরই ক্ষয়ক্ষতির দায়িত্ব নিতে হবে। এর আগে পোল্যান্ডে হওয়া সিওপি-১৯-এর সভায় (সিওপি-১৯, ১১-২৩ নভেম্বর, ২০১৩, ওয়ারশ, পোল্যান্ড) ক্ষয়ক্ষতি মেটানোর উদ্দেশ্যে ‘ওয়ারশ আন্তর্জাতিক মেকানিজম’ (Warsaw International Mechanism বা WIM) গঠিত হয়। ডব্লিউআইএম-এর অধীনে একটি কার্যকরী কমিটিও গঠিত হয় বিষয়টির বিবেচনার জন্য। কমিটি এ ব্যাপারে পদক্ষেপ করে একটি পাঁচসালা পরিকল্পনাও তৈরী করে। সিওপি-২৩-এর সভায় এই পরিকল্পনার উপর বিস্তারিত আলোচনাও হয়। একটা কথা পরিস্কার করে বলা দরকার, ক্ষয়ক্ষতি মেটানোর জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে প্রয়োজনীয় তহবিল কিভাবে গড়া হবে, পাঁচসালা পরিকল্পনা সে ব্যাপারে একাবারেই নিশ্চুপ ছিল। ধনী দেশগুলো গরীব দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে তহবিল গড়তে একদমই রাজী ছিল না।
কিন্তু এই গরীব রাষ্ট্রগুলোই ভূ-উষ্ণায়নের ফলে সংঘটিত বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ, দুর্ভিক্ষ, সমুদ্র ঝড় প্রভৃতির বেশী করে শিকার হচ্ছে। অথচ, ভূ-উষ্ণায়ন ঘটার পিছনে তাদের ভূমিকা অতি সামান্য। উদাহরণ স্বরূপ, আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের নাম করা যায়। সারা বিশ্বের মোট জিএইচজি নিঃসরণে পাকিস্তানের অবদান মাত্র ০.৯%। কিন্তু এবার অতিবৃষ্টিজনিত কারণে পাকিস্তানে ভয়ঙ্কর বন্যা হয়। সারা দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এবারের প্রলয় ভয়ঙ্কর বন্যায় পাকিস্তানে সম্পদ ও সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৪.৯ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী। আর্থিক ক্ষতির (economic loss) পরিমাণ ১৫.২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এরকমই বিশ্ব জিএইচজি নিঃসরণের ভাঁড়ারে ছিটেফোঁটা অংশ নিয়েও নিরন্তর চরম আবহাওয়ার মতো ঘটনার করাল ছোবল খাওয়া থেকে নিস্তার নেই পৃথিবীর বহু দেশেরই।
চুক্তি মতে ধনী দেশগুলো থেকেই অনুদান নিয়ে প্রাথমিকভাবে এই তহবিল গড়া হবে। সম্মেলনের শুরু থেকেই এই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গড়ার ইস্যুটি সভার অ্যাজেন্ডায় ঢোকানোর ব্যাপারে উন্নত এবং উন্নয়নশীল ও গরীব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটা চাপানউতোর লক্ষ্য করা যায়। স্পষ্ট বিভাজন ঘটে উত্তর এবং দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর মধ্যে (north south divide)। উত্তর বিশ্বের (global north) শিল্পন্নোত ধনী দেশগুলো প্রথম থেকেই এ জাতীয় তহবিল গড়ার বিরুদ্ধাচারণ করছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনাকে ভূ-উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সৃষ্ট বলে মানতে চাইছিল না। এই দুটো ব্যাপারের মধ্যে যে অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র রয়েছে তা মানতে আমেরিকার ঘোরতর আপত্তি ছিল। আপত্তি ছিল বিশেষ করে ‘ক্ষতিপূরণ’ (compensation) শব্দটাতেই। আরও জুতসই প্রতিশব্দ ‘reparation’-এর কথা না হয় বাদই দেওয়া যাক। ‘ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার কথা উঠলেই সে যে দুশো বছর ধরে কারুর ক্ষতি করে আসছে নির্বিচারে অসহনীয় মাত্রায় জিএইচজি নিঃসরণ ঘটিয়ে তা মান্য হয়ে পড়ে। তাই সে এবং তার চেলাচামুন্ডরা চাইছিল এই দায় মামুলি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে চালিয়ে দিতে এবং ‘ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার দায় এড়াতে। বাস্তবে অবশ্য শিল্পন্নোত ধনী দেশগুলো এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এবং দক্ষিণ বিশ্বের (global south) সমবেত চাপের মুখে বাধ্য হয় এই তহবিল গড়ার অঙ্গীকার করে চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে।
এ প্রসঙ্গে আরও একটা কথা না বললে ঠিক হবে না। গত বছর গ্লাসগোয় জলবায়ু সম্মেলনের সভায় (সিওপি-২৬,৩১ অক্টোবর-১৩ নভেম্বর, ২০২১, গ্লাসগো, ইউকে) যে ‘গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি’ (Glasgo Climate Pact) স্বাক্ষরিত হয়, তাতে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গড়ার ব্যাপারটি একরকম নির্ধারিত হয়েই গিয়েছিল। ঠিক হয়ে গিয়েছিল আর্থিক ক্ষতিপূরণের মেকানিজম (financial mechanism for compensation) হিসাবে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফ্যাসিলিটি’ (Loss and Damage Facility) চুক্তিতে স্থান পাবে। কিন্তু তারপর ধনী রাষ্ট্রগুলো কলকাঠি নাড়া শুরু করাতে শেষাবধি বিষয়টি নির্বিষ হয়ে মামুলি ক্ষয়ক্ষতির সংলাপ (Loss and Damage Dialogue) হয়েই চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
এবারে তাই শুরু থেকেই উন্নয়নশীল ও গরীব দেশগুলো সতর্ক ছিল, যাতে যেভাবেই হোক না কেন ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল গড়ার ব্যাপারে চুক্তি হয়। তাই হয়েছে। যদিও চুক্তি কিভাবে লাগু হবে, তা ঠিক হবে, আরও কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে। উত্তর বিশ্বের (Global North) কাছ থেকে দক্ষিণ বিশ্বের (Global South) এই জয় ছিনিয়ে নেওয়া খুব একটা কম বড় ব্যাপার নয়।
শেষের কথা
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত চরম আবহাওয়ার মত ঘটনায় উন্নত, উন্নয়নশীল ও গরীব দেশগুলো মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। উন্নয়নশীল ও গরীব দেশগুলোর কাছে এ সংকট ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে, কারণ তাদের সহন ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। আলোচনাকে শুধু এই পরিসরে আটকে রাখলেই চলবে না। আলোচনার পরিসরে নিয়ে আসতে হবে সেইসব অসহায় মানুষগুলোর কথা, যারা জানে না কেন তাদের জীবন ও জীবিকা এহেন সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। আফ্রিকার দক্ষিণ সুদান এবছর ভায়াবহ বন্যার শিকার হয়েছে। কেনিয়া, সোমালিয়া ভয়ঙ্কর খরার কবলে পড়েছে। এই সব দেশের মানুষ কৃষির উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে কোন মতে। তাদের সেই বেঁচে থাকাটাই খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। হর্ন অফ আফ্রিকার (Horn of Africa) এক বৃহৎ গোষ্ঠীর মানুষ নিতান্ত বেঁচে থাকার তাগিদে ছুটে বেড়াচ্ছে নিজেদের অজন্মের পরিচিত বাসভূমি ছেড়ে অন্যত্র। বাড়ছে গোষ্ঠী সংঘর্ষ। Inter-Governmental Authority on Development, Climate Prediction and Application Centre-এর বিশেষজ্ঞ লিন্ডা ওগাল্লো (Linda Ogallo)-এর কথায়, ‘a big block of communities in the Horn of Africa are framers who rely on agriculture and pastoralism. Therefore their lives are tied to climate. Any negative event leads to disruption of livelihoods and displacement that push people to new areas leading to inter-community or cross-border conflicts.’ চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলো অসহায় মানুষগুলোকে বাধ্য করছে ছুটে বেড়াতে, রসদের জন্য বাড়ছে তীব্র প্রতিযোগিতা, বাড়ছে সংঘর্ষ। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিবের অফিস অফ স্পেশাল এনভয় টু হর্ন অফ আফ্রিকার (Office of the Special Envoy of the UN Secretary General to the Horn of Africa) আধিকারিক এলিজাবেথ কারাবাইন (Elizabeth Carabine)-এর কথায় নিদারুন বাস্তবতার এক ছবি ফুটে ওঠে – ‘People displaced by climate events are more prone to conflicts that lead to instabilities. Climate change has become a threat to peace and security…’। এই বিপন্নতা সারা পৃথিবী জুড়েই। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংঘটিত দুর্যোগের কবলে পড়া পৃথিবী ব্যাপি অগণিত অসহায় মায়েদের কাছে তাদের অবোধ শিশুগুলো যখন একটু জল আর খাবারের জন্য কাঁদতে থাকে, আর মায়েরা সেইটুকু জোটাতে না পেরে গভীর যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন, সেই যন্ত্রণা কোন বিশেষ অঞ্চলের নয়, কোন বিশেষ দেশের নয়। সেই যন্ত্রণা সারা বিশ্বেরই। সেই অহায়তা, সেই কান্না, সেই যন্ত্রনা যেদিন সারা বিশ্বের মানুষ অন্তর দিয়ে নিজের বলে সত্যি সত্যিই উপলব্ধি করতে পারবে, সেদিনই হয়ত এই গভীর সংকট থাকে চির মুক্তির কোন সঠিক দিশা মিলবে। আমাদেরই এখন ঠিক করতে হবে আমাদের এ সময়ের করণীয় কর্তব্যকে।
তথ্যসূত্র :
১। ‘জলবায়ু পরিবর্তনের তেইশতম বিশ্ব সম্মেলন (COP-23)’, ওমপ্রকাশ চক্রবর্তী, কালধ্বনি, বর্ষ ২২, সংখ্যা ১-৩, পাতা ১৩-২৬, মে, ২০১৮
২। ‘Kyoto Protocol – Targets for the First Commitment Period’, unifccc.int/ process-and-meetings/the-kyoto-protocol
৩। ‘কিয়োটোর কেরামতি : বাজার অর্থনীতিতে পরিবেশ’ রবীন মজুমদার, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী, বর্ষ ১৫, জানুয়ারি-ডিসেম্বর, ২০০৩
৪।‘Hope for Humanity’, The Statesman, 08 November, 2022
৫। Greta Thunberg to skip ‘greenwashing’ Cop27 climate summit in Egypt- The Guardian, 30 October, 2022. https://www.theguardian.com
৬। Global Climate Risk Index 2021- Germanwatch. https://www.germanwatch.org
৭। ‘দায় ও দায়িত্ব’, সম্পাদকীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ নভেম্বর, ২০২২
৮। ‘অধরা প্রতিশ্রুতি’, সম্পাদকীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ নভেম্বর, ২০২২
৯। ‘Heat is on’, Editorial: The Statesman, 09 November, 2022
১০। ‘Of the climate and other farces’, Aasim Sajjad Akhtar, The Statesman, 13 November, 2022
১১। ‘Draft COP 27 climate deal shows inaction on loss and damage funding’, Business Standard, 18 November, 2022; https://www.business-standard.com
সারণী -১ । কিয়োটো চুক্তির প্রথম অঙ্গীকার সময়কালে (First Commitment Period), ২০০৮-২০১২-তে অ্যানেক্সার-বি অন্তর্গত দেশগুলোর নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা (target)
দেশ নিঃসরণ হ্রাসের
লক্ষ্যমাত্রা
[সময়কাল ২০০৮-২০১২;
ভিত্তি বৎসর ১৯৯০]
সারণী - ২ । ১৯৯০ থেকে বিগত কয়েক দশকে গোটা বিশ্বের সামগ্রিক CO2-এর উদ্গীরণের মাত্রা (বিলিয়ন মেট্রিক টনে)
সাল ১৯৯০ ১৯৯১ ১৯৯২ ১৯৯৩ ১৯৯৪ ১৯৯৫ ১৯৯৬ ১৯৯৭ ১৯৯৮ ১৯৯৯
CO2 ২২.৭৫ ২৩.২৪ ২২.৫৭ ২৩.৮০ ২২.৯৬ ২৩.৪৫ ২৪.১৫ ২৪.৩০ ২৪.২১ ২৪.৫২
সাল ২০০০ ২০০১ ২০০২ ২০০৩ ২০০৪ ২০০৫ ২০০৬ ২০০৭ ২০০৮ ২০০৯
CO2 ২৫.২৩ ২৫.৪৫ ২৬.০৪ ২৭.৩৭ ২৮.৬৩ ২৯.৬০ ৩০.৫৮ ৩১.৪৯ ৩২.০৭ ৩১.৬১
সাল ২০১০ ২০১১ ২০১২ ২০১৩ ২০১৪ ২০১৫ ২০১৬ ২০১৭ ২০১৮ ২০১৯ ২০২০ ২০২১
CO2 ৩৩.৩৪ ৩৪.৪৭ ৩৪.৯৭ ৩৫.২৮ ৩৫.৫৩ ৩৫.৫০ ৩৫.৪৫ ৩৫.৯৩ ৩৬.৬৫ ৩৬.৭২ ৩৬.৮১ ৩৬.৪০