সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
কাঞ্চন মুখোপাধ্যায়
তেলের শিশি অথবা বুকের পাঁজর
দুহাজার বাইশ সালে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে সারা ভারত জুড়ে অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন হল। সেই ‘অমৃত মহোৎসব’-এর ছটা যখন বহু মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে, তখনই কিছু মানুষ স্মরণ করেছেন দেশভাগের দুঃখ ও ভয়াবহতা। পৌনে-এক শতাব্দী আগে টুকরো হয়েছিল দুটো প্রদেশ - বাংলা আর পাঞ্জাব – তাদের পাঁজর ভেঙ্গে গড়া হল স্বাধীন ভারতবর্ষ। তারই কিছুদিনের মধ্যে কাশ্মীর টুকরো হয়ে গেলো, তার মাঝখান জুড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো পাহারাদার সান্ত্রীর দল কামান বন্দুক নিয়ে।
আমরা অনেকেই এই সময়ে দাঁড়িয়ে খানিক দ্বিধাগ্রস্ত – এই পঁচাত্তর আনন্দের না বিষাদের? যখন কেউ ব্যস্ত থাকলেন মহোৎসবের ফানুস ওড়াতে, তখনই কেউ আবার দেশভাগের দুঃখ স্মরণ করলেন সমব্যথীদের সঙ্গে। দেশভাগ বিষয়ক একটি সভার উদ্যোক্তাদের কাছে শুনলাম ওই সভা আয়োজন করা হচ্ছে শুনে কেউ কেউ আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁদের মতে এমন অথৈ আনন্দের দিনে দেশভাগ-চর্চা নেহাতই দুঃখবিলাস। একজন আয়োজক সামাজিক মাধ্যমে ওই সভার উদ্দেশ্য এবং দিনক্ষণ ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরই এক বন্ধু সেই পোস্টে মন্তব্য লিখলেন – দেশ-বিভাজন তো অনেককাল আগের কথা। যারা সাতচল্লিশের দেশভাগে সরাসরি প্রভাবিত হয়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশই আজ আর জীবিত নেই, তাঁদের সন্তান-সন্ততিরা জীবনটাকে নিজেদের মতন করে গুছিয়ে নিয়েছেন। তাহলে এই স্মরণসভা কাদের জন্যে? আরও কিছু পরে সামাজিক মাধ্যমের কর্তারা সেই ঘোষণা মুছে দেন এবং পোস্টকর্তাকে জানিয়ে দেন, দেশভাগ বিষয়ে আলোচনা থেকে সামাজিক ঘৃণা ছড়াতে পারে। অবাক হওয়া ছাড়া আমাদের বিশেষ কিছু করার ছিলো না। পরদিনই বিষয়টিতে খানিক মোচড় আসে যখন ভারত সরকারের কর্তাব্যক্তিরা জানান দুহাজার তেইশ সাল থেকে ১৪ই আগস্ট দিনটি দেশভাগ দিবস হিসেবে পালন করা হবে।
আশঙ্কা থেকে যায় দেশভাগ দিবস পালনের নামে কেউ কেউ একপেশে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইতিহাসের ব্যাখ্যা প্রচার করবেন এবং তাঁদের পক্ষে ‘সুখশ্রাব্য’ ইতিহাসের ঢাক বাজানো হবে। ঐ একপেশে প্রচার আটকাতেই দেশভাগ বিষয়ে ব্যাপক চর্চা হওয়া দরকার, আমরা চাই পরস্পর বিরোধী অনেক কণ্ঠস্বর সামনে আসুক। যে সব সাম্প্রদায়িক চিন্তা ও কার্যকলাপকে প্রায়শই দেশভাগের জন্য দায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, সেগুলো বারবার খুঁটিয়ে দেখা যাক এবং তাদের জন্মবৃত্তান্ত কাটাছেঁড়া হোক। এটা কোন শুদ্ধ বিদ্যাবিলাস নয়, আমাদের জীবনে এই চর্চার একান্ত দরকার আছে।
ইদানিংকালে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু দ্বন্দ্বে যেভাবে সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যার আমদানি করা হচ্ছে বা নাগরিকত্ব প্রমাণ করার যে দায় বহুমানুষের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার মূলেও তো দেশভাগ। সীমান্তের এপারে বা ওপারে যারা ভিটেমাটি এবং স্বজন হারিয়েও বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে গেছেন এবং এখনও যাচ্ছেন, তাঁদের সমস্যাগুলো নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা হওয়া উচিত। এই বিষয়গুলো এড়িয়ে গিয়ে দেশভাগ-দিবস পালন বা দেশভাগ-চর্চা সফল হতে পারেনা।
এত গুরুগম্ভীর সমস্যা ছাড়াও আমাদের সাদামাটা দৈনন্দিন জীবনে মাঝেমাঝেই হানা দেয় দেশভাগের তিক্ততা। দু’হাজার ষোল সালের মে মাস, পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন সবেশেষ হয়েছে। সেই সময় খবরের কাগজের পাতা জুড়ে রাজনৈতিক সংঘর্ষের বর্ণনা আর কিছু নেতার মুখে কুকথার ফুলঝুরি। রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছি, দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা। সেই গরম হাওয়ার সময়ে যা হয়, আমাদের কথাবার্তায় এসে গেল ভোটের ফল আর গ্রামেগঞ্জে রাজনৈতিক হিংসার বৃত্তান্ত। এক বন্ধু বললেন এইসব মারপিট খুনোখুনিকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেননা কেননা এই দেশ এর থেকে অনেক বড় মাপের হিংসা দেখেছে দেশভাগের সময়, তখন হাজার হাজার মানুষের প্রাণ গেছে। আমি জানি ওই বন্ধুটির পরিবার এবং তাঁদের অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ভিটেমাটি ছেড়ে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। বন্ধুটি মন্তব্য করলেন, সেই সময় মুসলমানরা হিন্দুদের ওপর যে অত্যাচার করেছে তার তুলনা ইতিহাসে কম আছে।
অন্য সময় বা ভিন্ন বিষয় হলে বন্ধুটিকে ঠাট্টা করে বলা যেত নদীর রচনায় গরু ঢুকে পড়ছে, বিধানসভা ভোটের মধ্যে দেশভাগের প্রসঙ্গ টেনে আনা একটু বাড়াবাড়ি রকমের কুতর্ক। কিন্তু তিনি তখন বেশ উত্তেজিত এবং স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তিনি যা বলছেন তাঁর বিশ্বাস থেকেই বলছেন। আমি ওনাকে এবং ওনার পরিবারের অন্যদের অনেক বছর ধরে চিনি। দেশভাগের পরে তাঁরা উত্তর-পূর্ব ভারতের এক শহরতলীতে আশ্রয় নেন, সেখানে তখন জঙ্গল বেশি আর বসতি কম। সেই অপরিসর আশ্রয়ে দেশ থেকে নিয়ে আসা ঠাকুর দেবতার পটের পাশে এক পেতলের কলসিতে রাখা থাকতো একটুখানি মাটি। পিতৃপুরুষের ভিটে থেকে সংগ্রহ করে আনা সেই মাটিকেও দেবতা জ্ঞানে পুজো করা হত। সারাদিনের কাজকর্ম আর পড়াশোনার ফাঁকে ছোটরা বড়দের থেকে শুনত তাদের গ্রামের জমিজমা ঘরবাড়ি মানুষজনের কথা, মুসলমান প্রজারা কত বাধ্য ছিল সেই বৃত্তান্ত। তারপর পালটে গেলো সবকিছু, হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে জমা হতে থাকল তিক্ততা ভয় আর অবিশ্বাস। অবশেষে দেশভাগ, চোখে জল নিয়ে বাস্তু ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দেওয়ার কাহিনী। সেই কাহিনীর পরতে পরতে ভরা থাকে মুসলমানরা কত হিংস্র আর সাম্প্রদায়িক সেইসব তথ্য।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এই বাস্তুচ্যুত পরিবারটি কোন ব্যতিক্রম নয়,এই রকম আরো অনেক পরিবারের ছেলেমেয়েরা একইরকম ধারণা নিয়ে বড় হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বামপন্থী রাজনীতিতে অংশ নিয়েছে এবং অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায় বিষয়ে বিরুপ ধারণা জামার তলায় তাগা-তাবিজের মতো লুকিয়ে রাখতে শিখেছে। পরিস্থিতির হেরফেরে কখনও সেই গুপ্ত দুর্বলতা প্রকাশ্যে চলেএসেছে গভীর অবচেতনের মতো।
বন্ধুটির উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তে থাকে, তিনি বলতে থাকেন ওই অত্যাচারের বদলা আজও নেওয়া হয়নি। এখন এদেশে মুসলমানদের সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করা উচিত সেই বিষয়ে তাঁর মতামত একটি বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ভাষ্যের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। তাঁর গলার স্বর উচ্চতর হয়, তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের নিরাপদ রাখার জন্য কি কি করা দরকার। সেইসব দরকারি কাজের মধ্যে বেশ কয়েকটা আইনসম্মত এবং গণতান্ত্রিক নয় সেটা বলা বাহুল্য। যেখানে আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল সেই রাস্তায় কিছু দোকান, নানা মানুষের জটলা। আমি তাঁকে নানাভাবে থামাবার চেষ্টা করি কিন্তু তিনি তখন অপ্রতিরোধ্য। ভয়ঙ্কর রেগে গিয়ে বলেন আমি ওনার সত্যি কথা সহ্য করতে পারছি না, তাই বাধা দিচ্ছি। এরপর উনি আমাকে খানিক গালিগালাজ করে সেখান থেকে হাঁটতে শুরু করেন। আমাদের অনেক বছরের বন্ধুত্ব সেই ধাক্কা আর সামলে উঠতে পারলো না, প্রায় বিনা চিকিৎসায় মাঝরাস্তায় মারা গেলো।
মাতৃরূপেণ
আমার প্রাক্তন বন্ধুটির ভাবনায় যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আছে, সেই বিদ্বেষ আরো লাখো লোকের মাথার মধ্যে নড়াচড়া করে। তাঁদের কাছে একটি ইতিহাসের গল্প আছে। সেই গল্পে আগে ‘কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’-এর সুদিন থেকে হঠাৎ করে মুসলিম লীগ এবং মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা হয়ে আমরা দেশভাগের গরম তেলের কড়াইতে পড়ে যাই। এই গল্প দীর্ঘ সময় ধরে চালু আছে এবং ডালপালা বিস্তার করছে তার একটা প্রধান কারণ এদেশে সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস নিয়ে তথ্যনিষ্ঠ চর্চা বড় একটা হয়নি, যেটুকু হয়েছে সেটাও অনেক সময় পণ্ডিতদের মধ্যে এবং পণ্ডিতি ভাষায়। ফলে চালু গল্পকথাগুলোর গায়ে বিশেষ আঁচড় লাগেনি, ‘হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা’ জাতীয় অপ্রিয় কথা তার মধ্যে ঢুকতে পারেনি, কোনরকমে ঢুকে পড়লেও তাকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তার ফলে ‘আমরা ভালো ওরা খারাপ’ জাতীয় ব্যাখ্যানের বাড়বাড়ন্ত বেড়েছে বৈ কমেনি। আমাদের মনে হয়েছে ওই ‘অপ্রিয়’ কথাগুলো বারবার নানাভাবে বলা দরকার নির্মিত বা কল্পিত ইতিহাসের ইমারতে ধাক্কা দেওয়ার জন্যে।
বাংলাভাগ বিষয়ে জয়া চ্যাটার্জিরএকটি তথ্যবহুল বই প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। সেই বইতে লেখিকা মন্তব্য করেছেন, দেশভাগের অনেক বছর পরেও ভারতে সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসচর্চা মানেই ছিল দেশভাগের ইতিহাসের চর্চা। সেই চর্চায় অনেক সময়েই ধরে নেওয়া হতো দেশভাগের কারণ মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার উৎপত্তি মুসলিম জাতিসত্ত্বার বাড়বাড়ন্ত থেকে। অর্থাৎ ইতিহাসবিদদের একটা বড় অংশ এককালে ওই ‘সুখশ্রাব্য’ ইতিহাসে আস্থা রেখেছিলেন। কিছু গবেষক বাঙলায় সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে অর্থনৈতিক শ্রেণির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ খুঁজে পেয়েছেন। কেউ দেখিয়েছেন সাম্প্রদায়িকতার শিকড় মুসলিম সমাজের মধ্যে উপস্থিত ছিল, তিরিশের দশকে মুসলিম কৃষকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ জনপ্রিয় ছিল। আর একটি মত অনুযায়ী পূর্ববঙ্গে জমিদার ও জোতদারদের সঙ্গে বিরোধ থেকেই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জন্ম। বাংলার কৃষিব্যবস্থা আলোচনা করতে গিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে, মুসলিম পরিচিতির অযৌক্তিক শক্তির জন্যেই গ্রামাঞ্চলের সাধারণ অর্থনৈতিক বিরোধ মিলেমিশে যায় পাকিস্তানের দাবির সঙ্গে।
এইসব তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে এটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে যে সাম্প্রদায়িকতা একান্তই মুসলমানদের সমস্যা। অর্থাৎ সমান্তরালভাবে কোনও হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা তৈরি হয়নি বা হয়ে থাকলেই সেটা এতো নগণ্য যে তার সঙ্গে দেশভাগের বিশেষ সম্পর্ক নেই। অথচগত শতাব্দীর শেষের দিক থেকেই বিদ্বজনদের আলোচনায় উঠে আসতে থাকে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি বিষয়ে আরও কিছু তথ্য, আরও চুলচেরা বিশ্লেষণ। জয়া চ্যাটার্জির মতে হিন্দু ভদ্রলোকীয় সাম্প্রদায়িকতা ঐতিহাসিকদের নজর এড়িয়ে গেছে বিভিন্ন কারণে। পণ্ডিতরা ধরে নিয়েছিলেন সাম্প্রদায়িকতার তৈরি হয় কিছু ধর্মীয় প্রতীককে কেন্দ্র করে, যেমন মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো, গো-কোরবানি, মূর্তি ভাঙ্গা, উপাসনাস্থল এবং উপাসনার সময় নিয়ে বিবাদ (চ্যাটার্জি ১৯৯৪ পৃষ্ঠা ১৫০-১৫৩)। যেহেতু অধিকাংশ সময়েই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সঙ্গে এইসব উপসর্গ জড়িত ছিল,তাই কেউ কেউ রোগের লক্ষণ এবং তার কারণ একাকার করে ফেলেছেন।
সাম্প্রদায়িকতার প্রাচীনতর উৎস খুঁজতে গিয়ে জয়া চ্যাটার্জি নজর দিয়েছেন উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমে বাংলায় যে নতুন ধরণের সংস্কৃতি-কেন্দ্রিক ভদ্রলোক পরিচিতি তৈরি হয়, তার দিকে। উচ্চবর্ণ এবং উচ্চবিত্ত ভদ্রলোকেরা দাবী করতেন তাঁরা নবজাগরণের আলোয় ভারতের সাংস্কৃতিক গরিমা আবিষ্কার করেছেন আর সেই সংস্কৃতির ভিত্তি প্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্য।
বাংলায়, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে,ভদ্রলোক শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল অনেক কাল আগে থেকেই। সুরজিত সিনহা এবং রঞ্জিত ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন কিভাবে জটিল সামাজিক স্তরভেদ এড়িয়ে বাংলায় গ্রামীণ সমাজকে ভদ্রলোক আর ছোটলোক - মোটামুটিএই দু’ভাগে ভাগ করা হয়। আক্ষরিক অর্থে ভদ্রলোক হলেন তাঁরা, যাঁদের রুচি পরিশীলিত আর ব্যবহার মার্জিত। ওই সংজ্ঞা অনুযায়ী ভদ্রলোক হওয়ার জন্যে ধনী হওয়া আবশ্যক নয়। বাস্তবে গ্রামসমাজের ভদ্রলোকরা হলেন ব্রাহ্মণ, বৈদ্য আর কায়স্থ জাতিভুক্ত সকলেই, যাঁদের অধিকাংশই বিত্তবান কিন্তু ঐ জাতির বিত্তহীনরাও ভদ্রলোক। কোন অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত মধ্য এবং নিম্ন-অবস্থানের জাতিরাও ভদ্রলোক গণ্য হতে পারেন যদি তাঁদেরও যথেষ্ট ভূসম্পত্তি এবং প্রচুর জনসংখ্যা থাকে। অর্থাৎ শুধু সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে আর্থিক অবস্থাও ভদ্রলোক বিচারের মাপকাঠি। সেই হিসেবেই হিন্দু ভদ্রলোকরা জমিজমাওয়ালা মুসলমানদের ভদ্রলোক বলে গণ্য করেন। আবার অন্যদিকে অন্ত্যজ এবং আদিবাসী মানুষরা ভূসম্পত্তির মালিক হলেও তাঁদের ভদ্রলোক শ্রেণীভুক্ত করা হয় না, ছোটলোক তকমা থেকে তাঁদের মুক্তি নেই (সিনহা এবং ভট্টাচার্য ১৯৬৯)।
জয়া চ্যাটার্জি যে ভদ্রলোকদের কথা বলছেন তাঁরা অধিকাংশই শহরবাসী জমিদার ও ব্যবসায়ী, মেকলিয় শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে উপনিবেশ-নির্ভর। চিরাচরিত গ্রামীণ ভদ্রলোকদের তুলনায় তাঁদের আমরা নব্য-ভদ্রলোক বলতে পারি। এই নব্য-ভদ্রলোকেদের অনেকেরই চিন্তাভাবনা প্রবলভাবে হিন্দু চিন্তাভাবনায় প্রভাবিত ছিল। তাঁরা মনে করতেন ভারতে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ ঘটেছিল হিন্দু সমাজের সঙ্গে পশ্চিমী জাতীয়তাবাদ ও উপনিবেশের বিরোধ এবং সংমিশ্রণে। ভারতীয়দের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার মেকলিয় নিদান জারি হয় ১৮৩৫ সালে আর নব্য-ভদ্রলোকেরা সেই শিক্ষা গ্রহণ করার পরেও একচেটিয়া পাশ্চাত্য জ্ঞানশিক্ষার বিরোধিতা করেন। তাঁদের প্রতিবাদের হাতিয়ার হল বাছাই করা কিছু ভারতীয়ত্বের প্রতীক, যার অনেকটা ওই নব্য-ভদ্রলোকরা নিজেরাই সৃষ্টি করলেন।
নবজাগরণের কালে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য ধারণার সংমিশ্রণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ ভারতে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব। সেই ধারণায় দেশবোধ এবং হিন্দুধর্মবোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, দেশমাতৃকা হিন্দু দেবীর রূপ নিয়ে দেখা দেন। এই ভাবনার প্রতিনিধিত্বমূলক চেহারা দেখিব ঙ্কিমচন্দ্রের লেখায়। যদিও লেখক স্বয়ং আনন্দমঠকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলতে রাজি হননি, কিন্তু ওই রচনা ভারতে জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে যায়।
ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মতে ওই উপন্যাসের গোড়ায় কিছু ঐতিহাসিক গলদ ছিল। দেশমাতৃকা যাদের জননী, আনন্দমঠের সেই সন্তানরা ,
“...বাঙালি ব্রাহ্মণ কায়স্থের ছেলে, গীতা যোগশাস্ত্র প্রভৃতিতে পণ্ডিত; কিন্তু যে সব ‘সন্ন্যাসী ফকিরেরা’ সত্য ইতিহাসের লোক, এবং উত্তরবঙ্গে (বীরভূমে নহে) ওই সব অত্যচার করে, তাহারা এলাহাবাদ কাশী ভোজপুর প্রভৃতি জেলার পশ্চিমে লোক এবং প্রায় সকলেই নিরক্ষর, ভগবদগীতার নাম পর্যন্ত জানিত না। বঙ্কিমের সন্তানসেনা বৈষ্ণব, আর আসল “সন্ন্যাসীরা” ছিল শৈব, আজ পর্যন্ত তাহাদের নাগা-সম্প্রদায় চলিয়া আসিতেছে, যদিও ইংরেজের ভয়ে তাহারা এখন অস্ত্র রাখিতে বা লুঠ করিতে পারে না ... সত্যকার সন্ন্যাসী ফকিরেরা অর্থাৎ পশ্চিমে গিরিপুরীর দল, একেবারে লুঠেড়া ছিল, কেহ কেহ অযোধ্যা সুবায় জমিদারিও করিত; মাতৃভূমির উদ্ধার, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন উহাদের স্বপ্নেরও অতীত ছিল, এই মহাব্রত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের কল্পনায় সৃষ্ট কুয়াশা মাত্র” (সরকার ১৯৩৮)।
অধ্যাপক সরকারের নিজের ব্যাখ্যানেও ভদ্রলোকীয় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট, তিনি ‘পশ্চিমে’ সন্ন্যাসী ফকিরদের সম্পর্কে অবজ্ঞাসূচক উক্তি করেছেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র তাদের সরাসরি উচ্চবর্ণ ভদ্রলোক বানিয়ে ফেলেছেন এবং শৈবধর্ম থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কিছু পরে আমরা দেখব ভারতে দীর্ঘকাল যাবত বৈষ্ণবধর্ম উচ্চবর্ণ এবং উচ্চবিত্তদের পরিচিতির অংশ হয়ে থেকেছে।
ওই সময়ে পশ্চিমী প্রভাবের মোকাবিলায় হিন্দুধর্মের নানা নতুন রূপ নির্মাণ করা হয়। জয়া চ্যাটার্জির মতে এইসব ধারণা সৃষ্টি করা হয় এক গরিমাময় হিন্দু অতীতের চিহ্ন হিসেবে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে রচিত ইতিহাসে জাতীয় গর্ব ও সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাসের উপকরণ সংযুক্ত করা হল মূলত মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালির জন্য, যা পরে দেশের অন্যান্য অংশে ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়ে (পৃষ্ঠা ১৫৫-১৫৯)।
ওই পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কিছু হিন্দু দাবী করলেন একেশ্বরবাদী মুসলিম এবং খ্রিষ্টানদের মত তাঁরাও এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং নিরাকারবাদী। শুরুটা হল ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরেরব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। তার প্রায় পাঁচ দশক পরে ১৮৭৫ সালে দয়ানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠা করলেন একেশ্বরবাদী আর্য সমাজ। আর ১৮৯৯ সালে হিমালয়ের মায়াবতীতে স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠা করলেন অদ্বৈত আশ্রম। এটি যদিও রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা, ওই মিশনের অন্য মঠ বা মন্দিরের মত মায়াবতীতে কোন সাকার দেবতা বা অবতারের পুজো করা হয় না।
শিকলের যুদ্ধ
সাম্প্রদায়িকতাকে সাধারণত ধর্মীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক চিন্তা হিসেবে দেখা হয়, এই চিন্তা একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে উৎসাহ দেয়। এই ধরনেরর মনোভাব ভারতীয় সমাজে কখন কিভাবে এলো সেই বিষয়ে নানা পণ্ডিতের নানা মত। কেউ বলছেন মুসলমান শাসনের কালে এর উদ্ভব – কোন মহল সাম্প্রদায়িকতার জন্মদাতা পিতা হিসেবে আওরঙ্গজেবকে চিহ্নিত করে ফেলেছেন। এক বিজ্ঞজনের মতে শাহজাহানের পরে দারাশিকো সিংহাসনে বসলে ভারতবাসীর চিন্তাভাবনা নাকি অন্যরকম হত। আবার অনেকে বলেন মোগল আমল পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতা বড় সমস্যা ছিলো না, ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরে উপনিবেশিক শাসকরা সাম্প্রদায়িকতার প্রচার এবং প্রসার শুরু করে যাতে ভবিষ্যতে হিন্দু-মুসলিম একজোট হয়ে তাদের বিরোধিতায় নামতে না পারে।
এইসব গড়পড়তা আলোচনায় প্রাচীন ভারতে সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা বা ধর্মভিত্তিক হিংসা বিষয়ে আলোচনা অনেক সময়েই দেখতে পাওয়া যায়না। অথচ প্রাচীন হিন্দু স্মৃতিশাস্ত্রে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী মানুষদের অচ্ছুত অপাংক্তেয় বলা হয়েছে। আর যাদের বৌদ্ধদের সঙ্গে একই শ্রেণীতে রাখা হয়েছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্রাহ্মণ-হত্যাকারী মহাপাতক এবং ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বর্ণপ্রথার সমালোচক লোকায়ত এবং নাস্তিক দার্শনিকদের দল। স্মৃতিশাস্ত্র বিধান দিচ্ছে, কোন বৌদ্ধকে স্পর্শ করলে স্নান করতে হবে, বৌদ্ধ হিন্দু মন্দিরে প্রবেশ করলে সেই মন্দির অপবিত্র হয়। মৃচ্ছকটিক নাটকে উল্লেখ আছে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুসারীরা বৌদ্ধদের এতটাই ঘৃণা করত যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জনসমক্ষে পিটিয়ে মারা হত (আম্বেদকর ২০০২ পৃষ্ঠা ৪০১-৪০৫)। পাঠকদের মনে হতেই পারে এই চিত্রনাট্য সাম্প্রতিক সময়ের – কেবল কে কাকে পিটিয়ে মারছে তাদের পরিচিতি পালটে গেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূজারিণী কবিতায় বর্ণনা করেছেন পঞ্চম শতাব্দীতে মগধের রাজা অজাতশত্রু বৌদ্ধ ধর্মকে ‘শোণিতের স্রোতে’ মুছে ফেলেছিলেন, বৌদ্ধশাস্ত্ররাশি যজ্ঞের আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। একসময় যে আক্রোশ বৌদ্ধদের প্রতি দেখানো হয়েছিল, পরবর্তীকালে তার অভিমুখ ঘুরে যায় মুসলমানদের দিকে।
এই আক্রোশ এবং তার উৎপত্তির কারণ বোঝার জন্য বর্ণবিভক্তপ্রাচীন সমাজের দিকে তাকানো যাক। ওই সমাজের মূল ভাবনা ছিল সামাজিক অসাম্য –চতুর্থ বর্ণভুক্ত শূদ্র এবং যাদের বর্ণাশ্রমের বাইরে রাখা হয়েছিল সেই অন্ত্যজরা ছিলেন তিন উচ্চবর্ণের দাস। মনুস্মৃতিতে উল্লেখ আছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যেদের অধীনে সাত প্রকার দাস থাকত (১) যুদ্ধে পরাজিত ব্যক্তির থেকে ধৃত, (২) ক্রীতদাসী বা দাসীর সন্তান, (৩) যে উদরান্নের জন্য দাস হয়েছে, (৪) অপরের কাছ থেকে যাকে কেনা হয়েছে, (৫) অপর ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত, (৬) পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত, (৭) জরিমানা দিতে অক্ষম হয়ে যে স্বয়ং দাসত্ব বরণ করেছে। স্মৃতিকার পণ্ডিতদের মতে দাস (এবং নারীরা) মনুষ্যপদবাচ্য নয়। মনুস্মৃতি অনুযায়ী শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে ভোজনরত ব্রাহ্মণ যদি চণ্ডাল, শুয়োর, মুরগি, কুকুর, রজস্বলা নারী, ও ক্লীব ব্যক্তিকে দেখে ফেলে তাহলে তার ভোজন অশুচি হয়ে যায় (৩/২৩৯)। ভোজন নষ্ট হতে পারে যদি শুয়োর তা ঘ্রাণ করে, মুরগির ডানার বাতাস লাগে, কুকুর তাকিয়ে দেখে বা শূদ্র স্পর্শ করে(৩/২৪১)। ওই স্মৃতিশাস্ত্রে এবং মেধাতিথির ভাষ্যে বলা হয়েছে উচ্চ তিন বর্ণের সেবাই শুদ্রের একমাত্র বৃত্তি। প্রভুপরিতক্ত বস্ত্র, ছাতা, জুতো, তোষক শূদ্র ব্যবহার করবে। প্রভুর উচ্ছিষ্ট তার ভক্ষ্য (মনু ১০/১২৪, ১২৫, ৬/৯৭)। দাসের নিজস্ব কোন সম্পত্তি রাখার অধিকার ছিল না (৮/৪১৬) এবং দাসশূদ্রের ধন ব্রাহ্মণ অবাধে নিজের কাজে প্রয়োগ করতে পারতেন (৮/৪১৭)।
শূদ্রদের অনেকেরই গ্রামে বসবাস করার অধিকার ছিলনা। সৈরন্ধ্র বা কেশপ্রসাধক, সংবাহক বা ব্যাধ, মৈত্রেয়ক – যারা প্রভাতে ঘণ্টা বাজিয়ে রাজা ও অন্যান্যদের স্তুতিকীর্তন করতেন, মার্গব বা নৌচালক, কারাবর বা চর্মকার, সোপাক –যাঁদের রাজা নরহত্যার জন্য নিযুক্ত করতেন, পাণ্ডুসোপাক বা বাঁশের ব্যবসায়ী, মেধ, অন্ধ্র, মদ্গু জাতীয় পশুবধকারী, ধিগবন বা চর্মোপজীবী, বেন বা বাদ্যযন্ত্র বাদক, অন্ত্যাবসায়ী –যারা শ্মশানে থাকতেন ও মৃতদেহ সৎকার করতেন, তাঁদের গ্রামের বাইরে গাছতলায়, শ্মশানে, পর্বতে বা উপবনে বাস করতে হত (বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৯ পৃষ্ঠা ৩৭)।
যে অসংখ্য মানুষকে এই মর্মান্তিক অবস্থায় থাকতে বাধ্য করা হয়েছে এবং স্মৃতিশাস্ত্র অনুযায়ী যাদের দাসবৃত্তি থেকে কোন অবস্থাতেই মুক্তি নেই, তাঁরা শিকল ছিঁড়ে মুক্ত হতে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। প্রাচীনকালে তাঁদের জন্যে মুক্তির একটা রাস্তা ছিল বর্ণপ্রথা অস্বীকার করে বৌদ্ধধর্মে শরণ নেওয়া। বর্ণপ্রথা যাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রচুর সুবিধা দিয়েছে, বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাদের আক্রোশের কারণ আমরা অনুমান করতে পারি। পরবর্তীকালে ইসলাম সেই সুযোগ নিয়ে এলো চতুর্থ এবং অন্ত্যজ-বর্ণের মানুষদের জন্যে।
শিকল ছেঁড়ার সব লড়াই বৌদ্ধ বা ইসলামের মুখাপেক্ষী ছিল না, কিছু গোষ্ঠী ধর্মান্তকরণ ছাড়াই বর্ণপ্রথার বিরোধিতা করেছেন। উত্তর ভারতের সবর্ণ জাতিগুলো – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আর বৈশ্য – বিগত হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে সগুণী ধর্ম পালন করেছেন। এই ধর্মাচরণে বৈষ্ণব মতবাদ প্রবল এবং ভক্তরা বিষ্ণুর অবতার রাম অথবা কৃষ্ণের উপাসক, তারা সাধারণত তাদের উপাস্যের মূর্তি গড়ে পুজো করে। অপরপক্ষে বেশ কিছু শূদ্র এবং অন্ত্যজ সম্প্রদায় গত প্রায় পাঁচ শতাব্দী ধরে মূর্তি-পুজক বৈষ্ণবধর্ম থেকে সরে গিয়ে একাধিক নির্গুণী ধর্মীয় সম্প্রদায় তৈরি করেন। তাঁদের মধ্যে আছেন শিখ, কবিরপন্থী এবং নাথযোগী– যারা বর্ণপ্রথার বিরোধিতা করেন, এক ঈশ্বরের কথা বলেন এবং মূর্তিপুজো পরিত্যাগ করেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে বেদ, যোগ এবং তন্ত্রশাস্ত্রের কিছু অংশ গ্রহণ করেন যেগুলো সাধারণত সগুণীরা এড়িয়ে চলেন (লোরেঞ্জেন ১৯৯৫ পৃষ্ঠা ৩, ১৩)।
লক্ষ্য করার মত বিষয় হল নবজাগরণের কালে বংশানুক্রমে সগুণী কিছু ভদ্রলোক নির্গুণী দর্শনের অংশ ব্যবহার করেন হিন্দুধর্মের গরিমা বাড়াতে এবং নিজেদের পরিচিতি তৈরি করতে। সেই উদ্দেশ্যে তাঁরা হিন্দুশাস্ত্রের নানা উপাদানের মধ্যে থেকে একেশ্বরবাদী ও নিরাকারবাদী ধারণাগুলোকে বেছে নেন। ব্রাত্যজনের প্রতিবাদী দর্শনকে যখন ভদ্র-বাবুজনেরা নিজেদের পরিচিতির চিহ্ন হিসেবে খুঁজে নেন, তখন সেই চেষ্টাকে ইতিহাসের রসিকতা হিসেবে দেখা যেতে পারে। নবজাগরণীয় নিরাকারবাদীরা কিন্তু সামাজিকভাবে নির্গুণীদের সঙ্গে একাত্ম হননি, আবার নিজেদের গোষ্ঠীতেও খুব একটা জনপ্রিয় হতে পারেননি।
উচ্চবর্ণীয়দের বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি ঝোঁক অনেক পুরনো। রমাকান্ত চক্রবর্তীর মতে তাঁরা অপাংক্তেয়দের নিজেদের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করেছেন অ্যাকালচারেশন বা সাংস্কৃতিক উপযোজনের মাধ্যমে এবং বৈষ্ণব ধর্মকে এই কাজে ব্যবহার করেছেন। আমরা জানি, বাংলায় সর্বত্র সবাই একই ধর্মের অনুসারী ছিলেন না– ধনী জমিদারদের মধ্যে শৈব এবং শাক্তধর্মও জনপ্রিয় ছিল, আবার অনেক জায়গায় কৃষকরা ছিলেন বৈষ্ণব। বৈশ্যদের অনেকেই আবার বৌদ্ধ ছিলেন। চৈতন্যের আবির্ভাবকালে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৃষ্ণ, শিব এবং চণ্ডীর জনপ্রিয়তা প্রায় সমপরিমাণ ছিল। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের তরফ থেকে এই ধর্মীয় বৈচিত্র্যের বিরোধিতা করা হয়নি বিভিন্ন কারণে। প্রথমত – এই ধর্মাচরণের বিভিন্নতার মধ্যে বর্ণব্যবস্থার বিরোধিতা ছিল না। দ্বিতীয়ত –এর সঙ্গে পুরোহিত ব্রাহ্মণদের আর্থিক স্বার্থ জড়িত ছিল। এবং তৃতীয়ত – বিভিন্নতাকে স্বীকৃতি দিয়ে সাংস্কৃতিক উপযোজনের পথ খোলা রাখা হয়েছিল, কারণ সেই সময় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন ইসলাম ধর্মপ্রচারকরা (পৃষ্ঠা ১৪-১৫, ২০-২১)।
বৈষ্ণবধর্মকে ব্যবহার করে দূরে সরিয়ে রাখা মানুষদের কাছে টানার চেষ্টা খুব একটা সফল হয়নি। অধিকাংশ বাঙালির ইসলামধর্ম গ্রহণ ঠেকানো যায়নি আর যারা ইসলামধর্ম গ্রহণ করেননি তাঁরাও সকলে স্বদেশী ভদ্রলোক নেতাদের খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠেননি। এই প্রক্রিয়ার একটা উদাহরণ পাওয়া যায় স্বদেশী আন্দোলনের প্রথম দিকে। ১৯০৫ সালে প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের সময় হিন্দু ভদ্রলোক নেতাদের প্রধান চেষ্টা ছিল মুসলিমদের সঙ্গে নিয়ে ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করা। কিন্তু মুসলিম সমাজের একটা বড় অংশ মনে করতেন প্রদেশ ভাগ হলে তাঁদের সুবিধে হবে, সরকার তাঁদের সমস্যাগুলোর প্রতি বেশি নজর দেবে। সেই সময় নমশূদ্র সমাজের নেতারা মুসলিমদের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়ান। ঢাকা নমশূদ্র হিতৈষিণী সমিতির কর্মকর্তারা ১৯০৫ সালে সরকারী অধিকারীদের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গভঙ্গে সম্মতি জানান এবং মুসলিম সমাজের মত একই ধরণের সুযোগসুবিধে দাবী করেন। পরে মতুয়া সম্প্রদায়ের নেতা গুরুচাঁদ ঠাকুরের ছেলে শশীভূষণ ঢাকার নবাব সলিমুল্লার সঙ্গে দেখা করেন এবং উভয়ে মিলে স্থির করেন মুসলিম এবং নমশূদ্ররা কেউই বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করবেন না।
পরবর্তীকালে নমশূদ্ররা তাঁদের সবর্ণ-ভদ্রলোক-বিরোধী অবস্থানকে আরও শক্ত করেন। ১৯০৬ সালে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে নমশূদ্র সমাজের পিছিয়ে থাকার কারণ তাঁদের প্রতি ব্রাহ্মণ, বৈদ্য আর কায়স্থদের ঘৃণা। তাই নমশূদ্র সমাজে ওই ভদ্রলোকদের বা তাদের আন্দোলনের প্রতি কোন সহানুভূতি নেই। তারা বরং মুসলিম ভাইদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলবে (শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৭ পৃষ্ঠা ৬৪-৬৫)।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত নমশূদ্ররা চণ্ডাল নামে পরিচিত ছিলেন। ওই নামের সঙ্গে এতটাই গ্লানি জড়িয়ে ছিল যে একটা নতুন নাম অবলম্বন করে তাঁরা একটা নতুন পরিচিতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ভারতের বর্ণবিভক্ত সমাজে তাঁদের অবস্থান কেমন ছিল, তার মধ্যেই নিহিত আছে বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের সূত্র। মনুসংহিতার বিধান অনুযায়ী চণ্ডাল বাস করবে গ্রামের বাইরে। তাদের পরিধেয় মৃতদেহ থেকে সংগৃহীত বস্ত্র, আহার ভগ্নপাত্র থেকে, তারা লোহার বালা প্রভৃতি পরে অনবরত একস্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়াবে এবং তাদের সম্পত্তি হবে কুকুর, গর্দভ (১০/৫০) (সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৯ পৃষ্ঠা ৩৭)।
যখন মেনে নেওয়া হয় সাম্প্রদায়িকতা মানে কেবলমাত্র অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ, তখন একই ধর্মে বিশ্বাসী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি বিদ্বেষকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আওতার বাইরে রাখা যায়। তাই হিন্দুত্ব নামক ধারণার প্রয়োজন হয় বর্ণ-জাতি-নির্বিশেষে সবাইকে একটা কাল্পনিক সংস্কৃতির মোড়কে পুরে ফেলার জন্যে, অনেক চলমান বিদ্বেষকে গালচের তলায় লুকিয়ে ফেলা যায়।
দুইয়ে পক্ষ তিনে নেত্র
যাঁরা হিন্দুধর্মবোধের মধ্যে দেশবোধ খুঁজছিলেন, যাঁদের কাছে দেশমাতৃকা সগুণী ঘরানার দেবীমূর্তি, সেই নব্য-ভদ্রলোকদের জাতীয়তাবাদের ভাষ্যে ‘আমরা-ওরা’ ভেদ খুব পরিষ্কার। এক্ষেত্রে ‘আমরা’ একমাত্রিক হলেও ‘ওরা’ কিন্তু একের বেশি । ‘আমরা’ যখন মুসলমান-পক্ষকে প্রধান শত্রু ঘোষণা করেছে, তখন নমশূদ্র এবং অন্যান্য প্রান্তিক জাতিদের সম্পর্কে নরম অবস্থান নেওয়া হয়েছে, হয়তো তারা ভবিষ্যতে ভদ্রলোকদের সঙ্গে হাত মেলাবে এবং মুসলমানদের শত্রু ঘোষণা করবে – এই আশায়।
সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে স্বদেশী আন্দোলনের যোগ ছিল এবং কিছুদিন তিনি হাওড়া জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতিত্বও করেছিলেন। তাঁর ‘হিন্দু মুসলমান সমস্যা’ বিষয়ে বক্তব্য সেই সময়ে মূলধারার জাতীয়তাবাদী অবস্থান হিসেবে গণ্য করা যায়।
১৯২৬ সালে তিনি বলছেন, “বছর-কয়েক পূর্বে, মহাত্মার অহিংস অসহযোগের যুগে এমনি একটা কথা এদেশে বহু নেতায় মিলিয়া তারস্বরে ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, হিন্দু-মুসলিম মিলন চাই-ই। চাই শুধু কেবল জিনিসটা ভাল বলিয়া নয়, চাই-ই এইজন্য যে, এ না হইলে স্বরাজ বল, স্বাধীনতা বল, তাহার কল্পনা করাও পাগলামি... তার পরে এই মিলন-ছায়াবাজীর রোশনাই যোগাইতেই হিন্দুর প্রাণান্ত হইল। সময় এবং শক্তি কত যে বিফলে গেল তাহার ত হিসাবও নাই। ইহারই ফলে মহাত্মাজীর খিলাফৎ-আন্দোলন, ইহারই ফলে দেশবন্ধুর প্যাক্ট। অথচ এতবড় দুটা ভুয়া জিনিসও ভারতের রাষ্ট্রনীতিক ক্ষেত্রে কম আছে ... বস্তুতঃ, মুসলমান যদি কখনও বলে—হিন্দুর সহিত মিলন করিতে চাই, সে যে ছলনা ছাড়া আর কি হইতে পারে, ভাবিয়া পাওয়া কঠিন... মিলন হয় সমানে সমানে। শিক্ষা সমান করিয়া লইবার আশা আর যেই করুক আমি ত করি না। হাজার বৎসরে কুলায় নাই, আরও হাজার বৎসরে কুলাইবে না। এবং ইহাকেই মূলধন করিয়া যদি ইংরাজ তাড়াইতে হয় ত সে এখন থাক। মানুষের অন্য কাজ আছে।’’
হিন্দু এবং মুসলমানকে আলাদা সম্প্রদায় এবং আলাদা জাতি চিহ্নিত করে ইতিহাসের যে ব্যাখ্যান উপনিবেশিক কালে তৈরি হয়েছিল, তারই প্রতিধ্বনি শরৎচন্দ্রের কথায় স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।
“হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ। সুতরাং এ দেশকে অধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই। মুসলমান মুখ ফিরাইয়া আছে তুরস্ক ও আরবের দিকে,—এ দেশে চিত্ত তাহার নাই। যাহা নাই তাহার জন্য আক্ষেপ করিয়াই বা লাভ কি, এবং তাহাদের বিমুখ কর্ণের পিছু পিছু ভারতের জলবায়ু ও খানিকটা মাটির দোহাই পাড়িয়াই বা কি হইবে! আজ এই কথাটাই একান্ত করিয়া বুঝিবার প্রয়োজন হইয়াছে যে, এ কাজ শুধু হিন্দুর,—আর কাহারও নয়।’’
তাঁর বক্তব্যে অন্য একটি পক্ষের কথাও আছে।
“...হিন্দুর সমস্যা এ নয় যে, কি করিয়া (মুসলমানের সঙ্গে) অস্বাভাবিক মিলন সংঘটিত হইবে; হিন্দুর সমস্যা এই যে, কি করিয়া তাঁহারা সঙ্ঘবদ্ধ হইতে পারিবেন এবং হিন্দুধর্মাবলম্বী যে-কোন ব্যক্তিকেই ছোট জাতি বলিয়া অপমান করিবার দুর্মতি তাঁহাদের কেমন করিয়া এবং কবে যাইবে’’ (১৯৫১ পৃষ্ঠা ৩৯৭ – ৪০২)।
এই বক্তব্য যখন শরৎচন্দ্রের মুখে শোনা যাচ্ছে, সেই সময়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবকসঙ্ঘ তৈরি হচ্ছে হিন্দুদের সঙ্ঘবদ্ধ করার এবং হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করার লক্ষ্যে। সঙ্ঘের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি গোলওয়ালকারের মতে হিন্দুরাষ্ট্র একটি সাংস্কৃতিক ধারণা, ‘আমাদের’ প্রাচীন এবং মহান সংস্কৃতি তার প্রাণ-বায়ু। কেবলমাত্র ওই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে তুলেই ভারতের জাতীয় জীবনে অসংখ্য সমস্যার সমাধান সম্ভব (২০০০)।
ওই সংস্কৃতি একেবারেই আমাদের এবং এক্ষেত্রে আমরা অর্থ হিন্দু। হিন্দুদের মধ্যেও তো নানারকম সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আছে, ধর্মীয় পন্থার প্রকারভেদ আছে। তাহলে এক্ষেত্রে কোন অংশের সংস্কৃতির কথা বলা হচ্ছে? সেই বিষয়টিও গোলওয়ালকার পরিষ্কার করে দিয়েছেন। বলেছেন পুরুষ সুক্ত অনুযায়ী হিন্দুসমাজ এক বিরাট পুরুষ, স্বয়ং ভগবানের রূপ। তাঁর দুই চোখ চাঁদ আর সূর্য, তাঁর নাভি থেকে সৃষ্টি হয় আকাশ এবং নক্ষত্র, ব্রাহ্মণ তাঁর মস্তক, রাজা বা ক্ষত্রিয় তাঁর বাহু, বৈশ্য তাঁর উরু এবং শূদ্র তাঁর পা।
হিন্দুসমাজের এই চিত্রকল্পে বর্ণভেদ এবং সামাজিক অসাম্যকে দৈব চেহারা দেওয়া হয়েছে এবং ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব শিরোধার্য করা হয়েছে, যাকে সাধারণভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলা হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বর্ণ এবং জাতিব্যবস্থাকে দূর করার কোন চেষ্টা করলে সেটা হবে ‘প্রাচীন এবং মহান সংস্কৃতি’র বিরোধিতার সামিল।
গোলওয়ালকারের ভাষ্যে বর্ণভেদ এবং তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত জাতিপ্রথা (যাকে প্রায় সব ভারতীয়রা এইকালে কাস্ট বলেন কেননা দেশের সরকার তাই বলেন) মেনে নেওয়া হয়েছে, যদিও কিছু অস্বস্তি জানানো হয়েছে অস্পৃশ্যতা বিষয়ে। তাঁর মতে, দেশের সাধারণ মানুষ মনে করেন অস্পৃশ্যতা তাঁদের ধর্ম আচরণের অংশ এবং ওই প্রথা না মেনে চললে সেটা খুবই পাপকাজ হবে। তিনি লক্ষ্য করেছেন, বিভিন্ন ধর্মগুরু এবং সমাজ-সংস্কারকের চেষ্টা সত্ত্বেও অবস্থা বিশেষ পালটায়নি। সামান্য পরেই তিনি অস্পৃশ্যতা প্রসঙ্গে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে চলে গেছেন – বর্ণহিন্দুরা হরিজনদের ওপর আক্রমণ করছে বলে যেসব খবর কাগজে ছাপা হচ্ছে, তাঁর মতে সেগুলো অনেক সময়েই অসত্য।
মুসলমানদের বিষয়ে বঙ্গীয় নব্য-ভদ্রলোক জাতীয়তাবাদীদের এবং সঙ্ঘী হিন্দুরাষ্ট্রবাদীদের বক্তব্যে বিশেষ তফাৎ পাওয়া যায়না। গোলওয়ালকারের মতে মুসলমানরা ভারতে এসেছেন আক্রমণকারী হিসেবে ও থেকেছেন শাসক হিসেবে, তাঁরা সেই মানসিকতা থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পারেনি। সেই মানসিকতা থেকেই তাঁরা মন্দির অপবিত্র করেছেন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বাধা দিয়েছেন, গো-মাতাকে খাদ্য হিসেবে দেখেছেন, মাতৃসমা নারীদের উৎপীড়ন করেছেন। জয়া চ্যাটার্জি তাঁর লেখায় এই পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাসচর্চারই সমালোচনা করেছেন, কেননা এই চেষ্টা আসলে অমুসলমানদের মধ্যে বহমান সাম্প্রদায়িকতাকে আড়াল করার চেষ্টা।
গোলওয়ালকার অবশ্য মুসলমান-সমস্যার একটি সহজ সমাধান বাতলে দিয়েছেন। যেহেতু তাদের পূর্বপুরুষ হিন্দু, অতএব মুসলমানদের উচিত আগ্রাসী শাসকসুলভ মনোভাব ছেড়ে সম্মানের সঙ্গে হিন্দুসমাজে ফিরে যাওয়া। তিনি অবশ্য স্পষ্ট করে বলেননি ফিরে যাওয়া মানুষের স্থান হিন্দুসমাজ নামক বিরাট পুরুষের দেহের কোন অংশে হবে, মস্তক, বাহু, উরু অথবা পদ নাকি অন্ত্যজদের মত দেহের বাইরে– কোথায় থাকলে সেই প্রতিশ্রুত সম্মান যথাযথ পাওয়া যাবে।
সৈয়দ ফেরদৌসের দেশভাগ বিষয়ক একটি বই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে যেখানে তিনি কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশে বসবাসকারী সামসুল নামে এক বিহারী ব্যক্তি দেশভাগের আগের সময়ের কথা বলেছেন। এক সকালে চায়ের দোকানে কেউ খবরের কাগজ পড়ছিলেন। সামসুল উঁকি দিয়ে খবরের কাগজের দিকে তাকাতে এক হিন্দু বাবু সামসুলকে বলেন, ‘খবরের কাগজ পড়ছ? নেতা হবার ইচ্ছে আছে নাকি?’ সেদিন কোন কথা না বলে ওই জায়গা ছেড়ে চলে এসেছিলেন সামসুল, কিন্তু সেই অপমান অনেকদিন পরেও ভোলেননি। সামসুলের মা বলেছিলেন হিন্দুরা কখনও মুসলমানদের উন্নতি সহ্য করতে পারেনা। তাই সামসুলের মনে হয়েছে মুসলমানদের আলাদা দেশ থাকা উচিত।
বাংলাদেশের জন্ম মুসলিম জাতিসত্ত্বার তত্ত্বকে একাধিক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সৈয়দ ফেরদৌস সেই প্রশ্ন আবার একবার তুলে এনেছেন। তাঁর মতে বাংলাদেশের জন্ম দেখিয়ে দিয়েছে (পূর্ব পাকিস্তানের) অধিকাংশ মানুষ আসলে পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না, যদিও সেই সময় দেশভাগ ও পাকিস্তানের সৃষ্টি পূর্ববঙ্গের কৃষকসমাজে মুক্তির অনুভুতি এনে দিয়েছিল। লেখক বাংলাদেশের বিহারী জনগোষ্ঠীর উদাহরণ দিয়ে বলেছেন ,যাদের একসময় দেশভক্ত পাকিস্তানী মনে করা হত, পরবর্তীকালে সেই মানুষদেরই দোষারোপ করা হল বাংলাদেশের প্রতি বেইমানির দায়ে (২০২২ পৃষ্ঠা ২-৪)।
বিপ্রতীপে
জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ বিষয়ে নানা রঙের ভাষ্য আমরা শুনেছি , কিন্তু সব ভাষ্য সমান গুরুত্ব দিয়ে শুনেছি কি? বাঙলার জাতীয়তাবাদী বা মহারাষ্ট্রের রাষ্ট্রবাদী ব্যাখ্যান ভালো করে দানা বাধার আগেই রবীন্দ্রনাথ ভারতে এবং বিশ্বের অন্যত্র জাতীয়তাবাদের বিকাশ নিয়ে গোটাকয় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেইসব বক্তৃতা ইংরেজিতে বই আকারে ছাপা হয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। নেশনালিজম শীর্ষক বইতে (১৯১৭)রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, অতীতে এবং সাম্প্রতিক কালেও ভারতের প্রধান সমস্যা ছিল রেস-এর বিভিন্নতা। ওই ইংরেজি শব্দ এককালে মানবজাতির মধ্যে শারীরিক বিভিন্নতা বোঝাতে প্রয়োগ করা হত। তাঁর বক্তৃতায় এবং লেখায় রবীন্দ্রনাথ ওই শব্দ প্রয়োগ করেছেন সম্ভবত বিদেশী শ্রোতাদের বর্ণপ্রথা বোঝাবার জন্যে। তাঁর মতে এই সমস্যা আমরা ভারতীয়রা কিভাবে মোকাবিলা করছি, সেটাই প্রমাণ করবে আমরা কতটা মানবিক। এবং এই সমস্যা সমাধান না করলে আমাদের অন্য কোন বিষয়েই উন্নতির আশা নেই।
যখন ইয়োরোপ থেকে জাতীয়তাবাদের ধারণা আমদানি করা হচ্ছে, সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ইয়োরোপীয় নেশনগুলোর সঙ্গে ভারতীয় সমাজের মূল প্রভেদের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণকরছেন। বলছেন, জগতে কিছু দেশ আছে যাদের শক্তি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা বা বৈরি প্রতিবেশীদের মোকাবিলা করতেই ব্যয় হয়। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে এই প্রতিকূলতা ঘরের ভেতরে। আমাদের ইতিহাস সামাজিক বোঝাপড়ার ইতিহাস, অন্যদের আক্রমণ করা বা আক্রমণ প্রতিহত করার ইতিহাস নয়।
জাতিরাষ্ট্রের সাধনা ইয়োরোপে কি চেহারা নিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে সেটা আমাদের কোন রাস্তায় নিয়ে যেতে পারে সেই বিষয়টাও তিনি উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, এক ছাঁচে ঢালা বিশ্বজনীনতা বা জাতিরাষ্ট্রের উগ্র-আরাধনা কোন মানব সমাজের লক্ষ্য হতে পারেনা। ভারত একদিকে তার বিবিধতাকে সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে, অন্যদিকে তার আধ্যাত্মিকতার মধ্যে ঐক্য খুঁজেছে। এই শক্তির কথা বলার সঙ্গে ভারতীয় সমাজের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ভারতীয় সমাজ তার জাতিগুলোর মধ্যে অনতিক্রম্য প্রাচীর তোলার মত মারাত্মক ভুল করেছে, তার সন্তানদের মধ্যে হীনমন্যতা তৈরি করেছে, তাদের জোর করে একটা ছাঁচে ঢালা সামাজিক ব্যবস্থায় সামিল করার চেষ্টা করেছে।
এইক্ষেত্রে জাতি শব্দ ব্যবহার হয়েছে ইংরেজি কাস্ট বোঝাবার জন্যে, সেগুলো এমন জনগোষ্ঠী যাদের অনেকেরই বংশানুক্রমিক পেশা আছে এবং যারা সাধারণত নিজেদের মধ্যে বিবাহসম্পর্ক স্থাপন করতে পছন্দ করে। রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন, অনেক শতাব্দী ধরে নতুন নতুন পরীক্ষা হয়েছে এই সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় আনার জন্যে।
প্রাচীন বর্ণপ্রথায় যারা সামিল ছিলো না এমন অসংখ্য অতিথি পরবর্তীকালে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের অভ্যাস আর প্রয়োজন অন্যদের থেকে ভিন্ন। এর ফলে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতে ভারতের আধ্যাত্মিক শিক্ষকরা শিখিয়েছেন সহানুভূতিশীল হতে আর মানুষের ঐক্য বিষয়ে সৎ থাকতে। তাই ভারতের ইতিহাসে সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন তত বেশি গুরত্ব পায়নি, যতটা পেয়েছে আমাদের সামাজিক আর আধ্যাত্মিক ইতিহাস। তাঁর মতে,আমাদের সেই সামাজিক কাজ সম্পন্ন হবার আগেই অন্য এক বিশ্ব আমাদের বন্যার মত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু নতুন নতুন উপাদান আসছে ভারতীয় সমাজে তাই আরও বড় মাপে সমন্বয় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। পশ্চিমী বিশ্ব আমাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে বাণিজ্য আর রাজনীতি মানবতাকে ছেঁটে কেটে বস্তাবন্দি করে পণ্য করেছে বৈজ্ঞানিক নিপুণতায় (পৃষ্ঠা ১৪-১৭)।
রবীন্দ্রনাথ ভারতের ক্ষেত্রে জাতিরাষ্ট্রের বিষয়টি বিচার করেছেন ইতিহাসের অভিজ্ঞতা দিয়ে। ভারতীয় মুসলমান আলাদা নেশন কিনা সেই বিষয়ে বলেছেন, মোগল এবং পাঠান ভারতে এসেছিল আক্রমণকারী হিসেবে কিন্তু ভারতীয়রা তাদের দেখেছে বিভিন্ন জাতি হিসেবে যাদের ধর্ম, সামাজিক প্রথা, পছন্দ-অপছন্দ আলাদা। কখনই তাদের নেশন হিসেবে দেখা হয়নি। ভারতের মানুষ তাদের ভালবেসেছে, ঘৃণা করেছে, তাদের পক্ষে এবং বিপক্ষে লড়াই করেছে, তাদের ভাষা বলেছে, তারা ভারতীয় ভাষা শিখেছে। এইক্ষেত্রে জাতি অর্থ কাস্ট নয়, বরং তাকে সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন উপনিবেশিক কালে অবস্থাটা আলাদা হয়ে গেল– এইবার যারা ভারতীয়দের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সেই বিদেশীরা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী নয়, তারা নেশন। তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে যে ভারতীয় সমাজ তারা অতীতে কখনও নেশন ছিলোনা।
এই দুই রকমের ব্যবস্থার উদ্দেশ্য এবং পন্থা অনেকটাই আলাদা। রবীন্দ্রনাথের মতে নেশনকে যখন মানুষের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমষ্টি হিসেবে দেখা হয়, তখন সব মানুষকে তার নামে সঙ্ঘবদ্ধ করা যায় কোনও যান্ত্রিক স্বার্থের জন্য। অন্যদিকে, একটা সমাজ কোন লক্ষ্য পুরনের স্বার্থে চলেনা –মানুষের মধ্যে যেসব সম্পর্ক আছে সমাজ সেগুলোর প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে– তার মধ্যে দিয়ে মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতা বিকশিত হয় এবং সমাজ নিজেকে রক্ষার কাজ করে। অন্যদিকে নেশন নিজের শক্তি এবং ধন বৃদ্ধি করে বিজ্ঞান ও সামাজিক সংগঠনের সাহায্য নিয়ে এবং অবিশ্বাস্য গতিতে তার নিজের সীমানা অতিক্রম করে। সে তার প্রতিবেশিদের থেকে সম্পদ ছিনিয়ে নেয় নিজে ধনী হবার জন্য। এইভাবে প্রতিবেশীদের মধ্যে হিংসা ও ভয় সঞ্চার করে। একটা সময় আসে যখন সে আর থামতে পারে না, প্রতিযোগিতা তীব্রতর হয়, স্বার্থপরতা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে যায়। নেশনভুক্ত সমাজে এই শক্তি ক্রমশ বাড়তে থাকে, একসময় এটাই সমাজের চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায় (পৃষ্ঠা ১৯-২০)।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের ওই সর্বব্যাপী সর্বনাশা চালিকাশক্তির বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ভারতের মূল সমস্যা রাজনৈতিক নয়, বরং সামাজিক। পশ্চিমী সমাজকে রাজনীতি গ্রাস করেছে, আমরা সেই পশ্চিমকে নকল করছি। তিনি মনে রাখতে বলেছেন যে ইয়োরোপে বিশেষ জাতি-বৈচিত্র ছিলোনা এবং সেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব ছিল। তাই তাদের সভ্যতায় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আগ্রাসনের প্রাবল্য। প্রতিবেশীদের সঙ্গে শত্রুতার মধ্যে দিয়েই তারা তাদের সমস্যা মেটাতে চেষ্টা করত। আগে তারা প্রতিবেশীদের লুঠ করত, এখন তারা সারা বিশ্বকে লুঠ করছে। অন্যদিকে ভারত তার ইতিহাসের আদিকাল থেকেই বর্ণ আর জাতি সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ভারতীয়দের বুঝতে হবে, যদি আমরা আমাদের সমাজের মূল সমস্যাগুলো এড়িয়ে গিয়ে ‘রাজনৈতিক’ হওয়ার চেষ্টা করি তাহলে আমরা অন্যদের কাছে হাসির পাত্র হয়ে যাব। মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারত এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা অনেক দিন ধরেই করে আসছে। নানক, কবির, চৈতন্য এবং আরো অনেকেই জাতি-সমস্যা এবং সামাজিক-অসাম্য সরিয়ে ঐক্যের সন্ধান করেছেন (পৃষ্ঠা ১১৭-১২০)।
রবীন্দ্রনাথ যে আধ্যাত্মিক শিক্ষার কথা বলেছেন, যার মূলে আছে মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীলতা এবং ঐক্যের প্রতি সততা, সেই শিক্ষার সারাৎসার নেশনালিজম বইয়ের ছত্রে ছত্রে। অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়ানোর আগে সামাজিক অসাম্যের অবসান দরকার, তাঁর এই কথা আজ আমরা অহরহ উপলব্ধি করছি। এখন আমরা নিজেদের প্রশ্ন করতে পারি, ওই আত্মদম্ভী নেশনালিজমের ভাবনা না থাকলে দ্বিজাতিতত্ব পায়ের তলায় কতটা জমি পেত।
যে সময় রবীন্দ্রনাথ নেশনালিজম বিষয়ে বলছেন এবং লিখছেন, প্রায় সেই সময়েই লিখছেন ঘরে বাইরে উপন্যাস (১৯২৬, প্রথম প্রকাশ ১৯১৫)। ওই কাহিনীর মূল চরিত্র নিখিলেশ একজন নব্য-ভদ্রলোক জমিদার, কিন্তু তিনি একান্তই দলছুট। তাঁর মধ্যে আমরা ঘরে বাইরের লেখককেই দেখতে পাই। নিখিলেশ উগ্র-জাতীয়তাবাদ ও উগ্র-দেশপ্রেমের বিরোধীতা করছেন– তিনি কৃষকদের স্বার্থকে নিজের জমিদারি স্বার্থের ওপর জায়গা দিচ্ছেন।
নিখিলেশের স্ত্রী বিমলা বলছেন,
“স্বদেশী কাণ্ডর সঙ্গে যে আমার স্বামীর যোগ ছিলোনা বা তিনি এর বিরুদ্ধে ছিলেন তা নয়। কিন্তু ‘বন্দে মাতরম’ মন্ত্রটি তিনি চূড়ান্ত করে গ্রহণ করতে পারেন নি। তিনি বলতেন, দেশকে আমি সেবা করতে রাজি আছি, কিন্তু বন্দনা করব যাকে তিনি ওর চেয়ে অনেক ওপরে। দেশকে যদি বন্দনা করি তবে দেশের সর্বনাশ করা হবে“ (পৃষ্ঠা ৩০)।
এক জায়গায় নিখিলেশ বলছেন,
“দেশকে সাদাভাবে সত্যভাবে দেশ ব’লেই জেনে, মানুষকে মানুষ ব’লেই শ্রদ্ধা করে, যারা তার সেবা করতে উৎসাহ পায়না, চীৎকার করে মা বলে দেবী বলে মন্ত্র পড়ে যাদের কেবলই সম্মোহনের দরকার হয়, তাদের সেই ভালোবাসা দেশের প্রতি তেমন নয় যেমন নেশার প্রতি” (পৃষ্ঠা ৫৪)।
স্বদেশী আন্দোলনকে ভদ্রলোক নেতাদের বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। নিখিলেশের উক্তিতে,
“এমন সময়ে স্বদেশীর বান খুব প্রবল হয়ে এসে পড়ল ...এরা একদিন দল বেঁধে আমার কাছে এসে উপস্থিত। বললে, আমাদের শুকসায়রের হাট থেকে বিলিতি সুতো র্যােপার প্রভৃতি একেবারে উঠিয়ে দিতে হবে।
আমি বললুম, সে আমি পারব না।
তাঁরা বললে, কেন, আপনার লোকসান হবে? বুঝলুম, কথাটা আমাকে একটু অপমান করে বলবার জন্যে। আমি বলতে যাচ্ছিলুম, আমার লোকসান নয়, গরীবের লোকসান।
মাস্টারমশায় ছিলেন; তিনি বলে উঠলেন, হাঁ, ওঁর লোকসান বৈকি, সে লোকসান তো তোমাদের নয়।
তারা বললে, দেশের জন্যে –
মাস্টারমশায় তাদের কথা চাপা দিয়ে বললেন, দেশ বলতে মাটি তো নয়, এই সমস্ত মানুষই তো। তা তোমরা কোনোদিন একবার চোখের কোণে এদের দিকে তাকিয়ে দেখেছ? আর, আজ হঠাৎ মাঝখানে পড়ে এরা কি নুন খাবে আর কি কাপড় পরবে তাই নিয়ে অত্যাচার করতে এসেছ, এরা সইবে কেন, আর এদের সইতে দেব কেন?” (পৃষ্ঠা ১৭৩-১৭৪)।
স্বদেশীওয়ালাদের প্রতি নিখিলেশের বিরাগ দেখা গেল বটে, কিন্তু বিদেশী শাসকের প্রতি তাঁর মনোভাব অতি কঠোর। তিনি বলছেন,
“বড় বড় ডাকাত-সভ্যতারও জবাবদিহির দিন কখন আসে তা বাইরে থেকে দেখা যায় না। ওদের পলিটিক্সের ঝুলি-ভরা মিথ্যা কথা, প্রবঞ্চনা, বিশ্বাসঘাতকতা, গুপ্তচরবৃত্তি, প্রেস্টিজ রক্ষার লোভে ন্যায় ও সত্যকে বলিদান, এই যে সব পাপের বোঝা নিয়ে চলেছে, এর কি ভার কম? আর, এ কি প্রতিদিন ওদের সভ্যতার বুকের রক্ত শুষে খাচ্ছে না?” (পৃষ্ঠা ৪৪)।
নিখিলেশের এই উক্তির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের যে দূরদৃষ্টি ছিল তা প্রমাণ করে দিয়েছে দু’খানা বিশ্বযুদ্ধ এবং ফ্যাসিস্ত শক্তির উত্থান। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে উপলব্ধি করেছেন উপনিবেশিক শক্তি কিভাবে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে।
“ইংরেজকে একদা মানব-হিতৈষী রূপে দেখেছি এবং কী বিশ্বাসের সঙ্গে ভক্তি করেছি। যুরোপীয় জাতির স্বভাবগত সভ্যতার প্রতি বিশ্বাস ক্রমে কী করে হারানো গেল তারি এই শোচনীয় ইতিহাস আজ আমাকে জানাতে হল। সভ্য-শাসনের চালনায় ভারতবর্ষের সকলের চেয়ে যে দুর্গতি আজ মাথা তুলে উঠেছে সে কেবল অন্ন বস্ত্র শিক্ষা এবং আরোগ্যের শোকাবহ অভাব মাত্র নয়; সে হচ্ছে ভারতবাসীর মধ্যে অতি নৃশংস আত্মবিচ্ছেদ, যার কোনো তুলনা দেখতে পাইনি ভারতবর্ষের বাইরে মুসলমান স্বায়ত্ব শাসন-চালিত দেশে। আমাদের বিপদ এই যে, এই দুর্গতির জন্যে আমাদেরই সমাজকে একমাত্র দায়ী করা হবে। কিন্তু এই দুর্গতির রূপ যে প্রত্যহই ক্রমশ উৎকট হয়ে উঠেছে সে যদি ভারত-শাসনযন্ত্রের ঊর্ধ্বস্তরে কোনো এক গোপন কেন্দ্রে প্রশ্রয়ের দ্বারা পোষিত না হত তাহলে কখনোই ভারত-ইতিহাসের এত বড়ো অপমানকর অসভ্য পরিণাম ঘটতে পারত না“ (১৩৪৮ (ইং ১৯৪১) পৃষ্ঠা ৬)।
আমরা অনেকেই সন্দীপ এবং তার সতীর্থদের দেশভক্তির হুঙ্কারে মুগ্ধ হয়ে থাকলাম, মৃদুভাষী নিখিলেশের যুক্তি শোনবার সময় আমাদের হলনা। সময় থাকতে যদি তার কথাও খানিক শুনতাম, দেবীমূর্তি ছেড়ে দেশের মানুষকে দেশ ভাবতাম, তাহলে ‘নৃশংস আত্মবিচ্ছেদ’-এর দুর্গতি হয়ত খানিক পরিমাণে এড়িয়ে যাওয়া যেত।
তথ্যসূত্র :
চক্রবর্তী রমাকান্ত ১৯৯৬ বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম, কলিকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।
চট্টোপাধ্যায় শরৎচন্দ্র বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা,শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (অষ্টম সম্ভার) ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) কলকাতা,এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্সপৃষ্ঠা ৩৯৭ – ৪০২
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ (১৯১৫) ঘরে বাইরে কলিকাতা, বিশ্বভারতী- গ্রস্থালয়।
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথবঙ্গাব্দ ১৩৪৮ (ইং ১৯৪১) সভ্যতার সঙ্কট কলিকাতা, বিশ্বভারতী।
বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্র ১৯৯৯ মনুসংহিতা, কলিকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।
সরকার, যদুনাথ ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ) আনন্দমঠ বঙ্কিম শত-বার্ষিক সংস্করণের ভূমিকা, কলিকাতা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ
Ambedkar B. R. 2002 Origin of Untouchability In The Essential Writings of B. R. Ambedkar Valerian Rodrigues (editor) New Delhi, Oxford University Press.
Bandyopadhyay, Sekhar 1997 Caste, Protest and Identity in Colonial India: The Namasudras of Bengal, Surrey, Curzon Press Chatterji, Joya 1994 Bengal divided:Hindu communalism and partion, 1932-1947, Cambridge, Cambridge University Press.
Conio, Caterina 1987 Puranas In The Encyclopedia of Religion Volume 12 (Ed. Mircea Eliad) New York, Macmillan Publishing Company.
Ferdous, Sayeed 2022 Partition as Border-Making: East Bengal, East Pakistan and Bangladesh Abingdon, Routledge Golwalkar, M. S. 2000 Bunch of Thoughts, Bangalore, Sahitya Sindhu Prakashana Lorenzen, David N. 1995 The Historical Vicissitudes of Bhakti Religion in Bhakti Religion in North India: Community Identity & Political Action, New York, State University of New York
Tagore Rabindranath 1917 Nationalism San Francisco, The Book Club of California