সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
অরুন্ধতী ভট্টাচার্য
কাঁঠাল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে চাঁদ, তাকে ঘিরে বলয়ের হালকা আভা, পাশে একটা উজ্জ্বল তারা আর এই সবকিছুকে স্বচ্ছ ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখার মতো ছেয়ে আছে বর্ষার মেঘ। অনুপমা উবু হয়ে বসে একটা তোলা উনুনে ঘুঁটে সাজাচ্ছে আর মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে আবছায়া চাঁদ ও তার পাশের তারাটিকে। খুব বেশি সময় তার হাতে নেই। একটা উনুন ধরাতে কতক্ষণই বা দেরি করা যায়। দুটো ঘুঁটে আধখানা করে চারদিকে দাঁড় করিয়ে ছোট ছোট কয়েকটা ঘুঁটের টুকরো দিয়ে ভরিয়ে দিল মাঝখানের ফাঁকটা। তখন একবার বাতাস বইল। সে দেখল কাঁঠাল পাতার ফাঁক সরে গিয়ে চাঁদটা আরও বেশি প্রকাশিত হয়েছে। ও ঘুঁটের উপর একটু কেরোসিন তেল ঢেলে তার উপর কয়লা রাখছে একটা একটা করে। ততক্ষণে বাতাসে উড়ে গেছে মেঘ, চাঁদের আলোর পাশে তারাটা যেন একটু ম্লান। পায়ের কাছে রাখা তেলের কুপি থেকে আগুন ধরালো উনুনে। আর সামান্য সময় আছে হাতে। উনুন ধরে গেলেই রান্নাঘরে চলে যেতে হবে। উনুনের ধোঁয়া তখন ক্রমশ উঁচুতে উঠতে উঠতে কাঁঠাল গাছের ডাল পেরিয়ে আরও উপরে উঠে বিছিয়ে যাচ্ছে চাঁদের বলয়ের ধার বরাবর। চাঁদটাকে এখন যেন অনেক বড় মনে হচ্ছে। সামনে পূর্ণিমা না অমাবস্যা? চিনেপুকুরের আকাশেও তো এই চাঁদটাই এখন দেখা যাচ্ছে! এ কথা মনে হতেই আরও অনেকক্ষণ ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হল। এরকমই সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে ঠাকুমার সঙ্গে ছাদে শুয়ে থাকত আর মাথার উপর দিয়ে অনেক বাদুড় উড়ে যেত গাব ফল খেতে। কটা বাদুড় যাচ্ছে তা গুনতে নেই, দিদিমা বলত, যে বাদুড়গুলোকে গোনা হবে সেগুলো গাবফলে মুখ দেওয়া মাত্র মরে যাবে। তাও অনিচ্ছাতেও একটা-দুটো আপনা থেকেই গুনে ফেলত, আর মন খারাপ হত ওই বাদুড়গুলো মরে যাবে বলে। সত্যি কি গুনলে বাদুড় মরে যায়? এখানে আকাশ দিয়ে কোনও বাদুড় উড়ে যায় না। ও খেয়াল করে দেখেছে এই বাড়ির চারপাশে কোনও পাখি আসে না। কতদিন যেন সে চড়াই দেখেনি, শালিখ দেখেনি। একটা ফিঙেও কোথাও এসে বসে না। উনুন ধরে এসেছে, ভাত বসাতে হবে, ছোট ঠাকুরজামাই এসেছে, সে খেয়ে যাবে।
চাল ধুচ্ছে যখন বড় ননদ এসে একবাটি মটর ডাল দিয়ে গেল। আলু আর ডালভাতে, শুধু এই দিয়ে কি জামাইকে ভাত দেওয়া যায়? ননদ বিধবা হওয়ার পর থেকে এখানেই থাকে, এ-সংসারের চাবিকাঠি এখন তার হাতে। সে বলল, যে জামাই ভিক্ষে করতে এসেছে তার জন্য এই যথেষ্ট। তার নিজের স্বামী বড়লোক ছিল; মরার পরেও যা রেখে গেছে তা এক নিঃসন্তান বিধবার পক্ষে অফুরন্ত। তাই ছোট বোনের নিষ্কর্মা স্বামীকে সে মানুষ জ্ঞান করে না। অনুপমার এতে কিছু বলার নেই, ভাত হওয়া পর্যন্ত করারও কিছু নেই। কিন্তু রান্নাঘর থেকে বেরোন যাবে না। বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেই বড় ননদ এসে জিজ্ঞাসা করবে ওখানে কি করছে সে। তাকে তো আর বলা যাবে না আকাশ দেখছি। বাতাস মেঘ উড়িয়ে দিয়ে চাঁদের ঘোমটা কেমন করে খুলে দিচ্ছে তাই দেখছি। তার চেয়ে ওখানেই বসে থাকা ভালো। আরও ভালো এই কারণে যে রান্নাঘরে এখন কেউ আসবে না আর এই সুযোগে সে ভাবতে থাকবে এমন বর্ষায় চিনেপুকুরে কত কামিনী ফুল ফুটত। সন্ধ্যেবেলা বৃষ্টি হলেই সে কামিনীর গন্ধ পায়, অথচ আশেপাশে কোথাও সে গাছ নেই, সে জানে। এখন ভাতের গন্ধের সঙ্গে ও সেই গন্ধটা আবার পাচ্ছে আর তাকিয়ে রয়েছে বাইরে, দাওয়ার উপর বাঁশের চালার যে ফাঁকটা দিয়ে আকাশের একটা ছোট্ট টুকরো দেখা যায়, সেই দিকে। কিছুক্ষণ পরে কামিনীর গন্ধ তাকে এত বেশি ঘিরে ধরল যে ভাতের গন্ধ আর পাওয়া যাচ্ছে না। সে ভাবছে, কামিনী গাছের গোড়ায় অপরাজিতা ফুলের যে চারা বেরিয়েছিল সেগুলো কত বড় হল। ওর চিন্তা হল, কে ওদেরকে কামিনী গাছের সঙ্গে বেঁধে দেবে যাতে লতিয়ে উঠে যেতে পারে। ঠাকুমা কি চারাগুলোর খেয়াল রাখবে? আসার সময় যে সে কথাটা বলে আসতে ভুলে গেছে। আর ঠিক তখনই কামিনীর গন্ধ চলে গিয়ে ভাতের গন্ধ ফিরে এল। সে ত্বরিতে এক ঘটি জল ঢেলে দিল ভাতে। ভাগ্যিস ধরে যায়নি, না হলে কি কেলেঙ্কারিটাই না হত। সে কথা ভাবতে ওর বুক ধরাস ধরাস করছে। তখন বড় ননদ আবার রান্নাঘরে ঢুকল, ভাত হয়েছে কিনা দেখতে। তার হাতে একটা চটের থলি ভর্তি চাল, তার উপরে দুটো গোপলাধোপা আম। সে অনুপমাকে বলল উনুনে হাওয়া দিতে, যাতে তাড়াতাড়ি ভাত রান্না হয়, যাতে তার ভাই বাড়ি আসার আগেই জামাইকে বিদায় করা যায়।
অনুপমা হাঁড়ি থেকে একটা চাল তুলে টিপে দেখল আরেকটু বাকি আছে। সে জোরে জোরে বাতাস করতে লাগল। তখন শাশুড়ির গলা শোনা গেল, ভাত হয়েছে কিনা জানতে চাইছে। ননদ উত্তর দিল, আর কিছুক্ষণ। অনুপমা বুঝতে পারল, শাশুড়িও চাইছে ছেলে বাড়ি ফেরার আগেই জামাই চলে যাক। ননদ তখন থলিসুদ্ধ চাল নিয়ে বাইরের দিকে গেল, জামাইকে দিতে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সবসুদ্ধ নিয়ে ফিরে এল রান্নাঘরে। থলিটা ঘরের কোণায় রেখে অনুপমাকে বলল, এখন এখানে থাক, খাওয়া হয়ে গেলে তারপর দিলেই হবে। সদরের ঘরে জামাই যেখানে বসে আছে সেখানে থলিটা রাখল না, যাতে ভাই আগে ফিরে এলেও ঢুকেই যেন থলিটা দেখতে না পায়। চালের নাকি এখন আক্রা চলছে, সে শুনেছিল স্বামীর কাছে। তাই এক থলি কেন, এক মুঠো চালেরও অনেক দাম। কিন্তু দু’ গোলা ভর্তি চাল, তাতেও আক্রা? প্রশ্নটা সেদিন তার মনে এসেছিল, কিন্তু কিছু বলেনি। কি জানি কি কথা থেকে কি কথা এসে পড়বে, তার চেয়ে চুপ করে থাকাই ভালো। এই এখন যেমন সে চুপ করে ভাতের হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে বসে আছে, অপেক্ষা কখন ভাত সেদ্ধ হবে, ডালভাতেটা আগে বের করে নিয়ে ফেন উপুড় দেবে, তারও পরে সাদা ধবধবে গরম ভাত বেড়ে দেবে থালায়। এই সেদিনও ভাত গরম বলায় ঠাকুমা এসে গরাস করে করে তাকে খাইয়ে দিল। ঠাকুমার মতো সে ভাত মাখতে পারে না, তাই খেয়েও যেন আর ঠিক তৃপ্তি হয় না। আজকাল কত কম খেয়ে সে উঠে পড়ে, ঠাকুমার সামনে সেটি হবার জো ছিল না। কিন্তু ঠাকুমা কি জানে চাল এখন আক্রা? জানলে হয়তো যে চাইত তাকেই অমন চাল বিলিয়ে দিত না। এই এক স্বভাব ঠাকুমার, তার কাছে কোনও জিনিস কেউ চাইলে তাকে সেটা না দেওয়া অবধি যেন তার শান্তি নেই। সে নিজেও ওইরকম ছিল। তবে এখন তার স্বভাব পালটে গেছে। তাছাড়া তার নিজের আছেটাই বা কি যে দেবে।
সদরের ঘর থেকে ঠাকুরজামাইয়ের গলার স্বর ভেসে আসছে। খুব জোরে জোরে কথা বলে মানুষটা আর বেশ সরল-সাধাসিধে। খুব খেতে ভালোবাসে, কিন্তু নিজের বাচ্চাদেরই খেতে দিতে পারে না তো নিজে কি খাবে। বেচারা, মনে মনে ভাবল অনুপমা। তার শাশুড়ি একবার কয়েক বিঘে জমি দিতে চেয়েছিল জামাইকে, কিন্তু ছেলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল ওসব দান-ধ্যান করা আর চলবে না। তারপর থেকে মাঝে মধ্যে ছেলেকে লুকিয়ে কিছু চাল আর গাছের ফল-পাকড় দু’-চারটে দেয়। তাতেও তো কিছুটা সুরাহা হয় আর ওইটুকু জিনিষ কমে গেলে ছেলে ধরতে পারে না, এই যা রক্ষে। কিন্তু আজ সে রক্ষা হবে কিনা সন্দেহ। বড় ননদ আবার এসে তাগাদা দিল। এবার ভাত হয়ে গেছে। অনুপমা ডালের পুঁটুলিটা তুলে নিয়ে সবে ফেন গালতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই সাইকেলের ঘন্টির শব্দ শোনা গেল।
কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। অনুপমার ফেন গালা হয়ে গেছে। ডালভাতেও মাখা হয়ে গেছে। নির্দেশ আসলেই সে ভাত বাড়বে। কিন্তু আর সবাই তখন সদরের ঘরে। রান্নাঘর থেকে সে ঘরখানা এত দূরে যে কিছুই শোনা যায়না। সেখানে তারা কি করছে, কি বলছে এখান থেকে তা জানার উপায় নেই। ও ভাবছে ননদ আসলে ভাতের পাতে একটু ঘি দেবে কিনা জিজ্ঞাসা করবে, সত্যিই কি আর ডাল-আলু ভাতে দিয়ে ভাত জামাইকে ধরে দেওয়া যায়! কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল, এদিকে কেউ আসা তো দূরস্থান, কারুর গলার স্বরও পাওয়া যাচ্ছে না। ঠিক তখনই ননদের চিৎকার শোনা গেল, এ কি করছিস তুই? তারপর আবার সব চুপচাপ। অনুপমা ভাবছে একবার ওঘরের দিকে যাবে কিনা, কিন্তু স্বামীর উপস্থিতিতে বাড়ির বাইরের দিকে যাওয়ার সাহস তার নেই। আবার চুপ করে যেন বসেও থাকতে পারছে না। বুঝতে পারছে, কিছু একটা ঘটেছে। আস্তে আস্তে রান্নাঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল সে। কলতলার দিকে গিয়ে একবার দেখবে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে কিনা? কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবে কলে যাচ্ছি, সে ভাবল। তখনই দেখল ননদ আসছে। সে আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ননদকে দেখে মনে হল বেশ বিভ্রান্ত। কি হয়েছে? সে কিছু প্রশ্ন করার আগেই বড় ননদ বলল কি ঘটেছে। তার স্বামী জামাইকে গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে আর বলেছে কখনও যেন এমুখো হওয়ার চেষ্টা না করে। জামাইয়ের মতো নিপাট ভালোমানুষেরও এতটা মানে লেগেছে যে সদরের বাইরে রোয়াকের উপর বসে কাঁদছে। কথা কটা বলেই ননদ আবার চলে গেল। অনুপমা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, ভাবল, তার কি কিছু করার আছে? সত্যিই কি সে কিছু করতে পারে?
তারপর মনের সমস্ত সাহসকে জড়ো করে সে হাতে তুলে নিল চালের থলি। তারপর দ্রুতপদে কিন্তু নিঃশব্দে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল খিড়কির দরজার দিকে। সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে খিড়কির পুকুরের পাশ দিয়ে গিয়ে পড়ল বাঁশবনের গভীর অন্ধকারের মধ্যে। এই বাঁশবনে সে দিনের বেলাতেও আসে না। কিন্তু এখন সে নিঃশঙ্ক, তাই অবলীলায় সে বন পেরিয়ে পা দিল সদরের রাস্তায়। আর একটু, আর একটু এগিয়েই সে দেখতে পেল চাতালের এক কোণে ঠাকুর জামাই দুটো হাত মাথায় দিয়ে উবু হয়ে বসে আছে। সে নিঃশব্দে তার পায়ের কাছে থলিটা নামিয়ে রাখল। ভেবেছিল, ঠাকুরজামাই তাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু থলিটা রাখামাত্র সে চমকে তার দিকে তাকাল। তারপরেই চাতাল থেকে উঠে হন হন করে রাস্তা দিয়ে খানিক এগিয়ে গেল। অনুপমা তাকে বলতে গেল, ঠাকুরজামাই, চাল কটা নিয়ে যান। কিন্তু তার আগেই সে দেখল মানুষটা পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারপর পেছনে ফিরল। এক-পা দু-পা করে ফিরে এল ওরই কাছে। তারপর থলিটা তুলে নিয়ে আর কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা চলে গেল স্টেশনমুখো সেই রাস্তা দিয়ে, যে রাস্তা দিয়ে সে একটু আগে এগিয়ে গিয়েছিল খালি হাতে এবং এখন সে যাচ্ছে চালের থলি হাতে নিয়ে।
অনুপমা আবারও বাঁশবন পেরিয়ে খিড়কি পুকুরের ধার দিয়ে খিড়কির দরজায় যখন এসে পৌঁছাল, বাড়ি তখনও নিস্তব্ধ। সে গেল রান্নাঘরে, না, সেখানে কেউ নেই, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে। এবার উনুনটা হাতে নিয়ে বাইরে গেল, ছাই বের করে নিকিয়ে রেখে দেবে। আসলে সে গেল চাঁদ দেখতে। কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে শুধু জমাট বাঁধা রক্তবর্ণ মেঘের দল, কৃষ্ণপক্ষের স্বল্পায়ু চাঁদ অনেক আগেই অস্ত গিয়েছে।