সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
প্রিয় বন্ধুরা,
আজ হলো শারীরিকভাবে অসমর্থ মানুষদের আন্তর্জাতিক দিবস।
হুইলচেয়ারে আটকানো শরীর, ৯০ শতাংশ শারীরিকভাবে অক্ষম, অধ্যাপক জি. এন. সাইবাবা ২০১৪ সাল থেকে আজও জেলে রয়েছেন।
কোনো প্রমাণাদি বা অপরাধকর্ম ছাড়াই দোষী সাব্যস্ত হবার পর ২০১৭ সালের ৭ই মার্চ থেকে নাগপুরের সেন্ট্রাল জেলের অ-মানুষিক ঠাণ্ডা জেলে থাকার দরুণ তাঁর স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়েছে।চোদ্দ মাস ধরে লম্বা লম্বা মুলতুবি ও বাদ-প্রতিবাদের পর, চিকিৎসার কারণে তাঁর জামিনের আবেদন ২০১৯ সালের ২৫শে মার্চ নাকচ হয়ে যায় বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চের রায়ে।
ভারত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারপত্রে (ICCPR), সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের অধিকার বিষয়ে আহূত অধিবেশনের (UNCRPD) এবং বন্দিদের চিকিৎসার জন্য জাতিপুঞ্জের ৭০/১৭৫ নং প্রস্তাবে সংবলিত ন্যূনতম আদর্শ ধারাসমূহে (যা নেলসন ম্যাণ্ডেলা রুলস বলে পরিচিত) একটি স্বাক্ষরদানকারী রাষ্ট্র। এই সব কটি ধারা সুনিশ্চিতভাবে বন্দিদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকারের কথা বলে। নেলসন ম্যাণ্ডেলা রুলস নির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করছে যে বন্দিদের স্বাস্থ্য বিষয়ে যত্ন নেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং ওই ধরনের বন্দিরা ‘অবশ্যই সেই মানের স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবেন ঠিক যেমনটা জনসমাজের অন্যান্যরা পেয়ে থাকেন’ কোনো রকম বৈষম্য ছাড়াই। এইটে আরো এই অধিকার দিচ্ছে যে, যেসব বন্দিদের বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা প্রয়োজন তাঁদের সেই ধরনের প্রতিষ্ঠানে বদলি করতে হবে কিংবা হাসপাতালের বাইরে নিয়ে যেতে হবে যখন সে ধরনের চিকিৎসা জেলখানায় পাওয়া যাচ্ছে না।
শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের অধিকার আইন, ২০১৬ নির্দিষ্ট ভাবে নিশ্চয়তা প্রদান করে যে উপযুক্ত সরকার নিশ্চিত করে দেখবে যে, শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষেরা অন্যান্যদের সঙ্গে সমভাবে সমতার অধিকার, মর্যাদাসম্পন্ন জীবনের অধিকার, এবং তাঁর মূল্যবোধের প্রতি সম্মান পাওয়ার অধিকার পাচ্ছেন। পুনশ্চ, ৭(১) ধারা কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতা প্রদান করছে ‘সব ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার’ এবং অন্তত ‘এই ধরনের ঘটনা পরিহার করার’ এবং নির্দেশ করছে ‘এই ধরনের ঘটনার যাঁরা শিকার তাঁদের উদ্ধার করার, রক্ষা করার ও পুনর্বাসিত করার’।
এতদিরিক্ত, জাতিপুঞ্জের বিশেষঞ্জরা যুক্তি দিয়ে অনুরোধ করেছেন ডঃ সাইবাবার শারীরিক কারণে মুক্তি দেওয়ার জন্য এবং জানিয়েছেন যে ‘উপযুক্ত বন্দোবস্ত ছাড়া শারীরিক ভাবে অক্ষম মানুষদের আটক রাখা শুধু বৈষম্যসূচকই নয়, বরং এটাকে নিষ্ঠুরতা অথবা অত্যাচারই বলা যেতে পারে। বিশেষ করে, এ ক্ষেত্রে নির্জন কারাবাস নিষিদ্ধ হওয়া উচিৎ। এই ব্যবস্থায় অক্ষমতাসম্পন্ন বন্দিদের অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে’।
ভারতের মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট বহু মামলার ক্ষেত্রে এই মত ব্যক্ত করেছেন যে ‘স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নের অধিকার’ সংবিধানের ২১ ধারার একটি অপরিহার্য অংশ। পণ্ডিত পরমানন্দ কাটারা বনাম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মামলায় (৪ সেক ২৮৬), সুপ্রিম কোর্ট এই মত ব্যক্ত করেছিলেন যে সংবিধানের ২১ ধারা রাষ্ট্রের ওপর এই দায়বদ্ধতা অর্পণ করে যে, জীবনের অধিকার রক্ষিত হবে।
বিচারাধীন বন্দি বা দণ্ডিত অপরাধী, যেই হোন না কেন, ভারতের সংবিধান তাঁর জীবনের অধিকারের প্রতি নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। এই সমস্ত অধিকারগুলিকে অস্বীকার করা মানবাধিকার ও বন্দিদের অধিকারসমূহের খুব স্থূল ধরণের লঙ্ঘন। ঠিক যেমনটা আজ ডঃ সাইবাবার ক্ষেত্রে ঘটছে।
এই সমস্ত আইন ও বিধিসমূহ থাকা সত্ত্বেও ডঃ জি.এন. সাইবাবা জামিন পান নি। বর্তমানে তিনি এমন অবস্থায় আছেন যে দুজন লোকের সাহায্য ছাড়া তিনি এক পাও চলতে পারেন না এবং প্রায়ই চোখে অন্ধকার দেখেন। কোনো ধরনের চিকিৎসা না পাওয়ায় তাঁর সমস্ত ধরনের পীড়া ও অসুখগুলির প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেগুলি মারাত্মক হয়ে উঠেছে। নাগপুরের সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা যায় তাঁর শিরদাঁড়া ও বাঁ হাতের পেশিগুলির ক্ষয় আরো বেড়ে গেছে। তিনি দারুণ যন্ত্রণা এবং মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন। আর তাঁর অবশিষ্ট প্রত্যঙ্গগুলি ক্রমেই কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। তাঁর পেট এক জায়গায় ভীতিপ্রদ রকমের ফুলে উঠেছে। সেখানে ঘনঘন সাংঘাতিক যন্ত্রণা হয় যেটার কোনো চিকিৎসাবিদ্যাসম্মত অনুসন্ধানই হয় নি। জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে নিয়মিত যে ফিজিওথেরাপি তাঁর দরকার তা দিতে পারে না। সেখানকার প্রতিকূল পরিবেশে তাঁর হুইলচেয়ারটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই সমস্ত ধরনের শারীরিক ও বাহ্যিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ডাক্তারি মতে সংকটাপন্ন রুগি হিসেবে জামিন পাওয়ার পরীক্ষায় সাইবাবা পাশ করতে পারেন নি।
সম্প্রতি ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে আমি সাইয়ের একটা চিঠি পেয়েছি। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ক্রমবিকাশমান পরিণতিতে আমি সব আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এই যে চিঠিটি সাই আমাকে লিখেছে তা আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করেছে। আমি মনে করি এই চিঠি যে বার্তাকে ধরে রেখেছে তা শুধু আমার জন্যই নয়, প্রত্যেকের জন্যই অনুভব করার। আমি চেয়েছি আপনাদের সবার সঙ্গে এই অনুপ্রাণনা ভাগ করে নিতে।
প্রিয় বসন্থা,
আমি আমার রুগ্ন অবস্থার দরুণ লেখার ও পড়ার অবস্থায় নেই। আমার সমস্ত ধরনের অসুখগুলো বেড়ে গেছে এবং তীব্রতর হয়েছে চিকিৎসার অভাবে। আশা করিও না। তোমাকে আরও সক্রিয় থাকতেই হবে। নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেল না। বিস্তৃত ক্ষেত্রের মানুষজনের সঙ্গে তোমাকে মিশতে হবে। খুবই সৃষ্টিশীল ও জীবনীশক্তিতে ভরপুর হয়ে ওঠো। আমার মুক্তির জন্য তুমি যা করতে পারো তার সবটুকুই করো। আমাকে দেখ। কীভাবে আমি এত ধরনের অসুখ ও যন্ত্রণা নিয়ে এই বদ্ধ নিষ্ঠুর জেলখানার ভেতরে এখনও জ্যান্ত আছি, এখনও বেঁচে আছি। আমি সাধ্যমতো সক্রিয় থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি এই সংকীর্ণ, পদে পদে নিয়ন্ত্রণমূলক জেলখানার গণ্ডীর মধ্যে। যে সামান্য ব্যায়াম আমি করতে পারি তা আমি প্রত্যেকদিন সকালে করছি। আমার নিজস্ব একটা নিয়ম অনুযায়ী আমি প্রতিদিন লেখাপড়া করি, গঠনমূলক চিন্তা করি এবং প্রতিদিন বাঁচি এই আশা নিয়ে যে হয়তো পরের দিনই আমি আমার স্বাধীনতা ফেরত পাবো। হাজার হোক, আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমি আমার সমাজের জন্য, আমার দেশের জন্য নিজের অবদান রেখেছি যদিও আমি একজন ৯০ শতাংশ অক্ষম মানুষ। আমি আমার নিজের জন্য কখনো বাঁচিনি। আমি জনগণের জন্য বেঁচেছি। যে মামলায় আমাকে মিথ্যে করে জড়ানো হয়েছে সেটি একটি রাজনৈতিক মামলা। এর মধ্যে কোনো অপরাধমূলক বিষয়বস্তু নেই; যদিও ওরা চেষ্টা করেছে আমার ওপর এরকম একটি মকদ্দমা চাপিয়ে দিতে।
তুমি ভাবোঃ আমরা যন্ত্রণা ভোগ করবো কেন? যদি তুমি মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে যাও এবং হতাশ হয়ে পড়ো, আমরা দুজনেই হেরে যাবো। আমাদের কোনো মতেই হেরে যাওয়া উচিৎ হবে না। তোমাকে সক্রিয় থাকতেই হবে। তোমার উচিৎ হবে সব সময়ে হাসা যেমন তুমি সারা জীবন হেসে এসেছো এই সেদিন আমার বন্দি হবার আগে এই অত্যাচার আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত। তোমাকে সাহসী হতে হবে। তোমাকে গঠনমূলক চিন্তা করতে হবে। তুমি চিরকাল সৃষ্টিশীল ছিলে। আমরা যতদিন বাঁচি ততদিনই মৃত্যু আমাদের। এইটেই মনুষ্যজন্মের মানে। আমরা সৃষ্টিশীল কারণ আমরা মানুষের জন্য বাঁচি, শুধুমাত্র আমাদের নিজেদের জন্য নয়।
ভালোবাসা নিও
ইতি তোমার ১৮.১০.২০১ সাই
(Page: 211–214)
Why do you fear my way so much?
Poems and Letters from Prison
G. N. Saibaba
Published in India by Speaking Tigers Books 2022