সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
এইরকম একটা ‘এক হলেও হতে পারে করোনা-আক্রান্তের দিনলিপি’ আমরা যে কেউ লিখতে পারতাম। অন্তত যারা সত্যিকারের আক্রান্ত হইনি, একটু দূর থেকে এই দুর্যোগকে লক্ষ্য করেছি, করতে বাধ্য হয়েছি আর এরই সঙ্গে অসহায়ভাবে বাধ্য হয়েছি কাছে দূরের অনেক মানুষের চলে যাওয়া দেখতে। আমরা সেই গোত্রের মানুষ, যারা করোনা সম্পর্কে রাষ্ট্রের সুচতুর প্রচারকে প্রশ্নহীনভাবে মেনে নিতেও পারিনি, আবার অনেক অকুতোভয় বন্ধুর মতো সবটাকে উপেক্ষা করে পারিনি নিজেদের চলা-ফেরাকে একেবারে স্বাভাবিক রাখতে। অনেক প্রশ্ন অনেক দ্বিধা নিয়েও করোনাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার মতো ধক্ ছিল না আমাদের অনেকেরই। ফেস্বুক হোয়াট্স অ্যাপে নানারকম বাদবিতণ্ডায় কোনো একটা পক্ষে সটান দাঁড়িয়ে যাবার পথে হাজারটা দ্বিধা পিছুটান কাজ করছিল। আমাদের প্রভাবিত করেন যেসব প্রতিষ্ঠিত শ্রদ্ধেয় চিকিৎসকেরা, তাঁদের পরস্পরবিরোধী পরিসংখ্যান, অভিমত, সিদ্ধান্ত ধন্দে ফেলে দিয়েছিল আমাদের মতো বহু সাধারণ নাগরিককে। একটা কালসময় কাটাতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। এই বাক্যগুলো যখন লেখা হচ্ছে, তখনো জানি না, আবার ওই কোভিডের নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন অমিতবিক্রমে সত্যি সত্যি আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে কি না! না কি জুজুর ভয় দেখিয়ে আমাদের মান্য রাষ্ট্রনায়কেরা আবার তাদের ‘বহুবিধ প্রতিশ্রুতি’ রাখার মহান কর্তব্যে ব্যস্ত হয়ে উঠবেন! হাজার হাজার মানুষ, শ্রমিক, যারা না কি আশ্চর্যজনকভাবে স্বদেশের ভেতরেই ‘পরিযায়ী’ হিসাবে নির্দিষ্ট হলেন, বৃহত্তর সমাজকল্যাণে তাঁদের ‘লাপাতা’ হয়ে যাওয়া তৈরি করা চরম ভীতির বাতাবরণে কোনো ব্যাপারই ছিল না। আমরা সেই ভয়ঙ্কর অমানবিক পরিস্থিতিকে অনেকটা দূর থেকে যথেষ্ট নিরাপদ জায়গা থেকে শুধু প্রত্যক্ষ করে গেলাম। বলা চলে, সহ্য করতে বাধ্য হলাম। কিন্তু কেউ কেউ এই অসহায়তার কথাই দলিল করে রেখে দিলেন ভবিষ্যতের জন্য, এই ছিল পরিস্থিতি, আমরা পার হয়েছিলাম, অন্তত চেষ্টা করেছিলাম এইভাবে। লেখক শৈবাল দত্ত-র ‘এক হলেও হতে পারে করোনা-আক্রান্তের দিনলিপি’ সেইরকম একটি আখ্যানই বলা চলে।
কিন্তু ধারণা, আমাদের অনেকেরই সেই দিনলিপি হয়ে উঠতো একেবারে ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার খতিয়ান, নিজের গণ্ডির পরিসরেই আটকে থাকতো সেটা। লেখক এইখানেই দেখিয়েছেন তাঁর মুন্সিয়ানা, ব্যক্তিগতকে এক অনবদ্য সহজতায় করে তুলেছেন সর্বজনীন। ওই দিনপঞ্জিতে আমরা নিজেদেরকেও প্রত্যক্ষ করি, আর সেই বয়ান চলে লেখকের বর্ণনাকে আশ্রয় করেই। বহুক্ষেত্রে আমি-ই ঢুকে পড়ি সেই বিবরণের একেবারে মাঝখানে, ঘটনার নিয়ন্ত্রক বা অভিঘাতে বিচলিত একজন মানুষ হিসাবে নিজেকেই দেখতে পাই, আবার কখনো কখনো একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় থাকে একটু দূর থেকে নতুন কোনো পরিস্থিতিকে জেনে বুঝে নেবার অবকাশ। অথচ সেই পরিস্থিতিও যে একেবারে নতুন, তা-ও তো না, আমরা শুধু দেখিনি। লেখক সেইদিকে আমাদের চোখ ফিরিয়ে দেন, এই যে, পাশেই রহিয়াছে এমন অভাবনীয় একটি জগত, শুধু আপনাদের একটু মনোযোগের অপেক্ষায়। শুধু এই সময়কালের বর্ণনাই তো নয়, খুব শান্তস্বরে, যেন বা একান্ত পাশে বসে শুনিয়েছেন এই দুর্যোগের কতটা বানিয়ে তোলা, কতটা বাস্তবিক, সমানে একটা হা হা রবকে ছড়িয়ে দিতে দিতে রাষ্ট্রনায়কেরা সমস্ত পৃথিবী জুড়ে রেখে যে সমাজ-অর্থনৈতিক অব্যবস্থাকে প্রায় অনিবার্য হিসাবে সাধারণ মানুষকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিলেন, তার ইঙ্গিতও সুস্পষ্ট, কিন্তু সেটাও কোনো উচ্চকিত স্বরে নয়। যেন বা প্রত্যেকের বিবেচনার সামনে তথ্যগুলো সাজিয়ে দেওয়া, এইবার তোমার অবস্থান নেওয়ার পালা। একজন প্রতিষ্ঠিত গায়ক,শান্তিনিকেতনেও যাঁর একটা বেশ আরামদায়ক আবাস রয়েছে, লক্ ডাউনের একেবারে চরম সঙ্কট সময়ে তিনি বেশ তৃপ্তি নিয়ে বলেছিলেন, কতদিন পর যে প্রাণভরে ঝিঁ ঝিঁ-র ডাক শুনলাম!- সে তো ঠিকই, মানুষের অত্যাচার থেকে কিছুদিনের জন্য হলেও প্রকৃতি মুক্তি পেলো! কিন্তু অনিন্দ্যসুন্দর সেই ঝিঁ ঝিঁ-র ডাকের সঙ্গে কি মিশে থাকে দিনের পর দিন রাতের পর রাত পথ হেঁটে হাজার হাজার শ্রমিকের ঘরে ফেরার আর্ত-কান্না, দেখতে কি পান সেই চলার পথে মরে পড়ে থাকা শিশু-কিশোরদের ছবি, কিম্বা মহানগরীর সম্পন্ন গেরস্থালিগুলোকে এতদিন নানাভাবে সচল রেখেছেন যেসব অমৃতের সন্তান, এই দুর্যোগে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে বাধ্য হলেন তাঁরা! লেখকের ভাষ্যে যেন দেশভাগ নিয়ে প্রবন্ধিক ঊর্বসী বুটালীয়া-র সেই কথাগুলিই প্রতিধ্বনিত হয়, এই ইতিহাস মনে রাখা ভয়ঙ্কর, ভুলে যাওয়া পাপ!
অত্যন্ত মৃদু কিন্তু স্পষ্ট স্বরে লেখক এগিয়ে নিয়ে যান এই দিনলিপিকে। আর শুধু করোনা-তেই সীমাবদ্ধ থাকে না সেই আখ্যান-পরিসর, যেন এই দুর্যোগকে কেন্দ্রে রেখে নানাভবে আমাদের যাপিত জীবনের আরও বহু ক্ষেত্রকে ঘুরে ফিরে দেখে আসা। বুঝে নেওয়া, কত সীমাবদ্ধ সঙ্কীর্ণ প্রশ্নহীন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে আছি আমরা। আর সেই অভ্যস্ততা এমনই, আমরা ধরতেই পারি না, কোথায় কীভাবে আমাদেরই চরম সব অমানবিকতা অনির্দিষ্ট হয়ে আছে আমাদের কাছ! লেখক কাউকেই চরম দোষী সাব্যস্ত করে আসামীর কাঠগড়ায় তুলে দেননি, কিন্তু এমন একটা স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি সামনে মেলে ধরেন, যাতে আমরা নিজেরাই আমাদের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে সংকুচিত হয়ে যেতে থাকি। শুধু সেইসব চেতাবনীই যে আমাদের শুনতে বা বুঝতে বাধ্য করেন, তা না, এরই সঙ্গে এমনকিছু বিষয়কে টেনে আনেন, যা প্রত্যক্ষভাবে করোনা-র সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলেও খুব দূরবর্তীও নয় বোধহয়। শারীরিক দুরত্ব’ বিষয়টাকে কেন ‘সামাজিক দূরত্ব’- হিসাবেই প্রচারে এবং ব্যবহারে বাধ্য করা হলো, এই ডামাডোলে রাষ্ট্রনায়কেরা কত বিচিত্রভাবে তাঁদের কতবিধ স্বার্থসিদ্ধি ঘটালেন, তাঁদের প্রত্যক্ষ মদতে কীভাবে নিঃশব্দে কতটা ‘লাভ’ তুলে নিয়ে যেতে সক্ষম হলো, এখনো নিয়ে যাচ্ছে, দাঁত লুকিয়ে রাখা হাঙ্গরেরা, সামাজিক স্বাস্থ্যবিধির দোহাই তুলে কোনো একটি ধর্মের জমায়েত যেদিন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো, ওইদিনই আরেকটি ধর্মীয় সংগঠন শাস্ত্রবিধি মেনে,‘করোনার হাত থেকে মুক্তির জন্য গোমূত্রসভা’ করলেন নির্বিবাদে। একেবারে সংখ্যাতথ্য দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন, তথাকথিত উন্নত সব দেশে ফ্লু-তে একেবারে মাসকাবারি হিসাবে যখন এরচেয়ে অনেক বেশি মানুষ মারা যান, তখন যেহেতু সমাজ-এলিটরা আক্রান্ত হন না, ফলে সেই নিয়ে এতো হই-চই-ও হয় না! কিন্তু করোনা যেহেতু একেবারে সেই সুরক্ষিত সদর দপ্তরে কামান দেগে দিয়েছে, সেইজন্য তাকে ঠেকানোর মাশুল দিতে হবে সবার! এসব তো তথ্য। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত প্রস্তুতি নিতে হবে কীভাবে! লেখক সরাসরি কোনো উপদেশের ঝাঁপি খুলে বসেননি। হতে চলা ঔপন্যাসিক অর্ঘ্য, কিম্বা চিত্রশিল্পী ছন্দাদি একেবারে শিল্পের ক্ষেত্রে যে মনন,যে চর্চাবোধের কথা বলেন, যা নিয়ে লেখকের সঙ্গে কথার আদানপ্রদান, তর্ক-বিতর্ক, তা আমাদের করোনা ঠেকাতে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যায় না ঠিকই, কিন্ত শিল্পকে সৃষ্টিকে এইভাবে জীবনের সঙ্গে যোগ করে না দেখলে যে কেবল কৃত্রিম পণ্যেই জীবনের পশরা ভরে ওঠে, এ সত্য-ভাষণ বহুযুগ আগেই উচ্চারিত, কিন্তু আমরা শুনি কই! আর সেই না শোনার খেসারতও আমাদের দিতে হয়, হচ্ছে নানাভাবে। এই করোনা-র পর আরও অনেক দুর্যোগ অনিবার্যভাবে আমাদের জন্য অপেক্ষমান, লেখকও জানান দিয়ে যান, এ হচ্ছে গল্পের শুরু! সমস্ত পৃথিবীর পরিস্থিতিকে একটু তলিয়ে গিয়ে ভাবলেই এটা বুঝতে পারা খুব কঠিন না যে, ওইসব দুর্যোগের তীব্রতা ঘিরে ফেলবে আরও বড়ো পরিসরকে, নাহলে রাজ্য চলে না, শাসকের রসদ-রপ্তানীকারিদের মুনাফার পথ খোলে না। সেইসব মারণযজ্ঞের প্রচার বা প্রতিষেধকের বাইরেও সেগুলোকে ঠেকানোর একটা প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে পাশের মানুষটিকে, শুধু মানুষ কেন, ঘরের বাইরে আলসেতে নিয়ম করে দোল খেতে আসা মুনিয়া পাখিটিকে, নিত্য ব্যবহারের জিনিসগুলিকেও আদরের নামে ডেকে, যেমন গার্গী ডাকেন, তাদেরকেও নিজেদের বেঁচে থাকার সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী হিসাবে জুড়ে নেওয়া, নিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা। জীবনকে দেখার ওই সংবেদনতা না থাকলে মহত্তর জীবনের করুণাধারা তো অপ্রাপণীয় হয়ে থাকবেই! এই করোনাকালে আমরা এটাও স্পষ্ট দেখতে পেলাম, সেই কাঙ্ক্ষিত জীবন থেকে কতটা দূরবর্তী আমরা! আর শুধু এই উপলব্ধিতে পৌঁছে দিলেন বলেই নয়, এই সময়কালের প্রতিনিধি হিসাবে ভবিষ্যতের কাছে সাহিত্যগুণসম্পন্ন একটি দলিলও উপহার দিয়ে গেলেন শ্রদ্ধেয় শৈবাল দত্ত। আমরা কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে।
দয়েকটি বানানের সামান্য এদিক-সেদিক ছাড়া ছাপা, বাঁধাই-এর পারিপাট্যে হাতে তুলে নিয়েই বইটি পড়তে শুরু করার মতো। প্রচ্ছদে ব্যবহার করা সোমনাথ হোড়-এর কাজটিও বিষয়কে বিন্যস্ত করার জন্য অনবদ্য। এই ভয়ঙ্কর সময়ে আমাদের ভেতরকার অসহ্য সব ক্ষত-র মুখই যেন সাজানো সামনে,যার বিস্তার ভেতরের বিষয়ে। এই বই প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
এক হলেও হতে পারে করোনা-আক্রান্তের প্রতিলিপি
শৈবাল দত্ত
প্রকাশক : লোকনদী
প্রচ্ছদ : অর্ক মিত্র
পৃষ্ঠা ১৫২ পেপার বাউন্ড
দাম : ২০০ টাকা