সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
গেল গেল সব গেল…
হঠাৎ রব উঠেছে। ঘুম ভেঙেছে অনেকের। কিন্তু ঘুম ভাঙলেও দু চোখ কি খুলেছে? নাকি এক চোখে এক দিকে দৃষ্টিপাত! সুশীল সমাজে রব উঠেছে - দেউচা পচামি কয়লা খনি পরিবেশের সর্বনাশ করে দেবে। কথাটা একেবারেই ঠিক, কিন্তু বিচ্ছিরি রকমের একপেশে।
শুরুতে কিছু তথ্য দেওয়া যাক -
দেউচা পচামি কোল ব্লক। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও এশিয়ার বৃহত্তম কয়লা খনি হতে চলেছে।
বীরভূম জেলায়, মোরগ্রাম পানাগড় ১৪ নম্বর রাজ্য সড়কে মহম্মদ বাজারে দেউচা পচামি কোল ব্লক। কাছাকাছি বড় জনপদ ও রেল স্টেশন সাঁইথিয়া, ২০ কিলোমিটার।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৬ ডিসেম্বর, ২০২১, জানাচ্ছে -
দেউচা পচামি কয়লা খনিতে মোট কয়লা পাওয়া যেতে পারে - ২১০২ মিলিয়ন টন।
জমি লাগবে - ৩৪০০ একর। এখানে বসবাস করে ৩০১০ টি পরিবার, তার মধ্যে আদিবাসী ১০১৩ টি পরিবার।
https://indianexpress.com/article/cities/kolkata/bengal-moves-on-mega-coal-block-7658016/
এই সময়, ১৯ নভেম্বর, ২০২১, জানাচ্ছে -
জেলাশাসক বিধান রায় বলেন, ‘মোট খাস জমির পরিমাণ ৫৯৬.০২ একর। বিভিন্ন সরকারি দফতরের জমি ৭২.৯২ একর। বনভূমি ৩০৯.৭০ একর। ব্যক্তি মালিকানাধীন রায়তি জমি ২৩৯২.১৩ একর। মোট ৩৩৭০.৭৭ একর জমির উপর কয়লাখনি করা হবে। বনভূমি ধ্বংস এবং খাস জমিতে যারা রয়েছেন তাঁদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যতগুলি গাছ কাটা হবে, তার দ্বিগুণ গাছ লাগানো হবে।
https://eisamay.com/west-bengal-news/bolpur-news/deocha-pachami-coal-block-work-to-start-from-vested-land-soon/articleshow/87805881.cms
দেউচা পচামি নিয়ে প্রকাশিত প্রায় সব প্রতিবেদনেই সবিস্তারে লেখা হয়েছে - রাজ্য সরকার কতটা ক্ষতিপূরণ দিতে চাইছে, সেটা কতটা ন্যায্য, অন্যান্য রাজ্য সরকার বা খনি সংস্থার সাথে এই ক্ষতিপূরণের প্যাকেজের তুলনা, ইত্যাদি।
আমরা এই ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ নিয়ে কোনও আলোচনা করবো না। কারণ - আসলে ক্ষতিপূরণ হয় না। তাই বলে এরকম ভাবারও কোনও কারণ নেই - কাউকে উৎখাত করলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দরকার নেই। আমরা এই বিষয়গুলোকে ক্রমে আলোচনা করবো।
শুরুতে বলে ছিলাম - এক চোখে দেখবো না, দু চোখে দেখার চেষ্টা করবো। অনেকেই দেউচা পচামি নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছেন - শুধুমাত্র খোলা মুখ কয়লা খনির বিপজ্জনক দিক নিয়ে। কিন্তু সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছেন - এই কয়লা খনির প্রভাব আমাদের সকলের জীবনে কতটা - এই বিষয়টা। কয়লা খনি থেকে প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধা ষোল আনা ভোগ করবো, কিন্তু কয়লা খনি বিরোধিতায় সোচ্চার হবো এই দ্বিচারিতার পথে হেঁটে কোনও সমাজ কল্যাণ হতে পারে বলে আমরা মনে করি না। কয়লা খনির বিরোধিতা করার আগে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে জেনে নেয়া দরকার - কেন এই কয়লা খনি? কাদের জন্য এই কয়লা খনি।
কথায় আছে - চ্যারিটি বিগিন্স এট হোম। তাই কয়লা খনি নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়া উচিত আমার আপনার ঘর থেকে। আমরা গোড়ায় বুঝে নিই - আমার আপনার ঘর কয়লা খনির সাথে কী ভাবে জুড়ে আছে। আমাদের সকলের ঘরে বিদ্যুতের যোগান আসে কয়লা পুড়িয়ে। গোটা দুনিয়ার ৮০% বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় কয়লা পুড়িয়ে তাপবিদ্যুৎ থেকে।
একটা বাড়িতে বিদ্যুতের আলো জ্বলে উঠলে আমরা সগর্বে বলে উঠি - এ সভ্যতার আলো। একটা প্রমাণ মাপের ঘরের মাপ ধরলাম লম্বায় চওড়ায় ১২ ফুট, আর উচ্চতা ১০ ফুট । এরকম একটা ঘরে ১ টা ৪ ফুটের টিউব লাইটেই যথেষ্ট আলো হয়। এরকম একটা আলোকিত ঘরের যেকোনো জায়গায় বই ভাল ভাবে পড়া যায়। আমরা সবাই এই আলোর যোগানকে ন্যূনতম মান ধরে নিয়েছি। এই আলোর কিন্তু মাপ আছে। এবার একটু মেপে দেখা যাক এই আলো মানে কতটা আলো। তার জন্য আমাদের কয়েকটা পরিভাষা বুঝে নিতে হবে - লাক্স, লুমেন,। যতটা সম্ভব সহজ করে বোঝানোর চেষ্টা করছি। বলা হয় বই পড়ার জন্য প্রতি বর্গ মিটারে ২৫ থেকে ৫০ লুমেন আলো দরকার(৩ ফিট ৩ ইঞ্চিতে এক মিটার প্রায়, মানে এক বর্গ মিটার হল তিন ফুট তিন ইঞ্চি চওড়া ও একই মাপের লম্বা জায়গা)। আমরা হিসেবের সুবিধার জন্য ৩৭ লুমেন ধরলাম। এই লুমেন ব্যাপারটা কী? বলা হচ্ছে এক বর্গমিটারে যদি এক লুমেন আলো পড়ে তবে তাকে বলা হবে ১ লাক্স। তাহলে এক লাক্স মানে কী? এক বর্গমিটার যায়গায়, এক মিটার দূর থেকে যদি ১ টা মোমবাতির আলো পড়ে তাহলে তা হবে ১ লাক্স। তাহলে দেখা যাচ্ছে ১ বর্গ মিটার যায়গায় যদি বই পড়ার উপযোগী আলো পেতে হয় তবে তার থেকে ১ মিটার দূরে অন্তত ৩৭টা (ন্যূনতম ২৫টা) মোমবাতি জ্বালাতে হবে। এবার শুরুতে আমরা যে ঘরটাকে ধরে হিসেব করছিলাম তার শুধু ৪টে দেয়ালের মাপই ৪৪.৬ বর্গমিটার। আমরা আগেই বলেছি ১ টা ৪ ফুটের টিউব লাইটে ঘরের সব দেয়ালেই বই পড়ার মত যথেষ্ট আলো পড়ে (পরীক্ষা করে দেখে নিতে পারেন)। তাহলে শুধু দেয়ালেই আলো পড়ছে ৩৭ গুণ ৪৪.৬ মানে ১৬৫০.২ লাক্স আলো। অর্থাৎ ঘরে এই পরিমাণ আলো পেতে গেলে জ্বালাতে হবে অন্তত ১৬৫০ টা মোমবাতি। এত আলোর বিলাসিতা সম্রাট শাহজাহানেরও ছিল না। আর একটা কথা মনে করিয়ে দিই, মোমবাতির মূল উপাদান প্যারাফিন, যা পেট্রোলিয়াম থেকে পাওয়া যায়। প্রদীপের আলো মোমবাতির থেকে অনেক কম হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ প্রদীপ মূলত উদ্ভিজ্জ তেল থেকে জ্বলে, যার শক্তি উৎপাদনের ক্ষমতা জীবাশ্ম জ্বালানির থেকে অনেক কম।
এত গেল শুধু একটা ঘরে একটা টিউব লাইটের হিসেব, এর বাদে ফ্যান আছে, একাধিক লাইট আছে, বহু ঘরে আছে ফ্রিজ, এসি, গিজার, টেলিভিশন, সাউন্ড সিস্টেম, মিক্সার গ্রাইন্ডার, মাইক্রোওভেন আরও বহু কিছু। এখনকার ৪ ফুটের এলইডি টিউব ১৮ ওয়াটের, আগের মোটা কাঁচের টিউব লাইট ছিল ৪০ ওয়াটের। এই প্রত্যেকটা যন্ত্রের গায়ে ওয়াটের হিসেব দেওয়া থাকে, একটু মিলিয়ে দেখে নেবেন। শুধু একটা বলি, ভাল মাইক্রোওভেন শুধু মাত্র গরম করার জন্য ৯০০ ওয়াট চায়। একটু আগে আমরা যে ১৬৫০টা মোমবাতির হিসেব দিয়েছিলাম তার মানে ছিল ১ টা ১৮ ওয়াটের টিউব লাইট। এবার নিজেরাই একটু হিসেব করে নিন ৯০০ ওয়াট মানে কী!
এত গেল একটা ঘরের হিসেব, এবার শহর জোড়া আলোর ঝলকানি, মেট্রো রেল, লোকাল ট্রেন, এসি শপিং মল যোগ দিতে থাকুন, কূল কিনারা পাবেন না।
এর পরে আসে বৃহৎ শিল্প। এক একটা যন্ত্র খায় হাজার হাজার ওয়াট বিদ্যুৎ। আইটি শিল্পের কাঁচে মোরা পেল্লায় বাড়িগুলোর অন্দর ঠাণ্ডা রাখতে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগে, সে সব তথ্য নেট ঘাঁটলেই পেয়ে যাবেন।
মোমবাতি দিয়ে কথা শুরু করলাম কারণ ওটা আমাদের চেনা। এর পর কয়লায় যাবো। কিন্তু কয়লার সাথে বিদ্যুতের অনুপাত কী রকম? মানে কত বিদ্যুতে কত কয়লা? এক মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ পেতে জ্বালাতে হয় - প্রায় ৫০০ কিলো কয়লা। ওয়াট ব্যাপারটা বুঝে নিই - ১০০ ওয়াটের একটা বাল্ব ১ ঘণ্টা জ্বললে ১০০ ওয়াট বিদ্যুৎ পোড়ায়। এক মেগা ওয়াট = ১০০০০০০ ওয়াট। শুধুমাত্র কলকাতা মেগা সিটি এলাকায় ১ কোটি ৬৩ লক্ষ মানুষ এখন প্রতি বছরে বিদ্যুৎ পোড়ায় ১২৩৮৩.০২ গিগা ওয়াট। মেগা ওয়াটে হিসেব করতে হলে ১ এর পিছনে ৬টা শূন্য বসিয়ে তাই দিয়ে গুন করতে হবে। তারপর কয়লার হিসেব পেতে হলে ৫০০ দিয়ে গুণ।
তথ্যসূত্র-
https://sites.ontariotechu.ca/sustainabilitytoday/urban-and-energy-systems/Worlds-largest-cities/energy-and-material-flows-of-megacities/kolkata.php
কয়লা নিয়ে বিশদে যাবার আগে সমসাময়িক উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে কিছু কথা আলোচনা করে নেয়া দরকার।
আজকের বৃহৎপুঁজির উৎপাদন ব্যবস্থার সূচনা - শিল্প বিপ্লব। ইউরোপের শিল্প বিপ্লব গোটা দুনিয়াকে প্লাবিত করেছে। প্রতিটি দেশের অর্থনীতি রাজনীতি সামাজিক ভারসাম্য শিল্প বিপ্লবের পণ্য প্লাবনে জারিত হয়ে আগেকার সব ব্যবস্থার বিপ্রতীপ অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। এই বিপুল পণ্য উৎপাদন কী ভাবে সম্ভব হল তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন দার্শনিক অর্থনীতিবিদ প্রযুক্তিবিদ সহ আরও বহু মানুষ। আমরা তাদের বক্তব্যের কাটা ছেঁড়া না করে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোতে নজর দিতে চাই।
যে কোনও শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল মূলত তিন রকমের - উদ্ভিজ্জ, প্রাণীজ, খনিজ (হাওয়া ও জলকে খনিজর সাথে যুক্ত রাখছি) শিল্প বিপ্লবের আগে শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে সব থেকে বেশি ব্যবহৃত হত - উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ বস্তু, খনিজের ব্যবহার ছিল সীমিত। শিল্প বিপ্লবে কাঁচামাল হিসেবে খনিজের ব্যবহার সব থেকে বেশি শুরু হল। এর আগে যন্ত্রের চালিকা শক্তি ছিল মানুষ বা পশুর কায়িক বল এবং কিছু ক্ষেত্রে বায়ু প্রবাহ, জলপ্রবাহ ( হাওয়া কল, জলযান )। শিল্প বিপ্লবে যান্ত্রিক শক্তির উৎস হল প্রথমে খনিজ কয়লা তারপর খনিজ তেল, যাকে এককথায় বলা হয় - জীবাশ্ম জ্বালানি।
জীবাশ্ম জালানিতে প্রকাণ্ড পরিমাণ শক্তি পাওয়া গেল যা যন্ত্রকে দিল দুর্বার গতি। কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানীতে এই শক্তি এলো কোথা থেকে? কয়লা তৈরি হয়েছে উদ্ভিদের অবশেষ থেকে পেট্রোলিয়াম প্রাণীর অবশেষ থেকে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এই উদ্ভিদ ও প্রাণীরা প্রকৃতি থেকে উপাদান নিয়ে পরিপুষ্ট হয়েছিল; বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক শক্তি লক্ষ বছর ধরে ক্রমান্বয়ে সঞ্চিত হয়েছিল এদের দেহে। তারপর তারা মাটির নিচে চাপা পড়ে ভূগর্ভের বিপুল পরিমাণ তাপ ও চাপকেও সঞ্চিত করেছে লক্ষ বছর ধরে। এই লক্ষ লক্ষ বছরের সঞ্চিত শক্তিকে আমরা
ব্যয় করেছি মাত্র আড়াইশো বছরে।
এতে মুশকিল হল দুটো -
১। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার পরিবেশ দূষণের মাত্রা ছাড়ালো, খনি তৈরি করতে গিয়েও বনভূমির ব্যাপক ক্ষতি হল।
২। উৎপাদন এমন বস্তুর উপর নির্ভরশীল হল, যা পূরণযোগ্য নয়। কোনও খনিজ একবার খরচ হয়ে গেলে আবার তৈরি করা যায় না।
শিল্প বিপ্লবের পরের উৎপাদন ব্যবস্থা যে ঝলমলে জীবন যাপনের হাতছানি দেয় তার পিছনের অন্ধকার নোংরা বাস্তবকে অত্যন্ত সযত্নে আড়াল করে। আমরা কখনোই বলি না এই বিদ্যুৎ কোথা থেকে এলো। এখনও সব থেকে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তাপবিদ্যুৎ থেকে, কয়লা পুড়িয়ে। জল বিদ্যুতের প্রকল্পগুলি একেবারেই সফল হয়নি। ভারতের অন্যতম বড় নদী নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ DVC এখন জল বিদ্যুৎ নয়, মূলত তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
এই খনিজ নির্ভর উৎপাদন ব্যাপারটা তুবড়ির মত, বহুক্ষণ ধরে বানিয়ে মুহূর্তে জ্বলে উঠে শেষ, তাই উজ্জ্বলতা বেশি, জৌলুস বেশি।
তুবড়ি সভ্যতা -
এই তুবড়ির বিষয়টা বিস্তারিত বোঝা দরকার। শুনতে মজার হলেও ব্যাপারটা আদৌ মজার তো নয়ই বরং ভয়ঙ্কর পর্যায়ের বিপজ্জনক।
খনিজের ব্যবহারের কয়েকটা দিক আগে দেখা যাক খনিজের ব্যবহার মূলত দু রকম -
১। গড়নের কাজে, যেমন - লোহা, বক্সাইট(এলুমিনিয়াম), তামা, পেতল, পাথর, নুড়ি, বালি ইত্যাদি।
২। জ্বালানির কাজে, যেমন - কয়লা, পেট্রোলিয়াম, লিথিয়াম ইত্যাদি।
এর বাইরেও অজস্র খনিজ আছে, তাদের বহু বিচিত্র ব্যবহার আছে, অতটা বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও এই দুই মূল ধারা নিয়ে আলোচনা করলেও আমরা পথভ্রষ্ট হবো না, তাই আমরা আমাদের আলোচনা মূলত এই দুই ধারায় সীমাবদ্ধ রাখবো
গৃহস্থ জ্বালানির প্রয়োজনে কয়লার ব্যবহার এখন খুবই সীমিত। কয়লার মূল ব্যবহার এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে। আগেই বলেছি - গোটা দুনিয়ার ৮০% বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তাপবিদ্যুৎ থেকে, যার মূল জ্বালানি কয়লা। তাই আজকের বিদ্যুৎ নির্ভর জনজীবন আসলে মূলত কয়লা নির্ভর।
এই কারণেই আমাদের এই বিদ্যুৎ নির্ভর সভ্যতাকে যদি তুবড়ি সভ্যতা বলি, বোধহয় খুব ভুল হবে না। কারণ একটা তুবড়ি জ্বললে দারুণ আলো হয় ঠিকই, কিন্তু তার আয়ু কয়েক সেকেন্ড। এবার আমরা যদি চাই চাই তুবড়ি জ্বালিয়ে ঘর আলো করবো তাহলে ক্রমাগত তুবড়ি জ্বালিয়েই যেতে হবে। তাতে ঘরের দশা যা হবে, সেটা আর বসবাসের উপযুক্ত থাকবে না। সত্যিই এই তুবড়ি সভ্যতার চোটে দুনিয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা অনেকেই সেটা টের পাচ্ছি না।
আগেই বলেছি এই বিদ্যুৎ মূলত তাপবিদ্যুৎ এবং তা কয়লা নির্ভর। কয়লা নির্ভর বিদ্যুতের বিকল্পে অনেকে পারমাণবিক বিদ্যুতের হয়ে সওয়াল করেন। এই লেখায় পারমাণবিক বিদ্যুতের গুণাগুণ নিয়ে আলোচনা করবো না, কলেবর প্রকাণ্ড বেড়ে যাবে। এই বিষয়ে বহু ভাল লেখা আছে, একটু খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন। শুধু একটা কথা স্পষ্ট করে দিই - আমরা পারমাণবিক বিদ্যুতের বিরোধী। আমরা মনে করি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কোনও কল্যাণকর বিকল্প হতে পারে না। খুব সহজ একটা উপমা দিয়ে পরমাণু বিদ্যুতের বিপদ বোঝানো যেতে পারে। মনে করা যাক একটা নতুন ফল আবিষ্কার হল - ক। ক খুবই সুস্বাদু কিন্তু খেলে সামান্য বিষক্রিয়া হতে পারে। সেই বিষক্রিয়ার জন্য চ ও ছ নামক ওষুধ পাওয়া যায়। এই ওষুধ এমনি ভালই কিন্তু কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, ট ও ঠ নামক ওষুধ খেলে সেটা সামলানো যাবে। তাতে প্রায় সব সমস্যাই মিটে যাবে শুধু একটু ঘুমের সমস্যা হতে পারে, আর কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। এবার বলুন, ক খেতে যতই ভাল হোক আপনি কি খাবেন ? নাকি খাবেন না? পরমাণু বিদ্যুৎ প্রায় এরকমই, বিপদের পর বিপদ, একটা চাপা দিতে অন্যটা হাজির, শেষমেশ খরচ দাঁড়ায় অকল্পনীয়।
কয়লা কোথা থেকে আসে?
খোলা মুখ খনি আর সুড়ঙ্গ খনি নিয়ে অনেকে কৌতূহল দেখাচ্ছেন। প্রাথমিক কিছু বিষয় বলা যাক। এবার কিছু ছবির সাহায্য নিতে হবে। সঙ্গের ছবিগুলোতে নম্বর দেওয়া আছে। প্রতিটি প্রসঙ্গের সাথে নম্বর মিলিয়ে দেখে নেবেন।
গোড়ায় আবার টার্মোলজির ধাঁধা - ক্রস সেকশন। শিখে নিই, ১ নম্বর ছবি দেখুন। একটা ডিমকে A,A1 বরাবর কাটলে A ছবির মত দেখতে পাবো। B,B1 বরাবর কাটলে B ছবির মত দেখতে পাবো। কাটলে সাইড থেকে যা দেখা যায় তাই ক্রস সেকশান।
সুড়ঙ্গ খনি
২ নম্বর ছবি দেখুন, এটা একটা কয়লা খনি অঞ্চলের ক্রস সেকশান। ওপরে মাটি টিলা জঙ্গল, নিচে বহু পাথরের স্তর। বেশ কয়েকটা স্তরের নিচে থাকে কয়লার স্তর(কালো রঙ দিয়ে দেখানো হয়েছে। কয়লার স্তরও সাধারণত কয়েকটা থাকে। এই কয়লার স্তরগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্রমাগত ঢালু হয়ে মাটির আরও গভীরে চলে যেতে থাকে। সাদা রঙ দিয়ে সুরঙ্গ বোঝানো হয়েছে। তীর চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়েছে সুড়ঙ্গ ক্রমাগত কোন দিকে বাড়বে। ছবিতে একটা গাঢ় ডটেড দাগ দেয়া হয়েছে, সেখান থেকে স্তরগুলো হঠাৎ বেঁকে গেছে। এই গাঢ় ডটেড দাগ দিয়ে চ্যুতি বা ফল্ট বোঝানো হয়েছে। ভূমিকম্পের ফলে মাটির নিচের স্তর হঠাৎ নেমে যায় বা উঠে যায়। সুড়ঙ্গও ওভাবেই কাটতে হয়। এই ধরনের কয়লা খনিতে প্রাণের ঝুঁকি খুবই বেশি। আমি যতবারই নেমেছি, বণ্ডে সই করে নামতে হয়েছে। এরকম খনির একটা নকল আছে কলকাতার বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড টেকনোলজিকাল মিউজিয়ামে। বেশ ভাল অনুকরণ, আগ্রহ থাকলে দেখে আসতে পারেন। ওই মডেলে পনেরো ফুটের মত নিচে নামতেই বহু দর্শকের ভয় লাগে, ক্লস্টোফোবিয়া হয়। আসল কয়লা খনি ৫০০ ফুটেরও বেশি গভীর হয়।
এই সুড়ঙ্গ খনিতে প্রাণের ঝুঁকি তো বেশি অবশ্যই এছাড়াও বহু সমস্যা আছে। মূল সমস্যা হল অপচয়। ৩ নম্বর ছবি দেখুন। কয়লার স্তরের ওপরের স্তরগুলো যদি সরিয়ে দেয়া হয়, তাহলে খনির কয়লার স্তর হবে কিছুটা এরকম দেখতে। যে কালো থামগুলো দেখতে পাচ্ছেন, সেগুলোও কয়লা। যে কয়লা ব্যবহারের জন্য তোলা হচ্ছে, সেই কয়লাই। এই থামের আকৃতির কয়লাগুলো ছেড়ে রাখতে হয়, নাহলে ওপরের স্তর ভেঙে পড়বে। অর্থাৎ এই থামগুলো পুরোটাই অপচয়। আসলে ব্যাপারটা আরও বহুগুণ জটিল, বোঝার সুবিধার জন্য সরল করে দেওয়া হয়েছে। বাস্তবত অপচয় আরও অনেক বেশি।
সুড়ঙ্গ খনিও একটা সময়ের পরে পরিত্যক্ত হয়। নিয়ম হচ্ছে, সুড়ঙ্গ বালি দিয়ে ভরাট করে দেওয়া। বাস্তবত তা হয় না। সেটার কারণ কখনও সদিচ্ছার অভাবে, আবার বাস্তবতও বালি দিয়ে ওই সুড়ঙ্গ পুরোপুরি ভরাট করা সম্ভব নয়। আর এই ভরাটের জন্য যে পরিমাণ বালি লাগবে সেটাও সেই বালির খনি অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটায়। ফলে খনি অঞ্চলে হঠাৎ করে মাটি ধ্বসে যাওয়া, নিচের কয়লার স্তরে আগুন লেগে মাটির উপরে উত্তাপ বা ধোঁয়া বার হওয়া ইত্যাদি আরও হাজার বিপদ থাকে।
খোলা মুখ বা ওপেন কাস্ট খনি
এখন সমস্ত কয়লা খনি ওপেনকাস্ট। অর্থাৎ একটা প্রকাণ্ড বড় গর্ত, সেই গর্ত কত বড়, আর কত গভীর তা সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে। সেই গর্তের পরিমাপ বর্গ কিলোমিটার দিয়ে মাপতে হয়, গভীরতা ৩০০ মিটারেরও বেশি।
আবার ছবির সাহায্য নিই।
৪ নম্বর ছবি দেখুন, আসল খনির ছবি দিয়ে বোঝানো মুশকিল, তাই মডেলের ছবি দেওয়া হল। একটা গর্তের মত যায়গা, লেখা আছে খাদান, আর একটা ঢিপির মত উঁচু, লেখা আছে ডাম্প। আগেই বলেছি ওপেন কাস্ট খনির গর্ত হয় প্রকাণ্ড বড়।
সেই গর্ত থেকে উঠে আসা বিপুল পরিমাণ মাটি-পাথর কী হয়? মূলত তিনটে ভাগ হয়। ১। টপ সয়েল ডাম্প, ২। মেইন ডাম্প, ৩। ব্যাকফিল।
মাটির নিচের কিছু দূর পর্যন্ত যা উপাদান থাকে তাতে গাছপালা জন্মাতে পারে, তাই এই মাটিটা আলাদা রাখা হয় টপ সয়েল ডাম্পে। বাকি পাথুরে মাটি জমা করা হয় মেইন ডাম্পে। খনির মূল গর্ত প্রথমে যেখানে হবে, পরে তার থেকে অন্য দিকে ক্রমাগত সরতে থাকে যেদিকে খনি এগোয় তার উলটো দিকের গর্তের পাড় ক্রমাগত ভরাট হতে থাকে, একে বলে ব্যাকফিল, এই ব্যাকফিলের উপরে টপ সয়েল বিছিয়ে দেওয়া হয়। কৃত্রিম বন সৃজন করা হয়। ৫ নম্বর ছবি দেখুন, বাঁদিকে ক্রমাগত মাটি কাটিতে কাটতে এগোবে, ডান দিকের ব্যাক ফিল ক্রমাগত ভরাট হতে হতে এগিয়ে আসবে। এই খনিটা ক্রমাগত বাঁদিকে সরে যাবে ( তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়েছে)।
একটা বড় খনিতে আড়াই তিন হাজার লোক কাজ করে। কিন্তু বুঝতে হবে অতি সামান্য অংশ খনির মূল টেকনিকাল কাজ করে। মাটি খোঁড়া ভরাট সবই যন্ত্রের সাহায্যে হয়, কয়েক শ লোক এই কাজগুলো করে ফেলে। বেশির ভাগ লোক রাস্তা, বাগান ঝাঁট দেয়, অন্যান্য ফাই ফরমাশ খাটে। খনিতে নামা ওঠার ঢালু রাস্তার পাশে নিরাপত্তার জন্য মাটি বা পাথরের বাঁধ দেওয়া হয়, একে বলে বার্ম। বহু লোক বার্মের দেখাশুনা করে, চুন দিয়ে মার্কিং করে। অর্থাৎ এই আড়াই হাজার লোকের মধ্যে খুব কম অংশই নিতান্ত অপরিহার্য, বাকিদের রোজ কাজ থাকে না।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এর থেকে সুন্দর ব্যবস্থাপনা আর কিই বা হতে পারে! কিন্তু এর পাশাপাশি আরও বহু ঘটনা ঘটে। ডাম্প আর ব্যাকফিলের মাটি একেবারেই প্রাকৃতিক থাকে না। ব্যাকফিল, ডাম্পে জড়ো হয় বিস্ফোরণে গুঁড়িয়ে যাওয়া পাথরের টুকরো, যা নিতান্ত ঝুরঝুরে। স্বাভাবিক মাটির নিচে পাথর জল বালি খনিজের অনেক রকমের স্তর থাকে। লক্ষ বছরের প্রাকৃতিক ক্রিয়া বিক্রিয়ায় এই ভূপ্রকৃতি তৈরি হয়। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বনভূমি শুধুমাত্র মাটির উপরিতলের চরিত্রের উপর নির্ভরশীল নয়, সেই মাটির বহু নিচে পাথরের স্তর, জলস্তর, জলপ্রবাহ, মাটির ঢাল আরও বহু কিছুর উপর নির্ভরশীল। ব্যাকফিল বা ডাম্পে এই ভূপ্রকৃতিই বিলীন হয়ে যায়। ভূপ্রকৃতির উপর নির্ভরশীল গাছপালা, বনজ সম্পদ, তার ওপর নির্ভরশীল প্রাণী জগত; খনিগুলো এই সমস্ত কিছুকেই ধ্বংস করে দেয়।
ওপেন কাস্ট খনিতে যতদিন খনিজ পাওয়া থাকে ততদিন খোদাই আর ভরাট চলতে থাকে। একদিকে খোঁড়া হচ্ছে অন্যদিকে ভরাট হচ্ছে। এই ভাবে চলতে চলতে একসময় খনিজ শেষ হয়ে যায়, অথবা যেটুকু থাকে তা তোলার খরচ এত বেশি যে তাতে খনি মালিকের পড়তায় পোষাবে না। তখন খনি পরিত্যক্ত হয়। পড়ে থাকে একদিকে মেইনডাম্পের ঝুরঝুরে পাথরের টিলা অন্যদিকে সিঁড়ির মত ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া এক প্রকাণ্ড গর্ত। এই একেকটা ধাপ তিন তলা বাড়ি সমান উঁচু। সেই গর্ত প্রায় একটা প্রমাণ আকারের হ্রদের মতো। তার গভীরতা কয়েক শ মিটার। কোনও বড় দীঘির গভীরতা ২০মিটারও হয়না, আর পরিত্যক্ত খনির গভীরতা ২৫০/৩০০ মিটার, অত গভীরে কোন উদ্ভিদ বা প্রাণী জন্মায় না। তাতে টলটলে জল জমে না, মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা বহু বিষাক্ত খনিজ সেই জলে মেশে। নিখুঁত প্রাকৃতিক ভারসাম্যের এক বনভূমি, খনিজর চাহিদা মেটাতে হয়ে যায় প্রকাণ্ড এক মৃত্যুফাঁদ। কত প্রজাতির প্রাণী উদ্ভিদ যে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই খনির সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় তার কোনও খতিয়ান নেই।
যে জঙ্গল উজাড় হয়ে গেল ঝকঝকে আলো জ্বালানোর স্বার্থে, সেই জঙ্গল এত দিন কী করছিল? সে কি শুধু অক্সিজেন আর কাঠের যোগানদার ছিল? এই বনভূমির উপর নির্ভরশীল আমাদের দেশের আদিবাসী সমাজ। আমাদের ইতিহাসে পড়ানো হয় - নদীর ধারে উর্বর পলি মাটি অঞ্চলে মানুষ প্রথমে বসতি স্থাপন করে, কারণ শেখানে কৃষি কাজ করা সহজ। কিন্তু আমরা কী ভেবে দেখি - আমাদের আদিবাসী সমাজ কেন দুর্গম বনাঞ্চলে, পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় বসবাস করে? কেন এত কষ্ট সহ্য করে তারা ঐরকম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকে? অনেকে বলেন - তথাকথিত সভ্য মানুষদের অত্যাচারে আদিবাসীরা এরকম জায়গা বেছে নিয়েছে। হ্যাঁ তা হতেই পারে, কিন্তু তার পাশাপাশি আরও একটা সত্য আছে - আদিবাসীরা জঙ্গল থেকে জীবনযাপনের বহু উপাদান সংগ্রহ করতে সক্ষম। তথাকথিত সভ্য মানুষেরা বনাঞ্চলকে আদিবাসীদের মত করে চেনেই না। এখনও বহু আদিবাসী সমাজে কৃষিকাজ প্রচলিত নয়, তারা এখনো মূলত সংগ্রাহক, অত্যন্ত কম তাদের চাহিদা। স্বাধীন ভারতে খনি ড্যাম রাস্তা রেলপথ আর কারখানা বানানোর উন্নয়নের গুঁতোয় আমাদের দেশের কোটি কোটি আদিবাসী উৎখাত হয়েছে তাদের নিজস্ব আবাস থেকে। তাদের ঠাঁই হয়েছে নোংরা বস্তিতে। স্বাধীন প্রকৃতি নির্ভর জীবন থেকে উৎখাত হয়ে তারা হয়েছে সস্তার মজুর। আদিবাসীদের শিল্প কলা গান নাচ কারিগরি সব কিছুই ধ্বংস হচ্ছে এই উৎখাতের পরিণামে। নগরায়নের বিনিময়ে কোটি কোটি মানুষের জীবনের এই অবনমনকে মানবো কোন নৈতিকতায়?
অর্থাৎ আমার আপনার বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতেই কয়লা খনি। উন্নত জীবনযাত্রার দ্যোতক হিসেবে যে পণ্যগুলোকে আমাদের সামনে থরে থরে সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো আসলে টোপ, ওর ভিতরে লুকোনো আছে বিষাক্ত বড়শি। আমরা যত বেশি পণ্য কিনে ‘সুখী’ হবার চেষ্টা করবো, আমাদের গলায় ঐ বিষাক্ত বড়শি তত বেশি করে গেঁথে যাবে। আমাদের বুঝতে হবে - গরমে ঘেমে নেয়ে যখন ফ্রিজের ঠাণ্ডা জলের বোতল হাতে নিই, ঐ শীতলতা তৈরি করতেই খনি খনন করা হচ্ছে, জঙ্গল উজাড় হচ্ছে, আদিবাসী উচ্ছেদ হচ্ছে। আমার শরীর ঠাণ্ডা করতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে মারা পড়ছে অজস্র জীবজন্তু পাখি। প্রত্যেকবার প্রতিটি জিনিস কেনার আগে নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার কিসের বিনিময়ে আমি এই পণ্য কিনছি? এই পণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে পরমা-প্রকৃতির যে ক্ষতি আমরা করছি, তার ক্ষতিপূরণ কি টাকা দিয়ে করা সম্ভব? ভাল জীবন যাপনের যে মাত্রাগুলো আমরা ধরে নিয়েছি - বাড়ি, গাড়ি, দামি পোশাক, আসবাব, হাজার রকমের বৈদুতিন যন্ত্র - এগুলো কি সত্যিই ভাল থাকার নিদর্শন? টাকা থাকলেই কি কিনে নেয়া যায় সব কিছু? দেউচা পচামির কয়লা খনির বিরোধিতার পাশাপাশি এই ভীষণ জরুরী প্রশ্নগুলো নিজেদের কাছে নিজের বারংবার তুলে যাওয়া আমাদের সামাজিক দায়িত্ব।
ঠিক এই কারণেই আলোচনার শুরুতে ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা বা প্রতিতুলনা করিনি? কিসের ক্ষতিপূরণ? কী দিয়ে আপনি পূরণ করবেন এক স্বাধীন স্বতন্ত্র অরণ্যনির্ভর প্রাকৃতিক জীবন যাপন থেকে উচ্ছেদ হয়ে রেল লাইনের ধারে ঝুপড়ি বাসির জীবন যাপনকে? হয়ত গুনলে দেখা যাবে মানুষগুলোর জীবনে নগদ টাকার আমদানি কিছু বাড়বে, কিন্তু তা দিয়ে কী পূরণ হবে? ঝোড়ার টলটলে জলে অবগাহন, সবুজ ঘাসে ঢাকা টিলায় মোষের পাল চড়াতে চড়াতে আড় বাঁশিতে তোলা সহজ সুর, চাঁদনী রাতে মাদলের বোলে দুলে ওঠা শরীর! টাকায় কি পূরণ হয় অরণ্যের অধিকার?
আমরা জানি সরকার জনগণের জীবনের মানোন্নয়নের নাম করে যে সমস্ত প্রকল্প গ্রহণ করে, সেখানে জনগণ পায় শুধুমাত্র বাইরের খোসা। এই উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর আসল শাঁস খেয়ে পুষ্ট হয় বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠী। দেউচা - পচামিও ব্যতিক্রম নয়, কোন মধুর গন্ধে নবান্নে শিল্পপতিরা ঘনঘন যাতায়াত করছেন সে আমরাও বুঝতে পারছি। দেউচা পচামিও আসলে গরীবের জীবনকে আরও দরিদ্র বানানোরই আয়োজন। তাই খনি প্রকল্পের বিরোধিতা করতেই হবে। বারংবার সোচ্চারে বলতে হবে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার ধ্বংসাত্মক দিকগুলো। কিন্তু সরকার আর পুঁজিপতিদের দোষারোপ করেই যদি থেমে যাই তা হবে বিকট আত্মপ্রবঞ্চনা। আমি শহরে বসবাস করে নাগরিক জীবনের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা নেব - এয়ারকন্ডিশন মলে মার্কেটিং করবো, এসি মেট্রোয় চড়বো, এসি বাসে চড়বো, আমার পরিবারের সন্তান দশ দিক কাঁচে মোড়া ঠাণ্ডা আইটি হাবে মোটা মাইনের চাকরি করবে আর আমি প্ল্যাকার্ড নিয়ে দেউচা পচামির বিরোধিতা করবো, এত ভণ্ডামি সইবে না।
তাহলে আমরা এসে দাঁড়ালাম এমন এক অবস্থানে যার এক দিকে আছে বিদ্যুতময় ঝলমলে জীবন যাপন আর অন্য দিকে আছে পরিবেশ দূষণ, অরণ্য ধ্বংস, আদিবাসী উচ্ছেদ। এর বাইরে কি হতে পারে এমন কোন অবস্থান, যেখানে আত্মবিশ্বাসী স্বরে উচ্চারণ করতে পারি - মেলাবেন, তিনি মেলাবেন…
আলোচনার এই মোড়ে এসে অনেক বন্ধু বলছেন - অত চাপ নিস না, বৈজ্ঞানিকরা ঠিক কোনও না কোন উপায় বের করে ফেলবেন, যাতে ধর্ম ও জিরাফ দুইই বাঁচবে। আমরা সবাই বিজ্ঞানের ছাত্র নই, কিন্তু এটুকু বুঝি বিজ্ঞানের জগৎ আলিবাবার গুহা নয়, যে চিচিং ফাঁক বললেই বন্ধ দুয়ার খুলে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে যাবে অনিঃশেষ খাজানা। বাষ্প শক্তির উদ্ভাবনের সময়েও ভাবা হয়েছিল - এই পাওয়া গেছে আলাদিনের দৈত্য। সব কিছুই করিয়ে নেয়া যাবে এই দিয়ে। কিন্তু বাস্তবত কী ঘটেছে সে আমরা সবাই জানি।
তাপবিদ্যুতের বিকল্প অনুসন্ধানও বহু দিন ধরে বহু পথে চলেছে। তার বিশদ আলোচনা পরে কোনও লেখায় করা যাবে, হিসেব কষা যাবে গ্রীন এনার্জির নাম করে যা কিছু সামনে আনা হয়েছে, হচ্ছে তা আসলে কত টুকু গ্রীন, কত টুকু ক্লিন। আপাতত বিকল্প বিদ্যুৎ উৎসগুলোর মুশকিল নিয়ে একটু মুখড়া করে রাখি।
সৌর বিদ্যুৎ পশ্চিমবঙ্গে সৌর বিদ্যুৎ বেশ ভাল বিকল্প, কারণ বছরের বড় অংশ ভাল রোদ পায়।
মুশকিল -
১। সোলার প্যানেলের মূল উপাদান এমন কিছু খনিজ যেগুলো ‘রেয়ার আর্থ মেটেরিয়াল’ গোত্রে পড়ে, ফলে দাম বেশ বেশি।
২। সৌর বিদ্যুতের উৎপাদনে একক পিছু জায়গা লাগে অনেকটা বেশি - খুব ভাল জাতের সোলার প্যানেল বসালেও ১ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ পেতে জায়গা লাগে ৪ একর।
জল বিদ্যুৎ
মুশকিল -
১। বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প বানাতে নদীতে বড় বাঁধ দিতে হয়, খরচ অত্যন্ত বেশি।
২। জলাধার বানাতে গ্রামের পর গ্রাম উচ্ছেদ হয়।
৩। বাঁধ দিলে পলি জমে খাত বুঁজে যায়, নদীটাই মরে যায় কিছু দিন পর।
জৈব বর্জ্য
বড় শহরে ভাল সম্ভাবনা আছে কিন্তু অন্যত্র যথেষ্ট যোগান পাওয়া সমস্যা।
মুশকিল -
১। তাপবিদ্যুতের সমকক্ষ নয়।
২। বর্জ্য উৎসতেই আলাদা করে ফেলতে হবে, এর জন্য যে জনসচেতনতা দরকার তা বিরল।
বায়ু শক্তি
ফাঁকা জায়গায় ভাল সম্ভাবনা আছে।
মুশকিল -
১। বড় হাওয়া কল বানানো প্রচুর খরচ সাপেক্ষ।
২। তাপ বিদ্যুতের সমকক্ষ নয়, কারণ বায়ুপ্রবাহ নিয়মিত নয়।
৩। সারা দুনিয়া জুড়েই বিধ্বংসী ঝড় যে হারে বাড়ছে, তাতে বড় হাওয়াকল টিকিয়ে রাখাই সমস্যা হচ্ছে।
এই সমস্ত পদ্ধতিগুলোর সাথে লেজুড় হিসেবে আর এক সমস্যা এসে যোগ হয় যার নাম - ব্যাটারি। কোনও বিদ্যুৎ উৎপাদনই সমরৈখিক নয়। উৎপাদন বাড়ে কমে। এই সমস্যার সমাধান হিসেবে রিচার্জেবল ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। ২০২০র ফিজিক্সে নোবেল দেওয়া হয়েছিল লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির গবেষণার জন্য। সব জাতের রিচার্জেবল ব্যাটারি মানেই তার আয়ু শেষ হবে এক সময়ে এবং সেই মরা ব্যাটারিকে রিসাইকেল করার সময় ব্যাপক পরিবেশ দূষণ হয়। আর লিথিয়ামের জন্য কী হতে পারে তার সাক্ষী দিচ্ছে রক্তাক্ত আফগানিস্তান, কঙ্গো সহ আরও বেশ কিছু দেশ। তাই যারা ব্যাটারি চালিত গাড়ি চালিয়ে ভাবছেন দূষণ কমিয়ে ফেললাম, তারা একবার চার্জিং পয়েন্টের পিছনে উঁকি দিয়ে দেখবেন - চার্জিংএর বিদ্যুৎ আসছে কোথা থেকে, আর ব্যাটারি বৃদ্ধ হলে কোন ভাগাড়ে পাঠাবেন?
এমত অবস্থায় উপায় কী?
একে তো কয়লার বিদ্যুতে ব্যাপক ময়লা, আর সেটাও ফুরিয়ে যাবেই। দুনিয়া জুড়ে কপালে ভাঁজ। সাথে উপরি পাওনা - গ্লোবাল ওয়ার্মিং, হিমবাহ গলছে, সমুদ্রের জল বাড়ছে, ঘূর্ণি ঝড় বাড়ছে, কলকাতা ডুবুডুবু। ক্লাইমেট এমার্জেন্সি। গ্রেটা থুনবার্গ। ফ্রাইডে ফর ফিউচার। দূষণ কমানোর আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার। আরও হাজার ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে শেষমেশ হাতে রইল পেনসিল।
অন্তত এখনও পর্যন্ত এমন কিচ্ছু নেই যা তাপবিদ্যুতকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে, সে রকম কোনও খবর নেই। মানে পরিস্থিতি এরকম - মাসের ২২ তারিখেই রেস্তো ফুরিয়ে এসেছে পরের মাসে মাইনে হবে কিনা তা নিয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা, হলেও পুরো মাইনে হয়তো পাওয়া যাবে না। এরকম অবস্থায় বাকি ৮ দিন যা করা হয়, আপাতত সেটাই করা ছাড়া আর কোনও উপায় হাতের কাছে নেই। প্রতি বার বিদ্যুতের সুইচ অন করার সময় নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে - ঠিক কতটুকু আমার নিতান্ত দরকার।
জানি - প্রয়োজন আর বিলাসিতার মাঝের সীমারেখা ভীষণ ঝাপসা, আর সেই সীমারেখাকে আরও বেশি করে গুলিয়ে দেওয়ার কাজটাই দক্ষতার সাথে করে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন। বুঝে ওঠাই মুশকিল হয়ে যায়, সত্যিই ঠিক কত টুকু আমার চাহিদা আর কোথায় গিয়ে বিলাসিতায় গা ডোবাই, তবুও বুকের মাঝে ধক ধক করে বেজে চলা হৃদয়ের কাছেই জানতে চাইতে হবে কোথায় আমি থামবো। কখন বলবো - আর না এতেই দিব্যি কাজ চলে যাবে। আমাদের চেতনা, শিক্ষা, সংস্কৃতি বলে গর্ব করার মত যদি কিছু থাকে, তাহলে সেটুকু সম্বল করে প্রয়োজন আর বিলাসিতার মাঝের ঝাপসা অঞ্চলে বারংবার তদন্ত করে দেখতেই হবে সক্কলকে, ফারাকগুলো স্পষ্ট করতে পারি কি না। অবিরাম পণ্য স্রোতের মাঝে বিবেক নামক খড়কুটো আঁকড়ে বেঁচে থাকতে পারি কি না।
তেমনই আমাদের গড়ে তুলতে হবে এক সামাজিক আন্দোলন - জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প অনুসন্ধান। ভাবছেন - এ তো বৈজ্ঞানিকদের কাজ, সাধারণ মানুষ কী করবে? আজ বৈজ্ঞানিক/প্রযুক্তিবিদরা কাজ করেন হয় বড় কোম্পানিতে অথবা বড় গবেষণা কেন্দ্রে। এই দুই জায়গাতেই টাকা ঢালে পুঁজিপতিরাই, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন - কী গবেষণা হবে এবং তা দিয়ে কারা মুনাফা করবে। তাই ঐ সব গবেষণাগার থেকে এমন কিছুই উদ্ভাবন হবে না যা সমাজকে পুঁজিবাদী উৎপাদনের ফাঁদ থেকে বেরোতে সাহায্য করবে। তাই বিকল্প জ্বালানির খোঁজ যদি শুধুমাত্র বড় গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে তা আবার কিছু মানুষের মুনাফার জন্যই ব্যবহৃত হবে, সামাজিক জ্ঞান ও সামাজিক প্রযুক্তির বিকাশ হবে না। সামাজিক জ্ঞান ও প্রযুক্তি, মানে যে জ্ঞান ও প্রযুক্তি পেটেন্ট দ্বারা সংরক্ষিত নয়, সামাজিক সম্পদ হিসেবে সমাজেই বিকশিত হয়, সেই প্রযুক্তিই আমাদের দরকার। তাহলে সামাজিক মানুষ হিসেবে আমাদেরও প্রত্যেকের সামাজিক দায়িত্ব হয় - যারা এই ধরনের সামাজিক প্রযুক্তি ও জ্ঞানচর্চার কাজ করেন, তাদের মাথায় ছাতা ধরা। যাতে এই সমস্ত নতুন পথের পথিকরা কর্পোরেট পুঁজিপতির সেবাদাস না হয়েও নিশ্চিত জীবন যাপন করতে পারেন। তাই সামাজিক আন্দোলন হোক দ্বিমুখী - একদিকে নতুন প্রযুক্তিবিদদের উৎসাহ দেওয়া হোক সমাজ বিকাশের উপযোগী প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে, অন্য দিকে তাদের তৈরি করা প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করাই হোক আমাদের সামাজিক দায়িত্ব।
এই রাস্তায় না হাঁটলে গলা থেকে বড়শি বার করা যাবে না।
পুনশ্চ - চার হাজারের বেশি শব্দে লিখে ফেলা এই বাক্যালাপ পড়ে ফেলার পর একটা ব্যক্তিগত অনুরোধ। আমি কোনও বিশেষজ্ঞ নই। ঘটনাচক্রে আজব এক পেশায় জড়িয়ে থাকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হরেক চত্বরে ঘুরে ফিরে করে খেতে হয়। নিতান্ত পেটের দায়ে শিখে নিতে হয় নানা বিষয়। কোনও ভুল বা অসংগতি চোখে পড়লে জানাবেন, শুধরে নেবো। ফেসবুকে - কারিগর শমীক সাহা নামে খুঁজলে (বাংলায় টাইপ করবেন) আমাকে পেয়ে যাবেন। যোগাযোগ রাখবেন। ধন্যবাদ।
ডিসেম্বর ২০২১