সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
আমি ছাদে দাঁড়িয়ে আমার মা’কে চলে যেতে দেখছিলাম।
সেদিন ষষ্ঠী। আমাদের পাড়ার মণ্ডপে ঠাকুর এসে গেছে। আমার ছাদ থেকেই পাড়ার পুজো মণ্ডপ দেখা যায়। কেউই প্রায় নেই সেখানে। মণ্ডপ খাঁ খাঁ করছে। বোধন কখন হবে কে জানে! একে অকালবোধন বলে। তার সময় হয়নি এখনও।
এবারে জাঁকজমক কম, সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। আশে পাশে ডাইনে বাঁয়ে সন্দেহ নিয়ে তাকায়, কোথায় করোনা-রুগী ঘাপটি মেরে দিব্যি ভালোমানুষটি সেজে বসে আছে, কে জানে! আমি ঘোষিত করোনা রুগী। দো-তলার ঘরে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত। কতটা স্বেচ্ছা কে জানে! সবাই মিলে কতরকম ইচ্ছে তৈরী করে ফেলে একেক সময়, যখন মনে হয়, ওই ইচ্ছেটাই আমার ইচ্ছে। সেভাবেই আমি আমার এই বন্দীত্বকে, আমার অসুখকে, আমার অসহয়তাকে মেনে নিয়েছিলাম। মেনে নেওয়াও নয় হয়ত, এই নির্বাসনকে আমি আমার সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখতে স্বস্তিবোধ করেছিলাম। সেই সিদ্ধান্তের একটা অংশ হল আমার মা’কে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া। তাঁরই ভালোর জন্য যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, সেখানে তাঁর মতামত বাহুল্য এবং অবাঞ্ছিত। তাই হাতের ছোট ব্যাগটা বুকের কাছে নিয়ে মা রওনা দিলেন সুস্থ কোনো নিকেতনের ঠিকানায়।
আমি তখন আমাদের ছাদে। সকালের রোদ তখন মোলায়েম, আমাদের পাড়া জুড়ে ছুটির মেজাজ আর আলস্য। আমি ছাদ থেকে দেখলাম পুজোর জোগাড় দেবার জন্য সদ্য-কিশোরী দু’জন চান-টান সেরে মণ্ডপে এল, পুরোহিত মশায় আসেননি তখনও। আমাদের গলিটার ধার ঘেঁষে ছোট্ট ছোট্ট ফুল ধরেছে চোখে না -পড়া গাছে। রাস্তার ধুলোয় তখনও ভিজে ভাব। বড় রাস্তা দিয়ে দু’একজন লোক হেঁটে, সাইকেলে পার হয়ে যাচ্ছে। সকলের মুখ ঢাকা অজানা যুদ্ধের মোকাবিলায়। আমি দেখলাম, রওনা হবার পর মা গলিটার মুখে গিয়ে একবার দাঁড়ালেন, পেছন ঘুরে তাকালেন, আমাদের বাড়িটাকে একবার দেখলেন, তারপর আবার হেঁটে গলির বাঁক ছাড়িয়ে গেলেন।
প্রথম যখন খবর এল, আমার রিপোর্ট পজিটিভ, আমার ভয় করেছিল। কিন্তু ভয় পেয়ে আমি কী ভেবেছিলাম, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না! আমি কী মরে যাব ভেবেছিলাম! মৃত্যুভয় কাকে বলে, আমি জানি না! প্রথমটায় একটু নার্ভাস হয়েছিলাম হয়ত, তারপর তো বেশ জাঁক করেই সবাইকে ফোন করে দিলাম, ফেসবুকে আপডেট দিয়ে দিলাম, আমি ভাই করোনা রুগী, একজন সচেতন নাগরিক। এই বার্তা প্রেরণ এক মহান সামাজিক কর্তব্য বলে আমি মনে করি। একটা চিনচিনে দু;খ ভেতরে কাজ করছিল, এ এমন এক পোড়ামুখো রোগ, যে কেউ দেখতেও আসবে না। ফোন করেই দায় সারবে! হলও তাই! ফোনের বন্যা বয়ে গেল! সকলেই একই কথা জানতে চায়, কী করে কী হল! আমি মুখস্থের মত সকলকে একই কথা বলে যাই। শুধু মা’য়ের চলে যাওয়ার খবরটা আমার বিবরণে থাকে না, কেন না, ওটা রোগ-সংক্রান্ত কোনো খবর নয় বলেই আমার মনে হয়। না লক্ষণ, না ফলাফল!
ছাদের মিঠে রোদে বসে কথাগুলো যখন মনে পড়ছিল, তখন হঠাৎই যেন মনে হল, গলির শেষপ্রান্তে মায়ের ছায়াটা এতক্ষণে বাঁক নিল! এমনটা তো হও্যার কথা নয়! শুনেছি রোগটা সবাইকে খুব দুর্বল করে দিচ্ছে। আমি কী সেই দুর্বলতার শিকার!
আমার নির্বাসনের পঞ্চম দিনে আমি খবর পেলাম, সুমিতা মারা গেছে! আশ্চর্যের ব্যাপার,এ খবরে আমার যতখানি প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা, তা হল না! সুমিতা আমার পাড়ার মেয়ে। মেয়ে, আমাদের খান তিনেক বাড়ির পরেই ওদের বাড়ি। ও আমার বউ মিত্রার কাছে প্রায়ই আসে বলে শুধু নয়, পাড়ার সমস্ত ব্যাপারে ও খুবই উদ্যোগী। দুর্গাপুজোর চারটে দিন ওই সবচেয়ে বেশি হই হই করে। আমার মা’কে ও ঠাকুমা বলে ডাকে। সেই সুমিতাকে ক’দিন ধরে যে মণ্ডপের ধারে কাছেই দেখলাম না, এই নিয়ে আমার কিছু মনে হয়নি তো! আলাদা করে মনেই পড়েনি ওর কথা! আসলে, দিনগুলো এমন হুড়মুড় করে ছুটতে থাকে সারা বছর, যে নিজের অসুখবিসুখ না করলে কাউকে নিয়ে দু’দণ্ড ভাবার অবসর হয় না! মিত্রাকে জিজ্ঞেস করাতে ও বলল, শুনেছিলাম, মেয়েটা নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছে, তা বলে.. মিত্রা কথা শেষ করে না ,বা করতে পারে না! চুপ করে আমার জন্য নির্ধারিত পুষ্টিকর খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখে। আমি দুরত্ব বজায় রেখে উষ্মা জানাই, কই, আমাকে তো কিছু বলোনি! মিত্রা আমার দিকে সোজা তাকায়। এটা আমার অপ্রয়োজনীয় ব্যাগ্রতা বলে ওর মনে হচ্ছে, এরকম কিছু ওর চোখ দেখে মনে হয় না!
তবু আমি ‘এত কিছু একবারে খাওয়া যায়’ বলে প্রসঙ্গ পাল্টাই। সেটা দশমীর দিনের কথা। মা দুর্গাকে সেদিন বিসর্জন দেওয়া হবে। বিলিতি লিকারের প্রভাবে পাড়ার ছেলেদের মুখ গর্জন তেলের মত চকচক করছে। সুমিতার বডি আসার আগে ঠাকুর বেরিয়ে যাবে। এবার নাচানাচি, হুল্লোড় এমনিই বন্ধ, আর পাড়ার মধ্যে এরকম একটা ঘটনায় তো সকলে আরও মুষড়ে পড়েছে। অনেকেই বলছে, সত্যি, পুজোগণ্ডার দিন কী সব খবর গো!
আমার মা’য়ের ফিরে তাকানোটা অনেকদুর পর্যন্ত গেল বলে আমার মনে হল। আমি সেই দৃষ্টিপথ ধরে তাকা্নোর চেষ্টা করলাম। বিশুদার বাড়ির সজনে গাছে চোখ আটকে যায় আমার। বিশুদার ছেলেটা বাইরে আছে। মুম্বাই না পুনে, কোথায় যেন! এমনকি ওর নামও মনে পড়ে না আমার! এরকম তো হওয়ার কথা নয়! এই রোগে স্মৃতিও লোপ পায় নাকি! মিত্রাকে কথাটা বলতে ও বলে, ‘আমারও ছাই মনে আছে নাকি, ওসব!’ আমি আশ্বস্ত হই!
বিশুদাদের সজনে গাছের পাতাগুলো কেমন আত্মসমর্পণের ভঙ্গীতে নত হয়ে আছে। ঘন পাতা ভেদ করে বিশুদার ঘর সংসার চোখে পড়ে না আমার। সে কী আমি এতটা উঁচুতে আটকে বলে! মা হয়ত দেখতে পেয়েছে ওদের গেরস্থালির ছবি। বিশুদার বউয়ের নামটাও মনে পড়ে না আমার! তবে এবার আর মিত্রার শরণাপন্ন হই না আমি!
দোতলায় থাকি বলে টি ভি দেখা হয় না আমার। মিত্রা খবরের কাগজটা ওপরে দিয়ে যায়। আমি বাইরে আটকে পড়া লোকগুলোর কথা পড়ি। পড়ি ওদের দুর্দশার কথা। বিশুদার ছেলের কথা মনে হয় আমার, একটু উদ্বেগও হয়। কিন্তু ছাদের কার্ণিশের কাছাকাছি এসেও আমি সজনে গাছ টপকে ওদের সংসারে ঢুকতে পারি না!
মণ্ডপে লোক বাড়লে আমি ঘরে চলে আসি। মণ্ডপের থেকে ঘুরে তাকালেই সবাই আমাকে দেখতে পাবে। হয়ত ভয় পাবে। আমি সেটা চাই না। আজকাল এই রোগের দৌলতে চারিদিকে খুব গণ্ডী কাটাকাটি হচ্ছে, স্টেশনে , বাজারে, রাস্তায়।এই গণ্ডীটাকে ঠিকঠাক চিনে নিতে পারি বলেই তো আমরা সভ্য। গণ্ডী টানতে টানতেই তো এগিয়ে চলে সবটা। আমি ঘরে চলে যাই।
সেই যে ষষ্ঠীর সকালে আমার মা চলে গেল নিরাপদ আশ্রয়ে, তারপর থেকে মা রোজই ফোন করে জানতে চায় আমার খবর। আমার বেশ তৃপ্তি হয়, আমি এক মহান কর্তব্য করেছি ভেবে। অন্যের ভালো করতে পারার মধ্যে একটা মানসিক তৃপ্তি আছে। কত জায়গায় কতজনের কতরকমের ভালো করার আয়োজন প্রতি মুহূর্তে আছড়ে পড়ে আমাদের বেঁচে থাকায়, ভাবলেও আমার অসুস্থ শরীরে শিহরণ হয়! যারা করছেন, তারা তো আমাদের ভালো হবে বলেই করছেন এ সব। আর অতো বড় করে ভাবতে পারেন বলেই তারা বড় মানুষ, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকে না আমার! সে ভাবেই গড়ে ওঠে নগর, সড়ক পথ, বিমানবন্দর, বা অতিথিশালা। ইতিহাসেও তো এ সব কথাই লেখা আছে। সুমিতার কথা আলাদা ভাবে ইতিহাসে লেখা হয় না বলে আমার এই সময়ে মনে হয়, সেটা আমার দুর্বল মনের বিকার কিনা কে জানে! সুমিতার নাকি একটা বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু ঠিক ঠিক ক’দিন ও শ্বশুরবাড়ির ঘর করেছিল, আমি জানি না। মিত্রা বা মা জানতে পারে। আমরা, পুরুষমানুষরা একটু উদাসীন থাকতে অভ্যস্ত। উদাসীনতাটা আমাদের সঙ্গে যায় ভালো! সুমিতাদের ঠিক পাশের বাড়ির দেবাঞ্জন বাবু, যার সঙ্গে আমার একটা মাপা ‘ হ্যালো হাই’এর সম্পর্ক, তিনি ওই দশমীর পড়ন্ত বিকেলে ছাদে উঠে আমার মুখোমুখি হয়েছিলেন, আর আমার শ্রবণগ্রাহ্য হতে পারে এমন চিৎকারে জিগ্যেস করেছিলেন, ‘কীসে মরল, জানলেন?’ দেবাঞ্জন বাবুর এই প্রশ্ন আমার কানে, মগজে লেগে থাকে অনেকক্ষণ! এরপর মা দুর্গাকে বাইরে আনার তোড়জোড় শুরু হয় মণ্ডপে। ঢাকের আওয়াজ উত্তরোত্তর বেড়ে চলে, ছোটবেলা থেকে আমরা ঢাক বাজলেই মিলিয়ে বলতাম, ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন!’ সেদিন বার বার ঢাকের আওয়াজে বেজে উঠছিল, ‘মরল কীসে! মরল কীসে!’ তালে তাল মিলছিল না, কিন্তু তার সময়ও নয় এখন। পরে ভেবেছি, অসুখটা আমাকে ভালোই পেড়ে ফেলেছিল!
সন্ধে গড়িয়ে গেলেও আমি ছাদে বসে থাকি।
বিসর্জনের পরে পুজো মণ্ডপ জুড়ে বিষাদ ছড়িয়ে থাকে। প্যাণ্ডেলের কাপড় কোথাও খোলা, কোথাও ছিঁড়ে ফেটে গেছে। চারিদিকে থার্মোকলের বাটি, দোমড়ানো জলের বোতল, শুকনো ফুল, আধপোড়া মোমবাতি, বাঁশের টুকরো পড়ে আছে। একটা লাইট টিমটিম করে জ্বলছে, বাকি আলো খুলে ফেলা হয়েছে। মণ্ডপের মাঝখানে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। ওর আলোর চারদিকে শূন্যতা যেন আরো বেশি হা হা করছে। আমি দেখি, সেই বিষন্ন সন্ধ্যায় বিজন মণ্ডপের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বিশুদার বউ। হাত দূটো বুকের কাছে নমস্কারের ভঙ্গীতে জড়ো করা। খানিকটা শিথিল সেই করজোড়। যেন কপাল পর্যন্ত হাত দুটো তোলার জোর পাচ্ছে না বউটা। ওর কী দেরী হয়ে গেল? দুগ্গাঠাকুর বিদায় নেবার পর ওকে এসে দাঁড়াতে হল শূন্য মণ্ডপে? আমার এসব কথা ভাবার মধ্যেই বউটা খুব ধীর পায়ে ওখান থেকে চলে যায়। যাবার আগে আমাদের দরজার দিকে একবার তাকায়। সম্ভবত আমার মা’কে দেখার প্রত্যাশা করে। কিন্তু ডাক দেয় না। আমি ছাদের ওপর থেকে সবই লক্ষ্য করি। কোনো আও্য়াজ দিই না। আমার কী মিত্রাকে ডেকে দেওয়া উচিত ছিল! হয়তো তাই! কিন্তু আমি নড়াচড়ার উদ্যোগ নিই না! এই অসুখ কী আমাকে সিদ্ধান্তহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে!
অষ্টমীর সকালে আমাদের মণ্ডপ জমে উঠেছিল। মেয়ে বউরা স্নান সেরে নতুন শাড়ি পরে একপ্রকার মণ্ডপের দখল নিয়েছে। নানা বয়সের পুরুষেরা পাঞ্জাবি-পাজামা, ইস্তিরি করা জামা-প্যাণ্ট পরে একটু দূরে তৃপ্ত মুখে দাঁড়িয়ে। আমি ছাদে থাকা দূরের দর্শক, তাই একটু উঁচু আর দূর থেকে সবটা দেখতে পাই। বিশুদাদের সজনে গাছের ওপর একটা বিজ্ঞাপনের ব্যানার ঝোলানো হয়েছে। ফলে এখান থেকে ওদের ইতিউতি দেখার সম্ভাবনাটুকুও গেছে। পুরোহিত মশায় ছোকরা ছেলে, গলার জোর আছে এমনিতেই। তার ওপর লাউডস্পিকারে মন্ত্র পড়ছে, যাতে অঞ্জলিদাতাদের কানে সবটুকু স্পষ্ট পৌঁছায়। এ সব ব্যবস্থা সব বারেই থাকে। মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ পাড়া ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত যায়। তখন অবশ্য সুমিতাদের বাড়ির খবর আমরা কেউ জানতাম না। সকলে হাতের মুঠোয় অঞ্জলির ফুল নিয়ে, পাশের জন ও বিগ্রহের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছিল ঠাকুরমশায়ের কথা মতো। তারই ফাঁকে ওরা আমাদের বাড়ির এদিক ওদিক তাকিয়ে জরিপ করছিল, আমি ঠিক কোথায় আছি!
মাতৃ-বন্দনার এ সময় অন্য বছর আমার মা থাকে। এবার আমার অসুখের জন্য মা ভীড়, কোলাহল থেকে দূরে সুস্থযাপনের জন্য অন্যত্র, একা। মাইকে শোনা যাচ্ছে, “….নমঃ শরণাগতদীনার্ত পরিত্রাণপরায়ণে/ সর্বস্যাতিহরে দেবী…..” বিশুদাদের সজনে গাছের ওপর ঝোলা ব্যানার আশ্বিনের বাতাসে দুলছে, কিন্তু তার ফাঁকফোকরে তেজী রোদ পড়লেও গাছের আড় ভাঙছে না, আমার দৃষ্টি ওদের উঠোনে পৌঁছতে পারছে না। এবার মিত্রাও যায়নি অঞ্জলি দিতে। এ কটা দিন ও মণ্ডপমুখোই হচ্ছে না। আমাদের এই সচেতনতা সবার তারিফ পেয়েছে। তবু সকলের তাকানো দেখে আমি বুঝতে পারি, নিজের চোখই সকলকে একশো শতাংশ নিশ্চিন্তি দেয়, বিশেষ করে এটা যখন জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন!
আমাদের পাড়া শুনশান হয়ে গেছে। দূর থেকে বিসর্জনের ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে। মিত্রা নীচ থেকে চেঁচায়, তুমি এখনও ছাদে? ওর গলায় বিরক্তি, উষ্মা, উদ্বেগ! আমি শরীরে কোনো অসুস্থতা অনুভব করছি না। বন্দী থাকার জন্যই মাথায় নানা চিন্তা ঘুরঘুর করছে। সেটা বয়স হলে সকলেরই হয়। তবু আমি ছাদ থেকে ঘরে চলে আসি। আশ্বিনের হিম আমাকে নতুন করে অসুস্থ করতে পারে, এটা বোঝার বয়স আমার হয়েছে। একটা ভয়ও কাজ করে। শরীরটা বেশি খারাপ হলে কাউকেই তো পাশে পাব না! এই ভয় কী মিত্রারও নেই! সুমিতার বাড়ির লোকও কী এই একই ভয় পেয়েছিল! তাই আমরা কিছু জানতে পারলাম না! অথচ আমাদের নাকের ডগায় এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল! আচ্ছা, কীভাবে একজন মানুষ অন্যের বিপন্নতার খবর জানতে পারে! আমিই কী খুব বেশি অসুস্থ হলে অন্যকে জানাবার মতো অবস্থায় থাকতাম! সে ক্ষেত্রে মিত্রাকে খুব হইচই করতে হত! সুমিতার মা-বাবারা কী সেটা করতে চাননি! কোনো বুক-চাপা কষ্টের কথা তেমন ভাবে না জানালে কেউ জানতেই পারবে না, একথা ভাবতে গিয়ে এবার আমার ভয়ই হয়! ঘরে সেঁধিয়ে যাবার আগে আমি একবার বিশুদার সজনে গাছে ঝোলা ব্যানারটার দিকে তাকাই। বিজ্ঞাপন তো আড়ালও করে!
নবমীতে পুজো-কমিটি থেকে প্রত্যেকবার খাওয়ানো হয়। ফ্রায়েড-রাইস, চিলি-চিকেন এই সব কত কী! এবার জমায়েত বারণ, তাই সেটাও বন্ধ রাখতে হয়েছে। অল্প বয়সীদের মন খারাপ। সবাই এদিক ওদিক ঘুরবে, বাইরে খাবে। বেশ কিছু রেস্টুরেণ্ট খুলেছে। নবমীর দুপুরে মণ্ডপ ফাঁকাই। পেতে রাখা চেয়ারগুলো মানুষের অপেক্ষায়। মণ্ডপের সামনের রাস্তার ধারে যে ছোট ছোট ফুলগুলো ষষ্ঠীর দিন ফুটে থাকতে দেখেছিলাম, আজকে দেখি, তার বেশির ভাগটাই পায়ের চাপে দলে মচড়ে গেছে! অন্য সময় তো এতো লোকের আনাগোনা এই গলিতে হয় না। চেনা পায়ের ছাপ ওদের বাঁচিয়ে রেখে চলে। মা যেদিন এই ঘর থেকে বেরোল, সেদিনও গলির বাঁক পার হবার আগে মা ওদের দেখে গেল! আমি তেমনটাই দেখেছিলাম। এটা তো ঠিকই, ফুল টবে বা বাগানে থাকলে যত্ন পায়, রাস্তার ধারে থাকলে তাকে নিজের জোরে বেঁচে থাকতে হয়। তবু তো এখানে ওখানে ফুল ফোটে, যত্নের তোয়াক্কা না করেই! মরে ঠিকই, আবার বেঁচেও তো যায়! দূরের কোনো মণ্ডপে ‘যেও না নবমী রজনী’ গান বাজছে। তবু নবমী রজনিকে যেতে হয়, উমাকেও!
দশমীর রাতের দিকে আমার আবার একটু জ্বর জ্বর ভাব হল। মিত্রাকে কিছু বলি না। সম্ভবত ছাদে বেশি সময় কাটানোতেই হয়েছে। রাতের খাবার মুখে ভালো লাগল না। আমি গায়ে হাল্কা চাদর টেনে শুয়ে পড়ি। সারা শরীরে ক্লান্তি, অবসাদ! আগুন! স্বপ্নে দেখি, দাউদাউ আগুন জ্বলছে! প্রচণ্ড আওয়াজে ঢাক বাজছে। আগুনের মধ্যে সুমিতার মুখটা আবছা দেখতে পাই। আমি আগুনের থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে আশে পাশে তাকানোর চেষ্টা করি। আগুনের লালচে আভা চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই আলোতে রাস্তার যতটা দেখা যায়, সব ফাঁকা! বিশুদার ছেলেকে আমি কোথাও দেখতে পেলাম না! আমি ওর নাম ধরে যে ডাকব, তাও পারছি না! আমার তো ওর নামই মনে নেই! ছেলেটা কী পথ হারিয়ে ফেলল! আগুনের হল্কায় আমার সারা শরীর গরম হয়ে উঠেছে। গলা, বুক শুকিয়ে গেছে! অস্থির হয়ে আমি উঠে বসি। গা থেকে ঢাকা সরে গেছে। আমার সত্যি সত্যি গরম লাগছে। কপালে ঘাম হচ্ছে, টের পাই। জ্বরটাও ছেড়ে গেছে।
ক’টা দিন কাটলে একটু ঝরঝরে লাগে আমার। মুক্তির দিন ঘনিয়ে আসছে ভেবে আহ্লাদ হয়। অনেকটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমি ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকি। মনে মনে লিস্টি বানাই, কতজনের কাছে যেতে হবে আমায়, ঢুকে পড়তে হবে কতরকমের কাজে!
মিত্রা খবর দেয়, মায়ের ঘর ঝাড়পোছ হচ্ছে।
মা আসছেন।