সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
যে-কোনো সৃষ্টিকাজই প্রাতিস্বিক। এককধর্মী— ব্যক্তির কাছে স্রষ্টা সমাজেরই একজন অবশ্যই; জনগণের মধ্যে থাকতে পারেন, মিছিলে-মিটিংয়ে আন্দোলনের অংশীদার বটেন, সভ্যতার নানা সংকটে অবশ্যই আলোড়িত হবেন কিন্তু সৃষ্টিসত্তায় যখন তিনি একাগ্র, মগ্ন— আপন শিল্পচেতনা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবেন। বাহ্যিক নির্দেশ, কোনো নিয়মতন্ত্র ঔচিত্য-অনৌচিত্যের অঙ্গুলি তাঁর সত্তাকে পরিচালনা করবে না।
কলকারখানা, ক্ষেতখামার বা সামাজিক নানা উৎপাদনের শ্রমবিন্যাসে মজুরি, মূল্য, নীতি, দল, সংগঠন-এর গুরুত্ব যেভাবে কার্যশীল, সৃষ্টিবিচারে তা কখনই প্রযোজ্য হয় না। অথচ শিল্প-সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্ব বিচারে দেশ-কাল-সমাজের জরুরী কিছু অভিঘাত বিচার্য। কারণ শিল্পের জন্যই শিল্প বা সৌন্দর্যের জন্যই সুন্দরতা সৃষ্টি — এ ভাবনা অতীতে কোনো কোনো মহল প্রচার চালালেও, আমাদের বোধ ও চেতনা বিকাশে শিল্প-সাহিত্যের সুদূর ও অপ্রত্যক্ষ ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েছি। তাই দেশ-কাল ও রাষ্ট্রচরিত্র- নিয়ন্ত্রিত জীবনধারায় — ব্যক্তি বা সমষ্টিগত জীবন যাই হোক না কেন নিয়ে শিল্পসৃষ্টির প্রবাহ চলছে। দেশ-বিদেশে সাহিত্য চলচ্চিত্র নাটক শিল্প তাই পৃথিবীর অনেক অনেক মানুষকে স্পন্দিত করে।
শিল্পসাহিত্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সৃষ্টি যেমন, এর সামাজিক উপযোগিতাও আছে। আরো একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। একই আদর্শ বা জীবনদর্শনে বিশ্বাসী থেকেও বিভিন্ন কবি লেখকের সৃষ্টির মধ্যে প্রকাশের ভিন্নতা আছে। মায়াকোভস্কি মার্কসবাদে বিশ্বাসী, পাবলো নেরুদাও একই দর্শনে দায়বদ্ধ। কিন্তু দুই কবির কাব্য প্রকাশে পাঠকের ভিন্ন ভাবনার জগৎ তৈরি হয়। তাই লেখক সংঘ অন্যান্য গণসংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নের কর্মপদ্ধতি এক হতে পারেনা।
কোন সংস্থা, রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত সাহিত্য শিল্পের ধারার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ে বিদ্রোহ বিরোধিতা লক্ষ্য করি। তাই ইওরোপে একদা চার্চ-নিয়ন্ত্রিত শিল্প-সাহিত্যের খোলস ভেঙে রেনেসাঁর জন্ম হয়েছিল।
আধুনিক যুগে, সোভিয়েত শাসনব্যবস্থায়, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত লেখকসংঘের সঙ্গে বহু ব্যক্তি-লেখকের বিরোধ-সংঘাত আজ ইতিহাস।
বাংলা ভাষাতেও প্রগতিসাহিত্যের দীর্ঘ ইতিহাসে, এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ক্ষতলাঞ্ছনার পর্ব খুব ছোট নয়। ইওরোপে হিটলার-মুসোলিনির উত্থানে ফ্যাসিবাদের দুর্বার জয়যাত্রায় ইওরোপের বিবেকবান লেখক-শিল্পীরা সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের ভাবনায় একত্রিত হয়েছিলেন। সালটা সম্ভবত ১৯৩৫ এবং স্থান প্যারিস। সেই সূত্রেই ভারতবর্ষে প্রগতি লেখক সংঘের জন্ম এবং এর প্রথম সম্মেলন লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত হয়, প্রেমচাঁদ-এর সভাপতিত্বে। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী নিয়ে সমবেত এই প্রয়াস শুরু হয়েছিল।
এই লেখকসংঘটি প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিলেন তৎকালীন লন্ডনে বসবাসকারী ভারতীয় ছাত্র, উর্দু সাহিত্যের প্রখ্যাত কিছু কবি, সাহিত্যিক— ভাবনা-চিন্তায় যাঁরা কেউ ছিলেন কমিউনিস্ট, কেউ বা সোসালিস্ট। কেউ কেউ বা ছিলেন মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী। যেমন ১৯৩৫-য়ে সে বুদ্ধিজীবীদের প্যারিস সম্মেলনের প্রাণপুরুষ রমাঁ রঁলা। আবার সেখানে এলড্উইনও ছিলেন।
ভারতে প্রগতি লেখকসংঘ গড়ে তোলার পিছনে ব্যক্তি হিসেবে জওহরলাল নেহেরু, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত বা জয়প্রকাশ নারায়ণের ভূমিকা প্রগতিশীল উর্দু লেখকদের পাশাপাশি সমান ভাস্বর। বিশেষত, লক্ষ্ণৌতে প্রথম অধিবেশন সফল করে তোলার পেছনে এঁরা খুবই সক্রিয় ছিলেন।
১৯৩৮য়ে এর দ্বিতীয় অধিবেশন হয়েছিল কলকাতায়। সে উপলক্ষে যে স্মারকগ্রন্থটি প্রকাশ পায় তা রবীন্দ্রনাথ সহ বাংলার তৎকালীন প্রায় সকল বুদ্ধিজীবীদের লেখায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুবোধ ঘোষ প্রমুখ লেখকবৃন্দ যেমন ছিলেন, মার্কসবাদে বিশ্বাসী ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, গোপাল হালদার বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ অনেকেই ছিলেন।
১৯৪০য়ে ঢাকায় প্রগতি লেখকসংঘের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কসবাদী চিন্তক রণেন দাশগুপ্ত এর সম্পাদক হলেও পরবর্তীতে দায়িত্ব নিয়েছিল সোমেন চন্দ। তখন তার বয়স ছিল বিশ কি একুশ।
বিশ্ব ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নানা রংয়ে-বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীরা সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যেহেতু শিল্পসৃষ্টি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত— সমবেত কোনো ফতোয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
৪১ সালে জার্মান সোভিয়েত অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করলে সব কিছু সমীকরণের বদল ঘটে। মিত্র শক্তি হিসেবে ব্রিটেন, সোভিয়েত, আমেরিকা লক্ষণের গণ্ডীরেখার একই দিকে অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারতের কমিউনিস্টরা ব্রিটিশ শক্তিকে উত্যক্ত করার চাইতে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েতকে ফ্যাসিবাদের কবলমুক্ত করার নীতি ও কর্মসূচী অধিক জরুরি মনে করল। আর দেশের জাতীয় চেতনার অংশীদারদের অধিকাংশই মনে করলেন, বৃটিশ শক্তি যখন হিটলারের দাপটে ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে, দেশকে স্বাধীন করার এই হলো চরম মুহূর্ত। ১৯৪২য়ে গান্ধীজীর ডাকে ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’, ৪১য়ে সুভাষচন্দ্রের দেশ থেকে গোপনে জার্মানিতে হাজির হওয়া, তার আগে কংগ্রেস থেকে তাঁর পদত্যাগ— দেশের মানুষের বৃহৎ অংশকে প্রাণিত করে তুলেছিল। দুস দ্বন্দ্ব তখন বন্ধুতামূলক থেকে শত্রুতামূলক দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়। ১৯৪২এর ৮ই মার্চ ঢাকার রাজপথে বিশিষ্ট লেখক সোমেন চন্দ খুন হলেন। তাঁর এই নৃশংসভাবে নিহত হবার ঘটনায়, দেখব তখনও দলমত নির্বিশেষে এই হত্যার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাচ্ছেন। সই স্বাক্ষরে গান্ধীবাদী অন্নদাশঙ্কর রায় যেমন ছিলেন, মানবতাবাদী প্রমথ চৌধুরী, ইন্দিরা দেবী থেকে মার্কসিস্ট ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, এমনকি বুদ্ধদেব বসুও জঘন্য হত্যার নিন্দা করেছিলেন। প্রগতি লেখকসংঘের নাম বদলে বাংলায় রাখা হল ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক সংঘ। এ সময়ের জাতীয়তাবাদী ও কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের অন্তর্দ্বন্দ্বের অসাধারণ পারিবারিক ছবি পা়ই লেখক সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ উপন্যাসে। সতীনাথ তখন পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রেস সোস্যালিস্ট দলের বড় নেতাও বটে।
৫০-এর ,মন্বন্তর পৈশাচিকতা সমূলে মানবতার উৎপাটন ইত্যাদি বিষয়ে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির মনুষ্যসৃষ্ট মন্বন্তরে, তিরিশ লক্ষ গ্রামীণ শিকড়ের নর-নারী স্রেফ অন্নের অভাবে নিহত হওয়ায়— সকল স্তরের বুদ্ধিজীবীই গল্প, উপন্যাস, নাটক, সংগীত, ছবি এঁকে এই নারকীয় কৃত্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। কারও সৃষ্টিতে সরাসরি ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে আঙ্গুল তোলা হয়েছিল কেউ কেউ আবার বাংলার জোতদার, মজুতদার ও কালোবাজারিদের যতটা সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন, বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগে একটু আড়াল ছিল।
ক্রমে, লেখক, শিল্পী, অভিনেতা— গণসংগীত, গণনাট্য এবং রবীন্দ্রস্নেহধন্য সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ পত্রিকা তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির মালিকানায় চলে আসার পর বাংলা লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের সমর্থনে পার্টি নিয়ন্ত্রণ প্রায় সরাসরি হয়ে ওঠে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ননী ভৌমিক, সমরেশ বসু, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য থেকে ‘নবান্ন’ নাটকের সাফল্য বাংলার বৌদ্ধিক জগতকে আলোকিত করে দিয়েছিল।
এর পেছনের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ছিলেন তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পি.সি. যোশী। তাঁর ব্যক্তিগত বৈভব বৌদ্ধিক চেতনা দিয়ে লেখক-শিল্পীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে যোগাযোগ বজায় রেখে— বাংলার প্রগতির সংস্কৃতির নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছিলেন। দলীয় কোন ফরম্যান জারি নয় বা প্রগতি সাহিত্যের শ্রেণী বিচারও নয়। সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্রষ্টাই অন্তিম নির্ণায়ক। কখনই শিল্প সাহিত্য বিষয়ে দল বা গোষ্ঠী লেখককে নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে না। তাই সোভিয়েত বিপ্লবের পর লেনিন টলস্টয় সম্পর্কে পুশকিনের বিষয়ে বা গর্কির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে বেশি জোর দিয়েছেন। যখনই দলের কোনো কর্মসূচিতে গর্কি দ্বিমত প্রকাশ করেছেন, দ্বন্দ্বটি আর বন্ধুত্বমূলক থাকেনি— লেনিন পরামর্শ দিয়ে গর্কিকে ইটালিতে কিছুদিনের জন্য অবকাশ নেওয়ার জন্য উপদেশ দিচ্ছেন। দলের কবি হওয়া সত্ত্বেও মায়াকোভস্কির চাইতে পুশকিন লেনিনের বেশি প্রিয় কবি ছিলেন। অর্থাৎ দল ও স্রষ্টার মধ্যে একটা গণতান্ত্রিক স্পেস রক্ষিত ছিল।
লেনিন ও গর্কির মৃত্যুর পর রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সোভিয়েত লেখক সংঘ এতটাই ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি-প্রচারিত Socailist Realismই প্রগতি সাহিত্যের একমাত্র চিহ্ন হয়ে উঠলো। অথচ আজ এসব প্রসঙ্গ জলের মতো স্বচ্ছ, দল-নির্দেশিত শাসনের লেখালিখি একমাত্র পরিচয় ছিল না প্রগতি সাহিত্যের। ইউরোপের বিভিন্ন ধারার চিন্তক লেখকরা সেকথা তথ্যগতভাবে বারবার বলে গেছেন। এখন যাকে আমরা ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলিং বলি মার্কসবাদী চিন্তায়। যেহেতু আমাদের বাংলায় কমিউনিস্ট নেতা লেখক-কবিদের সঙ্গে সঙ্গে সংযোগ ছিল নিবিড়, প্রগতি সাহিত্যের মডেল বলতে একমাত্র সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাকেই দলীয় ছাপ দেওয়া হতো। তাই সোমেন চন্দকে নিয়ে যতই আলোচনা চলুক, তাঁর ইঁদুর, দাঙ্গা বা সংকোচ এর মত গল্প এ বাংলায় প্রগতিশীলতার ছাপ পেতে এত বছর লাগিয়ে দিল।
আন্তর্জাতিকভাবে মস্ত বিস্ফোরকটি ফাটলো যখন দেখা গেল ঝানভ-গাঁরদি বিতর্ক। গাঁরদি দিয়েছিলেন ফ্রান্সের বিশিষ্ট বামপন্থী মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী এবং ঝানভ ছিলেন সোভিয়েত সরকারের সম্ভবত সাংস্কৃতিক মন্ত্রী। সালটা সম্ভবত ১৯৪৮-৪৯। ভারত সদ্য স্বাধীন হয়েছে। কমিউনিস্টদের একটা লাইন দেখা গেল ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়’। পরে অবশ্যি দলের প্রতি সরকারি নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে, সম্ভবত ৫১ সালে, ৫২এর সংসদীয় নির্বাচনে দল অংশগ্রহণ করলো। তখন তে-ভাগা তেলেঙ্গানা চাপা পড়ে গেছে।
ঝানভ বললেন, সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে শিল্প সাহিত্য জগতের ভাবগত ঐক্য একত্রিত করতে হবে। তাই-ই প্রগতি সাহিত্যের সার্থকতা। গাঁরদি বললেন, তা নয়। প্রগতিসাহিত্যের এমন কোন যান্ত্রিক ভূমিকা থাকতে পারেনা। প্রগতি সাহিত্য শিল্পের দায় বজায় রেখেই পাঠকের চেতনা ও বোধকে প্রবর্ধমান করবে। আন্তর্জাতিক এই বিতর্কে বিশ্বের সকল দেশের প্রগতিসাহিত্যের ধারা ঝাঁকুনি খেয়ে গেল। হাওয়ার্ড ফাস্ট, আঁদ্রে জিদ্ এর মত বাঘা বাঘা আন্তর্জাতিক প্রগতিশীল শিবিরের বুদ্ধিজীবীরা ‘God that failed’ সংকলন বার করে শিবির ত্যাগ করলেন।
আমাদের ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক হিসেবে পি সি যোশী অপসারিত। কট্টরপন্থী হিসেবে চিহ্নিত রণদিভে সম্পাদক হয়েছেন। সে-সময়ে প্রগতি সাহিত্যের প্রধান প্রতীক ‘পরিচয়’ তখন গোলাম কুদ্দুস সরোজ দত্তর সম্পাদনায় বার হত। দেখা গেল দীর্ঘকালের পরিচয়-এর সঙ্গে নিবিড় সংযুক্ত লেখকরা একে একে ‘পরিচয়’ থেকে সরে গিয়ে নতুন পত্রিকা প্রকাশ করলেন। বিষ্ণু দে করলেন ‘সাহিত্য’, অনিল কাঞ্জিলাল ‘নতুন সাহিত্য’ এবং এর কিছু পরেই ‘অগ্রণী’, ‘অরণি’ প্রকাশ পেতে থাকে। অর্থাৎ প্রগতিশীলতার একমাত্র কেন্দ্র ‘পরিচয়’-এর বিকল্প হিসেবে এইসব পত্র-পত্রিকাগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। এর অন্যতম একটি পত্রিকা ‘মার্কসবাদী পথ’। সেখানে দলের নেতা ভবানী সেন রবীন্দ্র গুপ্ত ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি আখ্যা দিয়ে খানিকটা ধসিয়ে দিতে চাইলেন। এটা ছিল ওনার নিছক ব্যক্তিগত মত। কিন্তু জাতীয়তাবাদী শক্তি প্রচার এর বন্যা ছোটালো, কমিউনিস্টরা রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া মনে করে। কোন রাজনৈতিক দল সমবেতভাবে এই সিদ্ধান্ত নিলে তো দলীয় এজেন্ডা হিসেবে সিদ্ধান্ত নেবে? এ-ভাবেই প্রগতি সাহিত্যের ভাবনা একের পর এক প্রচারের গাড্ডায় পরতে থাকলো। পার্টি নিয়ন্ত্রিত সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট ক্ষমতাশালী হয়ে ৪২ধর্মতলা স্ট্রিট, স্বাধীনতা পত্রিকা এবং ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রকাশনা জাঁকিয়ে ক্ষমতাশালী হয়ে রইল। সেখানের কঠিন দেওয়ালে বারেবারে প্রগতি সাহিত্যের ব্যক্তি-লেখক আহত হয়েছে অপমানিত হয়েছে, কেউই স্নেহ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধায় স্রষ্টার সংকটটি বুঝবার চেষ্টা করেনি— সমাধানের কথা দূরে থাকুক। এ যেন কোন ট্রেড ইউনিয়নে কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কমিশন তৈরি করে খেসারত আদায়। একজন স্রষ্টা হিসেবে কোন শ্রদ্ধা সহমর্মিতা নেই। দু-চারটে উদাহরণ। সাবিত্রী রায় ‘স্বরলিপি’ উপন্যাসে তে-ভাগা আন্দোলনে, কোন কোন অঞ্চলের কিছু নেতার নেতৃত্বের ভুল উল্লেখ করে সমালোচনা ছিল। কলকাতার তৎকালীন জিলা কমিটি ফতোয়া জারি করলো ‘স্বরলিপি’ ন্যাশনাল বুক এজেন্সির কোন কাউন্টার থেকে বিক্রি হবে না। অসীম রায়ের দু’খন্ডের আত্মজীবনী ‘জীবন ও মৃত্যু’তে পড়লাম, যখন এম.এ পড়ছেন তিনি, মাঝেমধ্যে উৎসাহে ৪২ ধর্মতলা স্ট্রিটে গল্পপাঠের আসরে হাজির হতেন। দেখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি গল্পপাঠের পর, শ্রোতাদের মধ্য থেকে মানিকবাবুকে আক্রমণ। লেখক স্বয়ং অসহায় ফ্যালফ্যাল করে দেখছেন। মানিকবাবুর বেঁচে থাকার কাল অবধি ন্যাশনাল বুক এজেন্সি তাঁর কোন বই ছাপেনি।
এরপর ৫৬ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায় বিশতম কংগ্রেসে ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় এলে স্তালিনকে কবর থেকে তোলার পর, বাংলার প্রগতি সাহিত্যের ডামাডোলে কোন নেতা বা কর্তৃপক্ষকে দেখা গেলো না শিল্পী-সাহিত্যিক-কবিদের পাশে এসে সহমর্মিতায় তাদের ব্যক্তিসত্তাকে নৈতিক সমর্থন জানায়। ননী ভৌমিক, সমর সেন, কামাক্ষীপ্রসাদ বা কবি ও ‘পরিচয়’-এর এক পর্বের যুগ্ম-সম্পাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ একঝাঁক প্রগতি সাহিত্য ধারার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য, অনুবাদের কাজে মস্কো পাড়ি জমাচ্ছেন— তৎকালীন দল বা সংঘের নেতারা কি স্রষ্টাদের সঙ্কটের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন? মানসিক চাপ বা হতাশার হাত থেকে ব্যক্তিস্রষ্টাদের সংকটমুক্ত করা কি সংগঠনের দায়িত্ব ছিল না? এরা দেশ ছেড়ে গেলে প্রগতিসাহিত্যের ক্ষতি, বলা দরকার ছিল না? আসলে বিশতম কংগ্রেসের পর থেকেই কমিউনিস্টরা সন্দেহ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং পার্টির ‘লাইন’ নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিতর্কে ক্রমশ যত জড়িয়ে গেছেন, প্রগতিসাহিত্য নিয়ে ছিল গাছাড়া ভাব।
প্রকৃতিতে কখনোই শূন্যতা থাকে না। ধীরে ধীরে বিপরীত দর্শন ভাবনার প্রয়াস ক্রমশ সক্রিয় হতে থাকে। বিমল করের আহবানে নতুন গল্পরীতির একটি ঢেউ সৃষ্টি করা হয়। যারা বলতে চায় গল্প-উপন্যাসে বিষয়বস্তুকে মনে রেখেও প্রকাশ বা বলার রীতির ওপরও জোর দেয়া দরকার। এ আহবানে সাড়া দিয়েছিলেন প্রগতিসাহিত্যের দুই উল্লেখযোগ্য লেখক সমরেশ বসু ও দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়। গল্প দুটি ছিল যথাক্রমে স্বীকারোক্তি ও জটায়ু। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব এসব নান্দনিকতা উপলব্ধি করতেন কিনা জানি না, দলীয় ফতোয়া জারিতে পিছিয়ে থাকত না। শুনেছি, এই ভাবে দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঘাম’ গল্পটি নিয়ে বিরূপ কিছু মতামত জারি করেছিল। শিল্পী form and content— আকরণ ও প্রকরণের পারস্পরিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেখক ও সমালোচকদের নিয়ে এ-নিয়ে কি খোলা মঞ্চে আলোচনার আয়োজন করা যেত না? ‘স্বাধীনতা’ তখন পার্টির দৈনিক সংবাদপত্র। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের আয়োজন করা যেত। তৎকালীন ‘পরিচয়’ পত্রিকাও বিষয়টিতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। উল্টে তাদের বৌদ্ধিক অহং ও অস্মিতা বেশ কিছু মানবিকতাধর্মী লেখককে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। প্রগতি সাহিত্যের চতুষ্পার্শ্ব ক্রমশ ক্ষুদ্র ও কানাগলিতে ভরে উঠছিল। এভাবেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বা বুদ্ধদেব বসু, আবু সৈয়দ আইয়ুবের মত ব্যক্তিত্বরা যেমন দূরে সরে গেছেন রমেন সেন, অমরেন্দ্র ঘোষ যথাযোগ্য মর্যাদা পাননি।
উপরন্তু ৬২সালের চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে একটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার পরামর্শে ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ আন্দোলন শুরু হতেই প্রগতিসাহিত্যের কফিনে শেষ পেরেকটি গেঁথে দেওয়া হয়। প্রবল এই জলোচ্ছাসের বিরুদ্ধে দল হিসেবে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত একটি পার্টির পক্ষে অসহায় পর্যবেক্ষণ ছাড়া বিকল্প কিছুই ছিল না। শুরু হলো সাহিত্যের নানা আন্দোলনের ঢেউ। হাংরি, ছাঁচ ভেঙে ফেলা, শাস্ত্রবিরোধী, নিম সাহিত্য ইত্যাদি গদ্যে-পদ্যে নানা আন্দোলনের নামে শুরু হলো ক্যাওস। এরপর ‘যার শিল, যার নোড়া, তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া’র মতো প্রগতি শিবিরের অন্যতম প্রতিনিধি স্থানীয় সমরেশ বসুকে নিয়ে ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’ উপন্যাস লিখিয়ে শুরু হল আন্দোলনের নামে নানা প্রকার ডেকাডেন্স।
রাজনৈতিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন সরাসরি বিভক্ত। বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সকল অংশই একভাগে। আর যাদের শক্তিতে সংগঠন চলে সকলেই বিপরীত অংশে। প্রগতিসাহিত্যের হাল খুবই করুণ। ঘৃণা, অবিশ্বাস, উদাসীনতা থেকে পারস্পরিক বিষোদগারে নতুন প্রজন্ম হতভম্ব। ‘স্বাধীনতা’ দৈনিক পত্রিকা বন্ধ। ‘পরিচয়’ দপ্তরে বেশ কিছুদিন তালামারা থাকার পর টিমটিম করে শুরু হলো বটে— বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর পূর্বের প্রভাব আর নেই। কম্যুনিস্ট পার্টির অন্য অংশটি— যাদের আনুগত্য চীন ও মাওসেতুংয়ের ভাবনায়— নিজ সাহিত্যমুখপত্র প্রকাশ করল, যদিও সরাসরি দলের মালিকানায় নয়— নন্দন। এর চরিত্র ছিল আরও কট্টর, আরও পার্টিলাইন নিয়ন্ত্রিত। এই পর্বেই, মনে আছে, গদ্য সাহিত্য আঙিনায় পা-দেয়া এক নবিশ, একবার একটি গল্পে জনৈক মজুরের মুখে ‘ভগবান’ শব্দটি উচ্চারণ করিয়ে কী ধমক যে খেয়েছিলাম। শব্দটি উড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম— আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ভাবলেও লজ্জা পাই।
ষাটের দশক জুড়ে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতিতে একাধারে বাণিজ্য পত্রিকার জবর উত্থান, সাহিত্যে লেখক-কবি তৈরীর মনোপলি তাদের হাতে। তথাকথিত প্রগতিসাহিত্য, নতুন প্রজন্মের পাঠকবৃন্দের কাছে নস্টালজিয়া।
সত্তরে এল নকশাল আন্দোলন। দেশভাগের পর, বিংশ শতাব্দীতে এমন প্রভাবশালী আন্দোলন আর হয়নি। সব কিছু ভাবনা চেতনার ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসে বলতে পারি রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি হিসাবে এ আন্দোলন ব্যর্থ। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা দূরে থাকুক, এখন উন্নয়নের নামে শহরই গ্রাম গ্রাস করছে। যারা এককালে চীনের চেয়ারম্যানকে আমাদের চেয়ারম্যান হিসেবে ভাবতে বাধ্য করিয়েছিল, তারাই বিশ্বাস করছে চীন নাকি নয়া ক্যাপিটালিস্ট দেশ। সে-সব প্রশ্ন থাক।
সৃষ্টিশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে গত পঞ্চাশটি বছর গুরুত্বপূর্ণ। লেখক হিসেবে যাঁরা ঐ দেশ-কাল পর্বে উঠে এসেছিলেন, ‘প্রগতি’ শব্দের অর্থ ও ধারণার বিকাশ ঘটিয়ে, দলনিয়ন্ত্রিত ‘প্রগতি’ বা মানব চেতনায় সাহিত্যের উপযোগিতাকে তছনছ করার উদ্দেশে যে আন্দোলন— দুয়ের পাশ কাটিয়ে তাঁদের এবং তাঁদের অনুসৃত পথের উত্তরসূরীরাই এখন বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ স্রষ্টা হিসেবে সমাজের স্বীকৃতিলাভ করছে।
রাজনীতি অর্থনীতি বিশ্ববোধ বদলাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে পা রেখে, দেশের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক শিকড়ের সন্ধানে, ‘প্রগতি’কে তাঁরা আর কোন পার্টি নিয়ন্ত্রিত ফরম্যান হিসেবে দেখতে রাজি নয়। প্রগতি লেখকদের নানা সমস্যা, ব্যক্তিসংকট ও ভাব বিনিময়ের জন্য মঞ্চের প্রয়োজন অবশ্যই, তা হবে কোন নির্দিষ্ট দল নিয়ন্ত্রণের বাইরে, এক-স্বরিক কোনো আদর্শবাদের দীক্ষা এড়িয়ে, গভীর এক বিশ্বমানবতার শিকড়ের সন্ধানে। স্বপ্ন, কল্পনা, মিথের মিশ্রণে যা আমাদের জীবনযাপনের সমস্ত শৃঙ্খলকে ক্রমশ মুক্তির সন্ধানে উড়ানে সহযোগিতা করবে।
পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় কি প্রগতিসাহিত্যের প্রাক্তন ধাঁচাটি বদলাবার সময় হয়নি?
[ব্যারাকপুর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মুখপত্র ‘কোজাগর’-এর শারদ ১৪২৮-এর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে তাৎক্ষণিক বক্তব্যের বিস্তারিত রূপ।]