সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
“Where is the life we have lost in living
Where is the knowlwdge we have lostin information
Where is the wisdom we have lost in knowledge.”
(The Rock I, T.S. Eliot)
সুজিত চৌধুরীর ‘বেগমপুরার পথের খোঁজে’ বইটি পড়ে এলিয়টের লাইনগুলো যা বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেছে, মনে আসে।
অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক এবং তাঁর এক প্রিয় ছাত্রের মধ্যে নানা বিষয়ে পারস্পরিক আলোচনার ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছে এই বইয়ের আখ্যান। দুজন অসমবয়সী মানুষ আপন আপন ব্যক্তি থেকে এই পৃথিবী, সমাজ, সভ্যতা, মানুষকে দেখেছেন, বুঝেছেন। সেখানে নিজেদের ব্যক্তিসত্তা আর সামাজিক অবস্থানের টানাপোড়েনের সঙ্গে মিশে গেছে সমাজ, রাজনীতি, জীবনকে দেখার দৃষ্টি। দুজন মানুষ এখানে দুজন ব্যক্তি মাত্র নয়, সকলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার মধ্যে দিয়ে এই আখ্যানকে যেমন পূর্ণতার দিকে নিয়ে গেছে তেমনি আসমুদ্র হিমাচল এই ভূখণ্ডের এক খণ্ডাংশের ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ এর নানা কাহিনীর মধ্যে দিয়ে সমগ্র ভারতেতিহাসের পূর্ণাঙ্গতার দিকেও ইঙ্গিত করেছে। আর বিন্দুর দর্শনের মধ্যে অনেকে যেমন সিন্ধুকে প্রত্যক্ষ করেন তেমনি খণ্ডের উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে পূর্ণতার অভিজ্ঞতাও অর্জিত হয়। ব্যক্তিমানুষও পূর্ণতা পায়। এই পূর্ণতার সন্ধানই উপন্যাসের লক্ষ্য।
‘ধর্মতত্ত্ব’-এ বঙ্কিমচন্দ্রের জিজ্ঞাসা ছিল — ‘‘এ জীবন লইয়া কী করিব? কী করিতে হয়।’’ সংবেদনশীল মানুষের এই চিরকালীন জিজ্ঞাসা রূপ পায় এক বিশাল দেশ, ভূখণ্ড, প্রকৃতি, মানুষ সকলের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেবার চেষ্টার মধ্যে দিয়ে।
অমরকণ্টক থেকে বারাণসী এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের ভৌগোলিক পটভূমি, সেখানকার ইতিহাস, যা সমগ্র দেশের ইতিহাসেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, আর যে মানুষ এই সভ্যতার নির্মাতা, ইতিহাসের ঘটনাপঞ্জীর কুশীলব, তাদের কথা শিক্ষক-ছাত্রের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়েছে। এর পাশাপাশি দুই প্রধান চরিত্রের ব্যক্তিগত জীবনের নানা সমস্যা কথার মধ্যে দিয়ে এসে উপন্যাসকে গতিময় করে তুলেছে। ব্যক্তিগত জীবনকে বৃহত্তর সমাজ ইতিহাসের প্রেক্ষিতে তুলে ধরার এই আখ্যান নিছক ইতিহাস ভূগোল বা সমাজবিজ্ঞানের বর্ণনায় পর্যবসিত হয়নি। জীবনকে প্রকৃত অর্থে নিরন্তর খুঁজে বেড়ানোর মধ্যেই জীবনের সার্থকতা। এই জীবন্ত মানুষকেই উপন্যাসকার ধরতে চান। নৈর্বক্তিতার মাধ্যমে ব্যক্তিমানুষের স্বরূপ নিয়ত আবিষ্কারের অনলস চেষ্টায় জীবনার্থের সন্ধান করে চলেন তিনি। অর্ক আর রবিশেখরের বেগমপুরার পথের খেঁাজে বেরোনো তো আসলে সেই জীবনার্থেরই অনুসন্ধান।
মানুষ আর মানবীয় সংকট সম্পর্ক উপন্যসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ, মানবীয় সম্পর্ক, ইতিহাস, সমাজজীবন— এই বৃত্তের মধ্যে ব্যক্তি মানুষের ভূমিকাকে লিও তলস্তয় What is Art বইতে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন— “The life of man is twofold— one side of it his own personal experiences which is free and independent in proportion as his interests are lofty and transcendental, the other is his social life as an atom in the human swarm which binds him down with its laws and forces him to submit them. For although a man has a conscious individual existence, do what he will, he is but the inconsistent tool of history and humanity.”
উপন্যাসে ব্যক্তিমানুষের প্রকাশ হয় তার অন্তরতম সত্তার পরিচয় প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। এই আখ্যানে রবিশেখর আর অর্ক পথের মধ্যে পরস্পরের যেমন খুব কাছাকাছি এসেছে, তেমনি সেই নৈকট্যবোধ তাদের অন্তরতম সত্তাকেও উন্মোচিত করেছে যে উন্মোচন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে স্বরূপ বোঝার চেষ্টা সার্থক হয়। উপন্যাস শেষে তাই রয়েছে— ‘কতটা পথ হাঁটলে বল পথিক বলা যায়?’ পথের শেষ কেউই জানে না।
জীবন অণ্বেষার অনন্ত আকাঙ্খা থেকেই এ দেশের ঋষি কণ্ঠে একদিন ‘চরৈবতি’ মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছিল। মানবিক জীবনের অন্তহীন জিজ্ঞাসা, অপ্রাপ্তির বেদনা থেকেই মানুষ নিরন্তর পথের খেঁাজ করে চলেছে। নিছক স্থূল জাগতিক সুখ ভোগে তৃপ্ত থাকে না মানুষ। কল্পনার খেঁাজে এমন এক দেশ, রাজ্য যেখানে তার মানসিক শান্তি, মুক্তি। আমাদের সাধকেরাও তাঁদের জীবনব্যাপী সাধনায় তাকেই খুঁজতে চেয়েছেন। আমরা জানি তা ইউটোপিয়া। কিন্তু ইউটোপিয়ারা কখনও মরে না। সমাজ ইতিহাসের সূত্র ধরে ধারাবাহিকভাবে তার খোঁজ করে চলে একদল মানুষ। আবার তার ভাবনার মত কল্পনার মত করে তাকে না পাওয়ার জন্য নিরন্তর অন্বেষণের আকূতি থেকেই যায়। এই আকূতি তাকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ক্রমশঃ উন্মোচিত হয় ‘প্রকৃত আমি’। ‘বাইরের আমি’র খোলস ছেড়ে সে বেরিয়ে আসে। বহুমাত্রিক একজন ব্যক্তিমানুষ যে এই সমাজে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রবল তাগিদে ক্রমাগত নিজের ক্ষুদ্রতাকে প্রতিষ্ঠা করে চলেছে, সে নিজেকে উপলব্ধি করে অনন্ত প্রবহমান জীবনের অংশ হিসাবে। এর মধ্যে সে আনন্দের খেঁাজ পায়, যার মধ্যে রয়েছে আমাদের যাপনের প্রকৃত অর্থ। উপনিষদের ঋষিরা এই উপলব্ধি থেকেই বলেছিলেন ‘অানন্দাদ্ধেব খল্বমানি ভূতানি জায়ন্তে’— ‘এক সর্বব্যাপী আনন্দ থেকেই সকল প্রাণীর জন্ম, আর এই আনন্দই প্রাণীর বেঁচে থাকার কারণ।’ ‘জগতে আনন্দ যজ্ঞে’র ‘নিমন্ত্রণ’ই আমার ‘আমি’কে পৌঁছে দেয় সমস্ত দুঃখকষ্ট, তুচ্ছতার ওপরে।
আজকের মানুষের যাপন তো নিছক সাময়িক প্রয়োজন মিটিয়ে সন্তুষ্ট থাকার। লাভক্ষতির হিসাব কষা নীরস গদ্যময় জগতে, যেখানে ‘শুধু দিন যাপনের শুধু প্রাণ ধারণের গ্লানি’ সয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা, সেখানে চিন্তার গভীরতার প্রত্যাশা অহেতুক। আধুনিক মন পার্থক্য করতে ভুলে যায় নানা বিষয়ের। কারণ ভোগবাদ-কেন্দ্রিক একমাত্রিক বৈচিত্র্যহীন জীবনে কিছুই ধরা যায় না। থোড়-বড়ি-খাড়া জীবনযাপন।
কাহিনীর শুরুতে অর্কর জীবনের যে পরিচয় রয়েছে তা তাকে অত্যন্ত সফল জীবনের অধিকারী করে তুললেও [অবশ্য সাফল্য বলতে যদি শুধু স্থূল বৈষয়িক সাফল্যকে বোঝায়] তার ক্ষতবিক্ষত মনের পরিচয় তার জিজ্ঞাসার মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছ। অর্কর এই দ্বন্দ্বসংকুল মনই রবিশেখরের সঙ্গ তার আলোচনার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছে এই বইয়ের কাহিনীকে। জীবন সম্বন্ধে অর্কর এই অন্বেষণই এই উপন্যাসের মূল চালিকাশক্তি। অর্ক জীবনকে যেভাবে অনুভব করতে চেয়েছে তা হয়নি। বরং বিপরীতটাই ঘটেছে। নিছক ভোগসর্বস্ব অর্থকরী বিদ্যা নিয়ে তার কোন মোহ নেই। রবিশেখরকে সে বলেছে ‘‘... এখন কেন জানি মনে হয় আমার কাজ, রিসার্চ এসব কি সত্যিই কোনো মানে রাখে? করতে হয় বলে করা। মাঝে মাঝে এসব অর্থহীন মনে হয়, কিছুটা অভ্যাসের জন্য করা যেন।’’ বোঝাই যায় অর্ক মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। সে বুঝতে পারছে— ‘‘আমি ধীরে ধীরে দেখতে পাচ্ছিলাম, আমার জানা, আমার জ্ঞান, আমার আবিষ্কার এমনকি আমার ডিগ্রিও ব্যবহৃত হচ্ছে অন্যের সম্পদ, পয়সা বাড়ানোর জন্য। আসলে আমি, আমার জ্ঞান ক্রমাগত ব্যবহৃত হচ্ছে অল্প কিছু মানুষের লোভের আর কর্পোরেটের বড়ো মুনাফার জন্য।’’ সে উপলব্ধি করেছে তার শিক্ষার ‘অন্তঃসারশূন্যতা’কে। তার কথায় ‘‘আমাদের মতো মানুষদের গবেষণার একটাই উদ্দেশ্য— ব্যবসাকে বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া।’’ তার কাছে ‘‘... কেমিস্ট্রি, বিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জনের উত্তেজনা এবং অণু-পরমাণুর বিশাল অজানা জগৎকে জানার যে আনন্দ তা ক্রমশ পাতলা হয়ে আসতে লাগল।’’
এ প্রসঙ্গে রবিশেখরের উপলব্ধি, মার্কস Economic and Philosophical Mauscripts এ যা বলেছেন তার কাছাকাছি পৌছে যায়। মার্কসের কথায়— “My own existence is a social activity. For this reason, what I myself produce, I produce for society and the consciousness of acting as a social being.” অর্কর জ্ঞান তাকে উপার্জনে সাহায্য করেছে। তা ভালো কাজের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে, তেমনি আজকের বাজার সর্বস্ব অর্থনীতি, যা মোটেই ন্যায়নীতির ওপর নির্ভর করে না, ব্যবহৃত হয় কিছু মানুষের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, তাকে ব্যবহার করে। অর্কর উপলব্ধিতে ‘‘আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা আমাকে মানুষ হিসাবে সমৃদ্ধ করার জন্য নয়। এ আমাদের তৈরি করে জাগতিক সম্পদ ও শক্তি তৈরির যন্ত্র হিসাবে।’’ গ্রীক পুরাণের কিং মিডাসের কথা মনে পড়ে। বাজারও সব কিছুকে পণ্যে পরিণত করে। সৃষ্টির আনন্দের পরিবর্তে একঘেয়ে শ্রমের দাসত্ব। ব্যক্তি নিছক যন্ত্র। অথচ বাজারও তো সমাজের অঙ্গ। কিন্তু মানবিকতা এখানে অচ্ছ্যুত।
মানুষের সংস্কৃতির স্তরে স্তরে ব্যক্তি মানুষ ও সমাজের দ্বৈত সম্পর্ক। সমস্ত সমাজ ব্যবস্থাই একদিকে মানুষের ব্যক্তিসত্তার নির্ণায়ক হিসেবে যেমন ভূমিকা নিয়েছে তেমনি ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে নিষ্পেষণ করেছে নানা বিধিনিষেধের পেছনে থাকে বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর, যারা ক্ষমতাবান, শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ। ভাবাদর্শ ও বৈষয়িক স্বার্থের সম্পর্ক ও দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ মার্কসের শিক্ষায় ছিল।
কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত আজকের রাজনীতি, অর্থনীতি। যারা পৃথিবীটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিতে যায়। পাশাপাশি গোলকায়িত এই বিশ্ব পরিণত হয়েছে এক গ্রামে। তথ্যপ্রযুক্তির দৌলতে দূর যেমন নিকট হয়েছে, তেমনি মানবিক সম্পর্কগুলো দূরে সরতে সরতে ক্রমশ অবলুপ্তির পথে। মানুষের ভেতরের শুভবুদ্ধির জায়গা নিচ্ছে প্রয়োজন মেটানোর তাগিদ। যা তাৎক্ষণিক গভীর ভাবনা, বিশ্লেষণের অভাব সর্বত্র। সেজন্যই আজকে আমাদের জীবনাচরণে এত বৈপরীত্য। অর্জিত শিক্ষা মানব কল্যাণের কাজে অব্যবহৃত হওয়ার চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে কর্পোরেটের বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জনের কাজে। লেখাপড়ায় প্রাধান্য পাচ্ছে ইকনমিক রিটার্নের ভাবনা। ‘লেখাপড়া করে যে / গাড়ীঘোড়া চড়ে সে।’ সে কারণে স্বচ্ছল ঘরের অভিভাবকরা শিক্ষার পেছনে অকাতরে ব্যয় করছেন। মানুষ তৈরি তার উদ্দেশ্য নয়।
বিজ্ঞান যেহেতু গভীর এক জীবনবোধ গড়ে তোলে, যার স্থান তাৎক্ষণিকতার অনেক ওপরে, তাকে সরিয়ে চরম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রযুক্তিকে। বিজ্ঞানমনস্কতা, বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির ভাবনাকে দূরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সেই কারণে প্রযুক্তি বিদ্যায় সফল একজন অবলীলায় বিজ্ঞানবিরোধী, যুক্তিবিরোধী নানা ভাবনাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সম্পর্ক, পার্থক্য তার মনে প্রশ্ন তোলে না। আর এ বিষয়ে অজ্ঞতা তার কাছে লজ্জার নয়। তথ্যসমৃদ্ধ ব্যক্তি কিন্তু প্রজ্ঞাহীন। এই প্রজ্ঞাহীন, বিশ্বাসনির্ভর জীবন তাই নিরানন্দ।
থিওডর অ্যাডর্নো বলেছিলেন আমাদের ভোগবাদী টেকনোলজি নিয়ন্ত্রিত জীবনে দৈনন্দিন যাপন প্রণালী মানবিক গুণাবলী বিযুক্ত। মানুষ তবুও মানুষ থেকে যায়। কারণ, The poetry of earth is never dead। নিরন্তর দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত আধুনিক মানুষের মন। অর্কের দ্বন্দ্ব, সংশয়, প্রশ্নে ভরা মন। তার সব জিজ্ঞাসার উত্তর কোথায় তা রবিশেখরও জানেন না। তাঁর সমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গী, ইতিহাস সচেতন তীক্ষ্ণ যুক্তিবাদী মন প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যেকার শান্ত সমন্বয়ী ভাবনাকে তুলে ধরে অর্কের জিজ্ঞাসার উত্তর দেবার চেষ্টা করেছে। অমরকন্টক থেকে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের নানা অংশে ছড়িয়ে রয়েছে এই মহাভারতের মানবিক ঐতিহ্যের, যা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে তার চিহ্ন। ‘মানবজমিন’ সেখানে পতিত নয়।
সভ্যতার উত্তরাধিকারকে স্বীকার করেই মানুষের এগিয়ে চলা। ব্যক্তিমানুষ সেই প্রবাহেরই অংশ। অর্কর জিজ্ঞাসার উত্তরে কিংবা আপন খেয়ালে আমাদের ইতিহাস সংস্কৃতির বর্ণনা, বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে এই আখ্যান এগিয়ে চলে। পথ চলতে চলতে দেখা মেলে নিহাল সিং, জুডিথ এর মতো মানুষদের সঙ্গে যাঁরা আপন অন্বেষণের তাগিদে পথে। একইভাবে দুজনে শুনেছেন মির্জাপুরে কিংবা অন্যত্র সেখানকার মানুষের মুখে, স্থানীয় ইতিহাসের কাহিনী যার সঙ্গে যোগ রয়েছে আজকের ভারতবর্ষের।
ইতিহাস কেবল কয়েকটি ঘটনার সমাহার বা পরম্পরা নয়। তা আমাদের সমাজ সংস্কৃতিরই অংশ। জীবনের ভিতর দিয়েই তাকে জানতে হয়, উপলব্ধি করতে হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে অর্কর মত আমরাও বিচ্ছিন্ন হয়েছি আমাদের শিকড় থেকে। মানুষ সমাজ সবই আমাদের থেকে দূরে সরে গেছে। আজকের ‘উন্নত’ সমাজে আমরা কিছু বিক্রয়যাগ্য পণ্যমাত্র। যান্ত্রিক এই জীবনে আমাদের সমাজ আক্রান্ত বিচ্ছিন্নতার গভীর ব্যাধিতে। এই ব্যাধি থেকে মুক্তি হতে পারে সত্তার শিকড়ে জল দিয়ে। বেগমপুরার পথের খেঁাজ করা সেই প্রক্রিয়ার অঙ্গ।
ধনতান্ত্রিক সভ্যতার ঊষালগ্নে ব্যক্তিমানুষ অর্জন করেছিল প্রাতিস্বিকতার বোধ। সেদিনের প্রেক্ষিতে তা ছিল বিরাট প্রাপ্তি। আর আজকের মানুষ, ধনতন্ত্রের এই চূড়ান্ত অবক্ষয়ী পর্বে ব্যক্তিমানুষ পরিণত হয়েছে নিছক সংখ্যায়। যান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন হয়েছে সে চূড়ান্তভাবে। অর্কের জীবন এই সমস্যায় দীর্ণ। শিক্ষক রবিশেখরের সঙ্গ তার কাছে এক গভীর অন্বেষণের সহায়ক। মানবিক সমস্ত কিছুর সঙ্গে তিনি যেন সম্পর্কিত। মার্কস বলেছিলেন— I am a man, and nothing human is alien to me. জীবনের শেষপর্বে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন— ‘‘আমি ভালবেসেছি এই জগৎকে, আমি কামনা করেছি মুক্তিকে। যে মুক্তি পরমপুরুষের কাছে আত্মনিবেদন। আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সত্য মহামানবের মধ্যে। তিনি সদা জাননাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট।’’ (‘আত্মপরিচয়’) মানুষই মানুষের বড় পরিচয়। এই আখ্যানে সেই পরিচয় ফুটেছে নানা জনের মধ্যে। মানুষের সঙ্গে সহমর্মিতা বোধে যুক্ত হয়েই সেই পরিচয় ফুটেছে। ‘মানুষের ধর্ম’ এর ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— ‘‘স্বার্থ আমাদের যেসব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তার মূল প্রেরণা দেখি জীব প্রকৃতিতে যা আমাদের ত্যাগের দিকে তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’’ মনুষত্বের এই বোধে মানুষ উদ্দীপিত হতে পারে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে। শান্তিনিকেতনে এই প্রয়াস চালিয়েছিলেন তিনি। ‘‘এখানে যখন আহ্বান করেছি প্রকৃতির সঙ্গে আনন্দের যোগ, তেমনি একান্ত ইচ্ছা করেছি এখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগ গড়ে তোলাতে।’’
ভারতের প্রাচীন গ্রাম সমাজ ও তার সংস্কৃতির মূল সুর ছিল বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে পরিপূর্ণ একাত্মতা। আধুনিক সময়ে এই সত্যটাকে নিজেদের মত করে বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী। যেহেতু দুজনের প্রাণের গভীর যোগ ছিল ভারতের গ্রাম সমাজের সঙ্গে। তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাশ্চাত্যের ধনতান্ত্রিক সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ/অনুসরণ অর্ককে নিয়ে গেছে বিচ্ছিন্নতার দিকে। জাগতিক সুখের সব কিছু পেয়েও সে তাই একা। রবিশেখরের সঙ্গ তার একাকীত্ব, দ্বন্দ্ব আকীর্ণ মনকে শান্তি দিয়েছে।
রবিশেখরের সঙ্গ অর্ককে উপলব্ধি করিয়েছে ব্যক্তিগত মানবকে অতিক্রম করে যে মানব রয়েছে সেই সর্বজনীন সর্বকালীন মানব। তার আকর্ষণেই মানুষের চিন্তায় ভাবে কর্মে সর্বজনীনতার আবির্ভাব হয়। সেই মানুষের উপলব্ধিতেই মানুষ নিজেই জীবনসীমা অতিক্রম করে মানবসীমায় পৌঁছে যায়। সেই মানবকেই মানুষ নানা নামে পুজো করে। সব মানুষের সঙ্গে ঐক্যের মধ্যে দিয়ে আপন বিচ্ছিন্নতা দূর করে। সেই ঐক্যের সুরই ধ্বনিত হয়েছে কবীর, নানক, সুরদাস এর শিক্ষায়। আমাদের সাহিত্য, সঙ্গীত, জীবন সাধনায়।
সেই সাধনায় সাফল্য আসে সদাচলিষ্ণুতা ও বহির্জগৎ সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণের দুরন্ত প্রয়াসে— ‘‘চারিদিকে মানুষ চলেছে সব গ্লানি/অন্ধকার অপভয় দুরন্ত আকাশে/সময় ও বিষয়ের সহিত সংঘর্ষে মরণ ও জীবনের যে দ্বয় মূর্তি ইতিহাসে/জাগে তারা মানুষকে জেগে নিতে বলে;/আত্মসমাহিত হয়ে নিতে;/কোথাও স্বর্গে নয়— এ নিরভিমান পৃথিবীতে,/যেতে বলে গতি ও জ্ঞানের মর্মস্থলে।’ (শত শতাব্দীর)।
যুক্তিবোধের সর্বজনীনতার মধ্যেই রয়েছে মানবতাবাদের ভিত্তি। এই কারণে নানা ধর্ম, নানা বিশ্বাস, নানা সংস্কৃতি, নানা সামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি সত্ত্বেও মানুষ সম্মিলিত হয়। সমাজ সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। একজন ব্যক্তিমানুষ বা বৃহত্তর মানবগোষ্ঠী যুক্তিবোধের এই অর্জনের মধ্যে দিয়ে বিরাটত্ব অর্জন করে। সে তখন বিশ্বের আপাতসীমাহীনতায় বারবার নিজেকে এবং মানুষকে ধন্য মনে করে। নিজের ক্ষুদ্র আয়তনে বিচলিত না হয়ে এই উপলব্ধিতে পৌঁছয়— মানবচৈতন্য না থাকলে বিশ্বজগৎ মানবিক অর্থে নিতান্ত একটা বস্তুপিণ্ড হত। এটাই অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা। ‘অসতো মা সত্গময়ো/তমসো মা জ্যোতিরগময়ো।’
রবিশেখর আর অর্ক অসত্য থেকে সত্য, অন্ধকার থেকে আলোর পথযাত্রী। রবিশেখর শিক্ষক হিসাবে অর্ককে দিশা দেন। তাদের অন্বেষণ নিরন্তর। সেই অন্বেষণ দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের, পাঠকের মনেও। উপন্যাসের অন্তর্নিহিত সুরে ধ্বনিত হয়েছে একটাই মাত্র মানবজীবনে সাধারণ মানুষের চিন্তা চেতনা ভালবাসা, ‘গতি ও জ্ঞানের মর্মস্থলে’ যাওয়ার অবিরাম প্রয়াস, আর ‘সময়ের জালে জড়িয়ে’ গিয়েও নিজ সময়ের ইতিহাসকে সমবেত চেষ্টায় অতিক্রম করে মানুষের ইতিহাসের ‘দ্রুত রক্তনদীটি সচ্ছল অমলজলে পরিণত’ করার প্রচেষ্টার মধ্যেই রয়েছে জীবনের সার্থকতা।
বেগমপুরার পথের খোঁজে
সুজিত চৌধুরী
প্রকাশক : ধানসিড়ি
প্রচ্ছদ : সুপ্রসন্ন কুণ্ডু
হার্ড বাউন্ড পৃষ্ঠা : ১৭৫
দাম : ২৫০ টাকা