সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
চর্যাপদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের তথা গানেরও জনক। চর্যাপদ, যার মূল নাম চর্যাগীতিকোষ তাকে প্রথম কম্পোজড বাংলাগীতিমালা ধরলে তার বয়স কত হল? হাজার?
১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে ১৪৭টি পদসমেত খেজুরপাতার ওপর লেখা একটি পুঁথি পেয়েছিলেন এবং সেটি ১৯১৬ সালে হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালাভাষায় বৌদ্ধগান ও দোঁহা নামে প্রকাশ করেন। মূল গঠন প্রচলিত সংস্কৃত শ্লোকের অন্য ধাঁচ হলেও ভূমিকায় উদ্ধৃতি থাকায় চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় নামেও এটি পরিচিত। এ সঙ্গেই সংগীতের বিষয়ে বাংলার ইতিহাস এক লাফে এগিয়ে গিয়েছিল অনেকটা বছর। যদিও এর সময়কাল কোনটা এ নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। কেউ বলেন পদগুলো লেখা হচ্ছে সপ্তম শতাব্দী থেকে আবার কেউ বলেন দশম বা একাদশ শতাব্দী থেকে। পূর্বদেশের ভাষা তখন বাংলা। মৈথিলি অসমীয়া ওড়িয়া একত্রে তখন অর্ধমাগধীর পূর্বী অপভ্রংশ। ওরই নতুন রূপ অবহট্ঠ। যা হয়ে উঠলো আঞ্চলিক ভাষা। ওই অবহট্ঠের কালটাকে ধরেই অনেকে চর্যাগীতির সময়কাল ধরেছেন দশম/একাদশ শতাব্দী। চর্যার ভাষা শুধুমাত্র বাংলা নয় আমরা জানি। তখনকার ভৌগলিক সীমা অন্যরকম ছিল তাই চর্যাপদের ভাষা বাংলা মৈথিলি অসমীয়া ওড়িয়াতে মিশে আছে। তাই অসম আজ বলছে এ অামাদের! সংগে ওড়িষাও। আমরা জেনে এসেছি বাংলাতেই এর উৎস তাই বাংলাগানের ইতিহাস লিখি ওই সপ্তম বা নবম শতাব্দী থেকে।
আমরা জানি যে বৌদ্ধদর্শনের দুটি ধারা, মহাযান ও হীনযান। এই সময়টায় মহাযান তিনটি উপধারায় বিভাজিত হয়ে যায়— বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। এই চর্যাকারেরা শেষোক্ত ধর্ম পালন করতেন। একেবারে নিচের তলার মানুষরা এই সহজযানের মতাবলম্বী। কিন্তু ভাবনা চিন্তায় কোন স্তরে উঠেছিলেন তাঁরা, এটা ভাবতে অবাকই লাগে। চর্যাপদে যে সাধনমার্গের কথা বলা হয়েছিল সাধারণভাবে তা বোঝা দুঃসাধ্য। সম্পূর্ণ একটা ধাঁধা বা হেঁয়ালি— আমরা যাকে সন্ধ্যা ভাষা বা এসোটেরিক বলি। আর এর রূপকার চর্যাকাররা সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত ছিলেন।
মজার ব্যাপার এই মিস্টিক গূঢ়তত্ত্বসম্পন্ন চর্যা নিছক শ্লোক নয়। জেনেবুঝে সংস্কৃত শ্লোকের ওই পিকটোরিয়াল ভাবকে পরিহার করা হয়েছে, গড়ে তোলা হয়েছে নিজস্ব এক ঢং। সেই ঢং গানের মত। চরণবিশিষ্ট। একটি কথার সঙ্গে আরেকটির মিল ঘটানো হয়েছে যাকে গানের লিরিকে অন্ত্যমিল বলা হয়। সঙ্গে যোগ হয়েছে ধ্রুবা আমরা আজ যাকে ধুয়া বলি। কোন কথাকে ভালোভাবে পরিস্ফূট করার জন্য কোন অংশ বারবার গাওয়াকে ধ্রুবা বা ধুয়া বলা হয়। এ তো পরবর্তীকালের কীর্তনেও আছে। চর্যা আসলে গানই তবে তা বিনোদনের গান নয়, উপলব্ধির গান। এ সাধারণের জন্য নয় —অতিগোপন একান্ত উপলব্ধির জিনিস। গণচক্র নামে এক আচার উপচারের স্থান, যেখানে সংগোপনে দুরূহ ক্রিয়াকলাপের সাথে গানগুলি গাওয়া হত। এ সম্বন্ধে আমজনতা কিছুই জানতে পারতো না শুধু অনুশীলনকারীদেরই যোগদান করার অধিকার ছিল। কথা ও সুরের মাধ্যমে একের উপলব্ধি প্রকাশিত হত আরেকজনের কাছে। আগেই জেনেছি এঁরা অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষজন। চর্যাপদের কবিদের কয়েকজনের নাম; শবরপা, কুক্কুরীপা, ডোম্বীপা, মীনপা— বোঝাই যায় কে ডোম কে শবর কে জেলে। অসম্ভব যুক্তিবাদী এঁরা। সেই মন নিয়ে এঁদের প্রশ্ন : সাধু! তুমি নাকি আমাদের ঈশ্বর দেখাবে? তুমি তো নিজেই ধুনির খোয়ায় অদৃশ্য! তাহলে তাঁকে দেখি কি করে? আবার প্রশ্ন : তুমি যদি বল বসন ত্যাগ করলেই মুক্তি পাওয়া যায় তবে কুকুর বেড়ালরাও তো বসন পরে না তারা মুক্তি পায়না কেন? মহাযান— গ্রেটার ভেহিকল, হীনযান— লেসার ভেহিকল আর এই সহজযানীরা ইজিয়ার ভেহিকলে আরো সহজে সাধনমার্গের লক্ষ্যে পৌঁছচ্ছেন।
যাইহোক, গানের প্রসঙ্গে আসি। এই গীতি-গায়নের কতগুলো ফর্ম ছিল আর সে ফর্মটা আজও হারায় নি। ভারতীয় উপনিবেশ আজব চরিত্রের যা কিছুরই সৃষ্টি হয় তা কোন গহন স্থানে রক্ষিত থেকে যায় অর্থাৎ কোন কিছুই হারায় না। পরম্পরায় কোন আড়ালে আবডালে জীবিত থাকে সূত্র খুঁজতে থাকো পেয়ে যাবে। আবার ঘটবে পুর্নজীবন।
এই চর্যার গঠনটা প্রবন্ধগীতির আদলে। এখন যেমন কোন কম্পোজড গানে থাকে স্থায়ী অন্তরা সঞ্চারী আভোগ, তখন গান বাঁধতে হত তুক দিয়ে। প্রবন্ধে যার উল্লেখ ধাতু মাতু ইত্যাদি। এখানে তুক হিসেবে ছিল উদগ্রাহ মেলাপক ধ্রুব এবং আভোগ। অদ্ভুত ব্যপার! অন্যসব সফিস্টিকেশন বর্জন করলেও গানের ক্ষেত্রে প্রচলিত রূপকেই আশ্রয় করেছেন এবং তা কোন লোকসংগীত নয়। পঞ্চম শতাব্দীতে নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়া মার্গ ও দেশী রাগের সেই অভিজাত শ্রেণীর দেশী সংগীত। আর সুর? তা ওনারাই দিয়ে গেছেন। পদগুলিতে পদকর্তার স্বনামের সংগে যুক্ত হয়েছে রাগরাগিনীর নাম। এটা গানের সপক্ষে একটা বড় বিষয়। পদগুলিতে সবচয়ে বেশি যে রাগটির নাম পাওয়া যাচ্ছে তা হল পটমঞ্জরী। আর যে সব রাগের নাম রয়েছে তারা এখনও দিব্যি বহাল। অবশ্য ভারতীয় স্কেলের ফরম্যাট প্রায়াংশেই ইকোয়াল টেম্পার্ড সিস্টেমে বদলে যাওয়ায় তাদের তেমনভাবে আর চিনতে পারা যাবে না। দেখা যাক কি কি রাগ সেই হাজার বছর আগে ব্যবহৃত হয়েছিল।
রামক্রী তো এখনকার রামকেলি! দ্বেশাখ এখন দেওশাখ। গউড়া হল গৌড়। মল্লার আর সারং এর সাথে মিশে রাগ সৃষ্টি হয়েছে গৌড়মল্লার আর গৌড়সারং। এভাবেই শিবরী - আশাবরী। মালসী - মালশ্রী। এ সঙ্গে কামোদ ধানশ্রী ভৈরবী এরাও আছে।
বঙ্গাল প্রাচীন রাগ। ওই পঞ্চম শতাব্দী নাগাদ এলাকাভিত্তিক চলিত সুরের চলন নিয়ে যে রাগগুলি তৈরি হয়েছিল তাতে বঙ্গাল অন্যতম। এখনও এক ধরনের টোনাল ফর্ম রূপে চালু বড় কোন রাগের সঙ্গে মিশ্র করে গাওয়া হয়। যেমন বঙ্গাল ভৈরব।
চর্যা লেখা হল পালরাজাদের সময়। এই সময়টায় বাংলায় ভাষা - সংস্কৃতি, সঙ্গে ভাস্কর্য স্থাপত্য ইত্যাদি নিয়ে আসছে জোয়ার। বাংলার সবচেয়ে ভাল সময়। পালরাজারা মূলত বৌদ্ধ মতাবলম্বী ছিলেন এবং সে মত তান্ত্রিক তারানাথের দুরূহ তিব্বতীয় বৌদ্ধ মতধারা। এদের বৌদ্ধদের প্রতি অনুরক্তি থাকলেও রাজানুগ্রহ থেকে অন্যান্যদের বঞ্চিত করেননি। যাইহোক ৪০০ বছর পালরাজারা রাজত্ব করল। তারপর এল বারোশ’ শতাব্দী! সময়টাতে ঘটলো বদল। পাল রাজবংশের অবলুপ্তি হল। পালদের বিদায়ের কারণে বৌদ্ধদের প্রভাব কমতে থাকলো। তার সঙ্গে চর্যাও ক্রমশ বিস্মৃতির আড়ালে যেতে যেতে একসময় হারিয়েই গেল কিন্তু তার দর্শন রয়ে গেল পরম্পরায় অনেক শত বছর পরের বাউলগান পর্যন্ত। চর্যাগানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল দেহের সঙ্গে দ্বরের কম্পন বা ভাইব্রেশনকে মেলানোর বিষয়টি। প্রাচীনকালে সাধকরা দেহধারণের নিমিত্তে বায়ুকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতেন। এই বায়ু নাকি নিয়মিত শ্বাসে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে দীর্ঘদিন দেহধারণ করা যায়। চর্যাকারেরা সংযোজন করলেন সাউন্ড বা শব্দ। শব্দের কম্পনকে স্বউপায়ে ব্যবহার করা। দেহতত্ত্বের দর্শনে দেহের অনেক স্তর কিন্তু এ জাগতিক দেহ! সে একটাই কম্পার্টমেন্ট। পুরো দেহকে ‘গাত্রবীণা’ রূপে ব্যবহার করা। শব্দ হল এখানে সাঙ্গীতিক শব্দ। গানের স্বর ও স্বনন হতে হবে পিওর মেলোডি। এই পিওর মেলোডির ভাইব্রেশনই বাঁচিয়ে রাখবে সাধককে বহুকাল। মজার ব্যাপার, এর কয়েকশ’ বছর বাদে লেখা হবে সঙ্গীতরত্নাকর। সেখানে আলোচনা চলবে স্বর ও ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্না নানা নাড়ীর বিষয় আশয়। এই পদ্ধতি ও রীতি প্রথা রূপে থেকে গিয়েছিল বৌদ্ধিক তত্ত্বসাধনার অনুশীলনে।
পাল সাম্রাজ্য অস্তমিত হওয়ার পর এলো সেন সাম্রাজ্য। বিজয় কি বল্লালসেনের ঐতিহাসিক তথ্য আনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। আমরা গানের ইতিহাস খুঁজতে লক্ষণসেনকে চাইবো। দীনেশচন্দ্র সেনের বৃহৎবঙ্গে তথ্য পাচ্ছি— ‘লক্ষণসেনের সময় রাগরাগিনী রাজসভায় মূর্ত হইত বলিয়া কথিত আছে— লক্ষণসেনের সভায় জয়দেবের হৃদয়াধিষ্ঠাত্রী পদ্মাবতী ‘গান্ধার’ রাগে গান গাহিয়া কপিলেশ্বরের সভা-জয়ী সঙ্গীতাচার্য্যকে জয় করিয়াছিলেন, স্বয়ং জয়দেব তাহার চরণের গতির ক্রম লক্ষ্য করিয়া তান রাখিতেন এবং নিজকে ‘পদ্মাবতীচরণচারণ-চক্রবর্তী’ বলিয়া পরিচয় দিয়াছেন।
জয়দেব-পদ্মাবতীর গান সম্পর্কে অনেক কাহিনী হলায়ুধ মিশ্র কৃত সেক শুভোদয়া চম্পূকাব্যে পাওয়া যায়। এখানে বর্ণিত আছে যে কেমনভাবে এক বহিরাগত সঙ্গীতাচার্য প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার প্রয়াসে গান গেয়ে গাছের পাতা ঝরিয়ে দেন এবং পদ্মাবতী বিপরীতভাবে সেই পত্রহীন বৃক্ষকে কিভাবে পুনরায় পল্লবিত করেন। লিখিতভাবে পাচ্ছি— ‘লক্ষণসেনের রাজসভায় নর্তকী শশিকলা এবং বিদ্যুৎ-প্রভার গানে রাগ-রাগিনী এরূপ মুর্ত্ত হইয়া উঠিত যে, লোকে তাহা শুনিয়া বেহুঁশ হইয়া যাইত।’ আবার গল্পে আছে, এক রমণী নাকি সুহা রাগে এই বিদ্যুৎপ্রভার গান শুনে এতটাই আবিষ্ট যে কলসী মনে করে নিজের শিশুকে দড়ি বেঁধে কুয়োয় নামিয়ে দিতে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার, এই সুহা গায়নের সময় কিন্তু দুপুর বারোটা থেকে একটা, যেটা আমাদের স্নানের সময়। গল্পটা সময়ের কথা মাথায় রেখে বানানো। কুয়োতলায় মানুষ তো এই সময়ই যেত।
যাইহোক, বাঙালীরা নাকি একটু বেশি গণতান্ত্রিক। কোন নিয়মের নিগড়ে বাঁধা পড়তে চায়না। — ‘নির্দ্দিষ্ট কায়দা বা বিধানের বশবর্তী হইয়া চলিতে রাজি নহে।’ এ প্রায়শই দেখা গেছে। এ কারণে ভারতে অন্যত্র প্রচলিত সঙ্গীতের অনুশাসন মানা হয়নি এমন অনুযোগও আছে। পরবর্তী কালে আকবরের সময় রাগরাগিনীর মান কি হবে তাই নিয়ে নিয়মনীতি তৈরি হয়েছিল কিন্তু বাঙালী তা মেনেছিল কি? তাই রাগরাগিনীর সুর তখন আর শুধু আঞ্চলিক নয়, দূরপ্রান্ত থেকে আহরণ করা গান্ধার, গুর্জর, খোখোজ অর্থাৎ কান্দাহার, গুজরাট, কাম্বোজদেশের সুর। মোটামুটিভাবে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে তখন গীতগোবিন্দের আস্বাদন চলেছে। গীতগোবিন্দ পুরীর মন্দিরেও গাওয়া হচ্ছে আবার শিখরাও তার থেকে আহরণ করছেন। কিন্তু অষ্টপদী গীতগোবিন্দের স্বাদ সাধারণ মানুষ সামান্য পেলেও এ তো রাজানুকূল্যে দরবারে সৃষ্ট। সে অভিজাতদের! তার ওপর ভাষা সংস্কৃত। আপামর বাঙালীর কি তাতে মন ভরেছিল?
বাঙালী মাতোয়ারা হল অব্যবহিত পর। এক মৈথিলি ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি প্রবল সাড়া ফেললেন এদেশে। চর্যার সে ভাষা কতিপয় ছাড়া আপামর জনসাধারণ বোঝেনি এবং তার বক্তব্য তো নয়ই। সংস্কৃতও শুদ্ধ ভাষা তা বাস্তবে মেলানো যায়না। কিন্তু মৈথিলি ব্রাহ্মণের এ ভাষা বোধগম্য। ছন্দ আলাদা, কি মধুর তার ধ্বনিমাধুর্য কি তার সুর! কেমন যেন আপন করে নেয়! তাই ব্রজবুলিতে বিদ্যাপতির পদাবলীতে মানুষকে মোহিত হয়ে উঠলো আর বিহারে জন্মানো বিদ্যাপতি কখন বাঙালিদের কবি হয়ে গেলেন! শোনা যায় শ্রীচৈতন্যর ভীষণ প্রিয় ছিল এই পদাবলী, গীত হিসেবে এগুলি নিয়মিত গাইতেন। এখান থেকেই বৈষ্ণব পদাবলীর সূচনা হল।
চতুর্দশ শতাব্দির মাঝামাঝি সালতানাত বা শাহীরাজের পত্তনে বাংলার একটা লাভ হয়েছিল যে সে মধ্যযুগীয় বিশ্বে অন্যতম সেরা বাণিজ্যিক দেশ হয়ে উঠতে পেরেছিল। কিন্তু চিরাচরিত ধর্মীয় অনুশাসন যা ছিল সেখানে এক নৈরাজ্য শুরু হল এবং সমাজের কাঠামো দ্রুত নড়বড়ে হতে লাগলো। তবে বেশ কিছুকাল পর আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সরাসরি হস্তক্ষেপে সুস্থিতি ফিরতে শুরু করল এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে কিছুটা সমন্বয় দেখা দিতে শুরু করল। কবিরা ফের পেতে লাগলেন অনুদান, শিরোপা। এ সময় সৃষ্ট হতে লাগলো পরমেশ্বরের পান্ডববিজয়। বিজয়সিংহের মনসামঙ্গল কাব্য আর হোসেন শাহের পারিষদ যশোরাজ প্রকাশ করলেন বৈষ্ণব পদ।
এই যুগটা বিভিন্ন দিক থেকে সঙ্গীত ও ভাষার মিশ্রণের যুগ। বদলাচ্ছে সংস্কৃতি। সরকারী ভাষা তখন বাংলা ও ফার্সি। তবুও বাংলার মনোজগতে এক অপরিসীম শূন্যতা। আসলে এর অব্যবহিত আগে বৌদ্ধতন্ত্রের প্রভাব স্তিমিত হলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক ভার বাঙলাকে চাপে রেখেছিল। তার ওপর ধর্মীয় ও সামাজিক হাজার নিয়মের নিগড়ে বেঁধে ফেলা আচারব্যাবহারিক নীতির টানাপোড়েনে উদভ্রান্ত মানুষের কোথাও একটা অন্তর্নিহিত ক্ষোভ জন্মাচ্ছিল এবং যে কোন সময়ে ফেটে পড়ার মত অবস্থা হয়েছিল। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষ চাইছিল উদার মানবিকতা। প্রয়োজন ছিল যেন এক বিপ্লবের। আর সেটা নিয়ে এলেন শ্রীচৈতন্য তাঁর নব্য বৈষ্ণব দর্শন নিয়ে। এক ভাববিপ্লবে তখন কূপ নালা নদী সাগর মিলেমিশে যেন সব একাকার। সবচেয়ে সাড়া পড়লো নিচের তলায়। তথাকথিত উচ্চ সমাজ তখন ভয়ংকর নাড়া খেল।
চৈতন্য বাণী প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে নিলেন গানকে। যা হল কীর্তন। গানের মাধ্যমে ভাগবতবিষয়ক যশঃপ্রচার বা মহিমা কীর্তন। মূল কীর্তনগুলি বেশ সুশৃঙ্খল ও প্রণালীবদ্ধ এবং এতে নানা স্বরের বিনিময় এবং বহু তাল ও ছন্দের বৈচিত্র্য। কীর্তন ও তার সুরবৈচিত্র্য এখনও জীবিত। ভাবতে অবাক লাগে একটি বিশেষ গানের ধারা কিভাবে এত বড় দেশ ও তার জনসাধারণকে বেঁধে ফেলল! চৈতন্যেও কীর্তনসঙ্গীত বহু আলোচিত আমরা আর এ আলোচনায় না গিয়ে এগিয়ে যাই অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙলায়।
তখনও চলেছে এক বিপ্লব। আখড়াই হাফ-আখড়াই পাঁচালি কবিগান আর খেউড়ে বাঁধা নব্যবাবুদের বেচাল ঝাড়বাতির মদিরা সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে শিক্ষিত সমাজ। এদের মধ্যে একদল যারা আবার চরমপন্থী, যারা সমাজের সব কিছু পালটে ফেলতে চায় দ্রুত আর বদল ঘটাতে গিয়ে তারা ডুবে গেলেন খ্রীষ্টিয় আচার-অনুষ্ঠান-ব্যবহারে, আর গানেও এল খ্রীষ্ট ভাব। অকৃত্রিম খেমটার সঙ্গে এরা বাজাতে চান অর্গান! কিন্তু যারা আসল তারা এই ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটির যুবকবৃন্দ নন। এরা আনতে চান এক প্রকৃত বদল। বক্তব্য — আমার ঐতিহ্য আমার সংস্কৃতির ধারা আমরাই বাঁচিয়ে রাখবো। পড়বো আরো জানবো, গাইবো গান লিখবো নাটক এবং আমি ভালো থাকবো অন্যকেও ভালো রাখবো। পশ্চিমীধারায় শিক্ষিত হয়েও রয়েছে এঁদের প্রবল জাত্যভিমান ও আত্মসম্মান। আত্মসচেতন তাঁরা ভাবছেন— প্রভুত্ব করছে ব্রিটিশ! ওরাই কি সর্বেসর্বা? ওরা যা পারে আমরা কেন পারবো না! এঁদের হাত ধরেই পরবর্তীকালে এসেছিল রেনেসাঁ। এর ঠিক আগে বাঙলায় চলত ধ্রুপদ খেয়াল তারানা চতুরঙ্গ হপ্তরঙ্গ ত্রিবট। মূলত গাইতেন বাঙলায় বসতি করা উস্তাদরা। বাঙালীরা এ কালোয়াতি গানে তখনও রপ্ত হননি। কিন্তু বিষ্ণুপুরে গানের চল ছিল তানসেনের বংশধর ও দিল্লির সভাগায়ক বাহাদুর হুসেন খানের আগমনের আর রামশঙ্কর ভট্টাচার্যরা জন্মানোর অনেক আগে থেকে। বিষ্ণুপুরের ইতিহাস ১৩শ ১৪শ শতাব্দী থেকে।
যাই হোক, তৎকালে বাঙ্গলায় অন্যান্যদের সাথে টপখেয়ালও চালু ছিল কিন্তু পশ্চিমী টপ্পার এত ব্যাপক চল ছিলো না। ১৭০০ সালের শেষদিকে বাঙলায় প্রচলিত হল টপ্পা। শোরিমিঞার টপ্পায় সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম দানা নিধিরাম গুপ্ত তাকে রূপ দিলেন বড় বড় দানায় আরো আয়ত করে। টপ্পা প্রেমের গান, নিধুবাবুর রচনায় সে টপ্পা হয়ে উঠলো আরো রসমধুর আরো আবেগঘন। রোমান্টিক আর আইডিয়ালিস্টিক। নিধুবাবুর গান পরিশীলিত গান। বাঙালী মজলো এতে। ঠিক আগের মিস্টিক ঘোর থেকে বেরিয়ে এল গান। পরবর্তীকালে কত না কম্পোজার টপ্পা অঙ্গের গান সৃষ্টি করে খ্যাতি পেলেন! টপ্পা বেঁচে রইলো রবীন্দ্রনাথের গানেও। অন্যতম শ্রেষ্ঠ সে গান— ‘এ পরবাসে রবে কে’।
রামনিধির আগে এসেছেন ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। অন্নদামঙ্গল যখন লেখা হচ্ছে রামনিধির বয়স তখন ১১। এর আট বছর পর ভারতচন্দ্র গত হচ্ছেন। নিধুবাবু জন্মাচ্ছেন ১৭৪১ এ আর অগ্রগণ্য আরেক কবি-কম্পোজার রামপ্রসাদ জন্মেছেন ১৭২৩ এ। বয়সের তফাৎ এমন কি! এর সঙ্গেই উঠে আসছেন কালি মির্জা শ্রীধর কথক পাঁচালিকার দাশরথি রায় প্রমুখেরা।
কলকাতা তখন ঔপনিবেশিক শাসনে ব্যবসা বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র। আর সময়টায়তেই জীবনধারণের তাগিদে গ্রামজীবন ছেড়ে বহু মানুষ কলকাতাভিমুখী হয়েছিল আর এদের নিয়ে আসা গ্রাম্য সংস্কৃতিতেই কলকাতায় চালু হয় লোকগান, কীর্তন, রামপ্রসাদী, কবিগান যাত্রার গান, ঝুমুর, খেউড়, পাঁচালি ইত্যাদি। এগুলোর সঙ্গে তৈরি হয় আখড়াই।
তৎকালীন সমাজের কিছু অংশ নেশাগ্রস্তের মত খেউড় আখড়াই শুনতে আগ্রহী এবং ব্যস্ত ছিল। সে আখড়াই শান্তিপুরের আখড়াই। তা দুরকম। খেউড় আর প্রভাতী। ওই আখড়াইয়ের চার বিষয়ের এক পর্ব সখীসংবাদ এখন শুনলে কানে আঙ্গুল দিতে হবে। উচ্ছৃঙ্খলতা স্বেচ্ছাচারিতা দুর্বৃত্তি সমাজের একধরনের মানুষকে ন্যায়ভ্রষ্ট করেছিল তারাই এ গান শুনত।
এ কিন্তু বহু পুরোন ধারা। আখড়াই এসেছে আখড়া শব্দ থেকে অর্থাৎ অনেকজন একত্রিত, জোটবাঁধা এক দল। ব্যান্ডের মত। এ গানে ছিল চাপান-উতোর, ছিল সওয়াল-জবাবের মত ব্যাপারস্যাপার। তবে কবির লড়াইয়ের মত নয়। আখড়াইয়ের দল হত কমপক্ষে কুড়ি বাইশজনের। সেকালে গায়ক মাথাপিছু ও কতজন বাদ্যযন্ত্রী আসছে তার ওপর পারিশ্রমিক বা দক্ষিণা স্থির হত। যেমন চুঁচুড়ার প্রসিদ্ধ এক দলের নাম ছিল বাইসেরা অর্থাৎ তারা বাইশজনের দল। অনেক সময় নাকি রান্নার উপকরণ বাসনপত্রও যন্ত্র হিসেবে ধরে নেওয়া হত টাকা বাড়ানোর জন্য। এরা শান্তিপুর থেকে কলকাতায় ঢুকেছিল চুঁচুড়া হয়ে রাজা নবকৃষ্ণ ইতাদিরা এদের পৃষ্ঠপোষক।
আর যে ঠাকুরবাড়ির বংশ থেকে এল রেনেসা! সেই বংশের পূর্বপুরুষ জয়রাম ঠাকুরের বাড়িতেও বসত এই আখড়াই গানের আসর। নিধুবাবু ও কুলুইচন্দ্র সেন পরিশীলিত করে প্রকাশ করলেন ভদ্র আখড়াইয়ের আরেক ফর্ম যাতে এমন অশ্লীল ভাষা পরিহার করা হয়েছে আর সংযুক্ত হয়েছে ভবানীসংবাদ বলে নতুন এক অংশ। পরিশীলিত আখড়াই চালু হবার সময় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সমাজের প্রগতিবাদী অগ্রগণ্যদের নিয়ে এক সংগঠন— আত্মীয়সভা, রামমোহন রায়ের উদ্যোগে। যেখানে দ্বারকানাথ ঠাকুরও আছেন। এর অব্যবহিত বাদে জন্মাবে ব্রাহ্মসমাজ। এখানে গান এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। আর সে গানের কাঠামোই গড়ে দেবে আজকের বাঙলাগানের গড়ন। ফিরে যাই সেকালে। তখন রামমোহন খুঁজছেন এক পথ যাতে গানের সুরকে কথা অবলম্বী করে তোলা যায় আর যে গান আয়তনে কখনো বড় হবেনা তার পরিসর ছোট কিন্তু অনেক বড় কথার অর্থ সে পৌঁছে দেবে সহজে। আসলে কি হবে গানের ফর্মটা! তাঁরা সেটাই খুঁজছিলেন। রামমোহন স্বয়ং তৈরি করতে শুরু করলেন গান। অনুরোধ করলেন নিধুবাবুকেও। আর অতিবৃদ্ধ নিধুবাবু ব্রাহ্মসমাজের জন্য কম্পোজও করে দিলেন দুটি গান।
ক্রমে ব্রহ্মসংগীত একটা ধারা বলে নির্ণীত হল। ব্রাহ্মরা গাইছেন সে গান সমাজগৃহে, অনুষ্ঠানে সমাবেশে। এই ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীরা ছিলেন শিক্ষিত ও মোটামুটি অবস্থাপন্ন ঘরের। লক্ষ্যনীয়ভাবে এঁরা সমাজসংস্কার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের পাশাপাশি প্রায় প্রতিজনই উদ্যোগী হয়েছেন গান রচনায়। এবং তা দান করেছেন ব্রাহ্মসমাজের ভাঙারে। দ্বারকানাথ ঠাকুর পরম রামমোহন অনুরাগী এবং তৎকল্পিত আত্মীয়সভায় উৎসাহী হলেও এ দিকটায় তাঁর নজর ছিলো না অথচ দ্বারকানাথ ছিলেন সঙ্গীতে মহা উৎসাহী।
১৮৪২শে দ্বারকানাঘের বিলেতযাত্রায় তাঁর সঙ্গী আঠারোজন ‘কনস্ট্যান্ট কম্পানিয়নের’ মধ্যে একজন হচ্ছেন এক জর্মন সংগীতজ্ঞ। তিনি একে কলকাতা থেকে তাকে নিয়ে যাচ্ছেন কারণ লন্ডন থেকে কেনা হবে বাৰ্বি ইয়ং কম্পানির বহুমূল্য ব্যারেল অর্গান আর তার সুর ভারতীয় স্বরগ্রাম অনুযায়ী ‘টিউন’ করে দেবেন সেই বিশেষজ্ঞ। দ্বারকানাথ বিদেশবাসের সময় অনেক গান রপ্ত করেছিলেন। ম্যাক্সম্যুলারের সংগে মৌখিক আলোচনায় ইটালিয়ান গান ও বাংলাগান এক বিষয় ছিল। পরবর্তীকালে দ্বারকানাথের প্রথমপুত্র দেবেন্দ্রনাথ ক্রমে হয়ে উঠলেন ব্রাহ্মধর্ম প্রসারের মূল হোতা। এ সময়েই এসেছিলেন একঝাঁক সুরকার। অতীতে দেবেন্দ্রনাথ ইওরোপীয় শিক্ষকের কাছে নিষ্ঠাভরে শিখেছিলেন পিয়ানো আর ইংলিশ ফ্লুট। উদ্দেশ্য সঙ্গীতসৃষ্টি। উনি ভারতীয় রাগরাগিনীতে দক্ষ হলেও পাশ্চাত্য সঙ্গীত ভালোভাবে মকশো করেছিলেন তা বোঝা যায়। উদারভাবাপন্ন দেবেন্দ্রনাথের কাছে এদের-ওদের এমত ভেদাভেদ ছিলো না এবং পুত্রকন্যাদের প্রতি পরিবারের আদেশ ছিল গানটা শিখতে হবে সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রও। বিশেষত পিয়ানো ও অর্গান। সে আদেশ পালন করেছেন তাঁর পুত্রকন্যা পৌত্রপৌত্রীরা। এই ঠাকুরবাড়িতে মাসমাইনে নিয়ে ছোটদের গান শিখিয়েছেন যদুভট্ট, বিষ্ণু চক্রবর্তী, মৌলাবক্স, শ্রীকন্ঠ সিংহরা। এঁরাই পরবর্তী প্রজন্মের ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন গানের সুরকার হিসেবে। একথা সত্যি যে ঠাকুরবাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই গীতিকার ও সুরকার। এ প্রসঙ্গে পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির অবশ্য উল্লেখ্য। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর বাঙলায় ইওরোপীয় চর্চার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সঙ্গীতের নাটকের প্রসারে তাঁর অনন্য অবদান। এঁরই তাগিদে সভাসদ সঙ্গীতবিশারদ ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী প্রথম ভারতীয় অর্কেস্ট্রার ফর্ম গড়ে তুললেন। পাশ্চাত্যসঙ্গীত জানা শিষ্য যদুনাথ পালকে নিয়ে তৈরি করলেন তার রূপরেখা। প্রথম বাজলো চার যন্ত্রের সমন্বয়ে ভারতীয় স্ট্রিং কোয়ার্টেট। কাছুয়া সেতার, সেতার, সুরবাহার ও বীণা নিয়ে। অর্কেস্ট্রার জন্য তৈরি হল ঐকতানিক স্বরলিপি। বাঙালী বুঝলো গানকে সংরক্ষণ করতে স্বরলিপি করতে হয়। এ বাড়িরই অন্যজন শৌরীন্দ্রমোহন সঙ্গীতের ওপর যা কাজ করে গিয়েছিলেন তার আয়তন মাপলে চমৎকৃত হতে হয়। সেই সময় অক্সফোর্ড থেকে পাওয়া ডক্টরেট রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর সারা পৃথিবীর তিরিশজন নামীদের মধ্যে একজন যার পরিচিতির বেশীর ভাগটাই দাবী করে সংগীত। এ সময় তৈরি হচ্ছে নাটকের গান। পরে তা জনগণে ছড়িয়ে যাবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদানে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটকের গান প্রেমের কথা আর বোলো না সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী বলছেন— উনি সাড়ে তেরো বছর বয়সে হিন্দু স্কুলে ভর্তি হলে ক্লাসে এক সহপাঠীকে টেবিল বাজিয়ে এই গান গাইতে শুনলেন তা নাকি ইটালিয়ান ঝিঁকিটে তৈরি। উনি এই গান ইতিপূর্বে গাড়োয়ানের মুখেও শুনেছেন। ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর ছাত্র কৃষ্ণধন বন্দোপাধ্যায় প্রথম গানে হারমোনাইজ করতে শুরু করেন। ঐকতানিক গান ও বৃন্দবাদনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেন। উনিই প্রথম লুপ্তপ্রায় ধ্রুপদগুলিকে স্টাফ নোটেশনের মাধ্যমে ধরে রাখতে প্রয়াসী হন এবং গভর্নমেন্টের চাকরি ছাড়েন সঙ্গীতের জন্য। এই প্রয়াসের হাত ধরে সৃষ্টি হল দক্ষিণাচরন সেন কৃত অর্কেস্ট্রা ব্যান্ড। নাম ব্লু রিবন অর্কেস্ট্রা। ওদিকে
অমৃতলাল দত্ত বা হাবু দত্ত যন্ত্রীদের সাজাচ্ছেন গিরিশ ঘোষ পরিচালিত নাটকের জন্য যেখানে পরবর্তীকালে উস্তাদ আলাউদ্দিন খান একজন ক্ল্যারিনেট বাজিয়ে হিসেবে খুঁজে পাবেন তার রুজি। আগে বলা হয়েছিল যে বাঙলা গানের আধুনিক রূপধারণের পেছনে ব্রহ্মসঙ্গীতের ভুমিকা আছে। এই রূপটির পরিকল্পনা করেছিলেন গায়ক বিষ্ণু চক্রবর্তী। ঠাকুরবাড়ির জিনিয়াসরা এখান থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে একেকজন অসামান্য সুরকার হয়ে উঠলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ সবাই। এদের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক বোধহয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ! জ্যোতিরিন্দর গান সপ্রতিভ ঝকঝকে। কর্ডনির্ভর, যেহেতু পিয়ানোয় বসে কম্পোজ করা। তৎকালে ইডেন গার্ডেনের ব্যান্ড সাধারণ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল। ওই সহজ সরল বিদেশী সুর এদেশী সুরকাররা আয়ত্ত করেছিলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হয়ত সবচেয়ে বেশী। অনুজ তরুণ রবীন্দ্র ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসছেন স্কটিশ আইরিশ গানের শিট মিউজিক আর দাদা তা পড়ে দ্রুত তুলে ফেলছেন সুর। এভাবেই তৈরি হয়েছে ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে, পুরানো সেই দিনের কথা এবং আরো কত গান! জ্যোতিরিন্দ্রকৃত স্বরলিপিগীতিমালা স্বরলিপি গ্রন্থে রয়েছে নাম— কথা রবীন্দ্রনাথ সুর গ্রন্থকার। এই সেজ দাদা না থাকলে রবি আমাদের এই রবীন্দ্রনাথ হতেন কিনা সন্দেহ! মিথ্যা নয়। একথা রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বলে গেছেন টাউনহলে সত্তর বছর পূর্ত্তির সম্বর্ধনাসভায়। এরপর সত্বর রবীন্দ্রনাথ ছাপিয়ে গেলেন সবাইকে। সং রাইটার হিসেবে সারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কম্পোজ করা সুরকার গীতিকারদের মধ্যে সম্ভবত যিনি দ্বিতীয়। ২২৩২টি গান! এমন কোন বাঙালি নেই যে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেনি। গানের এমন জনগ্রাহ্যতা আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। পুরো একটা জাতি রবীন্দ্রগানে অবগাহন করেছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথের চেয়ে দু বছরের ছোট, বাঙলা গানে তাঁর অবদান প্রচুর কিন্তু তাঁর স্বল্পজীবন। মাত্র ৪৯ বছর বেঁচে রইলেন। তৎরচিত জাতীয়তা গান ও নাটক ব্রিটিশদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। তাই হয়ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরিতে ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে দূর দূর প্রান্তে ঘনঘন বদল করা হত এবং এ কারণে ক্রমেক্রমে স্বাস্থ্যহানি, অবশেষে সেরিব্রাল স্ট্রোকে এই অকাল মৃত্যু। একমাত্র দ্বিজেন্দ্রলালই বিলেত থাকা কালীন নিজের পয়সা খরচ করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে গানটা শিখেছিলেন। অপেরাধর্মী হাস্যরসাত্মক গানগুলোয় তার নিদর্শন ছিল কিন্তু তা হারিয়ে গেছে।
বাঙলায় পাঁচজন কবি কম্পোজারকে একত্রে বলা হয় পঞ্চকবি। রবীন্দ্রনাথকে মূল ব্যক্তিত্ব ধরে বাকিরা হলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন ও নজরুল ইসলাম। এঁরা বহু আলোচিত বহু অন্বেষণ হয়েছে এবং এঁরা একেকজনে নিজেরাই একেকটি ইতিহাস গ্রন্থ। তাই এই সংক্ষিপ্ত সফরে তাঁদের আনা হল না। ১৯০০ সাল নাগাদ বোম্বাই হয়ে কলকাতায় এল সিলিন্ডার রেকর্ড এবং পরে গালার রেকর্ড ডিস্ক। হেমেন্দ্রমোহন বসু এইচ বোসেস কোম্পানি খুলে বাঙলা ও উর্দু গান রেকর্ড করার পাশাপাশি বাঙ্গলার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদেরও গান আবৃত্তি ভাষণ এই সিলিন্ডারে গ্রহণ করতে শুরু করলেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ ১৯০৪ এ গাইলেন নিজের সুরে বন্দেমাতরম। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পটভূমিকায়। পরে এই রবিবাবুর গানই বহু শিল্পী গাইতে চাইবেন। বেদানা দাসীর ‘আজ তোমাকে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে’ শুনলে বোঝা যাবে এই রবীন্দ্রসঙ্গীতই তখন কিভাবে গাওয়া হত। এরপর এল বিদেশী কোম্পানি। ব্যবসা বুঝে তারা নিশানা করতে লাগলো প্রতিষ্ঠিত বাইজিদের ও অন্য গায়ক গায়িকাদের। গহরজান, মালকাজান, জড্ডনবাই, জানকীবাই ছপ্পনছুরি এঁদের রেকর্ড ব্যাপকভাবে বিক্রি হতে লাগলো। এলেন লালচাঁদ বড়াল কাদের মল্লিকের মত শিল্পীরা। এবং পরম্পরায় - জ্ঞান গোঁসাই নজরুল ইসলাম সায়গল আব্বাসউদ্দিন ভীমদেব চট্টোপাধ্যায় আঙুরবালা ইন্দুবালা কাননবালা আরো পরে শচীনদেব বর্মন পঙ্কজকুমার মল্লিক - এরা।
কলের গান আসাতে গান এখন ঘরে ঘরে। সবাই চোঙাওলা গ্রামোফোন কিনতে চান গান শোনা অবশ্য প্রয়োজন। তবে রেকর্ড কোম্পনির প্রয়োজন আরো বেশী চাই আরো শিল্পী। আর ঠিক তখন দুটো বিষয়ের প্রয়োজন হল —এক গীতিকার দুই সুরকার। তখনই সুরকার হিসেবে প্রসিদ্ধি পেলেন রাইচাঁদ বড়াল কমল দাশগুপ্ত সুবল দাশগুপ্ত তিমিরবরণ হিমাংশু দত্ত কৃষ্ণচন্দ্র দে হীরেন বসু সুধীরলাল প্রমুখেরা। সঙ্গে গীতিকার হিসেবে এলেন প্রণব রায় শৈলেন রায় অজয় ভট্টাচার্য সুবোধ পুরকায়স্থ মোহিনী চৌধুরীরা। এঁরা তিরিশ থেকে চল্লিশ দশকের শিল্পী।
এইসঙ্গে তিরিশ দশক থেকে বাংলা চলচ্চিত্র সবাক হল। এই টকি ফিল্মের আগে এখানে তৈরি কি বিদেশ থেকে আসা যে নির্বাক বা শব্দহীন যেসব ‘বায়োস্কোপ’ দেখানো হত তাকে আরো বিনোদনী বা আমোদজনক করতে সিনেমা হলে লাইভ অর্কেস্ট্রা ব্যবহার করা হত। পর্দার উল্টোদিকে বসে থাকা যন্ত্রীরা ছবির মুড বুঝে তাতে সংগত করতেন। এমন ছবিতে বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরী কিশোর বয়সে এক প্রেক্ষাগৃহে স্টান্ট পিয়ানিস্ট হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। প্লে ব্যাক পদ্ধতি আসার আগে এরাই শুটিং লোকেশনে অভিনেতা অভিনেত্রীর গানের সাথে বাজানোর জন্য ক্যামেরার আড়াল হয়ে বসতেন। এমত গানের রেকর্ডিং নিয়ে অনেক গল্প শোনা যায় আজও। যাইহোক এই যন্ত্রীরা ক্রমে প্রডাকশন হাউজগুলোর বাঁধা মাইনের চাকুরিজীবি হয়ে গেলেন। এরকম দল কলকাতায় প্রচুর ছিল। নিউ থিয়েটার্স হাউজ থেকে এদের রেকর্ড বেরোত রাইচাঁদ বড়াল তিমিরবরণের পরিচালনায়। গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া ছাড়াও তিনটে বাঙালী রেকর্ড কোম্পানি তখন - মেগাফোন হিন্দুস্থান ও সেনোলা। রবীন্দ্রনাথ গায়ক এবং আবৃত্তিকার হিসেবে হিন্দুস্থানের শিল্পী ছিলেন। চল্লিশদশক পর্যন্ত সুরকৃত গানগুলো মোটামুটি ভাবে রাগরাগিনী ও লোকসঙ্গীতাশ্রিত ছিল। যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীতেই বিদেশি সঙ্গীতের মেলবন্ধন ঘটেছে এ আমরা আগেই দেখেছি। কিন্তু লিরিকের সাহিত্যমূল্য উচ্চস্তরের হলেও একটু এলায়িত লীলায়িত আর সুরও যেন হেলেদুলে চলে। ১৯৩৯ - ১৯৪৫ ভয়াবহ বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ। এই ভীষণ দুর্বহ দুর্মর টেনে চলা জীবন। পরে পরেই দুর্ভিক্ষ কালোবাজারী দাঙ্গা – এই অবক্ষয়ী সময়ের মধ্যেই উঠে দাঁড়ালো মধ্যবিত্ত সমাজের কিছু মানুষ। এরা শিল্পী। এরা লিখলেন গান কবিতা নাটক আঁকলেন ছবি, নতুন মূল্যবোধের এবং অবশ্যই এক নতুন আঙ্গিকে। সে গানের সুর মিলে যায় বাঙ্গলার লোকগান বা কখনো লাতিন কখনো কালো আমেরিকানদের সুরে। গণনাট্যের এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রবিশঙ্কর থেকে প্রায় সব শিল্পীই এখানে সামিল হয়েছিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সলিল চৌধুরী সুধীন দাশগুপ্ত সবাই এই কর্মকান্ডের সামিল তখন।
বাঙলা গানের প্রধান স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তী যে ধারা প্রবাহিত হতে লাগলো তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। গানের ফর্ম এমনভাবে ভাঙলো যা অনেকস্থানে পূর্বপরিপন্থী। ১৯৪৯ সালে গাঁয়ের বধূ যখন বেরোয় তখন ধ্রুপদিয়ারা প্রশ্ন তুলেছেন একি গান? এতে কেন অন্তরা সঞ্চারী নেই! ১৯৫৩ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠ হারমোনাইজ করা হয়েছিল আর এতে সঙ্গীত পরিচালককে অনুযোগ করা হয়েছিল কেন তিনি লতা মঙ্গেশকরকে সুরে গাওয়াতে পারেননি। আর আজ গানে হারমোনাইজ করার প্রতিযোগিতা চলেছে। সত্যিই এরা যুগের তুলনায় কত এগিয়েছিলেন।
পঞ্চাশের মাঝামাঝি গানের যন্ত্রানুষঙ্গ শব্দগ্রহণ মিশ্রণে আসছে নতুন ভাবনা।
এখন যন্ত্রানুষঙ্গ হয়ে উঠছে প্যানোরামিক। দূরে আবহে মায়াময় ভায়োলিনবৃন্দ বাঁশিতে অবলিগ্যাটো। অর্কেস্ট্রা তৈরি করছে সাঙ্গীতিক ভাষা। বাজছে গানের ভাবানুসারী প্রিলিউড ইনটারলিউড। এর ঠিক আগে বদলে গেছে গানের উচ্চারণ বদলে গেছে এক্সপ্রেশন। কুন্দন সায়গল পঙ্কজ মল্লিকের গলার সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আকাশপাতাল তফাৎ। আনুনাসিক শব্দ উধাও।
এবার গায়ক হেমন্ত সুরকারও। সুরকার সলিল চৌধুরী সুধীন দাশগুপ্ত নচিকেতা ঘোষ বদলে দেবেন গানের ধারা। একের পর এক লিজেন্ডারি গান গেয়ে যাবেন হেমন্ত মান্না সতীনাথ শ্যামল মানবেন্দ্র দ্বিজেন সন্ধ্যা গীতা প্রতিমা আরতি আরো আরো অনেকে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন না! নদীর বাঁকগুলোই মডার্ন। সত্যি এ মডার্নিটির ধারানদী কত বাঁকবদল করে আনলো কবীর সুমনকে, এলো কথা ও গানের নতুন রূপ, এলেন নচিকেতা চক্রবর্তী অঞ্জন দত্ত তারপর ক্রুশ উইনডজের রক ব্যান্ডের সাথে এল বাঙলা ব্যান্ড ভূমি ক্যাকটাস পরশপাথর চন্দ্রবিন্দু ফসিলস লক্ষীছাড়া।
আ মরি বাংলা ভাষা - তার গানের কতনা বৈচিত্র্য! এ ভাষার গান নিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষ বলে গিয়েছিলেন— ‘গান কি জান? কোনও রসের আবেগ যখন এত গভীর হয় যে কথায় তা বলা যায়না, ছন্দে কবিতায় তা প্রকাশ করতে পারেনা, তখন মানুষ সুরে সেই অব্যক্ত ভাবকে ব্যক্ত করবার চেষ্টা করে। সেই সুর যখন জাগে - তখন ছন্দে তার রূপ ফুটে ওঠে, কন্ঠে তখন গান হয়ে ব্যক্ত হয়।’
এই রসের আবেগ বাঙলার খুবই বাঙালীর কণ্ঠে তুলে দেবে গান আরো আরো হাজার বছর!