সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
স্কুল থেকে ফিরে এসেই আমি চিৎকার করতাম - মা খেতে দাও। মা হয়তো তখন গেছে বারান্দায় বা ছাদে, সেখানে মেলে রাখা শুকনো জামাকাপড় তুলে আনতে। আমার চিৎকার শুনে মা হয়তো বলেছিল যে - আগে একটু ভালো করে হাত-মুখ ধুয়ে আয়, তারপর দিচ্ছি। তাতে আমি নিশ্চয়ই জবাব দিয়েছিলাম যে - এখন হাত-পা ধুয়ে কী হবে? খেলতে যাবো তো। তারপর জামা-প্যান্ট ছাড়তে ছাড়তে হয়তো বলেছিলাম - বেশি কিছু দিও না, খাওয়া বেশি হয়ে গেলে, দৌড়াদৌড়ি করতে গেলে পেটে ব্যাথা করে।
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা মোটামুটি একই কথাবার্তা সামান্য একটু অদল-বদল করে আমরা বলতাম। খেতে খেতে সেদিন স্কুলে নতুন কী ঘটেছিল, সেটাও ওই খেতে খেতেই বলতে চাইতাম। মা বলতো - খেতে খেতে কথা বলতে নেই। গলায় আটকে যাবে। কে জানে, আমার তো কোনো দিন আটকেছে বলে মনে পড়ে না।
খেয়ে উঠে কোনোরকমে হাত-মুখ ধুয়ে আমি ছিটকে বেরিয়ে আসতাম বারান্দায় আর তারপর লাফিয়ে আমার সাইকেলের ওপর চেপে বসে, বলে উঠতাম - চল মেরে ঘোঁড়ে! মা পেছন থেকে বলতো - ঘোঁড়ে নয়, ওটা হবে ঘোড়ে, চন্দ্রবিন্দু নেই। সেটা আমি জানতাম, কিন্তু ঠিক ওইসময় কেন যে মুখ থেকে চন্দ্রবিন্দু দিয়েই শব্দের উচ্চারণ হতো, সেটা আজও রহস্য!
কিন্তু একদিন এই বাঁধা রুটিনে ঘটলো গন্ডগোল। খেয়ে উঠে এসে আমি দেখলাম বারান্দায় আমার সাইকেলের চিহ্ন মাত্র নেই। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। চুরি হয়ে গেল নাকি? গেট লাগানো থাকে বলে সাইকেলে আর তালা দিয়ে রাখিনি। কিন্তু এর মধ্যেই?
ছুটে ফিরে এলাম ঘরের মধ্যে। মাকে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম - মা সাইকেলটা...
মায়ের মুখে কিন্তু খুব একটা ভাবান্তর দেখলাম না। বেশ শান্ত হয়ে মা বললো - হ্যাঁ, ঋজু এসেছিল একটু আগে। ওর নাকি সাইকেল লিক হয়ে গেছে। আজকে নাকি ওর খুব গুরুত্বপূর্ণ খেলা। তাই, তোর সাইকেলটা চাইলো।
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম - ও চাইলো, আর তুমি আমাকে জিজ্ঞেস না করেই দিয়ে দিলে? ওর খেলা আছে, আর আমার নেই?
- তুই কি আজকের ম্যাচে খেলছিস? মা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো।
আমি মুখ নামিয়ে বললাম, শুরু থেকেই হয়তো নয়, কিন্তু যদি তারপরও দীপকদা মনে করে, হয়তো শেষের দিকে নামাতেও পারে।
মা বললো - তাহলে যা, দশটা টাকা নিয়ে, মতিগঞ্জের মোড় থেকে একটা টোটো নিয়ে বেরিয়ে যাবি। অনেক দিন ও তোকে পড়াশোনায় অনেক সাহায্য করেছে। একদিন একটুখানি সাইকেল চাইতে এলে না বলা যায়?
রাগে গজগজ করতে করতে কিটব্যাগ আর বুকজোড়া দুই কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলাম।
সেদিন মতিগঞ্জের মোড় থেকে টোটো পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে যখন মাঠে পৌঁছালাম, তখন খেলা প্রায় শুরু হতে যাচ্ছে। দীপকদা রাগী চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।
খেলা শুরু হতেই আমি ক্লাবঘরে ঢুকে দেখি দেয়ালের একপাশে হেলান দিয়ে রাখা আছে আমার সাইকেল। তালা লাগানো নেই। আমি তালাটা লাগিয়ে চাবিটা আমার ব্যাগের সাইড পকেটে রাখলাম।
সেদিনের ম্যাচ আমরা জিততে পারিনি। আমাকেও সামান্য সময়ের জন্যেও নামানো হয় নি। ম্যাচ শেষে দীপকদার ধরে ধরে ভুল-ত্রুটি বিশ্লেষণের শেষে আমি সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে সাইকেলের তালা খুলে বেরিয়ে এলাম। কেউ আমাকে কোনো প্রশ্ন করলো না।
যদিও আমি চাইছিলাম যে, কেউ কিছু বলুক। একটু চিৎকার-চেঁচামিচি হোক। কিন্তু কিছুই হলোনা দেখে, সরাসরি বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে হলোনা। সাইকেল ঘুরিয়ে চললাম তিষ্টিদের বাড়ির দিকে। মন ভালো থাকলেও কি, আর অস্হির হলেও কি - ওই বাড়িটাই আমাকে টানে।
আসলে এইটা হয়তো কোনো ঘটনাই নয়। হয়তো বা এটা আমি রোজকার সাধারণ আর পাঁচটা ঘটনায় জড়িয়ে-মিশিয়ে কবেই হারিয়ে ফেলতাম। তাছাড়া ঋজুদা আমার চেয়ে তিনটে ক্লাস সিনিয়র, পড়াশোনা করে আর সবচেয়ে বড়ো কথা, কম্পিউটার বিষয়ে কোনো কিছু সমস্যায় পড়লে, ওর কাছেই পরামর্শ নিতে যেতাম আমি। তবে, সে সবই গতবছর বা তার আগের কথা।
তিষ্টি আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমরা এক ক্লাসেই পড়ি। এর সঙ্গে কয়েকটা টিউশনিতেও আমরা একসাথে যাই। তাই, সকাল সাতটা বা রাত দশটার সময়েও যদি আমরা একে অপরকে ফোন করি, আমাদের বাড়ির লোকেরা তাতে কিছু মনে করে না।
ক্লাস ইলেভেন-এ পড়ি বলে, স্কুলে সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব সেবার আমাদের ওপর। সকাল সাতটায় আমরা সবাই ঠিক পৌঁছে গেছি। কাজকর্ম, হৈ-হল্লা, এর-ওর পেছনে লাগা - সবটাই চলছে পুরোদমে। তিষ্টি আলপনা দিচ্ছিলো দোতলায় ওঠার সিঁড়ির সামনে। হঠাৎই আমার মনে যে কিসের পুলক জাগলো - আমি ঠিক করে ফেললাম, হয় আজকেই আর না হলে কখনোই নয়। ওর আশেপাশে তখন কেউ নেই দেখে আমি বলে উঠলাম - তিষ্টি, আজকে তোকে আমি একটা কথা বলবো।
তিষ্টি উঠে দাঁড়ালো আমার কথার ধাক্কায়। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো, সামান্য একটু সময়। তারপর বললো - বেশ, তবে কিছু দিন আগে ঋজুদা যেটা বললো, তুই নিশ্চয়ই সেটা আবার বলবি না।
এবার ওর থেকেও বড়ো ধাক্কা খেলাম আমি। কিন্তু প্রাণপণে চেষ্টা করে নিজের ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটিয়ে গলায় খুব উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলাম - কী বলেছে তোকে রে ঋজুদা? কখন দেখা হলো, তোর সঙ্গে?
তিষ্টি আবার বসে পড়লো, আলপনার কাছে। তারপর আঁকতে আঁকতেই বললো - এই তো, স্কুলে আসার সময়। আমার মুখে এসে গেছিলো যে, কিন্তু ও তো তোর থেকে অনেকটা সিনিয়র। কিন্তু অনেক কষ্টে সেটা চেপে গেলাম। এটুকুই বুঝলাম যে, এবার আমি যাই বলি না কেন, আরো বেশি করে ধরা পড়ে যাবো। তাই মুখে শুধু বললাম - গুড! তারপর ফিরে এসে মিশে গেলাম আমার বন্ধুদের দঙ্গলে।
অন্যদের সঙ্গে মিশতে কোনো অসুবিধা না হলেও আমি বুঝতে পারছিলাম যে, ঋজুদার সঙ্গে মিশতে আমার অসুবিধা হচ্ছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কেমন যেন বাধো-বাধো ঠেকছে।
আর, তার দিন পনেরো পরেই সেই ঘটনাটা ঘটেছিল। নেহাতই একটা প্র্যাকটিস ম্যাচ। বিপক্ষের একজন কেউ কর্নারের কাছ থেকে ব্যাক-সেন্টার করেছিল আমাদের পেনাল্টি বক্সের মাথায়। মরিয়া হয়ে আমি ভলি করে সেটা ফেরত পাঠাতে চেষ্টা করেছিলাম মাঝমাঠে। ওমনি কোথা থেকে ছুটে এসেছিল ঋজুদা। ট্যাপ করতে নয়, সরাসরি হিল করেছিল আমার পায়ের চেটোতে। যন্ত্রনায় গড়িয়ে পড়তে পড়তে আমি ভাবছিলাম, তাহলে কি তিষ্টি আমাকে যেমন বলেছিল, তেমনি ঋজুদাকেও কি বলেছিল আমার বলতে চাওয়ার ইচ্ছা?
তিনদিন স্কুলে যেতে পারিনি, টিউশনিতেও না। তিষ্টি এসেছিল আমাদের বাড়িতে, আমাকে দেখতে। আমাকে বললো - কীভাবে হলো? আমি সরাসরি বলতে পারি নি। বলেছিলাম - রংফুটিং হয়ে গেছিলো, মচকে গেছে। খেলতে গিয়ে ওরকম হয়।
সেদিন দুপুরে অনেকটা সময় আমার বিছানার পাশে বসেছিল তিষ্টি। অবশ্যই তার একটা কারণ এটা হতে পারে যে, সেই দুপুরে ও আসার পর আচমকাই আকাশ ঢেকে গেছিল কালো মেঘে। কিন্তু সেকথা না ভেবে, আমার মনটা ভরে উঠছিল শুধু এই কথাটাই ভেবে যে, সে এসেছে। আমি ভেতরে ভেতরে এতোটাই খুশি হয়েছিলাম যে, পা-টা যদি আমাকে সাহায্য করতো, তাহলে আমি হয়তো নেচেও উঠতে পারতাম।
তারপর আমাদের চারপাশে অনেক দিন কেটে গেছে। পড়ার ক্লাবের উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মঞ্চে উপস্থিত গন্যমান্য মানুষের সামনে তিষ্টি রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করে সবাইকে মুগ্ধ করেছে। আমরা দর্শকদের পেছনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছি। রূপকথার গল্পের ওপর নির্ভর করে তৈরি বিদেশি সিনেমা দেখতে গিয়ে রাজকন্যার ভূমিকায় অভিনয় করা মেয়েটার মধ্যে নিজের ভাবনায় আমি ওরই মুখের আদল দেখে উল্লাস প্রকাশ করেছি। ভোরবেলায় রাস্তা ধরে দৌড়তে দৌড়তে ওদের বাড়ির পাশেই বকুলতলায় ফুল পড়ে থাকতে দেখে, আশা করেছি, আর একটু অপেক্ষা করলেই হয়তো সাজি হাতে সে বেরিয়ে আসতে পারে, ফুল কুড়োতে।
কিন্তু দৌড় শুরু করলে, যখন-তখন সেটা থামানো যায় না। এভাবেই দৌড়তে দৌড়তে আমি স্কুল থেকে কলেজ হয়ে একসময় ইউনিভার্সিটি পৌঁছে যাই। সময়- সুযোগ পেলে সকালের দৌড় আর বিকেলের খেলা চলতেই থাকে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় ওদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়েই ফিরি। কোনো কোনো দিন ওকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আবার কোনো দিন ফাঁকা বারান্দায় একা একাই একটা নীল রঙের আলো জ্বলে।
তারপর একদিন দেশে এক ভাইরাস হানা দেয়। প্রথমে সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আমার দৌড় আবার শুরু করি। কিন্তু ক্লাবের দরজা বন্ধ-ই থাকে। বাড়ির ছাদে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পাই, ফাঁকা রাস্তা ধরে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলে যায়, ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের দল। ঋজুদাও ভালো একটা চাকরি পেয়ে চলে গেছিল বিলাসপুরের কাছে একটা কোথাও। একদিন খবর পাই, সেও নাকি ফিরে এসেছে অনেক খরচাপাতি করে। একদিন রাস্তায় দৌড়াতে গিয়ে দেখা হয়। ঋজুদাই এগিয়ে এসে কথা বলে। আমি বলি - কেমন আছো? ও বলে - বলবো একদিন সবকিছু। তুই থামিস না, দৌড়ে যা।
আরো খবর পাই, এবছর নাকি কলুষতা মুক্ত হয়েছে অনেক নদীর জল। অস্ট্রেলিয়ার হাইওয়েতে নাকি দৌড়ে বেরাচ্ছে ক্যাঙারুর পাল। ক্যারিবিয়ান সাগরের বুকে নাকি আবার ফিরে এসেছে তিমি-ডলফিনের দল। আমাদের এখানেও গাছে গাছে দেখতে পাই, অনেক পাখি আর কাঠবিড়ালি। নিশ্চিত করে অবশ্য বলতে পারি না, আগের থেকে অনেক বেশি কিনা। কেননা, আগে তো এদের দিকে তাকিয়ে দেখার ফুরসৎ-ই পাইনি।
এখন তো কেউ কারোর বাড়িতে যাই না। আশেপাশের বন্ধুদেরকেও পাড়ার মোড়ে নয়, ফোনে ফোনেই কথা বলে, মেসেজ করে খোঁজ খবর নিই। ফোনে ফোনেই এটা-সেটা খবর ছড়ায়। চেনা অচেনা কতো মানুষ পৃথিবী ছেড়ে পাড়ি দেয় অজানা দেশে। আবার, এরমধ্যেই জন্ম নেয় কতো নবজাতক, কতো জনের বিয়েও হয় - তারা ঘর বাঁধে। আমি মনে মনে ঋজুদাকে ক্ষমা করে দিই।
আর একটা বদ-অভ্যাস হয়েছে এখন। দুপুর বেলায় খাবার খেয়ে উঠেই বড্ড ঘুম পায়। খুব বেশি নয়, হয়তো আধঘন্টা বা চল্লিশ মিনিটের মতো সময় পেলেও একটু শুয়ে পড়ি। যেদিন খাওয়া একটু বেশি হয়ে যায়, সেদিন ঘুমিয়ে পড়লেই স্বপ্ন দেখি। অদ্ভুত সব স্বপ্ন।
পঞ্চাশ জন মাত্র আমন্ত্রিত। এর মধ্যে আমি যে ডাক পাবো, ভাবিনি। গিয়ে দেখি ঋজুদাও আছে সেখানে। আমাদের বয়সী ছেলেমেয়ে খুব বেশি নেই। এখন কনের পিঁড়ি ধরবে কে? এ ওকে ডাকছে। ঋজুদাই এগিয়ে গেল প্রথমে, আমি এড়িয়ে গেলাম।
মুখের সামনে একটা পানপাতা ধরে নিয়ে সাতপাকে ঘুরছিল তিষ্টি । আর একটা হাত ঋজুদার কাঁধে । তিষ্টিকে বিয়ে করতে আসা বরটা মাটির দিকে তাকিয়েই একমনে কী যেন ভাবছিল ।
নতুন কেনা শেরওয়ানির পকেট থেকে ঠিক এইসময় একটা মোবাইল ফোন বের করে দৃশ্যটা তুলে রাখার কথা ভাবলাম আমি। ঠিক তখনই ঋজুদার সাথে আমার চোখাচোখি হয়ে গেল ।
আমি এতোক্ষণ ভাবতে চেষ্টা করছিলাম ঋজুদা কী ভাবছে! এখন ঋজুদাও বোধহয় বুঝতে চাইল - আমি সেটা ধরতে পেরেছি কিনা । তিষ্টিদের বাড়ির পাশের জুড়িপুকুরের ধারের বকুলগাছটা থেকে তখন বকুল ফুলের মাতাল করা গন্ধটা ভেসে আসছিল।