সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
আশ্বিন মাস, কৃষ্ণপক্ষের ঘন অন্ধকার রাত, এক আকাশ তারা। আর কয়েকদিন পরই মহালয়া, বেশ শীত রয়েছে, সন্ধে ৭টা বাজে, ঘন অন্ধকার, অরূপদা আর আমি দুজনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি আমলাশোল গ্রামের মাঝে, ‘সবার ঘর’এর বাইরে দাঁড়িয়ে গল্প করছি। ‘সবার ঘর’ আমলাশোলের স্থানীয় কমিউনিটি হল, গ্রামে ঢোকার রাস্তার উপর চারিদিকের জঙ্গল পাহাড় ঘেরা উপত্যকার চাষের জমির মাঝে। আকাশ ভর্তি তারার আলোয় চারপাশে জঙ্গলে ঢাকা উঁচু পাহাড়ের অস্পষ্ট ছায়া, দুরে অন্ধকারের মধ্যে গ্রামের ঘরে একটা দুটো লন্ঠনের আলো। নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল অরূপদার সঙ্গে, তার অনেকটা অংশ জুড়ে ছিল ওনার মতো কলকাতায় বড় হওয়া মানুষ কেমন করে ছোটনাগপুরের এই প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামে এসে পৌঁছালেন। অরূপদার এখানে আসার শুরু ২০০৫-০৬ থেকে বন্ধু দীপক বড়াপন্ডার উৎসাহে এই আদিবাসী গ্রামের কচি কাঁচাদের ইস্কুলের জন্য, এখনকার জঙ্গল আর মানুষের টানে। সমাজ সেবার জন্য নয়, কারুর উপকার করার জন্য নয়, দয়া পরবেশ হয়ে নয় বা কারুর কাছে কিছু প্রমাণ করার তাগিদে নয়, এক ভালোবাসা, ভালোলাগার সম্পর্কের তাগিদে এই আসা। শুনছিলাম সেই অদ্ভুত সম্পর্কের কথা, সময়ের সাথে একজন আধুনিক ভারতের নগরসভ্যতায় পুষ্ট উচ্চশিক্ষিত মানুষের সাথে জঙ্গলে ঘেরা ভারতবর্ষের প্রাচীন নিরক্ষর আদিবাসীদের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা। দুই বিপরীত জগৎ একে অপরকে আকর্ষণ করেছে, কাছে এনেছে, আর চলেছে পরস্পরের কাছ থেকে জানার, শেখার আদান-প্রদান। জঙ্গল পাহাড় আর আদিবাসীরা ওনার সামনে নিয়ে আসে প্রকৃতির গভীরতম সৌন্দর্য আর উনি ওদের সামনে খুলে দেন আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি তার ভাষা আর গণিতের সুন্দর জগত। অরূপদা আসেন এই সরল মানুষদের টানে, এই বিশাল নক্ষত্র খচিত আকাশের নীচে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা আদিম বনানীর টানে, নিজের তাগিদে, ভালো লাগে বলে আসেন।
দিনটা ছিল ২রা অক্টোবার ২০১০, সেদিন সকালেই কলকাতায় প্রথম অরূপদার সঙ্গে আলাপ। আভিজিতদার কাছে শুনেছিলাম উনি এই আদিবাসী গ্রামে বাচ্চাদের জন্য একটা স্কুল চালান কলকাতার এক নামী কলেজের নিজের ব্যস্ত অধ্যাপনার বাইরে। সেদিন উনি এবং আরো কয়েকজন এখানকার মানুষদের জন্য শীতের জামা কাপড় নিয়ে আসছিলেন একটা টাটা সুমো গাড়িতে, দুদিন ছুটি তাই আমিও জুটে যাই ওনাদের সঙ্গে কাঁকড়াঝোড় আর আমলাশোলের জঙ্গল আর পাহাড়ের লোভে। লম্বা যাত্রা, সকালে কলকাতা থেকে বেরিয়ে ঝাড়গ্রাম, শিলদা, বেলপাহাড়ি হয়ে আমলাশোল পৌঁছই বিকালে। শিলদা ঢোকার আগে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পুলিশের জীপ আমাদের গাড়ি দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল আমরা কোথায় যাচ্ছি, আমলাশোল শুনে এবং অরূপদার পরিচয় পেয়ে সহজেই যেতে বলল। বুঝলাম নকশাল আন্দোলনের জন্য এই অঞ্চলের গাড়ির আসা যাওয়ার উপর নজর এবং একই সঙ্গে কে কি করছে কোথায় যাচ্ছে তারও খবর আছে পুলিশের কাছে।
পথে বেলপাহাড়ির পরে ওদোলচুয়া পেরোনোর সময় মনে পড়ে গেল আমার প্রথম কাঁকড়াঝোড় আসার কথা। কলেজে পড়ার সময় ১৯৮৪-৮৫ সাল নাগাদ, চার বন্ধুর হঠাৎ অ্যাডভেঞ্চারের উৎসাহে বেরিয়ে পরা। ট্রেনে ঝাড়গ্রাম আর সেখান থেকে বাসে করে বেলপাহাড়ি হয়ে ওদোলচুয়া তারপর প্রায় ১৫কিমি পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে মোরামের চড়াই উৎরাই রাস্তা ধরে হেঁটে পড়ন্ত বেলায় পৌঁছেছিলাম কাঁকড়াঝোড়। স্থানীয় লোকে বলেছিল উদুলচুয়া থেকে উপত্যকার মাঝখান দিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পায়ে চলা একটা শর্টকাট রাস্তা আছে কিন্তু জঙ্গলে পথ হারানোর ভয়ে আমরা পাহাড়ের গায়ে গায়ে অনেক লম্বা পথে চওড়া মোরামের রাস্তা নিয়েছিলাম। রাত কাটিয়েছিলাম গোপীনাথ মাহাতো নামে ওখানকার এক বড় সম্পন্ন চাষির বাড়িতে। তার বাড়ির একটু আগে পাহাড়ের উপর ছিল সাজানো ফরেস্ট বাংলো, শহুরে পর্যটকের জন্য, যেখানে কলকাতা থেকে অনেক টাকা দিয়ে বুকিং করতে হ’ত। সেই সময় ধারণাই ছিল না যে কাঁকড়াঝোড়ের পরেও জঙ্গলের ভিতর কোন গ্রাম আছে আমলাশোল বলে। এ’ত বছর পরে এসে দেখলাম সেই উপত্যকায় রাস্তা পিচের হয়েছে কাঁকড়াঝোড় পর্যন্ত, দিনে সেই রাস্তা দিয়ে নাকি একটা বাস চলে ঝাড়গ্রাম থেকে কাঁকড়াঝোড় পর্যন্ত। সেখান থেকে কিলোমিটার দুয়েক আমলাশোল পৌঁছানোর রাস্তা কাঁচা। সেই রাস্তা দিয়ে টাটা সুমোতে আমলাশোল আসতে কোন অসুবিধা হয়না।
অনেক বছর পরে এসে বুঝলাম জঙ্গল অনেক পাতলা হয়েছে, কিন্তু বেলপাহাড়ির পর থেকে এদিককার জঙ্গলের আদিবাসী গ্রামের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি, কেবল অভাব আর দারিদ্র্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে নকশাল আন্দোলন, আর সেই সুবাদে এই অঞ্চলে জায়গায় জায়গায় পুলিশ, বড় বড় আধাসামরিক বাহিনীর ক্যাম্প আর সশস্ত্র জোয়ানের উপস্থিতি। সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে ২০০৪ সালের আমলাশোলে অনাহার মৃত্যু আর নকশালদের কাঁকড়াঝোড়ের সেই ফরেস্ট বাংলো জ্বালানোর খবরে আমলাশোল/কাঁকড়াঝোড় বেশ নামকরা জায়গা হয়ে উঠেছে। ওদোলচুয়ার আগের আধাসামরিক বাহিনীর ক্যম্পের সামনে আবার আমাদের গাড়ি দাঁড় করিয়ে আর একবার জিজ্ঞাসাবাদ এবং শিলদার পুলিশের মতো এদের এখানেও এই স্কুল আর অরূপদার ব্যাপারে ভালো খবর আছে তাই কোন ঝামেলা ছাড়াই ছেড়ে দিয়েছিল। আমলাশোল ঢোকার আগে দেখলাম কাঁকড়াঝোড়ের জ্বলে যাওয়া ফরেস্ট বাংলো পরিণত হয়েছে আধাসামরিক বাহিনীর ক্যম্পে।
প্রথমে গিয়েছিলাম গ্রামে ঢোকার আগে ডান দিকের রাস্তায়, জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ি এবড়ো খবড়ো রাস্তা ধরে নতুনপাড়া হয়ে, কেন্দগোরা টোলার সেই স্কুলে একটা বড় পাহাড়ি নালা পেরিয়ে। জঙ্গলের মধ্যে একা বিকালের আলোয় দাঁড়িয়ে লম্বা খড়ের চালের একটা ঘর যার ছাদের অর্ধেক খড়ের আর বাকি অর্ধেক টিনের, ঘরের সামনে শালবল্লার খুঁটি দেওয়া মাটির বারান্দা। তার চারপাশে বাঁশের বেড়া। এই ঘরের মালিক দান করেছেন এই ঘর বাচ্চাদের স্কুলের জন্য। তার সামনেই একটা জায়গার সঙ্গে বেমানান পাকা চার কামরার আধ-তৈরি, একতলা বাড়ি, ছাদের ঢালাই হয়েছে, প্লাস্টার এখনো বাকি, জানলা কপাটের কোন খবর নেই। এখানকার স্থানীয় বিধায়কের বদান্যতায় তৈরি হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। নকশালদের ভয়ে সরকারি ঠিকাদার আসতে ভয় পায়, তবু পয়সার জন্য মাঝে মাঝে এসে মিস্ত্রি আর কাজের লোক নিয়ে কিছু কাজ করে যায়।
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যার মুখে আমরা পৌঁছেছিলাম ‘সবার ঘরে’। একটা বড় পাকা দেওয়ালের ঘর, ছাদ টিনের, এক দিকের দেওয়াল একটু ভাঙা মতো, রাতে ওখানেই থাকার ব্যবস্থা। আমরা স্কুলে পৌঁছানোর পর থেকে বিভূতি, লক্ষ্মী, জগদীশেরা ছয় সাতজন, এক এক করে হাজির হয়েছে গ্রামের নানা টোলা থেকে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে শীত বাড়ছে, সবার ঘরের মেঝেতে খড় পাতা হয়েছে তার উপর শতরঞ্চি আর গায়ে দেবার জন্য কতকগুলো কম্বল, আমরা চার জন আর গ্রামের জনা-চারেক থাকবেন আমাদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে অরূপদা স্কুল নিয়ে আলোচনা করছেন। রাত্রে খাওয়ার জন্য আনা হলো মুড়ি পেঁয়াজ আর চানাচুর। অরূপদা বলছিলেন এখানে উনি খুব কম দিনই রাত কাটিয়েছেন কারণ এই গ্রামে কোন পাকা স্যানিটারি ল্যাট্রিন নেই আর অরূপদা মাঠে প্রাতঃকর্ম করতে অভ্যস্ত নন যা এখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। উনি একবার দেখেছিলেন দুটি ছোট বাচ্চা সরু নালায় জমে থাকা ঘোলা জল পান করছে, ওনার কাছে যা ছিল অবিশ্বাস্য, বুঝতে পারি এই ঘটনা ওনার মনে গভীর দাগ কাটে। এখনকার বেশিরভাগ মানুষের পরিষ্কার পানীয় জলেরই ব্যবস্থা নেই। কিছু পাড়ায় পানীয় জলের প্রয়োজন মেটে হাতে গোনা দু-একটা কুয়ো থেকে। অনেকেই মাঠে বয়ে যাওয়া নালার জল খায় যখন নালায় জল থাকে। অভাব যেখানে নিত্যসঙ্গী, প্রতিদিন ভাত খাওয়া যেখানে বিলাসিতা মনে হয়, সেখানে বাঁধানো স্যানিটারি ল্যাট্রিন এক অলীক কল্পনা। ওখানে শুনছিলাম যে ২০০৪-এ শবর পাড়ার দুইজন শবর মানুষের অনাহারে মৃত্যু এই অঞ্চলে কোন নতুন ঘটনা ছিল না। শবরদের জীবন এবং জীবিকা এই জঙ্গল ঘিরেই। আর যখন থেকে সরকার ওদের জঙ্গলের অধিকার কেড়েছে ওদের খাবারের অভাব বেড়েছে। কিন্তু সেই বিশেষ দিনে কোন সংবাদপত্রের সাংবাদিক এই খবর পেয়ে বিষয়টিকে শহরের মানুষের কাছে - মানে যাকে আমরা বলি মেইনস্ট্রীম - নিয়ে আসে খবরের মাধ্যমে, তারপরই প্রশাসন জেগে ওঠে, শুরু হয় রাজনীতি এবং অনেক অনেক লেখালেখি।
আমি সেই গভীর অন্ধকারে দেখছিলাম দুই সম্পূর্ণ আলাদা জগতকে; একদিকে প্রাচুর্য আর সম্পন্নতার আধুনিক শহুরে সভ্যতা অন্যদিকে জঙ্গলে ঘেরা দারিদ্র্য আর অভাবক্লিস্ট প্রাচীন আদিবাসী গ্রামীণ সমাজ। একদিকে রাতের ঘন কালো আকাশে ছায়াপথে ধুলোর মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য তারা আর নীচের বিস্তীর্ণ বনানীর ভিতর ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট আদিবাসী গ্রাম। যারা এই জঙ্গলের ভিতর শত শত বছর স্বাধীনভাবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল আজ তারা নগর সভ্যতার উপনিবেশে পরিণত হয়ে তাদের বদান্যতার অপেক্ষায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
দুই
ওদোলচুয়ার পর থেকেই ক্রমাগত দেখা যায় শালবন ঝোপঝাড় উঁচু নিচু রাস্তা, পথে পড়ে দু-একটা নালা আর জঙ্গলের মাঝে মাঝে ছড়িয়ে থাকা দু-একটা টোলা, এদিকের বেশিরভাগই সাঁওতাল গ্রাম। মাটির বাড়ির লম্বা বাইরের দেওয়াল সুন্দর করে নিকানো। তার গায়ে আঁকা জ্যামিতিক বিন্যাসে সুন্দর রঙিন নকশা। কতদিন দেখেছি ফ্রক পরা সাঁওতাল কিশোরী কাদা হাতে দেওয়াল ঘসে চলেছে, তৈরি করছে মাটির ক্যানভাস, এর উপর ফুটে উঠবে সুন্দর রঙিন ফুল লতা পাতা। এই রাস্তায় কতবার দেখেছি বয়স্ক মানুষ বা সাঁওতাল বউ বাবুই ঘাসের দড়ি পাকিয়ে চলেছে এক মনে। বুড়িঝোর, কদমডিহা পেরিয়ে মকড়ভুলার পর দুইদিকের পাহাড়ের চাপে সরু হয়ে যায় উপত্যকা, রাস্তা পাহাড়ের গায়ে উঠে সাত বাঁকির জঙ্গল ধরে একটা নালা পেরিয়ে কাঁকড়াঝোড়ের দিকে এগিয়ে যায়। পুরো যাত্রাপথে এই জায়গা আমার খুব প্রিয়। একই জঙ্গলকে এখানে কত রূপে যে দেখেছি তা বোধহয় বলে শেষ করা যাবে না। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রবল রোদে ঝলসানো, ধুসর ক্লান্ত, ধুঁকতে থাকা বৃদ্ধ জঙ্গল, বর্ষায় জলে ভেজা সদ্যস্নাত উজ্জ্বল সবুজ শাড়ি পড়া সুন্দরী যুবতীর চেহারা নেয়, আবার মাঘের শীতে সেই জঙ্গলই পাতা ঝরার পর রুক্ষ শুষ্ক একাকী ত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকে বসন্তের রঙিন ফুল আর পাতার অপেক্ষায়। বসন্তে এই জঙ্গলই নতুন হলদে লাল সবুজ পাতায় সদ্য যুবার চেহারা ধারণ করে। ফাগুন চৈত্রে শাল গাছে ফুল আসে, আদিবাসী গ্রামে গ্রামে সেই শাল গাছের পুজোর উৎসব, শারুল।
সেই যে আসা শুরু হ’ল তা এখনো চলছে। লক্ষ্মী, বিরসা, বিভূতি, বাসন্তী, সাবিত্রী, কমল, সতীশবাবু, দুলালী, মিহির, সরস্বতি, মুখী, সোমবারি, রঞ্জিত, আরো আরো কতজন কখন আমার জীবনে ঢুকে গেছে কে জানে। আমিও ওখানকার কোন কাজ না করেও মাঝে মাঝে অরূপদার সঙ্গে জুটে যাই আমলাশোল যাত্রায় ঐসব পাহাড় জঙ্গলে আর শিলদার মোড়ের কিছু দোকানের মিষ্টি আর তেলেভাজার লোভে। এর মধ্যে ২০১১’র শেষ দিকে আমলাশোলের ৩০-৪০ কিমি দূরে কুশবনির জঙ্গলে কিসানজীর এনকাউন্টারে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এদিকের নকশাল আন্দোলনে ভাঁটা পড়েছে। জঙ্গলের দখল নকশালদের থেকে চলে গিয়েছে আধাসামরিক বাহিনীর হাতে। প্রথমের দিকে ট্রেনে করে ঝাড়গ্রাম গিয়ে ওখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া হতো আমলাশোল। থাকার জায়গা আর টয়লেটের অভাবের জন্য রাত কাটানো হতো ঝাড়গ্রামের কোন ছোট হোটেলে। নকশাল আন্দোলনের জন্য সরকারের নজর পড়েছে এইসব জঙ্গলমহলের আদিবাসী গ্রামের মানুষের অভাবের দিকে। সেই অর্ধেক তৈরি স্কুল ২০১১-তেই সম্পূর্ণ হয়, তার উঁচু সিমেন্টের বারন্দায় কচি কাঁচাদের কিচির মিচির। সামনের মাটির ঘরগুলোকেও সারানো হয়েছে। সেখানে একটা ঘর ক্রেশ; যেসব বাচ্চাদের মায়েরা জঙ্গলে বা মাঠে রোজগারের জন্য যায় তাদের একদম খুদে বাচ্চাদের খেলার জায়গা; তারা বড় হতে থাকে এই স্কুলের পড়াশোনার পরিবেশে, আর একটা ঘর ভাঁড়ার হিসাবে ব্যবহার হয়, সেখানকার মাটির দাওয়ায় স্কুলের বাচ্চারা হাত আর থালা ধুয়ে দুপুরের খাবার খায়।
এরই মধ্যে কোন এক বসন্তের সকালে আমালাশোলের সকলের লক্ষ্মী মানে লক্ষ্মীকান্ত মুড়া আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উপত্যকার অনেকটা দেখায়। আমলাশোল দলমা পাহাড়ের পুব দিকে পাহাড়ের উপর এক উপত্যকা আর এর ঠিক মাঝখানে, জঙ্গল আর পাহাড় থেকে নামা উত্তর পশ্চিমের দুটো নালা এসে মিশেছে, তারপর সেই নালা দক্ষিণ পূর্ব দিকে বয়ে কাঁকড়াঝোড়ের পশ্চিমের মাঠ হয়ে ঝাড়খণ্ডের খরসোতি নদীতে পড়েছে। তারপর খরসোতি হুলুং পেরিয়ে ঘাটশিলার পুবে সুবর্ণরেখায় মিশেছে। এই দুই মিলিত নালার ধারাই যমজ গ্রাম-দুটোর জীবনরেখা। বর্ষায় প্রচুর জল পাহাড়ের উপরের উপত্যকার এই নালা বয়ে পৌঁছায় সুবর্ণরেখায়। এই উপত্যকায় পুকুর খুবই কম দেখেছিলাম, একটা সরকারি বাঁধ রয়েছে নামো পাড়ায় যেখানে পাহাড়ের জল জমে। এছাড়া এখানে জল সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেই, চাষে সেচের জলের তীব্র অভাব, গ্রামে মানুষের জলকষ্ট। লক্ষ্মী বলেছিল আশ্বিন কার্তিক মাস থেকেই এখানে শুরু হয় জলের অভাব আর জৈষ্ঠ্যে জলের হাহাকার। আগে ঘন জঙ্গল মাটির নীচের জলকে ধরে রাখত কিন্তু জঙ্গল পাতলা হবার ফলে মাটির নিচের জল ধারণ ক্ষমতা অনেক কমেছে। জল নেই বলে চাষ ভাল হয় না তাই লোকে আরো জঙ্গল কাটে আরো জল কমে আর অভাব আরো বাড়ে। জলই এইসব অঞ্চলের গ্রামের জীবন ও অর্থনীতিকে ধরে রাখে।
জঙ্গলঢাকা দলমা পাহাড়ের গুরুত্বপূর্ণ বাসিন্দা হাতিদের আসা যাওয়ার পথ এই যমজ গ্রামদুটো। উপত্যকার মাঝবরাবর নালার পাশে চাষের জমি। জমি ঘিরেই উঁচু পাহাড়ের কোল ঘেঁসে গ্রামের পাড়া বা টোলা, বসতির পিছনে পাহাড়-জঙ্গল। ধান পাকলে হাতিদের উপদ্রব বাড়ে। মহুয়া বা শাল গাছে মাচা বেঁধে রাত-পাহারা। হাতির দল ঢুকলে টিন পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে ধান বাঁচানোর চেষ্টা। আমঝর্না একটু উঁচুতে, উত্তর পশ্চিমের লাখাইশিনি পাহাড়ের কোল ঘেঁসে। ঝাড়গ্রাম জেলার শেষ গ্রাম আবার পশ্চিমবঙ্গেরও শেষ গ্রাম। এর পরের জায়গাটাকে ত্রিসীমানা বলে; একদিকে পুরুলিয়া আর অন্যদিকে ঝাড়খণ্ডের পূর্ব-সিংভুম জেলা। ওদোলচুয়া থেকে আসার পথে বেশ কয়েক জায়গায় কাঁচা রাস্তার মাথায় গাছের গায়ে বোর্ডে তীরচিহ্ন দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে ঝাড়খণ্ড লেখা দেখেছি কয়েক জায়গায়। শুনেছি এখান থেকে ঘাটশিলা মাত্র ২৫ কিমি কিন্তু রাস্তা ভালো নয় বলে আমাদের ঝাড়গ্রাম হয়ে আসতে হয়।
আমরা এলে স্কুলের মাস্টারমশাই লক্ষ্মী, বিভূতি, রঞ্জিতদের ব্যস্ত আনাগোনা, বাসন্তী দিদিমণির ক্লাস ফেলে হাসিমুখে এগিয়ে আসা, জয়ন্তী, সরস্বতীর দুপুরের খাবার তৈরির আয়োজন, ওরই ফাঁকে কখন লাল চা চলে আসে। এই কয়েক বছরে স্কুল শুধু বাইরের চেহারায় নয় এখনকার বাচ্চাদের জীবনযাত্রার মানেরও পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করেছে। স্কুলের কোন ছেলেই চটি ছাড়া খালি পায়ে হাঁটে না। বইয়ের সাথে সাথে পোশাক ও চটির ব্যবস্থা হয়েছে। প্রথম প্রথম প্রায় ২৫-৩০ জন বাচ্চা ছিল, পরে তা বেড়ে হয়েছে ৬০-৬৫। আমি অবাক হয়ে দেখি, ছোট ছোট বাচ্চারা ক্লাসে ঢোকার আগে সুন্দর করে সাজিয়ে স্কুলের সিঁড়ির নিচে চটি খোলে, দুপুরের খাবার ঘণ্টা বাজলে আবার সুন্দর সারিবদ্ধ হয়ে হাত আর থালা ধুয়ে খেতে বসে। দুপুরের ছেলেদের খাওয়ার ব্যবস্থা এখানেই, আগে এর পুরো ব্যবস্থা অরূপদাকেই করতে হ’ত। এখন সরকার খাবার চাল দেয় কিন্তু উনি তার সাথে বাচ্চাদের পুষ্টির জন্য ডাল এবং সয়াবিন, রাজমা, ডিম আর কোন কোন দিন মাছেরও ব্যবস্থা করেছেন, গ্রামের শাক সবজিও কেনা হয়। স্কুল লাগোয়া জমির বেগুন বা অন্য সবজিও চলে আসে কখনো কখনো। অরূপদার তীক্ষ্ণদৃষ্টি বাচ্চাদের স্বাস্থ্য এবং পরিচ্ছন্নতায়। পরিচ্ছন্নতার অভাবে এদিকে বাচ্চাদের খুব চামড়ার রোগ হ’ত এখন প্রায়শই সরকারি বেসরকারি মেডিকেল ক্যাম্প হয়। এছাড়া অরূপদাও বিভিন্ন সময়ে কলকাতা থেকে বন্ধু ডাক্তারদের নিয়ে আসেন। ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য সচেতনতা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামের বাচ্চাদের, বড়দেরও।
চারিদিকে বড় বড় গাছ, শাল-মহুয়ার জঙ্গল, ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু-একটা শিমুল বা অন্য কোনও গাছ। এরই মাঝে বাচ্চাদের আওয়াজ আর মাঝে মাঝে মাস্টারমশাইদের ভালবাসার ধমকানি। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনও চলে নিজস্ব গতিতে, অহেতুক কোনো তাড়া নেই। অরূপদা ব্যস্ত কখনও মাস্টারমশাইদের নিয়ে কখনওবা কচি কাঁচাদের লেখাপড়ার ছোট ছোট সমস্যা নিয়ে। এসবের মাঝে আমি কাউকে পাকড়ে স্কুলের কাঁচা আর পাকা ঘরের সামনে ছেলেদের খেলার জায়গায় ছোট একটা আমগাছের নীচে গল্প করি। বেশিরভাগ গল্পই, আমলাশোলের চাষবাস আর জীবন নিয়ে। বসার জায়গাটাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমলাশোলের জীবনের মতোই বদলেছে। প্রথম যখন আসি এখানে বসার কোন ব্যবস্থা ছিল না, গাছটাও ছিল ছোট। দু-এক বছর পর ওই গাছের নীচে কাঠের পাটা দিয়ে চৌকো টেবিলের মতো মাচা বানানো হয়ছিল। মাচা ঘিরে বাঁশের বাতা দিয়ে চারদিকে সুন্দর বেঞ্চ। জনা বারো চোদ্দ লোক আরামে বসতে পারে। গাছটা বেড়ে ওঠার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বসার জায়গাটাও বড় হয়ে গেল। স্কুলেই খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হওয়ায় শুরুর রাতের মুড়ি কখন ভাতে উঠে এল, খিদে পেটে কাঁচা ধোয়া-শালপাতার ওপর গরম ভাতের ধোঁয়া আর গন্ধ নিয়ে এক অলস আকর্ষণ। স্কুলের শেষে দেখি বাসন্তী দিদিমণি কোলে ছোট্ট মেয়ে জননীকে নিয়ে বাড়ি ফেরার আয়োজন করছে।
যমজ এই গ্রামে মোট ১২৫ ঘর মানুষের বাস। আমঝর্নায় মাত্র ২৫ ঘর মুণ্ডা ও ভুমিজ পরিবার। আমলাশোলে কম বেশি এক’শ ঘর মানুষ উপত্যকা ঘিরে পাঁচটা টোলায় ছড়িয়ে আছে। এখানকার বেশির ভাগ মানুষই মুণ্ডা বা ভুমিজ। এছাড়া দুটো পাড়ায় প্রায় ২০ ঘর শবর, দুই তিন ঘর বৈষ্ণব আর মাহাতো আর এক ঘর কর্মকার। এদের ছেলে মেয়েরাই আসে এই স্কুলে পড়তে। আমলাশোল আমঝর্নার রাস্তার পাশে একটা পাকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ১০-১৫ টি বাচ্ছা ওখানে পড়ে, সরকারি মাস্টারমশাই অনেক দিনই আসেন না কাজেই স্কুলের সরকারি খরচ চলতে থাকে, ছাত্র থাকে না।
অরূপদা বলেছিলেন, উনি যখন প্রথম আসেন তখন থেকেই দেখেন মুণ্ডারা, শবরদের নিচু জাতি বলে মনে করে। এমনকি তখন নাকি তাদের ছোঁয়াও খেতো না, শুনে অবাক হয়েছিলাম, এখনও মুণ্ডাদের চোখে শবররা একটু নিচুই। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, প্রত্যন্তের আদিবাসী গ্রামেও নিজেদের মধ্যে সেই জাতপাত, ছোঁয়াছুয়ির দূরত্ব। আমার দেশের একি দুরারোগ্য সামাজিক ব্যাধি! এর থেকে কি আমাদের কোথাও মুক্তি নেই? এই স্কুলের মধ্যে দিয়ে অরূপদা এই জাতিভেদের তফাতটা কিছুটা দূর করেছেন, শবরদের সঙ্গে সহজ মেলামেশা আর ওঠাবসায়, মুণ্ডাদের শবরদের সঙ্গে মেলামেশাকে অনেক সহজ করে দিয়েছেন, ছ্যুৎমার্গ অনেকটাই কমেছে । এখন এই স্কুলে মুণ্ডা বাচ্চারা শবর বাচ্চাদের সঙ্গে সহজেই খেলে, একসঙ্গেই খাওয়া দাওয়া করে।
দু’হাজার এগারোর শেষের দিকে আমি প্রথম দেখি ইন্দ্র শবরকে। বড় কাঠামোর মানুষ, গায়ের রং রোদে পুড়ে কালো, এলোমেলো চুল, সামনের দুটো দাঁত ভাঙা। ছেঁড়া জামাকাপড়ের সঙ্গে সারা দেহে লেপ্টে রয়েছে অভাব আর দারিদ্র্য। অকালেই বুড়িয়ে যাওয়া নেশাকরা মুখে হাসি আর রাগ দুটোই। অল্প দূরেই স্কুলের পশ্চিম দিকে জঙ্গলের মধ্যে শবর পাড়ায় ইন্দ্রর বাড়ি। তিনটে নাগাদ স্কুল শেষের সময় যখন বড় গাছের ছায়ারা লম্বা হচ্ছে, সে হাজির হয়েছিল, সঙ্গে শতছিন্ন শাড়ি পরা স্ত্রী বুধনি, কোলে দুর্বল দুই তিন বছরের একটি বাচ্ছা, দেখলেই বোঝা যায় অপুষ্টিতে ভুগছে। রোগা দুর্বল বুধনির গায়ে জড়ানো একটা পরিষ্কার গোলাপি ফুল তোলা কম্বল, অরূপদা শহর থেকে যে সব শীতের জামা কাপড় এনেছিলেন হয়ত তারই একটা। কারুরই গায়ে মাথায় তেল নেই, স্বামী-স্ত্রী এসে অরূপদার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। অরূপদা মন দিয়ে ওদের কথা শুনে হাসি মুখে কিছুর আশ্বাস দিলেন। এরপর ধামসা-মাদলের সঙ্গে স্কুলের বাচ্ছাদের নাচ গান শুরু হোল, ইন্দ্র বাজাচ্ছিল ধামসা, স্ত্রী বুধনি হাসি মুখে অন্য মেয়েদের সঙ্গে একে অপরকে ধরে সেই পড়ন্ত আলোয় মুণ্ডারি গান গাইতে গাইতে ঘুরে ঘুরে নাচছিল। সেই আনন্দ উৎসবে চোখে পড়েনি শবর বাচ্চাদের সঙ্গে মুণ্ডা বাচ্চাদের হাসির কোন তফাৎ। শেষ বিকালের রোদে সেই আনন্দের গান আর নাচ ধামসা মাদলের তালে তালে জঙ্গলের ভিতর ছড়িয়ে পড়তে থাকে ।
এই সময় আমাদের বন্ধু সোমনাথ অরুপদার কাজে হাত বাড়িয়ে এসেছিল আমেরিকা থেকে; ২০১৫ নাগাদ। সেই সময় সে একদিন গল্প করতে ইন্দ্রর বাড়ি যায়। সেদিন ওরা খাবে বলে জঙ্গল থেকে মাটি খুড়ে তুলে এনেছিল একটা বড় ওলের মতো কন্দ। ইন্দ্র, বুধনি আর তার ছোট ছোট ছেলেরা সেই বড় ওলকে নুন দিয়ে সিদ্ধ করে খাবার আয়োজন করছিল তখন। ওরা হাসিমুখে ওদের সঙ্গে সোমনাথকেও সেই খাবার এগিয়ে দেয়, সোমনাথের ভালো লেগেছে শুনে ইন্দ্র রেখে দেওয়া বাকি ওল সোমনাথকে নিয়ে যাবার অনুরোধ করতে থাকে। যারা কাল কি খাবে জানেনা ওই বাকি ওলে হয়ত তাদের কাল চলে যাবে কিন্তু ওরা হাসিমুখে সেটাই বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওর চর্চিত সভ্যতার সংস্কৃতিতে এই তুচ্ছ সঞ্চয়ের থেকে অতিথির তৃপ্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিগত দশ বছরে আমি বহু বার আমলাশোলে এসেছি, কিন্তু কোন জিনিষ টাকা, পয়সা, চুরির কথা শুনিনি, ঘরের দরজা খোলা থাকলেও কেউ ভাবেও না অন্যের জিনিস নিয়ে নেওয়ার কথা। এ এক অন্য সভ্যতা অন্য জগত।
শুনেছিলাম বেশিরভাগ শবরদের মতোই তারও জমি খুব কম, চাষবাসের প্রতি কোন আকর্ষণ নেই, বহু পুরুষ ধরে জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল শবরদের এখন আর কোন অধিকার নেই জঙ্গলে। জঙ্গল এখন সরকারের আর সরকার কখনো শবরদের নয়। এখন সেই ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু জঙ্গল থেকে জংলি কন্দ শিকড় এসবের উপর নির্ভর করে চলে, কখনো মাঠের কাজেও যায় আর অল্প একটু টাকা পেলেই মহুয়ার নেশা। প্রথমে ভেবেছিলাম এতো বয়স্ক মানুষ তার এতো ছোট বাচ্ছা, পরে অরূপদার কাছে ২০০৬-০৭ সালের তোলা এক মাথা কোঁকড়ানো কালো চুল, সবল পেশিবহুল চেহারার ছাব্বিশ সাতাশ বছরের এক যুবকের খালি গায়ে হাসিমুখে বসে থাকার ছবি দেখি। অরূপদা বলেছিলেন ‘এটা ইন্দ্র’। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে পাঁচ ছয় বছরের সময়ের ব্যবধানে কোন মানুষের এরকম পাঁচ গুন বয়স বেড়ে যেতে পারে। আমার কাছে যতই অবিশ্বাস্য লাগুক এটাই তো সত্যি, কলকাতায় যখন দেখি ষাট বছরের মানুষ যুবক থাকার তাগিদে মুখে বয়সের বলিরেখা ঢাকতে দামী ক্রিম মাখছে তখন ইন্দ্রদের এক এক বছরে এক দশক করে বয়স বাড়ছে।
শবররা চিরকালই জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল কিন্তু মুণ্ডারা বহুদিন ধরেই ছোটনাগপুরের পাহাড় জঙ্গল ঘেরা এরকম উপত্যকার জমিতে চাষবাসে অভ্যস্ত। কিন্তু এই দুই জনগোষ্ঠীই বিগত দুশো বছর ধরে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে এক সর্বগ্রাসী আধুনিক সমাজ ব্যবস্থাকে, যার নাম সভ্যতা। আমাদের সেই সভ্যতার প্রবল প্রতাপে জঙ্গল শেষ হয়ে গেছে, ইন্দ্র শবরেরা হেরে গেছে, তারা চায়নি মানিয়ে নিতে, কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের সহজ জীবন আর জীবিকা।
তিন
ফাগুনের রাত, বাতাস বেশ গরম, আমালাশোলে আমাদের থাকার ঘরের বাইরে খটিয়ায় বসে বসে দেখছি পাহাড়ের উপর আঁকাবাঁকা হলুদ আগুন, জঙ্গলে আগুন দেওয়া হয়েছে ঝোপ ঝাড় জ্বলছে, মহুয়ার ফুল কুড়নোর প্রস্তুতি। আগুন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠছে দেরি করে, মাথার উপরের লম্বা বড় গাছটার পাতা হাওয়ায় নাকি ভয়ে কাঁপছে, কে জানে। বসে বসে সাক্ষী হই, লাখাইশনির খাণ্ডবদহনে।
রাস্তার ওপাশে অন্ধকারে উঁচু করে রাখা আছে সতীশবাবুর শুকনো বাবুই ঘাসের পালুই। বাড়ির বাইরের ইলেকট্রিক বাল্বের আলোটা বড় অস্বস্তিকর। একটু পরেই দুলালী খেতে দেবে, যত্ন করে রুটি তরকারি। নতুন পাড়ায় রাস্তার ধারে আমাদের আমলাশোলের নতুন মাটির বাড়ি, টালি দিয়ে ছাওয়া, দুদিকে বারান্দা। ঘরের মাঝে এক টুকরো চৌকো চাতাল থেকে দেখা যায় এক টুকরো আকাশ। এখন গাছের ফাঁকে চাঁদ দেখা যাবে ঘরের দাওয়া থেকে। সেই প্রথম আসা থেকে এখন আমাদের থাকা আর খাওয়া অনেক বদলে গেছে, কিন্তু বছর বছর জঙ্গল এখনো জ্বলে। সকালে দেখবো বড় বড় গাছ দাঁড়িয়ে আছে গায়ে পোড়া দাগ আর নীচের পুড়ে যাওয়া ঝোপঝাড়ের পোড়া ছাই আর আর কিছু না নিবে যাওয়া আগুন থেকে বেরোনো ধোঁয়া। মেয়েরা কোমরে ঝুড়ি নিয়ে পাহাড়ি পথে জঙ্গলে, মহুয়া কুড়োতে।
অনেক শীত গ্রীষ্ম আর বর্ষার মধ্যে দিয়ে আমলাশোলও অনেক বদলে গেছে। এরই মধ্যে আমিও কখনো কখনো অস্তিন গুটিয়ে নেমে পড়ি বিভূতি, বিরশা, কমলদের সঙ্গে আমলাশোলের জল জমি আর চাষের কাজে আমার সীমিত জ্ঞানগম্যি নিয়ে। আমলাশোলের প্রথম ল্যাট্রিন তৈরি হয় স্কুলে, বেশ কয়েক বছর আগে, এখন আমাদের মাটির ঘর হলেও কমোড দেওয়া বাথরুমে কল খুললেই জল। সরকারি উদ্যোগে এখন সব পাড়াতেই খাবার জলের টিউবয়েল না হলে উপরের ট্যাঙ্ক থেকে পাইপের জল। গ্রামে বছর কয়েক হ’ল ইলেকট্রিক এসে গেছে। সরকারি চেষ্টায় রাস্তার অবস্থাও অনেক ভালো এখন আর ঝাড়গ্রাম থেকে গাড়ি নিয়ে আসতে হয় না, ঘাটশিলা থেকে সহজেই সোজা পাকা রাস্তা দিয়ে হুলুং পেরিয়ে ঘটিডুবা হয়ে আমলাশোলের বীরসা চকের বাঁধানো রাস্তায় ওঠা যায়। দেখতে দেখতে গ্রামে এখন অনেক পুকুর, জলের অভাব অনেক কম। অনেক ঘরে এখন মোটর সাইকেল কিছু কিছু ঘরে ডিশ এন্টেনা লাগানো টেলিভিশন। আমার দেখা ২০১০-এর আমলাশোল গ্রাম আর এখানকার মানুষ অনেক বদলেছে।
বছর সাতেক আগে এক ভাদ্রে সবার ঘরের উল্টো দিকে সবুজ ধানগাছে ভরা বড় মাঠে দেখেছিলাম, উমাপদ আর তার স্ত্রী হাতে-ঠেলা মেশিনে সযত্নে তাদের ধানের খেতের আগাছা নিড়েন করতে। পুরো উপত্যকা জুড়ে সবুজের বন্যা, সবুজ জঙ্গল থেকে বয়ে আসা হাওয়ায় লকলকে ধানগাছ খেলে বেড়াচ্ছে মাঠ জুড়ে। এর এক দুই বছর আগে আমলাশোলে Systematic Rice Intensification (SRI) পদ্ধতিতে চাষের চেষ্টা শুরু হয়েছে। এই ধান চাষের পদ্ধতি এতদিনের প্রচলিত পদ্ধতির থেকে আলাদা তাই প্রথম প্রথম এখানকার আদিবাসী চাষিদের মধ্যে প্রচুর সন্দেহ ছিল। কিন্তু এই স্বামী স্ত্রী সাহস করে এগিয়ে এসেছিল, যত্ন করে চাষ করে প্রচুর ফসল ফলায়। এদের সঙ্গে দেখেছি বিভুতির ভাই রোগা পাতলা কমলকে, সব সময় তার মুখে হাসি। সে মাঠ ভালোবাসে, চাষ ভালোবাসে, সেও এগিয়ে আসে বিভূতির সাথে নতুন চাষের পদ্ধতিতে। এখানে চাষে এরাই বিপ্লব নিয়ে আসে, তাদের ধান চাষের সুফল দেখে এখানকার অন্য চাষিরাও চাষের পদ্ধতি বদলাতে শুরু করেছে। এই সময়ে একবার শীতের শেষে একদিন স্কুলে আম গাছের নীচে বসে আছি, হাসিমুখে লজ্জা লজ্জা করে বিভুতি বলেছিল আমি এইবার তিরিশ হাজার টাকার ধান বিক্রি করেছি, এ আমার বাপ ঠাকুরদাও কখনো ভাবতে পারবে না।
এখন স্কুলের সঙ্গে চলে গ্রামের গরীব ছেলে মেয়েদের এক হোস্টেল, সেখানে তারা পড়ার সাথে সাথে গান বাজনা হাতের কাজও করে। মিহিররা স্বামী-স্ত্রী মিলে হস্টেলের বাচ্চাদের দেখাশোনার সাথে সাথে পাশের জমিতে খুব ভালো সবজি চাষ করে। এই রকমই কোন এক সময় স্কুলে দেখেছিলাম আট বছরের শান্ত পাতলা তনূ শবরকে কোলে ছোট বোনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। সে তার ছোট দুই বোনকে নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আসত পিছনের শবরপাড়া থেকে, বাবা লুলু শবর খুঁড়িয়ে হাঁটত আর তনুর মা মারা যাবার পর বেশিরভাগ সময় মদ খেয়ে পড়ে থাকে, কোন কাজ নেই। কাজেই তিন বোনের যার মধ্যে এক কোলের বোন, সবার দায়িত্ব তনুর উপর। অরূপদা কয়েকদিন দেখেন দুপরের খাওয়ার আগে তনূ স্কুলের একটু দুরে কোন একজন গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলছে আর তারপর কিছু নেয়। কৌতূহলের ব্যাপার, এমনিতে চুপচাপ ছোট ছেলে কি কথা বলে দুপুরে ওই মানুষের সঙ্গে। অরূপদা জিজ্ঞাসা করায় প্রথমে চুপ করে থাকে তারপর বলে যে সে সকালে কাঠ কেটে রেখে দিয়ে আসে, সেই কাঠ লোক এসে নিয়ে যায় আর পরে এসে সেই টাকার চাল জিনিস দিয়ে যায় যা দিয়ে তনূর পরিবার চলে। একই দেশে বড় শহরে যখন কুড়ি বছরের যুবক ‘বাবুসোনা’ তখন সেই দেশে আট বছরের তনূ শবর সংসার সামলে প্রাথমিক স্কুলে যাচ্ছে।
অরূপদা প্রথমে জোর দেন বাচ্চাদের স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা আর পুষ্টির উপর, কিন্তু এই অভাবের দেশে পুষ্টি কোথায়? বুঝতেন যে বই পড়া শিক্ষার আগে দরকার ভাত তাই নানাভাবে চেষ্টা করতেন যাতে এখনকার লোকের জীবিকার উন্নতি হয়। ওনার সারা জীবন শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্ক, চাষবাস আর গ্রামের জীবিকার ব্যাপারে ওনার ধারণা খুব কম। তাই এই সব বিষয়ের নানা মানুষকে ধরে ধরে আনতেন যাতে এখনকার মানুষের রোজগার বাড়ে। কিন্তু জঙ্গল কমার সাথে পাহাড়ের উপরের এই গ্রামে কমেছে জল, সেই নালায় বর্ষার মাস তিনেক জল থাকলেও মাঘ ফাগুনে নালা শুকিয়ে যায়, আর জলের ব্যবস্থা না হলে, চাষ নির্ভর হয়ে পড়ে অনিশ্চিত বৃষ্টিপাতের উপর। কাজেই ধীরে ধীরে ওনাকে ঘিরে বাইরের নানা মানুষের ও প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে গ্রামের মানুষ চেষ্টা করে পুকুর, বাগান আর ভালো চাষের। গ্রামের মানুষ পুকুরে মাছ ছাড়ে, ছেলেরা শিখেছে মোটর সাইকেল আর মোবাইল সারাতে, মেয়েরা শিখছে শেলাই, তারা গ্রামের আম আর অন্য সবজি দিয়ে বানাতে শিখেছে আচার। অনেক বাচ্চা এখন এই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরের স্কুলে পড়ে। এরই সঙ্গে পঞ্চায়েত ও সরকারি প্রকল্পের কল্যাণে আমলাশোলে আরো কিছু হয়, বর্তমানে অনেক পুকুর, গ্রামে তুলনামূলকভাবে জলের অভাব বেশ কম ।
অরূপদার এই আশ্চর্য চলার পথে যোগ দিয়েছেন তার ছোটবেলার বন্ধু অমিতদা আর শাশ্বতদা। এরা ছাড়াও তাঁর অনেক ছাত্র আর দেশে বিদেশের ভালোবাসার মানুষ নিজেদের অজান্তেই জড়িয়ে গেছেন, নানা ভাবে হাত বাড়িয়েছেন। ওনাকে ঘিরে সহমর্মিতার সাথে নীরব সহযোগিতা চলতে থাকে অনেক কাছের আর দুরের মানুষের। আস্তে আস্তে ওনাকে ঘিরে খুব স্বাভাবিক নিয়মেই এক প্রতিষ্ঠানের জন্ম নিয়েছে যার সাথে আমার মতো অনেক মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে গেছে। প্রথমদিন থেকেই দীপক বড়াপন্ডাও আছেন তাঁর এই কর্মযজ্ঞের সাথে। অভিজিতদা, বৌদি, শান্তনু এবং আরো কত মানুষ যে ক্রমাগত পথ চলেছেন তার সঙ্গে নানা সময়ে তার এই যাত্রায় তা বোধহয় বলে শেষ করা যাবে না। তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ঝাড়গ্রামের অরুণাভ আর তার বাড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানের ঝাড়গ্রামের অফিস। অরুণাভর মা গ্রামের কিশোরী ও সদ্যযুবতী মেয়েদের মধ্যে স্বাস্থসম্মত ভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যাবহারের কাজে এখনো সাহায্য করে চলেছেন। বন্ধু মনোজ স্কুলের বাচ্চা এবং মাষ্টারমশাইদের নিয়ে সিকিম, দীঘায় ঘোরাতে নিয়ে গেছে তাদের অন্য প্রকৃতির আস্বাদ দিতে। ফর্দের যেন শেষ নেই, না হওয়ারই কথা, কত জনের কথাই বা বলা যাবে এই ছোট পরিসরে।
সময়ের সাথে দুটো গ্রামের মুণ্ডা ভুমিজ পরিবারদের অভাব অনেকটা কমলেও শবরদের জীবনে পরিবর্তন খুব কমই এসেছে। ওদের চাষের জমি আগেও ছিল না সরকারি বদান্যতায় ঝোপঝাড় ঢাকা পাথুরে অল্প কিছু টাঁড় জমির পাট্টা পেয়েছে যাতে চাষের চেষ্টা করেও ভালো ফসলের আশা করা বৃথা। তবুও সরকারি সাহায্য, কখনো কখনো একশো দিনের কাজ আর সমাজসেবী কিছু প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে আর জঙ্গলের গাছ কাটার দৌলতে তাদের অবস্থা ২০১০’র থেকে তুলনামুলক ভালো। রাস্তা জল এবং বিদ্যুৎ এলেও কোন পরিবর্তন হয়নি গ্রামের শিক্ষার পরিকাঠামোর। কেন্দগোড়ার ঐ স্কুলে এবং আমলাশোলের সরকারি স্কুলে কেবল ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার ব্যবস্থা, তারপর কাঁকড়াঝোড়ের হাইস্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়া যায় আর দশ কিমি দুরে বুড়িঝোরের স্কুলই গ্রামের সব থেকে কাছের হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল। আসে পাশের পঁচিশ তিরিশ গ্রামের বাচ্ছাদের কাছের স্কুলের এটাই ব্যবস্থা, না হলে ছাব্বিশ কিমি দুরে বেলপাহাড়ি বা শিলদা। এইসব স্কুলে শিক্ষার মান নিয়ে যত কম বলা যায় তত ভালো। পুরো বিনপুর ২ ব্লকের শিক্ষার হাল একই রকম ভাবে খারাপ। শিক্ষা নিয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপনের বাজেটের ভগ্নাংশ খরচ করলেই এদিকে ভালো স্কুল তৈরি হয়ে যেত, অরূপদার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা তার জলন্ত সাক্ষী।
সময়ের সাথে সাথে হয়তো দারিদ্রের প্রকোপ কিছু কমেছে কিন্তু জঙ্গল পাতলা হয়েছে, ঘন জঙ্গলের বড় বড় গাছেরা আর তাদের নীচের ঝোপঝাড় আগে পাহাড়ের মাটিকে ধরে রাখত আর বর্ষার জল জমাতো মাটির নীচে। পাহাড়ের গায়ের ঝর্নায় সারা বছর জল থাকত। কিন্তু জঙ্গল কমার সাথে সাথে এইসব ঝর্নারা শুকিয়ে আসছে। জঙ্গলে ঢাকা দলমা পাহাড়ের ইকোলজি আজ ছোটনাগপুরের আর পাঁচটা জায়গার মতোই বিপন্ন। এর সঙ্গে এই সব জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল জন্তু, পাখী আর এখানকার আদিবাসী মানুষদের অস্তিত্বও বিপন্ন, যদিও আধুনিক সভ্যতার শিক্ষাহীন উন্নয়ন নামের এক ব্যবস্থায় এদের আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে বাঁধার চেষ্টা চলছে। আমলাশোলও তার ব্যতিক্রম নয় বরং এক বড় উদাহরণ। এখন ওরা ধীরে ধীরে শিখছে শহুরে মেকী সভ্যতাকে নকল করতে। সরকারি প্রকল্পের সাথে ধীরে ধীরে ভ্রষ্টাচারও ছড়িয়ে এখনকার সমাজ জীবনে। এই আপাত উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদী হবে কিনা তা ভবিষ্যতই বলবে।
এখনো প্রতি বছর নগর সভ্যতার চোখের অন্তরালে অনাহারে অপুষ্টিতে এই পাহাড় জঙ্গলের সব থেকে প্রান্তিক শবরেরা মারা যায় যেমন তনুর মা আর লুলু শবর চলে গেল চার অনাথ বাচ্ছাকে রেখে। বুধনীও মারা গেলো প্রবল দারিদ্র্য আর অপুষ্টিতে, ইন্দ্র সেই যে কাজের লোক যোগান দেওয়া ঠিকাদারের সাথে ব্যাঙ্গালোর না মাদ্রাজ কোথায় গেলো আর ফিরে এলো না। কারুর কিছু যায় আসেনি, এখানকার মানুষ মেনে নিয়েছে, আমরা মেনে নিয়েছি। এই স্কুল, হস্টেল আর অরূপদার জন্য ওদের দুই ছেলে অজয় আর তার ভাই আর তনুরা এখনো গ্রামে রয়ে গেছে, না হলে ওরাও কবেই হারিয়ে যেতো। এই সব গ্রাম নতুন ভারতের হিসাবের বাইরের গ্রাম, এইসব মানুষরা সভ্যতার হিসাবের বাইরের মানুষ, এদের জঙ্গল আর খনিজ, কয়লা, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ এইসবের প্রয়োজন আছে সভ্যতার। এইসব মানুষদের কোন প্রয়োজন নেই। তবুও এরা থেকে গেছে। তাই আমরা দয়া করি এদের, রেশনে সস্তা চাল, কিছু প্রকল্পের টিনের চালের পাঁচ ইঞ্চির গাঁথনির পাকা বাড়ি দিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত করি, আর ঝুঁকে পড়া এইসব মানুষের ভোটের লোভে নির্বাচনের আগে ঘুরতে থাকে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তৈরি মাফিয়া রাজনৈতিক দলেরা, যাদের উপর একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক ভারত দাঁড়িয়ে।