সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
সমাজ অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক
কালধ্বনি
In Search of a decent living
জীবনের অন্বেষণে
গাড়িটা বিদ্যুৎচালিত। কোনো আওয়াজ নেই। সাধারণ টোটো গাড়ির চেয়ে একটু বড় কী, দিয়ার তেমনই মনে হয়। এটা কী ব্যাটারিতে চলছে? দিয়ার প্রশ্নের উত্তরে গাড়ির চালক একটা ‘হুম’ শব্দ করে মুখে। ওর মুখাবরণী ভেদ করে সেই শব্দ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া কোনো শব্দ নেই। দিয়া ঘাড়টা একটু পেছনের দিকে হেলিয়ে বসে, চোখদুটো আধবোজা। ক্লান্ত লাগছে ওর, খুব অবসন্ন। কার কাছে হারল দিয়া? ওর নিজের কাছে? নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ ওর নিজের কাছে জোরালো ঠেকে!
এ সময় প্রাণীটা একটু নড়ে ওঠে। কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ও নিজের শরীরের ওমেই আরাম বোধ করছিল। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন আরামে বোধহয় ক্লান্তির প্ররোচনা থাকে! তাই নড়ে চড়ে নিজেকে সুসহ করে নেওয়া। দিয়া অবশ্য তাকায় না ওর দিকে। এ যেন নিজের সঙ্গে লড়াই! দেখব না ওকে, যতক্ষণ সম্ভব! ও ও তো দিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে নেই। ‘তুমি আছো, আমি আছি’ এই বিশ্বাসের চাদর ওদের দুজনের গায়েই লেপ্টে আছে, কুকুরটা তো সেই বিশ্বাসেই থিতু হয়ে আছে! দিয়ার চাদরের অংশটা জ্যালজ্যালে হয়ে এসেছে, দিয়া টের পায়! এখন প্রবল শীতবোধ হয় ওর!
ঠাণ্ডাটা সত্যি খুব জবর পড়েছে! কতটা জবর, দিয়া বাইরে না বেরোলে টের পেত না। ঘরের মধ্যে নানা উষ্ণতার আয়োজন যেমন আমদের উদাসীন করে রাখে শৈত্যের প্রবল থেকে, তেমন আর কী! কিন্তু শীতের কিছু স্বধর্ম থাকে, সে তো আবহাওয়া বিজ্ঞানের নানা কার্যকারণের ফলাফল মাত্র, উত্তুরে হাওয়ার কাঁধে চড়ে বসা তার নিয়তি নয়, স্বাধর্ম্য! দিয়ার পায়ের কাছে গুটিশুটি মেরে থাকা কুকুরটা এর সবটুকুই মেনে নিয়ে ওর বেঁচে থাকা জারি রাখে! কোন আদাড়ে বাদাড়ে জন্ম হয়েছিল ওর। রাস্তায় ফেলে দেওয়া খাবারের ভাগ নিয়ে রক্তারক্তি করা, লোমওঠা ঘেয়ো কুকুরটাই ওর গর্ভধারিণী। প্রকৃতিরই এরকম কোনো স্বাধর্ম্যে সেই ঘেয়োচর্মসার সারমেয় নিজের শরীরে আহ্বান করেছিল কোনো সারমেয়-পুরুষের বীজ! আশ্লেষে জিভ ঝুলে পড়েছিল! গর্ভসঞ্চারও হল একই নিয়মে। তারপর এক জল ঝড়ের রাতে, সজীব জংলার মাঝে, গুপ্ত হয়ে থাকা যে অন্ধকারে বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা জল আনত হয়ে পড়ে, তার আড়ালে, আদিম মাটিতে খালাস হল সে! সে এবং কয়েকজন। ওরা ওর সহোদর। এ ওর ঘাড়ে লিপ্ত হয়ে মায়ের স্তনের বোঁটা খুঁজে নিতে চাইত। উদাসীন জননীর মধ্যে আগামী দিনের খাবারের ভাগ বাঁটোয়ারা সংক্রান্ত কোনো দুরভিসন্ধি তখনও ওদের চোখে পড়েনি, কেন না চোখই ফোটেনি ওদের তখন!
তারপর যেমন হয়। জগতের সমস্ত প্রতিকূলতা, অসঙ্গতি, অন্যায় অথবা ব্যভিচারের বিরুদ্ধে ওই ছোট্ট, তুলতুলে শরীরের একেবারে ভেতর থেকে উঠে আসে শব্দ, তাকে কান্না বলা হয়। অশ্রু থাকে না তাতে, একটানা একটা আওয়াজ—ক্ষীণ, তীক্ষ্ণ! সুর্য-চন্দ্র উঠে পড়ে, বৃষ্টির দাগ শুকিয়ে আসে, এলোমেলো হাওয়া বয় কখনও, সেই শব্দটা ভেসে বেড়াতে থাকে দশদিক জুড়ে।
আলোড়ন তৈরি হয়। যে অস্বস্তি আমাদের বেঁচে থাকাকে এখনও নানাভাবে অর্থবহ করে রাখে, সেই অস্বস্তি বুড়বুড়ি কাটে। ইতিমধ্যে সহোদরগুলো অন্য কোনো উপায়হীন হয়ে মরে গেছে! মা-কুকুর পরবর্তী আশ্লেষের হাতছানিতে পুর্বকৃতির দায় ঝেড়ে ফেলেছে! এই সঙ্গতিহীন বাস্তবতার আবহ হয়ে ভেসে বেড়ায় সেই একটানা, তীক্ষ্ণ কান্নার আওয়াজ। সে আওয়াজ আকাশে, বাতাসে, নভোমণ্ডলে, মেট্রোপলিটনে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে এসে ঢোকে এক ছিমছাম আবাসনে, এবং শেষমেশ দিয়ার কানে। দিয়া বিচলিত হয়। বিচলিত হওয়ার জন্য জগতসংসারে আরও নানা বিষয় ছড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও ওই একটানা , একঘেয়ে কান্নার সুরটাই অস্থির করে তোলে দিয়াকে।
সেই রাত্তিরে আকাশে চাঁদ ছিল না, ছিল শীতের রাত্রের নির্মোহ একাকীত্ব! দিয়া বেরিয়ে এল; পেছনে রয়ে গেল ওদের নিরুপদ্রব আবাসন, সন্ধের টি.ভিতে নানা খবরের জমকালো আয়োজন, মা-বাবা-পরিজনদের নিত্য বিমূঢ়তা, আর অপরাপর জগৎ সংসারের নিস্পৃহ বহমানতা!
জঙ্গল নয়,জঙ্গলের মতো। দুটো-চারটে বাড়ি থেকে ছিটকে আসা আলো, পড়ে থাকা ঝোপঝাড়কে চিকচিকে ঝলক দেয়। দিয়া সহজেই ঠাহর করতে পারে কান্নার উৎস। কান্নাটুকু কোলের মধ্যে জড়ো করে দিয়া ঘরমুখো হয়।
বিজয়ী দিয়া নিশ্চিত, তৃপ্ত পদক্ষেপে রাস্তাটুকু পার হয়ে আসে। জীবন বিমার বিজ্ঞাপনে দু’হাতে আগলে রাখা আলোকশিখার মতো দিয়া সেই জীবনকে আগলে রাখে। কম্পমান সেই শিখাজীবন কোথাও হয়ত নিশ্চিত আশ্রয়ের বার্তা পায়! ওর উদ্গত কান্না থেমে যায়।
কিন্তু জীবন তো শুধুই দু’হাতের বেড়ে আগলে রাখা বিজ্ঞাপনের বিষয়মাত্র নয়। তার নিজস্ব ছক আছে। সে ছক, ভেবে রাখা অন্যান্য যাবতীয় ছককে ওলটপালট করে দেওয়ার ছক! কতরকমভাবে তার নকশিকাঁথা বোনা হয়! দিয়া শুধু সেই জীবনকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অগণিত জীবের প্রবহমান ধারায়। সেটুকু উজ্জীবনে ভর করে সেই সারমেয়শিশু খায়, ঘুমোয়, হয়ত স্বপ্নও দেখে! এভাবেই পার হয় আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি। সুতরাং কালের নিয়মে সেই শিশু দাবি জানাতে শেখে। সোচ্চার দাবি। আর এখানেই তার জীবনছকের বাঁক বদল হয়। ওর উৎকট, কর্কশ, অপরিচিত তীব্র চিৎকার নাগরিক যাপনের ছেয়ে থাকা জালকে ছিঁড়ে খুঁড়ে ফ্যালে! অস্বস্তি, অসহায়তা ঢুকে পড়ে স্থির, নিস্তরঙ্গ, মজে যাওয়া জীবনে!
দিয়া এসে দাঁড়ায় ওর সামনে। বাঁধানো শানে প্রাণীটা আদুরে ভঙ্গীতে শুয়ে আছে। সামনের দিকে দুটো পা ছড়ানো। দুটো পায়ের মাঝখানে মুখটাকে রেখে ও জুলজুল করে তাকিয়ে আছে দিয়ার দিকে। দুজনে চুপ করে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনেরই প্রতীক্ষা-- কে আগে পলক ফ্যালে! লেজের প্রবল আন্দোলনে প্রাণীটি দিয়াকে প্ররোচিত করে আগে প্রতিক্রিয়া দিতে! দিয়া দু’আঙুল নাচিয়ে হাতছানি দেয়! প্রাণীটা ঝাঁপিয়ে উঠে পড়ে দিয়ার গায়ে। ঢেউ ওঠে দুটি হৃৎযন্ত্রে! লাবডুব দ্রুত হয়! অহৈতুকী আদিখ্যেতার নিরবচ্ছিন্নতা বাধা পায় কলিং বেল বেজে ওঠার শব্দে। কলিং বেল সেই আশ্চর্য যন্ত্র, যার বেজে যাওয়া সুর অনেকক্ষণ বেজে যাবার পরেও শ্রোতাকে মোহিত করে না, সচকিত করে! এবারও দিয়ার লাবডুব বেড়ে যায়, তবে তা কোনো অজানা আশঙ্কায়!
ভদ্রলোক কথা বলছিলেন দিয়ার বাবার সঙ্গে। সে কথা বিজ্ঞপ্তি জারির মতো, একতরফা। মুহ্যমান বাবাকে দেখে দিয়া বুঝতে পেরেছিল, সে বিজ্ঞপ্তি দিয়া পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারছেন না তিনি। ওর বুঝতে অসুবিধা হয় না, কোথায় লাগছে বাবার! পক্ষ নেবার আহ্বান এসেছে। হয় অভ্যস্ত সামাজিক জীবনের তরঙ্গে যেমন ভেসে আছো, থাকো; নয়তো এক প্রাণকে সেখানে জড়িয়ে নিতে গিয়ে সম্ভাব্য ওলটপালটগুলোর জন্য প্রস্তুত থাকো। সে প্রাণ এত তুচ্ছ, এত অগণ্য যে, উপদ্রব হয়ে দেখা না দিলে তার কথা কেউ মনেও আনবে না! এখন সেই প্রাণ যখন নিজের যাবতীয় অনুভূতিকে একটা মাত্র আওয়াজেই ব্যক্ত করতে জানে, সে আওয়াজ, হয়ত কান্না, বা কান্না নয়, বোধের অগম্য কোনো সঙ্কেত, তা অস্থির করে তোলে চেনা সমস্ত যাপনকে। এ থেকে মুক্তি চান ভদ্রলোক। নিজের ভেতরকার সমস্ত দাঁত-নখ-জিঘাংসাকে দাম হিসেবে দিতে প্রস্তুত তিনি। এখন যেন দিয়ার বাবাকে যুদ্ধ শুরুর একটা নোটিশমাত্র দিয়ে গেলেন তিনি। সেই অবলা জীবের সামান্যতম বলার চেষ্টা, তার ক্ষোভ-দুঃখ-ক্রোধ-রিরংসা-আহ্লাদকে সমূলে নিকেশ করাই একমাত্র পন্থা, যার মধ্যে দিয়ে তিনি পৌঁছতে পারেন চেনা তরঙ্গে। সে কথাই বলতে আসা ওঁর। দিয়ার বাবা সেই অনিবার্য প্রস্তাব পেয়ে বিমূঢ় হয়ে বসে থাকেন! অদ্ভূতভাবে তাকিয়ে দেখেন দিয়াকে! তার বীজের পূর্ণতার রূপ! মনে পড়ে ওর জন্মের প্রথম দিন থেকে নানা টুকরো টুকরো কথা! একটা জীবনের মধ্যে কিছু ক্রোমোজম, জিন, ডি এন এ’র বাইরেও কত পলস্তরা পড়তে থাকে! সে কথা ভেবে নতুন করে আশ্চর্য হওয়ার সুযোগ হয় ওঁর! প্রতিবেশি ভদ্রলোকের পাঠানো সমন যেন এ সবের বিরুদ্ধেই এক চ্যালেঞ্জ!
ক্রমশঃ সন্ধে গড়িয়ে রাত নেমে আসে। বাবা-মেয়ের মধ্যেখানে একটা অস্বস্তির পর্দা ঝুলতে থাকে। বাবা-মেয়ে-মা সবাই থম মেরে অপেক্ষা করতে থাকে, আবার কখন ডেকে উঠবে কুকুরটা ওই বিচিত্র স্বরে! আবার কখন অস্থির হয়ে উঠবে অবশিষ্ট পৃথিবীর দাঁত-নখ-থাবা!
ঘড়ির কাঁটার শব্দ চড়া হয়ে কানে বাজে। চরাচর ঘুমিয়ে পড়ে। এ বাড়ির তিনজন মানুষের বোধ অবশ হয়ে আসে। বাইরে ধাবমান মোটরসাইকেল একরাশ আওয়াজ ছড়িয়েই মিলিয়ে যায়। পাহারাওয়ালার ফুকারিত বাঁশিতে কর্তব্যের ক্লান্তি ধরা পড়ে! ঠিক তখনই ছেয়ে থাকা নৈশঃব্দ্যকে খানখান করে দিয়ে দিয়ার বাবার মোবাইল বেজে ওঠে! রিংটোনে ধরে রাখা গানের সুর অসহ্য হয়ে হাতুড়ি পেটাতে থাকে তিনজনের মাথায়! ‘কিছু সিদ্ধান্ত নিলেন?’ শুধু এটুকু শোনার পর দিয়ার বাবার ফোন-ধরা হাত শিথিল হয়ে পড়ে! ফোন কেটে যাবার পর দিয়া ওর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়, ‘দিয়ে এসো ওকে কোনো বাজার বা জঙ্গলে’।
কিন্তু এত শলা, পরিকল্পনা, চিন্তা-ভাবনা-উদ্বেগ---- কোনো কিছুই সেই প্রাণীর হেলদোল ঘটায় না! শুধু খাওয়া পরার অধিকারই অধিকার নয়, মনোজগতে স্থান করে নেওয়াও অর্জিত অধিকারের মধ্যে পরে, সেই বিশ্বাসেই সে বড় হয়েছে। আজ সে অধিকার ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না! এই বার্তা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ওকে নিতে আসা পেশাদার দলের সঙ্গে ওর প্রবল টানা হ্যাঁচড়া শুরু হয়। চোকাতে হয় বেশ কিছু নগদ মূল্যও! অবশেষে হস্তক্ষেপ করে দিয়া।
গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়া ওর চেনা উষ্ণতা ফিরিয়ে দেয়। আগন্তুকের দল ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে যায়। দিয়া ওর নির্ভরতা দিয়ে, বিশ্বাস দিয়ে, একবুক ভালোবাসা দিয়ে জীবনের প্রথম খুনটা সংঘটিত করে ফ্যালে! দিয়ার এক ডাকেই সে নির্ধারিত টোটোতে গিয়ে বসে পড়ে। চেনা পৃথিবী দিয়ার কাছে আবছা জলছবি হয়ে যায়! ওর মনোজগতের সেই ভাঙন প্রাণীটির কাছে হয়ত পৌঁছায়, হয়ত না!
এক সাদা, পাঁশুটে শীতের ভেতর দিয়ে শূন্য টোটো ভাঙাচোরা দিয়াকে নিয়ে ফিরে আসে! দিয়া এলোমেলো কল্পনা করে, সেই চিরনির্বাসনভূমিতে অনাবিল বিশ্বাসী এক প্রাণী ওর জন্য, শুধু ওরই জন্য প্রতীক্ষা করে থাকবে আমৃত্যু!
রিক্ত দিয়া বুঝে উঠতে পারে না, বধ্যভূমির মাটি সত্যিই ও এতদিন চিনে উঠতে পারেনি কেন!